1 of 2

আলো জ্বেলো না, কেউ শব্দ কোরো না…

আলো জ্বেলো না, কেউ শব্দ কোরো না…

কারণ, ঘরের আলো যদি জ্বেলে রাখো, যদি শব্দ করো, তাহলে যাঁর আবির্ভাবের জন্যে এত আয়োজন, এত ডাকাডাকি, তিনি আর দেখা দেবেন না।

এ যেন এক অন্যরকম পুজো! তাই এর জন্যে প্রয়োজন অন্যরকম উপচার। দেবতার আরাধনা একা-একা তুমি করতে পারো, কিন্তু এঁকে আহ্বান জানানোর সময় একা হলে চলবে না—অন্তত তিনজন একসঙ্গে বসা চাই। ‘প্ল্যানচেট’ অথবা প্রেতচক্রের নিয়মই তাই।

কীভাবে বসবে সেটা এবারে বলি শোনো।

একটা ছোট্ট গোল টেবিলকে ঘিরে থাকবে কয়েকটা চেয়ার। ধরো, চারটে চেয়ার। সেই চেয়ারে তিনজন বসবে, তারপর তুমিও বসবে। তোমরা টানটান হয়ে বসে একে অপরের হাত ধরে থাকবে—তবে দেখবে কারও হাঁটুর সঙ্গে যেন কারও হাঁটুর ছোঁয়া না লাগে।

একটা কথা মনে রেখো—ঘরটা যেন পুরোপুরি অন্ধকার না হয়। ঘরের কোথাও একটা ছোট মোমবাতি জ্বেলে রাখতে পারো। সেই অল্প আলোয় তোমাদের মুখগুলো অস্পষ্টভাবে হলেও যেন দেখা যায়।

তোমরা সবাই শান্ত হয়ে বসবে। চুপ করে শুধু তাঁর কথাই চিন্তা করবে যাঁকে আজ আহ্বানের আয়োজন করেছ তোমরা। ইচ্ছে করলে হালকা কোনও মোলায়েম সুর বাজাতে পারো টেপরেকর্ডারে। তবে বেশিক্ষণ নয়—দশ কি পনেরো মিনিটের জন্যে। তারপর…তারপর তোমাদের মধ্যে যে মিডিয়াম—মানে, যাকে অবলম্বন করে তিনি দেখা দেবেন—যে সবাইকে ফিসফিস করে জানাবে, কেন তোমরা আলো-আঁধারিতে একটা গেল টেবিলকে ঘিরে হাতে হাত ধরে বসেছ। কার কথা তোমরা সবাই ভাববে, কার স্মৃতিকথা তোমরা কল্পনার চোখে জীবন্তভাবে ‘দেখতে’ চেষ্টা করবে। শুধু ভাববে তাঁর কথা, শুধু ভাববে, শুধু ভাববে। আর একইসঙ্গে ফিসফিস করে তাঁর নাম ধরে ডাকবে: ‘এসো…তুমি এসো…।’

হঠাৎই একসময় তোমরা টেবিলের পায়ার একটা শব্দ শুনতে পাবে, শুনতে পাবে ভারী শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ। তখন হয়তো তুমি প্রশ্ন করবে, ‘কেউ কি এসেছেন?’

কোনও উত্তর তুমি পাবে না। তবে তার বদলে টেবিলের পায়া নড়ে উঠে একবার শব্দ করবে: খুট। যার মানে, হ্যাঁ—এসেছি।

তোমরা প্রথমটায় বিশ্বাস করতে পারবে না। তোমরা ভয় পাবে, ভীষণ অবাক হবে। কিছুক্ষণ তোমরা কেউই কথা বলতে পারবে না। তারপর…তারপর তোমাদের মধ্যেই কেউ হয়তো জিগ্যেস করবে, ‘আপনি কি এ-ঘরে আগে থেকেই ছিলেন?’

