১. দেশে থাকব বলে

সংখ্যার সংকেত – সুজন দাশগুপ্ত (একেনবাবু গোয়েন্দা কাহিনী)

।।।।

এবার প্ল্যান করেই আমরা তিনজন ন’মাসের জন্যে দেশে থাকব বলে এসেছি। আমি নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটি থেকে ছুটি নিয়ে রিসার্চের ছুতো করে যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে অতিথি অধ্যাপক হয়েছি। দেশেও থাকা হবে আর ছাত্র পড়াবার দায়িত্বও থাকবে না। সোনায় সোহাগা। রিসার্চের একটু-আধটু কাজ –সেটা করতে আমার ভালোই লাগে। প্রমথ ইউনিভার্সিটিকে পুরো গুডবাই করে ইন্ডাস্ট্রিতে চলে যাচ্ছে। ওর ফিঁয়াসে ফ্রান্সিস্কা সুইটজারল্যান্ডে গেছে অসুস্থ মায়ের কাছে শেষ সময়টা থাকবে বলে। সুতরাং নিউ ইয়র্কে একা থাকার কোনও মানে হয় না, তাই প্রমথও চলে এসেছে। তবে এসেছে একটা চাকরি পাকা করেই। জয়েন করবে ন’মাস বাদে। এবং আমার যদ্দুর ধারণা এবার নিউ ইয়র্কে ফিরে ওর চাকুরি এবং বিবাহ –দুটোই হবে। দু’জনের চোখই আজকাল যেরকম প্রেমঘন দেখি। তবে একেনবাবুও যে আমাদের সঙ্গে আসবেন সেটা ভাবিনি। উনি এখন নিউ ইয়র্কের লাইসেন্সড ডিটেকটিভ। হাতে দেদার কেস। কিন্তু উনিও দেখলাম টিকিট কেটে বাক্সপত্র গোছাচ্ছেন। প্রমথও অবাক। “আপনি আবার বাক্স গোছাচ্ছেন কেন? বেশ তো টু-পাইস আসছিল।”

“কী যে বলেন স্যার! আপনারা আর ম্যাডাম ফ্রান্সিস্কা ছাড়া নিউ ইয়র্কে কী আছে! তাছাড়া ফ্যামিলির ব্যাপারটাও তো আছে।”

প্রমথ যে প্রমথ –কটু কথা বলতে যার জুড়ি নেই। সেও দেখি চুপ।

এখানে বলি, ফ্যামিলি মানে একেনবউদি। একেনবউদির অবশ্যই একটা নাম আছে, সেটা হল মিনতি। কিন্তু একেনবউদি লিখে লিখে এমন অভ্যাসে দাঁড়িয়েছে, যে মিনতিবউদি লিখলে অন্য কারও কথা বলছি মনে হয়।

তিনজনের কেউই আমরা ন’মাস নিউ ইয়র্কে থাকছি না, তাই অ্যাপার্টমেন্টটা ছেড়ে দিয়ে একটু-আধটু যা ছিল, সেগুলো একটা স্টোরেজে জমা রেখেছি। ফিরে এসে আবার নতুন একটা জায়গা খুঁজতে হবে। এরকম ভালো লোকেশনে জায়গা পাওয়াটা সহজ হবে না। কিন্তু আমাদের অফিসের সেক্রেটারি বেভ ভরসা দিয়েছে, ও একটা কিছু জোগাড় করে রাখবে। বেভ খুবই রিসোর্সফুল, আর আমাকে পছন্দ করে। না না, প্রেম-টেম নয় যদিও প্রমথ সেটা মানতে চায় না।

আমরা যখন সেপ্টেম্বরে এসেছি তখন খুবই গরম। অক্টোবরে নভেম্বরেও গরমটা ঠিক কাটেনি। এখন ডিসেম্বর। শীতের আমেজ একটু একটু পাওয়া যাচ্ছে।

সেই সঙ্গে পশনটাও বেড়েছে। হাঁচি-কাশি ইত্যাদির কারণ ভাইরাস না পশন –সে বিতর্কে কার জয় হবে জানি না, কিন্তু ফলটা আমি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। ক’দিন ধরেই বেদম কাশছি। ভাগ্যিস আজ রোববার, কলেজ নেই। এই অবস্থায় কলেজ যাওয়া একটা বিড়ম্বনা।

সাধারণত রবিবার আমরা একেনবাবুর বাড়িতে আড্ডা মারি। আজকে প্ল্যানটা অন্যরকম। প্রমথ আগে থেকেই মাকে বলে রেখেছিল পাটিসাপটা খাবে। আমার আবদারে সব সময় সায় না দিলেও প্রমথর কথা মা ফেলতে পারেন না। সুতরাং বাড়িতে পাটিসাপটার আয়োজন হয়েছে। আমরা তিনজনে যখন চা খেতে খেতে পাটিসাপটা আসার অপেক্ষা করছি, তখন ছোটমামা ঘরে ঢুকলেন। ছোটোমামা রিটায়ার করার আগে বহুদিন আলিপুর জেলের জেলার ছিলেন।

প্রমথ ছোটোমামাকে চেনে, অপরিচিত শুধু একেনবাবু। উনি সোফায় বসতেই একেনবাবু সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলাম।

আমাকে অবাক করে দিয়ে একেনবাবু হাতজোড় করে একেবারে মাথা নুইয়ে বললেন, “আমি কিন্তু স্যার, আপনাকে আগে দেখেছি।”

“তাই নাকি!” একেনবাবুর মাথা নোয়ানো আর কথা বলার ভঙ্গীতে কৌতুক বোধ করলেন ছোটোমামা।

“হ্যাঁ স্যার, আপনি তো আলিপুর জেলে ছিলেন?”

ছোটোমামা রহস্য করতে ভালোবাসেন। চোখ কপালে তুলে বললেন, “সর্বনাশ, এ তো ভালো কথা নয়, তুমিও সেখানে কয়েদি ছিলে?”

“কী যে বলেন স্যার…”

“একেনবাবু এক কালে সি.আই.ডি-তে কাজ করতেন,” আমি বললাম।

“তাই বলো।”

তখন হিসেব করে বার হল, ছোটমামা যে বছর রিটায়ার করেন একেনবাবু সে বছরই পুলিশে যোগ দেন।

ছোটোমামাকে আমার খুবই পছন্দ। সত্যিকারের গোপ্পে লোক। জেলার ছিলেন বলে নানান ধরনের অপরাধীর সঙ্গে ওঁর পরিচয় হয়েছিল –তাদের জীবনের বহু ঘটনাই উনি জানতেন। সেই সব কাহিনিগুলো নিয়ে বই লিখলে ‘জরাসন্ধের লৌহকপাট’ হয়তো হত না, কিন্তু বইটার কাটতি হত।

কিন্তু লেখার কথা তুললেই ছোটোমামা বলতেন, “খেপেছিস, বানিয়ে বানিয়ে গল্প তো নয়, এগুলো সব সত্যিকারের সুখ-দুঃখের কাহিনি! বিশ্বাস করে যেগুলো লোকে বলেছে, সেগুলো লিখে নাম কিনতে আমি রাজি নই।”

“নামগুলো পালটে দাও আর বিভিন্ন চরিত্র পাঞ্চ করে এক একটা নতুন চরিত্র খাড়া কর।”

“তা মন্দ বলিসনি, তবে মনে হয় না এই বয়সে আমার লেখক হওয়া হবে বলে।”

লেখা প্রসঙ্গের সেইখানেই ইতি। তারপর আরম্ভ হতো নানান গল্প।

.

আজ আর লেখার কথা তুললাম না। সকালে পত্রিকায় পড়েছিলাম রাজা জগদীশনারায়ণের হত্যাকারী গজলাল প্যাটেল কুড়ি বছর শাস্তি ভোগ করে আলিপুর জেলে মারা গেছে। ছোট্ট কয়েক লাইনের খবর, চোখে কী করে পড়েছিল নিজেই জানি না। আলোচনা সেই নিয়েই শুরু হল।

গজলাল প্যাটেলের কেস নিয়ে এক কালে বেশ হইচই হয়েছিল। বয়স্কদের কারও কারও সে ঘটনা হয়তো মনে আছে। আমাদের জেনারেশনে সেটা মনে থাকার কথা নয়। আমি ঘটনাটা জানি, কারণ রাজা জগদীশনারায়ণকে আমার মা আর ছোটমামা দুজনেই চিনতেন। দাদুর বাড়ি ছিল হাবড়ায়। সেখান থেকে মাইল দশেক দূরে ছিল জদগীশনারায়ণের প্রাসাদতুল্য বাড়ি। এককালে পূর্ববঙ্গে ওঁর বিশাল জমিদারি ছিল, রাজা খেতাবটা বোধহয় তখনই পান। দেশবিভাগের কিছুদিন পর এদেশে চলে এসে কৈগাছিতে ওঁর বাড়িটা তৈরি করান। যখন উনি খুন হন তখন অবশ্য ওঁর পড়তি অবস্থা। দুপুর বেলায় খেতে বসেছিলেন, তিনজন আততায়ী হঠাৎ ঘরে ঢুকে ওঁকে গুলি করে। পুলিশ পরে তদন্ত করে আবিষ্কার করে যে স্থানীয় ব্যবসায়ী গজলাল প্যাটেল গুণ্ডাদের সাহায্য নিয়ে ওঁকে খুন করেছে। ঘটনাটা যখন ঘটেছিল তখন আমার বয়স বছর এগারো, অর্থাৎ প্রায় বাইশ বছর আগের ঘটনা।

গজলালের খবরটা ছোটোমামা নিজে পড়েননি, কিন্তু শুনেছেন। সকালে খবরটা পড়ার পর থেকে একটা প্রশ্ন আমার মাথায় ঘুরছিল, সেটাই প্রথমে জিজ্ঞেস করলাম। আমার ধারণা ছিল যাবজ্জীবন কারাবাস মানে চোদ্দো বছরের জেল। সেক্ষেত্রে গজলাল কুড়ি বছর জেলে থাকে কী করে?

ধারণাটা ভুল। ক্ষেত্র বিশেষে কুড়ি, পঁচিশ এমন কী তিরিশ বছরের কারাদণ্ডও হতে পারে। আর গজল শুধু একটা খুনের জন্য জেলে যায়নি, সাজা পেয়েছিল দু’টো খুনের জন্য। এটা ছিল আমার প্রশ্নের টেকনিক্যাল উত্তর। তবে এই প্রসঙ্গে যেটা ছোটোমামা বললেন, সেটা বেশ শকিং।

“দেখ, আমি ছিলাম জেলার। আমার দায়িত্ব ছিল সরকারি হুকুম মেনে কয়েদিদের ঠিকমতো দেখভাল করা, তারা দোষী না নির্দোষ –তার বিচার করা নয়। আমি অবাধে ওদের সঙ্গে মেলামেশা করেছি। কেন তাদের শাস্তি দেওয়া হয়েছে, সে নিয়ে প্রশ্ন করিনি। কেউ কেউ নিজের থেকেই এগিয়ে এসে তাদের অপকর্মের কথা স্বীকার করেছে। অনেকটা ক্যাথলিক খ্রিস্টান ফাদারের কাছে কনফেশন করার মতো। অনেকে আবার অভিযোগ জানিয়েছে বিনা অপরাধেই তাদের শাস্তি হয়েছে। সত্যি কি মিথ্যা, আমার পক্ষে জানা অসম্ভব। কিন্তু গজলালের কথার সুরে এমন একটা কিছু ছিল যে, ওকে অবিশ্বাস করতে পারিনি।”

“ভেরি ইন্টারেস্টিং স্যার,” একেনবাবু বললেন। “তারমানে আপনার ধারণা লোকটা খুন করেনি?”

“গজলাল নিজে খুন করেনি। গুণ্ডাদের এনে খুন করিয়েছিল বলে ওকে শাস্তি দেওয়া হয়েছিল। প্রশ্ন হল, সত্যি সত্যিই সেটা করিয়েছিল কি না। ওর কেসটা নিয়ে আমি তোমাদের সি.আই.ডি-র রথীন দত্তের সঙ্গেও আলোচনা করেছিলাম। রথীন দত্তকে চেনো?” একেনবাবুকে জিজ্ঞেস করলেন ছোটোমামা।

“নিশ্চয়ই স্যার, আমাদের সবার বস ছিলেন।”

“রথীন ছিল ওই কেসটার ইনভেস্টিগেটিং অফিসার। রথীন অবশ্য শিওর ছিল যে ওর তদন্তে কোনো ভুল নেই। হি মে বি রাইট। আমি শুধু আমার ফিলিং এর কথা বলছি। আসলে আমরা সবাই ছিলাম শাসনচক্রের শিকলে বাঁধা। রথীন যদি বুঝতেও পেরে থাকে কোথাও ভুল হয়েছে –সেটা শোধরানো সহজ ব্যাপার ছিল না।”

“আর এখন তো সেটা অসম্ভব স্যার।”

“ঠিক, গজলাল আমাদের আইন-আদালতের ঊর্ধ্বে চলে গেছে। তবে কী জানো, গজলালের ব্যাপারটা আমাকে এত নাড়া দিয়েছিল যে, রিটায়ার করার পরে, আমি ঠিক করেছিলাম নিজেই তদন্ত করব। কেস ফাইলও কিছু ঘেঁটেছিলাম, এমনকী কৈগাছিতে, মানে যেখানে রাজা জগদীশনারায়ণ খুন হয়েছিলেন সেখানেও গিয়েছিলাম লোকজনদের জিজ্ঞাসাবাদ করতে। কিন্তু ক’দিনের মধ্যেই বুঝলাম গোয়েন্দা হবার এলেম আমার নেই।”

প্রমথ বলে উঠল, “এলেমদার গোয়েন্দা তো এখানে আছেন, তাঁকে কাজে লাগান।”

ছোটোমামা একটু হেসে বললেন, “আগে ওকে চিনলে তো ভালোই হত।”

ইতিমধ্যে পাটিসাপটা এসে গেছে। তাতে আমরা মনসংযোগ করলাম।

আমাদের রান্নাঘরটা বসার ঘরের লাগোয়া। মায়ের কানে সবকিছুই যাচ্ছিল। আমাদের খাওয়ার মাঝখানেই মা বললেন, “একটা লোক যদি অকারণে জেলে গিয়ে পুরো জীবনটা কাটায়, তার জীবন তো যায়ই, তার বৌ-বাচ্চার জীবনও ধ্বংস হয়। ওর ফ্যামিলির কথা কিছু জানো বিনয়?”

বিনয় ছোটোমামার নাম। ছোটোমামা একটু চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, “স্ত্রী ছিল। প্রথম কয়েক মাস বছর তিনেকের একটা ছেলেকে নিয়ে আসত ওকে দেখতে। তারপর আর আসতে দেখিনি। পরে শুনেছি গজলই ওকে গুজরাতে বাপের বাড়ি চলে যেতে বলেছিল।”

আমরা সবাই একেবারে চুপ হয়ে গেলাম। বুঝলাম ছোটোমামা আর মায়ের ব্যথাটা কোথায়।

ক্রিসমাসের সময়ে আমার কয়েকদিনের ছুটি। ছুটির ঠিক দু’দিন আগে একেনবাবু ফোন করে বললেন, “আমি আর প্রমথবাবু দিন তিনেকের জন্যে কৈগাছি যাচ্ছি স্যার, আপনি আসবেন?”

এটা এত অপ্রত্যাশিত যে, আমি কী বলব ভেবে পাচ্ছিলাম না।

“কৈগাছি যাচ্ছেন মানে!”

“কী করব স্যার, আপনার বাড়ি থেকে ফেরার পথে প্রমথবাবু আমাকে যাচ্ছেতাই বকলেন। মাসিমার অনারে অন্তত আমার কেসটা নেওয়া উচিত ছিল।”

“কীসের কেস!”

“কেন স্যার গজলালের?”

“এটা আবার কী কেস, এর সাজা তো অলরেডি হয়ে গেছে! খুনিও ডেড।”

“কী যে বলেন স্যার, সাজা তো হয় শুধু সত্যের দরবারে।”

আমি বেশ বুঝতে পারছিলাম এই পুরো ব্যাপারটার পেছনে প্রমথ রয়েছে।

আমরা প্ল্যান করেছিলাম পৌষমেলায় শান্তিনিকেতনে যাব। প্রমথর উপর ভার ছিল থাকবার জন্য ওর মাসির বাড়িটা ম্যানেজ করা। নিশ্চয়ই সেটা করতে পারেনি। এখন আমাদের ডাইভার্ট করার চেষ্টা করছে কৈগাছিতে।

আমি বললাম, “প্রমথকে ফোনটা দিন।”

“প্রমথবাবুকে?”

“হ্যাঁ, ও নিশ্চয়ই আপনার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। আপনিই শুধু গোয়েন্দা নাকি? ছলচাতুরি আমি কিছু বুঝি না!”

“দিচ্ছি স্যার।”

প্রমথ ফোনটা তুলেই আক্রমণাত্মক ভঙ্গীতে বলল, “তুই কৈগাছি যেতে না চাস যাবি না। আমাদের একটা দায়িত্ববোধ আছে, আমরা যাচ্ছি।”

“দায়িত্ববোধ সম্পর্কে আমাকে তুই জ্ঞান দিস না। মাসির শান্তিনিকেতনের বাড়িটা ম্যানেজ করেছিস?”

“না, তার কারণ আমরা কৈগাছি যাচ্ছি। তোর ইচ্ছে হয় তো শান্তিনিকেতনে যা।”

“থাকব কোথায়?”

“দ্যাটস ইওর প্রবলেম।”