আমার ভারত – জিম করবেট
উৎসর্গ
আপনি যদি এই পাতাগুলিতে ভারতবর্ষের ইতিহাস খোঁজেন, কিংবা ব্রিটিশ রাজের অভ্যুদয় ও পতনের একটি বিবরণ; অথবা জানতে চান যে এই উপমহাদেশটি কী কারণে পরস্পর-বৈরভাবাপন্ন দুটি অংশে খণ্ডিত হল; এবং পরিণামে খণ্ডদেশ দুটির শেষ অবধি এশিয়ার কি হবে; এখানে তা পাবেন না। কারণ, যদিও এই দেশেই আমি একটি জীবন-কাল কাটিয়ে দিয়েছি, তবু আমি ঘটনাগুলির কেন্দ্রের এতটা কাছে ছিলাম আর এই রঙ্গমঞ্চের অতিনেতাদের সঙ্গে এত বেশি ঘনিষ্ঠভাবে সংশ্লিষ্ট ছিলাম যে, সে সব নিরপেক্ষভাবে লিপিবদ্ধ করতে হল যে পরিপ্রেক্ষিতের প্রয়োজন তা আমি পাই নি।
আমার ভারত, যে ভারতকে আমি জানি, সেই ভারতে যে চল্লিশ কোটি মানুষের বাস, তার মধ্যে শতকরা নব্বই জনই সরল, সৎ, সাহসী, আর কঠোর পরিশ্রমী। ভগবানের কাছে-তা সে ক্ষমতায় যে-কেউই আসীন থাকুক না কেন–তাদের প্রতিদিনের প্রার্থনা শুধু এইটুকুই যে, তাদের ধনপ্রাণ যেন নিরাপদ থাকে, যাতে তারা তাদের পরিশ্রমের ফল উপভোগ করতে পায়। সত্যিই এরা বড় গরিব। এদের প্রায়শই ‘ভারতের বুভুক্ষু কোটি-কোটি মানুষ’ বলে বর্ণনা করা হয়ে থাকে। এদের মধ্যেই আমি বাস করেছি এবং এদের আমি ভালবাসি। এই নরনারীদের কথাই এই বইয়ের পাতায় বলার চেষ্টা করেছি। আমার বন্ধু, ভারতের সেই গরিবদের উদ্দেশ্যে আমি আমার এই বইখানি শ্রদ্ধাভরে উৎসর্গ করলাম।
.
প্রস্তাবনা
আমার উৎসর্গপত্রটির পর আপনি প্রশ্ন করতে পারেন : যাদের কথা বলছেন ভারতের সেই গরিব মানুষ কারা? ‘আমার ভারত’ কথাটা দিয়ে আপনি কি বোঝাতে চান? প্রশ্ন দুটি ন্যায্য। উত্তর-দক্ষিণে দু’হাজার মাইলের কিছু বেশি, এবং পূর্ব-পশ্চিমেও প্রায় ততটাই বিস্তৃত এই বিশাল উপ-মহাদেশের যে-কোনো অধিবাসীকে বোঝাতে হলেই ‘ভারতীয়’ শব্দটা ব্যবহার করা দুনিয়ার লোকের একটা অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গিয়েছে। ভূগোলের দিক থেকে দেখলে শব্দটিতে আপত্তি করা চলে না বটে, কিন্তু খোদ মানুষগুলির বেলায় এ শব্দটা ব্যবহার করার সময় আর-একটু স্পষ্ট করে বলাই উচিত।
এই শব্দটা যথেচ্ছ ব্যবহার করার ফলে অনেক ভুল-বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছে। ভারতের চল্লিশ-কোটি নরনারী একদিকে যেমন সারা ইউরোপের চাইতেও অনেক বেশিসংখ্যক জাতি উপজাতি এবং বর্ণে বিভক্ত, অপর দিকে তারা ধর্ম-বিশ্বাসের দিক । থেকেও পৃথক। যে সব পার্থক্য এক দেশ থেকে আর এক দেশকে পৃথক বলে চিহ্নিত করে, এই বিভেদগুলি তার চাইতে কম গভীর নয়। জাতি নয়, ধর্মই ভারত-সাম্রাজ্যকে হিন্দুস্থান ও পাকিস্তানে বিভক্ত করেছিল। তাই, এই বইখানির নামের অর্থ কি, সেটা বলি।
‘আমার ভারত’ গ্রামের জীবন ও কাজকর্ম সম্বন্ধে যে চিত্রগুলি দেওয়া হয়েছে, তা প্রকাণ্ড এক দেশের শুধু এমন কয়েকটি জায়গা নিয়ে, যা আমার ছোটবেলা থেকে চেনা, যেখানে আমার কর্মক্ষেত্র ছিল। আর, যে সরল মানুষগুলির জীবনযাত্রা এবং স্বভাক চরিত্র সম্বন্ধে কয়েকটি আলেখ্য আপনাদের কাছে উপস্থিত করতে চেয়েছি, সেই ধরনের লোকের মধ্যেই আমি জীবনের ৭০ বছরের বেশির ভাগ কাটিয়েছি।
ভারতবর্ষের একখানা ম্যাপের দিকে তাকান। ভারত-উপদ্বীপের দক্ষিণতম বিন্দু, কন্যাকুমারিকা অন্তরীপটি খুঁজে বের করুন। সেখান থেকে চোখ সোজা উপরে নিয়ে যান যেখানে উত্তরপ্রদেশের উত্তরে গাঙ্গেয় সমতলভূমি ক্ৰমে উঁচু হয়ে উঠতে-উঠতে গিয়ে হিমালয়ের পাদ-শৈলীশ্রেণীকে ছুঁয়েছে। এখানেই উত্তরপ্রদেশ সরকারের গ্রীবাস শৈলনগরী নৈনিতাল। এপ্রিল থেকে নভেম্বর মাস পর্যন্ত গ্রীষ্মের হাত এতে ইউরোপীয় এবং ধনী ভারতীয়রা সমতল থেকে এখানে এসে ভিড় জমায়।
শীতকালে সেখানে বাস করে শুধু কয়েকজন স্থায়ী বাসিন্দা। জীবনের বেশিরভাগ সময় আমি এদেরই একজন ছিলাম। এবার এই শৈলনগরী ছেড়ে আপনাদের দৃষ্টিকে নামিয়ে নিয়ে চলুন গঙ্গানদীর সঙ্গে-সঙ্গে সমুদ্রের পথে-এলাহাবাদ, বারাণসী আর পাটনা ছাড়িয়ে। শেষে পৌঁছবেন মোকামা ঘাট। ভারতের এই দুটি জায়গাকে কেন্দ্র করেই আমার এই চিত্রগুলির পটভূমিকা।
অনেকগুলি পায়ে-চলার পথ ছাড়াও একটি মোটর রাস্তা দিয়েও নৈনিতালে পৌঁছনো যায়। রাস্তাটির জন্যে আমরা গর্বিত। সে গর্ব অহেতুক নয়, কারণ সমানভাবে তৈরি করা এবং ভারতের সবচেয়ে সুন্দর ও সুরক্ষিত পাহাড়ী রাস্তা বলে এর খ্যাতি আছে।
রেলপথের শেষ স্টেশন কাঠগুদাম থেকে বেরিয়ে বাইশ মাইল লম্বা এই রাস্তাটি এমন সব জঙ্গলের ভিতর দিয়ে গিয়েছে যার মধ্যে কখনও-কখনও বাঘ আর মারাত্মক শঙ্খচূড় সাপের দেখা মেলে। ক্রমশ উঁচু হতে-হতে রাস্তাটি সাড়ে চার হাজার ফুট উঁচুতে উঠে নৈনিতালে এসে পৌঁছেছে। নৈনিতাল পূর্ব-পশ্চিমে বিস্তৃত একটি উন্মুক্ত উপকা। তিন দিক তার পাহাড়ে ঘেরা। এটাই নৈনিতালের সবচেয়ে ভাল বর্ণনা। তার মধ্যে সবচেয়ে উঁচু ‘চিনা’ পাহাড়টির উচ্চতা ৮৫৬৯ ফুট। মোটরের রাস্তাটি এসে যেদিক দিয়ে ঢুকছে সেইদিকটাই এর খোলা।
উপত্যকাটির কোলে একটি হ্রদ। তার পরিধি হবে মাইল-দুয়েক। হ্রদটির উপরের মাথায় একটি ঝরনা বার মাস তাকে জল যোগাচ্ছে। অপর প্রান্তে মোটরের রাস্তাটি যেখানে শেষ হয়েছে, সেখানে জল উপচে পড়ছে। উপত্যকাটির উপরে আর নিচের প্রান্তে বাজার চারিদিক গাছে ঢাকা পাহাড়ে ঘেরা। তার গায়ে ঘরবাড়ি, গির্জা, স্কুল, ক্লাব, হোটেল ইত্যাদি যেন ছিটনো রয়েছে। হ্রদটির তীরের কাছে কয়েকটা নৌকো রাখার ঘর, ছবির মত একটি অতি পবিত্র শিলা-মন্দির। একজন বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ পুরোহিত এর অধ্যক্ষ। তিনি আমার দীর্ঘদিনের বন্ধু।
হ্রদটির উৎপত্তির কারণ সম্বন্ধে ভূতত্ত্ববিদদের মধ্যে মতভেদ আছে। কেউ কেউ বলেন যে এর সৃষ্টি হয়েছে হিমবাহ এবং পাহাড়ের ধস থেকে, আবার কেউ বলেন, আগ্নেয়গিরির উদগীরণ থেকে।
হিন্দু কিংবদন্তীতে কিন্তু হ্রদটির জন্যে কৃতিত্ব দেওয়া হয় তিনজন প্রাচীন ঋষি–অত্রি, পুলস্তা, এবং পুলহকে। পবিত্র গ্রন্থ স্কন্দ-পুরাণে লেখা আছে যে এই তিনজন ঋষি একবার প্রায়শ্চিত্তের জন্যে তীর্থযাত্রায় বেরিয়ে চিনা পর্বতের শিখরে এসে পড়েন। সেখানে তৃষ্ণা নিবারণের জন্যে জল না পেয়ে তারা পর্বতের পাদদেশে একটি গর্ত খুঁড়ে, তিব্বতের পবিত্র হ্রদ মানস-সরোবর থেকে জল এনে তাতে ঢালেন। ঋষিরা চলে যাওয়ার পর নৈনী দেবী এখানে এসে হ্রদের জলে আঁর আসন পাতেন।
কালক্রমে খাতটির চারপাশ অরণ্যে ছেয়ে যায়, এবং জল আর গাছপালার আকর্ষণে পশুপাখিরা প্রচুর সংখ্যায় এসে এই উপত্যকায় বাসা বাঁধে। দেবীর মন্দিরের চার মাইল ব্যাসার্ধের মধ্যে অন্যান্য জীবজন্তু ছাড়াও আমি বাঘ, চিতা, ভালুক আর সম্বর হরিণ দেখেছি, এবং একশো আটাশ জাতের পাখি চিনতে পেরেছি।
অনেকদিন আগেই এই হ্রদটির অস্তিত্ব সম্বন্ধে জনরব ভারতের এই অঞ্চলের, শাসকদের কানে এসে পৌঁছেছিল। কিন্তু পাহাড়ী লোকেরা তো তাদের পবিত্র হ্রদটির অবস্থানের কথা প্রকাশ করতেই চায় না। তখন ১৮৩৯ খ্রিস্টাব্দে অন্যতম এক শাসক একটি কূট-কৌশল বের করলেন। একজন পাহাড়িয়ার মাথায় একখানা পাথর চাপিয়ে দিয়ে তাকে বলা হল যে নৈনী দেবীর হ্রদে না পৌঁছনো পর্যন্ত তাকে ওটা বইতে হবে। অনেকদিন ধরে পাহাড়ে-পাহাড়ে ঘুরে পাথরখানা বয়ে-বয়ে লোকটি শেষে ক্লান্ত হয়ে পড়ল। তখন সে আর না পেরে তার অনুগামী দলটিকে পথ দেখিয়ে হ্রদটিতে নিয়ে গেল।