টেবিলের পায়া নড়ে উঠবে অন্ধকারে। শব্দ করে ‘খট-খট’—দুবার। যার মানে, না—এ-ঘরে আগে ছিলাম না।

এবার তোমার শীত করবে। মনে হবে, ঘরের বাতাস হঠাৎই যেন হিম ঠান্ডা হয়ে গেছে। আবহাওয়া জেলির মতো ভারী হয়ে গেছে।

এরপর মিডিয়াম তোমাদের হয়ে তাঁকে শব্দ করবে—আর তিনি ‘হ্যাঁ’ কিংবা ‘না’ এই ঢঙে প্রশ্নের উত্তর দেবেন। অর্থাৎ, গোল টেবিলটা শব্দ করে নড়ে উঠবে—হয় একবার, নয় দুবার।

ছায়া-অন্ধকারে ঘটনাক্রম যত এগোবে ততই তুমি টের পাবে যে, তোমার হাতে ধরা হাত দুটো বেশ কাঠ-কাঠ হয়ে উঠেছে, অল্প-অল্প কাঁপছে। তোমাদের কেউ-কেউ—হয়তো তুমি নও—উসখুস করছে, মুখে চাপা ‘উঃ…আঃ’ শব্দ করছে।

এর মানে কী জানো?

ওরা ভয় পাচ্ছে। এই প্রেতচক্র ছেড়ে চলে যেতে চাইছে। কিন্তু কী এক অলৌকিক টানে পারছে না। ভয়ে সিঁটিয়ে চেয়ারে বসে আছে। না, না, তোমাকে বলছি না। তুমি নিশ্চয়ই ওদের মতো ভয় পাওনি—কারণ, তোমার সাহস হয়তো অনেক বেশি।

এবার তোমরা একটা কুয়াশা দেখতে পেলে। শূন্যে, টেবিলের ঠিক ওপরে, ধীরে-ধীরে গাঢ় হছে, জমাট বাঁধছে। অন্ধকার ঘরে ছাইরঙা মেঘ। কী অদ্ভুত! আর একইসঙ্গে একটা অচেনা সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে।

তোমাদের মিডিয়াম ফিসফিসে গলায় প্রশ্ন করল, ‘আপনি কে? আপনার নাম কী?’

মেঘের সঙ্গে মেঘ ঘষা লাগলে শব্দ হয় কি না জানি না, কিন্তু একটা খসখস শব্দ শোনা গেল। মনে হল যেন ওই মেঘটা উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করছে, কাঁপছে।

একই প্রশ্ন আবার করল মিডিয়াম। তারপর আবার। তারপর আরও একবার।

তখন অদ্ভুত কাণ্ড হল একটা। ফিসফিস করে কেউ যেন বলল, ‘আমি…কেউ…না। আগে…ছিলাম। এখন…আমি…নেই। আমি এখন কেউ না…।’

তুমি একটা ঝাঁকুনি খেলে। কে কথা বলল? এতগুলো কথা! ভুল শোনার তো কোনও প্রশ্ন নেই! তা হলে কথাগুলো বলল কে?

তোমার গায়ে কাঁটা দিল। কিন্তু তুমি চেয়ারে বসেই রইলে। বেশ টের পাচ্ছ, হাতে হাত ধরা অবস্থাতেও তোমার হাতের পাতা কাঁপছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও স্রেফ মনের জোরে তুমি বসে আছ। গোল টেবিল ঘিরে হাতে হাত ধরে তৈরি করা ‘চক্র’ ভাঙছ না।

তুমি মনে-মনে যুক্তি তৈরি করতে চাইলে। অকালের শীত যে তোমার গায়ে কাঁটা ফুটিয়ে তুলেছে সেটার অন্য ব্যাখ্যা তুমি খুঁজলে। মিডিয়াম চুপ করে আছে—হয়তো ভয় পেয়েছে। কিন্তু তুমি তো সহজে ভয় পাওয়ার পাত্র নও। তাই তুমি মিডিয়ামকে ডিঙিয়ে প্রশ্ন করলে, ‘টেবিলটা কি আপনি নাড়াচ্ছিলেন?’

এর উত্তরে ঘরের কুয়াশায় আবার কাঁপন ধরল। মোমের আলো তার মধ্যে দিয়ে প্রতিসৃত হয়ে ছোট মাপের এক অদ্ভুত রামধনু তৈরি করে ফেলল। তারপর সেই রামধনু তিরতির করে কাঁপতে লাগল। সেইসঙ্গে ঘরের জমাট বাতাসেও কাঁপন ধরল।

নিস্তব্ধ ঘরের মধ্যে তুমি ফিসফিসে হাসির শব্দ পেলে যেন। শব্দ না করে কেউ হাসছে। তোমার প্রশ্নের উত্তরে হাসছে।

