৩. জগদীশনারায়ণের কেস

।।।।

যেটা আমি জানতাম না সেটা হল, ছোটোমামা যখন জগদীশনারায়ণের কেস ফাইলগুলো দেখেছিলেন, তার বহু তথ্যই উনি একটা ডায়েরিতে টুকে রেখেছিলেন। একেনবাবু এর মধ্যেই সেটা হস্তগত করেছেন। আমি এ ব্যাপারে কিছুই জানি না, তার কারণ প্রমথ আর একেনবাবু দু’জনেরই ভয় ছিল, পৌষমেলায় না গিয়ে আমরা এখানে আসছি জানলে আমি কুরুক্ষেত্র বাঁধাব। তাই শেষ সময়ে আমাকে সারপ্রাইজ দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ এই সমস্ত কেসটাতেই আমি একটা ডিস-অ্যাডভান্টেজিয়াস পজিশনে। একেনবাবু অনেক কিছুই জানেন, প্রমথও বেশ কিছু জানে, আমার জ্ঞান শূন্য। দুপুরে খেতে বসার আগে একেনবাবুর কাছ থেকে মোটামুটি যা উদ্ধার করলাম, তার সংক্ষিপ্তসার হল:

রাজা জগদীশনারায়ণ যখন মারা যান, তখন তাঁর বয়স প্রায় আশি। তিনি বিপত্নীক ছিলেন –ছেলেপুলেও ছিল না। পূর্ববঙ্গে ওঁর বিরাট জমিদারি ছিল, কিন্তু তার বেশির ভাগই দেশ বিভাগের সময় খোয়ান। এদেশের এক ভদ্রলোকের সঙ্গে জমি-বাড়ি এক্সচেঞ্জ করে কিছু ক্যাশ টাকা পেয়েছিলেন; আর মৃত স্ত্রীর কিছু গয়নাগাটি –এই ছিল ওঁর সম্বল। সেই ক্যাশ টাকা আর সম্ভবত কিছু গয়নাগাটি বেচে বিশাল বাড়িটা করান। কেন? তার কোনো সদুত্তর নেই। তবে ওঁর মেজাজটা রাজার মতোই ছিল। তাই সব কিছু খুইয়েও প্রাসাদে থাকার অভ্যাসটা বোধহয় ছাড়তে পারেননি।

ওঁর কাজের লোক বলতে ছিল চারজন –একজন রান্না করত, আরেকজন ফাইফরমাশ খাটত। আর ছিল একটি ঠিকে ঝি, আর এক পার্ট-টাইম মালী। নিজে প্রাসাদের এক কোণে থাকতেন।

নিজের শোবার ঘরটা বাদ দিলে খাবার ঘর, বসার ঘর আর একটা অফিসঘর ছাড়া বাড়ির অন্যান্য ঘরগুলো বন্ধ অবস্থাতেই থাকত। পেছনের বাগানের লাগোয়া একটা ছোটো সার্ভেন্টস কোয়ার্টার বানিয়েছিলেন, কিন্তু কাজের লোকেরা কেউই সেখানে থাকত না। রাজা জগদীশনারায়ণ একলা শুতে ভয় পেতেন বলে তাদের দুজন জগদীশনারায়ণের শোবার ঘরের সামনে বারান্দায় ঘুমাত।

সিঁড়ির নীচে একটা খুপরিতে ওদের জিনিসপত্র থাকত। জগদীশনারায়ণের সঙ্গে বাইরের জগতের যোগাযোগ রক্ষা করতেন ওঁর এক সেক্রেটারি-কাম বাজার সরকার। এই ভদ্রলোকই সুরেশ মিত্র, যিনি সুবীরবাবুর নিজের বাবা।

জিনিসপত্র কেনাকাটা করা, কাজের লোকদের মাইনেপত্র দেওয়া, যেটুকু জমিজমা আছে সেটা সামলানো, টাকাপয়সার হিসেব রাখা –সংসারের প্রায় যাবতীয় কাজকর্ম সুরেশবাবুই করতেন। ১৯৫৫ সালে জগদীশনারায়ণ যখন ওঁর বাড়িটা তৈরি করাচ্ছিলেন তখন সুরেশবাবুর বাবা ছিলেন বিল্ডিং কনট্রাক্টরের সাইট সুপারভাইজার। বাড়িটা শেষ হয়ে গেলে জগদীশনারায়ণ সুরেশবাবুর বাবাকে ওঁর সেক্রেটারির কাজ অফার করেন। বছর কুড়ি চাকরি করার পর যখন সুরেশবাবুর বাবার মৃত্যু হয়, তখন সুরেশবাবুকে কাজে বহাল করেন। সুরেশবাবু সেই সময়ে বি.এ. পাশ করে একটা প্রাইমারি স্কুলে পড়াচ্ছিলেন। স্কুলের পাকা চাকরি না ছেড়েই একস্ট্রা টাকার জন্যে এই কাজটা নেন। জগদীশনারায়ণ ব্যাঙ্ক-ট্যাঙ্কে টাকা রাখায় বিশ্বাস করতেন না। কারণ ওঁর কোনো অ্যাকাউন্টের খবর পুলিশ উদ্ধার করতে পারেনি। পোস্ট অফিসে হাজার দশেক টাকা ছিল। পোস্ট অফিসের পাশ বই আর কিছু কোম্পানির কাগজ পুলিশ ওঁর অফিসঘরের সিন্দুকে পায়। কাগজগুলোর মূল্যও বিরাট কিছু নয় বড়জোর হাজার তিরিশেক হবে। এছাড়া সিন্দুকে আর কিছুই ছিল না-না গয়না, না ক্যাশ টাকা। টাকাকড়ি নিয়ে জগদীশনারায়ণ চিন্তিত ছিলেন এবং এই নিয়ে ওঁর সঙ্গে সুরেশবাবুর আলোচনার কথা বাড়ির কাজের লোকদের জেরা করে পুলিশ জেনেছিল। এও জেনেছিল যে, জগদীশনারায়ণ ওঁর পুরোনো কিছু মোহর আর একটা হিরে বিক্রি করার কথা ভাবছিলেন। ওটা বিক্রি করলে সব সমস্যা মিটে যাবে-ওঁদের কথাবার্তা শুনে এটাই কাজের লোকদের মনে হয়েছিল। এই নিয়ে অশোকনগরের এক গুজরাতি ব্যবসায়ী গজলাল প্যাটেলের সঙ্গে সুরেশবাবুর কথা হয়েছিল। গজলাল জগদীশনারায়ণের সঙ্গেও কথা বলে যান।

এর ঠিক কয়েকদিন বাদে, দিনটা স্মরণীয় দিন, ১৫ই অগাস্ট, তিনজন মুখে রুমাল বাঁধা লোক দুপুরবেলা যখন জগদীশনারায়ণ খেতে বসেছেন তখন বাড়িতে ঢুকে ওঁকে গুলি করে। কাজের লোকদুটো সঙ্গে সঙ্গে ভয়ে পেয়ে চম্পট দেয়। বহু দূরে গিয়ে কিছুক্ষণ লুকিয়ে থেকে পরে সাহসভরে সুরেশবাবুর স্কুলে যায় ওঁকে ঘটনাটা জানাতে। কিন্তু স্কুল তো বন্ধ। স্কুলের পাশে একটা বাড়িতে অন্য এক মাস্টারমশাই থাকতেন। তাঁকে ব্যাপারটা জানায়।

পুলিশ এসে সুরেশবাবুকে না পেয়ে, প্রথমে সন্দেহ করেছিল সুরেশবাবু এর মধ্যে জড়িত। ইতিমধ্যে একটা খবর আসে যে, গজলাল বলে একটি লোক মুম্বাইয়ের এক হিরের ব্যবসায়ীকে বারো লাখ টাকায় একটা হিরে বিক্রি করার চেষ্টা করছে। তখন পুলিশ গজলালকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে।

গজলালের বক্তব্য সে ওই হিরে আর কয়েকটা আকবরি মোহর দশ লাখ টাকা ক্যাশ দিয়ে জগদীশনারায়ণের কাছ থেকে কিনেছে। নিজে গিয়ে সুরেশবাবু আর জগদীশনারায়ণকে টাকাটা দিয়ে এসেছে। গজলালের কথাটা যদি সত্যি হয়, তাহলে সুরেশবাবুর দোষী হবার সম্ভাবনাটা আরও জোরদার হয়ে ওঠে। উনিই নিশ্চয়ই টাকাটা হস্তগত করে জগদীশনারায়ণকে খুন করিয়ে গা ঢাকা দিয়েছেন। সুরেশবাবুর বিরুদ্ধে ওয়ারেন্টও বেরিয়ে যায়। কিন্তু এর মধ্যে গ্রামের কয়েকজন লোক জগদীশনারায়ণের বাগান থেকে ফুল তুলতে গিয়ে বিশ্রী পচা গন্ধ পায়-যেটা আসছে সার্ভেন্টস কোয়ার্টার থেকে। খবর পেয়ে পুলিশ আসে। তারা দরজার তালা ভেঙ্গে আবিষ্কার করে মুখ-বাঁধা অবস্থায় পিছমোড়া করে হাত-পা বাঁধা সুরেশবাবুর পচা-গলা মৃতদেহ। এবার সন্দেহটা আবার গিয়ে পড়ে গজলালের উপরে। সুরেশবাবুর মৃতদেহটা সরানোর পর পুলিশের চোখে পড়ে পেছনের দেয়ালে নখের আঁচড়ে করা কিছু সাংকেতিক দাগ। সেখান থেকেই পুলিশ নিঃসন্দেহ হয় যে, গজলই খুনি।।

কী ধরণের সাংকেতিক দাগ সেটা আর শোনা হল না, তার আগেই লাঞ্চের ডাক পড়ল।