৫.২ পরাশ্রিত অকেজো প্রাণী

পরাশ্রিত অকেজো প্রাণী

তোমরা ‘কুঁড়ের রাজা’ দেখিয়াছ কি? মানুষের মধ্যে খোঁজ করিলে কুঁড়ের রাজা অনেক দেখা যায়। ইহারা সংসারের একটুও ভালো কাজ করে না; খায়-দায় ঘুমায়, তার পরে বুড়া হইয়া মরিয়া যায়। ইহাদের কিছুরই অভাব হয় না। অন্য কেহ উপার্জ্জন করিয়া খাওয়ায় বা বাপ পিতামহেরা যে টাকা জড় করিয়া রাখিয়াছেন, তাহা খরচ করিয়া জীবনটা বেশ কাটাইয়া দেয়। এই সব লোক এমন অকেজো যে, যদি তাহাদিগকে খাটিয়া খাইতে বলা যায়, তবে তাহারা একটুও নড়াচড়া করে না। শেষে হয় ত অনাহারে মরিয়া যায়। কুঁড়ের রাজারা জীবনে কখনো পরিশ্রম করে না, অথচ পরের ঘাড় ভাঙিয়া খায় এবং বাবুগিরি করে। এই জন্য সমস্ত লোকে তাহাদের ঘৃণা করে; মনে করে, এমন লোক মরিয়া গেলে সংসারের একটুও ক্ষতি নাই।

কেবল মানুষের মধ্যেই যে কুঁড়ের রাজা আছে, তাহা নয়। অন্য ছোট প্রাণীদের মধ্যেও এই রকম অকোজো জানোয়ার অনেক দেখা যায়। মানুষের মধ্যে অকেজোর ছেলে কেজো হয়; কিন্তু ছোট প্রাণীদের মধ্যে তাহা দেখা যায় না। অকেজো প্রাণীদের পুত্র পৌত্র জ্ঞাতি গোষ্ঠী সকলেই অকেজো,—ইহারা যেন, অকেজোর ঝাড়! পরের ঘাড়ে চাপিয়া আরামে জীবন কাটানো ইহাদের স্বভাব।

এই রকম প্রাণী কি তোমরা দেখ নাই? কুকুরের গায়ে যে আঁটুলি থাকে, তাহা এই রকম প্রাণী। ইহারা আহারের চেষ্টায় সহজে চলা-ফেরা করিতে চায় না। কুকুরের গা কাম্‌ড়াইয়া রক্ত চুষিয়া খাওয়াই ইহাদের কাজ। কিন্তু ইহাদের পুরুষরা নিরীহ প্রাণী। তাহারা রক্ত খায় না,—রক্ত খায় স্ত্রীরাই। যদি কুকুরের গা হইতে আঁটুলি ধরিয়া তোমরা বাগানের ঘাসের মধ্যে ছাড়িয়া দাও, তবে তোমরা দেখিবে সে অন্য এক প্রাণীর গায়ে উঠিবার চেষ্টা করিতেছে। তাহারা ফড়িং, প্রজাপতি বা ব্যাঙের মত তাড়াতাড়ি চলা-ফেরা করিতে জানে না। পরের ঘাড়ে চাপিয়া নিজেরা আহার করে বলিয়াই, আমরা এই সব প্রাণীকে পরাশ্রিত নাম দিলাম!

কেবল আঁটুলিই পরাশ্রিত প্রাণী নয়। মাথার চুলের মধ্যে যে উকুন থাকে, তাহাও এই দলের প্রাণী। ইহারা মাথার চাম্‌ড়া কাটিয়া রক্ত খায়, মাথার চুলেই শত শত ডিম পাড়ে এবং সেগুলি হইতে যে বাচ্চা বাহির হয় তাহারাও মাথার রক্ত খাইতে শুরু করে। যে-সব লোক কোনো ব্যবসায় বা লেখাপড়া শিক্ষা করে না, তাহারা যেমন পেটের দায়ে শেষে চুরি-ডাকাতি পর্য্যন্ত করে এবং পরের সর্ব্বস্ব লুটিয়া খায়, ইহারাও যেন সেই রকম অকেজোর দল।

গাছপালার মধ্যেও অনেক পরভোজী আছে। যাহারা কেজো গাছ তাহার মাটির ভিতর শিকড় চালাইয়া খাদ্য জোগাড় করে এবং হাজার হাজার সবুজ পাতা দিয়া বাতাস হইতে অনেক খাদ্য দেহে টানিয়া লইয়া বেশ সুখে স্বচ্ছন্দে জীবন কাটায়। কিন্তু পরাশ্রিত গাছপালারা তাহা করে না। ইহারা অন্য গাছের ঘাড়ে চাপিয়া বসে এবং এই আশ্রয়-গাছেরই রস নিজের শিকড় দিয়া টানিয়া আহার করে। এই রকম গাছকে পরগাছা বলে। আম গাছে প্রায়ই পরগাছা দেখা যায়। ইহারা এমন নিষ্ঠুরভাবে রস চুষিয়া খাইতে আরম্ভ করে যে, অনেক সময়ে আশ্রয়-গাছ ইহাদের উৎপাতে মরিয়া যায়। পরাশ্রিত গাছকে বাগানের সার-দেওয়া মাটিতে পুঁতিলে বাঁচে না। ইহারা এমন অকেজো যে, মাটি হইতে একটু রসও চুষিয়া লইতে পারে না। টাট্‌কা তৈয়ারি রস অন্য গাছের শরীর হইতে চুষিয়া না খাইলে ইহারা বাঁচে না। এমন অকেজো জীব আর কোথাও দেখিয়াছ কি?

কেঁচো খুবই ইতর প্রাণী, ইহাদের স্ত্রী-পুরুষ ভেদ নাই, চোখ কান নাক কিছুই নাই। কিন্তু তথাপি ইহারা নিজেদের খাবার নিজেরাই খুঁজিয়া পাতিয়া লয়। সুতরাং আঁটুলি বা উকুনের চেয়ে কেঁচো উৎকৃষ্ট বলিতে হয়। কিন্তু কেঁচোদের জাত-ভাই দুই একটি প্রাণী এমন অকেজো হইয়া পড়িয়াছে যে, তাহাদের কথা শুনিলে তোমরা অবাক্ হইয়া যাইবে। একটু চেষ্টা করিলেই কত ভালো খাবার পাওয়া যায়, কিন্তু তাহার কিছুই ইহাদের মুখে রুচে না। পরের ঘাড়ে চাপিয়া জীবন কাটানো ইহাদের স্বভাব।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *