চৌগড়ের বাঘগুলি
০১.
আমার সামনের দেওয়ালের যে পূর্ব কুমায়ুনের ম্যাপটি ঝুলছে, সেটি অনেকগুলি ক্রস্ চিহ্নে চিহ্নিত এবং প্রতিটি চিহ্নের নিচে একটি করে তারিখ। চৌগড়ের মানুষখেকো বাঘের নিহত মানুষের, হত্যার তারিখ ও সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের সরকারী নথিভুক্ত হিসেবে বোঝাচ্ছে এই ক্রগুলি। এ হিসেব নির্ভুল এমন দাবি আমি করি না, কেন না দু বছর ধরে আমি ম্যাপটি সম্পূর্ণ করি, আর এ সময়কালে সবগুলো হত্যার খবর আমাকে দেওয়া হয় নি। তা ছাড়া যে সব মানুষ শুধু জখম হয় ও পরিণামে মারা যায়, ক্রচিহ্ন ও দিনাঙ্কে তাদের সম্মানিত করা হয় নি।
প্রথম এটির দিনাঙ্ক ১০ই ডিসেম্বর ১৯২৫, এবং শেষটির ২১শে মার্চ ১৯৩০। সীমানাজ্ঞাপক ক্ৰগুলির মাঝামাঝি দূরত্ব হল, উত্তর থেকে দক্ষিণে পঞ্চাশ মাইল, এবং পুব থেকে পশ্চিমে ত্রিশ মাইল। ১,৫০০ বর্গমাইলের এই এলাকাটি হল পাহাড় ও উপত্যকা, সেখানে শীতে পড়ে থাকে গভীর তুষার, আর উপত্যকাগুলি গ্রীষ্মে জ্বলে খাক হয়।
এই এলাকা জুড়ে চৌগড়ের বাঘ এক সন্ত্রাসের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিল। এই অঞ্চল জুড়ে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত বিভিন্ন আয়তনের গ্রাম। কয়েকটিতে একশো বা তারও বেশি সংখ্যায় মানুষ, অন্যগুলিতে আছে শুধু ছোট ছোট একটি বা দুটি পরিবার। পায়ে চলা পথ সংযুক্ত করেছে গ্রামগুলিকে। মানুষ খালি পায়ে হেঁটে যাওয়ার ফলে সেগুলি পায়ের চাপে শক্ত হয়ে গেছে। এই পথগুলির কয়েকটি গেছে নিবিড় বনের ভেতর দিয়ে, আর যখন কোনো নরখাদক সে-পথে চলাকে বিপজ্জনক করে তোলে, গ্রামে গ্রামে সংযোগ চালু রাখা হয় চেঁচিয়ে। এক বিশাল পাথর, অথবা বাড়ির ছাত, এমনি কোনো গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় দাঁড়িয়ে একটি লোক কু ছাড়ে প্রতিবেশী গ্রামের লোজনদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে এবং সে কুক্ ডাকের উত্তর এলে বার্তাটি তীক্ষ্ণ ও
ছবি। পেজ ৬০২।
উচ্চস্বরে চেঁচিয়ে জানানো হয়। গ্রাম থেকে গ্রামে বার্তাটি ফেরে এবং এক অবিশ্বাস্য রকম সংক্ষিপ্ত সময়কালের মধ্যে বিস্তীর্ণ এলাকার সবটুকুতে প্রচারিত হয়।
১৯২৯ সালের ফেব্রুআরিতে এক জেলা-সম্মেলনে দেখলাম, এই বাঘটি মারতে চেষ্টা করব বলে কথা দিয়ে ফেলেছি। কুমায়ুন ডিভিশনে সে সময়ে তিনটি নরখাদক ছিল এবং যেহেতু চৌগড়ের বাঘটি সর্বাধিক ক্ষতি করেছিল, আমি প্রথমে ওটির উদ্দেশে যাওয়াই স্থির করলাম।
গভর্নমেন্টের দেওয়া সেই ক্ৰস্ ও দিনাঙ্ক সংবলিত ম্যাপটিতে দেখা গেল কালা আগর শৈলশিরার উত্তর ও পুবমুখের গ্রামগুলিতে মানুষখেকোটি সবচেয়ে বেশি সক্রিয়। এই শৈলশিরাটি প্রায় চল্লিশ মাইল লম্বা; এটি উঠে গেছে ৮,৫০০ ফুট অব্দি এবং চূড়ার দিকে এটি নিবিড় বনে ঢাকা। এর উত্তর দিয়ে বরাবর চলে গেছে একটি জঙ্গুলে পথ। কোনো কোনো জায়গায় তা মাইলের পর মাইল গেছে ওক রডোডেনড্রনের নিবিড় জঙ্গল দিয়ে। অন্যত্র এটি জঙ্গল ও চাষ-জমির সীমারেখা সৃষ্টি করেছে। এক জায়গায় পথটি দড়ির ফাঁসের মত এক বৃত্ত রচনা করেছে, এই বৃত্তের মাঝে অবস্থিত কালাআগর ফরেস্ট বাংলো।
এই বাংলোটিই ছিল আমার উদ্দিষ্ট এবং ১৯২৯ সলের এপ্রিলের এক সন্ধ্যায় সেখানে পৌঁছলাম আমি চার দিনের পদযাত্রার শেষে, শেষ পর্যায়ে ৪,০০০ ফুট খাড়া চড়াই ভাঙার পর।
এ অঞ্চলের শেষ নিহত মানুষ একটি বাইশ বছরের ছেলে। সে তাদের পালিত পশু চরাবার সময় নিহত হয়। আমার পৌঁছবার পরদিন সকালে আমি যখন প্রাতরাশ খাচ্ছিলাম, যুবকটির ঠাকুমা আমার সঙ্গে দেখা করতে এল। সে আমাকে জানায়, কোনো প্ররোচনা ব্যতিরেকেই নরখাদকটি পৃথিবীতে তার যে একমাত্র আপনজন ছিল, তাকে মেরেছে। যেদিন ও জন্মায়, সেদিন থেকে শুরু করে ওর নাতির আদ্যোপান্ত ইতিহাস আমাকে বলে, ওর গুণগুলি বারবার তুলে ধরে সে আমাকে, বাঘের টোপ হিসেবে তার তিনটি দুধেল মোষকে নিতে বলল। বলল, ওর মোষের সহায়তায় আমি বাঘটি মারলে পরে ও এই মনে করে সান্ত্বনা পাবে, যে নাতির মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে ও সহায়তা করেছে।
এই পূর্ণবয়স্ক প্রাণীগুলি আমার কোনো কাজে লাগবে না, কিন্তু ওদের নেবার ব্যাপারে প্রত্যাখ্যান জানালে আঘাত করা হবে তা জেনে আমি সেই বৃদ্ধাকে ধন্যবাদ জানালাম এবং তাকে আশ্বস্ত করলাম, নৈনিতাল থেকে সঙ্গে করে যে চারটি বাচ্চা মদ্দা মোষ এনেছি, সেগুলো খতম হবার সঙ্গে সঙ্গেই আমি ওর কাছে টোপের জন্যে সাহায্যার্থী হব। কাছাকাছি গ্রামের গ্রামমোড়লরা তখন একে একে জড়ো হয়েছে আর তাদের কাছে আমি শুনলাম যে শৈলশিরাটির পূর্ব দিকের ঢালে, বিশ মাইল দূরে একটি গ্রামে দশদিন আগে শেষ দেখা গেছে বাঘটিকে; সেখানে সে একটি লোক ও তার স্ত্রীকে হত্যা করেছে, খেয়েছে।
দশ দিনের পুরনো নিশানা অনুসরণ করার মত নয় এবং গ্রামমোড়লের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনার পর আমি শৈলশিরার পুবদিকে ডালকানিয়া গ্রামের উদ্দেশে রওনা হওয়া স্থির করলাম। কালা আগর থেকে ডালকানিয়া দশ মাইল দূরে, এবং যেখানে সেই লোকটি এবং তার স্ত্রী নিহত হয়েছে সে গ্রামের সঙ্গেও ডালকানিয়ার দূরত্ব সমানই।
ডালকানিয়া এবং তার সংলগ্ন গ্রামগুলি যত সংখ্যক ক্ৰস্ অর্জন করেছে তা থেকে বোঝা যায় এই গ্রামগুলির কাছাকাছিই বাঘটির প্রধান ঘাঁটি।
পরদিন সকালে প্রাতরাশের পর আমি কালা আগর থেকে রওনা হলাম এবং চললাম জঙ্গুলের পথ ধরে; শুনেছিলাম পথটি আমাকে নিয়ে যাবে শৈলশিরার শেষে। সেখানে আমাকে জঙ্গুলে পথটি ছাড়তে হবে, একটি পথে পাহাড়ের উত্রাইয়ে যেতে হবে ডালকানিয়া। নিবিড় অরণ্যের মধ্য দিয়ে শৈলশিরান্ত অবধি চলে যাওয়া এ পথটি খুব কম ব্যবহার হয়। আর চলতে চলতে পথটিতে নিশানা খুঁজতে খুঁজতে বেলা দুটোর সময়ে আমি একটি জায়গায় পৌঁছলাম, সেখানে এসে পথটি শেষ হয়েছে। এখানে এসে ডালকানিয়ার একদল লোকের সঙ্গে দেখা হল। তারা কু-ডাক সংযোগ ব্যবস্থার মাধ্যমে, তাদের গ্রামে আমার ক্যাম্প করার উদ্দেশ্যের কথা শুনেছে এবং শৈলশিরায় এসেছে আমাকে জানাতে-ডালকানিয়ার দশ মাইল উত্তরে একটি গ্রামে একদল মেয়ে যখন শস্য কাটছিল, তাদের বাঘটি আক্রমণ করেছে।
আমার ক্যাম্পের সরঞ্জামকারী লোকরা আট মাইল হেঁটেছে, আরো হাঁটতে তারা বেশ ইচ্ছুকই ছিল। কিন্তু দশ মাইল দূরের সে গ্রামটির পথ খুব এবড়োখেবড়ো এবং ঘন জঙ্গলের ভেতর দিয়ে তা গেছে–গ্রামবাসীদের কাছে এ খবর জেনে, আমার লোকজনকে ওদের সঙ্গে ডালকানিয়া পাঠাবার এবং বাঘের আক্রমণস্থলে একা যাবার সিদ্ধান্ত নিলাম আমি।
আমার ভৃত্য তখনি আমার জন্যে ভরপেট খানা পাকাতে ব্যস্ত হল এবং ভরপেট খেয়ে বেলা তিনটেয় আমি দশ মাইল হাঁটা পথে রওনা দিলাম। অনুকূল অবস্থায় দশ মাইলের পথ আড়াই ঘণ্টার ব্যাপার, কিন্তু এক্ষেত্রে পরিস্থিতি আর যা হক, মোটেই অনুকূল ছিল না। পাহাড়ের পুব দিক ধরে ধাবমান পথটি সুগভীর গিরিখাতে ঘুরে ঘুরে ডুকেছে আর বেরিয়েছে। তার কিনারায় যথাক্রমে আছে পাথর, নিবিড় ঘন ঝোঁপ আর গাছ, পালা। যখন প্রতিটি আড়াল এক ক্ষুধার্ত নরখাদকের চেহারায় আকস্মিক মৃত্যুতে গোপন রাখতে সক্ষম এবং সে আড়ালের কাছে যেতে হয় সাবধানে, তখন অগ্রগতি মন্দ হতে বাধ্য। উদ্দিষ্ট স্থল থেকে আমি তখনো বহু মাইল দূরে, তখন নিভু নিভু দিন আমাকে হুঁশিয়ারী জানিয়ে দিল, থামার সময় হয়েছে।
অন্য যে কোনো অঞ্চলে, তারার নিচে শুকনো পাতার এক বিছানায় ঘুমনো এক বিশ্রামভরা রাতের প্রতিশ্রুতি দেয়, কিন্তু এখানে মাটিতে ঘুমনো মানে এক অতি অপ্রীতিকর মৃত্যুকে আহ্বান জানানো। এক উপযুক্ত গাছ নির্বাচনে দীর্ঘদিনের অভ্যাস, তাতে আরামে ঘুমোবার ক্ষমতা, গাছের উপর ঘুমনোকে এক তুচ্ছ ব্যাপারে পর্যবসিত করেছে। এবারটা আমি বেছেনিলাম একটি ওক গাছ, এবং রাইফেলটি একটি ডালে শক্ত করে বেঁধে আমি কয়েক ঘন্টা ঘুমিয়েছি, তখন গাছের নিচে বহু জানোয়ারের খসখস শব্দে জেগে উঠলাম। শব্দটি এগিয়ে গেল এবং অচিরে গাছের ছালের ওপর নখ আঁচড়ানোর আওয়াজ পেলাম ও বুঝলাম, একটি ভাল্লুক পরিবার কয়েকটি কারফল গাছে উঠছে; পাহাড়গাত্রের একটু নিচের দিকে গাছগুলিকে দেখেছিলাম (আমাদের পাহাড়ে ৬০০০ ফুট উচ্চতায় কারফল দেখা যায়। গাছগুলি উচ্চতায় প্রায় চল্লিশ ফুট হয় এবং তাতে ছোট, লাল অতি সুমিষ্ট ফল হয়, মানুষ এবং ভাল্লুক উভয়েই তার কদর করে থাকে)।
খাবার সময়ে ভালুকরা ভারি ঝগড়াটে এবং ওরা মন খুশি করে ভরপেট খেয়ে চলে না যাওয়া অব্দি ঘুমনো অসম্ভব হল।
অরণ্যবেষ্টিত পনের বিঘা হাসিল জমিতে দুটি কুঁড়েঘর ও একটি বাথান সংবলিত গ্রামটিতে আমি যখন পৌঁছলাম, তখন সূর্য দু ঘন্টা হল উঠে গেছে। মানুষগুলি আতঙ্কে বিবস হয়ে ছিল এবং আমাকে দেখে অত্যত আনন্দিত হল। কুঁড়েঘরগুলি থেকে কয়েক গজ দুরের গমখেতটি সাগ্রহে দেখিয়ে দেওয়া হল আমায়। সেখানে শস্য কাটতে ব্যস্ত তিনটি মেয়েকে তাক করছিল বাঘটি পেট মাটিতে ঠেকিয়ে, তাকে সময় থাকতে কোনোমতে দেখে ফেলা হয়।
যে লোকটি বাঘটাকে দেখে ও চেঁচিয়ে হুশিয়ার করে, সে আমাকে বলল, বাঘটা পিছু হটে জঙ্গলে ঢুকে যায়, সেখানে তার সঙ্গে যোগ দেয় দ্বিতীয় আরেকটি বাঘ, আর দুটি জানোয়ারই পাহাড়ের গা ধরে নেমে নিচের উপত্যকায় চলে যায়। দুটি কুঁড়েঘরের বাসিন্দারাই ঘুমোতে পারে নি, কেন না শিকার হাতছাড়া হওয়াতে সারারাত ধরে বাঘগুলো অল্পক্ষণ বাদে বাদে ডাকে এবং আমি পৌঁছবার সামান্য কিছুক্ষণ আগে ওরা ডাক থামিয়েছে সবে। এই যে কথাটি, যে বাঘ আছে দুটো তা ইতিমধ্যে যে রিপোর্ট পেয়েছি, তাকেই সমর্থন করল–মানুষখেকোটির সঙ্গে থাকে এক বড়সড় শাবক।
আমাদের পাহাড়ের লোকজন খুবই আতিথ্যপরায়ণ আর গ্রামবাসীরা যখন জানল, আমি জঙ্গলে রাতটা কাটিয়েছি, আমার ক্যাম্প ডালকানিয়াতে, ওরা আমার জন্য খানা পাকাবার প্রস্তাব করল। আমি জানতাম তাতে ছোট্ট গ্রামটির ভাঁড়ারে টান পড়বে, তাই চাইলাম এক পেয়ালা চা। কিন্তু যেহেতু গ্রামে কোনো চা ছিল না, আমাকে দেওয়া হল ঝোলাগুড়ে অত্যধিক মিষ্টি করা টাটকা দুধের একটি গেলাস-অতীব তৃপ্তিদায়ক পানীয়, তেমন মন্দ লাগারও নয়–যখন ওতে অভ্যস্ত হয়ে যায় কেউ। আমার আতিথ্যদাতাদের অনুরোধে যখন গমো ফসলের বাকিটুকু কাটা হল, আমি পাহারায় মোতায়েন থাকলাম। আর ওদের শুভেচ্ছা নিয়ে মধ্যাহ্নে নেমে গেলাম উপত্যকায়, যেদিকে বাঘগুলিকে ডাকতে শোনা গেছে, সেইদিকে।
লাটিয়া, ননধাউর ও পূর্ব গৌলা, এই তিনটি নদীর জলবিভাজিকা থেকে শুরু হয়ে উপত্যকাটি দক্ষিণ-পশ্চিমে চলে গেছে বিশ মাইল। এটি নিবিড় বনে ঢাকা। নিশানা অনুসরণ অসম্ভব, আর বাঘগুলিকে দেখার আমার একমাত্র উপায় হল, ওদের আমার প্রতি আকৃষ্ট করা; অথবা ওদের হদিস পেতে আরণ্য প্রাণীদের সাহায্য পাওয়া।
আপনাদের মধ্যে যদি কেউ পায়ে হেঁটে মানুষখেকো বাঘ শিকারের স্পোর্টে রত হতে ইচ্ছুক হয়ে থাকেন, তাদের এটি জেনে রাখা ভালো যে, জঙ্গলের পাখি ও পশু, ঈশ্বরদত্ত চারটি প্রধান বায়ুস্রোত, এই জাতের শিকারে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শিকারী স্বীয় নিরাপত্তা এবং তিনি যে শিকারকে মারতে চান, তার গতিবিধি সম্পর্কে জানার জন্যে যে সব বিপদজ্ঞাপক ডাকের ওপর বহুদূর অবধি নির্ভর করেন, সেগুলি যেসব প্রাণীরা ডাকে, তাদের নাম দেবার জায়গা এ নয়। কেননা এদেশে পাহাড়ের চড়াই অথবা উৎত্রাইয়ে তিন বা চার মাইল ওঠা বা নামার অর্থ দাঁড়ায়, তিন বা চার হাজার ফুট উচ্চতা এবং উচ্চতা ভেদে জানোয়ারের তারতম্য ঘটে। অবশ্য সকল উচ্চতাতেই বাতাস একটি সদাই-বিরাজ ব্যাপার এবং পায়ে হেঁটে মানুষখেকো শিকার প্রসঙ্গে এর গুরুত্ব সম্পর্কিত কয়েকটি কথা অবান্তর হবে না এখানে।
বাঘরা জানে না যে মানুষের গন্ধ বিষয়ে কোনো বোধ নেই, আর কোনো বাঘ যখন মানুষখেকো হয়ে ওঠে, সে বন্যপ্রাণীদের সঙ্গে যেমন, মানুষের সঙ্গেও ঠিক একই আচরণ করে–উজান বাতাসে উদ্দিষ্ট শিকারের কাছে এগোয়, নয়তো ভাটি-বাতাসে শিকারের জন্যে ওৎ পেতে থাকে।
যখন উপলব্ধি করা যায়, যেসময়ে শিকারী:বাঘের দেখা পেতে চেষ্টা করছেন, বাঘ তখন শিকারীকে তাক করছে অথবা তার জন্যে ওৎ পেতে বসে আছে সে। খুবই সম্ভব, তখন ওপরে যে বিষয়ের কথা বলা হল, তার গুরুত্ব স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বাতাসের ব্যাপারটি শিকারীর অনুকূলে না থাকলে বাঘের উচ্চতা, লোমের রং ও নিঃশব্দে চলাফেরার ক্ষমতার কারণে এ প্রতিযোগিতা অতীব অসম হয়ে দাঁড়াত।
যখন চুপিসাড়ে অথবা ওৎ পেতে মারা হয়, তখন সর্বক্ষেত্রেই শিকারের কাছে আসা হয় পেছন থেকে। শিকারী যদি বায়ুপ্রবাহকে সম্পূর্ণ কাজে লাগাতে সমর্থ না হন, তবে যে জঙ্গলে মানুষখেকো অপেক্ষা করে আছে বলে বিশ্বাস করবার সকল কারণ আছে, তেমন নিবিড় জঙ্গলে প্রবেশ করা শিকারীর পক্ষে আত্মহত্যার সামিল এক ব্যাপার হবে। দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা যায়, যদি ধরে নিই, এগোবার জমিটা এমন, যে-দিক থেকে বাতাস বইছে, শিকারীকে সেদিকেই এগোতে হচ্ছে, তাহলে বিপদ থাকবে শিকারীর পেছনে। সেক্ষেত্রে সে-বিপদের সঙ্গে মোকাবিলা করতে তিনি সামান্যই সক্ষম হবেন। তবে ঘন ঘন এদিক থেকে ওদিক বাতাস কেটে চলতে থাকলে শিকারী সে-বিপদকে যথাক্রমে বাঁয়ে ও ডাইনে রেখে চলতে পারবেন। ছাপার হরফে এ পরিকল্পনাটি তেমন চিত্তাকর্ষ বোধ না হতে পারে, কিন্তু কার্যকালে এটিতে ফল দর্শায়। আর যে দুর্ভেদ্য জঙ্গলে এক ক্ষুধার্ত মানুষখেকো ওৎ পেতে আছে, তার ভেতর দিয়ে উজান-বাতাসে যেতে হলে এর চেয়ে ভাল বা নিরাপদ। কোনো পন্থা আমি জানি না।
বাঘগুলিকে না-দেখে জঙ্গলে তাদের উপস্থিতি বিষয়ে পাখি বা পশুর কাছে কিছুমাত্র জানান-না পেয়ে, সন্ধ্যা নাগাদ পৌঁছে গেলাম উপত্যকার উচ্চতর প্রান্তে। উপত্যকার উত্তর দিকে অনেক উঁচুতে একটি বাথানই একমাত্র বসতস্থান যা চোখে পড়ল।
আজ, দ্বিতীয় রাতে, গাছ বাছাইয়ের ব্যাপারে সযত্ন ছিলাম আমি, এবং তার পুরস্কার পেলাম রাতভোর অনুপদ্রব বিশ্রাম। আঁধার ঘনবার অল্প পরেই বাঘগুলি ডাকে, আর কয়েক মিনিট বাদে উপত্যকা প্রতিধ্বনিত করে ভেসে আসে গাদাবন্দুকের দুটি গুলির আওয়াজ, তার পেছনে আসে গো-বাথানের গাইচরীদের প্রচুর হইহল্লা। তারপর থেকে নিশীথ নিঃশব্দই ছিল।
পরদিন বিকেলের মধ্যে আমি উপত্যকাটির সবটুকু আঁতিপাঁতি করে দেখে ফেললাম। ডালকানিয়াতে আমার লোকজনের সঙ্গে মিলিত হবার উদ্দেশ্যে একটি ঘাসঢাকা ঢাল দিয়ে চড়াই অঙছি, এমন সময়ে বাথানটির দিক থেকে এক লম্বা টানা কুক-ডাক শুনলাম। আবার একবার কুটি পুনর্বার ডাকা হল, এবং উত্তরে আমার জবাব পাঠালে পরে একটি লোককে একটা খুঁচিয়ে বেরিয়ে আসা পাথরে চড়তে দেখলাম, এই সুকেন্দ্রিত জায়গা থেকে ও উপত্যকা পেরিয়ে চীৎকার করে ওর প্রশ্ন পাঠাল, নৈনিতাল থেকে যিনি মানুষখেকোকে মারতে এসেছেন, আমিই সেই সাহেব কি না। যখন তাকে বললাম, আমিই সেই সাহেব, সে খবর দিল যে দুপুর নাগাদ, উপত্যকার যেদিকে আমি আছি, সেদিকের এক গিরিখাত থেকে ওর গরুর পাল ভয়ে ছুটে বেরিয়ে আসা এবং বাথানে ওরা পৌঁছলে পরে ও ওদের গুনতি করে, এবং গুনতির পর দেখে, একটি সাদা গরুকে পাওয়া যাচ্ছে না।
আমি যেখানে দাঁড়িয়েছিলাম, তা থেকে আধ মাইল পশ্চিমে, গতরাতে ও যে বাঘদের ডাকতে শুনেছে, ওর সন্দেহ, গরুটিকে তারাই মেরেছে। এ খবরের জন্যে ওকে ধন্যবাদ জানিয়ে, গিরিখাতটি তল্লাসী করতে রওনা হলাম আমি। খাতটির কিনারা ধরে স্বল্প দূরে এগিয়েছি, পলায়মান গরুর পালের খুরের চিহ্ন পেয়ে গেলাম আর সে খুরের চিহ্ন ধরে পেছনপানে গিয়ে যেখানে গরুটি নিহত হয়েছে সে জায়গাটি খুঁজে পেতে কোনো কষ্ট হল না আমার।
গরুটিকে মারার পর বাঘরা ওটাকে নিয়ে খাড়াই পর্বতপার্শ্ব ধরে গিরিখাতে নেমে গেছে। হেঁচড়ে নেবার চিহ্ন ধরে এগনো বুদ্ধির কাজ নয় তাই উপত্যকা ধরে নেমে আমি অনেক দূর থেকে সম্পূর্ণ ঘুরে গেলাম, এবং যেখামে মড়িটি থাকবে বলে আশা করছি সেখানে গেলাম গিরিখাতটির অন্য দিক থেকে।
গিরিখাতের যেদিক দিয়ে মড়ি নিয়ে নেমে যাওয়া হয়েছে, তার চেয়ে এ পাশটি কম খাড়াই এবং ওৎ পেতে তাক করার আদর্শ জায়গা এটি, কচি ঢেঁকিশাক বনে ঘন ও নিবিড়। ছায়ার মত নিঃশব্দে, পায়ে পায়ে আমি চেঁকিশাকের বন দিয়ে পথ করে নিয়ে চললাম, গাছগুলি আমার কোমর ছাপিয়ে উঠেছে। আমি যখন গিরিখাতের অঙ্ক থেকে আন্দাজ ত্রিশ গজ দূরে, সামনে একটি নড়াচড়া চোখে ধরা পড়ল। বাতাসে ছিটকে উঠল একটি সাদা পা, সেটি ভীষণ জোরে ছটফটাল। পর মুহূর্তেই গলার গভীর গর্জন-বাঘগুলি মড়ি নিয়ে বসেছে এবং সুস্বাদু গ্রাস নিয়ে ওদের মতবিরোধ ঘটেছে।
বহু মিনিট ধরে আমি একেবারে নিস্পন্দ দাঁড়িয়ে থাকলাম। পা-টি ছটফটাতে থাকল তবে গর্জনের আর পুনরাবৃত্তি হল না। এর চেয়ে কাছে যাওয়া ঠিক হবে না। কেননা আমাকে দেখা যাবে না, এভাবে যদি ওই ত্রিশ গজ যেতে সক্ষম হইও এবং একটা বাঘকে মেরে ফেলতে পারি, তবুও অন্যটি আমার ওপর এসে পড়তে পারে নাও পারে। আর পড়লে পরে যে জমিতে আছি তা আমাকে প্রাণ বাঁচাবার কোনো সুযোগই দেবে না।
বাঁ দিকে আমার সামনে বিশ গজ দূরে, বাঘগুলির থেকে প্রায় সমানই দূরত্বে আন্দাজ দশ থেকে পনের ফুট উঁচু একটি পাথরের ঢিপি। চুপি চুপি ওটিতে পৌঁছতে পারলে হয়তো বাঘগুলিকে অনায়াসে মারতে পারব, তার পুরোদস্তুর সম্ভাবনা আছে। হাতে আর হাঁটুতে ভর দিয়ে হামাগুড়ি টেনে, রাইফেলটিকে সামনে ঠেলতে ঠেলতে চেঁকিশাকের ভেতর দিয়ে হামা টেনে সেই পাথরের আড়ালে পৌঁছলাম, দম ফিরে পেতে এক মিনিট থামলাম, নিশ্চিত হয়ে নিলাম যে রাইফেলে গুলি ভরা আছে, তারপর পাথরে চড়লাম। পাথরের মাথা ও আমার চোখ এ সমান লাইনে যখন, তখন টপকে নিচে চাইলাম এবং বাঘ দুটিকে দেখলাম।
একটি বাঘিনী গরুটির পেছন থেকে খাচ্ছিল, অন্যটি কাছে শুয়ে থাবা চাটছিল। দুটি বাঘিনীকেই দেখতে সমান আকারের দেখাল, কিন্তু যেটি থাবা চাটছিল, তার রং অন্যটির চেয়ে অনেক পর্দা পাতলা। এই হাল্কা রং ওর বয়সের কারণে, এবং এই বাঘিনীটিই বৃদ্ধ নরখাদকটি, এই সিদ্ধান্ত করে খুব সযত্নে ওর দিকে মাছি টিপ করলাম এবং গুলি ছুঁড়লাম।
আমার গুলিতে ও পেছনে ছিটকে উঠে চিত হয়ে পড়ে গেল, ওদিকে অন্যটি বড় বড় লাফে গিরিখাতটি ধরে ছুটল এবং আমি দ্বিতীয় ট্রিগারটি টিপতে পারার আগেই সে চোখের আড়ালে চলে গেল। যে বাঘিনীকে গুলি করলাম, সে আর নড়ে নি এবং ও মরেছে তাতে নিশ্চিত হবার জন্যে ওর গায়ে পাথর ছোঁড়ার পর আমি এগোলাম এবং তারপরই ভীষণ এক নৈরাশ্যের অভিজ্ঞতা হল। কেননা কাছে এসে একটি চাহনিতেই আমাকে বলে দিল আমি ভুল করেছি, মেরেছি শাবকটিকে পরবর্তী বার মাসে পনেরটি প্রাণহানিতে এ ভুলের মাশুল গুনতে হয় এবং একবার আমার প্রাণও খোয়া যেতে বসে।
এই জোয়ান বাঘিনীটি যদি বা নিজে কোনো মানুষকে না মেরেও থাকে সম্ভবত ওর মাকে মানুষ মারতে সাহায্য করেছে (পরে দেখেছিলাম আমার এ ধারণা সত্যি)–এ চিন্তায় নৈরাশ্য কিছুটা কমল। আর আমার অনুভূতিতে সান্ত্বনার প্রলেপ দেবার জন্যেও বলি, একথা সত্যি, মানুষের মাংসে লালিত হবার পর এই বাঘিনীটি ভবিষ্যতে মানুষখেকো হয়ে ওঠা সম্ভব, এই হিসেবে ওকে বিচার করা হবে, এও হতে পারত।
সহায়তা পেলে এবং প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম থাকলে কঁকা জায়গায় বাঘের চামড়া ছাড়ানো এক সহজ কাজ। কিন্তু এখানে সে কাজ আর যাই হক সোজ নয় কেননা আমি একা, চারদিকে ঘিরে আছে ঘন বন, আর একটি পেনাইফ আমার একমাত্র সরঞ্জাম। যদিও মানুষখেকোটির তরফ থেকে কোনো প্রকৃত বিপদের আশঙ্কা নেই, কেননা বাঘরা কখনো ওদের দরকারের বেশি মারে না–তবু আমার মনের পেছনে এক অস্বস্তির অনুভূতি থেকেই গেল, বাঘিনীটি ফিরে এসেছে এবং আমার প্রতিটি নড়াচড়া লক্ষ করছে।
এ শ্রমসাধ্য কাজ শেষ করার আগেই সূর্য অস্ত গেল প্রায়, এবং যেহেতু আমাকে আরো একটি রাত জঙ্গলে কাটাতে হবে, যেখানে আছি সেখানেই থাকা স্থির করলাম। ওর থাবার ছাপ দেখে যেমন বুঝছিলাম, বাঘিনীটি এক অতি প্রাচীন জানোয়ার এবং যেখানে যত বন্দুকবাজ মানুষ প্রায় তত বন্দুক আছে, এমন এক জেলায় সারা জীবন বাস করার ফলে ওর মানুষ এবং মানুষের আচার আচরণ বিষয়ে আর কিছু শেখার নেই। রাতে কোনো সময়ে ও মড়ির কাছে ফিরে আসতে পারে এবং সকালে আলো হওয়া অব্দি কাছাকাছি থাকতে পারে, এরকম হলেও হতে পারে।
বাধ্যতার কারণেই আমার গাছ বাছাইয়ের ব্যাপারটি বাঁধাবাঁধি হয়ে গেল এবং যে গাছে সে রাত কাটালাম, যত গাছে আমি বার ঘণ্টা কাটিয়েছি তার মধ্যে এটি সবচেয়ে কম আরামের বলে সকালের মধ্যেই প্রমাণ মিলল। থেমে থেমে বাঘিনীটি সারারাত ধরে ডাকল আর সকাল যতই কাছে এল, ডাকটি ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হল, অবশেষে তা মিলিয়ে গেল আমার ওপরের শৈলশিরায়।
যখন বস্তুজগৎ দেখবার আওতায় এল, আমি নামলাম গাছ থেকে–শরীরে খিল ধরল, শরীর আড়ষ্ট, ক্ষুধার্ত, চৌষট্টি ঘণ্টা আছি বিনা আহারে, পোশাক গায়ে সাঁটা– রাতে এক ঘণ্টা বৃষ্টি হয়েছে, বাঘিনীর চামড়া আমার কোটে বেঁধে নিয়ে রওনা হলাম ডালকানিয়ার উদ্দেশ্যে।
বাঘের চামড়া যখন কাঁচা আছে, তা কখন্যে ওজন করি নি আমি, আর মাথা ও থাবাসুদ্ধ ওই চামড়াটি, যেটি সেদিন পনের মাইল বয়ে নিয়ে যাই, রওনা হবার সময়ে সেটির ওজন যদি ৪০ পাউন্ড হয়ে থাকে, আমি হলফ করে বলতে পারি গন্তব্যে পৌঁছবার আগে সেটির ওজন দাঁড়িয়েছিল ২০০ পাউন্ড।
নীল স্লেট পাথরের বড় বড় টালিবসানো, বারটি বাড়ির বারোয়ারী এক উঠোনে দেখলাম আমার লোকজন একশো অথবা তারও বেশি গ্রামবাসীদের সঙ্গে পরামর্শ করছে। দুটো বাড়ির মাঝখানের এক গজ চওড়া এক গলি দিয়ে আমার ঢোকা কারো চোখে পড়ে নি, এবং গোল হয়ে মাটিতে বসে থাকা লোকজনের মধ্যে রক্তমাখামাখি, বিধ্বস্ত চেহারায় আমি যখন টলতে টলতে ঢুকলাম, তখন যে স্বাগতম পেয়েছিলাম তা থাকবে আমার স্মৃতিতে, যতকাল স্মৃতি থাকে, ততকাল।
গ্রাম থেকে একশো গজ দূরে নাড়া ভরা খেতে (নাড়া : শস্য কাটার পর তার যে গোড়া থাকে) আমার ৪০ পাউন্ড তাবু খাটানো হয়েছিল, সেখানে আমি পৌঁছতে না পৌঁছতেই দুটো স্যুটকেস আর গ্রাম থেকে চেয়ে আনা তক্তায় বুদ্ধি করে তৈরি একটি টেবিলে আমার জন্যে চা সাজিয়ে দেওয়া হল। পরে আমাকে গ্রামবাসীরা বলে, মানুষখেকোটি আমাকে শিকার, বলে শেষ করেছে একথা বিশ্বাসে অস্বীকার করে আমার লোকজন তারা আমার সঙ্গে বহু বছর আছে আর অনুরূপ বহু অভিযানে আমার সঙ্গে গেছে; তারা আমি ফিরে আসব এই আশায় এক কেটলি জল রাতেদিনে ফুটন্ত রেখেছিল এবং ডালকানিয়া ও সমীপবর্তী গ্রামগুলির গ্রামমোড়লকে ‘আমি নিখোঁজ’ বলে আলমোড়া ও নৈনিতালে খবর পাঠানোর ব্যাপারে আগাগোড়া প্রবল বাধা দিয়েছিল।– গরম জলে স্নান–বাধ্য হয়েই তা খোলা জায়গায়, এবং তা প্রকাশ্যেই করতে হল, কে আমায় দেখল, তা ভাবার পক্ষে আমি তখন বড় বেশি নোংরা বড় বেশি ক্লান্ত–তারপর ভরপেট ডিনার। আমি রাতের মত শুয়ে পড়ার কথা ভাবছিলাম, এমন সময়ে বিদ্যুতের একটি ঝলক, তারপর প্রচণ্ড বজ্রগর্জন, ঝড়ের আগমন ঘোষণা করল। খেতে তাঁবুর খোটা সামান্যই কাজে লাগে যখন তাড়াহুড়োয় খোঁটাটি যোগাড় করা হয়–আর তেমন খোঁটাতেই তাবুর দড়ি বাঁধা ছিল।
বাড়তি নিরাপত্তার জন্যে তাঁবুতে যা পাওয়া গেল সব দড়ি তাবুর মাথা দিয়ে কোনাকুনি করে ফেলে খোঁটার সঙ্গে বাঁধা হল। বৃষ্টি বাতাসের ঝড় রইল এক খণ্টা। এ ছোট্ট তাঁবু যা সয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে অন্যতম প্রবল এক ঝড়। তাবু খাড়া রাখবার অনেকগুলো দড়িই ক্যানভাস থেকে ছিঁড়ে গেল। কিন্তু খোঁটাগুলো আর কোনাকুনি দড়িগুলো টিকে গেল। আমার অধিকাংশ মালপত্রই জবজবে হয়ে ভিজে গেল। বেশ কয়েক ইঞ্চি গভীর এক ছোট্ট নদী বইতে থাকল তাবুর এ মাথা থেকে ও মাথা অব্দি। তবে আমার বিছানা তুলনায় অবশ্য শুকনোই ছিল, আর রাত ১০টার মধ্যে, যে বাড়িটি গ্রামের লোকেরা ওদের ব্যবহারার্থে দিয়েছে, সে বাড়িতে বন্ধ দরজার পেছনে আমার লোকজন নিরাপদ আশ্রয়ে ঢুকে গেল এবং সঙ্গী হিসেবে একটি গুলি বোঝাই রাইফেল নিয়ে আমি তলিয়ে গেলাম ঘুমে, সে ঘুম বার ঘন্টা স্থায়ী হয়।
পরের দিনটা গেল মালপত্র শুকোতে এবং বাঘিনীর চামড়া সাফ করে টান টান করে মেলতে। যখন এইসব কাজকর্ম এগোচ্ছে, গ্রামবাসীরা ভিড় জমাল আমার অভিজ্ঞতা শুনতে, ওদের অভিজ্ঞতা বলতে, ওরা সেদিন খেতের কাজ থেকে ছুটি নিয়েছিল। উপস্থিত প্রতিটি পুরুষই এক বা একাধিক আপনজনকে হারিয়েছে, বহুজন মানুষখেকোটির হানা দাঁত ও নখের চিহ্ন বইছে, তা তারা মৃত্যু অবধি শরীরে বইবে। মানুষখেকোটিকে মারবার এক সুযোগ নষ্ট হওয়ায় আমার খেদ জড়ো হওয়া পুরুষদের সমর্থন পেল না। আগে একটি মানুষখেকো ছিল, একথা সত্যি। তবে, সাম্প্রতিক মাসগুলিতে নিহত মানুষদের অবশেষ উদ্ধার করতে যে উদ্ধারক দলগুলি গেছে, তারা মড়ির ওপর দুটি বাঘ দেখেছে এবং মাত্র একপক্ষ আগে একই সঙ্গে নিহত হয়েছে একটি লোক এবং তার স্ত্রী। দুটি বাঘই যে পাকা মানুষখেকো এদের কাছে এটিই তার যথেষ্ট প্রমাণ।
আমার তাঁবুটি ছিল পাহাড়ের এক পাশে চুড়োর ওপর, এক ছড়িয়ে থাকা, প্রাকৃতিক দৃশ্যের মুখোমুখি। আমার ঠিক নিচে ননঘাউর নদীর উপত্যকা, তাতে একটি পাহাড়, এটি একেবারেই অনাবাদী, আর দূরে একটা ন’হাজার ফুট উঁচু পাহাড়। পাশে সরকারী ম্যাপ বিছিয়ে হাতে একটি ভাল বাইনোকুলার নিয়ে সে সন্ধ্যায় যখন আমি ধাপ কাটা খেতের কিনারে বসে আছি, গত তিন বছরে বিশটি মানুষ যেখানে নিহত হয়েছে, গ্রামবাসীরা তার সঠিক অবস্থিতি আঙুল দিয়ে দেখাল। চল্লিশ বর্গমাইল এলাকা জুড়ে মোটামুটি সমান দূরে দূরে ভাগ করে এই হত্যার ব্যাপার ঘটেছে।
এ অঞ্চলের জঙ্গলগুলিতে গরু চরাবার অধিকার দেওয়া আছে এবং ওগুলিতে পৌঁছবার গো-রাস্তায় আমার চারটি তরুণ মোষকে বাঁধিব বলে স্থির করলাম।
পরের দশদিন বাঘিনীটির কোনো খবর পাওয়া গেল না এবং সে সময়কাল আমি কাটালাম সকালে মোষগুলির খোঁজ নিয়ে, দিনে বনগুলি তল্লাসী করে এবং সন্ধ্যায় মোষগুলি বেঁধে; আমার তাবুর ওপরকার পাহাড়ের এক গিরিখাতে একটি গরু মারা পড়েছে এ সংবাদে এগারদিনের দিন আমার আশা বেড়ে গেল। তবে মড়িটি একবার দেখে জানলাম, গরুটি মারা পড়েছে এক বুড়ো চিতার হাতে, তার থাবার ছাপ আমি বারবার দেখেছি। গ্রামবাসীরা নালিশ জানাল, বহু বছর ধরে চিতাটি তাদের গরু, মোষ, এবং ছাগল প্রচুর মেরে আসছে এবং আমি ওকে মারব বলে বসা ঠিক করলাম। মরা গরুটির কাছাকাছি এক অগভীর গুহা আমার যে আড়াল দরকার ছিল, তা দিল। সে গুহায় বেশিক্ষণ কাটাই নি আমি, চোখে পড়ল, গিরিখাতের উলটো পাশ দিয়ে চিতাটি নেমে আসছে; আমি গুলি ছুঁড়তে রাইফেল তুলেছি, তখন গ্রামের দিক থেকে আমার উদ্দেশে এক অতি বিচলিত কণ্ঠস্বর শুনলাম।
এ জরুরী আহ্বানের একটি মাত্র কারণ থাকতে পারে এবং টুপিটি ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে আমি গুহা থেকে ছুটে বেরোলাম, চিতাটি তাতে বেজায় ঘাবড়ে গেল ও প্রথমে মাটিতে পেট চেপটে বসে পড়ল। তারপর সক্রোধে ‘উ’ গর্জনে যেপথ দিয়ে এসেছিল, তাই ধরে পালাল লাফ মেরে। গিরিখাতের যে-পাশে আমি, সে-পাশ ধরে হাঁচড়ে-পাঁচড়ে উঠলাম। ওপরে উঠে লোকটিকে চেঁচিয়ে জানালাম আমি আসছি। আর যত জোরে পারি ছুটলাম ওর কাছে যেতে।
গ্রাম থেকে আগাগোড়া পথ পাহাড়ের চড়াই ধরে ছুটে এসেছে লোকটি, দম ফিরে পেলে ও খবর দিল, গ্রামের দূর প্রান্তে, আন্দাজ আধ মাইল দূরে একটি স্ত্রীলোক এইমাত্র মানুষখেকোর হাতে মারা পড়েছে। আমরা যখন পাহাড়ের গা বেয়ে উত্রাইয়ে ছুটছি, দেখলাম, ইতিপূর্বে উল্লিখিত চত্বরে জনতার এক ভিড় জমেছে। আবার একবার সংকীর্ণ গলি দিয়ে আমার ঢোকা চোখে পড়ল না কারো এবং জড়ো হওয়া লোকদের মাথার ওপর দিয়ে ঝুঁকে চেয়ে একটি মেয়েকে মাটিতে বসে থাকতে দেখলাম।
মেয়েটির বয়স অল্প। তার দেহের ওপরের দিকের কাপড় ছিঁড়ে গেছে। মাথাটা পেছন থেকে হেলিয়ে হাতের ওপর ভর দিয়ে সে বসেছিল। কোনো সাড়াশব্দ নেই। কেবল নিঃশ্বাসের সঙ্গে তার বুক ওঠানামা করছে, তার মুখ ও ঘাড় থেকে রক্ত গড়িয়ে বুকের মাঝখানে গিয়ে জমাট বাঁধছে।
আমার উপস্থিতি শীঘ্রই ঠাহরে এল এবং মেয়েটির কাছে আমার এগোবার জন্যে পথ ছেড়ে দেওয়া হল। আমি যখন ওর জখম পরীক্ষা করছি, এককুড়ি লোক, একসঙ্গে কথা কইতে কইতে আমাকে জানাল, খানিকটা ফাঁকা জমিতে মেয়েটির স্বামী আর বেশ কিছু লোকের চোখের সামনে মেয়েটিকে আক্রমণ করা হয়। ওরা একজোটে চেঁচিয়ে উঠতে ভয় পেয়ে বাঘটি মেয়েটিকে ছেড়ে দেয় এবং জঙ্গলের দিকে চলে যায়। মেয়েটি মরে গেছে ভেবে ও যেখানে পড়ে যায়, সেখানেই ওকে ফেলে রেখে ওর সঙ্গীরা আমাকে খবর দিতে ছুটে গ্রামে ফিরে আসে। ক্রমে মেয়েটি জ্ঞান ফিরে পায় এবং গ্রামে ফিরে আসে। জখমের কারণে ও কয়েক মিনিটে মারা যাবে এ সুনিশ্চিত। তখন ওরা ওকে বয়ে নিয়ে যাবে আক্রমণের জায়গায় এবং ওর মড়িটা সামনে রেখে বসতে পারব আমি, গুলি করে মারতে পারব বাঘটিকে।
যথক্ষণ আমাকে এ সব খবর দেওয়া হতে থাকল, মেয়েটির চোখ আমার মুখ। থেকে একবারও নড়ল না। জখম, ভয় খাওয়া জন্তুর মত মিনতিভরা টলটলে চাহনিতে ও আমার প্রতিটি নড়াচড়া অনুসরণ করতে থাকল। আমার তখন অবাধে নড়াচড়ার জায়গা দরকার, হতবুদ্ধি হয়ে গেছি, সে অবস্থা কাটানো দরকার, মেয়েটির নিঃশ্বাস নিতে খোলা বাতাস দরকার। সসংকোচে বলি, এগুলোর জন্যে আমি যে ব্যবস্থা নিলাম তা খুব একটা কোমল হল না।
পুরুষদের মধ্যে শেষ জন যখন তাড়াতাড়ি চলে গেল, মেয়েরা এতক্ষণ ছিল পেছনে, তাদের লাগিয়ে দিলাম জল গরম করতে আর আমার শার্টটা ছিঁড়ে ব্যান্ডেজ বাঁধতে-ওটা তুলনায় পরিষ্কার ও শুকনো ছিল; যাকে দেখে মনে হচ্ছিল হিস্টিরিয়া শুরু হবার পর্যায়ে পৌঁছেছে, সেই মেয়েটিকে ঠেলে পাঠালাম একটি কঁচির জন্যে গ্রাম ছুঁড়ে ফেলতে। জল ও ব্যান্ডেজ আগেই তৈরি হয়ে গেল, যে মেয়েটিকে কঁচির খোঁজে পাঠিয়েছলাম সে ফিরে এল, সঙ্গে কাঁচি। ও বলল, গ্রাম থেকে এই একমাত্র কাচিই বেরোল। বহুকাল যাবৎ মৃত এক দর্জির বাড়িতে কঁচিটি পাওয়া গেছে, দর্জির বিধবা ওটি আলু খুঁড়ে তোলার কাজে ব্যবহার করে। প্রায় আট ইঞ্চি লম্বা মরচে ধরা ফলা দুটিকে কোনোমতে পরস্পরের কাছে আসতে বাধ্য করা গেল না। সে চেষ্টায়– ব্যর্থ হবার পর রক্ত-জমাট ঘন চুলের গোছাগুলি না কেটে ফেলে রাখলাম।
প্রধান ক্ষত হল নখের ঘায়ে কাটা দুটি জখম। একটি দুচোখের মধ্যে থেকে শুরু হয়ে সোজা মাথার ওপর দিয়ে ঘাড়ের গোড়া অব্দি চলে গিয়েছে। সেটি খুলির চামড়া সমান দু-ভাগে চিরে দুপাশে ঝুলিয়ে দিয়েছে। অপরটি প্রথমটির কাছে শুরু হয়ে কপাল বরাবর ডান কান অব্দি চলে গেছে। এই বীভৎস হাঁ-করা ক্ষতগুলির ওপর ডান বুক, ডান কাঁধ ও ঘাড়ে কয়েকটি গভীর নখের আঘাত, আর ডান হাতের পিঠে একটি গভীর কাটা, মাথা বাঁচাবার ব্যর্থ চেষ্টায় মেয়েটি যখন হাত তোলে এ জখমটি তখন করা হয়, এ একেবারে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে।
এক ডাক্তার বন্ধুকে একবার আমি পায়ে হেঁটে বাঘ শিকারে নিয়ে যাই। এক উত্তেজনামধুর সকালের পর ফিরে এসে তিনি আমাকে এক হলদে তরল পদার্থের দু আউন্সের একটি শিশি দিয়ে যখনি আমি শিকারে বেরোই তখনি সেটি সঙ্গে রাখতে উপদেশ দেন। এক বছরেরও বেশি শিশিটি আমি আমার শিকার জ্যাকেটের ভেতরের পকেটে বয়ে বেড়িয়েছি এবং তরল পদার্থটির খানিকটা উপে গেছে। তবু শিশিটির তিন ভাগ ছিল ভর্তি এবং মেয়েটির মাথা ও শরীর ধুয়ে সাফ করার পর আমি শিশিটির মাথা ভাঙলাম ও শিশির জিনিসটির শেষ ফোঁটাটি অব্দি ঢেলে দিলাম ক্ষতগুলিতে। এটি সারা হলে, খুলির ঝুলন্ত চামড়া জুড়ে রাখা দরকার বলে মাথা ব্যান্ডেজ করলাম, মেয়েটিকে তুলে নিলাম আর বয়ে নিয়ে গেলাম তার বাড়িতে–সে একটি ঘরেই বাসবসতি, রান্নাঘর ও নার্সারী। মেয়েরা এল পেছন পেছন।
দরজার কাছে আড়া থেকে ঝুলছে একটি খোলা ঝুড়ি, তার মালিক এখন খাওয়ার জন্যে হইহল্লা জুড়ল। এ এমন এক জটিল ব্যাপার, যে এর ব্যবস্থা আমি করতে পারি না অতএব এর সমাধানের ভার ছেড়ে দিলাম জড়ো হওয়া মেয়েদের ওপর। দশ দিন বাদে আমার চলে যাবার আগে যখন মেয়েটির সঙ্গে শেষবারের মত দেখা করতে যাই, দেখলাম ও বসে আছে ওর বাড়ির দোড়গোড়ায়, কোলে ঘুমন্ত শিশু।
যেখানে বাঘের নখ মাংসে সব চেয়ে গভীর গেঁথে বসে যায়, সেই ঘাড়ের গোড়ায় একটি ঘা ছাড়া ওর সব ক্ষতই শুকিয়ে গেছে। যেখানে খুলির চামড়া নিখুঁত জুড়ে গেছে তা দেখাবার জন্যে ওর কোকিলকালো চুলের অজস্র সম্পদ ফাঁক করে ও সহাস্যে বলল, ওর বোন ভুল করে দর্জির বিধবার কাছ থেকে ভুল কঁচিটা ধার করে এনেছিল বলে ও খুব খুশি (কেন না এখানে ন্যাড়া মাথা হল বৈধ্যব্যর চিহ্ন)। আমার বন্ধু সেই ডাক্তার এই লাইনগুলি যদি কোনদিন পড়েন, আমি চাইব উনি জানুন, যে অমন ভেবেচিন্তে উনি আমার জন্যে যে হলদে তরল পদার্থের ছোট্ট শিশিটি যোগাড় করে দিয়েছিলেন, সেটি একটি অতীব সাহসী তরুণী মায়ের জীবন বাঁচিয়েছে।
আমি যখন মেয়েটিকে দেখছিলাম, আমার লোকজন একটি ছাগল যোগাড় করে। মেয়েটির রেখে আসা রক্তের নিশানার পেছনে পেছনে গিয়ে যেখানে আক্রমণটি হয়, সে জায়গাটি খুঁজে পেলাম আমি। ছাগলটিকে এক ঝোপে বেঁধে দিয়ে আমি কাছাকাছির মধ্যে একমাত্র গাছ–একটি বেঁটে ওকগাছে চড়লাম ও রাত ভোর পাহারায় জাগব বলে তৈরি হলাম। মাঝেমধ্যে ঘুমিয়ে নেওয়াও সম্ভব ছিল না, কেন না আমার বসার জায়গা জমি থেকে মাত্রই সামান্য ক ফুট উঁচুতে এবং বাঘিনীটি তখনো ডিনার খায় নি। যাই হক, সারা রাতেও আমি আর কিছু দেখি নি, শুনি নি।
আগের সন্ধ্যায় এ কাজ করতে সময় পাই নি, সকালে মাটি পরীক্ষা করে দেখলাম যে মেয়েটিকে আক্রমণ করার পর বাঘিনীটি উপত্যকা ধরে আধ মাইল গেছে, সেখানে একটি গো-পথ নাউর নদী অতিক্রম করেছে। ডালকানিয়ার ওপরের শৈলশিরাটির উপরের জঙ্গুলে পথের সঙ্গে এই গো-পথটি যেখানে মিশেছে, সেই অব্দি গো-পথে দু মাইল গেছে বাঘিনী। এখানে আসার পর জমি শক্ত হয়ে গেল, আমি নিশানা হারিয়ে ফেললাম।
শৌচ ব্যবস্থার অভাব মেনে নিয়ে ঘরের যত কাছাকাছি থাকা যায়, দুদিন ধরে চারদিকের সকল গ্রামের লোকরা তা থাকল। তারপর তৃতীয় দিন চারজন রানার আমার কাছে খবর আনল, ডালকানিয়ার পাঁচমাইল দক্ষিণে লোহালি নামে এক গ্রামে মানুষখাকী একটি শিকার নিয়েছে। রানাররা জানাল জঙ্গল পথে দূরত্ব হল দশ মাইল, কিন্তু শর্টকাটে পাঁচ মাইল। তাই দিয়ে ওরা আমাকে নিয়ে ফিরতে চাইল। আমার প্রস্তুতি সমাধা হল চটপট এবং দুপুরের সামান্য পরে আমি আমার চার গাইড সহ রওনা হলাম।
দু মাইল ব্যাপী এক অতি দুরারোহ চড়াইপথ আমাদের পৌঁছে দিল ডালকানিয়ার দক্ষিণে দীর্ঘ শৈলশিরাটির চুড়ায়। যেখানে ‘মড়ি পড়েছে বলে খবর এসেছে, তিনমাইল নিচের সেই উপত্যকা এখান থেকে দেখা যাচ্ছিল। আমার গাইডরা কোনো বিশদ খবর দিতে পারল না। ওরা থাকে একটি গ্রামে, সেটি লোহালি থেকে এক মাইল দূরে এবং যেমনটি আগে বলা হয়েছে সেই একই পন্থায় তাদের কাছে সকাল দশটায় খবর আসে যে মোহালিতে একটি মেয়ে মানুষখেকোর হাতে মারা পড়েছে আর ডালকানিয়ায় আমাকে এ খবর পৌঁছতে তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়।
পাহাড়ের যে চূড়ায় আমরা দাঁড়িয়েছিলাম তা গাছপালাশুন্য এবং যতক্ষণে আমি দম ফিরে পেলাম ও একটি সিগারেট খেলাম, আমার সঙ্গীরা আমাকে জমি-নিশানীগুলি দেখাতে থাকল। আমরা যেখানে জিরোচ্ছিলাম তারই কাছে, একটি বড় পাথরের নিচের আড়ালে একটি ছোট পোড়ো কুটির, তার কাছে গোল কাঁটাঝোপের বেড়া। এই কুটিরটির বিষয়ে জিজ্ঞেস করতে, লোকগুলি আমাকে এই গল্পটি বলল।
চার বছর আগে একজন ভুটিয়া (সীমান্তের ওপারের একটি লোক) বিশ্রাম করার জন্য এবং গ্রীষ্ম ও বর্ষায় তার ছাগলগুলোকে হৃষ্টপুষ্ট করে পরবর্তী শীতের কাজের জন্য তাদের তন্দুরস্ত করে তুলতে এই কুটিরটি তৈরি করে। লোকটি সারা শীতকাল পাহাড়ের পাদদেশের বাজারগুলি থেকে গুড়, লবণ এবং অন্যান্য জিনিসপত্র কিনে জঙ্গল এলাকায় বিক্রি করত। কয়েক সপ্তাহ বাদে ছাগলগুলি পাহাড়ের উত্রাই বেয়ে নেমে যায় এবং আমাকে যারা গল্পটি বলছে, তাদের শস্যের ক্ষতি করে। ওরা যখন প্রতিবাদ জানাতে উঠে আসে তখন দেখে কুটিরটি খালি, তার ভেড়া ছাগলের পাহারাদার যে হিংস্র কুকুর ওদের তাঁবুতে রাতে পাহারা দেবার জন্যে ভুটিয়ারা সর্বদা সঙ্গে রাখে সে কুকুরটি লোহার খুঁটিতে শেকলে বাঁধা, মৃত।
অসৎ উদ্দেশ্যে কিছু করা হয়েছে বলে সন্দেহ করা হয়। পরদিন কাছাকাছি গ্রামগুলি থেকে পুরুষদের জড়ো করা হয় ও এক তল্লাসী দল গঠিত হয়। আন্দাজ চারশো গজ দূরে একটি বাজেপোড়া ওক গাছের দিকে আঙুল দেখিয়ে আমার সংবাদদাতারা বলল যে ওটির নিচে মানুষটির দেহাবশেষ–তার খুলি, কয়েক কুচি হাড় ও পোশাক পাওয়া যায়। এটিই হল চৌগড়ের মানুষখাকীর প্রথম মানুষ শিকার।
যেখানে আমরা বসেছিলাম সেখান থেকে ওই খাড়াই পাহাড় বেয়ে নামার কোনো পথ নেই এবং লোকগুলি আমাকে জানাল, শৈলশিরা ধরে আমাদের আধ মাইল এগোতে হবে। সেখানে আমাদের একটি বেজায় খাড়াই ও এবড়োখেবড়ো পায়ে চলা পথ মেলা উচিত। সেটি ওদের গ্রাম পেরিয়ে আমাদের সিধে নিয়ে যাবে লোহালিতে। জায়গাটি থেকে আমরা নিচের উপত্যকা দেখতে পাচ্ছিলাম।
শৈলশিরা ধরে যাবার পথের অর্ধেক আন্দাজ গিয়েছি তখন সহসা মনে হল আমাদের পেছনে পেছনে অনুসরণ করা হচ্ছে। এ রকম মনে করার জন্য কোনো যুক্তি দর্শাতে আমি অক্ষম। এ রকম মনে করার বিরুদ্ধে নিজের সঙ্গে তর্ক করে লাভ হল না। এই সমগ্র এলাকায় শুধু একটি মানুষখাকীই আছে এবং তিন মাইল দূরে সে এক শিকার সংগ্রহ করেছে, তা ছেড়ে সে এখানে আসবে সে সম্ভাবনা নেই। যাই হক এই অস্বস্তির অনুভূতি লেগেই রইল এবং যেহেতু আমরা এখন ঘাস ঢাকা শৈলশিরার সব চেয়ে চওড়া অংশটিতে পৌঁছেছি, লোকগুলিকে বসতে বাধ্য করলাম, আমি না ফেরা অব্দি ওদের নড়াচড়া না করতে নির্দেশ দিলাম আর নিজে বেরুলাম তল্লাসী করে দেখব বলে।
শৈলশিরাটি যেখানে প্রথম ধরি, সেখান অব্দি আবার ফিরে গিয়ে জঙ্গলে ঢুকলাম, সযত্নে ফাঁকা জমিটি দেখে ঘুরে এলাম এবং ফিরে গেলাম যেখানে লোকগুলি বসেছিল। কোনো পশু বা পাখির বিপজ্জনক ডাক ইঙ্গিত জানায় নি কাছাকাছি কোথাও কোনো বাঘ আছে বলে, তবু সেখান থেকে আমি লোক চারজনকে আমার আগে আগে হাঁটালাম। সেফটিক্যাচে বুড়ো আঙুল রেখে সমানে পেছনে চাইতে চাইতে আমি এলাম পেছনে।
যে ছোট গ্রামটি থেকে আমার সঙ্গীরা রওনা হয়েছিল সেখানে পৌঁছলাম যখন, ওরা আমার কাছে বিদায় নিতে চাইল। এ অনুরোধে আমি খুবই খুশি হলাম। কেননা তখনো এক মাইল ব্যাপী নিবিড় জঙ্গল দিয়ে যেতে হবে আমাকে। আমার পেছনে পেছনে অনুসরণ করে কিছু আসছে, এ ভাবটা মন থেকে অনেকক্ষণ হল কেটে গেছে। তবু শুধু নিজের জীবন বাঁচিয়ে চলতে আমার অনেক বেশি নিরাপদ, স্বস্তিকর লাগবে। বাইরের ধাপকাটা খেতগুলির সামান্য নিচে, যেখানে নিবিড় জঙ্গল শুরু হয়েছে, যেখানে একটি স্ফটিক স্বচ্ছ জলের ঝরনা, তা থেকে গ্রামটি জলের যোগান নেয়। এখানে নরম ভিজে মাটিতে আমি বাঘিনীটির থাবার টাটকা ছাপ দেখলাম।
যে গ্রামের উদ্দেশে আমি যাচ্ছি, তার দিক থেকে উজিয়ে আসা এই থাবার ছাপ, তার সঙ্গে ওপরের শৈলশিরায় আমার যে অস্বস্তির অনুভবের অভিজ্ঞতা হয়েছে, দূয়ে মিলে আমার বিশ্বাস দৃঢ় হল, যে মড়ির ব্যাপারটা কোনো না কোনো ভাবে বিগড়ে গেছে এবং আমার অভিযান ব্যর্থ হবে। জঙ্গল থেকে যেমন বেরিয়ে এলাম, পাঁচটি কি ছয়টি ছোট ছোট বাড়ি সংবলিত লোহালি চোখের পটে ধরা দিল। এই বাড়িগুলির একটির দরজায় একদল লোক জড়ো হয়েছে।
খাড়াই ফাঁকা জমি ও সংকীর্ণ ধাপকাটা খেতের পথে আমার এগনো ওদের দলের চোখে পড়ল। দরজার কাছের দলটি থেকে সরে এসে কয়েকটি লোক আমার সাক্ষাতের জন্যে এগোল। তাদের মধ্যে একজন, একটি বৃদ্ধ, আমার পা ছুঁয়ে নিচু হল। দুগাল চোখের জলে ভাসিয়ে, ওর মেয়ের জীবন বাঁচাতে অনুনয় জানাল আমাকে। ওর কাহিনী যেমন সংক্ষিপ্ত, তেমনই মর্মান্তিক। এ পৃথিবীতে ওর এক মাত্র আপন জন ওর বিধবা মেয়েটি, যে কাঠ জ্বেলে ওদের দুপুরের রান্না করবে তা সংগ্রহ করতে গিয়েছিল আন্দাজ সকাল দশটায়।
পাহাড়তলির মধ্য দিয়ে বইছে এক ছোট নদী এবং নদীটির ওপার থেকে পাহাড় উঠে গেছে খাড়া হয়ে। বাড়ি থেকে প্রায় ১৫০ গজ দূরে, সবচেয়ে নাবাল খেতটির কিনারে মেয়েটি লকড়ি কুড়োতে শুরু করে। কয়েকটি রমণী কাপড় কাঁচছিল নদীতে, তারা একটু বাদে এক আর্তচীৎকার শোনে ও মুখ তুলে চেয়ে দেখে একটা বাঘ মেয়েটিকে নিয়ে কাঁটা ঝোপের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল। কাঁটাঝোপগুলি খেতের কিনার থেকে একেবারে নদীর ধার অবধি ছড়ানো।
গ্রামে ছুটে ফিরে এসে রমণীরা হইহল্লা তোলে। আতঙ্কিত গ্রামবাসীরা মেয়েটিকে উদ্ধার করার কোনো চেষ্টাই করে না। সাহায্য চেয়ে উপত্যকার আরো ওপরে একটি গ্রামে খবর পাঠানো হয় চেঁচিয়ে। যেখান থেকে খবরটি একই উপায়ে জানানো হয় আরেকটি গ্রামে, সেখান থেকেই চারটি লোক আমার খোঁজে রওনা হয়। খবর পাঠাবার আধ ঘণ্টা বাদে জখম রমণীটি হামা টেনে ফিরে আসে বাড়ি। ওর কাহিনী হল, বাঘটি ঠিক যখন ওর ওপর ঝাঁপ মারবে তখনি ও দেখতে পায় এবং সেও লাফ দেয় খাড়া পাহাড়ের নিচে, আর যখন ও শূন্যে, বাঘ তখনি ওকে ধরে এবং দুজনেই একসঙ্গে পাহাড় বেয়ে গড়িয়ে পড়ে যায় নিচে। চেতনা ফিরে পেয়ে নিজেকে নদীর ধারে না দেখা অব্দি আর কিছুই মনে নেই ওর এবং সাহায্যের জন্যে চেঁচাতে পারছিল না বলে হাতে হাঁটুতে হেঁচড়ে ও গ্রামে ফিরে আসে।
এ গল্প বলা হতে হতে আমরা বাড়িটির দরজায় পৌঁছে গেলাম। ঘরে চার দেওয়ালের একমাত্র মুক্তিপথ দরজাটি থেকে লোকজনকে পিছু হটিয়ে দিয়ে মেয়েটির পা থেকে আমি রক্ত মাখা চাদরটা টেনে সরিয়ে দিলাম। ওর শোচনীয় অবস্থা আমি বর্ণনা করতে চেষ্টাও করব না। পকেটে যার শুধু একটু পার্মাঙ্গানেট অফ পটাশ আছে এমন এক সামান্য মানুষ না হয়ে আমি যদি আধুনিক সাজসরঞ্জামে সজ্জিত এক পাশকরা ডাক্তারও হতাম, আমার মনে হয় না মেয়েটির প্রাণ বাঁচানো সম্ভব হত। কেননা সেই গরম, বাতাসহীন বদ্ধ ঘরে মেয়েটির মুখ ঘাড় ও শরীরের অন্যত্রের গভীর দাঁত ও নখের জখমগুলো তখনি বিষিয়ে উঠেছে। সৌভাগ্যক্রমে মেয়েটি তখন আধা অজ্ঞান। বৃদ্ধ পিতা আমার পেছনে পেছনে ঘরে ঢুকেছিল। মেয়েটির মাথা ও শরীর থেকে জমাটবাঁধা রক্ত ধুয়ে দিলাম আমি, এবং আমার রুমাল ও পার্মাঙ্গানেটের কড়া দ্রবণ দিয়ে যত ভাল করে পারলাম, জখমগুলি পরিষ্কার করলাম। এতে যতটা উপকার হবে তার জন্যে যত না হ’ক, ওই বৃদ্ধকে সান্ত্বনা দেবার জন্যে আরো বেশি করে কাজটি করলাম।
আমার ক্যাম্পে ফিরে যাবার কথা ভাবার পক্ষে এখন বড় বেশি দেরি হয়ে গেছে ও যেখানে রাত কাটাতে হবে তেমন একটা জায়গা খুঁজে পাওয়া দরকার। নদী থেকে একটু এগিয়ে মেয়েরা যেখানে কাপড় কাঁচছিল তার অনতিদূরে একটি অতিকায় পিপল গাছ, তা ঘিরে একটি একফুট উঁচু বাঁধানো চাতাল। গ্রামবাসীরা সেখানে ধর্মের অনুষ্ঠান করে।
চাতালে পোশাক ছাড়লাম আমি, নদীতে স্নান করলাম, বাতাস যখন তোয়ালের কাজ সমাধা করল, আবার পোশাক পরলাম, গাছের গায়ে পিঠ ঠেস দিয়ে বসলাম এবং গুলিভরা রাইফেল পাশে রেখে রাত কাবারের জন্যে প্রস্তুত হলাম। রাত কাটাবার পক্ষে জায়গাটি অনুপযুক্ত একথা মেনে নিচ্ছি, কিন্তু এই গ্রাম, ওই উত্তপ্ত ও পচধরা পরিবেশ এবং ভনভনে মাছির ঝকে বোঝাই ওই ঘর যেখানে একটি মেয়ে যন্ত্রণায় দীর্ণ হয়ে নিশ্বাসের জন্য মরিয়া সংগ্রাম করছে। তার চেয়ে যে কোনো জায়গাই ভাল।
রাতে মেয়েদের শোকবিলাপ ঘোষণা করল যে জখমী মেয়েটির সকল যন্ত্রণার অবসান ঘটেছে এবং সকালের শুরুতে আমি যখন গ্রাম দিয়ে যাচ্ছি তখন সকারের তোড়জোড় বহুদূর এগিয়েছে।
ডালকানিয়ার সেই মেয়েটি এবং এই হতভাগিনী মেয়েটির অভিজ্ঞতা থেকে এখন বোঝা গেল যে মানুষদের আক্রমণ করত, তাদের মারার জন্য বৃদ্ধ বাঘিনীটি ওর শাবকের ওপর বহুদূর অব্দি নির্ভর করেছিল। সাধারণত নরখাদক বাঘ কর্তৃক আক্রান্ত প্রতি একশো জনের মধ্যে মাত্র একজন পালাতে পারে, কিন্তু পরিস্কার বোঝা গেল এই মানুষখাকীটির ক্ষেত্রে সরাসরি নিহত হবার চেয়ে বেশি মানুষ জখম হবে। যেহেতু নিকটতম হাসপাতাল পঞ্চাশ মাইল দূরে–যে এলাকায় মানুষখাকীটি ক্রিয়াকলাপ চালাচ্ছে তার গ্রামগুলির সকল গ্রামমোড়লদের কাছে সংক্রমণ-নাশক ওষুধ ও ব্যান্ডেজের এক যোগান পাঠাতে সরকারের কাছে আবেদন জানালাম যখন আমি নৈনিতাল ফিরি। পরবর্তী যাত্রায় জেনে খুশি হলাম যে অনুরোধ রক্ষা করা হয়েছে এবং বিসংক্রমক ওষুধগুলি বেশ কিছু মানুষের প্রাণ বঁচিয়েছে।
ডালকানিয়ায় আরেক সপ্তাহ থাকলাম এবং এক শনিবার ঘোষণা করলাম সামনের সোমবার বাড়ির উদ্দেশে যাত্রা করব। প্রায় একমাস মানুষখাকীর সাম্রাজ্যে থাকা হল আমার। খোলা তাঁবুতে শোবার ও প্রতিটি পা ফেলা। শেষ পা ফেলা হতে পারে সে সম্ভাবনা রোজ তানেক, অগণিত মাইল হাঁটার লাগাবাঁধা ধকল আমার নার্ভের সংমতায় চিড় ধরতে শুরু করেছিল। গ্রামবাসীরা অত্যন্ত ভয়ের সঙ্গে এ ঘোষণা গ্রহণ করল। আমার সিদ্ধান্ত বদল করায় আমাকে বাধ্য করা থেকে ওরা তখনি নিরস্ত হল যখন আমি কথা দিলাম প্রথম সুযোগেই ফিরে আসব।
রবিবার সকালে প্রাতরাশের পর ভালকানিয়ার গ্রামমোড়ল দেখা করতে এল এবং আমি যাবার আগে খাবার জন্যে কিছু জানোয়ার শিকার করে দিয়ে যেতে বলল। অনুরোধটি সানলে স্বীকার করা হল এবং চারজন গ্রামবাসী ও আমার একজন লোক সঙ্গে নিয়ে একটি ২৭৫ রাইফেল ও একপাতা কার্তুজ নিয়ে আধ ঘণ্টা বাদে আমি নাউর নদীর অনেক দূরে পাশের পাহাড়ের উদ্দেশে রওনা হলাম। আমার ক্যাম্প থেকে আমি তার উপর দিকের তালে বহুবার ঘুরালকে ঘাস খেতে দেখেছি।
আমার সঙ্গীদের মধ্যে একটি গ্রামবাসী একটি লম্বা, শীর্ণ লোক, মুখ তার বীভৎসভাবে বিকৃত। আমার ক্যাম্পে সে ছিল বাঁধাধরা অতিথি এবং আমাকে ভাল শ্রোতা পেয়ে, মানুষখাকীর সঙ্গে ওর মোকাবিলার কথা বলেছিল, এতবার বলেছিল যে আমি ঘুমের মধ্যেও বিনা চেষ্টায় গোটা গল্পটি বলতে পারি। চার বছর আগে সে সংঘর্ষ ঘটে এবং ওর মুখ থেকে সে গল্প শোনাই সব চেয়ে ভাল।
“পাহাড়ের গায়ে ঘাসের ঢালের তলে ওই পাইন গাছটা দেখছ সাহেব? হ্যাঁ, পুব দিকে একটা বড় সাদা পাথরওলা ওই পাইন গাছ। ওই ঘাসের ঢালের ওপর কিনারে মানুষখাকীটা আমার ওপর চড়াও হয়। ঘাসের ঢালটা হল বাড়ির দেওয়ালের মত সোজা, পাহাড়ী মানুষ ছাড়া ওতে কেউ পা রাখতেই পারে না। আমার আট বছর বয়সের ছেলেকে নিয়ে আমি একদিন ওখানে ঘাস কাটছিলাম। কাটা হয়ে গেলে সমতল জায়গাটায় ঘাসগুলি হাতে-হাতে বয়ে আনছিলাম।
“ঢালের একেবারে কিনারে ঝুঁকে ছিলাম আমি, ঘাসগুলো বাঁধছিলাম বড় একটা বান্ডিলে, তখন বাঘটা আমার ওপর ঝাঁপ দিল আর দাঁত বসাল। একটা আমার ডান চোখের নিচে, একটা আমার চিবুকে আর দুটো এখানে, আমার ঘাড়ের পেছনে। বাখের মুখটা আমাকে প্রচণ্ড আঘাত হানে আর আমি পড়ে যাই চিত হয়ে। বাঘটা চেপে থাকে আমাকে আমার বুকে ওর বুক, ওর পেট আমার পা দুটোর মাঝখানে। চিতিয়ে পড়ার সময়ে হাত দুটা ছটকে ছড়িয়ে দিয়েছিলাম আর আমার ডান হাত ছুঁল গিয়ে একটা ওকের চারা। আমার আঙুলগুলো চারাটা আঁকড়ে ধরতে মাথায় একটা মতলব এল। আমার পা দুটো খোলা আছে, যদি সে দুটো গুটোতে পারি, পায়ের চেটো দুটো বাঘের পেটের নিচে উল্টো চাপে ঢোকাতে পারি, বাঘটাকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিতেও পারি আর পালাতে পারি। মুখের ডান পাশের সবগুলো হাড় বাঘটা র্ণ করে ফেলছিল তাতে যন্ত্রণা অসহ্য হয়। কিন্তু জ্ঞান আমি হারাই নি। কেন জান সাহেব? তখন আমার জোয়ান বয়েস আর গোটা পাহাড়ে গায়ের বলে আমার তুল্য কেউ ছিল না। বাঘটাকে না-রাগাবার জন্যে অতি সন্তর্পণে আমি ওর দুপাশে পা গোটালাম আর খুব আস্তে ওর পেটের নিচে ঢোকালাম পায়ের চেটো। তারপর আমার বাঁ হাত ওর বুকে ঠেকিয়ে সর্বশক্তিতে ওপর পানে ধাক্কা দিয়ে আর লাথি মেরে বাঘটাকে আমি মাটি থেকে শূন্যে তুলে ফেললাম। আর আমরা ওই সিধা পাহাড়ের গায়ের একেবারে কিনারায় ছিলাম বলে বাঘটা হুড়মুড়িয়ে নিচে পড়ে গেল। চারাগাছে আমার মুঠ শক্ত হাতে ধরা না থাকলে হয়তো ও আমাকে ওর সঙ্গেই নিয়ে নিচে পড়ত।
“পালিয়ে যাবার পক্ষে আমার ছেলে খুবই ভয় পেয়েছিল, আর বাঘ যখন পড়ে গেল, ওর লেংটিটা ওর কাছ থেকে নিলাম, মাথায় জড়ালাম আর ওর হাত ধরে ফিরে এলাম গ্রামে। নিজের ঘরে পৌঁছে বউকে বললাম আমার সব বন্ধুদের একসঙ্গে ডাকতে, কেননা মরে যাবার আগে ওদের মুখ দেখতে চাই। আমার বন্ধুরা যখন জড়ো হল, আমার অবস্থা দেখল, আমাকে এক চারপাইয়ে তুলে ওরা পঞ্চাশ মাইল পথ বয়ে আলমোড়া হাসপাতালে নিয়ে যেতে চাইল কিন্তু তাতে আমি রাজী হই নি। কেননা যন্ত্রণা হচ্ছিল প্রবল, আর আমার শেষ সময় এসে গেছে নিশ্চিত জেনে যেখানে জন্মেছি, বাস করেছি সারা জীবন, সেখানেই মরতে চেয়েছিলাম আমি। জল আনা হল, কেননা আমার তেষ্টা পেয়েছিল, মাথায় যেন আগুন জ্বলছিল, কিন্তু যখন মুখে জল ঢালা হল, আমার গলার ফুটো দিয়ে জল গলে বেরিয়ে গেল। তারপর এক দীর্ঘ সময়কাল ধরে, হিসাব নেই তার, আমার মনে সব তালগোল পাকিয়ে গিয়েছিল, মাথার আর ঘাড়ে ছিল অসহ্য যন্ত্রণা, যখন এ যন্ত্রণার শেষ করে দিতে মরণকে ডাকছি, তার জন্যে অপেক্ষা করছি, আপনা থেকেই জখম সেরে গেল, আমিও ভাল হয়ে গেলাম।
“আর এখন সাহেব, আমাকে যেমন দেখছ, আমি বুড়ো, রোগা, চুল আমার সাদা, আর মুখ এমন, যে আঁতকে না উঠে কোনো মানুষ তা চেয়ে দেখতে পারে না। আমার শত্রু বেঁচেই আছে আর শিকার ধরে চলেছে। তবে ভুলেও ভেব না ওটা কোনো বাঘ, কেননা ও কোনো বাঘ নয়, ও দুষ্ট আত্মা, যখন মানুষের রক্ত মাংসের আকাঙ্ক্ষা হয় তখন ও কিছুক্ষণের জন্যে বাঘের চেহারা নেয়। তবে ওরা বলে সাহেব, তুমি সাধু, আর যেসব শক্তি সাধুদের রক্ষা করে তারা এই দুষ্ট আত্মার চেয়ে শক্তিশালী। তুমি জঙ্গলে একা তিনদিন তিনরাত কাটিয়েছিলে, তুমি যা করবে বলেছিলে, সেইমতই প্রাণে বেঁচে অক্ষত বেরিয়ে এলে তুমি, এই ঘটনাতেই আমার কথা প্রমাণ হচ্ছে।”
লোকটির বিশাল আড়ার দিকে চেয়ে, যথার্থই এক দৈত্য ছিল বলে সহজে কল্পনা করা গেল ওকে। শক্তিসামর্থ্যে নিশ্চয় ও দানবই ছিল, কেননা সাধারণের চেয়ে অনেক বেশি জোর না থাকলে কোনো মানুষই বাঘিনীটিকে শূন্যে ফেলতে, মাথার পাশ থেকে ওর থাবার দখল ছিঁড়ে ফেলতে, বাঘিনীকে খাড়া পাহাড়ের নিচে ছুঁড়ে ফেলতে পারে না–সে সময়ে বাঘিনী ওর মুখের অর্ধেকটা নিয়ে চলেও যায়।
আমার শীর্ণকায় বন্ধুটি নিজেকে আমাদের গাইড খাড়া করল এবং লম্বা, সরু হয়ে যাওয়া বাঁটযুক্ত একটি চমৎকার পালিশ করা কুড়োল কাঁধে ফেলে গোলমেলে সব খাড়াই পথে আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে গেল নিচের উপত্যকায়। নাউর নদী পেরিয়ে আমরা বহু চওড়া ধাপকাটা খেত পেরোলাম, সেগুলি এখন মানুষখেকোর ভয়ে বরবাদ-আবাদী হয়ে গেছে। পাহাড়ের তলদেশে পৌঁছে যা ভাঙতে শুরু করলাম, দেখা গেল–তা এক দুরূহ চড়াই, জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে গেলাম ওপরের ঘেসো ঢালে আমার বন্ধুটি রোগা হতে পারে কিন্তু দমে কমতি যায় না ও, আর আমি শক্তপোক্ত হলে কি হয়, ওর সঙ্গে তাল রেখে চলতে পারলাম শুধু দৃশ্যাবলীর তারিফ করতে ওকে ঘনঘন থামতে বলে।
গাছের জঙ্গল থেকে বেরিয়ে ঘাসের ঢালটি কোণাকুণি পেরিয়ে আমরা গেলাম একটি পাথর-চূড়োর দিকে, সেটি ওপর পানে হাজার ফুট বা তার কাছাকাছি উঁচিয়ে উঠেছে। আমার তাবু থেকে এই চূড়াতেই আমি ঘুরালকে ঘাস খেতে দেখেছি, এটিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে গজিয়েছে ছোট ছোট ঘাসের গোছা। আমরা কয়েকশো গজ এগিয়েছি, তখন ওই ছোট্ট পাহাড়ী ছাগলগুলোর একটি এক গিরিখাত থেকে লাফিয়ে উঠল, আমার গুলিতে ধসে পড়ে পিছলে চলে গেল চোখের আড়ালে। রাইফেলের শব্দে এস্তচকিত হয়ে আরেকটি ঘুরাল পায়ের ওপর লাফিয়ে উঠে পাথরটির গা বেয়ে উঠল, তেমন করে ঘুরাল অথবা ছাগ গোষ্ঠীতে ঘুরালের বড় ভাই থার শুধু উঠতে পারত। ঘুরালটি নিশ্চয় চূড়াটির পায়ের কাছে ঘুমিয়ে ছিল।
ও যেমন ওপরপানে চড়ছে, আমি শুয়ে পড়লাম এবং পাল্লা-নিশানী দুশো গজে রেখে ও থামার জন্যে অপেক্ষা করতে থাকলাম। আর তখনি ও বেরিয়ে এল একটি বেরিয়ে আসা পাথরের ওপর, নিচে আমাদের পানে চাইল। আমার গুলিতে টলে পড়ে গেল ও, ফিরে পেল পায়ের ধরতাই এবং অতি আস্তে চড়াই ভাঙতে থাকল। দ্বিতীয় গুলিতে পড়ল ও, এক বা দুই সেকেন্ড ঝুলে রইল এক সরু কার্নিসে, আর তারপর শূন্যে দিয়ে পড়ল, যেখান থেকে রওনা হয়েছিল সেই ঘাসের ঢালে। মাটিতে পড়ে ও গড়িয়ে গড়িয়ে আমাদের একশো গজের ভেতর দিয়ে পেরিয়ে গেল, অবশেষে দেড়শো গজ নিচে এক গো-পথে গিয়ে নিশ্চল হল।
পরের কয় মিনিটে যে দৃশ্য দেখলাম আমরা যতকাল ধরে শিকার করছি, তার জোড়া দৃশ্য দেখেছি মাত্র একবার, এবং সেবার লুঠ করেছিল একটি চিতা।
ঘুরালটি সবে পড়েছে, তখন ঘাসের ঢালের দিকের এক গিরিখাত থেকে থপথপিয়ে বেরিয়ে এল এক বিশাল হিমালয়ান ভাল্লুক। একবারও না থেমে বা পেছনপানে না চেয়ে দেখে গো-পথ ধরে দ্রুত হালকি চালে চলে এল। মরা ছাগলটির কাছে পৌঁছে ও বসে পড়ল, ওটাকে কোলে নিল, আর ও যেমন ছাগলটি শুঁকতে আরম্ভ করেছে, আমি গুলি ছুঁড়লাম। হয়তো গুলি ছুঁড়তে তাড়াহুড়ো করেছিলাম, অথবা বেঁকে যাবে বলে বেশি বেঁকিয়ে নিশানা করেছিলাম, যাই হক, বুলেটটি নিচে চলে গেল আর বুকের বদলে বিধল ভাল্লুকটির পেটে। আমরা ছ জন, যারা মন দিয়ে দেখছিলাম, আমাদের মনে হল যে বুলেটের আঘাতটিকে ভাল্লুকটি ঘুরালের আক্রমণ মনে করল। কেননা পিছিয়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে ও মরা জানোয়ারটা ছুঁড়ে ফেলে দিল এবং ক্রুদ্ধ হুঙ্কার ছাড়তে ছাড়তে লাফাতে লাফাতে চলে এল পথ ধরে। আমাদের একশো গজ নিচ দিয়ে ও যখন যাচ্ছে, আমার পঞ্চম ও শেষ গুলিটি ছুঁড়লাম। বুলেটটি ওর পেছনের মাংসল অংশ ফুটো করে বেরিয়ে গেল তা পরে দেখেছিলাম।
লোকজন যখন দুটি ঘুরালকে উদ্ধার করেছিল, রক্তের নিশানা পরীক্ষা করতে আমি নামলাম নীচে। গো-পথের ওপরকার রক্ত বুঝিয়ে দিল ভাল্লুকটি জবর জখম হয়েছে তবু ফাঁকা রাইফেল নিয়ে ওর অনুসরণে বিপদ ছিল কেননা সুসময়েও ভাল্লুকরা বদমেজাজী এবং জখম হলে পরে মুকাবিলা করতে গেলে এরা অতীব বিপজ্জনক।
লোকজন আমার সঙ্গে আবার এসে মিললে পরে এক সংক্ষিপ্ত যুদ্ধালোচনা সভা বসল। ক্যাম্প সাড়ে তিন মাইল দূরে এবং এখন যেহেতু বেলা দুটো–আরো গুলিবারুদ এনে শেষ অবধি অনুসরণ করে ভালুকটিকে মারা ও অন্ধকার হতে না হতে ঘরে ফেরা সম্ভব হবে না। অতএব সর্বসম্মতিক্ত, স্থির করা হল যে আমরা যখন জানোয়ারটিকে অনুসরণ করব এবং পাথর ও কুড়োলটির সহায়তায় ওটিকে খতম করতে চেষ্টা করব।
পাহাড়টি খাড়াই, ঝোপ-জঙ্গল তেমন নেই এবং ভাল্লুকটি যদি ওপরেই থেকে যায়, তবে গুরুতর কোনো ক্ষতি না ঘটিয়ে আমাদের কাজটি হাসিল করতে পারি। সে সম্ভাবনা ভাল মতই আছে। তাই ভেবে নিয়ে রওনা হলাম আমরা। আমি পথ দেখিয়ে চললাম সামনে, আমার অনুসরণে চলল তিন জন, সবচেয়ে পেছনে দুজন লোক, প্রত্যেকের পিঠে একটি করে ঘুরাল বাঁধা। যেখানে আমার শেষ গুলি ছুঁড়ি সেখানে পৌঁছতে গো-পথে আরো আরো রক্ত আমাদের প্রভূত উৎসাহ দিল। দুশো গজ এগিয়ে রক্তের নিশানা নেমে গেল এক সুগভীর গিরিখাতে।
এখানে আমরা বাহিনীটাকে ভাগ করে ফেললাম, দুজন লোক খাত পেরিয়ে গেল দূরের দিকে, কুড়োলের মালিক ও আমি রইলাম কাছের দিকটায়। ঘুরালবাহী লোকদুটি আমাদের পেছনে আসতে থাকল। আমরা পাহাড়ের উত্রাইয়ে এগোতে থাকলাম। আমাদের পঞ্চাশ ফুট নিচে গিরিখাতের অঙ্কে বেঁটে বাঁশগাছের এক ঠাস বুনোন বন, এবং এই ঘনবনে যখন একটি পাথর ছোঁড়া হল, রাগে পাগল হয়ে এক চীৎকারে ভাল্লুকটি উঠে দাঁড়াল এবং ছয়টি মানুষই তাদের ডান-পা লম্বা লম্বা ফেলে পাহাড় বেয়ে উঠে গেল সিধে।
এ জাতীয় ব্যায়ামের ট্রেনিং নিই নি আমি, এবং ভাল্লুকটি আমাদের ধরে ফেলছে না কি দেখার জন্যে পেছন ফিরে চেয়ে সুগভীর স্বস্তিতে দেখলাম আমরা যেমন তেড়েফুঁড়ে চড়াই উঠছি, ও তেমনি সমান বেগে নামছে উত্রাই। আমার সঙ্গীদের উদ্দেশে একটি চীৎকার, দ্রুত দিক-বদল, আমরা বেদম চেঁচিয়ে ছুটে চললাম, দ্রুত ধরে ফেলতে থাকলাম উদ্দিষ্ট শিকারকে। কয়েকটি ভাল মত আঘাত হানা হল, সঙ্গে সঙ্গে শোনা গেল লক্ষ্যভেদের উল্লাস চীৎকার ও ভাল্লুকটির ক্রুদ্ধ গর্জন। সামনে গিরিখাতের মোড়টি বেজায় বেয়াড়া বলে সন্তর্পণে এগনো দরকার হল এবং আমরা ভাল্লুকটির হদিস হারিয়ে ফেললাম।
রক্ত-সংকেত অনুসরণ সহজ হত কিন্তু গিরিখাতটি এখানে বড় বড় পাথরে বোঝাই, যে-কোনোটিরই পেছনে ভালুকটি ওৎ পেতে থাকতে পারে। তাই বোঝাভারাক্রান্ত লোকগুলি যখন জিরোবার জন্যে বসল, গিরিখাতের দুপাশ ধরে কেমন করে যাব তা আমরা ভাগাভাগি করে নিলাম। আমার সঙ্গী যখন গিরিখাতের ভেতরপানে ঝুঁকে দেখতে এগিয়ে গেল, আমি গেলাম ডান দিকে একটি পাথর ঢাকা চূড়া ঘুরে দেখতে, সেটি দুশো গজ সিধা নিচে নেমে গেছে। ভর সামলাতে একটি গাছ আঁকড়ে ধরে আমি ঝুঁকলাম ও আমার ঠিক চল্লিশ ফুট নিচে একটি সংকীর্ণ কার্নিসে ভাল্লুকটিকে শুয়ে থাকতে দেখলাম। আন্দাজ ত্রিশ পাউন্ড ওজনের একটি পাথর তুলে নিলাম আমি এবং কিনারা অব্দি এগিয়ে, নিজে পড়ে যাবার বিপদ বেশি, তা জেনেই দুহাতে পাথরটি মাথার ওপর তুললাম আর ফেললাম।
ভাল্লুকের মাথায় ক ইঞ্চি দূরে কার্নিসে পড়ল পাথরটি, হাঁচড়েপাঁচড়ে পায়ে দাঁড়িয়ে উঠে সে উধাও হল চোখের সামনে থেকে, এক মিনিট বাদে পাহাড় যে দিকে, সেদিকে আবার বেরিয়ে গেল। আবার শিকারের খোঁজ চলল। এখানে জমি আরো ফাঁকা, কম পাথর এখানে, আমার চারজন যারা বিনাবোঝায় দৌড়াচ্ছিলাম, আমাদের কোনো অসুবিধা হল না ওর সঙ্গে তাল রেখে চলতে। এক মাইল কি তারও বেশি পথ আমরা ওকে পুরো দমে ছুট করালাম–যতক্ষণ না ক্রমে আমরা জঙ্গল ছেড়ে বেরিয়ে ধাপকাটা খেতে পড়ি। খেতগুলির এপার-ওপার দিয়ে বৃষ্টির জল অনেকগুলি গভীর ও সংকীর্ণ নালা কেটেছে এবং এরই একটি নালাতে গা ঢাকা দিল ভাল্লুকটি।
দলের একমাত্র সশস্ত্র সদস্য হল বিকৃত মুখ লোকটি এবং সকলে একমত হয়ে তাকেই জল্লাদ ঠিক করল। বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে ও খুব সাবধান ভাল্লুকটির কাছে এগোল এবং তার সুন্দর পালিশ করা কুড়োলটি শূন্যে দুলিয়ে তার চৌকো ফলাটি নামিয়ে আনল ভাল্লুকের মাথার ওপরে। পরিণামটি হল যেমন অপ্রত্যাশিত, তেমনি আশঙ্কাজনক। যেন বরারে ঘা হেনেছে অমনি করেই ভাল্লুকটির খুলি থেকে কুড়োলের ফলা লাফিয়ে উঠে এল এবং খ্যাপা রাগে চেঁচিয়ে জানোয়ারটি পেছনের পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াল পেছনে সরে গিয়ে। আমাদের সৌভাগ্য, ও যে সুবিধে মত দাঁড়িয়ে আছে। তার সুযোগ কাজে লাগাল না–কেন না আমরা ছিলাম গায়ে গায়ে ঘেঁষে এবং দৌড়বার চেষ্টায় প্রত্যেকে প্রত্যেকের বাধাই সৃষ্টি করছিলাম।
ভাল্লুকটি এই কঁকা জমি পছন্দ করছে বলে বোধ হল না এবং নালাতে অল্প নেমে গিয়ে আবার গা ঢাকা দিল। এবার কুড়োল মারার পালা আমার। তবে একবার ঘা খাওয়ার ফলে ভাল্লুকটি আমার এগনোতে আপত্তি জানাল এবং একমাত্র বহু কৌশলের পরই ক্রমে আমি ওকে যেখান থেকে কোপ বসাতে পারব তেমন দূরত্বে পৌঁছলাম। যখন বালক, তখন উচ্চাশা ছিল কানাডায় আমি কাঠচেরাইয়ের কাঠুরে হব এবং একটি দেশলাই কাঠিকে দু-ফাঁক করার মত যথেষ্ট দক্ষতা আমি কুড়োল মারায় অর্জন করেছিলাম। কুড়োলটি সরে গিয়ে পাথরে লেগে জখম হবে বলে কুড়ালের মালিকের যেমন ভয় ছিল, আমার তা ছিল না এবং যে মুহূর্তে নাগালের আওতায় পৌঁছলাম, পুরো ফলাটি বসিয়ে দিলাম ভাল্লুকটির খুলিতে!
আমাদের পাহাড়ী মানুষদের কাছে হিমালয়ের ভাল্লুকের চামড়ার কদর খুব এবং কুড়োলের মালিককে যখন বললাম ঘুরালের মাংসের ডবল ভাগের ওপরে ও চামড়াটি পেতে পারে, ও খুবই গর্বিত হল, সবাই ওকে ঈর্ষা করতে থাকল। গ্রাম থেকে নতুন করে যারা এল, তারা লোকজনের সংখ্যা বাড়িয়ে তুলল এবং আমার লোকজনকে শিকারের চামড়া ছাড়িয়ে বাঁটোয়ারা করার ভার দিয়ে ওদের রেখে আমি উত্রাই বেয়ে গ্রামে গেলাম। আগে যা বলেছি, আহত মেয়েটির সঙ্গে শেষবারের মত দেখা করতে গেলাম। দিনটি খুবই হয়রানিতে গেল এবং সে রাতে যদি বাঘিনী আমার সঙ্গে দেখা করতে আসত, ঘুমন্ত অবস্থাতেই ধরতে পারত আমাকে।
ডালকানিয়াতে আসার সময়ে যে পথে আসি, তাতে গাছপালা শূন্য পাহাড়ে লম্বা লম্বা অনেকগুলো খাড়াই চড়াই-ভাঙার ব্যাপার ছিল। এ রাস্তার অসুবিধাগুলির কথা যখন গ্রামবাসীদের বলি, ওরা বলেছিল আমার হায়রাখান হয়ে ফিরে যাওয়া উচিত। গ্রামের ওপরে শৈলশিরা পর্যন্ত একবার মাত্র চড়াই ভাঙা প্রয়োজন হয় এ পথে। সেখান থেকে রানীবাগ অব্দি পুরো রাস্তাটাই পাহাড়ের উত্রাইয়ে। সেখান থেকে গাড়িতে নৈনিতাল অব্দি চলে যেতে পারব।
রাতেই লোকজনকে হুঁশিয়ারী জানিয়েছিলাম খুব ভোর ভোর রওনা হবার জন্য তৈরি থাকতে। মালপত্র বেঁধেছেদে আমার পেছন পথে ওদেরকে আসতে বলে সূর্যোদয়ের একটু আগে আমি আমার ডালকানিয়ার বন্ধুদের বিদায় জানালাম, এবং ওপরের শৈলশিরার জঙ্গুলে রাস্তায় পৌঁছবার জন্যে দু মাইল চড়াই ভাঙা শুরু করলাম। যে পথে প্রথমে আমার লোকজন, পরে আমি ডালকানিয়ায় পৌঁছই, এখন যে পায়ে চলা পথ ধরেছি এটা সে পথ নয়। তবে পাহাড়তলির বাজারে যেতে আসতে গ্রামবাসীরা এটি ব্যবহার করে।
ঘন ওক ও পাইনের জঙ্গল এবং নিবিড় ঝোপ-জঙ্গলের ভেতর দিয়ে গভীর গিরিখাতে পথটি পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে ঢুকেছে আর বেরিয়েছে। এক সপ্তাহ বাঘিনীটির কোনো পাত্তা নেই। এই খবর-না-থাকা আমাকে আরো বেশি সতর্ক করে তুলল এবং ক্যাম্প ছাড়ার এক ঘণ্টা বাদে বিনা ক্ষতিতে আমি পৌঁছলাম জঙ্গুলের রাস্তার একশো গজের ভেতরে। পাড়াহের চূড়ার কাছে একটি উন্মুক্ত ভূ-খণ্ডে।
এই জায়গাটার আকার পীয়ার ফলের মত, প্রায় একশো গজ লম্বা এবং পঞ্চাশ গজ চওড়া, তার ঠিক মাঝখানে একটি বৃষ্টি জলের বদ্ধ ভোবা। জলপানের ও গা ডোবাবার স্থান হিসেবে সম্বর ও অন্য জানোয়ার এটি ব্যবহার করে এবং এটি ঘিরে জানোয়ারের পা ও খুরের দাগ দেখার আগ্রহে আমি পথটি ছাড়লাম। বাঁয়ের যে পাহাড়টি রাস্তা অব্দি এগিয়ে চলে এসেছে, পথটি সেটি ঘুরে চলে গেছে। ডোবার কাছে এগোলাম যখন, জলের কিনারে নরম মাটিতে বাঘিনীটির থাবার ছাপ দেখলাম।
আমি যেদিক থেকে এগিয়েছি, ও সেদিক থেকেই ভোবাটির কাছে এগিয়েছে এবং স্পষ্টতই, আমার কারণে উত্যক্ত হয়ে জল পেরিয়ে চলে গেছে ফাঁকা জমিনের ডান হাতি নিবিড় গাছ ও ঝোঁপঝাড়ের জঙ্গরে মধ্যে। মস্ত একটা সুযোগ নষ্ট হল। কেন না পেছনে যেমন সতর্ক নজর রেখেছিলাম, সামনে তা রাখলে পরে ও আমাকে দেখার আগেই আমি ওকে দেখে ফেলতাম। যাই হক, যদিও আমি একটি সুযোগ হারিয়েছি, তবু সুবধাজনক সব কিছুই আমার সপক্ষে এবং অতি স্পষ্টভাবেই আমারই অনুকূলে।
বাঘিনী আমাকে দেখেছে, নইলে ও ডোবা পেরোত না এবং তাড়াতাড়ি আড়াল খুঁজতে যেত না। ওর নিশানা বলে দিচ্ছে ও তাই করেছে। ও আমাকে দেখেছে এবং আরো দেখেছে আমি একাকী, আর নিঃসন্দেহে ও যা করছে, আড়াল থেকে নজর করছে আমায়। ধরে নিচ্ছে ও যেমন ডোবায় জল খেতে গিয়েছিল, আমিও তাই যাচ্ছি। এ পর্যন্ত আমার চলাফেরা খুবই স্বাভাবিক থেকেছে। ওকে যদি বোঝাতে পারি যে আমি ওর উপস্থিতি টের পাইনি, ও হয়তো আমাকে এক দ্বিতীয় সুযোগ দেবে।
নুয়ে পড়ে, টুপির কানাচ থেকে অতি তীক্ষ্ণ নজর রেখে আমি অনেকক্ষণ কাটলাম, জল ছেটালাম, তারপর ধীর গতিতে চলতে চলতে শুকনো কাঠ কুড়োতে কুড়োতে আমি খাড়া পাথরটার নিচে গেলাম। সেখানে ছোট্ট একটি আগুন জ্বালোম এবং পাথরটিতে পিঠ ঠেস দিয়ে একটি সিগারেট ধরালাম। সিগারেট শেষ হতে হতে আগুনও নিভে গেল। তখন শুয়ে পড়লাম, বাঁ হাতটি বালিশ করে তাতে মাথা রাখলাম, ট্রিগারে আঙুল রেখে রাইফেলটি রাখলাম মাটিতে।
আমার ওপরের পাথরটি কোনো জানোয়ারের দাঁড়ানোর পক্ষে বড় বেশি খাড়াই। তাই শুধু সামনেটিই পাহারা দিতে হচ্ছিল আমাকে এবং ঘন জঙ্গলটি কোনোদিনই আমার থেকে বিশ গজের কম দূরে নয় বলে আমি বেশ নিরাপদে। এতখানি সময়ে আমি কিছু দেখিও নি, শুনিও নি তবু আমি স্থির বিশ্বাস করি যে বাঘিনী আমাকে লক্ষ করে চলেছে। টুপির কানাটি আমার চোখকে আড়াল করে রাখলেও আমার চোখের দেখায় কোনো ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে না। আমি জঙ্গলের যতদূর দেখতে পাচ্ছি, তা ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে তন্ন তন্ন করে দেখলাম। এক ফোঁটা বাতাস বইছে না, একটি পাতা বা ঘাসের ফলা নড়ছে না। আমার লোকজনকে পরস্পরের কাছাকাছি থাকতে এবং ওরা ক্যাম্প ছাড়া থেকে জঙ্গল পথে আমার সঙ্গে মিলিত না-হওয়া অব্দি গান গাইতে বলে দিয়েছি আমি। তারা দেড় ঘন্টার আগে এসে পৌঁছচ্ছে না। সম্ভবের চেয়েও বেশি সম্ভব যে, এই সময়ের মধ্যেই বাঘিনী আড়াল থেকে বেরোবে আর আমাকে তাক অথবা আক্রমণ করবে।
অনেক সময়ে সময় চলে পা টেনে টেনে, অন্য সময়ে উড়ে চলে যায়। আমার বাঁ হাতটিকে বালিশ করে মাথা রেখেছিলাম, বহুক্ষণ তার ঝিঁঝি ধরাও চলে গেছে, সে হাত একেবারে অসাড়, তবু নিচের উপত্যকা থেকে আমার লোকজনের গান যেন বড্ড তাড়াতাড়ি আমার কানে পৌঁছল।.গলাগুলি ক্রমে স্পষ্ট হল এবং ওরা যখন একটা বেয়াড়া বাঁক ঘুরছে, অচিরে ওদের দেখতে পেলাম। বাঘিনীটি যখন জলপান করে নিজের পায়ের ছাপ ধরে ফিরে যেতে পেছন ফেরে, বোধহয় এই বাঁকেই ও আমাকে দেখেছিল। আরেকটি ব্যর্থতা এবং এ যাত্রার শেষ সুযোগটিও চলে গেল।
আমার লোকজন জিরিয়ে নেবার পর আমরা চড়াইপথে রাস্তায় উঠলাম, হায়রাখানের ফরেস্ট রেস্ট হাউসে রওনা হলাম। বিশ মাইল পথ যাব, সে মনে হল যেন বড় বেশি দীর্ঘ। ফাঁকা জমির ওপর দিয়ে দুশো গজ গিয়ে পথটি ঢুকে গেল অতি দুর্ভেদ্য জঙ্গলে। এখানে আমি লোকজনদের সামনে চলতে বাধ্য করলাম, নিজে রইলাম পেছনে। এই ভাবে দু মাইল গেছি তখন মোড় ঘুরতে দেখলাম একটি লোক পথে বসে মোষ চরাচ্ছে। প্রাতরাশের জন্যে এখন একটু থামার সময় হয়েছে তাই লোকটিকে জিজ্ঞেস করলাম জল পাব কোথায়। ও সিধাসিধি ওর সমুখের পাহাড়টি দেখাল এবং বলল, ওর গ্রামটি পাহাড়ের ঢালের মোড় ঘুরেই, পাহাড়টির নিচেই এক ঝরনা আছে। ওর গ্রাম তা থেকে জলের যোগান নেয়। তবে জলের জন্যে পাহাড় বেয়ে নিচে নামার দরকার নেই। কেননা আমরা যদি আরেকটু এগোই পথের ওপরেই একটি ভাল ঝরনা পাওয়া যাবে।
লোহালির সে মেয়েটি গত সপ্তাহে এ উপত্যকায় নিহত হয়, তারই উঁচু দিকের কিনারে লোকটির গ্রাম এবং ও আমাকে বলল, তখন থেকে নরখাদক বাঘিনী বিষয়ে আর কিছু শোনা যায় নি। ও আরো বলল, জানোয়ারটি সম্ভবত এখন জেলার অপর প্রান্তে। ভাবায় আমি যে টাটকা থাবার ছাপ দেখেছি, সে কথা বলে আমি ওর ভুল শুধরে দিলাম এবং মোষগুলি জড়ো করে তাড়াতাড়ি গ্রামে ফিরে যেতে বলে দিলাম। ওর মোষগুলি, সংখ্যায় গোটা দশ হবে। পথটির দিকে উঠে আসছিল ছড়িয়ে ছিটিয়ে। লোকটি বলল, ও যেখানে বসে আছে, চরতে চরতে মোষগুলো সে পর্যন্ত এলেই ও চলে যাবে। ওকে একটি সিগারেট দিলাম, শেষবারের মত, হুশিয়ারী জানিয়ে আমি ওকে রেখে রওনা হলাম। যখন কয়েক মাস বাদে দ্বিতীয় বারের মত এ জেলাতে যাই, তখন গ্রামের পুরুষরা আমায় বলে আমি চলে আসার পর কি ঘটেছিল।
সেদিন লোকটি অবশেষে যখন বাড়ি পৌঁছয়, আমাদের যে দেখা হয়েছিল, আমি যে হুঁশিয়ারী করেছিলাম ওকে, সে কথা সমবেত গ্রামবাসীদের ও বলে। বলে, একশো গজ দূরে পথের একটি বাঁকে আমাকে ঘুরে যেতে দেখে ও আমার দেওয়া সিগারেটটি ধরাতে শুরু করে। জোর বাতাস বইছিল। দেশলাইয়ের আগুন বাঁচাতে ও সামনে নুয়েছিল এবং যখন ও এই অবস্থাতেই, তখন ওকে পেছন থেকে ডান কাঁধে কামরে ধরা হয়, টানা হয় পেছনপানে। যে দলটি ওকে এমনি রেখে চলে গেছে, ওর প্রথমেই মনে হয় তার কথা, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সাহায্য চেয়ে ও যে চেঁচায় তা তারা শুনতে পায় না।
তবে সাহায্যব্যবস্থা হাতের কাছেই ছিল, কেননা বাঘিনীর গর্জনের সঙ্গে মিশ্রিত ওর আর্তনাদে মোষগুলি যেই শুনল, ওরা তেড়ে উঠে এল রাস্তায় এবং বাঘিনীকে তাড়িয়ে দিল। লোকটির কঁধ ও বাহু ভেঙে গিয়েছিল এবং অতি কষ্টে ও ওর এক সাহসী বন্ধুর পিটে চড়তে সক্ষম হয় আর বাড়ি পৌঁছয়। দলের অন্য মোষগুলো আসে পেছন পেছন। গ্রামবাসীরা যতটা ভালভাবে পারে ওর জখমগুলো বেঁধে দেয় এবং সঙ্গে সঙ্গে ওকে ত্রিশ মাইল পথ ধরে নিয়ে যায় হলদোয়ানির হাসপাতালে, সেখানে ভর্তি করার অল্প পরেই ও মারা যায়।
দেবী অ্যাট্রোপস, যিনি জীবনের সূত্রগুলি কেটে দেন, তিনি একটি সূত্র হাত থেকে ফসকে ফেলেন আরেকটি কাটেন। আর আমরা, যাঁরা জানি না কেন একটি সূত্র ফসকে গেল, আরেকটি কেটে ফেলা হল। এটিকে কত কি বলি, ভাগ্য, কিস্মাৎ, আরো যা মনে হয়।
এক মাস ধরে নিকটতম মানুষটি থেকে দূরে বাস করছি এক খোলা তাঁবুতে। ভোর থেকে সন্ধ্যা ঘুরছি জঙ্গলে জঙ্গলে, বহুবার রমণীর ছদ্মবেশে সাজিয়েছি নিজেকে আর স্থানীয় অধিবাসীরা যে সব জায়গায় যেতে সাহস করে না, সেখানে গিয়ে ঘাস কেটেছি। এই সময়কালের মধ্যে আমাকেও ওর শিকারতালিকায় অন্তর্ভুক্ত করবার বহু সুযোগই নিশ্চয় হারিয়েছে বাঘিনী। যখন শেষ চেষ্টা করল, তখন নেহাত দৈববশে এই হতভাগ্যের সঙ্গে ওর মোকাবিলা হল এবং তাকে ও শিকার হিসেবে হত্যা করল।
.
০২.
পরের ফেব্রুআরিতে আমি ডালকানিয়াতে ফিরলাম। গত গ্রীষ্মে এ জেলা থেকে আমার চলে যাওয়ার পর থেকে বেশ কিছু সংখ্যক মানুষ মারা পড়েছে। বহু বেশি মানুষ জখম হয়েছে এবং যেহেতু বাঘ কোথায় তা জানা নেই, আর বাঘিনীটির থাকার সম্ভাবনা এখানে যেমন, অন্যখানেও তেমন; তাই সে জায়গার সঙ্গে আমি এখন পরিচিত, মন ঠিক করে সেখানেই ফিরলাম।
ডালকানিয়া পৌঁছতে আমাকে বলা হল, যে পাহাড়ে ভাল্লুক শিকারের ঘটনা ঘটে, সেখানে গত সন্ধ্যায় একটি গরু মারা পড়েছে। সে সময়ে যে লোকগুলি গরু চরাচ্ছিল, তারা জোর দিয়ে বলল যে তারা যে জানোয়ারকে গরুটিকে মারতে দেখে, তা একটি বাঘ। একটা ছেড়ে আসা খেতের কিনারে কয়েকটি ঝোপের কাছে মড়িটি পড়েছিল এবং যেখানে আমার তাঁবু খাটানো হচ্ছিল সেখান থেকে তা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল। মড়ির ওপর গোল হয়ে উড়ছিল শকুন। আমার ফিল্ডগ্নাসের ভেতর দিয়ে চেয়ে, মড়িটির বাঁ দিকে একটি গাছের ওপর অনেকগুলো পাখিকে বসে থাকতে দেখলাম। মড়িটি পড়ে আছে ফাঁকা জায়গায় এবং শকুনরা ওর ওপরে নামে নি, এ ঘটনা থেকে আমি সিদ্ধান্ত নিলাম (ক) যে গরুটি মারা পড়েছে এক চিতার হাতে, এবং (খ) চিতাটি মড়ির কাছেই গুঁড়ি মেরে আছে।
যে খেতে গরুটি পড়েছিল তার নিচের জমি অত্যন্ত খাড়াই এবং নিবিড় গুল্মে ঢাকা। বাঘিনীটি এখনো অবাধে বিচরণ করছে, সে জন্যে এই জমি দিয়ে এগনো মোটেই সুবুদ্ধির কাজ হবে না।
ডানদিকে একটি ঘাসে-ঢাকা ঢালু জমি কিন্তু চোখের অলক্ষে আমার মড়িটির কাছে এগিয়ে যাবার পক্ষে জমিটি সেখানে খুবই ফাঁকা। পাহাড়ের চুড়োর প্রায় কাছে শুরু হয়ে এক নিবিড় বনাচ্ছাদিত গভীর গিরিখাত, মড়িটির স্বল্প দূর দিয়ে সোজা নেমে গেছে নাউর নদীতে। যে গাছটিতে শকুনগুলো বসেছিল তা উঠেছে এই গিরিখাতের কিনার দিয়ে। এই গিরিখাতটিই আমার এগোবার পথ বলে ঠিক করলাম। গ্রামবাসীরা এ জমির প্রতিটি ফুট জানে এবং ওদের সঙ্গে আমি যখন শিকারের উপায় আর পরিকল্পনা করছি আমার লোকজন আমার জন্যে চা করে ফেলল। দিন শেষ হতে চলেছে কিন্তু খুব দ্রুত চললে পরে মড়িটি দেখার এবং রাত নামার আগে ক্যাম্পে ফেরার সময় পাওয়া যাবে কোনমতে।
রওনা হবার আগে লোকজনকে নির্দেশ দিলাম নজর রাখতে। যদি একটি গুলির শব্দ শোনার পর ওরা আমাকে মড়ির কাছে ফাঁকা জায়গায় দেখে, ওদের মধ্যে তিন বা চারজন তৎক্ষণাৎ ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে ফাঁকা জমি দিয়ে চলে আমার কাছে যাবে। ওদিকে, আমি যদি গুলি না করি এবং সকালে ফিরতে না পারি, একটি তল্লাসী দলের বন্দোবস্ত করতে হবে।
গিরিখাতটি র্যাসপবেরি ঝোপ, আর বড় বড় শিলাখণ্ডে ঢাকা। পাহাড়ের নিচ থেকে ওপর পানে বইছে বাতাস। তাই আমি এগোচ্ছিলাম ধীরে ধীরে। এক দুরারোহ চড়াই ভাঙার পর অবশেষে যেটির ওপরে শকুনগুলো বসেছিল, সেই গাছটির কাছে যখন পৌঁছলাম, শুধু তখনি দেখলাম এ জায়গাটি থেকে মড়িটি নজরে আসে না। আমার ফিল্ডগ্লাস দিয়ে দেখে, যে ছেড়ে আসা খেতটিকে দিব্যি সোজা মনে হয়েছিল, সেটি দেখলাম অর্ধচন্দ্রাকৃতি, চওড়াতম অংশটি আড়াআড়ি দশগজ, দুটি প্রান্ত সরু হয়ে গেছে দুই বিন্দুতে। বাইরের কিনারাটিতে নিবিড় ঝোঁপঝাড়ের বেড়া এবং ভেতরদিকের কিনারা থেকে পাহাড় খাড়া নেমে গেছে। যেখানে দাঁড়িয়ে আছি সেখান থেকে খেতটির দুই তৃতীয়াংশ মাত্র নজরে আসে এবং যে এক-তৃতীয়াংশে মড়িটি পড়ে আছে তা দেখতে হলে হয় অনেকটা জায়গা ছেড়ে ঘুরে গিয়ে দূরের দিকের পাশ থেকে এগোতে হয়, নয়তো যে গাছে শকুনগুলো বসে আছে তাতে চড়তে হয়।
পরের পন্থাটি গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিলাম। যতদূর বুঝতে পারলাম, গরুটি গাছটা থেকে আন্দাজ বিশ গজ দূরে এবং সে জানোয়ার ওটিকে মেরেছে সে আরো সম্ভবত কম দূরে আছে। খুনীটিকে বিরক্ত না করে গাছে ওঠা এক অসাধ্য কাজ হত, এবং শকুনগুলি না থাকলে সে চেষ্টা করাই হত না। গাছের ওপর এখন প্রায় বিশটি পাখি, নতুন আগন্তুকরা আসছে বলে সে সংখ্যা বাড়ছে এবং ওপরের ডালগুলিতে জায়গা যেহেতু খুব কম, প্রচুর ডানা ঝাঁপটানি এবং ঝগড়া চলছিল। পাহাড়ের দিক থেকে বাইরের পানে গাছটি হেলে আছে এবং জমি থেকে আন্দাজ দশ ফুট ওপরে একটি সুবিশাল বড় ডাল খাড়াই পাহাড়ের গায়ের ওপর দিয়ে ঝুঁকে আছে। রাইফেলের বোঝার ভার ছিল বলে এই বড় ডালে শাখার পৌঁছতে খুবই অসুবিধে হল। শকুনদের মধ্যে এক নতুন ঝগড়াঝগড়ি শুরু হওয়া অব্দি সবুর করে আমি শাখাঁটির ওপর দিয়ে হেঁটে চললাম–তাল সামলে হাঁটায় এক দুরূহ পরীক্ষা একবার পা পিছলালে বা পা ফসকালে পরিণাম হবে একশা বা বেশি ফুট নিচে তলের পাথরগুলিতে পতন–পৌঁছলাম দুটো ডাল যেখানে দু মুখো গেছে তার গোড়ায় এবং বসলাম।
মড়িটি এখন পুরো দেখা যাচ্ছে এবং ওটি থেকে মাত্র কয়েক পাউন্ড মাংস খাওয়া হয়েছে। আন্দাজ দশ মিনিট এইভাবে বসে আছি, বসার দাঁড়টি তেমন আরামের মনে হচ্ছে না, তখন দুটি শকুন, গরুটি থেকে অল্প দূরে ওপারে নামল। ওরা অনেকক্ষণ ধরে চক্করই দিচ্ছে। গাছের থেকে নামলে কেমন অভ্যর্থনা পাবে, তা তারা জানে না। নিচে বসেছে কি বসেনি, আবার ডানা মেলে ওপরে উঠল ওরা এবং সেই মুহূর্তেই মড়িটি আমার যে দিকে, সেদিকের ঝোপগুলি মৃদু আন্দোলিত হল। বাইরে বেরিয়ে এল একটি চমৎকার মদ্দা চিতা।.।
তার স্বভাব-পরিবেশ, অনুকূল পরিস্থিতিতে এক চিতাকে যাঁরা কখনো দেখেন নি, আমাদের ভারতের জঙ্গলের সকল প্রাণীর মধ্যে সব চেয়ে সলীল, সুন্দরতম এই প্রাণীটির গতিভঙ্গী যে কত লাবণ্যভরা, এর গায়ের রং যে কি চমৎকার, সে বিষয়ে তাঁদের কোনো ধারণাই থাকতে পারে না। এর আকর্ষণ শুধু বাইরের চেহারাতেই সীমাবদ্ধ নয় কেননা পাউন্ড বনাম পাউন্ডে ওর বল দ্বিতীয় রহিত এবং সাহসেও অতুলন। এমন এক প্রাণীকে ‘বিনষ্টেয়’ আখ্যাভুক্ত করা, ভারতের কোনো কোন অংশে যা করা হয়, তা অপরাধ-এ অপরাধ তারাই করতে পারে, অসহায়, স্বল্পাহারে শীর্ণ, ঘেয়ো যে সব চিতা বন্দী অবস্থায় দেখা যায় তাদের মধ্যেই যাদের চিতা সম্পর্কে সব জ্ঞান সীমাবদ্ধ।
কিন্তু আমার সামনে যে চিতাটি দাঁড়িয়ে আছে সেটি যত সুন্দরই হক, ওর আয়ু এখন শেষ হয়ে এসেছে কেননা ও গৃহপালিত পশু মারতে শুরু করেছে এবং গতবার যখন আসি তখন ডালকানিয়া এবং অন্যান্য গ্রামের লোকজনকে কথা দিয়েছি, সুযোগ পেলে পরে এই ক্ষুদ্রতর শত্ৰুটির হাত থেকে ওদের রেহাই দেব। যে গুলিটি ওকে মারলাম, তার আওয়াজ চিতাটি শুনতে পেল বলে মনে হল না আমার।
জীবনে এমন সব ঘটনা ঘটে যার কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। সব চাইতে আশ্চর্য লাগে যখন কোন ব্যক্তিবিশেষ বা গোটা একটা পরিবারকে দুষ্ট গ্রহের ফেরে পড়তে দেখা যায়। যে গরুটির সহায়তায় আমি চিতাটিকে মারলাম, সেটির মালিকের কথাই এক দৃষ্টান্ত হিসেবে দেখা যাক। সে একটি বালক, আট বছর তার বয়স, একমাত্র সন্তান। ওর মা যখন গরুর ঘাস কাটছিল দুবছর আগে, বাঘিনী তাকে মারে ও খায়। বার মাস বাদে ওর বাবারও একই পরিণাম ঘটে। পরিবারিটর যে সামান্য বাসনপাতি ছিল তা বাবার সামান্য ঋণ শোধ করতে বিক্রি করা হয় এবং একটি গরুর মালিক হিসেবে বালকটি জীবন শুরু করে। গ্রামের দুশো বা তিনশো গরুর পালের ভেতর থেকে চিতাটি বিশেষ করে ওর গরুটিই বাছল এবং মারল। (আমি স্বীকার করছি, এ ক্ষেত্রে একটি ভাঙা বুক জোড়া দেবার প্রচেষ্টাটি আমার খুব একটা সফল হয় নি। কেননা নতুন লাল গরুটি, যদিও গুণী জানোয়ার, বালকটির আজীবনের সঙ্গী সাদা গরুটি হারাবার ক্ষতি ও পুরোপুরি পূরণ করতে পারে নি)।
যে লোকটির দায়িত্বে ওদের রেখে গিয়েছিলাম, তার হাতে আমার বাচ্চা মোষগুলি বেশ যত্নেই ছিল। যদিও বাঘিনীটি ওদের টোপ হিসেবে পছন্দ করবে বলে আমার সামান্যই আশা ছিল তবুও পৌঁছবার পরদিন আমি ওদের বাইরে বাঁধতে শুরু করলাম।
ননধাউর উপত্যকায় পাঁচ মাইল গিয়ে প্রায় এক হাজার বা তারও বেশি ফুট উঁচু। এক ভীষণ চড়াই পাহাড়ের পাশ। তার পায়ের কাছে কোল জুড়ে একটি ছোট্ট গ্রাম। গত কয়েক মাসে এই গ্রামটির বাইরের সীমানায় বাঘিনী চারজন মানুষকে মেরেছে। আমি চিতাটিকে মারবার অল্পদিন বাদেই, তাদের গ্রামের কাছে আমার জন্যে যে জায়গা ঠিক করে রাখা হয়েছে, ডালকানিয়া থেকে সেখানে আমার ক্যাম্প সরিয়ে নেবার জন্যে অনুরোধ জানাতে ওই গ্রাম থেকে এক প্রতিনিধিদল এল। আমাকে বলা হল, গ্রামটির উঁচুতে পাহাড়ের গায়ের ওপর বাঘটিকে ঘন ঘন দেখা গেছে। মনে হয় পাহাড়ের গায়ের বহু গুহার একটিতে ওর আবাস। আমাকে বলা হল, সেদিন সকালেই কয়েকটি মেয়ে ঘাস কাটতে গিয়ে বাঘটিকে দেখেছে এবং গ্রামবাসীরা এখন ভয়ে জুজু। ঘর ছেড়ে বেরোবার পক্ষে তারা বড় বেশি ভয় পেয়েছে।
ওদের সাহায্য করার জন্য আমার সাধ্যমত সবই করব আমি, প্রতিনিধি দলটিকে এ প্রতিশ্রুতি দিয়ে পরদিন সকালে খুব ভোর ভোর বেরোলাম। গ্রামটির উলটোদিকের সাহাড়টিতে উঠলাম এবং এক ঘণ্টা কি তারও বেশি সময় ফিল্ডগ্লাসের মধ্যে দিয়ে পাশ পাহাড়টি চুলচিরে দেখলাম। তারপর পেরোলাম উপত্যকাটি, এক অতি গভীর গরিখাতের পথে গ্রামের ওপরের পাশ পাহাড়ে চড়লাম। এখানে পথ চলা খুবই কঠিন এবং মোটেও আমার মনোমত নয়। কেননা পড়ে গেলে পরিণাম হবে ঘাড় ভেঙে যাওয়া। তার ওপর বিপদ হল যে, এ রকম জায়গায় বাঘের আক্রমণ থেকে প্রাণ বাঁচানো একেবারে অসম্ভব।
পাহাড়ের পাশটির যতটা আমার দেখার ছিল ততটা আমার দেখা হয়ে গেল বেলা দুটোর মধ্যে। আর ক্যাম্প এবং প্রাতরাশের উদ্দেশে উপত্যকা ভেঙে ওপরপানে ফিরছি যখন, যে-দিক থেকে এখনি এলাম, সেদিক থেকে আমার পানে ছুটে আসছে দুটি লোক। আমার কাছে এসে ওরা খবর দিল, সকালের দিকে যে গভীর গিরিখাত ধরে আমি গিয়েছিলাম, তাতে একটি বাঘ একটি বলদকে এখনি মেরেছে। চড়াই ভেঙে আমরা ক্যাম্পে গিয়ে আমার ভৃত্যকে চা এবং কিছু খাবার পাঠাতে বলার জন্যে ওদেরই একজনকে বলে আমি পেছন ফিরলাম এবং অপর লোকটির সঙ্গে, যে পথ ছেড়ে এলাম উপত্যকা ধরে সেই পথেই আবার ফিরে চললাম উপত্যকা ধরে।
যেখানে বলদটি মারা পড়েছে সে গিরিখাতটি আন্দাজ দুশো ফুট গভীর এবং একশো ফুট চওড়া। যেমন ওটার কাছে এগোলাম, দেখলাম কতকগুলো শকুন ওপরে উঠছে আর মড়ির কাছে এলাম যখন, দেখলাম শকুনরা ওটাকে সাফ করে খেয়ে গেছে, পড়ে আছে শুধু চামড়া আর হাড়। যেখানে বলদটির দেহাবশেষ পড়ে আছে, জায়গাটি গ্রাম থেকে মাত্র একশো গজ দুরে কিন্তু খাড়াই পাড় ধরে ওঠার কোনো পথ নেই তাই আমার গাইড আমাকে গিরিখাত ধরে সিকি মাইল নিয়ে গেল, সেখানে একটি গো-পথ খাতটি পেরিয়ে গেছে। এই পথটি ডাঙা জমিতে পৌঁছবার পর গ্রামে ফিরে শেষ হবার আগে ঘন ঝোঁপ জঙ্গলের ভেতর দিয়ে এঁকেবেঁকে ঢুকেছে আর বেরিয়েছে। গ্রামে পৌঁছে আমি গ্রামমোড়লকে বললাম শকুনে মড়ি খতম করেছে এবং আমাকে একটি বাচ্চা মোষ আর শক্ত একটি খাটো দড়ি দিতে অনুরোধ জানালাম। এগুলো যখন যোগাড় করা হচ্ছে, তখন যে খাবার পাঠাতে বলেছিলাম তা নিয়ে আমার দুজন লোক এসে গেল ডালকানিয়া থেকে।
আমার জন্যে গ্রামমোড়ল এক প্রতিবেশী গ্রামে যে সতেজ নওল মদ্দা মোষ খরিদ করল সেটি নিয়ে বহু লোকজন সহ আমি যখন গিরিখাতে আবার ঢুকলাম, তখন সূর্য অস্ত যেতে বসেছে। যেখানে বলদটি মারা পড়ে সেখান থেকে পঞ্চাশ গজ দুরে, ওপরে পাহাড় থেকে জলে ভেসে নেমে আসা একটি পাইন গাছের একটি প্রান্ত গিরিখাতটির অঙ্কে ভালমত গেঁথে গেছে। পাইন গাছটি যে দিকটা বেরিয়ে আছে তাতে মোষটিকে খুব শক্ত করে বেঁধে লোকগুলি ফিরে গেল গ্রামে। কাছে কোনো গাছ ছিল না এবং বসে অপেক্ষা করতে হলে গিরিখাতটির যে পাশে গ্রাম সে দিকে একটি সরু কার্নিস একমাত্র জায়গা।
খুব কষ্ট করে এ কার্নিসে উঠলাম, এটি দু ফুট চওড়া, পাঁচ ফুট লম্বা এক গিরিখাতের অঙ্ক থেকে বিশ ফুট উঁচুতে। কার্নিসটির একটু নিচ থেকে পাহাড়টি ঢুকে গেছে ভেতর পানে। তাতে একটা ভেতরে ঢোকানো কুলুঙ্গি মত তৈরি হয়েছে। সেটি কার্নিস থেকে চোখে পড়ে না। কার্নিসটি বেয়াড়াভাবে কোনাচে হয়ে নিচে নেমে গেছে এবং যখন আমি তাতে বসলাম, যেদিক থেকে আসবে বলে আশা করছি সেদিকপানে পিঠ দিয়ে বসলাম, আমার থেকে আন্দাজ ত্রিশ গজ দূরে, বাঁদিকে, সমুখে, বাঁধা মোষটি রইল।
সূর্য ডুবেছে, মোষটি শুয়েছিল, এখন ও ধড়মড় করে উঠে দাঁড়িয়ে গিরিখাতের মুখোমুখি হল এবং এক মুহূর্ত বাদে একটি পাথর গড়িয়ে পড়ল নিচে। যেদিক থেকে শব্দ এল, সেদিকে গুলি করা আমার পক্ষে সম্ভব হত না, অতএব ধরা পড়া এড়াতে আমি একেবারে নিস্পন্দ বসে রইলাম। কিছুক্ষণ বাদে, যতক্ষণ না আমার দিকপানে মুখোমুখি হয়, ততক্ষণ ধরে মোষটি ধীরে বাঁয়ে ফিরল। আমি তো দেখতেই পাচ্ছি ও ভয় পেয়েছে। এতে বোঝা গেল ও যাতেই ভয় পেয়ে থাকুক–তা আছে আমার তলের কুলুঙ্গিতে। অচিরে আমার ঠিক নিচে দেখা গেল একটি বাঘের মাথা। বাঘের মাথায় গুলি তখনি করা ঠিক, যখন অবস্থাটি জরুরী। আমার তরফে কোনো নড়াচড়া আমার উপস্থিতির কথা ফাঁক করে দিতে পারে। লম্বা এক কি দু মিনিট মাথাটি একেবারে অনড় রইল। তারপর দ্রুত সামনে ছুটে এসে এক পেল্লায় লাফ মেরে বাঘটা পড়ল মোষটির ওপর। আমি আগেই বলেছি, মোষটি ছিল বাঘটির মুখোমুখি এবং মোষের শিং থেকে জখমের সম্ভাবনা আছে বলে সমুখ থেকে আক্রমণ এড়িয়ে বাঘটি লাফের জোরে চলে গেল মোষটির বাঁ পাশে এবং আক্রমণ করল সমকৌণিকভাবে। দাঁতে ধরতাই পেতে কান হাতড়াহাতড়ি হল না, কোনো ধস্তাধস্তি নয়, দুটি ভারি শরীরের সংঘর্ষ ছাড়া আর কোনো শব্দ নয়। তারপর মোষটি পড়ে রইল একেবারে নিশ্চল। শরীরের খানিকটা মোষের ওপরে রেখে বসা ওর গলা কামড়ে ধরে আছে বাঘটা। প্রচলিত বিশ্বাস, বাঘরা ঘাড়ে প্রচণ্ড আঘাত হেনে হত্যা করে। এটি ভ্রান্ত। বাঘরা মারে দাঁত দিয়ে।
বাঘটির ডান পাশটি আমার দিকে এবং সকালে ক্যাম্প থেকে বেরোবার সময়ে যে ২৭৫ টিতে সশস্ত্র হয়ে বেরিয়েছি, তাতে সযত্ন তাক করে আমি গুলি ছুঁড়লাম। মোষের দখল ছেড়ে দিয়ে একটি আওয়াজ না করে বাঘটি পেছন ফিরল এবং লাফ মেরে গিরিখাত বেয়ে ওপরে উঠে চোখের আড়ালে চলে গেল। তাক ফসকে গেছে পরিষ্কার, সে জন্য কোনো কারণ খাড়া করতে পারলাম না আমি। বাঘটি যদি আমাকে, অথবা রাইফেলের ঝলকানি না দেখে থাকে, তবে ও ফিরবে সে সম্ভাবনা আছে। তাই রাইফেলে আবার গুলি ভরে আমি বসে রইলাম।
বাঘটি ওকে ছেড়ে চলে যাবার পর মোষটা পড়ে রইল নিস্পন্দ আর আমার বিশ্বাস দৃঢ় হতে থাকল, বাঘের বদলে ওকেই গুলি করেছি আমি। দশ বা পনের মিনিট চলে গেল ঘেঁতিয়ে ঘেঁতিয়ে, তখন আমার নিচের কুলুঙ্গি থেকে দ্বিতীয়বার বাঘের মাথা বেরিয়ে এল। আবার এক দীর্ঘ বিরতি, তারপর অতি ধীরে বাঘটি বেরোল, চলে গেল মোষটির কাছে, ওর দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে রইল। নিশানা করার জন্যে পুরো লম্বা পিঠটা পাচ্ছি, দ্বিতীয়বার আর ভুল করছি না আমি। অতি যত্নে সাইটগুলি মেলানো হল। ট্রিগার টেপা হল ধীর গতিতে। কিন্তু যেমনটি আশা করেছিলাম, সেভাবে মরে পড়ে যাওয়ার বদলে বাঘটি বাঁদিকে লাফিয়ে উঠল, ছোট একটি উপ-গিরিখাত ধরে ছিঁড়ে খুঁড়ে ওপরে উঠল এবং খাড়াই পাহাড় ধরে ওঠার সময়ে পাথর ঠাইনাড়া করে ফেলতে ফেলতে গেল।
ত্রিশ গজ পাল্লার মধ্যে, অপেক্ষাকৃত উজ্জ্বল আলোয় দুটি গুলি ছোঁড়া হল। আশ-পাশের উদ্বিগ্ন গ্রামবাসীরা তা শুনল। একটি তো বটেই, সম্ভবত দুটি বুলেটের গর্তই এক মরা মোষের গায়ে। হয় আমার দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হচ্ছে নয়তো পাহাড়ে চড়াই ওঠার সময়ে আমি সমানের সাইটটি নড়িয়ে দিয়েছি। কিন্তু ছোট ছোট জিনিস লক্ষ্য করে দেখলাম দৃষ্টিশক্তিতে কোনো গণ্ডগোল ঘটে নি, এবং নলটির দৈর্ঘ্য বরাবর একবার তাকাতেই বোঝা গেল সাইটগুলি ঠিকই আছে। অতএব দুবার বাঘটি ফসকে যাবার কারণ হিসেবে বলতে পারি নিকৃষ্ট গুলি ছোঁড়া।
তৃতীয়বার বাঘটি ঘুরে আসার কোনো সম্ভাবনা নেই। আর যদিবা আসেও, তবু যখন আলো উজ্জ্বলতর ছিল, তখন ওকে যখন মারতে পারি নি, এই কম আলোতে ওকে শুধু জখম করাই যাবে হয়তো। তাতে কিছুই লাভ হবে না। এ পরিস্থিতিতে এ কার্নিসে বেশিক্ষণ থেকে লাভ কিছু নেই আমার।
সারাদিনের পরিশ্রমের ফলে আমার জামাকাপড় তখনো স্যাৎসেঁতে। ঠান্ডা বাতাস বইছিল আর বোঝা যাচ্ছিল তা আরো ঠান্ডা হবে। আমার হাফ প্যান্ট পাতলা খাকির আর পাথরটি কঠিন ও শীতল, এবং গ্রামে আমার অপেক্ষায় আছে গরম এক পেয়ালা চা। এসব যুক্তি যত ভালই হক, আমি যেখানে আছি সেখানেই থেকে যাবার আরো শ্রেষ্ঠতর, আরো বিশ্বাসযোগ্য কারণ আছে-বাঘিনীটি।
এখন বেশ অন্ধকার। আমার এবং গ্রামের মধ্যিখানে নুড়ি বেছানো এক গিরিখাত ধরে সিকি মাইল হাঁটা পথ এবং নিবিড় ঝোপ-জঙ্গলের ভেতর দিয়ে আঁকাবাঁকা পথ। গ্রামবাসীদের সন্দেহ, ওরা আগের দিন যে বাঘটিকে দেখেছে, পরিষ্কার যেটিকে আমি এখনই গুলি করেছি–সেটিই নরখাদক বাঘিনী। সেটি কোথায় আছে সে বিষয়ে আমি নির্দিষ্ট কিছুই জানি না। এই মুহূর্তে ও পঞ্চাশ মাইল দূরেও থাকতে পারে, আবার পঞ্চাশ গজ দূর থেকে আমায় নজর করছে তাও হতে পারে। তাই আমার বসার জায়গাটি যত অসুবিধাই হক না কেন সাবধানী বুদ্ধি বাতলে দিল, যেখানে আছি সেখানেই থাকা উচিত হবে আমার।
দীর্ঘ ঘণ্টাগুলি ঢিকিয়ে টিকিয়ে যেতে থাকল, আমার বিশ্বাস বদ্ধমূল হতে থাকল। যে রাতে মানুষখেকো শিকার এমন কোনো প্রমোদ নয় যাতে আমার মন নেচে ওঠে। দিনের আলোর সময়ে যদি জানোয়ারটিকে মারা না যায়, বুড়ো হয়ে মরার জন্যে ওকে ফেলে রেখে যেতে হবে। এ বিশ্বাস আরো দৃঢ় হল যখন গুলি ছোঁড়ার পক্ষে প্রয়োজনীয় আলো ফুটতেই আমি ঠান্ডায় জমে আড়ষ্ট হয়ে উত্রাই নামতে থাকলাম এবং শিশিরভেজা পাথরে পিছলে শূন্যে ঠ্যাং তুলে আমার অবরোহণ সমাপ্ত করলাম। সৌভাগ্যক্রমে নিজের বা রাইফেলের কোনো ক্ষতি না করে বালির ওপরে পড়েছিলাম।
তখন যদিও খুবই ভোর, তবু গ্রামটি জেগে উঠে পড়ল এবং অচিরে আমি একটি ছোট্ট জমায়েতের মধ্যে পড়লাম। চারপাশের সাগ্রহ প্রশ্নের উত্তরে আমি শুধু বলতে পারলাম, বিনা গুলিতে আমি এক কল্পিত বাঘকে ফায়ার করছিলাম।
গনগনে আগুনের কাছে বসে এক পট চা পান আমার ভেতরে ও বাইরে তাপ ফিরিয়ে আনতে যথেষ্ট সহায়তা করল। তারপর, গ্রামের অধিকাংশ পুরুষ ও বালকসহ, আমার নৈশ কীর্তিস্থলের সরাসরি উঁচুতে গিরিখাদের ওপর দিয়ে একটি পাথর যেখানে উঁচিয়ে এগিয়ে আছে সেখানে গেলাম আমি। জমায়েত ভিড়ের কাছে আমি সব খুলে বললাম। আবার নিচের কুলুঙ্গি থেকে বাঘটি বেরিয়েছিল, লাফিয়ে পড়েছিল মোষটির ওপর, আমি ওটাকে গুলি করার পর যেমন করে বাঘটা ও-ই দিকে পালায়, আর যেমন গিরিখাতটি দেখিয়েছি, এক উত্তেজিত চিৎকার শোনা গেল “দেখ সাহেব! ওই যে বাঘটা মরে পড়ে আছে!
রাতভোর পাহারা দেওয়ার ফলে আমার চোখ ক্লান্ত কিন্তু এদিক থেকে ওদিকে বারবার চেয়ে দেখেও অস্বীকার করার উপায় রইল না যে বাঘটা মৃত অবস্থায় ওখানে পড়ে আছে। বিশ বা ত্রিশ মিনিট গেলে পরে কেন আমি দ্বিতীয়বার গুলি ছুঁড়লাম এই অতি স্বাভাবিক প্রশ্নের উত্তরে আমি বললাম, ঠিক একই জায়গা থেকে বাঘটি। দ্বিতীয়বারও বেরিয়েছিল এবং যখন ও মোষটির কাছে দাঁড়িয়ে, তখন আমি ওকে গুলি করি আর ও উঠে যায় গিরিখাতটির ও-ই দিকটা ধরে। আর তখনি আবার শোনা গেল চিৎকার, দেখ সাহেব! ওই যে আরেকটা বাঘ মরে পড়ে আছে। এখন তাতে যোগ দিল রমণী ও বালিকারা, ওরা এসে পড়েছিল। দুটি বাঘকে একই মাপের দেখাল এবং আমি যেখান থেকে গুলি করি, তা থেকে ষাট গজ দূরে দুটিই পড়ে ছিল।
এই দ্বিতীয় বাঘটির প্রসঙ্গে প্রশ্ন করতে গ্রামবাসীরা বলল, যখন চারজন মানুষ মারা পড়ে আর আগের দিন যখন বলদটি মারা পড়ে, শুধু একটি বাঘই দেখা গিয়েছিল। বাঘদের মিলন-ঋতু নভেম্বর থেকে এপ্রিল অব্দি টেনে লম্বা করা যায়। চোখের সামনে যে বাঘ দুটো পড়ে আছে। তার একটা যদি নরখাদক বাঘিনী হয়, তবে সে স্পষ্টতই তার এক সঙ্গী জুটিয়েছে।
আমি যেখানে বসেছিলাম তার তলে পাহাড়ের খাড়াই গা দিয়ে নিচে নেমে গিরিখাতে ঢোকার একটি পথ পাওয়া গেল আর গ্রামের সমস্ত মানুষকে সঙ্গে নিয়ে, যেখানে প্রথম বাঘটি পড়ে আছে সেখানে গেলাম মরা মোষটা পেরিয়ে। ওর কাছে যেতে আশা উচ্চে উঠল কেননা ও একটা বৃদ্ধা বাঘিনী। সবচেয়ে কাছের লোকটির হাতে রাইফেলটি দিয়ে আমি হাঁটুতে ভর দিয়ে ঝুকলাম ওর পাগুলো লক্ষ করতে। যে মেয়েরা গম কাটছিল তাদের যেদিন আক্রমণ করতে চেষ্টা করে বাঘিনীটি, সেদিন খেতের কিনারে কয়েকটি চমৎকার থাবার ছাপ রেখে গিয়েছিল। বাঘিনীটির থাবার ছাপ সেই প্রথম দেখি আমি এবং খুব যত্ন করে দেখেছিলাম ওগুলো। ওগুলো জানিয়ে দিয়েছিল, বাঘিনীটি এক অতি বুড়ো জানোয়ার। বার্ধক্যের ফলে তার পায়ের তলাটা বাইরের দিকে ছেতরে গেছে। সামনের পায়ের থাবাগুলোয় ভীষণ ফাটল হয়েছে, সামনের ডান পায়ের থাবা আড়াআড়ি চিরে একটি ফাটল চলে গেছে এবং আঙুলগুলো এত দূর অব্দি লম্বা হয়ে গেছে, যা কখনো অন্য বাঘের দেখিনি আমি। এই বিশেষত্ব-যুক্ত পাগুলির জন্যে একশোটি মরা বাঘের মধ্যেও বাঘিনীটিকে বেছে নেওয়া সহজ হত।
গভীর খেদে লক্ষ করলাম, সামনের জানোয়ারটি নরখাদক নয়। জমা হওয়া লোকের জনতাকে যখন এ খবরটি সরবরাহ করলাম, চারদিক থেকে জোর মতদ্বৈধের গুঞ্জন উঠল। জোর দিয়ে বলা হল যে আমি গতবার আসার সময়ে বলেছিলাম, নরখাদকটি এক বৃদ্ধা বাঘিনী এবং যেখানে সামান্যকাল আগে ওদের চারজন মারা পড়েছে, সেখান থেকে সামান্য ক’গজ দূরে অনুরূপ একটি প্রাণীকেই মেরেছি আমি। এই বিশ্বাস জাগানো নজীরের বিপক্ষে থাবার নজীরের মূল্য কি বা, কেননা সব বাঘের থাবাই একরকম।
এ পরিস্থিতিতে দ্বিতীয় বাঘটি এক মন্দাই হতে পারে, আর যখন বাঘিনীটির চামড়া ছাড়াবার বন্দোবস্ত করছি, ওটাকে আনার জন্যে কয়েকটি মানুষের একটি দল পাঠালাম। উপ-গিরিখাতটি খাড়াই এবং সংকীর্ণ আর প্রচুর চেঁচামেচি ও হাসির পর দ্বিতীয় বাঘটিকে, সে এক চমৎকার মন্দা, তাকে বাঘিনীর পাশে শুইয়ে দেওয়া হল।
আমি যে সব অত্যন্ত অসন্তোষজনক কাজের ভার এ-জীবনে নিয়েছি তার মধ্যে, যে দুটি বাঘ চোদ্দ ঘন্টা হল মরেছে তাদের ছাল ছাড়ানো হল অন্যতম–ক্রমবর্ধমান জনতার ভিড় চেপে ধরছে, পিঠ পুড়ে যাচ্ছে রোদে। দুপুর পেরিয়ে কাজটি শেষ হল এবং আমার লোকজনের নিয়ে যাবার জন্যে চামড়াগুলি ভাল করে বেঁধেছেদে আমি ক্যাম্পে ফেরার জন্য পাঁচ মাইল হাঁটতে প্রস্তুত হলাম।
সকালে আশপাশের গ্রামগুলি থেকে গ্রামমোড়লরা ও অন্যরা এসেছিল। চলে আসার আগে আমি ওদের দৃঢ় বিশ্বাসে বললাম, চৌগড়ের নরখাদক বাঘিনী মরে নি। ওদের হুঁশিয়ারী জানালাম, বাঘিনীটি যে সুযোগের অপেক্ষায় আছে, সতর্কতা ব্যবস্থায় ঢিলে দিলে পরে ওর হাতে সেই সুযোগই তুলে দেওয়া হবে। আমার হুশিয়ারীতে যদি কান দেওয়া হত, তাহলে পরবর্তী মাসগুলিতে বাঘিনী যতগুলি শিকার ধরে, তা সে ধরত না।
বাঘিনীর আর কোনো খবর ছিল না এবং ডালকানিয়ায় কয়েক সপ্তাহ থাকার পর, তরাইয়ে জেলা অফিসারের সঙ্গে দেখা করার কথা রাখার জন্য আমি বিদায় নিলাম।
.
০৩.
