০৩.
নোরেনা চুপচাপ সামনের দিকে তাকিয়ে গাড়িতে বসেছিল। মায়ের কথাই সে চিন্তা করছিল। কথা বললেই বিরক্ত প্রকাশ করছেন বলে মিঃ টেরলকেও কিছু জিজ্ঞাসা করতে পারছিল না। তার তন্ময়তা তখনই দূর হলো যখন সে দেখল পথ ছেড়ে বুইককে বিপথে নামতে দেখে। তাকে বিস্মিত করে ফিল ওরফে মিঃ টেরলকে যেন রোড থেকে সরু আর ধুলোভরা এক রাস্তায় প্রবেশ করতে দেখে সে চিৎকার করে উঠল। একি কী করছেন আপনি। এটাতো প্যারাডাইস সিটিতে যাবার পথ নয়।
চিন্তার কিছু নেই, ঠিক আছে।গম্ভীর মুখে মন্তব্য করে গাড়ির গতিবেগ আরো প্রবলভাবে বাড়িয়ে দিল ফিল।
–না, ঠিক একেবারেই নেই, এ পথ আমার চেনা-সোজা নাক বরাবর চলে গেছে সমুদ্রের দিকে। আপনি ভুল পথে চালিত হচ্ছেন, মিঃ টেরল। তীক্ষ্ণ সুরে তাকে সাবধান করতে চাইল নোরেনা।
–সমুদ্র রয়েছে তো কী হয়েছে? সমুদ্র দেখতে তোমার কী ভালোলাগে না?
এ পথের আগাগোড়াই ফিলের নখদর্পণে। গত হপ্তায় হাইওয়ে নাম্বার ৪এ, ধরে সে বারংবার যাওয়া-আসা করেছে আর সন্ধানের অপেক্ষায় আছে একটি খুনের আদর্শ জায়গা। নির্বিকার চিত্তে নোরেনাকে হত্যা করে তার লাশটা সহজেই সরিয়ে ফেলতে পারবে। অনেক খোঁজাখুঁজি আর বিচার-বিবেচনার পর এখন যে পথ ধরে তারা এগিয়ে চলেছে নোরেনাকে সঙ্গে রেখে, সেটাই একমাত্র উপযুক্ত আর আদর্শ স্থান বলে মনে হয়েছে ফিলের।
গত সপ্তাহের শেষ কদিন দিনে রাতের বিভিন্ন সময়ে এখানে হাজির হয়েছে কোন সময়ের জন্যই জনমানবের সে সম্মুখীন হয়নি। না পথে, না সমুদ্রের ধারে। শুধু লক্ষ্য করেছে, সপ্তাহের শেষ দুটো দিন শনিবার আর রবিবার কেউ কেউ সমুদ্রস্নান বা আমোদ আহাদের উদ্দেশ্যেও এখানে আসে।
ফিলের এই প্রশ্নের জবাবের উত্তরে নোরেনা জবাব দিল,সেকথায়, মিঃ টেরল সমুদ্র দেখতে আমিও ভালোবাসি। সমুদ্রের চেয়ে অনেক বেশী জরুরী আমার মায়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করা। আর সেটা যত তাড়াতাড়ি ঘটে ততই মঙ্গল। কারণ আপনিই এই মাত্র বলেছেন আমার মার মারাত্মক অ্যাক্সিডেন্ট ঘটেছে। তাই অযথা সময় নষ্ট না করে গাড়ি ঘুরিয়ে নিন, মিঃ টেরল হাইওয়ে ধরুন।
–তুমি কী করে জানলে যে এ পথ ধরে গেলে তুমি তার কাছে পৌঁছতে পারবে না? আমি কী একবারও বলেছি যে তোমার মাতৃদেবী প্যারাডাইস সিটিতে আছে? শুধু বলেছি–তার অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে?
–প্যারাডাইস সিটিতে আমার মা নেই? তাহলে কোথায় আছেন?
-তোমার মাকে কালভার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এই রাস্তাটা ধরে এগোলে। কালভার অনেক তাড়াতাড়ি পোঁছন যাবে। মিথ্যে বলল ফিল।
মোটেই না, দৃঢ় কণ্ঠে প্রতিবাদ জানাল নোরেনা, এ রাস্তা আমার পরিচিত। এপথ গিয়ে পড়েছে সমুদ্রের বালিয়াড়ির ধারে। স্কুলে কলেজের মেয়েদের সঙ্গে দুতিনবার এখানে পিকনিক করতে এসেছি আমি।
ফিলের রাগে মাথা সপ্তমে চড়ে গেল। সে চোখ লাল করে কর্কশস্বরে বলল, বাজে কথা না বলে চুপচাপ নিজের জায়গায় বসে থাক। এ রাস্তা কোথায় গেছে তা আমার অজানা নয়। মায়ের কাছে তোমার পৌঁছে যাওয়া নিয়ে কথা।
ভীতসন্ত্রস্ত বিস্ময় ভরা চোখ নিয়ে ফিলের দিকে তাকিয়ে রইল নোরেনা।ডঃ গ্রাহামের অফিসে যে লোকটিকে কিছুক্ষণ আগে সে দেখেছিল, এই কি সেই লোক? তাকে দেখে ভদ্র, চমৎকার আর বিনয়ের অবতার বলেই মনে হয়েছিল। আর এ?
শীতল হিমস্রোত কুল কুল করে প্রবাহিত হয়ে গেল নেব্লেনার শিরদাঁড়া বেয়ে। সেকুলকিনারা করতে পাচ্ছিল না, যে–একজন মানুষ এতো তাড়াতাড়ি নিজেকে এমন সুন্দর ভাবে বদলে ফেলল কি উপায়ে? একটু পরেই সমুদ্র দেখা চোখের সামনে।
শতখানেক গজ এগিয়ে গিয়ে এপথ শেষ হয়ে আবার ইউ-য়ের আকারে মোড় নিয়েছিল। নোরেনা আবার তাকাল ফিলের দিকে। মুখের ভাব নরমের পরিবর্তে এখন কঠিন। ঘামে ভিজে সারা মুখ চক্করছে। চোয়াল দৃঢ় হয়ে উঠেছে। চোখের দৃষ্টি জুড়ে বিরাজমান ভয়ঙ্কর জ্বালাময় দ্যুতি। নোরেনার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় তাকে সাবধান হতে নির্দেশ করল বারবার।
খবরের কাগজে সে বহু তরুণী রমনীর চরম সর্বনাশের কাহিনী পড়েছে। নেরেনা বার বার এই ভেবেছে যে মেয়েরা নিজেদের দোষেই এভাবে ধর্ষিতা আর নিহত হয়েছিলকামুক নরপশুদের হাতে। তাদের পোশাক-পরিচ্ছদ অভদ্র আর অশালীন আচার আচরণে লুব্ধ হয়ে ওঠে সেই কামুক নরপশুর দল আক্রমণ হেনেছে মেয়েগুলোর ওপর। তাদেরনারীত্বের সঙ্গে সঙ্গে প্রাণটুকুও ছিনিয়ে নিয়েছে নিজেদের বাঁচার অগিদে। কিন্তু এ লোকটি অযথা তাকে কেন আক্রমণে প্রবৃত্ত হয়? কী অশালীনতা, কী অভব্যতা সে প্রকাশ করেছে এর কাছে? তার কোন অসভ্য আচরণের স্কুল ইঙ্গিতে এই পুরুষের প্রথম রিপুটি জেগে উঠেছে? এতো একজন শিক্ষিত, সুবেশধারী, সুদর্শন পুরুষ–তার মায়ের অ্যাটনী। কোন কামোন্মাদ নরঘাতক নয়। কিন্তু এ লোকটি সত্যিই তার মায়ের অ্যাটনীতে? কৈ, মাতো কোনদিনই তার কাছে এর বিষয়ে গল্পচ্ছলেও বহির্ভকাশ করেনি। নোরেনা আবার অগ্নিদগ্ধ দৃষ্টিতে তাকাল ফিলের দিকে। ফিল ততক্ষণে তার গাড়ি থামিয়ে ফেলেছে।
নোরেনা এরকম পরিস্থিতিতে যে কী করবে তা সে ভেবে পেল না। তার মনে ততক্ষণে এই বিশ্বাস দানা বেঁধেছে যে, মায়ের অ্যাক্সিডেন্টের কথা সর্বৈব মিথ্যা। লোকটি এক মস্ত প্রবঞ্চক। প্রবঞ্চনার মাধ্যমে ভুলিয়ে-ভালিয়ে তাকে বাইরে বের করে এনেছে কোন কু-মতলব সিদ্ধ করার উদ্দেশ্যে।
ফিল গাড়ির ইগনিশান-কীট সবেমাত্র পকেটে পুরতে যাবে, ঠিক সেই সময় পাশের দরজা খুলে বাইরে ঝাঁপ দিল নোরেনা। তারপর দে ছুট।
এইরকম পরিস্থিতি যে ফিলের সম্মুখীন হতে পারে তা সে স্বপ্নেও ভাবেনি। তাই ঝাঁপ দিতে তার কয়েক মুহূর্ত দেরী হল।
নোরেনা ছুটে চলেছে বালির ওপর দিয়ে। ভয়ে দিশেহারা হয়ে পড়ায় সে যে পথ দিয়ে এসেছিল বুইক চেপে, সে পথে না গিয়ে সমুদ্রের সমান্তরাল বালিয়াড়ি ভেঙে ছুটল।
