মুনসেফ, সদর আমিন, প্রিন্সিপাল সদর আমিন, জেলার জজ আর সদর দেওয়ানি আদালত
আমি আমার পাঠকদের সামনে রাজস্ব আর ফৌজদারি দপ্তরগুলোয় কেমন বজ্জাতি চলে তার কিছু নমুনা দাখিল করেছি। এবার তাই দেওয়ানি আদালতের দিকে নজর ফেরানো যাক। পাঠক আপনারা এই মামুলি আর্দালির কাছ থেকে কানুনি এলেম আশা করবেন না। আমি স্রেফ ততটাই বলতে পারব যা এই আদালতগুলোতে প্রত্যেক দিন ঘটতেই থাকে। আপনারা চাইলে আমার কথা পরখ করেও নিতে পারেন। আদালতের কাজ কারবার চালু রাখতে বহাল হয়েছে হরেক আদমি। তাদের আবার নানা রকম তফরিক (tafriq)। মুনসেফ, সদর আমিন, প্রিন্সিপাল সদর আমিন, আর সবার উপরে জজ সাহেবরা। এত কিছুর পরেও দেখবেন আদমি নাখুশ। কোনও একটা যন্ত্র চালু রাখতে দরকার হয়তো অনেকগুলো চাকা। একটা কোনও ছোট চাকাও যদি চলা বন্ধ করে তা হলে পুরো যন্ত্রটাই থেমে যাবে। দেওয়ানি আদালতেও দেখবেন অনেক সময় কোনও মামুলি কারণে কাম কাজ বন্ধ। তখন বড় বড় হুজুরদেরও চুপচাপ বসে থাকতে হয়। তাঁরা ইন্তেজার করেন কখন চাকায় তেল ঢালা হবে আর সেগুলো ঘুরতে শুরু করবে। এখানে সাফ কবুল করাটা জরুরি যে আমার নিশানা কোনও একজন খাস আদমি বা জেলা নয়। আমি বলতে চাই পুরো বন্দোবস্তের কথা। যা একটা যন্ত্রেরই বরাবর। যে যন্ত্রের আবার কোনও কোনও বল্টু ঢিলে হয়ে গেছে।
আমার তো পাবন্দি, তাই বড় বড় আদমিদের ছেড়ে শুরুটা নীচের থেকে হোক। মুনসেফ কেমন বিচার করেন চলুন তাই দেখি। কোনও এক লালার বেটার মাহিনা ভর কামাই ছিল স্রেফ দশ রুপিয়া। ছোট থেকেই সে নানা ছোটখাটো ফেরেব্বাজি আর বদমাইশিতে দুরস্ত। আখেরে সে হয়ে উঠল এক উকিলের মুহুরি বা কেরানি। অনেকটা গ্যামালিয়েল (Gamaliel)-এর মেহেরবানি পেয়ে পল (Paul) বনে যাওয়া, যার কাজ কানুনি ফয়সালা। পল হতে চাইলে দরকার ছিল কুদরতি চমৎকারের। কিছু বছর কাজে লেগে থেকে সেই ছোকরার খেয়াল হল সে তো বেশ কানুনি ধারা আওড়াতে পারে আর কোন মামলা কী ধারায় চলেছিল সেটাও তার অজানা নয়। মুনসেফ হতে চাইলে এগুলোরই তো দরকার। অনেকের থেকেই সে বেশি সেয়ানা, তা হলে সে কেন মুনসেফ হবে না? সেরেস্তাদারকে বখশিশ কবুল করায় সে তার নাম সুপারিশ করল জজ সাহেবকে। ছোকরা দরখাস্তে লিখেছিল সে নাকি জমিদার। আসলে তো তার বাপের ছিল কোনও এক গ্রামে এক আনার হিস্সা যার থেকে সালিয়ানা আমদানি চব্বিশ রুপিয়া। দরখাস্তকারীদের সওয়াল জবাব করার সময় স্রেফ দেখা হত কার কত ভাল মনে রাখার ক্ষমতা আর আদালতের লব্জে সে দোরস্ত কি না। ইমতেহানে তাকে এমন কোনও সওয়াল করা হত না যাতে বোঝা যায় তার কানুনি এলেম। পরখ করার চেষ্টা ছিল না তার তালিম বা কানুনের সোচবুঝ। তাই লালার বেটাও ইমতেহানে কামইয়াব হল। এবার কোনও কুর্সি খালি হলে আর নসিব বেইমানি না করলে তার মুনসেফ হওয়া কে ঠেকায়।
দপ্তরে বহাল হলে লালা পালটে তার খেতাব হল রায়বাহাদুর। তখন তার মাথায় আমামা পাগড়ি আর গায়ে চড়েছে কাবা (Kubba)। জজ সাহেবের ঢঙে পায়ের উপর পা তুলে বসে কুর্সিতে। চিনা পুতুলের মতো মাথাটা ঘোরায় এদিক আর ওদিক আবার মাঝে মাঝে সেটা একটু হেলিয়ে দেয়, যেন কত সমজদার। চালু কথায় বলে, কায়স্থের মাথা যত বড় হবে তত ঠাসা থাকবে কানুনি প্যাঁচ, মামলার চড়াই-উতরাইতে এই প্যাঁচের কামাল নজরে আসে। বাবু দেবীদয়াল মামলা রুজু করল মুসম্মত দিলচস্পের খিলাফ। আর্জি ১০০ টাকা ধার আর ১২ শতাংশ হারে সুদ তার পাওনা। উকিল তার হয়ে হাজির করল সাক্ষী আর দস্তখত করা তমসুক। তমসুকের যে মুসাবিদা করেছিল তাকেও তলব করা হল। সবাই হলফ নিয়ে কবুল করল দিলচস্প যখন ফরিয়াদির মকানে যায় তারা তখন সেখানে হাজির। লেনদেনটা তাদের সামনেই হয়েছে। আসামির কাছে আদালতের নোটিশ গেল। সে উকিলের কাছে জানতে চাইল তাকে কী করতে হবে? তার সাফ জবাব, এটা ঝুঠা ইলজাম। তার মতো একজন আওরত কী কখনও একশো টাকার মতো মামুলি রকম উধার নিতে পারে! বাবু থেকে মহারাজ সবাই যেখানে তার খুবসুরতির জন্য দেওয়ানা? উকিল একটু নারাজ হয়েই মাথা নাড়ল তবে ভরসা দিতে ছাড়ল না যে কিছু একটা করবে। তবে দিলচস্পকে সাবিত করতে হবে সে কোনও তমসুকে দস্তখত করেনি। উকিলের থুতনিতে ঠোনা মেরে সে জবাব দিল, তোবা। তোবা! মেহেরবানি করে ডিক্রিটা হাসিল করো আর আমাকে শান্তিতে থাকতে দাও। উকিল দেখল মামলায় কোনও ফাঁক নেই। তবে মুনসেফকে দেখে মনে হয় আওরতের সুরত তাকে দেওয়ানা করেছে। ফরিয়াদিরা যে চাল চেলেছে উলটে সেই একই চাল সেও ইস্তেমাল করতে পারে। এই দু’নম্বর রাস্তাই বেছে নিল উকিল। সে এমন কিছু ইশাদি বাছাই করল যারা আদালতে হলফ নিয়ে বলবে, তাদের হাত দিয়ে দিলচস্প বাবু দেবীদয়ালের কাছে ১০০ টাকা পাঠিয়েছিল আর ফরিয়াদিকে ১০ টাকা হারে সুদও দেওয়া হয়। এর সঙ্গে দাখিল হল একটা রসিদ যাতে দস্তখত করেছে ফরিয়াদি। মামলা খারিজ।
আপনারাই জবাব দিন, এই বাঁকা পথে রেহাই মেলায় কাকে বলবেন গুনাহগার? বজ্জাতির মোকাবিলা বজ্জাতি ছাড়া আর কী ভাবে সম্ভব? খোদ আইন এখানে নাচার। আমার মতো হাজারও আনপড়ের বিচার করতে কানুন যখন নাস্তানাবুদ তখন আমাদেরই দরকার কানুনকে নিজেদের হাতে তুলে নেওয়া। আমরা খোদ সেয়ানা হলে তবেই মোকাবিলা করা যাবে বজ্জাতির।