১৯৩০ সালের মার্চ মাসে আমাদের জেলা কমিশনার ভিভিয়ান নরখাদক বাঘিনী অধিরাজ্যে টুর করেছিলেন এবং সে মাসের ২২শে আমি তার কাছ থেকে, কালাআগারে যাবার জরুরী তলপ পেলাম। তিনি জানালেন সেখানে তিনি আমার যাবার জন্য অপেক্ষা করবেন। নৈনিতাল থেকে কালাআগারে আন্দাজ পঞ্চাশ মাইল এবং ভিভিয়ানের চিঠি পাবার দুদিন বাদে আমি প্রাতরাশের সময় থাকতে কালাআগার ফরেস্ট বাংলোয় হাজির হলাম, সেখানে তিনি ও মিসেস ভিভিয়ান উঠেছিলেন।
প্রাতরাশ খেতে খেতে ভিভিয়ানরা আমাকে বললেন, তারা ২৯শের বিকেলে বাংলোতে পৌঁছান এবং যখন তাঁরা বারান্দায় চা খাচ্ছেন, বাংলোর উঠনে যে ছয়টি মেয়ে ঘাস কাটছিল, তাদের মধ্যে একজনকে বাঘিনী মারে ও নিয়ে যায়। তাড়াতাড়ি করে রাইফেলটা আরও’র সঙ্গীদের কয়েকজনকে নিয়ে ভিভিয়ান হেঁচড়ে টেনে নেবার দাগটি অনুসরণ করেন ও একটি ওক গাছের পায়ের কাছে মৃতা মেয়েটিকে পান। তাকে একটি ঝোপের নিচে গুঁজে ঢুকিয়ে রাখা হয়েছিল। সে জমি পরে পরখ করে আমি দেখি, যে ভিভিয়ানে দলটি পৌঁছতে বাঘিনী পাহাড়ের উত্রাই বেয়ে পালায় ও তখন যা যা করা হয়, সে সময়ের আগোগোড়াটা মড়ি থেকে পঞ্চাশ গজ দূরে একটি র্যাস্পবেরি ঝোঁপঝাড়ের মধ্যে বাঘিনীটি বসে থাকে। ওক গাছে ভিভিয়ানের জন্যে একটি মাচা বাঁধা হয়, ওঁর কর্মীদলের সদস্যদের জন্যে আরো দুটি মাচা বাঁধা হয় যে জঙ্গুলে পথ মড়িটির ত্রিশ গজ উপর দিয়ে গেছে তার কাছাকাছি গাছগুলিতে। মাচাম তৈরি হতেই তাতে বসে পড়া হয় এবং দলটি সারারাত বসে থাকে। কিন্তু বাঘিনীর আর দেখা মেলে না।
পরদিন মেয়েটির দেহ সৎকারের জন্য সরিয়ে নেওয়া হয়। বাংলো থেকে আধ মাইল দূরে জঙ্গুলে রাস্তার ওপর একটি মোষ বেঁধে রাখা হয় এবং সেই রাতেই সেটা মারা পড়ল বাঘিনীর হাতে। পরের সন্ধ্যায় ভিভিয়ানরা মোষটি রেখে মাচায় উঠলেন। চঁদ ছিল না, আর দিনের আলো যেই ক্ষণ হতে থাকল, কাছের সব কিছু আবছা দেখাল। ওরা প্রথমে শুনলেন, পরে দেখলেন একটি জানোয়ার মড়ির কাছে আসছে। সে অনিশ্চিত আলোতে তাঁরা সেটিকে এক ভাল্লুক বলে ভুল করলেন। এই শোচনীয় ভুল না হলে তাদের এই অত্যন্ত প্রশংসযোগ্য চেষ্টার ফল হত বাঘিনীর মরণ। কেননা ভিভিয়ানরা দুজনেই ভাল রাইফেলশিকারী।
২৫ তারিখে ভিভিয়ানরা কালাআগার ছেড়ে চলে গেলেন। দিনমানের মধ্যে ডালকানিয়া থেকে আমার চারটি মোষ চলে এল। যেহেতু মনে হচ্ছে এখন বাঘিনীটি এ ধরনের টোপ খেতে রাজী আছে। জঙ্গল পথে কয়েকশো গজ তফাতে তফাতে আমি মোষগুলিকে বেঁধে দিলাম। পরপর তিন রাত্তির মোষগুলিকে স্পর্শ না করে বাঘিনীটি ওদের কয়েক ফুটের মধ্যে দিয়ে চলে গেল কিন্তু চতুর্থ রাতে বাংলোর সবচেয়ে কাছের মোষটি মারা পড়ল।
সকালে মড়িটি পরীক্ষা করে দেখে নিরাশ হলাম। আগের রাতে বাংলোর উঁচুতে যে এক জোড়া চিতাকে ডাকতে শুনেছি, তাদের হাতেই মারা পড়েছে মোষটি। পাছে বাঘিনীটি দূরে চলে যায় এই ভয়ে, এ অঞ্চলে গুলি ছোঁড়ার চিন্তাও আমার পছন্দ নয় তবে এও পরিষ্কার, যদি চিগুলোকে গুলি না করি, ওরা বাকি তিনটে মোষকেও মেরে ফেলবে। তাই, মড়ির উপরের কয়েকটি বড় বড় পাথরে ওরা যখন রোদ পোহচ্ছিল তখন ওদের তাক করে দুটোকেই মেরে ফেললাম।
কালাআগার বাংলো থেকে জঙ্গুলে পথটি বহু মাইল চলে গেছে পশ্চিমপানে পাইন, ওক ও রডোড্রেনডনের অতি অপূর্ব জঙ্গলের মধ্য দিয়ে এবং এই সব বনে, কুমায়ুনের বাকিটুকর তুলনায় পাখির জগতের এক বিপুল সম্পদ তো আছেই; তাছাড়াও সম্বর, কাকার ও শুয়োর জাতীয় প্রচুর আহার্য পশু আছে। দুবার এ জঙ্গলে বাঘিনীটি সম্বর মেরেছে বলে আমার সন্দেহ কিন্তু যদিও দুবারই যেখানে জানোয়ারটি মারা পড়েছে সেই রক্তাক্ত জায়গাটি খুঁজে পেয়েছি, কিন্তু দুটি মড়ির একটিও খুঁজে পাই নি। ব্যর্থ হয়েছি।
পরের চোদ্দদিন ধরে দিনের আলো যতক্ষণ থাকে, তার প্রতিটি ঘণ্টা কাটালাম জঙ্গুলে পথে। তাতে আমি ছাড়া কেউ কোনোদিন পা দেয় নি। কিন্তু এত কষ্ট স্বীকার করার পর মাত্র দু’বার আমি বাঘিনীর কাছে যেতে পেরেছিলাম। প্রথমবার কালাআগার শৈলশিরার দক্ষিণ গায়ে অনেক দূরের একটা একটেরে গ্রামে গিয়েছিলাম আমি। নরখাদক বাঘিনীর অত্যাচারে গত বছর গ্রামটি পরিত্যাগ করা হয়। ফিরতি পথে ধরেছিলাম একটা গো-পথ। সেটি শৈলশিরা টপকে নেমে গেছে নিচের দিকে আঙ্গুলে পথটির দূরের দিক ধরে। তখন এক পাথুরের স্তূপের কাছে এসে আমার এক আকস্মিক অনুভূতি হল–সামনে বিপদ।
শৈলশিরা থেকে জঙ্গলে পথের দূরত্ব প্রায় তিনশো গজ। গো-পথটি শৈলশিরা ছাড়ার পর কয়েক গজ খাড়াই নেমে গেছে এবং তারপর ডাইনে ঘুরেছে ও একশো গজ ধরে পাহাড়ের ওপর কোনাকুনি গেছে। পথটির এই জায়গায় লম্বালম্বি ডান দিকে মাঝামাঝি জায়গায় পাথরের স্তূপ। পাথরগুলির ওপারে চুলের কাটার মত এক মোড় পথটিকে নিয়ে গেছে বাঁয়ে এবং আরো একশো গজ এগিয়ে আরেকটি বেয়াড়া মোড় এটিকে নামিয়ে নিয়ে গেছে, যেখানে জঙ্গুলে পথের সঙ্গে এ পথটি মিশেছে সেই জায়গায়।
এ পথ ধরে বহুবার গেছি আমি এবং এই প্রথম পাথরগুলো পেরোতে ইতস্তত করছি। ওগুলি এড়াতে হলে হয় আমাকে বহুশত গজ পথ গভীর ঝোপ-জঙ্গলের মধ্য দিয়ে যেতে হয়, নয়তো ওগুলি ঘুরে, ওগুলির ওপরের জমি দিয়ে অনেক জায়গা ছেড়ে ঘুরে যেতে হয়। প্রথমটি দিয়ে যেতে হলে বিপদের ঝুঁকি নিতে হয় বেশি আর পরেরটির কোনো সময় পাচ্ছি না, কেননা সূর্য ডোবে ডোবে, আমাকে আরো দু মাইল যেতে হবে।
তাই, আমি এ কাজ করতে চাই, বা না চাই, পাথরগুলির সামনে দিয়ে যাওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। পাহাড়ের চড়াই পানে বইছে বাতাস, অতএব পথের বাঁ ধারের ঘন ঝোঁপ উপেক্ষা করে চলে যেতে পারলাম। আমার ডানদিকের পাথরের স্তূপের ওপর আমার সমস্ত মনোযোগ দিলাম। একশো ফুট গেলেই আমি বিপদ-এলাকা মুক্ত হই আর এ দুরত্ব আমি পেরোলাম পাথরগুলির দিকে মুখ করে কাঁধে রাইফেল রেখে, পাশের দিকে এক পা এক পা করে হেঁটে। এগোবার এক আশ্চর্য রীতি। কেই যদি দেখত!
পাথরগুলি পেরিয়ে ত্রিশ গজ গিয়ে এক ফাঁকা ঘেসো জমি। গো-পথের ডানদিক থেকে সেটির শুরু। তা পাহাড় পর্যন্ত পঞ্চাশ বা ষাট গজ অব্দি উঠে গেছে। পাথরগুলি থেকে ঝোপের বেড়ায় তা আড়াল করা। এই ঘেসো জমিতে চরছিল এক কাকার। ও আমায় দেখার আগেই ওকে দেখলাম আমি আর চোখের কোণ থেকে লক্ষ করলাম ওকে। আমাকে দেখে ও মাথা পেছনে ঠেলে ওঠাল এবং যেহেতু আমি ওর দিকে চাইছি না, চলছি ধীর গতিতে, ও দাঁড়িয়ে গেল চুপ-চাপ। এই জানোয়ারগুলির যখন ধারণা হয় কেউ ওদের দেখতে পায়নি, এই রকম করাই ওদের অভ্যাস। সেই চুলের কাটা সদৃশ তীক্ষ্ণ মোড়ে এসে আমি ঘাড়ের পেছন দিয়ে চাইলাম। দেখি কাকারটি মাথা নামিয়েছে, আবার ঘাস খাচ্ছে।
মোড়টি পেরোবার পর পথ ধরে আমি সামান্য দূর এগিয়েছি, তখন উদ্ৰান্ত ভয়ে ডাকতে ডাকতে কাকারটি পাহাড় ধরে ছুটে উঠে গেল। সামান্য কয়টি লম্বা পা ফেলে আমি মোড়টিতে চলে এলাম আবার। গো-পথের নিচের দিকে পাশের ঝোপে একটুখানি নড়াচড়া মাত্র দেখতে পেলাম। কাকারটি যে বাঘিনীকে দেখেছে, তা সুস্পষ্ট এবং পথের ওপরটি হল একমাত্র জায়গা যেখানে ও তাকে দেখতে পারে। যে নড়াচড়া দেখেছি আমি তা এক পাখির চলে যাবার কারণে হতে পারে, অপরপক্ষে ওটি বাঘিনীটির কারণেও হতে পারে। যা হক নিজের গন্তব্যে এগনোর আগে একটু তদন্ত করা দরকার।
যে লালা মাটিতে পথটি রচিত, তা স্যাঁতসেঁতে করে তুলেছে পাথরগুলির তলা থেকে চুঁইয়ে বেরুনো একটি ক্ষীণ জলের সুতো। ফলে মাটিটা থাবার ছাপ পড়ার পক্ষে একেবারে আদর্শ। এই ভিজে মাটিতে আমি পায়ের ছাপ রেখে হেঁটে গেছি। এখন দেখলাম, যতক্ষণ না কাকারটি ওকে দেখে বিপদ জানাতে ডাকতে থাকে, ততক্ষণ ধরে ও পাথর থেকে লাফিয়ে নেমে আমাকে অনুসরণ করছে। আমার পায়ের দাগের ওপর দিয়ে বাঘিনীর ছেরে পড়া থাবার ছাপ। তখন বাঘিনীটি পথটা ছেড়ে ঝোপে ঢুকে পড়ে ও সেখানেই আমি তার নড়াচড়া দেখি। এ জায়গার প্রতি ফুট জমির সঙ্গে বাঘিনীটি নিঃসন্দেহে পরিচিত এবং পাথরের স্তূপের কাছে আমাকে মারবার সুযোগ না পেয়ে–প্রথম চুলের কাটার মত মোড়ে আমাকে পাকড়াবার সুযোগ কাকারটি নষ্ট করে দেওয়াতে সম্ভবতও এখন চলেছে সেই নিবিড় ঝোঁপ-ঝাড়ের মধ্য দিয়ে। দ্বিতীয় মোড়ে আমাকে বাধা দেবার জন্যে।
পথ দিয়ে আরো এগনো এখন বুদ্ধিসম্মত নয়, তাই ফাঁকা ঘেসো জমি ধরে চড়াই অব্দি গেলাম কাকারটির পেছন পেছন। বাঁকে মোড় নিয়ে ফাঁকা জমি ধরে পথ করে নামলাম নিচে, তলার জঙ্গুলে পথে। আমার বিশ্বাস, যথেষ্ট দিনের আলো থাকলে সে সন্ধ্যাতেই আমি বাঘিনীর ভাগ্যের পাশা উল্টে দিতে পারতাম। কেননা পাথরের স্কুপের আড়াল ছেড়ে ও বেরোবার পর থেকে সকল অবস্থাই ছিল আমার অনুকূলে। এ জায়গাটি ও যত ভাল চেনে, আমিও তা চিনি। আর ওর বিষয়ে আমার উদ্দেশ্য কি তা সন্দেহ করার ওর কোনো কারণ নেই। আমার সুবিধে হল, আমার বিষয়ে ওর কি উদ্দেশ্য তা খুব পরিষ্কার জানি। যাই হক যদিও অবস্থা আমার অনুকূলে, সন্ধ্যা গড়িয়ে গিয়েছে বলে আমি সে অবস্থার সুযোগ নিতে পারলাম না।
যে ইন্দিয়ানুভব আমাদের আসন্ন বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করে দেয়, তার উল্লেখ আমি অন্যত্র করেছি। এই অনুভব খুবই বাস্তব। আর কিসে যে এটিকে কার্যকরী করে তা আমি জানি না বলেই ব্যাখ্যা দিতে পারব না। এটুকু বলার বাইরে এ বিষয় নিয়ে আর কথা বাড়াব না। এইবারটিতে, বাঘিনীকে আমি দেখি নি বা শুনি নি; কোনো পাখি বা পশুর কাছে ওর উপস্থিতি বিষয়ে কোনো জানানও পাই নি। তবু, নিঃসংশয়ে আমি জেনেছিলাম ও আমার জন্যে পাথরের স্তূপে ওঁৎ পেতে বসে আছে। সেদিন অনেক ঘণ্টা আমি বাইরে ছিলাম, সাবধানতায় ঢিলে দিয়ে জঙ্গলের বহু মাইল পার করেছিলাম। কিন্তু একটি মুহূর্তের জন্যেও অস্বস্তি হয় নি। তারপর, শৈলশিরার চূড়া পেরিয়ে পাথরগুলি নজরে আসতেই আমি জেনেছিলাম ওখানে আমার বিপদ আছে এবং কয়েক মিনিট বাদে জঙ্গলের জানোয়ারদের উদ্দেশে কাকারটি সতর্কতাজ্ঞাপক ডাক ও আমার পায়ের দাগের ওপর দিয়ে বাঘিনীর থাবার ছাপ আবিষ্কারের ফলে, আমার অনুভব যে সত্যি, তাই প্রমাণ হল।
.
০৪.
এই কাহিনীতে এতদূর অবধি আমার সঙ্গে সঙ্গে আসার ধৈর্য যেসব পাঠকের আছে বলে দেখা গেল, তাদের আমি-বাঘিনীটির সঙ্গে আমার প্রথম ও শেষ সাক্ষাৎকারের পরিষ্কার এক বিশদ বর্ণনা দিতে চাই।
কালাআগারে আমি পৌঁছবার উনিশ দিন বাদে, ১৯৩০ সালের ১১ই এপ্রিল সে সাক্ষাৎকার ঘটে।
জঙ্গলের পথে জায়গা বেছে বেছে আমার তিনটি মোষকে বাঁধার উদ্দেশ্যে সেদিন আমি দুপুর দুটোয় বেরিয়ে গিয়েছিলাম। বাংলো থেকে এক মাইল দূরে এক জায়গায়, যেখানে পথটি একটি শৈলশিরা পার হয় ও কালাআগার শৈলমালার উত্তর থেকে পশ্চিম পানে যায়, সেখানে আমি বড় একদল মানুষকে দেখলাম। ওরা জ্বালানী কাঠ সংগ্রহ করতে এসেছে। সে দলে একটি বৃদ্ধ ছিল। আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছি তা থেকে প্রায় পাঁচশো গজ দূরে পাহাড়ের নিচে, তরুণ এক ওক গাছের এক ঘন সন্নিবেশ দেখিয়ে সে বলল, ওই সন্নিবেশে এক মাস আগে বাঘিনী ওর একমাত্র ছেলে, এক আঠার বছরের তরুণকে মেরেছে।
ওর ছেলের হত্যা বিষয়ে বাপের বক্তব্য আমি শুনি নি, তাই আমরা যখন পথের কিনারে বসে ধূমপান করছি, ও তার কাহিনী বলল। আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল কোথায় ছেলেটি মারা পড়ে, কোথায় পরদিন ওর যা কিছু দেহাবশেষ আবিষ্কৃত হয়। সেদিন যে পঁচিশ জন লোক জ্বালানী কাঠ সংগ্রহ করছিল, তাদেরই ও ছেলের মৃত্যুর জন্য দায়ী করল ও গভীর ক্ষোভে বলল, ওরা পালিয়ে যায়, বাঘের হাতে মারা পড়বার জন্যে ওর ছেলেকে ওরা ফেলে রেখে যায়।
আমার কাছে যারা বসেছিল তাদের মধ্যে কয়েকজন ওই পঁচিশ জনের দলের মধ্যে ছিল। তারা ছেলেটির মৃত্যুর দায়িত্ব উত্তপ্ত কণ্ঠে অস্বীকার করল। বাঘকে গর্জাতে শুনেছে বলে আর্ত চীৎকার করে সকলকে জান বাঁচাতে পালাতে বলে উন্মত্ত হুড়োহুড়ি বাধিয়ে দেবার জন্যে ওরা বুড়োকেই দায়ী করল। এ কথা বুড়োর মনোমত হল না। ও মাথা নাড়ল, ‘তোমরা বয়স্ক পুরুষ, ও ছিল বালকমাত্র, তোমরা পালিয়ে গেলে আর মারা পড়বার জন্যে ফেলে গেলে ওকে। যে সব প্রশ্ন থেকে ওই উত্তপ্ত তর্ক শুরু হল সেগুলি জিজ্ঞাসা করেছি বলে আমি দুঃখিত হলাম। এতে যা ফল হবে, তার চেয়ে বেশি ওই বুড়োকে ঠাণ্ডা করা যাবে বলে আমি বললাম, যেখানে ওর– ছেলে মারা পড়েছে বলে বলছে ও, সে জায়গাটির কাছে আমার একটা মোষ বেঁধে দেব। তাই, বাংলোতে ফিরিয়ে নেবার জন্যে দুটি মোষকে ওই দলটির হাতে দিয়ে, বাকি মোষটি সহ আমরা দুজন লোককে পেছন নিয়ে রওনা হলাম।
আমরা যেখানে বসেছিলাম তার কাছাছাকছি জায়গা থেকে একটি পায়ে-চলা পথ পাহাড় বেয়ে নিচের উপত্যকায় নেমে গেছে। দুমাইল সামনের জঙ্গুলে পথে গিয়ে পড়বার জন্যে উলটো দিকে পাইন ঢাকা পাহাড়ের ঢাল বেয়ে সে পথ এঁকেবেঁকে উঠে গেছে। যে ওক ঝাড়ে ছেলেটি মারা পড়েছে, তা ঘিরে এক খণ্ড ফাঁকা জমি। পথটি সে জমির কাছ দিয়ে গেছে। এই খোলা জমিটি প্রায় ত্রিশ বর্গগজ, তাতে একটি মাত্র পাইন চারা। গাছটিকে কেটে ফেললাম। মোষটাকে বাঁধলাম কাটা গোড়ায়; একটি লোককে লাগিয়ে দিলাম ওর জন্যে ঘাস কাটতে। আরেকজন হল মাধো সিং। তাকে তুলে দিলাম একটি ওক গাছে। বলে দিলাম, ও কুড়োলের মাথা দিয়ে একটা শুকনো ডালে ঘা মারবে আর পাহাড়ের মানুষ পালিত পশুর জন্যে পাতা কাটার সময়ে যেমন গলা ছেড়ে চেঁচায় তেমন করে চেঁচাবে। এই মাধো সিং মহাযুদ্ধে গাড়োয়ালী ফৌজে কাজ করেছে, ও এখন য়ুনাইটেড প্রভিনস সিভিল পায়োনীয়র ফোর্সে কাজ করছে। তারপর ফাঁকা জমির নিচের দিকের কিনারে আন্দাজ চার ফুট উঁচু একটি পাথরে জায়গা করে নিয়ে বসলাম আমি। ওই পাথরের ওপারে পাহাড়টি খাড়াই নেমে গেছে নিচের উপত্যকায় এবং গাছ ও গুল্ম জঙ্গলে তা ঘন করে ঢাকা। যে লোকটি নিচে ছিল, সে যে ঘাস কেটেছে তা নিয়ে বহুবার যাওয়া আসা করল। গাছের ওপরে বসে মাধো সিং একবার চেঁচাচ্ছিল, একবার গাইছিল গলা ছেড়ে। আমি পার্থরটিতে দাঁড়িয়ে ধূমপান করছিলাম, রাইফেলটি ছিল আমার বাম বাহুর কোলে, হঠাৎ জানতে পারলাম নরখাদক বাঘিনীটি এসে গেছে। নিচে যে লোকটি ছিল তাকে হাতছানি দিয়ে তাড়াতাড়ি আমার কাছে আসতে বলে শিস দিয়ে মাধো সিংয়ের মনোযোগ আকর্ষণ করলাম এবং ওকে চুপ করে থাকার জন্য ইশারা জানালাম। তিন দিকের জমি তুলনামূলকভাবে খোলা। আমার সামনে বাঁ দিকে গাছের ওপরে মাধো সিং, যে ঘাস কাটছিল সে লোকটি আমার সামনে ডান দিকে, আর মোষটি আমার সামনে বাঁ দিকে–এখন ও অস্বস্তির লক্ষণ দেখাচ্ছে। আমার অদেখায় বাঘিনীটি এ জায়গায় এগোতে পারে না। আর যেহেতু সে এসে হাজির হয়েছে, একটি মাত্র জায়গায় এখন থাকতে পারে ও, তা হল আমার ঠিক নিচে, পেছনে।
যখন বসি, লক্ষ করেছিলাম, পাথরটি দুরের দিকে পাশে খাড়াই এবং মসৃণ। ওটি পাহাড়ের ঢালে আট বা দশ ফুট বিস্তৃত হয়ে গেছে, আর জায়গাটির নিচের অংশটি নিবিড় ঝোপ-জঙ্গল ও ছোট পাইন চারায় আড়াল করা। পাথরটিতে উঠে পড়া বাঘিনীটির পক্ষে সামান্য কঠিন হবে তবে তা ওর সাধ্যের মধ্যে। ও যদি সে চেষ্টা করে তাহলে ঝোপ-জঙ্গলে ওর আওয়াজ পাওয়ার ওপর আমার নিরাপত্তার জন্যে নির্ভর করলাম।
