৪. লাল ফিতের আগেকার আমল
হিমালয়ের পাদদেশে যে অনুচ্চ ভূ-খণ্ডকে তরাই বলে, একবার শীতকালে সেখানে আমি আণ্ডারসনের সঙ্গে এক ক্যাম্পে ছিলুম। জানুয়ারির গোড়ার দিকে একদিন ভোরবেলা জল খাবার পর আমরা বিন্দুখেরা ছেড়ে আমাদের পরবর্তী ক্যাম্প বোকসার-এর দিকে বেরিয়ে পড়লুম। চাকর-বাকররা যাতে বাঁধা-ছাঁদা করে মাল-পত্র নিয়ে গিয়ে সেখানে আমরা পৌঁছবার আগেই তাবু ফেলতে সময় পায়, এইজন্যে আমরা অনেকটা ঘুরপথে গেলুম।
বিন্দুখেরা আর বোকসারের মধ্যে পুল-শূন্য দুটি নদী পার হতে হয়। দ্বিতীয় নদীটিতে পৌঁছে, আমাদের তাবু-বওয়া একটা উট কাদার মধ্যে হড়কে গিয়ে নদীর মধ্যে তার পিঠের বোঝা ফেলে দিল। ফলে আমাদের লোকদের যেতে অনেক দেরি হয়ে গেল। সারাদিন ধরে সাধ মিটিয়ে পাখি শিকার করে বোকসারে এসে দেখি যে তখনও উঠের পিঠ থেকে মাল-পত্র নামানো চলছে।
বোকসার গ্রাম থেকে মাত্র কয়েকশো গজ দূরে তাবু ফেলা হল। অ্যাণ্ডারসনের সেখানে আসাটা তো একটা বড় ঘটনা, তাই সারা গাঁয়ের লোক তাকে সম্মান দেখাবার জন্যে আর শিবির স্থাপনে যথাসাধ্য সাহায্য করবার জন্যে সেখানে চলে এসেছিল।
স্যার ফ্রেডারিক অ্যান্ডারসন সে সময়ে ছিলেন তরাই আর ভাবরের সরকারী মহলের সুপারিন্টেন্ডেন্ট। মানুষটি সহৃদয় ছিলেন বলে তাঁর শাসনাধীন বহু সহস্র বর্গমাইল এলাকার বাসিন্দা সব জাতি আর সব ধর্মের লোকদের তিনি প্রিয় পাত্র হয়ে উঠেছিলেন। দয়ালু ছাড়াও তিনি দক্ষ শাসকও ছিলেন, এবং তার মত স্মরণশক্তি আমি মোটে আর একজনেরই দেখেছি–তিনি হলেন জেনেরাল স্যার হেনরি র্যামজে। আটাশ বছর ধরে তিনি এই একই ভূখণ্ডের শাসনদণ্ড পরিচালনা করেছিলেন। চাকরিতে থাকার সময় আগাগোড়া তাঁকে লোকে জানত ‘কুমায়ুনের মুকুটহীন রাজা’ বলে।
র্যামজে আর অ্যাণ্ডারসন–দুজনেই ছিলেন স্কটল্যাণ্ডের লোক। তাদের বিষয়ে লোকে বলত যে একবার কারও নাম শুনলে কিংবা মুখ দেখলে তারা কখনও তা ভুলে যেতেন না। সরল, অশিক্ষিত লোকদের সঙ্গে যাঁদের কারবার আছে শুধু তারাই বুঝবেন যে ভাল স্মরণশক্তির মূল্য কত। কেননা, সাধারণ একজন লোকের নামটা যদি কেউ মনে করে রাখে, কিংবা কী পরিস্থিতিতে এর আগে তার সঙ্গে দেখা হয়েছিল সে-কথা যদি কেউ বলতে পারে, তাহলে তার যেমন ভাল লাগে, এমন আর কিছুতে নয়।
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের উত্থান ও পতনের ইতিহাস যখন লেখা হবে, তখন এ কথা বিবেচনা করতে হবে যে তার পতনের ব্যাপারে ‘লাল-ফিতে’র প্রভাব কতখানি ছিল। র্যামজে আর অ্যাণ্ডারসনের আমলে ভারতে সে জিনিসটা অজানা ছিল, এবং তাদের জনপ্রিয়তা এত অধিক হয়ে উঠেছিল এবং তাঁদের শাসনও এতটা সফল হতে পেরেছিল।
কুমায়ুনের জজ ছাড়াও র্যামজে ছিলে সে অঞ্চলের ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশস, বন-পাল এবং ইঞ্জিনীয়ার। তার অসংখ্য এবং দুরূহ কাজগুলির মধ্যে অনেকগুলিই তিনি এক ক্যাম্প থেকে অন্য ক্যাম্পে হেঁটে যেতে-যেতেই সেরে ফেলতেন।
এইসব পদ-যাত্রার সময়ে দলে-দুলে লোক তার সঙ্গ নিত। সেই সময়েই তিনি তার দেওয়ানী আর ফৌজদারী মামলার বিচার করতেন। বাদী আর তার সাক্ষীদের কথা আগে শোনা হত, আর তারপর শোনা হত বিবাদী আর তার সাক্ষীদের কথা। তারপর রীতিমত ভেবে-চিন্তে র্যামজৈ তাঁর রায় দিতেন। হয় জরিমানা, নয় তো কারাদণ্ড হত। সে রায় নিয়ে কখনও কেউ প্রশ্ন তুলেছে বলে জানা যায় নি। আর, যাকে তিন জরিমানা করতেন বা কারাদণ্ড দিতেন, সে সরকারী খাজাঞ্চিখানায় গিয়ে জরিমানাটা দিয়ে দিত, কিংবা সবচেয়ে কাছের জেলে নিজেই গিয়ে হাজির হয়ে, র্যামজের হুকুম-মত বিনাশ্রম বা সশ্রম কারাদণ্ড ভোগ করতে কখনও গাফিলতি করেনি।
আগে র্যামজে যা করতেন, তরাই আর ভাবর অঞ্চলের সুপারিন্টেন্ডেন্ট হিসেবে অ্যাণ্ডারসনকে তার খানিকটা মাত্র করতে হত বটে, কিন্তু তার প্রশাসনিক ক্ষমতার ক্ষেত্র যথেষ্ট বিস্তৃত ছিল। সেদিন বিকেলবেলা যখন বোকরে আমাদের তাঁবু ফেলা হচ্ছিল, তখন অ্যাণ্ডারসন জমায়েত-হওয়া লোকদের বসে পড়তে বললেন। তিনি এ কথাও বললেন যে কারও যদি কোনো নালিশ থাকে শুনবেন কিংবা কেনো দরখাস্ত থাকে তা নেবেন।
প্রথম আবেদন জানাল বোকসারের পাশের এক গ্রামের মোড়ল। জানা গেল, যে সেই গ্রাম ও বোকরের লোকরা একটা যৌথ জলসেচের নালা থেকে জল নেয়। নালাটা বোকসারের ভিতর দিয়েই গিয়েছে। সেবার ভাল বৃষ্টি না হওয়ায় নালায় দু-গ্রামের পক্ষে পর্যাপ্ত জল হয় নি। সব জলটাই বোকসার নিয়ে নিয়েছে। ফলে নিচের গ্রামে ধানের ফসল নষ্ট হয়েছে। বোকরের মোড়ল স্বীকার করল যে নালার জল নিচের গ্রামে যেতে দেওয়া হয় নি, কিন্তু সাফাই হিসেবে সে বলল যে, জলটা ভাগাভাগি করে নিলে দুই গ্রামেরই ধান নষ্ট হত। ফসলটা আমাদের আসার কয়েক দিন আগে কাটাই আর মাড়াই হয়ে গিয়েছিল।
দুই মোড়লের বক্তব্য শোনার পর অ্যাণ্ডারসন হুকুম দিলেন যে দুই গ্রামের জমির পরিমাণের অনুপাতে সমস্ত ধান ভাগাভাগি করে দেওয়া হবে। বোকরের লোকরা মেনে নিল যে বিচারটা ন্যায্য হয়েছে, কিন্তু তারা ফসল কাটাই আর মাড়াইয়ের মেহনতের মজুরি দাবি করল। নিচের গ্রামটি এই বলে এই দাবিতে আপত্তি করল যে সে সময়ে তাদের সাহায্য করতে ডাকা হয় নি। এই আপত্তি ন্যায্য বলে অ্যাণ্ডারসন মেনে নিলেন। অমনি দুই মোড়লে ধান ভাগ করতে চলে গেল, আর এর পরের দরখাস্ত অ্যাণ্ডারসনের কাছে পেশ করা হল।
এটা করল ছেদী। তার বউ তিলনীকে কালু ভুলিয়ে নিয়ে গেছে, এই তার নালিশ। দিন-কুড়ি আগে নাকি কালু তিলনীকে প্রেম নিবেদন করে। ছেদী আপত্তি করলেও সে ক্ষান্ত হয় নি। শেষে তিলনী তার ঘর ছেড়ে কালুর সঙ্গে গিয়ে বাস করে। অ্যাণ্ডারসন যখন জিগ্যেস করলেন যে কালু হাজির আছে কি না, তখন আমাদের সামনে গোল হয়ে বসে-থাকা লোকদের একপাশ থেকে একটি লোক উঠে দাঁড়িয়ে বলল যে সে-ই কালু।
ধানের ব্যাপার নিয়ে যতক্ষণ কথা চলছিল ততক্ষণ জমায়েত-হওয়া মেয়েরা আর বউরা আগ্রহ দেখায় নি, কেননা তার মীমাংসা করবে পুরুষরা। কিন্তু এখন তাদের মুখের ভাব আর দমবন্ধ অবস্থা দেখে বেশ বোঝা গেল যে এই ফুসলানোর মামলায় তাদের বেজায় আগ্রহ আছে।
অ্যাণ্ডারসন যখন কালুকে জিগ্যেস করলেন, নালিশটি সত্যি কি না, তখন সে স্বীকার করল যে তিলনী তার দেওয়া একখানা কুটিরেই থাকে বটে, কিন্তু ফুসলে আনার কথাটা সে জোর করেই অস্বীকার করল। যখন তাকে জিজ্ঞাসা করা হল যে সে তিলনীকে তার বৈধ স্বামীর কাছে ফিরিয়ে দিতে প্রস্তুত আছে কি না, তখন কালু জবাব দিল যে তিলনী তার কাছে স্বেচ্ছায় এসেছে-ছেদীর কাছে ফিরে যেতে তাকে বাধ্য করতে সে পারবে না।
অ্যাণ্ডারসন জিগ্যেস করলেন, ‘তিলনী হাজির আছে?’
স্ত্রীলোকদের দল থেকে এগিয়ে এসে একটি মেয়ে বলল, ‘আমিই তিলনী। আমার উপর হুজুরের কী হুকুম?’
তিলনী মেয়েটি অল্পবয়সী, তার বয়স বছর আঠার হবে। তার গড়নটি পরিষ্কার, চেহারাটি চটকদার। তরাইয়ের মেয়েদের চিরাচরিত প্রথায় তার মাথার চুলগুলো, ফুটখানেক উঁচু একটা বিড়ে করে বাঁধা, তাতে একখানা সাদাপাড়ের কাল শাড়ি : জড়ানো। তার দেহে একটা আঁট লাল রঙের কাঁচুলি আর খুব ঘের-ওয়ালা একটা রঙচঙে ঘাগরা এই তার সাজ।
যখন অ্যাণ্ডারসন তাকে জিগ্যেস করলেন যে সে তার স্বামীকে কেন ছেড়ে গিয়েছে, তখন সে ছেদীর দিকে দেখিয়ে বললে, ‘ওর দিকে তাকান। ও যে শুধু নোংরা তাই নয়, তা তো দেখতেই পাচ্ছেন, তার উপর আবার হাড়-কেপ্পনও। বিয়ে হওয়া থেকে এই দুবছরের মধ্যে ও আমাকে কাপড় কিংবা গয়না কিচ্ছু দেয় নি। আমার জামাকাপড় এই যা দেখেছেন, আর.এইসব গয়না’–এই বলে সে তার হাতের কয়েকগাছা রুপোর চুরি আর তার গলার কয়েক ছড়া পুঁতির মালায় হাত দিল-কালু আমাকে দিয়েছে। ছেদীর কাছে ফিরে যেতে সে রাজী আছে কি না সে কথা জিগ্যেস করায় সে মাথা ঝেকে বলল যে কিছুতেই সে যাবে না।
অস্বাস্থ্যকর তরাই অঞ্চলের বাসিন্দা এই আদিবাসী জাতটি দুটি মস্ত গুণের জন্য বিখ্যাত–তা হল পরিচ্ছন্নতা, আর স্ত্রী-স্বাধীনতা। ভারতের আর কোনো অংশে গ্রাম আর ঘরবাড়ি তরাই অঞ্চলের মত এমন নিখুঁতভাবে পরিষ্কার রাখা হয় না। আর, ভারতের অন্য কোথাও অল্পবয়সী মেয়ে নিজের পক্ষ সমর্থন করবার জন্যে স্ত্রী-পুরুষের সমাবেশের মধ্যে দু-জন সাহেবের সামনে দাঁড়াতে সাহস পেত না–তাকে তা করতে দেওয়াই হত না।
এবার অ্যাণ্ডারসন ছেদীকে জিগ্যেস করলেন যে সে কিছু বুদ্ধি দিতে পারে কি না। তার উত্তরে সে বললে, হুজুর আমার মা, হুজুরই আমার বাপ। সুবিচার পাবার জন্যে আপনার কাছে এসেছিলুম, এখন হুজুর যদি আমার বউকে আমার কাছে ফিরে যেতে বাধ্য করতে না চান, তাহলে আমি ওর বদলে খেসারত চাই।
অ্যাণ্ডারসন জিগ্যেস করলেন, সেটা কত চাও?
ছেদী উত্তর দিল, ‘আমি দেড়শো টাকা চাই। এবার চারদিক থেকে আওয়াজ শোনা গেল, ‘লোকটা বেশি চাইছে!’ ‘বড্ড বেশি!’ ‘মেয়েটার দাম অত নয়! ইত্যাদি।
তিলনীর জন্যে সে দেড়শো টাকা দিতে ইচ্ছুক কি না অ্যাণ্ডারসন সে কথা কালুকে জিগ্যেস করায় সে বললে যে দাবিটা বড়ই বেশি, কেননা এ কথা সেও জানে, বোকরের সবাই জানে যে তিলনীর জন্যে ছেদী মোটে একশো টাকা দিয়েছিল। সে যুক্তি দেখাল যে এই দামটা যখন দেওয়া হয়, তখন তিলনী ‘টাটকা’ ছিল এখন তো আর তিলনী তা নেই, কাজেই তার জন্যে সে বড়জোর পঞ্চাশটি টাকা দিতে পারে।
সমবেত জনতা এবার পক্ষাবলম্বন করতে লাগল। কেউ কেউ বললে যে দাবির পরিমাণ নিতান্তই বেশি, অন্যরা তেমনি জোট করে বলতে লাগল যে যা দিতে চাওয়া হয়েছে সে-টাকাটা একেবারেই কম। সপক্ষে-বিপক্ষে সমস্ত যুক্তিই যথাযোগ্যভাবে বিবেচনা করে (সে-সব যুক্তি নিতান্ত সূক্ষ্ম এবং একান্ত ব্যক্তিগত খুঁটিনাটি-ঘটিত, এবং তিলনী তার সুন্দর মুখখানায় হাসি মাখিয়ে তা সব শুনল) অ্যাণ্ডারসন তিলনীর দাম পঁচাত্তর টাকা ধার্য করে কালুকে হুকুম করলেন ছেদীকে টাকা দিয়ে দিতে।
কোমরবন্ধ খুলে কালু তা থেকে একটা সুতোর থলি বের করে অ্যাণ্ডারসনের পায়ের কাছে সেটাকে ঝেড়ে খালি করে দিল। তাতে ছিল মোট বাহান্নটি টাকা। তারপর কালুর দুই বন্ধু তাকে সাহায্য করে আরও তেইশ টাকা তাতে যোগ করল। তখন ছেদীকে টাকাটা গুনে নিতে বলা হল। সে গুনে বলল যে টাকাটা ঠিক আছে। খানিকক্ষণ আগেই আমি লক্ষ করেছিলুম য়ে সবাই বসে পড়ার পর একটি স্ত্রীলোক গ্রামের দিক থেকে অত্যন্ত যন্ত্রণাকাতরভাবে খুব ধীরে-ধীরে এসে একটু তফাতে বসে ছিল। সে এখন অতি কষ্টে উঠে দাঁড়িয়ে বললে, “আমার তবে কী হবে, হুজুর?
অ্যাণ্ডারসন জিগ্যেস করলেন, তুমি আবার কে?
সে জবার দিল, ‘কালুর বউ।’
তার চেহারা লম্বা আর হাড়-বের করা। হাতির দাঁতের মত সাদা মুখখানায় একফোঁটা রক্ত নেই। পেটজোড়া পিলেতে তার চেহারা বিক্রিত হয়ে গিয়েছে, তার পা দু-খানাও ফুলে উঠেছে। তরাই অঞ্চলের অভিশাপ যে ম্যালেরিয়া, এ-সব হল তারই ফল।
ক্লান্ত, একঘেয়ে গলায় স্ত্রীলোকটি বলল যে কালু এখন আর-এক বউ কিনল, কাজেই সে আর ঘর করতে পারবে না। গ্রামে তার আপন জন কেউ নেই, আর অসুস্থ বলে সে কাজ করতেও পারবে না। কাজেই তাকে অবহেলায় আর অনাদরে মরতে হবে। এই বলে তার মুখ শাড়ি দিয়ে ঢেকে নিঃশব্দে কাঁদতে লাগল। রুদ্ধ আবেগে তার জীর্ণ দেহ কাঁপতে লাগল, তার ভাঙা শরীর বেয়ে টপ-টপ করে চোখের জল পড়তে লাগল।
এই এক উড়ো ফ্যাসাদ এসে জুটল। অ্যাণ্ডারসনের পক্ষে এটা মেটানো শক্ত, কেননা ব্যাপারটা যখন আলোচনা করা হচ্ছিল, তখন ঘৃণাক্ষরেও এ-কথা ওঠে নি যে কালুর এক বউ আছে।
স্ত্রীলোকটির করুণ বিলাপের পর খানিকক্ষণ ধরে একটা অস্বস্তিকর স্তব্ধতা চলল। তিলনী দাঁড়িয়ে ছিল। সে হঠাৎ দৌড়ে সেই দুঃখী ক্রন্দনরতা স্ত্রীলোকটির কাছে গিয়ে নিজের সবল দুখানা হাত দিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে বলে উঠল, ‘কেঁদো না দিদি, কেঁদো না। তোমার ঘর নেই, একথাও বলো না। কালু আমাকে যে ঘরখানা বানিয়ে দিয়েছে, সেটা আমি তোমার সঙ্গে ভাগাভাগি করে নেব। আমিই তোমার সেবা-যত্ন করব। কালু.আমাকে যা দেবে, তার অর্ধেক আমি তোমাকে দেব। তাই বলি, দিদি, আর কেঁদো না। আমার সঙ্গে এস। চল তোমাকে আমাদের ঘরে নিয়ে যাই।
রুগ্ন স্ত্রীলেকাটিকে নিয়ে তিলনী যখন চলে যাচ্ছে, তখন অ্যাণ্ডারসন উঠে দাঁড়িয়ে সজোরে নাক ঝাড়তে ঝাড়তে বললেন যে, পাহাড়ের হাওয়া লেগে তাঁর বিচ্ছিরি রকমের সর্দি হয়েছে, তাই সব কাজ সেদিনকার মত মুলতুবী হল। দেখা গেল যে পাহাড়ী হাওয়াটার ছোঁয়া অ্যাণ্ডারসনের মত অনেকেরই লেগেছে। কেননা, নাক ঝাড়বার বেজায় দরকার যে একা তাঁরই হয়েছিল; এমন নয়।
কাজ কিন্তু তখনও শেষ হয় নি, কেননা এবার ছেদী অ্যাণ্ডারসনের কাছে এসে তার দরখাস্তখানা ফেরত চাইল। সেটাকে নিয়ে টুকরো-টুকরো করে ছিঁড়ে ছেদী পকেট থেকে সেই পঁচাত্তর টাকা বাঁধা ন্যাকড়াটা বের করে তা খুলে বললে, কালু আর আমি একই গাঁয়ের মানুষ। তাকে এখন দুটো মুখে ভাত যোগাতে হবে, তার মধ্যে একটার জন্যে আবার বিশেষ খাদ্য চাই। এ টাকাটা সবই তার দরকার হবে। তাই বলি, হুজুর, আপনার হুকুম হলে এই টাকাটা তাকে ফিরিয়ে দি।
নিজেদের এলাকায় ট্যুর করবার সময় অ্যাণ্ডারসন আর তার পূর্ববর্তীরা লাল ফিতের আগেকার আমলে এইভাবে, সকলের সন্তোষ-মতে, শত-শত কেন, হাজার-হাজার এই ধরনের মোকদ্দমার ফয়সালা করে দিতেন–তাতে কোনো পক্ষের একটি পয়সা খরচ হত না।
কিন্তু এখন ‘লাল ফিতের ব্যবস্থা হবার পর থেকে মামলাগুলো আদালতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সেখানে বাদী-প্রতিবাদী দুজনেরই রক্ত চুষে খাওয়া হয়। আরও বিবাদের বীজ বোনা হয়। তা থেকে অনিবার্যভাবে ক্রমেই বেশি-বেশি করে আদালতে মামলা হতে থাকে যাতে আইন-ব্যবসায়ীদের ধনবৃদ্ধি হয়, আর গরিব, সরল, সৎ, পরিশ্রমী চাষীরা ছারখার হয়ে যায়।