০৬. পালসাম্রাজ্য

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ –পালসাম্রাজ্য

১. গোপাল (আ ৭৫০-৭৭০)

শশাঙ্কের মৃত্যুর পর শতবর্ষব্যাপী অনৈক্য, আত্মকলহ ও বহিঃশত্রুর পুনঃপুন আক্রমণের ফলে বাংলার রাজতন্ত্র ধ্বংসপ্রায় হইয়াছিল। প্রায় সহস্র বৎসর পরে তিব্বতীয় বৌদ্ধ লামা তারনাথ এই যুগের বাংলার সম্বন্ধে লিখিয়াছেন যে সমগ্র দেশের কোনো রাজা ছিল না, প্রত্যেক ক্ষত্রিয়, সম্ভ্রান্ত লোক, ব্রাহ্মণ, এবং বণিক নিজ নিজ এলাকা স্বাধীনভাবে শাসন করিতেন। ফলে লোকের দুঃখ-দুর্দশার আর সীমা ছিল না। সংস্কৃতে এইরূপ অরাজকতার নাম মাৎস্যন্যায়। পুকুরের যেমন বড় মাছ ছোট মাছ খাইয়া প্রাণ ধারণ করে, দেশে অরাজকতার সময় সেইরূপ প্রবল অবাধে দুৰ্ব্বলের উপর অত্যাচার করে, এই জন্যই মাৎস্যন্যায় এই সংজ্ঞার উৎপত্তি। সমসাময়িক লিপিতে বাংলা দেশে মাৎস্যন্যায়ের উল্লেখ আছে-সুতরাং তারনাথের বর্ণনা মোটামুটি সত্য বলিয়াই গ্রহণ করা যায়। এই চরম দুঃখ-দুর্দশা হইতে মুক্তিলাভের জন্য বাঙ্গালী জাতি যে রাজনৈতিক বিজ্ঞতা, দূরদর্শিতা ও আত্মত্যাগের পরিচয় দিয়াছিল, ইতিহাসে তাহা চিরস্মরণীয় হইয়া থাকিবে। দেশের প্রবীণ নেতাগণ স্থির করিলেন যে পরস্পর বিবাদ-বিসংবাদ ভুলিয়া একজনকে রাজপদে নির্বাচিত করিবেন এবং সকলেই স্বেচ্ছায় তাঁহার প্রভুত্ব স্বীকার করিবেন। দেশের জনসাধারণও সানন্দে এই মত গ্রহণ করিল। ইহার ফলে গোপাল নামক এক ব্যক্তি বাংলা দেশের রাজপদে নিৰ্বাচিত হইলেন। এইরূপে কেবলমাত্র দেশের মঙ্গলের দিকে চাহিয়া ব্যক্তিগত স্বার্থ বিসর্জনপূর্ব্বক সর্ব্বসাধারণে মিলিয়া কোনো বৃহৎ কাৰ্য্য অনুষ্ঠান যেমন বাঙ্গালীর ইতিহাসে আর দেখা যায় না, বর্ত্তমান ক্ষেত্রে এই মহান স্বার্থত্যাগ ও ঐক্যের ফলে বাঙ্গালীর জাতীয় জীবন যে উন্নতি ও গৌরবের চরম শিখরে উঠিয়াছিল, তাঁহার দৃষ্টান্তও বাংলার ইতিহাসে আর নাই। ১৮৬৭ অব্দে জাপানে যে গুরুতর রাজনৈতিক পরিবর্ত্তন ঘটিয়াছিল, কাৰ্য্য, কারণ ও পরিণাম বিবেচনা করিলে তাঁহার সহিত সহস্রাধিক বৎসর পূর্ব্বে গোপালের রাজপদে নির্বাচনের তুলনা করা যাইতে পারে।

গোপালের বংশপরিচয় সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানা যায় না। গোপাল ও তাঁহার বংশধরগণ সকলেই বৌদ্ধধর্ম্মাবলম্বী ছিলেন। পালরাজগণের তাম্রশাসনে উক্ত হইয়াছে যে গোপালের পিতামহ দয়িতবিষ্ণু সর্ব্ববিদ্যাবিশুদ্ধ ছিলেন এবং গোপালের পিতা বপট শক্রর দমন এবং বিপুল কীর্তিকলাপে সসাগরা বসুন্ধরাকে ভূষিত করিয়াছিলেন। সুতরাং গোপাল যে কোনো রাজবংশে জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন এরূপ মনে হয় না। তাঁহার পিতা যুদ্ধ ব্যবসায়ী ছিলেন এবং গোপালও সম্ভবত পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করিয়া প্রবীণ ও সুনিপুণ যোদ্ধা বলিয়া পরিচিত হইয়াছিলেন। কারণ এই সঙ্কট সময়ে বাংলার নেতাগণ যে বংশমর্যাদাহীন যুদ্ধানভিজ্ঞ তরুণ-বয়স্ক কোনো ব্যক্তিকে রাজপদে নির্বাচন করিয়াছিলেন, এরূপ সম্ভবপর বলিয়া মনে হয় না। পরবর্ত্তীকালে পালগণ ক্ষত্রিয় বলিয়া পরিচিত ছিলেন। গোপালের পুত্র ধর্ম্মপাল সমসাময়িক একখানি গ্রন্থে ‘রাজভটাদিবংশ পতিত’ বলিয়া উক্ত হইয়াছেন। ইহা হইতে কেহ কেহ অনুমান করেন যে পালরাজগণ খড়গবংশীয় রাজা রাজরাজভটের বংশধর। কিন্তু এখানে রাজভট শব্দ রাজসৈনিক অর্থে গ্রহণ করাই অধিকতর সমীচীন বলিয়া মনে হয়। ইহা পূর্ব্বোক্ত সিদ্ধান্তের সমর্থক।

গোপালের তারিখ সঠিক জানা যায় না। তবে তিনি অষ্টম শতাব্দীর মধ্যভাগে রাজপদে নিৰ্বাচিত হইয়াছিলেন, ইহাই সম্ভবপর মনে হয়। প্রায় চারিশত বর্ষ পরে রচিত রামচরিত গ্রন্থে বরেন্দ্রভূমি পালরাজগণের ‘জনকভূ’ অর্থাৎ পিতৃভূমি বলিয়া বর্ণিত হইয়াছে। ইহা হইতে পণ্ডিতগণ অনুমান করেন যে গোপাল বরেন্দ্রের অধিবাসী ছিলেন। তিনি প্রথমেই সমগ্র বাংলা দেশের অধিপতি নির্বাচিত হইয়াছিলেন কি না তাহা সঠিক জানা যায় না। কিন্তু তাঁহার রাজ্যকালে সমগ্র বঙ্গদেশই তাঁহার শাসনাধীন হইয়াছিল এবং বহুদিন পরে বাংলায় দৃঢ়প্রতিষ্ঠিত রাজশক্তির সহিত সুখ ও শান্তি ফিরিয়ে আসিয়াছিল। ইহাই গোপালের প্রধান কীর্তি। তাঁহার রাজ্যকালের কোনো বিবরণই আমরা জানি না। কিন্তু তিনি যে শতাব্দীব্যাপী বিশৃঙ্খলার পর তাঁহার রাজ্য এমন শক্তশালী ও সুসমৃদ্ধ করিয়া যাইতে পারিয়াছিলেন, তাঁহার পুত্র যে সমগ্ৰ আৰ্য্যাবর্তে এক বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন, ইহাতেই তাঁহার রাজোচিত গুণাবলী ও ভূয়োদর্শনের যথেষ্ট পরিচয় পাওয়া যায়।

.

