১০. ডায়েরি উদ্ধার

।। ১০৷৷

ডায়েরি উদ্ধার করতে সেই রাত্রেই আমরা সাহানিদের বাড়ি গেলাম। সাহানিদের বাড়িতে সে রাত্রে গেস্ট আসার কথা, তাও যখন ফোন করলাম অশোক বললেন, “ঠিক আছে, চলে আসুন।”

আমি এরকম ভাবে শর্ট নোটিসে কারুর বাড়ি যাওয়াটা পছন্দ করি না। লোকের ওপর শুধু শুধু ইম্পোস করা। কিন্তু মনে হল ডায়েরিটা একেনবাবুর হঠাৎ ভীষণ জরুরি দরকার! একেনবাবু বাইরে ভাব দেখান চূড়ান্ত ফ্লেক্সিবল, কিন্তু আসলে ভেতরে ভেতরে অসম্ভব রিজিড় আর একগুঁয়ে। ডায়েরিটা যখন দরকার, তখন সেই মুহূর্তেই দরকার!

নোটিস শর্ট হলেও আমাদের অভ্যর্থনার কিছুমাত্র কমতি হল না। ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই অরুণ কফির আয়োজন করলেন, আমি একটু আপত্তি জানাবার চেষ্টা করতেই বললেন, “কী মুশকিল, আমরা খাব না! শুধু কী আপনাদের জন্য করছি নাকি!”

অবশ্য এর আগেই যে একপ্রস্থ কফি খাওয়া হয়ে গেছে, সেটা টেবিলে পড়ে থাকা কাপগুলো থেকে বুঝলাম।।

ওঁদের গেস্ট দু’জন কমবয়েসি, নিশ্চয়ই অশোকের অফিসের। দু’জনেই খুব এক্সাইটেড হয়ে অফিসের নানান গল্প করছিল। আমি অবশ্য কিছুই শুনছিলাম না। কী হবে শুনে? গল্পের সেটিং জানা নেই, না চিনি ক্যারেক্টারগুলোকে, না জানি তাদের পাস্ট হিস্ট্রি! রসটা তাহলে পাব কোত্থেকে?

.

একেনবাবু ইতিমধ্যে নীচ থেকে ওঁর ডায়েরিটা উদ্ধার করে এনেছেন। নিতান্ত কফি খেয়ে সঙ্গে সঙ্গে উঠে আসা যায় না। নইলে তাই করতাম।

সাহানিদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আমরা ছোটো একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকলাম। রেস্টুরেন্টটা ইটালিয়ান। আমি অর্ডার করলাম শ্রিম্প স্ক্যাম্পি, প্রমথ নিল চিকেন পার্মাজাঁ। একেনবাবু রেস্টুরেন্টে অর্ডার দেবার বেলায় সাধারণত আমাদের লিড ফলো করেন। এবার ওস্তাদি করে পাস্তা আরাবিয়েত্তা অর্ডার করে খাবার সময় আফশোস করা শুরু করলেন।

“এ তো শুধু নুডুল আর ঝাল সস স্যার। আমি ভেবেছিলাম ল্যাম্ব-ট্যাম্ব কিছু থাকবে। দারুণ মিসটেক করলাম স্যার অর্ডারটা দিয়ে। কী করে খাই এটা?”

আমি বললাম, “কী আর করবেন, আপনি বরং আমার থেকে কিছুটা নিন।”

“তা কী করে হয় স্যার, আপনার তাহলে কম পড়ে যাবে!”কিচ্ছু কম পড়বে না, আপনি নিন।”

“তাহলে আপনি স্যার আমারটা একটু নিন,” বলেই একেনবাবু সস শুদু একগাদা পাস্তা আমার প্লেটে ফেলে দিয়ে শ্রিম্প স্ক্যাম্পির পুরো টেস্টটাই বরবাদ করে দিলেন। তারপর প্রমথকে জিজ্ঞেস করলে, “আপনি কী খাচ্ছেন স্যার?”

“চিকেন।”

“লুকস গুড! ওটাই স্যার আমার অর্ডার করা উচিত ছিল।”

“তাহলে নিন মশাই একটু। নইলে আমার আবার পেট খারাপ করবে।”

“আরে না না স্যার, আমার প্লেট একেবারে ফুল। এই তো বাপিবাবু এতগুলো চিংড়ি মাছ দিলেন।”

“তা বললে শুনব কেন মশাই! লোভ যখন একবার করেছেন, তখন নিতেই হবে!” বলে প্রমথ ওর কিছুটা পোরশন একেনবাবুকে দিল।

একেনবাবু এই সুযোগে ওঁর পাস্তার বাকিটুকু প্রমথকে পাস করে দেবার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু প্রমথ বলল, “না, ওসব আমি নিচ্ছি না। আপনার কর্মফল মশাই আপনি ভোগ করবেন।”

আমরা যেখানে বসেছিলাম, তার ঠিক সামনেই একটা বড় টিভি মনিটর।

সেখানে দেখি আমার একটা ফেভারিট পুরোনো গেম শো ‘টেল দ্য টুথ’ –এর রি-রান হচ্ছে। ‘টেল দ্য টুথ’ –এর প্রত্যেকটা শো-ই এক ধাঁচের। প্রথমে মোটামুটি একটা ইন্টারেস্টিং লোকের একটু ব্যাকগ্রাউন্ড দেওয়া হয়। তারপর সেই লোকটি ছাড়া আরও দুজন এসে দাবি করে, তারাই হচ্ছে সেই লোক। শো-তে প্রশ্ন করার জন্য কয়েকজন সেলিব্রেটি থাকে। তারা নির্দিষ্ট সময়ের ভেতরে এই তিনজনকে নানান ধরনের প্রশ্ন করে বের করার চেষ্টা করে, কে আসল, এবং কারা নকল!

ন্যাচারালি দর্শকরাও সেই সঙ্গে গেস করার চেষ্টা করে। শো-র শেষে যারা প্রশ্ন করছিল, তাদের বলা হয় নিজেদের অনুমানগুলো জানাতে। তারপর আসল লোকটি উঠে দাঁড়ায়।

এবার যে লোকটা এসেছিল, তার নাম, এডওয়ার্ড ব্র্যান্ডো। সে হচ্ছে একজন পেস্ট্রি মেকার। ব্র্যান্ডোর তৈরি পেস্ট্রি নাকি আমেরিকার তাবৎ গণ্যমান্য লোকে খেয়েছে! ওর স্পেশালিটি হচ্ছে ওয়েডিং কেক বানানো। মাত্র কয়েকমাস আগে এই নিউ ইয়র্কেই নাকি ব্র্যান্ডো একটা আট ফুট উঁচু ওয়েডিং কেক বানিয়েছে! ইত্যাদি, ইত্যাদি।

মাত্র আধ ঘন্টার শো। খেতে খেতেই শেষ হয়ে গেল। আমি আগে এই এপিসোডটা দেখিনি, তার ওপর শো-টা দেখছি বহুদিন বাদে। তাই খুব এনজয় করছিলাম। যথারীতি, প্রশ্নের শেষে শো-র হোস্ট গ্যারি মোর প্যানেলকে জিজ্ঞেস করলেন, আসল ব্র্যান্ডো কে? কে যে আসল, আমি তো কিছুতেই ভেবে পেলাম না। কিন্তু প্যানেলের সবাই দেখলাম একবাক্যে বলল, তিন নম্বর চেয়ারে বসা লোকটা।

তখন গ্যারি মোর বললেন, “উইল মিস্টার রিয়েল এডওয়ার্ড ব্র্যান্ডো প্লিজ স্ট্যান্ড আপ!”

কী আশ্চর্য! দ্য প্যানেল ওয়াজ রাইট!

একেনবাবুও একেবারে স্টান্ড! কিছুতেই ভেবে পেলেন না প্রশ্নকারীর তিন-তিনজনেই কী করে আসল লোকটাকে বের করে ফেললেন!

আমাকে বললেন, “আমার তো মনে হচ্ছিল স্যার, প্রত্যেকেই চমৎকার উত্তর দিয়েছেন! তিন নম্বরের বদলে দু’নম্বর উঠে দাঁড়ালেও মেনে নিতুম।”

প্রমথও নিশ্চয়ই ভুল লোককে বেছেছিল। তাই বলল, “ধস, যাকেই ভোট দিন না, থার্টিথ্রি পারসেন্ট চান্স যে, ইউ আর রাইট। আই বেট, আজ সবাই লাকে মেরে দিয়েছে!”

“মোটেও নয়,” বলে আমি প্রমথর সঙ্গে তর্ক জুড়তে যাচ্ছি। হঠাৎ খেয়াল করলাম একেনবাবু কেমন একটু অন্যমনস্ক।।

আমি বললাম, “কী ব্যাপার, সামথিং রং?”

একেনবাবু বললেন, “আই ওয়াজ এ ফুল স্যার। ইট ওয়াজ রিয়েলি সো সিম্পল!”

আমি আর প্রমথ অবাক হয়ে ওঁর দিকে তাকালাম। কী সিম্পল, কিসের কথা উনি বলছেন?

“এখনো লিঙ্কটা বুঝতে পারছেন না স্যার? টু ডেথস, অ্যান্ড ফ্রোজেন ফুড, আই মিন ইটস ডাম্পিং!”

“কী বলছেন মশাই যা তা? একটু খোলসা করে বলুন তো?” প্রমথ ধমকে বলল।

উনি উত্তর না দিয়ে বললেন, “স্যার, আপনাদের কাছে একটা কোয়ার্টার হবে, একটা জরুরি ফোন করতে হবে।”

.

প্রমথ একটা কোয়ার্টার দিতেই হুড়মুড় করে চলে গেলেন।

কিছুক্ষণ বাদে ফিরে এসে বললেন, “চলুন স্যার, আর একবার একটু মিস্টার সাহানিদের বাড়িতে যেতে হবে।”

আমি বললাম, “সে কী, কেন?”

“আপনি সেদিন বললেন না যে, ওঁদের ফ্রিজারটা চলছে, কিন্তু ভেতরটা ফাঁকা। সেটা মোটেও সুবিধার নয় স্যার!”

সত্যি কথা বলতে কি, আমি একেনবাবুর এই কথাটার কোনো অর্থই খুঁজে পেলাম না। উনি কি হঠাৎ খেপে গেছেন!

“তাতে হয়েছেটা কী?” প্রমথ বিরক্ত হয়ে বলল, “ইট ইজ নট গোয়িং টু গেট ড্যামেজেড ফর দ্যাট।”

“চলুন স্যার, আর কোনো প্রশ্ন করবেন না, আই অ্যাম স্টিল লিটল কনফিউজড।” কথাটা বলে একেনবাবু মুখে একেবারে কুলুপ দিয়ে বসে রইলেন।