২. টিভির সামনে

০৬.

টিভির সামনে সিট নারীমূর্তির যেন বাহ্যবোধ লুপ্ত। হলঘরে আর কেউ ছিল না। নিঃশব্দে কলেভিন ওর দিকে এগিয়ে গেল। ফিসফিসিয়ে বললো, টি. ভি.-কে নিয়ে এভাবে সময় নষ্ট করে কি লাভ।

চমকে ওঠে এলিস ক্রেগ, স্যার।

কলেভিন যেন আরো অন্তরঙ্গতার সঙ্গে প্রগলভ, আপনার মতন নিষ্ঠাবান ব্যাঙ্ককর্মীর ভবিষ্যৎ নিয়ে আমাকে কিছু ভাবতেই হবে।

 স্যার।

 হ্যাঁ, বিশ্বাস করুন, আপনার মতন ব্যাঙ্কগতপ্রাণ কর্মীর আজ ভীষণ অভাব। কামচোরের দল দুনিয়া ছেয়ে ফেলেছে। উন্নতি করবার চেষ্টাও নেই, ইচ্ছেও নেই। আমার দৃঢ় বিশ্বাস মন দিয়ে পড়াশুনা করে পরীক্ষা দিয়ে দিয়ে আপনি ব্যাঙ্কে অনেক উন্নতি করতে পারবেন। ব্যাঙ্কের সদর দপ্তর সানফ্রান্সিসকোতে আপনি বদলিও হয়ে যাবেন।

এলিস ক্রেগের শরীর ঈষৎ উদ্বেলিত হয়। চোখে স্বপ্ন ঘনায়, আমি কি করতে পারি?কলেভিন বললো, সন্ধ্যার সময় টি. ভি.র সামনে বসে থাকাটা বন্ধ করতে হবে। এই দু-তিন ঘণ্টা আপনি আপনার ঘরে গিয়ে দরজায় খিল তুলে পড়াশুনা করতে পারেন। ব্যাঙ্কিং মেনুয়্যাল, গাইড বুকগুলি পড়ুন, মুখস্থ করুন। রাতে খাওয়াদাওয়া সেরে দূরদর্শন দেখুন। সন্ধ্যাটা নষ্ট করবেন না।

 মিস ক্রেগ কৃতজ্ঞতায় উঠে দাঁড়ায়, তাহলে আমি আজ থেকেই শুরু করে দিই।

নিশ্চয়।

অভ্যাসমত এলিস কোট ও টুপি হলঘরে রেখে নিজের ঘরে চলে গেল। এখন সে এক অদ্ভুত উচ্চাশা নিয়ে ব্যাঙ্কের আইনকানুন মুখস্থ করবে।

ক্ৰেগের টুপি ও কোটটা এনে কলেভিন রান্নাঘরের এক কোণে রেখে দেয়।

মিস পীয়ারসন ও মেজর হার্ডির হলঘরে পদার্পণ ঘটলো। কলেভিন এদের দিকে চেয়ে রহস্যময় গলায় বলে, টি. ভি. চলছে, কিন্তু টি. ভি.-র সামনে মিস ক্রেগ বসে নেই।

মিস পীয়ারসন বলে, ওমা তাই তোত। মেয়েটা গেল কোথায়?

কলেভিন–মিঃ এর্কে এসে ওকে নিয়ে গেছে। সম্ভবত ওরা এখন পার্কে কোন একটা গাছের তলায় ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে আছে।

মেজর হার্ডি–এর্কেস কে?

কলেভিন–মিস ক্ৰেগের হৃদয়।

বুড়ো বুড়ি প্রায় একই সঙ্গে মিহি ও খটখটে গলার মিশ্রণে বলে, মিসেস লোরিং বলেছিল বটে।

কলেভিন অনুনয় করে, বড় লাজুক মেয়ে এলিস। ওকে এ ব্যাপারে কিছু বলে লজ্জা দেবেন না যেন।

 মেজর হার্ডি মাথা নাড়ে, না, না। আমরা এখনই ওকে ঘাঁটাতে যাচ্ছি না। ওর ধূ ধূ মন ঠিক ঠিক সবুজ হয়ে উঠুক, তারপর

মিস পীয়ারসন হি-হি করে হেসে ওঠে।

 কিটি লোরিংকে বেশি রাতে পাকড়ানো হলো। তার চোখ লাল, চুল আলুথালু, বদন অশংবৃত, মুখে বিহ্বলতা, চোখের নিচে কালির আস্তরণ, সর্বাঙ্গ শিথিল–এ্যালকোহলে চুর চুর।…

কলেভিন বললো, কিটি, টাকাটা সরাবার পরই কিন্তু তা ভোগ করতে পারছি না।

 কেন?

কারণ, তোমার ও আমার–দুজনেরই বর্তমান আর্থিক অবস্থাটা সুবিধের নয়। এখন হঠাৎযদি আমাদের বড়লোকি চাল চলন শুরু হয়ে যায়, ফ্রেডারেল গোয়েন্দারা নেক নজরে, তাকাতে বাধ্য।

তোমার অভিমতটাই শুনি।

আমার পরিকল্পনাটা হলো, মালটা হাতাবার পরও বেশ কিছুকাল আমরা এমনি অবস্থাতেই থাকবো। ডাকসাইটে ধনী হয়ে উঠবার কোন কিছুই থাকবে না তোমার আমার আচরণে। এরকম কিছুদিন চলবার পর একদিন লোকেরা দেখবে, তোমার সঙ্গে আমার বিয়ে হয়ে গেল।

 লোরিংয়ের হেঁচকি উঠলো, বিয়ে? তো-মার সঙ্গে। অসম্ভব। খানিকটা খিঁচিয়ে উঠলো কলেভিন, তিন শ হাজার ডলারের অর্ধেকটা পেতে গেলে এরকম কিছু কৌশল তোমাকে নিতেই হবে। এমন সুযোগ জীবনে সবসময় আসে না।

ঠিক আছে। তারপর?

 তারপর একদিন আমি চাকরিতে ইস্তফা দেবো। তুমিও হোটেল বেচে দেবে। পাঁচ জনে জানবে, এ সুখী দম্পতি এখন যৌথ উদ্যোগে নিজেদের ভাগ্য গড়তে লড়াই শুরু করবে। তখন আমরা দক্ষিণের কোন বড় শহরে পাড়ি দেব। সেখানে গিয়ে কারবার, জুয়ার বোর্ড ইত্যাদি লোক দেখানো ব্যাপারের মধ্য দিয়ে প্রমাণ করবো, আমরা দ্রুত ধনী হয়ে উঠছি। তারপর একসময় কোর্টে গিয়ে ডিভোর্স চাইবো তোমার মতন তুমি, আমার মতন আমি।

নিষ্প্রাণ স্বরে লোরিং বললো, এ যে অনেকদিনের ব্যাপার।

 এমন কিছু নয়, তিন থেকে চার বছরের মামলা।

 উরে ব্বাশ। না-না।

বোকার মতন মাথা নেড়ো না। বাকি জীবনটা পায়ের উপর পা তুলে কাটাতে হলে তিন চার বছর ধৈর্য ধরতেই হবে। যে মানুষের ধৈর্য নেই, ভাগ্যও তার চিরকাল জোড়াতালি মারা অবস্থায় থাকে।

লোরিং বলে, টাকাটা সরিয়ে রাখবে কোথায়?

আপাতত ঐ ব্যাঙ্কের মধ্যেই।

 আশ্চর্য তো।

এটাই বাস্তবসম্মত ভাবনা। আমাদের ঐ ব্রাঞ্চে অনেক পুরনো বাক্স-প্যাটরা ডাই করা আছে। টাকাটা ওরই মধ্যে কোথাও খুঁজে রাখবো। ফেডারেল পুলিশ যখন পাতি পাতি করে টাকাটা খুঁজবে, কুবেরের ধন তখন ব্যাঙ্কেরই এক কোণে ঘুমিয়ে আছে। কোন শালা ভাবতেই পারবে না। পরে অস্থিরতা থিতিয়ে এনে মাল এনে ফেলবো তোমার কাছে।

কলেভিন খুক খুক করে হেসে লোরিংয়ের কোমরে একটা আলতো থাপ্পড় দিয়ে বললো, তোমার কিন্তু অনেকগুলি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে হবে। প্রতি কাজই সূক্ষ্ম, সাবধানে করতে হবে। তোমার ওপরে অনেকটা নির্ভর করবে। মাথা গরম করবে না। খাপ্পা হয়ে উঠবে না। আমি যেমন : বলি, তেমন তেমন করো।

বলে যাও।

 প্রথমত, মিস এলিস ক্রেগ আজ থেকে আর হলঘরে বসে সন্ধ্যায় টি.ভি. দেখে কাটাবে না। আমি এমন মন্ত্র দিয়েছি যে, এখন থেকে সে প্রতি সন্ধ্যাতেই তার ঘরে বসে ব্যাঙ্কের কানুন মুখস্থ করে কাটাবে। তুমি এই সুযোগে শ্ৰীমতীর টুপি ও কোট পরে, বাইরে বেরিয়ে পড়বে। আমিও একটা অন্য ধরনের কোট পরে নকল গোঁফ লাগিয়ে একটা পুরনো গাড়ি নিয়ে হাজির হবো এই হোটেলের লনে। গাছ গাছালির আবছা ছায়ায় দুজনে মিলিত হবে। আমি তখন কলেভিন নই, এলিসের প্রেমিক এর্কেস। আর তুমিও তখন লোরিং নও, এলিস ক্রেগ। হলঘরের জানালা দিয়ে দুই বুড়োবুড়িহার্ডি ও মিস পীয়ারসন আলিঙ্গনাবদ্ধ,চুম্বনাবদ্ধ অবস্থায় এলিস ও এর্কেসকে দেখে কি খুশিই না হবে।

 অদ্ভুত। তারপর?

দ্বিতীয়ত, তোমার সঙ্গে আমার যে বেশ একটা ভাব ভালোবাসা গড়েছে সেটা প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। সবসময় কাছাকাছি থাকা। চোখে চোখে মধুর ইশারা, একটু ছোঁয়া…..নিজের মেয়েকে জানিয়ে দেবে, আমাকে তুমি বিয়ে করতে চলেছে।

ও ঈশ্বর।

 ভগবানের দোহাই দিচ্ছ কেন? আমার সঙ্গ আর বুদ্ধির দৌলতে তোমার বরাত খুলে যাচ্ছে।

 বেশ তারপর?

তারপর তো সেই শুক্রবারের কালরাত্রি। ঐ তারিখে সন্ধ্যার পরেও অনেকক্ষণ যাবৎ ব্যাঙ্কের কাজে আমি এলিসকে আটকে রাখবো। সে যখন কাজে ডুবে থাকবে, আমি এক ফাঁকে গিয়ে ব্যাঙ্কের পিছনের দরজাটা খুলে দেবো। ঐ দরজাটা সাধারণতঃ বন্ধই থাকে, ওর চাবি আমার আর এলিসের কাছে থাকে। ফিরে এসে কয়েক মিনিটের মধ্যেই এলিসকে চিরকালের মতন

 আতঙ্কে আড়ষ্ট লোরিং আবার উচ্চারণ করে, হা ঈশ্বর!

কলেভিন বলে চলে, তিন শ হাজার ডলারের জন্য দু একটা পায়রা শাবকের রক্ত এমন কি বড় কথা, যা বলছিলাম, তুমি আর একটা গাড়িতে চেপে চলে আসবে ব্যাঙ্কের পেছনে।চুপচাপ– ভেতরে ঢুকে এলিসের টুপি ও কোট পরে সামনের দরজা দিয়ে আমার সঙ্গে বেরিয়ে আসবে।

 শেরিফ সাহেব দেখবেন, ব্যাঙ্ক ম্যানেজার এবং এলিস ক্রেগ ব্যাঙ্কের সব বাতি নিভিয়ে বেরিয়ে গেল।

মিসেস লোরিং ঠোঁট কামড়ে পায়ের দিকে চেয়ে আছে, ঘাড় ফেরাচ্ছে না, কেবল তার নাসা কাঁপছে।

কলেভিন কিন্তু বলতেই থাকে, মধ্যরাতে তুমি আবার ঐ এলিসের পোশাক পরেই ব্যাঙ্কের সামনে দিয়ে হেঁটে যাবে। তবে আমি থাকবো, এর্কেসের ছদ্মবেশে। ব্যাঙ্কের পেছনের দরজা দিয়ে ঢুকবো। তোমার গাড়িটা তো সেখানেই থাকবে। ব্যাঙ্কের মধ্যে ঢুকে অন্ধকারে আমি পট পট সব কটা বাল্ব খুলে ফেলবো। থাকবে কেবল ভল্টের মধ্যেকার বাল্ব। এই বাটার সুইচ্ অন করা মাত্র ইলেকট্রনিক আইটা নিষ্ক্রিয় হয়ে যাবে। শেরিফ মহাশয় টেরও পাবেন না, কারণ ভল্টের মধ্যের আলোটা বাইরে থেকে আদৌ দেখা যায় না। আমরা টাকাটা সরাববা, লুকিয়ে রাখবে এবং ক্রেগের লাশটাকে এনে তোমার অপেক্ষমান গাড়িতে ফেলবো।

 ও ঈশ্বর!

 অনেকটা পথ–ঢালু পথে–আমরা গাড়িতে এলিস ক্ৰেগের লাশটা নিয়ে যাবো-স্টেশনের দিকে। গাড়িটা একটা পেট্রল পাম্পে দাঁড় করাবো। সেখানে কথাচ্ছলে আমরা পরস্পরকে এলিস ও এর্কে নামে অভিহিত করবো। কথাবার্তায় আমরা দুজনে থাকবোযুগপৎস্ফুর্তিবাজ।…ও বলতে ভুলে গেছি, এ ঘটনার আগের দিন তুমি তোমার বর্তমান গাড়িটাকে স্টেশনের কাছাকাছি কোথাও। পার্ক করে রেখে আসবে।আমরা দুজনে এলিসের লাশটার একটা হিল্লে করে ব্রাহ্মমুহূর্তের আগেই ফিরে আসুবো। লাশবাহী গাড়িটা পথেই পড়ে থাকবে।

 লোরিংয়ের প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করে কলেভিন। লোরিং কাঁপছে, এখন তার লোভর চেয়ে আতঙ্কই বেশি। কাঁপা হাতে গলায় হুইস্কি ঢালে, হাঁসফাস করে, বুকের বাঁধন আলগা, শরীরময় তন্দ্রালুচল!কলেভিন ইচ্ছে করলেই এখন ওকে বিছানায় নিয়ে ঝাপাতে পারে। কিন্তু এক রাত্তিরের অভিজ্ঞতাতেই কলেভিন টের পেয়েছে, লোরিং বিছানায় কি বস্তু–মিলনের ঝোঁক নেই, পাল্টি খাবার রোখ নেই, কেবল দেহটাকে হেঁদিয়ে রাখে–ক্ষমতাবান পুরুষ কলেভিনের ওরকম– মেয়েমানুষ একদম অপছন্দ।

 পরদিন বিকেলে সিঁড়ি বেয়ে উঠবার মুখে ফুটফুটে এক স্বাস্থ্যবতী আকর্ষণীয়া কিশোরীর । মুখোমুখি হতেই কলেভিন চমৎকৃত।

 কিটি লোরিংয়ের মেয়ে ইরিস লোরিং। অমন উঠতি যৌবনাকে দেখে মুগ্ধ না হয়ে উপায় নেই, মুগ্ধতা ইরিসের চোখেও–অমন এক পুরুষালি চেহারা, দৃষ্টিতে বুদ্ধিদীপ্ত হাসি-তামাশা।

আপনিই তো মিঃ ডেভ কলেভিন। ব্যাঙ্ক ম্যানেজার, আমাদের নতুন বোর্ডার?

এবং তুমিই তো ইরিস লোরিং?

 মার কাছে আপনার কথা শুনেছি।

 তোমার কথাও কিটি আমায় বলেছে, এখন চললে কোথায়?

 টেনিসের কোর্টে। এমন সুযোগ বড় একটা পাই না। পরে আবার দেখা হবে।

 নিশ্চয়।

আপন উদ্দীপনায় ডানা কাটা পরী উড়ে গেল। কলেভিন দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে–কিটির বদলে যদি ওর মেয়ের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা হত। পিটসভিলের দিনগুলি কি মাধুর্যময়ই না হতো।

ইরিস কোর্ট থেকে বেরিয়ে ডেপুটি শেরিফ কেন ট্রেভারসের সঙ্গে পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে একেবারে সমুদ্রবেলায়। সমুদ্র আজ উদাসীন, ক্রমশ শ্লেটের রং নিচ্ছে।

ইরিস–আমার খুব চিন্তা হচ্ছে।

কেন–হেতু?

ইরিস–মা আবার ড্রিংক করতে শুরু করেছে। আমার মা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে।

কেন–এরকম হবার কারণ?

 ইরিস-বুঝতে পারছি না।

কেন–দরকার মনে করলে তোমার পরিচিত মানসিক ডাক্তারের সাহায্য নাও।

 ইরিস–অবস্থার আরো অবনতি ঘটলে তাই করতে হবে।

 দেরি না করাই ভাল। ব্যাধির উপসর্গ যখন দেখা দিয়েছে, ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়াই ভাল।

বেদনার ছায়া ইরিসের মুখে। বাবা দুর্ঘটনায় মারা যাবার পর প্রচণ্ড হতাশায় মা মদের দিকে ঝুঁকে পড়েছিল। কদিনের মধ্যেই দুঃসহ স্নায়বিক রোগে আক্রান্ত হলো। সর্বক্ষণ অ্যালকোহলের জন্য আঁচড়াচ্ছে, খামচাচ্ছে। অসংলগ্ন কথা বলছে, সম্মানবোধ থাকছেনা। সেই ভয়ঙ্কর দিনগুলিতে মাকে সারিয়ে তুলতে কিশোরী মেয়ে ইরিস কী লড়াইটা না করেছে। সিনেমা হলে টিকিট বেচা, হোটেল চালানো-মানসিক হাসপাতালে মাকে রোজ দেখতে যাওয়া ইরিসকে যারা চেনে সকলেই বাহবা দেয়।

মা ভালো হয়ে উৎসাহ ও উচ্চাশা নিয়ে ফিরে এলো। মদ ছেড়েই দিয়েছিল। আবার কেন বোতলের দিকে হাত বাড়াতে শুরু করেছে সে?

 ইরিস অন্য কথায় যায়–আজ আমাদের নতুন বোর্ডার ব্যাঙ্ক ম্যানেজার মিঃ ডেভ কলেভিনের সঙ্গে পরিচয় হলো।

সন্দিগ্ধ স্বরে কেন, তাই নাকি?

দারুণ চেহারা, তাই না?

 চোখে মুখে কিন্তু কেমন যেন দুষ্কর্ম ও নিষ্ঠুরতার চিহ্ন।

 মোটেই না। বরং কী অমায়িক উদার হাসি।

 সেই হাসিতে বধ হয়ে গেলে নাকি?

ছিঃ কেন, আমাকে এভাবে কখনো অপমান করবে না।

ট্রেভারস স্বস্তির ছোঁয়া পেয়ে হেসে ওঠে, আরে আমি ঠাট্টা করছিলুম। তুমি হলে আমার বাগদত্তা।

.

০৭.

 আশ্চর্য আবির্ভাব যেন।ব্রাঞ্চ ম্যানেজারের চেম্বারে ইরিস লোরিং ঢুকে পড়েছে। ম্যানেজারের চেম্বারের সাফসুফ টেবিলের এধারে একটা চেয়ার নিলো। মুখোমুখি, সামান্য বিচলিত, সপ্রশ্ন।

আপনি নাকি আমার মাকে বিয়ে করতে চলেছেন? কলেভিন চেয়ারে দোল খেতে খেতে মিষ্টি হেসে বললো, কিটির মতন সঙ্গিনী দুর্লভ।

 আপনি ওকে ভালবাসেন?

অদ্ভুত প্রশ্ন তো। ভাল না বাসলে আমি তাকে বিয়ে করতে যাবো কেন? কিটিও আমাকে ভালবাসে। আমরা দুজনে যথেষ্ট পরিণত মনস্ক। বিয়ের পর আমরা দুজন দুজনকে নানাভাবে সাহায্য করতে পারবো।

ক্রমশ ইরিসের উদ্বেগ কমে আসছে, সে কলেভিনের মুখের দিকে চেয়ে থাকে।

কলেভিন বললো, বিয়ের পর যৌথ প্রয়াসে আমরা আমাদের ভাগ্যের চাকা ঘোরাবার চেষ্টা করঝে। হয়তো আমি এই ব্যাঙ্কের চাকুরি ছেড়ে দেবো। কিটিও হোটেল বেচে দেবে। তারপর আমরা দক্ষিণের কোন শহরে যথাসর্বস্ব নিয়ে চলে যাবো। সেখানে কোন লাভজনক ব্যবসা করব। আমার কিছু প্রতিষ্ঠিত ধনী বন্ধু আছেন, যাদের সহায়তা পেতে পারি।

কলেভিন থামলো। প্রতিটি উচ্চারিত শব্দে প্রত্যয় ও হাসি।

ইরিস বললো, তার মানে, আপনারা পিটভিল থেকে আমাকেও নিয়ে যাবেন?

তোমার মার তো তাই ইচ্ছে। সে কেবল কেন ট্রেভারসের সঙ্গে তোমার প্রেমকে নাকচ করছে না, তরুণ ডেপুটি শেরিফকে বেইজ্জতি করবার সুযোগ খুঁজছে।

 তীক্ষ্ণভাবে ইরিস বলে, সে আমি জানি। আপনার কি অভিমত? 

হাসি আরো মোলায়েম করে কলেভিন সিগ্রেট ধরায়, ধোঁয়ার রিং ছাড়ে বাতাসে, এ ব্যাপারে আমার অভিমত তোমার মার ঠিক বিপরীত। আমি মনে করি কেন হচ্ছে সচ্চরিত্র যুবক যার সঙ্গে নিশ্চিন্তে মেয়েকে বিয়ে দেওয়া চলে। কিটিকে বুঝিয়ে রাজি করাবো–আমরা দক্ষিণে গেলেও তুমি পিটভিলে ডেপুটি শেরিফের ঘরনী হয়ে থেকে যাবে।

 দুচোখ কৃতজ্ঞতায় চকচকে। ইরিস বলে, আপনি যদি মাকে রাজি করাতে পারেন, বড় ভালো হয়। মা ট্রেভারসের নাম নিলেই তেতে ওঠে।

এ ব্যাপারটা আমার ওপরেই ছেড়ে দাও। আর কিছু?

ইতস্ততঃ করে ইরিসনরম স্বরে বললো, আপনি আমার ভাবী পিতা। তাই আপনাকে ব্যাপারটা জানানো উচিত। কয়েক বছর, আগে মা মানসিক অসুস্থতার শিকার হয়েছিল।

 চমকে ওঠে কলেভিন, ইরিস দুঃখিনীর গলায় থেমে থেকে বলতে থাকে, বাবা মারা যাবার পর মা অস্বাভাবিক মদ খায়। তৃষ্ণার্ত লোকের জলপানের মতন মদ্যপান। এতে কেবল পয়সার শ্রাদ্ধ হলোনা, মা স্নায়বিক রোগগ্রস্ত হলো। বুদ্ধি ও স্মৃতি–দুইই, লোপ পেল। বাধ্য হয়ে মানসিক হাসপাতালে পাঠাতে হলো। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে আমি তাকে সুস্থ করে তুলি। ইদানীং আবার মদের দিকে ঝুঁকেছে। আচার আচরণে কেমন যেন অপরাধবোধ।.আপনি বিয়ের পর ওর ওপর সতর্ক দৃষ্টি রাখবেন। আমার মা খুব দুঃখিনী, অসহায়। মেয়ে হিসেবে এটা আমার একান্ত অনুরোধ।

যথাসম্ভব দরদের সঙ্গে কলেভিন জবাব দেয়, নিশ্চয়। কিটির মঙ্গল মানে তো আমারও মঙ্গল। এখন যদি একটু আধটু মদ খায় সেটা ধর্তব্যের মধ্যে এনো না। একবার যখন জেনে গেছি, তখন এ ব্যাপারে যাবতীয় ধকল সামলাবার দায়িত্ব আমারই।

 সন্তুষ্ট, নিশ্চিন্ত, কৃতজ্ঞ ইরিস চলে যায় চোখ কান দিয়ে হকা বের হচ্ছে। সে সর্বনাশের সেঁতে হাসি দেখতে পাচ্ছে। আমি এক নম্বরের বুদ্ধ, তিনশ হাজার ডলার ভাবতে ভাবতে এমন চেগে গেলাম যে তোক চিনতে ভুল করলাম। একটা মাথা খারাপের কাছে কিনা সব খুলে বলেছি। যার মাথারই ঠিক নেই। মদের গন্ধে যে ছোঁক ছোঁক করে, তার পেটে গোপন কথা কতক্ষণ থাকবে?…কি করা যায়?…..কি…। যাক টাকাটা তো আগে সরাই ঐ পাগলাকে নিয়ে। তারপর খুনের সংখ্যা একের বদলে যদি দুই হয়…সেটা প্রায় তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেবার মতন হবে কারুকর্ম। তাই না?….

কলেভিনের ঘরে রাত দুপুরে কপাট খুলে কিটি লোরিং ঢুকলো। পোশাক অসংবৃত। দুই পা টালমাটাল। ঘন নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস। জীবন মানেই প্রতিযোগিতা, লোরিং তা ভুলে গেছে। উচ্চারণে অস্থিরতা, তা হলে কাল তোমার হাতে এলিস খুন হচ্ছে?

সে রকমই তো কথা। আদৌ যদি টাকাটা সরাতে হয়–

 না-না-না। তুমি কান খাড়া করে শোন, এলিসকে তুমি খুন করতে পারবে না।

তিনশ হাজার ডলার।

চুলোয় যাক তোমার তিনশহাজার ডলার। আমার একটি পয়সারও দরকার নেই। যে টাকায় রক্তের দাগ থাকবে, আমি তা ছোঁব না। খবর্দার তুমি যদি এলিসকে খুন করো

কলেভিনের মুখের দিকে চেয়ে লোরিং থেমে গেল। সেই মুখে বিকট হিংস্র দুটো চোখ জ্বলছে। দাঁতে দাঁত চেপে বললো, অর্থাৎ আমাকে উস্কে দিয়ে তুমি আমার সঙ্গে বেইমানি করতে চাইছে। ঠিক আছে, তোমার যা ইচ্ছে তাই করো। তবে আমি তোমার যা ক্ষতি করার তা করবো। দুনিয়ার সব লোক জেনে গেছে আমাদের প্রেম ও বিয়ের কথা। কাল ভোরে উঠেই আমার প্রথম কাজ হবে ঘোষণা করা–কিটি লোরিংকে বিয়ে করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ কিটির মাথায় গণ্ডগোল দেখা দিয়েছে। ব্যাঙ্ক থেকে টাকা হাতানো, এলিসকে খুন করা–এই রকম কী উদ্ভট কথা প্রলাপের মতন বকছে আর ঢক ঢক করে মদ গিলছে…। ওকে এখনই উন্মাদগারে পাঠানো উচিত। আমার কথা সকলেই বিশ্বাস করবে এমন কি তোমার মেয়ে অব্দি। কারণ কয়েক বছর আগে তোমার এরকম হয়েছিল। তোমার চিৎকার, প্রতিবাদ কেউ শুনবে না, কেউ বিশ্বাস করবে না-পাগলে কিনা কয়।…আমরা সকলে মিলে তোমাকে হিড়হিড় করে টেনে পাগলাগারদে নিয়ে যাবো। ইরিস হোটেল চালাবে আর আমি এই ঘরে বহাল তবিয়তে শুয়ে বসে কাটাবো। খাক খ্যাক করে হেসে ওঠে কলেভিন। আতঙ্কে কিটির শুকনো ঠোঁট কাঁপতে থাকে, সে ঝাঁকিয়ে ওঠে, না, না, তুমি এভাবে বলল না। আমার অতবড় সর্বনাশ করো না।

কলেভিন খিঁচিয়ে ওঠে, তুমি আমায় জেলে পুরতে চাইবে আর আমি তার প্রতিদান দেবনা?

 ফোঁপাতে ফোঁপাতে দুহাতে মুখ ঢেকে কিটি নিজের ঘরে ঢুকে দুম্ করে দরজা বন্ধ করলো।

হাতের সিগ্রেটটা ছুঁড়ে ফেলে কলেভিন স্বপ্নভঙ্গের হতাশাকে নিয়ে আর কিছু ভাবতে পারছে না। কোনক্রমে শুয়ে পড়লো।

অনেক রাতে কলেভিনের ঘুম ভেঙ্গে গেল। তার শিথিল স্নায়ু কৌতূহল ও সতর্কতার ফণা তুলেছে।নীল চোখে খুনীর মানসিকতা। একটা হাত বালিশের তলায় পিস্তলের ওপর, অদৃশ্য কারুর ইশারা পেলে এখনই ঘটিয়ে দেবে রাত্রিকালীন নৈঃশব্দের মন্বন্তর–একটি ছায়ামূর্তি ঘরের মধ্যে হাঁটাচলা করছে। সেই মূর্তি তার খাটের কাছে এসে দাঁড়ায়, ঝুঁকে পড়ে তার মুখের ওপর এবং করুণ আর্তি শোনা যায়। ডেভ আমি, আমি এসেছি, আমি তোমার সঙ্গে আছি। আমি তোমার সবকথায় রাজি।

কলেভিন তার হাতটা পিস্তলের ওপর থেকে সরিয়ে কিটির কপালে রাখে। তারপর গালে, তারপর বুকের ওপর ওকে টেনে নেয়। যদিও ইঙ্গিত সুখ মিলবে না, তবুও নিজেকে ও কিটিকে চকিতে নগ্ন করে ভীষণ এক শারীরিক যুদ্ধে বিছানাপত্র লণ্ডভণ্ড করতে থাকে কলেভিন।

.

০৮.

নির্দিষ্টকুঠুরিতে তিনশ ডলারের বাক্সটা ঢুকিয়ে জেনারেটরের সাহায্যে যন্ত্রচক্ষুটাকে চালু করে বৃদ্ধ শেরিফ সদলবলে বিদায় নিলেন। যাবার আগে উচ্চিংড়ি তাড়াবার ভঙ্গিতে হাত নেড়ে কলেভিনকে মনে করিয়ে দিলেন, ব্যাঙ্ক থেকে বের হবার ঠিক আগে মেইন লাইনটা অফ করে যাবেন। তার আগে লাইট অফ করবেন না। মিস ক্রেগ অবশ্য সবই জানেন।

 মৃদু হেসে সায় দেয় কলেভিন। কিন্তু তার হাত ও কপাল ঘামে ভিজছে। পুলিশ চলে যাবার পর সে ব্যাঙ্কের দরজা বন্ধ করে দেয়। এলিস একমনে কাজ করে চলেছে। কলেভিন ভাবে আর মাত্র ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ মিনিটের মধ্যে মেয়েটা আমার হাতে বলি হবে।

কলেভিন কাজে মন বসাতে পারছে না। সামান্য মান্থলি স্টেটমেন্ট লিখতে ও মেলাতে গিয়ে হিমশিম। ভুল হয় আর এক একটা শিটকে দলা পাকিয়ে ওয়েস্ট পেপার বাক্সে নিক্ষেপ করে। কিটির সাহায্য তার আজ খুব দরকার। কিন্তু কিটির মত বেসামাল মনের সাক্ষীকে বেশিদিন বাঁচিয়ে রাখা যাবেনা। খালি চুক চুক মদ গিলছেআর খিস্তি পাড়ছে,কখন যেসবাসকরে দেবে–ভাবলে কলেভিনের গায়েকটা দেয়। টাকাটা হাতাবার পর অবশ্য তাকে কিছুটা সময় নিতেই হবে। তারপর একদিন বাথরুমে ঢুকে কিটির মাথায় মোক্ষম আঘাত। কেউ খুন বলে ভাববেনা। মাতাল মহিলা পা পিছলেকলের সঙ্গে মাথা ঠুকে বাথটাবে চিৎপটাং এবং খাবি খেতে খেতে নিশ্চিত মৃত্যু।তারপর রয়ে সয়ে চাকুরিতে ইস্তফা দিয়ে সে লাস ভেগাসেযাবে। সেখানে তার বন্ধু জুয়াড়ি বোর্ডের মালিক মারভিন গডউইনের সাহায্যে এমন প্রমাণ করবে যেন জুয়ার দান জিততে জিততে কলেভিন কোটিপতি হয়ে গেল। তারপর একদিন লাস ভেগাসকেও গুডবাই।..ছকটা কি খুব খারাপ?

সময় বয়ে চলে। কলেভিন তার ড্রয়ার থেকে বালিভর্তি মোজাটাকে বের করলো। বেশ ভারী ও সহজে ব্যবহারযোগ্য। এলিস ক্রেগকে খতম করার পক্ষে যথেষ্ট।

টেলিফোনের বোম টিপে টিপে সে কিটিকে ধরলো।

কে রে?–কিটির চিৎকার। গলার আওয়াজটা টের পাওয়া যায়, আকণ্ঠ মদ গিলে যাচ্ছে। কলেভিন একে নিয়ে কাজে নেমে যে কি ফাপড়ে পড়েছে।

আমি ডেভ। আর আধঘন্টার মধ্যে আসছে তো?

অত মনে করিয়ে দিতে হবে না। আমাকে কি ভাবো বলো তো?

প্লিজ আস্তে। এলিস শুনতে পাবে।

আমি এই পনের মিনিটের মধ্যেই আসছি।

কলেভিন ফোন নামিয়ে রাখে। কুল কুল করে ঘামছে। সময় নেই, সময় নেই…। সে এখনই এলিসকে শেষকরবে। যেহাতে কাজ সারবে, কোনবাহানায় এত কাঁপছে?আঘাত হানবার আগেই অমন কালঘাম তো ভাল নয়।ই, কলেভিন জীবনে অনেক খুন করেছে তা যে কারণেই হোক। খুন করার মধ্যে সে খুঁজে পায় এক অদ্ভুত আনন্দ ঘন শিহরণ, যেন কোন পারঙ্গমা স্বৈরিণীর সঙ্গে পরমসুখে কাজ সারছে। সে যখন যুদ্ধে ছিল,প্রতিপক্ষের এক জাপানী তরুণকে একটা গাছের সঙ্গে ঠেসে ধরে সে হত্যা করেছিল। আহ, তখন কী সুখ, কী সুখ…।

 মিস ক্রেগ!

এলিস কলেভিনের ডাক শুনে পর্দা সরিয়ে এ ঘরে এল। টেবিলের ওপর রাখা এলোমেলো কাজগুলো দেখিয়ে কলেভিন বলল, আজ কেন জানিনা আমার কাজে ভুল হচ্ছে। আপনি দেখুন তো স্টেটমেন্টটা ঠিক হয়েছে কিনা।

 এলিস অফিসের কাজে সদা উদগ্রীব। বিরাট টেবিলটাকে পাক খেয়ে কাগজগুলো গুছোতে থাকে, তারপর নির্ভুল কাজ করবার তাগিদে চেয়ারে বসে পড়ে।কলেভিন ওর সাদা ঘাড়ের ওপর প্রখর দৃষ্টি রেখে আস্তে আস্তে এগোতে থাকে ডান হাতে সেই ভারী বালিভর্তি মোজা নিয়ে। সে যেই অস্ত্রসমেত হাতটা তুলল ঠিক তখনই কলেভিনকে ভীষণ চমকে দিয়ে টেলিফোনটা চিৎকার করে উঠলো।কলেভিন হকচকিয়ে অস্ত্রটাকে পকেটে রাখে। এলিস হাত বাড়িয়ে রিসিভারটাকানে তুললো, কলেভিনের দিকে ঘুরে বললো, মিসেস রসন আপনার সঙ্গে কথা বলতে চান।

 বিস্মিত হয় এলিস কলেভিনের মুখের দিকে চেয়ে, স্যার আপনাকে ওরকম দেখাচ্ছে কেন? আপনি কি অসুস্থ বোধ করছেন?

কলেভিন কোন জবাব না দিয়ে ফোনে কথা বলা শুরু করে। ব্যাঙ্কের এক বিশিষ্ট গ্রাহক মিসেস রসন শেয়ার বেচাকেনা সম্পর্কে খোশমেজাজে ব্যাস্ক ম্যানেজারের পরামর্শ চাইছেন। বড় বাঁচাল। কানের পোকা খসে যায়। কলেভিন মনে মনে খিস্তি দেয়। সময় বয়ে যায়, এখন ব্যাঙ্কের পিছনের দরজাটা খোলা হয়নি। যদি লোরিং দরজা বন্ধ দেখে ফিরে যায়? দুম করে ফোনটা কেটে দিয়ে লাফিয়ে ছুটলো পিছনের দরজা খুলতে। এলিসের মনে বিপদ ও অস্বস্তি বিজকুড়ি কাটছিল। সেও কলেভিন-এর পিছন পিছন ছুটলো। দরজা খুলতেই কলেভিন দেখলো, অন্ধকারে কিটি দাঁড়িয়ে। যথারীতি মদে টালমাটাল।

এলিসের বিস্মিত বিপন্ন কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, মিসেস লোরিং! আপনি! এখানে এ সময়ে?

দুজনকে একসঙ্গে গলা টিপে ধরতে ইচ্ছে হচ্ছে কলেভিনের। আবার বুকের মধ্যে টিপটিপ করছে। বিপদের গন্ধ পেয়ে এলিস না এখনই ছুটে পালায়। কিটি কিছু বলবার আগেই আবার টেলিফোনের আর্তস্বর। চড়া গলায় কলেভিন এলিসকে হুকুম দেয়, দাঁড়িয়ে কেন? যান, ফোনটা ধরুন না। বিহ্বল এলিস ফোনটা ধরতে গেছে কি না গেছে, বেসামাল কিটি হাউমাউ করে ওঠে আরে, আমি যে ওকে মৃত দেখবো আশা করেছিলাম তুমি তাহলে এতক্ষণ ধরে

কলেভিন চাপা হঙ্কার দেয়-চুপ! না হলে মুখ চেপে ধরবো।

এলিস এসে বললো, স্যার, মিসেসরসন আবার আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাইছেন।কলেভিন একলাফে নিজের চেম্বারে গেল। আর তখন ব্যাঙ্কের সবচেয়ে বড় টেবিলের সামনে দুই নারী মুখোমুখি-এলিস ও কিটি। এলিস আবার প্রশ্ন করে, আপনার কি কোন দরকার আছে এখানে?

বড় বড় চোখ করে কিটি বললো, আমার চেয়েও বেশি দরকার আছে ঐ লোকটার। ঈশ্বরের দোহাই এলিস ও আজ তোমাকে খুন করবে। সত্যি বলতে কি এতক্ষণে, তোমার লাশটা এখানে পড়ে থাকবার কথা ছিল।

মিসেস রসনকে আগামীকাল সকালে আসতে অনুরোধ করে কলেভিন এ ঘরে ঢোকামাত্র কিটির কথাগুলো শুনতে পেল। এলিস ক্রেগ চকিতে ভল্টের দিকে যাবার চেষ্টা করে।কিন্তু ভল্টের কপাট বন্ধ করার সুযোগ সে পায় না। কলেভিন ভল্টের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। ইস্পাতের দেয়ালে পিঠ দিয়ে এলিস থরথরিয়ে কাঁপছে, ভয়ে আতঙ্কে গোঙাতে থাকে। না, আমাকে ছোঁবেন না, না –কলেভিন যখন অনায়াসে তার মোটা মোটা আঙুল দিয়ে এলিসের ঘর্মাক্ত নরম গলা টিপছে তখনো সেই অস্ফুট আর্তি না, আমাকে ছোঁবেন না…না…

.

০৯.

ডেপুটি শেরিফ কেন ট্রেভারস প্রেমিক ইরিসের কথা ভাবতে ভাবতে রাস্তার অপরধারে ব্যাঙ্কের দিকে তাকিয়েছিল। সন্ধ্যা সাতটা পাঁচ মিনিটে ব্যাঙ্কের আলোগুলি নিভিয়ে সেই উদ্ভট ওভারকোট ও টুপি পরিহিতা এলিস ক্রেগ এবং ব্রাঞ্চ ম্যানেজার ডেভ কলেভিন অফিস থেকে বেরিয়ে এলো। ওরা বেরিয়ে আসা মানেই ট্রেভারস নিশ্চিন্ত। কিন্তু এলিসের চঞ্চল ভঙ্গিমা দেখে সে অবাক, ঠিক দেখছে তো? নাকি দৃষ্টিভ্রম? এলিস যেন এক নেশাচুরের মতন এলোমেলা পা ফেলে কলেভিনের সাহায্যে কোনমতে গাড়িতে গিয়ে বসলো। হয়তো মিস ক্রেগ অসুস্থ। কেন ট্রেভারস সচেতন হতে গিয়েও কেমন যেন আনমনা হয়ে পড়ে। এলিস ক্ৰেগের মতন মেয়েরা এই পৃথিবীতে সর্বত্র উপেক্ষিতা, যদিও ওদের ভূমিকানীরবেবহুবিধ গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনীয়তা সাধিত করে। জোকারদের দেখে যেমন তামাশাপ্রিয় জনতা জোকারদের বুকের ওপর কান পাততে ভুলে যায়, এলিসের মতন মেয়েদের কথাও কেউ ভুলেও ভাবে না।

শক্ত চোয়ালে কলেভিন গাড়িটাকে স্বাভাবিক গতিতে রেখে মিসেস লোরিংয়ের একখানা হাত বেশ জোরে মুচড়ে দেয়, শালা, মাথা যদি ঠিক না রাখো, মাথাটাই গুঁড়িয়ে দেবো। হোটেলে গিয়ে চুপচাপ ওপরে উঠে যাবে। ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করেছে কি একদম ফাঁসিয়ে দেবো। বুঝলে?..কলেভিন কিছু অশ্রাব্য খিস্তি দেয় যেন আগুনের ফুলকির মতন।

এলিসের কোট ও টুপি পরা কিটি যখন হোটেলের সিঁড়ি দিয়ে টলতে টলতে উঠছে, মেজর হার্ডি হলঘরে ঢুকে ব্যাপারটা লক্ষ্য করলো। আবছা আলোয় কিটি লোরিং এখানেও এলিস ক্রেগ হয়ে গেল। যখন সে দৃষ্টিসীমার বাইরে, কলেভিন তখন মেজরকে শুনিয়ে শুনিয়ে হাঁকলো। ঘরে চুপচাপ শুয়ে থাকুন মিস ক্ৰেগ। আমি মিসেস লোরিংকে মাথা ধরার ওষুধ দিয়ে আসতে বলছি।

মেজর হার্ডি বলল, এলিসের শরীর খারাপ বুঝি?

কলেভিন মুচকি হাসে, বলছে, খুব মাথা ধরেছে। মেয়েদের ব্যাপার কত রকমের যে অসুখ আছে ওদের।

চিরকুমার হার্ডি হাসে, সত্যি। মেয়েদের অসুখের আর শেষ নেই।

হাসি আর থামতে চায় না। যৌবন পদ্মপাতার জল,কবে যেটুপ করে খসে পড়ল, হার্ডি টেরও পায়নি। যুদ্ধ, যুদ্ধ আর যুদ্ধ। তারই মধ্যে কখনো ক্কচিৎ ঝিলিক দিয়ে ওঠে নারী। নারী নিছক শরীরময় নারী, যার হৃদয়ের তল হার্ডি কখনো পায়নি। হাসির প্রভাবে মুখের বলিরেখা গম্ভীর হয়। বলিরেখায় হাসি আর ঠিক হাসি থাকে না। শোকেরও ছোঁয়া লাগে।

 ঘরে ঢুকে কিটি পোশাক এমন কি জুতো পর্যন্ত না খুলে বিছানায় বালিশের মধ্যে মুখ গুঁজে গোঙাতে থাকলো। সময় ও ভাগ্য আবার মস্তিষ্কের বিবিধ বিস্ফোরণ ঘটাচ্ছে। কলেভিনের কাছে তাৎক্ষণিক কয়েক দফা চড়-চাপ্টা খাবার পরও নেশা কাটল না। হাতে পায়ে থেকে থেকে খিচ ধরছে, দু হাত খুঁজে বেড়ায় মদ–আরো মদ।.বাথরুম থেকে ঘামে-ভেজা হাত-মুখ ধুয়ে এ ঘরে কলেভিন ঢুকলো। কিটির অবস্থা দেখে রাগে-ঘৃণায় শরীর রি রি করে ওঠে। দাঁতে দাঁত ঘষে বুনো যাঁড়ের ক্ষিপ্রতা নিয়ে মিসেস লোরিংয়ের ওপর চড়াও হলো। স্কার্ট তুলে ওর দুই গোলাপী দাবনা, যা কিনা চোখের আরাম হতে পারে, কলেভিনের হিংস্র নখের আক্রমণে চাকা চাকা দাগে ফুলে ওঠে। চুলের মুঠি ধরে কলেভিন তাকে মুখোমুখি দাঁড় করায়। পিঠের ওপর কয়েকটা কিল ঘুষি মারে, কোমরে লাথি কষায়। লোরিং ব্যথায় ঝাঁকিয়ে ওঠে, আর মেরো না…আমি মরে যাবো।

 কলেভিন ক্রুদ্ধ স্বরে বললো, সম্বিৎ ফিরেছে? না ফিরলে বলো, দুটুকরো করে দিই মেরুদণ্ডটাকে।

আমি ঠিক আছি।

হুঁ, ঠিক থাকতেই হবে। আর পিছিয়ে আসার পথ নেই।…যা যা করতে হবে, সব মনে আছে?

 আছে, আছে।

একদম গলা তুলবেনা। এক ঘুষিতে দাঁত তুলে নেবো।.রাত একটার পর এলিসের পোশাকে ব্যাঙ্কের পেছনে, মনে আছে?

 আছে, আছে।দু চোখে অভাবনীয় ঘৃণা ও ক্রোধ। শঙ্খিনী সাপের মতন তার সর্বশরীরে বিষ। সে বিষের জ্বালায় জর্জরিত। আমি প্রতিশোধকড়ায় গণ্ডায় নেব।কলেভিনকে আমি পাগল বানিয়ে ছাড়ব। ও আমায় যে যন্ত্রণা দিচ্ছে, যথাকালে আমি তার দ্বিগুণ দেব।

 কলেভিন ব্যাঙ্কের পিছনের দরজা দিয়ে ঢুকলো। বুকের মধ্যে তুবড়ি ফাটছে। এখানে এক অদ্ভুত ভৌতিক রাজত্ব, একটা লাশ পড়ে আছে। একটা লকারে তিনশ হাজার ডলার রয়েছে। কলেভিন দক্ষ হাতে একটার পর একটা বা খুলে নিল। ভল্টের মধ্যের বাদবাকি রইল। অতঃপর মেইন সুইচ অন করলো। আহ–এ পর্যন্ত সব ঠিক ঠিক। ইলেকট্রনিক চোখটা ঘুমিয়ে পড়েছে।কলেভিন একাই টাকার বাক্সটা ভাঙলো। কড়কড়ে নোটগুলো এনে ভরলো আর একটা পুরনো বাক্সে। যেটা সে ঠেশিয়ে রাখলো ব্যাঙ্কের অব্যবহার্য বস্তুদের ভিড়ে। তারপর ক্রেগের লাশটাকে টানতে টানতে পেছনের দরজার কাছে এনে রাখলো। দানব কলেভিনের গলা শুকিয়ে কাঠ, হাঁপ ধরে গেছে। এখন শুধু প্রতীক্ষা কিটি লোরিং কখন আসবে।

নিশুতি নিস্তব্ধ রাত হলেও কলেভিনের দুকানে দ্রিমি দ্রিমি অদ্ভুত একটা বাজনা বেজে চলেছে। গহন আফ্রিকায় আদি মানবরা ঐ বাজনা বাজিয়ে দুলতে দুলতে এগিয়ে আসে। বুকের রক্ত হিম হয় বিপদ ও মৃত্যুর আশঙ্কায়। একসময়ে কলেভিন গহন আফ্রিকাতেও ছিল। আবার দক্ষিণ আমেরিকার খরস্রোতা খালের মধ্য দিয়ে নৌকাও ছুটিয়েছে, খুন করেছে, মাতলামি করেছে, সারারাত বেশ্যাবাড়িতে থেকেছে, ধর্ষণও করেছে, কিন্তু সুখ পায়নি, নিশ্চিন্তি পায়নি কারণ সুখ ও নিশ্চয়তা দিতে পারে টাকা। টাকাকে কলেভিন কখনো ধরতে পারে নি। যদিও টাকাই হচ্ছে ঈশ্বরের একমাত্র বিকল্প তার কাছে। সেই ঈশ্বরকে সে এখন বাক্সবন্দী করে রেখেছে। যথাকালে পকেটে পুরবে, বাধা কেবল ঐ একটা লাশ। জীবিত এলিসের সঙ্গে মৃত এলিসের কোন প্রভেদ খুঁজে পায় না কলেভিন। জীবিত অবস্থাতেও যেমন বরফ ছিল মৃত অবস্থাতেও তাই। কলেভিন পা দিয়ে এলিসের বাহুমূল স্পর্শ করে। শরীরটা এখনা শক্ত হয়নি। সে ওর গালে আঙ্গুল বোলায়, ওর তলপেটে চাপ দেয়। ওর স্কার্টের তলায় হাত ঢুকিয়ে ডান স্তন ও বাম স্তন ধরতে থাকে। খুব একটা নরম নয়। যেমনটি হয়ে থাকে নিখাদ কুমারীদের প্রাণ ও চেতনা যদি থাকত, অস্ফুট শব্দ উখিত হত। ঠোঁটের রং কদাপি তার রক্তাভ নয়, ঈষৎ কালচে। এখন কিন্তু নীলাভ। কলেভিন ঠোঁটের ওপর তর্জনী রাখে, খানিকটা চটচটে শুকনো রক্ত লাগে। কলেভিন যে কী দুর্দান্ত ও ভয়াবহ, সে এলিসকে বিবস্ত্র করে। নিবিষ্ট তন্ময়তায় পরখ করে এলিসের যোনিদেশ এবং এক দীর্ঘশ্বাস ও আক্ষেপ উচ্চারণ, ই। এই বয়সেও এলিস ক্রেগ যথার্থ কুমারী ছিল–যা কিনা এদেশে ভাবাই যায় না। মৃত্যুর পূর্বে এলিস যদি ধর্ষিতা হত। ব্যাপারটা মানানসই হয়ে উঠত।

.

১০.

 পঞ্চাশের ওপর বয়স হবে ডাউন সাইডের ফেডারেল এজেন্ট জেমসইস্টনের, চেহারায় কুমড়োপটাশ, মাথায় মস্ত টাক। এখানে কাজকর্ম না থাকায় শরীরে থাক থাক চর্বি জমেছে, মানসিক উদ্বেগ বাড়লেই পেটের মধ্যে চিনচিনে ব্যথা–ডাক্তার বলেন আলসার,ইস্টনের আতঙ্ক–হয়তো ক্যানসার। অনেকদিন দৌড়ঝাঁপ করেনা।বন্দুক টন্দুক চালায় না। এসব কাজের কথা মনে হলেই তার ভেতর অনিশ্চয়তাবোধ সংক্রামিত হতে থাকে। একফালি ঘর ও আধফালি বারান্দা নিয়ে তার অফিস, যেখানে গত দেড় বছর ধরে তৎপরতা তার কেবল একটা ব্যাপারেই–অফিসের একমেবাদ্বিতীয় সহকর্মিনী মাভিস হার্টের সঙ্গে চুটিয়ে ফুর্তি ফাৰ্তা করা। শরীর তার যখনই গরম হয়, মাভিস পোশাক-টোশাক খুলে এগিয়ে আসে তাকে ঠাণ্ডা করতে। ঝড় থেমে গেলে ঢক ঢক্‌ করে এক গেলাস দুধ খায় ইস্টন এবং মাভিস অবোধ্য ভাষায় কি সব বলে খি খি হাসে। মাভিস সুন্দরী নয়, সামনে পিছনে মাংস নেই বললেই চলে। তবে যুবতী, পঞ্চাশ বছরের এক প্রৌঢ়ের কাছে লোভনীয়। ইস্টনের বউ ব্যাপারটা নিয়ে ভেবেছে, সন্দেহ করেছে। ইস্টন যখনই ঘরে ফেরে, বউ-এর বাক্যবাণে একবারে অস্থির হয়ে ওঠে।

 এহেন মেজর ইস্টন পদাধিকারে পিটভিলের ব্যাঙ্ক ডাকাতির সুরাহায় কাজে নেমেছে। পেটে চিনচিনে ব্যথা, মহা অনিশ্চয়তাবোধ। কাজ দেখাতে না পারলে উপরতলার সাহেবরা এবার তার টাক ফাটাবেন।

 শেরিফ টমসন বুঝলো, এই মোটা টেকোটাকে দিয়ে কিছুই হবে না, যদিও আইনানুযায়ী ব্যাঙ্ক ডাকাতি মোকাবিলা করাটা ফেডারেল এজেন্টেরই দায়িত্ব। কলেভিন মনে মনে হাসে-জেমসইস্টনের মত গবেট লোক যদি ফেডারেলের এজেন্ট হয়, তাহলে ওরকম আরো দশ-পাঁচটা খুন নির্বিবাদে করা যেতে পারে। তবে ইস্ট একটু অলস ও ভীরু হলেও বোকা নয়। সে তদন্তে নামলো ডেপুটি শেরিফ কেন ট্রেভারসকে সঙ্গে নিয়ে।

ইস্টন সরকারী গাড়িতে উঠে ট্রেভারসকে বললো, মিস এলিস ক্রেগ আর তার বয়ফ্রেন্ডকে পাকড়াতে পারলেই চুরি যাওয়া টাকার বেশির ভাগটা উদ্ধার করা সম্ভব হবে। তিনশহাজার ডলার খরচ করাটা চাট্টিখানি কথা নয়। ট্রেভারসের কপালে ভাঁজ, আমার কিন্তু স্যার সন্দেহ হচ্ছে।

কিসের সন্দেহ?

আমি এলিসকে গত কয়েক বছর দেখেছি। ওরকম মুখচোরা, লাজুক, কাজে একাগ্র মেয়ের পক্ষে ব্যাঙ্ক ডাকাতি দূরের কথা, বয়ফ্রেন্ড যোগাড় করাটাও যেন অবাস্তব।

 তা বললে তো হবে না। শেরিফ আমাকে বলেছেন, এই শহরতলির অন্তত চারজন লোক তাকে তার বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ অবস্থায় দেখেছেন। এই চারজন হলেন ব্রাঞ্চ ম্যানেজার মিঃ কলেভিন। হোটেলের মালকিনীকিটি লোরিং, অবসর প্রাপ্ত মেজর হার্ডি এবং বৃদ্ধা মিসপীয়ারসন। এদের বক্তব্যকে তো উড়িয়ে দেয়া যায় না।

তা অবশ্য ঠিক।

 আসলে তোমার বয়স কম, মানুষ সম্পর্কে অভিজ্ঞতাও কম। আমরা বয়সের সঙ্গে দেখেছিও অনেক। যে সব পুরুষ বা মহিলাকে আপাত খুব নিরীহ, যৌনবোধশূন্য, অফিসসর্বস্ব, অসামাজিক বলে মনে হচ্ছে, তাদেরই কারুর কারুর বুকে লুকিয়ে থাকে নানা ধরনের লোভ, কামনা, বাসনা। ক্রেগ ঐ ধরনেরই একজন। ব্যাঙ্কে কাজ করতে করতে সে ধনী হবার স্বপ্ন দেখেছে, নানা রকম পরিকল্পনা করেছে। পরে জনী একার্সের মতন এক ডাকাবুকো ছোকরাকে দোসর পেয়ে কাজটাও হাসিল করে চম্পট দিয়েছে।

ট্রেভারস মাথা নাড়ে, তা হবে, কিন্তু মন থেকে কিছুতেই সায় দিতে পারে না।

পুলিশের চাকুরিতে আজকাল লোভী ও গোঁয়ার লোকের যতটা সমারোহ ঘটছে, বুদ্ধিমান লোকের ততটা নয়। অপরাধ ও সন্ত্রাসের জগতে যে পরিমাণ অগ্রগতি দেখা গেছে, পুলিশ ও গোয়েন্দা বিভাগের চাতুর্য তদনুযায়ী হচ্ছে না। এই অবক্ষয়টা এখন প্রায় সর্বত্র। ইস্টকে আদৌ বুদ্ধিদীপ্ত মনে হচ্ছে না। কেমন যেন একটা পূর্ব নির্ধারিত ধারণার বশবর্তী হয়েই সে কাজে নেমেছে। তবে এই ধরণের লোক সাহসী হয়ে থাকে। যদি চোখের সামনে তাদের একটা খুড়োর কল লাগিয়ে রাখা হয়, তবে সর্বশক্তি নিয়ে সে ছুটবে আর ছুটবে।

 দুজনে জিজ্ঞাসাবাদ করতে কিটি লোরিংয়ের কাছে গেল। কিটির অবস্থা দেখে ট্রেভারসের খুব খারাপ লাগে মিসেস লোরিং মদ খেয়েছে অথচ মদ ওর কাছে বিষের চেয়েও হানিকর। ইস্টন কিন্তু কিটিকে দেখে একেবারে মোহিত, সত্যিকারের রূপবতী, যৌবনবতী বলতে যা বোঝায়। ভরাট বুক, মাংসল পশ্চাৎদেশ, সরু কোমর, পা থেকে থাই অব্দি নির্লোম গোলাপী মুক্তাঙ্গন…ইস্টন যেন দুচোখে ওকে চাটছে। ওর কাছে মাভিস তো নেহাৎ পেত্নী। কিটির কথার দিকে তেমন মন না দিয়ে সে ওর শরীর নিয়েই নানারকম কল্পনা করে।

— ইস্টন–আপনি এলিসকে তার প্রেমিকের সঙ্গে দেখেছেন?

 কিটি–একাধিকবার।

ইস্ট-কোথায়? কোন প্রেক্ষাগৃহে?

কিটি-না। এই হোটেলের লনে।

 ইস্টন–লোকটার একটা বর্ণনা দেবেন?

কিটি–লম্বা চওড়া লোক। গালে একটা জড়ল, মোটা কালো গোঁনফ, মাথায় কপাল ঢাকা টুপি।

ইস্টন–গাড়িটার একটা বর্ণনা দিন না।

কিটি–যদ্দুর মনে পড়ছে, গাড়িটার মাথার দিকটা লাল বাকী অংশ বাদামী।

ইস্টন–ধন্যবাদ। দরকার হলে আবার আসবো। আমি কি একবার পলাতকার ঘরটা দেখতে পারি?

 কিটি–আলবাৎ। আসুন আমার সঙ্গে।

 তাদের এলিসের ঘরে নিয়ে যায় কিটি। তারপর নীচে রান্নাঘরে চলে গেল।

ইস্টন চকচকে চোখে কিটির যাওয়াটা দেখে বলেই ফেলে, আঃ! কী একখানা মাল মাইরি। গম্ভীর গলায় ট্রেভারর্স বলে, উনি আমার ভাবী শাশুড়ি।

তাই নাকি? ইস, আগে বলতে হয়–সে চটপট এলিসের ঘরে তল্লাশি শুরু করে। এই একটা কাজে সে কিন্তু সত্যিই দক্ষ। তার খেয়াল হয়, পালাবার আগে এলিস তার যাবতীয় বাক্স প্যাটরা সঙ্গে নিয়ে গেছে। এখানে ওখানে হাতাতে হাতাতে ব্যস্ত ইস্ট হঠাৎ বুঝি আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ পেয়ে গেল। সে খুশিতে ঝলমলিয়ে ওঠে–একটি চিঠি! টাইপ করা। নিচের কালিতে জড়ানো স্বাক্ষর

প্রিয়া,
আজ রাত দেড়টার মধ্যে আমরা তাহলে উড়ান দিচ্ছি। ব্যাঙ্কের পেছনের দরজাটা খুলে রাখবার সময় তোমার ম্যানেজারের নজর সম্পর্কে সতর্ক থেকে। তবে মনে হয়, সকলের কাছে তুমি খুব বিশ্বাসী হওয়ায় কাজটা তোমার পক্ষে মোটেই কঠিন হবে না। সর্বাঙ্গে আমার অজস্র চুম্বন নিও।
ইতি–
তোমার জনী।

 ইস্টনের হৃদপিণ্ড সাফল্যের গৌরবে লাফিয়ে উঠল, ট্রেভারসও চিঠিটা পড়লো। ইস্টন তাকে  বললো, বুঝলে হে, এই হচ্ছে মানুষের চরিত্র। জীবনে কত দেখলাম।

 বিশ্বাসের ভিত আলগা হয়ে গেছে ট্রেভারসের, সত্যি মানুষ চেনা সবচেয়ে কঠিন কাজ। মিস এলিসের মতন মেয়ে…।

মেজর হার্ডি এবং মিস পীয়ারসন ঐ একই অভিমতের শরিক–এলিসের মতন মেয়ে ভাগ্যক্রমে হয়তো একজন বয়ফ্রেন্ড যোগাড় করতে পারে, কিন্তু ব্যাঙ্ক ডাকাতি নৈব নৈব চ।

ইস্টন তাদের বললো, সে আপনাদের বিশ্বাসমর্যাদা রাখতে পারেনি। এই চিঠিটাই তার প্রমাণ।

অবশ্য ঐ চিঠিটাকে মেজর হার্ডি পাত্তা দিতে রাজি নয়। আরে রাখুন মশাই চিঠি-ফিঠি, কেউ তো শয়তানি করে ওটা ঐ ঘরে রেখেও যেতে পারে।

ট্রেভারসের চমক লাগে হার্ডির কথায়। বুড়োর কথায় যুক্তি আছে। এলিস হয়তো কোন জটিল ও প্রখর চক্রান্তের শিকার। তার কানে এলো, মেজর বলছে, মেয়েটাকে নির্ঘাৎ কিডন্যাপ করা হয়েছে। ওকে খুঁজে বের করুন, সব রহস্য ফাস হবে।

ফেডারেলের বড়কর্তার ফোন এলো ইস্টনের নামেডাউন সাইড স্টেশানে যাবার পথে ক্যালটের পেট্রল পাম্পের এক কর্মচারী নাকি ঐ দিন মাঝরাতে এলিস ও তার বয়ফ্রেন্ডের দেখা পেয়েছিল। তারা গাড়িতে তেল ভরতে এসেছিল শেষ রাতের সানফ্রান্সিসকোগামী ট্রেন ধরবার পথে। তখনই সেই পেট্রল পাম্পের উদ্দেশ্যে ইস্টন ট্রেভরসকে নিয়ে ছুটলো। ছোকরা কর্মচারী গলায় উত্তেজনা নিয়ে এলিস ও তার বয়ফ্রেন্ডের বর্ণনা দিলো। এলিসের গায়ে সেই বেঢপ কোট ও মাথায় বিচিত্র টুপি। তার বয়ফ্রেন্ডের গালে মস্ত জড়ল এবং মোটা গোঁফ। ওরা নিজেদের মধ্যে সানফ্রান্সিসকোগামী ট্রেন ধরা নিয়ে আলোচনা করছিল। ইস্টনের প্রত্যয় দৃঢ়তর। ট্রেভারস কিন্তু তখনো বলছে, একটা কথা ভেবে দেখুন স্যার, যারা টাকা নিয়ে পালিয়েছে তারা নিজেদের কেন এভাবে জাহির করবে? এলিসের বয়ফ্রেন্ড যেন নিজেকে চিনিয়ে দিতে তাদের গন্তব্যস্থানের হদিশ দিতে কত উদগ্রীব। গালে জড়ল, ঝাঁকা গোঁফ–এসব ছদ্মবেশ নয়তো? আর তা ছাড়া এই ছোট জায়গায় মাত্র চারজন লোক তাদের একসঙ্গে দেখতে পেয়েছে। আমি সন্ধান নিয়ে দেখেছি, ঐ রকম চেহারার ঐ নামের কোন লোক পিটভিলে থাকে না। অথচ, সে টাইপ করা চিঠি পৌঁছে দিল। তার মানে সে এখানে টাপইরাইটার সমেত থাকে। আর চিঠির চেয়ে টেলিফোনটা কি অনেক বেশি নিরাপদ নয়?ইস্টন প্রায় ফুঁসে উঠলো, সব মানুষের অভ্যেস কি এক রকমের হয়? অনেকে আছে, যারা দিনের মধ্যে পঁচিশবার বউকেই ফোন করে। আবার অনেকে আছে, টেলিফোনে কিন্দুবিসর্গ জানাবে না, কলম বা টাইপরাইটার নিয়ে বসবে। আর টাইপরাইটারের কথা বলছো? আজকাল তো অনেকে পকেট টাইপ রাইটার নিয়েই ঘোরাঘুরি করে থাকে। ওপরওয়ালার সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করবার পর ইস্টনের গর্ব ও উল্লাস আরো বৃদ্ধি পায়স তার তদন্ত করবার ধারাটিকে যথার্থ বলেছেন। নির্দেশ দিয়েছেন, একবার স্টেশনে গিয়ে যাচাই করে দেখতে সত্যি ঐদিন শেষ রাতের সানফ্রান্সিসকোগামী ট্রেনে চেপে ঐ রকম একজোড়া কেউ রওনা দিয়েছিল কিনা। ইতিমধ্যে এলিস ও তার দোসরের বর্ণনা রেডিও ও দূরদর্শন দপ্তরে পাঠানো হয়েছে। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই তাদের বিবরণ ছোট ছোট পর্দাতে প্রতিফলিত হবে।

কয়েক ইঞ্চি প্রসারিত ইস্টনের বুক। আত্মবিশ্বাস বাড়ছে। দৈবের আশীর্বাদ তথা যদি সুযোগ আসে, আমিও ফেডারেলের সিঁড়ি বেয়ে উঠতে পারি। আর সিঁড়ি বেয়ে ওঠানামা মানে চমকপ্রদ নারীসঙ্গের সুযোগ লাভ। যেমন ঐ কিটি। বাহ্! কে বলবে ঐ রমনী এক যুবতীর জননী। ইস্টন শিস দিয়ে ওঠে।  ইস্টন রেলস্টেশনে পৌঁছে প্রথম ধাক্কা খেল। না, সেদিন ডাউন সাইড স্টেশান থেকে শেষরাত্রের ট্রেনে কোন যাত্রীই এখান থেকে ওঠেনি সানফ্রান্সিসকোগামী ট্রেনে। অর্থাৎ এলিস ও.তার বয়ফ্রেন্ড রেলপথে যায়নি। এমনও হতে পারে, তারা এখনো পালায় নি। কোন এক গোপন স্থানে ঘাপটি মেরে বসে আছে। অথবা ১৯৫৯ মডেলের নির্জন গাড়িতে চেপেই তারা পাড়ি দিয়েছে। পিটসভিলের প্রতিটি বাড়িতে বাড়িতে আমরা এবার তল্লাশি চালাবো, ইস্টন বললো। ট্রেভারস কোন মন্তব্য করে না।