বিচারের নামে মশকরা
পাঠকরা আলবাত শুনেছেন বকেয়া রাজস্ব আদায়ের জন্য সামারি সুট (summary suit) বলে লব্জটার কথা। অনেকে আবার একে মুকদ্দমা সরাসরি বা ভেজা তলবি নামেও জানে। এইসব মামলার বিচার করতেন হয় ডিপটি কালেক্টর বা কালেক্টরের কাছে শর্তনামা দাখিল করা অ্যাসিস্ট্যান্টরা। কিন্তু যে কথাটা অনেকের অজানা তা হল এইসব মামলায় সাবুদ বলে যা দাখিল করা হত তা হল পাটোয়ারিদের হিসাব। হিসাব নিয়ে কোনও বহস হলে বলা হত দেওয়ানি আদালতে যাও। ইশাদিকে জেরা করা হত না বলে পাটোয়ারির সুবিধা ছিল হয় জমিদার না হলে রায়তের তরফদারি করার। গ্রামের জমিদার বা তালুকদারের বয়ান মাফিক পাটোয়ারি দাখিল করত জমা বন্দির হিসাব। হয়তো কোনও জমিদার বয়ান দিল সে কোনও একজন রায়তের কাছে টাকা পায়। কারণ সেই রায়ত তার পাওনা মেটায়নি। রায়ত টাকা জমা করেছে কী করেনি তা জানার উপায় জাবদা। দিয়ে থাকলে জরুর তা জাবদায় লেখা হবে। বেচারা রায়ত! সে তো নাচার। ঈশ্বরকে সাক্ষী মানা ছাড়া আর তার কী বা করার থাকে, সে হয়তো বলার চেষ্টা করত সেই মহাজনের নাম, যার কাছে বয়েল বাঁধা রেখে সে তার খাজনা চুকিয়েছিল। নাম করত সেইসব সাক্ষীর যাদের সামনে লেনদেন হয়েছে। এদের পরেও বেরহম ডিপটির স্রেফ একটাই সওয়াল, “পাটোয়ারি ইয়া জমিন্দার কা রসিদ রাখতে হো?” (Putwaree yah zemindari ka ruseed rukhteh ho?) “নেহি, রায়ত পরওয়ার!” (Nuhee, ryut purwar!) এরপর ফরিয়াদির তরফে ডিক্রি জারি হত। কিন্তু ডিপটি বা অ্যাসিস্ট্যান্টকে এর জন্য কে বদনাম করবে? তাঁদের কাছে তো এমনটাই চাওয়া হয়েছে। তাঁরা যে কোনও কানুনি কার্রবাই চালাবেন সেটাও নামঞ্জুর। জমাবন্দি তাই খোদ একটা রেওয়াজ। মামলা করতে হলে দরকার পড়ে কাগজের সাবুদ। যে সাবুদ আবার সরাসর ঝুঠ আর গলদ। আপনি চাইলে সনাক্ত করতে পারেন এই রকম এক বা এক ডজন মামলা। তারপর দেখুন এই মামলাগুলোয় কী ফারাক। দেখবেন জমির মাপ সব হুবহু। জমা বা এলাকাও এক। দুই-তিনজন বাছাই করা আসামিই কেবল মামলা দায়ের করছে। আপনি সওয়াল করতেই পারেন এরকম কেন হচ্ছে? তা হলে কি আমরা ধরে নেব কেবল জমিদার আর পাটোয়ারিদের মালগুজারি আদায়ের জন্য আর মামলা রুজু করার জন্যই এই বন্দোবস্ত চালু? লেকিন সওয়াল উঠবে তা হলে ডেপুটি কালেক্টর আর তাঁর পল্টন কী করছিল? তহশিলদার, কানুনগো আর মুহুরিরা বহাল কেন, তারা তো কাগজ-পত্রে কোনও গলদ থাকলে সে সব ঠিক করতে পারে? একদম ঠিক কথা! কিন্তু ভেবে দেখুন একজন লোক কি চারজনের কাজ সামাল দিতে পারে? এর জন্যই তো যাচাই করার কাজগুলো কেবল এড়িয়ে যাওয়া হয় আর বেকায়দায় পড়ে কেবল বেচারারা।
আমি যে ফালতু একরার করছি না তা বোঝাতে একটা কিস্সা শোনাই। রামকিষন কুনবি ছিল ভুরতুরা (Bhurturra) গ্রামের বাসিন্দা। তার ছিল বিঘা সাতেকের মতো এক মৌরসি জোত। রামকিষন ছিল বহুত মেহনতি। ঠিক সময়ে সে তার ২১ টাকা খাজনা বলভুদ্দর সিং নিলামদারের হাতে জমা করত। ধীরে ধীরে তার ছেলেরা জোয়ান হল। এদের দু’জনকে সে ভার দিল জমির হেপাজত করার আর নিজে চলে গেল বেতিয়ায় আরেক ছেলেকে নিয়ে সেখানকার রাজার হয়ে মেহনত করবে বলে। আমি যে সময়ের কথা বলছি তখন তারা দুই সাল ভুরতুরাতে ছিল না। এক বিঘা জমি তারা ছেড়ে রেখেছিল আখের চাষ করবে বলে। ঠিক যখন আখের চারা পুঁততে যাওয়ার সময় এল তখন দেবীলালা তার পাঁচজন মুসকো লাঠিয়াল সমেত হাজির। জবরদস্তি তারা শুরু করে দিল জমি চাষ। রামকিষনের বেটারা সওয়াল করলে জবাব মিলল, তাদের বাপকে দু’সাল হল জমি থেকে উৎখাত করা হয়েছে। বেটাদের সেই হিম্মত ছিল না যে দেবীলালার খিলাফ লড়াই করবে। তারা চুপচাপ ফিরে গিয়ে বাকি জমিতে মেহনত করতে লাগল। আরও এক সাল বাদ রামকিষন ফিরে এল ভুরতুরায়। বেটাদের মুখে শুনল কেমন করে তাদের জমি বেদখল হয়েছে। রামকিষনের মাথা গেল গরম হয়ে। সে সরাসরি আদালতে একটা বেদখলির মামলা রুজু করল। তলব হল পাটোয়ারির। সে শপথ নিয়ে একরার করল, তিন সাল হল রামকিষানের জমি বেদখল করা হয়, আর তাই সে এতদিন ফেরার ছিল। নিলামদার তাই রামদিহুল সিং-এর সঙ্গে এই সাত বিঘা জমির বন্দোবস্ত করে নিয়েছে। সে তাকে নিয়ম মাফিক মালগুজারি দেয়। কুনবির তো এবার চক্কর লাগার জোগাড়। করিন্দা দেবীলালকে তার বেটারা যে খাজনা দিয়েছিল এবার সে দাখিল করল সেই রসিদ। সাহেবের কাছে তখন তার একটাই আর্জি, কমসে কম ছয় বিঘা জোত যেন তারই থাকে। আর্জি মোতাবেক পরখ করা হল নথিপত্র। হায় রে! কোথায় ইনসাফ! আখরি জমাবন্দি দুটোতে দেখা গেল ফিলহাল জমির দখল রামদিহুল সিং-এর নামে যা আগে ছিল রামকিষন কুনবির। নাচার সাহেব কী করবেন? রামকিষনের মামলা খারিজ। বলা হল চাইলে সে দেওয়ানি আদালতে আর্জি জানাতে পারে।
এই হচ্ছে বেনসিব কিষানের হাল; শুরুতে তাকে উৎখাত করা হল তার মৌরসি জমি থেকে তারপর ধীরে ধীরে পুরো জমিটাই কব্জা করে নিল বজ্জাত নিলামদার আর বদমাশ পাটোয়ারি। কানুনগো যদি শুরুতেই হুজুরকে এত্তেলা করত যে জমাবন্দির নথিতে একটা নতুন নাম দাখিল হয়েছে যা পুরনো নামের সঙ্গে মিলছে না, তা হলে জরুর হুজুর হুকুম করতেন যাচ-পরখ করার। তখনই ভুয়ো নাম বাতিল হয়ে যেত। জমাবন্দিতে যত ভুল তত আমদানি। রিশবত মনমাফিক হলে আর কোনও ঝঞ্ঝাটই থাকে না। হুজুরকে দিয়ে তখন সহজেই দস্তখত করিয়ে নেওয়া হয়। হুজুর ফরিয়াদির তরফে খোঁজ-তল্লাশি করলেও সবসময় ইনসাফ মেলে না। একবার এক তজরবা (tajraba) অফিসারের কাছে একটা মামলা এল। তিনি আবার অন্যদের মতো চালু রাস্তা ধরে চলার লোক নন। মামলা একটা আম বাগিচা নিয়ে। সাহেব হুকুম করলেন, তাঁর ছাউনি যেন সেই বাগিচাতেই খাড়া করা হয় আর তিনি খোদ রওনা হলেন সে দিকে। তাঁর নজরে পড়ল কিছু আদমি লকড়ি আর খড়কুটোর বোঝা নিয়ে তাঁরই ছাউনির পাশ দিয়ে চলেছে। হুকুম হল, “ইধার আও সব!” তারা তো বোঝা ফেলে দিল দৌড়। হুজুরের চাপরাশিরা আবার তাদের ধরে আনল। হুজুর গরম মেজাজে জানতে চাইলেন, “তুম লোগ কিঁউ ভাগা?” জবাব এল, “আপকা ডর সে!” এবার তাদের সওয়াল করা হল, তারা কি জানে এই বাগিচার মালিক কে? লোকেরা জানাল আমগাছ পুঁতে ছিল জিত সিং, যে আবার ঈশ্বর সিং-এর পরদাদা। দুনিয়া জানে এই বাগিচার মালিক হচ্ছে ঈশ্বর। জেনে বুঝেই এই লোকগুলোকে ঈশ্বর সিং ওই বাগিচায় পাঠায়। তার তো ওই বাগিচার উপর কোনও হকই ছিল না। সাহেব কিন্তু তার সেই বজ্জাতি আন্দাজ করতে পারলেন না। রিপোর্টে লিখে দিলেন, হর এক রাহাগির যো ইত্তেফাকুন উস রাস্তে যাতা থা; কবুল করেছে ওই বাগিচার আসল হকদার ঈশ্বর সিং। সময় মাফিক তাই ঈশ্বরের তরফে ডিক্রি জারি হল।
পুরো জেলার জন্য পাটোয়ারির কাগজপত্র তৈরি করা ছিল মহা ঝক্কির কাজ। লেকিন সাহেবান ব্রুড (Brrud) হাকিমদের কাছে কড়া ফরমান পাঠালেন, সব কাগজ সময় মতো দাখিল করতে হবে। আমাদের মতো আর্দালিরা তো তাতে বেহদ খুশ। শুরুতে ডিপটিদের দস্তক গেল জমিদার আর পাটোয়ারিদের কাছে। তারপর লাগাতার যেতেই লাগল। সবাইকে হাজির হতে হল তাঁর সামনে যিনি খোদ তখন একজন ‘হুকুমত’। এর নতিজা কী হবে সেই ভয়েই সবাই তখন কাবু। তলবানা (tullabana) দিয়েছে? না হুজুর। তবে পাটোয়ারিকে নাজিরের হেপাজতে পাঠাও আর জমিদারের উপর নজর রাখুক বাড়তি পেয়াদা। দেখ যাতে তলবানা আদায় হয়। জমিদার বলতে বসল, স্রেফ চারদিন আগে তার হাতে নোটিশটা এসেছে। কিন্তু তার সে কথা শোনার ফুরসত কোথায় লোকেদের। যা দিতে বলা হয়েছে জমিদার সেটুকু মেটাতে চাইলে পেয়াদা হেঁকে বসল দশ টাকা। জমিদার তাতে নারাজ। ফলে হররোজ তার উপর বাড়তে লাগল চাপ। শুরুতে যে তলবানা চাওয়া হয়েছিল এবার হর দিনের তলবানা তার সঙ্গে জুড়তে থাকল। লাচার (lachar) জমিদারকে তাই পেয়াদার খোয়াহিস পুরো করতে হল। সে তখন চায় কাছারির এই জবরদস্তি থেকে কোনও রকমে রেহাই পেতে। কিন্তু কানুন কী বলে? জমিদার যদি জমাবন্দি না দেয় তা হলে কানুন মোতাবেক তাকে সাজা দেওয়া যায় না। শুধু বলা আছে জমাবন্দি না দিলে জমিদার কোনও আদালতে খাজনা নিয়ে মামলা রুজু করতে পারবে না। কানুনে যাই বলা হোক দেখা যাবে হর সাল গ্রাম পিছু পাঁচ থেকে দশ টাকা জরিমানা করা হচ্ছে। এই বেআইনি আমদানির পুরো ফয়দা উসুল করে একপাল বেঠিকানা আদমি যাদের বলা হয় মুসকারি (mushkoorie) পেয়াদা। যে সব গ্রামে নিয়ম মাফিক পাটোয়ারির কাগজপত্র লেখা হয়, সেখানেও দেখা যাবে বছরের শুরুতে জমিদারের পিছনে লেলিয়ে দেওয়া হচ্ছে একপাল মুসকারি। ইরাদা হল সাহেবান আলিসানের মর্জি মাফিক জমিদারকে দিয়ে কাজ হাসিল।