মন্দিরে কার ছায়া

মন্দিরে কার ছায়া

 কর্নেল সারাদুপুর নকশা নিয়ে কাটিয়ে দিলেন। বিকেলে বিজয়কে ডেকে সঙ্গে নিয়ে বেরোলেন। দক্ষিণের পোড়ো জমি আর বাগানের ভেতর দিয়ে এগিয়ে ঠাকুরবাড়িতে গেলেন। মাধবজি তার ঘরের সামনে খোলা জায়গায় দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছিলেন। বিজয় কর্নেলের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিল। মাধবজি বারান্দায় কম্বল বিছিয়ে কর্নেলকৈ বললেন, “আমার সৌভাগ্য কর্নেলসাব! একটেরে পড়ে থাকি। কেউ আমার খোঁজ-খবর রাখে না। বড়কুমারসাব তো চিড়িয়াখানা নিয়েই মশগুল। আর এই যে দেখছেন ছোটকুমারসাব, ইনি তো ঘর থেকেই বেরোন না। শুধু জয়াবেটি আসে কখনও-সখনও। আর হাবিপ্রদাসজি আসেন হরঘড়ি। উনি না আসবেন তো চলবে কী করে? তবে আজ বিপ্রদাসজিকে দেখতে পাচ্ছি না।”

বিজয় বলল, “ভাগলপুরে গেছেন সকালে। দুদিন থাকবেন বলে গেছেন।”

মাধবজি বললেন, “ও, হ্যাঁ। কাল বলছিলেন বটে! ভাগলপুরে ওঁর এক .. বহিনজি থাকেন শুনেছি।”

কর্নেল পা ঝুলিয়ে বসে বাইনোকুলারে নালা ও পুকুরের সঙ্গমস্থলে কিছু দেখছিলেন। বাইনোকুলার নামিয়ে বললেন, “মাধবজি, আপনি কতবছর রাজবাড়িতে আছেন?”

মাধবজি হিসেব করে বললেন, “তা বিশসালের বেশি। সত্যি কথা বলতে গেলে, কর্নেলসাব, সে জমানা আর নেই। রাজবাহাদুরের আমলে কী ছিল! হরঘড়ি শোরগোল, লোকজন, কত কিছু। এখন তো শ্মশান মনে হয়। মোটর গাড়ি ছিল। দুটো ঘোড়া ছিল। এখন আর কিছু দেখতে পাবেন না। তবে বাকি যেটুকু দেখছেন, সব বিপ্রদাসজির জন্য। কুমারসাবদের তো বিষয়সম্পত্তিতে মন নেই। ঘর সংসারেরও ইচ্ছে নেই। আবার দেখুন, জয়াবেটির বরাত। এই বয়সেই বিধবা হয়ে গেল!”

কর্নেল বললেন, “শরদিন্দুবাবুর সঙ্গে আপনার কেমন আলাপ ছিল?”

“খুউব। অমন ভদ্রলোক আমি কখনও দেখিনি কর্নেলসাব। নিজের পেটের কথা সব আমাকে বলতেন। এক বদমাসের পাল্লায় পড়ে খামোকা বেচারা জেল খেটেছিলেন।”

কর্নেল বিজয়ের দিকে তাকালেন। বিজয় বলল, “শরদিন্দু বিশেষ কারুর নাম করেছিল বলে জানি না। অন্তত জয়া আমাকে বলেনি।”

মাধবজি চাপা স্বরে বললেন, “জামাইবাবু তো আর বেঁচে নেই। তাই বললেও ক্ষতি নেই এখন। আমাকে বলতে বারণ করেছিলেন। সেই হারামিটা ওঁর সঙ্গে ব্যাংকে চাকরি করত। তার নাম ছিল পরিতোষ। তো জামাইবাবু যে রাতে চিতার পাল্লায় পড়েন, সেইদিন বিকেলে এসে আমাকে কথায় কথায় বলেছিলেন, পরিতোষ হারামিকে বাজারে কোথায় দেখেছেন। তার খুব ভয় হচ্ছে। আবার কোনো ক্ষতি না করে। কী মতলবে কানাজোলে এসেছে সে, তাই নিয়ে খুব ভাবনা করছিলেন। আমি বললুম, বড় কুমারসাবকে বলুন। ওকে খুঁজে বের করে চাবুক মারবে। তারপর পুলিশে ধরিয়ে দেবে। তো জামাইবাবু বললেন, কী জানি, দূর থেকে দেখেছি। ভূল হতেও পারে।”

কর্নেল বললেন, “শরদিন্দুবাবু যে রাতে মারা যান, আপনি কোনো চিৎকার শুনেছিলেন?”

 “না। তবে এখান থেকে বড়কুমারসাবের ঘর নজর হয়। ওই দেখুন–ওই ঘরের ব্যালকনিতে বড়কুমারসাব আর জামাইবাবুকে বসে থাকতে দেখেছিলুম। তখন রাত প্রায় দশটা। অবাক লাগছিল জামাইবাবু মদ খাচ্ছেন দেখে। উনি মদ খান বিশ্বাস করতে পারিনি।

“আপনি দেখেছিলেন মদ খেতে?”

“হ্যাঁ দুজনের হাতেই গেলাস ছিল। ঘর থেকে আলো এসে ব্যালকনিতে পড়েছিল। “

 “আচ্ছা মাধবজি, আজ সকালে বা অন্য কোন সময়ে অচেনা কোনো লোককে রাজবাড়ির চৌহদ্দিতে দেখেছেন কি? ধরুন, খিড়কি দিয়ে বেরুতে বা বাগানে, কি অন্য কোথাও?”

মাধবজি মাথা জোরে নেড়ে বললেন, “দেখিনি। তবে সবসময় তো সবদিকে নজর থাকে না। চোখ এড়িয়ে যেতেও পারে।”

কর্নেল উঠলেন। “চলি মাধবজি! অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে।”

মাধবজি করজোড়ে বললেন “কৃপা করে যদি এক কাপ চা পিয়ে যেতেন কর্নেলসাব!”

“ঠিক আছে। ফেরার সময় হবে। একটু ঘুরে আসি ওদিক থেকে।”

ঠাকুরদালানের সামনে দিয়ে পুকুরের ধারে পৌঁছলেন দুজনে। পুকুরটা চৌকোনা। শালুক পদ্ম আর জলজদামে ভর্তি। সেই নালাটা এসে পুকুরে পড়েছে। এখানে ইটের সাঁকো আছে। সাঁকোটা পেরিয়ে হরটিলার নিচে গিয়ে কর্নেল বললেন, “এস বিজয়, মন্দিরটা দেখে আসি।”

বিজয় একটু হাসল। “কোনো ব্লু থাকতে পারে ভাবছেন?”

 “কিসের?”

“জয়াকে অজ্ঞান করে যে একটা কী জিনিস হাতিয়েছে, সে এদিকে নিশ্চয় আসেনি।” বিজয় খিকখিক করে হাসতে লাগল। “পরিতোষ না কার কথা বললেন মাধবজি, তারও হরটিলায় উঠে লুকিয়ে থাকার চান্স কম। মাধবজি বললেন বটে, সবদিকে নজর থাকে না, কিন্তু আমি জানি উনি একটি বাজপাখি।”

কর্নেল কৌতুকে মন না দিয়ে গম্ভীরভাবেই বললেন, “পূর্বে গঙ্গার তীরে ওই ফটকটার পাশে পাঁচিল ভাঙা আছে। আমরা সকালে বাইরে থেকে ওখান দিয়েই ঢুকেছি। সেইভাবে কেউ ঢুকে কোথাও লুকিয়ে থাকলে অবাক হবার কিছু নেই, বিজয়। তোমার কী মনে হয়?”

বিজয় বলল, “তাই তো! ওটার কথা মনে ছিল না। আমাদের পুরো এলাকা তন্ন তন্ন করে খোঁজা দরকার।”

এবার কর্নেল হাসলেন। “তবে জয়ার কাছ থেকে মূল্যবান জিনিসটি হাতিয়ে সে নিশ্চয় লুকিয়ে থাকবে না আর। কী দরকার আর লুকিয়ে থাকার?”

“তাহলে–

কর্নেল টিলার গায়ে পাথরের ধাপে পা রেখে বললেন, “জিনিসটা কী হতে পারে বলে তোমার ধারণা?”

বিজয় তাকে অনুসরণ করে বলল “কোনো দামি রত্ন-উত্ন হবে। কাকাবাবুকে হয়তো বাবা রাখতে দিয়েছিলেন।”

কর্নেল আর কোনো কথা বললেন না। টিলাটা একেবারে সিধে উঠেছে। পরিশ্রম হচ্ছিল সিঁড়ি ভাঙতে। ওপরে উঠে ছোট্ট মন্দিরটার সামনে একটা পাথরে বসে বিশ্রাম নিতে থাকলেন। বিজয় গঙ্গার শোভা দেখতে থাকল। এখান থেকে চারদিকে অনেক দূর অব্দি চোখে পড়ে। চিড়িয়াখানার টিলার দিকে বাইনোকুলার তাক করলেন কর্নেল। নানকু হরিণটাকে কিছু খাওয়াচ্ছে। ঘাড়ে হাত বুলিয়ে আদরও করছে। জয় কাকাতুয়াটা কাঁধে নিয়ে আউট-হাউসের ছাদে বসে আছে। সেও গঙ্গার শোভা দেখছে হয়তো। বাইনোকুলার ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কর্নেল চারদিকটা খুঁটিয়ে দেখতে থাকলেন।

সেইসময় হঠাৎ বিজয় চমকখাওয়া গলায় বলল, “আরে! ওটা কী?”

কর্নেল বাইনোকুলার নামিয়ে বললেন, “কী বিজয়?”

 বিজয় এগিয়ে গিয়ে মন্দিরের পাশে জবাফুলের ঝোঁপের ভেতর থেকে একটা ছোট্ট ভেলভেটে মোড়া কৌটা কুড়িয়ে আনল। উত্তেজিতভাবে বলল, “কর্নেল! কর্নেল! জয়া তো এরকম একটা কৌটোর কথাই বলছিল! সেইটেই সম্ভবত।”

কর্নেল কৌটোটা নিয়ে বললেন, “ভেতরের জিনিসটা নেই। খালি কৌটোটা ফেলে রেখে গেছে।”

বলে জ্যাকেটের পকেট থেকে আতস কাঁচ বের করে খুঁটিয়ে কৌটোর ভেতরটা দেখতে থাকলেন। বিজয় দমআটকানো গলায় বলল, “কী আশ্চর্য! কী আশ্চর্য!”

একটু পরে কর্নেল বললেন, “তুমি বলেছিলে রত্নের কথা। কিন্তু কৌটোর ভেতর মরচের গুঁড়ো দেখতে পেলাম। পুরনো লোহার কোনো জিনিস ছিল সম্ভবত।…হু চাবি হতেও পারে।”

“কিসের চাবি?”

“জানি না। এর জবাব বিপ্রদাসবাবুই দিতে পারেন। ওঁকে কালই লোক পাঠিয়ে খবর দিয়ে আনা দরকার।”

“বুদ্ধকে পাঠিয়ে দেব।” বিজয় চঞ্চল হয়ে বলল। “এখনও পাঠানো যায়। সাড়ে ছটায় একটা ট্রেন আছে।”

“ভাগলপুরে রাত্রে গিয়ে কি ওঁকে খুঁজে বের করতে পারবে বুদু? অবশ্য ঠিকানা জানা থাকলে”।

কর্নেল বাধা দিয়ে বললেন, “তুমি বরং এখনই গিয়ে খোঁজ নাও, বুন্ধু বা কেউ ভাগলপুরের ঠিকানা জানে নাকি। মাধবজিকে জিগ্যেস করে যেও।”

“আপনি থাকছেন?”

 “হ্যাঁ–আমি ঘুরি কিছুক্ষণ।”

বিজয় সিঁড়ির ধাপ বেয়ে নেমে গেল সবেগে। কর্নেল ফের কিছুক্ষণ বাইনোকুলারে চারদিক দেখে নিয়ে তারপর মন্দিরের ভেতর উঁকি দিলেন। বেলা পড়ে এসেছে। তবে পশ্চিমের অস্তগামী সূর্যের আলো সোজা এসে মন্দিরে ঢুকেছে। তাই ভেতরটায় রোদ পড়েছে।

একটা শিবলিঙ্গ ছাড়া আর কিছু নেই। ধুসর গ্রানাইট পাথরের বেদির ওপর শাদা পাথরের যোনিপট্টে প্রোথিত কালো পাথরের শিবলিঙ্গ। কর্নেল গুঁড়ি মেরে ঢুকে বেদিটার চারদিকে হাত বুলিয়ে পরীক্ষা করছিলেন। পেছনদিকে হাত বুলোতে গিয়ে হাতে শক্ত কাঠের মতো কী ঠেকল। অত্যন্ত অপরিসর ভেতরটা। অনেক কষ্টে ওপাশে ঝুঁকে চমকে উঠলেন। একটা গর্তে যে জিনিসটা ঢোকানো, সেটা একটা ভাঙা চাবি ছাড়া আর কিছু নয়। কারণ নিচেই গোলাকার চাকতির .. মতো ভাঙা মাথাটা পড়ে আছে।

কেউ চাবি ঢুকিয়ে জোরে চাপ দিতে গিয়ে চাবিটা ভেঙে গেছে। হতাশ হয়ে চলে গেছে। হয়তো অন্ধকার নামলে বেদিটা ভাঙার জন্য তৈরি হয়েই আসবে। কী আছে বেদির ভেতর? বেদিটা তাহলে সম্ভবত পাথরের সিন্দুকই?

হঠাৎ কর্নেলের মনে হল একটা বিপদ আসন্ন।

এই অদ্ভুত অনুভূতি জীবনে বহুবার আসন্ন বিপদের মুহূর্তে তাকে সজাগ করে দিয়েছে। এ যেন অতিরীন্দ্রিয়ের বোধ।

দ্রুত ঘুরলেন। একপলকের জন্য বিকেলের লালচে আলোয় যেন একটা ছায়া সরে যেতে দেখলেন। পকেট থেকে রিভলবার বের করে গুঁড়ি মেরে ঝাঁপ দিলেন মন্দিরগর্ভ থেকে।

কিন্তু কাউকে দেখতে পেলেন না। টিলার পেছন দিকটা খাড়া নেমে গেছে। তার পেছন চৌহদ্দিঘেরা উঁচু পাঁচিল। কিন্তু টিলার চারদিকই ঘন ঝোপে ঢাকা। রিভলবারটা অটোমেটিক। নল তাক করে মন্দিরের চারদিক ঘুরে খুঁটিয়ে দেখলেন। কোনো ঝোঁপের পাতা পর্যন্ত নড়ছে না।

তাহলে কি মনের ভুল? অথবা যে এসেছিল, সে যেন অদৃশ্য হওয়ার মন্ত্র জানে। অস্বস্তিতে অস্থির হয়ে কর্নেল সিঁড়ির ধাপে পা রাখলেন। ছায়া যে দেখেছেন, তা ভুল নয়। আর একটা বিষয়ে নিশ্চিন্ত হওয়া গেল যে সে যেই হোক, তার কাছে আগ্নেয়াস্ত্র নেই। থাকলে গুলি ছুড়ত। তাকে রেহাই দিত না।…