ভৌতিক ছড়া

ভৌতিক ছড়া

 বুদ্বুরাম বা কেউই জানে না ভাগলপুরে কোন ঠিকানায় বিপ্রদাসবাবুর বোনের বাড়ি। তাই বুদ্বুরাম আগামীকাল ভোরের ট্রেনেই ভাগলপুরে যাবে। সেখানে তার এক দূরসম্পর্কের আত্মীয় থাকে। কাজেই দিনসবরে গিয়ে খুঁজে বের করতে অসুবিধে হবে না। বিজয় এসে জানাল কর্নেলকে।

কর্নেল জয়াকে দেখতে গিয়েছিলেন তার ঘরে। তার শরীর ভাল, কিন্তু মন ভাল নেই। কর্নেলকে বসিয়ে রেখে বিজয় হয়তো কবিতা লিখতে গেল।

একথা-ওকথার পর কর্নেল বললেন, “আচ্ছা জয়া, তোমাকে শরদিন্দু কি পরিতোষ নামে কারুর কথা বলেছিল?”

জয়া একটু চমকে উঠে বলল, “হ্যাঁ বলেছিল। ওদের ব্যাংকের ক্যাশডিপার্টে : কাজ করত সে।”

“তাকে কানাজোলে দেখতে পাওয়ার কথা বলেছিল কি?”

জয়া বলল, “বলেছিল। কিন্তু আপনি কেমন করে জানলেন?”

 “কী বলেছিল, আগে বলল। আমি পরে বলছি সেকথা।”

“বলেছিল, দেখার ভুল হতেও পারে। তবে বাজারের ওখানে যেন পরিতোষ নামে ওর কলিগকে দেখেছে। আসলে ওর সন্দেহ ছিল পরিতোষই ক্যাশ সরিয়ে, ওকে বিপদে ফেলেছিল। কারণ পরিতোষের স্বভাবচরিত্র নাকি ভাল ছিল না।”

“শরদিন্দুর মদ খাওয়া সম্পর্কে তোমার কী ধারণা?”

জয়া একটু চুপ করে থেকে বলল, “ওর মদ খাওয়ার কথা আমি বিশ্বাস করি না।”

“কিন্তু মর্গের রিপোর্টে পাওয়া গেছে, ওর পেটে অ্যালকোহল ছিল।”

“বিশ্বাস করিনি। এখনও করি না।”

“মাধবজি দেখেছিলেন, যেরাতে শরদিন্দু মারা যায়, সেরাতে–তখন দশটা বাজে, জয়ের সঙ্গে ব্যালকনিতে বসে মদ খাচ্ছিলো।”

জয়া নিষ্পলক চোখে তাকাল। “…মাধবজি বলেছেন?”

 “হ্যাঁ। উনি দেখেছিলেন।”

জয়া মুখ নামিয়ে আস্তে বলল, “সেদিন সন্ধ্যায় আমার মেজাজ ভাল ছিল না। ওকে নিয়ে কানাজোল জুড়ে স্ক্যান্ডাল ছড়িয়েছিল। লোকে আড়ালে আমার নামেও কদর্য তামাশা করত। এমন কি আমাদের বাড়িতেও গোপনে আলোচনা চলত দারোয়ানের ঘরে। রঙ্গিয়া এসে বলে যেত। তো সেদিন সন্ধ্যায় খামোকা ওর সঙ্গে ঝগড়া বাধালুম। বললুম, আমাকে যদি কোথায় না নিয়ে যেতে পারো, তাহলে চলে যাও।”

জয়া ধরা গলায় বলতে থাকল, “সেরাতে ও খেতে এল না। মাধবজির ওখানে আছে খবর পেলুম। আমিও খাইনি। শরীর খারাপ বলে দরজা আটকে শুয়ে পড়লুম। অনেক রাতে দরজায় নক করে ডাকল। আমি দরজা খুলিনি।”

জয়া চুপ করলে কর্নেল বললেন, “তারপর?”

“তারপর আর সাড়া পেলুম না। মিনিট পাঁচেক পরে উঠে গিয়ে দরজা খুলে দেখলুম, বারান্দায় নেই। ভাবলুম, ছোড়দার ঘরে শুয়েছে। সেরাতে আমার কী যে হয়েছিল!”

“জয়ের সঙ্গে শরদিন্দুর সম্পর্ক কেমন ছিল?”

 “বড়দা ভীষণ খেয়ালি। মাঝেমাঝে ওকে ডেকে নিয়ে গিয়ে গল্প করত।”

 “হু–আচ্ছা জয়া, কেন তোমার সন্দেহ যে শরদিন্দু চিতার আক্রমণে মারা যায়নি?”

জয়া একটু উত্তেজিত হল। “কেন ও অত রাতে বড়দার স্যুতে যাবে? সুইসাইড করার ইচ্ছে থাকলে অন্যভাবে কি করা যেত না? তাছাড়া ওর বডিতে যেসব ক্ষতচিহ্ন ছিল, তা চিতার নখ বা দাঁতের বলে আমার মনে হয়নি।”

“কিন্তু মর্গের ডাক্তার তো”

“ডাক্তারের রিপোর্ট আমি বিশ্বাস করি না। কেউ তাকে ঘুষ খাইয়ে মিথ্যা রিপোর্ট লিখিয়েছে।”

“তুমি কি বলতে চাইছ শরদিন্দুকে খুন করা হয়েছিল।”

 “হ্যাঁ। তাছাড়া কিছু হতেই পারে না।”

“কেন ওকে খুন করবে কেউ?”

আবার একটু চুপ করে থাকার পর জয়া আস্তে বলল, “আমার সন্দেহ হয় বড়দা জানে, কে কেন ওকে খুন করেছে। বড়দা খুনীকে গার্ড করেছে। বড়দাই হয়তো ব্যাপারটা ঢাকতে চিতাবাঘের কাঁধে দোষ চাপিয়েছে।”

কর্নেল তীক্ষ্ণদৃষ্টে ওকে লক্ষ্য করছিলেন। বললেন, “কেন বড়দাকে সন্দেহ হয়, জয়া?”

“বড়দার হাবভাব দেখে। সেদিন থেকে বড়দার পাগলামি বেড়ে গেছে। তাছাড়া লক্ষ্য করেছি, মাঝে মাঝে লুকিয়ে কাঁদে। রাত্রে মাতাল-অবস্থায় চুল আঁকড়ে ধরে বলে, আর আমার বাঁচতে ইচ্ছে করছে না, আমি শিগগির মরে যাব।”

“তুমি শুনেছ নিজের কানে?”

“হ্যা”। জয়া গলার স্বর আরও চেপে বলল, “দুদিন আগে রাত বারোটা নাগাদ ঘুম ভেঙে গেল। বৃষ্টি হচ্ছিল। দরজা খুলে বারান্দায় গেলুম। হঠাৎ শুনি বড়দার ঘর থেকে কান্নার আওয়াজ আসছে। ছুটে ওর ঘরের দিকে গেলুম। চমকে উঠলুম বড়দার কথা শুনে। বড়দা কাঁদতে কাঁদতে বলছে, আমিই জয়াকে বিধবা করে ফেলেছি! ভগবান, আমাকে শিগগির মেরে ফেলো! দরজায় নক করে ওকে ডাকলুম। অমনি আলো নিভে গেল ঘরের ভেতর। বড়দার কোনো সাড়াই পেলুম না। তখন অবাক হয়ে ফিরে এলুম।”

“তোমার মনে হয় না হঠাৎ ঝোঁকের বশে জয় মানুষ খুন করতে পারে?”

জয়া জোরে মাথা নেড়ে বলল, “না। বড়দা মনে মনে ভীষণ ভিতু। খুব দয়ালু ছেলে বড়দা। ওই যে চিড়িয়াখানা করেছে, জন্তু আর পাখিগুলোকে কী যে ভালবাসে ভাবতে পারবেন না। তাছাড়া ওর মুখেই যত হাঁকডাক। ভেতর ভেতর খুব ভিতু আর গোবেচারা।”

কর্নেল চোখ বুজে দাড়িতে হাত বুলোচ্ছিলেন। হঠাৎ চোখ খুলে বললেন, “জয়ের কাকাতুয়ার জিভ কেটে বোবা করে দিয়েছিল কেউ। এসম্পর্কে তোমার কী ধারণা?”

জয়া ঈষৎ লজ্জিত ভঙ্গিতে বলল, “রঙ্গিয়ার কাছে শুনেছি বড়দা নাকি পাখিটাকে অসভ্য কথা শেখাত।”

“বেশ। তাই যদি হয়, কে পাখিটার জিভ কেটেছিল বলে তোমার সন্দেহ হয়?”

জয়া বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর আস্তে বলল, “আমার সন্দেহ কাকাবাবুকে।”

“বিপ্রদাসবাবুকে?”

জয়া মাথাটা একটু দোলাল।

“কেন, বলতে আপত্তি আছে?”

জয়া মুখ তুলল এবং কিছু বলতে গিয়ে ঠোঁট ফাঁক করল। কিন্তু বলল না। সেই সময় বিজয় হন্তদন্তভাবে ঘরে ঢুকে বলল, “জানিস জয়া? আমাদের বাড়িতে নিশ্চয় ভূত আছে।”

কর্নেল বললেন, ‘কী ব্যাপার, বিজয়?”

বিজয় ধপাস করে একটা গদি-আঁটা চেয়ারে বসে বলল, “ইশ! এখনও বুকটা কাঁপছে। ভাবা যায় না।”

জয়া বিরক্তভাবে বলল, “কী হয়েছে বলবে তো?”

বিজয় চাপা গলায় বলল, “কয়েক লাইন লিখেছি–বেশ এগোচ্ছে লেখা, হঠাৎ আলো নিভে গেল ঘরের। তারপর খসখস শব্দ–কেউ যেন ঘরে ঢুকেছে। আমি সঙ্গে সঙ্গে পালিয়ে এসেছি। ইশ! এখনও বুকটা”

কর্নেল উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “এস তো দেখি।”

বিজয় কুণ্ঠিতভাবে একটু হেসে বলল, “চলুন। কিন্তু আমি পেছনে থাকব।”

জয়াও অনুসরণ করল। কিন্তু কর্নেল বললেন, “জয়া, তুমি বারান্দায় থাক– অথবা তোমার দরজায় তালা এঁটে তবে এস।”

জয়া বিস্মিত হল। বলল। “ঠিক আছে। আমি এখানেই থাকছি।”

জয়ার ঘরের পাশেরটা তালাবন্ধ। তার পরেরটা বিজয়ের ঘর। ঘরে আলো জ্বলছে দেখে বিজয় অবাক হয়ে বলল, “এ কী! আলো জ্বলছে দেখছি যে! ভারি অদ্ভুত ব্যাপার তো!

কর্নেল ও বিজয় ঘরে ঢুকল। বিজয় বলল, “তার চেয়ে অদ্ভুত, আমি টেবিলল্যাম্প জ্বেলে লিখছিলুম। কিন্তু দেখুন কর্নেল, টেবিলল্যাম্পের প্লাগটা সুইচবোর্ডে অফ করা আছে। ওটা অন করেই লিখছিলুম। আর বড় আলোটা কেউ জ্বেলে দিয়ে গেছে।”

কর্নেল টেবিলের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। বললেন, “বিজয় কি বাংলাভাষায় কবিতা লেখ?”

বিজয় অবাক হয়ে বলল, “না তো। হিন্দি আমার মাতৃভাষা। হিন্দিতেই লিখি।”

“ওই বাংলা দুলাইন পদ্য তাহলে তোমার নয়। ভূতটাই লিখে গেছে।”

বিজয় কবিতার খাতার ওপর ঝুঁকে গেল। বলল, “কী আশ্চর্য!”

কর্নেল বললেন, “ভূতটা রসিক। পড়ে দেখ, কী লিখেছে।”

 বিজয় বাংলা পড়তে পারে। সে পড়লঃ

 “বামুন গেছে যমের বাড়ি।
বুড়ো ঘুঘু ছিঁড়বে দাড়ি”

 বিজয় হাসতে হাসতে বলল, “ধাঁধা নাকি? কিছুই তো বোঝা যাচ্ছে না কর্নেল!”

কর্নেল গুম হয়ে বললে, “তোমার খাতায় ছড়া লিখে আমার সঙ্গেই রসিকতা করে গেছে কেউ। তুমি হয়তো জানো না বিজয়, আমাকে পুলিসমহলে রসিকতা করে বুড়ো ঘুঘু বলে থাকে। কিন্তু বামুন গেছে যমের বাড়ি-মাই গুডনেস!” কর্নেল নড়ে উঠলেন। “বিপ্রদাস মুখুয্যেমশাইয়ের কোনো বিপদ হয়নি তো? কিংবা মাধবজি–বিজয়, তুমি বুদ্বুরামকে বলো, মাধবজি ঠিক আছে কি না খোঁজ নিয়ে আসুক!”

বিজয় বারান্দার থামের পাশে কার্নিসে ঝুঁকে বুন্ধুকে ডাকতে থাকল। কর্নেল পদ্যটা ছিঁড়ে নিয়ে বেরিয়ে এলেন। তখন জয়া বলল, “কী হয়েছে, কর্নেল?”

কর্নেল এগিয়ে গিয়ে বললেন, “ঘরে চলো, বলছি!”