কেউ কেউ বলেন যে মুনসেফ বাছাই করতে হবে পিছড়ে বর্গ থেকে। কারণ তারা মুলুকের রীতি-রেওয়াজ আর আচার-বিচার খুব ভাল রকম বুঝবে। তারাই পারবে কানুনি ইনসাফ দিতে, সরকারের বাকি কর্মচারীরা যা পারবে না। এটা কী একটা ফয়সালা হতে পারে? আপনি যদি লোকেদের ধরে ধরে সওয়াল করেন তা হলেই দেখবেন ঠিক জবাবটা পেয়ে যাচ্ছেন। লোকেরা মনে করে উঁচু খানদান আর তালিম নেওয়া আদমিরাই হচ্ছে এই কাজের উপযুক্ত। পিছড়ে বর্গের আদমিদের তারা ঠিক বিশ্বাস করতে পারে না। এমন লোক পাওয়া মুশকিল যে কোনও ফয়সালা করার সময় নিজের জাত-ধর্মকে আমল দেয় না। এসব কথা বিবেচনা না করেই দেখবেন মুনসেফদের সেই সব জেলায় বহাল করা হচ্ছে যেখানে কেটেছে তাদের বচপন। চেনা-জানা লোকেদের মামলায় তাই ফয়সালা আলবাত তাদের দিকে ঝুঁকে পড়বেই। হিন্দু সমাজের রীতি রেওয়াজ হল উঁচু জাতের মানুষকে কুর্নিশ করে নিচু জাতের মানুষ। ধরা যাক একজন বামুনের খিলাফ একটা মামলা রুজু হল। কোনও কায়স্থ মুনসেফ বা সদর আমিনের সেই হিম্মত আছে নাকি যে বামুনের বিরুদ্ধে ডিক্রি জারি করে? এসব জাত-ধর্মের প্রভাব আমাদের রোজকার জীবনে এত বেশি আর গভীর যে বেশির ভাগ পাঠক তা আন্দাজ করতে পারবেন না।
একজন মুনসেফ আর তার ওপরওয়ালার ফারাক স্রেফ মাহিনা আর জিম্মাদারির। আদমির খাসিয়ত একই থাকে শুধু বেড়ে যায় ভুখ। এতে লোকেদের এত তাজ্জব হওয়ার কী আছে? কে কোন কুর্সিতে বসে তাই দিয়ে না ঠিক হয় তার নজরানা কত হবে! ছোট কোনও দেবতাকে যা ভেট চড়ানো যায় কোনও জবরদস্তকে সেই একই ভেট দেওয়া মানে তার বেইজ্জত। হরেক কিসিমের দপ্তর মানেই বদমাইশির আখড়া। আমার ইশারা এই দপ্তরগুলোর হুজুরদের দিকে যাদের কাজ শুধু মাসে মাসে রিপোর্ট দাখিল করা। সেই রিপোর্ট আবার পরখ করে দেখবে আরও উঁচু কোনও আদালত। রিপোর্ট মানে তো তাদের কাজ কারবারের হাল বয়ান। এই বয়ান থেকে কেউ আন্দাজ করতে পারবে না কোন কাজ কীভাবে হয়েছিল। কানুনের রখওয়ালাদের ভিতর এমন কেউ কেউ আছেন যাদের লোকেরা ইজ্জত করে কিন্তু সদর যাঁদের নিয়ে নাখুশ। এমনই একজন হলেন জনাব জেমস ক্যাম্পিয়ের (Mr. James Campier) পুরো কাশী শহরের লোক যাঁর তারিফ করে। আর সদরের সালিয়ানা রিপোর্টে দেখা যাবে তাঁকেই হেনস্থা করা হচ্ছে। তাঁকে তারিফ করার পাশাপাশি আমি এ কথাও বলব যে তিনি ছিলেন একজন দুখি মানুষ। মরহুম মৌলভি গুলাম ইয়াহিয়ার সঙ্গেই কেবল তাঁর তুলনা করা যায়। এইরকম মানুষদের আমরা কেন ছোটখাটো ইনাম দিই না? একটা ঘড়ি বা আংটি দিয়েও তো তাঁর কাজের তাজিম করা চলে।