প্রথম খণ্ড
দ্বিতীয় খণ্ড

মোহনের মানুষখেকো

মোহনের মানুষখেকো

০১.

হিমালয়ে আমাদের গ্রীষ্মবাস থেকে আঠার মাইল দূরে একটি দীর্ঘ শৈলশিরা পুব থেকে পশ্চিমে চলে গেছে, উচ্চতায় প্রায় ৯,০০০ ফুট। এই শৈলশিরার উঁচু দিকের ঢালের পূর্ব প্রান্তে এই ঘাসের এক সতেজ-উর্বর ফলন। এই ঘাসগুলির নিচে পাহাড়টি খাড়াই নেমে এসে রচনা করেছে হেলানো শৈল প্রাচীরের এক সারি এবং বিলীন হয়েছে নিচের কোশী নদীতে।

শৈলশিরার উত্তর দিকের গ্রামের একদল রমণী ও বালিকা একদিন ওই ঘাস কাটছিল, তখন আকস্মিক তাদের মধ্যে এসে পড়ে একটি বাঘ। বাঘ দেখে ছুটোছুটি লেগে যায়, তাতে এক বয়স্কা রমণীর পা পিছলে যায়, খাড়াই ঢাল ধরে গড়িয়ে পড়ে ও, হেলানো শৈল প্রাচীর টপকে অদৃশ্য হয়ে যায়। মেয়েদের আর্তনাদ শুনেই ভড়কে গিয়ে বাঘটি যেমন রহস্যে আবির্ভূত হয়েছিল তেমনি রহস্যজনকভাবেই অদৃশ্য হয় এবং মেয়েরা যখন আবার একজোট হয় ও ভয় কাটিয়ে ওঠে, ওরা ঘাসের ঢাল ধরে নেমে যায় এবং শৈল প্রাচীরের ওপর দিয়ে ঝুঁকে, ওদের থেকে কিছু নিচে এক সরু কার্নিসে ওদের সঙ্গিনীকে পড়ে থাকতে দেখে।

রমণীটি বলে ও জোর জখম হয়েছে–পরে দেখা গিয়েছিল তার একটি পা এবং অনেকগুলি পাঁজরা ভেঙেছে–এবং সে নড়তে পারছে না। ওকে উদ্ধার করবার উপায় ও পন্থা আলোচনা হয় ও অবশেষে স্থির হয়, এ হল পুরুষমানুষের কাজ। যেহেতু সেখানে থেকে যেতে কেউ রাজী বলে বোধ হল না, ওরা আহত রমণীটিকে জানাল সাহায্য আনতে ওরা গ্রামে ফিরে যাচ্ছে। ওকে একলা যেন রেখে যাওয়া না হয় বলে রমণীটি মিনতি জানাল এবং ওর অনুনয়ে ষোল বছরের একটি মেয়ে ওর সঙ্গে থাকতে স্বেচ্ছায় রাজী হল। তাই, যখন দলের বাকি সবাই গ্রামের উদ্দেশে রওনা হল, মেয়েটি পথ করে নিয়ে ডাইনে নেমে এল, সেখানে পাহাড়ের পাঁচিলের গায়ের একটি ফাটল ওকে কার্নির্সটিতে পা-রাখার সুযোগ করে দেয়।

পাহাড়ের পাঁচিলের গা বরাবর মাত্র আধা-পথ বেরিয়ে গেছে কার্নিসটি এবং যেখানে রমণীটি পড়েছিল সেখান থেকে কয়েক গজ দূরে একটি অগভীর নাবালে শেষ হয়েছে। কার্নিস থেকে পড়ে গিয়ে শত শত ফুট নিচের পাথরের ওপর পড়ে মাথা পড়বে ভয়ে রমণীটি, মেয়েটিকে ওকে এই নাবালে সরিয়ে দিতে বলল এবং এই কঠিন ও বিপজ্জনক কাজটি মেয়েটি সাফল্যের সঙ্গে সমাধা করল। সে নাবালে শুধু একজনেরই জায়গা হয় তাই যে-ভাবে শুধু এক ভারতীয় উবু হয়ে বসতে পারে, সে ভাবে-রমণীর দিকে মুখ করে বসল মেয়েটি। গ্রাম চার মাইল দূরে, এবং কার্নিসের উপরে ওরা দুজন বারবার আলোচনা করল ওদের সঙ্গিনীদের গ্রামে ফিরতে কত সময় লাগবে; দিনের এ সময়ে গ্রামে কোন্ পুরুষদের ওরা খুঁজে পেতে পারে; কি ঘটেছে তা বুঝিয়ে বলতে কতটা সময় যাবে; সব শেষে, পুরুষেরা এসে পৌঁছতে কতক্ষণ সময় লাগবে।

বাঘটি কাছেই ওৎ পেতে আছে এবং ওদের কথা শুনতে পাবে এই ভয়ে কথাবার্তা চালানো হচ্ছিল ফিসফিস করে। হঠাৎ রমণীটি আঁতকে ওঠার শব্দ করল এবং তার মুখের আতঙ্ক আর যেদিকপানে ও তাকাল তা দেখে মেয়েটি মাথা ফেরাল আর কাঁধের ওপর দিয়ে পাহাড়ের পাঁচিলের ফাটল থেকে বাঘটিকে কার্নিসে পা রাখতে দেখল।

আমার মনে হয়, আমাদের মধ্যে কম জনই সেই ভয়ংকরতম দুঃস্বপ্নটির হাত এড়াতে পেরেছেন; যে দুঃস্বপ্নে আমাদের সকল অঙ্গ ও স্বরনালী ভয়ে পঙ্গু হয়ে যায়, যখন দানবিক চেহারার কোনো ভয়ংকর জানোয়ার আমাদের ধ্বংস করতে এগোয়; প্রতি রন্ধ্র থেকে ভয়ের কালঘাম ফেলতে ফেলতে এ শুধু স্বপ্ন’ বলে ঈশ্বরকে সোচ্চার ধন্যবাদ জানিয়ে সে দুঃস্বপ্ন থেকে, জেগে উঠি আমরা। ওই হতভাগিনী মেয়েটির দুঃস্বপ্ন থেকে তেমন কোনো সুখ-স্বস্তি জাগরণ ঘটে নি এবং সে দৃশ্যটির ছবি মনে এঁকে নিতে সামান্যই কল্পনাশক্তি প্রয়োজন। একটি পাহাড়ের পাঁচিল; একটি সরু কার্নিস চলে গেছে তার একাংশ ধরে; শেষ হয়েছে ছোট এক নাবালে; তাতে পড়ে আছে এক জখম রমণী; একটি অল্পবয়সী মেয়ে ভয়ে পাথর হয়ে উবু হয়ে বসে আছে সে কার্নিসে; একটি বাঘ আস্তে আস্তে গুঁড়ি মেরে এগোচ্ছে তার দিকে; পালাবার পথ বন্ধ চারদিকে; কোনো সাহায্যের ভরসা নেই হাতের কাছে।

মেয়েরা যখন পৌঁছয় তখন আমার এক পুরনো বন্ধু মোতি সিং ওর এক অসুস্থ মেয়েকে দেখতে গ্রামে এসেছিল এবং ওই ত্রাণদলের নেতা হল। এই দলটি যখন ঘাসের ঢাল ধরে নেমে পাহাড়ের পাঁচিলের ওপর দিকে ঝুঁকে দেখল, ওরা দেখল রমণীটি অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে কার্নিসের ওপরে বড় বড় রক্তের ছাপ।

জখম রমণীটিকে নিয়ে আসা হল গ্রামে, যখন ওর জ্ঞান হল এবং ও নিজের কাহিনী বলল, মোতি সিং আমার কাছে রওনা হল আঠার মাইল হেঁটে। ও এক বুড়ো মানুষ, বয়েস ষাটের ওপারে, কিন্তু ও ক্লান্ত আর ওর জিরনো দরকার এ প্রস্তাব ও উড়িয়ে দিল। তাই আমরা দুজন তখনি রওনা হলাম তদন্ত করতে। তবে আমার করবার কিছুই ছিল না। কেননা চব্বিশ ঘণ্টা কেটে গেছে আর যে সাহসী ছোট্ট মেয়েটি তার আহত সঙ্গীর সঙ্গে স্বেচ্ছায় থেকেছিল, বাঘ তার অবশিষ্ট বলতে রেখে গেছে কয়েক টুকরো হাড় আর ছেঁড়া, রক্তমাখা জামাকাপড়।

যে বাঘ পরবর্তীকালে সরকারী নথিতে ‘মোহনের মানুষখেকো’ আখ্যা লাভ করে, এ তার হাতে নিহত মানুষদের মধ্যে প্রথম।

মেয়েটিকে মারার পর বাঘটি শীতকালের মত নেমে যায় কোশী উপত্যকা ধরে, পথে অন্য লোকদের মধ্যে হত্যা করতে করতে যায় পি. ডরু. ডি বিভাগের দুটি লোককে এবং লেজিসলেটিভ কাউন্সিলে আমাদের সদস্যের পুত্রবধূকে। গ্রীষ্ম এগিয়ে আসে যেমন, প্রথম নরহত্যার ঘটনাস্থলে ফিরে আসে ও। তারপর কয়েক বছর ধরে কোশী উপত্যকায় এপার থেকে ওপার পর্যন্ত কাকরিঘাট থেকে গর্গিয়া অব্দি প্রায় চল্লিশ মাইল জুড়ে–তার তাণ্ডব নৃত্য চালাতে থাকে। শেষ পর্যন্ত সে মোহনের ওপরে পাহাড়ের কোলে কাৰ্তকানৌলা নামে এক গ্রামের কাছাকাছি আস্তানা ঠিক করে।

এক পূর্ববর্তী গল্পে যে জেলা সম্মেলনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, তাতে সে সময়ে কুমায়ুন ডিভিশনে কার্যচালানকারী তিনটি মানুষখেকো বাঘকে তাদের গুরুত্বের পর্যায় মত এই ক্রমে ভাগ করা হয়েছিল :

প্রথম–চৌগড়, নৈনিতাল জেলা।

দ্বিতীয়–মোহন, আলমোড়া জেলা।

তৃতীয়–কান্দা, গাড়োয়াল জেলা।

চৌগড়ের বাঘটির সঙ্গে হিসেব চুকনো হয়ে গেলে পরে আলমোড়ার ডেপুটি কমিশনার বেই আমাকে মনে করিয়ে দিলেন, সে সম্মেলনে আমার দেওয়া প্রতিশ্রুতিটি আংশিক মাত্র পালন করা হয়েছে এবং মোহনের বাঘটি তালিকায় পরবর্তী। তিনি বললেন প্রত্যেক দিন বাঘটি বেশি করে সক্রিয় এবং এক বৃহত্তর উপদ্রব হয়ে উঠছে আর আগের সপ্তাহে কাৰ্তকানৌলা গ্রামের বাসিন্দা তিনটি মানুষকে মেরেছে। বেই প্রস্তাব করেছেন ওই গ্রামেই আমার যাওয়া উচিত।

আমি যখন চৌগড়ের বাঘকে নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম, বেইন কয়েকজন শিকারীকে কাৰ্তকানৌলা যেতে রাজী করিয়েছিলেন। তবে যদিও তাঁরা মানুষ ও জানোয়ারের মড়ি রেখে বসে, তবু মানুষখেকোটির নাগাল পেতে বিফল হন ও তাঁদের ঘাঁটিতে, রানীখেতে ফিরে যান। বেই জানালেন, এখন আমার এলাকায় রইল শিকারের জায়গাটি–এ সতর্কতা ব্যবস্থা খুবই প্রয়োজনীয় ছিল। মানুষখেকো শিকার করার সময়ে স্নায়ু সহজে উত্তেজিত হয় আর দুই বা ততোধিক জন যখন একই জানোয়ারকে খুঁজে ফিরছে, দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা থাকে।

.

০২.

মে মাসের এক ফোস্কা ফেলা গরম দিনে আমি, আমার দুই চাকর এবং নৈনিতাল থেকে যে দুজন গাড়োয়ালীকে এনেছিলাম তারা, রামনগর থেকে দুপুর একটার ট্রেনে নামলাম এবং কার্তকানৌলার উদ্দেশে পঁচিশ মাইল পদযাত্রার পথে রওনা হলাম। প্রথম দফায় শুধু সাত মাইল যাব কিন্তু আমরা গর্গিয়া পৌঁছবার আগে সন্ধ্যা হয়ে গেল। বেইসের চিঠি পেয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলাম তাড়াহুড়ো করে এবং গর্গিয়া ফরেস্ট বাংলো দখলের অনুমতি চাইবার সময় ছিল না, তাই ফাঁকায় ঘুমোলাম।

গর্গিয়াতে কোশী নদীর দূরের দিকে বহু শত ফুট উঁচু একটি পাহাড়ের পাঁচিল আছে, আর আমি যখন ঘুমোতে চেষ্টা করছিলাম, মনে হল পাহাড়ের পাঁচিল থেকে নিচের শিলার পাথর গড়িয়ে পড়ার শব্দ শুনতে পেলাম। দুটো পাথর প্রবল বেগে। ইকোঠুকি করলে যে বকম শব্দ হয়, এ শব্দ ঠিক তারই মত। কিছুক্ষণ বাদে, গরমের রাতে কোনো শব্দ যেমন উদ্বেগ সঞ্চার করে, এ শব্দও তাই করল আর যেহেতু চাঁদ উঠেছিল, সাপের গায়ে পা ফেলা এড়াবার পক্ষে জ্যোৎস্না যথেষ্ট উজ্জ্বল, আমি ক্যাম্প-বেড ছেড়ে তদন্ত করতে রওনা হলাম। দেখলাম, পথের পাশে এক জলায় এক দল ব্যাং শব্দটা করছে। পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে আমি জমি, জল ও গাছের ব্যাংদের অদ্ভুত সব শব্দ করতে শুনেছি, কিন্তু সেই মে মাসে গর্গিয়াতে ব্যাঙের যে শব্দ, তার মত বিদঘুঁটে শব্দ শুনি নি কখনো।

পরদিন খুব সকালে রওনা হয়ে সূর্যের তেজ বাড়ার আগেই আমরা বার মাইল রাস্তা অতিক্রম করে মোহনে পৌঁছলাম এবং আমার লোকজন যখন তাদের খাবার রান্না করছিল আর আমার চাকরেরা যখন আমার প্রাতরাশ তৈরি করছিল তখন বাংলোর চৌকিদার, দুজন বনরক্ষী আর মোহন বাজারের বেশ কয়েকজন লোক আমাকে মানুষখেকোটার গল্প শুনিয়ে আনন্দ দিচ্ছিল। তার সর্বশেষ ঘটনাটি কোশী নদীতে মাছ ধরছিল এমন এক জেলেকে কেন্দ্র করে। বনরক্ষীদের মধ্যে একজন দাবি করল সেই ছিল এই ঘটনার গর্বিত নায়ক আর সে খুব নিখুঁতভাবে বর্ণনা করল কেমনভাবে সে একদিন জেলেটার সঙ্গে বেরিয়েছিল এবং নদীর একটা বাঁক নিতেই তারা পড়েছিল মানুষখেকোটার মুখোমুখি; কেমনভাবে জেলেটা ছিপ ফেলে দিয়ে তার অর্থাৎ বনরক্ষীর কাঁধ থেকে বন্দুক ছিনিয়ে নিয়েছিল; কেমনভাবে তারা বাঘের তাড়া খেয়ে প্রাণ হাতে করে দৌড়েছিল। তুমি কি পেছনে তাকিয়েছিলে’? আমি প্রশ্ন করলাম। না সাহেব’ সে বলল আমার অজ্ঞতায় একটু তাচ্ছিল্যভরেই। যে মানুষখেকোর হাত থেকে প্রাণ নিয়ে পালাচ্ছে সে কেমনভাবে পেছন দিকে তাকায়। সে আরও বর্ণনা করল কেমনভাবে জেলেটা, যে এক পা আগে দৌড়চ্ছিল এক ফালি ঘন ঘাসের মধ্যে পড়েছিল এক ঘুমন্ত ভাল্লুকের ওপর, যার পর একটা ভয়ানক গণ্ডগোল চিৎকার চেঁচামেচির সৃষ্টি হয় এবং ভাল্লুকটি সুষ্ঠু প্রত্যেকে বিভিন্ন দিকে দৌড়য় এবং জেলেটি হারিয়ে যায়; এবং কেমনভাবে বহুক্ষণ পরে জেলেটি অবশেষে পথ খুঁজে বাংলোয় ফিরে আসে এবং তাকে অর্থাৎ বনরক্ষীকে তার রাইফেল নিয়ে পালিয়ে এসে জেলেকে একা শুধু হাতে একটা মানুষখেকো বাঘ আর একটা ক্রুদ্ধ ভাল্লুকের মহড়া দেওয়ার জন্যে ফেলে রেখে আসার বিষয়ে অনেক কথা শোনায়। বনরক্ষী তার বর্ণনা শেষ করল এই বলে যে জেলেটি মোহন ছেড়ে তার পরদিন চলে যায় এবং যাওয়ার সময় বলে যায় যে ভাল্লুকটার ওপর পড়ার সময় তার পায়ে লেগেছে আর তাছাড়া কোশী নদীতে ধরার মত মাছ একটাও নেই।

বেলা দুপুর নাগাদ আমরা আবার যাত্রার জন্যে প্রস্তুত হলাম এবং আমাদের বিদায় জানানোর মধ্যে যে ছোটখাট জনতার সমাবেশ হয়েছিল তাদের কাছ থেকে সামনের গভীর জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে যাওয়ার সময় মানুষখেকোটার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখা সম্বন্ধে নানারকম সাবধান বাণী শুনে আমরা কার্তকানৌলার চার হাজার ফুট চড়াইয়ের পথে রওনা হলাম।

আমাদের গতি ছিল মন্থর কারণ আমার লোকজনের মোটের বোঝা ছিল বেশি, পথটা ছিল অত্যন্ত খাড়াইয়ের পথ আর গরম ছিল অসহ্য। অল্প কিছুদিন আগেই, ওপরের গ্রামগুলিতে কোনো ঝঞ্ঝাট হয়েছিল যার জন্যে নৈনিতাল থেকে একটা ছোটখাট পুলিস বাহিনী পাঠাতে হয় এবং আমাকে বলে দেওয়া হয়েছিল আমার এবং আমার লোকজনদের প্রয়োজনীয় সব জিনিস সঙ্গে নিতে কারণ এই অস্বাভাবিক অবস্থায় স্থানীয়ভাবে কোনো জিনিস কিনতে পাওয়া যাবে না। আমার লোকজনদের মোটের বোঝা ভারি হওয়ার সেইটিই কারণ।

বহুবার থেমে থেমে অপরাহ্নে আমরা পৌঁছলাম চষা জমির প্রান্তে এবং এখন মানুষখেকোটির দরুণ আমার লোকজনদের আর কোনো আশঙ্কা না থাকায় আমি তাদের রেখে একাই এগোলাম ফরেস্টার্স হাট-এর দিকে যেটি দেখা যায় মোহন থেকে এবং বনরক্ষীদের মতে কার্তকানৌলায় থাকাকালীন এইটিই আমার থাকার পক্ষে সবচেয়ে ভাল জায়গা।

কুঁড়েঘরটি মোহনমুখী পাহাড়ের ঢালের ওপর এবং আমি যখন পাহাড়ের গা বেয়ে সমতল রাস্তাটি দিয়ে কুঁড়েঘরটির দিকে এগোচ্ছি তখন ঘন ঝোপঝাড়পূর্ণ একটা খাতে মোড় নিতে আমার সঙ্গে দেখা হল একটি স্ত্রীলোকের, সে কাঠের চোঙের মধ্যে দিয়ে বয়ে আসা ক্ষীণ জলধারা থেকে একটা মাটির কলসী ভরছিল। আমি রবার সোলর জুতো পরে এগোলে ও ভয় পেয়ে যেতে পারে ভেবে আমি ওর দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্যে একটু কাশলাম, লক্ষ করলাম আমার কাশির আওয়াজ শুনে ও ভয়ানক চমকে উঠল তারপর ওর কয়েকগজ দূরে একটা সিগারেট ধরানোর জন্যে দাঁড়ালাম। মিনিটখানেক কি মিনিট দুয়েক পরে মাথা না ঘুরিয়ে আমি জিজ্ঞাসা করলাম এরকম জনবিরল জায়গায় থাকা কি কারো পক্ষে নিরাপদ, একটু ইতস্তত করে স্ত্রীলোকটি উত্তর দিল নিরাপদ নয় তবে জল নিতে যেতেই হবে আর বাড়িতে তার সঙ্গে আসার মত লোক কেউ না থাকায় সে একাই এসেছে। বাড়িতে কি কোনো পুরুষমানুষ নেই? হ্যাঁ, একজন পুরুষমানুষ আছে কিন্তু সে খেতে জমি চষছে আর তাছাড়া জল আনাটা তো মেয়েদেরই কাজ। কলসীটা ভরতে কতক্ষণ সময় লাগবে? আর একটুক্ষণ। স্ত্রীলোকটির ভয় আর আড়ষ্টতা চলে গিয়েছিল এবং এবার আমাকে পড়তে হল তার প্রশ্নবানের সামনে। আমি কি পুলিস? না। আমি কি বনবিভাগের কোনো অফিসার? না। তাহলে আমি কে? নেহাতই একজন মানুষ। আমি কেন এসেছি? কাৰ্তকানৌলার লোকজনকে সাহায্য করার চেষ্টা করতে। কিভাবে? মানুষখেকোটাকে গুলি করে। মানুষখেকোর সম্বন্ধে কোথায় আমি শুনেছি?–আমি কেন একলা এসেছি?–আমার লোকজন কোথায়?- কতজন আমার সঙ্গে আছে? কতদিন আমি থাকব? এইরকম আরো কত কি।

স্ত্রীলোকটির কৌতূহল সম্পূর্ণ নিরসন না হওয়া পর্যন্ত কলসী ভরে যাওয়াটা সে গ্রাহ্যই করল না এবং আমার পেছন পেছন আসতে সে পাহাড়ের দক্ষিণ দিক দিয়ে নেমে আসা অনেকগুলি ঢালের মধ্যে একটা আমায় দেখাল এবং সেখানে ঘেসো ঢালের ওপর একটা বড় গাছ দেখিয়ে বলল তিনদিন আগে মানুষখেকোটা এই গাছটার নিচে একটি মেয়েকে মেরেছে; আমি আগ্রহভরে লক্ষ করলাম গাছটি আমার লক্ষস্থল ফরেস্টার্স-হাট থেকে মাত্র দু তিনশ গজ দূরে। আমরা এখন পাহাড়ের গা বেয়ে উঠে যাওয়া একটা পায়ে চলার পথে এসেছি, সেই পথটি ধরার সময় স্ত্রীলোকটি বলল সে যে গ্রামে থাকে সেটা পাহাড়ের গায়ে ঠিক ওদিকটায় আর যোগ করে দিল এখন সে যথেষ্ট নিরাপদ।

ভারতীয় মহিলাদের সম্বন্ধে যাঁরা জানেন তারা বুঝবেন আমার কৃতিত্ব কতখানি বিশেষ করে যদি স্মরণ করা যায় যে এই অঞ্চলে কিছুদিন আগেই পুলিসের সঙ্গে গণ্ডগোল হয়ে গেছে। স্ত্রীলোকটিকে ভয় পাইয়ে পুরো গ্রামাঞ্চলের বিরূপ মনোভাব অর্জন করার পরিবর্তে তার কলসী ভরার সময় দাঁড়িয়ে থেকে কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর দিয়ে আমি এমন একজন বন্ধু পেয়েছি যে যতদূর সম্ভব কম সময়ের মধ্যে পুরো গ্রামবাসীদের আমার উপস্থিতি সম্বন্ধে জানাবে; জানাবে যে আমি কোনো শ্রেণীর অফিসার নই এবং আমার আসার একমাত্র উদ্দেশ্য হল মানুষখেকোর সন্ত্রাস থেকে তাদের মুক্ত করা।

ফরেস্টার্স-হাট রাস্তার বাঁ দিকে প্রায় কুড়ি গজ দূরে একটা ছোট ঢিবির ওপর এবং দরজাটা শুধুমাত্র একটা শেকল দিয়ে বন্ধ থাকায় আমি দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে গেলাম। ঘরটি প্রায় দশ বর্গফুট এবং মোটামুটি পরিষ্কার কিন্তু ঘরটার মধ্যে অব্যবহারজনিত একটা ভ্যাপসা গন্ধ।

আমি জেনেছিলাম আঠার মাস আগে মানুষখেকোর আবির্ভাবের পর ঘরটিতে আর কেউ বাস করে নি। প্রধান ঘরটির দুপাশে দুটি ছোট ছোট ঘরের মতন, একটি রান্নাঘর হিসাবে ব্যবহার করা হয়, অন্যটিতে রাখা হয় জ্বালানি। কুঁড়েঘরটি আমার লোকজনের পক্ষে বেশ ভাল নিরাপদ আশ্রয় হবে এবং পেছনের দরজা খুলে ঘরে এক ঝলক হাওয়া বইতে দিয়ে আমি বাইরে গিয়ে রাস্তা এবং কুঁড়েঘরটির মাঝামাঝি আমার ৪০ পাউন্ড তাবুটা ফেলার একটা জায়গা বেছে নিলাম। কুঁড়েঘরটিতে কোনো আসবাবপত্রের চিহ্নমাত্র ছিল না, সুতরাং আমি রাস্তার ধারে একটা পাথরের ওপরে বসে আমার লোকজন পৌঁছনোর অপেক্ষা করতে লাগলাম।

পাহাড়ের ঢালটা এই জায়গাটায় প্রায় পঞ্চাশ গজ চওড়া এবং যেহেতু কুঁড়ে ঘরটি ঢালের দক্ষিণ দিকে আর গ্রামটা পাহাড়ের উত্তর দিকে, কুঁড়েঘর থেকে গ্রামটা দেখা যায় না। আমি পাথরটার ওপর প্রায় মিনিট দশেক বসে থাকার পরে গ্রামের দিক থেকে চুড়োর ওপর দিয়ে একটি মাথা দেখা গেল তারপরে দ্বিতীয় এবং তৃতীয়টি। আমার জলের কলসী বহনকারী বন্ধু আমার পৌঁছনোর সংবাদ গ্রামে পৌঁছে দিতে মোটেই কালক্ষেপ করে নি।

ভারতবর্ষে যেমন আগন্তুকেরা একে অপরের সঙ্গে মিলিত হয় এবং যখন পরস্পরের কাছ থেকে কোনো বিশেষ বিষয়ে সংবাদ সংগ্রহের ইচ্ছে তাদের থাকে, তখন এখানকার প্রচলিত রীতি হচ্ছে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সেই বিষয়টির উল্লেখ না করে, পরস্পরের পারিবারিক সুখদুঃখের আদানপ্রদান করা, যেমন বিবাহিত কিনা, বিবাহিত হলে ছেলেমেয়ে কটি, তাদের বয়স কত, বিবাহিত না হলে কেন নয়; কি কাজ করা হয় এবং উপার্জন কত ইত্যাদি, এটা ইচ্ছাকৃত হতে পারে আবার ঘটনাচক্রেও হতে পারে। যে সব প্রশ্ন পৃথিবীর অন্য যে-কোনো জায়গায় মানুষ শুনেও শুনবে না, তা ভারতে–বিশেষ আমাদের পাহাড়ে-সর্বত্র এমন অকৃত্রিম সারল্যে করা হয় যে, যে মানুষ সাধারণ মানুষজনের মধ্যে বাস করছে, সে তাতে দোষ দেখার কথা স্বপ্নেও ভাববে না। স্ত্রীলোকটির সঙ্গে কথপোকথনের সময় আমি রীতি অনুযায়ী অনেক প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিলাম, এবং যখন আমার লোকজন এসে পৌঁছল তখন আমাকে রীতিমত অমহিলা জনোচিত একান্ত পারিবারিক ধরনের প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। ওরা ছোট্ট ঝরনাটি থেকে একটা কেটলি ভরে এনেছিল এবং অবিশ্বাস্যরকম কম, সময়ের মধ্যে শুকনো কাঠ সংগ্রহ করা হল, আগুন জ্বালানো হল, জল ফোঁটানো হল এবং চা ও বিস্কুট পরিবেশন করা হল। যখন আমি এক টিন জমানো দুধ খুলছিলাম তখন শুনলাম লোকগুলি আমার চাকরদের জিজ্ঞাসা করছে টাটকা দুধের বদলে জমানো দুধ ব্যবহার করা হচ্ছে কেন তার উত্তরে তাদের বলা হচ্ছে টাটকা দুধ নেই বলে এবং যেহেতু আগে থেকেই অনুমান করা হয়েছিল গত কিছুদিন আগেকার ঝঞ্ঝাটের দরুণ এ অঞ্চলে টাটকা দুধ পাওয়া যাবে না। সেইজন্যে প্রচুর পরিমাণে টিনের দুধ সঙ্গে নিয়ে আসা হয়েছে। লোকগুলি এই কথা শুনে ভয়ানক দুঃখিত হয়েছে মনে হল এবং নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করে আলোচনার পর ওদের মধ্যে একজন, যেটা আমি পরে জেনেছিলাম কার্তকানৌলার মোড়ল, আমাকে সম্বোধন করে বলল যখন গ্রামের সব কিছুই আমার সেবার্থে, তখন টিনের দুধ নিয়ে আসায় তাদের অপমান করা হয়েছে। আমি নিজের ভুল স্বীকার করে নিলাম; বললাম ভুলটা হয়েছে কারণ আমি এ অঞ্চলে নবাগত এবং মোড়লকে আরও বললাম তাদের যদি প্রয়োজনের অতিরিক্ত দুধ থাকে আমি সানন্দে আমার প্রতিদিনের প্রয়োজন মত সামান্য দুধ কিনে নিতে পারি কিন্তু দুধ ছাড়া অন্য কোনো জিনিসের আমার প্রয়োজন নেই।

এতক্ষণে আমার জিনিসপত্রের বাঁধনছাদন খোলা হয়ে গেছে, ইতিমধ্যে আরো লোক এসেছে গ্রাম থেকে এবং আমি যখন আমার চাকরদের বললাম কোথায় আমার তাঁবুটা খাটাতে হবে তখন সমবেত গ্রামবাসীদের মধ্যে একটা ভয়ার্ত কলরব উঠল। তাবুতে বাস-বাঃ বেশ বলেছেন! আমি কি জানি না এই অঞ্চলে একটা মানুষখেকো বাঘ আছে আর সেটা প্রতি রাতে নিয়মিত এই রাস্তা ব্যবহার করে? যদি তাদের কথায় আমার সন্দেহ থাকে তাহলে রাস্তাটা যেখানে গ্রামের ওপর দিক দিয়ে গিয়েছে সেখানে এসে আমি বাড়ির দরজায় নখের আঁচড়ের দাগ দেখে যেতে পারি। তাছাড়া বাঘটা যদি আমাকে তাঁবুতে নাও খায় তাহলেও আমি রক্ষা করার জন্যে না থাকলে কুঁড়েঘরের মধ্যে আমার লোকজনদের বাঘটা নিশ্চয়ই খেয়ে ফেলবে। শেষের উক্তিটি আমার লোকজন কান খাড়া করে শুনল এবং গ্রামবাসীদের উপদেশের সঙ্গে মিলল তাদের কাকুতি মিনতি, তাই সবশেষে আমি বড় ঘরটিতে থাকতে রাজী হলাম, আমার চাকর দুজন দখল করল রান্নাঘর আর ছ’জন গাড়োয়ালী ঠাই নিল জ্বালানি রাখার ঘরে।

মানুষখেকোর বিষয়ে আলোচনা একবার চালু হয়ে যাওয়ায় আমার পক্ষেও সম্ভব হল তাতে যোগ দেওয়া, অবশ্য একথা না জানিয়ে যে ঢালুর ওপর প্রথম মাথাটি যখন দেখি তখন থেকেই এই একটি মাত্র বিষয়ে আলোচনা করাই আমার ইচ্ছে ছিল। বাঘটা যেখানে তার শেষ শিকারটি মারে সেই গাছটার দিকে যাওয়ার রাস্তাটা আমায় দেখিয়ে দেওয়া হল, বিশদভাবে বলা হল দিনের কোন সময়ে কোন অবস্থায় মেয়েটি মারা পড়েছিল। আমাকে জানানো হল যে–যে রাস্তা দিয়ে বাঘটি প্রতি রাত্রে আসে সেটি পুবমুখী হয়ে বৈতাল ঘাট পর্যন্ত গিয়েছে, তারই একটি শাখা গিয়েছে মোহনে আর রাস্তাটি গ্রামের ওপরাংশের এবং চষা জমির মধ্যে দিয়ে আধ মাইলটাক গিয়ে পাহাড়ের গা বেয়ে দক্ষিণে মোড় নিয়েছে তারপর যে ঢলটার ওপর কুঁড়েঘরটা অবস্থিত সেটার সঙ্গে মিলে ঢাল বরাবর চাকনাকল পর্যন্ত চলে গিয়েছে। কার্তকানৌলা এবং চাকনাকলের মধ্যে রাস্তার ছয় মাইল লম্বা এই অংশটি অত্যন্ত বিপজ্জনক বলে পরিগণিত এবং মানুষখেকোর আবির্ভাবের পর আর ব্যবহার করা হয় নি; আমি পরে দেখেছিলাম যে চষা খেত ছাড়ার পর রাস্তাটা গিয়ে ঢেকে ঘন গাছ আর ঝোপের জঙ্গলের মধ্যে আর সেটার বিস্তার একেবারে নদী পর্যন্ত।

কাৰ্তকানৌলা গ্রামের প্রধান চাষবাস সবই পাহাড়ের উত্তর কোলে এবং এই খেতগুলির পরে অনেকগুলি ছোট ছোট ঢাল মতন আর তার মধ্যে মধ্যে গভীর গিরিখাত, ফরেস্টার্স-হাট থেকে প্রায় হাজার গজ মত দূরে সব চেয়ে কাছের ঢালটিতে একটা বড় পাইন গাছ আছে। এই গাছটির কাছে প্রায় দশদিন আগে বাঘটা একটি। মোষকে মেরে, আংশিকভাবে খেয়ে ফেলে রেখে গিয়েছিল এবং যে তিনজন শিকারী চারমাইল দূরে একটা ফরেস্ট বাংলোতে ছিলেন তাঁরা পাইন গাছটাতে উঠতে না • পারায় গ্রামের লোকেরা তিনটে আলাদা গাছে তিনটে মাচা বেঁধে দিয়েছিল–মড়ি থেকে গাছগুলির দূরত্ব ছিল একশো দেড়শো গজের মধ্যে আর সন্ধের একটু আগেই শিকারীরা চাকরদের নিয়ে মাচায় উঠে বসেন। প্রথম সন্ধের চাঁদ তখন ছিল আকাশে, চাঁদ ডুবে যাওয়ার পর গ্রামবাসীরা বেশ কিছু বন্দুক ছোঁড়ার আওয়াজ পায় এবং পরদিন সকালে চাকরদের জিজ্ঞাসা করায় তারা উত্তর দেয় তারা জানে না কিসের দিকে গুলি ছোঁড়া হয় কারণ তারা নিজেরা কিছুই দেখে নি। দুদিন পরে একটি গরু মারা পড়াতে শিকারীরা তার মড়ির ওপর বসেন এবং আবার গতবারের মতনই চাঁদ ডুবে যাওয়ার পর গুলি চালানো হয়। মানুষখেকো মারার এই নিঃসন্দেহে শিকারীসুলভ কিন্তু ব্যর্থ চেষ্টাগুলিই মানুষখেকোদের অসম্ভব সতর্ক করে দেয়, আর ওরা আরও যতদিন বাঁচে ওদের গুলি করাও ততই কঠিন হয়ে ওঠে।

গ্রামবাসীরা আমাকে বাঘটি সম্বন্ধে একটি চিত্তাকর্ষী খবর দিল। ওরা বলল বাঘটা যখনই গ্রামে আসে তখনই ওরা বাঘটার উপস্থিতি সম্বন্ধে টের পেয়ে যায় একটা চাপা বিলাপের গোঙানি থেকে। ওদের আরো প্রশ্ন করে আমি জানলাম বাঘটা যখন বাড়িঘরের পাস দিয়ে যায় তখন গোঙানিটা হয় একটানা কিন্তু অন্যান্য সময়ে গোঙানিটা কোনো সময় কম বা কোনো সময় বেশিক্ষণের জন্যে থেমে থাকে।

তথ্যটি থেকে আমি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছলাম যে (ক) বাঘটি কোনো জখম থেকে ভুগছে (খ) যে জখমটি এমনই যে একমাত্র চলার সময়েই এর ব্যথা টের পাওয়া যায় সুতরাং (গ) জখমটা ওর কোনো একটা পায়ে। আমাকে জানানো হল যে কোন স্থানীয় শিকারী বা রানীখেত থেকে যে শিকারীরা বাঘটার জন্যে বসেছিল তাদের দ্বারা বাঘটা জখম হয় নি। যাই হক এর কোনো গুরুত্বই নেই কারণ বাঘটা বহু বছর ধরেই মানুষখেকো এবং যে জখমে ও ভুগছে বলে আমার বিশ্বাস সেটাই হয়তো ওর মানুষখেকো হয়ে ওঠার মূল কারণ। খুবই কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় কিন্তু কৌতূহল নিরসন করা যাবে একমাত্র বাঘটাকে পরখ করে–এবং মারা যাওয়ার পর।

বাঘটার গোঙানি সম্বন্ধে আমার কৌতূহলের কারণ জানতে লোকগুলি উৎসুক হল এবং যখন আমি বললাম যে এই ধরনের গোঙানির মানে বাঘটার একটা পায়ে জখম আছে আর সে জখমটা হয়েছে হয় বুলেটে নয় শজারুর কাটায়। তারা আমার যুক্তির সঙ্গে একমত হল না, বলল তারা বাঘটার যেটুকু দেখেছে তাতে বাঘটা সম্পূর্ণ সুস্থ বলেই মনে হয়, তাছাড়া যেরকম অনায়াসে সে শিকার মেরে বয়ে নিয়ে যায় তাতেই প্রমাণ হয় যে বাঘটা কোনোভাবেই পঙ্গু নয়। যাই হক আমি ওদের যা বলেছিলাম তা তারা স্মরণে রেখেছিল এবং পরে এক দিব্য দৃষ্টির অধিকারী হিসাবে আমার সুনাম অর্জনের সহায়ক হয়েছিল।

 রামনগর দিয়ে যাওয়ার সময় আমি তহশীলদারকে আমার জন্যে দুটো বাচ্চা মদ্দা মোষ কিনে মোহনে পাঠিয়ে দিতে বলেছিলাম যেখানে আমার লোকজন সেগুলির জিম্মা নিয়ে নেবে।

আমি গ্রামের লোকজনদের বললাম যে গাছটির নিচে তিনদিন আগে মেয়েটি মারা পড়েছে তার কাছে একটা ও চাকনাকালের রাস্তায় একটা মোষ আমি বাঁধতে চাই–তারা বলল এর থেকে ভাল জায়গা তাদের চোখে পড়ছে না কিন্তু ব্যাপারটা ওরা নিজেদের মধ্যে একটু আলোচনা করে নেবে এবং সকালে আমাকে জানাবে এ সম্বন্ধে ওদের অন্য কোনো পরামর্শ আছে কিনা। এখন রাত ঘনিয়ে আসছে এবং যাওয়ার আগে মোড়ল আমায় কথা দিয়ে গেল যে সকালে আশপাশের সব গ্রামে আমার পৌঁছনোর খবর পাঠিয়ে দেবে, আমার আসার কারণ জানিয়ে দেবে এবং কোনো সময় নষ্ট না করে তাদের এলাকায় বাঘের কোনো শিকার বা আক্রমণের সংবাদ আমাকে পৌঁছে দেওয়ার গুরুত্ব বুঝিয়ে দেবে।

ঘরের ভ্যাপসা গন্ধটা এখনও বোঝা গেলেও অনেক কমে গিয়েছিল। যাই হক আমি আর ওদিকে নজর না দিয়ে স্নান, রাতের খাওয়া সেরে দরজায় দুটো পাথর চাপা দিলাম এছাড়া দরজা দুটো বন্ধ রাখার কোনো উপায় ছিল না–তারপর সারাদিনের পরিশ্রমে ক্লান্তিতে ভেঙে পড়া শরীর নিয়ে বিছানায় শুয়ে ঘুমোতে গেলাম। আমার ঘুম হাল্কা এবং দুতিন ঘণ্টা পরে জঙ্গলে একটা জানোয়ারের ঘোরাফেরার আওয়াজে জেগে উঠলাম। জানোয়ারটা এসেছে একেবারে পেছনের দরজা পর্যন্ত। রাইফেল আর টর্চ নিয়ে পা দিয়ে পাথর সরিয়ে দিয়ে যখন বাইরে এলাম তখন একটা জানোটারের সরে যাওয়ার শব্দ পেলাম–যে ধরনের আওয়াজ করছিল তাতে ওটা বাঘও হতে পারে অবশ্য কোনো চিতা বা শজারু হওয়াও অস্বাভাবিক নয়। যাই হক ওটা কি তা দেখার পক্ষে জঙ্গলটা বেশি ঘন ছিল। ঘরে ফিরে এসে পাথরটা যথাস্থানে আবার লাগিয়ে লক্ষ করলাম গলাটা খুসখুস করছে–ভাবলাম মোহন থেকে ঘেমে নেয়ে হেঁটে এসে হাওয়ায় বসার ফলেই এটা হয়েছে; কিন্তু আমার চাকর যখন দরজা ঠেলে খুলে আমার ভোরের চায়ের কাপ নিয়ে এল আমি বুঝলাম আমার যেটা হয়েছে সেটা হচ্ছে ল্যারিনজাইটিস হয়তো বাদুড়ভর্তি ছাদওয়ালা বহুদিনের অব্যবহৃত একটা কুঁড়েঘরে শোওয়ার জন্যেই এটা হয়েছে। আমার চাকর জানাল সে এবং তার সঙ্গী এই সংক্রমণের হাত থেকে বেঁচে গিয়েছে কিন্তু জ্বালানির ঘরে ছ’জন গাড়োয়ালীও আমারই মত একই অসুখে ভুগছে। আমার ওষুধের মধ্যে ছিল আইডিনের একটা দু আউন্সের বোতল আর কয়েকটা কুইনিন ট্যাবলেট এবং আমার বন্দুকের খাপ আঁতিপাঁতি করে খুঁজে বেরোল এক প্যাকেট পারম্যাংগানেট যেটি আমার বোন আমার আগের কোনো অভিযানের সময় আমার সঙ্গে দিয়ে দিয়েছিল। প্যাকেটটা বন্দুকের তেলে একেবারে ভিজে গিয়েছিল কিন্তু গুঁড়োগুলো এখনও গলবার মত আছে এবং আমি একটা টিনে গরম জলের মধ্যে বেশ কিছু গুঁড়ো কিছুটা আইডিনের সঙ্গে ঢেলে দিলাম। পরের কুলকুচিটা খুব কাজের হয়েছিল এবং আমাদের দাঁত কালো হয়ে গেলেও এর দরুণই আমাদের গলা খুসখুসি ভাল হয়ে গিয়েছিল।

সকালে তাড়াতাড়ি প্রাতরাশ সেরে নেওয়ার পর আমি চারজন লোককে মোহনে পাঠালাম মোষ দুটি নিয়ে আসতে এবং নিজে বেরিয়ে গেলাম যে জমিতে মেয়েটি মারা পড়েছিল সেই জমিটি সরেজমিনে তল্লাসী করার জন্যে। গতরাতে আমি যে নির্দেশ পেয়েছিলাম তাতে কাটা ঘাস বেঁধে আঁটি করার সময় মেয়েটিকে যেখানে বাঘটি আক্রমণ করে ও মেরে ফেলে সে জায়গাটা খুঁজে নিতে বিশেষ বেগ পেতে হল না। ঘাস ও যে দড়িটা সে ব্যবহার করেছিল সেগুলি যেমন ছিল তেমনিভাবেই পড়ে আছে। আরও আছে ওর সঙ্গীরা ভয়ে গ্রামের দিকে দৌড়ে পালানোর সময় যে দু বোঝা ঘাস ফেলে যায় সেই দুটি। লোকেরা আমায় বলেছিল যে মেয়েটির দেহ খুঁজে পাওয়া যায় নি কিন্তু যেহেতু তিনটি ভাল মাপের দড়ি এবং মেয়েটির কাস্তে জঙ্গলে পড়েছিল, আমার মনে হয় মেয়েটিকে খুঁজে বার করার কোনো চেষ্টাই করা হয় নি।

মেয়েটি মারা পড়েছিল একটা ছোট মাটির ধসের ওপরের দিকটায় এবং বাঘটা ওকে ঢাল দিয়ে নিচে নিয়ে গিয়েছিল একটা ঘন ঝোপের মধ্যে। এখানে বাঘটা অপেক্ষা করেছিল সম্ভবত অন্য দুটি স্ত্রীলোককে দৃষ্টির বাইরে চলে যাওয়ার সময় দেওয়ার জন্যে এবং তারপর কুঁড়েঘর থেকে যে ঢালটা দেখা যায় সেটা পেরিয়ে মড়ি নিয়ে পাহাড়ের গা বেয়ে সোজা মাইলখানেক কি তারও বেশি নেমে যায় ঘন ঝোপঝাড় বৃক্ষ সমাকীর্ণ জঙ্গলে। ছাপগুলো এখন প্রায় চারদিনের পুরনো তাই সেগুলো অনুসরণ করে কোনো লাভ নেই বলে আমি কুঁড়েঘরের দিকে ফিরলাম।

চালের ওপরে ওঠার চড়াইটা খুব খাড়া এবং আমি যখন বেলা দুপুর নাগাদ কুঁড়েঘরে পৌঁছলাম তখন দেখলাম বারান্দায় বিভিন্ন আকার ও মাপের সারি সারি নানাধরনের পাত্র–সব কিছুর মধ্যেই দুধ। আগের দিনের দুর্ভিক্ষের তুলনায় আজ প্রাচুর্য, সত্যি বলতে কি দুধ যা ছিল তাতে আমি স্নান করতে পারি। আমার চাকরেরা জানাল তারা বারণ করেছিল কিন্তু কোনো ফল হয় নি, প্রতিটি লোক বারান্দায় পাত্র রাখার সময় বলেছে যে সে দেখবে ওদের মধ্যে থাকার সময়ে আমার জমানো দুধ যেন না খেতে হয়।

মোহন থেকে মোষগুলি নিয়ে লোকেরা রাতের আগে ফিরে আসতে পারবে বলে মনে হয় না তাই মধ্যাহ্নভোজনের পর আমি চাকনাকলের রাস্তাটা একবার দেখার জন্যে বেরোলাম।

কুঁড়েঘর থেকে পাহাড়ের ঢালটা প্রায় পাঁচশো ফুট পর্যন্ত উঠে গেছে এবং আকারে এটা মোটামুটি ত্রিভূজাকৃতি। রাস্তাটা, চষা জমির মধ্য দিয়ে আধ মাইলটাক গিয়ে তির্যকভাবে বাঁদিকে সরে গেছে, তারপর একটা খাড়া পাথুরে পাহাড়ের গা বেয়ে আবার মিলেছে ঢালটার সঙ্গে এবং পরে ডান দিকে মোড় নিয়ে ঢালবরাবর চলে গেছে চাকনাকল পর্যন্ত। ঢাল থেকে বেরনোর পর রাস্তাটা কিছুটা সমতল তারপর খাড়া নেমে গেছে নিচের দিকে, চুলের কাটার মত কিছু বাঁক ঢালের খাড়াইটি কিছুটা সহজ করে দিয়েছে।

সারা বিকেলটাই আমার হাতে, তাই রাস্তাটার তিন মাইল অংশ খুব ভালভাবেই পরীক্ষা করে দেখলাম। যখন কোনো বাঘ কোনো একটা রাস্তা নিয়মিতভাবে ব্যবহার করে তখন রাস্তার ধারে আঁচড়ের দাগে সে তার যাতায়াতের নিশানা রেখে যেতে বাধ্য। এই আঁচড়ের দাগগুলি যে কারণে পোষা বেড়াল বা বেড়াল বংশজাত সব জীবই করে সেই একই কারণে করা, এবং শিকারীদের কাছে অত্যন্ত জরুরী কারণ; এর থেকে নিম্নলিখিত মূল্যবান তথ্যগুলি জানা যায় : (১) যে জানোনায়ারটি আঁচড়ের দাগগুলি কেটেছে সে স্ত্রী না পুরুষ, (২) কোন দিকে ছিল তার গতি, (৩) ও চলে যাওয়ার পর কতটা সময় কেটেছে (৪) ওর আবাসস্থলের দিক এবং দূরত্ব (৫) ও যা শিকার করে তাদের প্রকৃতি এবং সর্বশেষে (৬) অল্পদিনের মধ্যে জানোয়ারটি নরমাংসের স্বাদ পেয়েছে কিনা। এমন একজন যে সম্পূর্ণ অজানা জায়গায় একটা মানুষখেকোকে খুঁজে বেড়াচ্ছে তার কাছে এই সহজলভ্য তথ্যের গুরুত্ব সহজেই অনুমেয়। বাঘেরা যে রাস্তা ব্যবহার করে তার ওপর থাবার ছাপও রেখে যায়। এই থাবার ছাপগুলিও অনেক প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ করতে পারে যেমন জানোয়ারটা কোনদিকে যাচ্ছিল এবং তার গতি কি ছিল, ও পুরুষ না নারী, ওর বয়েস, ওর চারটে পা-ই সুস্থ কিনা, তাহলে কোন বিশেষ পা-টিতেও খুঁত আছে।

যে পথটার ওপর আমি দাঁড়িয়েছিলাম সেই পথটা দীর্ঘকাল অব্যবহারের ফলে ছোট ছোট শক্ত ঘাস জন্মিয়েছিল সেইজন্যে দু একটি স্যাঁতসেঁতে জায়গা ছাড়া পথটি থাবার ছাপ ফেলার পক্ষে মোটেই উপযোগী নয়। পথটা যেখানে ঢাল থেকে বেরিয়েছে তার কয়েক গজের মধ্যেই এরকম একটা ভিজে জায়গা ছিল আর ঠিক সেই জায়গাটির নিচে একটা খুব সবুজ বদ্ধজলের ডোবা ছিল; সম্বরদের নিয়মিত জল খাওয়ার জায়গা ওটা।

চষা জমি ছেড়ে পথটা যেখানে বাঁদিকে ঘুরছে সেই মোড়ে আমি বেশ কয়েকটা আঁচড়ের দাগ দেখলাম, তার মধ্যে সবচেয়ে টাটকা যেটা সেটা প্রায় তিন দিনের পুরনো। এই আঁচড়ের দাগগুলি থেকে দুশো গজ দুরে পথটা তার চওড়ার প্রায় এক তৃতীয়াংশ ঢাকা একটা পাথরের নিচে দিয়ে গিয়েছে। পাথরটা দশ ফুটটাক উঁচু হবে এবং এর ওপরে দু-তিন গজ চওড়া একটা চ্যাটাল জায়গা যেটা দেখা যায় একমাত্র গ্রামের দিক থেকে পথটা দিয়ে পাথরটার দিকে এগোলে। আমি ঢালের ওপর আরও আঁচড়ের দাগ দেখলাম কিন্তু থাবার ছাপ দেখলাম প্রথম চুলের কাটা সদৃশ বাঁকের কাছে আসার পর। এখানে বাঁকটা কাটানোর জন্যে বাঘটা লাফ দিয়ে নরম মাটিতে পড়ে সেখানে কিছু ছাপ রেখে যায়। ছাপগুলো একদিনের পুরনো আর কিছুটা বিকৃত হয়ে গেলেও বোঝা কঠিন নয় যে ছাপগুলো করেছে একটা বিরাট, বয়স্ক, পুরুষ বাঘ।

একটা মানুষখেকো সন্ত্রাস সৃষ্টি করছে এরকম অঞ্চলে যখন কেউ ঘোরাফেরা করেন তখন গতি স্বভাবতই হয় খুব মন্থর কারণ চলার পথে যে কোনো বাধার দিকে, সে একটা ঝোঁপই হক, গাছই হক আর পাথরই হ’ক বা যার আড়ালে মৃত্যু আত্মগোপন করে থাকতে পারে এমন অসমতল জমিই হক, খুব সতর্কভাবে এগোতে হয়, সেই একই সঙ্গে যদি হাওয়া না থাকে–যেমন সে সন্ধেবেলায় ছিল না–প্রতি মুহূর্তে পেছনে ও দুপাশে সতর্ক সজাগ দৃষ্টি রাখতে হয়। এছাড়া, দেখার জিনিসও সেখানে ছিল প্রচুর, কারণ সময়টা মে মাস, তখন এই উচ্চতায় অর্থাৎ ৪০০০ থেকে ৫০০০ ফুটের মধ্যে অর্কিড ফোঁটার সবচেয়ে ভাল সময় এবং অর্কিড়ের বৈচিত্র্যে, সমারোহে সেদিন পাহাড়ের ওপর যা দেখেছিলাম ঠিক তেমনটি আর আমি কখনও দেখি নি। সবচেয়ে বেশি প্রাচুর্য ছিল অপূর্ব সাদা প্রজাপতি অর্কিডের–যে কোনো আকারের প্রতি দ্বিতীয় গাছটি মনে হচ্ছিল যেন এই ফুলের সাজে সেজে এসেছে।

এইখানেই আমি প্রথম সেই পাখিটি দেখি যেটা পরে বম্বে ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটির প্রেটার মাউন্টেন ‘ক্র্যাগমার্টিন পাখি’ বলে পরিচয় করিয়ে দেন। পাখিটির গায়ের রং ধূসর আর ঠিক বুকের কাছটায় একটু গোলাপীর ছোঁয়া, আকারে গোলাপী শালিক পাখির থেকে একটু ছোট। এই পাখিগুলির সঙ্গে ছিল তাদের বাচ্চা, আর বাচ্চারা প্রতি পাখির চারটে করে বাচ্চা সার দিয়ে বসে ছিল একটা খুব উঁচু গাছের ওপর শুকনো একটা ডালে আর মা পাখিগুলো পোকামাকড় ধরার জন্যে উড়ে উড়ে যাচ্ছিল, কখনও কখনও দু তিনশো গজ দূর পর্যন্ত। আশ্চর্য গতিতে ওরা উড়ে যাচ্ছিল আর পাখার রং? আমি নিশ্চিত যে উত্তর ভারতে কোনো পাখির চেয়ে কোনো অংশে কম নয়, ওরা আমাদের শীতকালীন অতিথি তিব্বতী সোয়ালোককে বাদ না দিলেও। এই পাখিগুলির সম্বন্ধে আর একটি আশ্চর্য জিনিস হচ্ছে এদের অদ্ভুত দৃষ্টিশক্তি। কোনো কোনো সময়ে ওরা একেবারে সোজা কয়েকশো গজ উড়ে গিয়ে মোড় নিয়ে ফিরে আসছিল। যে গতিতে ওরা যাচ্ছিল তাতে কোনো উড়ন্ত পোকাকে তাড়া করা অসম্ভব কিন্তু প্রতিবার ফেরার পরেই পাখিটি নিশ্চিতভাবে কোনো একটা হাঁ করা মুখে ছোট্ট কিছু একটা ঢুকিয়ে দিচ্ছিল–আমার বিশ্বাস যে দূরত্ব থেকে ওরা পোকামাকড় পরিষ্কার দেখতে পায় সে দূরত্ব থেকে মানুষের চোখ সবচেয়ে শক্তিশালী দূরবীনের সাহায্যেও কিছুই দেখতে পাবে না।

প্রাণ বাঁচিয়ে চলতে চলতে থাবার ছাপ খুঁজতে খুঁজতে, প্রকৃতির দাক্ষিণ্য উপভোগ করতে করতে, আর জঙ্গলে নানারকম বিচিত্র শব্দ শুনতে শুনতে–একটা সম্বর মোহনের দিকে পাহাড়ের প্রায় এক মাইল নিচে একটা বাঘের উপস্থিতি সম্বন্ধে জঙ্গলবাসীদের হুশিয়ারী জানাচ্ছিল এবং চাকনাকলের রাস্তার ওপর একটা কাকার আর একটা হনুমান অন্যান্য জঙ্গলবাসীদের একটা চিতার উপস্থিতি জানিয়ে দিচ্ছিল-সময় খুব তাড়াতাড়ি কেটে গেল এবং আমি যখন সেই ঝুলে থাকা পাথরটার কাছে ফিরে এলাম তখন সূর্য অস্ত যাচ্ছে। পাথরটার দিকে এগোতে এগোতে এটাকেই, এ পর্যন্ত যত জমি আমি পরখ করেছি তার মধ্যে সবচেয়ে বিপজ্জনক জায়গা হিসাবে চিহ্নিত করলাম। পাথরের ওপর ঘাসে ঢাকা জমির ফালিটুকুর ওপর একটা বাঘ শুয়ে থাকলে তাকে শুধু অপেক্ষা করতে হবে কতক্ষণে কেউ পথের ওপর দিকে বা নিচের দিকে যাওয়া আসার পথে পাথরটার নিচে আসে বা পেরিয়ে যায়, কারণ সে তখন থাকবে বাঘটার সম্পূর্ণ এক্তিয়ারের মধ্যে–সত্যিই জায়গাটা বিপজ্জনক এবং এটা মনে রাখা বিশেষ দরকার।

কুঁড়েঘরে ফিরে গিয়ে দেখলাম মোষ দুটো পৌঁছে গেছে কিন্তু তাদের নিয়ে কিছু করার পক্ষে সে সন্ধ্যেবেলা একটু বেশি দেরি হয়ে গেছে।

আমার চাকরেরা কুঁড়েঘরের মধ্যে সারাদিন আগুন জ্বালিয়ে রেখেছিল, তাই ভেতরের হাওয়াটা পরিষ্কার, মধুর কিন্তু আমি আর বন্ধ ঘরে শোয়ার ঝুঁকি নিতে রাজী নই; সেইজন্যে আমি শুতে যাওয়ার আগে তাদের দিয়ে দুটো কাঁটা ঝোঁপ কাটিয়ে দরজায় বেড়ার মত বসিয়ে দিলাম। সে রাতে পেছনের দরজার কাছে জঙ্গলে কোনো চলাফেরার শব্দ ছিল না, এবং গাঢ় ঘুমের পর সকালে যখন উঠলাম তখন গলা অনেকটা ভাল।

সকালের বেশির ভাগ সময়টা আমার কাটল গ্রামের লোকজনের সঙ্গে কথাবার্তা বলে, মানুষখেকোটা সম্বন্ধে তাদের নানারকমের গল্প শুনে আর সেটাকে গুলি করার কতরকমের চেষ্টা হয়েছে সেই কথা শুনে এবং মধ্যাহ্ন ভোজনের পর আমি বাঘটা স্ত্রীলোকটিকে বয়ে নিয়ে যাওয়ার সময় যে ঢালটার ওপর দিয়ে গিয়েছিল সেখানে একটা মোষ বেঁধে দিলাম আর অন্যটা বাঁধলাম সেই চুলের কাটার মত বাঁকের কাছে যেখানে আমি বাঘটার থাবার ছাপ দেখি।

পরদিন সকালে দেখি যে প্রচুর ঘাস ওদের দেওয়া হয়েছিল তার অধিকাংশই শেষ করে দুটি মোষই শান্তিতে ঘুমোচ্ছে। আমি দুটো জন্তুর গলাতেই ঘণ্টা বেঁধে দিয়েছিলাম তাই যখন আমি এগোতেও ঘণ্টার কোনো আওয়াজ হল না তখন আমাকে হতাশ হতে হল দুবার কারণ আগেই বলেছি দুটি মোষই ছিল শান্তিতে নিদ্রামগ্ন। সেই সন্ধেবেলা আমি দ্বিতীয় মোষটিকে চুলের কাটার মত বাঁকটি থেকে সরিয়ে পথটা যেখানে ঢাল থেকে বেরিয়েছে সেই বন্ধ জলের ভোবাটার কাছে বাঁধলাম।

বাঘ শিকারের সময় যে পন্থাগুলি সাধারণভাবে গ্রহণ করা হয় সেগুলি সংক্ষেপে বলা যায় : (ক) বসে থাকা এবং (খ) জঙ্গল-হাঁকানো এবং এই দুটি ক্ষেত্রেই পুরুষ মোষ টোপ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। যে উপায়ে এগুলি করা হয় সেগুলি হচ্ছে বসার বা হাঁকানোর সবচেয়ে সুবিধাজনক একটা জায়গা বেছে নেওয়া, সন্ধে গম্ভীর হলে টোপটাকে এমন একটা দড়ি দিয়ে বেঁধে নেওয়া যেটা টোপটা ছিঁড়তে পারবে না কিন্তু বাঘ পারবে, টোপটা একবার নেওয়া হয়ে গেলে গাছের ওপর মাচায় মড়িটার ওপর চোখ রেখে বসে থাকা কিংবা যে গোপন জায়গায় মড়িটা নিয়ে যাওয়া হয়েছে সেই জায়গাটা হাঁকানো।

বর্তমান ক্ষেত্রে এ দুটো পন্থার কোনটিই প্রযোজ্য নয়। আমার গলা, যদিও আগের চেয়ে অনেকটা ভাল, তবে এখনও খুসখুস করছে তাই আমার পক্ষে না কেশে চুপ করে বেশিক্ষণ বসে থাকা অসম্ভব আর এই রকম বৃক্ষ সমাকীর্ণ, ভাঙাচোরা জমির বিস্তীর্ণ অঞ্চলে হাঁকাই করে কোনো লাভই হত না আমি একহাজার লোক যোগাড় করতে পারলেও, সেইজন্যে আমি বাঘটার পিছু নেওয়াই স্থির করলাম আর সেই উদ্দেশ্য নিয়েই মোষ দুটোকে বাঁধার জায়গা বাছলাম এবং তাদের চারটে এক ইঞ্চি মোটা পাটের দড়ি দিয়ে মজবুত চারা গাছের সঙ্গে বাঁধলাম আর পুরো চব্বিশ ঘণ্টার জন্যে তাদের ছেড়ে এলাম জঙ্গলে।

আমি এবার প্রতি সকালে, গুলি করার মত যথেষ্ট আলো ফোঁটার সঙ্গে সঙ্গে পালা করে মোষ দুটোর কাছে যেতে থাকলাম-সেই একই ব্যাপার আবার সন্ধেবেলায়; কারণ বাঘেরা সে মানুষখেকো হ’ক বা নাই হ’ক, যে সব অঞ্চলে বাধা পায় না সেসব জায়গায় রাতে যেমন শিকার মারে দিনেও তেমনি, দিনের বেলা আমি যখন আশপাশের গ্রাম থেকে খবরের জন্যে অপেক্ষা করতাম, গলার চিকিৎসা করতাম আর বিশ্রাম নিতাম তখন আমার ছ’জন গাড়োয়ালী মোষগুলোকে খাইয়ে, জল খাইয়ে আসত।

চতুর্থ সন্ধেবেলা সূর্যাস্তের সময়ে আমি যখন ঢালের ওপরকার মোষটাকে দেখে ফিরছি তখন ঝুলে থাকা পাথরটার তিরিশ গজ দূরে একটা বাঁকের মুখে এসেই হঠাৎ কার্তকানেীলাতে আসার পর এই প্রথম, আমি অনুভব করলাম আমি বিপদের মধ্যে আর সে বিপদ আমার জন্যে ওৎ পেতে আছে, তা আমার সামনে ওই পাথরটার ওপর। পাঁচ মিনিট আমি নিশ্চলভাবে দাঁড়িয়ে রইলাম, আমার দৃষ্টি পাথরটার ওপর দিকে, কোনো নড়াচড়া যদি ওখানে দেখা যায়। এত কাছে চোখের পলক পড়লেও তা আমি দেখতে পেতাম কিন্তু সামান্যতম নড়াচড়ার কোনো আভাসও আমি সেখানে। পেলাম না; দশ পা এগিয়ে আবার আমি বেশ কয়েক মিনিট দাঁড়িয়ে লক্ষ করলাম। কোন নড়াচড়া না দেখে আমি মোটেই আশ্বস্ত হলাম না-মানুষখেকোটা যে ওই পাথরের ওপরেই আছে সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত, এখন প্রশ্ন হচ্ছে আমার কর্তব্য কি? পাহাড়টা আমি আগেই আপনাদের বলেছি, ভীষণ খাড়া, বড় বড় পাথর বেরিয়ে আছে তার গা থেকে আর বড় বড় ঘাস, গাছ আর ঝোঁপঝাড়ের জঙ্গলে ভর্তি। রাস্তা যত কঠিনই হক এটা যদি দিনের আরো আগে হত তাহলে আমি ফিরে গিয়ে ঘুরে বাঘটার ওপরে গুলি করার চেষ্টা করতাম, কিন্তু যখন দিনের আলো আছে মাত্র আর আধ ঘন্টা আর আমাকে যেতে হবে প্রায় এক মাইল রাস্তা তখন পথটা ছাড়া পাগলামিরই সামিল হত। তাই সেফটি ক্যাচটা তুলে রাইফেলটা কাঁধে রেখে আমি পাথরটা পেরোতে আরম্ভ করলাম।

এখানে রাস্তাটা প্রায় আট ফুট চওড়া এবং আমি রাস্তাটার একেবারে বাইরের ধারে গিয়ে কাঁকড়ার মতন হাঁটতে শুরু করলাম শরীরের ভার দেওয়ার আগে পা দিয়ে অনুভব করে করে এক পা এক পা এগোতে হচ্ছিল আমাকে, কারণ তা না হলেই পা হড়কে একেবারে শূন্যে। এগোনো খুব কষ্টসাধ্য ছিল আর স্বভাবতই আমার গতি ছিল খুব ধীরে, কিন্তু আমি যখন ঝুলন্ত পাথরটার নিচে, যখন আমি ওটা পেরিয়ে এলাম তখন আমার আশা হল যে, যেখানে বাঘটা শুয়ে আছে, পাথরের ওপরকার সেই সমতল জায়গাটা যেখান থেকে দেখা যায়, পথের সেই অংশটায় যাওয়া অব্দি বাঘটা সেখানেই থাকবে। বাঘটা অবশ্য আমার অসতর্ক অবস্থায় না পেয়ে কোনো আচরণে ঝুঁকি নিচ্ছিল না এবং আমি পাথরটা পেরনো মাত্রই ওপরে একটা চাপা গর্জন শুনতে পেলাম তার একটু পরেই একটা কাকার ডাকতে ডাকতে দৌড়ে ডান দিকে চলে গেল, তারপর দুটো সম্বর ত্রিভুজাকৃতি পাহাড়টার চূড়ার কাছে ডাকতে শুরু করল।

বাঘটা সুস্থ শরীরেই চলে গেল। তবে সত্যি কথা বলতে কি আমিও ফিরেছিলাম বহাল তবিয়তেই, তাই আক্ষেপের কিছু নেই আর সম্বরের ডাক অনুযায়ী পাহাড়ের যে জায়গাটায় ও আছে সেখান থেকে বন্ধ জলের ডোবার কাছে ঢালটার ওপর বাঁধা আমার মোষের গলায় বাঁধা ঘন্টার আওয়াজও শুনতে পাব সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত ছিলাম।

চষা জমির কাছে পৌঁছে দেখলাম আমার জন্যে একজন লোক অপেক্ষা করছে। ওরা কাকার ও সম্বরের ডাক শুনেছিল এবং আমি বাঘটা দেখি নি শুনে ওরা খুব হতাশ হল কিন্তু ওরা আবার উৎফুল্ল হয়ে উঠল যখন শুনল কাল সকালে আমার বিরাট আশা আছে।

রাত্রে একটা ধূলোর ঝড় উঠল, তারপরেই জোর বৃষ্টি, গায়ে বৃষ্টিজল পড়তে টের পেলাম কুঁড়েঘরের ছাদে অনেকগুলো ফুটো আছে। যাই হক শেষ পর্যন্ত একটা জায়গা খুঁজে বার করলাম যেখান দিয়ে জল চোয়াচ্ছে কম, সেখানেই ক্যাম্প খাটটা টেনে নিয়ে গিয়ে ঘুমোতে লাগলাম। আমার ঘুম ভাঙল একটা ঝকঝকে সুন্দর সকালে; বৃষ্টিতে গরমের ভ্যাপসাভাব, ধুলো সব ধুয়ে মুছে গেছে চারিদিক থেকে, প্রতিটি পাতা, প্রতিটি ঘাস চিকচিক করছে নতুন ওঠা সূর্যের আলোয়।

এর আগে আমি প্রথমে যেতাম কাছের মোষটিকে দেখতে কিন্তু আজ সকালে আমার প্রাত্যহিকের পরিবর্তন করতে ইচ্ছে হ’ল তাই আমার লোকজনদের নির্দেশ দিলাম তারা যেন সূর্য ভালভাবে ওঠা পর্যন্ত অপেক্ষা করে, তারপরে যায় কাছের মোষটিকে খাবার ও জল দিতে–তারপর আমার বহু বছরের ভাল এক বিশ্বস্ত সঙ্গী ও চমৎকার অস্ত্র ৪৫০/৪০০ রাইফেলটি প্রথম ভালভাবে পরিষ্কার করে ও তেল দিয়ে নিয়ে চাকনাকালের রাস্তায় অনেক আশা নিয়ে বেরোলাম।

গত সন্ধেবেলা যে ঝুলন্ত পাথরটা পেরোতে আমার এত কষ্ট হয়েছিল সেটা কিন্তু আজ মুহূর্তের জন্যেও আমার অস্বস্তির কারণ হল না এবং সেটা পেরিয়ে আমি থাবার ছাপ খুঁজতে লাগলাম কারণ বৃষ্টিতে রাস্তার ওপরটা নরম ছিল। পথের সেই সঁতসেঁতে জায়গাটা, যেটা আমি বলেছি, ঢালের এদিকটায়, আর সেই বন্ধ জলের ডোবা যার কাছে মোষটা বাঁধা আছে, তারই কাছে–সেখানে আসা পর্যন্ত আমি কিছুই দেখতে পাই নি। এখানে নরম মাটির ওপর আমি বাঘটার থাবার ছাপ দেখতে পেলাম–ছাপগুলো পড়েছে ঝড় ওঠার আগেই আর গিয়েছে ঢালের দিকে। এই জায়গাটার কাছাকাছি পথের খাদের দিকে একটা ফুট তিনেক উঁচু পাথর আছে। এর আগে এই পথ দিয়ে যাওয়ার সময়ে আমি লক্ষ করে দেখেছি এই পাথরটার ওপর দাঁড়িয়ে পথের উঁচু জায়গাটার ওপর চল্লিশগজ দূরে বাঁধা আমার মোষটা দেখা যায়। এবার যখন পাথরটার ওপর দাঁড়িয়ে আস্তে আস্তে মাথা তুললাম তখন দেখলাম মোষটা অদৃশ্য হয়েছে। আবিষ্কারটা যেমন চমকপ্রদ তেমনি ব্যাখার অতীত। বাঘটা যাতে মোষটাকে জঙ্গলের কোনো দূরান্তে না নিয়ে যেতে পারে, যেখানে বাঘটাকে আমার গুলি করতে হবে হয় মাটিতে নয় গাছে বসে–যেটা আমার বর্তমান গলার অবস্থায় একেবারেই অসম্ভব–আমি ব্যবহার করেছিলাম চারটে এক ইঞ্চি মোটা পাকানো পাটের দড়ি, কিন্তু তা সত্ত্বেও বাঘটা মড়ি নিয়ে চলে গেছে।

আমি খুব পাতলা রবার সোলের জুতো পরেছিলাম এবং খুব নিঃশব্দে আমি যে চারা গাছটির সঙ্গে মোষটা বাঁধা ছিল সেটার দিকে এগোলাম আর জমিটা পরখ করে দেখলাম। মোষটা মারা পড়েছে ঝড় ওঠার আগেই কিন্তু ওটাকে বয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বৃষ্টি থামার পরেওটার কোনো অংশই খাওয়া হয় নি। আমি যে চারটে দড়ি একসঙ্গে পাকিয়েছিলাম তার তিনটে দাঁত দিয়ে কেটে ফেলা হয়েছে আর চতুর্থটা ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে।

বাঘেরা সাধারণত দাঁত দিয়ে কামড়ে দড়ি ছেড়ে না; যাই হক এটা তাই করেছে এবং মোহনের মুখোমুখি পাহাড়টা দিয়ে মুড়ি নিয়ে নিচে চলে গেছে। আমার সব প্ল্যান একেবারে ভেস্তে গেল কিন্তু আমার ভাগ্য ভাল যে বৃষ্টিটা আমার কাজের সহায়ক হল। মরা পাতার পুরু কার্পেট যেটা আগের দিন পর্যন্ত একটা স্ফুলিংগ পড়লেই জ্বলে ওঠার মত শুকনো ছিল আজ ভিজে আর নরম এবং আমি যদি কোনো ভুল না করি বাঘটা মড়ি নিয়ে যেতে যে কষ্ট করেছে সেটাই ওর সর্বনাশের কারণ হবে।

যে কোনো মুহূর্তে গুলি করার প্রয়োজন হতে পারে এরকম কোনো জঙ্গলে ঢোকার আগে আমি সব সময় নিশ্চিত হয়ে নিই যে আমার রাইফেলে গুলি ভরা আছে–তা না হলে আমার শান্তি হয় না। এক জরুরী অবস্থায় ট্রিগার টেপা এবং বন্দুকে গুলি ভরতে ভুল হয়ে গিয়েছিল বলে স্বর্গীয় মৃগয়া কানন বা অন্য কোথাও জেগে ওঠা, এ এমন একটা অসাবধানতার পরিচায়ক যার কোনো মার্জনা নেই; সুতরাং যদিও আমি জানতাম যে ঝুলন্ত পাথরটার কাছে আসার আগে রাইফেলে গুলি ভরেছিলাম, আমি এখন রাইফেলটা খুলে গুলিগুলো বার করে নিলাম। যে গুলিটা বিবর্ণ ও ভোতা হয়ে গিয়েছিল সেটা আমি বদলে নিলাম তারপর সেফটি ক্যাচটা কয়েকবার ওপর নিচ করে দেখে নিলাম সেটা ঠিকমত কাজ করছে কিনা–আমি কখনও সেফটি ক্যাচ তোলা অবস্থায় অস্ত্র নিয়ে যাই না–তারপরে মড়ি ছেড়ে টেনে নিয়ে যাওয়ার দাগ অনুসরণ করে রওনা হলাম।

এই ছেঁচড়ানো কথাটা, বাঘ মড়ি টেনে নিয়ে এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় নিয়ে যাওয়ার সময় মাটিতে যে দাগ হয় সেটা বর্ণনা করার জন্যে যখন ব্যবহার করা হয় তখন তাতে ভুল বোঝার সুযোগ থাকে কারণ বাঘ যখন তার মড়িকে কোনো দূরত্বে নিয়ে যায় (আমি একটা বাঘকে একটা পূর্ণ বয়স্ক গরু নিয়ে চার মাইল যেতে দেখেছি) তখন সেটা টেনে নিয়ে যায় না, বয়ে নিয়ে যায়; আর যদি মড়িটা বেশি ভারি হয় তাহলে সেটা ফেলে যাওয়া হয়। মড়ি নিয়ে যাওয়ার সময়ে দাগ হালকা হবে কি গম্ভীর হবে তা নির্ভর করে যে জানোয়ারটি বহন করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তার আকারের ওপর এবং কি ভাবে জানোয়ারটিকে ধরা হয়েছে তার ওপর। উদাহরণস্বরূপ ধরে নেওয়া যাক মড়িটা একটা সম্বরের আর বাঘটা সেটাকে ধরেছে ঘাড়ে তাহলে তার পেছনের অংশটা মাটির সঙ্গে ঘেঁষটে যাবে আর পরিষ্কার একটা টেনে নিয়ে যাওয়ার দাগ থাকবে। কিন্তু অপর পক্ষে সম্বরটাকে যদি পিঠের মাঝামাঝি জায়গায় ধরা হয়ে থাকে তাহলে আবছা একটা টেনে নিয়ে যাওয়ার দাগ থাকতেও পারে আবার একেবারেই কোনো দাগ নাও থাকতে পারে।

বর্তমান ক্ষেতে বাঘটা মোষটাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল ঘাড়ে ধরে এবং তার পেছনের অংশটা মাটি ঘেঁষটে যাচ্ছিল বলে একটা টেনে নিয়ে যাওয়ার দাগ ছিল যেটা অনুসরণ করা সহজ। প্রায় একশো গজ বাঘটা পাহাড়ের গা বেয়ে যাচ্ছিল কোনাকুনিভাবে তারপর সামনে দেখেছিল একটা খাড়া মাটির পাড়। এই পাড়টা পেরনোর চেষ্টায় সে পিছলে যায় এবং মড়িটার ওপর কামড় ছেড়ে দেয়–সেটা পাহাড়ের গা বেয়ে গড়িয়ে তিরিশ চল্লিশ গজ নেমে একটা গাছের গায়ে আটকিয়ে যায়। মড়িটা আবার উদ্ধার করে বাঘটা এবার সেটা ধরে পিঠে এবং এখান থেকে শুধু একটা পা কখনও কখনও মাটিতে লেগে একটা আবছা ঘেঁষটানোর দাগ দেখা যায়–পাহাড়ের দিকটা চেঁকিশাকে ঢাকা থাকায় এ দাগটা অনুসরণ করা খুব কঠিন হল না। পড়ে যাওয়ার সময়ে বাঘটার দিক গোলমাল হয়ে গিয়েছিল তাই ঠিক স্থির করতে পারছিল না কোনদিকে নিয়ে যাবে মড়িটাকে। প্রথমে সে ডানদিকে কয়েকশো গজ গিয়েছিল তারপর একটা রিঙ্গালের ঘন ঝোপের মধ্যে দিয়ে পাহাড়ের গা বেয়ে সোজা একশো গজ নেমে যায়। রিঙ্গালের মধ্যে দিয়ে বহু কষ্টে রাস্তা করে নিয়ে বাঘটা বাঁ দিকে বেঁকে পাহাড়ের গা বেয়ে কোনাকুনি কয়েকশো গজ এগিয়ে একটা বিশাল পাথরের সামনে পড়ে, এবং সেটার ডান দিকে ঘুরে যায়। এগনোর দিক থেকে পাথরটা মাটির সঙ্গে সমান, তারপর ঢাল হয়ে পাথরটা প্রায় কুড়ি ফুট উঠে গিয়ে ঢাকনার মত ছড়িয়ে পড়েছে একটা বিরাট গর্তের ওপর। যদি পাথরটার নিচে কোনো গুহা বা গর্ত থাকে তাহলে বাঘের পক্ষে মড়িটা নিয়ে যাওয়ার সেটাই সব চেয়ে সম্ভাব্য জায়গা, সেইজন্যে আমি মড়ি টেনে নিয়ে যাওয়ার দাগ ছেড়ে পাথরটার ওপর উঠে খুব ধীরে ধীরে এগোতে থাকলাম এবং সেখান থেকে যতটুকু দেখা যায় আমার নিচের আর দু পাশের প্রতিগজ জমি তন্ন তন্ন করে পরখ করে চললাম। পাথরটার শেষ প্রান্তে এসে তাকিয়ে দেখে হতাশ হলাম যে পাহাড়টা খাড়াভাবে এসে মিশেছে। পাথরটার সঙ্গে আর আমার আশামত কোনো গুহা বা গর্ত পাথরটার নিচে নেই।

পাথরটার প্রান্ত থেকে ছোট উপত্যকাটা এবং আশপাশের জঙ্গলের দৃশ্য বেশ ভাল দেখা যায়–এবং জায়গাটা মানুষখেকোর আক্রমণের আশঙ্কা থেকে অপেক্ষাকৃত নিরাপদ–সেইজন্যে আমি বসলাম, বসা মাত্রই আমার সোজাসুজি চল্লিশ কি পঞ্চাশ গজ নিচে একফালি ঘন ঝোপের মধ্যে একটা লাল-সাদা মত জিনিস আমার নজরে পড়ল। যখন গভীর জঙ্গলে কেউ বাঘের খোঁজ করে তখন লাল কিছু চোখে পড়লেই সেটা তক্ষুণি বাঘ বলে মনে হয় আর এখানে তো আমি শুধু লালটাই নয় বাঘের সাদা ডোরাটাও দেখতে পাচ্ছিলাম। দীর্ঘ এক মিনিট ধরে গভীর মনোযোগ দিয়ে জিনিসটা আমি লক্ষ করলাম তারপর ফ্লিক সিনেমায় আপনাকে যে মুখটা লক্ষ করতে বলা হয়েছে সেটা যেমন হঠাৎ সম্পূর্ণ বেঁকেচুরে বদলে যায় তেমনি আমি দেখলাম যেটা এতক্ষণ আমি লক্ষ করছিলাম সেটা হচ্ছে মড়িটা, বাঘ নয়; লালটা হচ্ছে যেখানে ও সদ্য সদ্য খাচ্ছিল সেখানকার রক্ত আর সাদা ডোরাগুলো হচ্ছে চামড়া ছিঁড়ে নিয়ে ও যেখানে পাঁজরার হাড় বার করে দিয়েছে সেই জায়গাগুলো। সেই দীর্ঘ একমিনিট গুলি চালানোর জন্যে আমি আমার ভাগ্যের কাছে কৃতজ্ঞ কারণ মোটামুটি এই ধরনেরই এক ক্ষেত্রে আর এক বন্ধু একটা চমৎকার বাঘ মারার সুযোগ সম্পূর্ণ নষ্ট করে দেয়; যে মড়িটার ওপর তার বসার কথা সেটাকে সে দুটো গুলি করে; ভাগ্যক্রমে তার হাতের নিশানা ভাল ছিল–যে দুজন লোককে ও আগে পাঠিয়েছিল মড়িটার সন্ধানে, আর মড়িটার ওপর একটা মাচা বাঁধার জন্যে যখন সে গুলি করে, তারা মড়িটার কাছেই একটা ঝোপের আড়ালে ছিল তা সত্ত্বেও তাদের কোনো চোট লাগে নি।

কোনো বাঘ যে কোনো বাধার সম্মুখীন হয় নি সে যখন খোলা জায়গায় মড়ি ফেলে রেখে যায় তখন বুঝতে হবে সে কাছেই কোথাও শুয়ে শকুন এবং অন্যান্য মাংসভুক পশুপাখির হাত থেকে রক্ষা করার জন্যে মড়িটাকে পাহারা দিচ্ছে আর আমি বাঘটাকে দেখতে পাচ্ছি না তার মানেই এ নয় যে বাঘটা ঘন ঝোপের মধ্যে খুব কাছাকাছি কোথাও শুয়ে নেই।

মাছির উপদ্রব বাঘদের বিব্রত করে তাই বাঘেরা এক জায়গায় বেশিক্ষণ থাকে না, সেই জন্য আমি যেখানে ছিলাম সেখনে থামাই স্থির করলাম যদি কোথাও কোনো নড়াচড়া দেখা যায়; কিন্তু সিদ্ধান্তটি নেওয়ার মুহূর্তেই গলায় একটা খুসখুসি অনুভব করলাম। আমি ল্যারিনজাইটিস থেকে সম্পূর্ণ সেরে উঠি নি এবং খুসখুসিটা বেড়েই চলল, শেষে এমন একটা পর্যায়ে চলে এল যে আমার না কেশে উপায় নেই। চার্চে বা জঙ্গলে সাধারণত এরকম ক্ষেত্রে যে সব উপায় অবলম্বন করা হয়ে থাকে যেমন নিঃশ্বাস চেপে থাকা বা জোরে ঢোক গেলা তার কোনোটাই আমাকে আরাম দিতে পারল না এবং শেষ পর্যন্ত অবস্থা দাঁড়াল হয় আমাকে কাশতে হবে নয় ফেটে যেতে হবে, মরিয়া হয়ে গলা পরিষ্কার করার জন্যে আমি হনুমানের হুঁশিয়ারীর ডাক ডাকলাম। শব্দ ভাষায় রূপান্তরিত করা কঠিন এবং আপনাদের মধ্যে যাঁরা আমাদের জঙ্গলের সঙ্গে পরিচিত নন তাদের জন্যেই এই হুঁশিয়ারী ডাকের বর্ণনা–এটা শোনা যায় আধমাইলের মধ্যে আওয়াজটা খো-খো-খোক–অল্প অল্প বিরতির পর পরই আওয়াজটার পুনারবৃত্তি হয় বারে বারে আর আওয়াজটা শেষ হয় খোক্ররররর শব্দে। সব হনুমানই বাঘ দেখলে ডাকে না কিন্তু আমাদের পাহাড়ের হনুমানেরা নিশ্চয়ই ডাকে এবং যেহেতু এই বাঘটি সম্ভবত জীবনের প্রতিটি দিন এই ডাক শুনতে, অভ্যস্ত, এই একটি ডাকের আওয়াজই আমি করতে পারতাম যার দিকে ও কোনো মনোযোগই দেবে না। এই বিপৎকালীন জরুরী অবস্থায় আমার ডাকটি খুব বিশ্বাসযোগ্য শোনায় নি কিন্তু আমার গলা খুসখুসি দুর করার উদ্দেশ্য সাধিত হয়েছে।

তারপরেও আধঘণ্টা আমি সেই পাথরটার ওপর বসে রইলাম-উদ্দেশ্য নড়াচড়া লক্ষ করা এবং জঙ্গলের প্রাণীরা যদি কোনো বার্তা পাঠায় তা শোনা এবং যখন আমি সম্পূর্ণ নিশ্চিত হলাম যে বাঘটা আমার দৃষ্টি সীমার মধ্যে কোথাও নেই তখন পাথরটার থেকে নেমে খুব সতর্কতার সঙ্গে মড়িটার কাছে নেমে গেলাম।

একটা পূর্ণবয়স্ক বাঘ একেবারে কত ওজনের মাংস খেতে পারে সে কথা আপনাদের জানাতে না পেরে দুঃখিত কিন্তু তার খাওয়ার ক্ষমতা সম্বন্ধে একটা ধারণা আপনার হবে যদি আমি বলি যে সে একটা সম্বর খেতে পারে দুদিনে, একটা মোষ তিনদিনে–চতুর্থ দিনের জলখাবারের জন্যে সামান্য উদ্বৃত্ত থাকতেও পারে।

যে মোষটা আমি বেঁধেছিলাম সেটা পূর্ণবয়স্ক না হলেও কোনো মতেই ছোট। আকারের প্রাণী নয় এবং বাঘটা তার প্রায় অর্ধেকটা খেয়ে ফেলেছে। আমি ধরেই নিলাম পেটের মধ্যে এই পরিমাণ খাদ্য নিয়ে ওর পক্ষে বেশি দূরে যাওয়া সম্ভব নয় এবং যেহেতু মাটি এখনও ভিজে আর আগামী দুএক ঘণ্টা ভিজেই থাকবে আমি স্থির করলাম খুঁজে বার করব ও কোনদিকে গিয়েছে এবং যদি সম্ভব হয় পিছু নেব।

মড়িটার কাছে থাবার ছাপ জড়াজড়ি হয়ে আছে কিন্তু ক্রমে বৃহত্তর বৃত্তাকারে ঘুরে আমি বাঘটা চলে যাওয়ার সময় যে থাবার ছাপটি ফেলেছে সেটি খুঁজে পেলাম। শক্ত পায়ের জানোয়ারের চেয়ে নরম থাবাওয়ালা জানোয়ারের পায়ের দাগ অনুসরণ করা অপেক্ষাকৃত কঠিন কিন্তু তা সত্ত্বেও বহু বছরের অভিজ্ঞতার দরুণ থাবার ছাপ অনুসরণ করতে কোনো বিশেষ চেষ্টার প্রয়োজন করে না–অনেকটা শিকারী কুকুর যেমন অনায়াসে গন্ধ অনুসরণ করে, সেইরকম ছায়ার মত ধীরে এবং নিঃশব্দে আমি দাগটা ধরলাম, জানতাম বাঘটা খুব কাছেই কোথাও আছে। প্রায় একশো গজ যাওয়ার পর আমি এসে পড়লাম প্রায় কুড়ি বর্গগজ আয়তন বিশিষ্ট একফালি সমতল ভূমিতে-জমিটা ছোট মোলায়েম নানা ধরনের ঘাসের গালিচায় ঢাকা-ঘাসগুলি সুগন্ধি; ঘাসের ওপর পরিষ্কার দাগ দেখেই বুঝতে পারলাম বাঘটা এখানেই শুয়েছিল।

আমি দাগটার দিকে তাকিয়ে যে জানোয়ার শোয়ার ফলে দাগটা হয়েছে তার আকার সম্বন্ধে অনুমান করার চেষ্টা করছিলাম হঠাৎ দেখলাম নিস্পিষ্ট কয়েকটা ঘাস আবার স্প্রিং-এর মত সোজা হয়ে দাঁড়াল। এর মানেই হচ্ছে বাঘটা এখান থেকে গিয়েছে মাত্র মিনিট খানেক কি তার কিছু বেশি সময় আগে।

জায়গাটা সম্বন্ধে মোটামুটি একটা ধারণা আপনাদের হবে যদি আমি বলি যে বাঘটা মড়িটাকে উত্তরদিক থেকে নামিয়ে এনেছিল, তারপর মড়িটা রেখে চলে গিয়েছিল পশ্চিমে এবং আমি যে পাথরটার ওপর বসেছিলাম সেটা, মড়িটা এবং আমি এখন যেখানে দাঁড়িয়ে আছি সে জায়গাটা, তিনে মিলে একটা ত্রিভূজের তিনটি কোণ–ত্রিভূজের একটা বাহু চল্লিশ গজ এবং অন্য দুটি বাহু একশো গজ মত লম্বা।

ঘাসটা সোজা হয়ে উঠতেই আমার প্রথম চিন্তা হল বাঘটা আমায় দেখতে পেয়ে সরে গেছে কিন্তু অল্পক্ষণেই বুঝতে পারলাম সেটা সম্ভব নয় কারণ পাথর বা মড়ি কোনোটাই ঘেসো জমিটার থেকে দেখা যায় না এবং আমি অনুসরণ শুরু করার পর ও যে আমাকে দেখে সরে যায় নি সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। তাহলে ও এরকম আরামের বিছানা ছেড়ে উঠে চলে গেল কেন? আমার ঘাড়ের পেছনে অগ্নিবর্ষী সূর্যই উত্তরটা আমাকে দিয়ে দিল। এখন ন-টা বাজে আর সময়টা মে মাসের এক অসহ্য গরম সকাল এবং সূর্য, আর যে গাছগুলির ওপর দিয়ে সূর্য চলে এসেছে সেগুলির দিকে তাকিয়ে বুঝলাম ঘাসের ফালির ওপর রোদ পড়েছে অন্তত দশ মিনিট। বাঘটার নিশ্চয়ই রোদে খুব গরম লাগছিল তাই আমি আসার কয়েক মিনিট আগেই ও উঠে গিয়েছে কোনো ছায়াঘন জায়গার সন্ধানে।

আমি আপনাদের বলেছি যে ঘেসো জমিটার আয়তন হবে বিশ বর্গ ফুট। আমি যে দিক থেকে এসেছিলাম তার উল্টোদিকে একটা কাটা গাছ উত্তর দক্ষিণমুখী হয়ে পড়েছিল। এই গাছটার ব্যাস হবে চার ফুট মত এবং যেহেতু গাছটা পড়েছিল ঘেসো জমিটার প্রান্তে আর আমি দাঁড়িয়েছিলাম জমিটার মাঝামাঝি জায়গায়, গাছটার দূরত্ব আমার থেকে হবে দশ ফুট মত। গাছের শেকড়ের দিকটা পাহাড়ের গায়ে–এখান থেকেই ঘন ঝোঁপঝাড়ের জঙ্গল নিয়ে খাড়াভাবে উঠেছে পাহাড়টা–এবং মাথার দিকটা (যেটা গাছটা পড়ার সময়ে ভেঙে গিয়েছিল) পাহাড়ের ধার দিয়ে বেরিয়ে আছে। গাছটার পরেই পাহাড়টা প্রায় দেয়ালের মত খাড়া আর এর গা বেয়ে পাথরের সরু কার্নিসের প্রায় তিরিশ গজ উঠে মিলিয়ে গেছে গভীর জঙ্গলে।

বাঘটা রোদের তেজের দরুণই স্থান পরিবর্তন করেছে আমার এই অনুমান যদি ঠিক হয় তাহলে ওই গাছটার সুরক্ষিত দিকের মত বিশ্রামের উপযুক্ত জায়গা আর নেই এবং আমার কৌতূহল নিরসনের একমাত্র উপায় হচ্ছে গাছটা পর্যন্ত হেঁটে যাওয়া–আর দেখা। এখানে বহুদিন আগে পাঞ্চ’ পত্রিকায় দেখা একটা ছবি আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল। ছবিটা ছিল এক নিঃসঙ্গ শিকারীর, সে সিংহ শিকার করতে বেরিয়েছিল এবং যে পাথরটার ওপর দিয়ে সে যাচ্ছিল, তার ওপরে তাকাতেই তার দৃষ্টি সোজা গিয়ে পড়েছিল আফ্রিকার সচেয়ে বড় সাইজের এক সিংহের হাসিহাসি মুখের ওপর। ছবিটার নিচে লেখা ছিল ‘আপনি যখন সিংহ খুঁজতে যাবেন তখন নিশ্চিত হয়ে নিন আপনি সত্যিই তাকে দেখতে চান। তবে তফাৎ এইটুকু যে আমার আফ্রিকার বন্ধু তাকিয়েছিল ওপর দিকে–একেবারে সিংহের মুখে, আমি তাকাব নিচে-বাঘের মুখে; তা নাহলে, বাঘটা যদি সত্যিই গাছটার ওদিকে থাকে, ঘটনা দুটো প্রায় একই রকমের হবে।

নরম ঘাসের ওপর ইঞ্চি ইঞ্চি করে পা ঘষটে ঘষটে আমি গাছটার দিকে এগোতে শুরু করলাম এবং গাছ ও আমার মধ্যে অর্ধেক দূরত্ব অতিক্রম করেছি এমন সময়ে পাথরের তাকটার ওপর একটা তিন ইঞ্চি কাল-হলুদ জিনিস আমার চোখে পড়ল–এতক্ষণে লক্ষ করলাম যে ওটা একটা বহু ব্যবহৃত জানোয়ারদের চলাচলের পথ। দীর্ঘ এক মিনিট ধরে অর্থাৎ যতক্ষণ না নিশ্চিত হলাম যে ওটা বাঘটার ল্যাজের ডগার অংশটুকু, আমি এই নিশ্চল জিনিসটার দিকে তাকিয়ে রইলাম। ল্যাজটা যদি আমার বিপরীত দিকে থাকে তাহলে মাথাটা নিশ্চয়ই আমার দিকে এবং পাথরের কানিসটা মাত্র দু ফুট চওড়া, বাঘটা নিশ্চয়ই ওৎ পেতে আছে গাছের গুঁড়িটা পেরিয়ে আমার মাথাটা দেখা গেলে সেই মুহূর্তে ঝাঁপ দেবে। ল্যাজের ডগাটা আমার থেকে কুড়ি ফুট দূরে-ওৎ পাতা অবস্থায় বাঘটা যদি আট ফুটও লম্বা হয় তাহলেও ওর মাথাটা আমার থেকে বার ফুট দূরে। আমাকে আরো অনেক কাছে যেতে হবে কারণ ওকে পঙ্গু করে দেওয়ার মত একটা গুলি করতে হলে ওর শরীরটা আমার যথেষ্ট দেখতে পাওয়া দরকার–আর পায়ে হেঁটে ফিরে যাওয়ার যদি কোনো বাসনা আমার থাকে তাহলে এক গুলিতে বাঘটাকে পঙ্গু করতেই হবে। আর এই সময়, জীবনে প্রথম সেফটি ক্যাচ না তুলে রাইফেল নিয়ে যাওয়ার অভ্যাসের জন্যে আমার নিজের ওপর ধিক্কার এল। আমার ৪৫০/৪০০ রাইফেলের সেফটি ক্যাচ তোলার সময় বেশ পরিষ্কার একটা খট করে আওয়াজ হয় আর এখন যে কোনো আওয়াজ করার মানেই হল বাঘটা আমার ওপর লাফিয়ে পড়বে নয় আমাকে গুলি করার কোনো সুযোগ না দিয়েই খাড়া পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে যাবে।

আবার ইঞ্চি ইঞ্চি করে এগোতে থাকলাম যতক্ষণ না পুরো ল্যাজ আর পেছনের অংশটা আমার নজরে এল। পেছনের অংশটা দেখে আমি আনন্দে চিৎকার করে উঠতে পারতাম কারণ এতে বোঝা গেল বাঘটা ঝাঁপ দেওয়ার জন্যে ওৎ পেতে নেই, শুয়ে আছে। দুফুট চওড়া পাথরের কার্নিসটার ওপর শুধুমাত্র তার শরীরটা রাখারই জায়গা থাকায় ও পেছনের পা-গুলো ছড়িয়ে রেখেছে একটা ওক চারার ওপরে ডালপালার ওপর–গাছটা উঠেছে খাড়া পাহাড়ের একেবারে গা বেয়ে। আর এক পা এগোতে দেখতে পেলাম ওর পেটটা–যেভাবে ওটা ওঠানামা করছে তাতে বুঝলাম ও ঘুমিয়ে আছে। এবার আমি সামনে এগোতে লাগলাম আরও ধীরে–এবার ওর কাধ তারপরে ওর পুরো শরীরটা আমার নজরে এল। ওর মাথার পেছন দিকটা রাখা ছিল ঘেসো জমিটার প্রান্তে যেটা কাটা গাছটা ছাড়িয়ে তিন চার ফুট বেরিয়ে আছে; ওর চোখ বোজা, নাক আকাশের দিকে।

আমার রাইফেলের সাইট ওর কপালের সঙ্গে এক সাইজে এনে আমি ট্রিগার টিপলাম আর ট্রিগারের ওপর চাপ সমান রেখে সেফটি ক্যাচটা তুলে দিলাম। আমি জানতাম না রাইফেল চালানোর প্রচলিত পদ্ধতির বিপরীত এই পন্থা কেমন কাজ দেবে–কিন্তু কাজ দিয়েছিল; এই সামান্য দূরত্ব থেকে ভারি বুলেটটা যখন ওর কপালে ঢুকে গেল তখন ওর শরীরটা কেঁপে পর্যন্ত ওঠে নি। ওর ল্যাজটা আগের মতনই ছড়ানো রইল; ওর পেছনের পা দুটো চারাগাছের ডালপালার ওপরে সেইরকমই ছড়ানো; আর ওর নাক তেমনই আকাশের দিকে। আমি যখন প্রথমটিকে অনুসরণ করে দ্বিতীয় নেহাতই অপ্রয়োজনীয় বুলেটটি পাঠালাম ওর শুয়ে থাকার ভঙ্গীর বিন্দুমাত্র তারতম্য হল না। একমাত্র পরিবর্তন যেটা লক্ষ করা গেল সেটা হচ্ছে ওর পেটের ওঠানামা বন্ধ হয়ে গেল আর দুটো আশ্চর্যরকম ছোট ফুটো দিয়ে ওর কপাল গড়িয়ে রক্ত পড়তে লাগল।

আমি জানি না বাঘের খুব কাছাকাছি এলে অন্যদের কি মনে হয়, তবে আমার সব সময়ে একটা রুদ্ধশ্বাস অনুভূতি হয় সেটা সম্ভবত যেমন ভয়ে তেমনি উত্তেজনায়–একটু বিশ্রামের ইচ্ছেও তার মধ্যে থাকে। যেদিন থেকে আমার গলা খারাপ হয় সেদিন থেকে যে সিগারেটের লোভ থেকে আমি নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিলাম এখন কাটা গাছটার ওপর বসে সেই সিগারেটটা আমি ধরালাম আর ভাবনা-চিন্তার রাশ ছেড়ে দিলাম। যে কোনো কাজ ভালভাবে করলে একটা তৃপ্তি আসে এবং আমি এখনই যেটা করেছি সেটাও কোনো ব্যতিক্রম নয়। মানুষখেকোটাকে মারাই আমার এখানে থাকার কারণ এবং আমি দু ঘন্টা আগে রাস্তাটা ছেড়ে আসার পর থেকে সেফটি ক্যাচ তোলা পর্যন্ত প্রতিটি ঘটনা, এমনকি হনুমানের ডাক পর্যন্ত নিখুঁত নির্ভুলভাবে কাজ করে গেছে। এতে একটা অদ্ভুত পরিতৃপ্তি আছে যে ধরনের পরিতৃপ্তি কোনো নাট্যকার অনুভব করেন যখন তার নাটক দৃশ্যের পর দৃশ্যে উন্মোচিত হতে হতে ঠিক তিনি যেমনটি চেয়েছিলেন তেমনিভাবেই শেষ হয়। আমার ক্ষেত্রে অবশ্য শেষটা সুখপ্রদ হয় নি কারণ আমি যে জানোয়ারটি মেরেছি তার দূরত্ব ছিল আমার থেকে পাঁচ ফুট আর সে ছিল ঘুমন্ত অবস্থায়।

এ ব্যাপারে আমার ব্যক্তিগত অনুভূতির দাম অন্যদের কাছে না থাকতে পারে, কিন্তু আপনি যদি ভেবে থাকেন ব্যাপারটা মোটেই সমাচীন হয়নি তাহলে আমি নিজের কাছে যে যুক্তি দিয়েছি সেটাই উপস্থাপন করব আপনার কাছে, হয়তো আমার থেকে আপনাকে সে যুক্তি বেশি সন্তুষ্ট করবে। এই যুক্তিগুলি হচ্ছে (ক) বাঘটা ছিল একটা মানুষখেকো–জীবন্ত থাকার চেয়ে ওটার মরাই ভাল, (খ) সেইজন্যে ও ঘুমিয়ে আছে না জেগে আছে সে প্রসঙ্গ সম্পূর্ণ অবান্তর এবং (গ) ওর পেটের ওঠানামা দেখেও আমি যদি চলে আসতাম তাহলে পরে যত লোককে ও মারত তাদের জীবনের নৈতিক দায়িত্ব প্রকারান্তরে আমার হত। আমি যা করেছিলাম তার সপক্ষে যুক্তিগুলি খুব ভাল এবং অকাট্য একথা আপনাকে মানতেই হবে; কিন্তু দুঃখ থেকেই যায় যে নিজের প্রাণের ভয়ে অথবা গুলি করার এই একমাত্র সুবর্ণ সুযোগটি হারানোর ভয়ে অথবা দূয়ে মিলে এমন একটা মনের অবস্থা আমার হয়েছিল যে আমি ঘুমন্ত জানোয়ারটাকে জাগাই নি–তার নিজেকে বাঁচানোর কোনো সুযোগ তাকে আমি দিই নি।

বাঘটা মৃত এবং আমি যদি না চাই যে আমার ট্রফি নিচের উপত্যকায় পড়ে ধ্বংস হয়ে যাক তবে ওকে পাথরের কার্নিসটার ওপর থেকে তত তাড়াতাড়ি সম্ভব নামিয়ে আনতে হবে। রাইফেলটা, যেটার আর কোনো প্রয়োজন আমার ছিল না, গাছের গুঁড়িটার সঙ্গে ঠেস দিয়ে রেখে আমি রাস্তার ওপরে উঠলাম আর চষা খেতের কাছে বাঁকটার মুখে এসে আমি দুহাত মুখের কাছে তুলে একটা কু’ আওয়াজ করলাম, সেটা পাহাড় উপত্যকায় প্রতিধ্বনি তুলে চলে গেল। আমার দ্বিতীয়বার আওয়াজ করার কোনো প্রয়োজন হল না কারণ আমার লোকজন প্রথম মোষটার তদ্বির করে ফেরার পথেই আমার ছোঁড়া দুটো গুলির আওয়াজ পায় আর তারা দৌড়ে কুঁড়েঘরে ফিরে হাঁকডাক করে যত গ্রামের লোক সংগ্রহ করতে পারে তাদের জড়ো করে। এখন আমার ‘কু ডাক শুনে পুরো ভিড়টা রাস্তা দিয়ে উধ্বশ্বাসে দৌড়ে এল আমার সঙ্গে দেখা করার জন্যে।

যখন মোটা মোটা দড়ি আর কুড়োল যোগাড় হল আমি জনতাকে নিয়ে ফিরলাম আমার সঙ্গে এবং যখন বাঘটার আষ্টেপৃষ্ঠে দড়ি বেঁধে দিলাম তখন অনেক উৎসুক হাত বাঘটাকে কিছুটা তুলে, কিছুটা হেঁচড়ে নামিয়ে আনল পাথরের কার্নিসটা থেকে, কাটা গাছটার ওপর দিয়ে ঘেসো জমিটার ওপর। এখানেই আমি বাঘটার ছাল ছাড়াতাম, কিন্তু গ্রামের লোকেরা আমাকে কাতর অনুরোধ জানাল তা না করতে কারণ কাৰ্তকানৌলা এবং তার আশপাশের স্ত্রীলোক এবং ছেলেমেয়েরা ভয়ানক হতাশ হবে বাঘটাকে চোখে না দেখলে এবং আশ্বস্ত না হলে, যে মানুষখেকোর ভয়ে তারা এত বছর কাটিয়েছে আর যে পুরো জলাটার ওপর একটা সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল সে সত্যি সত্যিই মৃত।

বাঘটাকে কুঁড়েঘর পর্যন্ত বয়ে নিয়ে যাওয়ার সাহায্যের জন্যে যখন কয়েকটা চারাগাছ কাটা হচ্ছিল তখন আমি দেখলাম কয়েকটি লোক বাঘটার পায়ের ওপর দিয়ে হাত বুলোচ্ছে-বুঝলাম তারা যে বলেছিল বাঘটার কোনো পুরনো ঘা নেই তাদের সে কথাটা সত্য কিনা সে সম্বন্ধে তারা নিজেরাই নিশ্চিত হয়ে নিচ্ছে। কুঁড়েঘরের কাছে বাঘটাকে একটা ছড়ানো গাছের ছায়ায় শুইয়ে দেওয়া হল এবং গ্রামবাসীদের বলা হল বেলা দুটো পর্যন্ত বাঘটা তাদের জিম্মায়–এর থেকে বেশি সময় তাদের দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না কারণ দিনটা ছিল অত্যধিক গরম আর চামড়া থেকে নোম ঝরে গিয়ে চামড়াটা নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল।

আমি নিজেই বাঘটাকে ভাল করে দেখি নি কিন্তু বেলা দুটোর সময় যখন আমি চামড়া ছাড়াবার জন্যে ওটাকে চিত করে শুইয়ে দিলাম তখন লক্ষ করলাম ওর সামনের বাঁ পায়ের ভেতর দিককার বেশির ভাগ লোেম নেই–তাছাড়া চামড়ার ছোট ছোট ফুটো আছে যার থেকে হলদে একটা রস গড়িয়ে পড়ছে। আমি এই ফুটোগুলোর দিকে কারো দৃষ্টি আকর্ষণ করলাম না, এই পা-টা ডান পায়ের থেকে অনেক সরু এবং এই পায়ের ছাল ছাড়ানো আমি শেষকালের জন্যে স্থগিত রাখলাম। যখন জানোয়ারটার শরীরের অন্যান্য অংশ থেকে ছাল ছাড়ানো হয়ে গেছে তখন আমি বাঘটার বুক থেকে ঘা-পচা বাঁ পা-টার থাবা পর্যন্ত লম্বাভাবে চিরে দিলাম, তারপর চামড়া ওঠানোর সময় মাংস থেকে একটার পর একটা শজারুর কাঁটা টেনে বার করতে লাগলাম যেগুলি ভিড় করে থাকা লোকেরা স্মারকচিহ্ন হিসেবে পরমোৎসাহে নিয়ে নিল; সবচেয়ে লম্বা কাটাটি প্রায় পাঁচ ইঞ্চি এবং কাটার মোট সংখ্যা ছিল পঁচিশ থেকে তিরিশ। বুক থেকে পায়ের থাবা পর্যন্ত চামড়ার নিচে মাংস হয়ে গিয়েছিল গলা-সাবানের মত তলতলে, গাঢ় হলুদ রঙের; জানোয়ারটার চলার সময়ে কাতরোক্তি করার এটাই যথেষ্ট কারণ–আর ওকে মানুষখেকো করার এবং মানুষখেকো করে রেখে দেবার মূলেও ওই একই কারণ–শজারুর কাটা যতদিনই মাংসের মধ্যে ঢুকে থাকুক না কেন, কখনও গলে যায় না।

আমি যে মানুষখেকো বাঘগুলো মেরেছি তাদের শরীর থেকে আমি সম্ভবত কয়েকশো শজারুর কাঁটা বার করেছি। এর মধ্যে অনেকগুলি কাটা ন ইঞ্চিরও বেশি লম্বা আর প্রায় পেনসিলের মত মোটা। বেশীর ভাগ কাঁটাই কঠিন মাংস পেশীর মধ্যে ফুটেছে, কিছু শক্তভাবে আটকে আছে হাড়ের মধ্যে, আর সবগুলোই চামড়ার ঠিক নিচে ঢুকে ভেঙে ছোট হয়ে গেছে।

এই কাঁটাগুলো নিঃসন্দেহে লেগেছে খাদ্যের জন্যে বাঘগুলো শজারু মারতে যাওয়ার সময়, কিন্তু প্রশ্ন ওঠে–যার কোনো সদুত্তর দিতে না পারার জন্যে আমিও দুঃখিত-বাঘের মত এত বুদ্ধিমান, ক্ষিপ্রগতি জানোয়ার শজারু কাটা গায়ের গভীরে ঢোকার মত অসাবধান হয় কি করে অথবা এত ধীরগতি হয় কিভাবে যে শজারুর মত জীব–যাদের আত্মরক্ষার একমাত্র উপায় হচ্ছে পেছন দিকে হাঁটা–তাদের গায়ে কাঁটা ফুটিয়ে দিতে পারে; তাছাড়া কাঁটাগুলো চামড়ার ঠিক নিচেই ভেঙে যায় কিভাবে কারণ শজারুর কাঁটা তো ভঙ্গুর নয়।

আমাদের পার্বত্য বাঘের মতনই চিতাদেরও শজারুর দিকে পক্ষপাতিত্ব বেশি কিন্তু তাদের গায়ে কাঁটা ফোটে না কারণ আমি নিজে দেখেছি তারা শজারু মারে মাথায় ধরে; বাঘেরা কেন চিতার নিরাপদ এবং অব্যর্থ কৌশলে শজারু মেরে আঘাত থেকে নিজেদের বাঁচায় না সেটা আমার কাছে একটা রহস্য।

সেই বহুকাল আগের জেলা সম্মেলনে উল্লিখিত তিনটি মানুষখেকো বাঘের মধ্যে দ্বিতীয়টির গল্প আপনাদের বলা হল এরপর যখন সুযোগ পাব, আমি আপনাদের বলব কিভাবে তৃতীয় বাঘটি, কান্দার মানুষখেকো মারা পড়ে।