১২. মোকামা ঘাটে জীবন–যাত্রা
আমার লোকরা আর আমি যে মোকামা ঘাটে শুধু কাজ করে আর ঘুমিয়েই সময় কাটিয়েছিলুম, তা নয়। গোড়ার দিকে কাজের চাপ আমাদের সকলের পক্ষেই অবশ্য সাংঘাতিক ছিল, আর সাংঘাতিক থেকেও গেল। কিন্তু সময় কেটে যাওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে যখন হাতে কড়া পড়ে গেল আর পিঠের পেশী গড়ে উঠল, তখন আমরা আমাদের জোয়ালের সঙ্গে বেশ খাপ খেয়ে গেলুম।
আমাদের উপর যারা নির্ভর করত তাদের মঙ্গলই আমাদের প্রত্যেকের সাধারণ লক্ষ ছিল বলে সেই লক্ষ নিয়ে আমরা সকলে একই দিকে জোয়াল টানতুম।
তাই কাজ অবাধে চলতে লাগল, আর আনন্দ করবার এক-আধটুকু ফুরসত পাওয়া যেতে লাগল। মোকামা ঘাটে যে বিপুল পরিমাণ মাল জমে উঠেছিল তা পরিষ্কার করে এবং তারপর মালের চলাচল ঠিক রেখে আমরা যে-সুনাম অর্জন করেছিলুম তাতে আমাদের প্রত্যেকেরই কৃতিত্ব ছিল। তাই আমরা প্রত্যেকে তার জন্যে গর্ব বোধ করতুম এবং সুনাম রক্ষার জন্যে কৃত-সংকল্প ছিলুম। তাই কেউ একজন ব্যক্তিগত কাজের জন্যে কামাই করলে তার সঙ্গীরা সানন্দে তার কাজটা করে দিত।
যখন একটুখানি সময় পেলুম আর হাতে দু-চারটে টাকা এল, তখন প্রথম যে-সব কাজে হাত দিলুম তা হচ্ছে আমার লোকদের এবং কম-মাইনের রেলের-কর্মচারীদের ছেলেদের জন্যে একটা স্কুল খোলা। বুদ্ধিটা প্রথম এল রামশরণজীর মাথায়। তিনি শিক্ষা-ব্যাপারে উৎসাহী ছিলেন–বোধহয় এইজন্যে যে, তিনি নিজে লেখাপড়া করবার বিশেষ সুযোগ পান নি।
আমরা দুজনে মিলে একটি কুটির ভাড়া করে, তাতে একজন মাস্টারকে বসিয়ে, কুড়িটি ছাত্র নিয়ে স্কুল আরম্ভ করে দিলুম। এর নাম বরাবরই ছিল ‘রামশরণের স্কুল। প্রথম যাতে এসে ঠোক্কর খেলুম তা হচ্ছে জাত-বিচার। কিন্তু আমাদের শিক্ষক মশায় কুঁড়েঘরখানার চারপাশটা খুলে ফেলে এই সমস্যার পাশ কাটিয়ে গেলেন। কেননা, উঁচুজাতের ছেলেরা আর নিচু জাতের ছেলেরা এক ঘরে বসতে পারে না বটে, কিন্তু একই চালার তলায় বসলে কোনো আপত্তির কারণ থাকে না।
গোড়া থেকেই স্কুলটি খুব ভাল চলতে লাগল, সেটা সম্পূর্ণভাবেই রামশরণজীর অদম্য উৎসাহের ফলে। যখন উপযুক্ত বাড়ি-টাড়ি তৈরি হল, আরও সাতজন মাস্টারকে নিযুক্ত করা হল। ছাত্রসংখ্যাও বেড়ে দুশোতে দাঁড়াল, গভর্নমেন্ট তখন আমাদের টাকাকড়ি-সংক্রান্ত সব দায়িত্ব নিজে নিয়ে স্কুলটিকে একটি মধ্য-ইংরেজি বিদ্যালয়ের পর্যায়ে তুলে দিল, এবং ‘রায়সাহেব’ উপাধি দিয়ে রামশরণজীকে পুরস্কৃত করা হল। তাতে তার বন্ধুরা সকলেই আনন্দিত হল।
বড় লাইনে রামশরণের সমপদস্থ ব্যক্তি টম কেলি ছিলেন একজন উৎসাহী ক্রীড়ামোদী মানুষ। তাতে আর আমাতে মিলে একটি রিক্রিয়েশন ক্লাব (অবসর বিনোদন সংঘ) প্রতিষ্ঠা করলুম। খানিকটা জায়গা সাফ করে নিয়ে, একটি ফুটবলের আর একটি হকি খেলার গ্রাউণ্ড চিহ্নিত করে, গোল-পোস্ট পুঁতে, ফুটবল আর হকি-স্টিক কিনে আমরা যে যার ফুটবল আর হকির দলকে তালেম দিতে লাগলুম।
ফুটবল খেলায় তালিম দেওয়াটা তবু সোজা হয়েছিল কিন্তু হকির বেলা তা হল না। নিয়মানুমোদিত হকিস্টিক কেনা আমাদের সংগতিতে কুলোল না বলে যা কিনলুম তাকে সেকালে বলা হত ‘খালসা স্টিক’। এগুলো একরকম ব্ল্যাৰ্থন কিংবা ছোট ও জাতীয় গাছ থেকে পঞ্জাবে তৈরি হত। তার শিকড়কে দুরকার-মত বাঁকা করে নিয়ে স্টিকের বাঁকটা বানানো হত।
প্রথমদিকে অনেকে আহত হতে লাগল, কেননা শতকরা আটানম্বই জনই খালি পায়ে খেলত, স্টিকগুলিও ছিল ভারি, তাতে কিছু জড়ানোও থাকত না, আর খেলা হত কাঠের বল দিয়ে। যখন আমাদের দুজনের দলই খেলা দুটোর অ-আ-ক-খ আয়ত্ত করে ফেলল–অর্থাৎ বলটাকে কোনদিকে ঠেলে নিতে হবে তা শিখে নিল (তার বেশি নয়)–তখন আন্তঃরেলওয়ে প্রতিযোগিতা আরম্ভ করে দিলুম। আমরা, খেলোয়াড়রা তাতে যত না আমোদ পেতুম দর্শকরা পেত তার চাইতে বেশি।
কেলি নিজেকে যতটা মোেটা বলে মানতেন তিনি তার চেয়ে মোটা ছিলেন বলে সব সময় নিজের দলের গোলে খেলতেন। আর বাইরের দলের বিরুদ্ধে আমরা সংযুক্ত দল হয়ে খেললেও তিনি আমাদের গোলকীপার হতেন। আমি রোগা পাতলা মানুষ, সেন্টার ফরওআর্ড খেলতুম। কারও পায়ে কিংবা হকি-স্টিকে বেধে দৈবাৎ কখনও পড়ে গেলে আমাকে ভারি বিব্রত হতে হত। কারণ, এরকম কিছু ঘটলে কেলি ছাড়া আর বাদবাকি সব খেলোয়াড়ই খেলা ছেড়ে এসে আমাকে তুলে দাঁড় করাতে আর পোশাক থেকে ধুলো ঝাড়তে লেগে যেত।
একবার আমার যখন এই ধরনের যত্ন-আত্তি চলছিল, তখন বিপক্ষ দলের একজন খেলোয়াড় বল ড্রিল করতে করতে মাঠ ধরে ছুটছে দেখে দর্শকেরা মাঝখানে পড়ে তাকে গোল দিতে তো দিলই না, উলটে তার বলটা বাজেয়াপ্ত করে তাকে গ্রেপ্তার করে ফেলল।
আমরা রিক্রিয়েশন ক্লাবটি পত্তন করবার অল্প পরেই বেঙ্গল অ্যান্ড নর্থওয়েস্টার্ন রেলওয়ে একটি ক্লাব-ঘর তৈরি করে। তাতে তাদের ইউরোপীয় কর্মচারীদের জন্যে একটি টেনিস-কোর্টও হয়। এরকম কর্মচারীর সংখ্যা আমাকে নিয়ে ছিল চার। কেলিকে সেই ক্লাবের একজন চাঁদা-না-দেওয়া সভ্য করে নেওয়া হল। দেখা গেল যে তাঁকে সভ্য করে নিয়ে বেশ কাজ হয়েছে, কেননা তিনি বিলিয়ার্ডস ও টেনিস দুই খেলাতেই সিদ্ধহস্ত ছিলেন। তিনি আর আমি মাসে দু-তিনবারের বেশি টেনিস খেলা উপভোগ করতে পারতুম না বটে, কিন্তু দিনের কাজ শেষ হয়ে যাবার পর অনেকদিনই সন্ধেবেলা আমরা মনের আনন্দে বিলিয়ার্ডস খেলেছি।
মোকামা ঘাটের মাল-গুদামগুলো আর সাইডিংগুলো দেড় মাইলেরও বেশি লম্বা ছিল। মিছিমিছি হাঁটার হাত থেকে তাকে বাঁচাবার জন্যে কেলির রেল-কোম্পানি তাকে একখানা ট্রলি আর সেটা ঠেলবার জন্যে চারজন লোক দিয়েছিল। ট্রলিটা কেলির আর অপর পক্ষের বড়ই আনন্দের জিনিস হয়েছিল, কেননা শীতকালে যখন বড় হাঁস আর বালি হাঁসেরা দেখা দিত আর পূর্ণিমা বা তার কাছাকাছি তিথি এসে পড়ত, তখন আমরা ট্রলি করে বড় লাইন ধরে ন-মাইল গিয়ে কতকগুলি ছোট-ছোট পুকুরের কাছে নামকুম।
পুকুরগুলোর কোনোটা কয়েক গজ মাত্র চওড়া, কোনো-কোনোটা বা আয়তনে তিন চারবিঘে পর্যন্ত। তাদের চারপাশে অড়হরের খেত থাকায় লুকিয়ে থাকবার বেশ সুবিধে ছিল। সূর্য যখন ডুবছে এমন সময় আমরা সেখান থেকে এসে পৌঁছলুম, তারপর একটা পুকুরের পাশে কেলি আর অন্য একটার ধারে আমি জায়গা নিতুম।
একটু বাদেই হাঁসগুলোকে আসতে দেখা যেত। সত্যিই তাদের সংখ্যা অযুত-অযুত। দিনের বেলা তারা গঙ্গার চড়ায় থাকত, আর সন্ধে হলে চড়া থেকে চলে এসে এই পুকুরগুলি পানা কিংবা তার ওধারে পাকা গম বা অন্য ফসল খেত। আমাদের আর গঙ্গার মাঝামাঝি জায়গা দিয়ে রেল-লাইন গিয়েছে। সেটা পার হয়েই হাঁসগুলো নামতে শুরু করত। তারপর আমাদের মাথার উপর সহজ পাল্লার মধ্যে এসে যেত।
চাঁদের আলোয় শিকার করতে হলে একটু অভ্যেস থাকা চাই, কেননা মাথার উপর দিয়ে উড়ে যাওয়া পাখি আসলে যতটা দূরে থাকে তার চাইতে বেশি দূর বলে মনে হয়। তাই শিকারী একটু বেশি সামনের দিকে গুলি ছুঁড়ে বসে। এরকম হলে পাখিগুলো বন্দুকের আগুনের ঝলক দেখে আর শব্দ শুনে খাড়া হয়ে আকাশে উঠে যায়। যখন তারা আবার উপুড় হয়, ততক্ষণে তারা বন্দুকের দ্বিতীয় নলটির পাল্লার বাইরে চলে গিয়েছে।
পূর্ণিমার চাঁদ যখন গঙ্গার ধারের তালগাছগুলোর মাথার উপর দিয়ে উঁকি-ঝুঁকি মারছে, মাথার উপর দিয়ে দশ থেকে একশোটা হাঁসের ঝুঁকের পর ঝক চলে যাচ্ছে এবং তাদের কলধ্বনি আর পাখা নাড়ার সাঁই-সাঁই শব্দে শুকনো ঠাণ্ডা হাওয়া স্পন্দিত ও প্রতিধ্বনিত হয়ে উঠছে, তখনকার সেই শীতের সন্ধেগুলির স্মৃতি আমার মোকামা ঘাটের দিনগুলির সবচেয়ে সুখের স্মৃতির মধ্যে অন্যতম।
আমার কাজ কখনও নীরস লাগত না সময়ও কখনও কাটছে না বলে মনে হত না। কারণ, গঙ্গা-পারাপারের ব্যবস্থা এবং মোকামা ঘাটে দশলক্ষ টন মাল চলাচলের বন্দোবস্ত করার উপরে আবার যে কয়েক লক্ষ লোক প্রতি বছর গঙ্গার দুই কুলের মধ্যে যাতায়াত করত, তাদের জন্য ফেরি-স্টীমার চালাবার ব্যবস্থা আমার উপরেই ছিল।
হিমালয়ে প্রবল বৃষ্টিপাতের পর নদীটা এখানে চার-পাঁচ মাইল চওড়া হয়ে উঠত। নদী পার হওয়াটা আমার আনন্দের ব্যাপার ছিল। তাতে যে শুধু আমার পা দু-খানা বিশ্রাম পেত আর একটু শান্তিতে ধূমপান করবার সুবিধে হত তা-ই নয়–এতে আমি আমার একটা শখের কাজ করবারও সুযোগ পেতুম তা হচ্ছে মানুষকে পর্যবেক্ষণ করা। ফেরি-স্টীমারটা ছিল মস্ত দুটো রেলপথের যোগসূত্র। তার মধ্যে একটা উত্তর দিকে, অপরটা দক্ষিণ দিকে ছড়িয়ে পড়েছে। প্রতি খেপে যে সাতশো লোক নদী পার হত, তাদের মধ্যে ভারতের সব জায়গা থেকে, এমনকি ভারতের সীমান্তপারের দেশগুলি থেকেও এসেছে এমন লোকও থাকত।.
একদিন সকালবেলা আমি স্টীমারের উপরের ডেক থেকে ঝুঁকে পড়ে নিচের ডেকে থার্ড ক্লাসের যাত্রীদের দেখছিলুম। আমার সঙ্গে একটি যুবক ছিল, সে সম্প্রতি ইংল্যান্ড থেকে এসে রেলের কাজে যোগ দিয়েছিল। মোকামা ঘাটে আমার কাজের পদ্ধতি পর্যবেক্ষণ করবার জন্যে তাকে আমার কাছে পাঠানো হয়েছিল। আমার কাছে সে একপক্ষ কাল কাটিয়েছিল।
তখন আমি তার সঙ্গে নদী পার হয়ে সামারিয়া ঘাটে চলেছিলুম। সেখান থেকে তাকে গোরখপুর যেতে হবে, সেই দীর্ঘ যাত্রায় তাকে রওনা করে দিয়ে আসব। আমার পাশের বেঞ্চেই পা মুড়ে বসে একজন ভারতীয়ও নিচের ডেকের দিকে দেখছিল। আমার যুবক সঙ্গী ক্রস্থওয়েট এদেশে কাজ করতে এসে এদেশের সবকিছু সম্বন্ধে আগ্রহী হয়ে উঠেছিল। যখন আমরা তোকগুলোকে বকবক করতে-করতে ভোলা ডেকে জায়গা করে নিতে দেখছিলুম, তখন সে বললে যে এই সব লোকেরা কারা, আর এরা ভারতের এক জায়গা থেকে আর জায়গায় যাচ্ছেই বা কেন এ বিষয়ে তার প্রচুর কৌতূহল।
জনতা ততক্ষণে মুড়ি-ঠাসা হয়ে বসে পড়েছে। তাকে বললুম যে তার কৌতূহল নিবৃত্তির চেষ্টা করব। বললুম, ‘ডান দিক থেকে আরম্ভ করা যাক। একেবারে বাইরের সারির লোক যারা রেলিং-এ পিঠ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, শুধু তাদের ধরে-ধরে সারা ডেকটা ঘুরে আসা যাবে। আমাদের সবচাইতে কাছের লোক তিনজন হচ্ছে ব্রাহ্মণ। কাদামাটি দিয়ে আঁটা যে বড়-বড় তামার হাঁড়িগুলিকে ওরা সাবধানে পাহারা দিচ্ছে, তাতে আছে গঙ্গাজল। গঙ্গার বাঁ পারের চাইতে ডান পারের কাছের জলই বেশি পবিত্র বলে গণ্য। তাই একজন বিখ্যাত মহারাজার কর্মচারী এই তিনজন ব্রাহ্মণ ওই পাত্রগুলিকে ওপারে এসে ভরে নিয়ে আশি মাইল দূরে চলেছে স্টীমারে আর রেলপথে-মহারাজার ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্যে। এমনকি ভ্রমণের সময়ও সেই মহারাজা ঘরোয়া কাজে ওই গঙ্গাজল ছাড়া আর কিছু ব্যবহার করেন না।
ব্রাহ্মণদের পরেই যে লোকটি, সে একজন মুসলমান ধনুকর। তার পাশে ডেকের উপরে ধনুকের মত যে যন্ত্রটি পড়ে রয়েছে, তা দিয়ে সে পুরনো তোষক-গদির ডেলা-বাঁধা তুলোগুলিকে ধুনে দেবার কাজ করে, জায়গায় জায়গায় ঘুরে বেড়ায়। এই যন্ত্রটি দিয়ে পুরনো তুলা ধুনতে ধুনতে ও সেগুলোকে ফুঁপিয়ে রেশমের মতন করে তোলে।
তার পরই রয়েছে দু-জন তিব্বতী লামা। তারা গয়ার পবিত্র বৌদ্ধ মন্দিরে তীর্থ করে ফিরে চলেছে। তাদের কপালে ঘামের ফোঁটা দেখেই বুঝতে পারছ শীতের এই ভোরেও তাদের গরম লাগছে।
লামাদের ওপাশে চারজন লোকের একটি দল। ‘এরা তীর্থ করতে কাশী গিয়েছিল, এখন নেপালের পাদ-শৈলে তাদের ঘরে ফিরে চলেছে। দেখতেই পাচ্ছ যে তাদের চারজনের প্রত্যেকেরই দুটো করে ফুঁকো কাঠের কুঁজো সঙ্গে আছে। সেগুলো বেতের বোনা দিয়ে সুরক্ষিত, আর খাটো বাঁশের বাঁকে ঝোলানো রয়েছে। কাশীর গঙ্গায় তোলা জল আছে ওতে। ওদের নিজেদের আর আশপাশের গ্রামগুলিতে পূজাপার্বণ উপলক্ষে এই জল ওরা ফোঁটা ফোঁটা করে বিক্রি করবে।‘
এইভাবে সারাটা ডেক ঘুরে আমি বাঁ-দিকের শেষ লোকটির প্রসঙ্গে এলুম। ক্রস্থওয়েটকে বললুম, ‘এই লোকটি আমার পুরনো পরিচিত লোক। সে আমার লোকদের একজনের বাবা। নদীর বাঁ-কুলে তার খেতে চাষ করবার জন্যে এখন গঙ্গা পার হচ্ছে।‘
নিচের ডেকের যাত্রীদের সম্বন্ধে যা যা বললুম, ক্রস্থওয়েট সে সব কথাই গভীর আগ্রহের সঙ্গে শুনল। তারপর সে জিগ্যেস করল যে আমাদের পাশের বেঞ্চে যে লোকটি বসে আছে সে কে?
আমি বললুম, ‘ও! উনি একজন মুসলমান ভদ্রলোক চামড়ার ব্যবসা করেন। গয়া থেকে মজফফরপুর চলেছেন।’
আমার কথা শেষ হতেই ভদ্রলোক পা দুখানা সোজা করে ডেকের মেজেতে নামালেন, তারপর হাসতে শুরু করলেন। তারপর আমার দিকে ফিরে নিখুঁত ইংরেজিতে বললেন, আমাদের নিচের ডেকের লোকদের যে বর্ণনা এতক্ষণ আপনি আপনার বন্ধুকে দিচ্ছিলেন তা শুনে আমার খুব মজা লাগছিল। আমার বর্ণনা শুনে তো আরও আমোদ হল।
আমি লজ্জায় লাল হয়ে উঠলুম, কেননা, আমি ধরে নিয়েছিলুম যে ইনি ইংরেজি . জানেন না। অবশ্য আমার রোদে-পোেড়া রঙে সেই লাল রঙটা চাপা পড়ে গিয়েছিল।
ভদ্রলোক বলতে লাগলেন, “আমার মনে হয় যে এক আমার ক্ষেত্রে ছাড়া আর সকলের ক্ষেত্রেই আপনার বর্ণনা ঠিক হয়েছে। আপনি যা বললেন আমি তা-ই মুসলমান। গয়া থেকে মজফফরপুর চলেছি, সে কথাও ঠিক–যদিও আপনি তা কী করে জানলেন তা জানি না, কেননা গয়াতে টিকিট কেনবার পর এ-পর্যন্ত আমি সেটা কাউকে দেখাই নি। কিন্তু আমাকে চামড়া-ব্যবসায়ী বলে মনে করে ভুল করেছেন। চামড়া নয়, তামাকের কারবার করি আমি।
.
কখনও-কখনও বিশিষ্ট-বিশিষ্ট ব্যক্তিদের জন্যে স্পেশাল ট্রেন চালানো হত, আর সেই উপলক্ষে বিশেষ খেয়া-স্টীমারও দেওয়া হত। এদের সময় ঠিক করে দেবার দায়িত্ব ছিল আমার। একদিন বিকেলবেলা আমি এইরকম একটি স্পেশাল ট্রেন দেখতে গিয়েছিলুম। তাতে নেপালের প্রধানমন্ত্রী, তার পরিবারের কুড়িজন মহিলা, তার একজন সেক্রেটারী আর মস্ত একদল চাকর-বাকর নেপালের রাজধানী কাঠমাণ্ডু থেকে কলকাতা যাচ্ছিলেন।
ট্রেন থামতেই নেপালের জাতীয় পোশাক পরা গৌরবর্ণ দৈত্যাকৃতি একটি লোক ট্রেন থেকে লাফিয়ে পড়ে, যে গাড়িতে প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তার কাছে এল। এখানে এসে সে একটি প্রকাণ্ড ছাতা খুলে কামরার দরজায় পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে ডান হাতখানা তুলে কোমরে রাখল।
শিগগিরই তার পিছনের দরজাটা খুলে প্রধানমন্ত্রী দেখা দিলেন, তাঁর হাতে একটি বেত, সেটার মাথায় সোনা বাঁধানো। তিনি অভ্যস্তভাবে এবং সহজেই লোকটির বাহুর উপর চড়ে বসলেন। তিনি আরাম করে বসবার পর লোকটি তার মাথার উপর ছাতাটা তুলে ধরে রওনা হল। যেমন করে মানুষ মোমের পুতুল নিয়ে যায়, সে তেমনই অবলীলাক্রমে এই বোঝা নিয়ে আলগা বালির উপর দিয়ে তিনশো গজ হেঁটে স্টীমারে গিয়ে পৌঁছল।
সেক্রেটারী মশায়কে আমি চিনতুম। তাঁকে বললুম যে এমন একটা গায়ের জোরের কাজ আমি কখনও দেখি নি। তিনি আমাকে জানালেন যে, যেখানে অন্য কোনো যানবাহন পাওয়া যায় না সেখানে সর্বদাই প্রধানমন্ত্রী এই ফরসা দৈত্যটিকে এই কাজে লাগান। তিনি বললেন বটে যে লোকটি নেপালী কিন্তু আমার অনুমান এই যে, সে উত্তর ইউরোপের কোনো জাতের লোক। কি কারণে সে ভারতের সীমান্তে একটি স্বাধীন রাজ্যে এসে চাকরি নিয়েছিল, সে-কথা সে কিংবা তার মনিবরাই ভাল বলতে পারবে।
প্রধানমন্ত্রীকে যখন বয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, ততক্ষণে চারজন অনুচর বারফুট লম্বা আর আটফুট চওড়া একটি চারকোনা কালো সিল্ক, বের করে নিয়ে এসে, সব দরজা-জানলা বন্ধ-করা একটি কামরার পাশে বালির উপর বিছিয়ে দিল। কাপড়খানার চারকোনায় দড়ির ফাঁস পরানো ছিল। মাথায় হুক লাগানো চারটে আটফুট উঁচু রূপেপার খুঁটির হুকগুলো ওই চারটে ফঁসের মধ্যে গলিয়ে খুঁটিগুলি খাড়া করে ধরতে সেই চৌকোনো জিনিসটা তালাশূন্য বাসের মত আকার ধারণ করল।
এবার এটার এক মাথা ওই কামরার দরজার সমান উঁচু করে তুলে ধরা হল, আর প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের কুড়িজন মহিলা সেই কামরা থেকে বেরিয়ে সেই সিল্কের ঘেরাটোপের ভিতরে ঢুকল। দণ্ডবাহকেরা ঘেরাটোপটার বাইরে হাঁটতে লাগল, মহিলাদের শুধু ঝকঝকে পেটেন্ট লেদারের জুতো-পরা পা ক-খানা দেখা যেতে লাগল–এইভাবে শোভাযাত্রা স্টীমারের দিকে রওনা হল।
স্টীমারের নিচের ডেকে এসে ঘেরাটোপটার একটা মাথা তুলে ধরতেই মহিলারা সিঁড়ি বেয়ে হালকা পায়ে ছুটে উপরের ডেকে যেখানে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আমি কথা বলছিলুম, সেখানে চলে এলেন।
তাদের সকলেরই বয়স ষোল থেকে আঠার বছর বলে মনে হল। এর আগে একবার যখন মহিলারা এভাবে এসে পড়েছিলেন, তখন আমি উপরকার ডেক ছেড়ে সরে যাবার প্রস্তাব করেছিলুম। তখন আমাকে বলা হয়েছিল যে তা করবার দরকার নেই–শুধু বাজে লোক যাতে রাজপরিবারের মহিলাদের দেখতে না পায়, এইজন্যেই ওই সিল্কের বাক্স।
মহিলাদের পোশাকের বিশদ বর্ণনা দেবার সাধ্য আমার নেই। এইটুকুমাত্র বলতে পারি যে তারা তাঁদের রঙচঙা, আঁটসাঁট কাঁচুলি আর চল্লিশ গজ মিহি সিল্কের তৈরি বিরাট ফঁদালো সালোয়ার পরে যা কিছু দেখবার আছে তা দেখবার জন্যে যখন স্টীমারের এ-ধার থেকে ও-ধার পর্যন্ত সঞ্চরণ করছিলেন, তখন তাদের দেখাচ্ছিল কয়েকটি দুষ্প্রাপ্য আর জাঁকালো প্রজাপতির মত।
মোকামা ঘাটে এসে প্রধানমন্ত্রীকে এবং মহিলাদের আবার একই ভাবে স্টীমার থেকে স্পেশ্যাল ট্রেনে নিয়ে যাওয়া হল। সমস্ত দলটা আর তার পর্বত-প্রমাণ মালপত্র গাড়িতে উঠতে তখন ট্রেন কলকাতার দিকে রওনা হয়ে গেল। পরে দলটা ফিরে এল। সামারিয়া ঘাটে গিয়ে আমি তাদের কাঠমাণ্ডুর পথে রওনা করে দিয়ে, এলুম।
কয়েকদিন বাদে আমি একটা রিপোর্ট লিখছিলুম সেটা সে রাত্রেই পাঠানো দরকার ছিল। এমন সময় সেই সেক্রেটারীটি আমার আপিসে এসে ঢুকলেন। তার পোশাক-পরিচ্ছদ ময়লা আর কোঁচকানো, দেখে মনে হচ্ছিল যে ওটা পরে কয়েক রাত শোয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ছিমছাম খোশ-পোশাকী যে কর্মচারীটিকে গতবার দেখেছি, তাঁর আর এঁর চেহারায় একেবারে আকাশ-পাতাল তফাত। তাকে যে চেয়ারখানা এগিয়ে দিলুম, তাতে বসে পড়েই তিনি কোনো ভূমিকা না করে বললেন যে, তিনি ভয়ানক বিপদে পড়েছেন। যে-কাহিনীটি তিনি আমাকে বললেন তা এই :
‘আমাদের কলকাতায় থাকার শেষ দিনে প্রধানমন্ত্রী তার বাড়ির মহিলাদের নিয়ে কলকাতার প্রধান গহনা-বিক্রেতা হ্যাঁমিলটন অ্যান্ড কোম্পানির দোকানে গিয়ে তাদের পছন্দমত গহনা নিতে বললেন। গহনাগুলোর দাম রুপোর টাকায় হল। আপনি জানেন যে, আমাদের সব খরচ আর সব কেনাকাটার জন্যে নেপালের কাঁচা টাকা সর্বদা যথেষ্টই সঙ্গে থাকে। গহনা পছন্দ করতে, টাকা গুনে দিতে, আমি যে সুটকেসটি নিয়ে গিয়েছিলুম তার মধ্যে গয়নাগুলো সাজিয়ে ভরে রাখতে, এবং দোকানদারের সেই সুটকেসটি গালানোহর করে বন্ধ করতে যা ভেবেছিলুম তার চাইতে বেশি সময় লেগে গেল। তার ফলে আমাদের হুড়োহুড়ি করে হোটেলে ফিরে গিয়ে মালপত্র আর লোকজন গুছিয়ে নিয়ে স্পেশ্যাল ট্রেন যেখানে অপেক্ষা করছিল সেখানে ঊর্ধ্বশ্বাসে যেতে হল।
‘সন্ধের শেষদিকে আমরা কাঠমাণ্ডু পৌঁছলুম। পরদিন সকালবেলা প্রধানমন্ত্রী আমাকে ডেকে পাঠালেন। তিনি গহনার বাক্সটা আমার কাছে চাইলেন। তখন প্রাসাদের প্রতিটি ঘর খুঁজে দেখা হল, যত লোক কলকাতা গিয়েছিল তাদের সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হল, কিন্তু সুটকেসটার কোনো চিহ্ন পাওয়া গেল না, এবং কেউ যে কখনও ওটাকে দেখেছে এমন কথা স্বীকার করল না।
‘আমার মনে আছে যে, যে-মোটরকার করে দোকান থেকে হোটেলে এসেছিলুম, সেই গাড়ি থেকে সুটকেসটা আমিই নামিয়ে নিয়েছিলুম। কিন্তু তারপর ফেরবার পথে আর কোনো সময়ে ওটাকে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। সুটকেসটা আর তার ভিতরকার জিনিসগুলোর জন্যে আমি ব্যক্তিগতভাবে দায়ী। ওটা যদি না পাওয়া যায় তাহলে আমার হয়তো চাকরির চাইতেও বেশি কিছু খোয়াতে হবে। কারণ দেশের আইন অনুসারে আমি ভয়ানক অপরাধ করেছি।
‘নেপালে একজন সন্ন্যাসী আছেন, তার নাকি দিব্য দৃষ্টি আছে। বন্ধুদের পরামর্শে আমি তাঁর কাছে গেলুম। তাকে খুঁজে বের করে দেখি যে তিনি ছেঁড়া-খোঁড়া কাপড় পরা এক বৃদ্ধ। প্রকাণ্ড এক পাহাড়ের গায়ে একটি গুহাতে তিনি থাকেন। তাকে আমার বিপদের কথা জানালুম। তিনি চুপ করে আমার কথা শুনলেন, কোনো প্রশ্ন করলেন না। পরদিন সকালবেলা আমাকে আসতে বললেন।
‘আবার যখন তার কাছে গেলুম তখন তিনি বললেন যে গত রাত্রিতে ঘুমের ঘোরে তিনি এক স্বপ্ন দেখেছেন। স্বপ্নে তিনি সুটকেসটিকে দেখেছেন। তার গালামমাহরগুলি সব ঠিকই আছে। সেটা একটা ঘরের কোণে অনেক বাক্স আর বস্তার তলায় লুকানো রয়েছে। ঘরটা একটা বড় নদীর থেকে বেশি দূরে নয়। তাতে একটা মোটে দরজা আছে, দরজাটা পূর্বমুখী। সন্ন্যাসী আমাকে এইটুকু বলতে পারলেন।
বলতে বলতে কখন সেক্রেটারীটির চোখে জল এল, গলা ধরে এল।
তারপর তিনি বললেন, তাই আমি এক সপ্তাহের জন্যে নেপাল ছেড়ে আসবার অনুমতি নিয়ে আপনার কাছে এসেছি, যদি আপনি আমাকে সাহায্য করতে পারেন। কেননা এটা সম্ভব যে, সন্ন্যাসী স্বপ্নে যে-নদীটি দেখেছেন, সেটা গঙ্গা নদী।
লোকে যাকে দিব্যদৃষ্টিসম্পন্ন বলে মনে করে এমন মানুষের যে হারানো বা খোয়ানো জিনিস উদ্ধার করতে সাহায্য করতে পারে, এ কথা হিমালয় অঞ্চলে কেউ অবিশ্বাস করে না। সেক্রেটারীটিও যে সন্ন্যাসীর কথা বিশ্বাস করেছিলেন, তাতে কোনো সন্দেহ ছিল না। তার তখন উদ্বেগ ছিল এই যে, অন্য কেউ সুটকেসটা পেয়ে সেটা লুট করে নেবার আগে সেটা কি করে ফিরে পাবেন। তাতে দেড় লক্ষ টাকার গহনা ছিল।
নানারকম মালপত্র রাখা আছে এমন অনেকগুলো ঘরই মোকামা ঘাটে ছিল। কিন্তু তার মধ্যে কোনোটাই সন্ন্যাসীর বর্ণনার সঙ্গে খাপ খায় না। তার সঙ্গে মেলে এমন একটা ঘরের কথা আমি জানতুম। সেটা হচ্ছে মোকামা ঘাট থেকে দু-মাইল দূরে মোকামা জংশন স্টেশনের পার্সেল আপিস। কেলির ট্রলিখানা চেয়ে নিয়ে সেক্রেটারীটিকে রামশরণজীর সঙ্গে মোকামা জংশনে পাঠিয়ে দিলুম। সেখানে পার্সেল আপিসের ভারপ্রাপ্ত কেরানী সুটকেসের কথা কিছুই জানে না বলল। তবে, আপিসের মালপত্রের স্তূপ সরিয়ে প্ল্যাটফর্মে নিয়ে আসবার কথায় সে আপত্তি করল না। তা করা হলে সুটকেসটা বেরিয়ে পড়ল–তার গালামোহর সব ঠিক ছিল।
তখন প্রশ্ন উঠল যে, কেরানীটির অজান্তে সুটকেসটা ওখানে এল কী করে? এতক্ষণে স্টেশনমাস্টার মশায় দেখা দিলেন। তাঁর অনুসন্ধানে আবিষ্কৃত হল যে সুটকেসটাকে আপিসে এনে রেখেছিলেন একজন গাড়ি-ঝাড়ুদার, রেলের লোকদের মধ্যে তার মাইনেই সবচাইতে কম। প্রধানমন্ত্রী যে গাড়িতে করে কলকাতা থেকে মোকামা ঘাটে আসেন, এই ঝাড়ুদারটিকে সেটা ঝাট দিতে বলা হয়েছিল। তারই একটা কামরায় সীটের তলায় গোঁজা এই সুটকেসটা সে দেখতে পায়।
কাজ শেষ হয়ে গেলে সে সুটকেসটা বয়ে নিয়ে সিকি মাইল দূরে প্ল্যাটফর্মে এল। . সেখানে সে সময়ে এমন কেউ ছিল না যার হাতে সে সুটকেসটা দিতে পারে। তাই সে ওটাকে পার্সেল আপিসের এক কোণে রেখে দিয়েছিল। তার কাজের জন্যে সে দুঃখ প্রকাশ করল এবং সে যদি কোনো অন্যায় করে থাকে, তার জন্যে মাপও চাইল।
.
সাধারণত এটাই নিয়ম যে, অবিবাহিত লোক আর তার চাকর-বাকর কতকগুলো কম-বেশি বঁধাধরা অভ্যেস মেনে চলে। আমার চাকরেরা আর আমি তার ব্যতিক্রম ছিলুম না। কাজ যখন খুব বেশি থাকত তখন ছাড়া আর সব সময়েই আমি রাত আটটার সময় বাড়ি ফিরে আসতুম। আমার গৃহভৃত্য তখন বারান্দায় অপেক্ষা করত। আমাকে আসতে দেখলেই সে পানিপাড়েকে ডেকে আমার স্নানের জল ঠিক করতে বলত। কেননা শীত হ’ক গ্রীষ্ম হক, আমি সব সময়েই গরম জলে স্নান করতুম।
বাড়িটার সামনের বারান্দার উপর পাশাপাশি তিনখানা ঘর ছিল–একখানা খাবার, একখানা বসবার, আর একখানা শোবার ঘর। শোবার ঘরের লাগোয়া ছিল ছোট একটি বাথরুম, দশ-ফুট লম্বা আর ছ-ফুট চওড়া। বাথরুমের দুটো দরজা-একটা বারান্দার উপর, অপরটা শোবার ঘরের দিকে। আর একটা ছোট জানলা ছিল, সেটা এই শোবার ঘরের দিকে দরজার উলটো দিকে, বাড়ির এক প্রান্তের দেওয়ালে অনেকটা উঁচুতে বসানো।
বাথরুমে আসবাব ছিল ডিম্বাকৃতি একটা কাঠের স্নানের টব, সেটায় বসা যায় এমন লম্বা সেটা। একটা কঠের বাথ-ম্যাট বা ফুটোওলা পাপোশ আর ঠাণ্ডা- জলভরা দুটির মাটির পাত্র। পানিপাঁড়ে স্নানের জল দিয়ে গেলে আমার চাকর বাথরুমের দরজায় খিল লাগিয়ে দিয়ে শোবার ঘরের ভিতর দিয়ে বেরিয়ে আসবার সময় আমার খুলে রাখা জুতো-জোড়া তুলে নিয়ে তা পরিষ্কার করে রাখবার জন্যে রান্নাঘরে চলে যেত। আমি বড়-হাজরি আনতে না বলা পর্যন্ত সে সেখানেই থাকত।
একদিন রাত্রে আমার চাকর রান্নাঘরে চলে যাবার পর আমি ড্রেসিং টেবিলের উপর থেকে ছোট একটা হাত-লণ্ঠন তুলে নিয়ে বাথরুমের মধ্যে গিয়ে, ঘরের চওড়ার দিক বরাবর আধাআধি পর্যন্ত গিয়েছে এমন একটা দু-ইঞ্চি উঁচু আর ন-ইঞ্চি চওড়া দেওয়ালের উপর সেটাকে রাখলুম। তারপর আমি দরজাটায় খিল লাগালুম। ভারতের অধিকাংশ দরজার মত এ দরজাটাও কাগুলো থেকে ঝুলে পড়েছিল। তাই খিল না দিলে দরজা বন্ধ থাকত না।
দিনের বেশির ভাগই আমি কয়লার প্ল্যাটফর্মে কাটিয়েছিলুম, তাই খুব কষে সাবান মাখলুম। মাথায় এমন ফেনা হল যে সাবানওয়ালাদের তার জন্যে বাহাদুরি দেওয়া যায়। তারপর বাথ-ম্যাটটার উপর সাবানখানা রাখব বলে যেই চোখ খুলেছি, অমনি ভয়ে চমকে উঠলুম।
স্নানের টবের শেষ মাথার ও-পাশে আমার পায়ের আঙুলগুলি থেকে কয়েক ইঞ্চি মাত্র দুরে একটা সাপের মাথা জেগে রয়েছে। মাথায় সাবান দেবার সময় আমার হাত নাড়া আর জল ঘাঁটা দেখে মস্ত গোখরো সাপটা স্পষ্টতই বিরক্ত হয়েছিল, কারণ সেটা ফণা চিতিয়ে তার সেই কুটিলদর্শন মুখ থেকে লম্বা চেরা জিভটা অনবরত বের করছিল আর মুখের মধ্যে টেনে নিচ্ছিল। তখন আমার যা করা উচিত ছিল তা হচ্ছে হাত-দুখানা নাড়তে থাকা, পা দুখানা সাপের কাছ থেকে গুটিয়ে নেওয়া, এবং সাপটার দিকে সারাক্ষণ চোখ রেখে খুব আস্তে-আস্তে উঠে দাঁড়িয়ে পিছন দিকে পা বাড়িয়ে দরজার দিকে যাওয়া।
কিন্তু আমি অত্যন্ত বোকার মতন স্নানের টবটার দু-পাশ ধরে দাঁড়িয়ে উঠে পিছনে পা ফেললুম। তিনটে কাজই একসঙ্গে করা হল। আমি গিয়ে পড়লুম সেই সিমেন্ট করা নিচু দেওয়ালটার উপর। তাতে আমার পা পিছলে গেল। টাল সামলাবার চেষ্টা করতে যেতেই আমার কনুই বেয়ে খানিকটা জল গিয়ে বাতিটার সতের উপর পড়ল, সেটাও নিবে গেল। ঘরটা ঘুটঘুঁটে অন্ধকার হয়ে গেল।
এইভাবে আমি ছোট একটা অন্ধকার ঘরের মধ্যে ভারতের সবচাইতে মারাত্মক একটা সাপের সঙ্গে বন্ধ হয়ে রইলুম। পিছন-দিকেই হক, আর বাঁ-দিকেই হক, একটা পা ফেললেই আমি দুটো দরজার একটার কাছে যেতে পারতুম, কিন্তু সাপটা কোথায় ছিল তা না জানায় আমি ভয়ে নড়তে পারলুম না, পাছে–আমার খালি পা তার উপর পড়ে যায়।
তাছাড়া দুটো দরজারই ছিটকিনি নিচের দিকে ছিল। যদিও বা সাপের গায়ে পা না পড়ে, তাহলেও তো আমাকে ছিটকিনি হাতড়ে দেখতে হবে, আর পালিয়ে যাবার চেষ্টায় সাপটারও সেখানে থাকার সম্ভাবনাই বেশি।
চাকরদের ঘরগুলি ছিল বাড়ির হাতার এক কোণে। বাড়ির যেদিকটাতে খাবার ঘর, সেখান থেকে তা পঞ্চাশ গজ দূরে। কাজেই চেঁচিয়ে তাদের ডাকলে কাজ হবে না। তাই আমার একমাত্র আশা এই যে হয়ত আমার চাকর খাবার নিয়ে আসবার হুকুমের জন্যে অপেক্ষা করে-করে বিরক্ত হয়ে এসে পড়বে, কিংবা কোনো বন্ধু আমার সঙ্গে দেখা করতে আসবেন। আমি ভক্তিভরে প্রার্থনা করতে লাগলুম যেন সাপটা আমাকে কামড়াবার আগেই এই দুটোর একটা ঘটে যায়।
সাপটাও আমারই মত ফঁদে পড়ে গিয়েছে বটে, কিন্তু সে কথা ভেবে কিছুমাত্র শান্তি হল না। মোটে কয়েকদিন আগেই আমার একজন লোকের এই ধরনের বিপদ হয়েছিল। আমি তাকে তার মজুরি দিয়েছিলুম। তা রাখতে সে বিকেলের দিকে তার বাড়িতে গিয়ে যেই বাকসটা খুলতে গিয়েছে, অমনি পিছনে একটা ফোঁস-ফোঁস শব্দ শুনে সে ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখে কি যে, খোলা দরজার দিক থেকে একটা ঘোখরো সাপ তার দিকে আসছে।
সে পিছনের দেওয়ালে পিঠ দিয়ে দাঁড়াল, কেননা ঘরের দরজা ঐ একটিই ছিল। বেচারা খালি হাত দিয়ে গোখরোটাকে ঠেকাবার চেষ্টাও করেছিল। তা করতে গিয়ে সে তার হাতে আর পায়ে বারবার সাপের ছোবল খায়। পড়শীরা তার চিৎকার শুনে তাকে বাঁচাতে এসেছিল, কিন্তু সে কয়েক মিনিটের মধ্যেই মারা যায়।
সেই রাত্রিতে আমি জানলুম যে ছোট-ছোট জিনিসও বড়-বড় ব্যাপারের চাইতে মর্মান্তিক আর ভয়ঙ্কর হতে পারে। জলের এক-একটি ফোঁটা আমার পা বেয়ে গড়িয়ে পড়ে, আর আমার মনে হয় যে সাপটা আমার পায়ের মাংসের মধ্যে তার বিষদাঁত বসাবার উপক্রমণিকা স্বরূপ তার লম্বা চেরা জিভটি দিয়ে ভোলা চামড়াটা চাটছে।
গোখরোটার সঙ্গে আমি ঘরটায় কতক্ষণ ছিলুম তা বলতে পারি না। পরে আমার চাকর বলে, যে তা মোট আধঘন্টা। সে খাবার টেবিল সাজাতে এসেছিল। সেই শব্দটা শুনে যেন হাতে স্বর্গ-পেলুম। তাকে ডেকে বাথরুমের দরজায় আসতে বললুম। সে এলে তাকে আমার বিপজ্জনক অবস্থার কথা জানিয়ে, একটা লণ্ঠন আর একটা মই নিয়ে আসতে বললুম।
আবার দীর্ঘকাল অপেক্ষা করবার পর আমি অনেকগুলো গলার হট্টগোল শুনতে পেলুম। তারপর বাড়ির বাইরের দিককার দেওয়ালের গায়ে মই রাখবার খচখচ শব্দ আমার কানে এল। লণ্ঠনটা জানলায় তুলে ধরা হল–জানলাটা ছিল মাটি থেকে দশ ফুট উঁচুতে কিন্তু লণ্ঠনে ঘরে আলো হল না। লণ্ঠনটা যে ধরে ছিল, তাকে বললুম জানলার একখানা কাঁচ ভেঙে সেই ফাঁক দিয়ে লণ্ঠনটাকে ভিতরে ঢুকিয়ে দিতে।
যা ফাঁক হল তার ভিতর দিয়ে লণ্ঠনটাকে খাড়াভাবে ঢোকানো গেল না, ফাঁকটা এত ছোট। যাই হক, তিন-তিনবার জ্বালাবার পর শেষে সেটাকে ঘরে ঢোকানো গেল। আমার মনে হতে লাগল যে গোখরোটা আমার পিছনেই রয়েছে।
মাথা ঘুরিয়ে দেখি যে আমার থেকে দু-ফুট দূরে, শোবার ঘরের দরজার নিচে সেটা শুয়ে রয়েছে। খুব আস্তে-আস্তে সামনে ঝুঁকে পড়ে আমি বাথম্যাটটা তুলে নিয়ে সেটাকে উঁচু করে ধরে, যেই গোখরোটা মেঝের উপর দিয়ে সুড়ুৎ করে আমার দিকে এল, অমনি সেটাকে ফেলে দিলুম। ভাগ্যক্রমে আমার তাক ঠিকই হয়েছিল। বাথ-ম্যাটটা গোখরোটার মাথার চু-ইঞ্চি পিছনে ঠিক ঘাড়ের উপর দুড়ুম করে গিয়ে পড়ল। সেটা কাঠে ছোবল মারছে আর লেজ আছড়াচ্ছে, এই ফাঁকে চট করে বারান্দার দরজার দিকে গিয়ে পড়লুম এক ভিড়ের মাঝখানে। লোকেরা লাঠি নিয়ে সশস্ত্র হয়ে এসেছে, সকলেরই হাতে লণ্ঠন। রেল-কোয়ার্টারে রটে গিয়েছিল যে আমি একটা তালাবন্ধ ঘরে মস্ত একটা সাপের সঙ্গে জীবন-মরণ সংগ্রাম করছি।
চাপা-পড়া সাপটাকে শিগগিরই মেরে ফেলা হল। আমাকে অভিনন্দন জানিয়ে শেষ লোকটি বিদায় হবার পর খেয়াল হল যে আমার পরনে একেবারে কিছু নেই, আর সাবানে আমার চোখ ভরতি হয়ে রয়েছে। সাপটা যে কি করে বাথরুমে এসেছিল, তা কোনদিনই জানা গেল না। সেটা দুই দরজার কোনোটা দিয়েও ঢুকে থাকতে পারে, অথবা ঘরের চাল থেকেও পড়ে থাকতে পারে। চালটা ছিল খড়ের। সেটা ছিল ইঁদুর আর কাঠবিড়ালিতে ভরতি, আর চড়ুই পাখির বাসা। সে যাই হক, যে চাকরেরা আমার স্নানের যোগাড় করেছিল তাদের আর আমার কৃতজ্ঞ হবার যথেষ্ট কারণ ছিল, কেননা সেই রাত্রিতে আমরা যমরাজার দক্ষিণ দরজার বড়ই কাছে গিয়ে পড়েছিলুম।
.
মোকামা ঘাটে আমরা কোনো হিন্দু বা মুসলমান পরব পালন করতুম না। কেননা, দিনটা যা-ই হক না কেন, কাজ তো চালাতেই হত। কিন্তু বছরে একটি দিন ছিল যে-দিনটির জন্যে আমরা আশা আর গভীর আনন্দ নিয়ে উন্মুখ হয়ে থাকতুম–তা। হচ্ছে বড়দিন।
প্রথা অনুসারে এইদিন বেলা দশটা পর্যত আমাকে বাড়িতে থাকতে হত। ঠিক দশটার সময় আমাকে আমার আপিসে নিয়ে যাবার জন্যে রামশরণজী আসতেন। তার পরনে থাকত তার সবচেয়ে ভাল পোশাকটি, এবং এই উপলক্ষে বিশেষ করে তুলে রাখা প্রকাণ্ড একটা গোলাপী রেশমী পাগড়ি তার মাথায় শোভা পেত।
নিশান কেনবার পয়সা আমাদের ছিল না বটে, কিন্তু আপিসে লাল আর সবুজ রঙের সিগন্যাল-এর ফ্লাগ ছিল প্রচুর। আর গাঁদা আর জুইফুলের মালা দিয়ে রামশরণজী আর তাঁর উৎসাহী সহায়কের দল ভোর থেকে পরিশ্রম করে আপিসটাকে আর তার আশপাশটাকে উজ্জ্বল ও উৎসববাচিত করে তুলতেন।
আপিসের দরজার কাছে একটি টেবিল আর একখানা চেয়ার রাখা হত। টেবিলের উপর একটি কাঁসার ঘটিতে আমার বাগানের সবচেয়ে ভাল গোলাপের একটি তোড়া বাঁধা। টেবিলের সামনে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকত রেলের কর্মীরা, আর আমার সর্দারেরা, আর আমার সব কর্মীরা। আর, সকলেই পরিষ্কার কাপড়-জামা পরে আসত। সারাটা বছর আমরা যতই নোংরা হয়ে কাটাই না কেন, বড়দিনে আমাদের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হতেই হত।
আমি চেয়ারে বসলে রামশরণীজ আমার গলায় একটি জুই ফুলের মালা পরিয়ে দিতেন। তারপর কাজ শুরু হত। প্রথমে রামশরণজী এক লম্বা বক্তৃতা দিতেন, তারপর আমার একটি ছোট বক্তৃতা হত। বক্তৃতা-শেষে শিশুদের মিঠাই বিলানো হত। সংশ্লিষ্ট সকলের পরিতোষ হবার পর এই ঝামেলাটা মিটে গেলে সেদিনকার আসল কাজ শুরু হত–তা হচ্ছে রামশরণজীকে, কর্মচারীদের আর মজুরদের নগদ বোনাস দেওয়া।
আমি মাল-চালাচালির ঠিকাদারিতে যে নিরিখে টাকা পেতুম তা শোচনীয়ভাবে। কম ছিল বটে, কিন্তু তা হলেও, সংশ্লিষ্ট সকলের সাগ্রহ সহয়েগিতার ফলে আমার কিছু লাভ হত। এই লাভের শতকরা আশি ভাগই.এই বড়দিনের দিন বিতরণ করে দেওয়া হত। বোনাসের টাকাটা সামান্যই হত–দু-বছরেও এক মাসের মাইনে কিংবা এক মাসের রোজগারের চাইতে বেশি হত না সেটা। তবুও লোকে একে যথেষ্ট মূল্য দিত। আর এর ফলে আমি তাদের যে শুভেচ্ছা এবং সাগ্রহ সহযোগিতা পেতুম, তাতেই আমি একুশ বছর ধরে প্রতি বছর দশলক্ষ টন মাল ভোলাই করতে পেরেছিলুম। তার মধ্যে এক দিনও একটি অপ্রিয় ঘটনা ঘটে নি, একদিনের জন্যে কাজ বন্ধ থাকে নি।