৫. জংলী কানুন
হরকোয়ার আর কুন্তীর বয়স যোগ করলে যখন দশও হয় না, তখনই তাদের বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। তখনকার দিনে ভারতে এটা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল। হয়তো আজও থাকত, যদি মহাত্মা গান্ধী আর মিস্ মেয়ো না জন্মাতেন।
বিরাট দুনাগিরি পর্বতের পাদদেশে কয়েক মাইল তফাতের দুই গ্রামে বাস করত হরকোয়ার আর কুন্তী। তারা আগেও কখনও কেউ কাউকে দেখে নি। শেষে এক পরম দিনে, ঝকঝকে নতুন কাপড়-চোপড়ে সেজে, খুব অল্প একটু সময়ের জন্যে তারা মস্ত একদল আত্মীয় আর বন্ধুদের আকর্ষণের কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল।
সেদিন তারা পেটভরে হালুয়া আর পুরি খেতে পেয়েছিল বলে এই দিনটির কথা অনেকদিন তাদের মনে ছিল। তাদের বাপেদেরও মনে ছিল, কেননা সেদিন তাদের ‘বাপ-মা’-স্থানীয় গ্রামের বেনে মশায় বেজায় দায় দেখে কয়েকটা করে টাকা দিয়েছিলেন আর তার খাতায় তাদের নামের পাশে নতুন একটি সংখ্যা লিখে রেখেছিলেন। সেই টাকা দিয়েই তো তাদের ছেলেমেয়েদের যে বয়সে বিয়ে হওয়া উচিত সেই বয়সে, আর গ্রামের পুরুত মহাশয়ের ঠিক করা শুভদিনে বিয়ে দিয়ে সমাজে নিজেদের মানসম্ভ্রম রক্ষা করা সম্ভব হয়েছিল।
অবশ্য একথা ঠিক যে এই অনুগ্রহটুকুর জন্যে মহাজন যে শতকরা পঞ্চাশ টাকা হারে সুদ দাবি করেছিলেন, সেটা বড্ড বেশি। কিন্তু ভগবানের ইচ্ছে হলে তার অন্তত কিছুটা শোধ করা যাবেই। আরও ছেলেমেয়ের বিয়ে তো বাকি আছে–তখন ঐ দয়ালু মহাজনটি ছাড়া আর কে সাহায্য করবে তাদের?
বিয়ের পর কুন্তী তার বাপের বাড়িতেই ফিরে এল। তারপর কয়েক বছর ধরে সে, খুব গরিব ঘরের ছেলেমেয়েদের যে সব ঘরের কাজ করতে হয় সেই সব কাজ করে কাটাল। বিয়ে হওয়ায় তার জীবনে শুধু এইটুকু তফাত এল যে, অবিবাহিত মেয়েরা যে পোশাক পরে, তা আর সে পরতে পেত না। তার নতুন পোশাক এখন হল তিনটি জিনিস নিয়ে–ছোট্ট একটি হাতকাটা কঁচুলি, কয়েক ইঞ্চি লম্বা একটি ঘাগরা, আর তিন হাত লম্বা একখানা চাদর যার একটা কোনা ঘাগরাটায় গোঁজা, আর অন্য দিকটা মাথার উপর জড়ানো।
কুন্তীর কয়েকটা বছর নিশ্চিন্তে কেটে গেল, উল্লেখযোগ্য কোনো ঘটনা ঘটল না। শেষে সেই দিনটি এল যখন ঠিক হল যে তার স্বামীর কাছে যাবার উপযুক্ত বয়স হয়েছে। আবার মহাজনটি এসে তাদের উদ্ধার করলেন। তখন নতুন জামা-কাপড়ে সেজে কাঁদতে কাঁদতে একটি ছোট্ট বউ তার বাচ্চা বরের ঘরের দিকে রওনা হয়ে গেল।
কুন্তীর ক্ষেত্রে এই বাড়ি-বদলের অর্থ শুধু এইটুকু হল যে, আগে সে তার মা-র জন্যে যে-সব কাজ করে দিত, এখন সেগুলো তার শাশুড়ীর জন্যে করতে হবে। ভারতে গরিবদের ঘরে কেউ বসে বসে খায় না। ছোট-বড় সবাইকে নির্দিষ্ট কাজ করতে হয়, এবং তারা তা খুশি হয়েই করে থাকে। কুন্তী এখন রান্নার কাজে সাহায্য করার মত বড় হয়েছিল।
সকালবেলার খাওয়া শেষ হয়ে গেলেই, মজুরির বিনিময়ে খাটতে পারে এমন সবাই যারা-যার কাজে বেরিয়ে যেত। সে কাজ যত তুচ্ছ হ’ক না কেন, তাতেই পরিবারের তহবিলে কিছু যোগ হত। হরকোয়ারের বাপ ছিল রাজমিস্ত্রী। সে তখন আমেরিকান মিশন স্কুলে একটা গির্জা তৈরির কাজ করছিল। হরকোয়ারের উদ্দেশ্য ছিল যে সে তার বাপের লাইনেই যাবে। যতদিন না তার সে কাজ করবার শক্তি হয়, ততদিন সে, তার বাপ আর অন্য সব রাজমিস্ত্রীর যোগালের কাজ করে, দৈনিক দশ ‘ ঘণ্টা খেটে দু-আনা মজুরি এনে সংসারের আয় বাড়াত।
ওদিকে সেচ-দেওয়া নিচু জমিগুলিতে ফসল পেকে উঠেছিল। সকালবেলা খাওয়ার পর এঁটো বাসনপত্র ধুয়ে-মেজে কুন্তী তার শাশুড়ী আর তার অনেকগুলো জা-ননদের সঙ্গে গাঁয়ের মোড়লদের খেতে চলে যেত। সেখানে গ্রামের মেয়েদের আর বউদের সঙ্গে সেও দশ ঘণ্টা খেটে তার স্বামীর অর্ধেক মজুরি রোজগার করত।
দিনের কাজ শেষ হলে গোধূলি সময়ে সমস্ত পরিবারটা ঘরে ফিরে আসত। মোড়লের জমিতে এই ঘরখানা বানিয়ে নেবার অনুমতি পেয়েছিল হরকোয়ারের বাপ। বড়রা যখন বাড়ি ছিল না, তখন বাড়ির বাচ্চা ছেলেমেয়েগুলো শুকনো কাঠকুটো কুড়িয়ে এনে রেখেছিল। তা দিয়ে রাত্রের খাবার রান্না করা হল, খাওয়া হল। এই আগুন ছাড়া ঘরে কখনও অন্য কোনো রকম আলো জ্বলে নি। থালাবাটিগুলো পরিষ্কার করে সেগুলো তুলে রেখে পরিবারের সবাই নিজের নিজের নির্দিষ্ট জায়গায় চলে গেল। হরকোয়ার শুল তার বাবা-ভাইদের কাছে, আর কুন্তী শুল বাড়ির আর সব মেয়ের মধ্যে।
যখন হরকোয়ারের বয়স আঠার আর কুন্তীর ষোলো, তখন তারা তাদের সামান্য মালপত্র নিয়ে গিয়ে সংসার পাতল আর একটা কুঁড়েঘরে। রানীখেত ছাউনি থেকে তিন মাইল দূরে এক গ্রামে হরকোয়ারের এক কাকা সেই ঘরখানায় তাদের থাকতে দিয়েছিল।
ছাউনিতে তখন অনেকগুলো গোরা-বারিক তৈরি হচ্ছিল, তাই রাজমিস্ত্রীর কাজ পেতে কোনো অসুবিধা হল না হরকোয়ারের। কুন্তীরও মজুরনীর কাজ পেতে কষ্ট হল না-সে একটা খাদ থেকে পাথর বয়ে এনে দিয়ে আসত বাড়ি তৈরির জায়গাটাতে।
চার বছর ধরে এই ছেলেমানুষ বর আর বউ. রানীখেতের গোরা-বারিকে কাজ করল। এর মধ্যে তাদের দুটি সন্তান হল। চতুর্থ বছরের নভেম্বর মাসে বাড়িগুলো শেষ হয়ে গেল। হরকোয়ার আর কুন্তীকে নতুন কাজ খুঁজতে হল। তারা সামান্য টাকাই জমিয়েছিল, তাতে তাদের দিনকয়েক মাত্র খাওয়া চলতে পারত।
শীতটা সে-বছর তাড়াতাড়ি এসে পড়ল, বরাবর যেমন হয় তার চাইতে এবার বেশি শীত পড়বে এমন লক্ষণও দেখা গেল। পরিবারের কারও গরম জামা ছিল না। দিন-সাতেক ধরে কাজ খুঁজে-খুঁজে ব্যর্থ হয়ে হরকোয়ার প্রস্তাব করল যে পাদ-শৈলশ্রেণীতে নেমে যাওয়া যাক। সে শুনেছে যে সেখানে নাকি একটা সেচখালের মুখটি খননের কাজ চলছে। সেই অনুসারে ডিসেম্বরের গোড়ার দিকে গোটা পরিবারটি মহা উৎসাহে পাদ-শৈলশ্রেণীর দিকে তাদের দীর্ঘ পদযাত্রায় বেরিয়ে পড়ল।
যে গ্রামে তারা বার বছরের জন্যে সংসার পেতেছিল, সেখান থেকে কালাধুঙ্গিতে সেচ-খালের কাজ যেখানে চলছিল, তার দূরত্ব হবে মোটামুটি মাইল-পঞ্চাশেক।
রাত্রিতে গাছতলায় ঘুমিয়ে, আর দিনের বেলায় পালা করে ছেলেমেয়ে-দুটিকে আর তাদের সামান্য মালপত্র বয়ে নিয়ে খাড়া এবড়ো-খেবড়ো পথে প্রাণান্ত করে চড়াই আর উত্রাই ভেঙে, ছয় দিনে ক্লান্ত আর ক্ষত-বিক্ষত পায়ে হরকোয়ার আর কুন্তী কালাধুঙ্গিতে এসে তাদের যাত্রা শেষ করল।
অনুন্নত শ্রেণীর অন্যান্য ভূমিহীন লোকেরা এই শীতের আরও গোড়ার দিকেই উঁচু পাহাড় থেকে পাদ-শৈলশ্রেণীতে এসে দলবদ্ধভাবে বাস করার জন্যে কুঁড়েঘর বানিয়ে নিয়েছিল। তার এক-একটাতে ত্রিশটি পরিবার অবধি বাস করত। হরকোয়ার আর কুন্তী সেখানে ঠাই না পাওয়ায় তাদের নিজেদের জন্যে একটি কুটির বেঁধে নিল।
বনের কিনারায়ই তারা এর জন্যে জায়গা ঠিক করল। সেখানে যথেষ্ট জ্বালানী কাঠ জোটে। বাজারেও সহজে যাওয়া যায়। দিনরাত খেটে-খেটে তারা ডাল আর পাতা দিয়েই ছোট একটি কুঁড়েঘর বানিয়ে নিল। তাদের নগদ টাকার পুঁজি তখন কয়েকটি মাত্র টাকাতে এসে ঠেকেছিল, আর এখানে এমন কোনো বন্ধুভাবাপন্ন মহাজন ছিল না যার কাছে তারা সাহায্যের জন্যে গিয়ে দাঁড়াতে পারত।
যে বনের ধারে হরকোয়ার আর কুন্তী তাদের কুঁড়েঘরটি বানিয়েছিল, সেই বনটি আমার একটি প্রিয় জায়গা ছিল। আমার সেকেলে গাদা বন্দুকটি নিয়ে প্রথম আমি এই বনে ঢুকেছিলুম বাড়ির জন্যে লাল বনমোরগ আর ময়ুর মেরে আনব বলে। তারপর আমি আধুনিক একটি রাইফেল নিয়ে বড়-বড় শিকারের খোঁজে এর প্রতিটি অংশে গিয়েছি।
যে সময় হরকোয়ার আর কুন্তী তাদের দুটি সন্তানকে নিয়ে কুড়েঘরটিতে বাস করতে আসে (পুনোয়া নামে তাদের ছেলেটির বয়স তখন তিন, আর পুতলি বলে মেয়েটির বয়স দু-বছর), তখন আমি নিশ্চিত করে জানতুম যে সে বনটাতে এই এই জন্তু ছিল: পাঁচটা বাঘ; আটটা চিতা; চারটি স্লথ ভালুকের একটি পরিবার; দুটি কালো হিমালয়ের ভালুক–তারা বুনো কুল আর মধু খাবে বলে উঁচু পাহাড় থেকে এসেছিল। অনেকগুলি হায়েনা পাঁচ মাইল দূরের ঘাস-জমিতে গর্তের মধ্যে বাস করত আর বাঘ ও চিতাদের মারা জীবজন্তুর দেহের ফেলে-যাওয়া অংশগুলি খাবার জন্যে প্রতি রাত্রে এই বনে আসত। এক জোড়া বন-কুত্তা; প্রচুর শেয়াল, খেঁকশেয়াল আর পাইন-মার্টেন। নানারকমের খট্টাস আর অন্য রকম বিড়ালজাতীয় জীব। এ ছাড়াও গোটা দুই ময়াল সাপ, অনেক রকমের ছোট সাপ, ঝুঁটিওয়ালা ঈগল, ধূসর ঈগল, এবং শত-শত শকুন এই বনে থাকত।
মানুষের ক্ষতি যারা করে না সেই হরিণ, কৃষ্ণসার, শুয়োর বাঁদর ইত্যাদির কথা তো বললুমই না, কেননা আমার এ গল্পের মধ্যে তাদের কোনো ভূমিকা নেই।
যেদিন তাদের পলকা কুঁড়েঘরটি তৈরি করা শেষ হল, তার পরদিনই হরকোয়ার আট আনা রোজে ক্যানেলের ঠিকাদারের কাছে রাজমিস্ত্রীর কাজ পেয়ে গেল। আর কুন্তী বনবিভাগ থেকে দু-টাকা দিয়ে এক পারমিট নিয়ে পাদ-শৈলে ঘাস কাটবার অধিকার পেল। সেই ঘাস সে বাজারের দোকানদারদের কাছে গরু-মোষের খাদ্য হিসেবে বিক্রি করত।
প্রায় একমণ ওজনের সেই সবুজ ঘাসের বোঝা নিয়ে আসতে রোজ তাকে বার–চোদ্দ মাইল খাড়া চড়াই আর উৎরাই ভাঙতে হত। তার জন্যে কুন্তী পেত চার আনা। তা থেকে এক আনা নিত বাজারে বিক্রির জন্যে নিযুক্ত সরকারী ঠিকাদার।
হরকোয়ারের আয় আট আনা, আর কুন্তীর পাওয়া তিন আনা দিয়ে চারটি প্রাণীর এই পরিবারটির বলতে গেলে আরামেই চলে যেত, কেননা খাদ্য ছিল প্রচুর ও সস্তা। জীবনে এই প্রথম তাদের মাসে একবার মাংস কিনে খাবার সংগতি হল।
হরকোয়ার আর কুন্তী যে তিন মাস কালাধুঙ্গিতে কাটাবে বলে এসেছিল তার মধ্যে দু-মাস বেশ শান্তিতে কেটে গেল। কাজে খাটতে হত অনেকক্ষণ, বিশ্রাম করবারও সুবিধে হত না বটে, কিন্তু শিশুকাল থেকেই তাতে তারা অভ্যস্ত। আবহাওয়া চমৎকার ছিল, বাচ্চাদুটির স্বাস্থ্যও ভাল ছিল। যে-ক-দিন ধরে কুঁড়েঘরটা তৈরি হচ্ছিল, সেই ক-দিন ছাড়া তাদের কখনও খাদ্যাভাব হয় নি।
গোড়ায়-গোড়ায় শিশুদুটোকে নিয়ে ভাবনায় পড়তে হয়েছিল, কারণ তারা এত ছোট, যে তারা হরকোয়ারের সঙ্গে তার ক্যানেলের কাজের জায়গায়ও যেতে পারত না, কুন্তীর সঙ্গেও দূরে-দুরে ঘাসের খোঁজে যেতে পারত না। তারপর একদিন একটি দয়ালু পঙ্গু বৃদ্ধা তাদের সাহায্য করতে এল। সে কয়েকশো গজ দূরে একটা বারোয়ারি কুঁড়েঘরে থাকত। সে বললে, বাপ-মা যখন কাজে যাবে তখন সে-ই বাচ্চাদের দেখাশোনা করবে।
দু-মাস এই ব্যবস্থা বেশ ভালভাবেই চলেছিল। প্রতিদিন সন্ধ্যয় হরকোয়ার যখন চার মাইল দূরে কাজ শেষ করে ফিরে আসত আর তার খানিকক্ষণ বাদে কুত্তী তার ঘাস বিক্রী করে বাজার থেকে ফিরত, তখন তারা দেখত যে পুনোয়া আর পুতলি তাদের জন্যে সাগ্রহে অপেক্ষা করছে।
শুক্রবার হচ্ছে কালাধুঙ্গিতে হাটবার। সেদিন আশপাশের যত গ্রামের সবাই বাজারে আসবেই। সস্তায় খাবার ফল, তরকারি ইত্যাদির জন্যে সেখানে অস্থায়ী চালাঘর তৈরি হত। এই হাটবারে হরকোয়ার আর কুন্তী অন্য দিনের চাইতে আধঘণ্টা আগে কাজ থেকে ফিরে আসত, কেননা হাটে শাক-সবজি কিছু পড়ে থাকলে রাত্রে দোকান বন্ধ হবার আগে সেগুলি কম দামে কিনতে পাওয়া যেত।
এক শুক্রবার হরকোয়ার আর কুন্তী সামান্য কিছু তরকারি আর আধসের পাঁঠার মাংস কিনে ঘরে ফিরে এসে দেখে যে তাদের সাদর অভ্যর্থনা জানাতে আজ পুনোয়া আর পুতলি সেখানে নেই।
বারোয়ারি কুঁড়েতে গিয়ে পঙ্গুল স্ত্রীলোকটির কাছে খোঁজ নিয়ে জানা গেল যে, সে দুপুর থেকেই তাদের আর দেখে নি। সে বললে যে তারা বোধহয় বাজারে নাগর দোলা দেখতে গিয়েছে। বারোয়ারি কুঁড়েঘরের সব ছেলে-মেয়েরাই সেখানে গিয়ে জমেছে তো? কথাটা যুক্তিসঙ্গত, তাই হরকোয়ার বাজার খুঁজে দেখতে গেল আর কুন্তী ঘরে ফিরে গেল রাতের খাবার বানাবার জন্যে।
ঘণ্টাখানেক বাদে কয়েকজন লোককে সঙ্গে করে হরকোয়ার ফিরে এল। এরা তাকে ছেলে-মেয়ে খুঁজতে সাহায্য করেছিল। তাদের কোনো চিহ্ন পাওয়া যায় নি। যত লোককে জিগ্যেস করা হয়েছে, তাদের মধ্যে কেউ বলে নি যে তাদের দেখেছে।
সেই সময়টাতে ভারতের সর্বত্র একটা গুজব রটেছিল যে হিন্দু ছেলে-মেয়েদের চুরি করে নিয়ে ফকিরেরা অসৎ উদ্দেশ্যে নিয়োগের জন্যে উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে বিক্রি করছে। বলতে পারব না যে এর মধ্যে সত্য কতটুকু ছিল। কিন্তু খবরের কাগজে প্রায়ই পড়তুম যে ফরিকেরা মারধোর খাচ্ছে, আর কখনও মারমুখী জনতার হাত থেকে পুলিস তাদের উদ্ধার করছে।
এই গুজব ভারতের সব বাপ-মার কাছেই এসেছিল নিশ্চয়। হরকোয়ার আর তার সাহায্যকারীরা ঘরে ফিরে এসে কুন্তীকে তাদের আশঙ্কার কথা জানাল যে, শিশুদুটিকে ফকিররাই চুরি করে নিয়ে গিয়েছে, হয়তো তারা এই উদ্দেশ্য নিয়েই হাটে এসেছিল।
গ্রামের নিচের মাথায় একটি থানার দুজন কনস্টেবল আর একজন হেড কনটেবল ছিল। হরকোয়ার আর কুন্তী চলল সেখানে। সঙ্গে গেল তাদের হিতার্থীরা। তাদের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছিল। দয়ালু বৃদ্ধ হেড-কনস্টেবলটির নিজেরও ছেলেমেয়ে ছিল। সে সহৃদয়ভাবে সেই উদ্ভ্রান্ত বাপমায়ের কথা শুনে তা তার ডায়েরিতে লিখে নিয়ে বলল যে, সে-রাত্রে তো কিছু করা যাবে না, কিন্তু পরদিন সকালবেলাই সে কালাধুঙ্গির পনেরখানা গ্রামে নোক পাঠিয়ে ছেলে হারানোর খবরটা প্রচার করে দেবার ব্যবস্থা করবে। তার পর সে প্রস্তাব করল যে, সেই লোকটি যদি গোটা-পঞ্চাশেক টাকা পুরস্কার ঘোষণা করতে পারে, তাহলে শিশুদুটিকে নিরাপদে ফিরে পেতে অনেক সুবিধে হয়।
পঞ্চাশ টাকা! কথাটা শুনে হরকোয়ার আর কুন্তী স্তম্ভিত হয়ে গেল, কেননা, তারা জানত না যে সারা পৃথিবীতেও এতগুলো টাকা আছে। যাই হক, পরদিন সকালবেলা যখন সেই হরকরা তার রোদে বেরোয় তখন সে ওই পুরস্কারটা ঘোষণা করতে সক্ষম হয়েছিল, কেননা কালাধুঙ্গির একজন লোক হেড-কনষ্টেবলের কথা শুনে টাকা দিতে চেয়েছিল।
সে রাত্তিরের খাওয়াটা অনেক দেরিতে সারা হল। ছেলেমেয়ের ভাগটা সরিয়ে রাখা হল। ভয়ানক শীত বলে সারারাত অল্প একটু আগুন জ্বেলে রাখা হল। হরকোয়ার আর কুন্তী থেকে-থেকে রাত্রির অন্ধকারে বেরিয়ে গিয়ে ছেলে-মেয়েকে ডাকতে লাগল, যদিও তারা জানত যে তাদের সাড়া পাবার কোনো আশা নেই।
দুটো রাস্তা কালাধুঙ্গিতে এসে সমকোণে পরস্পরকে কাটাকাটি করেছে। তার একটা গিয়েছে পাদ-শৈলশ্রেণী ধরে ধরে হলদোয়ানি থেকে রামনগর পর্যন্ত, অপরটা গিয়েছে নৈনিতাল থেকে বাজপুর। সেই শুক্রবার রাত্রে শীত কাটাবার জন্যে ছোট্ট আগুনটুকুর পাশে বসে হরকোয়ার আর কুন্তী ঠিক করল যে ছেলে মেয়েকে যদি । ভোর হবার মধ্যে পাওয়া না যায়, তাহলে তারা প্রথম রাস্তাটা ধরে গিয়ে খোঁজ করবে, কেননা ছেলে ধরার ওই পথে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
শনিবার ভোর হতেই তারা থানায় গিয়ে তাদের এই সিদ্ধান্তের কথা জানাল। তাদের বলা হল তারা যেন হলদোয়ানি আর রামনগরের থানায় এজাহার দিয়ে আসে। হেড-কনস্টেবলের একটা কথায় তারা খুবই উৎসাহিত হল। সে বলল যে ডাকের রানারকে দিয়ে সে একখানা চিঠি পাঠাচ্ছে–আর কাউকে নয়, খোদ পুলিসের বড় দারোগা-মশায়কে। তাকে অনুরোধ করা হয়েছে যে তিনি যেন সমস্ত রেলের জংশনগুলিতে ঐ ছেলেমেয়ে-দুটির জন্যে নজর রাখতে টেলিগ্রাম করে দেন–চিঠির সঙ্গেই তাদের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে।
সেইদিন সন্ধ্যেবেলা সূর্যাস্তের একটু আগে আটাশ মাইল রাস্তা হেঁটে হলদোয়ানি থেকে ফিরে এসে কুন্তী সোজা থানায় গিয়ে তার ছেলে-মেয়েদের খোঁজ করল আর হেড-কনস্টেবলকে জানাল যে তার খুঁজতে যাওয়াটা বৃথা হলেও সে তাঁর কথামত হলদোয়ানি থানায় এজাহার দিয়ে এসেছে। খানিকক্ষণ পরেই হরকোয়ার ছত্রিশ মাইল হেঁটে রামনগর থেকে ফিরে এল। সেও সোজা থানায় চলে গেল খোঁজ নেবার জন্যে। সেও জানাল যে ছেলেমেয়েদের কোনো হদিস পায় নি, কিন্তু হেড-কনস্টেবলের আদেশ পালন করে এসেছে।
তাদের কুটিরে অনেক বন্ধু অপেক্ষা করে বসে ছিল, এদের মধ্যে ছিল অনেক মায়েরা ওরা নিজেদের সন্তানদের বিপদের ভয়ে ভীত হয়ে উঠেছিল। তারা সহানুভূতি জানাতে এসেছিল হরকোয়ারকে আর পুনোয়ার মা-কে। ভারতের প্রথা অনুসারে জন্মের সময় কুন্তী যে-নামটি পেয়েছিল সে নামটি বিয়ের সঙ্গে-সঙ্গেই খোয়াল। পুনোয়া যতদিন হয় নি ততদিন তাকে ডাকা হত আর উল্লেখ করা হত ‘হরকোয়ারের বউ’ বলে, এবং পুনোয়ার জন্মের পর সে হয়ে গেল ‘পুনোয়ার মা’।
ঠিক শনিবারের মতই রবিবারটা কেটে গেল। তফাতের মধ্যে শুধু এই যে সেদিন পুবে-পশ্চিমে না গিয়ে কুন্তী গেল উত্তর-দিকে নৈনিতালে, আর হরকোয়ার গেল দক্ষিণে বাজপুরে। কুন্তী হাঁটল ত্রিশ মাইল, হরকোয়ার গেল এল বত্রিশ মাইল।
ভোরে বেরিয়ে, রাত্রে ফিরে আসা পর্যন্ত সেই উদ্ভ্রান্ত পিতা আর মাতা এমন সব গহন অরণ্যে দুর্গম পথ অতিক্রম করেছিল, যেখানে লোকেরা সাধারণ অবস্থায় বড়-বড় দল না পাকিয়ে চলাফেরা করে না। ছেলে-মেয়ের জন্য উদ্বেগ ডাকাত ও হিংস্র পশুর ভয় ছাপিয়ে গিয়েছিল। নইলে ও-পথে একা যাবার কথা হরকোয়ার ও কুন্তী মনেও ভাবত না।
রবিবারের সেই সন্ধ্যেবেলা ক্লান্ত আর ক্ষুধার্ত অবস্থায় তারা একজন নৈনিতাল আর অন্যজন বাজপুর থেকে ব্যর্থ-মনোরথ হয়ে ফিরে এসে খবর শুনল যে, হরকরা গ্রামে-গ্রামে ঘুরে এবং পুলিশ তদন্ত করে ছেলে-মেয়েদের কোনো চিহ্ন পায় নি। তখন তাদের মন ভেঙে গেল, আর কখনও যে তারা পুনোয়া আর পুতলিকে দেখতে পাবে, সে আশা তারা ছেড়ে দিল।
দেবতারা যে কেন এমন রাগ করলেন যার ফলে স্পষ্ট দিনের আলোয় ফকিরদের পক্ষে তাদের সন্তানদের চুরি করে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হল, তার কারণ তারা বুঝতে পারল না। পাহাড় থেকে বেরিয়ে এত দূরে হেঁটে আসার আগে, পুরোহিতের মতামত নিয়ে তার ঠিক করে-দেওয়া শুভ দিনে তারা যাত্রা করেছিল। পথে প্রত্যেক দেবস্থানে তারা যথা নিয়মে পুজো দিতে-দিতে এসেছিল।
এক জায়গায় একটুকরো শুকনো কাঠ, আর এক জায়গায় হয়তো কুন্তীর চাদর থেকে ছেঁড়া একটা টুকরো, আরও এক জায়গায় হয়তো একটি পয়সা তারা দিয়েছে, যা দেওয়া তাদের সাধ্যাতীত। আর তারপর এই কালাধুঙ্গিতে এসে যতবার তারা কোনো মন্দিরের সামনে দিয়ে গিয়েছে, ততবার হাতজোড় করে প্রণাম করতে ত্রুটি করে নি। তবে তাদের এই বিষম দুর্ভাগ্য ঘটল কেন? তারা তো দেবতারা যা চান তাই করে এসেছে, এবং কোনো মানুষের কখনও ক্ষতি করে নি!
সোমবার এই দম্পতি এত মন-মরা আর ক্লান্ত হয়ে পড়ল যে তারা ঘর ছেড়ে বেরোতে পারল না। খাবার কিছু ছিল না, কাজ না করা পর্যন্ত তা জুটবেও না। কিন্তু এখন কাজ করে হবে কী? যে সন্তানদের মুখ চেয়ে মুখটি বুজে তারা ভোর থেকে রাত পর্যন্ত খেটেছে, তারাই তো নেই।
তাই, যখন বন্ধুরা যথাসাধ্য সান্ত্বনা দেবার জন্যে তাদের কাছে আসা-যাওয়া করতে লাগল। হরকোয়ার কুটিরের দরজায় বসে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে তার আশাহীন, শূন্য ভবিষ্যই বোধহয় দেখতে লাগল, আর কুন্তী ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঘরের এক কোণে বসে দুলতেই থাকল, দুলতেই থাকল–চোখের জল তার শুকিয়ে গিয়েছে।
সেই সোমবারই, যে-জঙ্গলে আমার উল্লিখিত বন্য জন্তু আর পাখিগুলি থাকত আমার চেনা, একটি লোক সেই জঙ্গলে মোষ চরাচ্ছিল। লোকটি অতি সরল, জীবনের বেশির ভাগই সে পতাবপুর গ্রামের মোড়লের মোষগুলি জঙ্গলে চরিয়ে কাটিয়ে দিয়েছে। বাঘের ভয়ের কথা সে জানত। সূর্যোস্তের আগেই সে মোষগুলোকে একত্র করে নিয়ে একটা গো-পথ ধরে তাদের তাড়িয়ে নিয়ে চলল।