২. ধর্ম্মপাল (আ ৭৭০-৮১০)

গোপালের মৃত্যুর পর আ ৭৭০ অব্দে তাঁহার পুত্ৰ ধৰ্ম্মপাল সিংহাসনে আরোহণ করেন। ধর্ম্মপাল বীর, সাহসী ও রাজনীতিকুশল ছিলেন। গোপালের সুশাসনের ফলে বাংলা দেশের শক্তি ও সমৃদ্ধি অনেক বাড়িয়েছিল। সুতরাং ধর্ম্মপাল প্রথম হইতেই আৰ্য্যাবৰ্ত্তে এক সাম্রাজ্য স্থাপনের কল্পনায় মাতিয়া উঠিলেন। কিন্তু শীঘ্রই তাঁহার এক প্রতিদ্বন্দ্বী উপস্থিত হইল। ইনি প্রতীহারবংশীয় রাজা বৎসরাজ। প্রতীহারেরা সম্ভবত গুজ্জরজাতীয় ছিলেন। কেহ কেহ অনুমান করেন যে এই গুজ্জর জাতি হূণদিগের সঙ্গে বা অব্যবহিত পরে ভারতে আসিয়া পাঞ্জাব রাজপুতানা ও মালবে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্য স্থাপন করে। অষ্টম শতাব্দীর শেষার্ধে মালব ও রাজপুতানার প্রতীহার রাজা বৎসরাজ বিশেষ শক্তিশালী হইয়া উঠেন। যে সময় ধর্ম্মপাল বাংলা দেশ হইতে পশ্চিম দিকে বিজয়াভিযান করেন, সেই সময় বসরাজও সাম্রাজ্য স্থাপনের চেষ্টায় পূর্ব্বদিকে অগ্রসর হন। ফলে উভয়ের মধ্যে সংঘর্ষ হয় এবং ধর্ম্মপাল পরাজিত হন। কিন্তু ধর্ম্মপালের সৌভাগ্যক্রমে এই সময় দক্ষিণাপথের রাষ্ট্রকুটরাজ ধ্রুব আৰ্য্যাবর্তে বিজয়াভিযান করিয়া বসরাজকে পরাজিত করেন। বসরাজ পলাইয়া মরুভূমিতে আশ্রয় লইলেন এবং তাঁহার সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার আশা দূরীভূত হইল।

ধ্রুব বৎসরাজকে পরাস্ত করিয়াই ক্ষান্ত হইলেন না। তিনি ধর্ম্মপালের বিরুদ্ধে অগ্রসর হইলেন। ধর্ম্মপাল ইতিমধ্যে মগধ, বারাণসী, ও প্রয়াগ জয় করিয়া গঙ্গা যমুনার মধ্যবর্ত্তী ভূভাগ পর্য্যন্ত অগ্রসর হইয়াছিলেন। এইখানেই ধ্রুবের সহিত তাঁহার যুদ্ধ হইল। রাষ্ট্রকূটরাজের প্রশস্তিমতে ধ্রুব ধৰ্ম্মপালকে পরাজিত করিয়াছিলেন। কিন্তু ইহাতে ধর্ম্মপালের বিশেষ কোনো অনিষ্ট হইয়াছিল বলিয়া মনে হয় না। ধ্রুব শীঘ্রই দক্ষিণাপথে ফিরিয়া গেলেন। এবং ধর্ম্মপালের আর কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী রহিল না। এই সুযোগে ধর্ম্মপাল ক্রমে ক্রমে প্রায় সমগ্ৰ আৰ্য্যাবর্ত্ত জয় করিয়া নিজের আধিপত্য স্থাপন করিলেন। ইহার ফলে তিনি সার্বভৌম সম্রাটের পদ প্রাপ্ত হইলেন এবং গৌরবসূচক ‘পরমেশ্বর পরমভট্টারক মহারাজাধিরাজ’ প্রভৃতি উপাধি গ্রহণ করিলেন।

ধর্ম্মপালের পুত্র দেবপালের তাম্রশাসনে উক্ত হইয়াছে যে ধৰ্ম্মপাল দিগ্বিজয়ে প্রবৃত্ত হইয়া কেদার ও গোকর্ণ এই দুই তীর্থ এবং গঙ্গাসাগর সঙ্গম দর্শন করিয়াছিলেন। কেদার হিমালয়ে অবস্থিত সুপরিচিত তীর্থ। গোকর্ণের অবস্থিতি লইয়া পণ্ডিতগণের মধ্যে মতভেদ আছে। কাহারও মতে ইহা বোম্বে প্রেসিডেন্সির অন্তর্গত উত্তর কাণাড়ায় অবস্থিত সুপরিচিত গোকর্ণ নামক তীর্থ। কিন্তু ধর্ম্মপাল যে দাক্ষিণাত্যের রাষ্ট্রকূটরাজ্য পার হইয়া এই দূরদেশে বিজয়াভিযান করিয়াছিলেন বিশিষ্ট প্রমাণ অভাবে তাহা বিশ্বাস করা কঠিন। নেপালে বাগমতী নদীর তীরে পশুপতি মন্দিরের দুই মাইল উত্তর-পূর্ব্বে গোকর্ণ নামে তীর্থ আছে–সম্ভবত ধর্ম্মপাল এই স্থানে গমন করিয়াছিলেন। এই অনুমানের সপক্ষে বলা যাইতে পারে যে স্বয়ম্ভুপুরাণে উক্ত হইয়াছে যে গৌড়রাজ ধর্ম্মপাল নেপালের সিংহাসন অধিকার করিয়াছিলেন। গোকর্ণ যেখানেই অবস্থিত হউক, ধৰ্ম্মপালের সেনাবাহিনী দিগ্বিজয়ে বাহির হইয়া যে পাঞ্জাবের প্রান্ত পর্য্যন্ত বিজয়াভিযান করিয়াছিল, সে বিষয়ে সন্দেহ নাই।

আর্য্যাবর্তে আধিপত্য লাভ করিবার জন্য ধর্ম্মপালকে বহু যুদ্ধ করিতে হইয়াছিল। কিন্তু উক্ত দিগ্বিজয়ের উল্লেখ ব্যতীত পালরাজগণের প্রশস্তিতে এই সমুদয় যুদ্ধের বিশদ কোনো বিবরণ নাই। এই দিগ্বিজয়ের প্রারম্ভেই তিনি ইন্দ্ররাজ প্রভৃতিকে জয় করিয়া মহোদয় অর্থাৎ কান্যকুব্জ অধিকার করিয়াছিলেন। প্রাচীন পাটলিপুত্র ও বর্ত্তমান দিল্লীর ন্যায় তৎকালে কান্যকুব্জই আৰ্য্যাবর্তের রাজধানী বলিয়া বিবেচিত হইত, এবং সাম্রাজ্য স্থাপনে অভিলাষী রাজগণ কান্যকুজের দিকে লোলুপ দৃষ্টি নিক্ষেপ করিতেন। ধর্ম্মপাল কান্যকুব্জ অধিকার করিয়া ক্রমে সিন্ধু নদ ও পাঞ্জাবের উত্তরে হিমালয়ের পাদভূমি পৰ্য্যন্ত জয় করিলেন। দক্ষিণে বিন্ধ্যপর্বত অতিক্রম করিয়াও তিনি সম্ভবত কিছুদূর অগ্রসর হইয়াছিলেন। এইরূপে আর্য্যাবর্তের সার্বভৌমত্ব লাভ করিয়া ইহা প্রকাশ্যে ঘোষণা করিবার জন্য তিনি কান্যকুজে এক বৃহৎ রাজাভিষেকের আয়োজন করিলেন। এই রাজদরবারে আর্য্যাবর্তের বহু সামন্ত নরপতিগণ উপস্থিত হইয়া ধর্ম্মপালের অধিরাজত্ব স্বীকার করিলেন। মালদহের নিকটবর্ত্তী খালিমপুরে প্রাপ্ত ধৰ্ম্মপালের তাম্রশাসনে এই ঘটনাটি নিম্নলিখিতরূপে বর্ণিত হইয়াছে। “তিনি মনোহর ভঙ্গি-বিকাশে ইঙ্গিত মাত্রে] ভোজ, মৎস্য, মদ্র, কুরু, যদু, যবন, অবন্তি, গন্ধার এবং কীর প্রভৃতি বিভিন্ন জনপদের [সামন্ত?] নরপালগণকে প্রণতিপরায়ণ চঞ্চলাবনত মস্তকে সাধু সাধু বলিয়া কীৰ্ত্তন করাইতে করাইতে হৃদচিত্ত পাঞ্চালবৃদ্ধকর্ত্তৃক মস্তকোপরি আত্মাভিষেকের স্বর্ণকলস উদ্ধৃত করাইয়া কান্যকুব্জকে রাজশ্রী প্রদান করিয়াছিলন।”

এই শ্লোকে যে সকল রাজ্যের উল্লেখ আছে, তাহাদের রাজগণ সকলেই কান্যকুজে আসিয়াছিলেন এবং যখন পঞ্চাল দেশের বয়োবৃদ্ধগণ ধর্ম্মপালের মস্ত কে স্বর্ণকলস হইতে পবিত্র তীর্থজল ঢালিয়া তাঁহাকে কান্যকুজের রাজপদে অভিষেক করিতেছিলেন তখন নতশিরে ‘সাধু সাধু’ বলিয়া এই কাৰ্য্য অনুমোদন করিয়াছিলেন-অর্থাৎ তাঁহাকে রাজচক্রবর্ত্তী বলিয়া সসম্ভ্রমে অভিবাদন করিয়াছিলেন। সুতরাং অন্তত ঐ সমুদয় রাজ্যই যে ধৰ্ম্মপালের সাম্রাজ্যের অন্তর্গত ছিল তাহা স্বীকার করিতেই হইবে। ইহার মধ্যে গন্ধার, মদ্র, কুরু ও কীর দেশ যথাক্রমে পঞ্চনদের পশ্চিম, মধ্য, পূর্ব্ব ও উত্তর ভাগে অবস্থিত। যবন দেশ সম্ভবত সিন্ধু নদের তীরবর্ত্তী কোনো মুসলমান অধিকৃত রাজ্য সূচিত করিতেছে। অবন্তি মালবের এবং মৎস্যদেশ আলওয়ার ও জয়পুর রাজ্যের প্রাচীন নাম। ভোজ ও যদু একাধিক রাজ্যের নাম ছিল। সুতরাং ইহা দ্বারা ঠিক কোন কোন দেশ সূচিত হইয়াছে, তাহা বলা কঠিন। সম্ভবত ভোজরাজ্য বর্ত্তমান বেরারে এবং যদুরাজ্য পাঞ্জাবে অথবা সুরাষ্ট্রে অবস্থিত ছিল।

এই সমুদয় রাজ্যের অবস্থিতি আলোচনা করিলে সহজেই অনুমিত হইবে যে ধর্ম্মপাল প্রায় সমগ্র আর্য্যাবর্তের অধীশ্বর ছিলেন। পালরাজগণের প্রশস্তি ব্যতীত অন্যত্রও ধর্ম্মপালের এই সাৰ্বভৌমত্বের উল্লেখ আছে। একাদশ শতাব্দীতে রচিত সোড়ল প্রণীত উদয়সুন্দরীকথা নামক চম্পু-কাব্যে ধর্ম্মপাল উত্তরাপথস্বামী বলিয়া অভিহিত হইয়াছেন।

এই বিশাল সাম্রাজ্যের মধ্যে মাত্র বাংলা দেশ ও বিহার ধর্ম্মপালের নিজ শাসনাধীনে ছিল। অন্যান্য পরাজিত রাজগণ ধর্ম্মপালের প্রভুত্ব স্বীকার করিয়া স্বীয় স্বীয় রাজ্য শাসন করিতেন। কেবলমাত্র কান্যকুজে পরাজিত ইন্দ্ররাজের পরিবর্তে ধর্ম্মপাল চক্ৰায়ুধ নামক একজন নূতন ব্যক্তিকে রাজপদে অভিষিক্ত করিয়াছিলেন।

ধর্ম্মপাল নিরুদ্বেগে এই বিশাল সাম্রাজ্য ভোগ করিতে পারেন নাই। তাঁহার পূর্ধ্বতন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতীহাররাজ বৎসরাজের পুত্র নাগভট শীঘ্রই কতক রাজ্য জয় এবং কতক রাজ্যের সহিত মিত্ৰতা স্থাপনপূৰ্ব্বক স্বীয় শক্তি বৃদ্ধি করিয়া ধৰ্ম্মপালের বিরুদ্ধে অগ্রসর হইলেন। তিনি প্রথমে চক্ৰায়ুধকে পরাজিত করেন, এবং চক্ৰায়ুধ ধৰ্ম্মপালের শরণাপন্ন হন। অবশেষে ধৰ্ম্মপালের সহিত নাগভটের বিষম যুদ্ধ হয়। প্রতীহাররাজের প্রশস্তি অনুসারে নাগভট এই যুদ্ধে জয়ী হন। কিন্তু অচিরকাল মধ্যেই রাষ্ট্রকূটরাজ ধ্রুবের পুত্র তৃতীয় গোবিন্দ নাটভটের রাজ্য আক্রমণ করিয়া তাঁহাকে সম্পূর্ণরূপে পরাভূত করেন এবং বৎসরাজের ন্যায় নাগভট্টের সাম্রাজ্য স্থাপনের আশাও দূরীভূত হয়।

রাষ্ট্রকূটরাজগণের প্রশস্তি অনুসারে ধর্ম্মপাল ও চক্ৰায়ুধ উভয়ে স্বেচ্ছায় তৃতীয় গোবিন্দের আনুগত্য স্বীকার করেন। ইহা হইতে এরূপ অনুমান করা অসঙ্গত হইবে না যে ধৰ্ম্মপাল ও চক্ৰায়ুধ নাগভটকে দমন করিবার নিমিত্তই রাষ্ট্রকূটরাজের শরণাপন্ন হইয়াছিলেন এবং তাঁহাদের আমন্ত্রণেই তৃতীয় গোবিন্দ নাটভাটের রাজ্য ধ্বংস করিয়াছিলেন। সে যাহাই হইক, পিতার ন্যায় তৃতীয় গোবিন্দও শীঘ্রই দক্ষিণাপথে রহিল না। নাগভট্টের পরাজয় এরূপ গুরুতর হইয়াছিল যে, তিনি এবং তাঁহার পুত্র আর পালরাজগণের বিরুদ্ধে কিছুই করিতে পারিলেন না। সুতরাং ধর্ম্মপালের বিশাল সাম্রাজ্য অটুট রহিল এবং সম্ভবত শেষ বয়সে তিনি শান্তিতে জীবন অতিবাহিত করিয়াছিলেন।

ধর্ম্মপালের বাহুবলে বাংলা দেশে যেরূপ গুরুতর রাজনৈতিক পরিবর্ত্তন হইয়াছিল সচরাচর তাঁহার দৃষ্টান্ত মিলে না। অর্দ্ধশতাব্দী পূর্ব্বে যে দেশ পরপদানত এবং অরাজকতা ও অত্যাচারের লীলাভূমি ছিল সেই দেশ সহসা প্রচণ্ড শক্তিশালী হইয়া সমগ্র আর্য্যাবর্তে নিজের প্রভুত্ব বিস্তার করিবে ইহা অলৌকিক কাহিনীর মতোই অদ্ভুত মনে হয়। এই সাম্রাজ্য বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গেই বাঙ্গালীর নূতন জাতীয় জীবনের সূত্রপাত হয়। ধৰ্ম্ম শিল্প ও সাহিত্যের অভ্যুদয়েই এই জাতীয় জীবন প্রধানত আত্মবিকাশ করিয়াছিল। পালরাজগণের চারিশত বর্ষব্যাপী রাজ্যকাল বাঙ্গালী জাতির আত্মপ্রতিষ্ঠার যুগ। ধর্ম্মপালের রাজ্য বাঙ্গালীর জীবন প্রভাত।

এই নূতন যুগের বাঙ্গালীর আশা-আকাক্ষা কল্পনা ও আদর্শ সমসাময়িক রচনার মধ্য দিয়া কিয়ৎ পরিমাণে প্রতিধ্বনিত হইয়াছে। খালিমপুর তাম্রশাসনে ধর্ম্মপালের ‘পাটলিপুত্ৰনগর-সমাবাসিত-শ্রীমজ্জয়স্কন্ধাবারের’ যে বর্ণনা আছে, তাহাতে নবসাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার গর্বে দৃপ্ত বাঙ্গালীর মানচিত্র ফুটিয়া উঠিয়াছে। অশোকের পুণ্যস্মৃতি বিজড়িত মৌৰ্য্য রাজগণের প্রাচীন রাজধানী পাটলিপুত্রে (বর্ত্তমান পাটনা) ধর্ম্মপাল সাময়িক অথবা স্থায়ীভাবে রাজধানী স্থাপন করিয়াছিলেন। কবি তাঁহার বর্ণনা প্রসঙ্গে লিখিয়াছেন যে এখানে গঙ্গাবক্ষে অসংখ্য বিশাল রণতরীর সমাবেশ সেতুবন্ধ রামেশ্বরের শৈলশিখরশ্রেণী বলিয়া মনে হইত; এখানকার অসংখ্য রণহস্তী দিনশোভাকে স্নান করিয়া নিবিড় মেঘের শোভা সৃষ্টি করিত; উত্তরাপথের বহু সামন্তরাজগণ যে অগণিত অশ্ব উপঢৌকনস্বরূপ পাঠাইয়াছিলেন তাহাদের ক্ষুরোখিত ধূলিজালে এই স্থান চতুর্দিক ধূসরিত হইয়া থাকিত; এবং রাজরাজেশ্বর ধর্ম্মপালের সেবার জন্য সমস্ত জম্বুদ্বীপ (ভারতবর্ষ) হইতে যে সমস্ত রাজগণ এখানে উপস্থিত হইয়াছিলেন তাঁহাদের অনন্ত পদাতিসেনার পদভারে বসুন্ধরা অবনত হইয়া থাকিত। শক্তি, সম্পদ ও ঐশ্বর্য্যের এই বর্ণনার মধ্যে যে আতিশয্য আছে তাহা বাঙ্গালীর তল্কালীন জাতীয় মনোভাবের পরিচায়ক।

এই নূতন জাতীয় জীবনের সৃষ্টিকর্ত্তা ধর্ম্মপালকে বাঙ্গালী কী চক্ষে দেখিত তাহা অনায়াসেই আমরা কল্পনা করিতে পারি। কবি একটিমাত্র শ্লোকে তাঁহার একটু আভাস দিয়াছেন। তিনি লিখিয়াছেন যে সীমান্তদেশে গোপগণ, বনে বনচরগণ, গ্রামসমীপে জনসাধারণ, প্রত্যেক গৃহপ্রাঙ্গণে ক্রীড়ারত শিশুগণ, প্রতি দোকানে ক্রয়বিক্রয়কারীগণ, এমনকি বিলাসগৃহের পিঞ্জরস্থিত শুকগণও সৰ্ব্বদা ধর্ম্মপালের গুণগান করিত; সুতরাং ধর্ম্মপাল সৰ্ব্বত্র এই আত্মম্ভতি শ্রবণ করিতেন এবং লজ্জায় সৰ্ব্বদাই তাঁহার বদনমণ্ডল নত হইয়া থাকিত।

একদিন বাংলার মাঠে-ঘাটে ঘরে-বাহিরে যাহার নাম লোকের মুখে মুখে ফিরিত, তাঁহার কোনো স্মৃতিই আজ বাংলা দেশে নাই। অদৃষ্টের নিদারুণ পরিহাসে বাঙ্গালী তাঁহার নাম পৰ্য্যন্ত ভুলিয়া গিয়াছিল। কয়েকখানি তাম্রশাসন ও শিলালিপি এবং তিব্বতীয় গ্রন্থের সাহায্যে আমরা তাঁহার কীর্তিকলাপের ক্ষীণ প্রতিধ্বনিমাত্র পাইয়াছি, কিন্তু তাঁহার জীবনীর বিশেষ কোনো বিবরণ জানিতে পারি নাই। বাঙ্গালীর দুর্ভাগ্য, বাংলা দেশের দুর্ভাগ্য যে কয়েকটি স্কুল ঘটনা ব্যতীত এই মহাবীর ও মহাপুরুষের ব্যক্তিগত জীবন ও চরিত্র সম্বন্ধে আর কিছুই জানিবার উপায় নাই।

ধর্ম্মপাল রাষ্ট্রকূটরাজ পরবলের কন্যা রন্নাদেবীকে বিবাহ করিয়াছিলেন। এই পরবল কে এবং কোথায় রাজত্ব করিতেন, সে সম্বন্ধে নিশ্চিত কিছুই বলা যায় না। ৮৬১ অব্দে উত্তীর্ণ রাষ্ট্রকূটবংশীয় পরবল নামক রাজার একখানি শিলালিপি মধ্যভারতে পাওয়া গিয়াছে। কেহ কেহ মনে করেন যে ইনিই রন্নাদেবীর পিতা। কিন্তু ঐ তারিখের অর্দ্ধশতাব্দী পূর্ব্বেই দীর্ঘকাল রাজত্বের পর ধর্ম্মপালের মৃত্যু হয়। সুতরাং একেবারে সম্ভব না হইলেও ধর্ম্মপালের সহিত উক্ত পরবলের কন্যার বিবাহ খুব অস্বাভাবিক ঘটনা বলিয়াই গ্রহণ করিতে হইবে। রন্নাদেবী দাক্ষিণাত্যের প্রসিদ্ধ রাষ্ট্রকূটবংশের কোনো রাজকন্যা ছিলেন এই মতটিই অধিকতর বিশ্বাসযোগ্য বলিয়া মনে হয়।

ধর্ম্মপালের কনিষ্ঠ ভ্রাতা বাপাল অনেক যুদ্ধে তাঁহার সেনাপতি ছিলেন এবং গর্গ নামে এক ব্রাহ্মণ তাঁহার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। বাপাল ও গর্গের বংশধরগণের লিপিতে এই দুইজনের কৃতিত্ব বিশদভাবে বর্ণিত হইয়াছে এবং প্রধানত তাঁহাদের সাহায্যেই যে ধর্ম্মপালসাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠায় সফলকাম হইয়াছিলেন এরূপ স্পষ্ট ইঙ্গিতও আছে। এই উক্তির মধ্যে কিছু সত্য থাকিলেও ইহা যে অতিরঞ্জন সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নাই।

পিতার ন্যায় ধর্ম্মপালও বৌদ্ধ ছিলেন। তিব্বতদেশীয় গ্রন্থে ধর্ম্মপালের অনেক কীর্তিকলাপের উল্লেখ আছে। মগদে তিনি একটি বিহার বা বৌদ্ধমঠ নির্মাণ করেন। তাঁহার বিক্রমশীল এই দ্বিতীয় নাম বা উপাধি অনুসারে ইহা ‘বিক্রমশীলবিহার’ নামে অভিহিত হয়। নালন্দার ন্যায় বিক্রমশীল বিহারও ভারতের সৰ্ব্বত্র ও ভারতের বাহিরে প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছিল। গঙ্গাতটে এক শৈলশিখরে অবস্থিত এই বিহারে একটি প্রধান মন্দির এবং তাঁহার চারিদিকে ১০৭টি ছোট মন্দির ছিল। এটি একটি উচ্চ শিক্ষাকেন্দ্র ছিল এবং ১১৪ জন শিক্ষক এখানে নানা বিষয় অধ্যাপনা করিতেন। তিব্বতের বহু বৌদ্ধ ভিক্ষু এখানে অধ্যয়ন করিতে আসিতেন এবং এখানকার অনেক প্রসিদ্ধ বৌদ্ধ আচাৰ্য্য তিব্বতে বিশুদ্ধ বৌদ্ধধর্ম্ম প্রচার করিয়াছেন। বরেন্দ্র ভূমিতে সোমপুর নামক স্থানে ধৰ্ম্মপাল আর একটি বিহার প্রতিষ্ঠা করেন। রাজসাহী জিলার অন্তর্গত পাহাড়পুর নামক স্থানে ইহার বিরাট ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হইয়াছে। এত বড় বৌদ্ধবিহার ভারতবর্ষের আর কোথাও ছিল বলিয়া জানা যায় নাই। যে সুবিস্তৃত অঙ্গনের চতুর্দিক ঘিরিয়া এই বিহারটি ছিল, তাঁহার মধ্যস্থলে এক বিশাল মন্দিরের ভগ্নাবশেষ পাওয়া গিয়াছে। এই প্রকার গঠনরীতি ভারতবর্ষের আর কোনো মন্দিরে দেখা যায় না। শিল্প-শীর্ষক অধ্যায়ে এই মন্দির ও বিহারের বর্ণনা করা যাইবে। পাহাড়পুরের নিকটবর্ত্তী ওমপুর গ্রাম এখনো প্রাচীন সোমপুরের স্মৃতি রক্ষা করিয়া আসিতেছে। ওদন্ত পুরেও (বিহার) ধর্ম্মপাল সম্ভবত একটি বিহার নির্মাণ করিয়াছিলেন। তিব্বতীয় লেখক তারনাথের মতে ধৰ্ম্মপাল ধৰ্ম্মশিক্ষার জন্য ৫০টি শিক্ষাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন।

ধর্ম্মপাল নিজে বৌদ্ধ হইলেও হিন্দুধর্ম্মের প্রতি তাঁহার কোনো বিদ্বেষ ছিল না। নারায়ণের এক মন্দিরের জন্য তিনি নিষ্কর ভূমি দান করিয়াছিলেন। তিনি শাস্ত্রানুশাসন মানিয়া চলিতেন এবং প্রতি বর্ণের লোক যাহাতে স্বধর্ম্ম প্রতিপালন করে তাঁহার ব্যবস্থা করিতেন। তাঁহার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন একজন ব্রাহ্মণ এবং ইঁহার বংশধররা বহুপুরুষ পৰ্য্যন্ত বৌদ্ধ পালরাজগণের প্রধানমন্ত্রীর পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। সেকালে যে রাজার ব্যক্তিগত ধর্ম্মবিশ্বাসের সহিত রাজ্যশাসন ব্যাপারের কোনো সম্বন্ধ ছিল না এই দৃষ্টান্ত হইতে তাহা সহজেই অনুমান করা যাইতে পারে।

খালিমপুর তাম্রশাসন ধৰ্ম্মপালের বিজয়রাজ্যের ৩২ সম্বৎসরে লিখিত। ইহার পর ধর্ম্মপাল আর কত বৎসর রাজত্ব করিয়াছিলেন, তাহা নিশ্চিত জানা যায় না। তারনাথের মতে ধর্ম্মপালের রাজ্যকাল ৬৪ বৎসর-কিন্তু ইহার সমর্থক কোনো প্রমাণ নাই।

ধর্ম্মপালের মৃত্যুর পর রন্নাদেবীর গর্ভজাত তাঁহার পুত্র দেবপাল সিংহাসনে আরোহণ করেন। ধর্ম্মপালের খালিমপুর তাম্রশাসনে কিন্তু যুবরাজ ত্রিভুবন পালের উল্লেখ পাওয়া যায়। এই যুবরাজ ত্রিভুবনপালই দেবপাল নামে রাজা হন অথবা জ্যেষ্ঠভ্রাতা ত্রিভুবনপালের মৃত্যুতে কনিষ্ঠ দেবপাল পিতৃসিংহাসনে আরোহণ করেন তাহা নিশ্চিত বলা যায় না। এই শেষোক্ত অনুমানই সত্য বলিয়া মনে হয়। কারণ খালিমপুর তাম্রশাসনে রাজপুত্র দেবটেরও উল্লেখ আছে এবং অসম্ভব নহে যে ইহা দেবপাল নামের অপভ্রংশ। অবশ্য ত্রিভুবনপাল জীবিত থাকিলেও কনিষ্ঠ দেবপাল সিংহাসন অধিকার করিয়া থাকিতে পারেন। কিন্তু এ সকলই অনুমান মাত্র।

.

৩. দেবপাল (আ ৮১০-৮৫০)

পরমেশ্বর পরমভট্টারক মহারাজাধিরাজ দেবপাল পিতার উপযুক্ত পুত্র ছিলেন এবং পিতৃসাম্রাজ্য অক্ষুণ্ণ রাখিতে সমর্থ হইয়াছিলেন। তিনি অনেক যুদ্ধে লিপ্ত হইয়াছিলেন এবং নূতন নূতন রাজ্য জয় করিয়াছিলেন। তাঁহার তাম্রশাসনে উক্ত হইয়াছে যে তাঁহার বিজয়বাহিনী দক্ষিণে বিন্ধ্যপর্বত ও পশ্চিমে কাম্বোজ দেশ অর্থাৎ কাশ্মীরের সীমান্ত পৰ্য্যন্ত অগ্রসর হইয়াছিল। তাঁহার সেনাপতি ও মন্ত্রীগণের বংশধরদের লিপিতে বিজিত রাজ্যের তালিকা পাওয়া যায়। পিতৃব্য বাকপালের পুত্র জয়পাল তাঁহার সেনাপতি ছিলেন। জয়পালের বংশধর নারায়ণপালের তাম্রশাসনে উক্ত হইয়াছে যে জয়পাল দিগ্বিজয়ে অগ্রসর হইলে উল্কলের রাজা দূর হইতে তাঁহার নামমাত্র শ্রবণ করিয়াই অবসন্ন হইয়া নিজের রাজধানী পরিত্যাগ করিয়াছিলেন। প্রাগজ্যোতিষের (আসাম) রাজা জয়পালের আজ্ঞায় যুদ্ধোদ্যম ত্যাগ করিয়া পালরাজের বশ্যতা স্বীকার করিয়াছিলেন। ধর্ম্মপালের মন্ত্রী গর্গের পুত্র দর্ভপাণি এবং প্রপৌত্র কেদারমিশ্র উভয়েই দেবপালের রাজ্যকালে প্রধানমন্ত্রীর পদ অলঙ্কৃত করিয়াছিলেন। কেদারমিশ্রের পুত্র গুরবমিশ্রের লিপিতে উক্ত হইয়াছে যে দর্ভপাণির নীতিকৌশলে দেবপাল হিমালয় হইতে বিন্ধ্যপর্বত এবং পূর্ব্ব ও পশ্চিম সমুদ্রের মধ্যবর্ত্তী সমগ্র ভূভাগ করপ্রদ করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন। এই লিপিতে আরও উক্ত হইয়াছে যে মন্ত্রী কেদারমিশ্রের বুদ্ধিবলের উপাসনা করিয়া গৌড়েশ্বর দেবপালদেব উৎকলকুল ধ্বংস, হূণগৰ্ব খৰ্ব্ব এবং দ্রবিড় ও গুজ্জরনাথের দর্প চূর্ণ করিয়া দীর্ঘকাল পর্য্যন্ত আসমুদ্র পৃথিবী উপভোগ করিয়াছিলেন।

উল্লিখিত লিপি দুইখানির মতে দেবপালের রাজত্বের যত কিছু গৌরব ও কৃতিত্ব তাহা কেবল মন্ত্রীদ্বয় ও সেনাপতিরই প্রাপ্য। গুরবমিশ্রের লিপিতে ইহাও বলা হইয়াছে যে অগণিত রাজন্যবর্গের প্রভু সম্রাট দেবপাল (উপদেশ গ্রহণের জন্য স্বয়ং) দৰ্ভপাণির অবসরের অপেক্ষায় তাঁহার দ্বারদেশে দাঁড়াইয়া থাকিতেন এবং রাজসভার আগে এই মন্ত্রীবরকে মূল্যবান আসন দিয়া নিজে ভয়ে ভয়ে সিংহাসনে বসিতেন।

যখন এই সমুদয় উক্তি লিখিত হয় তখন পালবংশের বড়ই দুর্দিন। সুতরাং তখনকার হতমান দুৰ্বলচিত্ত পালরাজের পক্ষে এই প্রকার আচরণ সম্ভবপর হইলেও ধর্ম্মপালের পুত্র আর্য্যাবর্তের অধীশ্বর দেবপালদেবের সম্বন্ধে ইহা বিশ্বাস করা কঠিন। এই সমুদয় অত্যুক্তির মধ্যে কী পরিমাণ সত্য নিহিত আছে তাঁহার অনুসন্ধান নিষ্প্রয়োজন। কারণ দেবপালের রাজ্যকাল বাংলার সাম্রাজ্য বিস্তারই ইতিহাসের মুখ্য ঘটনা, তাহা কী পরিমাণে সেনাপতির বাহুবলে অথবা মন্ত্রীর বুদ্ধিকৌশলে হইয়াছিল এই বিচার অপেক্ষাকৃত গৌণ বিষয়।

উপরে বিজিত রাজগণের যে বিবরণ দেওয়া হইয়াছে তাহা হইতে সহজেই বুঝা যায় যে, দেবপাল উড়িষ্যা ও আসাম বাংলার এই দুই সীমান্ত প্রদেশ জয় করেন। আসামের রাজা বিনাযুদ্ধে বশ্যতা স্বীকার করিয়া সামন্ত রাজার ন্যায় রাজত্ব করিতেন। কিন্তু উড়িষ্যার রাজাকে দূরীভূত করিয়া উড়িষ্যা সম্ভবত পালরাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করা হইয়াছিল। উকলাধীশের রাজধানী পরিত্যাগ এবং ‘উকীলিতোকলকুল’ এই প্রকার পদপ্রয়োগ এই সিদ্ধান্তের সমর্থন করে। উড়িষ্যার ভঞ্জ রাজবংশের লিপি হইতে জানা যায় যে, রণভঞ্জের পর এই বংশীয় রাজগণ প্রাচীন খিঞ্জলী রাজ্য ও রাজধানী ত্যাগ করিয়া উড়িষ্যার দক্ষিণ সীমান্তে গঞ্জাম জিলায় আশ্রয় লইতে বাধ্য হইয়াছিলেন। রণভঞ্জ সম্ভবত নবম শতাব্দের প্রথম ভাগ পর্য্যন্ত রাজত্ব করেন। সুতরাং খুব সম্ভব যে এই বংশীয় রাজাকে দূর করিয়াই দেবপাল উড়িষ্যা, অন্তত তাঁহার অধিকাংশ ভাগ, অধিকার করেন।

দেবপাল যে হৃণজাতির গৰ্ব্ব খৰ্ব্ব করেন তাহাদের রাজ্য কোথায় ছিল তাহা নিশ্চিত বলা যায় না। ষষ্ঠ শতাব্দীর প্রারম্ভে হূণজাতি আৰ্য্যাবৰ্ত্তের পশ্চিম ভাগে বিস্তৃত রাজ্য স্থাপন করিয়াছিল। কিন্তু তাহারা ক্রমশ হীনবল হইয়া পড়ে এবং বিভিন্ন স্থানে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্য স্থাপন করে। হর্ষচরিত পাঠে জানা যায় যে, উত্তরাপথে হিমালয়ে নিকটে হূণদের একটি রাজ্য ছিল। সম্ভবত দেবপাল এই রাজ্য জয় করিয়া কাম্বোজ পৰ্য্যন্ত অগ্রসর হইয়াছিলেন। কাম্বোজ পঞ্চনদের উত্তর পশ্চিমে ও গন্ধারের ঠিক উত্তরে এবং হূণরাজ্যের ন্যায় পালসাম্রাজ্যের সীমান্তে অবস্থিত ছিল। সুতরাং এই দুই রাজ্যের সহিত দেবপালের বিরোধ খুবই স্বাভাবিক। এখানে বলা আবশ্যক যে মালব প্রদেশেও একটি হূণরাজ্য ছিল।

দেবপাল যে গুজ্জর রাজার দর্প চূর্ণ করিয়াছিলেন তিনি সম্ভবত নাগভট্টের পৌত্র প্রথম ভোজ। রাষ্ট্রকূটরাজ তৃতীয় গোবিন্দের হস্তে নিদারুণ পরাজয়ের পর প্রতীহাররাজ নাগভট ও তাঁহার পুত্র রামভদ্রের শক্তি অতিশয় ক্ষীণ হইয়াছিল। রামভদ্রের রাজ্যকালে প্রতীহার রাজ্য শত্রু কর্ত্তৃক বিধ্বস্ত হইয়াছিল এরূপ ইঙ্গিতও এই বংশের লিপিতে পাওয়া যায়। তৎপুত্র ভোজ প্রথমে কিছু সফলতা লাভ করিয়াছিলেন, কারণ তিনি ৮৩৬ অব্দে কনৌজ ও কালঞ্জরের আধিপত্য লাভ করিয়াছিলেন, কিন্তু তিনি ৮৬৭ অব্দের পূর্ব্বে রাষ্ট্রকূটরাজ কর্ত্তৃক পরাজিত এবং ৮৬৯ অব্দের পূর্ব্বে স্বীয় রাজ্য গুজ্জরা (বর্ত্তমান রাজপুতনা) হইতে বিতাড়িত হন। সম্ভবত ৮৪০ হইতে ৮৬০ অব্দের মধ্যে দেবপাল তাঁহাকে পরাজিত করেন।

এইরূপে দেখিতে পাই যে, ধর্ম্মপাল যে সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন দেবপাল তাঁহার সীমান্তস্থিত কামরূপ, উল্কল, হূণদেশ ও কামোজ জয় করেন এবং চিরশত্রু প্রতীহাররাজকে পরাজিত করেন। সুতরাং প্রশস্তিকার যে তাঁহার রাজ্য হিমালয় হইতে বিন্ধ্যপর্বত এবং পূর্ব্ব হইতে পশ্চিম সমুদ্র পর্য্যন্ত বিস্তৃত বলিয়া বর্ণনা করিয়াছেন তাহা মোটামুটিভাবে সত্য বলিয়া গ্রহণ করা যায়।

মুঙ্গেরে প্রাপ্ত দেবপালের তাম্রশাসনে তাঁহার সাম্রাজ্য হিমালয় হইতে রামেশ্বর সেতুবন্ধ পৰ্য্যন্ত বিস্তৃত ছিল বলিয়া বর্ণিত হইয়াছে। ইহা অতিরঞ্জিত এবং নিছক কবিকল্পনা বলিয়াই সকলে গ্রহণ করিয়াছেন। কিন্তু ইহার মূলে কিছু সত্য থাকিতে পারে। দেবপাল যে দ্রবিড়নাথের দর্প চূর্ণ করিয়াছিলেন ঐতিহাসিকেরা তাঁহাকে দাক্ষিণাত্যের রাষ্ট্রকূটরাজ বলিয়াই গ্রহ করিয়াছেন। প্রতীহার রাজার ন্যায় রাষ্ট্রকূট রাজার সহিতও পালরাজগণের বংশানুক্রমিক শত্রুতা ছিল, সুতরাং দেবপাল কোনো রাষ্ট্রকূটরাজাকে পরাভূত করিয়া থাকিবেন ইহা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু দ্রবিড় বলিতে সাধারণত দাক্ষিণাত্য বুঝায় না, ইহা দক্ষিণ ভারত অর্থাৎ কৃষ্ণা নদীর দক্ষিণস্থিত ভূভাগের নাম। এই সুদূর দেশে যে দেবপাল যুদ্ধে লিপ্ত হইয়াছিলেন ইহার সপক্ষে কোনো প্রমাণ না থাকাতেই পণ্ডিতগণ তাঁহার প্রতিদ্বন্দ্বী দ্রবিড়নাথ ও রাষ্ট্রকূটরাজকে অভিন্ন বলিয়া গ্রহণ করিয়াছেন। কিন্তু দক্ষিণ ভারতের কয়েকখানি লিপি হইতে জানা যায় যে, মগধ, কলিঙ্গ, চোল, পল্লব ও গঙ্গ প্রভৃতি রাজ্য মিলিত হইয়া পাণ্ড্যরাজের সহিত যুদ্ধ করে। কুম্বকোন নামক স্থানে পাণ্ড্যরাজ শ্রীমার শ্রীবল্লভ ইহাদের পরাস্ত করেন। শ্রীমার শ্রীবল্লভের রাজ্যকাল ৮৫১ হইতে ৮৬২ অব্দ। ইহার অব্যবহিত পূর্ব্বে দেবপাল যে মগধের রাজা ছিলেন সে সম্বন্ধে কোনো সন্দেহ নাই; এবং উত্তাল জয় করার পর যে তিনি কলিঙ্গ প্রভৃতি দেশের সঙ্গে রাজনৈতিক সম্বন্ধে আবদ্ধ হইয়া থাকিবেন ইহাও খুব স্বাভাবিক। সুতরাং অসম্ভব নহে যে উল্লিখিত মিলিত শক্তির সহিত দেবপাল পাণ্ড্যরাজ্যে অবস্থিত। সুতরাং দেবপালের সভাপতি হয়তো এই সমরবিজয় উপলক্ষ করিয়া দেবপালের রাজ্য রামেশ্বর সেতুবন্ধ পর্য্যন্ত বিস্তৃত বলিয়া বর্ণনা করিয়াছেন।

দেবপাল অন্তত ৩৫ বৎসর রাজত্ব করিয়াছিলেন। তাঁহার রাজ্যকাল ৮১০ হইতে ৮৫০ অব্দ অনুমান করা যাইতে পারে। তাঁহার সময়ে পালসাম্রাজ্য গৌরবের চরম শিখরে আরোহণ করিয়াছিল। তাঁহার রাজত্বকালে বাঙ্গালী সৈন্য ব্রহ্মপুত্র হইতে সিন্ধু নদের তীরে এবং সম্ভবত দক্ষিণ ভারতের প্রায় শেষ প্রান্ত পৰ্য্যন্ত বিজয়াভিযান করিয়াছিল। প্রায় সমগ্র আর্য্যাবর্ত্ত তাঁহাকে অধীশ্বর বলিয়া স্বীকার করিত। ভারতবর্ষের বাহিরেও তাঁহার খ্যাতি ও প্রতিপত্তি হইয়াছিল। যবদ্বীপ, সুমাত্রা ও মলয় উপদ্বীপের অধিপতি শৈলেন্দ্রবংশীয় মহারাজ বালপুত্রদেব তাঁহার নিকট দূত প্রেরণ করেন। শৈলেন্দ্ররাজ প্রসিদ্ধ নালন্দাবিহারে একটি মঠ প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন এবং ইহার ব্যয় নির্বাহের জন্য পাঁচটি গ্রাম প্রার্থনা করেন। তদনুসারে দেবপাল তাঁহাকে পাঁচটি গ্রাম দান করেন। নালন্দা তখন সমগ্র এশিয়ার মধ্যে বৌদ্ধধর্ম্মের প্রধান কেন্দ্র হইয়া উঠিয়াছিল এবং পালরাজগণও বৌদ্ধধর্ম্মের পৃষ্ঠপোষকরূপে ভারতের বাহিরে সর্বত্র বৌদ্ধগণের নিকট সুপরিচিত ও সম্মানিত ছিলেন। দেবপাল যে নালন্দাবিহারের সহিত ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত ছিলেন অন্য একখানি শিলালিপিতে তাঁহার কিছু আভাস আছে। ইহা হইতে আমরা জানিতে পারি যে নগরহার (বর্ত্তমান জালালাবাদ) নিবাসী ব্রাহ্মণবংশীয় ইন্দ্রগুপ্তের পুত্র বীরদেব “দেবপাল নামক ভুবনাধিপতির নিকট পূজাপ্রাপ্ত” এবং “নালন্দার পরিপালনভার প্রাপ্ত হইয়াছিলেন।”

