5 of 8

তৈজসপত্র

তৈজসপত্র

এই নিবন্ধনিভ লঘু রচনার নামকরণেই মারাত্মক ভুল হয়ে গেল।

এবারের বিষয় তেজপাতা। বিশুদ্ধ সংস্কৃতে তৈজসপত্র লিখে বেকায়দা হয়ে গেছে। অভিধান বা ব্যাকরণ কিছুই আমাকে সাহায্য করছে না এ বিষয়ে। অভিধানে অবশ্য তেজপাতা এবং তেজপত্র দুইই আছে। যার অর্থ সুবলচন্দ্র মিত্র লিখেছেন, ‘দারুচিনি জাতীয় বৃক্ষবিশেষের পত্র।’ অন্যদিকে তৈজসপত্রের মানে হল বাসন-কোসন। তৈজস হল ধাতুনির্মিত। ধাতু নির্মিত বাসনপত্র, কাঁসা পিতলের ঘটি-বাটি-থালা-গেলাস এই সব।

অভিধান এবং/অথবা ব্যাকরণ নিয়ে বাচালতা আপাতত থাক। তেজপাতার সুরভি-বিহ্বল পৃথিবীর কথা বলি।

সে ছিল শৈশবের কল্পনার জগৎ। আমার ধারণায় ছিল সে এক অসম্ভব কল্পবৃক্ষ। রূপকথার পৃথিবীর সেই গাছের পাতা ছিল তেজপাতা, তার ফুল হল লবঙ্গ, তার কচি ফল হল সাদা ছোট এলাচ, তার পাকা ফল হল বড় এলাচ। সে গাছের বাকল হল দারুচিনি বা দালচিনি। সেই দারুচিনির খোসায়, শুকনো তেজপাতায় আর লবঙ্গফুলের ডেলার থেকে ঝরে পড়া জোয়ানের বিন্দু বিন্দু দানায় ছেয়ে থাকে সেই কল্পবৃক্ষের তলা।

বড় হয়ে জেনেছি এ রকম কোনও গাছ জগৎসংসারে নেই, হয় না। মশলার খবর পেয়েছি ইতিহাসের বইয়ে, ভূগোলের মানচিত্রে আর জীবনানন্দ দাশের কবিতায়।

টাঙ্গাইলে আমার বন্ধু মইদুলদের বাসায় একবার একটা লবঙ্গের গাছ দেখেছিলাম। এমন হতে পারে, ওদের বিশ্বাস ছিল যে ওটা লবঙ্গের গাছ। যা নাও হতে পারে। আমার কিন্তু মোটেই বিশ্বাস হয়নি। একটিও লবঙ্গ সে গাছে দেখিনি।

এই রকম ভাবে জীবনের ষাটবছর চলে গেল। শৈশবের সেই কল্পবৃক্ষের রোমাঞ্চ আজকাল আর অনুভব করি না। কিন্তু এবার শীতের শেষে শান্তিনিকেতনে তেজপাতা গাছের দেখা পেলাম।

সঠিক সময়-তারিখ হল পহেলা মার্চ, শনিবার অপরাহ্ণ। কলকাতা লবণহ্রদ নিবাসিনী শ্রীযুক্ত মিনতি রায় শান্তিনিকেতন গুরুপল্লীতে সেনবাড়িতে গিয়েছিলেন, এই প্রতিবেদকও তাঁর সঙ্গে ছিলেন।

উল্লিখিত বাড়িটি শান্তিনিকেতন আশ্রমের প্রায় সমবয়সি। বিশাল এলাকা জুড়ে অসংখ্য গাছপালা, পুষ্করিণী তার মধ্যে দুই দিকে টানা বারান্দা দেওয়া এক প্রাচীন অট্টালিকা। শীতশেষের আবছায়া অপরাহ্ণ তখন সন্ধ্যার নিবিড়তার দিকে এগোচ্ছে। জানা-অজানা নানারকম দিনমানের পাখি ফিরে আসছে বড় বড় গাছের আশ্রয়ে। আমগাছ মুকুলে ছেয়ে গেছে।

দেশি-বিদেশি নানা রকমের গাছ সে বাড়িতে। তারই মধ্যে থেকে একটা নাতিদীর্ঘ গাছের একটা ডাল ভেঙে গৃহকর্ত্রী শ্রীমতী নীলাঞ্জনা আমাদের উপহার দিলেন। বললেন, ‘এটা তেজপাতার ডাল। এই কাঁচা পাতাগুলো শুকিয়ে নিলেই তেজপাতা হয়ে যাবে।’

এত সহজে হাতের নাগালে তেজপাতার গাছ! সেই শীতের সন্ধ্যায় আর একবার শিহরিত হয়েছিলাম।

তখনই গুনে দেখেছিলাম গাছের ডালটিতে ছোট-বড় মিলিয়ে মোট আটচল্লিশটি পাতা আছে। আমরা শ্ৰীমতী নীলাঞ্জনাকে বলেছিলাম, ‘পাতাগুলো শুকিয়ে নিয়ে এর উপযুক্ত সদ্ব্যবহার করে তোমাকে বিস্তারিত জানাব।’

আজ সেই সুযোগ মিলেছে। আজকেই শেষ তেজপাতাও ফুরল, আজ কিশমিশ দিয়ে, নারকেল দিয়ে ছোলার ডাল হয়েছিল। সেই ব্যঞ্জন ছিল এই শেষতম তেজপাতাটির সৌরভ ভরপুর।

বাকি সাতচল্লিশটি তেজপাতার হিসেব এই রকম।

প্রথমে শান্তিনিকেতনে এবং পরে কলকাতায় এসে দুটো-দুটো করে চারটে পাতা নষ্ট হয়েছিল সত্যিই তেজপাতা কিনা পরখ করার জন্যে পাতা ছিঁড়ে, গন্ধ শুঁকে।

এই পরীক্ষায় সসম্মানে উত্তীর্ণ হওয়ায় পরে প্লাস্টিকের প্যাকেটে পুরে বাকি পাতাগুলোকে ছাদে শুকোতে দিই। চৈত্রমাসের প্রখর কালবোশেখিতে প্লাস্টিকের প্যাকেটটি ছাদ থেকে উড়ে বাড়ির পাশের পার্কে গিয়ে পড়ে। পরের দিন সকালে মিনতিদেবী প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়ে ঘাসের ওপরে পাতাভরা প্লাস্টিকের ব্যাগটা দেখে চিনতে পারেন। এবং সেটিকে উদ্ধার করেন।

ছাদের ওপরে যে তেজপাতা শুকোতে দিয়েছি সেটা আমরা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম। এর পরে আমরা সতর্ক হয়ে যাই। প্লাস্টিকের প্যাকেটটি দক্ষিণের জানালার শিকের সঙ্গে দড়ি দিয়ে বেঁধে ঝুলিয়ে দিই। পুরো চৈত্রমাস তেজপাতাগুলি দক্ষিণের হাওয়ায় দুলে দুলে রোদ্দুরে শুকোয়।

অবশেষে শুভনববর্ষে, বাংলা পহেলা বৈশাখে প্যাকেট খুলে শুকনো তেজপাতাগুলি বের করা হয়।

দুঃখের বিষয় সেই সময় গুনে দেখা যায় কী করে বন্ধ এবং দোদুল্যমান প্যাকেটের মধ্যে থেকে চারটি পাতা কমে গেছে। আর মাত্র চল্লিশটি পাতা আছে।

এদিকে ওই পয়লা বৈশাখেই ঘি-ভাত, মাংস এবং পায়েসে সাতটি মহার্ঘ পাতা ব্যয় হয়ে যায়। এর পরে আমরা খুব সাবধান হয়ে যাই, না হলে গত তিনমাস আমরা মাত্র তেত্রিশটি তেজপাতা দিয়ে চালাতে পারতাম না। কালেভদ্রে মোহনভোগ, ছানার পায়েস বা মোচার ঘণ্ট হলে তেজপাতা ব্যবহার করা হয়েছে।

আজকের ছোলার ডালের সঙ্গে নিঃশেষে তেজপাতা ফুরল, এই রকম চিন্তায় যখন বিষাদগ্রস্ত হয়ে বসে আছি, মিনতিদেবী জানালেন, এখনও তাঁর কাছে চারটে তেজপাতা আছে, সেই চারটি যেগুলো আমরা হারিয়ে গেছে ধরে নিয়েছিলাম, সেগুলো তিনি লুকিয়ে রেখেছিলেন আমাদের অদূর বিবাহবার্ষিকীর জন্যে।

তেজপাতা পুনরুদ্ধারের এই সংবাদে হাসব কি কাঁদব বুঝতে পারছি না। তবে এটা জানি, চারটে তেজপাতার জন্যে অন্তত চারশো টাকার বাজার করতে হবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *