এক তসবির কে লিয়ে

এক তসবির কে লিয়ে

সেবার জানুয়ারি মাসে জাহানাবাদের ঐতিহাসিক নিজামত-কেল্লার রক্ষণাবেক্ষণের ভার কেন্দ্রীয় প্রত্নদফতরের হাতে গেলে দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকায় যখন সেই খবর চোখে পড়ার মতো করে প্রথম পাতায় বেরুল, তখন একটু অবাক লেগেছিল। তারপর আরও অবাক হলাম, যখন পত্রিকার চিফ অফ দা নিউজ ব্যুরো তারক গাঙ্গুলি আমাকে জাহানাবাদ ঘুরে এসে একটি জাঁকালোগোছের রেপোর্টাজ লেখার ফরমাস করলেন। হাঁ করে তাকিয়ে আছি দেখে গাঙ্গুলিদা দাঁতে পাইপ কামড়ে বললেন, “কী বুঝলে?”

“জাহানাবাদ ঘুরে এসে কিছু লিখতে হবে।”

“শুধু ঘোরা নয়, পর্যবেক্ষণ করতে হবে।” গাঙ্গুলিদা পাইপের ডগায় জ্বলন্ত লাইটার ঠেকিয়ে বললেন। “একজন ভাল রিপোর্টার হতে গেলে এটাই প্রথমে দরকার।”

“পর্যবেক্ষণ, গাঙ্গুলিদা?”

“পর্যবেক্ষণ।” ধোঁয়ার ভেতর গাঙ্গুলিদা প্রতিধ্বনি তুলেই ক্ষান্ত হলেন না, ব্যাপারটা যথেষ্ট জোরালো করার জন্য ইংরিজিতে উচ্চারম করলেন, “কিন অবজার্ভেশন।”

শ্বাস ছেড়ে বললাম, “কর্নেলও ঠিক এই কথা বলেন।”

গাঙ্গুলিদা ভুরু কুঁচকে বললেন, “হু ইজ দ্যাট ফেলা?”

 “আমার ফ্রেন্ড-ফিলসফার-গাইড কর্নেল নীলাদ্রি সরকার।”

গাঙ্গুলিদা হাসলেন। “তাই বলো! সেই সান্তা ক্লজ বুড়ো? কেমন আছেন ভদ্রলোক? অনেকদিন আর কোনো সাড়া পাচ্ছি না। শখের গোয়েন্দাগিরি ছেড়ে ধর্মকর্মে মন দিলেন নাকি?

“না। এখনও গোয়েন্দাগিরি চালিয়ে যাচ্ছেন, তবে পাখি-প্রজাপতি অর্কিড ক্যাকটাসের পেছনে।”

গাঙ্গুলিদা আর আমার কথায় কান দিলেন না। গম্ভীর হয়ে ধোঁয়ার ভেতর। বললেন, “ওক্কে মাই বয়! উইশ য়ু গুড লাক।”….

অফিস থেকে বেরিয়ে যখন রাস্তায় নেমেছি, তখন রাগ:খ-অভিমান হতাশায় আমার মন ভারাক্রান্ত। সবে স্পেশাল রিপোর্টার পদে প্রমোশন পেয়েছি। একখানা সাংঘাতিক রাজনৈতিক স্কুপ কাগজে ঝেড়ে দিল্লি অব্দি কাঁপিয়ে দেবার ফিকিরে রাজনেতিক মহলে ছোঁক করে ঘুরে বেড়াচ্ছি, হঠাৎ বিনিমেঘে বজ্রাঘাতের মতো এই মামুলি অ্যাসাইনমেন্ট! তাও অন্য কোথাও যেতে হলে কথা ছিল। সেই ধাদ্ধাড়া-গোবিন্দপুর জাহানাবাদ! শুনেছি নবাবী আমলে সেখানে নাকি দেশের রাজধানী ছিল। পরের যুগে ইংরেজরা স্থানটিকে লন্ডনের চেয়ে সমৃদ্ধশালী বলে বর্ণনা করেছে। কিন্তু ইংরেজরাও তো সেখানে বেশিদিন পা রাখেনি। রাজধানী সরিয়ে এনেছিল কলকাতা শহরে। আসলে কোনো জনপদ, তা যতই সমৃদ্ধশালী হোক, যখন নিজের ভেতর থেকেই পচ ধরতে শুরু করে, তখন আর স্বয়ং ঈশ্বরও তার পতন রোধ করতে পারেন না। জাহানাবাদ কবে মরে হেজে গেছে। এখন সে নিতান্ত গোরস্থানে পরিণত। সাদা কথায় প্রেতপুরী। কিছু কিছু রোমান্টিক স্বভাবের মানুষ আছেন, যাঁরা এইসব প্রেতপুরী আর কবরখানায় নাক গলাতে ভালবাসেন, তাঁদের বলা হয় প্রত্নতাত্ত্বিক।

ইদানীং আবার এই এক হাওয়া উঠেছে, মাটির তলায় যা কিছু পাওয়া যায়, তাই নাকি হাজার-হাজার বছরের পুরনো, কিংবা নিদেনপক্ষে গুপ্তযুগের! জাহানাবাদের মাটি খুঁড়ে তেমন কিছু পাওয়া গেলেও কথা ছিল। সেখানে বড়জোর নবাব-টবাব লোকেদের কবর আর বাসভবনের ধ্বংসাবশেষ ছাড়া আর কী আছে? আমাকে সেখানে এভাবে ঠেলে দেওয়ার মানে জ্যান্ত অবস্থায় কবরে পাঠানো। অতীত–যা মরে হেজে গেছে, তার প্রতি আমার বিন্দুমাত্র সহানুভূতি নেই–জীবন্ত বর্তমানই আমার প্রিয়, কারণ আমি তার মধ্যে হাঁটছি, শ্বাস নিচ্ছি, তার কাছ থেকে পাওনা আদায় করছি। বর্তমান আমার রক্তে আছে। আর কি আমাকে জোর করে কবরে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে–গাঙ্গুলিদার এ নিশ্চয় কোনো চক্রান্ত। কারও কাছে আঁচ করে থাকবেন আমি একটা পলিটিকাল স্কুপ করতে চলেছি, তাই আমাকে সে-ক্রেডিট থেকে বঞ্চিত করে এই উদ্ভুট্টে অ্যাসাইনমেন্টে পাঠাচ্ছেন। আমি কি জানি না গাঙ্গুলিদা আমার প্রমোশনে খুশি হননি? আলবাৎ জানি। চিৎপুর রেলইয়ার্ডের ওয়াগানব্রেকারদের ব্যাপারে যে স্টোরিটা করেছিলাম, ম্যানেজিং এডিটর প্রশান্ত চ্যাটার্জির নেকনজরে পড়ার পক্ষে সেটাই যথেষ্ট এবং আমার প্রমোশনের একমাত্র কারণ ছিল সেই নেকনজর। আর গাঙ্গুলিদা কিনা চোখ নাচিয়ে বলেছিলেন, “করে দিলাম, জয়ন্ত! খাইয়ে দিও।”

কিছুক্ষণ পরে অভিমান আর হতাশাটা চলে গেল এবং যা বাকি রইল, তা রাগ। রাগ এলে নাকি আমার মুখে আগুনজ্বলা ভাব থাকে না, কঁচা উচ্ছের রস গেলার ভাবটাই ফুটে ওঠে। চিফ রিপোর্টার মধুদা কথাটা বলেছিলেন একবার। কারণ তিনি রোজ নাকি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ব্লাডসুগার কমাতে ওই বস্তুটি পান করেন। কাজেই তিনি ব্যাপারটা বোঝেন। যাই হোক, আমি গাঙ্গুলিদার মুণ্ডপাত করছিলাম। বারবার ওঁর হাত-পা বেঁধে জাহানাবাদের কবরে ঢোকাচ্ছিলাম। আর সেই সময় কেউ বলে উঠল, “কবর কারুর কারুর পক্ষে নিরাপদ জায়গাও হতে পারে, ডার্লিং!”

চমকে উঠে দেখলাম, যাদুঘরসদৃশ বিশাল ড্রয়িংরুমের কোনার দিক থেকে একটা অদ্ভুত খুরপি হাতে নিয়ে আমার ফ্রেন্ড-ফিলসফার-গাইড কর্নেল নীলাদ্রি সরকার এগিয়ে আসছেন। সাদা গোঁফ-দাড়ির মধ্যিখানে ওঁর অসম্ভব শক্তিশালী সরু-সরু দাঁতগুলো দেখা যাচ্ছে। প্রকাণ্ড দেহটিতে তখনও গার্ডেনিং উর্দি চড়ানো। সুতরাং বুঝতে পারছিলাম, ছাদের প্ল্যান্ট ওয়ার্ল্ড থেকে সদ্য অবতরণ করেছেন।

ডাইনে মোড় নিয়ে বাথরুমে অদৃশ্য হলেন। তারপর ষষ্ঠীচরণ ট্রেতে করে। কফি আর স্ন্যাক্স রেখে গেল সোফা টেবিলে। তাকে আজ একটু গম্ভীর দেখাচ্ছিল। সম্ভবত প্রভু-ভৃত্যে কিছু নিয়ে মনকষাকষি হয়ে থাকবে এবং তাতে অস্বাভাবিক কিছু নেই। দীর্ঘকাল ধরে দেখে আসছি, এ ব্যাপারটা ঘটে আসছে। তবু সেই ষষ্ঠীই বহাল আছে বা কর্নেল তার বাবামশাই’-পদেই অধিষ্ঠিত আছেন।

 “কবরকে বিপজ্জনক জায়গা মনে করা হয়। আমার বৃদ্ধ বন্ধু পুনঃপ্রবেশ করলেন। সোফার দিকে ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে আসতে আসতে বললেন, “কারণ বাইবেলে বলা হয়েছে, বিহোল্ড! হোয়েন দা ডেডস আর অ্যাওয়েক, দা এভিল আওয়ার বিগিনস। ডার্লিং, তবু কবর কোনো-কোনো জীবিত মানুষের পক্ষে ভ্রমণের জন্যও আদর্শস্থান হতে পারে। বিশেষ করে যদি তা ঐতিহাসিক গোরস্থান হয়। চিয়ার আপ, জয়ন্ত! চিয়ার আপ!”

ভীষণ অবাক হয়ে বললাম, “কী আশ্চর্য! আপনি কি থটরিডিং শিখেছেন

হাত তুলে কর্নেল বললেন, “দরকার দেখি না। আশা করি তুমি লজিক শাস্ত্রের নাম শুনে থাকবে।”

“কলেজে আমার পাঠ্য ছিল।” একমুঠো স্ন্যাক্স তুলে নিয়ে বললাম। “কিন্তু এক্ষত্রে তা অবান্তর। আমি আপনার এ ঘরে যখন ঢুকি, তখন আপনি ছাদে। তাছাড়া ঘরে ঢোকার পর আমি এমন কিছু বলিনি ষষ্ঠীকে, কিংবা বললেও আপনার পক্ষে শোনা সম্ভব ছিল না যে আমি কবর নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছি। অতএব হয় আপনি টেলিপ্যাথি নয়তো থটরিডিংয়ের সাহায্যে আমার ভাবনাটা টের পেয়েছেন।”

কর্নেল হাসিমুখে পট থেকে কফি ঢাললেন। তারপর পেয়ালায় চুমুক দিয়ে বললেন, “জয়ন্ত, প্রবাদ আছে, ময়রা নাকি সন্দেশ খায় না। অন্তত বরাবর তোমার ব্যাপারে লক্ষ্য করে আসছি যে কাগজের লোক হয়েও কাগজে যা ছাপা হয়, সে-সম্পর্কে তোমার ঔৎসুক্য কম। আজ তোমাদের এবং আরও অন্যান্য কাগজে খবর বেরিয়েছে, জাহানাবাদের ঐতিহাসিক নিজামতকেল্লা কেন্দ্রীয় প্রত্নদফতরের হাতে গেল। সুতরাং এবার সেখানে ট্যুরিস্ট ব্যুরো একটি পর্যটন ভবন তৈরি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।…ওয়েট, ওয়েট! বলতে দাও আমাকে। এই খবর থেকে আমার পক্ষেও সিদ্ধান্ত নেওয়া সোজা যে ট্যুরিস্ট দফতর এবার পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য খবরের কাগজে প্রচুর বিজ্ঞাপন দিতে থাকবেন। সেই বিজ্ঞাপনের লোভে সব কাগজই ওঁদের খুশি করার জন্য রিপোর্টার পাঠিয়ে খুব জাঁকালো রেপোর্টাজ ছাপবে। আর–”

বাধা দিয়ে বললাম, “কিন্তু কবরের চিন্তাটা কীভাবে–”

কর্নেলও বাধা দিয়ে বললেন, “ওই দেখ, ছাদ থেকে নামবার সিঁড়ি। নামবার সময় আমার চোখে পড়ল তোমার মুখে ভীষণ তিতিবিরক্ত ভাব। তারপর– আমার চোখ গেল ওই টেবিলে। ফোন ডাইরেক্টরিটা তলা থেকে ওপরে উঠে এসেছে এবং ফোনটাও উল্টোভাবে বসানো রয়েছে। সুতরাং তুমি কোথাও টেলিফোন করছিলে। তার চেয়ে বড় হ ম আমার কাছে এমন অসময়ে এসেছ।” কর্নেল ঘড়ি দেখে বললেন। “সাড়ে পাঁচটা বাজে। এখন তোমার অফিসে থাকার কথা। অথচ তুমি অফিস থেকে হন্তদন্ত আমার কাছে এসে তেলোমুখে টেলিফোন করেছে। নিশ্চয় শেয়ালদা স্টেশনে জাহানাবাদ-গামী ট্রেনের সময়গুলো জানতে চেয়েছিলে। আসলে আমার খুলির ভেতর প্রাকৃতিক কম্পিউটারটি খুব দ্রুত কাজ করে, ডার্লিং!” কর্নেল হাসতে লাগলেন। তারপর বললেন ফের, “যাই হোক, কফি জুড়িয়ে যাচ্ছে। গরম কফি মানুষের এনার্জি বাড়ায়।”

কফির পেয়ালা তুলে নিয়ে চুমুক দিয়ে বললাম, “কিন্তু কবরের কথাই “ ভাবছিলাম, তার মানে নেই!”

“আছে।” কর্নেল তার সাদা দাড়িতে হাত বুলিয়ে বললেন। “এই অ্যাসাইনমেন্টে তুমি খুশি হওনি। আর সত্যিই জাহানাবাদে অন্যান্য ঐতিহাসিক জায়গার তুলনায় কবরের সংখ্যা বেশি। নিজামতকেল্লার ভেতরই এক বিশাল কবরখানা। এমতাবস্থায় যিনি তোমাকে এই অ্যাসাইনমেন্ট দিয়েছেন, তাকে তোমার মনে-মনে কবরে পাঠানোই স্বাভাবিক। সদ্য প্রমোশনের পর সব সাংবাদিকই চাইবেন জব্বর বা চমকপ্রদ কিছু এক্সকুসিভ স্টোরি করে বুঝিয়ে দিতে যে, যোগ্য লোককেই প্রমোশন দেওয়া হয়েছে। ডার্লিং! মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা সনাতনকাল থেকে অনেকখানি ছকবন্দি। যাই হোক, তুমি কফি খেয়ে নাও। মেঘ না চাইতেই জলের মতো তুমি এসে গেছ। নইলে তোমার অফিসে একবার ফোন করব ভাবছিলাম।”

“কী ব্যাপার?”

“কাকতালীয় ঘোগ মনে হলেও ব্যাপারটা তা নয়।” কর্নেল চুরুট ধরিয়ে বললেন। “চলো, একটু ঘুরে আসা যাক। ছটায় যাব বলে কথা দিয়েছি।”

আমার বৃদ্ধ বন্ধু যখন কোনো প্রশ্নের জবাব দেন না, তখন বুঝতে পারি, উনি কোনো বিষয় নিয়ে গভীর চিন্তায় ডুবে আছে। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে শুধু জেনে নিয়েছিলাম কোথায় যেতে হবে। উনি আস্তে বলেছিলেন, “পার্ক স্ট্রিট। পার্ক স্ট্রিট।” পার্ক ট্রিট ধরে এগিয়ে মুনলাইট হোটেলের কাছে ট্রাফিক জ্যামে আটকে গেলাম। মিনিট কুড়ি লাগল জ্যাম ছাড়তে। একটু এগিয়ে গেলে কর্নেল বললেন, “বাঁদিকের রাস্তাটা।” রাস্তাটা গলি বলাই ভাল। শীতের দিনে পাঁচটা বাজতে না বাজতে সন্ধ্যার আবছায়া ঘনিয়ে এসেছে। সবখানে আলো জ্বলে উঠেছে। এই গলিটা একেবারে অন্ধকার আর নিঝুম। লোডশেডিং বলে মনে হচ্ছিল না। কারণ সব বাড়ির ভেতর আলো জ্বলছিল। সম্ভবত এই গলির স্ট্রিট ল্যাম্পগুলো বহুকাল ধরে অদৃশ্য। পুরসভা তো থেকেও নেই। একটু পরে কর্নেল গাড়ি থামাতে বললেন। বাঁদিকে একটা বাড়ির গেটের মাথায় যথেষ্ট জঙ্গল এবং তা থেকে অত্যদ্ভুত হলুদ ফুলের মতো একটু আলো জুগজুগ করছে। সেই আলোয় জীর্ণ গেটের ডানদিকে একটুকরো মার্বেল ফলকে “জাহানাবাদ প্যালেস” লেখা আছে দেখে চমকে উঠলাম।

কর্নেল বললেন, “এস।”

