০২. কলেজ যাবার পথে

।। ।।

সোমবার কলেজ যাবার পথে ডেভের দোকানে থেমেছি কফি আর ক্রোঁসার জন্যে, দেখি একটি মেয়ে দুধ কিনছে! ডেভ আমাকে দেখেই বলল, “তুমি একদম ঠিক সময়ে এসেছ।”

তারপর মেয়েটিকে বলল, “এই যে নাদিয়া, ইনিই প্রফসর ডে, যাঁর কথা সেদিন বলছিলাম। হি উইল বি এর টু হেল্প ইউ।” তারপর আমায় বলল, “এঁর হাজবেন্ডই এজে।”

কী হেল্প করব বোঝার আগেই নাদিয়া বলে মেয়েটি ঘুরে আমার সামনে এসে দাঁড়াল, “হাই, প্লিজ টু মিট ইউ।”

চমৎকার ফিগার। মুখটাও সুন্দর, তবে ওই ফিগারের সঙ্গে পাল্লা দেবার মতো নয়। গলাটা একটু ভারী, অ্যাকসেন্ট সুস্পষ্ট স্লাভিক। হয়তো বেশিদিন এদেশে আসেনি।

আমি উত্তর দিলাম, “সেইম হিয়ার।”

“আই ব্যাডলি নিড ইওর হেল্প।”

“মাই হেল্প!” আমি একটু অবাক হয়েই বললাম।

“আপনি একটু আমার অ্যাপার্টমেন্টে আসবেন? একটা জিনিস দেখাব।”

আমি হতভম্ব হয়ে ডেভের দিকে তাকাতে ডেভ বলল, আমি একটু আগেই দেখেছি। ইট ওয়াজ গ্রিক টু মি!”

“প্লিজ, দু’-এক মিনিটের বেশি সময় আপনার নষ্ট করব না।” মেয়েটি অনুনয় করল।

এরপর আর ‘না’ বলা যায় না।

হাঁটতে হাঁটতে নাদিয়া বলল, “আপনাকে এই সময় পেয়ে যাব ভাবিনি, নইলে ওটা সঙ্গে আনতাম।”

“আমি কিন্তু এখনও বুঝতে পারছি না, কীভাবে আপনাকে আমি হেল্প করতে পারি!”

“কাল রাতে আমি একটা ই-মেল পেয়েছি। ভেরি আর্জেন্ট লেখা, কিন্তু চিঠিটা ইংরেজিতে নয়। আমি এখানে কাউকেই চিনি না। আজ ভোরে ডেভ যখন দোকান খুলতে আসে তখন ওকে দেখিয়েছি। ও পড়তে না পেরে আপনার কথা বলল।”

আজকাল অবশ্য বিভিন্ন ভাষায় ই-মেল লেখা যায়। আমিও মাঝেমধ্যে পাই। সম্ভবত কোনো জাঙ্ক ই-মেল। জিজ্ঞেস করলাম, “ই-মেলটা কার কাছ থেকে এসেছে?”

“আমার কোনো ধারণাই নেই।”

“আজেবাজে ই-মেল কিন্তু অনেক সময়েই আসে। কে পাঠিয়েছে যদি না জানেন, ডিলিট করে দেবেন। আমি তো তাই করি।”

“আমিও তাই করি। কিন্তু ভাষাটা পড়তে পারছি না। যদি দরকারি কিছু হয়!”

“আই ডাউট ইট। আমিও মাঝেমধ্যে চাইনিজ বা জাপানিজ স্ক্রিপ্টে উলটোপালটা ই মেল পাই। খুলিও না। সোজা ডিলিট করি। চেনাজানা কেউ যদি আপনাকে খবর পাঠাতে চায়, তাহলে যে ভাষা আপনি জানেন তাতেই পাঠাবে।”

“আই হোপ ইউ আর রাইট।” বলে মেয়েটা আর কিছু বলল না।

কয়েক মিনিটের পথ। তার বেশির ভাগটাই গেল এলিভেটর অর্থাৎ দেশে যাকে লিফট বলি- তার অপেক্ষায়। পুরোনো লিফট ক্যাঁচকোঁচ করে অনেক আপত্তি জানাতে জানাতে ছ’তলায় উঠল। নাদিয়া দরজা খুলে ঘরে ঢুকে আমায় বসতে বলে ভেতরে গেল চিঠি আনতে। আমি আর বসলাম না। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘরটার চারদিক দেখলাম। আসবাবপত্র সবগুলোই বেশ পুরোনো। মনে হল অ্যাপার্টমেন্টের সঙ্গেই ছিল। এন্টারটেইনমেন্ট সেন্টারটা শুধু নতুন। একটা বড়সড় প্লাজমা টিভি তার মধ্যিখানে বসানো। সাইডে কতগুলো ইন্ডিয়ান টুকিটাকি জিনিস আর রাশিয়ান ডল। ওপরের তাকের একদিকে নাদিয়া আর তার ছেলে। অন্যদিকে একটা লোকের ছবি। চোখে সানগ্লাস, বোঝা যায় ভারতীয়। নিশ্চয়ই ওর স্বামী এজে ডাট।

নাদিয়া এর মধ্যে ওর ল্যাপটপ নিয়ে এসেছে। ই-মেলটা দেখাল। বাংলায় লেখা চিঠি –কোনো সম্বোধন নেই। ই-মেলের হেডিং ইংরেজিতে –‘ভেরি আর্জেন্ট’। নীচে লেখা

শেষ সতর্কবার্তা-Nadiya ত্যাগ করা আবশ্যক অথবা মৃত্যু…

বাংলাটা আড়ষ্ট এবং অশুদ্ধ –সরকারি নোটিসে অনেক সময় যেমন থাকে। নিঃসন্দেহে কারোর রসিকতা, তবে নট ইন এ গুড টেস্ট। নীচে কোনো নামও নেই।

নাদিয়া জিজ্ঞেস করল, “কী লেখা আছে?”

বন্ধু হলে মজা করে বলা যেত, মনে হচ্ছে আপনার কোনো প্রেমিকের চিঠি। কিন্তু যার সঙ্গে এই মাত্র পরিচয় হল, তাকে তো আর সেটা বলা যায় না!

একটা ব্যাপারে বিরক্তি লাগল, মেয়েটিকে যত সরল ভেবেছিলাম তা নয়। স্বামীর ওপর গোয়েন্দাগিরি চালাচ্ছে! বলেই ফেললাম, “চিঠিটা তো দেখছি আপনার স্বামীর ই-মেল অ্যাড্রেসে-এ পাঠানো হয়েছে!”

“হ্যাঁ,” নাদিয়া সপ্রতিভ ভাবেই বলল, “কলকাতায় ওর ই-মেল দেখার সমস্যা হয়। আমিই প্রতিদিন ওর ই-মেল চেক করি –যাতে দরকারি কিছু হলে ওকে জানাতে পারি। কাল রাতে এই ই-মেলটা দেখি। সকালে ডেভকে দেখাতে ও বলল হয়তো বাংলা– আপনি পড়তে পারবেন।”

“পড়তে পারছি, তবে এর মাথামুন্ডু নেই। আপনার স্বামী কবে আসছেন?”

“ও এখন প্লেনে।”

“উনি এলেই এটা ওঁর হাতে দেবেন। অনেক সময় বন্ধুদের মধ্যে চিঠিতে অনেক কিছু লেখা থাকে, শুধু বন্ধুরাই বুঝতে পারে।”

“এটা কোনো বন্ধুর চিঠি?”

“তাও বলতে পারব না।”

“কোনো নাম নেই নীচে?”নাদিয়া জিজ্ঞেস করল।

“না। ই-মেল অ্যাড্রেসটা থেকেও বোঝার উপায় নেই। xyz ইত্যাদি নানান অক্ষর দিয়ে @gmail.com খুব সম্ভবত এটা spam…junk mail।”

নাদিয়া আমার কথা কতটা বিশ্বাস করল বুঝলাম না। একটু উদ্বিগ্ন স্বরে বলল, “অন্য কিছু পড়তে পারছি না, কিন্তু আমার নামটা পড়তে পারছি। আমার সম্বন্ধে কি কিছু লিখেছে?”

“সেটা আমিও দেখলাম, হয়তো একই নাম দিয়ে হাজার হাজার জায়গায় পাঠিয়েছে, আপনার ক্ষেত্রে নামটা মিলে গেছে।”

নাদিয়া একটু চুপ করে রইল। “আমি জানি আপনার এখন তাড়া আছে। কিন্তু আপনার কি মনে হয় এতে ভয় পাবার কিছু আছে? আমি এখানে একা আছি ছেলেকে নিয়ে।”

“মনে হয় না,” আমি ওকে ভরসা দিলাম।

হয়তো আরেকটু পজিটিভলি কথাটা বলা উচিত ছিল। নাদিয়া আর কিছু বলল না।