০১. সাবমেরিন লেদু

[আমার আর সব রচনাই আত্মজৈবনিক। শুধু এই একটি ছাড়া। মৃত মানুষদের নিয়ে লিখতে গিয়ে এই প্রথম আমাকে একটি কাল্পনিক উপন্যাস লিখতে হল। কেননা, আমি দেখলাম, মৃতের গল্প কোনও জীবিত মানুষের পক্ষে লেখা সম্ভব নয়। তা যদি হত, তাহলে জীবিতের ত্বক মৃতের চামড়া গ্রহণ করত। কিন্তু, না, জীবিতের শোক মৃত গ্রহণ করে না। আমরা এ-দিক থেকে বড় পরাধীনভাবে বেঁচে আছি। তাই, এই প্রথম আমার একটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক উপন্যাস, যার সব চরিত্র কল্পনাপ্রসূত। এমন কি, নায়ক হিরণের সঙ্গেও আমার কোনও মিল নেই। এই প্রথম এ-রকম। আমার আর সবই গঙ্গার কবিতা। শুধু এইটে যমুনার।]

 

০১. সাবমেরিন লেদু

ঠিক ঘুম ভাঙার আগে স্বপ্নের শেষটা ছিল চিনু তাকে নাড়া দিয়ে ডাকছে। অথচ, জেগে উঠে হিরণ দেখল, চিনু পাশে শুয়ে নেই।

বাইরে অঝোরে বৃষ্টি হচ্ছে। তারা তখনও জেগে, হিরণের মনে পড়ল, যখন-এ বছরের প্রথম মেঘ-ডাকাডাকি শুরু হল হঠাৎ, ঝোড়ো হাওয়ায় ছাদের দরজার খোলা-বন্ধের ঘনঘন আওয়াজ থামাতে চিনু উঠে গিয়েছিল পাশ থেকে, আর সে নেমে আসার আগেই কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিল হিরণ।

ছাদের দরজার চাবি সব ফ্ল্যাটেই আছে একটা করে। কে কখন খুলে রেখে গেছে তা জানার উপায় নেই। শেষ পর্যন্ত কোন ফ্ল্যাট বন্ধ করতে উঠবে, তা নির্ভর করে একটা দরজা ঝড়ে আছড়াচ্ছে—সারারাত আছড়াচ্ছে এটা উপেক্ষা করা তথা এই টেনশন, বুকে-করাঘাত বা ওই হাহাকার সহ্য করার ক্ষমতা কোন ফ্ল্যাটের কতখানি, তার ওপর। অবশ্য, এও অস্বীকার করা যায় না যে ছতলার টপ-ফ্লোরের দুটি ফ্ল্যাটের যে-কোনও একটির ওপরেই নৈতিকত এ দায়িত্ব বর্তায়, এবং প্রায় মিনিট পাঁচেক অপেক্ষা করে মুখোমুখি ১২ নং থেকে কোনওরূপ প্রতিক্রিয়া না দেখা দিলেও, শেষ পর্যন্ত, চিনু জানে, সে কিন্তু হার মেনেছিল রতিক্লান্ত হিরণের প্রতি অসীম মমতাবশতই। বয়স বাহান্ন পেরল, আহা, রোগা মানুষটা এ-বয়সে যেন বড্ড নেতিয়ে পড়ে। নয়-নয় করেও চিন্ময়ী প্রায় বছর দশেকের ছোট।

ঝড়-বাদল উপেক্ষা করে চিনু তাই ছাদে উঠেছিল।

এখন, এই মাঝরাতে ধড়মড়িয়ে জেগে, চিনু-নেই-এমন বিছানায় একা উঠে বসে, হিরণের প্রথমেই মনে হল, অ্যাঁ, চিনু কি তবে সেই তখন থেকে আর ফেরেনি নাকি?

