1 of 2

৩.০৩ মনুষ্যেতর প্রাণী মোহিত করণ

তৃতীয় পাঠ
মনুষ্যেতর প্রাণী মোহিত করণ

মনুষ্যেতর প্রাণী-পশু, পক্ষী, সরীসৃপ, মৎস্য ইত্যাদি প্রাণীদিগকে মোহিত করা যায় কিনা, সে সম্বন্ধে বিশেষজ্ঞগণ এক মত নহেন। কেহ বলেন, উহাদিগকে মোহিত করা যায়। আবার কেহ বলেন যে, যথার্থরূপে মোহিত করা যায় না, কেবল মোহিতাবস্থার সহিত সাদৃশ্য বিশিষ্ট একটি অবস্থায় অল্পাধিক সময়ের জন্য উহাদিগকে অভিভূত রাখিতে পারা যায়। বস্তুতঃ মানুষ মোহিত হইয়া যেরূপ অবস্থায় উপনীত হয়, উহাদিগকে মোহিত করিয়া কখনও সেইরূপ অবস্থায় অনিয়ন করা যায় না। উহাদিগকে “মমাহিত করা” অর্থে কেবল “স্তব্ধ করা” বা “হতবুদ্ধি” করাই উপলব্ধি হইয়া থাকে।

দীর্ঘকাল ব্যাপী নানা প্রকার পরীক্ষার পর, বিশেষজ্ঞগণ নিম্নোক্ত প্রাণী দিগকে সংবেদ্য বলিয়া স্থির করিয়াছেন। যথা—বানর, ঘোড়া, নেড়া বাঘ, খরগোস, কাঠ বিড়াল, ইন্দুর, কুকুর, বিড়াল, হাঁস, রাজহাঁস, তোতা, কবুতর, ঘুঘু, মুরগী, কুমীর, টিকটিকি, সাপ, ব্যাঙ ইত্যাদি। এতদ্ব্যতীত ইয়ুরোপ ও আমেরিকার নানা প্রকার পাখী এবং মৎস্য প্রভৃতি। এই সকল প্রাণীদিগের মধ্যে কতকগুলিকে মোহিত করার প্রণালী নিম্নে প্রদত্ত হইল।

(১) কবুতর মোহিত করণ একটা কবুতরের ঠোটের উপর খানিকটা সাদা পুটিন, (যতক্ষণ না পাখীটা উহা দেখিতে পায়, ততক্ষণ) স্থিরভাবে ধরিয়া রাখিবে। কিছুক্ষণ পরে মনুষ্যের চক্ষের ন্যায় উহার চক্ষু বুজিয়া যাইবে এবং পাখীটা মোহিত হইয়া পড়িবে। উত্তাবস্থায় উহার শরীর শক্ত করিয়া দেওয়া ব্যতীত অন্য কিছুই করা যায় না। উহার মাথার উপর রুমাল দ্বারা বাতাস কিম্বা ফু দিলেই মোহিতাবস্থা বিদূরিত হইয়া থাকে।

(২) মুরগী, হাঁস, রাজহাঁস ইত্যাদি মোহিত করণ

একটা মুরগীকে টেবিলের উপর রাখিয়া তর্জনী দ্বারা উহার মাথা হইতে ঠোট পর্যন্ত কয়েকবার পাস দিবে। তৎপর একটা দড়ি দ্বারা উহার ঠ্যাং দুইটা বাঁধিয় ঘরের মেঝেতে শায়িত করতঃ, ঠোট হইতে কিছু দূর পর্যন্ত ঘরের মেঝেতে সুস্পষ্টরূপে চ দ্বারা একটা রেখা আঁকিবে। এরূপ করার কয়েক মিনিট পরেই পাখীটা সম্পূর্ণরূপে শিথিল ও অবসন্ন হইয়া পড়িবে। তখন উহার পায়ের বাধন খুলিয়া দিয়া মাথা পাখার নীচে রাখিলে কিম্বা উহাকে অন্য কোন অবস্থায় রাখিলে বা ঠেলা দিলে, সেই অবস্থাতেই উহা জড়ের ন্যায় পড়িয়া থাকিবে এবং নড়া-চড়া করিবার কিছু মাত্র চেষ্টা পাইবেনা। কবুতর জাগ্রত করার ন্যায় উহাকে জাগাইবে।

(৩) কুকুর, বিড়াল, ছাগল, খরগোস ইত্যাদি

মোহিত করণ কুকুর, বিড়াল, ছাগল, খরগোস ইত্যাদি জন্তুদিগের পিঠের উপর (মাথা হইতে লেজ পর্যন্ত) সৰ্ব্বদা হাত বুলাইয়া দিলে, কিম্বা আস্তে আস্তে চাপরাইলে উহারা স্বভাবতঃই, যে উহা করে, তাহার বশ্যতা স্বীকার করিয়া থাকে। উহাদের কাহাকেও মোহিত করিতে উহার মাথা হইতে চক্ষের উপর দিয়া নাকের অগ্রভাগ পর্যন্ত আস্তে আস্তে কিছুক্ষণ পাস দিবে। যদি উহা চঞ্চলতা প্রকাশ করে, কিম্বা উহার শরীর ঝাপিয়া উঠে, তবে সে মোহিত হইবে বলিয়া বুঝিবে। উহার চোখ দুটি আঙ্গুলের সাহায্যে বন্ধ করিতে চেষ্টা না পাইয়া, উহাদিগকে আপনা হইতে বন্ধ হইতে দিবে। উক্তরূপে কিছুক্ষণ পাস ও মানসিক আদেশ প্রদান করিলে উহার চক্ষু স্বতঃই বন্ধ হইয়া যাইবে। কুকুরদিগকে মোহিত করিতে কেবল পাসের উপর নির্ভর না করিয়া মোহিনী দৃষ্টির সহায়তা গ্রহণ করিবে, কারণ উহারা সময় সময় পাসের দ্বারা মোহিত করিবার শক্তির গতি রোধ করিয়া থাকে। সুতরাং উক্ত স্থলে মোহিনী দৃষ্টির সাহায্যই অধিক গ্রহণ করিবে।

(৪) ব্যাঙ, টিকটিকি ইত্যাদি মোহিত করণ

এই শ্রেণীর প্রাণীদিগকে চিৎভাবে মাটিতে ফেলিয়া রাখিয়া, দুইগাছ। মোটা দ্বারা উহাদের সামনের পা দুইটা বাঁধিবে। পরে ঐ সূতা দুই গাছকে মাটিতে পোতা দুইটা খুঁটির সহিত এমন ভাবে বাঁধিবে, যেন বেশী নড়া-চড়া করিতে না পারে। যতক্ষণ চঞ্চলতা প্রকাশ করিবে, ততক্ষণ এই অবস্থায়ই রাখিবে। পরে খুটির বাঁধন খুলিয়া দিয়া আস্তে আস্তে নাড়া-চাড়া করিলেও, উহারা সম্পূর্ণ উদাসীনের ন্যায় উত্তাবস্থায়ই কিছুক্ষণ পড়িয়া থাকিবে।

দুষ্ট ঘোড়া বশীভূত করণ

সম্মোহনবিৎ নির্ভয়ে ও দ্রুতপদে আস্তাবলে প্রবেশ করিয়া অশ্বের নিকটবর্তী হইবে। যদি তাহাকে দেখিয়া উহা গর্জন করে, কিম্বা কামড়াইতে আসে, তবে সে তাহাতে ভয় পাইবে না। সে উহার সম্মুখে দাঁড়াইয়া ক্ষিপ্ৰকারিতার সহিত দক্ষিণ হাত দ্বারা উহার মাথার, সম্মুখস্থ কেশগুচ্ছ ধরিয়া ফেলিবে, এবং বাম বৃদ্ধাঙ্গুলি ও তর্জনী উহার নাসারন্ধ,দয়ে প্রবেশ করাইয়া দিয়া বিচ্ছিন্নকারী পরদাটাকে (যে পরদাটা ছিদ্র করিয়া বলদের নাকে দড়ি বাঁধে) শক্তরূপে ধরিয়া রাখিবে। তৎপরে বলের সহিত উহার মাথা নীচের দিকে টানিয়া ধরিয়া ৫৬ মিনিটকাল জোরের সহিত অথচ ধীরে ধীরে উহার কাণের মধ্যে ফু দিবে। কিছুক্ষণ এরূপ করিলে সে আর লাফ-ঝাপ দিবে না এবং কামড়াইতেও আসিবে না; পক্ষান্তরে উহার মাথা হইতে পা পর্যন্ত কঁপিতে থাকিবে। এখন উহাকে কাঁধের উপর শান্তভাবে ২৩টি চাপড় দিবে এবং দৃঢ় স্বরে অথচ সদয়ভাবে—যেমন মানুষের সহিত কথা বলা যায়, সেইরূপে উহাকে শান্ত। ও বাধ্য হইতে বলিবে। তৎপরে, বাম হাত দ্বারা নাকের ধৃত পরদাটা ছাড়িয়া না দিয়া, ডান হাত দ্বারা মাথার উপর হইতে আরম্ভ করিয়া, পিঠের উপর দিয়া যতদূর হাতে পাওয়া যায়, ততদূর পর্যন্ত কতকগুলি পাস দিবে। যদি উহা সম্মোহনবিদের হাত হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া যাইতে, কিম্বা লাফ-ঝাপ দিতে বা লাথি মারিতে চেষ্টা করে, তবে। সে ডান হাত দ্বারা খুব জোরের সহিত উহার কেশগুচ্ছ বা একটা কাণ ধরিয়া ফেলিবে এবং পুনর্বার মাথাটা নীচের দিকে টানিয়া আনিয়া উক্ত প্রক্রিয়ার পুনরাবৃত্তি করিবে। উহা শান্ত হওয়া মাত্র আবার পাস দিবে ও কাধ চাপড়াইবে কিম্বা মাথার উপর হইতে আরম্ভ করিয়া নাসারন্ধু, পৰ্যন্ত পাসও দেওয়া যাইতে পারে। যে পর্যন্ত জন্তুটা সম্মোহনধিদের বশীভূত না হয়, অর্থাৎ বাধ্যতার সহিত তাহার হুকুম পালন না করে, ততক্ষণ পর্যন্ত উক্ত ফু দেওয়া প্রক্রিয়াটির পুনরাবৃত্তি করিবে। তৎপরে উহাকে আস্তাবলের মধ্যে দুই-একবার এদিক-ওদিক চালাইবার পর, বাহির্মে লইয়া গিয়া তাহার উপর চড়িবে, তজ্জন্ত লম্বা জিন ও চাবুক ব্যবহার করিবে। এখন তাহাকে হটিতে বা দৌড়াইতে দিবে এবং যখন উহার শরীরে ঘাম দেখা দিবে, তথন উহাকে আস্তাবলে লইয়া গিয়া উত্তমরূপে উহার শরীর বুরুশ দ্বারা ঘর্ষণ করিয়া একটু শান্ত হইতে দিবে। এক সপ্তাহ কাল প্রতিদিন নিয়মিতরূপে এক ঘণ্টা এই প্রক্রিয়া করিলে সে সম্পূর্ণরূপে বাধ্য হইবে। দীর্ঘ সময় উক্তরূপে পাস দিলে উহাকে সম্মোহন নিদ্রায় নিদ্রিতও করিতে পারা যায়।

যে সকল বন্য জন্তুর নিকটে যাইতে কাৰ্যকারকের ভয় হয়, তাহার পক্ষে উহাদিগকে সম্মোহিত করার চেষ্টা বৃথা। ইহা কেবল ইতর জন্তুর সম্মোহন সম্বন্ধে নয়, মানুষের সম্মোহন বিষয়েও তুল্যরূপে প্রযোজ্য। কাৰ্য্যকারক গৃহপালিত বা বন্য জন্তুদিগের সম্মোহন বিষয়ে পারদর্শিতা লাভের প্রয়াসী হইলে, তাহাকে বিশেষভাবে উহাদের রুচি প্রকৃতি ইত্যাদি সম্বন্ধে জ্ঞান লাভ করিতে হইবে। তজ্জন্য সে নানাস্থানে যাইয়া চিড়িয়াখানা, সার্কেস পার্টির পশুশালা ইত্যাদি দেখিবে এবং যে সকল ব্যক্তি উহাদিগকে পালন করে বা শিক্ষা দেয়, তাহাদের সঙ্গে ঘনিষ্টভাবে মিলামিশা করিয়া এবং তাহাদের কাৰ্য্য-প্রণালী দেখিয়া নানা বিষয় শিক্ষা করিবে, অন্যথায় সে এই বিষয়ে বিশেষ সাফল্য লাভ করিতে পারিবে না। এই নিয়ম-প্রণালীগুলির অধিকাংশই মিঃ জেমস কোটস্ এর বর্ণিত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *