৩. মোতি
মোতির মুখখানা ছিল সুন্দর, যেন কুঁদে কাটা। ভারতের উঁচু জাতের সব লোকেরই বংশানুক্রমে তাই হয়। তবে, যখন তার বাপ মা তার উপর পরিবারের সব দায়িত্ব ফেলে দিয়ে মারা গেল তখন সে কচি ছেলে। থাকবার মধ্যে তার ছিল শুধু ক-খানা হাত-পা। ভাগ্য ভাল যে পরিবারটি ছিল ছোট, শুধু তার ছোট ভাই আর ছোট বোনকে নিয়ে।
তখন মোতির বয়স চোদ্দ, ছ-বছর হল তার বিয়ে হয়েছে। হঠাৎ নিজেকে পরিবারের কর্তা হয়ে পড়তে দেখে সে প্রথমেই যা-যা কাজ করল, তার মধ্যে একটা হল তার বার বছরের বউকে শ্বশুরবাড়ি থেকে আনিয়ে নেওয়া। বিয়ের পর থেকে তাদের আর দেখা হয় নি। বউ ছিল বাপের বাড়িতে, কালাধুঙ্গি থেকে মাইল বার দূরে, কোটাদুন গ্রামে।
ওয়ারিস সূত্রে মোতি যে আঠার বিঘে জমি পেয়েছিল, তা চাষ করা তো এই চারটি বাচ্ছা ছেলেমেয়ের কর্ম নয়; তাই মোতি একজন ভাগীদার নিল, স্থানীয় ভাষায় যাকে বলে “সাগী”। সে দিনরাত কাজ করার বিনিময়ে পাবে মাগনায় থাকা খাওয়া আর ফসলের অর্ধেক।
সরকারী ছাড়পত্র নিয়ে বহুদূর থেকে মাথায় আর ঘাড়ে করে বয়ে জঙ্গল থেকে বাঁশ আর ঘাস এনে সবাই মিলে থাকবার জন্যে একটি ঘর তৈরি করা মোতি আর তার সাহায্যকারীদের পক্ষে বড্ড কষ্টকর হবে বলে আমি তাদের একটা বাড়ি বানিয়ে দিলুম। তাতে ছিল তিনখানা ঘর আর চওড়া একটা বারান্দা, অর ভিত চার ফুট উঁচু। মোতির বউ একটু উঁচু অঞ্চল থেকে এসেছিল বলে সে ছাড়া আর সবাই ছিল ম্যালেরিয়ার জর্জরিত।
ফসল রক্ষা করবার জন্যে প্রজারা সারা গ্রামটাকে কাঁটাগাছের বেড়া দিত। এর জন্যে কয়েক সপ্তাহ ধরে কঠিন খাটুনি খাটতে হত বটে, কিন্তু এই পলকা বেড়ায় বুনো জন্তুদের বা দল-ছাড়া গরু-মোষদের ঠেকিয়ে রাখা যেত না। যখন জমিতে ফসল থাকত তখন প্রজারা কিংবা তাদের পরিবারের লোকেরা সারা রাত জেগে খেত পাহারা দিত।
বন্দুক দেওয়া সম্বন্ধে খুব কড়াকাড়ি ছিল বলে আমাদের চল্লিশ জন প্রজার জন্যে গভর্নমেন্ট থেকে মোটে একটা, একনলা গাদা বন্দুক দেওয়া হয়েছিল। এই বন্দুকটি পালা করে এক-এক জনে নিত, তাতে শুধু তার খেত পাহারা দেবার কাজ চলত বাকি সবাইকে নির্ভর করতে হত ক্যানেস্তারার উপর–তা পিটিয়ে সারা রাত কাটাত।
শুয়োর আর শজারুগুলোই ছিল যত নষ্টের গোড়া। বন্দুকটা দিয়ে মেলা শুয়োর আর শজারু মারা হত বটে, তবু প্রতি রাতেই প্রচুর ক্ষতি হত; কেননা গ্রামটার কাছাকাছি আর কোনো গ্রাম ছিল না, আর তার চারপাশেই ছিল বন। তাই, যখন মোকামা ঘাটে আমার ঠিকাদারী কাজ থেকে লাভ হতে লাগল; তখন আমি গ্রাম ঘিরে একটা পাকা পাঁচিল তুলতে শুরু করলুম। যখন শেষ হল, সেটা হল ছ-ফুট উঁচু আর তিন মাইল লম্বা। সেটা তৈরি করতে দশটি বছর লেগেছিল, কেননা, আমার লাভের পরিমাণ ছিল যৎসামান্য।
আজ মোটরে করে বোর নদীর পুল পার হয়ে হলদোয়ানি থেকে কালাধুঙ্গি হয়ে রামনগর যেতে হলে বনে ঢোকবার আগে সেই প্রাচীরটার উঁচু দিকের মাথাটার পাশ দিয়ে যেতে হবে।
একদিন ডিসেম্বরের ঠান্ডা সকালে আমি গ্রামের মধ্য দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলুম। সঙ্গে ছিল আমার কুকুর রবিন। সে আমার আগে-আগে ছুটছিল আর তাড়া খেয়ে ঝাঁকের পর ঝক ছাইরঙা তিতির পাখি উঠে পড়ছিল। এক রবিন ছাড়া আর কেউ কখনও তাদের ঘাঁটাত না, কেননা গ্রামের সবাই সকাল সন্ধ্যায় তাদের ডাক শুনতে ভালবাসত। এমন সময় একটা জলসেচের নালার ধারে নরম জমিতে আমি একটা শুয়োরের খুরের ছাপ দেখতে পেলুম।
শুয়োরটা প্রায় একটা মোষের বাচ্চার মত বড়। তার গজদাঁত ছিল প্রকাণ্ড, বাঁকা, আর দেখতে ভয়ানক। গ্রামের সবাই তাকে চিনত। একেবারে বাচ্চা অবস্থা থেকে সে কাটাঝোঁপের বেড়ার ফাঁকে গলে খেতে ঢুকে ফসল খেয়ে-খেয়ে মোটা হয়েছিল। পাঁচিল হওয়ায় প্রথমে সে একটু ভাবনায় পড়ে গিয়েছিল বটে, কিন্তু সেও কম জেদী নয়, আর পাঁচিলটার গা-ও ছিল এবড়ো-খেবড়ো। তাই সে ক্রমে-ক্রমে পাঁচিলে উঠতে শিখে নিল। কতবার খেতের প্রহরীরা তাকে গুলি করেছে, কয়েকবার সে রক্তের দাগ রেখেও গিয়েছে। কিন্তু তার আঘাত কখনও মারাত্মক হয় নি। এর একমাত্র ফল হয়েছে এই যে, সে আরও হুশিয়ার হয়ে গিয়েছে।
ডিসেম্বরের এই ভোরে শুয়োরটার খুরের ছাপ ধরে আমি মোতির খেত অবধি গেলুম। কাছাকাছি যেতেই দেখি, মোতির বউ কোমরে দুই হাত রেখে খেতের সামনে দাঁড়িয়ে তাদের আলুর খেতের ধ্বংসাবশেষ লক্ষ করছে।
শুয়োরটা রীতিমত ক্ষতি করে গিয়েছিল। আলুগুলো পুষ্ট হয় নি। শুয়োরটারও খিদে পেয়েছিল নিশ্চয়। উৎপাতটা কোন দিকে গিয়েছিল রবিন তা খুঁজে দেখতে লাগল। ততক্ষণে স্ত্রীলোকটি তার মনের ভাব ব্যক্ত করতে শুরু করেছে। সে বললে, ‘সব দোষ হচ্ছে পুনোয়ার বাবার। কাল রাতে বন্দুকের পালা ছিল তারই। সে কোথায় ঘরে থেকে নিজের খেত পাহারা দেবে, না, সে গেল কালুর গম-খেতে বসে সম্বর হরিণ মারবার আশায়। সেও গেছে, আর শয়তানটা এসে এই কাণ্ড করে গেছে।
ভারতে আমরা যেখানে থাকি সেই অঞ্চলে কোনো স্ত্রীলোক তার স্বামীর নাম উচ্চারণ করে না, তাকে নাম ধরে ডাকেও না। ছেলেমেয়ে হবার আগে তাকে বাড়ির লোক’ বলে উল্লেখ করা হয়, আর ছেলেমেয়ে হবার পর তাকে বলা আর ডাকা হয় তার প্রথম সন্তানের বাবা বলে। তখন মোতির তিনটি ছেলেমেয়ে হয়েছে, তাদের মধ্যে পুনোয়া বড়। তাই সে তার স্ত্রীর কাছে পুনোয়ার বাপ’ আর স্ত্রী গ্রামের সকলের কছে ‘পুনোয়ার মা’ বলেই পরিচিত।
পরিশ্রমী, তেমনি সে সকলের চেয়ে বেশি মুখরা। গত রাত্রে বাড়িতে না থাকায় পুনোয়ার বাপ সম্বন্ধে তার যা মনোভাব তা সে খুব স্পষ্ট ভাষায় বলা শেষ করে তারপর আমাকে নিয়ে পড়ল।
সে বললে যে, যে-পাঁচিলে উঠে আলু খেয়ে যেতে পারে, এমন পাঁচিল বানিয়ে আমি শুধু কতকগুলি টাকাই নষ্ট করেছি। যদি আমার শুয়োরটাকে মারবার ক্ষমতা না-ই থাকে তবে আমার উচিত হচ্ছে পাঁচিলটাকে আরও কয়েক ফুট উঁচু করে দেওয়া যাতে শুয়োরটা তাকে ডিঙোতে না পারে। ভাগ্যক্রমে আমার মাথার উপর এই ঝড় বইতে থাকার কালেই মোতি এসে পড়ল। অমনি আমি শিস দিয়ে রবিনকে ডেকে নিয়ে, মোতিকে সেই ঝাঁপটা সামলাবার জন্যে রেখে তাড়াতাড়ি সরে পড়লুম।
সেই সন্ধ্যেবেলায়ই আমি পাঁচিলটার একেবারে ও-মাথায় সেই শুয়োরটার খুরের ছাপ দেখতে পেয়ে, কখনও জানোয়ারদের চলাচলের রাস্তা ধরে কখনও বা বোর নদীর তীর ধরে ধরে মাইল দুই চলে গেলুম। শেষে এসে পৌঁছলুম- ল্যান্টানা-লতায় জড়াজড়ি একটা ঘন কাটা-ঝোঁপের ধারে। এই ঝোঁপের ধারে আমি ঠাই নিলুম, কেননা গুলি চালাবার মত আলো যতক্ষণ থাকবে, ততক্ষণের মধ্যে শুয়োরটার এখান থেকে বেরিয়ে আসার সম্ভাবনা আট-আনা রকম ছিল।
নদীর পাড়ে একটা পাথরের পেছনে বসে পড়লুম। খানিক বাদেই কাছে একটা জঙ্গলের ও-মাথায় একটা সম্বর হরিণী ডাকতে শুরু করল। সেই বনেই কয়েক বছর বাদে আমি ‘পাওআলগড়ের কুমার-কে’* [* Man-Eaters of Kumaon] গুলি করে মেরেছিলুম। হরিণীটা বনের প্রাণীদের একটা বাঘের উপস্থিতি সম্বন্ধে সাবধান করে দিচ্ছিল।
দিন-পনের আগে তিনজন শিকারীর একটি দল আটটি হাতি নিয়ে কালাধুঙ্গিতে এসেছিল। জঙ্গলের একটা ব্লকে শিকার করবার একটা পাস ছিল আমার। সেই ব্লকেই তখন আস্তানা গেড়েছিল একটা বাঘ। এই শিকারীদের প্রকাশ্য উদ্দেশ্য ছিল সেটাকে মারা।
তারা যে ব্লকটা নিয়েছিল, সেটার আর আমারটার মধ্যে ছিল বোর নদী। বাঘটাকে ফুসলে নিজেদের ব্লকে নিয়ে আসবার জন্যে তারা নদীর নিজেদের দিকের পাড়ে চোদ্দটা বাচ্চা মোষ বেঁধে রেখেছিল। তার মধ্যে দুটোকে বাঘটা মেরেছিল, বাকি বারটা অবহেলায় আর না খেয়ে মারা পড়েছিল। আগের রাতে আন্দাজ ন-টার সময় আমি একটা ভারি রাইফেলের আওয়াজ শুনেছিলুম।
ঘণ্টা-দুই ধরে পাথরখানার পিছনে বসে থেকে আমি সম্বরটার ডাক শুনলুম, কিন্তু শুয়োরটার কোনো চিহ্ন দেখলুম না। শেষে যখন আর শিকার করবার মতো আলো রইল না, তখন আমি নদী পার হয়ে কোটা যাবার রাস্তায় পৌঁছে সেটা ধরে নিচে নামতে লাগলুম।
কয়েকটা গুহার পাশ দিয়ে যাবার সময় আস্তে আর সাবধানে যেতে হল, কারণ ওখানে ছিল একটা প্রকাণ্ড ময়াল সাপের বাসা। তাছাড়া ওখানেই মাসখানেক আগে বনবিভাগের বিল বেইলি একটা আট হাত লম্বা শঙ্খচুড়কে গুলি করে মেরেছিল। গ্রামের দরজায় পৌঁছে আমি থেমে চেঁচিয়ে মোতিকে বললুম সে যেন পরদিন সকালে খুব ভোরেই আমার সঙ্গে যাবার জন্যে তৈরি থাকে।
মোতি অনেক বছর ধরে কালাধুঙ্গিতে আমার নিত্যসঙ্গী ছিল। সে ছিল উৎসাহী আর বুদ্ধিমান, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিশক্তি আর শ্রবণশক্তি-সম্পন্ন। সে নিঃশব্দে বনের মধ্যে চলাফেরা করতে পারত, আর তার সাহস ছিল মানুষের পক্ষে যতটা থাকা সম্ভব। সে কখনও নির্ধারিত কাজে দেরি করে আসত না। সেই ভোরে যখন আমরা শিশির-ভেজা বনের মধ্য দিয়ে বন-জাগানো অনেক রকম শব্দ শুনতে-শুনতে পথ চলছিলুম, তখন আমি তাকে সম্বর হরিণীটার ডাকের কথা বলে বললুম যে আমার সন্দেহ হয় সে বাঘটা দেখেছিল তার বাচ্চাকে মারছে এবং দাঁড়িয়ে থেকে বাঘটাকে মড়ি নিয়ে বসে থাকতে দেখেছিল। এরকম ঘটনা বিরল নয়। তার একটানা ডাকের আর কোনো মানে আমি করতে পারি নি।
টাটকা একটা মড়ি পেয়ে যাবার সম্ভাবনা আছে জেনে মোতি উৎফুল্ল হয়ে উঠল, কেননা তার যা সংগতি ছিল তাতে মাসে একবারের বেশি সে তার পরিবারের জন্য মাংস কিনে খেতে পারত না। তাই, বাঘের কিংবা চিতার টাটকা-মারা একটা সম্বর, চিতল বা শুয়োর পাওয়া তার পক্ষে দেবতার আশীর্বাদের মত হত।
আমি গত সন্ধ্যায় যেখানে ছিলুম সম্বর ডাকার জায়গাটা সেখান থেকে সোজা উত্তরে হাজার-দেড়েক গজ দূরে বলে ঠিক করেছিলুম। কিন্তু পোঁছে কোনো মড়ি দেখতে না পেয়ে আমরা মাটিতে রক্ত, লোম, বা হেঁচড়ে নিয়ে যাবার দাগ খুঁজতে লাগলুম, যা থেকে আমরা মড়িটার হদিস পেতে পারি। আমার তখনও দৃঢ় ধারণা যে এমন একটা মড়ি নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে যেটাকে বাঘেই মেরেছে।
কয়েকশো গজ দূরে একটা পাহাড়ের তলা থেকে বেরিয়ে দুটো অগভীর খাত এসে এই জায়গায় মিলেছে। খাত দুটো মোটামুটি সমান্তরালভাবে গজ-তিরিশেক ব্যবধানে চলে গিয়েছে। মোতি বললে যে সে ডানদিকেরটা, আর আমি বাঁ-দিকেরটা ধরে এগিয়ে গেলে হয়। দুয়ের মাঝখানে শুধু নিচু-নিচু ঝোঁপ থাকায় আমরা দুজনে দু-জনকে দেখতে পাব আর কাছাকাছিও থাকব, এই ভেবে আমি তার কথায় রাজী হয়ে গেলুম।
তন্ন-তন্ন করে জমিটা দেখব বলে আমরা খুব আস্তে-আস্তে শ-খানেক গজ এগিয়েছি, এমন সময় আমি ঘাড় ফিরিয়ে মোতিকে দেখতে যেতেই দেখি যে সে চিৎকার করে পিছু হটে গেল। তারপর সে এক ঝটকায় ফিরে দাঁড়িয়ে প্রাণপণে ছুট দিল। এমনভাবে যে তার দুই হাত হাওয়ায় চাপড়াতে লাগল, যেন সে এক ঝাঁক মৌমাছিকে খেদাচ্ছে।
জঙ্গলে যেখানে এক মুহূর্ত আগে সব নিস্তব্ধ ছিল, হঠাৎ সেখানে মানুষের মর্মভেদী আর্তনাদ শুনতে ভয়ানক লাগে। তা বর্ণনা করা অসম্ভব। সহজ বুদ্ধিতে বুঝে নিলুম কী হয়েছে। রক্ত বা লোম দেখবার জন্যে মাটির দিকে চোখ রেখে যেতে-যেতে মোতি খেয়াল করে নি সে কোথায় চলেছে। এইভাবে সে পড়েছে একেবারে বাঘটার উপর।
সে বেশি আঁচড়-কামড় খেয়েছে কি না দেখতে পেলুম না, কেননা ঝোঁপ-ঝাড়ের উপরে শুধু তার মাথা আর কাধ জেগে ছিল।
সে যখন দৌড়চ্ছিল আমি তখন তার এক ফুট পিছনে বন্দুক তাক করে ছিলুম, কিছু নড়তে দেখলেই ঘোড়া টিপব, এই উদ্দেশ্যে। কিন্তু আমি ঘুরে দাঁড়ানো পর্যন্ত কিছু নড়ল না দেখে হাঁপ ছেড়ে বাঁচলুম। মোতি দৌড়ে শ-খানেকগজ যাবার পর আমি মনে করলুম যে আর বিপদ নেই। চিৎকার করে তাকে থামতে বলে বললুম যে আমি তার কাছে যাচ্ছি। তারপর কয়েক গজ পিছু হটে গেলুম, কেননা বাঘটা তার জায়গা ছেড়েছে কি না জানা যাচ্ছিল না। তারপর খাদটা ধরে তাড়াতাড়ি মোতির দিকে গেলুম।
সে একটা গাছে পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। দেখে খুব নিশ্চিন্ত হলুম যে তার গায়ে কিংবা পায়ের তলার মাটিতে রক্ত দেখা যাচ্ছে না। কাছে পৌঁছতেই সে আমায় জিজ্যেস করল কী হয়েছিল। কিছুই হয় নি বলায় সে অবাক হয়ে গেল। জিগ্যেস করল, ‘বাঘটা আমার দিকে লাফ দেয় নি, কিংবা পিছনে আসে নি? আমি বললুম সে বাঘটা যাতে তা করে, তার জন্যে মোতির চেষ্টার কোনো ত্রুটি হয় নি। তখন সে বললে, “জানি সাহেব, তা জানি আমি। আমার দৌড়নো আর চেঁচানো উচিত হয় নি, কিন্তু আমি–তা না করে পা-র-লু-ম না!” তার গলার আওয়াজ জড়িয়ে এল, মাথাটা সামনে ঝুঁকে পড়ল।
আমি তার গলাটা ধরতে যেতেই সে আমার হাত ফসকে ধপ করে মাটিতে পড়ে গেল। তার মুখ একেবারে রক্তশূন্য হয়ে গেল, দেহ একেবারে স্থির হয়ে পড়ে রইল। তার দিকে চেয়ে আমার প্রতিটি মিনিট অতি দীর্ঘ মনে হতে লাগল, আর ভয় হল যে এই মানসিক আঘাতে তার মৃত্যু হয়েছে।
এ-ধরনের আকস্মিক দুর্বিপাকে এই জঙ্গলে সামান্যই করবার থাকে। সেই সামান্য কাজটুকুই করলুম। মোতিকে চিত করে শুইয়ে, তার জামা-কাপড় সব ঢিলে করে দিয়ে তার বুকের কাছটা ডলতে লাগলুম। যখন আমি আশা ছেড়ে দিয়েছি এবং তাকে বয়ে বাড়ি নিয়ে যাবার জন্যে তৈরি হচ্ছি, তখন সে চোখ খুলল।
মোতি যখন সুস্থ হয়ে ঠোঁটের ফাঁকে একটি আধপোড়া সিগারেট চেপে ধরে গাছে পিঠ দিয়ে মাটিতে বসল, তখন আমি ব্যাপারটা ঠিক কী ঘটেছিল তাকে বলতে বললুম।
সে বললে, আপনাকে ছেড়ে যাবার পর আমি জমিতে রক্ত কিংবা লোমের চিহ্ন আছে কি না তা ভাল করে দেখতে-দেখতে খাদটা ধরে খানিকটা এগিয়ে যেতেই একটা পাতার উপর কি যেন একটা দেখতে পেলুম। সেটা এক ফোঁটা শুকনো রক্তের মতো দেখতে। কাজেই আরও কাছে থেকে সেটাকে দেখবার জন্যে আমি হেঁট হলুম। তারপর যেই না মুখ তুলেছি, অমনি সোজা বাঘটার মুখের উপর আমার চোখ পড়ল। সেটা তিন কি চার পা দূরে মাটিতে নিচু হয়ে বসে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। তার মাথাটা একটু উঁচু করা ছিল, মুখটা একেবারে খোলা। থুতনিতে আর বুকে রক্ত মাখানো।
দেখে মনে হল যে সে আমার দিকে লাফ মারে আর কি! তাই দেখে আমার মাথা বিগড়ে গেল, আমি চিৎকার করে দৌড় লাগালুম।সম্বরের মড়িটার কিছুই সে দেখতে পায় নি। সেখানে জমিটা ফঁকা, ঝোঁপ-ঝাড় কিছু নেই। বাঘটা যেখানে শুয়ে, কোনো মড়ি নেই সেখানে।
মোতিকে সেখানেই থাকতে বলে অমি সিগারেটটা নিবিয়ে তদন্তে বেরিয়ে পড়লুম। যে-বাঘের মুখ হাঁ হয়ে রয়েছে, যার থুতনিতে আর বুকে রক্ত লেগে রয়েছে, সে যে কেন মোতিকে খোলা জমির উপর দিয়ে তার কয়েক হাতের মধ্যে আসতে দিল, আর মোতি তার মুখের সামনে চিৎকার করে উঠলেও তাকে মেরে ফেলল না–এর কোনো কারণ আমি ভেবে পেলুম না।
