রিশবতখোর কর্মচারী
বহুদিন ধরেই একটা কায়দা চালু ছিল। এখন আর সেই রেওয়াজটা তেমন নেই। কসরতটা ছিল এই রকম যে, কোথাও কোনও ঝামেলা বেধেছে অথবা কোনও মালদার আদমির পয়সা ছিনিয়ে নিতে হবে, তখন নিজের দেহে কোনও চোট দিয়ে তার দায় উলটো তরফের উপর চাপিয়ে দেওয়া। একটা সময় ছিল যখন ম্যাজিস্ট্রেট হুজুর মামলার বিচার করতেন আমলাদের কথায়। বহু বেকসুর আদমির তখন সাল ভর কয়েদও হয়েছে। এই বজ্জাতগুলোর যোগসাজস থাকত বেইমান কর্মচারীদের সঙ্গে। আর বেবুনিয়াদ সাক্ষীসাবুদের কথা তো ছেড়েই দিন। জব্বর খানের কাছে শুনেছি তাদেরই মহল্লার এক বদমাশের কথা। নাম ছিল তার হুরা (Hurha)। পড়শিকে ফাঁসাবে বলে এ কান থেকে ও কান পর্যন্ত নিজের গলাতেই তলোয়ারের পোঁচ দিয়েছিল। হুরা মনে করত তার জরুর সঙ্গে সেই পড়শির একটা নাজায়েজ রিস্তা আছে। সেই চোট সারতে লেগে গেল ছ-ছয়টা মাস। তবুও হুরার কোনও সাজা হয়নি। কারণ চোটটা খোদ তার নিজের করা। জব্বর খানের উপর হুকুম হয়েছিল এই মামলার তল্লাশি চালানোর। তার কাছে থেকে আমি যেমন যেমন শুনেছিলাম তেমনটাই বলব।
শিউ সুহাই সিং ওরফে সিংহর বেশ কয়েকবার কয়েদ হয়েছে জুয়া খেলার অপরাধে। এ ছাড়াও ছিল মারপিট আর বজ্জাতির নালিশ। কোতোয়ালির কয়েকজন কর্মচারীর সঙ্গে তার বেশ দহরম-মহরম হয়। কোতোয়ালির পুব দিকটা হল চৌক। সেখানে একটা বাজার বসে। সেই বাজার ঘুরতে যাওয়ার বাহানায় সে হয় রোজ একবার করে হাজিরা দিত কোতোয়ালিতে। ম্যাজিস্ট্রেট বাহাদুরের মদতে সেই বাজারে ধীরে ধীরে তৈরি হয় হরেক কিসমের পাথর আর ইমারতি মালের দোকান। মহাজন আর দালালরাও শুরু করে সেখানে কারবার। কারণ তাদের ভরসার জায়গা ছিল কাছের পুলিশ ফাঁড়ি। রাস্তার উলটো ধারেই ছিল নতুন তৈরি হওয়া কোতোয়ালি। কারবারিরা মনে করত কোনও ঝামেলা হলেই পুলিশ এসে থামিয়ে দিতে পারবে। পুলিশ কী করবে সেটা ঠিক করে মজুদি হাল হকিকত। মামুলি কোনও মাপকাঠিতে তার বিচার করতে যাওয়াটাই ভুল।
সময়টা আজ থেকে পচাশ সাল আগের। ঘোর আন্ধেরা। খুব বেশি হলে ঘড়িতে দশটা বাজবে। কাপড়ের মহাজন বালকিষণ দাশ আর বুচনো ওরফে রামকিষণ ফিরছিল ঘর। সঙ্গে ছিল তাদের ভরসামন্দ আদমি বিশ্বেশ্বর সিং আরও এক-দু’জন। পুরনো কোতোয়ালির ফটক পর্যন্ত এসেছে কী আসেনি তারা এমন সময় মার! মার! করে ছুটে এল তিনজন লোক। মহাজনরা তাদের ঠেকাবে বলে এককাট্টা হল। যারা মারবে বলে ছুটে আসছিল আচমকাই দেখা গেল তাদের একজন খুনে লতপত হয়ে গড়িয়ে পড়ল জমিতে। তার সাঙাতরা এবার উলটো হাঁক পাড়তে শুরু করল ডাকু! ডাকু! জাদু বলে যেন হাজির হল পুলিশের এক জমাদার আর ফটকবন্দি। মহাজনরা তো দেখে তাজ্জব। তারা তখন না পারে এগোতে না পারে পিছোতে। সেই চোট খাওয়া আদমি শনাক্ত হল ভইরো ওরফে গুজ্জু বলে। গুজ্জু জবানবন্দি দিল তাকে তলোয়ারের কোপ মেরেছে বিশ্বেশ্বর সিং। সিংহ, সে নিজে আর সেই সঙ্গে আরও কয়েকজন যখন রাস্তা পারাপার করছিল তখন মহাজনের আদমিরা এই হাদসা ঘটায়। সিংহ সায় দিল তার কথায়। জমাদার এবার গ্রেফতার করে কোতোয়ালিতে নিয়ে চলল বিশ্বেশ্বর সিং আর তার আদমিদের। সেখানে মহাজনের পায়ে কেমন বেড়ি পরানো হল তারপর সেই বেড়ি খুলে নেওয়া হল সেসব কথায় আমি আর যাচ্ছি না। শুধু এটা বলাই অনেক যে রেওয়াজ মাফিক চালু হল তহকিকাত। (আসলে কিছুই হল না। ঝুটমুট মহল্লার লোকেদের হয়রান করা)। মামলা দাখিল হল সাহেব বাহাদুরের সামনে। রিপোর্টে বলা হল, মহাজনের খিলাফ সাবুদ মিলেছে মারপিট আর তলোয়ার চালানোর।
এই ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন দুসরা কিসমের আদমি। যিনি কাম-কাজ নিজের হাতে করতেই পসন্দ করতেন। তাই সেরেস্তায় কী জবানবন্দি নেওয়া হল আর তাঁর কামরায় এক কোণে কে কী কবুল করল সে শুনে বিচার করার লোক তিনি ছিলেন না। হুকুম হল, দুই তরফকে সামনে হাজির কর। আর ইশাদিদের সরিয়ে দেওয়া হল বাইরে। ফরিয়াদি হলফ করে বলতে বসল, বিশ্বেশ্বর সিং-এর সঙ্গে তার কোনও দুশমনি ছিল না। তবুও সে তার উপর হামলা করে। তখন তার জুড়িদার সিংহ তাকে ঠেকায় আর কেড়ে নেয় হাতের তলোয়ার। পুলিশরা সেখানে হাজির হয়ে যাওয়ায় তাদের হাতেই ছেড়ে দেওয়া হয় বিশ্বেশ্বরকে। সিংহ ও প্রায় হুবহু একই কথা বয়ান করল। গুজ্জুকে তলোয়ারের কোপ মেরে বিশ্বেশ্বর নাকি হাতিয়ারটা ছুড়ে ফেলে। তার কাছে জানতে চাওয়া হল অত রাতে গুজ্জুর সঙ্গে সে কী করছিল। সে জবাব দিল, আচমকাই কোতোয়ালির সামনে তাদের মোলাকাত হয়ে যায়। পুলিশের জমাদার আর ফটকবন্দি এই কথায় সায় দিল। আসামি আবার সে কথা মানতে নারাজ। উলটে সে জানাল, তারা যখন ঘরে ফিরছে তখন কোতোয়ালির সামনে গুজ্জু আর সিংহ তাদের তাড়া করে। তরোয়াল ছিল সিংহের হাতে সেই গুজ্জুকে কোপটা মারে। তারপর হাতিয়ার ফেলে দিয়ে ডাকু! ডাকু! বলে চেপে ধরে বিশ্বেশ্বরকে। পরে জমাদার আর ফটকবন্দি এলে শুধু তাকে নয়, গ্রেফতার করা হয় সবাইকে। পুলিশ কেমন করে এত জলদি সেখানে হাজির হল, তাই দেখে তার মনে হয় আলবাত কোনও সাজিশ ছিল। মহাজনের সাথিরাও একই বয়ান দিল। তারা বলল কে কবে শুনেছে তাদের জাত আর পেশার আদমিরা হাতিয়ার নিয়ে ঘুরে বেড়ায় আর সিংহ বা গুজ্জুর মতো বদমাশদের উপর হামলা করে?
