৭-৯. হেলিকপ্টারের জানলা দিয়ে

০৭.

হেলিকপ্টারের জানলা দিয়ে উঁকি মারলো গেই। দেখা যাচ্ছে সবুজ ঘাসের মখমল বিছানো লন, ফুলের কেয়ারী, সোজা সোজা পথ এবং ছবির মতো একখানা বাড়ি। বাড়িটা লম্বা প্রায় সত্তর মিটার।

গেঈ বলে উঠলো কি সুন্দর বাড়িটা। একটা সুইমিং পুল, বিরাট মাঠ,বড় বড় ছাতা এবং বাগানে বসবার চেয়ার চোখে পড়লো। এবারে নেমে পড়া যাক।

হেলিকপ্টার নামাবার একটা উপযুক্ত জায়গা খুঁজে পাওয়া গেলো অবশেষে। একটু নীচে নামতেই সামরিক পোশাক পরা তিনজন জুলু তাকালো মাথা তুলে।

গ্যারী এবং গেঈ লাফিয়ে নামলো আসন থেকে। একটা জীপ এসে থামলো একটু দূরে।

গ্যারীকে ফেলে গেঈ এগিয়ে এলো। টক গাড়ি থেকে নামলো।

–আমি গেঈ ডেসমন্ড। অ্যানিম্যাল ওয়ার্ল্ড পত্রিকার তরফ থেকে এসেছি, হাত বাড়িয়ে দিলো সে।

টক তাকে খুঁটিয়ে দেখলোবাঃ ছবির চেয়ে রক্তমাংসের মেয়েটা তো বেশীসুন্দরী। সংক্ষেপে সে করমর্দন সারলো।

–এরকম বিনা নোটিসে এখানে নেমে পড়ার জন্য প্রথমেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। ওয়ান-এর জঙ্গলের দিকে যাচ্ছিলাম। পথে এই সুন্দর ছবিরমতোবাড়িটা দেখে আর লোভ সামলাতে পারলাম না। নেমে পড়লাম। যদি অন্যায় করে থাকি বলুন, এক্ষুনি চলে যাবো।

গেঈ-এর কথা শুনে টক মৃদু স্বরে বললো, আপনার মতো সুন্দরী দর্শনার্থী এখানে কদাচিৎ আসেন। আপাততঃ এখানে থাকুন, খাওয়া-দাওয়া করুন, তারপর যাওয়ার কথা ভাববেন।

আমার নাম গাইলোটক।গ্যারীততক্ষণে এসে পড়েছে। গেঈ তার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল। মিঃ টক, ইনি গ্যারী এডওয়ার্ডস–আমার পুষ্পক রথের রথী। টক মাথা নীচু করে অভিবাদন জানালো।

গ্যারী টক-এর সঙ্গে করমর্দন করলো।

গেই বলে চললো কি সুন্দর বাড়ি আপনাদের।

আমার বাড়ি নয় এটা মিস্ ডেসমন্ড। মিঃ ম্যাক্স কালেনবার্গ-এর মালিক।

গেঈ বড় বড় চোখ করে তাকালো তার দিকে, সেই বিখ্যাত ম্যাক্স কালেনবার্গ, কোটিপতি!

আমি তো শুনেছি লোকজন বড় একটা পছন্দ করেন না তিনি। গ্যারীর দিকে চিন্তিত ভাবে ফিরলো সে।

গ্যারী আমাদের থাকাটা বোধহয় ঠিক হবেনা, উনি বিরক্ত হতে পারেন। চলে যাওয়াই ভালো। বাঃ চোস্ত অভিনয় করছে তো গেঈ, গ্যারী ভাবলো।

টক বললো, আপনারা ব্যস্ত হবেন না মিস ডেসমন্ড। মিঃ কালেনবার্গ লোকজন ভালোবাসেন না, এমন নয়। তিনি আপনাদের দেখে খুশীই হবেন বরং। চলুন বাড়িতে যাওয়া যাক।

জীপে উঠলো তিনজন। ড্রাইভার গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে চললো বাড়ির দিকে। গাড়ি থেকে নেমে ফুলের বাগান এবং সুইমিং পুল বাঁয়ে রেখে তারা এসে ঢুকলো এক বিরাট ঘরে। এত প্রাচুর্য গেঈ বা গ্যারী জীবনে দেখেনি। বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল তারা। নিঃশব্দে সাদা পোশাক পরিহিত একজন জুলু এসে দাঁড়ালো।

ততক্ষণে একটু গলা ভিজিয়ে নিন বরং। টক চলে গেলো।

জুলুটি অভিবাদন করে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো। দুগ্লাস জিনের অর্ডার দিয়ে দুজন এলো ঘরের বাইরে প্রশস্ত–গাড়ি বারান্দায়। ওরা নিজেদের মধ্যে আলোচনায় মত্ত হলো। জুলু দুগ্লাস পানীয় এবং টোস্ট দিয়ে গেলো নিঃশব্দে।

খাওয়া প্রায় শেষ হয়ে এসেছে এমন সময় টক এলো।

মিস ডেসমন্ড, আপনাদের আগমনে মিঃ কালেনবার্গ খুবই খুশী হয়েছেন। দুর্ভাগ্যবশতঃ তিনি এখন দেখা করতে পারছেন না কারণ তিনি কয়েকটি জরুরী কাজে ব্যস্ত আছেন। রাত্রিতে ছাড়া তিনি সময় করতে পারবেননা। আপনাদের যদি কোন অসুবিধা না থাকে তবে রাতটা এখানে কাটিয়ে যান।

গেঈ-এর চোখ খুশিতে জ্বলজ্বল করে উঠলো–বেশ রাতটা তাহলে কাটিয়েই যাই। কালেনবার্গকে আপনি দয়া করে আমার হয়ে ধন্যবাদ জানাবেন মিঃ টক।

মাথা নেড়ে সম্মতি জানালোটক।টক গাড়ি বারান্দায় মায়াকে দেখেফিরলো।ইনিমিস-দাস। আপনাদের দুজনের দেখাশোনা ইনিই করবেন। আমার একটা কাজ আছে চলি।টক বিদায় নিল।

মায়া এগিয়ে এলো, আসুন আপনারা আমার সঙ্গে।

মায়া একটা ট্রলীতে করে ওদের নিয়ে একেবারে একটি লম্বা বারান্দার একেবারে শেষ প্রান্তে পৌঁছলো। বারান্দাটা এতো লম্বা যে খাটনি বাঁচাবার জন্য এই ভাবেই যাতায়াত করতে হয়।

মায়া ট্রলী থামিয়ে একটি দরজা খুলে বললো, এই আমাদের অতিথি নিবাস। আসুন, ভেতরে আসুন।

ঘরটি বিলাসবহুল আসবাবে নিখুঁত ভাবে সাজানো। মায়া বললো, যা যা দরকার এখানে সবই পাবেন। বেলা একটায় আপনাদের খাবার দেওয়া হবে বাইরের ঘরে, এই হলো আপনার শোবার ঘর মিস ডেসমন্ড। একটু এগিয়ে একটা ঘরের দরজা খুললো সে।

গেঈ খোলা দরজাপথে তাকালা ঘরের ভেতরে। ফিকে নীল রঙের দেয়াল, বিরাট একখানা বড় খাট, একধারে আলমারী, ড্রেসিং টেবিল, নানারকম প্রসাধনসামগ্রী একটা রূপোর বাক্সে, সব মিলিয়ে ঘরটি ভারী সুন্দর। ঘরের মধ্যে ঢুকে গেঈ সবকিছু ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলো। বিছানার উল্টো দিকের দেয়ালজোড়া এক বিরাট আয়না। ঘরের আবহাওয়া গরম করে শরীর শুকিয়ে নেবার শীততাপ নিয়ন্ত্রণের মেশিন আছে একটা। বৈদ্যুতিক উপায়ে ম্যাসেজেরও মেশিন রয়েছে একধারে।

এতো বিলাস-ব্যসনে কেউ যে থাকতে পারে–গেঈ-এর ধারণা ছিল না। সে বিস্ময়ে হতবাক হলো।

মায়া বলে গেলো স্বচ্ছন্দে আপনারা যা খুশি করতে পারেন–বিশ্রাম করতে পারেন, বাগানে ঘুরে বেড়াতে পারেন। যখনই কোনো কিছুর প্রয়োজন হবে আমাদের ফোনে দয়া করে জানাবেন। মৃদু হেসে মায়া বিদায় নিলো।

গেঈ এবং গ্যারী উভয়ের দিকে তাকালো, গ্যারী আনন্দে শিস দিয়ে উঠলো। হঠাৎ একজন জুলু ঘরে ঢুকলো তাদের রুকস্যাক দুটি নিয়ে। মেঝেয় নামিয়ে রেখে নিষ্ক্রান্ত হলো। গ্যারী তাড়াতাড়ি খুলে দেখে নিলো ট্রান্সমিটার আছে কিনা। গেঈর দিকে তাকালো সে, দেখতে পায়নি তো ওরা ট্রান্সমিটারটা?

গেই বললো, দেখলো তো ভারী বয়ে গেলো। সে স্নান করার জন্য তৈরী হতে লাগলো। রুকস্যাকটা তুলে নিয়ে ঘরে ঢুকে সে দরজা বন্ধ করে দিলো।

পোশাক খুলে ফেললো শীঘ্র। বিরাট আয়নার সামনে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে নিজের নিরাবরণ রূপ দেখতে লাগলো অনেক সময় ধরে। আয়নার পেছনে এক সঙ্কীর্ণ হুইল চেয়ারে বসে কালেনবার্গ তার প্রতিটি মনোহারী ভঙ্গিমাই হুবহু দেখতে লাগলেন। এক বিশেষ কায়দায় তৈরী আয়নাটি দ্বিমুখী। সামনের দিক থেকে সাধারণ আর পাঁচটা আয়নার মতোই। শুধু পারদের দিকটাই অন্যরকম–সেদিক থেকে আয়নার সামনে দাঁড়ানো মানুষটিকে স্বচ্ছ কাঁচের মধ্যে দিয়ে দেখার মতোই পরিষ্কার দেখতে পাওয়া যায়।

গেই ধীরে ধীরে এবার বাথরুমে গিয়ে বাথটবের কল খুলে দিলো।

.

জঙ্গলের আড়ালে বসে ফেনেল হেলিকপ্টারটা নামতে দেখলো। ঝড় বাদলে ক্ষয়ে যাওয়া এক বিরাট পাথরের চাঁইয়ের ওপর তারা জায়গা বেছে বসেছে। গাছপালা, ঝোঁপঝাড়ে চারপাশে ঘেরা ডালপালার ফাঁক দিয়ে কালেনবার্গ-এর বাড়িটা পরিষ্কার নজরে আসছে। ফেনেলের চোখে শক্তিশালী দূরবীন। জোন্স ট্রান্সমিটার তুলে নিলো হাতে। খুলে রেখে দিলো সেটা। কখন গ্যারী খবর পাঠাবে কে জানে। ফেনেল একটা সিগারেট ধরিয়ে গা হাত-পা ছড়িয়ে দিলো পাথরের ওপর। ধকল বড় কম যায়নি–অমন একটা বোঝা ঘাড়ে করে এতখানি পথ হাঁটা। চোখ দুটো তার ভারী হয়ে এলো।

হঠাৎ ট্রান্সমিটারে খট করে একটা শব্দ হলো–ওপাশ থেকে খবর আসছে যন্ত্রটা কানের কাছে তুললো সে। জোন্স–গ্যারী কথা বলছি–বেশ পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছি সব-পরে বলবো আরো কথা–ছাড়ছি। মেশিন বন্ধ হতে ফেনেল জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো জোন্স-এর দিকে।

ওরা আজ রাত্তিরটা বাড়িতেই কাটাচ্ছে। কালেনবার্গ অসন্তুষ্ট হয়নি বলে ওদের ধারণা। কালেনবার্গ রাতনটায় ওদের সঙ্গে দেখা করবেন। গ্যারী আমাদের এখানেই থাকতে বললো রাত এগারোটায় সে আবার খবর পাঠাবে।

এখন বেলা দুপুর। ওরা খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা করতে আরম্ভ করলো।

এদিকে গেঈ এবং গ্যারী দুপুরের খাওয়ার পর গাড়িবারান্দায় বসে আছে। গেঈকে খুব সুন্দর লাগছে, সোনালী রঙের একটা শাড়ি পরেছে সে। দুআঙুলের ফাঁকে একটা জ্বলন্ত সিগারেট।

ওরা আলোচনা করতে লাগলো যে ফেনেল কি ভাবে ঢুকবে। গাড়ি বারান্দায় দুএকজন পাহারাদার থাকতে পারে।

চল, বাগানটা একটু ঘুরে দেখে আসি।

বাইরে প্রচণ্ড গরমের জন্যে গে যেতে রাজী হলো না। গ্যারী তাকে বললো, তুমি বরং একটু ঘুমিয়ে নাও, আমি ঘুরে আসি। একথা বলে সে উঠে দাঁড়ালো। সবুজ সিমেন্টের পথ ধরে সে এগিয়ে গেলো। গেঈ তার গমনপথের দিকে অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে রইলো। তারপর চোখবুজিয়ে গ্যারীর কথা ভাবতে লাগলো, চিন্তার সাগরে ডুবে আকাশ-কুসুম ভাবনা ভাবতে লাগলো। এক সময় ঘুমিয়ে পড়লো সে। ঘুম ভাঙলো গ্যারীর ধাক্কায়। সে এসে জানালো বাড়ির শেষ সীমানা পর্যন্ত যাবার এক্তিয়ার কারোর নেই।

বাগানটা যেখানে শেষ হয়েছে, সেখানে একটা মস্ত পুকুর। আর পুকুর ভর্তি কিলবিল করছে বড় বড় কুমির। গ্যারী জানালো যে এখানকার পরিবেশটা কেমন যেন অদ্ভুত মনে হলো। কাউকে বেপাত্তা করে দেবার পক্ষে জায়গাটা বেশ ভালো। আগাগোড়া ঘটনাগুলো ভাবলে কেমন যেন খটকা লাগে। কত সহজে ঢুকে পড়লাম আমরা। টক-এর দৃষ্টিটাও খুব সাংঘাতিক।

হঠাৎ ওরা টককে এদিকে আসতে দেখলল। টক এগিয়ে এলো তার মুখে একচিলতে হাসি। চোখের দৃষ্টি প্রথমে গ্যারীতারপর গেঈর ওপর গিয়ে স্থির হলো। কোন অসুবিধা হয়নি তো, দুপুরের খাওয়া?

গেঈ একমুখ হাসি নিয়ে জানালো যে, না, কোনো অসুবিধা হয়নি। জায়গাটা ভারী সুন্দর। টক হঠাৎ করে বলে উঠলো মিঃ কালেনবার্গের মিউজিয়াম দেখবেন নাকি মিস ডেসমন্ড?

ঘরের মধ্যে বজ্রপাত হলেও এতটা চমকে উঠতো না গ্যারী। তাড়াতাড়ি অন্য দিকে মুখ ঘোরালো সে। গেঈ ভাবলেশহীন চোখে তাকালো টক-এর দিকে, মিঃ কালেনবার্গ-এর আবার মিউজিয়ামও আছে নাকি?

–আছে মানে? পৃথিবীর অন্যতম সংগ্রাহকদের মধ্যে মিঃ কালেনবার্গ একজন।

 গেই বলে উঠলো, নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই আমরা দেখতে চাই।

গ্যারীও মিউজিয়াম দেখার জন্য উৎসাহ দেখালো।

ঘর থেকে বারান্দায় এলো তারা। যেতে যেতে গেঈ এবং গ্যারীর মধ্যে একবার দৃষ্টি বিনিময় হলো। তিনজন গিয়ে ট্রলিতে উঠলো৷ ট্ৰলী লম্বা বারান্দা পার হয়ে এসে এক জায়গায় থামলো। সামনে পথ রোধ করে দাঁড়িয়ে আছে এক দেয়াল। তারা ট্রলীথেকে নামলোটক কাছাকাছি একটা জানালার ওপর আঙুল দিয়ে কি যেন টিপলো। দেয়াল সরে গেলো এক পাশে। একটা বন্ধ দরজা চোখে পড়লো। দরজার সামনে এসে দাঁড়াতেই দরজাটা আপনা আপনি খুলে গেলো। সমস্ত দরজাই বৈদ্যুতিক শক্তিতে নিয়ন্ত্রিত।

 তিনজনে এগিয়ে গিয়ে একটা লিফটে উঠলো। সাইডবোর্ডে চার রঙের চারটে বোতাম। টক প্রথমে সবুজ বোতামটি টিপলো। লিফট নীচে নামতে লাগলো ধীরে ধীরে। লিফট মাটি স্পর্শ করতে দরজা খুলে গেলো, তারা ঢুকলো শীতল গুহাকৃতি এক প্রকোষ্ঠে। কয়েক মিনিট টক গেই এবং গ্যারীকে দাঁড় করিয়ে রেখে দরজায় কি যেন সব নাড়াচাড়া করলো, তারপর তাদের দিকে ফিরে বললো, মিউজিয়ামে অমূল্য কতগুলি বস্তু আছে। চুরির ভয়ে আমরা সব রকম ব্যবস্থাই নিয়েছি। এই যে ঢোকার দরজাটা দেখছেন। এটা নিরেট স্টিলের তৈরী। চারপাশের দেওয়াল পাঁচ ফুট চওড়া। দরজায় আছে একটা টাইম লক–এই তালার এমনই কায়দা যে, রাত দশটায় বন্ধ করে দেবার পর, পরদিন সকাল দশটার আগে খোলার আর কোনো উপায় নেই। আসুন এবার।

নীচু ছাদের ঘর একখানি, মৃদু আলোয় রোমাঞ্চকর তার পরিবেশ। দেয়ালে–অসংখ্য ছবি। তাদের মধ্যে রেমব্রার একখানি, পিকাসোর কয়েকখানি এবং রেনেসাঁসের যুগের কয়েকটি অনবদ্য শিল্পকর্ম গেঈর চোখ এড়ালো না। তাঁর মনে হলো সে যেন একই সঙ্গে উফিজি, ভ্যাটিকান মিউজিয়াম এবং লুভ-এ এসে হাজির হয়েছে।

এগুলো নিশ্চয়ই আসল নয়, তাই না মিঃ টক?

–কে বললো আসল নয়? আমি তো আগেই বলেছি আপনাদের মিঃ কালেনবার্গ পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ সংগ্রাহকদের মধ্যে একজন। ভিতরের ঘরে চলুন, সেখানে আরো বিস্ময়কর জিনিস দেখতে পাবেন।

ছবির ঘর থেকে বেরিয়ে তারা গিয়ে ঢুকলো এক প্রশস্তঘরে। ঘরের মাঝখানে চার মিটার উঁচু এক সোনার বুদ্ধমূর্তি।

টক বললো, ব্যাঙ্কক থেকে আনা হয়েছে মূর্তিটা। গত যুদ্ধের সময় জাপানীরা মূর্তিটির খোঁজে শহর তোলপাড় করে ফেলেছে। মূর্তিটি আগাগোড়া নিরেট সোনার তৈরী। টক শিল্পকর্মের এক একটি নিদর্শন ব্যাখ্যা করলো তাদের কাছে। গ্যারীর শিল্প সম্পর্কে উৎসাহ কম, তবু সব দেখেশুনে তার মন্দ লাগলো না। এগিয়ে চললো তারা।

গেঈ ঘাড় ফেরালো, আর তখনই চোখে পড়লো তার বার্জিয়া আংটি, একটি ছোট আলোকিত মঞ্চের ওপর ছোট্ট একটি কাঁচের বাক্সে রয়েছে।

টক বললো, এই হলো সেই বিখ্যাত বার্জিয়া আংটি। বার্জিয়ার অনুরোধে এক স্বর্ণকার বানিয়েছিলো এই বিষের আংটিটা। শোনা যায় সেই স্বর্ণকারই হয়েছিলো বিষের প্রথম শিকার। আংটির কার্যকারীতা পরীক্ষা করতে এবং স্বর্ণকারের মুখ চিরতরে বন্ধ করতে সিজার আংটি আঙুলে পরে তার সঙ্গে করমর্দন করেছিলেন। আংটির হীরেগুলোর আড়ালে লুকোনো আছে একটা সূক্ষাতিসূক্ষ্ম উঁচ-খোলা চোখে তা ধরা পড়ে না। বার্জিয়ার করমর্দনের সময় স্বর্ণকার মারা যায়।

গেই জানতে চাইলো যে এখনও আংটিটায় বিপদের আশংকা আছে কিনা।

না না মিস্ ডেসমন্ড। এখন আর সে ভয় নেই। আংটিটাকে আবার কার্যকরী করতে হলে আগে বিষ ভরতে হবে।

তারা এগিয়ে চললো। তাদের আরো আধঘণ্টা কাটলোনানারকম বিচিত্র নমুনা দেখে। তারপর সকলে মিলে বাইরে এলো। টক বিদায় নেবার আগে বলে গেলো যে দেড় ঘণ্টার মধ্যে গাড়ি বারান্দায় নৈশভোজ দেওয়া হবে। একজন ভৃত্য এসে তাদের ডেকে নিয়ে যাবে।

সাড়ে সাতটা বাজে তখন, ভোঙ্কার সঙ্গে মার্টিনি মিলিয়ে দুটি গেলাস নিয়ে বসলো দুজন। গ্যারী বললো জান গেই, আমার যেন কেমন লাগছে আগাগোড়া, বারবার মনে হচ্ছে আমরা যেন ফঁদে পা দিয়ে ফেলেছি। ভেবে দেখ, মিউজিয়ামের প্রত্যেকটা জিনিসই যে চুরি করা–তা আমরা স্বাভাবিক ভাবেই ধরতে পেরেছি। এখান থেকে ফিরে গিয়ে তোআমরা একথা রটিয়ে দিতে পারি। তা সত্ত্বেও আমাদের মিউজিয়াম দেখানো হলো কেন? কেন টক আমাকে লিফট কি ভাবে কাজ করে এবং তালাটার গোলমেলে রহস্যের কথা শোনালো? এদের কি উদ্দেশ্য কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।

গেঈ মনে মনে ভাবলো, তাহলে কি আমরা এখান থেকে কোনদিন বের হতে পারবো না! চিরকাল এখানে আমাদের বন্দী হয়ে থাকতে হবে।

গ্যারীর একটা ভরসা ফেনেল এবং জোন্স আছে। ওদের সঙ্গে কথা বলা দরকার একবার।

ঠিক কাটায় কাটায় নটা বাজে তখন একজন ভৃত্য এসে ডেকে নিয়ে গেলো তাদের গাড়ি বারান্দায়। কালেনবার্গ তাদের জন্য চেয়ারে বসে অপেক্ষা করছিলেন। তারা আসাতে সাদর অভ্যর্থনা জানিয়ে বসতে বললেন।

ওরা আসন গ্রহণ করলে তিনি বললেন,টক এর মুখে শুনলাম, আপনি নাকি অ্যানিম্যাল ওয়ার্লড পত্রিকার তরফ থেকে এসেছেন। কতদিন হলো আছেন ওদের সঙ্গে? আমি পত্রিকাখানি নিয়মিত রাখি। জন্তু-জানোয়ার সম্পর্কে জানতে আমার ভালো লাগে, তা আপনার নামে তো কোনো লেখা, প্রকাশ হতে দেখিনি কোনদিন?

গেঈ একটুও বিচলিত না হয়ে উত্তর দিল, আমি ওখানে মাস ছয়েক হলো আছি। কত বড় বড় লেখকদের লেখাই কাগজে বের হয় না আর আমি তো চুনোপুঁটি মাত্র। তাছাড়া আমার ওপর কতগুলি বাঁধা ধরা কাজ করার নির্দেশ আছে। ভাবছিলাম এই সুন্দর বাড়িটার একটা সুন্দর ছবি নিয়ে ছাপবো।

কালেনবার্গ তাকালেন মুখ তুলে। আমি দুঃখিত মিস্ ডেসমন্ড, এখানে ছবি তোলা নিয়ম-বিরুদ্ধ কাজ।

–যাই হক এখানকার মিউজিয়াম আপনার কেমন লাগলো বলুন?

–অপূর্ব, এমন এক মিউজিয়ামের মালিক হওয়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ মিঃ কালেনবার্গ। তিনজন ভৃত্য এসে নিঃশব্দে দাঁড়ালো সুন্দর কারুকার্যখচিত এক ডিনার টেবিলের পাশে।

ডিনারে বসে কালেনবার্গ গ্যারীকে বললেন, মিঃ এডওয়ার্ডস আপনি কি একজন পেশাদার পাইলট?

গ্যারী মাথা নেড়ে বললো না, সবে আরম্ভ করেছি মাত্র। মিস্ ডেসমন্ডই আমার প্রথম খদ্দের।

কালেনবার্গ গেঈ এর দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনি তাহলে এক বিরাট কাজে নেমেছেন বলুন?

–হ্যাঁ বিরাট কাজই তোবটে। ওয়ানক-এর গভীর জঙ্গলে যাবোবলে বেরিয়েছি, চোখ পড়লো আপনার এই সুন্দর বাড়িটার ওপর। নেমে পড়লাম।

গেঈ বললো আপনার বাগানটা ঘুরে দেখলাম মিঃ কালেনবার্গ, দেখলাম যুদ্ধের পোশাক পরা একজন জুলু বাগান পাহারা দিচ্ছে। বেশ ভালোই লাগছে।

কালেনবার্গ বললেন, একশো জন এই ধরনের আমার পাহারাদার আছে। ওদের চোখ এড়িয়ে কেউ এখানে ঢুকতেও পারে না। আবার বের হতেও পারে না। সারা দিনরাত্তির ওরা পাহারা দেয় চারপাশের জঙ্গল।

গ্যারী কথা প্রসঙ্গে জিজ্ঞাসা করলো, বাগান নিশ্চয় পাহারা দেবার দরকার হয় না?

না মিঃ এডওয়ার্ডস, রাতে বাগান পাহারা দেবার জন্য কেউ থাকে না। যখন কোনো অতিথি আসেন এখানে, তখনই তারা বাগান পাহারা দেয়। তাও অবশ্য দিনে-রাতে নয়।

কালেনবার্গ চিন্তান্বিত ভাবে হিন্ডেনবার্গের গায়ে হাত বোলাতে লাগলেন।

আরো নানা ধরনের মুখোরাচক খাবার এলো। খাওয়া শেষ হলে টক এসে দাঁড়ালো-বিরক্ত করছি একটু স্যার, মিঃ ভোরস্টার টেলিফোনে আপনার সঙ্গে কথা বলতে চান।

এক মুহূর্ত কি যেন ভাবলেন কালেনবার্গ,ও ভুলেই গিয়েছিলাম একেবারে, আমি পাঁচ মিনিটের মধ্যেই যাচ্ছি।

টক চলে গেল।

কালেনবার্গ বললেন, মাফ করবেন মিস্ ডেসমন্ড। আপনাদের সঙ্গ দিতে পারছি না বলে দুঃখিত, এখনও কয়েকটা কাজ বাকি পড়ে আছে। আপনারা চলে যাবার আগে নিশ্চয়ই দেখা হবে। ছবি তোলার অনুমতি দিতে পারলাম না বলে দুঃখিত, চলি।

গেঈ এবং গ্যারী উঠে দাঁড়িয়ে তাকে ধন্যবাদ জানালো। কালেনবার্গের সন্ধানী দৃষ্টি একবার ঘুরে গেলো দুজনের মুখের ওপর দিয়ে।

অফিসে পৌঁছে টক-এর সঙ্গে দেখা। টক খবর দিলো যে, গাইডটা মারা গেছে। ফেনেল আর জোন্স পাথরের ওপর বসে নজর রাখছে বাড়ির দিকে, এডওয়ার্ডস-এর সাথে ট্রান্সমিটারে যোগাযোগ করছে ওরা। কথাবার্তা যা যা হয়েছেসব টেপকরে রাখা হয়েছে। ফেনেল আজ রাত্রিরে এনএকলা আসবে। জোন্স ওখানেই থাকবে, এডওয়ার্ডসবুঝতে পেরেছেআমরা ওদের সন্দেহ করছি। টক বিদায় নিল।

কালেনবার্গ চিন্তাক্লিষ্ট মুখে তাকালেন তার দিকে। বিকেলের ডাকে আসা চিঠিপত্রগুলো দেখতে লাগলেন কালেনবার্গ।

হঠাৎ দরজায় মৃদু করাঘাতের শব্দ হলো, কিমোসা এসে ঘরে ঢুকলো।

–জোয়াইদ মারা গেছে।

 কালেনবার্গ ভুরু তুলে তাকালেন তার দিকে, মারা গেছে–কি হয়েছিল?

–ঠিক জানিনা, মরার আগে শুধু বলছিল গলা নাকি জ্বলে যাচ্ছে।

বড় দুঃখের সংবাদ শোনালে কিমোসা, ঠিক আছে।কবর দেবার ব্যবস্থা করো। বেঁচে থাকতে ও তো কোন উপকারেই আসতো না, মরে গিয়েও তাই ক্ষতি হল না কারোর।

কিমোসা আড় চোখে তাকালো তার দিকে তারপর অভিবাদন করে বিদায় নিলো।

কালেনবার্গ চেয়ারে হেলান দিয়ে ভাবতে বসলেন। ঠোঁটের কোনে শয়তানীর হাসি খেলে গেলো তার, এই বর্জিয়া আংটি তাহলে এখনও তেমন মারাত্মক।

.

০৮.

 গেঈ এবং গ্যারী তাদের নির্দিষ্ট ঘরে ফিরে দেখলো বাইরের গাড়ি বারান্দার দিকের সমস্ত দরজা জানালা কে যেন এর মধ্যে বন্ধ করে রেখেছে। শীততাপ যন্ত্রটি চালু থাকায় সব বেশ ঠাণ্ডা হয়ে রয়েছে।

 গ্যারী সমস্ত দরজা টেনে দেখলোখোলা গেলো না, সব তালা বন্ধ।

গ্যারী ভাবলো ফেনেলকে আগে সাবধান করে দেওয়া উচিত। তালা খোলার ব্যবস্থা সেই যা করে করবে। ঘড়ির দিকে তাকালো গ্যারী। এখন দশটা বাজে।

গ্যারী বললো আমার ধারণা লোকটা ভয়ঙ্কর প্রকৃতির। গেঈ শান্ত স্বরে বললো, মাথায়ও কিছু গণ্ডগোল আছে। আমার মনে হয় আমরা ফাঁদে পা দিয়ে ফেলেছি। এখানে একবার যখন এসেছি আর পিছু হটবার কোন মানে হয় না। শেষ পর্যন্ত দেখে যেতে হবে। বাগানে রাতে কেউ পাহারায় থাকে না–এটা মিথ্যা কথা। ফেনেলকে আমি বলে দেবো, আসার সময় সে যেন খুব সাবধানে আসে। গ্যারীও বললো–আমারও আগাগোড়া ব্যাপারটা গোলমেলে লাগছে।

গেঈ এবং গ্যারী দুজনে ঠিক করলো লিফটটা একবার দেখে আসবে। কিছুক্ষণ নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলে তারা দরজা খুলে বারান্দায় এলো। নিঃশব্দে তারা লিফটের দিকে গেলো, জানলার নীচের বোতামটা খুঁজে পেতে অসুবিধা হলো না। টিপতেই দেয়াল সরে গেলো। লিফটের দরজা খুলে গেলো, গ্যারী ভেতরে ঢুকে প্রথমে লাল বোতামটা টিপে অ্যালার্ম বন্ধ করে দিলো। তারপর সবুজ বোতাম টিপতে লিফট নীচে নামতে লাগলো। একেবারে শেষ পর্যন্ত পৌঁছে গ্যারী আবার সবুজ বোতাম টিপলো-লিফট উঠে এলো ধীরে ধীরে। ওপরে পৌঁছে সে লিফট থেকে বেরিয়ে এসে.জানলার বোম টিপে দেয়াল বন্ধ করে দিলো। তারপর গেঈর হাত ধরে নিঃশব্দে ছুটে এসে ঢুকলো ঘরে।

তাহলে বোঝা গেল যে লিফট চালু আছে। এখন ফেনেল এর ওপরেই সব–নিরাপদে এখানে ঢুকে মিউজিয়ামের দরজা একবার খুলতে পারলেই হলো।

একটু পরে গ্যারী ট্রান্সমিটারে কথা বললো ফেনেলের সঙ্গে। সমস্ত ঘটনা খুলে বললো। ফেনেল বললো সে বাড়ির দুপ্রান্তের দুটি ঘরের জানলা দিয়ে আলো দেখতে পাচ্ছে।

ফেনেল জানালো আর আধঘণ্টার মধ্যে সে এখানে পৌঁছে যাবে। জোন্স এখানেই থাকবে আমাদের ইশারা না পাওয়া পর্যন্ত। গ্যারী ট্রান্সমিটার বন্ধ করে দিলো। গেইকে সে জানালো যে ফেনেল এখুনি রওনা দিচ্ছে। বাড়ির আর সব আলো নিভে গেছে। সে টেবিলল্যাম্প জ্বেলে ঘরের বড় আলোগুলো সব নিভিয়ে দিলো। তারপর জানালার কাঁচের মধ্যে দিয়ে তাকিয়ে রইলোবাইরের অন্ধকারে।

আর কয়েকঘণ্টার মধ্যেই আমরা হেলিকপ্টারে মেনভিলে গিয়ে পৌঁছবো। গেঈ বললো এবার পোশাকটা পাল্টে আসি। শোবার ঘরে গিয়ে শাড়ি ছেড়ে জামাপ্যান্ট পরে নিলো সে। গ্যারীও পোশাক পাল্টে নিলো।

আবার তারা গিয়ে জানালার কাছে বসলো।

একটু পরেই নিঃশব্দে ফেনেল জানলার কাছে এসে দাঁড়ালো। যন্ত্রপাতির ব্যাগ নামিয়ে সে ছোট টর্চের আলো ফেলে দরজার তালা পরীক্ষা করলো। তারপর প্রয়োজন মতো একটি যন্ত্র বেছে দরজার তালা খুলতে বসলো। কয়েক মিনিট পর খট করে একটা শব্দ, তালা খুলেছে। দরজা ঠেলে ফেনেল বসবার ঘরে এলো। গেঈর দিকে তাকিয়ে বললো, বেশ মজায় আছেন দেখছি।

গ্যারীর দিকে তাকিয়ে ফেনেল বললো চলুন, লিফটের দিকে যাওয়া যাক। গেঈকে তারা বলে গেলো, আমরা চললাম তুমি কিছুক্ষণ একলা থাকো। গেঈ ঘাড় নেড়ে তাদের যেতে বললো।

গ্যারী দরজা খুলে ফেনেলকে ডাকলো, আসুন এদিকে, দেখে যান।

প্রায় পঁয়ত্রিশ খানা ঘর করিডোরের দুপাশে, নিঃশব্দে তারা এগোলো বারান্দা ধরে। কয়েক মিনিট পর লিফটে নামতে লাগলো নীচে। ফেনেল দরজার কাছে গিয়ে তালা এবং ডায়ালটা ভালোভাবে পরীক্ষা করে পেছন ফিরলো। যন্ত্রপাতির ব্যাগ থেকে কয়েকটা যন্ত্র বের করে সে মেঝেয় নামালো। গ্যারী চেয়ারে বসে একটা সিগারেট ধরিয়ে ঘন ঘন টানতে লাগলো।

ফেনেল নিঃশব্দে কাজ করে যাচ্ছে। কি যে করছে সে-ই জানে। গ্যারী অধৈর্য হয়ে পড়লো। চেয়ার ছেড়ে উঠে পায়চারী করতে লাগলো নিঃশব্দে। অবশেষে এক ঘণ্টা পর দীর্ঘ অপেক্ষার শেষ হলো। দরজা ঠেলতে খুলে গেলো। তার পর একের পর এক ঘরে ঢুকতে লাগলো। এগিয়ে গেলো সেই আলোকিত মঞ্চটির দিকে। কিন্তু একি! আংটি কোথায়? সেই কাঁচের বাক্সটির সঙ্গে আংটি-টিও উধাও হয়েছে মঞ্চ থেকে! তারা খোঁজাখুঁজি করতে লাগলো। হঠাৎ দেখা গেলো দরজার মুখে দাঁড়িয়ে আছে চারজন দৈত্যাকৃতি জুলু, পরনে তাদের চিতাবাঘের ছাল, হাতে বিরাট বর্শা। তাদের দুজনের চোখে স্থির দৃষ্টি। একজন ভাঙা ভাঙা ইংরাজীতে বললো, আসুন আমাদের সঙ্গে বিনা বাক্যব্যয়ে। গ্যারী দরজার দিকে এগিয়ে গেল। ফেনেল ইতস্ততঃ করলোপালাবার চেষ্টা বৃথা। দ্বিতীয় কোনো পথ নেই পালাবার। অগত্যা সেনীচু হয়ে তার যন্ত্রপাতির ব্যাগ কুড়িয়ে কাঁধে তুলে সেও গ্যারীর পেছন পেছন এগিয়ে গেলো।

দীর্ঘক্ষণ ধরে গেঈ একা একা বড় চঞ্চল হয়ে উঠেছে। ঘণ্টা দুই ধরে পায়চারী করে বেড়াচ্ছে। সে মনে করলে সে ওদের সঙ্গে গেলেই বোধ হয় ভালো হতো।

হঠাৎ দরজায় শব্দ হলো। গ্যারী শীঘ্র পরজা খুলে দিলো। কিন্তু একি–পাহারাদার জুলু একজন দাঁড়িয়ে দরজায়। বারান্দার মৃদু আলোয় ঝিকিয়ে উঠেছে তার হাতের বর্শা।

আতঙ্কে আর্তনাদ করে উঠলো গেঈ। দরজা বন্ধ করতে গিয়ে ব্যর্থ হলো। জুলটি বলে উঠলো যে মালিক আপনাকে ডেকেছেন। ইতস্ততঃ করলো গেঈ, গ্যারী তাহলে ঠিকই বলেছে–ওরা ফাঁদেই পা দিয়েছে। ভয়বোধটা ততোক্ষণে থিতিয়ে এসেছে। মনে সাহস সঞ্চয় করে ওদের সঙ্গে গিয়ে ঢুকলো কালেনবার্গের কামরায়।

এই তো এসে গেছেন আপনি! চোখ তুলে তাকালেন তিনি, আসুন, এদিকে আসুন। আমি একটা ভারী মজার জিনিস দেখাচ্ছি। টেলিভিশন-এর আলোকিত পর্দার দিকে তাকিয়ে গেঈয়ের অন্তরাত্মা শুকিয়ে গেলো। পর্দায় ফেনেলকে মিউজিয়ামের দরজার সামনে হাঁটু মুড়ে বসে থাকতে দেখা যাচ্ছে। আর দেখা গেলো যে ফেনেল তালাটা খুলে ফেললল। গ্যারী ফেনেলের দিকে এগিয়ে আসছে। গেঈ নিষ্পলক নেত্রে তাকিয়ে রইলো পর্দার দিকে। তার শরীরের সবটুকু রক্ত বুঝিবা জমে বরফ হয়ে গেছে।

কালেনবার্গ বললেন আজকে ইচ্ছা করেই লিফটুটা চালু রেখেছিলাম। গেঈ দেখলো ফেনেল মঞ্চের দিকে তাকিয়ে বলছে, কি হলো?

কালেনবার্গ টেলিভিশন বন্ধ করে দিলেন, বললেন, এই অবধি থাক, ওরা কয়েক মিনিটের মধ্যে এখানে এসে পড়বে। তখন বাকিটুকু জানা যাবে।

কালেনবার্গ একটি সিগারেট ধরিয়ে গেঈকে জিজ্ঞেস করলেন স্যালিকের খবর।

গেঈ একটুও চমকালো না। চমকের যা কিছু তা আগেই শেষ হয়ে গেছে। ভাবলেশহীন মুখে সে বললো, এখানে আসার আগে তো দেখে এসেছিলাম বেশ ভালোই আছে, তবে এখন কি হয়েছে বলতে পারি না।

কালেনবার্গের চোখ জ্বলে উঠলো, এবার তাকে চিরদিনের মতো থামতে হবে। দপ করে জ্বলে উঠলো তার চোখ। –হীনতার সীমা তিনি ছাড়িয়ে গেছেন।

গেঈ-এর স্বরে শ্লেষ ফুটে উঠলো, আমার তো মনে হয় তার মতো হীন জঘন্য চরিত্রের লোক আশেপাশে খুঁজলে আরো দু-চারটে অনায়াসে মিলবে। আপনিও তো কম যান নামিঃ কালেনবার্গ।

গেই কথা শেষ করতে না করতে দরজা খুলে গেলো। গ্যারী এবং ফেনেলকে নিয়ে চারজন জুলু ঘরে ঢুকলো।কালেনবার্গ হাতের ইশারায় জুলুদের চলে যেতে বললেন। তারা বেরিয়ে যেতে দরজা বন্ধ হয়ে গেল।

কালেনবার্গ ওদের বসতে বলে ফেনেল-এর দিকে তাকিয়ে বললেন, প্রথমেই আপনাকে ধন্যবাদ দিই মিউজিয়ামের দরজা খোলার জন্য। ফেনেল গর্জন করে উঠলো, আংটির জন্য এসেছিলাম আংটি পাইনি। এখান থেকে আমরা চলে যাবে। আপনি আমাদের অনর্থক আটকে রাখতে পারেন না।

নিশ্চয় যাবেন তবে যাবার আগে কয়েকটা বিষয়ে আলোচনা করতে চাই।

-বার্জিয়া আংটির জন্য আপনারা যে অসাধ্য সাধন করেছেন তা একেবারে নষ্ট হতে দেব না আমি। মিস ডেসমন্ড একটু আগে বলেছিলেন, আংটিটা আইনত আমার প্রাপ্যও নয়, আপনারা আমার চেয়ে কম পরিশ্রম করেননি আংটিটা পেতে, তাই আমার একান্ত ইচ্ছা–আংটি আমি আপনাদের দিয়ে দেবো, তবে কয়েকটা শর্তে। ড্রয়ার খুলে কাঁচের বাক্সটি বের করে তিনি ডেস্কের ওপর রাখলেন। গ্যারী এবং গেঈ আংটিটা দেখেই চিনতে পারলো।

গ্যারী বললো, কিসের শর্ত?

কালেনবার্গ বললেন, একটা খেলার আয়োজন করেছি আমি–শিকার খেলা। আপনারা তিনজন এবং আপনাদের এক বন্ধু জোল হবেন শিকার আর আমার জুলুরা হবে শিকারী। আপনাদের পালাবার সুযোগ আমি করে দেবো-ভোর চারটের সময় আপনারা রওনা দেবেন। তার তিনঘণ্টা পর সাতটায় জুলুরা রওনা দেবে আপনাদের খোঁজে। বেশ তাড়াতাড়ি এগোতে হবে কিন্তু আপনাদের, নয়তো ধরা পড়ে যাবেন। আর ধরা পড়লে আপনাদের নৃশংসভাবে হত্যা করা · হবে।তিনি আরো বললেন যে, আমি জানি, আংটির জন্য আপনাদের পারিশ্রমিকনহাজার ডলার। আংটিটা নিয়ে যান–স্যালিককে দিয়ে দেবেন গি, কাঁচের বাক্সটি নিয়ে তিনি গেঈর হাতে তুলে দিলেন।

গ্যারী বলে উঠলো, তাহলে আপনি আপনার হীন বিকৃত-মনের সন্তুষ্টির জন্য এই শিকারের আয়োজন করেছেন–তাই তো?

কালেনবার্গের মুখের রেখা বদলে গেলো। শান্ত সদাশয় ভদ্রলোকটির মুখে ফুটে উঠলো ঘৃণা, চরম বিরক্তির চিহ্ন, আমার জমিদারীতে অনধিকার প্রবেশের শাক্তি আপনাদের পেতে হবেচরম শাস্তি। মিউজিয়ামে যখন ঢুকিয়েছি একবার, তখন আপনাদের মুখ চিরদিনের মতো বন্ধ না করে দেওয়া পর্যন্ত শান্তি নেই আমার।

গ্যারী বললো তাহলে, কেন দিলেন আমাদের আংটিটা? ডাকুন আপনাদের লোকজন–মেরে ফেলুক আমাদের।

–না শিকার দেখতে আমার খুব ভালো লাগে। আংটি দিয়েছি ঠিকই, কিন্তু পালাতে দেব আর। তিনি ডেস্কের একটি বোতাম টিপলেন, একদিকের দেওয়াল সরে যেতে বিরাট একখানা ম্যাপ দেখা গেলো।–এই আমার জমিদারির ম্যাপ, বেশ ভালো করে দেখে নিন সকলে। আমার ইচ্ছা বেশ কয়েকদিন ধরে চলুক এ খেলা। দেখুন ম্যাপটা, পূর্ব দিক পাহাড়ে ঘেরা। দক্ষিণ দিকটাও সুবিধার নয় একটা নদী আছে, নদীর আশেপাশের জমিতে বড় বড় বিষাক্ত সাপ কুমির সবই আছে। উত্তর এবং পশ্চিম দিকের পথটাই সোজা, পশ্চিম দিকে মেনভিলের বড় রাস্তায় গিয়ে উঠতে আপনাদের মোট হাঁটতে হবে একশো কুড়ি কিলোমিটার,সুতরাংবুঝতেই পারছেন কত তাড়াতাড়ি যেতে হবে আপনাদের। জুলুদের হাঁটার গতি জানেন তো!

এসব ভেবেই তিনঘন্টা আগে আপনাদের রওনা দিতে বলেছি। এবারে যে পথ ইচ্ছা আপনারা বেছে নিতে পারেন রওনা দেবার জন্য।

কালেনবার্গ ঘড়ির দিকে তাকালেন, আমার ঘুমোতে দেরী হয়ে গেলো আজ, আপনারা ঘরে ফিরে বিশ্রাম নিন একটু। ঠিক চারটেয় রওনা হবেন। বাধা দেবে না কেউ। বেশ তাড়াতাড়ি হাঁটবেন কিন্তু। মিস্ ডেসমন্ডদের দিকে ফিরে তাকিয়ে বললেন, একটা কথা এখানকার লোকেদের মুখে মুখে ফেরে, শকুনের চোখে পলক পড়ে না। আমার জুলুদের চোখ কিন্তু শকুনের চেয়ে কম প্রখর নয়। গুডনাইট!

ওরা ঘরে ফিরে এলো। গেঈ বললো, চলো আমরা এখন বাইরের দিকের দরজা খুলে পালাই। গ্যারী জানালে তার কোনো উপায় নেই, কেননা জুলুরা ওদিকে পাহারা দিচ্ছে।

ফেনেল কপালের ঘাম মুছে বললো, জোন্স-এর সঙ্গে আগে কথা বলে নিই। উত্তর দিকে রওনা দিয়ে থেকে সঙ্গে নিয়ে যেদিকে হয় যাওয়া যাবে, ওর কাছে রাইফেলটা আছে।

গেঈ বাক্সের মধ্যে আংটিটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছিল, গ্যারী বললো, এক কাজ করো আংটিটা তুমি আঙুলে পরে নাও। বাক্সের থেকে আঙুলে আংটিটা অনেক নিরাপদ হবে। গেঈ আংটিটা আঙুলে পরে ফেললো।

চারটের সামান্য আগে ঘুম ভেঙে গেলো গেঈর। ধড়মড়িয়ে উঠে বসলো বিছানার ওপর, কোথায় যেন মাদল বাজছে–খুব দূরে নয়, কাছাকাছি কোথাও, রাতের সেই অন্ধকার যেন আরো ভারী, আরো গম্ভীর হয়ে উঠেছে মাদলের একটানা শব্দে

এক লাফে বিছানা থেকে নেমে রুকস্যাকটা নিয়ে গেঈবসবার ঘরে এলোগ্যারীআর ফেনেল বাইরের দিকের বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। ঠিক চারটে বাজতেই এক বিশাল চেহারার জুলু এসে দাঁড়ালো বারান্দার দিকের দরজার বাইরে।

গ্যারী বললো, এক্ষুনি বেরোচ্ছি আমরা। দরজা খুলে দিলো সে।

মাদলের শব্দ আরো প্রবল হলো। দূরে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে প্রায় তিরিশ জন জুলু, পরনেতাদের চিতাবাঘের ছাল, মাথায় উটপাখীর পালকের টুপি। এক হাতে চামড়ার ঢাল, আর একহাতে নিরেট ইস্পাতের তৈরী তীক্ষ্ণ-বর্শা, আগুন জ্বলছে বৃত্তের মাঝখানে, একজন জুলু আগুনের সামনে বসে উন্মাদের মতো বাজাচ্ছে এক প্রকাণ্ড মাদল। বাজনার তালে তালে নাচছে সেই তিরিশজন জুলু।

সেই বিশালাকৃতি জুলু তার বর্শা তুলে ধরলো তিনজনের দিকে প্রথমে, তারপরে জঙ্গলবরাবর তুললো।

গ্যারী এবং ফেনেল রুকস্যাক কাঁধে তুলে গেঈকে মাঝখানে রেখে এগোলো গুটি গুটি, মাদলের শব্দ আরো প্রবল হলো, ভয়ে গেইর গলা শুকিয়ে গেল।

ওরা তাড়াতাড়ি পা চালালো, লন পেরিয়ে এগিয়ে চললল জঙ্গলের দিকে, পেছন ফিরে তাকাবার সাহস কারুর হলোনা,জঙ্গলে এসে প্রথম কথা বললো গ্যারী, ওঃ কি সাংঘাতিক। জোন্স কোথায়?

–ঐ তো ওখানে পাথরের চাইটার ওপর। ফেনেল দুহাত মুখের কাছে নিয়ে ডাকলো, জোন্স! তাড়াতাড়ি এসো–এদিকে।

টর্চ বের করে আলো জ্বেলে দোলাতে লাগলো সে। জোন্স-এর গলা শোনা গেলো, আলোটা জ্বেলে রাখো, আমি যাচ্ছি।

পাঁচ মিনিটের মধ্যে জোন্স এলো, পেয়েছে আংটিটা? হেলিকপ্টারে এলে না কেন?

পেয়েছি আংটি। ফেনেল বললো, থেম্বার কাছে যেতে হবে। হেলিকপ্টার নেই। চলে যেতে যেতে সব বলছি। ফেনেল আর জোন্স পাশাপাশি কথা বলতে বলতে এগোলো। গ্যারী আর গেই পেছন পেছন, সব কিছু শুনে গতিবেগ বাড়িয়ে দিল জোন্স।

ওরা ভাবতে লাগলো-কি ভাবে কোন পথেজুলুদের এড়ানো যাবে, পূব দিকের পথ অসম্ভব। তারা কেউ পাহাড়ে চড়তে পারে না, উত্তর দিক সম্পর্কে কালেনবার্গ মিথ্যা বলেছে মনে হয় না-নিশ্চয় তার লোক আছে ও পথে, না হলে গ্যারীদের সম্পর্কে অত খুটিনাটি খবর পেলো কি ভাবে। বাকি রইলো শুধুদক্ষিণ দিকের পথ-কুমির আর বিষাক্ত সাপে বোঝাই। অবশ্য পশ্চিম দিকের পথটা ভালো।

চল্লিশ মিনিটের মধ্যে তারা পৌঁছালো থেম্বার কাছে। আঙুল দিয়ে জোন্স দেখালো, ঐ যে, ঐ গাছের নীচে থেম্বার থাকার কথা।

ফেনেল আবছা অন্ধকারে চারিদিক তাকালো।

জোন্স চিৎকার করে ডাকলো, থে-মবা—

ডানার শব্দ করে উড়ে গেলো এক ঝাক নিশাচর পাখী কোথায়

না হাসলো। কিন্তু থেম্বার গলা শোনা গেল না।

জোন্স এগিয়ে গেল গাছের কাছে। না, ভুল হয়নি তার। এই তো একরাশ শুকনো কাঠ জমা করে রাখা, এইখানে ছিলো জলের টিন, রাইফেল আর খাবারের টিনের ব্যাগটা গেল কোথায় সব।

ফেনেল গর্জন করে উঠলো ঠিক ভেগে পড়েছে আমাদের জিনিসপত্র নিয়ে।

না না, তা কখনও হতে পারে না, নিশ্চয়ই কিছু অঘটন ঘটেছে।

এটা কি! একটা জায়গা দেখিয়ে গ্যারী বলে উঠলো, সকলে তাকালো। সদ্য তোলা মাটির স্তূপ একটা, এগিয়ে গেল তারা সেদিকে। ক্রুপের ওপর থেম্বার ছড়ানো পালকের টুপিটা বসানো।

বুঝতে বাকি রইল না কার কবর ওটা! জোন্সই প্রথম কথা বললো, ওরা মেরে ফেলেছে ওকে–খাবার, জল, রাইফেল সব নিয়ে ওকে কবর দিয়ে রেখে গেছে! অনেকক্ষণ তারা নিঃশব্দে কবরের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।

গ্যারী–দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে বললো, আমাদের আর দেরী করা উচিত হবে না জোন্স। চারটে রাস্তার মধ্যে আমার দক্ষিণ দিকের রাস্তাটাই ধরার ইচ্ছা। ওরা ভাববে আমরা হয়তো পশ্চিম দিক দিয়ে যাবে–তাই ঐ পথেই যাবে ওরা, ভাগ্য ভালো থাকলে মনে হয় কোনক্রমে হয়তো পার হয়ে যেতে পারবো সীমানা, তোমরা কি বলে?

রাস্তার ওপর নির্ভর করে সব। কুমিরের রাজত্ব বলে তো জানি ও দিকটা!

তবু ঐ পথই ভালো। তোমার কাছে কম্পাস আছে তো?

পকেট থেকে কম্পাস বের করে জোন্স দিলো গ্যারীর হাতে। গ্যারী কম্পাসের দিক ঠিক করে নিলো।

যাত্রা শুরু হলো। প্রথমে গ্যারী, তার পেছনে গেঈ তার পেছনে ফেনেল আর জোন্স। কেউ কোনো কথা বললোনা। থেম্বার মৃত্যুতে সকলেই শোকাভিভূত। আশু বিপদের আশঙ্কায় পরস্পর পরস্পরের অনেকটা কাছে এগিয়ে আসতে পেরেছে।

তারা দ্রুত এগোতেলাগলো, সময় চারটে বেজে পঞ্চাশ। আর প্রায় দুঘণ্টা পরেই জুলুরা রওনা দেবে।

আরো মিনিট কুড়ি চলার পর গ্যারী কম্পাসে দিক ঠিক করলো। এ পথটা পশ্চিম দিকে বেঁকে গেছে ক্রমশ, আমরা রাস্তা ছেড়ে জঙ্গলের মধ্য দিয়ে এগোবো।

ঘন–গাছপালায় ঢাকা জঙ্গল। ইতস্ততঃ কাটাঝোঁপ, ঘাসগুলো, প্রায় মানুষের সমান উঁচু।

ফেনেল বললো, এই জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে যাবো কি ভাবে?

–কিছু করার নেই। দক্ষিণ দিকের একটাই পথ।

জোন্স বললো, এই জায়গাটা খুব সাপের উপদ্রব। সাবধানে দেখেশুনে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।

গেই গ্যারীর হাত চেপে ধরলো। গ্যারী সান্ত্বনা দিলো তাকে, ভয় নেই, আমি তো আছি।

উঁচু ঘাসের ভিতর দিয়ে আঁকাবাঁকা পথ। মাথার ওপর বাঁদর সমানে কিচির-মিচির করছে। তারা এগোতে লাগলো। গ্যারীকম্পাস নিয়ে বারবার দিক ঠিক করতে করতে এগোলো, কালেনবার্গ যখন ম্যাপটা দেখাচ্ছিলেন, সে দেখেছে, নদীটা দক্ষিণে জমিদারীর সীমানা পেরিয়ে একটা ছোট শহরের ভেতর দিয়ে এগিয়ে গিয়েছে।

 সঙ্গে জল আছে খুব সামান্য। নদীর কাছে গেলে সুবিধাই হবে সব দিক থেকে।

আরো তিন কিলোমিটার এগিয়ে এক গভীর জঙ্গলে এসে ঢুকলোর্তারা। গেঈ-এর হাত গ্যারীর মুঠের মধ্যে ধরা, বললো, কি খুব কষ্ট হচ্ছে?

–না, কষ্ট আর কি। আর কতখানি যেতে হবে আমাদের?

–খুব একটা বেশি নয়, আপাততঃ কুড়ি কিলোমিটার, তারপরই জমিদারীর সীমানা ছাড়িয়ে যাবো আমরা। দেয়ালের ম্যাপটা আমি খুব ভালোভাবে দেখেছি। এই পথটাই সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত।

ফেনেল বারবার পিছিয়ে পড়ছে, যন্ত্রপাতির ব্যাগের ওজন বড় কম নয়। ফেনেল বললো, এই বোঝা কাঁধে চাপিয়ে হাঁটলে কোনদিনই সীমানা পেরিয়ে যাওয়া যাবে না। সে কি ভেবে নিয়ে ব্যাগটাকে দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিলো, যাক, ব্যাগটা ফেলে দিয়ে বেশ হাল্কা লাগছে এখন।

সূর্যের মুখ দেখা গেলো, ততক্ষণে তাপ ধীরে ধীরে বাড়তে লাগলো। কাদা জল বাঁচিয়ে রোদের সেই অসহ্য তাপ মাথায় নিয়ে সতর্ক দৃষ্টি ফেলে ধীরে ধীরে তারা এগোতে লাগলো,

ঘড়িতে এখন কাটায় কাটায় সাতটা বাজে, ভয়ে-আতঙ্কে ওরা গতিবেগ বাড়িয়ে দিলো।

 জোন্স বলে উঠলো জলের গন্ধ পাচ্ছি যেন। নদীর কাছাকাছি এসে গেছি প্রায়।

আরো দশ মিনিট পর সত্যিই সত্যিই নদীর দেখা মিললো, নদীর পাড় চওড়া, পিচ্ছিল।

নদীটা পার হতে পারলে হতো। জোন্স বললো, খুব একটা গভীর বলে মনে হচ্ছে না। এমন কিছু চওড়া নয়, হেঁটেই পার হওয়া যেতে পারে। জুতো জামা খুলে সে মাটির ওপর জড়ো করে রাখলো। গাছের একটা ডাল ধরে ঝুলে পা দিয়ে জল মাপার চেষ্টা করলো।

মনে হয় গভীর আছে।সাতরে পার হতে হবে।ঝাঁপ দিয়ে পড়লো সেনদীর জলে, হাতের বড় বড় টানে জল কাটতে কাটতে এগিয়ে গেল ওপারের দিকে।

হঠাৎ ঘটলো এক অঘটন, তিনজন এপারে দাঁড়িয়ে অবাক বিস্ময়ে দেখলো সবটুকু। বিপরীত পারের মাথাগুলো নড়ে উঠলো হঠাৎ। বাদামী রঙের একটা কিছু গাছের গুঁড়ির মতো দেখতে অনেকটা মুহূর্তের মধ্যে লাফিয়ে পড়লো জলে ঠিক জোন্স এর সামনে। কাঁটা ভরা। লেজটা একবার জলের ওর প্রলম্বিত হলো মুহূর্তের জন্য। জো আর্তনাদ করে হাত পা ছেড়ে দিলো।

জলের নীচে নিমেষের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেলো। একটা প্রচণ্ড আলোড়ন, ঝটপটানি, ধীরে ধীরে জলের বাদামী রঙ পাল্টে প্রথমে ফিকে লাল, তারপর লাল, শেষে ঘন লাল হয়ে চারপাশে ছড়িয়ে পড়লো।

.

০৯.

 দুপুরে বৃষ্টি নামলো। গত প্রায় দুঘণ্টা ধরে রাশি রাশি কালো মেঘ এসে জমা হয়েছে আকাশে, সূর্য গেছে ঢেকে, চারিদিকে নেমেছে নিকষ কালো অন্ধকার। হঠাৎ বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটা গড়িয়ে পড়লো মেঘের গা বেয়ে। মুহূর্তের মধ্যে তিনজন ভিজে একাকার হয়ে গেলো।

গেঈর হাত ধরে গ্যারী ছুটলো জঙ্গলে একটু আশ্রয়ের জন্য। একটা বিরাট গাছের নীচে তারা দুজনে বসলো। ফেনেলও গালি দিতে দিতে এসে জুটলো। নদীর জল ক্রমশ বেড়ে চললো। গত চার ঘন্টা কেউ কোনো কথা বলতে পারেনি। জোন্স-এর আকস্মিক মৃত্যু সকলের মনে গভীর ছায়া ফেলেছে। কয়েকদিনের পরিচয়ে প্রত্যেকেই জোলকে ভালোবেসে ফেলেছিলো।

ক্ষণিকের জন্যও গেঈ ভুলতে পারেনি সেই দৃশ্য। জোন্স এর মুখের সেই ভয়াবহ অভিব্যক্তি বুক ফাটানো আর্তনাদ। সর্বক্ষণ সেই ভয়াবহ দৃশ্য তার মনের মধ্যে ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছে।

দুঃখ গ্যারীরও কিছু কম নয়। কিন্তু এখন শোক প্রকাশ করার সময় নয়। এক মুহূর্ত সময় নষ্ট করা মানে জুলুদের অনেকটা এগিয়ে আসতে সাহায্য করা। সুতরাং এখন থেমে এগিয়ে যাওয়াই কর্তব্য। সে তাই, না দাঁড়িয়ে ক্রন্দনরতা গেঈ-এর হাত ধরে একরকম টানতে টানতেই এগিয়ে চলেছে জঙ্গলের পথে।

তিনজনের মধ্যে সম্ভবত সবচেয়ে বেশি দুঃখ পেয়েছে ফেনেল, জোন্সকে তার পছন্দ হয়ে গিয়েছিল।

গাড়িটা খাদে গড়িয়ে পড়ার সময় তার ধৈর্য তার অমিত আত্মপ্রত্যয়–সবকিছু মুগ্ধ করে ফেলেছিলো ফেনেলকে। যেন মনে হয়েছিলো যে জোন্স তার কতদিনের বন্ধু।

গ্যারী মৃদুস্বরে গেঈকে বললো, বৃষ্টি হয়ে ভালোই হলো গেই, আমাদের পায়ের দাগ সব ধুয়ে মুছে যাবে এখন আর ওরা বুঝতে পারবে না আমরা কোন পথে এসেছি।

গেঈ উত্তরে শুধু হাত চেপে ধরলো গ্যারীর। শোকে-দুঃখে সে মুহ্যমান।

আরো মিনিট দশেকের পর বৃষ্টি কমে এলো। গ্যারী উঠে দাঁড়ালো আর এখানে নয়, এগোতে হবে আবার।নদীর পাড় ধরে তারা এগিয়ে চললো। ও পাড় ঘন-ঝোঁপ আর বড় বড় ঘাসে ঢাকা। কুমির লুকিয়ে থাকার আদর্শ আশ্রয়। জোন্স এর ঘটনা ঘটে যাবার পর ঝোঁপঝাড়ের কাছ দিয়ে আর নদী পার হওয়া ঠিক নয়। ফাঁকা মতো একটা জায়গা পেলে তবেই চেষ্টা করা যাবে একবার।

এবারে খেয়ে নেওয়া যাক, তারপর আবার এগোবো।গ্যারী জোন্স-এররুকস্যাক খুলে খাবারের টিন বের করলো, সেদ্ধ মাংস খানিকটা, তিন জনের জন্য সমান ভাগ করলো সে।

গেঈ অলস সুরে বললো, আমার ক্ষিধে নেই, আমি খাবো না।

গ্যারী তাকালো তার দিকে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলোমুখটা যেন কেমন সাদাটে, রক্তহীন, চোখ দুটো যেন বুজে আসছে।

গেঈ কিছু খেলোনা, গ্যারী আর ফেনেল ভাগ করে খেলো খাবারগুলো খেতে খেতে বারবার গ্যারী তাকালো গেঈর দিকে–গেই গাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে চোখ বুজে আছে চুপচাপ।

খাওয়া শেষ করে ওরা দুজন উঠে দাঁড়ালো। গেঈরকাঁধে হাত রেখে উঠতে বললোগারী। একরকম টেনেই তুলতে হলে তাকে শেষ পর্যন্ত।

কোনরকমে গ্যারী এবং গেঈ পাশাপাশি হাঁটতে লাগলো, ফেনেলের পিছনে পিছনে। গ্যারী হাত ধরল তার।

ফেনেল ফিরলো তাদের দিকে। দোহাই তোমাদের একটু পা চালিয়ে এসো, কোনরকমে তারা দুকিলোমিটার গেলো, গেঈ আর পারছে না। যেন সে ঘুমের মধ্যে হাঁটছে।

আরো তিন কিলোমিটার যাওয়ার পর একটু বিশ্রামের জন্য একটা জায়গা পাওয়া গেলো নদী এখানে সামান্য সঙ্কীর্ণ,দুপাশে মাটির পাড়, অনেকদূর বিস্তৃত ঝোঁপঝাড় পাড় থেকে অনেক দূরে।

-এখানেই নদী পার হবো আমরা। গেঈকে সেএনোলো এক গাছের ছায়ায়, আরো একটা গাছের ডাল ভেঙে নিয়ে আসি-সঙ্গের জিনিসগুলো তো ভিজতে দেওয়া যায় না।

গ্যারী চলে যেতে ফেনেল আড়চোখে তাকালো গেঈর দিকে। রোদ এসে পড়েছেতার হাতের আংটিটার ওপর, হীরেগুলো যেন জ্বলছে। ফেনেলের চোখে বিদ্যুৎ খেলে গেলো। সে আংটিটা খুলে নেবার জন্য গেস্টর দিকে এগিয়ে গেলো।

গ্যারী সেই মুহূর্তে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এলো হাতে একটা ডাল নিয়ে। ফেনেল সরে গেল গেঈর কাছ থেকে।

জুতো এবং রুকস্যাকগুলো গাছের ডালে দ্রুত বাঁধা হলো। এসো, গেঈকে ডাকলো সে, ডালটা তুমি ধরে থাকবে, আমি ঠেলে নিয়ে যাবো।

দুজনে জলেনামলো, ফেনেল দাঁড়িয়ে রইলো পাড়ে।কই, এবার তোকুমির এলোনা! ওপারে গিয়ে কাদার ওপর বসে পড়লো গেই। ফেনেল জলে নেমে ভয়ে আতঙ্কে দ্রুত সাতরে নদী পার হলো। গ্যারী ততক্ষণে ঝুঁকে পড়েছে গেঈর অচেতন প্রায় মুখের ওপর।

ফেনেলের গা বেয়ে জল ঝরছিল টস্ টস্ করে। কর্কশ গলায় সে বললো, কি ব্যাপার তোমাদের?

–দেখতেই তো পাচ্ছো, গ্যারী অচেতন গেইকে পাজাকোলা করে তুলে নিয়ে শুইয়ে দিলো এক গাছের ছায়ায়, জুতো আর রুকস্যাকগুলো নিয়ে এসো।

ফেনেল নিঃশব্দে আদেশ পালন করলো।

গ্যারী বললো, দুটো ডাল পাওয়া যায় নাকি দেখো, স্ট্রেচারের মতো করে বরং ওকে নিয়ে যাবো।

–তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে নাকি।ওকে বয়ে নিয়ে আমাদের এগিয়ে যাওয়া কি সম্ভব? তোমার ইচ্ছা হয় তুমি বয়ে নিয়ে যাও, আমি পারবো না।

গ্যারী কঠিন চোখে তাকালো তার দিকে, তার মানে তুমি বলতে চাও, ওকে এখানে ফেলে রেখে যাবো?

আলবাত, কেন যাবো না? ও আমাদের কে যে এত দরদ দেখাতে হবে? চলো সময় নষ্ট করে লাভ নেই।

গ্যারী বললো, তুমি যাও, ওকে ফেলে আমার পক্ষে যাওয়া সম্ভব নয়।

 বেশ, কম্পাস আর আংটিটা দাও আমাকে। আমি যাচ্ছি।

বেরিয়ে যাও–কোনটাই পাবে না।

ফেনেল সবল হাতে ঘুষি ছুড়লো গ্যারীর দিকে, গ্যারীও ফেনেলের চোয়ালে ঘুষি মারলো। আঘাত সামলাতে না পেরে ফেনেল চিত হয়ে পড়লো মাটিতে।

ফেনেল মাটি হাতড়ে তুলে নিলো একটা পাথর–মাথার কাছেই মাটিতে গেঁথে ছিলো সেটা নিমেষে ছুঁড়ে মারলো গ্যারীর মাথা লক্ষ্য করে। আচমকা আঘাতের জন্য প্রস্তুত ছিলো না গ্যারী। চোখ ধাধিয়ে গেলো তার–অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে গেলো।

ফেনেল বহু কষ্টে উঠে দাঁড়ালো, পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলো গ্যারীর দিকে, পকেট হাতড়ে কম্পাসটা বার করে নিলো। এবার সে এগিয়ে গেলো গেঈ-এর দিকে, এক ঝটকায় তার আঙুল থেকে আংটিটা খুলে নিলো। তারপর দাঁত বার করে হাসতে হাসতে বললল, চললাম কম্পাস আর আংটি নিয়ে, এখানে দুজনে মবো। জুলুদের হাতে না পড়লেও শকুন তোমাদের টুকরে খাবে।

আর দেরী না করে অবশিষ্ট খাবারের রুকস্যাকটা তুলে নিলোকাঁধে, তারপর দুজনের উদ্দেশ্যে থুতু ছিটিয়ে এগিয়ে চললো অন্ধকার জঙ্গলের দিকে।

অনেকক্ষণ পর গ্যারীর জ্ঞান ফিরলো। একটা ছায়া সরে গেলো, তারপর আর একটা, আরও একটা, মাথার ওপর গাছের দিকে তাকিয়ে ভয় পেলো সে। পাতার আড়ালে দুটো শকুন। গ্যারীর মেরুদণ্ড বেয়ে শীতল স্রোত নেমে গেলো।

গ্যারী সার্টের পকেটে হাত দিয়ে দেখলো কম্পাস নেই। বহু কষ্টে টলতে টলতে গিয়ে দাঁড়ালো গেঈ-এর সামনে, গেঈ-এর চোখ মুখ রক্তাভ, কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। অনড়, অচল হয়ে পড়ে আছে একই রকম ভাবে, ডান হাতের বুড়ো আঙুল থেকে আংটিটা অদৃশ্য।

বসে পড়লো সে গেঈ-এর পাশে। আরো ষাট কিলোমিটার জলাভূমি পেরোলে তবেই সেই শহরটাতে পৌঁছানো সম্ভব। খাবারের রুকস্যাকটা নেই, জলও নেই। ফেনেল সব সঙ্গে নিয়ে গেছে।

ঘড়িতে এখন বিকেল চারটা, গেঈকে বড় অসুস্থ দেখাচ্ছে। এই নির্জন বনভূমিতে কি করবেই বা সে ওকে নিয়ে, কার কাছে সাহায্য চাইবে!

ধীর ধীরে চোখ মেললো গেঈ, গ্যারী জানালো যে, কম্পাস আর আংটি নিয়ে ফেনেল চলে গেছে।

জানি, তুমি কিছু ভেবো না। গেঈ গ্যারীর হাতটা তুলে নিলো তার হাতের মধ্যে।

হঠাৎ একটা শব্দে দুজনেই মাথার ওপর তাকিয়ে দেখলো একটা শকুন মগডাল থেকে নেমে এসেছে নীচের ডালে-গলা বাড়িয়ে আছে।

গ্যারী রক্তাক্ত পাথরটা হাতে তুলে নিলো, ছুঁড়ে মারলো ডাল লক্ষ্য করে। শকুনটা ডানা ঝটপটিয়ে উড়ে গেলো।

ও বুঝতে পেরেছে আমি মরতে বসেছি। আমি আর বাঁচবোনা গো, তুমি বরং চলে যাও এখান থেকে–আমার জন্যে তুমি কেন জুলুদের হাতে প্রাণ দিতে যাবে? কি যে হলো আমার বুকটা যেন টুকরো টুকরো হয়ে ছিঁড়ে যাচ্ছে, পা দুটো কি ঠাণ্ডা মাথাটা ভারী হয়ে আছে, উঃ!

গ্যারী গেঈর পায়ে হাত দিলো। বরফের মতো ঠাণ্ডা তার পা, বললো, তা বলে আমি তো তোমাকে ফেলে যেতে পারি না।

গ্যারী মনে মনে ভাবলো তাহলে গেঈ কি বাঁচবে না? এই ঘন জঙ্গলে গেঈ পাশে থাকলে তবুও সাহসে ভর করে এগোনো সম্ভব, কিন্তু একা একা!

এই অবস্থায় ভগবানকে স্মরণ করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। সে গেঈ-এর মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলল, দেখো, আমি বলছি তুমি ঠিক সেরে উঠবে।

এমন সময় গাছের ডালে আবার শব্দ শকুনটা আবার এসে বসেছে।

গেঈ গ্যারীর একটা হাত চেপে ধরে বললো, তুমি আমার একটা কথা রাখবে? আমি আর বাঁচবো না, মরার আগে আমি উইল করে যেতে চাই, তুমি আমাকে বলেছিলে–সব কিছু টাকার ওজনে মাপতে নেই। ঠিকই বলেছিলে তুমি, টাকাকে যদি বড় করে না দেখতাম তাহলে হয়তো এখানে এসে এরকম ভাবে মরতাম না। তোমার কাছে কাগজ কলম আছে গ্যারী?

গেই অসহায়ের মতোকাঁদতে শুরু করলো, গ্যারী-তুমি তো বুঝতে পারছেনা, কথা বলতে আমার কত কষ্ট হচ্ছে। বুক যেন ফেটে যাচ্ছে লক্ষ্মীটি আমার, আমাকে উইল করতে দাও, দোহাই তোমার!

রুকস্যাক হাতড়ে একটা নোটবুক আর পেন বের করলো গ্যারী।

–উইলটা নিজের হাতেই লিখবো। সুইস ব্যাঙ্কের ম্যানেজার আমার হাতের লেখা চেনেন। গেঈ বহু কষ্টে সোজা হয়ে চিঠিটা লিখতে লাগলো। লেখা শেষ করে গ্যারীর হাতে দিলো সে নোটবুকটা।

আমার সব সঞ্চয় তোমাকে দিয়ে গেলাম গ্যারী, বার্ন-এ আমার অ্যাকাউন্টে প্রায় এক লক্ষ ডলার জমা আছে। ডঃ ফাস্ট সেখানকার ডাইরেক্টর। ওঁর সঙ্গে দেখা করে সব বলো তুমি। কিভাবে আমরা এখানে এলাম, আমার কি হয়েছে, কালেনবার্গের মিউজিয়ামে কি কি আছে কিছু যেন বাদ দিও না। যা করার সব তিনি করবেন। এই উইলটা তাকে দিও, তিনি তোমাকে সব কিছু দেবার ব্যবস্থা করবেন।

–আচ্ছা সে সব হবেখন। তুমি এবার একটু বিশ্রাম করো দেখি।

গ্যারী মুখ নামিয়ে তপ্ত চুম্বন এঁকে দিলো গেঈর ঠোঁটে।

আরো তিন ঘণ্টা পর। সূর্য তখন দিনের শেষ আভা মেলে পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়েছে। গেই মারা গেলো, ডান হাতের বুড়ো আঙুলের ছড়ে যাওয়া জায়গাটা তাঁর বা গ্যারীর কারুর নজরে পড়লো না। পড়লে বুঝতে বার্জিয়া আংটি তার বিষের ছোঁয়ায় আরও একটি প্রাণ হরণ করলো।

.

গত দুঘণ্টা ধরে সমানে হাঁটছে ফেনেল, রোদের সেই প্রচণ্ড তেজ, বনের সেই গভীর নিস্তব্ধতা এবং সর্বোপরি সেই নির্জন একাকীত্ব তার বিশ্রী লাগছিল। তবু সান্ত্বনা এই যে-সীমানার প্রায় কাছাকাছি চলে এসেছে সে। সীমানা পার হতে পারলেই তার সমস্ত কষ্টের শেষ হবে। হাজার ভাবনা তার মনে ভিড় করলো।

স্যালিকের অফিসে গিয়ে যখন আংটি দেখাবো কি অবস্থাই না হবে! স্যালিক যদি ভেবে থাকে নহাজার ডলার দিলেই আংটিটা তার হাতে পৌঁছবে তবে মূর্খতারই পরিচয় দেবে সে। আগে স্যালিক আমাকে চারজনের ফি বাবদ মোট ছত্রিশ হাজার ডলার দেবে–তবেই পাবে সে আংটিটা। তারপরনগদ ছত্রিশ হাজার ডলার পকেটে নিয়ে সোজানাইমস-এ। একটু নিরিবিলিতে না বেড়িয়ে এলেই নয়।

গেঈ আর গ্যারী গেছে-আপদ গেছে। উচিত শাস্তি হয়েছে। মরুক ওখানে পড়ে পড়ে।

সূর্য আস্তে আস্তে ঢলে পড়েছে। তার একটা রাতের আস্তানা খুবই দরকার। খুঁজতে খুঁজতে অবশেষে মনের মত একটা জায়গা মিললো। হেলান দিয়ে বসা যাবে বেশ। তাছাড়া বৃষ্টি এলে মাথা বাঁচানোও যাবে।

ক্ষিধে পেয়েছে বেশ। রুকস্যাক থেকে মাছ ভাজার টিনটা খুলে বসলো সে। শুকনো কাঠপালা জোগাড় করে আগুন জ্বাললো।

রাতের অরণ্য জেগে উঠলো ধীরে ধীরে। কোথাও মৃদু শব্দ কোথাও পায়ের চাপে শুকনো পাতা গুঁড়োবার শব্দ। গাছের ওপর বাদুড়ের ডানার ঝটপটানি।বাঁদরের কিচিরমিচির-সবমিলিয়ে এক আশ্চর্য রোমাঞ্চকর–পরিবেশ।

ফেনেলের চোখের পাতা বুজে আসতে চাইছে। চোখ বুজলো সে। মুহূর্তে সমস্ত বনভূমির যাবতীয় শব্দ সরব হয়ে উঠলো তার কানের পর্দায়। ভয়ে আতঙ্কে চোখ মেলে আগুনের আভায় দূরের ঝোঁপঝাড়ের দিকে তাকালো। জুলুরা আবার আগুন দেখে ধরে ফেলবেনা তো! ফেনেলের মেরুদণ্ড বেয়ে হিমস্রোত নেমে গেলো একটা। না, আগুন জ্বালাটা বোকামি হয়েছে। দূর থেকেই আগুন চোখে পড়ে। সে আর দেরী না করে আগুন নিভিয়ে দিল। কালো চাদরের মতো অন্ধকার নেমে এল।

প্রায় এক ঘণ্টা সে জেগে রইলো। এক একটা শব্দে চমকে চমকে উঠলো বারবার। চোখের পাতা ভারী হয়ে এলো। একসময় ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়লো।

হঠাৎ ধড়মড় করে উঠে বসলো ফেনেল। কেমন একটা আতঙ্ক পেয়ে বসেছে তাকে। বিপদের গন্ধ যেন পাওয়া যাচ্ছে। বিপদে সতর্ক হবার এক সহজাত প্রবৃত্তি তার আছে। সেই প্রবৃত্তিটাই যেন তাকে ঘুম থেকে তুলে দিলো।

কে যেন পায়ে পায়ে এগিয়ে আসছে। শুকনো পাতার শব্দ হচ্ছে। হাতড়ে হাতড়ে মোটা লাঠিটা পেলো সে–শক্ত মুঠোয় চেপে ধরে প্রস্তুত হয়ে রইলো।

টর্চের কথা তার এতক্ষণ মনেই ছিলো না। পাশেই রেখে দিয়েছিলো। নিমেষে টর্চটা তুলে সুইচ টিপলো সে।

আলো গিয়ে সোজা পড়লো জন্তুটার গায়ে। মুখটা শেয়ালের মতো, বসার ভঙ্গীতে শিকারী কুকুরের ক্ষিপ্রতা, শিউরে উঠলো ফেনেল। হায়নাটা আর একটু হলে লাফিয়ে পড়তো তার উপর।

আলো দেখে জন্তুটা মুহূর্তের মধ্যে অদৃশ্য হলো। ফেনেল ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়ালো। টর্চের আলোটা আর একটু দূরে ফেললো সেদুটো জ্বলজ্বল চোখ ঝোঁপের আড়ালে অদৃশ্য হলো।

ঘড়িতে তিনটে বাজে, আর ঘুম নয়। আর এক ঘণ্টা পর মোটামুটি আলো ফুটবে। এই এক ঘণ্টা জেগে থাকাই ভালো। আবার বসলো সে মাটিতে। হেলান দিলো গাছে।

হঠাৎ রাত্রির নীরবতা ভেঙে টুকরো টুকরো করে ভেসে এলো এক উচ্চ হাসির শব্দ–হি হি হি হি ।

রক্ত হিম করা উন্মত্ত সেই হাসি। ফেনেলের চুল খাড়া হয়ে উঠলো, ভয়ে গলা শুকিয়ে গেল। আবার শোনা গেলো সেই হাস্যরোল হি হি হিহি হিহি–ক্ষুধার্ত হায়নাটা ডাকছে।

দুঃখে হতাশায় চোখ ফেটে জল এলো ফেনেলের, বাকি রাতটুকু জেগেই কাটিয়ে দিল সে।

ধীরে ধীরে আলো ফুটলো। ফেনেলের শরীর অশক্ত, পেশীতে অসহ্য যন্ত্রণা। সারারাত ঠায় বসে কেটেছে, এখন একটু বিশ্রামের একান্ত প্রয়োজন, কিন্তু এখন বিশ্রাম করার সময় নেই।

হাঁটতে শুরু করলো ফেনেল। মন্থর গতিতে কোনোক্ৰমে অশক্ত শরীরটাকে নিয়ে চললো টানতে টানতে। ঘণ্টা দুই হাঁটার পর এক গাছতলায় বসে পড়লো সে। টিন খুলে খাবার খেলে, জলের বোতল থেকে জল খেলল একটু। আবার হাঁটতে শুরু করলো। আরো খানিকটা এগিয়ে কম্পাস বের করলো সে। একি! এগগাবার কথা দক্ষিণ দিকে অথচ সে এগোচ্ছে দক্ষিণ পশ্চিমে। কখন ঘুরতে ঘুরতে ভুল পথ ধরে ফেলেছে সে। বড় বড় ঘাস, জলা জমি–কোথায় সাপ-খোপ লুকিয়ে আছে কে জানে!

তবু না গেলে উপায় নেই। হাতের লাঠি দিয়ে ডালপালা, ঘাস ঝোঁপঝাড় সরাতে সরাতে সে এগোলো। সমস্ত শরীর বেয়ে তার ঘাম ঝরছে। অসম্ভব রোদের তেজ। একটু বিশ্রামের ভীষণ দরকার এখন।

ঘুমোলে মন প্রাণ অনেক তাজা হবে। দেহে নতুন শক্তি আসবে। দিনের বেলা তো আর হায়না নেই, শুধু জুলুদের নিয়েই যা ভয়।

মনের মতো জায়গা সে একটা খুঁজে বের করলো।

বিরাট একটা গাছের গুঁড়ি, মাঝখানটা ফাঁকা। সে শুয়ে পড়লো। রুকস্যাক দিয়ে বানালো মাথার বালিশ। রাত্রি জাগরণের ক্লান্তি মোচন করতে তার চোখ ভরে নামলো নিশ্চিন্ত ঘুম।

হঠাৎ জঙ্গল থেকে হায়নাটা বেরিয়ে এসে ঘুমন্ত ফেনেলকে দেখলো, দুদিন ধরে সে উপোসী, শিকার জোটাতে পারে নি। তাই মরিয়া হয়ে দিনের আলোয় বেরিয়েছে। ফেনেলের দিকে তাকিয়ে সে দাঁড়িয়ে রইলো।

এবার আর ফেনেলের ঘুম ভাঙলো না। এত ক্লান্ত এত পরিশ্রান্ত সে যে বিপদে সতর্ক হবার সহজাত প্রবৃত্তি তার হারিয়ে গেছে। হায়নাটা দীর্ঘ আধঘণ্টা অপেক্ষা করে পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলো। পেছনের দুপায়ে ভর করে একবার শরীর তুললো তারপর প্রচণ্ড শক্তিতে আছড়ে পড়লো ফেনেলের ডান পায়ের হাঁটুর ওপর।

নিদারুণ যন্ত্রণায় আর্তনাদ করে উঠলো ফেনেল, ঘুম ভাঙলো তার, উঠতে চেষ্টা করলো কয়েকবার, কিন্তু পারলোনা। ঘাড় কাত করে তাকালো পায়ের দিকে হাঁটুর মালাইচাকিটা উধাও। রক্তে মাখামাখি হয়ে কয়েক টুকরো সাদা হাড় পড়ে আছে সেখানে।

যন্ত্রণায় গোঙাতে গোঙাতে চারিদিকে তাকালো ফেনেল। দৃষ্টি স্থির হলো হায়নাটার ওপর। সে পরম তৃপ্তিতে চিবোচ্ছে তার হাড়-মাংস। গল গল করে রক্ত ঝরছে ক্ষতস্থান থেকে, ব্যথায় কুঁকড়ে গেলো ফেনেলের শরীর।

সমস্ত শক্তি সঞ্চয় করে সে চীৎকার করে উঠলো। কে আছো বাঁ-চা-ও।

সেই গভীর ঘন অরণ্যেতার বুকফাটা আর্তনাদ ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হতে হতে একসময় হারিয়ে

ফেনেল আর একবার চীৎকার করার চেষ্টা করলো। গলা দিয়ে ঘড়ঘড় আওয়াজ বের হলো এবার, যন্ত্রণা শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে ছড়িয়ে পড়লে সমস্ত শরীরে। ধীরে ধীরে তাঁর চেতনা অবলুপ্ত হয়ে এলো।

ফেনেল নিঃশব্দে শুয়ে রইলো, নড়াচড়ার শক্তি তার নেই। যন্ত্রণায় গোঙাতে গোঙাতে সে তাকালো আকাশের দিকে। একদল শকুন ঘাড় উঁচু করে তার দিকে তাকিয়ে আছে।

হায়না ঝোঁপ থেকে বেরিয়ে এলো আবার পেছনের দুপায়ে ভর করে ঝাঁপিয়ে পড়লো ফেনেলের পেটের উপর–তী দাঁতের আঘাতে বের করে আনলো সমস্ত নাড়িভুড়ি। তীব্র যন্ত্রণায় ফেনেল চীৎকার করে উঠলো, এ তার শেষ আর্তনাদ–সেই আর্তনাদ আকাশ বাতাসে ছড়িয়ে পড়লো।

বনে জঙ্গলে কম দিন কাটলো না নোগুমেন-এর। কালেনবার্গ-এর জমিদারীতে কাজ করার সময় জঙ্গল পাহারা দিতে হতো। চাকরিটা তার নিজের দোষেই গেছে। সে যাই হোক, এখন সে জঙ্গলেই ফিরে এসেছে জীবিকার সন্ধানে। দক্ষিণ দিকে নদীর আশেপাশে ঘুরে বেড়ায় নিয়ত। সাপ মারে, কুমির মারে। চামড়া নিয়ে যায় মেনভিলেদাম ভালোই পাওয়া যায়।

 সেদিন দক্ষিণ দিকের জঙ্গলের পথ ধরে এগোচ্ছিলো সে সন্তর্পণে নদীর দিকে। থমকে দাঁড়ালো হঠাৎ কে যেন চীৎকার করে উঠলো কাতর গলায়। বহুদিনের পুরোনো রাইফেলটা বাগিয়ে ধরে পায়ে পায়ে সে এগোলো শব্দ লক্ষ্য করে। দৃষ্টি স্থির হলে গাছটার নীচে-ফেনেলের শরীরের অবশিষ্ট অংশটুকু নিয়ে তখন কাড়াকাড়ি করছে দুটো শকুন।

.

ধীর মন্থর গতিতে গ্যারী এগিয়ে চললো নদীর পাড় ধরে। রোদের অসহ্য তাপ, সাবধানে সন্তর্পণে পায়ের দিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখে সে এগোতে লাগলো।

কম্পাস ছাড়া সীমানা পার হবার চেষ্টা অসম্ভব–পায়ে পায়ে–বিপদের সম্ভাবনা। জঙ্গলের পথনা ধরে তাই সেনদীর পাড় ধরেই এগিয়ে চলেছে। নিরাপদে সীমানা পার হয়ে ছোট শহরটিতে ঢোকার এইটাই একমাত্র পথ। অবশ্য অসুবিধা যে নেই তা বলা যায় না। কুমিরে টেনে না নিয়ে গেলেও জুলুদের হাতে পড়ার সম্ভাবনা আছে। তবু ভবিষ্যৎ না ভেবে গ্যারী ভাগ্যের হাতে নিজেকে সমর্পণ করে এগিয়ে চলেছে।

গেঈকে নদীতে ভাসিয়ে দিয়ে সে রাতের মতো আর এগোয়নি গ্যারী। দুঃখে ক্লান্তিতে শুয়ে পড়েছিলো জঙ্গলের একটা নিরাপদ জায়গা বেছে। বন্য-জন্তুর দুশ্চিন্তা সে একেবারেই করেনি। ভোর পাঁচটা পর্যন্ত সে ঘুমিয়েছে। ঘুমের মধ্যে বার বার গেঈ-এর ক্লান্ত রোগাক্রান্ত মুখটা ভেসে। উঠেছে।

ভোর পাঁচটা থেকে সে আবার হাঁটতে শুরু করেছে। দেখতে দেখতে চার ঘণ্টা পার হয়ে গেলো। ক্ষুধায়-তৃষ্ণায় তার বুক একেবারে শুকিয়ে গেছে। সম্বলের মধ্যে আছে চার প্যাকেট সিগারেট, একের পর এক তাই খেয়ে চলেছে।

হিসাব মতে ফেনেল-এর এতক্ষণে মেনভিল থেকে জোহান্সবার্গে রওনা হবার কথা। সেখান থেকে সোজা লন্ডনে পৌঁছে স্যালিককে আংটিটা দিয়ে টাকা হাতিয়ে আর কি দাঁড়াবে। সেখানে!

সে আরো ভাবতে লাগলো যে, আংটিটা একবার স্যালিক-এর হস্তগত হলে তার হাত দিয়ে কি আর জল গলবে! গ্যারীকে কি আর দেবে সেন হাজার ডলার। সে যাই হোক না দেয় বয়েই গেলো। একবার ইংল্যান্ডে যেতে পারলেই হয়–গেঈ-এর এক লাখ ডলার তুলে স্বচ্ছন্দেই দিন কাটবে তার। ইলেকট্রনিক্স-এর ট্রেনিংটা শেষ করে একটা কোম্পানি খুলে বসতে তার বেগ পেতে হবে না।

দুপুরে ঘণ্টাখানেক বিশ্রাম করে আবার চলা শুরু করলো গ্যারী। সন্ধ্যে পর্যন্ত পঁচিশ কিলোমিটার যেতে পারলো সে। এখনো তার তিরিশ কিলোমিটার পথ যেতে বাকি। জঙ্গলের পথনা ধরে নদীর পাড় দিয়ে এগোনো অনেক সোজাই হয়েছে বলতে হবে। এতে পথ হেঁটে এখন সে ক্লান্ত বোধ করছে। একটু বিশ্রামের প্রয়োজন তার।

জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে নিরাপদ একটি জায়গা বেছে শুয়ে পড়লো সে। ক্লান্তিতে সে ঘুমিয়ে পড়লো। ঘুম ভাঙতে আবার সে চলতে শুরু করলো। একটু গতিবেগ বাড়ালে আজ জমিদারীর সীমানা ছাড়িয়ে ছোট শহরটিতে ঢুকতে পারবে সে।

সামনে একটা বাঁক।নদীটা মোড় নিয়েছে ডাইনে। অন্যমনস্ক ভাবে এগোতে গিয়ে হঠাৎ থমকে দাঁড়ালো সে। ওটাকি!নদীর পাড়ে আটকে আছে! ক্ষুধা তৃষ্ণা ভুলে গ্যারী সেইদিকে দৌড়োলো। ছোট্ট একটা ডিঙি। উল্লাসে আনন্দে বা শক্তি রহিত হলো তার। ডিঙির পাটাতনে পড়ে আছে এক জুলু। লোকটা বেঁচে নেই। মারা গেছে।

জুলুর ডান হাতের দিকে নজর পড়তেই বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলো সে। তার ডান হাতের তর্জনিতে গাছের পাতার আড়াল থেকে বোদ পড়ে ঝিঁঝিক্ করে উঠছে বার্জিয়া আংটির হীরেগুলো।

.

লন্ডনের বিমান বন্দরে শুল্ক বিভাগের নিয়ম কানুন সেরে বেরিয়ে গ্যারী আর দাঁড়ালো না, সোজা গিয়ে ঢুকলো টেলিফোন ঘরে। টনিরনম্বর ডায়াল করলো। সকাল সাড়ে দশটা হতে চললো টনির কি ঘুম ভেঙেছে এখন। কয়েক মিনিট পর ওপাশ থেকে ঘুমে জড়ানো টনির স্বর ভেসে এলো। গ্যারীতাড়াতাড়ি বললো,টনি, আমি গ্যারীকথা বলছি। আমি এই মাত্র নেমেছি জোহান্সবার্গ এর প্লেন থেকে।

তাই নাকি! আনন্দে-উল্লাসে টনি বোধহয় উঠে বসলো বিছানায়, গ্যারী ডার্লিং–আমি ভেবেছিলাম, সেই মেয়েটা বোধ হয় তোমাকে এতদিনে তুকতাক করে ফেলেছে…

বাদ দাও ওসব। শোনন, আগামীকাল আমি বার্ন-এরওনা হবো, তুমি থাকবে আমার সঙ্গে বুঝলে?

-কতদিন থাকবে ওখানে?

বার্ন-এ দিন কয়েক, ওখান থেকে যাবো ক্যাপরিতে, হপ্তা দুয়েক থাকবে সেখানে-স্রেফ বেড়াবো।

–যদিও যেতে ভীষণ ইচ্ছা করছে, কিন্তু যাই কিভাবে। বড় জোর দিন তিনেকের ছুটি আদায় করা যাবে। তাই বলে এতদিন। কাজকর্ম তো করতে হবে, না কি?

যাই হোক, ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে তোমার ফ্ল্যাটে যাচ্ছি আমি। সে ফোন ছেড়ে দিলো।

একটা ট্যাক্সি ডেকে মালপত্র নিয়ে উঠে বসলো গ্যারী। ড্রাইভারকে রয়্যাল টাওয়ার্স হোটেলে যেতে বললো।

মালপত্র দারোয়ানের কাছে রেখে সেখান থেকে স্যালিককে খবর পাঠিয়ে ওপরে উঠেস্যুইটের দরজা ঠেলে বাইরের ঘরে ঢুকলো গ্যারী। সোনালী চুলের একটি মেয়ে স্যালিকের কামরার দরজা খুলে দিলো।

গ্যারী ঘরে ঢুকলো। স্যালিক বসেছিলেন তার ডেস্কে–মুখে সিগার, থলথলে হাত দুটো টেবিলের ওপর ন্যস্ত।

সুপ্রভাত মিঃ এডওয়ার্ডস। তিনি গ্যারীর চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন, আংটিটা এনেছেন?

–এনেছি। টেবিলের সামনে একটা চেয়ারে বসলো গ্যারী।

–এনেছেন, ধন্যবাদ। আর তিনজন? তারা কোথায়? কখন আসছেন তারা?

–তাঁরা আর আসবেন না। তারা কেউ বেঁচে নেই, সবাই মারা গেছে।

মারা গেছেন! চোখ ছোট ছোট হলো স্যালিকের, মিস্ ডেসমন্ডসে ও?

–হ্যাঁ সকলেই মারা গেছে।

 স্যালিক অধৈর্য হলেন, আর দুজন সম্পর্কে তাঁর বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই, কি হয়েছিলো গেঈর?

–খুব সম্ভবত কালাজ্বর–জঙ্গলে পোকামাকড় হাজারো রকমের–মারা গেলেন শেষে।

স্যালিক নিঃশব্দে জানলার দিকে তাকিয়ে রইলেন। গেঈর মৃত্যু সংবাদ তাকে বড় আঘাত দিয়েছে।

কিছুক্ষণ পর তিনি গ্যারীর দিকে ফিরে তাকিয়ে বললেন, কি করে বুঝবো যে আপনি সত্যি কথা বলছেন? বাকি দুজন কিভাবে মরলেন?

বিশ্বাস করা, না করা আপনার মর্জি, মিঃস্যালিক, গ্যারীঅন্য দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলো, জোন্স কুমিরের পেটে গেছে আর ফেনেলের কি হয়েছে সঠিক বলতে পারি না। খুব সম্ভবত সে মরেছে এক জুলুর হাতে। ফেনেলের রুকস্যাক এবং আংটিটা নিয়ে জুলুটাকে আমি মরে পড়ে থাকতে দেখেছি। ফেনেল আংটি আর কম্পাস নিয়ে আমাকে আর গেইকে ফেলে একলাই এগিয়ে গিয়েছিল। আমি বেঁচে ফিরে আসলেও গেঈ ফিরতে পারে নি।

স্যালিক চেয়ারে বসে পড়লেন। ভিজে হাতের তালু রুমালে মুছলেন। গেঈর জন্য দশ লক্ষ ডলারের একটা কাজ হাতছাড়া হয়ে গেলো তার। ভেবে রেখেছিলেন,ফিরে এলেই কাজটা করাবেন তাকে দিয়ে। দুঃখের বদলে রাগে আপাদমস্তক জ্বলে গেলো তার।

কই আংটিটা দিন।

গ্যারী পকেট থেকে একটা দেশলাইয়ের বাক্স বের করে ঠেলে দিলো স্যালিক-এর দিকে। স্যালিক আংটিটা বাক্স থেকে বের করে টেবিলের ওপর রাখলেন। তৃপ্তিতে মন ভরে উঠলো তার। সেফ মাথা খাঁটিয়ে চারটে লোককে দাবার খুঁটির মতো চালিয়ে পাঁচ লক্ষ ডলার রোজগার-এ কম কথা নয়।

আংটিটা খুঁটিয়ে দেখে সন্তুষ্ট হয়ে চোখ তুললেন স্যালিক, ঝামেলা যে আপনাদের কম পোয়াতে হয়নি বুঝতে কষ্ট হচ্ছে না আমার। যাই হোক, আপনারা আমার জন্য যে কষ্ট করেছেন তার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। আপনাকে ঠকাবো না আমি। পুরস্কার হিসাবে আপনার ফি দ্বিগুন করে দেবো। তার মানে আপনি পাবেন মোট আঠারো হাজার ডলার, খুশি তো?

 গ্যারী মাথা নাড়লো, দরকার নেই,নহাজার যথেষ্ট। আপনার টাকা যত কম নিতে পারি, ততই মঙ্গল।

স্যালিক এক মুহূর্ত গ্যারীর চোখের দিকে তাকিয়ে নীচু হয়ে ড্রয়ার খুলে একটা লম্বা খাম বের করে ছুঁড়ে দিলেন গ্যারীর দিকে।

গ্যারী খামটা তুলে নিলো–গুণে দেখারও প্রয়োজন বোধ করলো না। বুকপকেটে খামটা রেখে চেম্বার ঠেলে উঠেদরজার দিকে এগোলো, তারপর সোজা গিয়ে লিফটের বোতাম টিপলো। টনিকে দেখবার জন্য তার মনটা বড়ই ব্যাকুল হয়ে রয়েছে।

স্যালিক বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে রইলেন। গেঈ-এর জন্য মনটা তার ভারাক্রান্ত হয়ে রয়েছে। তবু ভালো, মেয়েটার আত্মীয়-স্বজন কেউ নেই। প্রশ্নের পর প্রশ্নে তাকে অকারণ ব্যতিব্যস্ত হতে হবে না। মেয়েটা তার জীবনে এসেছিলো, যতদিন বেঁচে ছিলো উপকারই করেছে। এখন নেই যখন আর চিন্তা করে লাভ নেই।

আংটিটা বাঁ হাতে তুলে নিয়ে ডায়াল ঘোরালেন টেলিফোনের। হীরেগুলো চমৎকার-ওপাশে টেলিফোন বাজলোতর্জনীতে তিনি আংটিটা গলিয়ে নিলেন–উঃ, ছুঁচের মত কি যেন একটা বিধলোতাড়াতাড়ি আংটি খুলে টেবিলে রেখে দিলেন তারপর আঙুলের দিকে তাকিয়ে দেখলেন ছড়ে গিয়ে রক্ত পড়ছে–ক্রি-রি-রিং ক্রি-রি-রিং-উঁচটায় তাহলে এখনও আঙুল ছড়ে রক্ত পড়ে–আঙুলটা নিয়ে তিনি জিভ দিয়ে চুষতে লাগলেন– ক্রি-রি-রিং ক্রি-রি-রিং-টেলিফোন বেজেই চলেছে–চারশো বছরের পুরনো বিষটা এতদিনে নিশ্চয় শুকিয়ে গেছে–ক্রি-রি-রিং ক্রি-রি-রিং–মার্সিয়েল কি বাড়ি নেই..রক্তটা এখনও ঝরছে, আবার তিনি আঙুলটা মুখের মধ্যে নিয়ে চুষতে লাগলেন। ক্রি-রি-রিং…ক্রি-রি-রিং টেলিফোন বেজেই চললো তিনি ভাবতে লাগলেন যে–আংটিটা পাওয়া গেছে এই আনন্দের সংবাদ শুনে মার্সিয়েল কি খুশিই না হবে!