চিৎকার করে ওঠবার সময় মোতি যেখানটায় ছিল, খুব সাবধানে এগিয়ে গেলুম সেখানে। দেখি, যে সামনেই একটা ফাঁকা জায়গা। বাঘটা এপাশ-ওপাশ গড়াগড়ি খেয়ে সেখানে বিছানো মরা পাতাগুলোকে যেন ঝেটিয়ে দিয়েছে। খালি জমিটার এধারে ধনুকের আকারে চাপ-বাঁধা জমাট রক্ত। যাতে জায়গাটা ওলট-পালট না হয়, সেইজন্যে বাঘটা যেখানে শুয়ে ছিল তার ধার দিয়ে ঘুরে গিয়ে, আমি ওধারে একটা টাটকা রক্তের দাগ চলে গেছে দেখতে পেলুম। সেটা যে কেন এঁকে-বেঁকে পাহাড়ের দিকে চলে গিয়েছিল, আপাতদৃষ্টিতে তার কোনো কারণ দেখা গেল না।
সেখান থেকে পাহাড় ধরে কয়েকশো গজ এগিয়ে গিয়ে দাগটা যে গভীর আর সংকীর্ণ গিরিখাদের মধ্যে চলে গিয়েছে, সেখানে ছোট একটা ঝরনা বয়ে যাচ্ছে। পাদ-শৈলমালার মধ্যে অনেকখানি চলে গিয়েছে এই গিরিখাদটা। বাঘটা এটা ধরে উপর দিকে গিয়েছে। খোলা জমিটাতে ফিরে এসে চাপ-বাঁধা রক্তটা পরীক্ষা করে দেখলুম। তার মধ্যে হাড়ের আর দাঁতের ভাঙা টুকরো দেখা গেল। আমি যা জানতে চাইছিলুম, এই কুচিগুলো আমাকে সে কথাটা বলে দিল। দু-রাত আগে যে রাইফেলের গুলির শব্দ পেয়েছিলুম, সেটা বাঘটার নিচের চোয়াল চূর্ণ করে দিয়েছিল। তারপর সে যে-বনে থাকত সে বনে চলে গিয়েছিল।
যন্ত্রণায় আর রক্তক্ষয়ে কাতর হয়ে সে যতদূর পারে চলে এসেছিল। তারপর সে যেখানে এসে লুটিয়ে পড়ল, সেইখানেই সে সম্বর হরিণীটা তাকে ছটফট করতে দেখতে পেয়েছিল। তার তিরিশ ঘণ্টা বাদে মোতি সেইখানেই তার কাছে গিয়ে পড়েছিল। কোনো পশুর নিচের চোয়াল চূর্ণ হয়ে যাওয়াটা হচ্ছে তার পক্ষে সবচাইতে কষ্টকর।
সেই জখমের তাড়সে বাঘটার প্রবল জ্বর এসেছিল বোঝা গেল। মোতি যখন তার মুখের উপরেই চিৎকার করে উঠেছিল, বেচারার তখন বোধহয় আধা-বেহুঁশ অবস্থা। সে নিঃশব্দে উঠে সেই গিরিখাদটাতে পৌঁছবার জন্যে চরম চেষ্টা করবে বলে টলতে-টলতে চলে গিয়েছিল, কারণ সে জানত যে সেখানে জল আছে।
আমার অনুমানগুলো সত্যি কি না যাচাই করবার জন্যে মোতি আর আমি নদীটা পার হয়ে ওধারের ব্লকে যেখানে চোদ্দটা মোষ বাঁধা হয়েছিল সে জায়গাটা দেখতে গেলুম। এখানে একটা গাছে খুব উঁচুতে যে মাচানে শিকারী তিনজন বসেছিল সেটা দেখতে গেলুম, আর গুলিটা খাবার সময় বাঘটা যে মোষটাকে খাচ্ছিল, সেটাও পড়ে ছিল। সেই মড়ি থেকে মোটা একটা রক্তের দাগ নদীটা পর্যন্ত চলে গিয়েছিল, তার দু-পাশে হাতির পায়ের ছাপ।
মোতিকে নদীর ডান-পাড়ে রেখে আমি নদী পার হয়ে ব্লকে গেলুম। সেখানে আবার রক্তের দাগ আর হাতির পায়ের ছাপ খুঁজে বের করা পাঁচ-ছশো গজ গিয়ে ঘন ঝোঁপ মিলল। হাতিগুলো এর ধারে এসে থেমেছিল, তারপর কিছুক্ষণ ওখানে দাঁড়িয়ে থেকে ডাইনে ফিরে কালাধুঙ্গির দিকে গিয়েছিল। আগের দিন সন্ধেবেলা আমি যখন সেই শুয়োরটাকে শিকার করবার চেষ্টায় চলেছি, তখন সেই ফিরতি হাতিগুলোকে দেখেছিলুম।
একজন শিকারী আমাকে জিগ্যেস করেছিল যে আমি কোথায় চলেছি। আমি তাকে সে কথা বলায় সে আমায় যেন কিছু একটা বলতে চাইল, কিন্তু তার সঙ্গীরা তাকে বাধা দিল। কাজেই তিন শিকারীর দলটি যে বন-বিভাগের বাংলোটায় উঠেছিল, সেইদিকেই হাতি চড়ে চলে গেল। যে-জঙ্গলে তারা একটা আহত বাঘকে ফেলে রেখে গেল, পায়ে হেঁটে আমি তার ভিতরে গিয়েছিলুম–কেউ সাবধান করেও দিল না।
মোতিকে যেখানে রেখে গিয়েছিলুম সেখান থেকে গ্রামে ফিরে যেতে তিন মাইল পথ, কিন্তু সে-টুকু যেতে আমাদের তিন ঘণ্টাই লাগল, কারণ-বলতে পারি না কেন–মোতি ভারি দুর্বল হয়ে পড়েছিল আর ঘন-ঘন বিশ্রাম নিচ্ছিল। তাকে তার বাড়িতে রেখে আমি সোজা বন-বিভাগের বাংলোয় চলে গেলুম। গিয়ে দেখি তিন জনের সেই দলটি মোট-ঘাট বেঁধে রওনা হচ্ছে হলদোয়ানিতে গিয়ে সন্ধের ট্রেন ধরবার জন্যে। বারান্দায় সিঁড়ির উপর দাঁড়িয়ে খানিকক্ষণ তাদের সঙ্গে কথা হল। বেশির ভাগ কথা অবশ্য আমিই বললুম। যখন শুনলুম যে বাঘটাকে আহত করেও সেটার পিছনে না যাবার একমাত্র কারণ এই যে তাদের একটা নেমন্তন্ন রাখতে যেতে হবে, তখন তাদের বললুম যে মোতি যদি ঐ ধাক্কায় মারা যায়, কিংবা যদি বাঘটা আমার কোনো প্রজাকে মারে তাহলে তাদের খুনের মামলায় পড়তে হবে।
আমার সঙ্গে কথা বলেই দলটা চলে গেল। পরদিন সকালে ভারি একটা রাইফেল নিয়ে আমি বাঘটা যে গিরিখাদ দিয়ে গিয়েছে সেটার মধ্যে ঢুকলুম। আমার উদ্দেশ্য ছিল অপরের শিকারের একটা স্মারক নিয়ে আসা নয়, বাঘটাকে কষ্ট থেকে মুক্তি দিয়ে তার চামড়াটাকে পুড়িয়ে ফেলা।
গিরিখাদটার প্রতি ফুট জায়গা আমি জানতুম, কিন্তু একটা আহত বাঘকে খুঁজবার জন্যে কোনোমতেই আমি সেখানে যেতুম না। তবু সে জায়গাটা আর দু-পাশের দুই পাহাড় আমি সারাটা দিন ধরে আগাপাশতলা খুঁজে দেখলুম, কিন্তু বাঘের কোনো চিহ্ন পেলুম না, কারণ সে গিরিখাদটার মধ্যে ঢোকবার পরই রক্তের চিহ্ন হঠাৎ লোপ পেয়ে গিয়েছিল।
দশদিন পরে একজন বন-রক্ষী তার রোদে বেরিয়ে শকুনিতে খাওয়া একটা বাঘের দেহাবশেষ দেখতে পায়। সেই বছর গ্রীষ্মকালে সরকার থেকে নিয়ম করা হল যে সূর্যাস্ত থেকে সূর্যোদয়ের মধ্যে বাঘ মারবার জন্যে কেউ বসতে পারবে না, এবং কোনো শিকারী যদি কোনো বাঘকে জখম করে তাহলে সে সেটাকে মেরে ফেলবার চেষ্টা করতে বাধ্য। আর তাছাড়া তাকে সবচেয়ে কাছের বন-বিভাগের কর্মচারীকে আর পুলিসের ফাঁড়িতে তখনই খবরটা জানিয়ে দিতে হবে।
মোতির এই অভিজ্ঞতা হল ডিসেম্বর মাসে। পরের এপ্রিলে আমরা যখন নৈনিতাল চলে যাই, তখন তাকে এই চোটটার জন্যে বিশেষ কাহিল দেখলুম না। কিন্তু তার বরাত মন্দ। মাসখানেই বাদেই তার খেতে একটা চিতাকে গুলি করে সেটার পিছনে-পিছনে একটা ঘন ঝোঁপ পর্যন্ত যায়। সেখানে সেটা তাকে ক্ষত-বিক্ষত করে ফেলে। এই জখমগুলো থেকে সেরে উঠতে না উঠতেই সে দুর্ভাগ্যক্রমে একটি গরুর মৃত্যুর কারণ হয়–যা হল হিন্দুর পক্ষে সবচেয়ে বড় পাপ।
বুড়ো জরাজীর্ণ গরুটা পাশের একটা গ্রাম থেকে ভুলে এসে মোতির খেতে চরছিল। সেটাকে তাড়িয়ে দেবার চেষ্টা করতেই সেটার পা একটা ইঁদুর-গর্তে পড়ে গিয়ে ভেঙে গেল। গরুটা মোতির খেতে পড়ে রইল। মোতি কয়েক সপ্তাহ ধরে যথাসাধ্য তার সেবা করা সত্ত্বেও সেটা শেষ পর্যন্ত মরেই গেল। ব্যাপারটা এতই গুরুতর যে গ্রামের পুরোহিত আর এতে হস্তক্ষেপ না করে মোতিকে হরিদ্বারে তীর্থে যেতে আদেশ করলেন। কাজেই মোতি রাহাখরচ ধার করে হরিদ্বার গেল।
সেখানে প্রধান মন্দিরের প্রধান পুরোহিতের কাছে গিয়ে মোতি তার পাপের কথা • স্বীকার করল। কেষ্ট-বিচ্ছু ভদ্রলোক বেশ ভাল করে বিবেচনা করে মোতিকে আদেশ করলেন, মন্দিরে কিছু টাকা দিতে হবে। তাতে তার পাপটা ঘুচে যাবে বটে, কিন্তু সে যে অনুতপ্ত হয়েছে তা দেখানোর জন্যে তাকে একটা প্রায়শ্চিত্তও করতে হবে। এই বলে তিনি মোতিকে জিজ্ঞাসা করলেন যে তার সবচাইতে বেশি সুখ কিসে। মোতি মানুষটা সরল, তাই সে বলে ফেলল যে শিকার করা আর মাংস খাওয়াতেই তার সবচেয়ে বেশি আনন্দ। পুরোহিত তখন তাকে বললেন যে ভবিষ্যতে তাকে এ দুটো সুখ ত্যাগ করতে হবে।
মোতি পাপ থেকে মুক্তি পেয়ে তীর্থ করে ফিরে এল বটে, কিন্তু জীবনভোর এক প্রায়শ্চিত্তের বোঝা তার ঘাড়ে পড়ল। শিকার করবার সুযোগ তার খুব কমই হত, কেননা সে দোনলা বন্দুকটা সে অন্য সকলের সঙ্গে ভাগে-যোগে ব্যবহার করতে পেত বই তো নয়! তা ছাড়া, তা দিয়ে সে শুধু গ্রামের মধ্যেই শিকার করতে পেত। তার অবস্থার লোকে সরকারী বনে শিকারের অনুমতি পেত না। তা হলেও সেই পুরনো বন্দুকটা চালিয়ে সে খুব আনন্দ পেত, আর আমি মধ্যে-মধ্যে যদিও একেবারে বেআইনীভাবে তাকে আমার রাইফেলটাও ছুঁড়তে দিতুম।
