০৬.
স্টিঙ লারসনের মৃত্যুর একমাস পরে এক অলস অপরাহ্নে গ্রাস হিলের বাড়ির সামনে একটা ক্যাডিলাক এসে থামলো।
ভিডা জানলার ধারে বসে ছিল। ম্যাগার্থ গাড়ি থেকে নেমে ভিডাকে জড়িয়ে চুমু খেল।তারপর, দুজনে একসঙ্গে বাড়ির ভেতর যেতে যেতে বলল, মেয়েটার সব বন্দোবস্ত ঠিক করে ফেললাম। ও যা ঝাটের কাজ, তা আর কি বলবো।
ও কেমন আছে?
ঠিক সেই আগের মতন। সর্বদা কেমন কঠিন ভাব, ওকে দেখে আমার ভয় লাগে।
এখনও কি ও আগের মতো গুম মেরে থাকে?
হ্যাঁ, আমি কোনও দিকেই ওর আগ্রহ ফেরাতে পারছি না। চেষ্টা করেছিলাম যাতে খবরের কাগজ ওর হাতে না পড়ে। কিন্তু জানি না কি করে কাগজটা পেয়ে ও নিজের সম্বন্ধে সব কথাই জেনে ফেলেছে। তারপর দরজা বন্ধ করে ঘন্টার পর ঘণ্টা ও পায়চারি করেছে।
দুদিন আগে তোক কি দুদিন পরে হোক খবরটা ও জানতোই। তবে এভাবে জানা ঠিক হল না। যাক এখন তো সব ব্যবস্থাই হয়ে গেছে। ও এখন চল্লিশ লাখ ডলারের মালিক। হার্টম্যান পালিয়েছে। যাই মেয়েটার সঙ্গে দেখা করে আসি। এখনও নিজের স্বাধীনতা ও সম্পত্তি দুই পেয়ে গেছে। আমার মনে হয় ও এখন আমাদের ছেড়ে চলে যাবার পরিকল্পনা করছে। তুমি ওকে একটু বুঝিয়ে বল ও একা। বাইরে ওর নিজের কেউ নেই।
জানালার সামনে ক্যারল বসে ছিল। ম্যাগার্থ ঘরে ঢুকতে ও মুখ ফিরিয়ে নিল। তবু ম্যাগার্থ ওর পাশের চেয়ারে বসে বলল, ক্যারল তুমি এখন এক ধনবতী যুবতী। কাগজপত্র সব আমার সঙ্গে আছে একবার দেখে নেবে।
না, আপনি বলছিলেন আমি এখন একজন ধনবতী মহিলা। কিন্তু কতটা ধনী?
চল্লিশ লক্ষ ডলার–অনেক টাকা। তুমি খুশী?
আমি খবরের কাগজে আমার সম্বন্ধে পড়েছি। আমার মায়ের মৃত্যুর জন্য দায়ী একটা পাগল খুনী আমার বাবা।
দ্যাখো ক্যারল কাগজের সব কথা বিশ্বাস করতে নেই। এর জন্য তুমি নিজেকে যন্ত্রণা দিয়ো না। ভিডা আর আমি তোমাকে সাহায্য করতে চাই।
ক্যারল বলল, আপনাদের আমার সঙ্গে থাকতে ভয় করে না। আমি তো পাগল।
থামো এসব কথা আমি শুনতে চাই না। তুমি এমন করছো কেন। সামান্য কেঁপে উঠে ক্যারল পেপারটা ফেলে দিল। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে পায়চারি করতে লাগল।
না না আপনি দয়া করে আর কিছু বলবেন না। আমি জানি আমি পাগল। আমি আপনাদের দুজনের কাছে কৃতজ্ঞ। আমি জানি আপনারা দুজন আমার ভাল চান।
এখন আমাকে একা থাকতে দিন, হয়তো আমি, আপনার কিংবা ভিডার কেবল ক্ষতি করে ফেলবো। ক্যারল বলল, আমি মনস্থির করে ফেলেছি, কাল আমি এখান থেকে চলে যাবো। কিন্তু যাবার আগে আমি সকলকে দিয়ে কয়েকটা কাজ করিয়ে নিতে চাই।
কিন্তু তুমি কোথায় যাবে? তোমার ঘরবাড়ি বলতে কোনও বস্তু নেই, তুমি তো আর উধাও হয়ে যেতে পারো না।
এসব আলোচনা করে আমরা বৃথা সময় নষ্ট করছি। আপনি কি আমার বিষয় সম্পত্তির ভার নিতে রাজী আছেন? টাকাপয়সার ব্যাপারে আমি কিছু বুঝিও না, বুঝতে চাইও না। আমি একজন উকিলের সঙ্গে কথা বলেছি। উনি এসব রক্ষণাবেক্ষণের জন্য আমাকে একজন লোক নিযুক্ত করতে বলেছেন। আমার দাদুর অনেকগুলো ব্যবসার মালিকানা এখন আমার হাতে। সেসব ক্ষেত্রে আপনি কি আমার প্রতিনিধি হতে রাজী আছেন?
ম্যাগার্থ অবাক হয়ে বলল, আমার যা সাধ্য আমি করব।
হ্যাঁ এর জন্য আপনি ভাল মাইনে পাবেন।
ক্যারল বলল, আমি এখুনি দু-হাজার ডলার চাই, পেতে পারি? আর একটা গাড়ি আমার জন্য কিনে আনবেন?
ঠিক আছে তুমি যা বলছে তাই করবো তবে যাওয়ার আগে আর একবার ভেবে দেখলে হতো না।
না, আমি আমার পরিকল্পনা ছকে ফেলেছি। আপনি এখন যান, দয়া করে ভিডাকে বলে দেবেন যে আজ আমি আর কারো সঙ্গে দেখা করতে চাই না। কাল সকালেই আমি এখান থেকে চলে যাব।
ম্যাগার্থ শেষবারের মতো চেষ্টা করল, আচ্ছা ক্যারল, আমার ওপর কি তোমার কোনই আস্থা নেই। হয়তো আমি তোমাকে সাহায্য করতে পারতাম। লোকদুটো যখন তোমার শত্রু হয়ে রয়েছে তখন কেন তুমি একা একা চলে গিয়ে নিজের বিপদ ডেকে আনতে চাইছো?
না, যা করার তা আমি একাই করবো। কেউ আমাকে সাহায্য করতে পারবে না।
বেশ বলে ম্যাগার্থ বেরিয়ে গেল।
ক্যারল জানলার পাশে বসেকপালের দুধার চেপে ধরল। তারপর মৃদু অথচ স্পষ্ট করে বলল, স্টিঙ, সোনা আমার যেখানেই থাকো তুমি আমাকে ভালবেসো। ওরা যেমন তোমার প্রতি খারাপ ব্যবহার করেছে আমিও তেমনি ওদের প্রতি নিষ্ঠুর ব্যবহার করব। ওদের শাস্তি দেওয়া ছাড়া আমার আর কোন অভিলাষ নেই।
.
পরদিনও সমানে বৃষ্টি পড়ছিল। কাদামাখা একখানা কালো রঙের ক্রাইসলার কুপ দুরন্ত চড়াই ভেঙে এগিয়ে আসছিলো টেক্স শেরিফের খামার বাড়ির দিকে।
কাঠের সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠেদরজার হাতল ধরে ঘর খোলবার চেষ্টা করলো ক্যারল। দরজা ভেতর থেকে চাবি বন্ধ।
বেশ কয়েকবার আঘাত করার পর ভেতরে হালকা পায়ের শব্দ শোনা গেল।
মিস ললির কণ্ঠস্বর শোনা গেল, কে?
ক্যারল ব্লানডিশ। আমি আপনার সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই।
তুমি ফিরে এলে কেন? তুমি ভিতরে আসতে পারবে না। আমি একা থাকতে চাই।
আমি সুলিভ্যানদের খুঁজছি।
কিন্তু বোকা মেয়ে ওরা তো তোমাকেই খুঁজছে।
ওরা আমার ভালবাসার লোককে মেরে ফেলেছে। আমি ওদের ছাড়ব না।
ও তুমি প্রতিশোধ নিতে চাও। ভিতরে এস।
ওরা কোথায় আছে আপনি জানেন?
না, আর জানলেই বা কি করতাম। তুমিই বা কি করবে? ওরা যত ক্ষিপ্রই হোক আমি ওদের শাস্তি দেবোই।
দ্যাখো ম্যাক্স আমার দাড়ি কেটে নিয়েছে, বলতে বলতে মিস ললির চোখ দিয়ে দুফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল।
কেন কাটল?
কারণ আমি তোমাকে যেতে দিয়েছিলাম। এর থেকে ওরা যদি আমায় মেরে ফেলত তাহলে ভাল হত। কিন্তু জানত যে এতেই আমি বেশী কষ্ট পাবো। তুমি চলে যাবার দুদিন পরে ম্যাক্স আর ফ্র্যাঙ্ক এসেছিল। কিন্তু ফ্র্যাঙ্ক গাড়িতে বসেছিল। ওকে আমি দেখিনি।
গাড়িতে বসে ছিল তার কারণ ও অন্ধ। স্টিঙকে খুন করার পর আমি ওকে অন্ধ করে দিয়েছিলাম।
ওরা যাবার সময় ওপরের যে ঘরটায় ওদের জিনিসপত্র রাখতে সেখান থেকে সব নিয়ে চলে যায়। ঘরটা একবার দেখবে? সেখানে একটা ছবি পড়েছিল। ওরা যাবার পর ওটা কুড়িয়ে পাই। আমি তুলে রেখেছি।
ছবিটা একটা মেয়ের। মাথার কালো চুল মাঝখানে সিথি করে আঁচড়ানো। পুরু ঠোঁট শরীরে। এমন একটা কন্য-সৌন্দর্য যে তাকে দেখলে পুরুষমানুষ সহজে ভুলতে পারবে না। ছবির নীচে আড়াআড়ি করে সাদাকালিতে আঁকাবাঁকা অক্ষরে লেখা, প্রিয় ফ্র্যাঙ্ককে লিনডা।ছবিউলটে পেছনে চিত্রগ্রাহকের ছাপটা দেখে নিলো ক্যারল কেনেথ কার, ৩৯৭১ মেইন স্ট্রীট, সানটোরিডা।
মিস ললি বললো, তুমি ওকে খুঁজে বার করো। তাহলেই তুমি ফ্র্যাঙ্ককে খুঁজে পাবে। কারণ এর কাছে ফ্র্যাঙ্ক যাবেই।
.
প্রশান্ত মহাসাগরের তীরে কোটিপতিদের লীলাভূমি এই ছোট্ট অথচ ঘন বসতিপূর্ণ শহর, সানটোরিডা। এখানকার অনেক বাসিন্দা জাল, জোচ্চুরি, ব্ল্যাক মেইলিংইত্যাদি নানা অসৎ উপায়ে সচ্ছলভাবেই জীবন কাটায়।
লম্বা-চওড়া সুদর্শন পুরুষ এডি রিগান। মাথায় কালো কোকড়ানো চুল, রোদে পোড়া গায়ের রং, অনেক মেয়েকেই আকর্ষণ করে। যে সব ধনবতীবয়স্কা মহিলা এখানেআনন্দ উপভোগ করতে আসে এডি তাদের সঙ্গ দেয় তাদের সঙ্গে প্রেম প্রেম খেলা করে। এবং এই থেকে তার ভালই আয় হয়।
লিনডার সঙ্গে নিতান্ত আকস্মিকভাবেই এডির পরিচয় হয়েছিল।
এক মধুর বিকেলে বয়স্কা মহিলাদের সন্ধানে চোখ খোলা রেখে এডি সমুদ্রতীরে অলসভাবে সময় কাটছিল। হঠাৎ সূর্য মানের জন্য লিনডা সমুদ্র থেকে উঠে এল।
লিনডার যে ধরনের শরীর তা স্নানের পোশাকেই ভাল মানায়। তাই সেই দেহবল্লরী দেখে মুহূর্তের মধ্যে বয়স্কা মহিলাদের চিন্তা মাথা থেকে হটিয়ে দিল এডি।
এডি অনেক সুন্দরী দেখেছে। কিন্তু এমনটি আর দেখেনি। সে এগিয়ে এসে লিনডার সঙ্গে ভাব করলো। লিনডাও এডির মতো সুপুরুষ সঙ্গী পেয়ে খুশিই হয়েছিল।
হয়ত এডির সুন্দর মুখ, রোদে পোড়া চামড়া তাকে আকর্ষণ করেছিল। যাইহোক কিছুদিনের মধ্যেই ওদের বন্ধুত্ব গাঢ় হয়ে উঠল।
এডি ভেবেছিল, অতীতের ঘটনার মতো এবারও সপ্তাহের শেষাশেষি লিনডার সৌন্দর্য তার কাছে বাসি ফুলের মতো বিবর্ণ হয়ে উঠবে। কিন্তু তার বদলে সে দেখল যে সে দিনরাত তার কথাই ভাবছে। এমনকি সে লিনড়াকে বিয়েও করতে চায়।
লিনডার বিলাসবহুল জীবনযাত্রা দেখে এডি অবাক হয়ে গিয়েছিল। ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য একটা সমুদ্রতট ছাড়াও সুন্দর একটা বাংলোর মালিক লিনডা।
লিনডার পোশাক-আষাক বাড়ির আসবাবপত্র, এমনকি লিনডার চড়বার জন্য একটা ঝলমলে নীল রঙা রোডমাস্টার বুইক আছে যেটা চালিয়ে ও যখন তখন ঘুরতে বেরিয়ে পড়ে। এসব সে কোথায় পেয়েছে?
লিনডা বলে যে তেলের ব্যবসায়ী ধনী মামার কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে সে এসব পেয়েছে। যদিও এডি কথাটা বিশ্বাস করেনি। সে ভেবেছিল যে লিন্ডা একমাত্র তাকেই ভালবাসে তাই সত্যিকারের উত্তরটা সে ভাবতেও পারেনি। সে জানতো না যে লিনডার এই সব বিলাসবৈভবের মূলে আছে তার এক প্রেমিক। এখানে যে খুব কমই আসে।
বছরে মাত্র চার কি পাঁচবার লোকটা আসে। লোকটাকে খুব বিশ্রী লাগলেও লিনডা সব মেনে নেয় কারণ না হলে এই সব সুখ তার হাতছাড়া হয়ে যাবে। ও কখনও সুলিভ্যান ব্রাদার্সের কথা শোনেনি। ও ভাবতেও পারবেনা সে যাকে ফ্র্যাঙ্ক বলে ডাকে সে সুলিভ্যান ব্রাদার্সের একজন।
লিনডার সঙ্গে ম্যাক্সের মাত্র দুবার দেখা হয়েছে। ম্যাক্সকে দেখে ভয় হয়। আর লিনডা যে সুলিভ্যানদের মধ্যে একজনের রক্ষিতা সেকথা জানতে পেরে এডিও সব আগ্রহ প্রথমেই হারিয়ে ফেলল। সুলিভ্যানদের সম্পর্কে অনেক কথা শুনলেও তাদের একজনকেও সে দেখেনি।
আজ এই উষ্ণ রৌদ্রময় বিকালে ওস্যান বুলেভার্ড ধরে ঘি আর টুকটুকে লাল রঙা রোডস্টার যেটা এডিকে এক বয়স্কা বান্ধবী দিয়েছিল সেটা চালিয়ে আসতে আসতে এডির মনে হচ্ছিল সত্যি জীবন কি মধুর!
বেলা সাড়ে তিনটার কয়েক মিনিট পরে লিনডার বাংলোতে পৌঁছে এডি দেখলো, লিন ফুলের বাগানে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
লিনডা এডিকে দেখে বলল আমি এখুনি ভাবছিলাম যে তুমি আসবে কিনা। বিকেলে একটু সাঁতার কাটতে গেলে কিন্তু দিব্যি মজার হতো।
এডি লিনডাকে আদর করতে করতে বলল, এখন না। বিকেলে ছটা নাগাদ জলটা বেশ ঠাণ্ডা হয়ে উঠবে, ততক্ষণ আমরা অপেক্ষা করবো।
তাহলে চলল ভিতরে বসে চা খাই।
প্রস্তাবটা এডির পছন্দ হলো।ওরাকাঁচের দরজা ঠেলে ঘরে এসে সোফার উপর বসল।লিনডা বলল ঘণ্টা বাজলেই চাকর চা নিয়ে আসবে।
কিন্তু এই মুহূর্তে এডির চা খাওয়ার একটুও আগ্রহ নেই। না এখন চা নয় এই বলে লিনডাকে কোলে নিয়ে দোতলার একটা ঘরে চলে গেল।
লিনডা বলে আমাকে ছোঁবে না বলছি। এখন আমরা বাইরে স্নান করতে যাবো।
সবই হবে চা খাওয়া, স্নান করা তবে আগে তোমাকে একটু আদর করি এই বলে লিনডাকে জড়িয়ে ধরল।
লিনডা বলল, দেখো আমাকে ছেড়ে দাও। জোর কোরো না, কিন্তু এডি এসব কথায় কানই দিল না।
সময় এগিয়ে চলল। প্রথমে এডির ঘুম ভাঙল। পেশল বাহুদুটো ছড়িয়ে আড়মোড়া ভেঙ্গে ও চোখ খুলল। পরক্ষণেই ওর পাকস্থলিটা যেন একটা ডিগবাজি খেয়ে উঠলো।
এডি দেখল বিছানার কাছে বসে একটা লোক ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। তার মনে হলো যেন স্বপ্ন দেখছে। লোকটার পোশাক কালো, মুখটা সাদা পাথরের মতো কঠিন।
এডির দৃঢ় আকর্ষণে লিনডা চমকে উঠে জেগে গেল। পরক্ষণেই কালো পোশাক পরা লোকটাকে চিনতে পেরে আতঙ্কে ওর গলার স্বর বন্ধ হয়ে গেল।
ম্যাক্স মৃদুস্বরে বলল, লিনডা তোমার নাগরটিকে বেরিয়ে যেতে বল। তোমার সঙ্গে আমার কথা আছে।
এডি বেরিয়ে গেল যাওয়ার আগে সে লিনডার দিকে তাকালও না। কারণ ম্যাক্স তাকে ছুরি দিয়ে তালু কেটে দিয়েছিল। লিনডা বলল–এডি আমাকে ছেড়ে যেও না। কিন্তু এডির কানে সে কথা ঢুকল না।
ছুরিটা পকেটে রেখে দিয়ে ম্যাক্স একটা রেশমী চাদর লিনডার দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বলল, নাও এটা গায়ে জড়িয়ে নাও।
কাঁপা হাতে চাদরটা জড়িয়ে নিতে নিতে লিনডা ভাবল যে ম্যাক্স নিশ্চয়ই ফ্র্যাঙ্ককে সব কথা বলে দেবে। এখন ফ্রাঙ্ক কি করবে। তাকে লাথি মেরে বাড়ি থেকে বার করে দেবে। তবে কি এই বিলাস বৈভব সব কিছু হারিয়ে আবার আগেকার জীবনে তাকে ফিরে যেতে হবে!
ম্যাক্স দেওয়ালে হেলান দিয়ে একটা সিগারেট ধরাল। বলল, ফ্র্যাঙ্কের থেকে টাকা নিয়েও লোকটাকে না ঠকালে চলছিল না। আমি তো ওকে আগেই সাবধান করে দিয়েছিলাম কিন্তু ও তোমার মধ্যে কি দেখেছে ওই জানে। এখন থেকে তোমার খরচের টাকা তোমাকেই রোজগার করে নিতে হবে।
লিনডা বলল, দেখো আর কখনও এমন হবেনা। তুমি ওকে বলো না। ও আমাকে ভালবাসে। শুনলে কষ্ট পাবে।
ঠিকই বলেছ। আর কখনও এমন হবে না। ফ্র্যাঙ্ককে আমি কিছু বলব না, ওর জীবনও নষ্ট করবো না। শোনা, ফ্র্যাঙ্ক চিরদিনের মতো এ বাড়িতে চলে এসেছে। তুমি ওর সঙ্গে থাকবে, ও যা বলে করবে। ওর সঙ্গে বেড়াতে যাবে, দাড়ি কামিয়ে দেবে, পোশাক গুছিয়ে রাখবে, কাগজপত্র পড়ে শোনাবে। মোট কথা সবসময় তুমি ওর পাশে থেকে ওকে সাহায্য করার চেষ্টা করবে। তোমার চোখ দিয়ে ও সবকিছু দেখবে।
আমার চোখ দিয়ে দেখবে মানে? ওর নিজেরই তো দুটো চোখ আছে।
ম্যাক্সের মুখে এক টুকরো হাসি ফুটে উঠল। তারপর ও লিনডার কাছে এসে ওর চুলের গোছা ধরে বলল, কোনও রকম চালাকি করলে আমি তোমাকে শেষ করে ফেলবো। আমি কিন্তু মাত্র একবারই সাবধান করেছি। যদি তুমি পালিয়ে যাওবা ওর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করতাহলে অ্যাসিড দিয়ে তোমার মুখ পুড়িয়ে দেবো। ও চিরকালই বোকা ও তোমার মধ্যে কি দেখেছিল কে জানে ও তোমাকেই চায়।
দরজা খুলে ম্যাক্স বেরিয়ে গেলো, বললো এসো ফ্র্যাঙ্ক। ও তোমার জন্য অপেক্ষা করছে।
একটু পরেই ফ্র্যাঙ্ক ঘরে এসে ঢুকল। দৃষ্টিহীন চোখদুটো চশমার কালো কাঁচের আড়ালে লুকোনো, হাতে লাঠি। মেদবহুল মুখে উপবাসীজাআকাঙ্ক্ষার সঙ্গে আত্মবিশ্বাসের করুণ ছায়া।
ফ্র্যাঙ্ক হাত বাড়িয়ে বলল, দেখো লিনডা আমি বাড়িতে ফিরে এসেছি।
পরের দুটো সপ্তাহ লিনডার জীবনে দুঃস্বপ্নের মতো কাটল। জীবনের শেষ দিন অবধিও এই দিনটার কথা ভুলতে ও পারবে না।
ফ্র্যাঙ্কের অজস্র চাহিদার আর বিরাম নেই।ফ্রাঙ্ক সর্বদাই ওকে কিছু পড়ে শোনাতে বলে।নয়তো ওর পাশে চুপ করে বসে থাকতে বলে পরবর্তী প্রয়োজন পালন করার জন্য। চোখের দৃষ্টি চলে যাওয়াতে ও এখন আরো ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে। এখন ও লিনডার শারীরিক সৌন্দর্য দেখতে পায় না এর জন্য ওর আকর্ষণী শক্তি ফ্র্যাঙ্কের ওপর কোনও কাজ করছে না। এখন ফ্র্যাঙ্ক ওকে কোনও পোশাকও কিনতে দেয় না। বলে ওসব পরে তোমাকে কেমন লাগছে তা যদি আমি দেখতেই না পাই তাহলে কিনে কি লাভ। লোকটা এখন ভীষণ কিপ্টে হয়ে উঠেছে।
ব্যক্তিগত সময় বলতে এখন আর লিনডার কিছু নেই। সবসময়েই ফ্র্যাঙ্ক লিনডাকে খোঁজে। অথচ ম্যাক্সের ভয়ে ও ফ্র্যাঙ্ককে ছেড়ে পালাতেও পারছে না।
ও এডির সঙ্গে দেখা করার জন্য ছটফট করছিল। তাই বড় আবেগময় ভাষায় ও এডিকে চিঠি লিখেছিল, এডিও যন্ত্রণায় পাগল, ও নিজেও আগে বুঝতে পারেনি যে লিনডাকে ছেড়ে থাকতে ওর এত কষ্ট হবে।
লিনডার শয়নকক্ষে ম্যাক্সের সেই নাটকীয় অবির্ভাবের ষোল দিন পরে এক ক্লান্ত অপরাহ্নে একটি বয়স্কা মক্কেলের আসার আশায় একটা রেস্তোরাঁয় বসে এডি সময় কাটাচ্ছিল। হঠাৎ লক্ষ্য করলো একটা মেয়ে তার অদূরেই একটা টুল নিয়ে টেনে বসলো। ওরা দুজন ছাড়া এখন আর কোনও খদ্দের নেই। অভ্যাসের বসে মেয়েটিকে দেখল সে। মেয়েটির পরনের পোশাক নোংরা হলেও রুচিশীল। মাথায় ছোট টুপির আড়ালে একরাশ কালো চুল এলিয়ে রয়েছে। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। তবু সে দেখলে যে মেয়েটির শরীরের গড়ন সত্যি সুন্দর।
একটু পড়েই সে শুনলো মেয়েটা দোকানীর সঙ্গে কথা বলছে।
মেয়েটি বলছে আমি একটা অল্প সময়ের কাজ খুঁজছি। ধরুন কেউ সন্ধ্যেবেলার জন্য সঙ্গিনী খুঁজছেন? অথবা কারো বাচ্চার দিকে নজর রাখার লোক দরকার। এমন কারো কথা আপনার জানা আছে।
দোকানদার আনড্রু মানুষকে সাহায্য করার জন্য সর্বদা উৎসুক। অবেশেষে বলল তবে এই ছোট্ট শহরে অধিকাংশ লোকেরই বাচ্চাকাচ্চা নেই।
মেয়েটি কফি নাড়তে নাড়তে বলল, আসলে আমি একটা কাজ করছি। তবে মাইনে খুব একটা সুবিধার নয়। বলল আমার নাম মেরি প্রেনটিস, ইস্ট স্ট্রীটে থাকি। লিখে দেবো?
তারপর একটু থেমে বলল, কোনও অন্ধ মানুষের যদি সঙ্গী প্রয়োজন হয় তাহলেও আমাকে জানাবেন ও বিষয়ে আমার শিক্ষাগত যোগ্যতা আছে।
ঠিক আছে জানাবো। তবে সানটোরিড়াতে অন্ধ মানুষ বড় একটা নেই। তেমন কেউ আছে। বলেই আমি জানি না। তবে আমি লক্ষ্য রাখবো।
এডি মেয়েটাকে রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে যেতে দেখলো। হঠাৎ তার মাথায় একটা চিন্তা খেলে গেল। সে দোকানদারকে বলল, আভু মেয়েটার নাম ঠিকানা আমাকে দাও তো। আমি একজন অন্ধ মানুষকে চিনি তার একজন মহিলার সঙ্গদরকার।
সেদিনই রাত এগারোটার সময় এডি লক্ষ্য করলো, পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী বাড়ি থেকে কিছু দূরে তার জন্য লিনডা অপেক্ষা করছে।
প্রথম কয়েকটা মুহূর্ত দুজন দুজনকে আবেগে জড়িয়ে ধরে থাকলো। তারপর এডি বলল শোন লিনডা, আমাদের হাতে বেশি সময় নেই। এভাবে বেশিক্ষণ লোকটার চোখে ধুলো দিয়ে থাকা যাবে না। এর মধ্যে আমি একটা প্ল্যান করেছি।
লিনডা বলল–আমি জানতাম তুমি কিছু না কিছু একটা ব্যবস্থা করবে। নাহলে হয়তো কবেই আত্মহত্যা করতে যেতাম।
শোন আমি একটা মেয়ের সন্ধান পেয়েছি। মেয়েটি সঙ্গিনী হবার কাজ খুঁজছে। তুমি ফ্র্যাঙ্ককে বুঝিয়ে বল যে মাঝে মাঝে এ ধরণের পরিবর্তন ওর ভালই লাগবে। দু-তিন দিন বইপত্র পড়ার জন্য মেয়েটাকে রাখবার জন্য তুমি ফ্র্যাঙ্ককে রাজী করিয়ে ফেল।
লিনডা চোখ ঘুরিয়ে বলল, তাতে আমার লাভ কি? তুমি কি ভেবেছো যে তাকে পেয়ে ও আমাকে ছেড়ে দেবে?
লিনডা একটা জিনিস তুমি ভুলে যাচ্ছো ও এখন তোমার রূপযৌবন দেখতে পায়না। এখন তাই নতুন মেয়ের কণ্ঠস্বর শুনতে পেলে ও খুশীই হবে। তারপর কিছুদিন পরেই ও একা হতে চাইবে। তখন ওই তোমাকে বাইরে যেতে বলবে। আর আমার সঙ্গে তুমি দেখা করতে পারবে।
কিন্তু এতে তো অনেক সময় লেগে যাবে এর মধ্যে ম্যাক্স এসে যাবে। সেটা আমি চাই না।
দেখো লিনডা, তুমি যদি ঠিকমতো চাল দিতে পারো, ওর সঙ্গে ঝাঁঝিয়ে কথা বল তাহলে ও কিছুদিন পর নিজেই তোমাকে চোখের বিষ হিসেবে দেখবে।
লিনডা হাত চেপে বলল–আমি চাই ও মরুক। অতএব অনিচ্ছা সত্ত্বেও রাজী হল।
এক সপ্তাহ ধরে সাবধানে এডির কথামত চলে ও ফ্র্যাকের কাছে কথাটা তুলল। ও এমনভাবে মেরি প্রেনটিসের বর্ণনা দিতে লাগল (যাকে ও এখনও দেখেই নি) যাতে ফ্র্যাঙ্ক উদ্দীপ্ত হয়ে উঠল। গত সপ্তাহে সে ফ্র্যাঙ্কের সঙ্গে খুবই খারাপ ব্যবহার করেছে। তাই নতুন কাউকে দেখার জন্য সে উদগ্রীব হয়ে উঠল।
পরদিন সন্ধ্যেবেলায় মেরি প্রেনটিস এলো। লিনডা মলিন পোশাক পরা মেয়েটাকে দেখে স্বস্তি পেল। দৃষ্টিশক্তি থাকলে ফ্র্যাঙ্ক দ্বিতীয়বার ওর দিকে তাকাত না।
খুব সাধারণ দেখালেও মেরি প্রেনটিসের বড় বড় সবুজ চোখদুটোর সৌন্দর্য সত্যিই অতুলনীয়। কিন্তু মলিন পোশাক আর প্রসাধনহীন মুখ সে সৌন্দর্য ঢেকে দিয়েছে।
ফ্র্যাঙ্কের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবার সময় মেয়েটি সামান্য বিচলিত হয়ে পড়ল। সেই অবস্থাতেই ওদের একসঙ্গে রেখে লিনডা বেরিয়ে গেল।
সেদিন মেয়েটা চলে যাবার পরেই ফ্র্যাঙ্কের মধ্যে লক্ষণীয় পরিবর্তন দেখতে পেল লিনডা। পরের সপ্তাহ থেকে প্রতি সন্ধ্যাতে ডিনার শেষ করে ফ্র্যাঙ্ককে পত্রিকা পড়ে শোনানোর জন্য মেরি প্রেনটিস এ বাড়িতে এসেছে।
পরের সপ্তাহেই ফ্র্যাঙ্ক বলল লিনডা তুমি বাইরে ঘুরে এসো। আমাকে পড়ে শোনানোর জন্য তো মেরি প্রেনটিস রয়েইছে। অতএব সে রাতে মেরি প্রেনটিস বই পড়ে শোনাতে সে বলল, মিস লি বাড়িতে নেই?
না, ফ্র্যাঙ্ক মুচকি হাসল। আমি তোমার সঙ্গে খানিকটা সময় একান্তে কাটাতে চাইছিলাম। কেন জানো নিশ্চয়ই।
জানি। আমার কাছে এসো।
না এখানে নয়। এটা মিস লির বাড়ি। যদি আমার বাড়িতে আসেন তাহলে আলাদা কথা।
ফ্র্যাঙ্ক রাজী হলে মেরি তাকে গাড়িতে চাপিয়ে গাড়ি স্টার্ট করে দিল। সে বলল, তাড়াতাড়ি চলো মনি, দেখবে আমি তোমাকে কত সুখ দেবো।
ধীরে ধীরে বড় রাস্তার ওপরে একটা ল্যাম্পপোস্টের কাছে গাড়ি থামাল মেরি।
ফ্র্যাঙ্ক বলল–আমরা কি পৌঁছে গেছি?
হ্যাঁ, এই তোমার শেষ যাত্রা।
আমি এখন তোমাকে খুন করতে নিয়ে যাচ্ছি।
তুমি কে?
আমি ক্যারল ব্লানডিশ।
আতঙ্কে অন্ধ ফ্র্যাঙ্ক গাড়ি থেকে নেমে ছুটতে লাগল। সহসা চারিদিকে অনেক চিৎকার আর অনেক গাড়ির ব্রেক চাপার শব্দ পেল।
একখানা লাল রোড মাস্টার দ্রুতগতিতে এগিয়ে এল, গাড়িতে বসে ছিল লিনডা আর এডি। এডি ব্রেক কষার চেষ্টা করলেও শেষ রক্ষা হল না। গাড়ির সামনের ধাক্কায় ফ্র্যাঙ্ক ছিটকে রাস্তায় পড়ল। পরক্ষণেই একটা ট্রাক ওকে পিষে দিয়ে গেল।
ওয়ালটনভিল হাসপাতালের রবারের চাদর মোড়া বারান্দা দিয়ে নার্সকে অনুসরণ করে ম্যাক্স এগিয়ে গেল।
দুমিনিটের বেশি কিন্তু নয়।
ঘরে ঢুকে বিছানায় শোয়া ফ্র্যাঙ্কের দিকে তাকাল ম্যাক্স।
ক্যারল ব্লানডিশ বলেছে প্রথমে আমি তারপর তুমি হাঁপাতে হাঁপাতে ফ্র্যাঙ্ক বলল। এরপর ফ্র্যাঙ্ক চিরদিনের মতো স্তব্ধ হয়ে গেল।