গেটের কাছে যেতেই যেন মন্ত্রবলে গরাদ দেওয়া প্রকাণ্ড কপাট একটু ফাঁক হল। কিন্তু কোনো দারোয়ানকে সেলাম দিতে দেখলাম না। একজন প্রৌঢ় এবং বহুব্যবহৃত স্যুট-টাইপরা ভদ্রলোক যেন অপেক্ষা করছিলেন। করমর্দন এবং অভ্যর্থনা করে আমাদের নিয়ে গেলেন। ছোট্ট একটি হলঘরের ভেতর কাঠের সিঁড়িতে জীর্ণ কার্পেট পাতা রয়েছে। দোতলার একটা ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে ভদ্রলোক একটু কাশলেন। ভেতর থেকে গম্ভীর স্বরে উর্দু ভাষায় কেউ কিছু বলল। তখন পর্দা তুলে ভদ্রলোক একটু ঝুঁকে আদাব দিলেন। তারপর আমাদের ভেতরে যেতে ইশারা করলেন।

ঘরের ভেতর গদিআঁটা ইজিচেয়ারে এক বৃদ্ধ বসে টেবিলল্যাম্পের আলোয় কী একটা বই পড়ছিলেন। কর্নেল আদাব দিলেন। কিন্তু উনি উঠে দাঁড়িয়ে করমর্দনই করলেন। কর্নেল আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। জাহানাবাদের নবাব মির্জা মোহাম্মদ বসির খানকে দেখে নবাব-সংক্রান্ত মোহ চলে গিয়েছিল। একেবারে সাধারণ মানুষের মতো চেহারা। পরনে ঢিলা পাজামা-কোর্তা, শ্যাওলা রঙের শাল জড়ানো। রোগা, সিঁড়িঙ্গে গড়নের মানুষ। গোঁফদাড়ি পরিষ্কার কামানো। নাকটা অসম্ভব খাড়া। এইরকম চেহারার মানুষ মুসলিম মহল্লায় অসংখ্য দেখেছি।

নবাবসাহেব মৃদু হেসে কর্নেলকে ইংরাজিতে বললেন, “শুনেছি আপনি কফির ভক্ত?”

“বলতে পারেন। তবে এইমাত্র কফি খেয়ে বেরিয়েছি।”

নবাবসাহেব একটু হাসলেন। “আমার কফি খাওয়া ডাক্তারের বারণ। এই সুযোগ থেকে আমাকে বঞ্চিত করবেন না। ফরিদ, যাওকফি লাকে আও। জলদি! ঔর শুন, দরওয়াজা বাহারসে বন্ধ করকে যাও।”

ফরিদসাহেব নামে সেই প্রৌঢ় ভদ্রলোক বেরিয়ে গিয়ে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করলে বুকটা ধড়াস করে উঠল। নবাবসাহেব গম্ভীর হয়ে চাপা গলায় বললেন, “এই বাড়িতে নাকগলানে স্বভাবের লোক আছে। হুট করে এসে ঢুকে পড়বে।”

কর্নেল বললেন, “তাহলে শুরু করুন, নবাবসাহেব!”

নবাবসাহেব আগের মতো চাপা গলায় বললেন, “তখন টেলিফোনে আসল কথাটা বলতে পারিনি বলেই আপনাকে এ গরিবখানায় ডেকেছিলাম কর্নেল! যাই হোক, সেই কথাটাই বলে ফেলি।”

 উনি আমার দিকে একবার তাকালে কর্নেল বললেন, “জয়ন্তের সামনে বলতে বাধা নেই। আপনি বলুন।”

নবাবসাহেব বললেন, “আমার ছোট ভাই মির্জা নাসির খাঁয়ের কথা আপনাকে বলেছি। সে গত জুন মাস থেকে পাগল হয়ে গেছে, তাও বলেছি। কিছুদিন আগে নাসির হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে যায়। গতকাল আমার বোন শামিম-আরা বেগমের চিঠি পেয়েছি। নাসিরকে নাকি সে কেল্লাবাড়ির পাঁচিলের ওপর দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতে পেয়েছ।”

“জাহানাবাদে থাকে আপনার বোন?”

“হ্যাঁ সে বিধবা। দুটি যমজ মেয়ে আছে। এখনও বিয়ে দিতে পারেনি তাদের। বুঝতেই পারছেন, সরকারি বৃত্তি বন্ধ হওয়ার পর আমাদের পরিবার কী দুর্দশায় কাল কাটাচ্ছে।” নবাবসাহেব বদ্ধ দরজার দিকে সন্দিগ্ধ দৃষ্টে তাকালেন। তারপর ফিসফিস করে বললেন, “এতদিনে আমার সন্দেহ হয়েছে, শামিম-আরার স্বামী জর্জিস খাঁকে কে খুন করেছিল–”

“খুন করা হয়েছিল?”

“হ্যাঁ। দু বছর আগে আমাদের কেল্লাবাড়ির পারিবারিক কবরখানায় তার লাশ পাওয়া যায়। তার মাথার পেছনদিকে ভোতা জিনিস দিয়ে আঘাত করা হয়েছিল। আশ্চর্য ব্যাপার, লাশটা পাওয়া যায় ভোরবেলা। জর্জিসের দুই যমজ মেয়ে কবরখানায় ফুল দিতে গিয়েছিল তাদের দাদামশাই অর্থাৎ আমার বাবার কবরে। যাই হোক, পুলিশ সেই খুনের কোনো কিনারা করতে পারেনি।”

“জর্জিসসাহেব কবরখানায় কেন গিয়েছিলেন, জানা যায়নি?”

“না। সেটাই তো অদ্ভুত লাগে। অবশ্য সে ছিল আমাদের তখনকার নিজামত ট্রাস্টের বেতনভোগী কেয়ারটেকার। কিন্তু এটুকু বোঝা গিয়েছিল, সে রাত্রে কবরখানায় ঢোকে এবং আততায়ী তাকে খুন করে পালায়।”

“আপনার কাকে সন্দেহ হয়েছে বলছিলেন?”

নবাবসাহেব আবার ফিসফিস করে বললেন, “নাসিরই হয়তো খুন করেছিল। ভগ্নীপতিকে খুন করার ধাক্কায় সে পাগল হয়ে গেছে শেষপর্যন্ত।”

“কেন তিনি ভগ্নীপতিকে খুন করবেন?”

নবাবসাহেব একটু চুপ করে থেকে বললেন, “নাসির বরাবর বাউণ্ডুলে স্বভাবের মানুষ। সে বেশিদূর লেখাপড়া শেখেনি। নেশাভাং খেত। টোটো করে বেড়াত সবসময়। জাহানাবাদে কিছুদিন দিদির কাছে, আবার কিছুদিন এখানে আমার কাছে–এই করে থাকত। খারাপ লোকেদের সঙ্গেই তার ছিল যত মেলামেশা।”

“জর্জিসসাহেব খুন হওয়ার সময় নাসির কোথায় ছিলেন?”

 “জাহানাবাদে বোনের বাড়িতে।”

“কিন্তু ভগ্নীপতিকে খুন করার কী উদ্দেশ্য থাকতে পারে বলে আপনার ধারণা?”

নবাবসাহেব করুণ হাসলেন। “সেটা খুঁজে বের করার জন্যই আপনার শরণাপন্ন হয়েছি, কর্নেল!”

“কিন্তু এতকাল পরে?”

নবাবসাহেব উঠে বন্ধ দরজার কাছে গেলেন। এতক্ষণে দেখলাম, কপাটে একটা ম্যাজিক আই’ রয়েছে। সেখানে চোখ রেখে বাইরেটা দেখে নিয়ে এসে তারপর নিজের আসনে বসলেন। বললেন, “আমার বোনের চিঠিতে একটা অদ্ভুত কথা লেখা আছে। নিজামতকেল্লার কবরখানায় ভূতপ্রেতের উপদ্রবের কথা সবাই জানে। শামিম-আরা লিখেছে, ইদানীং প্রায় প্রতি রাত্রে সে জানলা থেকে কবরখানায় কাউকে চলাফেরা করে বেড়াতে দেখে। শামিম-আরা খুব, সাহসী মেয়ে। একরাত্রে সে খিড়কি দিয়ে বেরিয়ে টর্চের আলো ফেলতেই মূর্তিটা যেন কবরে ঢুকে গেল।”

কর্নেল একটু হাসলেন। “কবরে ঢুকে গেল কীভাবে, তা লেখেননি আপনার বোন?”

“না।” নবাবসাহেব গম্ভীর হলেন আরও। “আপনি তার মুখেই সব শুনতে পাবেন। শামিম-আরা তত পর্দা মানে না। লরেটোর ছাত্রী ছিল। আমাদের পরিবারের দুর্ভাগ্যের কথা, কী আর বলব? প্রিভিপার্স বন্ধ হওয়ার পর আমরা প্রায় ফকির হয়ে গেছি। নইলে জর্জিসের সঙ্গে ওর কি বিয়ে হত? জর্জিস ছিল আমাদেরই কর্মচারী। অবশ্য সেও গ্র্যাজুয়েট ছিল। লখনউ থেকে কলকাতায় পড়তে এসে আত্মীয়তাসূত্রে আমাদের সঙ্গে চেনাজানা হয়েছিল। বিশ্বাসী এবং আপনজন হিসেবে তাকে জাহানাবাদ নিজামতকেল্লার কেয়ারটেকার পদে নিযুক্ত করা হয়।

“আপনার বোনেরও কি সন্দেহ যে তার স্বামীকে তাঁর ছোট ভাই-ই খুন করেছেন?”

নবাবসাহেব মাথা নেড়ে বললেন, “না, না। শামিম-আরা তেমন কিছু লেখেনি। ওর চিঠিতে শুধু দুটো ঘটনার উল্লেখ আছে। এক : রাতবিরেতে কবরখানায় জলজ্যান্ত ভূত দেখা। দুই ও পাঁচিলের ওপর পাগলা নাসিরকে দেখা। এই থেকেই আমার সন্দেহ কবরখানায় একটা রহস্যজনক ব্যাপার আছে।”

আমি বলে উঠলাম, “গুপ্তধন নয় তো?”

নবাবসাহেব হেসে ফেললেন। “ওসব জিনিস গল্পে উপন্যাসে থাকে। –আপনারা বোধ করি জানেন না, মুসলিমদের কবরে নগ্ন মৃতদেহ ঢাকার জন্য তিনটুকরো সাদা থান কাপড় অর্থাৎ যাকে বলা হয় কাফন, তা বাদে আর কিছু। রাখা ইসলামি শরিয়ত অনুসারে হারাম–নিষিদ্ধ। তা গহিত পাপ। আমাদের বংশের যা ইতিহাস, তাতে গুপ্তধনের অস্তিত্ব অসম্ভব নয়। তা যদি থাকেও, কবরে থাকবে না।”

কর্নেল বললেন, “মৃতদেহের হাতে আংটি বা গলার হার।” বাধা দিয়ে নবাবসাহেব বললেন, “না। সব খুলে নেওয়া হয়। যে অবস্থায় মাতৃগর্ভ থেকে মানুষ ভূমিষ্ঠ হয়, সেই অবস্থায় সে কবরে যাবে। শুধু নগ্নতাজনিত লজ্জানিবারণে ওই কাফনে তাকে ঢেকে দেওয়া হবে। নইলে মৃত ব্যক্তির অনন্ত নরক।”

এতক্ষণে ফরিদসাহেব দরজা খুলে নিজেই ট্রেতে করে কফি নিয়ে ঢুকলেন। নবাবসাহেব বললেন, “ফরিদ আমাকে ছেড়ে যায়নি। নইলে আমাকে বোনের কাছে চলে যেতে হত। আমার স্ত্রী বহু বছর আগে মারা গেছেন। দুই ছেলে বিদেশে মেম বিয়ে করে সংসার পেতেছে। তারা আর বুড়ো বাবাকে একটা চিঠিও লেখে না। এক মেয়ে। সে থাকে কুয়েতে স্বামীর সঙ্গে। বছরে একবার আসে। সেই টাকাকড়ি পাঠায়। কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে এই যে সুপ্রিম কোর্ট অব্দি মামলা লড়ে হেরে গেলাম, তার সব খরচ আমার মেয়ে নার্গিস-আরাই যুগিয়েছিল। নইলে আমার সাধ্য ছিল না। নিন, কফি খান আপনারা। ফরিদ, তুমি একটু বাইরে নজর রাখো। হারামজাদা আজ সকাল থেকে আমার ঘরের আনাচে-কানাচে ঘুরঘুর করে বেড়াচ্ছে কী মতলবে, কে জানে!”

ফরিদসাহেব বেরিয়ে গেলে কর্নেল একটু হেসে বললেন, “এই হারামজাদাটি কে?”

“বিড্ডু খাঁ। আমাদের নিজামতকেল্লার একজন সহিসের বংশধর। আমাদের কলকাতার এই বাড়িতে সে বাবুর্চির কাজকর্ম করে। নাসিরকে সে কোলেপিঠে করে মানুষ করেছিল। নাসিরের খাতিরেই তাকে বহাল রাখা হয়েছিল। নইলে ওই চোর-চোট্টা দাগাবাজকে কবে জুতো মেরে বিদায় করে দিতাম।”

“বিড্ডু কি এখনও আছে আপনার কাছে?”

নবাবসাহেব তারিয়ে তারিয়ে কফি খাচ্ছিলেন। বললেন, “বেহায়ার মতো পড়ে আছে। কবে ছাড়িয়ে দিয়েছি, যেতে চায় না। পা ধরে কান্নাকাটি করে। অগত্যা কী করব বলুন? আর ফরিদও বলল, একজন বাবুর্চি তো দরকার। বিড্ডু যখন বিনাবেতনে থাকতে চাইছে, থাক। ও অবশ্য রাঁধেও খাসা।”

কর্নেল কফিটা দ্রুত শেষ করে চুরুট ধরিয়ে বললেন, “দুবছর আগের এক হত্যারহস্যের কিনারা এতদিন পরে করতে পারব কি না জানি না। তবে এই সুযোগে ঐতিহাসিক জাহানাবাদ আমার দেখা হবে, আমার দিক থেকে সেটাই লাভ।”

নবাবসাহেব কর্নেলের হাত ধরে বললেন, “আমার বোন খুব আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে। সেজন্যই আপনার সাহায্য চেয়েছি। আপনি নিশ্চয় বুঝতে পেরেছেন এক্ষেত্রে পুলিশের কাছে যাওয়ার মতো কোনো নির্দিষ্ট অভিযোগ তার হাতে নেই। অথচ সে আশঙ্কা করছে যেন শিগগির তার জীবনে আবার সাংঘাতিক কিছু ঘটতে চলেছে।”

কর্নেল একটু অবাক হলেন। “শামিম-আরা তাই লিখেছেন বুঝি?”

“হ্যা! পাগলা নাসিরকে দেখার পর তার আতঙ্ক আরও বেড়ে গেছে।”

“নাসির তো ওঁর সহোদর ভাই! তাহলে সে-”

নবাবসাহেব জিভ কেটে ঈষৎ লজ্জিতভাবে বললেন, গুছিয়ে বলতে পারছি না আমারই দোষ। নাসির আমার আর শামিম-আরার বৈমাত্রেয় ভাই। আমার বাবার দুই স্ত্রী। নাসিরের ছোটিবেগম আর আমাদের মা ছিলেন বড়িবেগম। নাসিরের জন্মের পর তার মা মারা যান। সেইজন্যেই তো বিড্ডু তাকে কোলে পিঠে করে মানুষ করেছিল।”

 কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। একটু হেসে বললেন, “যা জানা গেল, আপাতত এই যথেষ্ট। চলি নবাবসাহেব!”

নবাবসাহেব সিঁড়ির মাথা অব্দি আমাদের এগিয়ে দিয়ে বললেন, “কোনো অসুবিধে হবে না আপনার। সে বন্দোবস্ত করেই রেখেছি।” বলে নিচে ঝুঁকে ডাকলেন, “ফরিদ! ফরিদ! কাহা হ্যায় তুম?”

সিঁড়ির নিচে থেকে সাড়া এল, “হাম ইহা নবাবসাব!”

“যো খত্ লিখকে দিয়া তুমকো, কর্নির্লসাহাবকো দে দো। ঔর উনলোগোকো গেটত পঁহছা দো।”

“জী নবাবসাব!”

হলঘরে দাঁড়িয়ে ছিলেন ফরিদসাহেব। আদাব করে কর্নেলকে খামে-আঁটা একটা চিঠি দিলেন। তারপর আমাদের গেট পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে চুপচাপ গেট বন্ধ করে চলে গেলেন।

গাড়িতে স্টার্ট দিয়েছি, হঠাৎ একটা বেঁটে মোটাসোটা ফো লোক গাড়ির পাশে এসে ঝুঁকে বলে উঠল, “সাব! শুনিয়ে সাব! শুনিয়ে!”

কর্নেল একটু হেসে বললেন, “তুমি বিড্ডু খাঁ?”

সে কপালে হাত ঠেকিয়ে আদাব দিয়ে বলল, “জী হাঁ সাব! হামি বিড্ডু আছি। একঠো বাত বলব সাব, কুছু মনে করবেন নাই।”

“না, না। বলো বিড্ডু, কী বলবে?”

“বড়া নবাবসাবের কথা বিশোয়াস করবেন না, সাব। ছোটা নবাবসাবকো উনহি দাওয়া পিলাকে পাগল বনা দিয়া স্রিফ এক তসবির কে লিয়ে।”

“তসবির?” “জী হাঁ। পিকচার সাব, পিকচার।” বলেই বিড্ডু হঠাৎ আবছা অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেল। কর্নেল ও আমি মুখ চাওয়াচাওয়ি করলাম। তারপর গিয়ার টেনে অ্যাকসিলেটারে পায়ের চাপ দিলাম। পার্ক স্ট্রিটের মোড়ে আড়চোখে দেখালম গোয়েন্দাপ্রবর চোখ বন্ধ করে আছেন। দাঁতের ফাঁকে জ্বলন্ত চুরুট।…