তোমার চোখ এবার বড় হল, মুখটা হাঁ হল। তোমার তিনসঙ্গীরও তখন একই অবস্থা। অবশ্য তুমি ওদের স্পষ্টভাবে দেখতে পাচ্ছ না।

হঠাৎ কেমন একটা গোঙানির শব্দ পাওয়া গেল। যন্ত্রণায় গোঙানি।

তুমি তখনও ভয় পেলে না। বরং তোমার মনের ভেতরে লড়াইয়ের একটা জেদ তৈরি করলে। অন্য তিনজনকে নিজের সাহস দেখানোর জন্যে একটু উঁচু গলায় একই প্রশ্ন করলে, ‘টেবিলটা কি আপনি নাড়াচ্ছিলেন?’

এবার উত্তর পাওয়া গেল সরাসরি। টেবিলের পায়াটা যেন মেঝেতে ‘পা ঠুকল’। একবার। যার মানে ‘হ্যাঁ।’

হঠাৎই তোমার মনে সন্দেহ তৈরি হল। টেবিলের এইসব ব্যাপার-স্যাপারগুলো বাকি তিনজনের কারও কীর্তি নয়তো! হয়তো প্রেতচক্রে বসে-বসেই কেউ অন্ধকারে লুকিয়ে নড়বড়ে টেবিলকে নাড়াচ্ছে। মেঝেতে তার পায়া ঠুকে দিচ্ছে। দরকার মতো একবার কিংবা দুবার।

কিন্তু ওই কুয়াশা? যেটা এখনও তোমার চোখের সামনে শূন্যে নিরালম্ব হয়ে ভেসে রয়েছে? সুগন্ধটা সামান্য ফিকে হয়ে এসেছে বটে কিন্তু এখনও অস্তিমান। এই কুয়াশা কি কারও পক্ষে তৈরি করা সম্ভব? কিংবা ওই মিনিয়েচার রামধনু?

কেন নয়?

তুমি নিজেকে যুক্তি দিয়ে বোঝালে। হয়তো তোমার তিন সঙ্গীর কেউ সবাইকে লুকিয়ে একটা বোতলে বন্দি করে খানিকটা ধূপের ধোঁয়া নিয়ে এসেছে। তারপর..।

কিন্তু সেই ধূপের ধোঁয়া সে ইচ্ছেমতো বোতলের বাইরে বের করবে কেমন করে?

এই প্রশ্নেরও উত্তর খুঁজে পেলে তুমি। গ্যাসের প্রসারণের সূত্র। বোতলের মুখ খুলে দু-হাতের তালু বোতলের গায়ে ভালো করে চেপে ধরে রাখলেই কাজ হাসিল করা যাবে। তালুর উত্তাপ বোতলের কাচের দেওয়ালের মধ্যে দিয়ে সঞ্চারিত হয়ে পৌঁছে যাবে ধোঁয়ায়—মানে, গ্যাসে। গ্যাস উত্তপ্ত হয়ে আয়তনে বাড়বে। তারপর ধীরে-ধীরে বেরিয়ে আসবে বোতলের মুখ দিয়ে। সুতরাং..।

তোমার মনে নতুন প্রশ্ন জেগে উঠল। ধোঁয়াটা বোতল থেকে বেরিয়ে শূন্যে একই জায়গায় ভেসে আছে কেমন করে? কেমন করে তৈরি হল ওই রামধনু?

এবার তোমার যুক্তি হোঁচট খেল। তোমার বিজ্ঞানমনস্ক মন আহত হল। তোমার আস্থায় আঁচড় পড়ল।

তুমি ভাবতে লাগলে। কারণ কিছুতেই হাল ছাড়তে রাজি নও তুমি।

একটু পরেই উত্তর খুঁজে পেলে।

সিনেমায় যেমন দেখায়, নায়ক-নায়িকার পায়ের কাছে ভেসে বেড়াচ্ছে জমাট ধোঁয়া। একই জায়গায় থেমে রয়েছে—ওপরে ভেসে উঠছে না। হয়তো সেইরকম কোনও কেমিক্যাল-ধোঁয়া ব্যবহার করেছে তোমাদের কেউ। তারপর তার ওপরে লুকোনো কোনও টর্চ থেকে স্পেশাল রঙিন আলো ফেলে রামধনুর হলোগ্রাম ইমেজ তৈরি করেছে।

