৭. অকির্ড শহরে

০৭.

অকির্ড শহরে প্রায় সন্ধ্যায় ফিরে এলাম। অফিসে পাওলা ছিল। আমাকে দেখে ওর চোখে মুখে স্বস্তি লক্ষ্য করি।

পাওলা প্রশ্ন করে, কী খবর? তোমার মাথার অবস্থা কেমন?

এখন মাথা স্কচ হুইস্কি চায়। লক্ষী মেয়ের মত হুইস্কি দাও। আর খবর? হ্যাঁ, সূত্রগুলো জড়ো হচ্ছে। জট খুলতে আরও সময় লাগবে। অন্তত জানতে পেরেছি বেনিকে কে খুন করেছে। লী থেলার নামে একটা হারামজাদা। হয় সে এখনও এখানে আছে অথবা স্যানফ্রান্সিসকোতে ফিরে গেছে। কারমানকে ওখানে রেখে এসেছি নজর রাখতে।

আমাকে হুইস্কি দিয়ে পাওলা প্রশ্ন করে, থেলার কে? ওর কী ভূমিকা?

থেলার হচ্ছে অনিতার স্বামী। থেলারকে এখনও খুঁজে পাইনি। ওকে নিয়ে হয়ত কিছু ঝামেলা হতে পারে। ও বন্দুকবাজ।

পাওলার দু’চোখ বিস্ফারিত হয়।

উত্তেজিত হবে না। তোমার নোটবুক কোথায়?

কিন্তু ডিক…।

নোট রেডি! এখন ফালতু সময় নষ্ট করতে চাই না।

নোট বুক আর পেন্সিল নিয়ে পাওলা প্রস্তুত হয়।

পটভূমি স্যানফ্রান্সিসকো। সময় দু’বছর আগে জুন মাসের গোড়ার দিক। একজন নর্তকী, নাইট ক্লাবে উলঙ্গ হয়ে নেচে যে অর্থ রোজগার করে, তার নাম অনিতা ব্রোদা। হলিউড থেকে শহরে উদয় হয়। শহরে সে কাজ খুঁজে বেড়ায়। অবশেষে নিক নেডিকের কাছে তৃতীয় শ্রেণীর ট্রিক শো চালায়। ওখানে অনিতা ব্রোদা এক সপ্তাহের জন্য কাজ পায়। কাজের মাধ্যমে সে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করে। তাকে কাজে লাগিয়ে নেডিক অনেক অর্থ রোজগার করে।

আর একজনের ট্রিক শো বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। থেলার এবং গেইল বোলাসের সম্মিলিত খেলা।

পাওলা তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলে, ঐ মেয়েটাই না…?

হা। থেলার এবং অনিতা উভয়ের প্রেমে পড়ে যায়। থেলার স্থির করে ট্রিক শোর কাজ ছেড়ে ফটো তোলার দোকানের অংশীদার হবে। ফটোর দোকানের মালিকের নাম লুই-যার আলাদা অর্থ আসত ব্ল্যাকমেইলের মাধ্যমে। সম্ভবতঃ এই অবৈধ কার্যকলাপে খেলার নিজেকে যুক্ত করে।

একটু থেমে আবার বলি, থেলার গত বছর আট-ইনভেম্বর অনিতাকে বিয়ে করে। ট্রিক শো থেকে সরে যায় গেইল বোলাস। একমাস পরে থেলারকে ছেড়ে অনিতা চলে যায়। হয়তো তাদের মধ্যে আর বনিবনা হচ্ছিল না। যাইহোক, কাপড়ের দোকানে কাজ করার সময় মিঃ কার্ফের সঙ্গে অনিতার পরিচয় হয়।

নিশ্চয়ই জান, গাড়ি দুর্ঘটনায় কয়েক বছর আগে স্ত্রীকে হারান মিঃ কার্ফ। ওর মেয়েটি পঙ্গু। মিঃ কার্ফের জীবনটা কোন দিক দিয়েই মধুর ছিল না। অনিতা জাল ফেলে মিঃ কার্ফকে ধরে। উনি বিয়ের প্রস্তাব দেন।

অনিতা থেলারকে মিঃ কার্কের কথা জানায়। একজন লক্ষপতিকে বিয়ে করে অনিতা অনেক অর্থ আদায় করতে পারবে। ফলে উভয়ের মধ্যে চুক্তি হয়। থেলার মুখ বন্ধ রাখবে যদি অনিতা ওকে অর্থ জোগায়। মিঃ কার্ফকে বিয়ে করে অনিতা সান্টা বোসা স্টেটে চলে এলো।

অনেকের কাছে জেনেছি যে, অনিতার চুরির বাতিক ছিলনা। কেউ ওর আলমারিতে গোপনে নানা রকম জিনিস রেখে দিয়েছে। উদ্দেশ্য মিঃ কার্ফকে অপদস্ত করা। অনিতাকে হেয় করতে পারে মিসনাটালি কার্ফ। কারণ, অনিতা বেঁচে থাকলে সান্টা রোসা স্টেটের সম্পত্তির অর্ধেক থেকে সে বঞ্চিত হবে।

বার্কলের সঙ্গে অনিতার মেলামেশা সম্পূর্ণ অন্য ব্যাপার। মিঃ কার্ফের সঙ্গে যৌন জীবনে অতৃপ্তির ফলে অনিতা বার্কলের দিকে ঝুঁকে পড়ে।

পাওলা বলে, ডিক, বেনি কিভাবে খুন হয়েছিল?

হ্যাঁ, এবার বেনির কথা টুকেনাও। অনিতার সঙ্গে লুইয়ের কোন সম্পর্ক আছে–বেনির এমন ধারণা ছিল না। লুইয়ের দোকানে ঢোকাই ওর পক্ষে বিপদ হয়েছিল। দোকানে ছিল থেলার। বেনি যখন অনিতা সম্পর্কে খোঁজ নিচ্ছিল রিভলবার হাতে থেলার এগিয়ে এসেছিল। তার আগেই অনিতা সব কিছু জানিয়েছে। থেলার অর্কিড় শহরে এসে অনিতার দেখা না পেয়ে উত্তেজিত হয়। ফলে তার মাথার ঠিক ছিল না, সে বেনিকে খতম করে দেয়। তারপর রাত দশটার প্লেনে সেঅর্কিড শহরে যায়। জানি না, সেই অনিতাকে খুন করেছে কিনা। তবে অনিতার হত্যার সময়–সেই জায়গায় থেলার ছিল। খুঁজে বের করতে হবে থেলার খুন করেছে কিনা। আমি জানি, পেছন থেকে আমার মাথায় থেলার আঘাত করেছিল। হয়ত থেলারই অনিতার মৃতদেহ সরিয়ে ফেলেছিল।

মদ্যপান শেষ করে বলি, যদি জানতে পারি ডানাকে কেন খুন করা হয়েছে এবং কেন ডানার ঘরে অনিতার হীরের নেকলেস রেখেছিল তাহলে আমাদের কাজ অনেকটা এগিয়ে যাবে। লা এটোলিতে আমাকে দেখামাত্র অনিতা কেন এত ভয় পেয়েছিল? সে কেন ওখানে আত্মগোপন করেছিল? ওকে কে খুন করে মৃতদেহ সরাল?

পাওলা প্রশ্ন করল, গেইল বোলাসের ভূমিকা কী?

জানি না। তবে ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা চলে মিস বোলাসের সঙ্গে থেলারের যোগাযোগ আছে। আঘাতের পরে ওকে দেখে আমি হতভম্ব হয়েছিলাম। এর রহস্য আমাকে খুঁজে বের করতে হবে।

একটু থেমে বলি, কাইজার মিলসের ব্যাপারটাও তলিয়ে দেখতে হবে। ফেয়ারভিউতে ওর বাড়িতে আমি হানা দেব।

পাওলা বলে, লীডবেটারের খুনের পর ব্রান্ডন খুব ক্ষেপে গেছেন। তোমার সঙ্গে কথা বলতে চান। সাবধান ডিক, একটু ফাঁক পেলেই ব্রান্ডন তোমাকে কিন্তু চেপে ধরবে।

আগে আমি থেলারের ব্যাপারে অগ্রসর হব। সেই সঙ্গে কাইজার মিলসের বিষয়টাও, থেলারকে খুঁজতে বেশ সময় লাগবে।

তারপর টেলিফোনের দিকে হাত বাড়িয়ে বলি, ডানার পুরনো বন্ধু ফিনেগান।ও সাহায্য করতে চেয়েছিল। থেলারকে খুঁজতে ফিনেগানের দরকার হতে পারে।

ফিনেগানকে লাইনে পেয়ে বলি, প্যাট, তোমার জন্যে কাজ আছে। লী থেলার নামে একজনকে খুঁজছি। লোকটা ট্রিক-শুটার, ব্ল্যাকমেইলার এবং সম্ভবত একজন খুনী।ওকে খুঁজে যদি বের করতে পার কয়েক শো ডলার পুরস্কার পাবে।

ফিনেগান বলে, ঠিক আছে, মিঃ ম্যালয়। চারিদিকে লোক লাগিয়ে দিচ্ছি। ওর একটা বর্ণনা দিন।

লোকটার একটা ফটো পাঠিয়ে দিচ্ছি। কাজটা খুব জরুরী। ডানার খুনের সঙ্গে লোকটার সম্পর্ক আছে।

কঠিন গলায় ফিনেগান বলে, ফটো পাঠিয়ে দিন। ঠিক খুঁজে বের করবোই।

 ধন্যবাদ জানিয়ে টেলিফোন ছাড়ি।

থেলারের ব্যবস্থা হল। এবার মিলকে নিয়ে ব্যাপার। পাওলা, এই নোটগুলি টাইপ করে আলমারিতে রেখে দাও। আর হীরের নেকলেসটা মিঃ কাকে দিয়ে তার কাছ থেকে একটা রসিদ নেবে। যদি আমাদের এখানে ওই মহা মূল্যবান জিনিষটি ব্রান্ডন দেখতে পান তাহলে আমাদের আস্ত চিবিয়ে খাবেন। মিঃ কার্ফের হেফাজতে থাকলে আমরা নিশ্চিন্ত।

পাওলা জানায় যে আমার নির্দেশ মত সে সব কাজ করবে।

দরজার দিকে যেতে যেতে বলি, যদি আমি কোন বিপদে পড়ি, নোটগুলি মিফিনের হাতে তুলে দেবে।

***

আমি কাইজার মিলসের বাংলো থেকে প্রায় দুশ গজ দূরে গাড়ি থামিয়ে নেমে পড়ি। সুন্দর চাঁদের আলো। হাওয়ায় ফুলের গন্ধ। দশটা বেজে কুড়ি মিনিট। আমি আস্তে আস্তে এগিয়ে যাই। মনে মনে ভাবছি-এর চেয়ে কী লী থেলারের ব্যাপারে সময় দিলে ভাল হোত।

চারিদিকে তাকিয়ে গেট খুলে ভেতরে ঢুকি। ছোট্ট সুন্দর একটা বাগান। অদূরে মিলস্-এর বাংলো।

বারান্দার দিকে চারটে জানলা দিয়ে বাইরে আলো পড়ছে। মনে হল মিলস্ বাড়িতেই আছে।

বারান্দার একটাজানালা দিয়ে ঘরের মধ্যে উঁকিমারি। বেশ সুন্দর ঘরটা সাজানো।মিলস্, আরাম কেদারায় বসে আছে। ঠোঁটের ফাঁকে সিগারেট, হাতে হুইস্কির গ্লাস। মিলস্ ম্যাগাজিন পড়ছে।

ইচ্ছে হলেও ঝুঁকি নিলাম না বাড়িটার চারিদিকে একবার খুঁজে দেখার। হয়ত একটু পরেই মিলস্ শুতে যাবে। আধঘণ্টা অপেক্ষা করা ভাল।

এক ঝোঁপের মধ্যে পাথরের বেদী, যেখান থেকে মিলকে দেখা যাচ্ছে সেখানে বসি।

কুড়ি মিনিট পরে মিলস্ম্যাগাজিন রেখে উঠে দাঁড়ায়। মিলস্ গ্লাসে আরও হুইস্কি ভরে চেয়ারে বসে কান খাড়া করে কি যেন শোনে।

নিস্তব্ধ রাত্রিকে চিরে একটা গাড়ির শব্দ, তারপর গেট খুলে পায়ের হালকা শব্দ–কোন মহিলার।

আমি, দেয়াল ঘেঁষে নিঃশ্বাস বন্ধ করে দাঁড়াই। আমার কাছ দিয়ে স্ত্রীলোকটি এগিয়ে যায়। সুগন্ধ পাই। মহিলাটি ঘরে ঢুকে যায়।

যে স্ত্রীলোকটিকে ঘরে ঢুকতে দেখলাম সে আমার বিশেষ পরিচিতা। মিস নাটালি কার্ফ।

***

আমার মনে পড়ল পাওলা নাটালি কার্য সম্পর্কে কি বলেছে। দু বছর আগে মোটর দুর্ঘটনা ঘটে। নাটালি পঙ্গু হয় আর ওর মা মারা যায়। প্রচুর অর্থ ব্যয় এবং চিকিৎসা সত্ত্বেও মিস কার্ফের অবস্থার পরিবর্তন হয়নি।

চিকিৎসক যা করতে পারেনি–মিলস্ তাই করেছে, অসাধ্য সাধন। নইলে মিম কার্ফ অমন সতেজ ভঙ্গিতে হেঁটে যেতে পারতো না।

 মিলসের ভারীকণ্ঠস্বর, আগে তোবলনি যে, তুমি আজ এখানে আসবে। আগে ফোন করনি কেন?

আস্তে আস্তে এগিয়ে যাই। দরজার কাছে মিলস্ অসন্তুষ্টভাবে দাঁড়িয়ে।

নাটালি কার্ফ নরম গলায় বলে, আমি এসে কী তোমাকে বিরক্ত করলাম?

মিস্ কার্ক ভ্যানিটি ব্যাগ চেপে ধরে, চেয়ারের হাতলের ওপর বসে, ওর বেশ সতর্ক ভাব।

 মিলস্ বলে, আমি এখন শুতে যাচ্ছিলাম।

তাই নাকি? রাত তো বেশি হয়নি এ জন্যেই কী তোমার মুখে রাগের চিহ্ন?

মিলস্ দরজা বন্ধ করে বলে, রাগ নয়। তোমার এভাবে আসা ঠিক হয়নি। ধর, যদি কেউ থাকতো?

ভাবিনি যে, নিজের বাড়িতে আসতে অনুমতি নিতে হবে। পরের বার ভেবে দেখবো।

নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে হাল্কা গলায় নাটালি বলে, আমাকে কী তুমি পানীয় দেবে না?

এ বাড়ি তোমার। এই সমস্ত দামী মদ তোমার। নিজেই নিয়ে নাও।

নাটালি টেবিলের কাছে গিয়ে গ্লাসে হুইস্কি ঢেলে এক খণ্ড বরফ ফেলে দেয় তাতে। ওর ঠোঁট কাপে। নাটালি কার্ফ বলে, তোমার কি হয়েছে কাইজার।

এভাবে কতদিন চলবে?

কতদিন কী চলবে? কী বলতে চাইছো তুমি?

ব্যাপারটা ভালভাবেই জান। কতদিন গেটে দাঁড়িয়ে বোকার মত মানুষকে স্যালুট করতে হবে? কতদিন লুকিয়ে চোরের মত তোমার শোবার ঘরে ঢুকবো? ফ্র্যাঙ্কলিন কোন কিছু না জানার ভান করে কতদিন থাকবে?

এ ছাড়া আমরা আর কী করতে পারি?

আমরা বিয়ে করতে পারি। এ বাড়িতে আমরা কী একত্রে থাকতে পারি না? তোমার নিজের যথেষ্ট অর্থ আছে। মিঃ কার্ফের বলার কিছু নেই। আমরা কী বিয়ে করতে পারি না?

উঁহু, পারি না।

মিঃ কার্ফকে তোমার সত্য কথা জানানো উচিত। তোমার জন্যে ওর কি কোন মাথা ব্যথা আছে? দু বছর আগে হয়তো ছিল–এখন আর কিছু নেই।

উনি আমার জন্যে এখনও ভাবেন।

আমি বলছি…উনি তোমার কথা মোটেও ভাবেন না। তোমার সঙ্গে ওনার ব্যবহারের নমুনা লক্ষ্য করেছ? তোমার খোঁজ খবর উনি নেন? আমি জানি, তুমি কি ভাবছে।

কী ভাবছি আমি?

তুমি ভাবছো, দিনে দুবারের বেশি তোমাকে দেখতে আসা তোমার বাবার পক্ষে কষ্টকর। তাই না? দিনরাত তোমাকে শুয়ে বা বসে থাকতে দেখা তোমার বাবার পক্ষে অসহনীয়–তুমি বুঝি তাই মনে কর?

আমার ওপর এভাবে রাগ করার কোন প্রয়োজন নেই।

মিলস্ আবার বলে, আমি যা বললাম, তুমি অস্বীকার করতে পারবে?

কর্কশ গলায় নাটালি কার্ফ বলে, হ্যাঁ, আমি জানি!আমার এমন অবস্থা বাবা সহ্য করতে পারেন না। তার জন্যে আমি খুশি।

অনেক হয়েছে। এবার বাস্তবের দিকে তাকাও। তোমার সেই দিনই বারটা বেজেছে যেদিন তোমার বাবা ঐ সোনালী চুলের মহিলাটিকে বিয়ে করেছেন।

নাটালি চিৎকার করে বলে, ওই ব্যাপার নিয়ে আর আলোচনা করতে চাই না। শোন, আমাকে খুকি বলনা..শুনতে বিশ্রী লাগে।

কবে আর আলোচনা করবে? আমি আর অপেক্ষা করতে রাজী নই।

কী বলতে চাও?

খুবই সোজা ব্যাপার। কাল থেকে আমার চাকরী শেষ। গেটে আর দাঁড়াতে পারবো না। আর পেছনের সিঁড়ি দিয়ে তোমার শোবার ঘরে চোরের মত…আর সহ্য হচ্ছে না।

বিশ্রী ভঙ্গিতে হেসে নাটালি কার্ফ বলে, তুমি কী সবকিছু ছেড়ে দেবে?

যদি এই বাড়ি আর দামী মদ-খানাপিনা–এ সবের কথা বল–তবে দরকার নেই। আর শোন, বিয়ে না হলে আমি পালাবো।

কাইজার, বাবা যতদিন বেঁচে আছেন–তোমাকে বিয়ে করা সম্ভব নয়।

তোমার কী ধারণা, তোমার বাবার মৃত্যুর পর কেউ তোমাকে বিয়ে করতে রাজী হবে?

আঃ চুপ কর। আমরা যেমন আছি, তেমনি কি থাকতে পারি না? তুমি প্রয়োজনীয় সবকিছু তো পাচ্ছ। তোমার স্বাধীনতা আছে, তোমার কোন কাজে আমি হস্তক্ষেপ করি না।

নাটালির কব্জি ধরে মিলস্ বলে,’শোন খুকি, তোমার শোবার ঘরের উর্দি পরা চাকরের কাজ আমার দ্বারা আর হবে না।

কাইজার..হঠাৎ আমি…বিশ্বাস কর..আমি দুঃখিত।

তুমি দুঃখিত, তোমার এই অদ্ভুত আচরণের জন্যে আমি বিন্দুমাত্র ভাবছি না, বুঝলে খুকি। তোমাকে উত্তেজিত দেখে আমি খুশি। জানতাম এরকম একটা কিছু হবে।

বাজে বকো না। তুমি এখন কুদ্ধ। আমি যাচ্ছি পরে আলোচনা হবে।

পরের দিন আমাদের জীবনে আসবে না। কারণ কাল চলে যাচ্ছি।

 মিলস তার হাতের সিগারেটটা অগ্নিকুণ্ডে ছুঁড়ে ফেলে বলে, সিগারেটের মত ওই রকম…।

 প্লীজ কাইজার…।

আমাদের দুজনের সম্পর্ক ওই সিগারেটের মত…।

দীর্ঘ নীরবতার পর নাটালি কার্ফ বলে, কাইজার, ভেবে দ্যাখ। তুমি কি হারাবে। এই বাড়ি, দামী মদ আর নিরাপত্তা?

খুকি, আর আমাকে ধাপ্পা দিয়ো না। তোমার বাড়ি আর অর্থ? আর কী কোন মেয়ে বা বাড়ি নেই? তোমার কি সেই ধারণা।

আঃ চুপ কর কাইজার।

তোমার মত মেয়ে আর অর্থ কালকেই জোগাড় করা আমার পক্ষে কোন কঠিন ব্যাপার নয়। শোন খুকি, আমাকে রাখতে হলে বিয়ে করতে হবে। তোমার অগাধ অর্থের জন্যে তোমাকে বিয়ে করতে চাই।

তাই নাকি?

হ্যাঁ, তাই..আমার জীবনে তুমিই একমাত্র প্রথম এবং শেষ নারী নও।

নরম গলায় নাটালি কার্য বলে, আমি হয়ত তোমার জীবনে শেষ নারী হতেও পারি।

মিথ্যে আশা কর না। আমি এখন শুতে যাব। আমি বড় ক্লান্ত। তুমি বরং বাড়ি ফিরে যাও।

বড় বড় চোখ করে নাটলি বলে, কালকে কী আমাদের আলোচনা হবে না?

কাল আমি এখান থেকে চলে যাব।

কাইজার, সত্যিই তুমি চলে যাবে?

তোমার সঙ্গে কী এতক্ষণ ইয়ার্কি করছিলাম? তোমাকে আমার প্রয়োজন নেই।

এই কথা কী অনিতাকেও জানিয়েছিলে?

কী বোকা তুমি! হা হা হা! হুঁ, তুমি অনিতার ব্যাপারটাও জান। কিন্তু তোমার মত অনিতার এত উৎসাহ ছিল না। শোন খুকি, তুমি কেন ফ্রাঙ্কলিনকে একবার সুযোগ দিচ্ছ না? লোকটা বুড়ো হলেও খুব উৎসাহী তোমার প্রতি।

নাটালি কার্ফ ঘুরে দাঁড়িয়ে ব্যাগ থেকে ছোট্ট অটোমেটিক পিস্তল বের করলো।

 নাটালি পিস্তলের নল মিলসের দিকে তাক করে, তুমি কোথাও যাচ্ছ না, কাইজার।

পিস্তল সরাও। শোন, হঠাৎ দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।

দুর্ঘটনা? হবে হতে চলেছে। উঁহু, একদম নড়বে না। কিভাবে পিস্তল চালাতে হয় আমি জানি। লক্ষপতির মেয়ের অনেক কিছু করার সুযোগ থাকে। আমি গুলি চালাতে ওস্তাদ।

শোন, বোকামী কর না খুকি…।

বলছি না, আমাকে খুকি বলবে না। এখন আমি যা বলবো চুপচাপ তুমি তাই শুনবে।

জানালার সামনে আমার তিনফুট দূরে দাঁড়িয়ে নাটালি কার্ফের চুলের সুগন্ধ টের পাই। আমি নিঃশ্বাস বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকি। একটু টের পেলেই ও গুলি করবে ভাবামাত্র আমি ঘামতে থাকি।

নাটালি কার্ফ বলে, জানতাম, খুব তাড়াতাড়ি এরকম কিছু ঘটবে।

কাইজার, তোমার মত লোকের সঙ্গে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা অসম্ভব। কিন্তু তুমি সুদর্শন এবং স্বাস্থ্যবান। আর মাঝে মাঝে তোমার সঙ্গে ফুর্তি করা যায়। আমায় বোকা মেয়েছেলে ভেব না। অনিতার ব্যাপারস্যাপার আমি জানি। আমি গোপনে সব লক্ষ্য করেছি। তোমার মত পাজী আর বদমাস লোক আর আমি দেখিনি।

হ্যাঁ, তোমার সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে আমি চেয়েছি। জানতাম তুমি ক্লান্ত হয়ে অন্য মেয়ে মানুষের খোঁজ করবে। উত্তেজিত হলেই তুমি কথা বলবে এবং তোমার আসল চেহারা প্রকাশ পাবে। একদিন তো তুমি আমার কথাও অন্য মেয়েদের কাছে বলবে। কিন্তু কাইজার, তোমার পক্ষে তা আর সম্ভব হবে না।

তুমি কী ক্ষেপে গেলে?

তোমাকে ছেড়ে দিলে আমি বোকার মত কাজ করবো। কাল সকালে সবাই তোমার মৃতদেহ। দেখে জানবে যে স্ত্রীলোকের দ্বারা এই কাজ হয়েছে কিন্তু কোন স্ত্রীলোক কেউ জানবে না। এই শহরে সবাই জানে, আমি হাঁটতে পারি না। একমাত্র ডাক্তার ম্যাকফিল্ডলে জানেন যে আমি হাঁটতে পারি। কিন্তু উনি বলবেন না। এ খবরে ফ্রাঙ্কলিনও খুশি হবে, সে তোমাকে পছন্দ করে না।

ফ্যাকাশে ঠোঁট কাঁপিয়ে মিলস্ বলে, পিস্তল নামাও..বোকা মেয়ে কোথাকার।

বিদায় কাইজার’ বলে নাটালি পিস্তল ওঠায়। তোমাকে নির্জনতার মধ্যে ঠেলে দিচ্ছি। একমাত্র মৃত্যুর মধ্যেই নির্জনতা অনুভব করতে পারবে।

খবরদার…গুলি কর না। মিলস্ কিছুটা ঘুরে হাত বাড়ায়।

আমি নাটালি কার্ফের কনুইতে জোরে আঘাত করি, পিস্তল দূরে ছিটকে যায়। সে মুহূর্তে ঘুরে দাঁড়িয়ে আমাকে আক্রমণ করে।

সে আমার মুখ রক্তাক্ত করে দেয় তার তীক্ষ্ণ নখরাঘাতে। তারপর সে বাগানের পথ ধরে গেটের দিকে ছুটে যায়।

***

মিলস্ বলে, এই যে ম্যাক, আমাকে রক্ষা করার জন্যে আপনি এগিয়ে এলেন।

ঘরে ঢুকে আমি ক্ষতস্থানে রুমাল চাপি। রুমাল রক্তে ভিজে যায়। চেয়ারে বসে বলি, খুব ঘাবড়ে গেছেন, তাই না? মনে হচ্ছে এই মাত্র আপনি কবর থেকে উঠে এলেন।

ঠিক তাই। বলে মিলস গ্লাসে হুইস্কি ঢালতে চেষ্টা করে কিন্তু ব্যর্থ হয়।

আমি মিলসের হাত থেকে বোতল নিয়ে বললাম, আমাকে দিন।

বেশ বড় ধরনের পেগ তৈরী করি। মিলস্ তিন চুমুকে গ্লাস শেষ করে। আটচল্লিশ ঘণ্টা বাদে এমন সুস্বাদু পানীয় আমার জোটে।

মিলস্ আরও পানীয় দিতে বলে।

মাই গড। আমি যা ভয় পেয়েছিলাম। যদি আপনি ঠিক সময়ে হস্তক্ষেপ না করতেন…।

আপনার সঙ্গে কথা বলার জন্যে এ সময় না এলে কী যে ঘটত…।

আপনার কাছে আমি কৃতজ্ঞ। মেয়েটার মাথার ঠিক নেই। ও সাংঘাতিক ধরনের। ওর কথা শুনেছেন? মৃত্যুর মধ্যে না কি নির্জনতা…ব্যাপারটা কী? কী এর অর্থ?

মিলসকে আরও পানীয় দিলাম।

একসঙ্গে খাবেন না। অন্তত দশ মিনিট আপনাকে শান্ত দেখতে চাই। কথা বলার আছে।

একটা সিগারেট দিন। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এখান থেকে চলে যেতে চাই। মেয়েটা পাগল। ও হয়তো আবার পিস্তল নিয়ে আসবে। সুতরাং তাড়াতাড়ি কেটে পড়াই ভাল।

মিলসের অবস্থা শোচনীয়। হয়তো অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে।

আমি বলি, ঘাবড়াবেন না। নিশ্চিন্ত থাকুন–মিস কার্ফ আর ফিরে আসছে না।

 পাঁচ মিনিট পরে মিলস প্রশ্ন করে, ম্যাক,আপনি এখানে কী করছিলেন? অনিচ্ছুক হলে বলবেন না। আপনি না থাকলে এতক্ষণে…। বলুন, আপনার কি কাজে লাগতে পারি। সেদিনের ঘটনার জন্যে আমি দুঃখিত।

ঠিক আছে, ব্যাপারটা ভুলে যান। মেয়েটা যে হাঁটতে পারে জানতাম না।

মিস কার্ফের মাথা খারাপ। মিঃ কার্ফকে মেয়েটা পথে বসাতে চায়।

কী করেছেন মিস কার্য?

আপনি শুনতে চান? শুনুন। সংক্ষেপে বলছি, মার সম্পর্কে মিস কার্ফের আবেগ ছিল। কিন্তু মিঃ কার্ফকে নিয়ে বিন্দুমাত্র ভাবতো না। অন্যদিকে মিঃ কাফ্ট মেয়ের জন্যে পাগল ছিলেন। মেয়ে মাকে নিয়ে যেভাবে মত্ত ছিল–তাতে মিঃ কার্ফের হিংসা হোত। একবার তিনজনে ভ্রমণে বেরোয়। ওরা দুপুরে খাওয়ার জন্যে এক জায়গায় গাড়ি থামায়।মিঃ কার্ফ অতিরিক্ত মদ্য পান করেন। স্ত্রী বা মেয়ে কাউকে গাড়ি চালাতে না দিয়ে নিজে জেদ করে গাড়ি চালান। সাংঘাতিক দুর্ঘটনা ঘটে। একটা চলন্ত ট্রাকের মুখোমুখি পড়ে ওর গাড়ি। ট্রাক ড্রাইভার মারা যায়। মিসকার্য ছিটকে বাইরে যায়। ওর মার সর্বাঙ্গে কাঁচ বিধে যায় অথচ মিঃ কাষ্ণ অক্ষত থাকেন। মিস কার্য জ্ঞান ফেরার পর তার মার রক্তাক্ত মৃতদেহ দেখতে পায়। ফলে মিস কার্ফের মাথায় গণ্ডগোল দেখা যায়। ওর ধারণা, ওর মার মৃত্যুর জন্যে ওর বাবা-ই দায়ী এবং বাবাকে ঘৃণা করতে শুরু করে। মিঃ কার্ফকে শাস্তি দেবার জন্যে মিস কার্ফ পঙ্গুতার ভান করে।

আপনি কিভাবে নিজেকে এই ঝামেলায় জড়ালেন?

ওরা গেটে একজন গার্ড চাইছিল। আমার কাছে অর্থ ছিল না তাই কাজটা নিই। তারপর মিস কার্ফ আমার দিকে ঝুঁকে পড়ে। মিস কার্ফ আমার সঙ্গে কিছুদিন ফষ্টিনষ্টি করতে চেয়েছিল।

আপনি কি জানেন যে অনিতার আলমারিতে চোরাই মালে ভর্তি একটা স্যুটকেস পাওয়া গেছে?

ওটা মিস কার্ফের কীর্তি। স্যুটকেস আমিই জোগাড় করেছি–আর মিস কার্ফ গোপনে সেটা অনিতার আলমারিতে রেখে দেয়।

গেইল বোলাস সম্পর্কে আপনি কি কিছু জানেন?

 অবাক হয়ে মিলস্ বলে, আপনি কিছু জানেন না?

 আপনি ওকে চেনেন?

 মিলস্ বলে, প্রায় চার মাস আগে গেইল বোলাস এ শহরে উদয় হয়। ও যুদ্ধ দেখতে ওস্তাদ। ক্রুগারের ওখানে ওর দেখা পাই। আমার বক্সিং ওর পছন্দ হয় ফলে আমাদের মধ্যে মেলামেশা শুরু হয়। আমি ছেড়ে দিলে বোলাস আর মেশে না আমার সঙ্গে। মেয়েটা বেশ কড়া ধাতের। জুয়ার রোজগারে ওর দিন কাটতো জানতাম। এখন ও কি করছে জানি না।

কখনও কি মেয়েটা লী থেলার সম্পর্কে তোমাকে কিছু বলেছে?

লী থেলার? লোকটা কে?

যাকগে। কয়েকদিন আগে আপনি বার্কলের বাড়িতে গোপনে কী করছিলেন?

একটু চমকে মিলস্ বলে, ওখানে আপনি কী করতে গিয়েছিলেন?

কাজ ছিল। আপনি কি খুঁজছিলেন?

আর কি মিস কার্ফের কাজে। এমন কিছু খুঁজে পাইনি যাতে মিঃ কার্ফ অনিতাকে সন্দেহ করতে পারে।

মিলস, ডানার মৃত্যু সম্পর্কে আপনি কিছু জানেন?

কিছু না। মিস কার্ফের ধারণা অনিতা ডানাকে খুন করেছে। কিন্তু অনিতার পক্ষে তা সম্ভব নয়। আর নয়, যত তাড়াতাড়ি পালাতে পারি ততই মঙ্গল।

কেটে পড়ুন তাড়াতাড়ি।

***

মিলসের কথাগুলি অর্কিড শহরে ফেরার পথে বারবার মনে পড়ছিল। ডানার হত্যার সঙ্গে ওর কোন সম্পর্ক নেই।

এখন থেলারই হলো সন্দেহ ভাজন ব্যক্তির মধ্যে এক নম্বর। ব্যানিস্টারের পক্ষে ডানাকে হত্যা করার কোন কারণ নেই অবশ্য যদি নেকলেসের লোভে…। নাটালি কার্ফের কোন কারণ নেই ডানাকে হত্যা করার। তাছাড়া, মিস কার্য কখনও ভারী বন্দুক চালাতে পারবে না।

আমার কেবিনে ঢুকে আলো জ্বেলে বসবার ঘরে যাই। তখন রাত একটা বেজে পনেরো মিনিট। এত ক্লান্ত লাগছিল যে পোশানা ছেড়ে শোবার কথা ভাবি। টেলিফোন বেজে ওঠে। নিস্তব্ধ রাত্রে টেলিফোনের শব্দ অবাস্তব মনে হয়। বিছানার এক ধারে বসে টেলিফোন তুলি।

প্যাট ফিনেগানের গলার আওয়াজ পাই। সে বলে, মিঃ ম্যালয়, আমি লোকটাকে খুঁজে পেয়েছি। জো, বেটিলোর আস্তানায় লোকটা লুকিয়ে আছে।

তুমি কী লী থেলারের কথা বলছো?

হ্যাঁ, আমি কি ওখানে যাবো?

প্যাট, তুমি শুয়ে পড়। এটা আমায় নিজেকে মোকাবিলা করতে হবে। ধন্যবাদ!

শুনুন মিঃ ম্যালয়…আপনি ওখানে একা যেতে পারবেন না। বেটিলো খুব সাংঘাতিক টাইপের।

প্যাট, ব্যাপারটা আমার ওপর ছেড়ে দাও। একটা উপকার করবে? স্যানফ্রান্সিসকোতে টেলিফোন করে কারমানকে প্রথম প্লেনে আসতে বলে দাও।ওকে জানিও কোথায় থেলাররয়েছে।

ফিনেগানকে কারমানের হোটেলের টেলিফোন নম্বরটা জানাই।

জো বেটিলো আর থেলারের ব্যাপার আমি সামলাবো।

ফিনেগান বলে, কিন্তু…জো অত্যন্ত সাংঘাতিক…।

তাই নাকি? শুতে যাও প্যাট। টেলিফোন রেখে আমি বিছানার দিকে একবার করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বেরিয়ে গাড়ির দিকে অগ্রসর হই।