০৫. চাইনিজ রেস্টুরেন্ট

।।।।

বাড়িতে ফিরে স্নান-টান সেরে আমরা বেরলাম। কাছেই একটা চাইনিজ রেস্টুরেন্ট ছিল। আগে কোনো দিন যাইনি, ভাবলাম এক্সপেরিমেন্ট করে দেখা যাক। একেনবাবু মেনু দেখে খুব সন্তুষ্ট।

“চাইনিজরা খুব এফিসিয়েন্ট স্যার, ইন্ডিয়ার রেস্টুরেন্টের থেকে অনেক কম দামে খাবার দিচ্ছে।”

“এতে এফিসিয়েন্সির কি আছে? ফ্রেঞ্চ রেস্টুরেন্টের খাবারের তো অনেক বেশি দাম। ওদের থেকে কি ইন্ডিয়ানরা বেশি এফিসিয়েন্ট?”

“এটা ভালো বলেছেন স্যার। একেবারে মোক্ষম বলেছেন!” তারপর মেনুতে চোখ বোলাতে বোলাতে বললেন,”আচ্ছা স্যার, নাদিয়া ম্যাডামের এটা কি দ্বিতীয় বিয়ে?”

“কেন বলুন তো?”

“না ছেলের বয়স তো বছর চারেক মনে হল। আর বিয়ে তো বললেন মাত্র এক মাস। আগে হয়েছে।”

“কেন অবিবাহিত অবস্থায় কারও বাচ্চা হতে পারে না?”

“তা পারে স্যার, সেটা তো বায়োলজিক্যাল ব্যাপার। আমি সোসাইটির কথা ভাবছি।”

“সোসাইটিও পালটাচ্ছে একেনবাবু। অবিবাহিত মেয়েদের বাচ্চা তো হামেশাই হচ্ছে এদেশে।”

“তাও তো বটে। আচ্ছা স্যার, টিভির নীচে পাঁচটা ডল লক্ষ্য করলেন? কেমন বড় থেকে ছোট!”

“ওগুলো টিপিক্যাল রাশিয়ান ডল –একটার মধ্যে একটা ঢুকে যায়।”

“ও হ্যাঁ, মাত্রিওস্কা ডল। “আপনি তো সবই জানেন, অথচ ভাব দেখান কিছুই জানেন না!”

“কী যে বলেন স্যার, কত শিখছি আপনাদের কাছ থেকে! আচ্ছা স্যার, কিংস্টন। উডস্টকের থেকে কত দূরে?”।

“খুবই কাছে, কেন বলুন তো?”

“শুনলাম কিংস্টনে একজন মার্ডারড হয়েছে। লোকটা সম্ভবত ইন্ডিয়ান।”

“কার কাছ থেকে শুনলেন?”

“ডি. সি থেকে যখন ফিরছিলাম, ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট সঙ্গে ছিলেন। উনিই বললেন।”

“ও মাই গড, লোকটা কি নাদিয়ার স্বামী এজে ডাট হতে পারে? নাদিয়ারাও তো উডস্টকের কাছে থাকত বলল!”

“এখন তো আর থাকেন না স্যার। তাছাড়া এদেশে তো এখন কত ইন্ডিয়ান থাকে।”

“তা হোক, আপনি এখুনি খোঁজ নিন লোকটার পরিচয় কিছু উদ্ধার হয়েছে কি না!”

আমার বলার কোনো প্রয়োজন ছিল না। একেনবাবুর মোবাইল বেজে উঠল। আমার ধারণা একেনবাবু কলটা এক্সপেক্ট করছিলেন, নইলে অকারণে মোবাইল ‘অন’ রাখার পাত্র উনি নন। ঠিকই ধরেছি, ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট।

একেনবাবুর দিক থেকে ‘হ্যাঁ স্যার’, ‘ঠিক স্যার’, ‘আপনি শিওর স্যার’, ইত্যাদি ছাড়া আর কিছুই শুনলাম না। ফোন শেষ হবার পর মনে হল একেনবাবুর মুখটা একটু যেন। গম্ভীর।।

“কী ব্যাপার, কোনো বাজে খবর?”

এর মধ্যে ওয়েটার এসে খাবার দিয়ে গেছে।

“না, না, আসুন স্যার, খাওয়া যাক।”

একেনবাবু যখন কোনো কথার উত্তর দেন না, তখন একশোবার জিজ্ঞেস করেও কোনো লাভ নেই। তাই খেতে শুরু করলাম।

একটু বাদে একেনবাবু বললেন, “বুঝলেন স্যার, নামের মিল নামেই শেষ হয়।”

“কথাটার মানে কী?”

“নাম থেকে লোক চেনা মুশকিল। আমার এক কলিগের বন্ধু নবীন শাহ থাকে ওয়াশিংটন ডি.সি.- তে। নম্বর জানতাম না। টেলিফোন ডিরেক্টরিতে দেখলাম বারো জন নবীন শাহ!” ।

“শেষ পর্যন্ত খোঁজ পেলেন?”

“নাহ, সময় পেলাম কই।”

“সেটা তো বুঝলাম, কিন্তু হঠাৎ এই প্রসঙ্গটা এল কেন?”

“আসলে স্যার, ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট বললেন, যে লোকটি খুন হয়েছেন, তাঁর নাম অজয় দত্ত। তবে ইনি নিশ্চয় অন্য কেউ। দেশে বিয়ে করতে গিয়েছিলেন।”

“মাই গড! নাদিয়ার স্বামীর নাম তো এজে ডাট!”

“তা ঠিক স্যার, কিন্তু তিনি তো বিয়ে করে গিয়েছিলেন, আর ইনি তো বিয়ে করতে গিয়েছিলেন। বিগ ডিফারেন্স!”

“কি বলছেন যা তা! এটা তো জাস্ট টাইমিংয়ের সমস্যা! আর পুলিশ এর মধ্যে এত ডিটেল্স জানলই বা কী করে!”

একেনবাবু চুপ করে রইলেন। “আই হোপ এ অন্য কেউ। নাদিয়ার স্বামী হলে আমার অপরাধবোধের সীমা থাকবে না।”

“কেন স্যার?”

“দেখুন, চিঠিটার নানা অর্থ হতে পারে। বাজে ভাবে এটা ধরলে এজে-র লাইফ কুড হ্যাভ বিন ইন ডেঞ্জার। কিন্তু আমি তো সেটা ওকে জানাইনি!”

“ট্রু স্যার, নাদিয়াকে পরিত্যাগ করা আবশ্যক অথবা মৃত্যু’ –সেটাই তো বোঝায়। কিন্তু স্যার পরিত্যাগ করার সুযোগটা তো দিতে হবে। তার আগেই যদি খুন করে ফেলা হয়, তাহলে চিঠিটার কোনো মানে থাকে না।”

“ওইটেই বাঁচোয়া। রসিকতার পাল্লাটা ওটাই ভারী করেছে। কিন্তু কে এই অজয় দত্ত? আপনি চেক করে দেখবেন না?”

“কেন দেখব না স্যার। খাওয়া-দাওয়ার পরই একবার পুলিশ স্টেশনে যাব। সেরকমই কথা হল স্টুয়ার্ট সাহেবের সঙ্গে।”

ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্টের অফিসটা খুব দূরে নয়। আমি উত্তেজনা চেপে রাখতে পারছিলাম না। প্রায় গোগ্রাসে খেলাম। একেনবাবুর ভ্রূক্ষেপ নেই। “তাড়াতাড়ি করছেন কেন স্যার, আমরা তো আর ট্রেন ধরতে যাচ্ছি না।”

“কী মুশকিল, এ যদি সেই অজয় দত্ত হয়!”

“হলেই বা আমরা কী করতে পারি স্যার? বসুন, স্যার বসুন, রিল্যাক্স করুন। চাইনিজ রেস্টুরেন্টে যখন এসেছি, ফ্রায়েড আইসক্রিমটা মিস করব না!” ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট অফিসে ছিলেন না। কিন্তু ছবিটা দেখানোর ইনস্ট্রাকশন দিয়ে গিয়েছিলেন। ছবিটা দেখে আমার বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল। নাদিয়ার অ্যাপার্টমেন্টে যে ছবি দেখেছিলাম তার সঙ্গে এই মৃত লোকটির মুখের মিল একেবারে সুস্পষ্ট। অর্থাৎ শুধু নামেরই মিল নয়! এই ডেডম্যানই নাদিয়ার স্বামী এজে!

আমার যে কী খারাপ লাগছিল বোঝাতে পারব না! একেনবাবুকে বললাম, “নাউ আই ফিল টেরিবলি গিল্টি, এজেকে লেখা চিঠিটার অর্থ নাদিয়াকে বলিনি বলে।”

“অর্থটা নাদিয়া ম্যাডামকে বললে কি আপনি এটা ঠেকাতে পারতেন স্যার?”

“তা হয়তো পারতাম না। কিন্তু চিঠিটার অর্থ জানতে মেয়েটা শুধু একটুখানি সাহায্য চেয়েছিল। জেনেও সে সাহায্যটুকুও আমি করিনি। আই ওয়ান্টেড টু প্লে গড। অর্থটা ওকে বললে মহাভারত কী অশুদ্ধ হত বলুন তো! এই চিঠি এখন পুলিশ পড়বে, অর্থটাও মেয়েটাকে জানাবে। নাদিয়া কী ভাববে –কী ধরনের প্রতিবেশী আমি! ডেভের কী ধারণা হবে আমার সম্পর্কে! এত বড়ো জিনিসটা আমি চেপে রেখে দিয়েছিলাম!”

.

একেনবাবুর কানে কথাগুলো মনে হয় পৌঁছল না। ফোন বার করে বললেন, “দাঁড়ান। স্যার, স্টুয়ার্ট সাহেবকে খবরটা দিই।”

ওদিক থেকে কী কথা হচ্ছে বোঝার উপায় নেই। কথা শেষ হওয়ার পর আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কী বললেন ক্যাপ্টেন সাহেব?”

নাদিয়ার বা এই বিয়ের কথা কিছু জানতেন না। তবে অবাক হলেন না। বাড়ির চাপে কেউ কেউ এখানকার বিয়ের কথা চেপে ইন্ডিয়াতে গিয়ে আরেকটা বিয়ে করে!”

“কিন্তু সেটা তো বিগ্যামি, সেকেন্ড বিয়েটা ভ্যালিডও নয়।”

“রাইট স্যার। তাও লোকে করে ফেলে, ভাবে দেশের বৌকে এখানে না নিয়ে এলেই হল। এরকম কেস এই নিউ ইয়র্কে সিটিতেই বেশ কয়েকটা হয়েছে।”

“নাদিয়াকে তো এটা জানাতে হয়।”

“কী জানাতে হয় স্যার –এই বিয়ের ব্যাপারটা?” একটু বিস্মিত হয়েই একেনবাবু প্রশ্ন করলেন।

“আরে না, আমি তো পাগল নই। আর কথাটা ঠিক না ভুল সেটাও তো জানি না। আমি ভাবছি এজের মারা যাবার খবরটা। কিন্তু এই দুঃসংবাদটা দেওয়া যায় কী করে!”

“স্যার, খবরটা তো আপনি অফিশিয়ালি পাননি। আর যে মারা গেছে তার সঙ্গে নাদিয়ার যে একটা সম্পর্ক আছে –সেটা পুলিশ আগে ভেরিফাই করুক। পুরো ব্যাপারটা শিওর না হলে –পুলিশ কাউকে মৃত্যুসংবাদ দেয় না।”

“কিন্তু ফটো ডোন্ট লাই।”

“ব্যাপারটা একটু রহস্যজনক ঠিকই। আপনি চান তো ম্যাডাম নাদিয়ার সঙ্গে এ ব্যাপারে কথাবার্তা বলা যেতে পারে। তবে মৃত্যুসংবাদটা চেপে রেখে –ওটা পুলিশই দিক।”

আবার আপনি আমাকে ভগবানের ভূমিকায় ফেলছেন! নাদিয়া যদি জিজ্ঞেস করে এজের কোনো খবর আমি পেয়েছি কি না।”

“ওটা আমি হ্যাঁন্ডেল করব স্যার। আপনি বরং চিঠিটার অর্থ ওঁকে বলতে পারেন, তাহলে আপনার গিল্টি ফিলিংটা যাবে।”

ঘড়িটা দেখলাম রাত দশটা। এই রাতে যাওয়াটা বোধহয় সঙ্গত হবে না।

কাল সকাল সকাল যাব।