তুমি স্বস্তির শ্বাস ফেললে। যাক, অবশেষে একটা নড়বড়ে হলেও যুক্তি খাড়া করতে পেরেছ তুমি।

নাঃ, এইসব প্ল্যানচেট-ফ্যানচেটে তোমার আর বিশ্বাস নেই। সব বাজে কথা। মিডিয়ামগুলো সব জালিয়াত। ম্যাজিশিয়ান হ্যারি হুডিনি এইসব জালিয়াত মিডিয়ামদের ধরে-ধরে বেনকাব করত। এতক্ষণ এইভাবে বসে-বসে ফালতু বাজে সময় নষ্ট হল।

তুমি হঠাৎই ওই ধোঁয়া—কিংবা কুয়াশা—লক্ষ্য করে জোরে ফুঁ দিলে। তোমাকে আবারও অবাক করে দিয়ে ওই ছোট্ট মেঘের টুকরোটা একইরকম রয়ে গেল। রামধনুটাও।

নাঃ, যুক্তি দিয়ে এটার একটা ব্যাখ্যা বের করতে হবে।

তুমি হঠাৎই সঙ্গীদের হাত ছেড়ে দিলে। বেশ জোরের সঙ্গে বললে, ‘তোদের মধ্যে কে চালাকি করছিস বল—।’

সবাই চমকে উঠল। অন্ধকার আর মোমের আলোয় মাখামাখি তোমার মুখের দিকে তাকাল। ওরা অসহায়ভাবে বলল যে, ওরা সত্যিই কোনও চালাকি করেনি।

তুমি বিশ্বাস করলে না। শূন্যে ঝুলে থাকা মেঘের মধ্যে পাগলের মতো এলোমেলো হাত চালালে।

মেঘটা ঘেঁটে গেল। রামধনু মিলিয়ে গেল। সাদা কুয়াশার টুকরো ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে শূন্যে ভেসে বেড়াতে লাগল। কিন্তু তারই মধ্যে একটা বিকৃত মুখের চেহারা দেখতে পেলে তুমি।

তুমি সেটাকে কোনও আমল দিলে না। আকাশের মেঘও তো অনেক সময় নানান ছবির চেহারা নেয়! এই বিকৃত ভয়ংকর মুখটাও সেরকম কিছু। তুমি নিজেকে বোঝালে, বিজ্ঞান আর যুক্তিই চিরকাল শেষ কথা বলবে।

কিন্তু তোমার সঙ্গীরা ভয় পেল। ওই মুখটা দেখে হঠাৎই একটা আতঙ্কের ঝোঁক ওদের গ্রাস করল। তোমার বকুনির তোয়াক্কা না করেই ওরা ছুট লাগাল ঘরের দরজার দিকে।

তুমি হকচকিয়ে গেলে। কিন্তু তারপরই চেঁচামেচি করে ধমক দিয়ে ওদের ধাওয়া করলে।

এতক্ষণ ধরে এত ঘটনা দেখার পরেও, শোনার পরেও, তুমি বিশ্বাস করতে চাইছ না। ভাবছ প্ল্যানচেট আসলে বুজরুকি, ম্যাজিকের লোকঠকানো কলাকৌশল।

কী করে তোমাকে যে বিশ্বাস করাই!

তোমার বন্ধুরা তখন দুদ্দাড় করে সিঁড়ি ভেঙে দোতলার দিকে ছুটছে। আর তাদের পেছন-পেছন তাড়া করে তুমিও ছুটছ।

তোমাকে বিশ্বাস করানোর জন্যে আমি তখন মরিয়া। তাই ঘরের বাইরে আমিও বেরিয়ে এলাম, সিঁড়ি দিয়ে উঠতে শুরু করলাম।

আমি জানতাম, এবার তুমি পেছন ফিরে তাকাবে—এবং বিশ্বাস করবে।

ঠিক তাই হল। পেছনে খটখট শব্দ শুনে তুমি সিঁড়ির ওপর থেকে পেছন ফিরে আমার দিকে তাকালে।

দেখলে, প্ল্যানচেটের গোল টেবিলটা খটখট শব্দ করে সিঁড়ি বেয়ে তোমাকে ধাওয়া করে উঠছে।

বলো, এবারে তোমার বিশ্বাস হল তো?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *