০২. বেন্টুমাসি

।। ।।

একেনবাবু বেন্টুমাসিকে ভালোভাবে চেনেন না। নইলে সেদিন ফিরে এসেই গোভিন্দ সন্ধানে তৎপর হতেন। কোনো কিছু একবার মাথায় চাপলে সেটা চট করে ভুলে যাবার লোক, আর যেই হোক, আমার বেন্টুমাসি অন্তত নন! দু’দিনও পার হয়নি, সাত সক্কালে ওনার ফোন! সাধারণত এই সময়ে আমি ঘুমে অচেতন, নিতান্ত আজ সরস্বতী পুজো বলে অ্যালার্ম দিয়ে উঠেছি। ফোনে তুলতেই, কী খবর, কেমন আছিস’ –কিছু নয়। আমাকে সোজা জিজ্ঞেস করলেন, “হ্যাঁ রে, একেন হদিশ পেল কিছু, কোনো সাড়া-শব্দ নেই তোদের?”

ভাগ্যিস একেনবাবু সামনেই বসে ছিলেন, আমি তাড়াহুড়ো করে একেনবাবুর হাতে ফোনটা ধরিয়ে দিলাম। তারপর ঝাড়া পাঁচ মিনিট একেনবাবুর তরফ থেকে শুধু “হ্যাঁ”

“তাই নাকি,”

“আচ্ছা,” আর “না” ছাড়া –আর কিছু কানে এল না!

ফোনটা নামিয়ে একেনবাবু মাথা চুলকোতে চুলকোতে বললেন, “মাসিমা স্যার, আমাদের ওপর খুব অসন্তুষ্ট হয়েছেন!”

প্রমথ বলল “দাঁড়ান, দাঁড়ান, এর মধ্যে আবার আমাদের কথাটা এল কোত্থেকে? খোঁজার ভার তো আপনার ওপর মশাই? “

আমি বললাম, “চুপ কর, ওঁকে আর জ্বালাস না। আচ্ছা সত্যিই, লোকটা গেল কোথায় বলুন তো?”

“নো আইডিয়া স্যার। গতকাল আমি ইনস্পেকটর লান্ডিকে ফোন করেছিলাম।”

“সে আবার কে?” একেনবাবুকে থামিয়ে প্রমথ জিজ্ঞেস করল।

“হোয়াইট প্লেইন্স পুলিশের লোক। ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্টের অফিসে একবার ওঁর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। সেই সূত্রেই …।”

“ও হরি! তার মানে আপনি এ-ব্যাপারে পুরোপুরি নিষ্ক্রিয় নন! আমাদের আড়ালে আবডালে অনেক কিছু চালিয়ে যাচ্ছেন!” প্রমথ ঠেস দিয়ে বলল।

“কী মুশকিল স্যার,” একেনবাবু আমাকে সাক্ষী মানলেন, “প্রমথবাবু এদিকে বলবেন টিমে নেই, আবার খেলতে না ডাকলে রাগ করবেন!”

“সত্যি,” আমি প্রমথকে বললাম, “তুই গাছেরও খাবি, তলারও কুড়োবি –সেটা তো চলে না!”

“তুই চুপ কর, আর ওকালতি করতে হবে না!” প্রমথ আমাকে ধমকে একেনবাবুকে হুকুম করল, “বলুন, যা বলছিলেন।”

“ও হ্যাঁ, স্যার, ইন্সপেক্টর লান্ডির কথা। উনিই গোভিন্দ জসনানির কেসটা হ্যাঁন্ডেল করছেন।”

“গোভিন্দ জসনানি! বাঃ, এই তো একটা নতুন তথ্য!”

“কী নতুন তথ্য স্যার?”

“এই যে পদবীটা বললেন, ‘জসনানি’ –সেইটে। এদ্দিন পর্যন্ত তো লোকটা ছিলেন সার্ভেন্ট গোভিন্দ! ঠিক আছে, চালিয়ে যান।”

“বলার বিশেষ কিছুই নেই স্যার। পুলিশের কোনো ধারণাই নেই যে, লোকটা কোথায়!”

“ব্যাপারটা সত্যিই খুব স্ট্রেঞ্জ,” আমি বললাম। “হঠাৎ এভাবে একজনের হাওয়ায় উবে যাওয়া!”

“হাওয়ায় উবে যাবে কেন,” প্রমথ বলল, “নিশ্চয়ই কারো বাড়িতে আছে, বা কাছাকাছি কোনো হোটেলে গিয়ে উঠেছে! এই ঠান্ডায় তো আর কারোর পক্ষে রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো সম্ভব নয়!”

“হোটেলে কখনোই ওঠেনি,” আমি বললাম। “তাহলে পুলিশ খবর পেত।”

“সেক্ষেত্রে অ্যানসার ইজ সিম্পল। লোকটা পরিচিত কারোর বাড়িতে উঠেছে। সুতরাং কাজ হচ্ছে চেনা-জানা সবাইকে ফোন করে খোঁজ নেওয়া। কী মশাই, ওরকম ভুরু কুঁচকে বসে আছেন কেন? কিছু ভুল বলছি?” প্রমথ একেনবাবুকে জিজ্ঞসে করল।

“কী যে বলেন স্যার, ভুল বলবেন কেন? আমি আসলে একটা অন্য কথা ভাবছিলাম।”

“আঃ, একটু ঝেড়ে কাশুন না! কী অন্য কথা?”

“মাসিমা একটু আগে বললেন যে, চেনা পরিচিত কারোর কাছ থেকেই নাকি কোনো খবর পাওয়া যায়নি। তাই উনি ভাবছেন যে, কোনো আমেরিকানের বাড়িতে গিয়ে হয়তো উঠেছে। আপনাদের কী মনে হয় স্যার?”

“আই ডাউট ইট,” আমি বললাম। “অন্য জায়গার কথা বলতে পারব না, তবে নিউ ইয়র্কের কেউই কোনও অচেনা লোককে বাড়ির ত্রিসীমানার মধ্যে আসতে দেবে না! কাজ দেওয়া তো দূরের কথা!”

“আমিও সেটাই ভাবছিলাম। তবে কিনা স্যার, আপনার হচ্ছেন এখানকার ভেটারেন লোক, এদের স্বভাবচরিত্র আপনারাই জানবেন বেশি।”

“তা হলে লোকটা গেল কোথায়?” প্রমথ খানিকটা আত্মগত ভাবেই প্রশ্নটা করল। “দ্য অ্যানসার টু দ্যাট পাজল উইল হ্যাভ টু ওয়েট। এখন যা, চানটান করে রেডি হয়ে নে। পুজোয় যাবি না!”

“ওই যাঃ, আপনাদের তো বলাই হয়নি স্যার! পুজোর কথায় মনে পড়ল। মাসিমা বললেন, আজ হোয়াইট প্লেইন্সেও সরস্বতী পুজো। সেখানে যদি যাই, তা হলে অরুণ, অশোক, মানে মিস্টার সাহানিদের সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে। আমাদের কথা মাসিমা ওঁদের বলেছেন। ওঁরাও স্যার খুব উৎসুক আমাদের সঙ্গে কথা বলতে।”

 “শুধু এই বলেছেন, না ওখানে যাবার হুকুম দিয়েছেন?” প্রমথ চোখ দুটো কুঁচকে প্রশ্নটা ছুঁড়ল।

“তা একরকম প্রায় হুকুমই স্যার।” একেনবাবু ধরা পরে স্বীকার করলেন। কিন্তু একটা ব্যাপারে আমি একটু কনফিউসড।”

“কী ব্যাপারে?”

“মাসিমা বললেন যে, জার্সি সিটিতে নাকি নেক্সট উইকে পুজো। সেটা কী করে হয়?”

“তার কারণ খুব সিম্পল মশাই, আমেরিকাতে দেশের মতো অত লগ্ন-ফগ্ন বিচার করে পুজো হয় না। পুজো করতে হলে করতে হবে উইকএন্ডে, সে আপনাদের পাঁজি যাই বলুক না কেন।”

প্রমথর কথা শুনে একেনবাবু হাঁ হয়ে আছেন দেখে আমি আবার যোগ করলাম, “শুধু তাই নয়, সব জায়গায় পুজো যদি একদিনে হয়ে যায়, তা হলে তো এক উইকএন্ডেই সব কিছু ফুরিয়ে গেল! ঘুরেঘুরে আমরা আনন্দ করব কী করে!”

“দিস ইস অ্যামেজিং স্যার, ট্রলি অ্যামেজিং!” একেনবাবু মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন।

.

সাধারণত আমরা ব্রুকলিনের একটা পুজোতে যাই। নিউ ইয়র্ক আর তার আশপাশ নিয়ে দুর্গাপুজোই হয় প্রায় গোটা দশেক। সরস্বতী পুজো তো অগুনতি! ভক্তি থাকলে অবশ্য যে কোনো পুজোয় গিয়ে অঞ্জলি দিলেই হয়। তবে আমি আর প্রমথ দু’জনেই হলাম অ্যাগনস্টিক। এইসব পুজোয়-ফুজোয় আমাদের বিশ্বাস নেই। আমাদের পুজোয় যাওয়ার একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে, পিওর অ্যান্ড সিম্পল আড্ডা মারা! সেটা আবার চেনাপরিচিত জায়গায় না গেলে হয়ে ওঠে না। সুতরাং আমার কাছে হোয়াইট প্লেইন্সে যাওয়াটা আউট অফ দ্য কোয়েশ্চেন, গেলে নিঃসন্দেহে প্রচণ্ড বোর হব! বিশেষ করে আমার বেন্টুমাসি যেখানে থাকবেন! তার ওপর গতকাল প্রচণ্ড বরফ পড়েছে। রাস্তাঘাট এর মধ্যে কতটা পরিষ্কার করেছে কে জানে! ক’দিন তবু টেম্পারেচারটা ফ্রিজিং পয়েন্টের ওপরে ছিল। কিন্তু আজ যা ঠান্ডা, রোদ্দুরেও বরফ গলবে না –এখন অ্যাকসিডেন্ট না হলেই বাঁচি! একেনবাবু অবশ্য আমাকে উৎসাহিত করার জন্য একটা বাড়তি আকর্ষণের কথা বললেন,

“ওখানে শুনলাম ভালো কালচারাল প্রোগ্রাম হয় স্যার।”

একেনবাবু আমেরিকাতে নতুন বলে ঠিক জানেন না যে, এখানকার বাঙালিদের কালচারাল সাইডটা আবার বড় উইক। ভালো প্রোগ্রাম মানে দু-চারটে আনট্যালেন্টেড নাছোড়বান্দা গাইয়ে হারমোনিয়ামে প্যাঁ পোঁ করে নর্মাল লোককেও পাগল করে ছেড়ে দেবে! কিন্তু আমার ওজর আপত্তি কেউই বিশেষ কানে তুলল না। প্রমথ যে প্রমথ, সেও দেখলাম হোয়াইট প্লেইন্সের দিকে ঝুঁকে বসেছে! আমি একা আর কত বাধা দেব! পুজোটা হচ্ছে হোয়াইট প্লেইন্সের একটা জুনিয়র হাই স্কুলে। প্রমথ ফোন করে শ্যামলদার কাছ থেকে ঠিকানা আর ডিরেকশনটা নিয়ে নিল।