ম্যাজিস্ট্রেট হুজুর এবার নিজেই শুরু করলেন তহকিকাত। তাঁর জেরার মুখে জমাদার আর রাজা-কা-দরওয়াজার ফটকবন্দি কবুল করল, হাদসাটা হওয়ার ঘণ্টা খানেক আগেই তারা সিংহ আর গুজ্জুকে দেখেছিল। সিংহর কাছে হাতিয়ার দেখতে পেয়ে তারা তাদের আটকে দেয়। কয়েকজন হাজতবন্দি দাগি বদমাশ যারা আবার সিংহের দোস্ত শনাক্ত করল তলোয়ারটার মালিক সিংহই। জাহির হল মহাজনের খিলাফ দায়ের করা মামলা বেবুনিয়াদ। খালাস করে দেওয়া হল তাদের। সিংহ যেহেতু হলফ নিয়ে ঝুঠা বয়ান দিয়েছিল তাই তাকে পাঠানো হল দায়রায়। বিচারে তার সাত বছর সাজা হয়।
বদমাশদের আর একটা কায়দা ছিল বাছাই করা কোনও আদমিকে কেতাদুরস্ত মহলে দাখিল করা। তারপর সে যখন মৌজ, মস্তি আর নেশায় চুর তাকে দিয়ে কাগজে দস্তখত করিয়ে নেওয়া। সেটাও যেন একটা মজাদার খেলা। এই কাগজ কোনও মামুলি কাগজ হত না। হত স্ট্যাম্প পেপার। ইশাদি বলে দস্তখত করত বদমাশেরই কোনও জুড়িদার। এই স্ট্যাম্প পেপারই তখন হয়ে দাঁড়াত আমদানির হাতিয়ার। কয়েক মাস পরে ভরা বাজারে অনেক সাক্ষীসাবুদের সামনে দস্তখতকারীকে আচমকাই তাগাদা করা হত, চুক্তি মোতাবেক তাকে বাকি টাকা দিতে হবে। এমন তাজ্জব কথা শুনলে কার দিমাগ ঠান্ডা থাকে। পাওনাদারকে তাই শুনতে হল গালি গালাজ। এবার বদমাশ গিয়ে হাজির হল আদালতে। মুনসেফের কাছে দাখিল করল সেই কবুলিয়ত। আসামি শুধু বলতে পারল, পুরোটাই জালসাজি। কোনও সাবুদ দিতে পারল না। তাই ডিক্রি মিলল ফরিয়াদির। দুই তরফই যদি সেয়ানা হয় তা হলে আবার অন্য গল্প। আসামি বলবে, জরুর আমি চুক্তিতে দস্তখত করেছিলাম; তবে সুদ সমেত পুরোটাই ওয়াপস করেছি। সেও তখন দাখিল করবে টাকা মিটিয়ে দেওয়ার রসিদ। যার উপর দস্তখত আছে তিনজন ওজনদার সাক্ষীর। দরকার পড়লে তারাও হলফ নিয়ে বলবে, আলবাত টাকাটা ফরিয়াদিকে দেওয়া হয়েছে। এখন তো আর মামলা সহজ থাকে না। রায় কোন তরফে যাবে সেটা ঠিক করাই মুশকিল।
একবার এক মশহুর হাকিম কবুল করেছিলেন, কোনও প্যাঁচিদা (pecida) মামলা হলে তিনি সেরেস্তাদারকে হুকুম দেন পুরোটা পড়ে শোনাতে। তিনি তখন চুপচাপ চোখ বন্ধ করে বসে থাকেন। ভাবখানা এমন যেন গভীর চিন্তায় পড়েছেন। দুই তরফই ভাবে তিনি জরুর মামলাটার কায়দাকানুন নিয়ে ভেবে চলেছেন। আসলে তিনি দেখছেন পাঙ্খার উপর কতগুলো মাছি এসে বসবে। গুনতি জোড় না বিজোড়। ফরিয়াদির তরফে রায় দেবেন যদি গুনতি বিজোড় হয়। যদি দেখেন যে দুটো মাছি বসেছে, তখন তিনি বলবেন: “হুকুম হুয়া কী দম সাবুদ মে, মুকদ্দমা ডিসমিস হো!” এইরকম একজন আদমিকে আপনি “ড্যানিয়েল” বলবেন না তো কী!