তার প্রায়শ্চিত্তের এই অংশটা খুবই কষ্টকর ছিল তা ঠিক, কিন্তু অপর অংশটা মোতির পক্ষে একেবারে মারাত্মক হয়ে উঠল। তা ছাড়া, এতে তার স্বাস্থ্যও খারাপ হয়ে গেল। যদিও তার সামান্য অবস্থায় সে মাসে বড়জোর একবার অল্প একটু মাংস কিনে খেতে পারত, তাহলেও শুয়োর আর শজারু পাওয়া যেত প্রচুর, হরিণও মধ্যে-মধ্যে রাতের বেলায় খেতে এসে পড়ত।
আমাদের গ্রামে একটা প্রথা ছিল–আমিও সেটা মেনে চলতুম–যে, একজন কিছু শিকার করলে সবাই তার ভাগ পাবে। কাজেই মোতি শুধু যেটুকু মাংস কিনে খেতে পারত, তার উপরেই নির্ভর করে থাকতে হত না তাকে।
হরিদ্বার থেকে তীর্থ করে ফিরে আসবার পরেই শীতকালটাতে মোতির সাংঘাতিক কাশি দেখা দিল। আমরা যে ওষুধ দিলুম তাতে আরাম না হওয়ায় আমি তাকে ডাক্তার দেখলুম। তিনি যে সময় কালাধুঙ্গি হয়ে কোথায় যাচ্ছিলেন। তার কাছে শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেলুম যে মোতির যক্ষ্মা হয়েছে। ডাক্তারের কথায় মোতিকে তিরিশ মাইল দূরে ভাওয়ালী স্বাস্থ্য-নিবাসে পাঠিয়ে দিলুম। পাঁচদিন বাদে সে সেখানকার কর্তার কাছ থেকে এক চিঠি নিয়ে ফিরে এল, তাতে লেখা যে, এর বাঁচবার কোননা আশা নেই বলে একে ভর্তি করে নেওয়া গেল না, তার জন্যে অধ্যক্ষ-মশায় দুঃখিত।
একজন ডাক্তার পাদরি তখন আমাদের ওখানে ছিলেন। তিনি এক স্বাস্থ্য-নিবাসে কয়েক বছর কাজ করেছিলেন। তিনি পরামর্শ দিলেন যে মোতি যেন ভোলা হাওয়ায় শুয়ে থাকে, আর রোজ সকালে কয়েক ফোঁটা প্যারাফিন দিয়ে আধসের দুধ খায়। তাই সারা শীতটা মোতি খোলা হাওয়ায় শুয়ে কাটাল। সকালবেলা সে আমাদের বারান্দায় বসে সিগারেট খেতে-খেতে আমার সঙ্গে কথা বলত আর আমাদের গরুর টাটকা দুধ আধসেরটাক করে খেত।
ভারতের গরিবরা একে অদৃষ্টবাদী, তার উপর আবার রোগের সঙ্গে যুঝবার তাগদ তাদের নেই। আমাদের সাহায্য থেকে মোতি বঞ্চিত হয় নি। কিন্তু আমাদের সঙ্গ থেকে সে বঞ্চিত হয়ে পড়ল। আমরা গ্রীষ্মকালে নৈনিতালের বাড়িতে চলে যাবার মাসখানেক বাদে সে মারা গেল।
আমাদের পাহাড়ী মেয়েরা ভারতের সবচেয়ে কঠিন পরিশ্রম করে থাকে। তাদের মধ্যে আবার সবচেয়ে পরিশ্রমী ছিল মোতির বিধবা, পুনোয়ার মা। ছোটখাট আঁটসাঁট গড়নের পাথরের মত শক্ত আর পিঁপড়ের মত কর্মঠ এই কমবয়সী মেয়েটি আবার বিয়ে করতেও পারত, কিন্তু তাতে তার জাতের বাধা ছিল। সে সাহসভরে কোমর বেঁধে ভবিষ্যতের সঙ্গে যুদ্ধ করতে প্রস্তুত হল। শিশুসন্তানগুলির সহায়তায় সে অপূর্ব বীরত্বের সঙ্গে তার কর্তব্য পালন করে যেতে লাগল।
তার তিনটি সন্তানের মধ্যে পুনোয়াই বড়, তার বয়স তখন বার। সে . প্রতিবেশীদের সাহায্যে লাঙল দিতে আর অন্য সব খেতের কাজ করতে লাগল।
তার বোন কুন্তী দশ বছরের মেয়ে, বিবাহিত। পাঁচ বছর পরে সে স্বামীর ঘর করতে যায়। সে-পর্যন্ত সে তার মাকে তার হাজারো কাজে সাহায্য করত। তার মধ্যে ছিল রান্না করা, বাসন মাজা, কাপড়-চোপড় ধোয়া আর মেরামত করা (পুনোয়ার মা তার নিজের আর ছেলেমেয়েদের কাপড়-চোপড় সম্বন্ধে হুঁশিয়ার ছিল। সেসব পোশাক যতই পুরনো আর তালি-দেওয়া হ’ক না কেন, তা পরিষ্কার থাকা চাই)। তাছাড়া, ঘরের কাজের জন্যে সেচের খাল থেকে কিংবা বোর নদী থেকে জল নিয়ে আসা; জঙ্গল থেকে জ্বালানির জন্যে কাঠ; আর দুধালো গাই আর তাদের বাছুরদের জন্যে ঘাস আর কচি পাতা নিয়ে আসা; ফসল নিড়ানো আর তা কাটা; পাথরের মধ্যে একটা গর্তে একটা লোহা বাঁধানো ডান্ডা দিয়ে ধান ভানা (ডান্ডাটা এত ভারি যে তা চালাতে পুরুষ মানুষেরও হাত ভেঙে যাবার কথা); গম ঝেড়ে পুনোয়াকে দেওয়া, যাতে সে গমগুলো নিয়ে গিয়ে পানিচাক্কিতে পেষাই করে আটা বানিয়ে নিয়ে আসতে পারে। আর প্রায়ই দু-মাইল দূরের বাজারে গিয়ে দরাদরি করে, তাদের সামর্থ্যে কুলোয় এমন যৎসামান্য খাদ্যদ্রব্য বা কাপড় কেনা।
সবচেয়ে ছোট শের সিং-এর বয়স ছিল আট। একটা ছেলে যা কিছু করতে পারে, ভোরবেলা চোখ খোলা থেকে রাত্তিরে খাওয়া-দাওয়ার পর চোখ বোজা পর্যন্ত সে তার সবকিছুই করত। এমনকি সে পুনোয়াকে লাঙল চালাতেও সাহায্য করত; তবে লাঙল ফেরাবার সময় তাকে সাহায্য করতে হত, কেননা ততটা জোর তার ছোট্ট দেহে ছিল না।
সংসারে শের সিং-এর ভাবনা কিছু ছিল না। গ্রামে তার মত হাসি-খুশি ছেলে ছিলনা একটিও। যখন তাকে দেখা যেত না, তখনও তার গলা শোনা যেত, কেননা সে গাইতে ভালবাসত। গরুগুলো বিশেষ করে তার জিম্মায় ছিল–চারটে বলদ, বারটা গাই, আটটা বাছুর, আর লালু বলে একটা ষাঁড়।
রোজ ভোরে দুধ দোহা হয়ে গেলে সে তাদের আগের দিন সন্ধ্যায় যে খুঁটি গুলিতে বেঁধে রেখেছিল তা থেকে খুলে দিয়ে, গোয়ালঘর থেকে বের করে দিয়ে, ঘেরা দেওয়ালের মধ্যেকার একটা কাটা দরজার ভিতর দিয়ে এসে গোয়াল পরিষ্কার করতে লেগে যেত। ততক্ষণ ভোরের খাবার খাওয়ার সময় হয়েছে। মা কিংবা কুন্তীর ডাক শুনতে পেলেই সে দুধের পাত্রটা হাতে করে খেতের মাঠ পার হয়ে বাড়িতে চলে আসত।
সকালবেলার যৎসামান্য খাওয়ার মধ্যে থাকত গরম-গরম রুটি আর নুন দিয়ে সরষের তেলে সাঁতলানো প্রচুর কাঁচা লঙ্কার ফোড়ন-দেওয়া ডাল। এই খাওয়া সেরে, আর ঘরের কাজ কিছু তাকে করতে বলা হলে তা করে সে তার আসল দৈনন্দিন কাজ শুরু করত। তা হচ্ছে গরুগুলিকে জঙ্গলে চরাতে নিয়ে যাওয়া, তারা হারিয়ে না যায় তা দেখা আর বাঘ এবং চিতার হাত থেকে তাদের রক্ষা করা।
ঘেরা দেওয়ালের বাইরে খোলা জায়গাটায় চারটে বলদ আর বারটা গাই রোদ পোহাত। সেখান থেকে তাদের নিয়ে, আর কুন্তীকে বাছুরগুলোর উপর নজর রাখতে বলে এই ঝকড়া-মাথা বাচ্চা ছেলেটা কাঁধে কুড়ুল আর পিছনে লালুকে নিয়ে প্রত্যেকটি গরুকে নাম ধরে ডেকে-ডেকে বোর নদী পেরিয়ে ও-পারের গভীরবনের মধ্যে নিয়ে যেত।
লালু ছিল একটা অল্পবয়সী বেঁটে ষাঁড়। তার কাজ ফুরোলে হালে বলদ করা হবে তা ঠিক করাই ছিল। কিন্তু যে-সময়ের কথা লিখছি সে-সময় সে স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়াত। সে আর শের সিং একই মায়ের দুধ খেয়েছিল বলে দু-জনে হল পাতানো ভাই। শের সিং-এর বড় গর্বের জিনিস ছিল লালু।
পাতানো ভাইটির লালু নাম শের সিং-ই দিয়েছিল–যার মানে হচ্ছে, লাল। কিন্তু লালুর রঙ লাল ছিল না–ছিল হালকা মেটে। তার ঘাড়ের রঙটা একটু বেশি গাঢ় ছিল, আর পিঠজোড়া ছিল আগাগোড়া একটা প্রায় কাল দাগ। তার শিংদুটো শক্ত, ছুঁচলো। সে সময়কার লোকের সজ্জিত ড্রেসিং টেবিলে যে রঙের শূ-হর্ন দেখা যেত, তার শিংটা ছিল সেইরকম ফিকে আর কাল দাগ দেওয়া।
মানুষ আর প্রাণীরা যখন ঘনিষ্ঠভাবে মিলে মিশে এমন অবস্থার মধ্যে বাস করে, তারা উভয়েই প্রতিদিন একই রকমের বিপদাপদের মুখোমুখি হয়, এবং একে অপরকে সাহস আর ভরসা যোগায়।
শের সিং-এর বাপ-ঠাকুরদারা মানুষের হাটের চাইতে বনে-জঙ্গলেই বেশি ভাল থাকত। চলন্ত কোনো কিছুকে তার শের সিং-ও ভয় করত না। অল্প বয়সী এবং তেজস্বী লালুরও নিজের উপর ভরসা ছিল অগাধ। তাই শের সিং-এর থেকে লালু পেত সাহস, আর লালুর থেকে শের সিং পেত ভরসা। তার ফলে যেখানে অন্যেরা . যেতে ভয় পেত, সেখান পর্যন্ত শের সিং-এর গরুরা চলত। আর গ্রামের মধ্যে সবচেয়ে হৃষ্ট-পুষ্ট গরু বলে আর বাঘ কিংবা চিতা কখনও তাদের একটাকে মারে নি বলে শের সিং যে গর্ব করত, সেটা অন্যায্য নয়।
আমাদের গ্রাম থেকে মাইল-চারেক দূরে একটা পাঁচ মাইল লম্বা উপত্যকা আছে। সেটা উত্তর-দক্ষিণে বিস্তৃত। উত্তরপ্রদেশের সারা পাঁচ হাজার বর্গমাইল বন-জঙ্গলের মধ্যে সৌন্দর্যে এবং বন্যপ্রাণীর প্রাচুর্যে এই উপত্যকাটির তুলনা নেই। তার উত্তর প্রান্তে, একটি প্রাচীন জামগাছের শিকড়ের নিচেকার একটি গুহায় একটি ময়াল সাপের বাস।
সেই গুহা থেকে একটি স্বচ্ছ ঝরনার জল হু-হুঁ করে বেরিয়ে এসে ক্রমেই আকারে বেড়ে চলেছে। কোথাও গভীর, কোথাও বা অগভীর এই স্ফটিক-স্বচ্ছ স্রোতস্বিনীটিতে ছোট-ছোট অনেক জাতের মাছ কিলবিল করে, আর তাদের খেয়ে বেঁচে থাকে অন্ততপক্ষে পাঁচ জাতের মাছরাঙা পাখি। উপত্যকার নানারকমের ফুলের আর গাছের এবং ঝোঁপ-ঝাড়ের আকর্ষণে মধু আর ফল খেতে আসে দলে-দলে পাখি আর পশু। আবার, তাদের দেখে চলে আসে শিকারী পাখিরা আর মাংসাশী প্রাণীরা। সেখানকার ঘন ঝাড়-জঙ্গলে আর জট-পাকানো বাঁশ-বেতের ঝোপে তারা বেশ লুকিয়ে থাকবার জায়গা পায়।
জলধারার গতিবেগে কোথাও কোথাও ছোট ধস নেমেছে। সে-সব জায়গায় শরের মত এক ধরনের ঘাস জন্মায়। তাদের চওড়া সবুজ পাতা সম্বরদের আর কাকার হরিণদের খুব প্রিয় খাদ্য।
এই উপত্যকাটিতে যেতে আমিও ভালবাসতুম। একবার আমরা গ্রীষ্মকালের বাসস্থান ছেড়ে কালাধুঙ্গিতে নেমে আসবার কিছু পরেই এক শীতের সন্ধ্যায়, যেখান থেকে উপত্যকাটি পরিষ্কার দেখা যায় আমি তেমনি এক জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিলুম।
হঠাৎ বাঁদিকে একটা ঘাসঝোপে কি যেন একটা নড়ে উঠল। অনেকক্ষণ লক্ষ করবার পর দেখা গেল যে, খাড়া একটা ঢালের গায়ে সবুজ ঘাসের মধ্যে একটা প্রাণী চরছে। তার রঙটা সম্বরের চাইতে ফিকে, অথচ আকারে সেটা কাকারের চাইতে বড়।
আমি চুপে-চুপে তার দিকে চললুম। এমন সময় কয়েক গজ নীচে উপত্যকার মধ্যে, একটা বাঘ ডাকতে শুরু করল। আমার লক্ষ যে প্রাণীটি, সেও তা শুনল। সে মাথা তুলতে অবাক হয়ে দেখি যে সে হচ্ছে লালু। মাথাটি তুলে, একেবারে স্থির হয়ে সে বাঘের ডাক শুনতে লাগল। তারপর যখন সে ডাক থেমে গেল, তখন সে নির্লিপ্তভাবে আবার ঘাস খেতে শুরু করল।
এ জায়গাটা লালুর পক্ষে নিষিদ্ধ, কেননা সংরক্ষিত সরকারী জঙ্গলে গরু চরাবার হুকুম নেই। তাছাড়া, বাঘটা লালুর বিপদ ঘটাতেও পারে। তাই আমি নাম ধরে তাকে ডাকতে লাগলুম। একটুখানি ইতস্তত করে সে পাহাড়ের খাড়া ধার বেয়ে উঠে এল, আমরা একসঙ্গে গ্রামে ফিরে এলুম।
যখন গ্রামে পৌঁছেছি, শের সিং তখন গোয়ালঘরে তার গরুগুলোকে বেঁধে রাখছিল। লালুকে যে কোথায় পেয়েছি সে কথা তাকে বলতে সে হেসে বললে, সাহেব, এর জন্যে ভয় কর না। বনের পাহারাওলা আমার বন্ধু, সে লালুকে খোঁয়াড়ে নিয়ে যাবে না। আর, বাঘের কথা? তা লালুর নিজেকে সামলাবার ক্ষমতা বেশ আছে।
এই ঘটনার বেশি পরের কথা নয়। মুখ্য বনপাল মিষ্টার স্বাইদিস আর তার স্ত্রী ট্যুর উপলক্ষে কালাধুঙ্গি এলেন। উটেরা তাদের ক্যাম্পের সাজ-সরঞ্জাম নিয়ে জঙ্গলের পথে বোর নদীর পুলের দিকে আসবার সময় তাদের সামনেই একটা বাঘ পথের উপর একটু গরুকে মারল। উটগুলো এসে পড়ায়, আর লোকদের চিৎকারে বাঘটা গরুটাকে ছেড়ে দিয়ে লাফ মেরে জঙ্গলে ঢুকে গেল।
স্মাইদিস পরিবার আমাদের বাড়ির বারান্দায় বসে সকালবেলাকার কফি খাচ্ছিলেন, এমন সময় উটওয়ালারা গরু মারবার খবরটা নিয়ে এল। মিসেস স্মাইদিসের খুব ইচ্ছে সে বাঘটাকে শিকার করেন। তাই আমি তার জন্যে একটা মাচান বাঁধব বলে চলে গেলুম। গিয়ে দেখি যে বাঘটা ইতিমধ্যে ফিরে এসে গরুটাকে জঙ্গলের চল্লিশ হাত ভিতরে টেনে নিয়ে গিয়েছে। মাচানটা তৈরি হলে আমি মিসেস স্মাইদিসকে আসবার জন্যে লোক পাঠিয়ে দিলুম। সঙ্গী হিসেবে একজন বন-রক্ষীকে সুদ্ধ তাঁকে মাচানে বসিয়ে দিয়ে বাঘটার একখানা ফটো নেব এই আশায় আমি নিজে রাস্তার ধারের একটা গাছে উঠে পড়লুম।
তখন বেলা চারটে। আটঘণ্টা হল আমরা জায়গায় বসেছি। বাঘটা যেদিকে লুকিয়ে আছে বলে জানি সেইদিকে একটা কাকার সবে ডাকতে শুরু করেছে, এমন সময় রাস্তা ধরে লালু এসে পড়ল। গরুটা যেখানটায় মারা পড়েছিল সেখানটায় এসে সে সযত্নে জমিটা আর রক্তের একটা মস্ত চাপ শুঁকে দেখল। তারপর সে পথের ধারের দিকে ফিরে, মাথা উঁচু করে, নাক বাড়িয়ে যেদিকে গরুটাকে টেনে নিয়ে গিয়েছে সেদিকে চলতে শুরু করল। যখন সে গরুটাকে দেখতে পেল, তার পাশে ঘুরে খুর দিয়ে মাটিটা ছিঁড়ে-খুঁড়ে ফেলে রাগে গজরাতে লাগল।
আমি ক্যামেরাটাকে একটা গাছের ঢালে বেঁধে গাছ থেকে নেমে পড়ে লালুকে খেদিয়ে গ্রামের ধার পর্যন্ত নিয়ে গেলুম, সে অবশ্য রাগ আর আপত্তি জানাতে ছাড়ল না। আমি ফিরে এসে সবে গাছে আমার দাঁড়টিতে উঠে বসেছি, অমনি লালু আবার রাস্তা দিয়ে এসে মরা গরুটাকে ঘিরে-ঘিরে ঘুরে তার রাগ দেখাতে লাগল।
তখন মিসেস স্মাইদিস তাকে তাড়িয়ে দেবার জন্যে বন-রক্ষীটিকে পাঠিয়ে দিলেন। লোকটি কাছ দিয়ে যাবার সময় আমি তাকে বলে দিলুম যে সে যেন লালুকে বোর নদীর পুলটা পার করে নিয়ে গিয়ে, যে-হাতিটা পরে মিসেস স্মাইদিসকে নিতে আসবে সেই হাতিটার কাছে ওকে নিয়ে অপেক্ষা করে। কাকারটা খানিকক্ষণ আগেই থেমে গিয়েছিল। এখন মাচানের কয়েক গজ পিছনে একঝাক বনমোরগ কাঁচ-ম্যাচ করতে শুরু করল। আমি ক্যামেরা ঠিক করে নিয়ে মিসেস স্মাইদিসের দিকে তাকালাম। দেখি যে তিনি বন্দুক বাগিয়ে ধরেছেন। ঠিক সেই মুহূর্তে লালু তৃতীয় বার এসে হাজির হল। (পরে জেনেছি যে তাকে পুলের ওধারে নিয়ে যাবার পর সে খানিকটা ঘুরে গিয়ে নদীতে নেমে সেটা পার হয়ে জঙ্গলের ভিতরে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল।)
এবার লালু গরুটার কাছে ছুটে চলে এল। বাঘটাকে দেখেই হক কিংবা তার গন্ধ পেয়েই হক, সে মাথা নিচু করে সজোরে গাঁক-গাঁক করতে করতে গিয়ে ঝোঁপটার উপর পড়ল। সে এরকম করল তিন বার। প্রত্যেক বার সে ঝোপে গুঁতো মেরেই উপর দিকে শিং চালাতে চালাতে পিছু হটে গরুটার কাছ পর্যন্ত এল।
মোষেরা মড়ি থেকে বাঘকে তাড়িয়েছে, এ আমি দেখেছি। গরুরা দল বেঁধে চিতাকে তাড়া করেছে, এও দেখেছি। কিন্তু এর আগে, শুধু একবার একটা হিমালয়ের ভালুক ছাড়া–বেঁটে একটা ষাঁড় তো দূরে থাকুক–আর কোনো প্রাণীকে একা একটা বাঘকে তার মড়ি থেকে তাড়িয়ে দিতে দেখিনি।
অসমসাহসী হলেও লালু কিছুই নয় বাঘটার কাছে। বাঘটার মেজাজ ক্রমে খারাপ হয়ে উঠছিল। সে লালুর হাঁক-ডাকের জবাবে ক্রুদ্ধভাবে গর্জন করতে লাগল। প্রিয় সঙ্গীটির একটা কিছু হলে তার বুক একেবারে ভেঙে যাবে গ্রামের এমন একটি ছেলের কথা মনে হল। তাই আমি লালুকে বাঁচাবার জন্যে যাবার উদ্যোগ করছিলুম, এমন সময় মিসেস স্মাইদিস দয়া করে বাঘ শিকারের সুযোগটা ছেড়ে দিলেন। কাজেই আমি চেঁচিয়ে মাহুতকে বললুম হাতিটাকে নিয়ে আসতে।
লালু খুব দমে গিয়ে আমার পিছন পিছন তার গোয়ালে ফিরে এল। সেখানে শের সিং তাকে বেঁধে রাখার জন্যে অপেক্ষা করছিল। মনে হল যে, মরা গরুটাকে রক্ষার করবার সময় লালুর হাঁক-ডাক শুনে বাঘটা যে তাকে আক্রমণ করে নি, তাতে আমার মত শের সিং-ও হাঁপ ছেড়ে বাঁচল।
বাঘটা সেই রাত্তিরে আর পরদিন সন্ধ্যায় এসে গরুটাকে খেল। মিসেস স্মাইদিস আর একবার সেটাকে শিকার করবার বৃথা চেষ্টা করলেন। আমি সেই ফাঁকে বাঘটার একটা সিনে-ছবি তুলে নিলুম। যাঁরা এ-কাহিনী পড়েছেন, তাদের মধ্যে কেউ-কেউ সে ছবি দেখে থাকতে পারেন। ছবিটাতে দেখা যাচ্ছে যে, বাঘটা একটা খাড়া পাহাড়ের গা বেয়ে নামছে আর একটা ছোট গর্তে জল খাচ্ছে।
জঙ্গলই ছিল শের সিং-এর খেলার জায়গা, এ-ছাড়া আর কোনো খেলার জায়গা সে জানত না। আমি যখন ছোট ছিলুম, আমারও ঠিক তাই ছিল। যত লোককে জানি, তার মধ্যে এক শের সিং-ই জঙ্গলে যেতে আমার মতই আনন্দ পেত। তার যেমন বুদ্ধি তেমনি নজর ছিল, আর জঙ্গলের ব্যাপারে তার জ্ঞান ছিল অবিশ্বাস্য। কিছুই তার নজর এড়াত না। যে জীবটির নামে তার নাম সেই জীবটির মতই ভয়শূন্য ছিল সে।
বোর নদীর পুলের ও-মাথায় এসে যে তিনটে রাস্তা মিলেছে, তার যে-কোনো একটা ধরে সন্ধ্যেবেলা বেড়াতে ভালবাসতুম আমরা। তার একটা হল মোরাদাবাদ যাবার পরিত্যক্ত রাস্তাটা, একটা হল কোটা যাবার সড়ক, আর তৃতীয়টা হল রামনগর যাবার বনপথ।
প্রায়ই সন্ধেবেলা সূর্যাস্তের পর শের সিং-কে চোখে দেখতে পাবার আগে তার গলা শুনতে পেতুম। গরু নিয়ে ঘরে ফেরবার সময় সে বেপরোয়া, স্পষ্ট, উঁচু গলায় গান গাইতে-গাইতে আসত। সব সময় সে হেসে আর নমস্কার করে আমাদের সম্ভাষণ জানাত। আর সব সময়েই তার কিছু-না-কিছু কৌতূহলজনক খবর দেবার থাকত।
‘আজ সকালবেলা সেই বড় বাঘটার থাবার ছাপ দেখলুম। কোটার দিক থেকে এসে নয়া গাঁওয়ের দিকে চলে গিয়েছে সেগুলো। দুপুরবেলা ধুনিগড়-এর বেতবনের নীচের মাথায় সে ডাকছিল, তা শুনতে পেলুম।
‘আজ সরাইয়া পানির কাছে শিঙের খটখটানি শুনে একটা গাছে উঠে দেখি দুটো চিতল হরিণ লড়াই করছে। সাহেব, তার মধ্যে একটার শিঙ যেমন বড়, দেহটাও তেমনি মোটা। ওঃ, অনেকদিন মাংস খেতে পাইনি।”
‘আমি এটা কী নিয়ে চলেছি? (তার ঝোড়ো কাকের মত মাথাটার উপর বড়-বড় সবুজ পাতা দিয়ে মোড়া আর গাছের ডাল দিয়ে বাঁধা কি যেন একটা জিনিস বসানো ছিল।) ‘ও একটা শুয়োরের রাঙ।’
‘দেখলুম একটা গাছে কয়েকটা শকুনি বসে রয়েছে। তাই একবার দেখতে গেলুম। একটা ঝোঁপের তলায় দেখি যে গত রাত্তিরে একটা চিন্তা একটা শুয়োরকে মেরে তার আধখানা খেয়ে রেখে গিয়েছে। সাহেব, আপনি যদি চিতাটাকে শিকার করতে চান তাহলে আপনাকে মড়িটার কাছে নিয়ে যেতে পারি।’
একদিন সে লম্বা-লম্বা কাঁটা দিয়ে গাঁথা মস্ত একটা পাতার ঠোঙায় দুধের মত সাদা একটুকরো মৌচাক আমাকে দেখিয়ে গর্বিতভাবে বলল, ‘আজ একটা হলুদ গাছের খোঁড়ালের মধ্যে একটা মৌচাক পেয়েছি। মধুটা আপনার জন্যে নিয়ে এলুম।’ তারপর আমার হাতের রাইফেলটার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমি কাজকর্ম সেরে মধুটা আপনার বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসব। নইলে যদি এখন একটা শুয়োর কিংবা কাকার দেখতে পান তাহলে এই মধু হাতে নিয়ে আপনি তো গুলি চালাতে পারবেন না!’
তার ছোট কুড়ুলটি দিয়ে হলুদ গাছ থেকে মৌচাকটা কেটে বের করতে, তার বোধহয় ঘণ্টা-দুই কিংবা তারও বেশি লেগেছিল। আর ততক্ষণ মৌমাছিরা তাকে বেজায় হুল ফুটিয়েছে বোঝা গেল–কেননা তার হাত ফুলে উঠেছিল আর একটা চোখ প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
সে কথা সে তুলল না। আমি তুললে তাকে বিব্রত করা হত। তারপর, রাত্রে যখন আমরা খেতে বসেছি, তখন সে নিঃশব্দে ঘরে এসে আমাদের টেবিলের উপর থালাখানা রাখল। মেঝে-ঘষে সেটাকে সোনার মত করে তোলা হয়েছে। থালা রেখে সে তার বাঁ হাতের আঙুলগুলো তার ডান-হাতের কনুইয়ে ঠেকাল। পাহাড়ীদের এই সম্মানসূচক প্রথাটি সেকেলে। আজকাল এটা উঠে যাচ্ছে।
উপহারটি এইভাবে টেবিলে রাখা হল। থালাখানা রইল, পরদিন সকালবেলা কুন্তী এসে সেটা নিয়ে যাবে। চলে যাবার সময় শের সিং হয়তো দরজার কাছে গিয়ে থেমে, মাথা নিচু করে, পায়ের আঙুল দিয়ে কার্পেটটাকে আঁচড়াতে আঁচড়াতে বলল, ‘সাহেব, যদি কাল পাখি মারতে যান তাহলে গরুগুলোর সঙ্গে কুন্তীকে পাঠিয়ে দিয়ে আমি আপনার সঙ্গে যাব। আমি জানি কোথায় অনেক পাখি আছে। বাড়িতে এলে সে লাজুক হয়ে পড়ত। তখন সে এমন বাধ-বাধ গলায় কথা বলত, যেন তার মুখে অনেক কথা এসে পড়েছে, আর সে অনেক কষ্টে তার মধ্যে কতগুলো গিলে গিলে পথ পরিষ্কার করছে।
পাখি শিকারের সময় শের সিং তার স্বভাব, গুণটি ফিরে পেত। আমার সঙ্গে সে আর গ্রামের ছেলেরা এতে খুবই আমোদ পেত। কেননা, এর যে উত্তেজনা, আর একটা পাখি নিয়ে বাড়ি ফেরবার সম্ভাবনা–তা ছাড়াও এর মধ্যে আর একটা ব্যাপার থাকত। আগে থেকে ঠিক করা একটা জায়গায় গিয়ে দুপুরবেলা আমরা বিশ্রাম করতুম। একটি নোক আগেই সেখানে ছোলা ভাজা আর টাটকা মেঠাই নিয়ে অপেক্ষা করত। সবাই মিলে তা খেতুম।
আমি গোছগাছ করে দাঁড়াবার পর শের সিং তার সঙ্গীদের লাইন করে সাজিয়ে নিয়ে নির্দিষ্ট ঝোঁপটা, ঠেঙাতে-ঠেঙাতে আমার দিকে আসত। সেই সকলের চেয়ে বেশি জোর চেঁচাত, আর সবচেয়ে ঘন ঝোঁপ-ঝাড়ের ভিতর দিয়ে এগিয়ে আসত। পাখি-টাখি তাড়া খেলে সে গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়ে উঠত, ‘আসছে, সাহেব! আসছে! কিংবা ভারি কোনো জানোয়ার বনবাদাড় ভেঙে চলে যাবার শব্দ হলে প্রায়ই তা হত–সে তার সঙ্গীদের ডেকে তাদের পালাতে বারণ করত, আর তাদের ভরসা দিত যে, ওটা একটা সম্বর কিংবা হয়তো একপাল শুয়োর–এ ছাড়া আর কিছু নয়।
সারাদিন এরকম গোটা দশ-বার ঝোঁপ-ঝাড় ঠেঙানো হত, তাতে গোটা দশ-বার ময়ুর আর বনমোরগ, দু-তিনটে খরগোশ, আর হয়তো একটা ছোট শুয়োর কি শজারু পাওয়া যেত। ঝোঁপ ঠেঙানো শেষ হলে এইসব ভাগ-বাঁটোয়ারা করে দেওয়া হত শিকারী আর ঐ ছোকরাদের মধ্যে। শিকার কম হলে ভাগটা হত শুধু ছোকরাদের মধ্যেই। দিনের শেষে শের সিং যখন একটা পুরো-পেখমওলা ময়ূর কাঁধের উপর ঝুলিয়ে গর্বভরে বাড়ি যেত তখন তাকে যেমন খুশি দেখাত, এমন আর কখনও নয়।
ইতিমধ্যে পুনোয়ার বিয়ে হয়ে গিয়েছে আর শের সিং-এর বাড়ি ছেড়ে চলে যাবার দিন ঘনিয়ে এসেছে। কেননা, তাদের ছোট আঠার বিঘের খেতটি দিয়ে দু-ভায়ের কুলোতে পারে না। জানতুম যে নিজের গ্রাম আর প্রাণাধিক জঙ্গলটি ছেড়ে যেতে হলে শের সিং-এর বুক ফেটে যাবে। তাই ঠিক করলুম যে কাঠগুদামে আমার এক বন্ধুর মোটর-মেরামত কারখানায় তাকে শিক্ষানবীশ করে দেব। নৈনিতালের মোটর-চলা, সড়কে বন্ধুটির অনেকগুলো গাড়িও চলত।
আমার ইচ্ছে ছিল যে শের সিং কাজ শিখলে তাকে আমাদের গাড়ি চালাবার কাজে নিযুক্ত করব। শীতকালে সে আমার সঙ্গে শিকারে যাবে, আর গরমকালে আমরা যখন নৈনিতালে থাকব, তখন সে আমাদের কালাধুঙ্গির বাড়ি আর বাগান দেখাশুনা করবে। তার জন্যে কী পরিকল্পনা করেছি সে-কথা তাকে যখন বললুম তখন সে আনন্দে বোবা হয়ে গেল। এ ব্যবস্থা হলে তো গ্রামে তার পাকাপাকিভাবে থাকা যায়-জন্মাবধি যে-বাড়ি ছেড়ে কখনও যায় নি, সেই বাড়ির কাছাকাছি সে থাকতে পারে।
জীবনে আমরা কত পরিকল্পনাই না করি। তার কোনো-কোনোটা যখন বিগড়ে যায়, তখন যে সেটা দুঃখের কারণ হবেই এমন কথা জোর করে বলতে পারি না।
কথা ছিল যে নভেম্বর মাসে আমরা কালাধুঙ্গিতে ফিরে এলে শের সিং তার শিক্ষানবিশী কাজে যাবে। কিন্তু অক্টোবরে তার ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়া হল এবং ‘ সেটা ক্রমে নিউমোনিয়াতে দাঁড়াল, তারপর আমরা ফিরে আসবার ক-দিন আগে সে মারা গেল। ছেলেবেলায় সে সারাটা দিন ধরে গান গেয়ে আনন্দে কাটিয়েছে। সে যদি বেঁচে থাকত, তাহলে এই পরিবর্তনশীল জগতে তার জীবনটা প্রথমদিককার দিনগুলোর মত আনন্দময় ও নিরুদ্বেগ হত কি না তা কে বলতে পারে?
হিটলারের যুদ্ধে স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ায় আমরা নতুন জায়গায় হাওয়া-বদল করতে কিছুকালের জন্যে বাড়ি ছেড়ে যাই। যাবার আগে আমাদের প্রজাদের সপরিবারে ডেকে আনিয়ে তাদের বলি যে তাদের খেত-খামার তারা নিয়ে নিক, আর গ্রামটা নিজেরাই চালাক। আগেও দু-বার একথা বলেছিলুম।
এবার প্রজাদের মুখপাত্র হয়ে এসেছিল পুনোয়ার মা। আমার যা বলবার তা বলা হলে সে উঠে দাঁড়িয়ে কাটছাঁটা গলায় বলল, ‘আপনি মিছিমিছিই আমাদের কাজ থেকে ডেকে নিয়ে এসেছেন। আগেও আপনাকে বলেছি, আজও আবার বলছি যে আপনার জমি আমরা নেব না। কেননা, যদি তা করি, তাহলে তার মানে হবে এই যে আমরা আর আপনার আপন জন থাকব না। আচ্ছা সাহেব, সেই যে শয়তানটা আপনার তৈরি পাঁচিল ডিঙিয়ে আমার আলু খেয়ে গিয়েছিল, তার বাচ্চাটার কী ব্যবস্থা হল? না পুনোয়া না এরা, কেউই তাকে মারতে পারছে না, এদিকে আমি সারারাত বসে থেকে টিনের ক্যানেস্তারা পিটিয়ে-পিটিয়ে হয়রান হয়ে গেলুম যে!”
উল্লিখিত বুড়ো শয়তানটা বিস্তর গুলি হজম করে, বুড়ো বয়সে একদিন একটা বাঘের সঙ্গে সারারাত যুদ্ধ করে মারা পড়ে। এই শুয়োরটা তারই উপযুক্ত পুত্র। পাদ-শৈলশ্রেণীর ধারে-ধারে যে পথ, একদিন তা ধরে আমার বোন ম্যাগি আর আমি যাচ্ছিলুম, ডেভিড আমাদের পিছনে ছিল। এমন সময় দেখি যে, শুয়োরটা ছুটে রাস্তা পেরিয়ে চলে গেল।
তখন সূর্য ডুবে গিয়েছে, পাল্লাটাও বড়ই দূর–পুরো তিনশো গজই হবে–কিন্তু গুলি চালানো উচিত বলেই মনে হল, কেননা, দেখা গেল যে সেটা গ্রামের দিকেই চলেছে। আমি বন্দুকের নিশানা ঠিকঠাক করে নিয়ে বন্দুকটা একটা গাছের উপর রেখে অপেক্ষা করতে লাগলুম। শেষে শুয়োরটা একটা গভীর নাবাল জমির ধারে এসে থামতেই আমি বন্দুকের ঘোড়া টিপলুম। অমনি শুয়োরটা নিচু জমিটায় লাফিয়ে পড়ে তার গা বেয়ে হাঁচোড়-পাঁচোড় করে উঠে তীর বেগে পালিয়ে গেল।
আমার বোন বলল, ‘ফসকে গেল বুঝি? ডেভিডের চোখেও সেই প্রশ্ন। এক যদি পাল্লার দূরত্ব হিসেব করতে ভুল হয়ে থাকে! নইলে গুলি শুয়োরটার গায়ে না : লাগবার তো আর কোনো কারণ ছিল না। কেননা রূপোলী রঙের সামনেকার মাছিটা তার কাল চামড়া বরাবর স্পষ্ট দেখা গিয়েছিল। তাছাড়া, গাছটা থাকতে আমি স্থিরভাবে তাক করতেও পেরেছিলুম। যাই হক, তখন বাড়ি ফিরে যাবার সময় হয়ে এসেছে, আর যে পথ ধরে শুয়োরটা যাচ্ছিল সেটাও যখন বোর নদীর পুলের দিকেই গিয়েছে, তখন আমার গুলির ফল কী হল তা দেখবার জন্যে আমরা রওনা হলুম। শুয়োরটা যেখান থেকে লাফ মেরেছিল সেখানে তার পা মাটিতে গম্ভীর হয়ে কেটে বসে গিয়েছিল। নিচু জমিটার ওপাশে যেখানে সে বেয়ে উঠেছিল, সেখানে রক্ত দেখা গেল।
শুয়োরটা যেদিকে গিয়েছে সেদিকে শ-দুই গজ দূরে অল্প খানিকটা ঘন ঝোঁপ : ছিল। হয়তো এর মধ্যেই তাকে কাল সকালবেলা মরে পড়ে থাকতে দেখব, কেননা ওখানে রক্তের দাগ খুব মোটা। যদি সেটা মরে না থাকে তবে একটা হাঙ্গামা বাধাবে। ম্যাগি তখন সঙ্গে না থাকাই ভাল। আর, এখনকার চাইতে সকালবেলা বেশি আলোও থাকবে গুলি চালাবার পক্ষে।
পুনোয়া আমার বন্দুকের আওয়াজ পেয়ে, পুলের উপর এসে আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছিল। তার আগ্রহ-ভরা প্রশ্নের উত্তরে আমি বললুম, হ্যাঁ, সেই ধাড়ী শুয়োরটাকেই গুলি করেছি। রক্তের দাগ দেখে তো মনে হয় যে তার খুব বেশিই চোট লেগেছে। আরও বললুম যে, পরদিন সকালবেলা সে যদি পুলের কাছে এসে আমার সঙ্গে দেখা করে তাহলে শুয়োরটা কোথায় আছে তা আমি তাকে দেখিয়ে দেব, সে যেন পরে দলবল নিয়ে গিয়ে সেটাকে নিয়ে আসে।
পুনোয়া জিগ্যেস করল, বুড়ো হাবিলদারকে নিয়ে আসব?’ আমি তাতে রাজী হলুম। এই অমায়িক বুড়ো হালিদারকে সবাই ভালবাসত আর শ্রদ্ধা করত। সে ছিল জাতে গুখ। সৈন্যদল ছেড়ে সে পুলিশে যোগ দিয়েছিল, তারপর বছরখানেক আগে পেনশন নিয়ে তার স্ত্রী আর দুই ছেলেসহ আমাদের গ্রামে এসে আমাদের দেওয়া একখণ্ড জমিতে বসবাস করছিল।
সব গুর্খাদের মত এই হবিলদারটিরও শুয়োরের মাংস খাবার লোভ কিছুতেই মিটত না, তাই, যদি আমাদের মধ্যে কেউ একটা শুয়োর শিকার করত, তাহলে তাকে তার ভাগ দিতেই হবে এ কথা সবাই জানত। তাকে দিতে গিয়ে অন্য কেউ বাদ পড়ে তো নাচার।
পরদিন সকালবেলা পুনোয়া আর হাবিলদার পুলের কাছে আমার জন্যে অপেক্ষা করছিল। গরু চলাচলের পথটা ধরে আমরা শিগগিরই গিয়ে সেই জায়গাটাতে পৌঁছলুম যেখানে গত সন্ধ্যেবেলায় আমি রক্তটা দেখতে পেয়েছিলুম। সেখান থেকে আমরা রক্তের সুস্পষ্ট চিহ্ন ধরে-ধরে গিয়ে, যেমনটি আশা করেছিলুম সেই ঘন ঝোঁপটার কাছে এসে পড়লুম। সঙ্গীদের রেখে গেলুম ঝোঁপের ধারে।
আহত শুয়োর বড় মারাত্মক জানোয়ার। আমাদের জঙ্গলে শুধু ভাল্লুক ছাড়া একমাত্র শুয়োরেই একটি বিশ্রী স্বভাব আছে-তা হচ্ছে মানুষকে আক্রমণ করে মাটিতে ফেলে দিয়ে তাকে গুতিয়ে মাড়িয়ে ক্ষত-বিক্ষত করা। এইজন্যেই আহত শুয়োরদের বিশেষ করে দাঁতাল শুয়োরদের–খুব সমীহ করে চলতে হয়।
যেখানে আশা করেছিলুম সেখানে শুয়োরটা থেমেছিল বটে, কিন্তু সেখানে সে মরে নি। যেখানে সে সারা রাত শুয়ে ছিল, সকালবেলা সেখান থেকে উঠে সে ঝোঁপ ছেড়ে চলে গিয়েছিল। আমি শিস দিয়ে পুনোয়াকে আর হাবিলদারকে ডাকলুম। তারা এলে আমরা দাগ ধরে এগোতে শুরু করলুম।
চিহ্ন ধরে এগোতে এগোতে আমরা পথটা পেরিয়ে গেলুম। আহত জানোয়ারটা যেদিকে গিয়েছে তা দেখে বোঝা গেল যে সে পাহাড়ের ওদিককার ঘন জঙ্গলের দিকে চলে গেছে। আমার সন্দেহ হল যে সে আগের দিন সন্ধ্যেবেলা ওই দিক থেকেই এসেছিল। সকালবেলাকার রক্তের দাগটা ছিল হালকা। যতই এগিয়ে যাচ্ছিলুম, ততই সেটা ফিকে হয়ে আসছিল। শেষে একসারি গাছের কাছে এসে সেটা একেবারেই মিলিয়ে গেল।
গাছের ঝরা পাতাগুলো হাওয়ার ঝাঁপটায় এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল। এই জায়গায় আমাদের সামনেই কোমর-ভর উঁচু খটখটে শুকনো ঘাসে ভরা একফালি জমি। তখনও আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে শুয়োরটা পাহাড়ের ওধারকার ঘন জঙ্গলের দিকে চলে গিয়েছে। তাই আমি ঘাসের মধ্যে ঢুকে পড়লুম। আশা হল যে ওটা পার হয়ে গিয়ে আবার পায়ের চিহ্ন পাব।
হাবিলদার একটু পিছনে পড়েছিল বটে, কিন্তু পুনোয়া ছিল ঠিক আমার পিছনে। ঘাসের ভিতরে কয়েক গজ যেতেই একটা কাটা-ঝোপে আমার পশমের মোজা আটকে গেল। আমি নিচু হয়ে সেটা ছাড়াতে গেলুম, আর পুনোয়া কাটা-ঝোঁপটাকে এড়াবার জন্যে ডানদিকে কয়েক পা সরে গেল।
আমি সবে কাটাটা ছাড়িয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াতে গিয়েছি, এমন সময় শুয়োরটা ঘাসের ভিতর থেকে যেন ছিটকে বেরিয়ে এসে সোজা পুনোয়ার দিকে তেড়ে গেল। পুনোয়ার গায়ে একটা সাদা শার্ট ছিল। কোনো বিপজ্জনক শিকারের পেছনে জঙ্গলে ঢুকবার সময় আমি সর্বদা সঙ্গীদের বলে রাখতুম যে আমাকে কোনো আহত জন্তু আক্রমণ করলে তাদের তখন কি করতে হবে। এখন আমিও তাই করলুম। বন্দুকের মুখ শূন্যে তুলে তার ঘোড়া টিপে আমি গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠলুম।
মোজায় কাটা বিঁধে এক লহমা সময় নষ্ট না হলে সবই ভালয়-ভালয় হয়ে যেত-পুনোয়ার কাছে পৌঁছবার আগেই শুয়োরটাকে গুলি করতে পারতাম। কিন্তু একবার সেটা পুনোয়ার উপর গিয়ে পড়লে তাকে বাঁচবার জন্যে শুয়োরটার মন অন্য দিকে ফিরিয়ে দেবার চেষ্টা ছাড়া আর কিছু করবার ছিল না। সেটার দিকে গুলি করলে পুনোয়ার জীবনই আরও বিপন্ন হত।
বন্দুক থেকে বেরিয়ে গুলিটা যখন মাইল-খানেক দূরের জঙ্গলের দিকে চলেছে, পুনোয়া তখন হতাশভাবে ‘সাহেব!’ বলে আর্তনাদ করে ঘাসের মধ্যে চিত হয়ে পড়ল, আর শুয়োরটা একেবারে তার উপর চড়াও হল। কিন্তু আমার চিৎকার আর বন্দুকের দুড়ুম শব্দ শুনেই শুয়োরটা চাবুকের দড়ির মত সপাং করে ফিরেই সোজা আমার দিকে তেড়ে এল। আমি খালি টোটাটা বের করে রাইফেলের খোপে নতুন টোটা ভরবার আগেই সে এসে পড়ল। বন্দুক থেকে ডান হাতটা সরিয়ে আমি হাতখানা বাড়িয়ে দিলুম। সে হাতটা তার কপালে ঠেকতেই সে একেবারেই থেমে : গেল–তার একমাত্র কারণ নিশ্চয় এই যে, আমার অন্ত তখনো ঘনায় নি।
শুয়োরটা এতই বড় আর এমনই রেগে ছিল যে, একটা গাড়ির ঘোড়াকে পর্যন্ত সে গুঁতিয়ে ফেলে ক্ষত-বিক্ষত করে দিতে পারত। তার দেহটা থেমে গেলেও মাথাটা খুব চলছিল। প্রকাণ্ড দুই দাঁত দিয়ে সে একবার এদিকে আর একবার উপর দিকে খোঁচা মারছিল, তবে, ভাগ্যক্রমে তাতে শুধু হাওয়াই কাটল। তার খসখসে কপালের ঘষায় আমার হাতের তেলোর ছাল খানিকটা ছড়ে গেল। তারপর, কেন তা জানি না, সে হুমড়ি খেয়ে মাথায় ভর দিয়ে পড়ে গেল।
সেই এক মরিয়া চিৎকারের পরে পুনোয়া আর শব্দও করে নি, নড়েও নি। ভয়ানক ভাবনা হল, তার মাকে কি বলব। তার চাইতেও বেশি ভয়াবহ কথা হল যে, সে আমাকে কি বলবে! পুনোয়া সেখানে ঘাসের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে পড়ে ছিল, ভয়ে কাঁপতে-কাঁপতে আমি সেখান গেলুম। আশঙ্কা হয়েছিল যে দেখতে পাব শুয়োরটা তাকে আগাগোড়া চিরে ফেলেছে। সে চিত হয়ে সটান পড়ে ছিল, তার চোখ বন্ধ। কিন্তু দেখে ধড়ে প্রাণ এল যে তার সাদা কাপড়-চোপড়ে রক্তের কোনো দাগ নেই। তার কাঁধটা ধরে নেড়ে তাকে জিগ্যেস করলুম সে কেমন আছে, আর তার কোথায় লেগেছে। খুব দুর্বল স্বরে সে বলল যে সে মরে গিয়েছে, আর তার পিঠটা ভেঙে গিয়েছে। তার দুই পাশে পা রেখে আমি আস্তে-আস্তে তাকে তুলে বসিয়ে দিলাম। তারপর হাত ছেড়ে দিয়ে দেখলুম যে সে সেইভাবে থাকতে পারছে। তা দেখে আমার অত্যন্ত আনন্দু হল।
তার পিঠে হাত বুলিয়ে দেখে তাকে আশ্বাস দিলুম যে তার পিঠ ভাঙে নি। সে নিজে হাত দিয়ে সে কথাটা যাচাই করে নিয়ে, তারপর মুখটা ঘুরিয়ে পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখল যে, শুকনো একটা কাটা গুঁড়ি মাটি থেকে ইঞ্চি-তিনেক উঁচু হয়ে রয়েছে। স্পষ্ট বোঝা গেল যে, শুয়োরটার টু খেয়ে পড়ে গিয়ে সে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল, তারপর জ্ঞান হয়ে যখন সে টের পেল যে কাটা গুঁড়িটা তার পিঠে খোঁচা মারছে, তখন সে চট করে ধরে নিয়েছিল যে তার পিঠটা ভেঙে গিয়েছে।
এইভাবে শয়তানের বাচ্চা সেই ধাড়ী শুয়োরটার লীলা-খেলা ফুরোল। তবে, মরবার আগে সে আমাদের দুজনের প্রাণপাখিকে ভয় দেখিয়ে খাঁচা-ছাড়া করেছিল আর কি! কিন্তু শুধু আমার হাতের তেলোর খানিকটা চামড়া ঘষে তুলে দেওয়া ছাড়া আমাদের আর কোনো ক্ষতি সে করে নি, কেননা পুনোয়া একটি আঁচড়ও না খেয়ে পার পেয়ে গিয়েছিল। আর, বলবার মত চমৎকার একটি গল্পও পেয়ে গেল সে।
হাবিলদার নেপথ্যেই ছিল–তার মত বিজ্ঞ ঝানু সৈন্যের পক্ষে তো সেটাই স্বাভাবিক। তাহলেও সে শুয়োরটার একটা বড় ভাগই দাবি করে বসল। দরকার হলে সে সাহায্য করবার জন্যে তৈরি হয়ে সে দাঁড়িয়ে ছিল না বুঝি? তা ছাড়া, যারা শিকারের সময় হাজির থাকে তারা ডল ভাগ পাবে, এটাই কি দস্তুর নয়? আর, যেগুলিতে শিকার মরে, তা দেখার আর তার শব্দ শোনার মধ্যে তফাত কিছু আছে নাকি? কাজেই তার ডবল ভাগ থেকে তাকে বঞ্চিত করা হল না। সেই সকালবেলাকার ব্যাপারে তার কী ভূমিকা ছিল, সে বিষয়ে তারও বলবার মত একটা জাঁকালো গল্প ক্রমে-ক্রমে তৈরি হয়ে গেল।
পুনোয়ার বাবার জন্যে আমি যে-বাড়ি বানিয়ে দিয়েছিলুম এখন সেই বাড়িতে পুনোয়াই কর্তা, সেখানে তার নিজের একটি সংসার গড়ে তুলছে সে। কুন্তী এ গ্রাম ছেড়ে তার স্বামীর ঘর করতে চলে গিয়েছে। আর শের সিং অপেক্ষা করে রয়েছে। স্বর্গের আনন্দময় মৃগয়ার রাজ্যে। পুনোয়ার মা আজও বেঁচে আছে।
আপনি যদি গ্রামের ফটকে গাড়ি থামিয়ে খেতের মধ্যে দিয়ে হেঁটে পুনোয়ার বাড়িতে আসেন তাহলে দেখতে পাবেন যে পুনোয়ার মা পুতোয়া আর তার স্ত্রী-পুত্রের সংসার চালাচ্ছে, আর, যখন সে মোতির বউ হয়ে প্রথম আমাদের গ্রামে এসেছিল, তখনকার মতই এখনও সে তার হাজারো কর্তব্য অক্লান্তভাবে এবং সানন্দে করে চলেছে।
যুদ্ধের ক-টা বছর প্রতি শীতে আমার বোন ম্যাগি একা আমাদের কালাধুঙ্গির কুটিরে কাটিয়েছিল–গাড়ি-টাড়ি ছিল না, সবচাইতে কাছের শহর ছিল সেখান থেকে চোদ্দ মাইল দূরে। তবু তার নিরাপত্তার জন্যে আমার এতটুকুও উদ্বেগ ছিল না, কেননা আমি জানতুম, যে সে আমার বন্ধু, আমার ভারতের গবির মানুষদের মধ্যে নিরাপদেই থাকবে।