৪-৬. স্যালিক ফিরে এলেন

০৪.

সোমবার সকাল সাড়ে আটটায় স্যালিক ফিরে এলেন তার স্যুইটে। ডেস্কে বসতে না বসতে শেরবর্ন-এর মুখে শুনলেন ফেনেলের প্যারিসে যাবার ইতিবৃত্ত। শুনে রাগে তার গা জ্বলে গেল। সকাল থেকেই তার মেজাজটা খারাপ। তবুও ভালো এখনও একটি খবর তিনি শোনেন নি যে বার্জিয়া আংটি চুরির আগোগোড়া খসড়াটা টেপবন্দী অবস্থায় ততক্ষণে ম্যাক্স কালেনবার্গের ডেস্কে পৌঁছে গেছে, শুনলে হয়তো তিনি হার্টফেল করতেন।

নটার মিটিংটা বিরক্তিতেই শেষ করলেন তিনি। গেঈ, গ্যারী এবং জোন্সের কাছে ব্যাখ্যা করলেন, ফেনেলকে কেন এখান থেকে পালিয়ে প্যারিসে গিয়ে উঠতে হয়েছে। তিনি বললেন, মিঃ ফেনেল চলে যাওয়ার ফলে একটু অসুবিধাই হয়েছে আমাদের। কলেনবার্গের নিরাপত্তা বিষয়ে তার কাছে অনেক কিছু জানার ছিলো। র‍্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল হোটেলে তার সঙ্গে দেখা হওয়া মাত্র খুঁটিনাটি সব কিছু জেনে নেবেন তার কাছ থেকে। আজ রাতে এখান থেকে রওনা হয়ে কাল সকালে আপনারা পৌঁছবেন জোহান্সবার্গ। একটু থেমে ইতস্ততঃ করে বললেন, ফেনেল একটা দাগী আসামী দুর্ধর্ষ প্রকৃতির। সাবধানে থাকবেন সকলে। কাজটা ওকে ছাড়া সম্ভব নয় তাই ওকে দলে নেওয়া। গ্যারীর দিকে তাকিয়ে বললেন, মিস ডেসমন্ডকে নিয়েই যা চিন্তা, একটু নজরে রাখবেন। ওর যেন কোনো ক্ষতি না হয়।

–আপনাদের যাত্রা শুভ হোক, শেরবর্ন-এর কাছে টিকিট এবং অন্যান্য খুঁটিনাটি পাবেন। আজ এই পর্যন্তই থাক। তিনজনকে বিদায় দিয়ে স্যালিক ডেস্কের দিকে তাকালেন। কিন্তু সেদিনের ফিরিস্তি লেখা কাগজ তার চোখে পড়লো না। এমন ভুল তো ন্যাটালি কখনো করে না। তিনি আরো অবাক হলেন যখন শুনলেন যে ন্যাটালি আসেনি। গত তিন বছরে যে মেয়ে একদিনও কামাই করেনি আজ তার হলোটা কি?

ফোনটা হঠাৎ বেজে উঠলো। শেরবর্নকে ধরতে বলে কাজে মন দিলেন তিনি কে বলছেন আপনি–অ্য।- শেরবর্ন এর অবাক স্বর শুনে চোখ তুলে তাকালেন স্যালিক। ফোনের ওপাশ থেকে কিছু একট শুনে শেরবর্ন হতভম্ব হয়ে পড়েছে বোঝা গেল। তার মুখের রঙ ধীরে ধীরে বদলাতে শুরু করেছে।

শেরবর্ন রিসিভারের মুখে হাত চেপে স্যালিকের দিকে তাকালো, স্পেশাল ব্রাঞ্চের সার্জেন্ট গুডইয়ার্ড, আপনার সঙ্গে দেখা করতে চান।

স্যালিক চিন্তিত হলেন। শেরবর্নকে, বললেন, ওকে আসতে বলে দাও। কিছুক্ষণ পর করাঘাতের শব্দে সুইটের দরজা খুলে শেরবর্ন মুখোমুখি হলো সার্জেন্ট গুডইয়ার্ডের। সার্জেন্ট স্যালিকের অফিস ঘরে বসলেন, তারপর স্থির দৃষ্টিতে তাকালেন স্যালিকের দিকে।

স্যালিকের মনে উৎকণ্ঠার শেষ নেই। ন্যাটালি নরম্যান আপনারই একজন কর্মচারী, তাই না মিঃ স্যালিক?-অবাক বিস্ময়ে ঘাড় নাড়লেন স্যালিক, হা, কিন্তু আজ তিনি আসেননি। কি ব্যাপার বলুন তো?

শনিবার রাতে মারা গেছেন তিনি, গুডইয়ার্ড পুলিশী কেতায় বললেন, আত্মহত্যা করেছেন।

আতঙ্কের একটা ছায়া ছড়িয়ে পড়ল স্যালিকের চোখেমুখে। মৃত্যুকে তিনি বড় ভয় পান। এখন তার মাথায় চিন্তা এসে গেল যে তার ব্যক্তিগত কাজকর্ম কিভাবে চলবে? ন্যাটালির মৃত্যুটা তার কাছে কিছুই নয়। আসল ব্যাপারটা তিনি এর মধ্যেই ন্যাটালিকে একটু বেশী বিশ্বাস করে ফেলেছিলেন।

গুডইয়ার্ড স্যালিককে বললেন, ন্যাটালির মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধানের জন্যেই এখানে আসা। আশা করি এ ব্যাপারে আপনি কিছু আলোকপাত করতে পারবেন। স্যালিক চুরুটে অগ্নিসংযোগ, করতে করতে বললেন, দুঃখিত মিঃ গুডইয়ার্ড। মিস নরম্যান বা তার ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে আমার কিছুই জানা নেই। শুধু এইটুকু বলতে পারি, কাজকর্মে তাঁর মতো চটপটে মহিলা আমি খুব কম দেখেছি। মেয়েটির স্বভাব ছিল নম্র আর ব্যবহার ছিল খুব মিষ্টি।

ওভারকোটের পকেট হাতড়ে গুডইয়ার্ড একটি ছোট্ট বস্তু বের করে রাখলেন স্যালিকের টেবিলে, দেখুন তো এটা চিনতে পারেন কিনা?

নিতান্তই সাধারণ একটা পেপার ক্লিপ, একগোছা কাগজপত্র একসঙ্গে আটকে রাখার কাজেই ব্যবহৃত হয়। পেপার ক্লিপের মতো দেখতে হলেও আসলে বস্তুটি এক অমিত শক্তিশালী মাইক্রোফোন। কেবলমাত্র কয়েকটি অনুমোদিত গোষ্ঠী ছাড়া কারুর কাছে রাখার আইন নেই। এটি সচরাচর গোপন খবরাখবর সংগ্রহের উদ্দেশ্যেই ব্যবহৃত হয়ে থাকে।

স্যালিকের মেরুদণ্ড বেয়ে একটা শীতল স্রোত নেমে গেলো, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। ব্যাপারটা।

এটি পাওয়া গেছে মিস নরম্যানের ফ্ল্যাটে। ভাগ্যক্রমে যে ডিটেকটিভের ওপর মৃত্যু তদন্তের ভার ছিলো, তার সজাগ চোখেই এর অস্তিত্ব ধরা পড়ে। তিনি এটি স্পেশ্যাল ব্রাঞ্চে পাঠিয়ে দেন। আমার আগমনের কারণ তাই।

–এই মাইক্রোফোন ব্যবহারের জন্য চাই এক বিশেষ ধরনের টেপরেকর্ডার। ক্লিপটি পকেটে ভরে মিস নরম্যানের ডেক্সটি তিনি পরীক্ষা করে দেখলেন কিন্তু সন্দেহজনক কিছু চোখে পড়ল না। গুডইয়ার্ড আর না দাঁড়িয়ে বেরিয়ে গেলেন। গুডইয়ার্ডের শীতল দৃষ্টি স্যালিকের মর্মস্পর্শ করলো।

স্যালিক তার চেয়ারে বসে পড়লেন। বড় ঘাবড়ে গেছেন তিনি। রুমাল বার করে ভিজে হাতের তালু মুছলেন। নানা চিন্তা এসে ভিড় করলো তার মাথায়। মাইক্রোফোনটা কি কখনও তার ডেস্কে ছিল। ডেস্কে যদি মাইক্রোফোনটা থেকেই থাকে তবে কোন্টা টেপ হয়েছে আর কোষ্টা হয় নি? টেপরেকর্ডারটাই বা কোথায় আছে সেইটাই ভাববার কথা নানা ধরনের চিন্তার স্রোত মাথার মধ্যে আসছে।

.

চার্লস ব্রানেটের অফিস ঘরে এসে ঢুকলেন তার সেক্রেটারী। সাঙ্কেতিক লিপিতে লেখা একখানি টেলিগ্রাম তার হাতে দিলেন। তিনি জানতে পারলেন হনিওয়েল শেয়ারের দর তিনগুণ বেড়েছে। আবার টেলিফোন বেজে উঠলো। ইনপেক্টর পার্কি-এর স্বর ভেসে এলোদূরাভাসে, ন্যাটালির মৃত্যু সংবাদ নিয়ে।

ব্রানেট বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলেন, কয়েক মুহূর্তের জন্য গলা দিয়ে কোন স্বর বের হলো না। পার্কি-এর কাছে আরও তিনি জানতে পারলেন যে ন্যাটালির ফ্ল্যাটে নাকি ড্যাজ জ্যাকসন ঘন ঘন যাতায়াত করতো। আশ্চর্যের কথা! ওকি ব্যাপারটায় জড়িয়ে পড়তে পারে?

তেমন সম্ভাবনা নেই। শনিবার রাতেই জ্যাকসন পালিয়েছে। ডাবলিনে গেছে হয়তো। পুলিশ ওকে খুঁজে বেড়াচ্ছে।

চুপচাপ বসে অনেকক্ষণ নানা কথা ভাবলেন ব্রানেট। ন্যাটালির ঘরে ফেলে আসা মাইক্রোফোনের কথাও তার মনে এলো। বিকেলটা একেবারেই তর মাঠে মারা গেল।

.

র‍্যান্ড ইন্টারন্যাশানাল হোটেলের লবিতে বড় ভিড়, হৈ চৈ। একদল আমেরিকান ট্যুরিস্ট খুব হৈ চৈ করছে। স্বচ্ছ বর্ষাতিতে শরীর ঢেকে তারা ঘোরাঘুরি করছে।

ব্রেকফাস্ট খেতে খেতে লিউ ফেনেল পরম বিরক্তিতে সব দেখছিলো। বৃষ্টি সমানে পড়েই চলেছে। প্রায় দেড় দিন সে জোহান্সবার্গে আছে। প্যারিস থেকে জোহান্সবার্গের প্লেনে ওঠার আগে পর্যন্ত তাঁর মনে দুশ্চিন্তা ছিলো। এখন সে নিশ্চিন্ত, সম্পূর্ণ নিরাপদ। পুলিশ বা মোয়রানি–উভয়েরই নাগালের বাইরে সে এখন।

আর কিছুক্ষণ পর হোটেলের সামনে এসে থামলো একখানা কালো ক্যাডিলাক। গাড়ি থেকে নামলো ওরা তিনজনে–গ্যারী, গেঈ আর জোন্স। তাঁরা হোটেলে এসে ঢুকলো।

মিনিট দশেক পরনতলায় ফেনেলের স্যুইটে বসবার ঘরে চারজন বসলো টেবিল ঘিরে। সবাই ঠিক করলো যে বিশ্রাম নেবার আগে আলোচনাটা সেরে নেওয়া যাক। ফেনেল বলতে শুরু করলো, শুনুন সকলে, স্যালিকের কাছ থেকে যেনক্সা আমি পেয়েছিতা থেকে ঘটনাস্থলের একটা মোটামুটি ধারণা আমার হয়েছে। আমার বিশ্বাস, কালেনবার্গের মিউজিয়ামটা মাটির নীচে কোথাও আছে।

নক্সায় ছটা টেলিভিশন এবং একটা বিপদজ্ঞাপক মনিটরের উল্লেখ আছে। এর থেকে এই সিদ্ধান্তেই আসা যায় যে মিউজিয়ামে মোট ঘরের সংখ্যা ছটা এবং বাড়ির কোথাও না কোথাও মনিটর তদারকি করার জন্য একজন পাহারাদার আছে। এর প্রধান দোষ এই যে, পাহারাদার কখনো ঘুমিয়ে পড়ে, কোনদিকে না তাকিয়ে একমনে বই পড়তে পারে কিংবা কখন সখনও বাথরুমেও যেতে পারে। আমাদের প্রথমেই জানতে হবে, এই তিনটের কোনটাই সে আদৌ করে কিনা এবং রাতেও সে পাহারায় থাকে কিনা। মিঃ গ্যারীর কাজ এই দুটো বিষয়ে খবর সংগ্রহ করা।

মিউজিয়ামের দরজাটারও উল্লেখ আছে নক্সায়। নিরেট স্টিলের তৈরী দরজা। এই ধরনের দরজা বানায় শুধু বলস্ট্রমরা। দরজায় সাধারণ তালার কোন ব্যাপার নেই–আছে এক টাইম লক। তালাটি লাগিয়ে ডায়াল ঘুরিয়ে ডায়ালে অন্য এক সময় ঠিক করে রাখলেই হলো। পৃথিবীতে একমাত্র বলস্ট্রমরা ছাড়া আর কেউ পারবে না সে তালা খুলতে। অবশ্য টাইম লক খোলার ব্যাপারটা আমার কাছে অতি সহজ ব্যাপার। যত ঝামেলার হলো লিফটাই। কাজটা আমাদের করতে হবে রাতে। আমাদের জানতে হবে রাতে লিফট চালু থাকে কি না, যদি না থাকে তবে বুঝতে হবে যে রাতে বৈদ্যুতিক যোগাযোগ সব কেটে দেওয়া হয়।

লিফ্ট চালু করার ভার গ্যারীকেই নিতে হবে। আগে থেকে সব দেখেশুনে রাখাই ভালো। আর একটা ব্যাপার আমাদের জানতে হবে সেটা হলো বাড়িতে ঢুকবো কিভাবে দরজা দিয়ে না জানলা দিয়ে। যেমন খবর আপনি জানবেন, তেমন খবর আমাকে জানাবেন। ট্রান্সমিটারে জানালে তবেই সেই ভাবে তৈরী হবো।

ফেনেল গ্লাসে শেষ চুমুক দিল। গেঈ উঠে দাঁড়ালো। নীল পোশাকটা তার গায়ে একেবারে কেটে বসেছে। ভারী সুন্দর দেখাচ্ছে তাকে, রক্তে যেন নেশা ধরিয়ে দেয়। তিনজনেই মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইলো তার দিকে।

গ্যারী ও জোন্স যে যার ঘরের দিকে পা বাড়ালো।

ঘণ্টা খানেক পরে জোন্স ফেনেলের ঘরে এলো। এতক্ষণ বসে বসে আরো হুইস্কি টেনেছে। ফেনেল। চোখ দুটি তার জবাফুলের মতো লাল।

জোন্সকে নিয়ে ফেনেল বেরিয়ে পড়লো বন্ধুর বাড়ির উদ্দেশ্যে, প্রয়োজনীয় জিনিসগুলি পাওয়ার আশায়। বৃষ্টি সমানে পড়েই চলেছে। মাথা নীচু করে দৌড়ল দুজন বৃষ্টির মধ্যে। প্লীনস্ট্রীটে স্যাম জেফারসনের গ্যারেজ কাছেই। স্যাম তাদের দেখে অভ্যর্থনা জানালো।

স্যাম জোন্সকে বললো, যা যা বলেছিলে সবই যোগাড় করে রেখেছি। অবশ্য এ ব্যাপারে জো আমাকে অনেক সাহায্য করেছে।

ফেনেল স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললো, সব আয়োজনই আপনি করে ফেলেছেন দেখছি। নিজেদের টুকিটাকি ব্যাগটা নিলেই চলবে তাহলে।

বৃষ্টি একটানা পড়েই চলেছে, আর দেরী না করে ওরা হোটেলের পথে পা বাড়ালো।

র‍্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল হোটেল সংলগ্ন চেকমেট রেস্তোরাঁয় রাত সাড়ে আটটায়। সকলে এসে জমায়েত হলো একে একে। গেঈ এলো সকলের শেষে। পরনে তার কমলালেবু রঙের ছোট স্কার্ট–গায়ের সঙ্গে আঁট হয়ে বসে আছে। ফেনেল স্থির দৃষ্টিতে দেখছিলো গেঈকে। জীবনে মেয়েমানুষ কম দেখেনি সে। কিন্তু এর মতো কেউ তার চোখে পড়েনি। গেঈ যেন এক জ্বলন্ত কামনা, লালসার এক উন্মত্ত রূপ।

গ্যারী বললো, বলুন, কি খাবার বলবো? সকলেই ক্ষুধার্ত। মাংস–পাঁউরুটি এবং অন্যান্য রুচিকর খাবারের ঢালাও অর্ডার দেওয়া হলো।

খেতে খেতে সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিলো যে, ব্যবস্থা যখন সব হয়েই গেছে তখন আগামী কালই রওনা দেওয়া ভালো। যত আগে বেরিয়ে পড়া যায় ততোই ভালো। জোন্স বলল, সাধারণতঃ এদিকের চেয়ে ড্রাকেন্সবার্গ-এ বৃষ্টি শুরু হয় দেরীতে।

সে বললো, কালেনবার্গের বাড়ি মেনভিল থেকে প্রায় চারশো কিলোমিটার। হেলিকপ্টার থাকবে মেনভিলে। আকাশপথে চারশো কিলোমিটার আর কতক্ষণ! মিঃ গ্যারী আর মিস্ গেই বরং একদিন থেকে যাবে মেনভিল-এর ক্যাম্পে। আমরা মিঃ ফেনেলকে নিয়ে গাড়িতে এগোবো। কাল সকালে রওনা দিলে ভাগ্য ভালো থাকলে আমরা দুপুরের একটু পরেই মেনভিল-এ পৌঁছে যাবো। ওখানে রাতটুকু কাটিয়ে পরদিন ভোরে আমি আর মিঃ ফেনেল বেরিয়ে পড়বো। আপনারা দুজন তার পরদিন বেলা দশটার পর হেলিকপ্টার ছাড়বেন। কালেনবার্গের জমিদারীর সীমানায়। পৌঁছতে আপনাদের সময় লাগবে বড়জোর ঘণ্টাখানেক।

গেই জানতে চাইলে মেনভিল জায়গাটা কিরকম?

ঘোড়ার গাড়ি আর টাঙ্গার রাজ্য বলতে পারেন। জোন্স থামলো, শহরে আমরা থাকবো না। শহর থেকে পাঁচ মাইল দূরের এক বনে তাবু খাঁটিয়ে আমাদের ক্যাম্প হবে।

ফেনেল মিস ডেসমন্ড-এর দিকে চোখ তুলে তাকিয়ে বলেই ফেললো আপনি এখন আর কি করবেন, চলুন না একটু বেড়িয়ে আসি আশেপাশে।

গ্যারী চমকে তাকালে ফেনেলের দিকে। গেঈ উঠে দাঁড়ালো, রেস্তোরাঁ ছেড়ে যাবার আগে বলে গেল, তার পক্ষে এখন যাওয়া সম্ভব নয়।

ফেনেলের চোখে আগুন ঠিকরে পড়লো। দাঁতে দাঁত ঘষে বললো, আচ্ছা দেখে নেবো একদিন তোমাকে।

হঠাৎ তার মনে পড়লো স্যালিকের সাবধান বাণী। গেঈয়ের দিকে নজর দেবার কোনো চেষ্টা করবেন না। যদি শুনি কোনো রকম নষ্টামির চেষ্টা আপনি করেছেন–আপনার সব গোপন ব্যাপার ফাঁস করে দেবো আন্তর্জাতিক গোয়েন্দা দপ্তরে।

অস্বস্তিবোধ করলো ফেনেল। হাত বাড়িয়ে সিগারেট নিলো, তারপর সেটা ধরিয়ে জানালার দিকে তাকিয়ে রইলো। সে ভাবতে লাগলো স্যালিক কি করে জানলো তার গোপন ব্যাপার। সে আর ভাবতে পারছে না। ওপাশের বাড়িটার মাথায় নিয়ন সাইনে বিজ্ঞাপন জ্বলছে নিভছে–জ্বলছে নিভছে–একে একে স্বাভাবিক হয়ে এলো তার মন।

.

০৫.

 ভোর পাঁচটায় ঘুম থেকে ওঠা ম্যাক্স কালেনবার্গের বরাবরকার অভ্যাস। প্রতিদিন তিনি সাতঘণ্টা ঘুমোন।

ঘুম ভাঙতেই জানলা দিয়ে চোখে পড়ে দূরে ছবির মতো পাহাড়ের সারির আড়ালে সূর্য উঁকি মারছে রক্তাক্ত চোখে।

বিরাট বিলাসবহুল তার বিছানাটি কমলা রঙের দামী সিল্কে মোড়া ডিম্বাকার এক কাঠের। পাটাতনের ওপর বসান। হাতের নাগালের মধ্যে ধোঁয়াটে এক কাঠের একটি বোর্ডে রঙবেরঙের একসারি বৈদ্যুতিক বোতাম। ঘুম ভাঙার পর একটি বোতাম টিপে তিনি নিয়মিত কয়েকটি কাজ করেন।

শায়িত অবস্থায় ম্যাক্স কালেনবার্গকে দেখায় রূপালী পর্দার নায়কের মতো। মাথা আগাগোড়া কামানো, নীল আয়ত দুটি চোখ, সুন্দর দীর্ঘ নাক, ভরাট মসৃণ মুখ, পাতলা ঠোঁট, গায়ের রঙ তামাটে।

শেষ চুমুক দিয়ে কাপ সরিয়ে রাখলেন তিনি। একটা সিগারেট ধরালেন তিনি। সবুজ বোতাম টিপে তাকালেন টেলিভিশনের দিকে। পর্দায় ভেসে উঠলো মায়ার মুখ। লাবণ্যে ঢলটল মুখখানি তাঁর ছবির মতো সুন্দর। ম্যাক্স সুন্দরের পূজারী। তিনি তার অফিসে সুন্দরী মেয়েদের বেছে বেছে চাকরি দেন।

খাতা পেন্সিল হাতে মায়া হাসলো তার দিকে চেয়ে সুপ্রভাত।

–তুমি ব্রেকফাস্ট সেরে নাও। এক ঘণ্টা পর ডিক্টেশন দিতে ডাকবো আমি।

টেলিভিশন বন্ধ করে দিয়ে কালো বোতামটি টিপে মানের ব্যবস্থা করলেন তিনি।

শোবার ঘরে তিনি কারোর সঙ্গে দেখা করেন না কখনও। পোশাক পরা অবস্থায় হুইল চেয়ারে। বিশেষভাবে নির্মিত ঢাকনায় পা দুটি ঢেকে তবেতিনি নিশ্চিন্ত হন,কারণ পাদুটি নিয়ে তার মানসিক। দুশ্চিন্তার শেষ নেই।

এই ঘরটি তার অফিসঘর। বিশাল স্বাচ্ছন্দ্যময়। দেওয়াল জোড়া জানালা, ডেস্কে বসে জানলা দিয়ে লনের সবটুকু ছাড়াও ফুলের কেয়ারী,দুরের জঙ্গল এবং জঙ্গলে ঢাকা পাহাড়ের সারি চোখে পড়ে।

ডেস্কে চিঠিপত্র সাজানো, গুরুত্ব অনুসারে এক-একটাতে এক-এক রঙের ফ্ল্যাগ লাগানো।কাল ঘুমোতে যাবার আগে জরুরীকয়েকটি চিঠি তিনি আলাদা করে রেখেছিলেন। সেগুলো হাতে তুলে । তিনি সবুজ বোতাম টিপলেন। টেলিভিশনের পর্দায় ভেসে উঠলো মায়ার মুখ। তিনি ডিক্টেশন দিতে শুরু করলেন।

দ্রুত সেদিন ডাকে আসা চিঠিগুলোতে চোখ বোলাতে লাগলেন তিনি। প্রায় পঞ্চাশ খানার মতো চিঠি।

একটু পর দরজা খুলে কালেনবার্গের একান্ত সচিব গাইলো টক মার ঢুকলো। কালেনবার্গ আবিষ্কার করছিলেন, পরিদর্শিতা ছাড়াও অন্য কয়েকটি বিরল গুণের অধিকারী টক। সে নির্মম, দয়ামায়াহীন এবং প্রভুর প্রতি একান্ত অনুগত। বেশ কিছুদিন ধরেই কালেনবার্গ তাঁর মিউজিয়াম সাজাবার জন্য কয়েকজন অভিজ্ঞ শিল্পচোরের সাহায্য নিচ্ছিলেন। এদের ঠিকমতো পরিচালনা করা, এদের দিয়ে কাজ করিয়ে নেওয়া এ এক মহা ঝাটের বিষয়। অনেক বিচার-বিবেচনা করে তিনি ঠিক করলেন–একমাত্র টকের ওপরই নির্ভর করা যায় এসব ব্যাপারে। তাঁর হাতেই সব ভার দিলেন। এখন সে যে শুধু মিউজিয়ামের তত্ত্বাবধায়ক, তাইনয় কালেনবার্গের তাবৎকাজের পরামর্শদাতাও সে।

-বর্জিয়া আংটির ব্যাপারে কিছু খবর আছে?

আছে। তিনটে চোর কয়েক মিনিট আগে এসে পৌঁছেছে র‍্যান্ড ইন্টারন্যাশনালে। ফেনেল : প্যারিস থেকে গতকালই সোজা হোটেলে পৌঁছে ওদের জন্য অপেক্ষা করছিলো। এক গ্যারেজের মালিক স্যাম জেফারসন ওদের দরকারী জিনিসপত্র জোগাড় করে রেখেছে। জিনিসপত্রগুলোর একটা তালিকা তৈরী করে রেখেছি আপনার জন্য। ওরা বিমানবন্দরে পৌঁছানো মাত্র ওদের ছবি তুলিয়ে নিয়েছি। ডেস্কের ওপর একখানা বড় খাম রাখলো সে,দলের মেয়েটা দেখতে খুবই সুন্দরী।

সকলের সম্পর্কেই প্রয়োজনীয় তথ্য খামের মধ্যে রাখা আছে।

–ঠিক আছে ধন্যবাদ। পরে আবার ডাকবো আপনাকে। টক চলে যাবার পর কালেনবার্গ একবার গেঈর ছবিটি তুলে নিলেন। কয়েক মিনিট পর্যবেক্ষণ করে রেখে দিলেন।

প্রয়োজনীয় কাগজপত্রগুলি পড়ে ড্রয়ারের মধ্যে রেখে দিলেন। তারপর লাঞ্চ সারতে গেলেন। লাঞ্চ সেরে আবার টককে অফিস ঘরে ডেকে পাঠালেন, টক ঘরে ঢুকতেই প্রশ্ন করলেন বার্জিয়া আংটি কিনতে আমার কত খরচ হয়েছিলো মিঃ টক?

টক বললো, ষাট হাজার ডলার। মর্সিয়েল আংটি কিনেছিলো আড়াই লক্ষ ডলারে। আমরা সস্তায় পেয়েছি বলতে হবে। মর্সিয়েল এখন স্যালিককে আবার পাঁচ লক্ষ ডলার দিচ্ছে আংটিটা উদ্ধারের জন্য। আংটিটা না পেলে তার বার্জিয়ার যাবতীয় সংগ্রহ একেবারে কানা হয়ে যাবে।

কালেনবার্গ চোখ তুলে তাকালেন টকের দিকে, নিক সে, দিয়ে দিলেই হয় তাকে আংটিটা। চারটে চোর আংটির মালিক হওয়ার চেয়ে তার হওয়া অনেক ভালো। আসুক না ওরা এখানে, দেখাই যাক। আমরা বরং ওদের উৎসাহিত করি দেখি জল কোথায় গড়ায়। কিভাবে কি করতে হবে, সব আপনাকে পরে জানাবো। ওদের ঢোকাটাই সহজ হবে-বেরোনোটা নয়। তবে মনে রাখতে হবে, আংটি নিয়ে আমার জমিদারীর সীমানা ছেড়ে ওদের চলে যেতে হবে–তবেই আংটি ওদের। মিউজিয়ামে কাউকে ঢুকতে দিতে আমার কোন আপত্তি নেই কিন্তু বেরোতে দিতে আমার মন চায় না। ভেবে দেখুন ভ্যাটিকান থেকে জুপিটারের মূর্তি হারিয়ে রোমের কোন লোকই সুখী নয়।

টক বিমূঢ়ের মত মাথা নাড়লো। কালেমবার্গ আরও বললেন যে, গোয়েন্দাবাহিনীকে আমার মাটির নীচের মিউজিয়ামের খবর জানানো কোনরকমেই ঠিক নয়।

কিন্তু তাই বলে স্যার, আপনি মর্সিয়েলকে আংটিটা ফেরৎ দেবেন।

-হ্যাঁ, আংটিটাই ফেরৎ যাবে তার কাছে উদ্ধারকারীরা নয়। অনেক দিন পর জুলুরা মানুষ শিকার করতে পেরে খুশী হবে। টক চমকে তাকালো তার দিকে।

টক বললো, জুলুদের আভাস দিয়ে রাখা ভালো।

আপনি বরং একটা পুরস্কারের ব্যবস্থা করুন। ভালো শিকার যে করবে সে-ই পুরস্কারটা পাবে।

 টক উঠে দাঁড়ালো, আর কিছু বলবেন স্যার?

না, আর কিছু বলার নেই। হ্যাঁ ভালো কথা, আংটিটা আমাকে একবার পাঠিয়ে দিন তো।

টক চলে গেলে কালেনবার্গ স্বয়ংক্রিয় টেলিফোনের বোতাম টিপলেন, কিমোসা কোথায়? আসতে বলল ওকে।

কয়েক মিনিট পর সাদা পোশাক পরা একনজদেহবৃদ্ধবানটু এসে ঘরে ঢুকলো। কালেনবার্গের বাবার আমলের লোক। এখন জমিদারীর জুলু এবং অন্যান্য নেটিভ কর্মীদের সর্দার। শক্ত হাতে তাদের শাসন করে। কালেনবার্গের সামনে দাঁড়িয়ে সে আদেশের অপেক্ষা করতে লাগলো।

সেই বুড়ো ওটা কি এখনও আমাদের জমিদারীতেই বাস করে? কালেনবার্গ জানতে চাইলেন।

-হ্যাঁ মালিক

অনেকদিন দেখিনি ওকে। ভেবেছিলাম, এতদিনে ও বোধহয় আর বেঁচে নেই। কিমোসা চুপ করে রইলো।

বাবা বলতেন, লোকটা নাকি হাজার রকমের বিষটিষ জানে।

কালেনবার্গ বললেন, ওর কাছে গিয়ে বলল, আমার একটা বিষের ভীষণ দরকার। খুব ধীরে ধীরে সেই বিষে কাজ হবে। যার রক্তে একবার মিশবে সে বিষ, বারো ঘণ্টার মধ্যেই সে মারা যাবে।

কাল সকালের মধ্যেই আমার বিষ চাই, কিমোসা মাথা নীচু করে অভিবাদন জানিয়ে চলে গেলো।

কালেনবার্গ একটা দলিল বের করে পড়তে লাগলেন। কিছুক্ষণ পর টক একটি ছোট কাঁচের বাক্স নিয়ে ঘরে ঢুকলো। বাক্সের নীল ভেলভেটের ওপর সিজার বার্জিয়ার আংটিটি বসানো। টক বাক্সটি ডেস্কের ওপর রেখে চলে গেলো।

দলিল পড়া শেষ করে কালেনবার্গ বাক্সটি তুলে নিলেন। দুআঙুলের চাপে ডালা খুলে আংটিটি বের করে হাতের তালুতে রাখলেন। তারপর আংটিটি পরীক্ষা করে দেখতে লাগলেন। অবশেষে একখণ্ড হীরার আড়ালে ঢাকা সেই স্থানটি চোখে পড়লো তার–এখানেই রাখা হয় সেই মারাত্মক তরল-বিষ।

.

সকাল আটটায় র‍্যান্ড ইন্টারন্যাশানাল হোটেল ছেড়ে তারা রওনা দিলো ১৬ নং হাইওয়ে ধরে হ্যারি স্মিথের দিকে।

অভিযাত্রীর পোশাক সকলের পরনেবুশশার্ট, হাফ প্যান্ট, হাঁটু অবধি মোজা, মজবুত রবার শোলের জুতো এবং বাঘের চামড়া জড়ানো টুপি। গেঈকে খুব সুন্দর মানিয়েছে।

সামনের আসনে বসেছে গেঈ আর জোন্স। গাড়ির চালক জোন্স। গ্যারী আর ফেনেল পেছনের আসনে। জিনিসপত্র আর চারজন আরোহী মিলিয়ে গাড়িতে প্রায় ঠাসাঠাসি অবস্থা।

রওনা দেবার সময় আকাশে অল্প মেঘ ছিল। আবহাওয়া ছিল আর্দ্র। গাড়ি চওড়া রাস্তা ধরে ছুটতে লাগলো হু হু করে।

প্রথম কথা বললো জোন্স। হ্যারিস্মিথ এখান থেকে দুশো কিলোমিটার। হ্যারিস্মিথে পৌঁছে বড় রাস্তা ছেড়ে আমরা ধরবো বার্জভিলের পথ। তারপর মেনভিলে পৌঁছে লাঞ্চ সেরে গাইডকে নিয়ে এগোবো আরও তিরিশ কিলোমিটার জঙ্গলের পথ ধরে। তবেই ক্যাম্পে পৌঁছবো। জঙ্গলের পথটাই হলো সবথেকে রোমাঞ্চকর।

জোহান্সবার্গ ছেড়ে এসে গেঈর ভালোই লাগছিলো।

গাড়ি এগিয়ে চললো। তিন জনে নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে লাগলো। ফেনেল চুপচাপ দুপায়ের ফাঁকে তাঁর যন্ত্রপাতির ভারী ব্যাগটা চেপে ধরে একদৃষ্টে চেয়ে আছে গেঈর নিটোল কাঁধের দিকে। মাঝে মাঝে পথের পাশে মৌমাছির চাকের মতো কয়েকটা কুটীর।

বেলা দুটোর সময় গাড়ি এসে পৌঁছালো মেনভিলে। শহরটা পরিষ্কার নয়। মাঝখানে একটা ছোট পার্ক। অশোক ফুলের গাছএখানে ওখানেকয়েকটা ছড়িয়ে আছে। পার্কের পাশ দিয়ে এগিয়ে জোন্স ভাঙাচোরা গ্যারেজে গাড়ি এনে তুললো। গাড়ি থেকে নামতেইদুজন বানটু এগিয়ে এলো তার দিকে। করমর্দন করলো, দেশী ভাষায় পরস্পর কুশল বিনিময় হলো।

সঙ্গীদের দিকে ফিরে জোন্স বললো, গাড়িটা বরং এখানেই থাক, হোটেল থেকে কিছু খেয়ে আসা যাক।

রোদের তাপ বেড়েছে। জোহান্সবার্গ ছাড়ার কিছু পরেই সূর্য উঠেছে–এখন প্রচণ্ড তেজ। সবাই মিলে রোদের মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে গেলো।

হোটেলটি সাধারণ হলেও বেশ পরিষ্কার। জোন্স এক ঘর্মাক্ত কলেবর রেডইন্ডিয়ান ওয়েটারকে ইশারায় ডাকলো, থেম্বার সঙ্গে দেখা হয়েছে নাকি?

হয়েছে, গেছেহয়তো আশেপাশে কোথাও,এখুনি আসবে। জোন্স উঠে দাঁড়ালো থেম্বার খোঁজ করার জন্য। গেঈ জানতে পারলো যে থেম্বাই হলো আমাদের গাইড।

দূরে এক শক্তসমর্থ চেহারার বানটুকে দেখা গেলো। বুকের ওপর কাপড় গিট দিয়ে বাঁধা, ছড়ানো পালকের টুপি আলগোছে মাথায় কাত করে বসানো।

জোন্স পরিচয় করিয়ে দিল। গ্যারী এবং গেঈকরমর্দনকরলো তাঁর সঙ্গে।সকলে মিলে গাড়িতে গিয়ে উঠলো, থেম্বা গিয়ে বসলো পেছনের সীটে মালপত্রের ওপর।

মিনিট দশেক পর গাড়ি বড় রাস্তা ছেড়ে জঙ্গলের এক মেঠো পথ ধরলো। রাস্তা উঁচু নীচু, এবড়ো-খেবড়ো–প্রচণ্ড ঝাঁকুনি খেতে খেতে এগিয়ে চললল ল্যান্ডরোভার। রাস্তা এতই খারাপ যে গাড়ির গতিবেগ কমাতে হলো। এখানে-সেখানে বড় বড় গর্ত গাড়ি লাফাতে লাগলো খুব। আরো মাইল খানেক এগিয়ে থেম্বার নির্দেশে জোন্স গাড়ি বাঁ দিকে ঘোরালো। জঙ্গল এবারে একটু ঘন। এখানে সেখানে কাটার-ঝোঁপ, ডালপালা নীচু করে পথ ঢেকে রেখেছে।

এখানে-সেখানে কয়েকটা গাছ ভেঙে পড়েছে। মরে গেছে কয়েকটা। গেঈ সেদিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করলো জোন্স-এর। –এগুলো এই রকমের কেন? বাজ পড়েছে নাকি?

না না, জোন্স গিয়ার বদলালো, এসব হলো হাতির একপাল এদিকে এসেছিলো, ভেঙেচুরে দিয়ে গেছে সব। জিনিসপত্র ক্ষতি করতে হাতির মতো ওস্তাদ আর কেউ নয়। আর একটু এগিয়ে দেখা গেলো পাঁচটা জিরাফ। শূন্যে মাথা তুলে চিত্রাপিতের মতো দাঁড়িয়ে।

থেম্বা ওপরে বসে জোন্সকে নির্দেশ দিচ্ছিলো। জোন্স গেঈ-এর দিকে তাকিয়ে বললো, থেম্বা ছাড়া এই জঙ্গলে আমি অসহায়, একেবারেই অসহায়। এদিকের পথঘাট সব ওর নখদর্পণে।

আরো আধঘণ্টা কাটলো। একপাল জেব্রা একবার হুড়মুড় করে বেরিয়ে এলো ওপাশের জঙ্গল থেকে, রাস্তা পার হয়ে ঢুকলো, এপাশের জঙ্গলে। গাড়ি এসে এক ভোলা জায়গায় থামলো। হেলিকপ্টার দাঁড়িয়ে আছে একটা। চারজন বানটু আছে হেলিকপ্টার ঘিরে। গাড়ি থামাতে তারা উঠে দাঁড়িয়ে জোন্স-এর দিকে তাকিয়ে হাসলো।

গাড়ি থেকে নেমে জোন্স তার সঙ্গীদের দিকে তাকালো।

গ্যারী গেলো হেলিকপ্টার দেখতে। বানটুদের বিদায় করে জোন্স ফিরে এলো। গেঈকে বললো ওই দিকে গাছের আড়ালে একটা ঝর্না আছে, পুকুরও আছে একটা ছোট খাটো। গিয়ে স্নান করে আসতে পারেন।

ফেনেল গুটি গুটি গেঈ-এর দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো।

 গেঈ লম্বা ঘাসে ছাওয়া জঙ্গলের দিকে পা বাড়ালো।

ফেনেলের হৃৎপিন্ডের স্পন্দন বাড়লো। রক্তে শিহরণ খেলে গেলো। গ্যারী হেলিকপ্টারের ইঞ্জিনের ঢাকনা খোলায় ব্যস্ত। জোন্স,আর থেম্বা এদিকে তাবু খাটাচ্ছে। সে আর দাঁড়ালো না। বড় বড় পা ফেলে এগোলো জঙ্গলের দিকে।

গেঈ একটু আগে আগে হেঁটে চলেছে। তার মাংসল নিতম্ব ঢেউয়ের মতো দুলছে হাঁটার ছন্দে। ফেনেল আরো জোরে পা চালালো।

আরো একটু এগিয়ে ঝর্না। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে জল নেমে নদীর আকারে ঢুকে পড়েছে বনের মধ্যে।

গেঈ ফেনেলের পায়ের শব্দে ফিরে তাকালো। রোদ এসে পড়েছে গেঈর চোখেমুখে। চারপাশে গাছপালা, ঘন-জঙ্গল। জনপ্রাণীর চিহ্নমাত্র নেই।

ফেনেল গেইকে বললো, চলো সাঁতার কাটি দুজনে। জামা খোলো,ন্যাংটা মেয়েমানুষ দেখা আমার অভ্যাস আছে।

গেঈ ঠাণ্ডা ভাবলেশহীন চোখে তাকালে ফেনেলের দিকে, আপনি স্নান করুন–আমি যাই।

সে পেছন ফিরে এগোবার উপক্রম করতেই ফেনেল এক পা এগিয়ে তার হাত চেপে ধরলো।

 যাওয়া চলবে না তোমার, এখানে থাকতে হবে, জামা-প্যান্ট খুলে আমার সঙ্গে স্নান করতে হবে।

গেই শান্ত স্বরে বললো, হাত ছেড়ে দিন আমার।

গেই ফেনেলের কব্জি চেপে ধরলো। ফেনেল গেঈ-এর কোমর জড়িয়ে ধরবার জন্য হাত বাড়াতে গিয়ে হঠাৎ যন্ত্রণায় আর্তনাদ করে উঠলো। আচমকা এক লাথি এসে পড়লো তার বুকে।— ফেনেল শুন্যে উড়তে উড়তে এসে পড়লো পুকুরে। গেঈর হাতে একটা বড় পাথরের টুকরো চোখে ঘৃণার দৃষ্টি। গেঈ পাথরসমেত হাত তুলেশাসালো, খবরদার, উঠলেই মাথা ফাটিয়ে দেবো। আমার কাছে আর কোনদিন ঘেঁষতে আসিস না। জলের ওপর সে পাথরটা ছুঁড়ে দিলো, জল ছিটকে উঠলো ফেনেলের চোখে মুখে।

.

কালেনবার্গ একগাদা চিঠি সই করছিলেন তার কামরায়, এমন সময় কিমোসা ঘরে ঢুকে দাঁড়িয়ে রইলো দরজার কাছে।

কালেনবার্গ তার দিকে তাকাতেই সে এগিয়ে এসে টেবিলের ওপর ছোট একটি শিশি রাখলো। শিশিটি হলো বিষের শিশি। বারো ঘণ্টার মধ্যে কাজ হবে এমন বিষ। কালেনবার্গ খুশী হলেন। উজ্জ্বল হাসিতে উদ্ভাসিত হলো তার মুখ। বললেন, বাঃ বেশ বেশ। এখন যাও, ওষুধের আলমারী থেকে আমাকে একটা সিরিঞ্জ আর একজোড়া দস্তানা এনে দাও।

কিমোসা একটু পরে দস্তানা আর সিরিঞ্জ নিয়ে ফিরে এলো। সে চলে যেতে তিনি ড্রয়ার খুলে কাঁচের বাটি বের করলেন।

বাক্স থেকে আংটিটি তুলে ডান হাতের অনামিকায় পড়লেন। ছোট ছোট অসংখ্য হীরের টুকরো থেকে ঠিকরে পড়লো দ্যুতি চারিদিকে। দুআঙুলে চেপে খুলে ফেললেন আংটির গোপন দরজা। আংটি রেখে শিশি খুলে সিরিঞ্জে টেনে তুললেন খানিকটা বিষ। তারপর সযত্নে আংটির ফাঁকা জায়গাটিতে ঢেলে দিলেন সবটুকু। জায়গাটি পূর্ণ হতে সিরিঞ্জ রেখে গোপন দরজাটি বন্ধ করে দিলেন। ড্রয়ারে আংটি রেখে একটি বড় খামে তিনি রুমাল, সিরিঞ্জ, শিশি এবং দস্তানা জোড়া ঢোকালেন। কিমোসাকে আবার ডেকে বললেন, এই খামটা পুড়িয়ে ফেলো, সাবধান শিরিঞ্জের ছুঁচে যেন হাত না লাগে।

কিমোসা চলে গেলে কালেনবার্গ চঞ্চল হলেন। কল্পনার ওপর সব কিছু ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হওয়া তার অভ্যাসের বাইরে, সঠিক প্রমাণ চাই সবকিছুর তবেই শান্তি। ছুঁচের দিকটা ওপরে এনে ডান হাতের অনামিকায় পরলেন আংটিটা। হাতের তালুর দিকে ঘুরিয়ে দিলেন হীরেগুলো। তারপর চেয়ার চালিয়ে কামরা ছেড়ে এলেন বাগানে। পেছনে এলো হিন্ডেনবার্গ।

 জোয়াইদকে সহজেই খুঁজে পাওয়া গেলো। জোয়াইদ তার বানটু কর্মচারীদের একজন। বাগানে মালীর কাজ করে। গাছের ছায়ায় বসে জোয়াইদ ঝিমোচ্ছিলো। কালেনবার্গকে দেখে চকিতে উঠে বসে। কালেনবার্গ তার কাছে এসে চেয়ার থামালেন। হিন্ডেনবার্গ মাটিতে বসে পড়লো। শান্তস্বরে তিনি বললেন, শুনলাম তুমি নাকি এ মাসের শেষেই চলে যাচ্ছো?

জোয়াইদ ভয়ে মাথা নাড়লো। কালেনবার্গ ডান হাতখানি বাড়িয়ে দিলেন তার দিকে। হ্যান্ডশেক করবে না? ভগবান তোমার মঙ্গল করুন।

জোয়াইদ ইতস্ততঃ করলো। অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাড়িয়ে দিল হাত। কালেনবার্গ তার ময়লা হাতখানি নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে করমর্দন করতে করতে তার চোখের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

জোয়াইদ একটু চমকে উঠলো তারপর তার হাতের একটা আঙুল নিয়ে চুষতে শুরু করলো।

পরীক্ষার প্রথম পর্যায় সার্থক–ছুঁচের মুখটা সত্যিসত্যিই এতদিনে তাহলে বন্ধ হয়ে যায় নি। আর বারো ঘণ্টা পরে বোঝা যাবে বিষটা সত্যিই মারাত্মক কি না।

.

খোলা জায়গায় ফিরে আসতেই গেঈ শুনলো হেলিকপ্টারের ইঞ্জিনের গর্জন। সে একটু থমকে দাঁড়ালো। ইঞ্জিনের পাখা ঘুরছে বন্ বন্ করে। চালকের আসনে গ্যারী।

চিৎকার করে গেঈ বললো, দাঁড়ান, একটু দাঁড়ান আমি যাচ্ছি।

ইঞ্জিনের গর্জনে চাপা পড়ে গেলো তার স্বর। হেলিকপ্টার শূন্যে উঠে অদৃশ্য হয়ে গেলো। জোন্স ও থেম্বাও দাঁড়িয়ে দেখছিলো হেলিকপ্টারের উড়ে যাওয়া। চোখের আড়ালে অদৃশ্য হতেই তারা শুরু করলো গাড়ি থেকে মালপত্র নামাতে। গেঈ এগিয়ে এলে তাদের দিকে।

জোন্স আকাশের দিকে তাকালো। বললো, যত তাড়াতাড়ি রওনা হওয়া যায় ততোই ভালো। বৃষ্টি হলে রাস্তাঘাটের যা অবস্থা হবে। জোন্স গেঈ-এর দিকে তাকিয়ে বললো বন্ধুকে কোথায় রেখে এলেন?

সাঁতার কাটছে।

তাঁর বলার ভঙ্গীতে এমন একটা কিছু ছিল, যার জন্য চকিতে ঘুরে দাঁড়ালো জোন্স, তার দিকে, গণ্ডগোল কিছু করেছে নাকি?

–সে তো জানা কথা। তাচ্ছিল্যের সুরে বললো গেঈ, ঠাণ্ডা করে দিয়েছি একেবারে।

জোন্স সপ্রশংস দৃষ্টিতে তাকালো তার দিকে। তারপর থেম্বার হাত থেকে স্লিপিং ব্যাগ চারটে নিলো। তারপর গেঈকে বললো, আমার আর গ্যারীর মাঝখানে আপনি শোবেন। আমার পাশে শোবে থেম্বা তার পাশে ফেনেল।

এক রাতের তো ব্যাপার।

 স্লিপিং ব্যাগগুলো তাবুতে রেখে জোন্স বেরিয়ে এলো। হাতে তাঁর ২২ বোরের রাইফেল আর একটা কার্তুজ। থেম্বা আগুন জ্বালাবার ব্যবস্থা করছে তাবুর একটু দূরে।

জোন্স বললো, দেখি কটা বনমোরগ পাই কিনা। যাবেন আমার সঙ্গে?

নিশ্চয়ই চলুন।

দুজনে গিয়ে ঢুকলো জঙ্গলে।

ফেনেল গুটি গুটি বেরিয়ে এলো গাছের আড়াল থেকে। গাড়ির থেকে রুকস্যাক নামিয়ে সে গিয়ে ঢুকলো তাবুতে। হেলিকপ্টারের শব্দ আবার শোনা গেল। ধীরে ধীরে মাটিতে নেমে এলো উড়ো জাহাজটা। গ্যারী চালকের আসন থেকে নামলো। জোন্স এবং গেঈ বন থেকে ফিরে এলো। জোন্স-এর কোমরের বেল্টে দড়ি দিয়ে বাঁধা চারটে বনমোরগ ঝোলানো।

গ্যারীর চোখের দিকে তাকিয়ে গেঈ বললো, আমার জন্য দাঁড়ালেন না কেন?

 ট্রায়াল দিচ্ছিলাম–সঙ্গে কাউকে নিতে ভরসা পাইনি।

থেম্বা মুরগীকটা নিয়ে রান্নার ব্যবস্থা করতে গেলো। সবাই মিলে ঘাসের ওপর বসে পড়লো। এবারে কাজের কথায় আসা যাক্। জোন্স বললো, ফেনেল আমি আর থেম্বা ভোর চারটে নাগাদ বেরিয়ে পড়বে। সঙ্গে নেবো রাইফেল, বন্দুক আর স্লিপিং ব্যাগ, রুকস্যাক, খাবার। জোন্স গ্যারীর দিকে তাকালো তারপর গেঈ এর দিকে। আপনাদের দুজনকে এখানে একটা দিন বেশী কাটাতে হবে। পরশু সকালে কালেনবার্গের বাড়ির দিকে রওনা হবেন আপনারা।

তারপর সে কালেনবার্গের জমিদারী সম্বন্ধে ভালো করে বুঝিয়ে দিলো।

এই হলো কালেনবার্গের জমিদারী। পূর্ব, পশ্চিম এবং দক্ষিণ দিকে জমিদারী পাহারা দেয় একদল জুলু।উত্তর দিকে পাহারা নেই, যাবার তেমন রাস্তাও নেই।কিন্তু থেম্বার মতে একটু কৌশল খাঁটিয়ে যেতে পারলে ঐ পথটাই সবচেয়ে নিরাপদ। গাড়ি নিয়ে যতটা এগোনো সম্ভব এগোবো। বাকি পথটুকু হেঁটেই যাওয়া যাবে।

গ্যারী উঠে গেল থেম্বার রান্না দেখতে। গেঈ এসে দাঁড়ালো গ্যারীর পাশে। রান্নার গন্ধ শুঁকে গেই বললো, আমার তো ক্ষিদে পেয়ে যাচ্ছে।

গ্যারী বললো, আমাদের আর আধঘণ্টা অপেক্ষা করতে হবে। ততক্ষণ চলুন হেলিকপ্টারটা আপনাকে দেখিয়ে আনি। দুজনে মিলে হেলিকপ্টারের দিকে এগোলো।

ফেনেল সেদিকে তাকিয়ে একটা অশ্রাব্য ভাষায় গালাগালি দিলো। তাঁর সঙ্গে কথা বলার আর প্রবৃত্তি হলো না জোন্স-এর। সে উঠে থেম্বার কাছে গেলো।

বৃষ্টি আসতে আর দেরী নেই। সে থেম্বার পাশে এসে বসল। আধঘণ্টা পরে রান্না শেষ হয়ে এলো। ধীরে ধীরে অন্ধকার ঘনিয়ে এলো, বাতাস ভারী হয়ে এলো। সকলে মিলে তাবুর চারপাশে গোল হয়ে খেতে বসলো। জোন্স তার স্বভাবসিদ্ধ পরিহাসপ্রিয়তায় ফেনেল ছাড়া আর সবাইকে খোশ-গল্পে মাতিয়ে রাখলো। ফেনেল নিঃশব্দে মাথা নীচু করে খেলো।

খাওয়ার শেষে প্রত্যেকেরই চোখের পাতা ঘুমে ভারী হয়ে এলো। সবাই মিলে শোবার জন্য তাবুর মধ্যে ঢুকলো। ফেনেল শুধুমাত্র অনেকক্ষণ ধরে তাঁবুর বাইরে ছিল তারপর চারপাশের অন্ধকার জমাট নিস্তব্ধতায় হঠাৎ কেমন যেন ভয় ভয় করতে লাগলো। ধীরে ধীরে সে তাবুর মধ্যে ঢুকে গুটিশুটি মেরে শুয়ে পড়লো স্লিপিং ব্যাগের মধ্যে।

রাত দুটোর সময় তাবুর চালে টপটপ বৃষ্টির শব্দে ঘুম ভাঙলো সকলের। হঠাৎ বৃষ্টির শব্দ ছাপিয়ে কানে ভেসে এলো এক সিংহেরক্রুদ্ধ গর্জন।

.

০৬.

ফেনেলের ঘুম ভেঙে গেলো চোখে জোরালো একটা আলো এসে পড়ায়। চোখ মেলে দেখলো থেম্বা আলো হাতে বাইরে দাঁড়িয়ে আছে।

থেম্বা ব্রেকফাস্ট তৈরী করতে যাচ্ছে এই ফাঁকে জোন্স স্নানটা সেরে আসতে গেলো। ফেনেলও গেলো তার পিছু পিছু।

পুকুরের স্নিগ্ধ-শীতল জল স্নান করে শরীর জুড়োলো যেন।তাবুতে ফিরে এসে তারা দেখলো গেঈ আর গ্যারী ইতিমধ্যে ঘুম থেকে উঠে বাইরে বসে থেম্বার ডিমভাজা দেখছে।

ব্রেকফাস্ট শেষ হতে হতে অন্ধকার অনেকটা কাটলো। রাঙা আকাশের ফাঁকে সূর্য উঁকি মারলো- এবার রওনা দিতে হয়।

জোন্স বললো গ্যারীকে,তবুটা আপনারা দুজন ভাজ করে গুটিয়ে রাখতে পারবেন তো?

খুব পিরবো। গুটিয়ে হেলিকপ্টারে তুলে নেবো।

জোন্স বললো, ঠিক এগারোটায় ট্রান্সমিটারে খবর পাঠাবো। এগারোটার পর থেকে দুঘণ্টা অন্তর অন্তর খবর পাবেন নিয়মিত।

ফেনেল গাড়িতে তার যন্ত্রপাতির ব্যাগ সমেত উঠে পেছনের আসনে বসলো। জোন্স গেই এর সঙ্গে করমর্দন করে বসলো গিয়ে চালকের আসনে।

গাড়ি ছাড়লো জোন্স। থেম্বা তার পাশে বসে দুজনকে বিদায় জানালেন।

.

জঙ্গলে এখনো ভালো করে আলো ফোটেনি। হেডলাইট জ্বেলে ধীরে ধীরে এগোতে হলো। থেম্বার নির্দেশ অনুসারে গাড়ি চালাতে লাগলো জোন্স।

একটু পরে আকাশ পরিষ্কার হলো। আলো ছড়িয়ে পড়লো জঙ্গলে। থেম্বা হঠাৎইশারা করে জোন্সকে গাড়ি থামাতে বললো। গাড়ি থেকে মাত্র বিশ মিটার দূরে একটা গণ্ডার দাঁড়িয়ে। গাড়ির শব্দে ধীরে ধীরে মাথা তুলে তাকালো একবার। তার নাকের ওপর এক বিরাট খড়গ। ফেনেল বললো, এগুলো বড় ভয়ঙ্কর হয়।

একে একে জোন্স গাড়ির গতিবেগ বাড়ালো। একপাল ইম্পালা পথের মধ্যে দাঁড়িয়ে ছিল। গাড়ির শব্দে দিশেহারা হয়ে ছুটে পালালো।

হঠাৎ তারা দেখলে পথের পাশে নিশ্চিন্ত হয়ে দুটো সিংহ শুয়ে রয়েছে। ফেনেল রাইফেলের ট্রিগারে আঙুল রেখে প্রস্তুত হয়ে রইলো। গাড়ি তাদের পাশ দিয়ে যাবার সময় সিংহ দুটো মাথা তুললো একবার তারপর শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আবার মাথা নিচু করে চোখ বুজলো। ফেনেলের যেন ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়লো।

এবারে ওরা জঙ্গল পার হয়ে মাটির রাস্তায় পড়লো, থেম্বা ডানদিকে যেতে বললো, এই হলো কালেনবার্গ-এরজমিদারীতে পৌঁছবাররাস্তা,যাট কিলোমিটারলম্বা। ঘড়ির দিকে তাকালো সে।এখন বাজে আটটা, জমিদারীর সীমানায় পৌঁছতে এগারোটা। ওখান থেকেই গ্যারীকে খবর পাঠাবো।

রাস্তা খুবই খারাপ। চড়াইয়ের মতো পাহাড়ের গা বেয়ে উঠছে ওরা ধীরে ধীরে। রাত্রে বৃষ্টি হওয়ায় মাটি বেশ নরম, চাকা মাঝে মাঝে বসে যাচ্ছে মাটিতে।

জোন্স গিয়ার বদল করলো। পেছনের একটা চাকা হঠাৎ মাটিতে বসে গেলো। নিমেষে ব্রেক কষে গাড়ি থামালো জোন্স।

জোন্স গিয়ার পাল্টে ব্রেক আলগা করলো। গাড়ি ধীরে ধীরে গড়িয়ে নামতে লাগলো যে পথে এসেছিলো সে পথে। খানিকটা নেমে সেই চড়াই ছেড়ে আর একটা চড়াইয়ের সামনে থামালো সে গাড়ি। জল এড়াতে হলে এই চড়াই বরাবর উঠতে হবে–একটু ঘুর পথ। গাড়ি উঠতে লাগলো। পথে ঘোট ঘোট ঝোঁপঝাড়। দশ মিনিট এগিয়ে আবার থামতে হলো। পেছনের চাকা দুটো কাদায় বসে গেছে।

ফেনেল এবং থেম্বা গাড়ি থেকে নেমে দুজনে একসাথে গাড়ি ঠেলতে লাগলো। কাজ হলো, গাড়ি গর্ত ছেড়ে উঠলো।

সূর্য ততক্ষণে মাথার ওপর, নোদ বেশ চড়েছে। গাড়ি ধীরে ধীরে উঠতে লাগলো।

পথ সংকীর্ণ থেকে সংকীর্ণ হয়ে এলো। এখানে-সেখানে বড় বড় পাথর। দেখে মনে হয় না যে এ পথে কখনও গাড়ি এসেছে। গাছের ডাল বিপজ্জনক ভাবে ঝুলে আছে। থেম্বা বলেছে সামনের রাস্তা নাকি আরও খারাপ। এইভাবে গড়াতে গড়াতে এগোতে হবে আর কি। বলতে না বলতেই চাকা সরে গেলো। সজোরে ব্রেক কষলো জোন্স। কিন্তু ততক্ষণে যা হবার হয়ে গেছে, ডানদিকের চাকা গিয়ে পড়েছে একটা খানায়।

থেম্বা ছুটে এলো। টেনে তোলা ছাড়া উপায় নেই। তিনজনেই হাত লাগালো। শেষ পর্যন্ত। গাড়ি টেনে তোলা হলো। জোন্স চালকের আসনে ফিরে গিয়ে বসলো। গাড়ি ছাড়ার আগে তিনজন মিলে একটু ড্রিঙ্কস করলো। তারপর ধীরে ধীরে গাড়ি ছাড়লো। পথ ভীষণ খারাপ। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে ঘুরতে ঘুরতে গাড়ি উঠছে। জোন্স অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে গাড়ি চালাচ্ছে একটু অন্যমনস্কতার ফলে যে কোন মুহূর্তে কয়েক হাজার ফুট খাদে গড়িয়ে পড়া বিচিত্র নয়।

হঠাৎ করে রোদ নিভে এলো। ধোয়ার মতো পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘে ভরে গেলো আকাশ এক নিমেষে। মুহূর্তের মধ্যে বৃষ্টি নামলো।

নিরুপায় হয়ে তিনজনে বৃষ্টির মধ্যে ভিজতে লাগলো গাড়ি থামিয়ে। শেষে একসময় মেঘ সরে গিয়ে আবার সূর্য উঁকি মারলো। জামাকাপড় ধীরে ধীরে শুকিয়ে উঠতে লাগলো। সিগারেট ধরিয়ে জোন্স গাড়ি ছাড়লো। পাহাড়ের ওপরে পৌঁছে গাড়ি থামাতে হলো। পাহাড় ঢালু হয়ে দুভাগে নেমে গেছে নীচে। এক ভাগ সাধারণ উত্রাইয়ের মতো, আর এক ভাগ গভীর খাড়াই। দুটো অংশ মিশেছে গিয়ে অনেক নীচে উপত্যকায়। রাস্তা খুব খারাপ। কোনরকমে একটা গাড়ি চলতে পারে শুধু। দুপাশে গভীর অতলান্ত খাদ। একবার পড়লে আর রক্ষা নেই। ফেনেলের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে উঠলো।

গাড়ি থেকে ধরাধরি করে মালগুলোনামানো হলো। গাড়ি অনেকটা হাল্কা হলো, থেম্বা বললো এখনও আমাদের কুড়ি কিলোমিটার যেতে হবে। সামনের আর কিছুটা রাস্তা পার হতে পারলে তারপর রাস্তা ভালো। ঘড়িতে এখন ঠিক এগারোটা। জোন্স ট্রান্সমিটার তুলে নিলো হাতে। খবর আদানপ্রদান শুরু হলো।

জোন্স আগাগোড়া ঘটনাটা সংক্ষেপে গ্যারীকে জানালো।

শুনে গ্যারী বললো, মুশকিলে পড়েছে দেখছি। এক কাজ করো, কপিকলটা এবারে কাজে লাগাও। কোনো গাছে আটকে আস্তে আস্তে এগোবার চেষ্টা করে দেখো একবার।

–ঠিক বলেছো, ভালো মনে করিয়ে দিয়েছে। কপিকলের কথাটা ভুলেই গিয়েছিলাম। ট্রান্সমিটার বন্ধ করলো জোন্স। থেম্বা ত্রিপল সরিয়ে কপিকলের তারের এক প্রান্ত ধরে দৌড়ালো পাহাড়ের ঢাল বেয়ে। জোন্স তারের অপর প্রান্তের গোঁজটা দিলো ফেনেসের হাতে, ভালো করে বাঁধার জন্য। তারপর জোন্স গিয়ার পাল্টে গাড়িতে স্টার্ট দিলো। হাত ব্রেক তুলে কপিকলের লিভার চালু করলো। ড্রামটা বনবন করে ঘুরতে লাগলো। জোন্স ড্রামের গতিবেগ কমিয়ে স্থির হয়ে বসে রইলো স্টিয়ারিং ধরে–গাড়ি ধীরে ধীরে এগোতে লাগলো।

ফেনেল গাড়ির পেছনে পেছনে চলেছে থেম্বা সামনের চাকা দুটোয় নজর রেখে হাত নেড়ে এগোতে বলছে জোন্সকে। গাড়ি গড়াতে গড়াতে এগোচ্ছে।গাড়ি কিছুটা যাবার পর হঠাৎ মাটি ধসে পড়লো। ফেনেল চীৎকার করে জোন্সকে থামতে বললো।

সর্বশক্তি প্রয়োগ করে পেছনের চাকা তুলে রাখার চেষ্টা করলো, পারলো না। গাড়ি গড়িয়ে। পড়ছে খাদে। ফেনেল চীৎকার করে উঠলো। জোন্স ততক্ষণে সীটের ওপর উঠে দাঁড়িয়েছে, তারটা ভয়ানক ভাবে দুলছে। নীচে, অতলান্ত খাদ-অনন্ত মৃত্যু যেন অপেক্ষা করছে ওখানে।

তারের টানে ড্রামটা আস্তে আস্তে খুলে আসতে লাগলো। জোন্স লাফিয়ে উঠলো, বনেটের ওপর ড্রামের পাশের লোহার রডটা চেপে ধরলো এক হাতে, কুঁকে পড়ে আর এক হাতে ধরলো তারটা। গাড়ি গড়িয়ে পড়লো খাদে।

থেম্বা তারের এক প্রান্ত ধরে টেনে জোন্সকে তোলার চেষ্টা করছিলো। ফেনেল কাঁপতে কাঁপতে দৌড়ে গিয়ে যোগ দিলো তার সঙ্গে। দুজনের আকর্ষণে জোন্স প্রায় গড়াতে গড়াতে উঠে এলো। পা দুটো ছড়ে গেছে। রক্তে কাদায় শরীর একেবারে মাখামাখি।

একটু পরে সে মাটির ওপর উঠে বসলো। তার ক্লান্ত মুখে এক চিলতে হাসি খেলে গেলো। বলল, গাড়িটা গেলো। এখন আমাদের পায়ে হাঁটা ছাড়া আর উপায় নেই।

.

জঙ্গলের আড়ালে ল্যান্ডরোভার অদৃশ্য হতে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো গেঈ। পুরুষটা দারুণ। আগুনের কাছে গিয়ে উবু হয়ে বসলো সে।

গ্যারী তাকিয়ে রইলো একদৃষ্টে। মেয়েটা নিঃসন্দেহে সুন্দরী। আগুনের ছটা এসে পড়েছে ওর মুখে। মুখখানি হয়ে উঠেছে আরো মোহময়। রক্তে কাপন লাগলো গ্যারীর। চোখ নামিয়ে তাঁবুর দিকে এগোলোদাড়িটা কামাতে হবে।

তাঁবুর ম্লান বাতির আলোয় দাড়িটা কামাতে কামাতে মনে বারবার ঘুরে ফিরে আসছিলো গেঈর কথা। হেলিকপ্টারে ওঠার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত এই শান্ত জনমানবহীন কনভূমিতে তারাই কেবল দুজন। কি ভাবে যে সময় কাটবে গ্যারী বুঝতে পারলো না। গেঈ কি আত্মসমর্পণ করবে।

গ্যারী একটা ভোয়ালে নিয়ে বাইরে এলো, গেঈকে বললো সে স্নান করতে যাচ্ছে।

গেঈ কখানা কাঠ গুঁজে দিল অগ্নিকুণ্ডে। ধিকি ধিকি আগুনটা দপ করে জ্বলে উঠলো। হঠাৎ নিজেকে বড় একা মনে হলো তার।

গ্যারীকে তার খারাপ লাগে না। সে সত্যি কাজের পুরুষ। গেঈর বুকে সে জোয়ার এনেছে।

সূর্যের তাপ খুব বেড়েছে। গ্যারীর সঙ্গে তার চোখাচোখি হলো। হাফপ্যান্ট আর জুতো পরে খালি গায়ে বড় বড় পা ফেলে হেঁটে আসছে সে। ভোয়ালেটা আলগোছে কাঁধের ওপর ফেলা। কি দুরন্ত পৌরুষ। দেখে মুগ্ধ হলো সে। মৃদু হেসে বললো, কি, কেমন লাগলো?

দারুণ! বরফ-ঠাণ্ডা জল, শরীর যেন জুড়িয়ে গেলো।

আমি একবার ঘুরে আসি তাহলে। উত্তরের অপেক্ষা না করে গেঈ দৌড়লো পুকুরের দিকে। গ্যারী মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো তার দিকে।

পুকুরে গিয়ে গেঈ জামা প্যান্ট খুলে ফেললো। এই নিরালা পরিবেশে নিরাবরণহয়ে স্নান করার তার প্রবল ইচ্ছা হল। পোশাক পুকুরের পাড়ে রেখে সে জলে ঝাঁপ দিলো। কিছুক্ষণ সাঁতার কেটে ক্লান্ত হয়ে সে চিৎ হয়ে জলে ভেসে রইলো। আরামে শান্তিতে তার চোখ বুজে এলো।

হঠাৎ দুটো হনুমান পুকুর পাড় থেকে গেঈ-এর জামা প্যান্ট তুলে নিয়ে অদৃশ্য হলো।

গেঈ জল থেকে উঠে অবাক হলো। তার নজর গেলো পলায়মান হনুমান দুটির ওপর। এখন উপায়?

এদিকে গ্যারীতাবুর ছায়ায় বসে স্যালিকের দেওয়া ম্যাপটার ওপর চোখ বোলাচ্ছিলো।হঠাৎ সামনে তাকিয়ে তার হাত থেকে ম্যাপটা পড়ে গেলো। একি স্বপ্ন না সত্যি। গেঈ সম্পূর্ণ উলঙ্গ হয়ে তার সামনে দাঁড়িয়ে। গ্যারীর উষ্ণ নিঃশ্বাস পড়লো গেঈর নিরাবরণ দেহে। গেঈ অসহায়ের মতো বললো বাঁদরের কাণ্ডকারখানা দেখ, জামা প্যান্ট সব তুলে নিয়ে গাছের ডালে ঝুলিয়ে রেখেছে। তুমি এনে দাও না প্লিজ!

গ্যারী আর দেরী না করে ছুটলো পুকুর পাড়ে। গেঈ ধীরে ধীরে তাঁবুর ভেতর ঢুকলো। শ্বাস প্রশ্বাস দ্রুত হলো তার। বুকটা হাঁপরের মতো ওঠানামা করতে লাগলো।নীচু হয়ে রুকস্যাক থেকে মার এক প্রস্থ জামা প্যান্ট বের করলো সে। একমুহূর্ত কি ভাবলো তারপরে ছুঁড়ে ফেলে দিল সব মাটিতে।

চিৎ হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো। তারপর পা মুড়ে দুহাতের তালুতে স্তনদুটি ঢেকে অপেক্ষা করতে লাগলো গ্যারীর জন্যে।

প্রায় এগারোটা বাজলো। গ্যারী পাশ ফিরলো। ওদের খবর পাঠাবার সময় হয়ে এলো।

গ্যারীকে ছাড়ার ইচ্ছা ছিল না গেঈর, অনিচ্ছায় সে হাত সরিয়ে নিলো। গ্যারী উঠে জামা প্যান্ট পরলো। গেঈ আবার চোখ বন্ধ করলো।

গ্যারীর সম্বন্ধে গেঈর ধারণা এতটুকু অমিল হয়নি। গ্যারীর সঙ্গসুখ বেশ আরামের। গত এক বছর ধরে মনের ওপর বড় ধকল যাচ্ছিল তার। আজ সুখের প্রচণ্ডতায় সব ধুয়ে মুছে গেলো। কেমন একটা চরম পরিতৃপ্তি, কেমন একটা ঝিম ধরানো নেশা। এই নেশা ভাঙতে চায়নি গেঈ–জন্মজশ্মান্তর গ্যারীর পাশে এমনিভাবে শুয়ে থাকার ইচ্ছা তার মন ভরিয়ে রেখে দিলো।

কিছুক্ষণ পর গ্যারীর ডাকে তাঁর তন্দ্রার ঘোর কেটে গেলো। বিছানায় উঠে বসলো সে। গ্যারী চিন্তিত মুখে এসে তাঁবুতে ঢুকলো। গেঈকে বললো, ওরা তিনজন বড় বিপদে পড়েছে। রাস্তা ধসে গিয়ে গাড়ি খাদে পড়েছে। জোন্স প্রায় মরতে মরতে বেঁচেছে।

পৌঁছাতে পারবে তত শেষ পর্যন্ত?

বলছে তো পারবে। দুঘণ্টা পর আবার খবর পাঠাবে।

 গাছে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো গেঈ। গ্যারী বললো, ওদের কথা এখানে বসে বসে ভাবলে কোন সুরাহা হবেনা। তার চেয়ে চলো আমরা পুকুরে খানিকটা সাঁতার কেটে আসি তাতে মনটা খানিকটা ভালো হবে। দাঁড়াও ভোয়ালেটা নিয়ে আসি।

দুজনে হাত ধরাধরি করে এগোলো পুকুরের দিকে।

.

সূর্য মাথার ওপরে। দুর্গম পাহাড়ী পথ। কষ্ট একটু বেশী হচ্ছে, জোন্সও থেম্বার সঙ্গে ফেনেল আর পাল্লা দিয়ে পেরে উঠছে না। সারা শরীর বেয়ে ঘাম ঝরছে। জোন্স বলেছে, কালেনবার্গের বাড়ি এখনো চব্বিশ কিলোমিটার।ওদের পা যেন আর চলতে চায় না। জোন্স-এর হাতে স্প্রিঙফিল্ড, কাঁধে রুকস্যাক। থেম্বার রুকস্যাক ভর্তি খাবারের টিন। পাঁচ লিটারের একটা জলের পাত্রও কাঁধে। কোথাও একটু বিশ্রামের জন্য গাছের চিহ্ন মাত্রও নেই।

পরের এক ঘণ্টা খাড়া চড়াই। পথের সবচেয়ে ক্লান্তিকর অংশ। জোন্স ঘড়ির দিকে তাকালো, আর দশ মিনিট পরে গ্যারীকে খবর পাঠাতে হবে। উত্রাইটুকু সহজেই ওরা পার হয়ে গেলো। জঙ্গলে গাছের ছায়ায় বসলো সকলে। রাস্তা এখন মোটামুটি ভালো। মনে হয় ছটার মধ্যেই পৌঁছে যাওয়া যাবে।

আধঘণ্টা বিশ্রাম করে ওরা আবার হাঁটতে শুরু করলো। ঘন্টাখানেক হাঁটার পর ওরা একটা গাছের ছায়া দেখে একসঙ্গে খেতে বসলো।

ফেনেল জানতে চাইলো এখনও আর কতটা পথ বাকী?

এখনো প্রায় ঘণ্টাতিনেকের পথ। তবেই বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছনো যাবে।

ঠিক তিনটে বাজতে গ্যারীর সঙ্গে আবার যোগাযোগ করা হলো। তারপর আবার শুরু হলো যাত্রা। দুপাশে বিরাট বিরাট গাছ–ছায়ার মধ্য দিয়ে তারা এগিয়ে চললল। কিন্তু তারা জানতে পারলো না সেই গহন অরণ্যে ওরা তিনজন ছাড়াও আরো লোক আছে যারা ওদের গতিবিধির ওপর তীক্ষ্ণ নজর রাখছে।

কালেনবার্গ ব্যবস্থার কোনো ত্রুটি করেন নি। কুড়িজন দৈত্যাকৃতি জুলুকে তিনি আগেই পাঠিয়ে দিয়েছেন জঙ্গলে। গোপনে তারা সব লক্ষ্য করে খবর পাঠাচ্ছে কালেনবার্গের একান্ত সচিব মায়ার কাছে। মায়া দ্রুত শর্টহ্যাভে খবর লিখে পাঠিয়ে দিচ্ছে হো-লুর কাছে। হো-লু টাইপ করে সেগুলো দিয়ে আসছে কালেনবার্গের ডেস্কে।

গাড়ি খাদে পড়ে যাবার পর যে তারা হাঁটতে হাঁটতে তার জমিদারীর সীমানায় ঢুকে পড়েছে-কালেনবার্গ সে খবর পেয়েছেন।

ওরা তিনজনে পৌঁছে গেছে বিশ্রাম নিচ্ছে। আর বড়জোর ঘণ্টা দুয়েকের পথ।ওরা ঠিক করলো থেকে এখানে রেখে যাবে। ওদের কাজের সঙ্গে ওকে আর জড়াবেনা। কাজ হয়ে গেলে আবার ফেরার সময় সঙ্গে নেবে পথপ্রদর্শক হিসাবে।

ফেনেল অনিচ্ছায় উঠে দাঁড়ালো। জোন্স থেকে কি যেন বললো, থেম্বা হেসে ঘাড় নাড়লো।

জোন্স কাঁধে তুলে নিলো রুকস্যাকটা, রাইফেলটাও থাক। থেম্বার সঙ্গে করমর্দন করে বললো, পরশু রাত্রিতে আমরা ফিরবো। যদি একান্তই না ফিরি তবে পরের দিনটা দেখে তুমি চলে যেও।

ফেনেল এক পা এগিয়ে এসে কুণ্ঠিত চিত্তে হাত বাড়িয়ে দিলো। থেম্বা উষ্ণ করমর্দনে বিদায় জানালো তাকে। দুজনের চলা শুরু হলো। যতক্ষণ দেখা যায়, ওদের গমন পথের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলো থেম্বা।

সন্ধ্যে হয়ে আসছে, আগুন জ্বালাবার জন্য কিছু কাঠ সংগ্রহ করতে হবে। সে একটু এগিয়ে গিয়ে নিচু হয়ে ডালপালা কুড়োতে লাগলো।

হঠাৎ যেন কিসের শব্দে সে থমকে দাঁড়ালো। ঝোঁপের আড়াল থেকে উঠে এলো এক জুলু। হাতে তার তীক্ষ্ণবর্শা, পরনে চিতাবাঘের ছাল। শেষ রৌদ্রের আলোয় ঝলসে উঠলো ইস্পাতের সুতীক্ষ্ণ ফলা। অভ্যস্ত ভঙ্গীতে শরীরের সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে ছুঁড়ে মারলো তার অস্ত্র। থেম্বার অনাবৃত পিঠে গেঁথে বর্শাটা কাঁপতে লাগলো থরথর করে। ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটলো। কালো মাটির রঙ লাল হলো। মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়লো থেম্বা। মাটির বুকেই মিশে গেলে তার শেষ নিঃশ্বাস।