পথটা বনের নিবিড়তম অংশ দিয়ে গিয়েছে। একটু পরেই সে লক্ষ করল যে, প্রত্যেকটি মোষ পথের একটা জায়গায় এসে ডানদিকে মাথা ঘুরিয়ে থেমে যাচ্ছে। পেছনের মোযটার শিঙের ঠেলা খেয়ে তবে সে আবার চলছে। সে যখন সেই জায়গাটায় পৌঁছল, তখন সেও ডানদিকে মাথা ফেরাল। সে দেখল কি-পথ থেকে কয়েক ফুট তফাতে একটা নিচু জায়গায় ছোট্ট দুটি শিশু শুয়ে রয়েছে।
শনিবার যখন হরকরা গ্রামে-গ্রামে ঘুরেছিল, এ লোকটি তখন মোষগুলো নিয়ে জঙ্গলে ছিল। কিন্তু সেই রাত্রে আর তার পরের রাত্রিতেও হরকোয়ারের ছেলে-মেয়ে চুরি হয়ে যাবার কথা শুধু এ গ্রামেই নয়-সারা কালাধুঙ্গির সব গ্রামেই লোকেরা আগুন ঘিরে বসে আলোচনা করেছিল। তবে এই তো সেই হারানো ছেলে-মেয়ে, যাদের জন্য পঞ্চাশ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে! কিন্তু তাদের খুন করে এই এত দূরে এনে ফেলা হয়েছে কেন? শিশু দুটির পরনে কাপড় নেই, জড়াজড়ি করে শুয়ে আছে তারা।
রাখালটি নিচু জায়গাটায় নেমে গিয়ে উবু হয়ে বসে দেখতে চেষ্টা করল যে শিশুদুটি কিসে মরেছে। তারা যে আর বেঁচে নেই, এ বিষয়ে তার কোনো সন্দেহ ছিল না। তাদের ভাল করে পরীক্ষা করে দেখতে গিয়ে সে হঠাৎ দেখল যে তাদের নিঃশ্বাস পড়ছে। আসলে তারা মরে নি, গাঢ় ঘুমে আচ্ছন্ন। সে নিজে ছেলেমেয়ের বাপ, খুব আস্তে তাদের গায়ে হাত দিয়ে তাদের জাগাল। জাত হিসেবে ওদের ছুঁলে তার পাপ হয়, কেননা সে ব্রাহ্মণ, আর ওরা হল নিচু জাতের। কিন্তু এরকম বিপদের সময় জাতে কী এসে যায়? কাজেই সে মোষগুলোকে নিজে থেকে পথ খুঁজে ঘরে ফিরে যাবার জন্যে ছেড়ে দিয়ে শিশুদুটিকে তুলে নিল। তারা এত দূর্বল যে চলতে পারছিল না।
দু-জনকে তার দুই কাঁধে নিয়ে সে কালাধুঙ্গি বাজারের দিকে চলল। সে নিজেও দুর্বল মানুষ, কেননা ওই অঞ্চলের আর সকলের মত সেও বেজায় ম্যালেরিয়ায় ভুগত। শিশু দুটিকে বয়ে নেওয়া এক ঝাট, তাদের আবার জায়গা মত ধরেও রাখতে হয়। তার উপর আবার এই বনের সব গো-পথগুলিই উত্তর থেকে দক্ষিণে চলেছে, অথচ তাকে যেতে হল পূর্ব থেকে পশ্চিমে। তাই, দুর্ভেদ্য ঝোঁপ আর গভীর গিরি-খাত এড়াবার জন্যে তাকে ক্রমাগত ঘুরে-ঘুরে যেতে হল। কিন্তু সে বীরের মত চলতে থাকল। ছ-মাইল হেঁটে আসতে তাকে বার-বার বিশ্রাম করতে হয়েছিল।
পুতলি কথা বলতে পারছিল না, কিন্তু পুনোয়া একটু-একটু পারছিল। তারা কি করে জঙ্গলে এল, এর উত্তরে সে শুধু এই বলতে পারল যে তারা খেলা করতে করতে হারিয়ে গিয়েছিল।
রাত অন্ধকার হয়ে আসছিল। কুটিরের দরজায় বসে হরকোয়ার সেইদিকে একভাবে চেয়ে ছিল। এখানে ওখানে লণ্ঠন আর রান্নার আগুন জ্বলে ওঠায় সেই অন্ধকারের মধ্যে আলোকবিন্দু দেখা যেতে লাগল। এমন সময় সে দেখল যে ছোট একটা দল বাজারের দিক থেকে আসছে। মিছিলের সামনে একজন লোক তার কাঁধের উপর কি যেন নিয়ে হেঁটে আসছিল। চারদিক থেকে লোক এসে মিছিলটাতে যোগ দিচ্ছিল।
একটা উত্তেজনাপূর্ণ গুঞ্জন তার কানে এল : “হরকোয়ারের ছেলেমেয়ে! হরকোয়ারের ছেলেমেয়ে!” সে তার কানদুটোকে বিশ্বাস করতে পারছিল না, কিন্তু তাতে কোনো ভুলও তো নেই। কেননা মিছিলটা তার কুটিরের দিকেই আসছিল।
কুন্তী দুঃখকষ্ট আর শারীরিক সহ্যশক্তির চরমে পৌঁছে কুঁড়েঘরের এক কোণে কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘুমিয়ে ছিল। হরকোয়ার তাকে ঝাঁকুনি দিয়ে জাগিয়ে দরজার কাছে নিয়ে আসতে-আসতে সেই রাখালটি পুনোয়ার আর পুতলিকে কাঁধে নিয়ে সেখানে এসে পৌঁছে গেল।
কান্নার মধ্য দিয়ে উদ্ধার-কর্তাকে সম্ভাষণ, আশীর্বাদ আর ধন্যবাদ জানানো হয়ে গেলে এবং বন্ধুবান্ধবদের অভিনন্দনের হিড়িক খানিকটা কমলে, রাখালকে পুরস্কার দেবার কথা উঠল। গরিব লোকের পক্ষে পঞ্চাশটা টাকা হচ্ছে অগুনতি টাকা, তা দিয়ে। সে তিনটে মোষ কিংবা দশটা গরু কিনে আজীবন স্বাধীনভাবে কাটাতে পারে। কিন্তু উদ্ধার-কর্তাটিকে লোকেরা যতটা বাহাদুরি দিচ্ছিল, সে তার চাইতেও বাহাদুর লোক।
সে বললে যে, এই রাত্রিবেলা তার মাথায় যে আশীর্বাদ আর ধন্যবাদ বর্ষিত হল, তা-ই তার পক্ষে যথেষ্ট পুরস্কার। সে ওই পঞ্চাশ টাকার একটি পয়সাও ছুঁতে একেবারেই অস্বীকার করল। হরকোয়ার আর কুন্তীও দান হিসেবে কিংবা ঋণ বলে ওই টাকাটা নিল না। যে-ছেলেমেয়েদের আবার দেখতে পাবার আশা তাদের ফুরিয়ে গিয়েছিল, তাদেরই তো ফিরে পেয়েছে তারা। এখন শরীরে একটু বল পেলেই তারা আবার কাজে লেগে যাবে। সমাগত লোকদের মধ্যে কেউ-কেউ আন্তরিক আনন্দিত হয়ে বাজারে ছুটে গিয়ে যে দুধ, মেঠাই আর পুরি নিয়ে এসেছে, আপাতত তাই দিয়ে তাদের চলে যাবে।
দু-বছরের পুতলি আর তিন বছরের পুনোয়া শুক্রবার দুপুরবেলা হারিয়ে গিয়েছিল, আর রাখালটি তাদের পেয়েছিল সোমবার বিকেলে আন্দাজ পাঁচটায়– সাতাত্তর ঘন্টার ব্যাপার। এই সাতাত্তর ঘণ্টা ওই শিশুদুটি যে-বনে কাটিয়েছিল, সেখানে আমার জ্ঞানত কত বন্য প্রাণী ছিল, তার বর্ণনা আমি আগেই দিয়েছি।
এ-কথা মনে করা যুক্তিসংগত হবে না যে অতগুলো হিংস্র পাখি আর পশুর মধ্যে কেউই শিশুদুটিকে দেখে নি, তাদের কথা কওয়া শুনতে পায় নি, কিংবা তাদের গন্ধ পায় নি। অথচ যখন রাখালটি পুনোয়াকে আর পুতলিকে এনে তাদের বাপ-মায়ের হাতে দিল, তখন তাদের গায়ে একটি দাঁতের বা নখের দাগ ছিল না।
একবার আমি দেখেছিলুম যে একটি বাঘিনী একটি এক মাসের ছাগল-ছানাকে ধরবার জন্যে গোপনে এগোচ্ছে। জায়গাটা ফাঁকা ছিল বলে বাঘিনীটা কিছু দূরে থাকতেই ছাগলছানাটা তাকে দেখতে পেয়ে চেঁচাতে শুরু করল। বাঘিনী গোপনতা ত্যাগ করে সটান তার দিকে চলে গেল। বাঘিনীর কাছে এসে সে তার গলাটা বাড়িয়ে মুখ উঁচু করে তাকে শুঁকতে গেল। আমার বুকটা কয়েকবার ঢিপঢিপ করতে যতটুকু সময় লাগল, ততক্ষণ সেই এক মাসের বাচ্চাটা আর বনের রানীজীর নাকে নাক ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর রানী মুখটা ফিরিয়ে যেদিক থেকে এসেছিল সেদিকে ফিরে গেল।
হিটলারের যুদ্ধ যখন শেষ হয়ে আসছে, তখন আমি এক সপ্তাহের মধ্যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের তিনজন শ্রেষ্ঠ লোকের বক্তৃতায় উদ্ধৃতি পড়েছিলুম। তারা যুদ্ধে নৃশংসতার নিন্দা করে অভিযোগ করেছিলেন যে, মানুষে-মানুষে যে যুদ্ধ, তার মধ্যে ‘জংলি কানুন’ প্রয়োগ করছে শত্রুপক্ষ। সৃষ্টিকর্তা বনের প্রাণীদের জন্যে যে কানুন করেছেন, মানুষের জন্যে যদি তা করতেন তাহলে যুদ্ধই হত না। কেননা, তাহলে মানুষের মধ্যে যারা প্রবল, দুর্বলের জন্যে তারাও ঠিক সেই রকম সহৃদয়তাই দেখাত যা বনের প্রাণীরা চিরকাল দেখিয়ে আসছে।