মাধো সিং যে চেঁচামেচি করছিল তাতেই আকৃষ্ট হয় বাঘিনী। ও তাই হক এই আমি চেয়েছিলাম। এতে আমার কোনো সন্দেহ নেই। ও এসেছিল পাথরটির কাছে আর যখন আমার দিকে মুখ তুলে চেয়েছিল এবং পরের চাল ভাজছিল, তখন আমি ওর উপস্থিতির কথা আঁচ করি। লোকগুলির নীরবতা আর আমার যুদ্ধ ফ্রন্ট পালটে ফেলায় ওর হয়তো সন্দেহ হয়েছে। যাই হক, কয়েক মিনিটের বিরতি গেলে পরে পাহাড়ের উৎরাইয়ে একটু নিচে একটা শুকনো ডাল ভাঙতে শুনলাম। তারপর অস্বস্তির বোধ চলে গেলে আমার, উত্তেজনায় টান টান ভাবাটা ঢিলে হল।
একটি সুযোগ নষ্ট হল, তবে এখনো একটি গুলি মারার খুব ভাল সুযোগ আছে আমার। কেন না নিঃসন্দেহে ও শীঘ্রই ফিরে আসবে আর যখন দেখবে আমরা নেই তখন হয়তো মোষটিকে মেরেই সন্তুষ্ট থাকবে। এখনো দিনের আলো চার বা পাঁচ ঘন্টা আছে আর উপত্যকাটি পেরিয়ে গিয়ে উলটো দিকের ঢাল ধরে উঠলে পরে যে পাহাড়ের গায়ে মোষটি খুটিতে বাঁধা আছে তার সবটা দেখতে পাব আমি। যদি ছুঁড়তে পারি তবে গুলি ছোঁড়া হবে দুই থেকে তিনশো গজ লম্বা পাল্লায়, কিন্তু যে ২৭৫ রাইফেল বইছিলাম, সেটি নির্ভুল নিশানী এবং যদি আমি বাঘিনীটিকে শুধু জখমই করি, অনুসরণ করতে রক্তের নিশানা পাব। এই এতগুলো মাস ধরে যা করেছি, সেই শত শত বর্গ মাইল জঙ্গল হাঁটকে ওর খোঁজ করার চেয়ে তা বরং ভালই হবে।
লোকগুলিকে নিয়ে মুশকিল। ওদের একা বাংলোয় ফেরত পাঠানো খুন করার চেয়ে কিছু কমতি হত না, তাই বাধ্য হয়েই ওদের আমার সঙ্গেই রাখলাম।
খোঁটার সঙ্গে মোষটিকে এমন করে বাঁধলাম যাতে বাঘিনীর পক্ষে ওকে বয়ে নিয়ে যাওয়া অসম্ভব হয়, আমি ফাঁকা জমিটি ত্যাগ করলাম এবং উলটোদিকের পাহাড় থেকে গুলি করতে চেষ্টা করবার যে পরিকল্পনা ছকেছি, তা কার্যকরী করার জন্য আবার গেলাম পথটিতে।
পথটি দিয়ে আন্দাজ একশো গজ চলে আমি এলাম একটি গিরিখাতে। এটির দুরের দিকে পথটি ঢুকে গেছে অতি নিবিড় ঝোঁপজঙ্গলে। যেহেতু পেছনে দুজন লোক নিয়ে আমার ঘন ঝোপে ঢোকা বুদ্ধিসম্মত নয়, গিরিখাতটি ধরা, উপত্যকার সঙ্গে গিরিখাতের সন্ধি অবধি ওটি ধরে চলা, বেয়ে উপত্যকায় ওঠা, এবং ঝোঁপজঙ্গলের দূরের দিকের পথটি আবার ধরা এই সিদ্ধান্তই করলাম।
গিরিখাতটি আন্দাজ দশ গজ চওড়া এবং চার বা পাঁচ ফুট গভীর। যেমন এটিতে নেমেছি, যে পাথরে আমি হাত রেখেছিলাম তা থেকে উড়ে গেল একটি পাহাড়ী-রাতচরা পাখি ডানা ঝটপটিয়ে। যেখান থেকে পাখিটি উড়ে গেল, সেখানে চেয়ে দেখি দুটো ডিম। এই গাঢ় বাদামী রঙের দাগ দেওয়া খড় রঙা ডিমগুলির আকার যেমন, তা সচরাচর দেখা যায় না। একটি লম্বা ও বেজায় সূচলো, অন্যটি মার্বেলের মত নিটোল গোল। যেহেতু আমার সংগ্রহে পাহাড়ী রাতচরার ডিম নেই, এই বেখাপ্পা ডিম দুটো তাতে যোগ করা মনস্থ করলাম। ডিম নেবার মত কোনো জিনিসই ছিল না আমার, তাই বাঁ হাতে আধমুঠো করে তাতে ডিম দুটো রাখলাম, একটু শ্যাওলা দিয়ে দুটিকে মুড়লাম।
আমি যেমন গিরিখাতে নামতে লাগলাম, পাড়গুলো উঁচু হতে থাকল। যেখানে আমি গিরিখাতে প্রবেশ করেছি সেখান থেকে ষাট গজ দূরে বার থেকে চোদ্দ ফুট গভীরে এক উত্রাইয়ের মুখে এলাম আমি। বৃষ্টির সময়ে এই সব পার্বত্য গিরিখাত দিয়ে যে জলের তোড় নামে তা পাথরগুলিকে ক্ষইয়ে ক্ষইয়ে কাঁচের মত মসৃণ করে ফেলেছে এবং যেহেতু তা পা রাখার পক্ষে খুবই অসুবিধাজনক, তাই একজনকে, রাইফেলটি দিলাম এবং কিনারে বসে ঘষটে-ঘষটে নামতে শুরু করলাম।
আমার পা তলার বালি ছুঁয়েছে সবে, তখন দুটি লোকই উড়ন্ত লাফ মেরে একেকজন আমার একেক পাশে এসে পড়ল ও আমার হাতে রাইফেল গুঁজে দিয়ে পরম উৎকণ্ঠায় জিজ্ঞেস করল, আমি বাঘের কিছু শুনেছি কি না। সত্যি বলতে কি, সম্ভবত পাথরের ওপরে আমার পোশাকের ঘষড়ানির কারণেই শুনি নি আমি কিছুই। আর যখন প্রশ্ন করলাম, ওরা বলল খুব কাছে কোথাও বাঘের চাপা গর্জন শুনেছে ওরা। কিন্তু সঠিক কোন দিক থেকে আওয়াজটি এল, তা তারা বলতে পারল না।
যখন শিকারের খোঁজ করছে তখন গর্জন করে বাঘরা তাদের উপস্থিতি ফাস করে দেয় না। এর একমাত্র সন্তোষজনক ব্যাখা আমি দিতে পারি তা হল, আমরা ফাঁকা জমিটি ত্যাগের পরই বাঘিনী আমাদের পেছু নেয়, আর আমরা গিরিখাত ধরে যাচ্ছি দেখে, যেখানে খাতটি যতটা চওড়া, তা থেকে সরু হয়ে গেছে আধাআধি, সেখানে দাঁড়ায়। আর যখন ও আমার ওপর লাফ মারতে যাবে, তখনি আমি পিছনে নামার ফলে চোখের আড়াল হয়ে যাই এবং বাঘিনী অনিচ্ছাতেই ওর আশাভঙ্গ প্রকাশ করে ফেলে একটি নিচু গর্জনে। খুব সন্তোষজনক যুক্তি নয়, বিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই, তবু যদি কেউ ধরে নেয়, যে শিকারের জন্যে ও আমাকেই বেছেছিল অতএব ঐ দুটি মানুষে কোনো আগ্রহ দেখায় নি।
আমার তিনজন দল বেঁধে যেখানে এখন দাঁড়িয়ে আছি, আমাদের পেছনে আছে সেই মসৃণ ও খাড়াই পাথর। আমাদের ডানদিকে পনের ফুট উঁচু একটি পাথরের দেওয়াল গিরিখাতের দিকে সামান্য ঝুঁকে আছে, এবং আমাদের বাঁ দিকে আছে ত্রিশ বা চল্লিশ ফুট উঁচু ছড়িয়ে থাকা বড় বড় পাথরের এক পাড়। যার ওপর দাঁড়িয়ে আছি আমরা, গিরিখাতের সেই বালি ঢাকা বুকটি আন্দাজ চল্লিশ ফুট লম্বা এবং দশ ফুট চওড়া। বালি-ঢাকা বুকের নিচের কিনারে একটি অতিকায় পাইন গাছ আড়াআড়ি পড়ে বাঁধ রচনা করেছে খাতটিতে এবং এই বাঁধের কারণে প্রচুর বালি জমেছে। পড়ে থাকা গাছটি থেকে আন্দাজ বার বা পনের ফুট দূরে সেই হেলে থাকা পাথরের দেওয়ালটি শেষ হয়েছে এবং আমি যেমন বালির ওপর দিয়ে নিঃশব্দ চরণে, দেওয়ালটির শেষটায় পৌঁছলাম অতীব সৌভাগ্যবশে লক্ষ করলাম, পাথরটির পেছন অব্দি চলে গেছে বালির বুক।
এই যে পাথরটির কথা এত করে বলছি, এটিকে আমি এক অতিকায় স্কুলস্লেট বললে সব চেয়ে ভাল বর্ণনা দেওয়া হয়। নিচের দিকে এটি দু ফুট পুরু এবং এটি দাঁড়িয়ে আছে একটি লম্বা হয়ে যাওয়া পাশের ওপর ভর রেখে। দাঁড়ানোটি যে একেবারে সোজা, তা নয়।
এই অতিকায় স্লেট পেরিয়ে গিয়ে ডান দিকে ঘাড় ফিরিয়ে পেছন পানে তাকালাম আমি এবং তাকাতেই সিধে বাঘিনীটির সঙ্গে মুখোমুখি।
আপনারা পরিস্থিতিটির পরিষ্কার ধারণা পান, তাই চাই আমি।
পাথরটির পেছনে বালুর বুকটি বেশ সমান সমান। তার ডানদিকে সেই বাইরের দিকে ঈষৎ হেলে থাকা পনের ফুট উঁচু সুমসৃণ স্লেট, বাঁদিকে এক ঘষা লেগে ক্ষয়ে যাওয়া খাড়াই পাড়। এটিও পনের ফুট উঁচু এবং এর গা দিয়ে ঝুলে পড়েছে কাঁটা ঝোপের এক সুনিবিড় জাল। এর দূরের দিকে আমি যে পাথর ধরে পিছলে নেমেছিলাম তারই মত আরেকটি সুমসৃণ পাথরে তবে এটি অপেক্ষাকৃত উঁচু। প্রকৃতিদেবীর তৈরি এই তিনটি দেওয়ালে ঘেরা বালির বুকটি প্রায় বিশ ফুট লম্বা এবং তার অর্ধেক চওড়া। আর সামনের থাবা দুটি সামনে এগিয়ে রেখে, পেছনের পা দুটি ভেতরে গুটিয়ে বসে আছে বাঘিনীটি তারই উপরে। ওর মাথা থাবা থেকে কয়েক ইঞ্চি ওঠানো এবং আমার থেকে আট ফুট দূরে (পরে মাপা হয়) এবং ওর মুখে এক হাসি। দীর্ঘ অনুপস্থিতির পর কোনো কুকুর তার প্রভুকে বাড়িতে স্বাগত জানালে তার মুখে যেমন হাসি দেখা যায়, এ যেন তেমনি এক হাসি।
দুটি চিন্তা ঝিলিক দিয়ে গেল আমার মনে; একটি–প্রথম ‘মার’ আমি মারব। সে ব্যাপারে এখন আমাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। অপরটিসে ‘মার’ মারতে হবে এমন পন্থায় যাতে বাঘিনী চমকে ভয় না পায় অথবা নার্ভাস না হয়।
রাইফেল আমার ডান হাতে, আমার বুকের পরে কোনাকুনি করে ধরা। তার সেফটি ক্যাচ খোলা এবং বাঘিনীর ওপর তাক করতে গেলে নলটিকে এক বৃত্তের তিন-চতুর্থাংশ ঘোরাতে হবে।
এক হাতে রাইফেল ঘোরাবার ব্যাপারটি শুরু করা হল অত্যন্ত একটু একটু করে, চোখে যেন পড়ে না প্রায় এই ভাবে, এবং যখন বৃত্তের এক-চতুর্থাংশ ঘোরানো হল, রাইফেলের বাঁট ঠেকল আমার শরীরের ডাইনে। এখন বাহু ছড়ানো দরকার এবং যেমন বাঁটটি আমার গা থেকে সরল, সরানোর কাজটি চলতে থাকল খুব তিলে তিলে। আমার বাহু এখন পুরো মেলে রেখেছি আর রাইফেলটির ওজনের ভার এখন টের পাচ্ছি। নলটি আর সামান্য ঘুরতে বাকি এবং বাঘিনীটিও একবারও আমার চোখ থেকে চোখ সরায় নিও এখনো মুখ তুলে চেয়ে আছে আমার দিকে, এখনো ওর মুখে সেই খুশির অভিব্যক্তি।
বৃত্তের তিন-চতুর্থাংশ ঘুরতে কত সময় লাগল রাইফেলের তা সঠিক বলার মত অবস্থা আমার নয়। বাঘিনীর চোখের দিকে তাকিয়ে আছি বলে নলের গতিবিধি চোখে দেখতে পাচ্ছি না। আমার মনে হল, আমার হাতটা অসাড় হয়ে গেছে, এই বৃত্তে ঘোরা কোনদিন সম্পূর্ণ হবে না। যাই হক, বৃত্ত ঘোরা সম্পূর্ণ হল অবশেষে, আর যেই রাইফেলটি বাঘিনীর শরীর তাক করল, আমি ট্রিগার টিপলাম।
জায়গাটি চাপা, তাই গুলির আওয়াজ অনেক বেশি জোরে হতে শুনলাম আমি। রাইফেলের পিছু ধাক্কায় ঝাঁকানি টের পেলাম, এবং রাইফেল যে ফায়ার করেছে, সে ঘটনার এইসব বাস্তব প্রমাণ না থাকলে পরে–সে গুলির ফল যদিও হাতে হাতে দেখা গেল তবু আমি সেই এক ভয়ংকর দুঃস্বপ্নের কবলেই থেকে যেতাম। যে দুঃস্বপ্নে সংকটের মুহূর্তে ট্রিগার বৃথাই টেপা হয়, রাইফেল গুলি ছুঁড়তে নারাজ হয়।
খুব সামান্য সময় বাঘিনী নিস্পন্দ রইল। সময়ের সে খণ্ড অংশটি যেন টের পাওয়া গেল। তারপর, অতি ধীরে ওর মাথা ডুবে গেল ওর সামনে মেলে রাখা থাবার ওপরে–একই সঙ্গে বুলেটের গর্ত থেকে বেরিয়ে এল রক্তের একটি ফিনকি। বুলটেটি ওর শিরদাঁড়া জখম করে এবং ওর হৃৎপিণ্ডের উপরাংশ ছিন্নভিন্ন করে দেয়।
যে দুটি লোক কয়েক গজ তফাতে আমার পেছু পেছু আসছিল, পাথরটি শুরু হয়েছে বলে বাঘিনী থেকে তফাত হয়ে পড়েছিল, তারা যখন দেখে আমি থামলাম, মাথা ফেরালাম, ওরাও দাঁড়িয়ে পড়ল। ওরা টের পেয়ে যায় যে আমি বাঘিনীটিকে দেখেছি এবং আমার আচরণ দেখে বোঝে বাঘিনী কাছেই আছে। মাধো সিং পরে বলে ও চেঁচাতে চেয়েছিল। আমাকে বলতে চেয়েছিল ডিমগুলো ফেলে দিয়ে দুহাতে রাইফেল ধরতে।
যখন গুলি ছুঁড়লাম এবং রাইফেলের মাথা নামিয়ে রাখলাম আমার পায়ের আঙুলে, আমার ইঙ্গিতে মাধো সিং এগিয়ে এল আমার হাত থেকে ওটা নিতে। কেননা হঠাৎ আমার পাগুলো যেন আমার শরীরের ভার বইতে পারছে না বলে মনে হল। তাই আমি পড়ে থাকা গাছটির কাছে গেলাম ও বসলাম। ওর পায়ের নিচের নরম অংশের দিকে চেয়ে দেখার আগেই আমি জেনে গিয়েছিলাম এ. সেই চৌগড়ের বাঘিনী। আমি ওকে পাঠিয়েছি আনন্দ মৃগয়া কাননে। চৌষট্টিটি মানুষের জীবনের সূত্র কাটতে-যে কাচি ওকে সহায়তা করেছিল, জিতের খেলা ওর হাতে থাকতে থাকতেই সে কচি ঘুরে দাঁড়িয়েছে, কেটে দিয়েছে ওরই জীবনের সূত্র। জেলার লোকরা অবশ্য সংখ্যাটিকে ওর দ্বিগুণ করে ধরে।
তিনটি ব্যাপার আসলে আমার অনুকুলে ছিল, তার প্রত্যেকটিকে আমার প্রতিকূল বলে আপনাদের মনে হবে। তা হল, (ক) আমার বাঁ হাতের ডিমগুলো, (খ) যে হালকা রাইফেল বইছিলাম আমি এবং (গ) বাঘিনীটি হল এক নরখাদক।
আমার হাতে যদি ডিমগুলো না থাকত, তবে আমার দু হাতই থাকত রাইফেলে আর যখন আমি পিছনে ফিরতাম ও অত কাছে বাঘিনীকে দেখতাম, সহজাত প্রবৃত্তি বশেই ওর মুখোমুখি হবার জন্যে বোঁ করে ঘুরে যেতাম আমি। আর আমার তরফে নড়াচড়া ছিল না বলে ওর তরফে যে লাফিয়ে পড়া রুখে যায়, তা তখন কার্যকরী করা হতই হত।
আবার, রাইফেলটি যদি হালকা না হত, তাহলে ওটি যেভাবে ঘোরানো অবশ্য দরকার ছিল, সেভাবে ঘোরানো এবং আমার হাত সম্পূর্ণ মেলে রেখে ওটি ছোঁড়া আমার পক্ষে সম্ভব হত না।
সর্বশেষে, বাঘিনীটি যদি নরখাদক না হয়ে সাধারণ এক বাঘিনী হত, যেই দেখত নিজে কোণঠাসা, অমনি ফাঁকায় পালাবার জন্যে ঝাঁপ দিত, আমাকে পথ থেকে সরিয়ে দিয়ে যেত। এবং বাঘ পথ থেকে সরিয়ে দিলে পরে সাধারণত তার ফল প্রাণঘাতী হয়।
লোকগুলি যখন অনেকখানি জায়গা জুড়ে ঘুরে গিয়ে মোষটিকে খুলে দড়িটি যোগাড় করতে পাহাড়ের ওপরে উঠে গেল, আমি পাথরগুলি টপকে উঠে গিরিখাতের ভাটি ধরে গেলাম ন্যায্য মালিকের কাছে ডিমগুলো ফেরত দিতে। দড়িটি এখন আরো আনন্দজনক আরেকটি কাজের জন্যে দরকার। আমার শিকারী ভায়েরা যেমন, আমিও তেমনি কুসংস্কারে বিশ্বাসী বলে দোষ মানছি। এক বছরের চেয়েও বেশি সময় তিনবার দীর্ঘ সময় ধরে চেষ্টা করেছি। কঠিন চেষ্টা করেছি বাঘিনীটিকে একটি গুলি মারার সুযোগ পেতে এবং ব্যর্থ হয়েছি। আর এখন, ডিমগুলি তুলে নেবার অল্প কয়েক মিনিটের মধ্যেই আমার ভাগ্য প্রসন্ন হল।
এতক্ষণ ধরে আমার হাতের মুঠোতেই নিরাপদে ছিল ডিমগুলি। যখন আমি ওগুলিকে পাথরের সেই ছোট্ট গর্তে ফিরিয়ে রাখলাম, ওগুলো তখনো গরম। গর্তটি নীড়ের কাজ করছিল। আর যখন আধঘন্টা বাদে আবার ও পথটি পেরোলাম, ডিমগুলি তখন অদৃশ্য হয়েছে তা-দান নিরত মায়ের নিচে। ওর গায়ের রং ছিটছিটে পাথরটির সঙ্গে এমন মিলে গেছে, যে আমি তো সঠিক জানি নীড়টি কোথায় আছে, আমার পক্ষেও চারপাশে থেকে পাখিটিকে তফাত করা কঠিন হয়েছিল।
এত মাস যত্নে থাকার ফলে মোষটি এখন এমন পোষা হয়েছে যে ওটি অনুসরণ করতে থাকল কুকুরের মত। লোকদের পিছু পিছু ও পাহাড় বেয়ে হাঁচড়ে-পাঁচড়ে নেমে এল, বাঘিনীটিকে শুকল এবং অতীব সন্তোষজনক জাবর কাটতে শুয়ে পড়ল বালিতে-তখন, লোকদুটি যে পোক্ত খুঁটি কেটেছে, আমরা বাঘিনীকে তার সঙ্গে বাঁধলাম।
বাংলোয় ফিরে গিয়ে আরও লোক আনার জন্যে আমি মাধো সিংকে তাওয়াতে চেষ্টা করি, কিন্তু সে তা করবার কোনো আগ্রহ-ই দেখাল না। ও এবং ওর সঙ্গী নরখাদকটাকে বইবার সম্মান আর কারো সঙ্গে ভাগ করে নেবে না। ও বলল, আমি যদি হাত লাগাই তবে জিরোবার জন্যে ঘন ঘন থেমে চললে এ কাজ খুব কঠিন হবে না। আমরা তিনজনই বলিষ্ঠকায় দুজন শৈশব থেকে ভারি বোঝা বইতে অভ্যস্ত–তিনজনই রোদে পুড়ে জলে ভিজে শক্তপোক্ত। তবুও যে কাজ করলাম তা শুধু হারকিউলিসের সাধ্য এক কাজ।
যে লম্বা খুঁটিতে বাঘিনীকে বাঁধা হল, তা বইবার পক্ষে যে পথে আমরা উত্রাই নেমেছিলাম তা বড় বেশি সংকীর্ণ, বড় বেশি পেঁচানো পেঁচানো। তাই, দম ফিরে পেতে এবং খুঁটিটি ঘাড়ের মাংসপেশীতে বড় বেশি কেটে-বসা, বাঁচাবার জন্যে রাখা পুরু কাপড়টি বারবার সামলাবার কারণে ঘনঘন থেমে থেমে, র্যাপবেরি এবং বন-গোলাপের কাঁটাঝোপের এক জড়াজড়ি জঙ্গল দিয়ে আমরা সিধেপাহাড়ের ওপরপানে চললাম। ওগুলোর কাটায় আমাদের পোশাক এবং চামড়ার বেশ খানিকটা রেখে গেলাম-ফলে বহুদিন ধরে স্নান করা এক যন্ত্রণার ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
চারদিকের পাহাড়ের ওপরে সূর্য তখনো জ্বলছে, তখন তিনজন বিস্রস্ত বেশ অতীব সুখী মানুষ একটি মোষকে পেছনে নিয়ে বাঘিনীটিকে বয়ে নিয়ে এল কালাআগার ফরেস্ট বাংলোয়। আর সেই সন্ধ্যা থেকে আজ অবধি, যে শত শত বর্গ মাইল ব্যাপী পাহাড় ও উপত্যকার ওপর পাঁচ বছর সময়কাল ধরে চৌগড়ের বাঘিনী জবরদখল রেখেছিল, সেখানে কোনো মানুষ নিহত বা জখম হয় নি।
আমার সামনের দেওয়ালে যে পূর্ব কুমায়ুনের ম্যাপ ঝুলছে তাতে আমি আরেকটি চিহ্ন ও দিনাঙ্ক যোগ করেছি। ওই ক্রচিহ্ন ও দিনাঙ্ক নরখাদক বাঘিনীটির অর্জিত। ক্রচিহ্নটি কালাআগারের দু মাইল পশ্চিমে এবং ওর নিচের দিনাঙ্ক হল ১১ই এপ্রিল, ১৯৩০।
বাঘিনীর নখগুলো ভেঙে ক্ষয়ে গিয়েছিল, ওর একটি কুকুর-দাঁত ভাঙা ছিল, সামনের দাঁতগুলো হাড় অব্দি ক্ষয়ে গিয়েছিল। এই সকল অঙ্গহানিই ওকে নরখাদকে পরিণত করেছিল। আমার প্রথম যাত্রায় ভুল করে আমি ওর যে শাবককে মারি, যেদিন থেকে তার সহায়তা লাভে ও বঞ্চিত হয়, সেদিন থেকে ও যে মানুষদের আক্রমণ করত তাদের অধিকাংশকেই ও তখনি নিজের সামর্থ্যে মেরে ফেলতে পারে নি–এই অঙ্গহানিগুলি তার কারণ বটে।