৮৫১ অব্দে আরবী ভাষায় লিখিত একখানি গ্রন্থ হইতে জানা যায় যে, তৎকালে ভারতে তিনটি প্রধান রাজ্য ছিল। ইহাদের মধ্যে দুইটি যে রাষ্ট্রকূট ও গুর্জর প্রতীহার তাহা বেশ বুঝা যায়। তৃতীয়টি রুগি অথবা রহ্ম। এই নামের অর্থ বা উৎপত্তি যাহাই হউক ইহা যে পালরাজ্যকে সূচিত করে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নাই। উল্লিখিত গ্রন্থ অনুসারে রক্ষ দেশের রাজা প্রতিবেশী গুর্জর ও রাষ্ট্রকূটরাজার সহিত সৰ্ব্বদাই যুদ্ধে লিপ্ত থাকিতেন। কিন্তু তাঁহার সৈন্য শত্রুসৈন্য অপেক্ষা সংখ্যায় অধিক ছিল। যুদ্ধ যাত্রাকালে ৫০,০০০ রণহস্তী এবং সৈন্যগণের বস্ত্রাদি ধৌত করিবার জন্যই দশ-পনেরো হাজার অনুচর তাঁহার সঙ্গে থাকিত। এই বর্ণনা সম্ভবত দেবপাল সম্বন্ধে প্রযোজ্য।

সোড্‌ঢল প্রণীত উদয়সুন্দরীকথা নামক কাব্য হইতে জানা যায় যে, অভিনন্দ পালরাজ যুবরাজের সভাপতি ছিলেন। অভিনন্দ প্রণীত রামচরিত কাব্যে যুবরাজের আরও কিছু পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি ধর্ম্মপালের বংশে জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন এবং “পালকুলচন্দ্র” এবং “পালকুল প্রদীপ” প্রভৃতি আখ্যায় বিভূষিত হইয়াছেন। তাঁহার উপাধি ছিল হারবর্ষ এবং পিতার নাম বিক্রমশীল। তিনি অনেক রাজ্য জয় করিয়াছিলেন।

যুজরাজ হারবর্ষ যে পালবংশীয় রাজা ছিলেন সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নাই। বিক্রমশীল ও ধর্ম্মপালেরই নামান্তর তাহাতেও সন্দেহ করিবার বিশেষ কারণ নাই-কারণ তাঁহার প্রতিষ্ঠিত বিহার শ্রীমদ্-বিক্রমশীল-দেব-মহাবিহার নামে অভিহিত হইয়াছে। সুতরাং যুবরাজ হারবর্ষ ধর্ম্মপালের পুত্র ছিলেন এইরূপ অনুমান করা যাইতে পারে। কিন্তু হারবর্ষ যুবরাজ দেবপালেরই নামান্তর অথবা তাঁহার ভ্রাতা এ সম্বন্ধে নিশ্চিত কিছু বলা যায় না।

ধর্ম্মপাল ও দেবপালের রাজ্যকালে বাংলার শক্তি ও সমৃদ্ধি কিরূপ বাড়িয়াছিল তাহা সহজেই অনুমান করা যাইতে পারে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই যে, তিব্বতদেশীয় গ্রন্থে বর্ণিত হইয়াছে যে ধর্ম্মপাল তিব্বতের রাজা খ্রী স্রং-দে-বৎ সনের (৭৫৫-৭৯৭ অব্দ) বশ্যতা স্বীকার করেন এবং তিব্বতীয় রাজা র-প-চন্ (৮১৭-৮৩৬) গঙ্গাসাগর পর্য্যন্ত জয় করেন। এই প্রকার দাবীর মূলে কত দূর সত্য নিহিত আছে তাহা জানিবার উপায় নাই কারণ ভারতীয় কোনো গ্রন্থ বা লিপিতে উক্ত তিব্বতীয় অভিযানের কোনো উল্লেখ নাই। তবে এরূপ অভিযান অসম্ভব নহে এবং সম্ভবত মাঝে মাঝে ইহার ফলে পালরাজগণ বিপন্ন হইতেন। নাগভট কর্ত্তৃক ধর্ম্মপালের পরাজয় এবং প্রথম ভোজের ৮৩৬ অব্দে কনৌজ অধিকার প্রভৃতি ঘটনার সহিত এরূপ কোনো তিব্বতীয় অভিযানের প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষ সম্বন্ধ থাকা বিচিত্র নহে।

অর্দ্ধশতাব্দীর অধিককাল পর্য্যন্ত ধর্ম্মপাল ও দেবপাল আর্য্যাবর্তে বিস্তৃত সাম্রাজ্যের অধীশ্বর ছিলেন। অনেকে মনে করেন যে হর্ষবর্দ্ধনের সাম্রাজ্যই আর্য্যাবর্তের শেষ হিন্দু সাম্রাজ্য কিন্তু পালসাম্রাজ্য যে ইহার অপেক্ষা বিস্তৃত ও অধিককাল স্থায়ী হইয়াছিল সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নাই।

প্রাচীন মৌৰ্য্য ও গুপ্তসাম্রাজ্যের সহিত পালসাম্রাজ্যের প্রকৃতিগত প্রভেদ ছিল। মৌর্য ও গুপ্তসাম্রাজ্যের বিস্তৃত ভূভাগ স্বয়ং সম্রাট অথবা তন্নিযুক্ত শাসনকর্ত্তার অধীনে থাকিত। কিন্তু বাংলা ও বিহার ব্যতীত আৰ্য্যাবর্তের অপর কোনো প্রদেশ যে পালরাজগণের বা তাহাদের কর্ম্মচারীর শাসনাধীন ছিল এরূপ প্রমাণ পাওয়া যায় নাই। পরাজিত রাজগণ পালরাজগণের অধীনতা ও কোনো কোনো স্থলে করদান করিতে স্বীকার করিলেই সম্ভবত তাঁহারা বিনা বাধায় স্বীয় রাজ্য শাসন করিতে পারিতেন। তাঁহারা পালরাজগণকে উপঢৌকন পাঠাইতেন, মাঝে মাঝে তাঁহাদের সভায় উপস্থিত থাকিতেন এবং সম্ভবত প্রয়োজন হইলে সৈন্য দিয়া সাহায্য করিতেন। কিন্তু ইহার অতিরিক্ত আর কোনো প্রকার দায়িত্ব সম্ভবত তাঁহাদের ছিল না। এ সম্বন্ধে এ পর্য্যন্ত যে প্রমাণ পাওয়া গিয়াছে তাহা এতই স্বল্প যে নিশ্চিত কোনো প্রকার সিদ্ধান্ত করা কঠিন; তবে হর্ষবর্দ্ধনের সাম্রাজ্য যে এ বিষয়ে পালসাম্রাজ্যের অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ ছিল এবং সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অংশে ধর্ম্মপাল বা দেবপাল অপেক্ষা সাক্ষাৎ সম্বন্ধে তাঁহার অধিকতর শক্তি বা ক্ষমতা ছিল এরূপ মনে করিবার কোনোই কারণ নাই।

বাঙ্গালীর বাহুবলে আর্য্যাবর্তে বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠাই ধৰ্ম্মপাল ও দেবপালের রাজ্যের প্রধান ঐতিহাসিক ঘটনা। বাঙ্গালীর জাতীয় ইতিহাসে ইহার অনুরূপ শক্তি বা সমৃদ্ধির পরিচয় ইহার পূর্ব্বে বা পরে আর কখনো পাওয়া যায় নাই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *