ব্যর্থ প্রেমের প্রতিহিংসা

ব্যর্থ প্রেমের প্রতিহিংসা

এদিন দুপুরে খাওয়ার পর আর ভাত-ঘুম ঠেকানো যায়নি। কম্বলের তলায় বিকেল অব্দি পড়ে থেকে এবং অজস্র দুঃস্বপ্ন-সুখস্বপ্ন দেখে আবুর ডাকে উঠে বসেছিলাম। আবু কফি এনে ডাকছিল। তার কাছে জানতে পারলাম, বুড়োসায়েব রোশনিবাগের আমবাগানে পরগাছা পাড়তে গেছেন। আবুকেই একজন গাছে চড়তে জানা লোক যোগাড় করে দিতে হয়েছে। ভাত-ঘুমের পর নিঝুম বেলায় কফিটা দারুণ লাগল। নিজামতকেল্লার ভগ্নস্তূপের ফোকরগলিয়ে টকটকে গোলাপী রোদ চুঁইয়ে পড়েছিল এবং কবরখানার গাছপালা জুড়ে তখনই নীলচে কুয়াশার আলোয়ান, মুড়ি দেওয়ার আয়োজন শুরু হয়েছে। কফি খেয়ে ভাবলাম, একটু চক্কর দিয়ে আসি। নইলে দুপুরের বিরিয়ানি আর কোর্মা-কোতা হজম হবে না।

কিন্তু এই অবেলায় একটা বেয়াড়া ইচ্ছে মাথায় চেপে বলস। কবরখানায় গিয়ে একটু গোয়েন্দাগিরি করলে কেমন হয়? জাভেদ পাঠানের ভূগর্ভস্থ গোপন ডেরার হদিস যদি পেয়ে যাই, কর্নেলকে টেক্কা দিতে পারব।

কবরখানার পশ্চিম প্রান্তে চলে গেলাম ঘুরতে ঘুরতে। ওদিক দিয়ে গেয়ে কারুর চোখে পড়ার চান্স কম। ধ্বংসস্তূপ এবং ঝোঁপঝাড়ের ভেতর দিয়ে কবরখানার নিচু পাঁচিল পেরিয়ে একটা প্রকাণ্ড কল্কেফুলের ঝোঁপের সামনে গিয়ে পড়লাম।

ঝোঁপটার ভেতর সার-সার কয়েকটা পুরনো কবর আছে। সেগুলোর মাথায় ছাদ ছিল মনে হল। কারণ তিনটে থাম এখনও তিন কোনায় খাড়া রয়েছে। একেকটা ফুট ছ-সাত উঁচু। চতুর্থ থামটার চিহ্ন নেই। থামগুলো বেশ মোটা। ধূসর আলোয় এই কবর-গুচ্ছকে খুঁটিয়ে দেখতে দেখতে বুঝলাম, ছাদের ধ্বংসাবশেষ কোন যুগে সরিয়ে কবরগুলোকে মুক্ত করা হয়েছিল এবং সবই অল্পবয়সী মানুষের। অথবা স্ত্রীলোকেরও হতে পারে। মধ্যিখানে একটা ফলক আঁটা রয়েছে লাইম কংক্রিটের পাটাতনে। তাতে ফার্সি হরফে কী সব লেখা আছে। ভাবছিলাম, এই মৃত মানুষগুলোর মধ্যে কি পরস্পর রক্তের সম্পর্ক ছিল, তাই এদের এভাবে আলাদা জায়গায় কাছাকাছি কবরে শোয়ানো হয়েছিল? হঠাৎ চোখে পড়ল, এই কবরগুচ্ছের শেষদিকে মাঝামাঝি একটা প্রকাণ্ড শ্বেতপাথরের কবর। তার ফলকে লেখা ফার্সি হরফের তলায় ইংরেজিতে কয়েক লাইন কী সব লেখা আছে।

‘এগিয়ে গিয়ে পড়ে দেখলাম :

“I see before me spread the road
 that leads to the kingdom of Death
like a thread stringing smooth
 the uniquiet broken bits of life
Thus peace comes, thus ends strife.”
—Mirza Ghalib

মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়ে কে এমন আশ্চর্য প্রতিধ্বনি করে গেছে কবি গালিবের? জীবনের সব আশা-আকাঙ্ক্ষা-স্বপ্ন ব্যর্থ না হলে মৃত্যুর মধ্যে জীবনকে আবিষ্কার করা যায় না, আর তখন মৃত্যুই হয়ে ওঠে শান্তি। এমনি করে উচ্চারিত হয়, সমুখে শান্তি পারাবার/ভাসাও তরণী হে কর্ণধার। মৃত্যু হয়ে ওঠে শ্যামসমান।

শ্মশানে যেমন, তেমনি গোরস্তানে গেলেও বুঝি বা মনে এক ধরনের দার্শনিকতা ঘনিয়ে আসে। দিনের শেষের এই ধূসর কুয়াশা যেমন অবশিষ্ট আলোটুকু ঘিরে ফেলেছে, তেমনি একটা অস্পষ্টতা ঘিরে ফেলে জীবন নামক অস্তিত্বকেই।

সেই সময় চমকে উঠলাম। কে গুনগুন করে গান গাইছে কোথায়। গায়ে। কাঁটা দিল। তারপরই বুঝতে পারলাম এ গান পাগল নাসির খাই গাইছেন। ‘ একটু তফাতে একটা কাঞ্চনফুলের গাছের তলায় একটা উঁচু কবরে আমার দিকে পিছু ফিরে বসে আছেন নাসির খাঁ।

বারবার গাইছেন। শুনতে শুনতে মুখস্থ হয়ে গেল।

“কি সে মাহরুমি কিসমতকি শিকায় কিজে
হামনে চাহাথা কে মর যায়ে সো উও ভি না হুয়া ॥”

তন্ময় হয়ে গান শুনছিলাম। শীতের দিনের শেষ আলোটুকু মিলিয়ে গিয়েছিল। কখন। আবছা আঁধার ঘনিয়ে এসেছিল। হঠাৎ আমার পিছনে কোথাও খটখট হড়মড় গোছের চাপা একটা শব্দ হতে লাগল। ঘুরে কিছু দেখতে পেলাম না। শব্দটা তারপরই থেমে গেল।

ভীষণ অস্বস্তিতে পড়ে গেলাম। এগিয়ে গিয়ে সাড়া দিলাম নাসির খাঁকে। কিন্তু উনি আমাকে দেখেও যেন দেখতে পেলেন না। আপন মনে গান গাইছে। গুনগুন করে। এবার গানের মানেটা অনুমান করতে পারছিলাম। “দুর্ভাগ্যের জন্য। কার কাছে অভিযোগ করব? মরে যেতে চাইলাম, তো মরণও হল না।”

কবরের সংসর্গ দেখছি বড় বিপজ্জনক। খালি মৃত্যু আর মৃত্যু ছাড়া কথা নেই। জলজ্যান্ত মানুষের পক্ষে মৃতদের মাঝে গিয়ে পড়া ঠিক নয়। এখনই। কেটে পড়া উচিত। গোয়েন্দাগিরি আমার সইবে না।

তারপর নাসির খাঁ সম্পর্কে কর্নেলের ভাবনার কথা মনে পড়ায় ওঁকে এখান থেকে চলে আসার জন্য ডাকলাম। এমন কী বোররাখ কিনতে চাওয়ার কথাও বললাম। উনি কানে নিলেন না। তাই ভাবলাম উত্তরের গেট দিয়ে বেরিয়ে। গিয়ে ওঁর ভাগ্নীদের খবর দিই।

কিছুদূর গেছি, হঠাৎ পেছনে কোথাও একটা হুংকার শুনতে পেলাম। আবছা আঁধারে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল না কিছু। কিন্তু তারপরই নাসির খায়ের চিৎকার শোনা গেল, নাফরমান! কুত্তাকা বাচ্চা!”

তারপর গুলির শব্দ। সন্ধ্যার গোরস্তানের স্তব্ধতা মুহূর্তের জন্য চিড় খেল। আমার আর এতটুকু সন্দেহ রইল না যে হতভাগ্য নাসির খাঁকে তার আকাঙিক্ষত মৃত্যু উপহার দিয়েছে জাভেদ, পাঠান!

সঙ্গে টর্চ নিয়ে বোরোইনি। তাই দৌড়ে উত্তরের গেট দিয়ে বেরিয়ে পোড়ো জমি ভেঙে বেগমসায়েবার বাড়ি পৌঁছুলাম। আবু ঘরের মেঝেয় ঝাড়ু বোলাচ্ছিল। রোজ সকালসন্ধ্যা এই তার কাজ। আমাকে দেখে বলল, “বুড়োসায়েব এসেছিলেন একদল পুলিশ নিয়ে। আস্তাবলে কী হচ্ছে দেখুন গে!”

কী হচ্ছে, তা জিগ্যেস করার মন ছিল না। টর্চ বের করে বললাম, “আবু! শিগগির বুড়োসায়েবকে খবর দাও! কবরখানায় আবার মানুষ খুন হয়েছে।”

আবু তাকিয়ে রইল। আমি দৌড়ে চললাম কবরখানায়। দূর থেকে টর্চের আলো ফেলে থমকে দাঁড়িয়ে গেলাম। নাসির খাঁ খুন হননি। কোমরে দু হাত রেখে সহাস্যে দাঁড়িয়ে আছেন। একটা লোক আরেকটা উপুড় হয়ে থাকা লোকের পিঠে চেপে বসেছে। সে নাসির খাঁকে বলছে, “জলদি লাও বেটা। জলদি করো!”

লোকটাকে কাছে গিয়ে চিনতে পারলাম। সে বিড্ডু।

এবং তলার লোকটি জাভেদ পাঠান। তার রাইফেলটা একটু তফাতে পড়ে রয়েছে। বুঝলাম, জাভেদের গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছে।

কিন্তু বিড্ডু কোত্থেকে হঠাৎ সময়মতো আবির্ভূত হয়েছিল? তাকে তো কলকাতায় দেখে এসেছিলাম!

বিড্ডু আমাকে চিনতে পারল না প্রথমে। সে দম আটকানো গলায় বলে উঠল, “দেখিয়ে সাব! এর নাম আছে জাভেদ পাঠান। খুনী ঔর দাগী আসামী আছে হারামি। ছোটানবাবকে খুন করতে গোলি চালিয়ে দিল। তো আমি একে পাকড়ে ফেললাম। সাব, জেরা মেহেরবানি করকে আপ থানামে খবর ভেজিয়ে জলদি। হামি ওকে পাকড়ে রেখেছে।”

রাইফেলটা কুড়িয়ে নিয়ে চেম্বার খুলে দেখলাম এখনও দুটো গুলি আছে। রাইফেলটা অটোমেটিক। তাই গুলি দুটো বের করে পকেটে রাখলাম।

বিড্ডু আবার তাগিদ দিল। তারপর আমাকে চিনতে পারল। একগাল হেসে বলল, “ও! চিনেছে–আপনি ছোটা গোয়েন্দাসাব আছেন। তো বুড়া গোয়েন্দাসাব

কোথায়? উনহিকো জলদি বোলাইয়ে!”– ওকে রুমাল ছুঁড়ে দিয়ে বললাম, “তুমি আসামীর হাত দুটো রুমাল দিয়ে বেঁধে ফেলো বিড্ডু। বুড়োগোয়েন্দাসায়েব এখনই এসে যাবেন।”

বিড্ডু জাভেদের হাত দুটো পেছন থেকে পিঠমোড়া করে বাঁধল। তারপর উঠে দাঁড়াল। জাভেদ ওঠার চেষ্টা করলে সে তার জুতোসুদ্ধ পা পিঠে চাপিয়ে গর্জন করল, “চুপসে শুঁকে–একদম চুপসে! শর তোড় দেগা ইটা মারকে।”

কয়েকটা টর্চের আলো ফেলতে ফেলতে কর্নেল এসে পড়লেন সদলবলে। কনস্টেবলরা এসেই জাভেদকে ওঠাল। তারপর তার কাঁধে থাবা হাঁকড়ে ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে চলল। রাইফেল এবং গুলি দুটো পুলিস অফিসার মিঃ ভদ্রকে দিলাম। আগাগোড়া ঘটনাটা বললামও।

কর্নেল টর্চের আলো ফেলছিলেন চারদিকে। গঠাৎ বললেন, “কিন্তু নাসির খাঁ কোথায় গেলেন?”

বিড্ডু ডাকল, ‘ছোটকু! বেটা ছোটকু! কঁহা হ্যায় তুম?”

কর্নেল হন্তদন্ত হয়ে উত্তরের গেটের দিকে এগিয়ে গেলে তাকে অনুসরণ করলাম। জিগ্যেস করলাম, “আস্তাবল অভিযানে লাভ হল কর্নেল?”

কর্নেল বললেন, “হয়েছে।”

“ছবিটা পেয়েছেন? কোথায় রাখা ছিল?”

 কর্নেল আমাকে অবাক করে বললেন, “ছবি? ছবি পাইনি!”

“তাহলে লাভটা কী হয়েছে?”

“বড়বাবসায়েবের কিছু চিঠি পাওয়া গেছে।” কর্নেল ব্যস্ততার মধ্যে বললেন। “যা অনুমান করেছিলাম। বসির খাঁ তাহের মিয়াকে তার ভগ্নীপতি জর্জিস খাঁর ওপর নজর রাখতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। ছবিটা বেচতে পারলে টাকার অর্ধেক ভাগ দিতে চেয়েছিলেন। তাই তাহের তক্কে তক্কে ছিল।”

“মশা মারতে কামান দাগার আয়োজন!”

মিনা উদ্বিগ্ন মুখে দাঁড়িয়ে ছিল দক্ষিণের খোলা বারান্দায়। কর্নেলকে বলল, “মাজীকে খুঁজে পাচ্ছি না। মুনা রুনা কান্নাকাটি করছে।”

কর্নেল বললেন, “পাগলানবাবকে তুমি দেখেছ, মিনা?”

মিনা কাঁদোকাঁদো মুখে বলল, “উনি ভাগ্নীদের কাছে বসে আছেন।”

কর্নেল ব্যস্তভাবে বললেন, “এস তো জয়ন্ত!”

বাড়ি ঘুরে নহবতখানার ফটক পেরিয়ে গিয়ে একটা সাইকেল রিকশো ডাকলেন কর্নেল। দুজনে উঠে বসলাম রিকশোতে। তারপর কর্নেল বললেন, “রোশনিবাগ চলো। একটু তাড়াতাড়ি গেলে বখশিশ পাবে।”

সারা পথ আমার কোনো প্রশ্নের জবাব পেলাম না। অবশেষে আবিষ্কার করলাম, আমরা গিয়াসুদ্দিন পাঠানের বাড়ির দিকে চলেছি।

দরজায় কর্নেল জোরে কড়া নাড়লেন। একটু দেরি করে দরজা খুলল। গিয়াসুদ্দিন আমাদের দেখে কেমন যেন হকচকিয়ে গেলেন।

কর্নেল বললেন, “বেগমসায়েবাকো খবর ভেজিয়ে মেহেরবানি করকে।”

 গিয়াসুদ্দিন কিছু বলতে ঠোঁট ফাঁক করছেন, তাঁর পেছন থেকে বেগম শামিম-আরা এগিয়ে এসে বললেন, “চলুন কর্নেলসায়েব! আর ঝামেলা করে লাভ নেই।”

কর্নেল বললেন, “আপনার হাতে কী?”

শামিম-আরা বাঁকা হাসলেন। “একমুঠো ছাই। নাসিরের মুখে মাখিয়ে দেব বলে নিয়ে যাচ্ছি।”

কর্নেল চমকে উঠলে। “সর্বনাশ! ছবিটা পুড়িয়ে ফেললেন আপনি! একটা অমূল্য ঐতিহাসিক ছবি। বেগমসায়েবা, এ কী করলেন আপনি!”

বৃদ্ধ গিয়াসুদ্দিন তেমনি কাঠপুতুল হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। শামিম-আরা বেরিয়ে এসে বললেন, “চলুন!”

জনহীন অন্ধকার রাস্তায় রিকশাওলা রিকশো নিয়ে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। কর্নেল বললেন, “বেগমসায়েবা আপনি এই রিকশোয় চলে যান। আমরা হেঁটেই ফিরব।”

রিকশোওলা বলল, “পথে রিকশা পেলে পাঠিয়ে দিচ্ছি স্যার।”

“তাই দিও। আর শোনো, তুমি ওঁকে পৌঁছে দিয়ে একটু অপেক্ষা কোরো। তোমার ভাড়াটা–”বলে কর্নেল পার্স বের করলেন। “না না–বরং তুমি ভাড়াটা নিয়েই যাও।”

শামিম-আরা রিকশাওলার উদ্দেশে চাপাস্বরে বললেন, “ছোড়। হামকো পছা দে জলদি! ফিকর মাত কর। হাম সব দে দেগি।”

“জী।” বলে রিকশোওলা প্যাডেলে চাপ দিল। কর্নেল ভাড়া দেওয়ার সুযোগ পেলেন না।

রোশনিবাগের জনহীন রাস্তায় শীতের সন্ধ্যায় হাঁটছিলাম দুজনে। একটু পরে কর্নেল চুরুট ধরালেন। লাইটার জ্বালানোর সময় ওঁর মুখে একটা প্রশান্তির ভাব দেখতে পেয়েছিলাম। তাই বললাম, “ছবিটা তাহলে বেগমসায়েবা _ গিয়াসুদ্দিনসায়েবের বাড়িতে এনে রেখেছিলেন?”

“হ্যাঁ। তবে সেটা আজই বেলা দশটার পরে কোনো এক সময়ে।”

 “বুঝেছি। মিনাকে নিয়ে ওই সময় বেরিয়েছিলেন–আবু বলছিল।”

কর্নেল একটু হাসলেন। “ছবিটা আস্তাবলে গতরাত্রে তাহের মিয়ার ঘর থেকেই হাতিয়েছিলেন শামিম-আরা। কাল রাতে পাগল নাসির খা ভাগ্নীদের বলেছিলেন, আস্তাবলে বোররাখ বাঁধা আছে। দুই বোনই আমাকে বলেছে, গতরাতে মা মিনাকে নিয়ে বেরিয়েছিলেন। তখন রাত্রি প্রায় বারোটা বাজে। আস্তাবলে তাহের দর্জির ঘরে ঢোকার অসুবিধে নেই কারণ পশ্চিমের জানালা একেবারে ভাঙাচোরা। মুনা-রুনা ভোরবেলা কবরখানায় ফুল দিতে গিয়ে আমাকে সেখানে দেখে ভড়কে গিয়েছিল। যাই হোক্ মেয়ে দুটো অত্যন্ত সরল। কথায় কথায় সব ফাস করে দিল।”

“তাহলে নাসির খায়ের কথা শুনেই বেমসায়েবা বুঝতে পেরেছিলেন ছবি কোথায় আছে?”

“ঠিক তাই।” কর্নেল চাপাস্বরে কথা বলছিলেন। “মুনা-রুনার বর্ণনা অনুসারে ছবিটা খুবই ছোট্ট। কাপড়ে আঁকা কালো রঙের স্বর্গীয় বাহনের ছবি। ইঞ্চিছয়েক লম্বা আর ইঞ্চিচারেক চওড়া ফ্রেমে কাঁচ দিয়ে বাঁধানো ছিল।”

“বোঝা যায়, ছবিটা বেচে প্রেমিকের সঙ্গে চলে যেতেন বেগমসায়েবা! হতভাগিনী মেয়ে দুটোকে ফেলে রেখে!”,

“কে জানে কী করতেন! স্ত্রীলোকের মনের কথা দেবতারাও নাকি টের পান না।“ কর্নেল একটু হাসলেন। “তবে আমি জানি, মেয়েদের প্রতি শামিম-আরার? স্নেহও কিছু কম নেই। তাই আমার ধারণা, স্নেহের জয়ই হত। জয়ন্ত, অবৈধ প্রেম-ট্রেমের চেয়ে বাৎসল্যর টান অনেক বেশি। আসলে জাভেদ ওঁকে প্ররোচিত করত। আর উনি ভুগতেন দ্বিধা-দ্বন্দ্বে। এবার বোধ করি, দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ঘুচে গেল। বাসল্যেরই জয় আশা করতে পারব।”

একটা রিকশোর ভেঁপু বাজছিল দূরে। জুগজুগ করছিল ভুতুড়ে একটা আলো। রিকশোটা এসে দাঁড়িয়ে গেল। রিকশোওয়ালা বলল, “সেলাম সাব!”

সেই রশিদ রিকশোওলা।

নহবতখানা ফটক পেরিয়ে যাবার সময় জিগ্যেস করলাম, “গিয়াসুদ্দিনের বাড়িতে ছবি রাখার খবর কে দিল আপনাকে?”

‘বাইনোকুলার।”

“সে কী!”

“অর্কিডটা পাড়ার জন্য নিজেই গাছে উঠেছিলাম। কিন্তু অত উঁচুতে এই প্রকাণ্ড শরীরের পক্ষে পৌঁছুনো অসম্ভব হত। ডালটা ভেঙে যেত এবং মারা পড়তাম। তবে আমার যা স্বভাব। গাছে উঠে বাইনোকুলারে গিয়াসুদ্দিনের বাড়ির উঠোনে বেগমসায়েবা আর মিনাকে দেখে অবাক হইনি। নাসিরের ভয়ে ছবিটা কোথাও লুকিয়ে রাখতেই হত ওঁকে।”

ডেরায় পৌঁছে দেখি, আবু দাঁড়িয়ে আছে। কর্নেল বললেন, “তোমার মাজী। এসেছেন?”

“জী সাব!”

“পাগলানবাব ঘরে আছেন তো?”

 “জী সাব! আপাদের সঙ্গে গল্প করছেন।”

“খুব ভাল। দেখ তো বাবা, একটু কফি খাওয়াতে পারো নাকি। বড়ড ঠাণ্ডা আজ।”

আবু চলে গেলে জিগ্যেস করলাম, “একটা কথা বুঝতে পারছি না। তাহের দর্জি কাল ভোরে কবরখানায় ঢুকেছিল কেন?”

“এ প্রশ্নের সঠিক জবাব হয়তো পাওয়া যাবে না। তবে আমার অনুমান, সে কবরখানায় জাভেদের লুকিয়ে থাকার ব্যাপারটা কোনোভাবে টের পেয়ে থাকবে। তাই কৌতূহলী হয়ে তদন্ত করতে গিয়েছিল হয়তো। কিংবা গতকাল ভোরবেলা তার চোখে পড়েছিল কিছু। হয়তো জাভেদকে দেখতে পেয়েই তার সঙ্গে কথা বলতে গিয়েছিল। সেটাই অবশ্য স্বাভাবিক। জাভেদকে জেরা করলে জানা যাবে কেন সে তাহের মিয়াকে খুন করেছে।”

“কর্নেল! জাভেদের লুকিয়ে থাকার জায়গাটা দেখতে কৌতূহল হচ্ছে।”

কর্নেল হাসলেন। “কল্কেফুলের জঙ্গলের ভেতর শাদা পাথরের একটা প্রকাণ্ড কবর আছে। ওটা নকল কবর। পাথরের ঢাকনা সরালে সিঁড়ি আছে। নিচে একটা ঘরের ভেতর নবাব ইস্কান্দার খানের আসল কবর। তার আশঙ্কা ছিল, ইংরেজরা তার মৃতদেহের অবমাননা করবে। তাই ওই পাতালঘরে নিজের আসল কবরের ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। যাই হোক, তোমাকে সেই পাতালঘরে ঢোকাতে রাজি আছি। তবে তুমি যদি ভয় পেয়ে হার্টফেল কর আমি দায়ী থাকব না।”

“ভয় পাওয়ার কী আছে? জাভেদ তত দিব্যি সেখানে থাকত।”

“ডার্লিং! জাভেদ একজন দুঃসাহসী লোক। খুনী, ডাকাত এবং একসময় স্মাগলারও ছিল সে। তার পক্ষে কবরের পাশে শুয়ে, নাক ডাকানো খুবই সম্ভব।”

দ্রুত বললাম, “থাক গে! কী দরকার কবরে ঢোকার!”

কর্নেল হাসতে লাগলেন। আবু কফি আনল। চাপাস্বরে বলল, “মাজী খুব কাঁদছেন। পাগলানবাব ওঁর পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে গান করছেন, কী সব হচ্ছে বাড়িতে। আমার একটুও ভাল লাগছে না।”

দুঃখিত বালকটি পশ্চিমের বারান্দায় চলে গেল। কানে এল, পাগল নাসির খাঁ গুন গুন করে গাইছেন। একটু পরে বিড্ডু এসে সেলাম দিয়ে মেঝেয় বসল।

কর্নেল জিগ্যেস করলেন, “থানা থেকে এলে বিড্ডু?”

“জী হাঁ সাব!”

“তুমি কলকাতা ফিরবে কবে?”

 “ছোটকুনবাবকে সাথে নিয়ে যাব। দেখি, উনির কখন মর্জি হয়।”

আমি জিগ্যেস করলাম, “তুমি হঠাৎ কলকাতা থেকে চলে এলে কেন, বিড্ডু?”

বিড্ডু বলল, “কর্নেলসাব হামাকে আসতে বলেছিলেন। তাই চলে আসল।”

“তুমি তখন কবরখানায় কী করছিলে?”

“কুছু না। আমি এসে ছোটকুনবাবকে ছুঁড়ছিল। ছুঁড়তে ছুঁড়তে কবরখানায় গেল। গিয়েই দেখল কী, জাভেদ হারামি বন্দুক তাক করেছে। আমি ওকে পাকড়ে ফেলল। গুলিভি ছুটে গেল। বাপরে বাপ! হারামি ডাকুর গায়ে এত্তা তাকত, হামাকে বুঢ়া সমঝেছিল।”

বিড্ডু হাসতে লাগল। তারপর গম্ভীর হয়ে ফের বলল, “সাব! জাভেদকে পাকড়াও করল পুলিশ। লেকিন ওর বড়ভাই ফরিদভি হারামি আছে। ওহি তো ছোটকুনবাবকে হেকিমি দাওয়া খিলিয়ে পাগল করে দিয়েছে! হামি এখন সমঝে লিয়েছি, ফরিদ এইসা কিয়া।”

কর্নেল নিভন্ত চুরুটটি ধরিয়ে ধোঁয়ার ভেতর বললেন, “ফরিদসায়েবকে শিগগির পুলিশ অ্যারেস্ট করবে, বিড্ডু! পাসপোর্ট জাল করার জন্য পুলিশ ওঁর দিকে নজর রেখেছে কিছুদিন থেকে।”

মিনা এসে মৃদুস্বরে বলল, “কর্নেলসাব! আপনাকে অন্দরে আসতে বললেন মাজী!” তারপর বিড্ডুকে দেখে অবাক হয়ে গেল সে। “বিড্ডভাইয়া, কখন এলে তুমি? তা এখানে বসে আছ কেন? ভেতরে এস।”

কর্নেল ও বিড্ডু অন্দরমহলে গেলে প্যাড বের করে রেপোর্টাজ লিখতে বলসাম। একখানা জম্পেশ রেপোর্টাজই লিখতে হবে। একাদশ শতাব্দীর পর্যটক ও পণ্ডিত আল-বিরুনির আঁকা স্বর্গীয় বাহনের ছবি থেকেই শুরু করা যাক। ওই বাহনে চেপে জাহানাবাদের নবাববংশীয়া এক প্রেমিকা প্রেমের স্বর্গে যেতে চেয়েছিলেন। শেষে ব্যর্থ প্রেমের প্রতিহিংসায় বাহনটিকে পুড়িয়ে ছাই করে দিলেন।….