০১. সকালে ঘুম ভেঙে গেল

ম্যানহাটানে ম্যানহান্ট – সুজন দাসগুপ্ত (একেনবাবু গোয়েন্দা কাহিনী)

।।।।

সকালে ঘুম ভেঙে গেল কিচেনে খুটখাট আওয়াজ শুনে। বুঝলাম প্রমথ আর একেনবাবু যথারীতি ওপরে উঠে এসে ব্রেকফাস্ট নিয়ে লড়ে যাচ্ছেন! এটা আমাদের প্রায় ডেইলি রুটিন। ব্রেকফাস্টটা আমার অ্যাপার্টমেন্টেই হয়, আর ডিনারটা নীচে প্রমথর অ্যাপার্টমেন্টে। অবশ্য শুধু প্রমথর অ্যাপার্টমেন্টে বলাটা আর ঠিক নয়। অবিনাশ চলে যাওয়ার পর একেনবাবু বেশ পাকাপাকি ভাবেই প্রমথর সঙ্গে অ্যাপার্টমেন্টটা শেয়ার করছেন। আসলে গত বছর উনি গেস্ট হিসাবে আমার কাছে এক মাসের মতো ছিলেন। সেই অল্প সময়ের মধ্যেই ম্যানহাটানে বিখ্যাত ‘মুনস্টোন মিস্ট্রি’ সলভ করে ওঁর একটা ফিল্ড হয়ে গেল যে, তার জোরেই এবার একটা ফুলব্রাইট স্কলারশিপ ম্যানেজ করে পুরোপুরি দু’বছরের মেয়াদে এখানে এসেছেন। আমাদের নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটিতেই ক্রিমিনোলজির ওপর রিসার্চ করছেন।

হাত-মুখ ধুয়ে বেরিয়ে এসে দেখি ফ্রেঞ্চ টোস্ট তৈরি হচ্ছে। খুন্তি হাতে ব্যস্ত একেনবাবু। মুখে আবার একখাবলা দাড়ি, চুলগুলো উসকোখুসকো, গায়ে আধময়লা পাঞ্জাবি, সেটাও আবার বিচ্ছিরিভাবে কোঁচকানো। পাশে দাঁড়িয়ে প্রমথ। হাত-পা নেড়ে প্রচন্ড ভাবে একেনবাবুকে ইনস্ট্রাকশন দিয়ে যাচ্ছে! আর একটু ভাজুন, ‘ব্যস, আর নয়, এবার উলটে দিন, ‘তেল বেশি গরম হয়ে গেছে, হিটটা একটু কমান,’ এইসব আর কি। একেনবাবু অনুগত শিষ্যের মত সেগুলো শুনছেন, আর গুরুকে মাঝে মাঝে প্রশ্ন করছেন, ‘কেমন হচ্ছে স্যার, ‘বেশি ভেজে ফেলছি না তো, ইত্যাদি।

ব্রেকফাস্টের মেইন কোর্সটা দেখেই আমার মেজাজ বিগড়োল। ফ্রেঞ্চ টোস্ট কথাটা শুনতেই শুধু গালভরা। আসলে ওটা হল প্লেন এন্ড সিম্পল ডিম-পাঁউরুটি ভাজা- নো পেঁয়াজকুচি, নো কাঁচালঙ্কা, নো কিছু! সায়েবরা আবার এগুলোই খায় মিষ্টি মিষ্টি মেপল সিরাপের সঙ্গে! কী ডেডলি কম্বিনেশন!

আমি প্রমথকে বললাম, “কী রে একটু পেঁয়াজ দিতে পারলি না?”

“ফ্রেঞ্চ টোস্টে!” প্রমথ চোখ কপালে তুলে বলল, “তুই একটা ইডিয়ট!”

“ফ্রেঞ্চ টোস্টের দরকার কী ছিল, আমাদের দেশি মতে করলেই তো পারতিস!”

“শুনছেন বাপিটার কথা,” প্রমথ একেনবাবুকে বলল, “এদিকে উনি উঠতে বসতে আমেরিকানদের তেল দেন, শুধু খাবার সময় হলেই ভেতো বাঙালি।”

“চুপ কর স্টুপিড, আমি মোটেও আমেরিকানদের তেল দিই না!” আমি প্রতিবাদ করলাম।

“থাক, আর নিজের সাফাই গাইতে হবে না। কষ্ট করে ব্রেকফাস্টটা খা। রাত্রে তো ফুল কোর্স বাঙালি খাবার জুটবেই।”

“তার মানে?”

“এর মধ্যেই ভুলে মেরে দিলি?” শ্যামলদার বাড়ি আমাদের নেমন্তন্ন না?

.

প্রমথর কথায় মনে পড়ে গেল। সত্যিই তো, শ্যামলদা আমাদের সবাইকে আজ ডিনারে ডেকেছেন। সাধারণত এরকম একটা সম্ভাবনায় আমি প্রচণ্ড উৎফুল্ল হই। কিন্তু আজকে হতে পারলাম না। অবশ্য তার কারণ শ্যামলদা বা রীনা বৌদি নন। ওঁরা দুজনেই অত্যন্ত অতিথিপরায়ণ লায়ন –হার্টেড লোক, যখন তখন আমাদের জুলুম সহ্য করেন। সত্যি কথা বলতে কি, এই নিউ ইয়র্কের আমেরিকান মরুভূমিতে বাঙালি ওয়েসিস বলতে যদি কিছু থাকে –সেটা হল এঁদেরই বাড়ি! কিন্তু ইদানীং সেখানে ঢোকার জন্য একটা বাড়াবাড়ি রকমের মাসুল দিতে হচ্ছে। মাসুলটা হল, বেন্টুমাসির বাক্যবাণে জর্জরিত হওয়া! বেন্টুমাসি হলেন আমার দূরসম্পর্কের মাসি, শ্যামলদার মা। মাস তিনেকের জন্য ছেলের কাছে বেড়াতে এসেছেন। না, গুরুজনদের নিন্দা করতে নেই আমি জানি। আসলে সব কিছুই হচ্ছে রিলেটিভ। বলতে কি, যে বিশেষ কারণে আমি বেন্টুমাসিকে সদা সর্বদা এড়াতে চাই, পুলিশের চাকরিতে ঠিক তার জন্যই লোকে রেগুলার প্রমোশন পেয়ে যায়! আমি ওঁর জেরা করার অসাধারণ ক্ষমতাটার কথা বলছি। মায়ের কাছে শুনেছি যে, ওঁর জেরার কাছে উত্যক্ত হয়ে বেন্টুমেসো নাকি একদিন প্রায় সন্ন্যাসীই হয়ে যাচ্ছিলেন! বাস্তবিকই, অত্যন্ত ডেঞ্জারাস মহিলা আমার এই বেন্টুমাসি! এদেশে এসে শুধু প্রথম ক’দিন একটু ড্যাম্প মেরে ছিলেন। এখন আবার ফুল ফর্মে। তার ওপর হঠাৎ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে, এখানকার ভারতীয়দের নিয়ে একটা উপন্যাস লিখবেন। ছেলেবেলায় স্কুলেরম্যাগাজিনে উনি নাকি দারুণ দারুণ সব ভ্রমণকাহিনি লিখতেন! সেই স্টাইলেই একটু রং টং ফলিয়ে একটা ভ্রমণ-কাম-উপন্যাস লিখে ফেলবেন, সেটাই হচ্ছে প্ল্যান! তার জন্য অবশ্য অনেক রসদ চাই। ফলে সামনে একবার পড়লেই হল! চেপে ধরে পেটের কথা মুচড়ে মুচড়ে টেনে বার করবেন!

.

শ্যামলদার বাড়ি খুব দূরে নয়, জার্সি সিটিতে। হল্যান্ড টানেল পার হওয়ার পর মাত্র পাঁচ মিনিট। আমরা পৌঁছলাম সন্ধ্যে সাতটা নাগাদ। বাইরের ঘরে লেজিবয় চেয়ারে হাত-পা ছড়িয়ে বসে আছেন বেন্টুমাসি। চুলে একটু একটু পাক ধরায় মুখটা আজকাল যেন আরও ভারিক্কি দেখায়। সোনালি ফ্রেমের চশমাটা নাকের ডগায় লাগানো। নাকের ঠিক নীচেই রোঁয়া রোঁয়া এত লোম যে, হঠাৎ গোঁফ বলে ভুল হতে পারে! আর তার বাঁ দিক ঘেঁসে কিসমিস সাইজের একটা আঁচিল। সাহেবদের দেশে এসেছেন বলেই বোধহয় শাড়ির ওপর একটা হাউসকোট চড়িয়েছেন! এমনিতেই উনি দশাসই, তার উপর বেঢপ সাইজের হাউসকোট, দেখে মনে হচ্ছে ছোটখাটো একটা পাহাড়।

“এই যে তোরা সব এসে গেছিস!” বেন্টুমাসি আমাকে আর প্রমথকে দেখে সোফা থেকেই চেঁচিয়ে উঠলেন, “কই, তোদের গোয়েন্দাবন্ধুটি কোথায়?”

“একেনবাবু গাড়িতে কী যেন ফেলে এসেছেন, সেটা নিয়ে আসছেন।” কথাটা বলেই আমি সুট করে কিচেনে গা-ঢাকা দিলাম।

রীনা বৌদি রান্নাঘরে ফিশফ্রাই করছিলেন। মুখ টিপে হেসে বললেন, “কী, মাকে বেশ এড়িয়ে এলেন যে!”

এরকম হাতেনাতে ধরা পড়ে যাব বুঝিনি! আমতা-আমতা করে বললাম, “না, না, বৌদি, আসলে ভাবলাম আপনার যদি কোনো হেল্প –মানে যোগান-টোগান দেয়ার দরকার পড়ে, সেইজন্যই …।”

“বুঝেছি, বুঝেছি,” রীনা বৌদি আমাকে থামিয়ে বললেন, “কিন্তু কোনো সাহায্যের দরকার নেই ভাই। বসে গল্প করুন, তাহলেই সাহায্য হবে!”

“থ্যাঙ্ক ইউ বৌদি।” বলে রান্নাঘরের সঙ্গে ব্রেকফাস্টের যে জায়গাটা সেখানেই জাঁকিয়ে বসলাম।

রীনা বৌদি ফ্রাই ওলটাতে ওলটাতে বললেন, “মা আজ আপনাদের জন্য অপেক্ষা করে বসে আছেন।”

“কেন বলুন তো?”

“একটা রহস্যের গন্ধ পেয়েছেন, তাই নিয়ে খুব উত্তেজিত! সকাল থেকে অনেক গবেষণা চলছে।”

ঠিক বুঝতে পারলাম না রীনা বৌদি ঠাট্টা করছেন কিনা। তাই দরজার ফাঁক দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বেন্টুমাসি কী বলছেন শুনবার চেষ্টা করতেই একেবারে চোখাচোখি হয়ে গেল!

“এই বাপি, রান্নাঘরে কী করছিস পেটুক কোথাকার! এদিকে আয়!”

এই ডাক কখনোই উপেক্ষা করা যায় না। গুটিগুটি সোফায় গিয়ে বসলাম। বেন্টুমাসি ইতিমধ্যে ওঁর পুরোনো প্রসঙ্গে ফিরে গেছেন, “বুঝলে একেন, একেবারে জলজ্যান্ত মার্ডার!”

মার্ডার কী করে জলজ্যান্ত হয়, সেটা অবশ্য বুঝলাম না। একেনবাবু কিন্তু অম্লান বদনে বললেন, “তাই নাকি ম্যাডাম, কী সর্বনাশ!”

“তোমার এই ম্যাডাম, ম্যাডাম ছাড় তো! মুখ দিয়ে কি মাসিমা কথাটা বেরোয় না?”

“না ম্যাডাম, মানে মাসিমা, নিশ্চয়ই বেরোয়।”

“তাহলে, সেটাই বলবে। ম্যাডাম কথাটা শুনলেই আমার গা জ্বলে! হ্যাঁ কী জানি বললে… সর্বনাশ … সর্বনাশ বলে সর্বনাশ! একেই বলে দুধকলা দিয়ে সাপ পোষা! যে তোকে এতদিন খাওয়াল, পরাল তাকেই কিনা শেষে খুন করলি!”

“কার কথা বলছ বেন্টুমাসি?” আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম।

“কার আবার, সাহানিদের বাড়িতে বেড়াতে এসে যিনি খুন হলেন, তাঁর সার্ভেন্টের কথা বলছি।”

কারোর উপর খুব না চটলে বেন্টুমাসি ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করেন না। কিন্তু সাহানি বলতে কার কথা বলছেন, ধরতে পারলাম না।

“কোন সাহানির কথা বলছো তুমি?” জিজ্ঞেস করলাম।

‘ক’টা সাহানি আছে তোদের এমুলুকে,” বেন্টুমাসি আমাকে ধমক দিলেন, “অরুণ আর অশোক ছাড়া?”

অরুণ বা অশোক কাউকেই আমি চিনি না। তবে শ্যামলদার কাছে ওদের গল্প অনেক শুনেছি। বড় ভাই অশোক আই.বি.এম বা ওরকম কোনো একটা বড় কোম্পানিতে কাজ করে, আর অরুণের একটা বিজনেস আছে। নিউ ইয়র্ক সিটির লাগোয়া হোয়াইট প্লেইন্স শহরে ওরা থাকে। শ্যামলদারাও আগে ওখানে থাকত। তাই এখনও খুব যাতায়াত আছে।

“কী বলছো তুমি, সাহানিদের গেস্টকে তাঁর কাজের লোকটা খুন করেছে?”

“না করেনি,” বিরক্ত হয়ে বেন্টুমাসি বললেন, “আমি তোদের বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলছি!”

“তা বলছি না। কিন্তু এটা যে মার্ডার সেটা তুমি জানলে কী করে! পুলিশ কি তাই বলছে?”

“আরে রাখ তোদের পুলিশ!” আমাকে এক ধমক দিলেন বেন্টুমাসি।

“আমাদের কি চোখ-কান নেই! আচ্ছা বল তো একেন, সার্ভেন্টটা যদি নির্দোষই হবে, তা হলে মনিব মরার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর বাক্স-প্যাঁটরা নিয়ে হাওয়া হল কেন?”

একেনবাবু দেখলাম প্রশ্নটা দিব্যি পাশ কাটিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “ভদ্রলোক মরলেন কী করে ম্যাডা… মাসিমা?”

শ্যামলদা এতক্ষণ চুপচাপ বসে ছিলেন। রান্নাঘর থেকে রীনা বৌদির ডাক শুনে উঠতে উঠতে বললেন, “ন্যাচারাল কজ। পিওর অ্যান্ড সিম্পল হার্ট অ্যাটাক।”

শ্যামলদার এই কথায় আমার আর সন্দেহ রইল না যে, বেন্টুমাসি তিল থেকে তাল করছেন!

“তোর তো সেই এক কথা,” পুত্রকে নস্যাৎ করলেন বেন্টুমাসি। “সবই যদি নর্মাল হবে, তাহলে অমন চুরিটা হবে কেন?”

.

শ্যামলদা ঘর থেকে বেরোবার আগে মাকে আড়াল করে আমার দিকে চোখটা একটু টিপে চলে গেলেন। অর্থাৎ ‘মার কথাগুলোকে গুরুত্ব দিস না।’

প্রমথ একটু ভারিক্কি চালে বলল, “আমার মনে হয়, এটা দুটো ইন্ডিপেন্ডেন্ট ব্যাপার। মানে এই ভদ্রলোকের মৃত্যু, আর চাকরের চুরিটা। এ দুটো মিক্স করা উচিত হবে না। বিশেষ করে ডেথটা যখন ন্যাচারাল।”

“তুই তো দেখছি তোর শ্যামলদার মতো কথা বলছিস! ধর, লোকটার খুব হার্টের ব্যামো ছিল, আর গন্ডায় গন্ডায় বড়ি গিলতে হতো। এবার ধর, ওই সার্ভেন্টটা ফন্দি করে আসল বড়ির বদলে ভেজাল কিছু দিয়ে দিল। তাহলে কী হবে, লোকটা হার্ট অ্যাটাকে মরবে না?”

বেন্টুমাসি যে এরকম বৈজ্ঞানিক ভাবে চিন্তা করবে, সেটা আমি কিন্তু স্বপ্নেও ভাবিনি। তবে প্রমথটা হচ্ছে গোঁয়ার। বলল, “না বেন্টুমাসি, ইট ডাজ নট মেক সেন্স। সেটা হবে, কিলিং এ গুজ দ্যাট লেইজ গোল্ডেন এগস। যে খাওয়াচ্ছে, পরাচ্ছে –তাকে মারা মানেতো রুইনিং ওয়ানস স্টেডি সোর্স অফ ইনকাম!”

“থামা তো বাপু তোর ইংরেজি কচাকচি! কচু বুঝেছিস!” প্রমথ তাও ছাড়ে না। বলল, “কেন কচু বুঝব? মারার কী মোটিভ থাকতে পারে?” বেন্টুমাসি হতাশ ভাবে মাথা নাড়লেন। “নাহ তোর মাথায়ও দেখছি বাপির মতোই গোবর! খামোখা কি মেরেছে! যেই জানতে পেরেছে যে, মনিবের ব্যাগ হিরে জহরতে ভর্তি, সঙ্গে সঙ্গে মুখে বিষ তুলে দিয়েছে!”

“বিষ?”

“ওই হল। মরণাপন্ন হার্টের রুগিকে ওষুধ না দেওয়া, আর বিষ তুলে দেওয়ার মধ্যে তফাত কোথায়?”

“পুলিশে মিসিং রিপোর্টটা করা হয়েছে তো?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।

“তা কী আর হয়নি। কিন্তু এখানকার পুলিশগুলো সব অকস্মার ভেঁকি! প্রতিদিন টিভিতে দেখিস না, গণ্ডায় গণ্ডায় লোক খুন হচ্ছে। ধরতে পারছে কাউকে? সে জন্যই একেনের ওপর খোঁজার ভারটা আমি দিতে চাই। সার্ভেন্টটাকে ধরতে পারলেই সব কিছু পরিষ্কার হয়ে যাবে। কী একেন চুপ করে আছ যে?” বেন্টুমাসি প্রশ্ন করলেন।

“কিছু না মাসিমা, একটু ভাবছিলাম। “ এবার খুব সতর্ক হয়ে মাসিমা’ বললেন একেনবাবু। বেন্টুমাসি বলে কথা!

“শুধু ভাবলে চলবে না, কাজে লেগে যাও। আর কোনো কেস আছে নাকি তোমার হাতে?”

“না, তা ঠিক নেই।”

“কেন বাপু, কেউ আর ডাকছে না তোমায়?”

“আসলে আমি এবার এখানে এসেছি শুধু রিসার্চ করতে, সেইজন্যই…।”

“এটা আবার কী রকম কথা বললে! গোয়েন্দারা যদি শুধু গবেষণা করেই কাটায়, তাহলে খুনে বদমাশদের ধরবে কে?”

“তা তো বটেই,” একেনবাবু কাঁচুমাচু মুখে একটু হাসলেন।

“ব্যস, তাহলে আর কী, কাজ শুরু করে দাও।”

“তা করব। আসলে সময়েরই যা একটু অভাব, মানে…।”

“ঘুম থেকে কখন ওঠো?”

“আজ্ঞে?”

“জিজ্ঞেস করছি, ঘুম ভাঙে কখন?”

“এই সাতটা নাগাদ।”

“কখন শুতে যাও?”

“শুতে শুতে প্রায় এগারোটা হয়।”

“বল কী, এই ছেলে ছোকরা বয়সে আট ঘন্টা ধরে ঘুমোচ্ছ! রাত্রি বারোটায় শোবে, ভোর পাঁচটায় উঠবে। যাও, তিন ঘন্টা তোমার একস্ট্রা সময় করে দিলাম, খুঁজে বের করো ব্যাটাকে। আর এই বাপি আর প্রমথটাকেও কাজে লাগাও। এইসব করে যদি ওদের বুদ্ধিটা একটু খোলে!”

প্রমথটার কী স্পর্ধা, বলে কিনা, “বাপিকে বলছ বলো বেন্টুমাসি, কিন্তু আমাকে গালমন্দ করছ কেন?”

বেন্টুমাসি সেই ছেলেবেলার মতো চটাস করে প্রমথর মাথায় চাঁটা মারলেন, “চুপ কর! তোকে দেখছি সেই এইটুকুন থেকে। তারপর শুধু লম্বাতেই বেড়েছিস, বুদ্ধিতে আর বাড় হয়নি!”

এমন সময় শ্যামলদা ঘরে ঢুকে বলল, “মা, তোমার যা বলার শেষ হয়েছে?”

প্রমথ চট করে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “অনেকক্ষণ, কেন বল তো শ্যামলদা?”

“আরে একটা দুর্দান্ত ফ্রিজার কিনেছি, তোদের দেখাব।”

ফ্রিজার দেখার আমার এতটুকু উৎসাহ নেই, কিন্তু বেন্টুমাসির হাত থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য আমি বললাম, “তাই নাকি? ওয়ান্ডারফুল, চলো চলো!”

বেন্টুমাসি স্বগতোক্তি করলেন, “মোলো যা, বরফকল কখনো দেখিসনি আগে?”

সিঁড়ি দিয়ে বেসমেন্টে নামতে নামতে শ্যামলদা বললেন মায়ের কাছে বসে বোর হচ্ছিস বলে নিয়ে এলাম। তবে ফ্রিজারটা খুব ভাল দাঁওয়ে পেয়েছি। লেস দ্যান থ্রি হানড্রেড!”

শ্যামলদা ভুল বলেননি। থার্টি টু কিউবিক ফিটের একটা বিশাল ফ্রিজার!

“এত বড় ফ্রিজার দিয়ে করবে কী, এর মধ্যে তো বাঘ লুকিয়ে থাকতে পারে!” আমি প্রশ্ন করলাম।

“আরে বুদ্ধিটা সেদিন অশোক সাহানি দিল। মাছ-মাংস বা ফ্রোজেন খাবার সস্তায় পেলেই একগাদা কিনে ফ্রিজারে ঢুকিয়ে ফেলব, তারপর মাসের পর মাস খাব! ইনফ্যাক্ট, ও ক্যালকুলেট করে দেখাল, দেড় বছরের মধ্যে ফ্রিজাররের দাম উঠে আসবে!”

“নাহ, তোমাদের বাড়ি আর আসব না।” প্রমথ নাক সিঁটকে বলল, “এলেই ছ-মাসের পুরোনো মাছ খাইয়ে দেবে।”

“স্টুপিডামো করিস না!” শ্যামলদা ধমক দিলেন। “সুপারমার্কেট থেকে যখন মাছ। কিনিস, তখন কি তোর জন্য নদী থেকে ওগুলো ফ্রেশ তুলে আনে? জায়ান্ট ফ্রিজারে ওগুলো যেসব স্টোর করা থাকে, সেটা জানিস না!” ।

একেনবাবু এতক্ষণ ফ্রিজারটার দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে শ্যামলদার কথাগুলো শুনছিলেন। মাথা নাড়তে নাড়তে ওঁর অনুকরণীয় ভঙ্গীতে মন্তব্য করলেন, “দিস কানট্রি ইস ট্রলি অ্যামেজিং স্যার।”

খাবার সময় আমরা আবার বেন্টুমাসির খপ্পরে পড়লাম। ফলে রীনা বৌদির দুর্দান্ত রান্না যে একটু প্রাণভরে উপভোগ করব, তা আর হয়ে উঠল না। ওঁর মাথায় এখন রহস্যের পোকা ঢুকেছে, সেটাকে তাড়াবে কে? ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সেই এককথা! যিনি মারা গেছেন তাঁর নাম অন্তত কুড়ি বার বললেন বেন্টুমাসি, পাছে একেনবাবু ভুলে যান। অথচ নামটা এমন কিছু কমপ্লিকেটেড নয়, শ্যাম মিরচন্দানি। আর সার্ভেন্টটার নাম হল গোভিন্দ। সাধে কি আর শ্যামলদার ওখানে যেতে চাই না!

.

বিকেলে ফেরার পথে একেনবাবু হঠাৎ বললেন, “একটা জিনিস ইন্টারেস্টিং স্যার, এদেশে মেডসার্ভেন্ট দেখেছি। কিন্তু কারো বাড়িতে কখনও সার্ভেন্ট দেখিনি।”

“তার কারণ মশাই অতি সিম্পল,” প্রমথ বলল। “এখানে আপনি শুধু চেনেন আমাদের বন্ধুদের। হাই সোসাইটিতে যান না, বাটলার, সার্ভেন্ট, গর্ডনার, কুক সব কিছুই পাবেন।”

আমি বললাম, “একেনবাবুর অবজার্ভেশনে কিন্তু কোনো ভুল নেই এখানকার অনেক বড়োলোক ইন্ডিয়ান দেশ থেকে মহিলাদের নিয়ে আসেন বাড়ির কাজ করার জন্য। কিন্তু কাজের লোক কেউ এনেছেন বলে শুনিনি। আই ওয়ান্ডার হোয়াই!”

এ নিয়ে অবশ্য আর কোনো কথা হল না। যথারীতি একেনবাবুর চিন্তা ইতিমধ্যে অন্যদিকে চলে গেছে। বললেন, “যাই বলুন স্যার, আপনার বেন্টুমাসি কিন্তু খুব ফোর্সফুল মহিলা।”

প্রমথ বলল, “এত ভদ্রতা করছেন কেন মশাই, বলুন না জাঁহাবাজ!”

“ছি, ছি, কী যে বলেন স্যার, বাপিবাবুর মাসি!”

“আমারও তো পাড়াতুতো মাসি তা বলে মুখে এক পেটে একের মধ্যে আমি নেই।”