যে-পাথরখানা সে বয়ে নিয়ে এসেছিল বলে বলা হয়, সেটা একজন আমাকে দেখিয়েছিল। তখন আমি ছোট ছিলাম। যখন আমি বললাম যে একজন লোকে বইবার পক্ষে পাথরখানা একটু বেশী বড় (তার ওজন প্রায় সাড়ে সাত মণ হবে), তখন যে পাহাড়ী লোকটি আমাকে ওটা দেখিয়েছিল সে বললে, হা, পাথরখানা বড়ই বটে; কিন্তু একথাটা ভুল না যে আমাদের জাতের লোকেরা সেকালে ভীষণ জোয়ান হত।
এবার একজোড়া ভাল দূরবীন জোগাড় করে আমার সঙ্গে চলে আসুন চিনা-র চূড়ায়। নৈনিতালের চারপাশের এলাকাটা আপনি এখান থেকে মোটামুটি একনজরে দেখতে পাবেন। যাবার পথটা খাড়া ঠিকই। কিন্তু পাখি, গাছ আর ফুল সম্বন্ধে যদি আপনার কৌতূহল থাকে তাহলে এই তিন মাইল চড়াই ভাঙা আপনি গ্রাহ্যই করবেন না। চূড়ায় পৌঁছতে-পৌঁছতে যদি সেই তিনজন ঋষির মত আপনিও তৃষ্ণার্ত হয়ে ওঠেন, তাহলে পিপাসা মেটাবার জন্যে আমি আপনাকে স্ফটিক-স্বচ্ছ একটা ঠান্ডা জলের ঝরনা দেখিয়ে দেব।
একটু বিশ্রাম করে আর দুপুরের খাওয়াটা সেরে নিয়ে উত্তর দিকে ফিরুন এবার। আপনার ঠিক নিচেই ঘন জঙ্গলে ঢাকা একটি উপত্যকা চলে গিয়েছে কোশী নদী পর্যন্ত। নদীর ওপাশে কয়েকটা সমান্তরাল শৈলশিরা, তাদের গায়ে এখানে-সেখানে ছিটেফোঁটার মত কয়েকটা গ্রাম। এর একটা শৈলশিরার উপরে আলমোড়া শহর অন্য একটার উপরে রানীখেত ছাউনি। তারও ওধারে আরও অনেকগুলি শৈলশিরা। তাদের মধ্যে উচ্চতম শিখর ‘ডুঙ্গার বাকওয়াল ১৪০০০ ফুট পর্যন্ত মাথা তুলেছে বটে, কিন্তু তুষারাবৃত হিমালয়ের সুবিপুল আকারের সামনে সেটা নেহাত ছোট আর নয়।
আপনার নাক-বরাবর ষাট মাইল উত্তরে হচ্ছে ত্রিশূল। ২৩৪০৬ ফুট উঁচু এই চূড়াটির পূবে আর পশ্চিমে শত-শত মাইল ধরে একটানা চলে গিয়েছে তুষার-পর্বতের সারি। সেই তুষার ত্রিশূল থেকে পশ্চিমে গিয়ে যেখানে দৃষ্টির বাইরে মিলিয়ে গিয়েছে, সেখানে প্রথমে হচ্ছে গঙ্গোত্রী পর্বতসমষ্টি, তারপর কেদারনাথ আর বদ্রীনাথের পবিত্র মন্দির দুটির উর্বে হিমবাহ ও পর্বতশ্রেণী। তারও পরে কামেট শৃঙ্গ, স্মাইদ যাকে বিখ্যাত করে গিয়েছেন। ত্রিশূলের পূর্বদিকে, খানিকটা দূরে আর পিছনে নন্দা দেবীর শুধু চূড়াটিই আপনি দেখতে পাবেন। ২৫৬৮৯ ফুট উঁচু এই পর্বতটি ভারতের উচ্চতম পর্বত।
আপনার সামনেই ডানদিকে নন্দা কোট-ভগবতী পার্বতীর শুভ্র উপাধান। আরও একটু পুবে পঞ্চচুলির রমণীয় শৃঙ্গমালা-তিব্বতে কৈলাস পর্বতে যাবার পথে পাণ্ডবেরা নাকি এই পাঁচটি উনুনে রান্না করেছিলেন। উষার প্রথম আবিভাবকালে যখন চিনা থেকে তুষারাবৃত পর্বতশ্রেণী পর্যন্ত সমস্ত মধ্যবর্তী জায়গা রাত্রির আঁচলের তলায় চাপা পড়ে থাকে, ঐ বরফের চুড়াগুলি তখন নীল থেকে ক্রমে গোলাপী হয়ে উঠতে থাকে। তারপর সূর্য যখন সবচেয়ে উঁচু শিখগুলিকে স্পর্শ করে, তখন সেই গোলাপী রঙটা ধীরে-ধীরে চোখ ঝলসানো সাদা রঙে পরিবর্তিত হয়ে যায়। বেলা বেড়ে গেলে এই পাহাড়গুলিকে দেখায় বর্ণহীন এবং নিরুত্তাপ। প্রত্যেক চুড়ায় সেই চূর্ণ তুষারের একটি করে পালক গোঁজা রয়েছে। অস্তরবির আলোয় দৃশ্যপটটি স্বর্গের শিল্পীর খেয়াল মত গোলাপী, সোনালী কিংবা লাল রঙে রঙিন হয়ে ওঠে।
এবার তুষারের দিকে পিছন ফিরিয়ে দক্ষিণ দিকে তাকান। আপনার দৃষ্টির শেষ সীমায় দেখবেন তিনটি শহর : বেরিলি, কাশীপুর আর মোরাদাবাদ। এদের মধ্যে সবচেয়ে কাছে হচ্ছে কাশীপুর-নাক-বরাবর ধরলে এর দূরত্ব ৫০ মাইল। যে প্রধান রেলপথ কলকাতা থেকে পঞ্জাব গিয়েছে, এই তিনটি শহরই তার উপরে।
রেলপথ থেকে পাদ-শৈলশ্রেণী পর্যন্ত যতটা জায়গা, তাকে তিনটি ফালিতে ভাগ করা যায়। প্রথমে মাইল-কুড়ি চওড়া একফালি চাষের জায়গা; তারপর দশ মাইল চওড়া একফালি ঘাসের রাজ্য, তাকে বলে তরাই’; তারপর মাইল দশেক চওড়া একফালি জমিতে বড় বড় গাছ হয় তাকে বলে ‘ভাবর’। এ অঞ্চলটা একেবারে পাদ-শৈলশ্রেণী পর্যন্ত বিস্তৃত। এর মধ্যে জায়গায়-জায়গায় জঙ্গল পরিষ্কার করা হয়েছে। বহু ছোট-ছোট নদীর জলে পুষ্ট এই উর্বর ভূমিতে ছোট-বড় অনেক গ্রাম গড়ে উঠেছে।
নিকটতম গ্রামসমষ্টি কালাধুঙ্গি হল নৈনিতাল থেকে পনের মাইলের পথ। এরই উপরকার মাথায় দেখতে পাবেন তিন মাইল লম্বা এক প্রাচীর দিয়ে ঘেরা আমাদের গ্রাম ছোটি-হলদোয়ানিকে। নৈনিতাল থেকে নেমে গিয়ে রাস্তাটি যেখানে পাদ-শৈলশ্রেণীর পাশের রাস্তায় এসে পড়েছে, সেই মোড়ের উপরেই আমাদের কুটিরটি। ওখান থেকে শুধু তার চালটা দেখা যাচ্ছে অনেকগুলি বড়-বড় গাছের মধ্যে।
এই এলাকার পাহাড়গুলি প্রায় পুরোপুরিই লৌহ আকরিকে গড়া। উত্তর ভারতে। আকরিক গলিয়ে প্রথম লোহা তৈরি হয়েছিল এই কালাধুঙ্গিতেই। তখন কাঠই ছিল জ্বালানি। তাই ‘কুমাওনের রাজা’ স্যর হেনরি র্যামজের ভয় হল যে ভাবর অঞ্চলের তামাম জঙ্গলটাই শেষে এইসব চুল্লির পেটে যাবে। তিনি সব লোহার কারখানা বন্ধ করে দিলেন।
চিনার উপরে আপনি যেখানে রয়েছেন, সেখান থেকে কালধুঙ্গি পর্যন্ত পাহাড়গুলি নিবিড় শালবনে আচ্ছন্ন। শালগাছ থেকেই আমাদের রেল লাইনের স্লীপারগুলি তৈরি হয়। এর একেবারে কাছেই শৈলশিরার একটি ভাজের কোলে শুয়ে আছে ছোট্ট খুরপাতাল হ্রদটি। তার চারপাশের খেতগুলিতে ভারতের শ্রেষ্ঠ আল উৎপন্ন হয়। দূরে ডানদিকে দেখতে পাবেন সূর্যের আলো গঙ্গার বুকে পড়ে ঠিকরে আসছে, বাঁয়ে দেখতে পাবেন সারদার জলেও অর ঝলকানি। পাদ-শৈলশ্রেণী থেকে এই দুই নদীর নির্গমের দুই জায়গার মধ্যকার ব্যবধান আন্দাজ শ-দুই মাইল হবে।
এবার পূর্বদিকে ফিরুন। আপনার সামনের দিকে, কাছ থেকে খানিক দূর পর্যন্ত বিস্তীর্ণ ভূখণ্ডকে পুরনো গেজেটিয়ার বইয়ে ‘যাট হ্রদের এলাকা বলে বর্ণনা করা হয়েছে। তার মধ্যে অনেক হ্রদই মজে গিয়েছে কয়েকটা তো আমার জীবন কালেই শুকিয়ে গেল। এখন যে-কটা আছে, তাদের মধ্যে বলবার মত চেহারা আছে শুধু নৈনিতাল, সাত-তাল, ভীম-তাল, আর নকুচিয়া-তালের।
নকুচিয়া তালের ওধারে মোচার ডগার মতে চেহারার পাহাড়টি হচ্ছে ছোটি-কৈলাস। ঐ পবিত্র পাহাড়ে জীবহত্যা করা দেবতারা পছন্দ করেন না। শেষ যে লোকটি তাদের এই ইচ্ছার বিরুদ্ধাচরণ করেছিল সে ছিল একজন সৈন্য। যুদ্ধের সময় সে তখন ছুটিতে ছিল। একটা পাহাড়ী ছাগলকে মারতেই কি করে যে তার পা ফসকে গেল, তা বলা যায় না। তারপর, তার দুই সঙ্গীর একেবারে চোখের সামনেই সে হাজার ফুট নিচে উপত্যকায় পড়ে গেল। ছোট-কৈলাস ছাড়িয়ে দেখা যাচ্ছে কালা-আগর শৈলশিরা, যেখানে দু-বছর ধরে আমি চৌগড়ের মানুষখেকো বাঘটাকে খুঁজে বেড়িয়েছিলাম। তারও পিছনে নেপালের পর্বতশ্রেণি স্পষ্ট হতে-হতে দৃষ্টির বাইরে মিলিয়ে গিয়েছে।
এবার মুখ ফেরান পশ্চিমদিকে। কিন্তু তার আগে আপনাকে কয়েকশ ফুট নেমে, চিনা-সংলগ্ন একটি পাথর-ছড়ানো ৭৯৯১ ফুট উঁচু চূড়া দেওপাট্টার উপর দিয়ে গিয়ে গয়গা নিতে হবে। আপনার ঠিক নিচেই গভীর বিস্তীর্ণ আর ঘন বনে ঢাকা একটি উপত্যকা চিনা আর দেওপাট্টার মাঝের থেকে শুরু হয়ে ডাচৌরির ভিতর দিয়ে চলে গিয়েছে কালাধুঙ্গি পর্যন্ত। এখানে যত ফুল আর যত পশুপাখি, হিমালয়ের আর কোথাও এত নেই।
এই অপরূপ উপত্যাকাটির ওধারে পাহাড়ের পর পাহাড় একটানা গঙ্গা পৰম্ভ চলে গিয়েছে–দেখতে পাবেন যে একশো মাইলেরও বেশি দূরে তার জল রোদে চকচক করছে। আর, গঙ্গার ওধারে রয়েছে শিবালিক পর্বতমালা। মহান হিমালয় যখন জন্মায়নি, তখনও এই পর্বতমালা প্রাচীন বলেই গণ্য হত।
.
১. গাঁয়ের রানী
চিনা শিখর থেকে আপনি একনজরে যে-সব গ্রাম দেখেছিলেন, এবার আমার সঙ্গে তার একটিতে আসুন। পাহাড়ের গায়ে এধার থেকে ওধার পর্যন্ত যে সমান্তরাল দাগের আঁচড়গুলি দেখছেন, সেগুলো হল ধাপে-ধাপে তৈরি খেত। এদের মধ্যে কয়েকটা হাত-ছয়েকের বেশি চওড়া নয়, তাদের ঠেকনো-দেওয়া পাথরের দেওয়ালগুলো জায়গায়-জায়গায় বিশ হাত উঁচু। এই সরু-সরু খেতের একধারে খাড়া পাহাড়ের গা, অন্যধারেও পাহাড় অনেকটা খাড়া নেমে গিয়েছে।
চাষ করা এখানে ভারি শক্ত আর বিপজ্জনক কাজ। সেটা সম্ভব হয় শুধু এই কারণে যে এখানকার লাঙলের বাঁট ছোট, আর হালের বলদগুলো পাহাড়িয়া বলে ছোট আর গাঁট্টাগোট্টা চেহারার। ছাগলের মত, তাদেরও পা কখনও ফসকায় না।
যেসব সাহসী মানুষ অসীম পরিশ্রম করে এই ধাপওয়ালা খেতগুলো তৈরি করেছে, তারা বাস করে স্লেটপাথরের ছাউনি-দেওয়া পাথরের একসারি বাড়িতে। ভাবর অঞ্চল আর তার ওপারের সমতল ভূমি থেকে এসে যে সরু এবড়ো-খেবড়ো পথটি হিমালয়ের মধ্যে চলে গিয়েছে, তারই ধারে এই কুটিরগুলি রয়েছে।
এই গ্রামের লোকেরা আমাকে জানে। মোকামা ঘাটে কাজ করতে-করতে আমি একবার তাদের একখানা জরুরী টেলিগ্রাম পেয়ে একটা মানুষখেকো বাঘের হাত থেকে তাদের বাঁচাবার জন্যে তৎক্ষণাৎ চলে এসেছিলুম। টেলিগ্রামটা করবার জন্যে সারা গ্রামের লোককে চাঁদা দিতে হয়েছিল, আর হরকরা দিয়ে সেটাকে পাঠানো হয়েছিল নৈনিতালে।
যে-ঘটনার ফলে টেলিগ্রামটা পাঠানো হয়েছিল, সেটা ঘটেছিল ঐ কুটিরশ্রেণীর ঠিক উপরকার একটা খেতে, দিন-দুপুরে। একটি স্ত্রীলোক আর তার বার বছরের একটি মেয়ে গমের ফসল কাটছিল, এমন সময় হঠাৎ একটা বাঘ এসে পড়ল। মা তাকে রক্ষা করবে এই ভেবে মেয়েটি মার কাছে ছুটে যাবার চেষ্টা করতেই বাঘটা এক লাফে তার ধড় থেকে মাথাটা খসিয়ে ফেলে, শূন্যেই তার দেহটাকে লুফে নিয়ে এক লাফে খেতের ধারের জঙ্গলে চলে গেল। মুণ্ডটাকে ফেলে গেল মার পায়ের কাছে।
সব টেলিগ্রামই–এমনকি জরুরী টেলিগ্রামও–পোঁছতে অনেক সময় লেগে যায়। আমাকেও হাজারখানেক মাইল আসতে হল রেলগাড়ি আর অন্য গাড়ি করে। শেষ কুড়ি মাইল পায়ে হেঁটে। তাই টেলিগ্রাম পাঠানো আর আমার গ্রামে এসে পৌঁছনোর মধ্যে কেটে গেল একটি সপ্তাহ।
ইতিমধ্যে বাঘটা আরও একজনকে মারল। এবারকার শিকার হল একটি স্ত্রীলোক, সে তার স্বামী আর সন্তানদের নিয়ে নৈনিতালে আমাদের পাশের বাড়িটার হাতার মধ্যে বাস করত। স্ত্রীলোকটি তখন আর কয়েকজনের সঙ্গে মিলে গ্রামের উপরের পাহাড়ে ঘাস কাটছিল, এমন সময় বাঘটা সকলের চোখের সামনেই তাকে আক্রমণ করে মেরে বয়ে নিয়ে চলে যায়। ভয় পেয়ে অন্য স্ত্রীলোকেরা চিৎকার করে ওঠে এবং সে চিৎকার গ্রামে শোনা যায়। স্ত্রীলোকগুলি যখন এই দুর্ঘটনার কথা বলবার জন্যে নৈনিতালের দিকে ছুটে আসছিল, তখন গ্রামের লোকেরা একজোট হয়ে খুবই সাহস দেখিয়ে বাঘটাকে তাড়িয়ে দেয়।
তাদের স্বভাবজ সরল বিশ্বাসে তারা জানত যে তাদের পাঠানো টেলিগ্রাম পেয়ে আমি সাড়া দেবই। তাই তারা মৃতদেহটাকে একটা কম্বলে জড়িয়ে বিশহাত উঁচু একটা রডোডেনড্রন গাছের মগডালে বেঁধে রেখে দেয়। এরপর বাঘটা যা করেছিল তা থেকে বোঝা যায় যে সে খুব কাছেই বসে-বসে এইসব ব্যাপার লক্ষ করেছিল। কেননা, সে যদি দেহটাকে গাছে তুলতে না দেখত তাহলে সে কখনও সেটাকে খুঁজে বের করতে পারত না। বাঘের ঘ্রাণশক্তি নেই।
স্ত্রীলোকগুলি নৈনিতালে এসে খবর দেবার পর মৃত স্ত্রীলোকটির স্বামী আমার বোন ম্যাগি-র কাছে এসে তাকে তার স্ত্রী-বিয়োগের কথা জানাল। পরদিন ভোর হতেই ম্যাগি আমাদের কয়েকজন লোককে পাঠিয়ে দিল। যতক্ষণ না আমি গিয়ে পোঁছই-তারা মড়ির উপর একটা মাচান বেঁধে তাতে বসে থাকবে। সেইদিনই আমার পোঁছবার কথা। মাচান বাঁধবার সাজসরঞ্জাম গ্রাম থেকে যোগাড় করে, গ্রামের লোজনদের সঙ্গে নিয়ে আমাদের লোকেরা রডোডেনড্রন গাছটার কাছে গিয়ে দেখে যে, তার আগেই বাঘটা গাছে চড়ে, কম্বল ফুটো করে মড়াটা নিয়ে চলে গিয়েছে।
আবার তাদের সাহসের প্রশংসা করতে হয়। কেননা নিরস্ত্র হলেও, আমার লোকেরা আর গ্রামবাসীরা মড়াটাকে টেনে নিয়ে যাবার চিহ্ন ধরে আধমাইলটাক এগিয়ে গেল। সেখানে আধখাওয়া দেহটাকে দেখতে পেয়ে তারা তার কাছেই একটা ওক গাছে মাচান বাঁধতে লেগে গেল। সেটাই যেই শেষ হয়েছে অমনি এক শিকারী নৈনিতাল থেকে সেখানে দৈবাৎ এসে পড়লেন। তিনি সারাদিনের জন্যে শিকারে বেরিয়েছিলেন। তিনি আমার বন্ধুলোক–এই বলে, এবং নিজেই বাঘটার জন্যে অপেক্ষা করবেন এই ভরসা দিয়ে আমার লোকদের চলে যেতে বললেন।
ইতিমধ্যে আমি নৈনিতালে এসে পৌঁছেছি। তাই, খবরটা আমাকে দেবে বলে সবাই নৈনিতালে ফিরে এল। ততক্ষণে শিকারী মশায়, তার বন্দুকবরদার এবং খানা আর লণ্ঠন বহনের এক ভৃত্য মাচানে উঠে জায়গা করে নিয়েছেন। আকাশে চাঁদ ছিল না। অন্ধকার হবার ঘণ্টাখানেক পরে বন্দুক-বরদারটি জিগ্যেস করল, “শিকারীমশাই, বাঘটাকে গুলি না করে মড়িটা নিয়ে চলে যেতে দিলেন কেন?”
বাঘটা যে কাছেপিঠে কোথাও এসেছিল, সে-কথা বিশ্বাস করতে না পেরে শিকারীমশায় লণ্ঠনটি জ্বাললেন। তারপর, মাটিতে আলো ফেলবার জন্যে লণ্ঠনটাকে খানিকটা দড়ি বেঁধে যেই সেটাকে নামিয়ে দিতে গিয়েছেন, অমনি তার আঙুলের ফাঁক গলে দড়ি গিয়েছে ফসকে, লণ্ঠনটা মাটিতে পড়ে গিয়েছে ভেঙে, আর আগুন উঠেছে জ্বলে।
তখন মে মাস, আমাদের বন-জঙ্গল তখন খটখটে শুকনো। দেখতে-দেখতে গাছের তলাকার মরা-ঘাস আর ঝোঁপ-ঝাড় দাউদাউ করে জ্বলে উঠল। খুব সাহস দেখিয়ে শিকারীমশায় গাছ বেয়ে নেমে পড়ে তার টুইডের কোটটা দিয়ে পিটিয়ে আগুন নেবাবার চেষ্টা করতে লাগলেন। শেষে হঠাৎ তার সেই মানুষখেকোটার কথা মনে হতেই তিনি তাড়াতাড়ি মাচানে ফিরে এলেন। কোটটাতে আগুন ধরে গিয়েছিল, সেটা পড়ে রইল।
আগুনের আলোয় দেখা গেল যে মড়িটা বাস্তবিক আর নেই। কিন্তু ততক্ষণে শিকারীমশায়ের সে সব বিষয়ে সমস্ত আগ্রহ উবে গিয়েছে। তখন তাঁর উদ্বেগ শুধু নিজের নিরাপত্তার জন্যে, আর আগুন লেগে সরকারী বনের কতটা ক্ষতি হবে, তার জন্যে।
প্রবল হাওয়ার তাড়নায় আগুনটা গাছের কাছ থেকে সরে যেতে লাগল। আধঘণ্টা বাদে মুষলধারে বৃষ্টি আর শিলাবৃষ্টি হওয়ায় সেটা নিভে গেল। কিন্তু ততক্ষণে বেশ কয়েক বর্গমাইল বন পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছে। কোনো মানুষখেকো বাঘের মহড়া নেবার চেষ্টা শিকারীটির জীবনে এই প্রথম। আর, যে নিদারুণ অভিজ্ঞতা তার হল, তার ফলে এই ভঁর শেষ চেষ্টাও বটে। কেননা, প্রথমে তিনি আগুনে আধপোড়া হন, তারপর শীতে প্রায় জমে গিয়েছিলেন।
পরদিন ভোরবেলা তিনি যখন ক্লান্তভাবে একটা পথ ধরে নৈনিতালে ফিরে আসছিলেন, আমি তখন তার এক পথে সেই গ্রামের দিকে চলেছি। আগের রাতে কি হয়েছে, তার কিছুই আমি জানতুম না!
আমি বলায় গ্রামের লোকরা আমাকে রডোডেনড্রন গাছটার কাছে নিয়ে গেল। মড়িটাকে আবার বাগাবার জন্যে বাঘটা যে কতটা কৃতসংকল্প হয়েছিল, তার পরিচয় পেয়ে স্তম্ভিত হলুম। ছেঁড়া কম্বলটা জমি থেকে ফুট পচিশেক উঁচুতে ছিল। গাছের গায়ে বাঘটার নখের দাগ, নরম জমিটার অবস্থা আর গাছের তলাকার ভাঙা ঝোঁপ-ঝাড় দেখে বোঝা গেল, যে সে অন্তত কুড়িবার গাছটাতে উঠে তা থেকে পড়ে যাবার পর শেষ পর্যন্ত কম্বলটা ছিঁড়ে ফেলে দেহটাকে সরিয়ে নিয়ে যেতে পেরেছে।
ওখান থেকে দেহটাকে বয়ে নিয়ে বাঘটা আধমাইল দূরে, যেখানে মাচান বাঁধা, সেই গাছটার বছে গিয়েছে। তার ওধারে দেহটাকে টেনে নিয়ে যাবার সব চিতা আগুনের ফলে লোপ পেয়েছে। কিন্তু বাঘটা যেদিকে যেতে পারে বলে আমার মনে হল, সেইদিকে মাইলখানেক এগিয়ে আমি স্ত্রীলোকটির আধ পোড়া মাথাটা হঠাৎ দেখতে পেলাম। সেখান থেকে শ-খানেক গজ দূরে খুব ঘন ঝোঁপ-ঝাড়–আগুন সে পর্যন্ত পৌঁছয় নি।
কয়েক ঘণ্টা ধরে তার মধ্যে খোঁজ করতে-করতে একেবারে পাঁচ মাইল দূরে উপত্যকার শেষ প্রান্ত পর্যন্ত চলে গেলাম, কিন্তু বাঘটার কোনো চিহ্ন মিলল না। (সেই শিকারীটি যখন দৈবাৎ মাচানের কাছে এসে পড়েন, আর বাঘটাকে যখন মারা হয়, এর মধ্যে পাঁচজন লোক প্রাণ হারিয়েছিল।)
বৃথাই এত খোঁজাখুঁজি করে আমি সন্ধের অনেক পরে গ্রামটিতে ফিরে এলাম। গ্রামের মোড়লের বউ আমার জন্যে খাবার তৈরি করে রেখেছিল। তার মেয়েরা পিতলের থালায় করে তা আমার সামনে এনে রাখল। খাদ্য যেমন প্রচুর, তেমন সময়মতও হল, কারণ সারাদিন কিছুই খাই নি।
খাওয়া শেষ হলে আমি থালাগুলো তুলে নিলাম। ইচ্ছে এই যে, কাছাকাছি কোনো ঝরনায় নিয়ে সেগুলো পোব। তা দেখে মেয়ে তিনটি ছুটে এগিয়ে এসে আমার হাত থেকে বাসনগুলো নিয়ে, মাথা নাচিয়ে হেসে বললে যে তারা ব্রাহ্মণ হলেও একজন গোরা সাধু যে থালা থেকে খেয়েছেন, তা ধুলে তাদের জাত যাবে না।
মোড়ল এখন আর-নেই, তার মেয়েরা বিয়ের পর গ্রাম ছেড়ে চলে গিয়েছে, কিন্তু মোড়লগিন্নী এখনও বেঁচে আছেন। চিনা থেকে একনজর দেখবার পর আপনি আমার সঙ্গে এই গ্রামে এলে কিন্তু তার তৈরি চা খাবার জন্যে তৈরি হয়ে আসবেন। সেই চা জল দিয়ে নয়, ঘন টাটকা দুধ ফুটিয়ে গুড় মিশিয়ে তৈরি।
গ্রামের সামনেই পাহাড়ের খাড়া গা বেয়ে আমরা যে এগিয়ে আসছি, গ্রাম থেকে তা দেখা গিয়েছে। ছোট একখানা চৌকো কানা-ছেঁড়া কার্পেটের উপর পাহাড়ী ছাগলের চামড়া দিয়ে মজবুত করে বানানো খান-দুই বেতের চেয়ার সাজিয়ে রাখা হয়েছে আমাদের জন্যে। আমাদের অভ্যর্থনা করবার জন্যে মোড়লগিন্নী সেই চেয়ারের কাছে দাঁড়িয়ে আছেন।
এখানে পরদা-প্রথা নেই। আপনি যদি তাকে বেশ ভাল করে দেখেন, তাতেও তিনি বিব্রত হবেন না। দেখবার মত চেহারাও বটে। এখন তার চুল দুধের মত সাদা, কিন্তু আমি যখন তাকে প্রথম দেখি তখন তা ছিল কাকের পালকের মত কাল। সেই দূর অতীতে তার যে গালদুটিতে টুকটুকে আভা দেখা যেত, আজ অ হাতির দাঁতের মত সাদা। তাতে একটুকু দাগ বা কুঞ্চন নেই। অতি প্রাচীন ব্রাহ্মণ বংশের মেয়ে তিনি। বংশের আদিপুরুষের মতই তাঁর রক্ত খাঁটি ব্রাহ্মণেরই রক্ত।
অকলুষিত বংশধারার গর্ব সব মানুষেরই মধ্যে সহজাত বটে, কিন্তু তার মর্যাদা ভারতে যেমন, তেমন আর কোথাও নয়। সকলের প্রিয় এই বৃদ্ধা মহিলার পরিচালনাধীন গ্রামটিতে নানা জাতের লোক আছে, কিন্তু তাঁর শাসন নিয়ে কোনো আপত্তি কখনও ওঠে না। তার মুখের কথাই আইন। তার কারণ এ নয় যে তার অনুচরদের দোর্দণ্ড প্রতাপ-তার কোনো অনুচরই নেই। যে ব্রাহ্মণ জাতি ভারতের মাটির প্রাণুরস, তিনি সেই ব্রাহ্মণ–তাই তাকে সবাই মানে।
খেতের ফসলের জন্যে সম্প্রতি কয়েক বছর চড়া দাম পাওয়া গিয়েছে বলে, ভারতে ‘সমৃদ্ধি’ বলতে যা বোঝায় তা এ গ্রামের হয়েছে। তার একটা অংশ আমাদের এই মোড়লগিন্নী পুরোপুরি পেয়েছেন।
যৌতুকের অংশ হিসেবে যে ছিলে-কাটা সোনার মটর-মালা তিনি পেয়েছিলেন সেটা এখনও তার গলায় আছে বটে, কিন্তু রূপোর হালকা হারছড়া তার পারিবারিক ব্যাংকে, অর্থাৎ উনুনের নিচে মাটির তলায় এক গর্তে–রেখে দেওয়া হয়েছে। তার বদলে তার গলায় উঠেছে নিরেট সোনার একটি হাঁসুলি। অনেকদিন আগে তার কানে গয়না ছিল না, কিন্তু এখন তার উপরকানে বেশ কয়েকটা হালকা সোনার মাকড়ি ঝুলছে, আর তাঁর নাকে দুলছে পাঁচ ইঞ্চি ফাঁদের একটি সোনার নথ। ডান-কানে জড়ানো একটি পাতলা সোনারচেন সেই নথটির ভার কতটা বহন করেছে। উঁচু জাতের পাহাড়ী মেয়েদের যা পোশাক, এঁরও তাই। একখানা শাল, গরম কাপড়ের একটি আঁটোসাঁটো কঁচুলি, আর একটি ছাপা কাপড়ের মস্ত বড় ঘাগরা। তার পা খালি, কেননা এই প্রগতির যুগেও পাহাড়ীদের মধ্যে জুতো পায়ে দেওয়া হল অসতীত্বের লক্ষণ।
বৃদ্ধা মহিলাটি এখন চা তৈরি করতে বাড়ির ভিতরে গিয়েছেন। তিনি যতক্ষণ এই উত্তম কাজটি করছেন, ততক্ষণ আপনি সরু রাস্তার ওধারকার বেনের দোকানটির দিকে মন দিতে পারেন।
বেনেও আমার এক পুরানো বন্ধু। আমাদের সম্ভাষণ করে আর এক প্যাকেট সিগারেট উপহার দিয়ে সে ফিরে গিয়ে আসন পিড়ি হয়ে বসেছে একটি কাঠের মাচার উপর-তার উপরেই তার বেসাতি খুলে সাজনো রয়েছে।
গ্রামের লোকদের আর রাহীলোকদের যা দরকার, এমন অল্প কয়েকটা জিনিস নিয়েই তার পসরা, যেমন–আটা-চাল-ডাল-ঘি-লবণ আর নৈনিতাল বাজারে কম দামে কেনা কিছু বাসি মেঠাই-রাজারাজড়ার খাওয়ার যোগ্য পাহাড়ী আলু–প্রকাণ্ড-প্রকাণ্ড শালগম (সেগুলো এমন ঝাঁঝালো যে লোকের সামনে তা খেলে দর্শকের চোখেও জল এসে যায়)–সিগারেট আর দেশলাই। আর এক টিন কেরোসিন। আর কাছে মাচার কাছে তার নাগালের মধ্যে একটি লোহার কড়াই–তাতে সারাদিন দুধ ফোঁটানো হচ্ছে।
দোকানদার তার মাচায় গিয়ে বসতেই তার অল্প কয়েকটি খদ্দের তার সামনে এসে জড় হয়েছে। প্রথম জন একটি ছোট ছেলে, তার সঙ্গে রয়েছে তার একটি ছোট বোন। তার ভারি দেমাক যে তার গোটা একটা পয়সা আছে। তার সবটাই সে মেঠাই কিনে খরচ করবার জন্যে ছটফট করছে। তার ছোট্ট নোংরা হাত থেকে পয়সাটা নিয়ে দোকানদার সেটাকে একটা ভোলা কাঠের বাক্সে ফেলল। তারপর বোলতা আর মাছি তাড়াবার জন্যে বারকোশটার উপর তার হাতখানা নেড়ে সে চৌকো একটি ক্ষীরের মিঠাই তুলে নিয়ে, সেটাকে আধখানা করে ভেঙে, ব্যাগ্রভাবে বাড়ানো দু-খানি হাতে এক-একটি টুকরো দিয়ে দিল।
তারপর আসছে নিচু জাতের একটি স্ত্রীলোক। সে বাজার করবার জন্যে দু-আনা নিয়ে এসেছে। এক আনা লেগে গেল আটা কিনতে, কেননা আমাদের পাহাড়ীদের প্রধান খাদ্যই হচ্ছে এই মোটা-করে-পেষা গম। দোকানে তিন-রকম ডাল আছে, তার, মধ্যে সবচেয়ে ওঁচা ডালটা কিনতে গেল আরও দুটি পয়সা। বাকি পয়সা-দুটি দিয়ে একটু নুন আর একটি সেই ঝাঁজালো শালগম কিনে নিয়ে সে দোকানীকে সসম্ভ্রমে নমস্কার করছে, কেননা দোকানী একজন মান্য ব্যক্তি। এরপর সে তার পরিবারের দুপুরের খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন করবার জন্যে তাড়াতাড়ি চলে যাচ্ছে।
এই স্ত্রীলোকটিকে যখন জিনিস দেওয়া হচ্ছে তখন কর্কশ শিষ আর মানুষের হাঁকডাক থেকে বোঝা গেল যে একপাল মাল-বওয়া খচ্চর এসে পৌঁছেছে। এরা। মোরাদাবাদ থেকে তাঁতের কাপড় নিয়ে চলেছে পাহাড়ের মাঝখানকার সব বাজারে। পাদ-শৈলশ্রেণী থেকে এবড়ো-খেবড়ো রাস্তায় শক্ত চড়াই উঠতে ঘেমে উঠেছে খচ্চরগুলো। তারা যতক্ষণে একটু দম নিয়ে নিচ্ছে ততক্ষণে তাদের রক্ষক চারজন গিয়ে দোকানীর দেওয়া বেঞ্চিখানাটাতে বসেছে। এক-একটি সিগারেট এবং এক-এক গ্লাস দুধ খাচ্ছে খুব আয়েশ করে।
এই দোকানেই হ’ক, কিংবা এই পাহাড়ী এলাকায় সর্বত্র পথের ধারে-ধারে যে শত-শত দোকান আছে তার যে-কোনোটাতেই হ’ক, দুধের চেয়ে কড়া কোনো পানীয় কখনও পাওয়া যায় না। কেননা শুধু যারা তথাকথিত সভ্যতার সংস্পর্শে এসেছে তারা ছাড়া আমাদের পাহাড়ী লোকেরা মদ খায় না। স্ত্রীলোকদের মধ্যে মদ খাওয়াটা আমার ভারতে একেবারেই অজানা।
কখনও কোনো খবরের কাগজ এই গ্রামে আসে নি। এখানকার লোকেরা বাইরের জগতের খবর পায় শুধু কালেভদ্রে নৈনিতালে গেলে, নয় তো রাহী লোকের কাছে। এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি খবর রাখে মালবাহকরা। পাহাড়ের ভিতরদিকে যাবার পথে তারা সুদূর সমতলভূমির খবর নিয়ে আসে, আর মাসখানেক বাদে ফিরে যাবার পথে তারা যেখানে তাদের মাল বেচে এসেছে সেইসব বাণিজ্য-কেন্দ্রের সংবাদ দিয়ে যায়।
বৃদ্ধা মহিলাটি আমাদের জন্যে যে চা বানাচ্ছিলেন তা এতক্ষণে তৈরি হয়ে। গিয়েছে। কানায়-কানায় ভর্তি কাঁসার বাটিটাতে খুব সাবধানে হাত দেবেন। কেননা সেটা এত গরম যে আপনার হাতের চামড়া উঠে আসতে পারে। সকলের দৃষ্টি এখন ফেরিওয়ালাদের দিক থেকে আমাদের দিকে ফিরেছে। মিষ্টি আর গরম এই তরল পদার্থটি ভাল লাগুক আর না-ই লাগুক, আপনাকে ওর শেষ ফোঁটাটি পর্যন্ত খেতেই হবে। আপনি সারা গ্রামটির অতিথি। সারা গ্রামের সবকটি চোখ রয়েছে আপনার উপর। বাটিতে কোনো তলানি ফেলে রাখার এই মানে দাঁড়াবে যে, আপনার বিবেচনায় চা-টা আপনার খাবার যোগ্য হয় নি।
অন্য লোক হলে এই অতিথি-সৎকারের জন্যে দাম দিতে চাইতে পারে, কিন্তু সে ভুল আমরা করব না। কেননা এই সরল অতিথি-বৎসল মানুষগুলি বেজায় গর্বিত। বৃদ্ধা মহিলাটিকে একবাটি চায়ের দাম দিতে চাইলে তাকে ভয়ানক অপমান করা হবে, আর দোকানদারকে তার এক বাক্স সিগারেটের দাম দিতে গেলেও তা-ই।
চিনা-র চূড়া থেকে ভাল দূরবীনের সাহায্যে আপনি যে বিস্তীর্ণ এলাকা দেখেছেন, তার মধ্যে ছড়ানো হাজার-হাজার একই ধরনের গ্রামের মধ্যে এই গ্রামও একটি। এই অঞ্চলেই আমার জীবনের বেশির ভাগ কাটিয়েছি আমি। এই গ্রামটি ছেড়ে যাবার সময় আপনি নিশ্চয়ই জানবেন যে, এখানে পৌঁছে আমরা যে অভ্যর্থনা পেয়েছি এবং শিগগির আবার আসবার যে আমন্ত্রণ পেয়েছি, তা হচ্ছে আমার ভারতের লোকদের ভালবাসা আর শুভেচ্ছার অকপট অভিব্যক্তি।