শোবার ঘর থেকে ডাইনিং স্পেসে বেরিয়ে এ-পর্যন্ত-অবিচলিত সে আলো জ্বালে। সঙ্গে সঙ্গে চোখের পলকে তার শরীরময় ছড়িয়ে পড়ে ভয়, ট্রেলে আগুন, তার সকল স্নায়ু-শিরা, বস্তুত তার মাথার চুল ও লোম–এ-সবও আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে সে টের পায়। কেননা, ঠিক যা ভেবেছিল, আবার যা ভাবতে চায়নি বলে শেষ পর্যন্ত পেরেও ওঠেনি ভাবতে, সে দেখল, ফ্ল্যাটের সদর দরজা দুহাট করে খোলা। এই দরজার এখন আর বন্ধ হওয়া নেই। এখন এ শুধুই হা-হা করছে খোলা। বাইরে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি হচ্ছে। কিন্তু এখন হাওয়া নেই। ছাদের দরজাতেও সেই খোলা-বন্ধ, কই, আর নেই তো।

দুজন লোক—দুজনই মনে হয় তার— যারা ছাদে লুকিয়ে ছিল সেই সন্ধে থেকে… চিনু ছাদে পা রাখা মাত্র তার মুখ চেপে ধরে টেনে নিয়ে গিয়ে… ও মাগো, চিনু সেই থেকে ছাদের অন্ধকারে চিৎ হয়ে পড়ে? জীবিত বা মৃত, এই আকাশ-ভাঙা বৃষ্টি তার ওপর ঝরে পড়ছে সেই তখন থেকে, যখন, যে-সময় জুড়ে, তারই সপ্ৰেম উপহার নাকডাকা কৃতঘ্ন ঘুমে সে ঘুমিয়ে–এই দৃশ্য কল্পনা করতে গিয়ে হিরণের ঝুলপির পাশ দিয়ে স্বেদধারা নেমে আসে দরদরিয়ে, আর, ঠিক তখনই তিনতলার ল্যান্ডিং-এ সে চেনা মনুষ্যকণ্ঠ শুনতে পেল।

কে লেদু? হিরণ জানতে চাইল।

হ্যাঁ-হ্যাঁ। উত্তরে চিনুর গলা শোনা গেল, লেদু এসেছে।

চিনুর স্বর আকণ্ঠ ও উন্মুল… ভয়ার্ত। তবু তা শুনে স্বস্তি বোধ করে হিরণ। পায়ের নিচের মাটির ছোঁয়া পায়।

হিরণদের ফ্ল্যাটবাড়ি। একতলায় কোলাপসিবল গেটে তালা। একদা, গেটের পাশে, ভেতর দিকে, বারোটি ফ্ল্যাটের জন্য ছিল ফ্ল্যাটপিছু একটি করে বেল। পিয়ানোর রিডের মতো সারবন্দী কালো ডেকোলাম-টপ বোর্ডের ওপর সাদা সুইচগুলো, টিপলেই টুংটাং। পাড়ার ছেলেরা গেটের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে বেল বাজিয়ে মাঝে-মধ্যে পালাত। গৃহিণীদের দিবানিদ্রায় ব্যাঘাত। সে অমন হয়ে থাকে। তারপর একদিন অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি মধুবাবুর ফ্ল্যাটে, তখন দুপুর রাত, বেল বেজে উঠল। ওঁর বাড়িতে আবার হ্যাপি বার্থডে টু ইউ। প্রথম তিন কলি না বেজে যার থামবার নাম নেই। পাঁচতলা থেকে শীতের মধ্যরাতে চাদরে মাথামুড়ি দিয়ে নেমে মধুবাবু দেখলেন, কোথায় কে, সব ভোঁ-ভাঁ।

মধুবাবু শাসকপন্থী শরিকি রাজনীতি করেন, স্থানীয় কাউন্সিলর। ছাদের সিঁড়িতে পাড়ার লুম্পেনদের প্রেম, কন্ট্রাসেপটিভ রাবার—সব দেখেছেন। কেন এ-সব, তাও জানেন। স্বাধীনতার পর যাদের জন্ম, তাদের সামনে যাহোক একটা জাতীয় আদর্শ, একটা মধুর স্বপ্ন যদি ওরা তুলে ধরতে পারত। যেমনটা করেছিল রাশিয়া-চীন! বিপত্নীক মধুবাবু বছরখানেক হল জেলা কমিটির কমরেড লীলা ঘোষকে পূর্বপক্ষের দুই ছেলে-মেয়ের মা হিসেবে ঘরে এনেছেন, বছর ঘুরতে না ঘুরতেই নবজন্ম— তিনি কি বোঝেন না, মধ্যমাঘের রাতদুপুরে এই জন্মদিনের শুভেচ্ছা—পরপর দুদিন—এ কার উদ্দেশ্যে এবং কারা এসব করছে। নিঃসন্দেহে, কংগ্রেসি মাস্তানদের কাজ।

পরদিনই বেল-বোর্ডটি তুলে নেওয়া হয়। এ-সব অবশ্য হিরণরা আসার আগের কথা। এখন নিচে থেকে ডাকাডাকি করতে হয়, রাতবিরেতে কেউ এলে। নিচে নেমে গিয়ে গেট খুলে দিতে হয়। চিনু তাই নিচে নেমে গিয়েছিল।

ওরা ওপরে উঠে আসছে। প্রথমে লেদু, পরে চিনু। পাখিও নয়, কেননা পাখি তো তবু ডানা থেকে জল ঝাড়ে–বোঝা যায়, গাছের ফল কি একটা শস্যের দানা যে-ভাবে ভেজে, ভিজে যায়, সেইরকম অচেতন, নিপ, আত্মরক্ষাহীনভাবে লেদু কে জানে কঘণ্টা ধরে এমন একটানা ভিজেছে যে, এখন তাকে দেখে তার ফ্যাকাশে-নীল কোঁচকানো মনুষ্য-চামড়াটা হ্যাঙারে টাঙিয়ে দেওয়ার কথাই প্রথমত মনে পড়ে। শেষ কটা সিঁড়ি উঠতে গিয়ে সে দু-দুবার হুমড়ি খেয়ে পড়ে। মানুষ নয়, তাকে দেখে হিরণের মনে হল, তাড়া খাওয়া জন্তুই এমন বোধবুদ্ধিহীনভাবে এগিয়ে আসে। যখন, সে এগচ্ছে না পিছচ্ছে, নাকি, সেই সর্বনাশাকেন্দ্রের দিকেই চলে যাচ্ছে যেখান থেকে তার পলায়ন, সে ব্যাপারে তার কোনও হুঁশ থাকে না। যখন শুধু ছোটা। আর হুমড়ি খেয়ে পড়া। নাজানি রাস্তায় আরও কতবার এ-ভাবে মুখ থুবড়ে পড়েছে বেচারা! পড়তে পড়তেও উঠে দাঁড়িয়েছে।

এসো এসো, তোমরা ঘরে এসো, বলে তাদের আগেই ঢুকে পড়ে বসার ঘরের মেঝেয় হাত-পা ছড়িয়ে বসে পড়ল লেদু। তাকে ঘিরে বৃত্তাকারে একটি জলাসন তৈরি হতে থাকে।

হ্যাঁ, যে-কোনও সর্বনাশের কথাই সে এখন বলবে। এবং সে যা বলবে শোনামাত্র তা সত্য হয়ে যাবে ও তা মেনেও নিতে হবে। কারণ, ঠিক যা ঘটেছে, সে দাঁড় করাবে সেই অনস্বীকার্যের সামনে। তবে যাই ঘটে থাকুক, যাই বলুক সে, আসল কথা হল, সে-সর্বনাশের সঙ্গে সে বা চিনু সরাসরি কতখানি জড়িত। আর, তাদের দুজনের যে কিছু হয়নি এতো দেখাই যাচ্ছে। লেদুর পক্ষে এমন কথা জানাবার আর সম্ভাবনা নেই যে, ওগো কাকা, ওগো কাকিমা, তোমাদের দুজনের বা দুজনের একজনের এই সর্বনাশ হয়েছে। হ্যাঁ, সুযোগ সে পেয়েছিল বটে একবার। যখন হিরণের কাঁধের মস্ত টিউমারটির ব্যাপারে সে গিয়েছিল পার্ক সার্কাসে বায়োপসি-রিপোর্ট আনতে আর সে ফেরার আগেই হিরণ বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছিল বাঁশদ্ৰোনিতে, ভাগ্নীর ওখানে। লেদু মোটরবাইক চালিয়ে এ-বাড়ি সে-বাড়ি করে শেষমেশ চেতলা থেকে সেই যার নাম বাঁশদ্ৰোনিতে তাকে খুঁজে বের করে ও হাসতে-হাসতে এন-এ-এফ বা নাথিং অ্যাবনর্মাল ফাউন্ড রিপোর্টটি তার হাতে তুলে দেয়। ভগ্নদূত সেই একবারই চান্স পেয়েছিল যখন সে বলতে পারত, ওগো কাকা, তোমার সর্বনাশ হয়ে গেছে। অমন সুযোগ জীবনে একবারই আসে। আর সে সুযোগ সে হারিয়েছে। চিরতরে।

অতএব, এ প্রলয়-পয়োধি রাতে এমন আর কী ঘটে থাকতে পারে যা তাকে আর চিনুকে জানাতে সে এ-ভাবে ছুটে এসেছে তা ভাবতে গিয়ে হিরণ কোথাও থই পেল না। তাই সে ধরে নিল, তাহলে এমন কিছু ঘটেছে যাতে লেদুই প্রত্যক্ষভাবে ইনভলভড়। সর্বনাশ হয়ে গেছে তারই।

বৌদি কেমন আছে? সে জানতে চাইল।

অর্থাৎ লেদুর মা।

ততক্ষণে একটা বড়সড় গামছা এনে লেদুর মাথা মুছিয়ে দিচ্ছে চিনু। গামছার ভেতর থেকে লেদু জানাল (তার মুণ্ডু দেখা যায় না) ন-কাকা, একটা টে-টেলিফোন এসেছে মার্সেদ থেকে। ওখানে একটা কিছু হয়েছে। মার্সেদ? সে তো ম্যাপে-নেই-তবু-আছে, ক্যালিফোর্নিয়ার এমন এক স্মল-টাউন— হাজার হাজার… প্রায় চার হাজার মাইল দূরে প্রশান্ত মহালমুদ্রের ধারে বোধ ও বুদ্ধির বাইরে শ্বেত জনবসতি এক—তার কাছে যা শুধু স্প্যানিশ শব্দ একটি, যা এসেছে মার্সি বা ক্ষমা থেকে, যা রঞ্জনের বৌ সুমিতা তাকে জানাল এই তো সেদিন, কমাস আগে, দীঘার ফরেস্ট বাংলোয় দোতলার বিমুগ্ধ বারান্দায় বসে।

চার মাসও পুরো হয়নি। ফেব্রুয়ারিতে মার্সেদ থেকে এবার সুমিতা এসেছিল একাই, তার ছোটভাই রবির বিয়েতে। তারপর কদিনের জন্যে ওরা দীঘা গিয়েছিল। চিনু ছিল, লেদু আর তার বৌ শর্মি ছিল। সঙ্গে ছিল ওদের চার বছরের বিছুটা যে সুমিত্তার রিস্টওয়াচটা ওখানে বাংলোর ফ্রিজে রেখে দিয়েছিল, নইলে পচে যাবে বলে। দুটো দিন, আহা কী মাতিয়েই রেখেছিল ছেলেটা। একতলার বাগান থেকে ছেলেটাকে দোতলায় সুমিতার কাছে পাঠানো হয়েছিল “সোনাদিদার কাছ থেকে, যাও, লাপিয়ের-এর সিটি অফ জয় বইটা চেয়ে আনো” এই বলে। ব্যাটা ঠিক ঠিক বলেছিল। এবং দুহাতে বুকে ধরে সিঁড়ি ভেঙে বইটা নিয়েও এসেছিল।

নন্দিন, বেশ ভাল আছেনদা, খুব অ্যাডজাস্ট করে নিয়েছে। পড়াশোনা খুব ভাল করছে। বারবার জানাত সুমিতা। দশ-পনের মিনিট অন্তর নিজের থেকেই বলত বারবার। কেউ জানতে চাক বা না চাক।

একটা কিছু?

হিরণ এই প্রথম টের পেল দিকচিহ্নহীন জলরাশির ওপর সবে মাথা তুলেছে একটি চঞ্চল টেলিস্কোপ-চক্ষু, সমুদ্রের গভীরে একটি স্থির সাবমেরিন দাঁড়িয়ে আছে।

রঞ্জন, সুমিতা, তাদের দুই ছেলে জীয়ন আর অঞ্জন এবং…এবং…হ্যাঁ, তাদের একমাত্র সন্তান নন্দিন এদের কারও একজনের ভীষণ একটা কিছু হয়েছে। তবু, হয়ত, না নিশ্চয়ই এদের কারও মৃত্যু-সংবাদ লেদুর কাছে নেই। না, নন্দিনের তো নয়ই। ভাইনয়, ভ্রাতৃবধু নয়, ভ্রাতুস্পুত্র নয়, শুধু তাদের আত্মজার কথা ভেবে এতক্ষণের মধ্যে এই প্রথম সে চিন্ময়ীকে খোঁজে ও তার মুখের ভাষা পড়তে তার মুখের দিকে তাকায়।

সে দেখল, লেদুর মাথা-মোছা থামিয়ে, গামছাটা বুকের কাছেদুহাতে দুমড়ে ধরে চিনু দাঁড়িয়ে। তার পিঠ দেওয়ালে।

চোখের তারা ছাড়া তার সব কাঁপছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *