মেক দ্য করপস ওয়াক
গ্রীষ্মের এক সুন্দর রাত। সময় এখন এগারটা বেজে কিছুক্ষণ মাত্র। একটা কালো আর ক্রোমিয়াম রংয়ের রোলস রয়েস ক্লার্জে স্ট্রিট থেকে কার্জন স্ট্রিটে এগিয়ে শেফার্ড মারকেটের দিকের সরু পথের ধারে এসে গাড়িটা দাঁড়িয়ে গেল।
খেকশিয়ালের চামড়ার কোট পরা দুটো যুবতী মেয়ে আবছা আলোছায়ার ভেতর ঘোরাঘুরি করছিল। তারা উৎসুক চোখে ব্যবসায়িক আগ্রহে রোলস রয়েসটাকে দেখতে লাগল। প্রচুর অর্থের মালিক হবার স্বপ্ন তাদের মনে ঈর্ষার মনোভাব জাগিয়ে তুলছিল।
সমস্ত কার্জন স্ট্রিট জনমানবশূন্য দুটি যুবতীনারী এবং রোলস রয়েসটা ছাড়া। লন্ডনের পশ্চিম প্রান্তের রাস্তা গুলোতে কোন কারণ অকারণ ছাড়াই হঠাৎ নিস্তব্ধতার দৃশ্য লক্ষ্য করা যায়।
দুজনের মধ্যে দীর্ঘাঙ্গী মেয়েটি বলল, মনে হচ্ছে আমাদের চাইছে, তাই না?
স্বর্ণকেশী মেয়েটি তার এই আশার কথা শুনে মুখ টিপে হাসল এবং তার ছোট্ট টুপীটার নীচে ঝুলে থাকা কোঁকড়ান চুলে হাত ঢুকিয়ে আনমনে বলল, আমরা রোলস রয়েসের শ্রেণীভুক্ত নই পেয়ারী।
শোফার তারা বসে কথা বলছে দেখে এগিয়ে এল।
দীর্ঘাঙ্গী মেয়েটি বলল, কি হে? কিন্তু তার অপরিণত মুখটা দেখেই মনে মনে বুঝতে পারল নেহাতই কাঁচা বয়স। কিন্তু কাঁচা বয়স হলেও শোফারটির দৃষ্টির মধ্যে এবং দাঁড়ানোর মধ্যে এমন এক ঋজুতা ছিল যা দেখে অস্বস্তিকর বলে মনে হচ্ছিল।
শোফারটি এদের দেখেই বুঝতে পারল এরা কারা। মুখে বিরক্তির একটা সূক্ষ্ম ইঙ্গিত প্রকাশ করল।
–তোমরা কি গিল্ডেড লিলিক্লাবটা কোথায় বলতে পারো? একটু ইতস্ততঃকরে বৈশিষ্ট্যহীন নরম গলায় সে প্রশ্নটা করল।
-হে ভগবান! মেয়েটি হতাশা আর রাগে বলল। আমার সময় নষ্ট না করে কোন পুলিসকে গিয়ে জিজ্ঞেস কর না। আমি ভেবেছিলাম আমাকে তোমার দরকার।
তার ঠাণ্ডা চোখে ঘৃণা ঠিকরে এলো। এখানে কোন পুলিস নেই জিজ্ঞেস করার মত। তাছাড়া তোমরাও তো কিছুমাত্র ব্যস্ত নও।
শোফারটি তার সরু মুখটা সিঁটকোল,-না জানলে তো বললেই হয়। আমি অন্য কাউকে জিজ্ঞেস করি।
তাই করো গিয়ে। মেয়েটি ফিরে গেল।
স্বর্ণকেশী বলল, আমাকে জিজ্ঞেস কর, আমি জানি।
শোফারটি অধৈর্যের সঙ্গে বলল, কোথায়?
স্বর্ণকেশী তার বন্ধুর মত মুখ টিপে হাসল। ওটা শুধুমাত্র সভ্যদের জন্য। খুব কড়া নিয়ম। তোমায় ঢুকতে দেবে না।
সে নিয়ে তোমার চিন্তা না করলেও চলবে। শুধু বল ক্লাবটা কোথায়?
সারা রাত ঘুরে মরলেও খুঁজে পাবে না। যদি আমায় সময়ের মূল্য কিছু ছাড় তবে বলতে পারি। স্বর্ণকেশী রোলস রয়েসের দিকে তাকাল।
কালো কোট পরা, মাথার টুপীটা চোখ পর্যন্ত ঢাকা,হাতে রাফস্কিনের দস্তানা পরা একটা বেঁটে লোক গাড়ি থেকে নামল। জুতোর ওপর চাঁদের আলো পরে চকচক করে উঠল। আবলুস কাঠের ছড়িটা নিয়ে ফুটপাত ধরে লোকটা এগিয়ে এল।
–ভাল মেয়ে, তাহলে তুমি জান ক্লাবটা কোথায়?
নিয়ে যাব। যদি আমার সময়ের দামটা পুষিয়ে দাও, মাথা নেড়ে মেয়েটি বলল।
তুমি কি রোলোকে চেন? হাতে একপাউন্ডের এক তাড়া নোট নিয়ে লোকটি প্রশ্ন করল। আঙ্গুলের হীরের আংটিটা ঝকমক করে উঠল।
সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় স্বর্ণকেশী বলল, মনে তো হয়।
আমি তার সম্বন্ধে কিছু জানতে চাই।
মেয়েটি চারিদিকটা দেখে নিলো। রাস্তায় আবার লোক চলাচল শুরু হয়েছে।
–তুমি বরং আমার ঘরে এস। রাস্তায় দাঁড়িয়ে এসব কথা বলা যাবে না।
লোকটা হাত ধরে তাকে গাড়ির দিকে নিয়ে গেল,তার চেয়ে বরং এস, গাড়ি চড়ে আমরা একটু ঘুরে আসি। ড্রাইভারের দিকে তাকিয়ে বলল, একটু এদিক-সেদিক গাড়ি নিয়ে ঘোর। কিন্তু বেশি দূরে যাবার দরকার নেই।
গাড়ি চলতে আরম্ভ করলে বেঁটে লোকটি জিজ্ঞেস করল, তুমি কি রোলোকে চেনো?
–তার সম্বন্ধে কিছু বলা সে পছন্দ করেনা। আমাকে সাবধান হতে হবে।
–আসলে টাকাই সব তাই নয় কি? বলে লোকটি তার দিকে এগিয়ে দিল দশ পাউন্ডের
সঙ্গে সঙ্গে টাকাটা ব্যাগে ঢুকিয়ে স্বর্ণকেশী বলল, চিনি বৈকি।
–সেকি গিল্ডেড লিলি ক্লাবের মালিক?
স্বর্ণকেশী মাথা নাড়ল।
ক্লাবটা কি?
একটু ইতস্ততঃকরে সে বলল, ওটা একটা বিলাসবহুলনাইট ক্লাব আর কি! লোকে ওখানে নাচাগানা করতে যায়। মেম্বার ছাড়া ওখানে কেউ ঢুকতে পারে না। তুমি পাবে না, কেননা আমি একবার চেষ্টা করেছিলাম কিনা, জানি।
বলে যাও।
–কি আর বলব? খাবার-দাবার পাওয়া যায় ওখানে। বাজে খাবার। রোলোও বেশ দু-চার পয়সা কামিয়ে নিচ্ছে।
তুমি যা কিছু আমাকে বললে এর জন্যে তোমাকে টাকা দিইনি আমি। ক্লাবের ভেতরের ব্যাপারটা বলো দেখি।
দেখো, আমি ঠিক জানিনা। তবে নোকমুখে শুনেছি। আসলে কোন বাজে ঝাটে আমি নিজেকে জড়াতে চাইনা।
ঝঞ্ঝাটে জড়াবার দরকার নেই তাহলে। টাকাটা আমি ফেরত নেব।
কয়েক মিনিট চুপচাপ থাকার পর সে বলল, শোনা যায় রোলো মানুষকে বিপদে সাহায্য করে। তাদের কাছ থেকে সে জিনিসপত্র কেনে। শুনেছি কিছু কিছু মেয়ে তার কাছ থেকে মাদকদ্রব্য কেনে। তার একটা দল আছে। বুচ বলে একটা লোক হোটেলময় ঘুরে বেড়ায়। তাকে আমার খুব ভয় করে। লোকে ওকে খুনী বলে জানে। মন দিয়ে শোন, আমি যা জানি তা হচ্ছে এটা একটা সাধারণ ক্লাব মাত্র।
তাহলে তুমি বলতে চাও রোলো চোরাই মাল আরমাদক ওষুধ কেনা বেচারব্য বসাদার। তাই না?
-হ্যাঁ, তাই।
–বেশ। আমি রোলোর সঙ্গে দেখা করতে চাই।
–ওরা এত কড়া যে তোমাকে ঢুকতেই দেবেনা।
–আমাকে ক্লাবে নিয়ে চল। গাড়ি থেকে নেমে পড়ল লোকটা।
গাড়ি থেকে নামবার সময় স্বর্ণকেশী অনুভব করল যে শোফারটি তাকে সন্ধানী দৃষ্টিতে দেখছে। বেঁটে লোকটিকে নিয়ে অন্ধকারে হাঁটবার সময় শোফারের দৃষ্টি সে পেছন থেকে অনুভব করতে পারছিল। অজানা ভয়ে কেঁপে উঠল সে।
অন্ধকার দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে গলিপথের মুখে এসে লোকটি প্রশ্ন করল, আর কত দূর?
–এই তো গলিটার শেষে। কোনো ভয় নেই। আমার কাছে টর্চ আছে।
অন্ধকারের বুক চিরে সরু সুতোর মত আলো পথ করে দিল। বেঁটে লোকটি আলোর পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে একটা সরু পথের মাথায় এসে দাঁড়াল। পথরুদ্ধ করে সামনেই একটা ইটের পাঁচিল। দেওয়ালের মাঝখানে একটা গেট। টর্চের আলোয় লোকটি দেখতে পেল কাঠের ওপর থেকে রং খসে পড়েছে। লোহার বড় কড়াটা মরচে ধরা।
স্বর্ণকেশী বলল, ঢুকতে না দিলে আমায় দোষ দিও না।
অনেক অনেক ধন্যবাদ, তুমি এবার নিশ্চিন্তে ফিরে যেতে পার।
গলি ধরে ফিরে আসার সময় সে দরজা খোলার শব্দ পেয়ে পেছন ফিরে তাকাল। দেখতে পেল লোকটা সহজেই ঢুকে গেল। হঠাৎ সে তার পাশে কারোর উপস্থিতি অনুভব করল। দ্রুত ঘুরে দাঁড়াল সে। টর্চের আলোটা পাগলের মতো সন্ধান করতে করতে শোফারটির ওপর। স্থির। তুমি আমায় ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে। তার ভয়ার্ত কণ্ঠ।
আলো নেভাও। শোফারটির গলায় হিংস্রতা। সাপ যেমন খরগোসকে সম্মোহিত করে ফেলে সেইরকম সম্মোহিত হয়ে টর্চ নিভিয়ে ফেলল সে। চারিদিক অন্ধকার গ্রাস করল। শোফারটি এগিয়ে এসে তার হাত ধরে বলল, কিছু অনুভব করতে পারছ?
স্বর্ণকেশী অনুভব করল তার পোষাকের ওপর দিয়ে পার্শ্বদেশে কিছু খোঁচা মারছে। হাত ছাড়িয়ে পালাবার চেষ্টা করল সে। তুমি কি কাজ করছ? ভয়ে সারা শরীর কাঁপছিল।
–এটা একটা ছুরি। খুবই ধারালো তোমার পেটটা চিরে ফেলতে পারি।
দম নিয়ে সে চীৎকার করতে গেল। কিন্তু ছুরিটি তার পশ্চাদদেশের হাড়ে খোঁচা মারল।কাঁপতে থাকল সে। মুখ হাঁ। বুকে যেন হাতুড়ির ঘা পড়ছে।
-ব্যাগটা দাও। নড়বে না।
স্বর্ণকেশী তাকে তার হাতের তলা থেকে ব্যাগটা ছিনিয়ে নিয়ে তার টাকাটা পকেটস্থ করতে শুনল।
–পচা ইঁদুর কোথাকার। রাগে এবং ভয়ে সে বলল।
নীচু গলায় লোকটি বলল, তুমি ঐ লোকটাকে এমন কোন খবর দাওনি যাতে উনি তোমাকে দশ পাউন্ড দিয়েছেন। উনি পাগল তাই এভাবে টাকা খরচ করছেন।
সে ছুরিটা দিয়ে মেয়েটার গায়ে চাপ দিতে লাগল। ফার কোটের জন্যে যন্ত্রণাটা সে অনুভব করতে পারলনা।
–আমি টাকাটা রাখছি। তোমার চেয়ে ওটা আমার বেশি প্রয়োজন।
–তুমি ওটা নিয়ে কিছুতেই যেতে পারবেনা। আমি ওকে বলে দেব। ও এখুনি ফিরে আসবে বুঝতে পেরেছে পচা শুয়োর।
সে সরে গেল। স্বর্ণকেশী তার স্কার্টের ভেতর উরুর ওপর যেখানটা কেটে গেছে সেখান থেকে রক্ত বেরিয়ে আসা অনুভব করল।
মেয়েটি বুঝতে পারল যেতটা খুব মারাত্মক নয়।তবুরক্তপাত অনুভবকরে ভীত হয়ে উঠল।
-কিন্তু তিনি যখন আসবেন তোমাকে দেখতে পাবেন না। একটা গেঁঠো আঙ্গুলওয়ালা মুঠো চোয়ালে এসে তীব্র আঘাত করল।
.
রোলো–পঞ্চাশ বছরের এই বিশাল চেহারার লোকটি রোলো। লম্বায় ছফুটের চেয়ে চার ইঞ্চি বেশি। বিশাল মেদবহুল দেহ। বিরাট ডিমের মতো নরম একটা ভুড়ি। মোটা মোটা হাত। চোখের দুপাশে মাংস ঝুলে পড়ে চোখ দুটো ঘোট ঘোট। সেই চোখে কখনও কোমলতা, কখনও ধূর্তামি, কখনও কামনা। তার ঠোঁটের ওপর মোম লাগানো একটা গোঁফ। বিশাল হাত দুটো মাকড়সার মতো সদাই ব্যস্ত।
গিল্ডেড লিলি ক্লাবের পরিচালনা করা ছাড়া সে আর কিছুই জানেনা। সমস্ত কিছু সন্দেহজনক ব্যাপারেই তার হাত আছে এরকম মনে করা হয়। কেউ বলে চোরাই মালের ব্যবসা, কেউ বলে মাদক ওষুধের। আবার কেউ বলে খুনকরা। কেউ সঠিকভাবে কিছু জানেনা। লন্ডনের এই ক্লাবের ছশো মেম্বারদের প্রত্যেকেই অসৎ সমাজের সর্বস্তরের অসাধু লোক।
ক্লাবটার ভেতরে একটা সাজানো-গোছানো ঘর আছে। তাকে ঘিরে ব্যালকনী। সেখানে কয়েকজন অনুগ্রহ ভাজন লোকই পৌঁছতে পারে। রোলোর সব কিছু লক্ষ্য করার জন্য এটাই পছন্দ সই জায়গা।
কেউ ক্লাবে ঢুকে রোলোর দিকে তাকাবে তার সঙ্গে রোলো কথা বলতে চায় কিনা। রোলো আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করে নিজের অফিস ঘরে ঢুকে যাবে।
কিন্তু সে সঙ্গে সঙ্গে ওপরে যেতে পারবেনা। তাকে বারম্যানের সঙ্গে দুচারটে কথা বলতে হবে। মদ খেতে হবে। তারপর ছোট্ট নাচবার জায়গায় ঘুরঘুর করতে করতে সবার চোখের আড়ালে ঝোলানো মোটা ভেলভেটের পর্দা সরিয়ে ব্যালকনীতে ওঠার সিঁড়িতে পা রাখতে হবে। সমস্ত ব্যাপারটাই গোপনীয়।
বুচ–পাতলা লম্বা। মৃত্যুশীতল চাউনী।কালো পোষাক কালো ঝোলানো টুপী,কালো জামা। লাল হলদে ঘোড়র ক্ষুরের ছাপ লাগানো সাদা লাল সিল্কের টাই। বুচের কাজ সিঁড়ির পাহারা।
রোলোর অফিসটা বেশ সাজানো গোছানো। রোলো ডেস্কের পেছনে ঘুম জড়ানো মুখের হলদে দাঁতে একটা সিগার চেপে ধরে থাকবে। শেলি থাকবে ফায়ার প্লেসের কাছে। মাঝে মধ্যে সে কথা বলবে। কিন্তু তুমি ঘরে ঢোকামাত্র বড় বড় কালো চোখ তোমার দিকে স্থির হয়ে থাকবে। তার চোখে কিছুই ফসকায় না।
শেলী একজন ক্রেয়ল। হাল্কা ব্রোঞ্জ রং-এর মূর্তির মতো চেহারা। তার বড় বড় কালো চোখ। চওড়া থুতনীর ওপর গোখরো সাপের মতো গালের হাড়। মুখটা লাল ফলের মত, উদ্ধত। শেলি তার পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জেররক্তের জন্যে লজ্জিত।তার সান্ধ্য রং বেরংয়ের পোষাকের ভেতর দিয়ে শরীরের রেখাগুলো স্পষ্ট। তার প্রচণ্ড যৌন আবেদনে প্রতিটা পুরুষ উত্তেজিত হয়ে পড়ে। শেলি হচ্ছে রোলোর রক্ষিতা। হয়তো কেউ রোলোর সঙ্গে ব্যবসা সংক্রান্ত আলোচনা সেরে চলে গেল। রোলো তখন শেলিকে জিজ্ঞেস করবে লোকটাকে বিশ্বাস করা যায় কিনা। লোকের মনের গোপন ভাব বুঝে বলার আশ্চর্য ক্ষমতা আছে শেলির এবং এই ক্ষমতার জন্যে সে বহুবার রোলোকে সাবধান করে দিয়েছে।
আজ রাতে রোলো তার ডেস্কে বসে একটা জড়োয়ার গয়না দেখছিল। বুচ এসে বলল, একটা লোক তোমার সঙ্গে দেখা করতে চায়, কিন্তু আমি তাকে আগে কখনও দেখিনি। সে এখানকার মেম্বারও নয়।
–কি চায় সে?
কিছু বলছে না।
–তবে বলে দাও, আমি দেখা করব না।
বুচ মাথা নেড়ে বলল, সেটা সে জানে। আর সেজন্যই সে এই খামটা তোমাকে দিতে বলেছে।
রোলো একবার শেলির দিকে তাকিয়ে কুঁচকিয়ে খামটা খুলল। ভেতরে একটা ব্যাংক নোট।
হঠাৎ ঘরে নিস্তব্ধতা নেমে এল। নীচের হল ঘরের ড্রামের মৃদু শব্দটা থেমে গেল। রোলো নোটটা টেবিলে মেলে ধরল। শেলি আর বুচ নোটের দিকে ঝুঁকে পড়ল। একশ পাউন্ডের নোট। —এ কে?
বুচ কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, বেঁটে মত একটা লোক। পোষাক দেখে মনে হচ্ছে বেশ শাসালো পার্টি।
–বেশ তবে আমি দেখা করে জানতে চাই লোকটা কে? আমি যদি দুবার ঘণ্টা বাজাই তুমি লোকটাকে অনুসরণ করবে।
বুচ বেরিয়ে গিয়ে আবার এল। সঙ্গে এলো রোলস রয়েসের সেই বেঁটেটা। মাথার টুপী ঝুঁকিয়ে বলল–আমার নাম ডুপন্ট। আমি আপনার সাক্ষাৎপ্রার্থী।
বুচ আড়চোখে রোলোর দিকে তাকিয়ে বেরিয়ে গেল।
-আপনি তো বেশ ব্যয়বহুল পথে নিজের পরিচয়টা দিয়েছেন। বসুন মিঃ ডুপন্ট।
লোকটি শেলির দিকে তাকিয়ে বলল, আমরা একটু একা হলে ভাল হতো না?
–আপনি নিশ্চিন্তে যা বলার বলতে পারেন। এবার বলুন আপনি আমার সঙ্গে কেন দেখা করতে চেয়েছেন?
আমি আপনার সাহায্য চাই।
আমার অনেক কাজ আছে। লোককে সাহায্য করা আমার পেশা নয়।
–তবে দেখছি আপনার সাহায্য আমাকে ক্রয় করতে হবে।
রোলো টেবিলে হাত ছড়িয়ে বলল, তাহলে আলাদা কথা।
ইতস্ততঃ করে ডুপন্ট বললেন,আমি ভুডুইজম সম্পর্কে আগ্রহী। আমার মনে হয় আপনার থেকে এ সম্বন্ধে কিছু জানতে পারবো। এর জন্যে খরচ করতেও আমি সমান আগ্রহী।
রোলোর এ সম্বন্ধে একটা অস্পষ্ট ধারণা ছিল। ভুডুইজম সম্বন্ধে তার চেয়ে বেশি কেউ জানেনা। অর্থের কথা মাথায় রেখে ব্যাপারটাকে উড়িয়ে দেওয়া যায়না। সুতরাং উৎসাহব্যাঞ্জক। হাসি হেসে সে বলল, আমার জানা নেই এমন জিনিস খুব কমই আছে। তবু আমি কিছু বলার আগে আপনাকে আরও বিশদ ভাবে বলতে হবে।
আমার মনে হয় না এর প্রয়োজন আছে। ভুডুইজমের আনুষ্ঠানিক ব্যাপার জানে এমন কাউকে কি আপনার জানা আছে? জানেন তো বলুন টাকা পাবেন। না জানলে বলে দিন খামোকা সময় নষ্ট করা ঠিক নয়।
–এ ধরনের ব্যাপার এদেশে উৎসাহব্যাঞ্জক নয়। ব্যাপারটা কি বলুন তো, আপনার এতে খোঁজ কিসের। প্রত্যেকেরই সাবধান হওয়া উচিত।
এক হাজার পাউন্ড পাবেন, কোন প্রশ্ন করবেন না। রোলো আশ্চর্য হলেও মুখে প্রকাশ না করে বলল, হ্যাঁ অনেক টাকার ব্যাপার, এবার মনে হয় আমি আপনাকে সাহায্য করতে পারব।
–ভাল কথা, তবে চটপট নাম, ঠিকানা দিন, আর হাতে হাতে টাকা নিন।
রোলোর নাম, ঠিকানা জানানা থাকলেও তার জানা আছে সে কোথায় থাকে। সুতরাং চাতুরীর আশ্রয় নিয়ে মুখে বলল–একটা লোক আছে, কালই তার সঙ্গে এ সম্বন্ধে কথা বলেছিলাম।
–কে সে?
–তাকে না জিজ্ঞেস করে নাম বলাটা ঠিক হবেনা।
আপনি তবে কথা বলে রাখুন, আমি আবার আসব।
সন্ধানী দৃষ্টিতে রোলো বলল, কিন্তু আপনার আসল উদ্দেশ্যটা কি বলে গেলেন না তো?
বলবেন আমি ভুইজমের আনুষ্ঠানিক পট দেখতে আগ্রহী, ব্যাপারটার মধ্যে জুমবিইজমও থাকবে। অনুষ্ঠানটা গোপনে হবে। দক্ষিণাও মোটা রকমের দেব।
জুমবিইজম কথাটা মনে রাখার জন্যে রোলো ব্লটিং পেপারে লিখে রাখল। এ কথাটা সে কোন দিনই শোনেনি, অর্থও কিছু বোধগম্য হচ্ছে না।
–মাপ করবেন, দয়া করে বলে যাবেন দক্ষিণাটা কত হবে? আপনার কাছে মোটা রকমের হলেও তার কাছে নাও হতে পারে।
–ঠিক আছে দশ হাজার পাউন্ড দেব। কিন্তু টাকাটার মতো ব্যাপারটাও যেন সফল হয়।
সমীহের দৃষ্টি হেনে রোলো বলল বৃহস্পতিবার ঠিক এসময়ে আমি লোকটাকে নিয়ে আসব।
-ঠিক আছে। পরিচয়ের জন্যে আপনি পাবেন হাজার পাউন্ড। আর সে পাবে দশ হাজার পাউন্ড।
–ঠিক আছে, বুঝেছি।
তবে আমার ব্যয়বহুল ভিজিটিং কার্ডটা ফেরত দিন। ঢোকবার জন্যে ওটার প্রয়োজন হয়েছিল।
–রোলো দ্বিরুক্তি না করে একশ পাউন্ডের নোটটা ফেরৎ দিল।
মিঃ ডুপন্ট চলে যেতেই শেলি বলল, লোকটা বদ্ধ পাগল, ওর চোখ দেখেছো?
-হ্যাঁ, তবে বেশ মালদার আছে। রোলো দুবার বেল বাজাল।
উদ্দেশ্যহীন ভাবে বেড়াতে বেড়াতে সুশানকে এই নিয়ে আটবার শুনতে হল এই যে খুকী যাবেনাকি আমার সঙ্গে? সে রাস্তা পেরিয়ে পিকাডিলীর দিকে এগিয়ে গেল। কিন্তু ফুলহাম রোডের ঐ পুরোন বাড়িটায় ফিরে যেতে ইচ্ছে করল না। ওটাই তার ঘর। কিছুক্ষণ আগেও যে ঘরের স্বপ্ন সে দেখছিল একটা চিঠিতেই তা ধুলিস্যাৎ হয়ে গেল। চিঠিটা নিয়ে চিন্তা করার জন্যে সারা জীবন পড়ে আছে। আজ নাই বা করল চিন্তা। কিন্তু ঘরে ফিরলেও নিঃসঙ্গতা তাকে আবার চিন্তার দিকে ঠেলে দেবে। তার চেয়ে এই মানুষ জন ভাল।
একটা লোক পা টেনে টেনে পেছন পেছন আসছে। সে মনিকো ছাড়িয়ে গ্লাস হাউসের দিকে আসতেই তার মনে হল গ্লাস হাউস স্ট্রিটে অন্ধকার আর শিকার ধরার জায়গা। এদিকে আসা ঠিক হয়নি। সামনে একটা ম্যাক্স বার দেখতে পেয়ে ঢুকে পড়ল।
ভেতরটা বেশ গরম। সব টেবিলই ভর্তি। দেখে শুনে একটা টেবিলে বসে পড়ল। সামনের লোকটা মুখ ঢেকে, দুটো গেঁঠো হাতে কাগজ পড়ছে।
ওয়েট্রেস এসে বলল, দোকান বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
ক্লান্ত সুশান হতাশ হয়ে বলল, কিন্তু আমি ভেবেছিলাম এক কাপ কফি
হবে না, বন্ধ করে দিচ্ছি।
সুশান ভাবল বিশ্রাম তাকে নিতেই হবে, যদি বাইরে সেই লোকটা অপেক্ষা করে থাকে?
সুশান অশান্তির ভয়ে চেয়ার ঠেলে উঠতে গেল।
বন্ধ কুড়ি মিনিট পর হবে।
–একটা নরম গলা বলল, ওকে এককাপ কফি দাও।
সুশান ও ওয়েট্রেস দুজনেই টেবিলে বসা লোকটার দিকে তাকাল।
ওয়েট্রেস কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। কফি না নিয়ে এলে তোকটা বোধহয় সারারাত এভাবে তাকিয়ে থাকবে।
সে কফি নিয়ে এসে ঠক করে রেখে বিল দিয়ে চলে গেল। লোকটি আবার কাগজের আড়ালে চলে গেল। ধন্যবাদ জানানোর ইচ্ছে হলেও কোন সুযোগ নেই। সুশান দেখে নিয়েছে লোকটার গায়ে শোফারের পোষাক। বয়স তার মতো একুশ-বাইশ হবে। তার চোখ দুটো গভীর কঠিন। ভয় পাবার মত।
সুশান ব্যাগ হাতড়ে প্রত্যাখানের চিঠিটা বার করল আর তার চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগল।
হঠাৎ সে শোফারকে লক্ষ্য করতে লাগল। কাগজটা এমনভাবে ধরা যে কেবলমাত্র সুশানই তার মুখ দেখতে পাবে।
কেঁদে কোন লাভ হবে না।
–সুশানের মনে হল এবার সে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে।
–শোফারটি চোখ দুটোনা সরিয়ে বলল, তুমিনরম, মনে হচ্ছে কোন পুরুষ সংক্রান্ত ব্যাপার। কিন্তু এতে কোন লাভ নেই।
রেগে সুশান বলে উঠল–তুমি নিজের চরকায় তেল দাও গে।
–ভাল। মনে হচ্ছে তোমার মধ্যে উদ্যম রয়েছে।
দয়া করে আমার সঙ্গে কথা বলবে না।
–আমি তোমাকে সাহায্য করতে আগ্রহী। সাহায্য চাই কিনা তোমার?
আমার মনে হয় তুমি কাকে কি বলছ জানো না।
মাথা ঝাঁকিয়ে সে বলল–আমি মেয়েদের জানি এবং এটাও সঠিকভাবে জানি তুমিই সে মেয়ে যাকে আমি খুঁজছি। আজ তুমি দুঃখী কিন্তু পরে তুমি দুঃখ কাটিয়ে উঠবে।
ব্যাগ তুলে নিয়ে সুশান বলল–অচেনা লোকের সঙ্গে আমি কথা বলি না। চলি।
–আমি তোমাকে কফি পাইয়ে দিলাম আর তুমি আমার একটা উপকার করবেনা।
–আমি কিছু বুঝতে পারছি না।
–ঘরের শেষ প্রান্তে বাঁ দিকের টেবিলে কালো জামা, সাদা টাই একটা লোক বসে আছে। দেখো
ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে সুশান বলল–আছে।
–লোকটা আমাকে অনুসরণ করছে।
–তা আমার কি করার আছে?
আছে। তুমি যে ধাক্কাটা খেয়েছো এ কাজটা করলে তুমি সেটা ভুলতে পারবে। তুমি আমার হয়ে লোকটাকে অনুসরণ করবে। আমি জানতে চাই লোকটা কে। স্থির দৃষ্টিতে সুশান তাকিয়ে রইল।
এতে ঝুঁকি আছে।
লোকটা বুঝতেও পারবে না। তোমাকে আমি দশ পাউন্ড দেব।
–পাগল হয়েছে। আমি তো স্বপ্নেও ভাবতে পারছি না।
–তোমাকে ভাবতে হবে। এই তুমিই না এক মিনিট আগে নদীতে ঝাঁপ দিতে চেয়েছিলে আর এখন প্রাণের ভয় করছ?
–কিন্তু আমি যে কখনও কাউকে অনুসরণ করিনি।
–খুব সোজা। বাইরে নম্বর এক্স.এল.এ৩৫৭৮একটা প্যাকার্ড গাড়ি আছে। পেছনসীটে একটা কম্বল আছে। তুমি ভেতরে ঢুকে কম্বল মুড়ি দিয়ে পড়ে থাক। সে পেছন ফিরে তাকাবেও না।
–কিন্তু তুমি কে আর লোকটাই বা কে?
–এখন জানার প্রয়োজন নেই। তবে প্রচণ্ড ঝুঁকিও আছে।
সুশান তার ফুলহাম স্ট্রীটের ঘরে ফিরে যাবার কথা ভেবে ভয় পেয়ে বলল ঠিক আছে। বলেই আফশোস হল।
.
বুচ, তার আসল নামমাইক এগান। টেমসের পার দিয়ে গাড়ি চালাতে চালাতে ভাবছিল সন্ধেটা ভাল কাটল। সময় তখন রাত বারটা ত্রিশ মিনিট। ব্যক্তিগত কাজগুলো সারবার সময় আছে। বুচ রোলোর কথা ভাবতে ভাবতে বার্কলে স্ট্রিটের একটা বাড়ির সামনে গাড়ি দাঁড় করিয়ে দেখলোত ওপরে পর্দার ফাঁক দিয়ে আলো দেখা যাচ্ছে। তার মানে শেলি ফিরেছে। সে দুবার হর্ন বাজাল। পর্দাটা খুলে আবার বন্ধ হয়ে গেল। এটা একটা সংকেত। মানে শেলি একলা রয়েছে। গাড়িটা বিশাল গ্যারেজে ঢুকিয়ে হেডলাইট নিভিয়ে গ্যারেজের দরজা বন্ধ করল। তারপর আলো জ্বালিয়ে পাশের দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল
শেলি বিছানায় আগুন রঙ-এর পাজামা পরে শুয়েছিল। মনিবন্ধে ভারি ব্রেসলেট, পায়ে চটি, মাথায় স্নান করার জন্য সিল্কের টুপী।
-কি হল?
–লোকটাকে পিছু করলাম। কি জিজ্ঞেস করছিল?
–লোকটা কে?
–কেস্টার ওয়েডম্যান-কোটিপতি। কিন্তু কি চাইছিল ও?
–পাগল, একেবারে পাগল।
খুলে বল।
–ভুডুইজমের ব্যাপার। ও চাইছিল ভুডুইজম জানে এমন লোকের সন্ধান।
–রোলো ভাগিয়ে দিয়েছে?
না, এগার হাজার পাউন্ডের ব্যাপার তো!
–অনেক টাকা। তা এসো না এটাকে আমরা ভাগাভাগি করে নিই।
–রোলো ছাড়া কেউ পারবেনা।
–তোমারও কিছু মনে আছে। ধাপ্পা দেবার চেষ্টা কোর না।
–মাইক এত সন্দেহ প্রবণ হয়ো না।
–শেলি! রোলোর কাছ থেকে ভেগে পড়ার তালে আছি। আশা করি যাবার সময় তুমি সঙ্গে থাকবে।
–এত সন্দেহ প্রবণ হয়োনা মাইক। গুড নাইট।
সিঁড়ির মুখে গুড়ি মারা সুশান হেডার একটা চড় মারার শব্দ পেল, তারপর সশব্দে একটা দেহের পড়ে যাওয়ার শব্দ। পরমুহূর্তে একটা আধা জাস্তব আওয়াজ ঢাকবার জন্যে সেকানে হাত চাপা দিল।
ডাঃ মাটিন রোলোর ঘরের ঘণ্টা বাজাল। রোলোর পাশ্বচর লংটম বেরিয়ে এল ডাক্তার, এত সকালে ওনার সঙ্গে দেখা হবেনা।
–ভাগো, রোলো আমাকে ডেকে পাঠিয়েছে।
বিশাল খাটে রোলো শুয়ে আছে। ডাক্তার পাশের চেয়ারে বসল।
পনের বছর আগে ডাঃ মার্টিনের চেম্বার ছিল হারলে স্ট্রিটে। কিন্তু একবার একটা যুবতীকে সাহায্য করতে গিয়ে সব কিছু গড়বড় হয়ে যায়। এখন তিনি শুধু গিল্ডেড লিলির ডাক্তার। অছাড়া তার অদ্ভুত সাধারণ জ্ঞানের ফায়দা লোটে রোলো।
ডাক্তার তুমি কি ভুডুইজম সম্পর্কে কিছু জান?
-পশ্চিমে ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জের একরকম ধর্মীয় অনুষ্ঠান। অর্থাৎ ডাকিনীবিদ্যা।
জুমবিইজম?
–মড়াকে জ্যান্ত করা।
–মানে?
–আমার হাইতির এক বন্ধু বলেছিল জোমবি মানে আত্মাবিহীন মৃতদেহ। কবর থেকে তুলে তাতে প্রাণসঞ্চার করা হয়। জুমবিকে দিয়ে মানুষের মত খুন করানো আর যত বাজে কাজ করানো যাবে।
–কি করে প্রাণসঞ্চার করা হয়?
–ওসব ভুডুর গাোপন ব্যাপার, কেউই বলতে পারবে না।
রোলো খেতে খেতে চিন্তা করতে লাগল ডাক্তারকে সে টাকার কথা সব খুলে বলবে কি? কিন্তু ডাক্তার ছাড়া এ সম্বন্ধে তাকে আর কেউই সাহায্য করতে পারবেনা। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ডাক্তারকে সব কথা বলাই স্থির করল।
আমি এ ব্যাপারে কিছু টাকা পেতে পারি। সাহায্য করবে আমাকে?
টাকা পেলে সবই করতে পারি।
রোলো এগার হাজার পাউন্ডের কথা চেপে গিয়ে কেস্টার ওয়েডম্যানের আসার ব্যাপারটা সব খুলে বলল।
বুচ কি জানতে পেরেছে, লোকটা কে? ডাক্তারের প্রশ্ন।
রোলো চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, হ্যাঁ ও হল কেস্টার ওয়েডম্যান।
ডাক্তার মার্টিন গভীর শ্বাস টেনে বলল–আন্তর্জাতিক ব্যাপার। ও তো কোটি কোটি টাকার মালিক।
জানি, আমি চাই তুমি এমন একজনকে খুঁজে বার করো, যে ভুডুইজম সম্পর্কে কিছু জানে। তারপর রোলো চিন্তা করল যে দুএকশ পাউন্ড দিয়ে ডাক্তারকে বোকা বানানো যাবে না, তাই অনেক কষ্টে বলল, তোমাকে হাজার পাউন্ড দেব।
–ওতে কাজ হবে না। ছুঁচো মেরে হাত গন্ধ আমি করি না। সাফ সাফ বলল যা পাবে তার এক তৃতীয়াংশ শেয়ার আমাকে দিতে হবে।
–ডাক্তার দেখ বেশি বাড়াবাড়ি কোর না। তবে বিদেয় করে দেব। তোমাকে ছাড়াই আমার কাজ চলবে।
–ডাক্তার বলল চলবে না। সম্ভবতঃ আমিই একমাত্র লোক যাকে তুমি অবিশ্বাস করতে। পারোনা। আমি বুড়ো মানুষ।বুড়োদের অবিশ্বাসীহওয়া পোযায়? ছেলে ছোকরাদের কথা আলাদা তাদের জীবনের অনেক বাকি।
–কি বলতে চাইছো? তুমি কি জান?
–আমি শুধু বলতে চাই আমাকে বিশ্বাস করতে পারো।
–বুচকে পারি না?
–ওর সম্বন্ধে আমি কিছু জানি না। তাহলে বলল এক তৃতীয়াংশে রাজি?
–এক চতুর্থাংশ।
–এক তৃতীয়াংশ।
–বেশ, যা বলার তাড়াতাড়ি বলো। কেস্টার কালই আসবে।
–আসুক। আজ আমি একটু পড়াশুনা করে নোব। ঐ পাগল কোটিপতিটাকে একটু খেলাতে পারলেই এক মিলিয়ন পাউন্ডও বাগাতে পারবে।
–কি যা তা বলছ?
–ঠিকই বলছি। ওকে আমি জানি। ওর পেছনে উকিল, পুলিশ সব আছে। তাছাড়া এদিকে বুচ টাকার লোভে ব্যাপারটা সে নিজেই হাসিল করার চেষ্টা করবে।
রোলো ঘুসি পাকিয়ে বলল, বারবার ওর কথা তুলছ কেন? ও আমার কথামতো কাজ করে। এছাড়া আর কিছু নয়।
দরজার দিকে যেতে যেতে ডাক্তার বলল-তবু খেয়াল রেখো, ভুলেও ওকে এ ব্যাপারে কিছু রোলো না। অনেক টাকার ব্যাপার কিনা!
.
সুশান হেডার গ্রীনমানে বাস থেকে নেমে হাত ঘড়ির দিকে তাকাল। দশটা বাজতে মিনিট কয়েক বাকী। শোফারটি কথামত আসবে তো?
গতকাল রাতের ঘটনা বেশ ভীতিপ্রদ এবং উত্তেজক। মাঝে তো সে জর্জের কথা ভুলতে রসেছিল। এরকম অভিজ্ঞতা কজন মেয়ের হয়? হঠাৎ করে দশ পাউন্ড রোজগার করা গেল। কিন্তু কঠিন পরিবেশের মেয়ে সুশান শিখেছিল অজানা লোকের থেকে কিছু নেবেনা। কিন্তু আজ সে নিজেকে বুঝিয়েছে টাকার বদলে সে একটা কাজ তো করেছে! শোফার যদি তার বিবরণে সন্তুষ্ট না হয়, তবে সে টাকাটা ফেরৎ দেবে।
হঠাৎ মৃদু একটা গলার আওয়াজে সুশানের চিন্তা ভগ্ন হল।
-তুমি তাহলে ঠিক সময়ে এসেছে।
দুরু দুরু বক্ষে তাকিয়ে দেখল শোফারটি ঠাণ্ডা অবন্ধুসুলভ, তিক্ত, বিপপূর্ণ চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে।
–ভাবছিলাম তুমি আসবে কিনা, সুশান বলল।
চল আমরা হাঁটি, রাস্তায় আমাদের কেউ দেখে ফেলতে পারে। সামনের বাগানে ঝোঁপের আড়ালে ফাঁকা বেঞ্চি দেখে সেবলল, বোস। এখানে কথা বলি। অনেকটা ফাঁক রেখে সুশান বসল।
-কি ব্যাপার? অনুসরণ করেছিলে?
-হ্যাঁ, তার আগে আমি জানতে চাই তুমি কে। কাল রাতে আমাকে বোকা বানিয়েছিলে। আমি বিপদে পড়তে পারতাম।
–আমি কে তা নিয়ে তোমায় ভাবতে হবেনা। কাজ করেছে, বদলে টাকা নিয়েছে। তাই নয় কি?
ব্যাগ খুলে সুশান দশ পাউন্ডের নোটখানা শোফারের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, নাও তোমার টাকা। আমার কাজের আগে এটা নেওয়া উচিত হয়নি।
শোফারটির চোখে বিস্ময়।
-নাও, নাও। তাড়া লাগাল সুশান।
–কি ব্যাপার? তোমার কি টাকার দরকার নেই?
–তা থাকবে না কেন? কিন্তু এভাবে টাকা আমি চাই না। সুশানের হাত থেকে টাকাটা হঠাৎ পড়ে গেল।
–ফেলে দিলে যে? তার মানে ভয় পেয়ে তুমি আমার কাজ করনি। এখন টাকা ফেরৎ দিতে এসেছে?
সুশান রেগে গিয়ে বলল
–অনুসরণ ঠিকই করেছি। কিন্তু তার আগে বলো তুমি কে?
শোফার গভীরভাবে চিন্তা করতে লাগল, সুশান ভয় পেয়ে এখানে চেঁচালেও কেউ শুনতে পাবেনা। সুশান পালাবে কিনা ঠিক করতে করতে শোফারটি সহজ হয়ে নোটটা কুড়িয়ে নিয়ে বললনাও। টাকাটা নাও। অবশ্য টাকাটা আমার নয়।
গোঁয়ারের মত মাথা নেড়ে সুশান বললনা নেবনা, যতক্ষণ না আমি জানতে পারছি টাকাটা আমি কার থেকে উপার্জন করেছি ততক্ষণ নয়।
টাকাটা পকেটে ঢুকিয়ে শোফার বলল–আমার নাম জো ফোর্ড। আমি মিঃ কেস্টার ওয়েডম্যানের কাছে চাকরী করি। সে যে কত ধনী তুমি কল্পনাও করতে পারবে না। তার ভাই একবার আমার উপকার করেছিল। যদি কেউ উপকার করে থাকে তাহলে আমি কি তার প্রত্যুৎপকার করব না?
কি ধরনের উপকার?
–আমি রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম। তার ভাই করনেলিয়াস আমাকে তাদের বাড়ি নিয়ে যায়। কেস্টারকে বলে আমাকে থাকতে দেয়। গাড়ি চালাতে শেখায়। তারপর থেকে আমি তাদের হুকুমের দাস। করনেলিয়াস সব সময় আমার সঙ্গে ভাল ব্যবহার করত।
তার মানে সে মারা গিয়েছে।
হা। দুসপ্তাহ আগে। কেস্টার তার ভাইকে খুব ভালবাসত। এখন তাকে ছাড়া কেস্টারের চলছে না।
–তার কি খুব অসুবিধে হচ্ছে?
–ঠিক বুঝতে পারছি না। মনেহয় কিছু একটা গণ্ডগোল হচ্ছে। খাওয়া-দাওয়া ঠিকই আছে, কিন্তু কোথাও বের হয়না। কাল আমি তাকে শেফার্ড মার্কেটে গিল্ডেড লিলি ক্লাবে নিয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু রোলো লোকটার কাছে সে কি চায়, এই ভেবে আমার দুশ্চিন্তা হচ্ছে।
–তোমার দরকারটা কি?
–তারা আমার উপকার করেছিল। এবার তাকে রক্ষা করে আমার উপকারের প্রতিদান দিতে হবে।
—তারা যদি টাকার গন্ধ না পায়?
পেয়েছে রোলো। জানিনা কালো পোষাক পরা লোকটা ক্লাব থেকে বেরোবার পর আমাদের অনুসরণ করে কেন? তাই আমি লোকটা কে জানতে চাই।
–সুশান সব খুলে বলে উদ্বিগ্ন মুখে তাকালো। কাজটা ঠিক হয়েছে কিনা।
–আমি খুব ভাল করেই জানতাম তুমিই পারবে কাজটা।
টাকাটা তুমি রোজগার করেছে। এই নাও ধরো।
সুশান টাকাটা নিয়ে নিল।
এখনও অনেক কিছু করার বাকি। ওরা আমাকে যে বকশিস করেছে আমি জমিয়ে রেখেছি। ও টাকাগুলো আমার দরকার নেই। আমাকে সাহায্য কর আর টাকাগুলো নাও।
–আমি তোমার জন্যে আর কি করতে পারি বল।
–আমি কাউকে ক্লাবের ভিতরে পাঠাতে চাই। সেক্ষেত্রে তুমি কি সঠিক?
সুশান সতর্ক হয়ে বলল মনে হয় না।
জো বাধা দিয়ে বলল, তুমিই পারবে।
–সেক্ষেত্রে তোমাকে আমার জন্যে ওখানে একটা চাকরীর ব্যবস্থা করতে হবে। এই নাও আমার নাম ঠিকানা।
বেশ, দেখা যাক কি করতে পারি।
.
সকাল এগারটা বেজেকয়েক মিনিট পরে শেলি সুন্দর দেহ-সৌষ্ঠব আর সুন্দর সাজ-পোষাক পরে নিউব্যান্ড স্ট্রিট ধরে এগিয়ে চলেছে। লোকেরা তাকিয়ে দেখলেও তার কোন খেয়াল ছিল না। সে একটা ট্যাক্সিতে উঠে এথেন কোর্টের একটা ঠিকানা বলল।
ট্যাক্সি থেকে নেমে বাড়ির উঠোন পেরিয়ে পুরানো ধরনের লিফটে গিয়ে উঠল সে। ওপরে উঠে একটা ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বেল টিপল। পেতলের পাতের ওপর নাম লেখা গিলোরী।
গিলোরী দরজা খুলল।
–অবাক হচ্ছে?
–তুমি এখানে এসো না, কেউ দেখে ফেলবে।
–ওসব ছাড়। ঢুকতে দেবে কি?
–তুমি বরং চলে যাও। এটা ঠিক নয়, নরম গলায় গিলোরী বলল।
শেলি নিগ্রো গিলোরীকে পাশ কাটিয়ে ঢুকে পড়ল।
–তুমি একমাত্র লোক যে আমার সঙ্গে এরকম ব্যবহার করে।
–সমস্ত কালো লোকই তোমার সঙ্গে এরকম ব্যবহার করবে। তুমি আর আমাদের জাতের নও। বল কি চাও?
–তোমাকে দেখার ইচ্ছে হল, তাই এলাম।
–আজ রাতে দেখতে পেতে।
শেলি গিলোরীর পাশে গায়ে গা লাগিয়ে একটা টুলে বসল। সারা শরীর কামনায় জর্জরিত। গিলোরী জাতে হাইতিয়ান। কয়েকবছর পর বুচ, রোলো এরাযখন তাকে নিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়বে তখন, তার কি হবে? গিলোরী যদি তাকে গ্রহণ করে তবে সে জন্মভূমি ফিরে যাবার জন্যে অধীর আগ্রহী।
শেলি প্রশ্ন করল আমি কি তোমার কেউ নই?
ভাবলেশহীন ভাবে গিলোরী বলল–কেন হবে?
তুমি কি ভুলে গেছ, তুমি আমায় ভালবাসতে?
তোমার কাছে ওসবের মূল্য ছিলনা।
–সবারই ভুল হয়। আমরা কি আবার নতুন করে জীবন শুরু করতে পারিনা?
–ভাগ্যকে পাল্টানো যায়না। চলে যাও তুমি। আর কখনোও আসবেনা।
–আমি কি তোমার থেকে একটু সাহায্য চাইতেও পারিনা?
না, কারণ তুমি জানো কাজটা ভালো নয়। আমি জানি কি ঘটতে যাচ্ছে। তাই কাজটা আমি করব। তোমার বলার দরকার নেই।
–কি বলতে চাইছো তুমি?
–রোলো যদি আমায় করতে বলে তবেই। এতে আমরা সবাই শেষ হয়ে যাব।
–হাত মুঠো করে শেলি বলল–রোলো কি করতে বলবে?
–তোমরা টাকার জন্য করতে পারনা এমন কি আছে? তাই এখন সাবধান করছি এর থেকে সরে থাকো।
–তুমি বড় হেঁয়ালি করে কথা বলছ।
তবে আমি তোমাকে বোঝাচ্ছি। বলে গিলোরী আলমারী থেকে একটা কালো এবং একটা সাদা পুতুল বের করে ডিভানের দিকে ছুঁড়ে দিল। দুটো পুতুল একসঙ্গে পড়ল। কিন্তু সাদা পুতুলটা কালো পুতুলের ওপর।
শেলি হাঁ করে তাকিয়ে রইল।
–আবার দেখো–বলে একই পুনরাবৃত্তি করল। এবারও কালো পুতুলটার ওপর সাদা পুতুলটা। দুবার একই ফল হল।-দেখতে পাচ্ছো?
–তুমি যদি আমাকে ভয় দেখাবার চেষ্টা কর, তবে ভুল করছ।
পুতুল দুটো শেলির দিকে বাড়িয়ে দিয়ে গিলোরী বলল–তবে নিজেই চেষ্টা করে দেখনা।
হঠাৎ প্রচণ্ড রাগে শেলি পুতুল দুটোকে দেওয়ালে আছড়িয়ে মারল। দেখা গেল ফলাফল সেই একই। কালো পুতুলটার ওপর সাদা পুতুল।
সাদাটা কে?
গিলোরী মাথা নেড়ে বলল–জানি না।
-ভয় দেখাচ্ছো?
হঠাৎ বেল বেজে উঠল।
দরজা খুল না।হয়ত বুচ।
–সেটা তোমার আগেই ভাবা উচিত ছিল।
শেলি দৌড়ে শোবার ঘরে লুকিয়ে পড়ল।
গিলোরী দরজা খুলে দেখল ডাক্তার মার্টিন, বলল–আসুন আপনাকেই চাইছিলাম।
ঘরে ঢুকেই ডাক্তারের নাকে শেলির প্রসাধনের গন্ধ ঢুকল। মনে মনে ভাবল–এই শেলির কি সর্বত্র যাতায়াত, চেয়ারে বসে ডাক্তার বলল তুমি তোনাচের ড্রাম বাজিয়ে, তুমি আমায় আশা করছিলে কেন?
বলুন, বলুন, যা বলার বলুন গিলোরী বলল।
–তুমি একটা অদ্ভুত মাল, ডাক্তার বলল।
–বোধ হয় তাই, গিলোরী ঘাড় নাড়ল।
–তুমি আমাকে একটা সাহায্য করবে? রোজগারের একটা সুযোগ করে দিতে পারি। লোকটার অনেক টাকা, ভুডু সম্বন্ধে জানতে চায়।
–আপনি কি করে ভাবলেন, আমি ভুডু সম্বন্ধে জানি?
-তা জানিনা। বই পড়ে জেনেছি এটা একটা আদিম সংস্কার। তবে তুমি না জানলে, জানার ভান করতে পার। ঐ ভানের বিনিময়েই পাবে এক হাজার পাউন্ড।
–তা কি করতে হবে?
–সে আমি শিখিয়ে পড়িয়ে নোব। সে রকম কিছুই নয়।
–আপনি ঠিক জানেন ব্যাপারটা সত্যিই সরল সোজা?
–অবশ্য আমাদের জানতে হবে আসলে সে কি চায়।
–আপনি কি ভুডুতে বিশ্বাস করেন?
ডাক্তার হেসে বলল–পাগল হয়েছো তুমি?
–আমার দেশের লোকেরা বিশ্বাস করে। কিন্তু আমি একজন অজ্ঞ-নিগ্রো।
তুমি বিশ্বাস করনা? বুঝিনা তোমার মধ্যে যেন কি আছে।
–যদি আজ রাতে আমরা রোলোর সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা বলি?
-তাহলে আমি বুঝলাম তুমি আমার সাহায্যে রাজি আছো। হাজার পাউন্ড তো আর আকাশ থেকে পড়ে না! তাহলে আজ রাতেই দেখা হবে। চলি। ডাক্তার চলে গেলেন।