শুধু শুধু হকি আর বাস্কেটবল খেলেনি সে স্কুল কলেজে অনর্থক ইন্টার কলেজ টুর্নামেন্ট একশ গজের ফ্ল্যাট রেসে বারংবার বিজয়িনী হয়নি…বিশ্রী হাই জাম্পে গোটাকয়েক মেডেল পায়নি স্পোর্টসে। এতোদিনে এটা তার কাজে এল, এবার সে নেমেছে জীবন দৌড়ে। সে কী সফল হবে, পারবে নাকি বাজিমাৎ করতে? ফিলও প্রাণপনে তাড়া করে ছুটছে তার শিকারকে। মেয়েটাকে কোন ভাবেই হাতছাড়া করা চলবে না। মেয়েটা না হলে সমস্ত প্ল্যান একেবারে রসাতলে যাবে তাদের। তার ওপর ধরা পড়লে জেলের ঘানি টানতে হবে। কিন্তু ব্যবধান দুজনের মধ্যে বেড়েই চলল। ফিলের বুকে হাঁফ ধরল…পা ভারাক্রান্ত হয়ে এল। গতিবেগ আপনা থেকেই কম হয়ে গেল। নোরেনা ক্রমশই অস্পষ্ট হয়ে ধরা দিচ্ছিল ফিলের দূর দৃষ্টিতে। এক সময় তার চোখে পড়ল, সমুদ্রের দিকে পেছন করে বাঁদিকে মোড় নিয়েছে মেয়েটি। তার লক্ষ্য–ওক, উইলো আর ম্যাপেল গাছে ভরা এক জতুলে জায়গা।
ফিল আর না ছুটে সেখানেই দাঁড়িয়ে পড়ল। সে জানত–ঐ জঙ্গুলে জায়গায় একটা পায়ে চলা পথ আছে, সেটা ঘুরতে ঘুরতে আবার ঐ পথে এসে মিশেছে–যে পথ ধরে বুইকে হাই হাই করে ছুটে এসেছে তারা। চট করে তার মাথায় এক বুদ্ধি খেলে গেল। মেয়েটাকে একসময় না একসময় এই পথেই ফিরে আসতে হবে ঘুরে ঘুরে। তখন তার হাত এড়িয়ে তার পালানোর কোন রাস্তাই খোলা থাকবে না।
নোরেনার অপেক্ষায় একটা গাছের আড়ালে নিজেকে গোপন করে বসে থাকার সময় নানা চিন্তা তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। বিশেষ করে ইরা মার্শের কথা। মেয়েটির প্রশংসায় টিকি একেবারে পঞ্চমুখ। তাদের প্ল্যানের শতকরা নব্বই ভাগ সাফল্যই নির্ভর করছে এই মেয়েটির কর্মশক্তি, বুদ্ধিশক্তি আর স্নায়ুশক্তির ওপরেই। ও যদি সফল হয় তবে তারাও সফলতা পাবে। আর ও যদি ডোবে তাহলে তাদের ভরাডুবি অবশ্যম্ভাবী। তার ওপর নির্ভর করছে সাফল্যের চাবিকাঠি অর্থাৎ শতকরা দশভাগ। ফিলের চালে যদি কোন ভুল হয় তবে জনি উইলিয়ামস, মুরিয়েলমার্শ আর নোরেনা মেয়েটার হত্যাকাণ্ড নিছকই হত্যাকাণ্ডরূপে সামনে ধরা দেবে।
তাদের প্ল্যান মাঠে মারা যাবে। তারই ভুল হয়েছিল টিকির প্রস্তাবে রাজী হওয়া। সে তার। পরিচিত সম্বন্ধে খুবই সচেতন যে সে একজন প্রতারক এবং প্রবঞ্চকও বটে। লোকের সঙ্গে প্রতারণা করাই তার মূল জীবিকা। আজ টিকির ফাঁদে পড়ে তাকে খুনী সাজতে হচ্ছে। আরও একটা ব্যাপারে সে টিকিকে ঠিক মনে-প্রাণে সমর্থন করতে পারছে না। ইরা মেয়েটাকে দশ হাজার ডলারের লোভ দেখালেই যেখানে কাজ চলে যেত, সেখানে পঞ্চাশ হাজার দেবার কোন যুক্তি আছে কি? টিকিকে কথাটা বলায় সে সাপের হাসি হেসে বলেছিল : আরে দেব বলেছি বলেই যে দিতে হবে তার কী মানে আছে? যেখানে তিন তিনটে খুন হওয়ার কথা, সেখানে খুনের সংখ্যা আরও একটা বেড়ে চারকে ছুঁয়ে যাবে, কী আসে যায় তাতে?
নাঃ টিকিকে সত্যি খুব নজরে রাখতে হবে। কে জানে সেও হয়তো আমারই মতো একই ভাবনা ভাবছে হয়তো : চারের জায়গায় ফিলকেও সরিয়ে দিয়ে সংখ্যাটা পাঁচে দাঁড়ালেই বা ক্ষতি কি? ভাবতে ভাবতে এক অস্থিরতা তার মনকে আরো বিচলিত করে তুলল।
ঠিক সেই সময়ে অধীর প্রতীক্ষার অবসান ঘটল। নোরেনা অসতর্ক ভঙ্গিতে বনের পথ ধরে তার সামনে এসে স্ব-শরীরে উপস্থিত হল–মাত্র কয়েক গজ তফাতে।
ফিলকে দেখামাত্র আতঙ্কে নোরেনার মুখ একপলকে ফ্যাকাশে হয়ে গেল। অজানা এক আগন্তুক নিমেষের মধ্যে তার শরীরের সমস্ত রক্ত আর শক্তি এক লহমায় শুষে নিল চো চো করে। ভয়ে কাঠ হয়ে গেল নোরেনা। ফিল বাঘের মতো অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল তার ওপর।
হাঁপাতে হাঁপাতে এক সময় উঠে দাঁড়াল ফিল। নোরেনা নিজের মহামূল্যবান প্রাণ বাঁচানোর আপ্রাণ সংগ্রাম চালিয়ে গেল তার আততায়ীর সঙ্গে। কিন্তু শেষরক্ষা তার হলনা। শক্তিহীন, অবসন্ন, বিপর্যস্ত ফিল নোরেনার মৃতদেহের পাশেই দুহাতের তেলোয় মাথাটা টিপে ধরে চুপচাপ বসে রইল বেশ কিছুক্ষণ। তার পরিচয় আজ থেকে পরিবর্তিত হয়ে গেল সমগ্র পৃথিবীর কাছে। এতোদিন ধরে তার পরিচয় ছিল প্রবঞ্চক রূপে। কিন্তু আজ সে খুনী, নিরীহ, নিরপরাধ একটি মেয়ের হত্যাকারী। বহুক্ষণ বাদে সে তার অবনত মাথা তুলল। ঘড়ি দেখল সকাল আটটা চলিশ। হাতে এখন অনেক কাজ। লাশ পাচার করতে হবে, টুকিটাকি প্রমাণ ইত্যাদি যা কিছু ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এদিক-ওদিকে, তা লোপ করতে হবে…টিকিকেও ফোন করে এই দুর্ঘটনার কথা জানাতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি।
তাই বসে এভাবে সময় নষ্ট করলেই চলবেনা। উঠে দাঁড়াল ফিল। ফিরে গেল বুইকের কাছে। ট্রাঙ্ক খুলে একটা বেলচাও বের করে ফেলল। বেলচা সঙ্গে নিয়ে ফিরে এল মৃতা নোরেনার নাগালের কছে। তার মরদেহ রক্তে ভেসে যাচ্ছে। পূর্বে সেই সুন্দর চেহারা বর্তমানে বীভৎস আর ভয়ঙ্কর। দ্বিতীয়বার তাকিয়ে দেখার মতো ফিলের বুকের পাটা নেই। তাই সে একরকম চোখ বন্ধ করেই লাশটা কাঁধে তুলে নিয়ে গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে চলল একটা বড় আর উঁচু বালিয়াড়ির দিকে। বালির তলায় পুঁতে ফেলতে হবে লাশটা।ফিলের মনোগত ইচ্ছা ছিল নোরেনার জামাকাপড়গুলো একটা পুঁটলিতে পাথরে বেঁধে সমুদ্র বক্ষে বিসর্জন দিতে কিন্তু এডরিসের কড়া হুকুমের বিপক্ষে যাওয়ার মানসিকতা তার ছিল না। তাই হুকুম ছিল : নিয়ে আসবে সঙ্গে করে। যদি কোনভাবে পুলিশের হাতে পড়ে তবে ওরা কলেজ-লীর ছাপ লক্ষ্য করে ঠিক তাদের জালে কোনভাবে ফাঁসিয়ে ধরে ফেলবে। সো উই কান্ট টেক এ চান্স।
তরুণী নোরেনাকে পোশাকমুক্ত করার সময় ফিলের দৃষ্টি গেল তার নধর-নিটোল তারুণ্যের ওপর। হাতকে স্পর্শও করল লোভনীয় ও আকাঙ্খিত কয়েকটি নারী অঙ্গ। অন্য সময় হলে তার যে পৌষত্ব জেগে উঠত তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। কিন্তু এখন পরিস্থিতি এতোই বেদনাদায়ক যে মৃত শরীরের পরশ লাগা মাত্রই সে অজানা এক আতঙ্কে শিউরে উঠছে। নোরেনার গলায় সোনার ক্রশ ঝোলানো সরু সোনার হার ঝুলছিল, সযত্নে খুলে সে পকেটে ভরল। জামা কাপড়গুলো বান্ডিল করে বেঁধে নিল। তারপর নোরেনার নগ্ন মৃতদেহটা বালির ওপর শুইয়ে বালিয়াড়ির গায়ে বেলচার ঘা দিয়ে আঘাত হানতে হানতে বালির মধ্যে তাকে কবর দিয়ে ফেলল।
.
সকাল তখন নটা পঁয়তাল্লিশ।
পুলিশ প্রধান মিঃ টেরলের অফিসঘরে কথোপকথন হয়ে চলছিল তার এবং হেরে মধ্যে। বেইগলারনীরবে বসে কথাবার্তা শুনছিলেন ঘরের এককোণে। হেস বলছিলেন : আমাদের হাতে যা কিছু প্রমাণ আছে তা ঘুরে ফিরে একটা দিকই নির্দেশ করছে, চীফ। মুরিয়েল মার্শ প্রথমে জনিকে হত্যা করে তারপর লো-কোকাইল রেস্তোরাঁয় এসে নিজেও মৃত্যু বরণ করেছে। রিভলবার আর হাইপোডার্মিক সিরিঞ্জের গায়ে মুরিয়েলেরই ফিঙ্গার ফ্রিন্ট পাওয়া গেছে। তার মানে এই দাঁড়াচ্ছে আমরা এমন আর কোন প্রমাণ পাইনি যাতে করে প্রমাণ করা যায় যে, সে জনিকে হত্যা করেনি অথবা নিজে বলি হয়েছে অপর কোন অজ্ঞাত আগন্তুকের হাতে।
-সুইসাইড নোটের হাতের লেখা রিপোর্ট কী বলছে?
–ওটা মুরিয়েলেরই হস্তাক্ষর। ওর অ্যাপার্টমেন্টে প্রবেশ করে অন্য যে সব নমুনা পেয়েছি–এক্সপার্টরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে এই রায় দিয়েছেন প্রত্যেকটা নমুনাই একজনের হস্তাক্ষর ইঙ্গিত করছে।
–হুম বুঝলাম।
আমার মনে হয় চীফ উই ক্যান্ ক্লোজ দ্য ফাইল, আপনি এ বিষয়ে কী বলেন?
মিঃ টেরল হেসের প্রশ্নের কোন জবাব না দিয়ে পরিবর্তে পাল্টা প্রশ্নের তীর ছুঁড়ে হেকে বললেন, ওর স্বামীর কোন সংবাদ আছে? সন্ধান করতে পেরেছ তার? এনকোয়ারীর জন্যে তাকে তো একবার প্রয়োজন হবেই। তাছাড়া কন্যাসন্তানও বর্তমান।
তারপর নিজেই নিজের গাল চুলকোতে চুলকোতে বেইগলারের উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন, জো এতক্ষণ ধরে ওদের কথাবার্তা চুপচাপ থেকে শুনে যাচ্ছিলেন।
জো! টেলিফোন ডাইরেক্টরী খুঁজে ফেল। ডেভন নামে কাউকে পাও কি একবার দেখতে।
বেইগলার চেয়ার ছেড়ে উঠেদাঁড়িয়ে সেই কামরার এককোণে বুক-সেল থেকে টেলিফোন ডাইরেক্টরী নামিয়ে এনে ঝুঁকে পড়ে পাতা উল্টাতে শুরু করে দিলেন। কিছুক্ষণ পরে মুখ তুলে জানালেন পেয়েছি চী, মেলভিন ডেভন, একশো পঞ্চান্ন হিলসাইড ক্রিসেন্ট। ফোন করবে?
কর।
বেইগলার লাইন জুড়লেন টেলিফোনের রিসিভার তুলে। সামান্য পরেই ওপাশ থেকে সাড়া এল এক মহিলার : দিস ইজ মিঃ ডেভন রেসিডেন্স।
-সিটি পুলিশ, বেইগলার জবাব দিলেন, মিঃ ডেভনকে কলটা একবার দেবেন কি?
-তিনি এসময়ে বাড়ি থাকেন না। আপনি ওঁর ব্যাঙ্কে ফোন করে দেখতে পারেন।
কোন ব্যাঙ্ক?
–ফ্লোরিডা সেফডিপোজিট ব্যাঙ্ক, নম্বর চান?
–নম্বর আমার জানা, আপনাকে আর কষ্ট করতে হবেনা, ধন্যবাদ।রিসিভার নামিয়ে রেখে বেইগলার তার চীফকে বললেন, ভদ্রলোক ফ্লোরিডা সেফ ডিপোজিট ব্যাঙ্কে কাজ করেন স্যার।
শুনে টেরলের ভুরু কুঁচকে গেল। তিনি একটু চিন্তিত কণ্ঠে বলে উঠলেন, লোকটি আমার। পরিচিত বলেই মনে হচ্ছে। গলফ খেলায় তার যথেষ্ট সুনাম।কন্ট্রি ক্লাবে দুজনে বেশ কয়েকবার এক সঙ্গে গলফ খেলেছি। চমৎকার মানুষ। যদি সেই ভদ্রলোক হন তবে একটু সমস্যা সৃষ্টি হবে, তোমাদের প্যারাডাইসকাগজেরবার্ট হ্যাঁমিলটনএসংবাদ তার কানে পৌঁছলে পাতাভর্তি ফীচার লিখতে বসে যাবেসঙ্গে সঙ্গে। হেডিং দেবেহয়তোফ্লোরিডা সেফডিপোজিট ব্যাঙ্কের একজন কর্তা ব্যক্তির স্ত্রী হত্যা এবং আত্মহত্যার কাণ্ডে জড়িত! ভাবতে পার কথাটা? ওঁর সঙ্গে কথোপকথনের ব্যাপারটা তুমি বরং আমার ওপরেই ছেড়ে দাও, জো। তুমি অন্য কাজে হাত দাও বরং।
মিঃ মেলভিন ডেভন একজন মধ্যবয়স্ক পুরুষ, লম্বাচওড়া বলিষ্ঠ চেহারা। বাদামী চুলে ধূসরতার ছায়া স্পষ্ট।
সমুদ্রের মতনীল চোখের তারা, শান্তদৃষ্টিতবেমর্মভেদী। মুখশ্রী যেমন সুন্দর তেমনি হাসি খুশি। তাকে দেখলে বোঝা যায় ভদ্রলোক কর্মী,দয়ালু, বিবেচক কিন্তু মনের দিক থেকে সরলতার পরিবর্তে জটিল মনোভাবই প্রকট।
বহুদিন পরে মিঃ টেরলকে দেখতে পেয়ে তিনি মনে মনে খুবই খুশী হলেন। তাকে সমাদরে বসিয়ে কুশলাদি বিনিময়ের পরে বলে উঠলেন, কতদিন পরে দেখা!
আপনি তো ক্লাবে যাওয়া একপ্রকার ভুলেই বসেছে, মিঃ টেরল। গলফ খেলা ছেড়ে দিলেন নাকি?
-না, একেবারে ছেড়ে বললে একটু ভুল বলা হবে। মাঝে মধ্যে ক্লাবেও ঝাঁকি দর্শন দিই। কাজের চাপে কোনটাই ঠিক নিয়ম মাফিক হয় না, এই আর কি।হাসি হাসি মুখে উত্তর দিলেন টেরল।
কিছুক্ষণ নিজেদের মধ্যে কথালাপ সারতে লাগলেন দুই বন্ধুতে। বুদ্ধিমান টেরলের বুঝতে অসুবিধা হলনা যে, যদিও মেল ডেভন তার সঙ্গে আন্তরিক ভদ্রতার এবং হৃদ্যতার বশবর্তী হয়েই আলাপকরছেন, তবু তিনি যেকর্মব্যস্ত এবং এই সময়টুকু তার অফিসের কর্তব্য আর কর্মভাণ্ডারকে একটু একটু করে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে বলে তার মনের মনি কোঠায় যে সাময়িক অন্যমনস্কতার গহুর সৃষ্টি হচ্ছে, তা তার চোখের দৃষ্টিকে ফাঁকি দিতে পারল না। তাই ভূমিকার আড়াল না নিয়ে টেরল মূল বক্তব্যে এসে পড়লেন। বললেন, মিঃ ডেভন! আমি একজন মহিলার সম্পর্কে কিছু তথ্য জানার অভিপ্রায় নিয়ে এসেছি। আপনি আমাকে সে ব্যাপারে যথেষ্ট সাহায্য করতে পারেন, বলেই আমার স্থির বিশ্বাস। ভদ্রমহিলার নাম মুরিয়েল মার্শ ডেভন।
এই অতর্কিত আক্রমণের জন্য ডেভন মানসিক দিক থেকে একেবারেই প্রস্তুত ছিলেন না। সঙ্গে সঙ্গে চেয়ারের ওপর শক্ত কাঠ হয়ে গেলেন ডেভন। চোয়াল আপনা থেকেই কঠিন আকার ধারণ করল। শান্ত দৃষ্টি হয়ে উঠল তীক্ষ্ণ আর সন্দেহপ্রবণ। তবে এই ভাবান্তরের রূপের প্রকাশ ছিল সাময়িক। অল্পক্ষণের মধ্যেই নিজেকে সংযত করে তিনি স্বাভাবিক কণ্ঠে জবাব দিলেন : আমার স্ত্রীর নাম, কিন্তু কী ব্যাপার? সে কোনরকম ট্রাবলে পড়েছে নাকি?
জবাব শুনে ভেতরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লেন টেরল, যাক নোরেনার পিতার সন্ধানও অবশেষে মিলল, মনোভাব গোপন রেখে টেরল এবার কথালাপের মধ্যে কিছুটা কৌশলের আশ্রয় নিলেন। গাল চুলকোতে চুলকোতে বললেন, হ্যাঁ, একরকম ট্রাবলই বটে। গতরাত্রে উনি মারা গেছেন..সুইসাইড করেছেন।
শুনে ডেভন অনড় হয়ে বসে রইলেন নিজের চেয়ারে। কিছুক্ষণ নিষ্পলক নেত্রে তাকিয়ে রইলেন টেরলের দিকে তারপর ধীরে ধীরে বললেন, বছর পনেরো-ষোল হবে আমাদের দুজনের মধ্যে বিবাহ-বিচ্ছেদ হয়ে গেছে। আমরা যখন বিবাহ করি তখন দুজনেরই বয়স ছিল খুবই কম–মাত্র উনিশ কি কুড়ি দুইছই। বছর দুই মতো আমরা একসঙ্গে সুখী গৃহকোণে বসবাস করেছিলাম। আমাদের একটি ফুটফুটে সুন্দর কন্যা সন্তান হয়েছিল। তাকে সঙ্গে নিয়েই সে ঘর ছাড়ে। অভিমানে পাথর হয়ে আমি তার বিপক্ষে গিয়ে তার পথে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করিনি। এতদিন পরে, আপনার কাছে এই প্রথম তার নাম শুনলাম, যখন সে মৃত, আত্মহত্যা করেছে শুনে মনে ব্যথা পেলাম। আপনি এ বিষয়ে নিশ্চিত যে, মহিলা মুরিয়েল? অন্য কেউ নয়?
একটি মেয়েও আছে, তার নাম নোরেনা।
–তবে সে মুরিয়েলই। কারণ মেয়ের নামকরণ আমি করেছিলাম। নোরেনার কোন সংবাদ জানেন?
মিঃ ডেভনের সঙ্গে দেখা করতে আসার কিছু আগে এডরিসের ফোন এসেছিল মিঃ টেরলের কাছে। তাতে সে জানিছিল:মুরিয়েলের হিতাকাঙকী একজন বন্ধু হিসেবেই সেমুরিয়েলের মৃত্যু সংবাদটা তার মেয়ে নোরেনাকে না জানিয়ে পারেনি। নোরেনা সংবাদ পেয়ে এখানে খুব শীঘ্রই আসছে। কিন্তু সে এসে কোথায়, কার কাছেই বা থাকবে? তারওপর তার ভরণ পোষণের প্রশ্নও আছে। এডরিস হয়তো কিছুদিন তার সব দায়িত্ব পালন করবে কিন্তু তারপর? সেই জন্যই টিকি টেরলকে অনুরোধ করেছে।
মিঃ টেরল যদি খুব তাড়াতাড়ি নোরেনার পিতার খোঁজ নিতে পারেন আর বুঝিয়ে-সুঝিয়ে সেই ভদ্রলোকের কাছে মেয়েটার একটা গতি করে দিতে পারেন, তাহলে মুরিয়েলের পারিবারিক বন্ধু হিসেবে খুব খুশী আর সুখের অন্ত থাকবে না তার। তারজন্য প্রয়োজনে যদি কিছু অর্থব্যয় করতেও হয় তাতেও এডরিস প্রস্তুত।
মিঃ টেরল জানিয়েছিলেন: নোরেনার পিতার সন্ধান তিনি অবিলম্বেই করছে, সেজন্য টিকির চিন্তার কোন কারণ নেই। নোরেনার পিতা ভেবে, এই মুহূর্তে যার খবরা-খবর নিতে তিনি প্রস্তুত হচ্ছেন, যদি তা সত্যি হয় তবে তিনি এডরিসকে এই উপদেশ দেকেন–এডরিস যেন মুরিয়েল আরজনি উইলিয়ামএর কেচ্ছা কাহিনী নিয়ে অযথা জল ঘোলানা করে তোলে। এর ফলস্বরূপ শুধু সেই ভদ্রলোকনয়, নোরেনার জীবনও অশান্তির আগুনে দগ্ধ হতে থাকবে। এডরিস যদি সত্যি সত্যিই নিজেকে ওদের পরিবারের একজন বলে মনে করে থাকে, নোরেনাকে যদি সে সত্যিই মেহ করে, ভালোবাসে তবে যেন মুখে কুলুপ এঁটে থাকে আপাততঃ।
এডরিস এই প্রস্তাবে রাজী হয়েছিল।
ডেভনযখন উদগ্রীব হয়ে নিজে থাকতেই নোরেনার সংবাদ জানতে ব্যাকুল হলেন তখন আরো একবার স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন মিঃ টেরল। সানন্দে বলে উঠলেন, নোরেনার খবর ভাললাই, আজই তার স্ত্রীকোম্ব-এ মায়ের অ্যাপার্টমেন্টে পৌঁছবার কথা, এই খবর আমরা তার মাধ্যমেই পেয়েছি।
বেচারি! এতো অল্প বয়সে মাকে হারিয়ে না জানি কত কষ্টই না পাবে?
টেরল কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে উঠলেন, যদি কিছু মনে করেন তবে পুলিশ অফিসার হিসেবে আমার কিছু প্রশ্ন করার ছিল আপনার কাছে। আপনি বিত্তবান, এ শহরের মাননীয় ব্যক্তি। তাই অধীনস্থ কাউকে না পাঠিয়ে তদন্তের কাজে আমি নিজে উপস্থিত হয়েছি–একজন বন্ধু হিসেবে।
–বেশ,করুন, কীপ্রশ্নকরবেন। আমার যতোটা জানা আছে অকপটে আপনাকে খুলে বলব।
টেরল একটু থেমে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনার স্ত্রী আপনাকে ছেড়ে চলে যাবার পর তার পরবর্তী জীবনের কাহিনী সম্পর্কে আপনি যদি কিছু আলোকপাত করতে পারেন।
শুধু সংক্ষিপ্ত জবাব, কর্কশ কণ্ঠে বলে উঠলেন : না।
মিঃ টেরল সংক্ষিপ্তভাবেমুরিয়েল মার্শের কাহিনীতুলে ধরলেন ডেভনের সামনে। ধীরে ধীরে বলে চললেন তার মর্মান্তিক কাহিনীর অন্তিম দিনটি পর্যন্ত। মিঃ ডেভন স্তব্ধ মুখে পাথরের মতো উপবিষ্ট ছিলেন তার আসনে, দরকারী অদরকারী সকল প্রমাণ সমেত মার্শের জীবনী টেরল তার কাছে তুলে ধরলে ডেভন বললেন, আপনি বলছিলেন না যে, নোরেনা আজ সকালে ফিরছে প্যারাডাইস সিটিতে?
–হ্যাঁ, এডরিস তাই তো বলছিল আমাকে, তার ধারণা, আপনার কানে এ সংবাদ পৌঁছলে তাকে দেখার জন্য আপনার মন ব্যাকুল হয়ে উঠবে।
মিঃ ডেভন বলে উঠলেন, এডরিসের ধারণাই ঠিক। তার মা আমার কাছে দোষী হতে পারে কিন্তু সে তো নয়। আচ্ছা মিঃ টেরল! নোরেনার সম্পর্কে আপনার আরো কিছু জানা আছে কি?
–যা জানতাম অর্থাৎ এডরিসের মুখ থেকে যা শুনেছি, তার সবটাই আপনার কাছে ব্যক্ত করেছি। বাড়তি হিসেবে তার একটা ছবি বরং আমি আপনাকে দিতে পারি। এই বলে মিঃ টেরল তার কোটের পকেট থেকে ইরা মার্শের একটি ছবি–এডরিস সুকৌশলে যেটা মুরিয়েলের ড্রেসিংটেবিলের ফটোস্ট্যান্ডে আটকে রেখেছিল আসল নোরেনার ছবির পরিবর্তে, সেটাই বার করে ডেভনের সম্মুখে বাড়িয়ে দিলেন, এই নিন।
মিঃ ডেভন সাগ্রহে ছবিটা নিয়ে অনেকক্ষণ বিস্মিতপুলকে দেখতে দেখতে এক সময়ে বললেন, অবিকল ওর রূপে ঠিক ওর মা। আমার সন্তান নোরেনা। আশ্চর্য! দীর্ঘ পনেরো বছর পরে ওর ছবি দেখছি। সত্যি ভাবতেই অবাক লাগছে যে, আমার সতেরো বছরের সুন্দরী একটি মেয়ে আছে। ওর মায়ের ফ্লাটেই উঠবে বোধহয়? এডরিসের ঠিকানাটা কী যেন মিঃ টেরল?
টেরল এডরিসের ফোন নাম্বার ও ঠিকানা দুই লিখে দিলেন ডেভনকে। আর বললেন, এডরিসকে টেলিফোন করে বলে দেবেন আপনি কোন উদ্দেশ্য নিয়ে সেখানে যেতে চান। তারপর না হয় যাবেন।
ডেভন শুধু হাসলেন। বললেন, আমার উদ্দেশ্য? সেতো জলের মতো পরিষ্কার। আমি আমার মেয়েকে তার নিজের বাড়িতে ফিরিয়ে আনতে চাই।
.
এয়ারপোর্টের বাইরে বাসটার্মিনাসের কাছে একটা বেঞ্চের ওপর দুহাত কোলের কাছে জড়ো করে চুপচাপ বসেছিল ইরা।ফিল অ্যালগিরের হাঁকিয়ে আসা গাড়ি তার থেকে একটু তফাতে এসে থেমে গেল। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকার পর বুঝতে পারল : এই মেয়েটি আসলে ইরা মার্শ, যার ফটো এডরিস তাকে দেখিয়েছিল। এডরিসের অ্যাপার্টমেন্টে একেই হাজির করাতে হবে।
গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়াল ফিল। তারপর ইরার সামনা-সামনি এসে গম্ভীর সুরে জিজ্ঞাসা করল: তুমিই কি ইরা মার্শ? ব্রুকলিন থেকে রাতের ফ্লাইট ধরে এসেছ?
ইরাও তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ফিলের পা থেকে মাথা পর্যন্ত জরিপ করে নিয়ে বলল, হ্যাঁ। আশাকরি, তুমি ফিল অ্যালগির?
-হ্যাঁ।
–তা এত দেরী হলো কেন? মাল টেনে মত্ত হয়ে ফুর্তি করতে করতে ঘুমে অচৈতন্য ছিলে নাকি?
ফিলতো হতভম্ব। বাপরে! কী সাংঘাতিক মেয়ে, দেহের বয়সে সতেরো হলে হবে কি, কথা শুনলে মনে হয় মনের বয়সে বুঝি আরো দশ এগিয়ে গেছে। কয়েক সেকেন্ড অতিবাহিত হল তার মুহূর্তের হতভম্ব ভাব কাটাতে। তারপর কর্কশ কণ্ঠে বলে উঠল; আমার কাজকর্মের কৈফিয়ৎ না চেয়ে চটপট করে গাড়িতে উঠে বস। এখন থেকে নিজের ওজন বুঝে কথা বলতে শেখ। নইলে বিপদে পড়বে কোনদিন।
ইরা ব্যঙ্গের হাসি হেসে বলল : উপদেশের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।বুইকের ব্যাকসীটে উঠে বসল।
পাহাড়-প্রমাণ এক বোঝা, নিজের মনে উৎকণ্ঠার সঙ্গে অ্যাপার্টমেন্টে ছটপট করছিল এডরিস। সাড়ে এগারোটা বেজে গেল অথচ ফিল বা ইরা কারো কোন দেখা নেই। কী ব্যাপার কে জানে? ভাবা শেষও হয়নি তার আগেই দরজার ঘন্টি বেজে উঠল। এডরিস ছুটে গিয়ে দরজা খুলে দিল। দোর গোড়ায় ইরা আর ফিল পঁড়িয়ে। দুজনে একসঙ্গে ঘরের মধ্যে পা রাখল। ফিলের হাতের ব্যাগটা দেখিয়ে এডরিস জিজ্ঞাসা করল : ওতে কী নোরেনার পোশাক বুঝি?
-হ্যাঁ। জবাব দিল ফিল।
এডরিস তখন ইরাকে বলল, ব্যাগটা নিয়ে গিয়ে ও ঘরে নিয়ে তোমার পোশাক তাড়াতাড়ি করে বদলে ফেল। মিঃ ডেভন আসছেন। হাতে কেশী সময়ও নেই। আর শোন, বুঝে শুনে ওর সঙ্গে মেপে মেপে কথা বলল। কারণ মাথায় রেখ তোমার মার সব দুঃখ কষ্টের মূলে কিন্তু ঐ ডেভনই। আর মা ছিল তোমার প্রাণের চেয়েই প্রিয়। যা যা শিখিয়েছি সেইমতো নিখুঁতভাবে অভিনয় করো। ক্লীয়ার?
–ঠিক আছে, ঠিক আছে। অত করে না বললেও চলবে। আমি নিরেট নই, বুদ্ধির জোর আমারও আছে। অভিনয়ের জন্যে যখন টাকাটা হাত পেতে নিচ্ছি তখন দক্ষতার সঙ্গেই অভিনয় করে যাব। এর জন্য অযথা চিন্তা ভাবনা করো না।
কথা শেষ হলে নিতম্ব দুলিয়ে ব্যাগ হাতে করে চলে গেল এডরিসের নির্দেশিত কামরার দিকে।
.
০৪.
বাহামায় তিন সপ্তাহ ধরে ছুটি উপভোগ করার পর তাই কিছুক্ষণ হবে বাড়ি ফিরেছে জয় অ্যানসলি। বাবাও গিয়েছিলেন তার এই ভ্রমণের পথে। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কী, জয়ের মতন একজন রোমান্টিক প্রকৃতির মেয়ের পক্ষে বাহমার মতন একটি সুন্দর রোমান্টিক দ্বীপে কোন পুরুষের সঙ্গে না এসে আশী বছরের বৃদ্ধ বাবার সঙ্গে বেড়াতে যাওয়ার ভ্রমণের আনন্দটা সম্পূর্ণভাবেই মাটি হয়ে গেছিল। কিন্তু উপায় যখন অভাব তখন এই কঠোর মতকেই মনে-প্রাণে গ্রহণ করতে হয়েছিল।
বহু চেষ্টা করেও বাবার পরিবর্তে মেল ডেভনকে কিছুতেই রাজী করানো সম্ভব হল না।
জয় অ্যানসলির বয়স ত্রিশ বত্রিশ লম্বা তবে স্বাস্থ্যের সঙ্গে তাকে বেশ মানিয়ে গেছে। এই বয়সেও মোহময়ী সুদৃঢ় যৌবনের অধিকারিনী সে। চরিত্র মাধুর্য আর চারিত্রিক দৃপ্ততায় সাধারণ ঘরের মেয়ের চাইতে অনেক ওপরেই ছিল এই জয়। বছর পাঁচেক আগের কথা, এক বান্ধবীর দেওয়া পার্টিতে মেল ডেভনের সঙ্গে সেই প্রথম আলাপ জয়ের। প্রথম দিন থেকেই সে মেলের প্রেমে পড়ে যায়। মেল যে বিবাহিত তবু পত্নীবিহীন এবং এই নিঃসঙ্গতা দূর করতে সে যে কাউকে আবার জীবন সঙ্গিনীরূপে বেছে নিতে তার বিশেষ কোন উৎসাহ নেই–তা অজানা ছিলনা জয়ের কাছেও। তবু দমবার পাত্রী সে নয়। জয়ের আশা ছিল, তার প্রেম যদি খাঁটি হয়, নিখাদ হয় তবে একদিন না একদিন মেল তার বাহুতে একান্তভাবেই জয়ের হয়ে নিজেকে সমর্পণ করবেই করবে। জয় চঞ্চল বা অস্থির প্রকৃতির মেয়ে নয়–সে প্রতীক্ষা করতে জানে। গত পাঁচ-পাঁচটা বছর ধরে সে তার প্রতীক্ষার দিন গুণছে। মেলের বান্ধবী আর সঙ্গিনী হিসেবেই জয় পরিতৃপ্ত। জয়ের বাবা একজন অবসর প্রাপ্ত বিচারপতি। লোকচরিত্র সম্পর্কে তার জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার ভান্ডার ও যথেষ্ট। মেলকে তিনি সুনজরেই দেখেছেন।
বেডরুমে বসে বসে একমনে মেলের কথা ভাবতে ভাবতে তন্ময় হয়ে টুকিটাকি জিনিসগুলো গোছগাছ করছিল এই সময় ফোনটা বেজে উঠল।
–হ্যালো
–জয়, আমি মেল বলছি। ভাল আছ তো? তারপর ছুটি কাটালে কেমন?
–মন্দ নয়, ভালোই।
–জজ সাহেব ভালো আছেন?
—আছেন।
–জয়! আজ সন্ধ্যা ছটা নাগাদ আমার সঙ্গে একবার দেখা করতে পার? কিছু জরুরী কথা ছিল।
মেলের কণ্ঠসরের এমন উদ্বেগ ছিল যা জয়ের কানকে ফাঁকি দিতে পারল না। সে মনে মনে রোমাঞ্চিত হয়ে জিজ্ঞাসা করে উঠল, নিশ্চয়ই হবে। কোথায় তোমার সঙ্গে দেখা হতে পারে তুমি না হয় ঠিক করো?
–আমার দপ্তরেই চলে এসো।
–ব্যাঙ্কে! একটু অবাক হলো জয়। দীর্ঘদিনের অদর্শনের পরে বিরহের পালাকাতর যুবক-যুবতীর সাক্ষাৎকারের আদর্শ মিলনস্থল হিসেবে মেল কিনা পরিশেষে তার দপ্তরকেই বেছে নিল। তাই সে অনুরাগ ভরা সুরে বলল, এমন চমৎকার সন্ধ্যা কাটানোর জন্যে তুমি আর কোন জায়গা পেলে না, মেল? কেন সমুদ্রের ধারে তোমার যে বাংলোখানা আছে, সেখানে গেলে, মন্দ হয় না।
–না জয়, না তুমি আমার দপ্তরেই এসো। দেখা হবার পর আগাগোড়া একেক করে সব খুলে বলব তোমায়। ঠিক ছটার সময় তোমার দর্শন পাচ্ছি তো?
–ও, হ্যাঁ? জয়ের কণ্ঠস্বর সামান্য হতাশায় ভারাক্রান্ত হয়ে উঠল।
সন্ধ্যে ছটা নাগাদ ব্যাঙ্কে মেল ডেভনের রুমে টেবিলে মুখোমুখি বসে আছে জয় আর মেল। ডেভন গম্ভীর মুখে কিছু বলছেন। আর জয় একমনে তা হজম করছে। তার চোখে মুখে নানান ভাবের খেলা। মুরিয়েল, জনি উইলিয়ামস, এডরিস আর নোরেনা, সবাইকে জড়িয়ে সমস্ত কাহিনীটাই কোথাও কোন অপূর্ণ না রেখে পুরোটাই শুনিয়ে গেলেন জয়কে।কাহিনীর অন্তহতেই অসহায়ের ভঙ্গিতে তিনি বলে উঠলেন, জয়! তোমার আর আমার মধ্যে বন্ধুত্ব বহু পুরনো।
প্রকৃত বন্ধুর মতোই আমরা দুজনে দুজনের কাছে সহজ, সরল আর কোন বিষয়েই ছলনার আশ্রয় নিতে হয়নি। অকপটেই উভয়ে উভয়ের কাছে সত্যতা স্বীকার করি। নোরেনার কথা আমি জানতাম না।মুরিয়েল ওকে নিয়ে ঘর ছাড়ার পর অভিমানে ওদের সম্বন্ধে কোন সংবাদ নিইনি আমি, তবে নোরেনা আমার সন্তান। তারজন্য আমার অন্তরে বরাব্বই একটা স্নেহকোমল স্থান সুসজ্জিত রয়েছে। তাই মনটা মাঝে মাঝে অবাধ্য হয়ে হু হু করে উঠত তারজন্য। যতো সময় পেরোতে লাগল ততই অস্পষ্টরূপেরূপ নিতে থাকলতার ছবি। এতদিন বাদে আচমকা বিস্মৃতিরত ছেয়ে থাকা কুয়াশা সরিয়ে দেখা দিলসূর্যের আলো।সপ্তাহ দুইআগের কথা তুমি তখনবাহামায় উদ্দেশ্যে পাড়ি দিয়েছে ছুটি কাটানোর জন্য, হঠাৎ করে ফিরে পেলাম আমার সন্তানকে। যখন তাকে হারাই তখন সে খুব ছোট মাত্র দুবছরের শিশু, আর আজ সে সপ্তদশী তরুণী।
হাব-ভাব, চালচলন..কথাবার্তাকত তফাৎ,কত পরিবর্তন।ও যদি অবিকল ওর মায়ের মতন দেখতে না হতো তবেও যে আমারই মেয়ে তা বিশ্বাস করতে আমার খুব কষ্ট হতো। ওকে দোষী বানিয়ে লাভটাই বা কোথায়? পরিবেশ আর পরিস্থিতি ওকে আজ এইভাবে গড়ে উঠতে বাধ্য করেছে। আমি ওকে কাছে পেয়ে লোভ সামলাতে পারলাম না। লোভীমন ওকে বুকে টেনে নিল। ওর মুখে একটু হাসি ফোঁটাতে, সুখে-সাচ্ছন্দ্যে রাখতে একজন আদর্শ পিতা রূপে যা যা করা প্রয়োজন–সবই করে গেলাম একেক করে। কিন্তু বার বার চেষ্টা করেও হার মানতে হল আমার বিরুদ্ধে ওর অশান্ত মনোভাবকে শান্ত করতে। ও বাবা বলে আমায় ডাকে বটে, শুনে মনে হয় যেন করুণা করে…মুখ বুজে কর্তব্য পালন করে।
জয় নোরেনার কথা শুনে মনে মনে আচমকা এক ধাক্কা খেল। মেলকে একান্তরূপে পাবার আশা সম্পূর্ণরূপে দুরাশার পরিণতি না পেলেও, আগের চাইতে এ সত্য যেন আরো কঠিন হয়ে দাঁড়াল। জয় অত সহজে দমবার পাত্রী নয়। বুদ্ধিমতী সে, মনে আশাও রাখে।
সে জানে, মানুষের মনের চাহিদা কেবলমাত্র তার মা-বোন-মেয়ের পক্ষে মেটানো সম্ভব নয়। বাড়তি অংশটুকু পূরণের জন্য চাই ভিন্ন প্রকৃতির এক নারী। সঙ্গিনী হোক আর পত্নীই হোক। তাই এখনই হতাশায় মনকে ভরিয়ে ভোলার যুক্তিসঙ্গত কোন কারণ নেই। সে বলল, ডীয়ার মেল। এতো দিনের দীর্ঘ মানসিক ব্যবধান চট করে আর সহজে কমিয়ে আনার আশা করতে পার না তুমি। এর জন্য তোমায় ধৈর্য ধরতে হবে। সহনশীলরূপে নিজেকে উপস্থিত করতে হবে। সহানুভূতিসম্পন্ন হতে হবে। তুমি ওর মনের পুঞ্জীভূত নিঃসঙ্গতা দূর করার জন্য এ যাবৎ কী কী প্রচেষ্টা করছে তা জানতে পারি কি?
যা যা করা আমার পক্ষে সম্ভবপর হয়েছে, সবকিছুই চেষ্টা করেছি। তবু ওর যেন কোন কিছুতেই রুচি বা আগ্রহ নেই। বেশীরভাগ সময়েই নিজের ঘরে শুয়ে বসে পপমিউজিক শোনে। কতবার বলেছি : খেলাধূলা করতে চাও? ক্লাবে যেতে ইচ্ছা করে? পড়াশুনোয় আগ্রহ আছে? নাচ-গান শিখতে চাও? সব প্রশ্নের জবাবে সেই বাঁধা-ধরা গদ, না। কেবল ওর একটা বিষয়ের প্রতি অসীম উৎসাহ বার বার লক্ষ্য করেছি। সেটা হলো বেঁটে এডরিসের সঙ্গে প্রায় প্রতিদিন দেখা করতে যায়। এই ব্যাপারটা আমার খুবই অপছন্দের। একজন সম্ভ্রান্ত মানুষের মেয়ে হয়েও টু হুট করে সামান্য একজন ওয়েটারের সঙ্গে মেলামেশা করবে–আমি এটা একদম বরদাস্ত করতে পারিনা তাই ভাবছি, ওদের মধ্যে দেখাশোনা বন্ধ করে দেব।
জয় শান্ত কণ্ঠে বলল, এটা করা উচিত হবেনা, মেল। ভেবে দেখ,বালিকা বয়স থেকে তোমার মেয়ে তাকে পরিবারের একজন বন্ধুর চোখেই দেখে আসছে। তোমার অনুপস্থিতিতে কাণ্ডারীহয়ে আপদে-বিপদে সে তাদের পাশে থেকেছে। তাই আজ হঠাৎ করে তার অস্তিত্বকে তোমার মেয়ের মন থেকে হেঁটে ফেলতে পার না তুমি। তাছাড়া, তুমি বাড়িতেই বা থাক কতক্ষণ? সকাল সাড়ে আটটার মধ্যেই বেরিয়ে পড়, আর ফের দিনের আলো শেষে। একনাগাড়ে গান শুনে বেচারীআর কতটা সময়ই বা কাটাতে পারে বলো তো? আর অন্যগুলোর প্রসঙ্গ তুলছ? মেয়ে সব জিনিস পছন্দ করে না। আমার একটা পরামর্শ শুনবে মেল?
বল।
–তোমাদের ব্যাঙ্কে নোরেনাকে একটা কাজ পাইয়ে দাও। সকাল সন্ধ্যে পাঁচজন সমবয়সী মেয়ে পুরুষ আর নানা ধরণের ক্লায়েন্ট আর কাজের মধ্যেও ডুবে থাকবে। মনেরও পরিবর্তন হবে।
মেল সঙ্গে সঙ্গে এই কথার কোন জবাব দিলেন না। কথাটা তার মনে ধরল।
ইরা যে এত তাড়াতাড়ি ব্যাঙ্কে কাজ জুটিয়ে নিতে পারবে এ বিশ্বাস কিছুতেই এডরিসের মন মেনে নিতে পারছিল না। তাই গম্ভীর মুখ করে বলল, বেবী! ঠাট্টা-তামাসারও একটা সীমা থাকা দরকার।
–সত্যি বলছি, টিকি, আগামী কাল থেকেই আমি কাজে জয়েন করব।
এডরিস কিছুক্ষণ ফ্যা ফ্যা করে তাকিয়ে রইল ইরার মুখের দিকে। পূর্বের বিহ্বলতা কাটিয়ে মিষ্টি হাসিতে মুখ ভরিয়ে বলে উঠল, সত্যিই ইরা, বাস্তবিক একখানা খেল দেখালে তুমি! তা মিঃ ডেভনের মতো ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষকে এতো অল্প সময়ে কাৎ করলে কী ভাবে?
ইরার মুখে জবাব রেডিই ছিল, এতে শীগগীর আমার পিতামহাশয় কাৎ হতেন না, যদি না এর পেছনে আর একজনের ছায়া বর্তমান থাকত।
এডরিস আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞাসা করল : সে আবার কে?
আমার পিতৃদেবের একজন বান্ধবী আছে। গত পনেরো দিন ধরে আমার হাবভাব দেখে পিতামহাশয় বড়ই চিন্তিত হয়ে পড়লেন, কী ভাবে সে আমার স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনবেন? তা ভেবে পেলেন না। শরণাপন্ন হয়ে পড়লেন তার সেই বান্ধবী প্রেমিকার ওপর। সেই পিতাকে বলল :তোমার মেয়েকে যদি ফিরিয়ে আনতে চাও, তবে তাকে কোন কাজের সঙ্গে যুক্ত করে দাও। দেখবে মনের দিক থেকে তখন তুমি অনেক সুস্থ। পিতৃদেব তার কথা ফেলতে পারলেন না এবং নিজেও অনুধাবন করলেন আমার নিঃসঙ্গ একাকিত্ব সঙ্গীন অবস্থার।
তারপর আর কি। অগত্যা কথাটা উত্থাপন করলেন আমার নিকটে আমি নানা-না করেও তার কথায় সম্মতি দিয়ে দিলাম।
-কোন্ ডিপার্টমেন্টে তোমায় ঢোকাচ্ছেন তোমার বাবা, সে সম্বন্ধে বলেছেন কিছু?
না, তা কিছু বলেননি, তবে এটুকু জানিয়েছেন : যেটা আমার ভালো লাগে আমার উপযুক্ত বলে মনে হবে, সেটাই বেছে নেবার দায়িত্ব সম্পূর্ণ আমার ওপরেই নির্ভরশীল।
–তবে আর কি, সোৎসাহে বলে উঠল এডরিস। তুমি তোমার বাবাকে জানিয়ে দেবে যে, অ্যাডিং মেশিন আর কম্পিউটার তুমি ভালোভাবে সামলাতে পার, কাজে কাজেই তোমাকে যেন অ্যাকাউন্টস ডিপার্টমেন্টেই রাখা হয়। এরপর এডরিস কতকটা আত্মগতভাবেই বলে বসল : প্রথম চাল চালার আগে আমাদের জানতে হবে, ব্যাঙ্কের ডেড সেফস্ গুলো কোথায়?
–ডেড সেফস! তার মানে? ভুরু কুঁচকে জানার ইচ্ছা প্রকাশ করল ফিল। এতক্ষণ সে নীরবে উভয়ের কথোপথন শুনছিল ঘরের এককোণে বসে, হাতে ধরা মদের গ্লাস।
–যে সেফগুলো দীর্ঘদিনের জন্য ব্যবহার করা হয় না, তাদের বলে ডেড সেফস্। আমেরিকা বা ইউরোপের নানান অঞ্চল থেকে টাকার কুমীরের দল এই শহরে ছুটি কাটাতে এসে এগুলো টাকা দিয়ে ভাড়া করে। টাকা পয়সা..সোনা-দানা..হীরেজহরতে ঠাসা। মন চাইলে বার করে খরচ করে, আবার বেটিং-এ অন্য কোন ভাবে কিছু টাকা উপার্জন করে সেগুলোও জমা রাখে এই সেফে।
ছুটি ফুরোলে চলে যায়। সে ঐভাবেই ঠিক পড়ে থাকে। আবার এক দেড় বছর বাদে যখন ছুটি মেলে, আসে ওখানে। বন্ধ হয়ে পড়ে থাকা সেফগুলো আবার কাজে লাগায়।
তারপর ইরাকে উদ্দেশ্য করে বলল, অ্যাকাউন্টস্ ডিপার্টমেন্টে একবার ঢুকতে পারলে এই ডেড সেফগুলোর নাম্বার, মালিকের পরিচয়,কতদিন হবে সেগুলোতে হাতের কোন স্পর্শ পড়েনি। ইত্যাতি ইত্যাদি জানার সুযোগ, সুবিধা দুই আছে।
ফুঁসে উঠল ফিল : তুমি একটা মাথা মোটা উজবুক! ডেড সেগুলোর নম্বর বা হালচাল জানতে পারলেই বা কোন লাভে লাভবান হচ্ছ একবার শুনি? তোমার ক্ষমতায় কুলোবে সেগুলোর ধারে কাছে পৌঁছবার? জান না, এই ব্যাঙ্কটা আমেরিকার দুর্ভেদ্য ব্যাঙ্কগুলোর অন্যতম?
এডরিস তার দিকে তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে তাকিয়ে ততোধিক তাচ্ছিল্যের সুরে সুর মিলিয়ে বলল, কে যাচ্ছে ওগুলোর ধারে ঘেঁষতে? আগে আমার প্ল্যানটা তৈরী হোক, তারপর দেখো আমি কী করতে পারি। এটা আমার কেয়ারফুল প্ল্যান করা নিখুঁত অপারেশন। এতে বেশ কিছু ধাপও আছে। প্রতি ধাপ বিচার-বিবেচনা করে, চিন্তা করে, সাবধানে সতর্কতার সঙ্গে পা ফেলে ফেলে এগোতে হবে। আমার প্ল্যানের পয়লা নম্বরের ধাপ ছিল :ব্যাঙ্কের মধ্যে আমার নিজের তরফ থেকে কাউকে ঢোকানো এবং বেশ ভালো পজিশনেই ঢোকানো। প্রথমাংশ ভালভাবেই পার হয়ে এসেছি। দ্বিতীয়াংশের জন্য প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে ইরাকে।
দ্বিতীয় ধাপ হলো : ডেড সেফগুলোর সন্ধান করা।
তৃতীয় ধাপ হলো : ডেড সেফগুলোর চাবি..অর্থের পরিমাণ…যেখানে অক্ষত রয়েছে। সেগুলো, সেখানে ঠিক কী ধরণের পাহারার বন্দোবস্ত আছে, তা জানা। এভাবেই ধাপের পর ধাপ রয়েছে আমার ছক করা প্ল্যানে। এগুলো বুদ্ধি, সাহসের পরিচয় দিয়ে পার হতে পারলেই একেবারে কেল্লা ফতে।
এতসব কাণ্ড করতে তো একটা বছরই কেটে যাবে ওর।
–তা তো যেতেই পারে, এডরিস মাথা নেড়ে বলে উঠল। সময় যাই লাগুক, ফলটা কিন্তু অমৃতই হবে।
ইরা এবার উঠে দাঁড়ায় চলে যাবার জন্য। বলল, আমার আর ঘন ঘন তোমার এখানে আসা চলবে না, টিকি। এখন থেকে আমার একটাই পরিচয় ওয়ার্কিং গার্ল দেবার মতো সংবাদ যদি কিছু থাকে তাহলে তোমার সঙ্গে আমি নিজেই সাক্ষাৎ করব। আচ্ছা, আজ তাহলে উঠি। সো লং টিকি।
চলে গেল ইরাফিলের দিকে একবার ফিরে তাকালও না বা তাকে কোন সম্ভাষণও জানাল না। ফিল এই মেয়েটার দাম্ভিক আচরণে মনে মনে বেজায় চটে গেল।
আরও দিন পনেরো পরের কথা
দীর্ঘ দু সপ্তাহ ধরে ইরার দিক থেকে কোন সাড়াশব্দ না পেয়ে ভেতরে ভেতরে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিল এডরিস।
এখন তার কী করণীয় এই চিন্তায় যখন সে বিভোর, তার এই বিভোরতা দূর করতে স্বয়ং ইরা এসে হাজির।
এসো এসো। ভেতরে এসো। কী দুর্ভাবনায় তুমি যে ফেলেছ। সেই যে গেলে এই কদিন তোমার টিকিটি পর্যন্ত দেখা গেল না। ব্যাপার কী?
–কিছুই না, কাজের মধ্যেই ডুবে ছিলাম, একটা সোফায় বসতে বসতে ইরা জানালো। তারপর হাতের মুঠো খুলে ভাঁজ করা এক টুকরো কাগজ বার করে এডরিসের দিকে বাড়িয়ে ধরে মুচকি হাসি হেসে বলল, আশা করি কাজ শুরুর পক্ষে এটা নেহাৎ মন্দ হবে না তোমার কাছে।
এডরিস কাগজটা নিয়ে ভাজ খুলে আগাগোড়া দেখে দুচোখ বোলাল। তারপর জিজ্ঞাসা করল : ডেড সেফগুলোর নম্বর?
–হ্যাঁ। মাত্র কয়েকটার। লাখপতি, কোটিপতির ভাড়া করা সেফগুলো। তবে এর মধ্যে। কতটা কী আছে, তার কোন যথার্থ রেকর্ড নেই ডিপার্টমেন্টের খাতায়। শুধু কে কত টাকা তুলেছে তার হিসেব রয়েছে। ড্রর বহর দেখে মনে হলো সেফগুলোয় অঢেল অর্থ আছে। আরও একটা সংবাদ পেয়েছি, পাঁচজন টেক্সাস অয়েলম্যান এই সপ্তাহের শেষে দেশে ফিরে যাবে। ক্যাসিনোয় গিয়ে জুয়া খেলে প্রচুর বাজি জিতেছে তারা। টাকাগুলো তাদের সেফে জমা রাখা যাবে বলেই মনে হয়। তাদের সেফের নম্বরও লিখে দিয়েছি ঐ ডানদিকের কলামে।
–চমৎকার! এডরিস হাসি হাসি মুখে জবাব দিল। এবার আমাদের জানতে হবে ওখানকার সিকিউরিটি সিস্টেম কেমন।
–তাও শুনেছি। হাত ব্যাগ বের করে সিগারেটের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট ধরিয়ে একগাল ধোয়ারকুণ্ডলীছাড়তে ছাড়তে ইরা তার বক্তব্য পেশ করল:আমার পিতৃদেব ভেবেছেন, ব্যাঙ্কে আমি আমার ভবিষ্যত গড়ার জন্য খুবই উদগ্রীব। তাকে একবার মুখ ফুটে জিজ্ঞাসা করতেই তিনি ওখানে সিকিউরিটির বন্দোবস্ত কেমন অকপটে উগরে দিলেন আমার কাছে।
–কী রকমের সিস্টেম? সাগ্রহে জানতে চাইল এডরিস।
–কড়া পাহারা, ভয়ানক কড়া বললেও অত্যুক্তি হবে না,বলল ইরা। ছ-ছজন সশস্ত্র গার্ড সারারাত ধরে ঠায় দাঁড়িয়ে তাদের কর্তব্য পালন করে। পাহারাদারদের প্রত্যেকেই বিশ্বাসী। তাদের নিয়ে চলা আর জীবন্ত বোমা নিয়ে নাড়াচাড়া করা প্রায় সমতুল্য ব্যাপার। এখানেও নিষ্কৃতি নেই, তাদের সঙ্গে গোটা কয়েক কুকুরও আছে। ব্যাঙ্কের নীচে তিন ইঞ্চি মোটা স্টীলের চাদর দিয়ে তৈরী সে এক-একটা। ঘরটা আগাগোড়াই চারফুট পুরু কংক্রিটের দেয়াল দ্বারা পরিবেষ্ঠিত। ব্যাঙ্ক বন্ধ হলে ঘরটা জলে ভরিয়ে দেওয়া হয় আবার ভোর ছটা বাজতে না বাজতেই সেই জল বার করে নেওয়ারও ব্যবস্থা আছে। অনুধাবন করতে কষ্ট হচ্ছে না যে কী সাংঘাতিক ব্যাপার।
আর দিনের বেলায়?
–জনাবারো বুলেট প্রুফ জামা পরা গার্ড অটোমেটিক রাইফেল হাতে নিয়ে পাহারায় অটুট। কী চেহারা এক একজনের! সাক্ষাৎ দৈত্য যেন। তাছাড়া অ্যালার্ম আছে জায়গায় জায়গায়। পুলিশের সঙ্গে সংযোগ রেখে চলেছে সর্বক্ষণ। পরিশেষে ঘন ঘন চেকিং।
ইরার কথা শেষ না হওয়া পর্যন্ত দমবন্ধ করে একাগ্রচিত্তে এডরিস তার কথা শুনে গেল। সে নীরব হলে এডরিস গম্ভীর মুখে বলল, আচ্ছা বেবী বলতো, ঐ ভল্টে একমাত্র কাদের যাওয়ার সুযোগ আছে?
–অবশ্যই ক্লায়েন্টদের। তবে হ্যাঁ, আর একজন যেতে পারে–সে হলো ঐ ব্যাঙ্কের রিশেপসনিস্ট। সেই ক্লায়েন্টদের সঙ্গ দেয় তাদের ভল্টের নাগাল পৌঁছন পর্যন্ত।
–তুমি দেখেছ, তাকে?
–দেখেছি বৈকি! তার নামও জানি, ডেরিস ক্লিয়বি। বয়স তেত্রিশ অথবা চৌত্রিশ হবে। গত আট বছর ধরে সুনামের সঙ্গে ব্যাঙ্কে কাজ করে এতদিনের সম্মান অটুট রেখেছে। মনে হয় ওকে আয়ত্তে আনা মোটেই সোজা নয়।
-ওর ঠিকানা জানা আছে তোমার?
জানা নেই বটে, তবে জেনে নিতে তেমন অসুবিধা হবে না।
-ঠিক আছে, ঠিকানা যত তাড়াতাড়ি হয় সংগ্রহ করে নাও। তারপর না হয় আমায় ফোনে জানিয়ে দিও।
-ওকে।
আচ্ছা ওর কাজ কর্মের ব্যাপারে তোমার কিছু জানা আছে?
হ্যাঁ, জানা আছে। ধরে নাও তুমি ওর হবু ক্লায়েন্ট, তুমি একটা সেফ ভাড়া নিতে ইচ্ছুক। প্রথমে ব্যাঙ্কে গিয়ে একটা ফর্ম ভর্তি করতে হবে নিজের নাম ঠিকানা আর ফোন নাম্বার দিয়ে। লিখতে হবে কতদিনের জন্য তুমি সে ভাড়া নিতে চাও আর কতবার তা ব্যবহার করার বাসনা মনে পোষণ কর। ফর্ম ভর্তি হলে ভাড়া গুণে নিয়ে, তারা তোমার হাতে একটা চাবি তুলে দেবে। ঐ চাবি যদি কোনভাবে হারিয়ে যায় তবে সে ভাঙ্গা ছাড়া অন্য কোন উপায় তখন থাকবে না। কারণ কোন ডুপ্লিকেট থাকে না ঐ চাবির। প্রত্যেকটি সেফের জন্য দুটো করে চাবি।একটা থাকবে তোমার কাছে, অপরটা অর্থাৎ পাসকী থাকবেব্যাঙ্কের হেফাজতে। চাবিদুটো একসঙ্গে পর পর ব্যবহার না করলে ভন্ট খোলা যাবে না। এই চাবি ব্যাঙ্কিং আওয়ার্সে থাকে ডেরিসের জিম্মায়। ছুটির পর চলে যাবার সময়ে ঐ পাসকীগুলো সে দিয়ে যায় ব্যাঙ্কের চীফ গার্ডের হাতে। তুমি যখন তোমার সে খুলতে চাইবে তখন তোমার চাবিটা দিতে হবে ঐ চীফ গার্ডের হাতে। সে তোমার চাবিরনম্বর…তোমার নাম…তোমার ছবি..যা তার কাছেএকটা খাতায় সযতে টোকা আছে, একবার চোখ বুলিয়ে সন্তুষ্ট হলেই তোমায় ভিতরে প্রবেশের অনুমতি দেবে। সিঁড়ি বেয়ে মাটির নীচের ঘরে এরপর নামতে হবে তোমায়। সিঁড়ির প্রায় কাছেই চেয়ার-টেবিল সাজিয়ে বসে থাকে। ডেরিস। তুমি তোমার চাবির নম্বর তাকে বলে দিলে সে তখন ঐ নম্বরের পাসকী বার করে, তোমায় নিয়ে যাবে, তোমার ভাড়া করা সেফের দোর গোড়ায়। পাস কী দিয়ে সেফের লকটা খুলে দিয়ে সে ফিরে আসবে পুনরায় তার টেবিলে। তুমি পরের লকটা খুলবে কিন্তু তোমার চাবি দিয়ে।তারপর তোমার প্রয়োজনীয় কাজ কর্ম সেরে নেবে।কাজ শেষ হলে সেফের গায়ে লাগানো পুশ বাটন টিপে ঘণ্টা বাজলেই ডেরিস এসে সামনে দাঁড়াবে। তারপর দুজনের চাবির সাহায্যে সেল করে দিয়ে তোমায় পৌঁছে দেবেচীগার্ডেরকাছে।এই হলো তার কর্মকাণ্ডেরব্যস্ততার ফিরিতি।
ইরার কথা শেষ হলে এডরিস কিছুক্ষণ আপনমনেকী যেন ভাবল,তারপরবহুক্ষণ ধরেচুপচাপ বসে থাকা ফিল আলগিরকে লক্ষ্য করে বলে উঠল, শোন ফিল, এবার তোমার কাজ।ইরা সেই ডেরিস মেয়েটার ঠিকানা এনেদিলে তোমাকে তার একটা ব্যবস্থাকরেদিতে হবে।কমকরেহলেও দিন পনেরোর জন্য সে যেন ভুল করেও অফিসমুখোহতে না পারে। আমার আসল উদ্দেশ্য বুঝতে পারছ?
–তাতে সুবিধেটা কী হবে? হতবুদ্ধি ফিল প্রশ্ন না করে পারল না।
–তাতে সুবিধেটা এই হবে মিঃ ব্লকহেড ইরা তার পিতৃদেবকে বলে ঐ পনেরো দিনের জন্য ডেরিসের জায়গায় কাজে নামবে। আমার স্থির বিশ্বাস, মিঃ ডেভন না করতে পারবেন না। বরঞ্চ এই মধ্যস্থতায় তিনি খুশি ছাড়া অখুশি হবেন না। এই ভেবে যে তার সন্তানের ব্যাঙ্কিং ব্যবসা সংক্রান্ত ব্যাপারেও উৎসাহ কিছু কম নয়। আর ইরার প্রধান কাজই হবে ক্লায়েন্টের চাবির আর পাস কী গুলোর ছাপ নেওয়া।
-বুঝলাম। কিন্তু ক্লায়েন্টরা তাদের নিজেদের চাবি ওর হাতে বিশ্বাস করে ছাড়বে কেন? এর পরিবর্তে হয়তো তখন চটে বলেই বসবে : জাহান্নামে যাও তুমি?
এডরিস সঙ্গে সঙ্গে চোখ পাকিয়ে বলে উঠল, ওহে বুদ্ধির টেকি,ইরার দিকে ভালোকরে চেয়ে দেখার সময় হয়েছে কখনো? সাংঘাতিক সেক্স বম্ব। ও যদি মিষ্টি হাসি হেসে চোখ মটকে বুক উচিয়ে মধুমাখা মুখে চাবিটা হাত পেতে চায় এই বলে : স্যার আপনি আবার কষ্ট করবেন কেন? বিশেষ করে বৃদ্ধ টোসটাকার কুমীরগুলোকে, শুধু তারাই বা কেন, তাদের পিতারা পর্যন্ত আহ্বাদে গদ গদ হয়ে নিজেদের চাবি ইরার হাতে খুঁজে দেবে। লোকচরিত্রের কিছু জ্ঞান আমারও আছে। তোমার কথাই ধরা যাক, তুমি পারবে কী কোন সুন্দরী তরুণীকে জাহান্নামে যাও বলতে?
ফিল এই আক্রমণের জন্য মানসিক দিক থেকে প্রস্তুত ছিল না। তাই আপন মনেই মাথা চুলকোতে লাগল।
এডরিস মাঝ পথে থেমে যাওয়া বক্তব্যকে একটানতুন দিকে পাক খাইয়ে বলল :ইরার হাতের তেলোয় লুকোন থাকবে চাবির ছাপ নেওয়ার এক টুকরো পুটি।
ইরা ছাপ এনে দিলে তুমি তার থেকে চাবির নকল তৈরী করে ফেলবে। তুমি আগামীকালই চলে যাও ব্যাঙ্কে। একটা সেফ ভাড়া নেবে। তাতে পেট মোটা একটা আজে বাজে কাগজ পুরে জমা করবে। সেই সঙ্গে ডেরিস মেয়েটাকেও ভাল ভাবে চোখে চোখে রাখবে, পরে যাতে চিনতে কোন রকম অসুবিধায় পড়তে না হয় তোমাকে। তারপর ইরা ঐ মেয়েটার ঠিকানা এনে দিলে, সময় বুঝে সেখানে গিয়ে তাকে দিন পনেরোর জন্য অচল করে আসবে। কিন্তু সাবধান! এমন কিছু বোকামি করে ভুল পদক্ষেপ ফেলনা, যাতে পুলিশের টনক নড়ে ওঠে। বুঝেছ?
–তা না হয় হলো। কিন্তু আমার সে ভাড়া করার কারণটা মাথায় ঠিক ঢুকল না।
–ঐ পনেরো দিন ধরে ইরা যে কটা ডেড সে যে পরিমাণে যতটা ফাঁকা করতে পারবে তা এনে তোমার ভাড়া করা, সেফে বোঝাই করবে। তুমি প্রতিদিন একবার করে অন্ততঃ সে ব্যবহার করার শর্তে–প্রতিদিন ব্যাঙ্কে পদধুলি দেবে আর মাল বার করে নিয়ে আসবে। কারো মনেই কোনরকম সন্দেহের উদ্রেক হবে না কারণ তুমি নিজে একজন জেনুইন ক্লায়েন্ট।কম করে। মাস ছয়েকের আগে ঐ সেগুলোর হাতের ছোঁয়া লাগবেনা কোন জনৈকের। যতোদিনে পড়বে। তখন আমরা ধরা ছোঁয়ার অনেকবাইরে চলে যাব।কী,আর কোন অসুবিধা হচ্ছেনা তো বুঝতে?
ফিল আর ইরা এডরিসের বুদ্ধির পরিচয় পেয়ে সত্যি এখন নির্বাক প্রতিমূর্তি।