বিগ্রহ রহস্য ১

বিগ্রহ রহস্য

০১.

কে ওখানে?

আনমনা মানুষের গলায় প্রশ্ন করে তাকিয়ে রইলেন দীনগোপাল।

দৃষ্টি রাস্তার ডানদিকে, যেখানে বৃক্ষলতার ঘন বুনোট। থমকে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন, হাতে ছড়ি।

নীতাও দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে আস্তে আস্তে বলল—কেউ না, আসুন।

দীনগোপাল পা বাড়িয়ে একটু হাসবার চেষ্টা করলেন। কী একটা ঘটছে, ঠিক বুঝতে পারছি না। হয়তো হ্যালুসিনেশান। অথচ

থেমে গেলে নীতা বলল–কী?

–অথচ তুই নিজেও তো পরশু বিকেলে দেখে এসে বললি, কেউ দাঁড়িয়ে ছিল। ঘাসগুলো সবে খাড়া হচ্ছিল। দীনগোপালের গলায় আরও অন্যমনস্কতা টের পাচ্ছিল নীতা। একটু পরে ফের বললেন–আমার বয়স হয়েছে। একটা চোখে ছানি। কিন্তু তুই-কথা কেড়ে নীতা বলল-কুকুরটুকুর হবে। ঘাসগুলো সোজা হচ্ছে দেখেছিলাম। তার মানে এই নয় যে, কোনও মানুষ এসে দাঁড়িয়ে ছিল!

–কিন্তু আমি মানুষই দেখেছিলাম।

নীতা একটু হাসল।–এখনও বুঝি মানুষ দেখলেন? দীনগোপাল ঘুরে সেই জায়গাটার দিকে ছড়ি তুলে বললেন, মানুষই মনে হলো।

–কিন্তু আমি কাউকে দেখতে পেলাম না তো?

একটু বিরক্ত হয়ে বললেন দীনগোপাল–তাহলে হ্যালুসিনেশান।

নীতা আর কথা বাড়াল না। হেমন্তের মাঝামাঝি এলাকার আবহাওয়ায় বেশ হিম পড়ে গেছে। এই শেষবেলায় হিমটা জোরাল। কলকাতার সবচেয়ে শীতের কোনও রাতের মতো। দুধারে রুক্ষ অসমতল মাঠ, কিছু ঝোঁপঝাড় আর উঁচু গাছে জটলা। চাষবাসের চিহ্ন কদাচিৎ। তবে বসতির দিকটায় একটা ক্যানেল এবং কিছুটা সমতল মাটি উর্বরতা এনেছে। আধ কিলোমিটার দূরে এখনই কুয়াশার ভেতর বাতি জ্বলে উঠল। অথচ পেছনে পশ্চিমে দূরে টিলার মাথায় ডুবুডুবু সূর্যের লালচে ছটা। আদিবাসী মেয়ে-পুরুষের একটা দল পাশ কাটিয়ে বোবা চলে গেল। খাটতে গিয়েছিল সরডিহিতে।

একটা উঁচু ডাঙ্গাজমির ওপর দীনগোপালের বাড়ি। পুরনো লালরঙের দোতলা বাড়ি। পাঁচিল-ঘেরা চৌহদ্দি। এখানে-সেখানে ধসে গেছে। কাঠ দিয়ে সেখানে বেড়া দেওয়া হয়েছে। পুরনো ফুলফলের গাছপালার চেহারায় ক্রমশ আদিম ছাপ ঘন হয়ে উঠেছে। পোড়ো হানাবাড়ি দেখায় নীচের রাস্তা থেকে।

ছড়ির ডগায় চাপ দিয়ে রাস্তা থেকে গেটে উঠছিলেম দীনপোপাল। একটু আগের মতো ফের বলে উঠলেন–কে ওখানে?

নীতা রাগ করে বলল–ভূত!

 দীনগোপাল কিছু বলার আগেই সাড়া এল–আমি জ্যাঠামশাই! দীপু।

 নীতা ছটফটে ভঙ্গিতে এগিয়ে গেল।দীপুদা! কখন এলে? বউদি আসেনি?

দীপ্তেন্দু দীনগোপালের পা ছুঁয়ে প্রণাম করার পর বললসবর কাছে শুনলাম বেড়াতে বেরিয়েছে। তাই আপনাদের খুঁজতে যাচ্ছিলাম। তারপর নীতার উদ্দেশে বলল–তোর বউদি আসবে কী? সামনে স্কুলের পরীক্ষা। দিদিমণিদের এখন সিরিয়াস অবস্থা। তা তোর খবর কী বল?

দীনগোপাল দীপ্তেন্দুর কাঁধে হাত রেখে বাড়ি ঢুকলেন। নীতা বলল–আমার কোনও নতুন খবর নেই–যথাপূর্ব।

কী যেন একটা চাকরি করছিলি কোথায়?

করছি। মরবার ইচ্ছে নেই যখন, তখন বেঁচে থাকতে হলে একটা কিছু করতে হবে।

দীপ্তেন্দু হেসে উঠল। দীনগোপাল বললেন–একটা খবর দিয়ে এলে স্টেশনে নবকে পাঠাতাম। তোমরা সব্বাই আমাকে ভুলে গেছ। একটা চিঠি পর্যন্ত না। কাজেই ধরে নিচ্ছি, এরিয়ায় কোম্পানির কোনও কাজে এসেছ।

দীপ্তেন্দু বলল–মোটেও না জ্যাঠামশাই! বিশ্বাস করুন, অনেকদিন থেকে ভাবছিলাম আসব–তো সময় করাই কঠিন।

দীনগোপাল বলবেননীতুও একই কৈফিয়ত দিয়েছে। যাই হোক, তোমরা এসেছ। আমার খুবই ভাল লাগছে। আগের মতো আর যখন-তখন কলকাতা ছুটতে পারি না। চোখে ছানি। শরীরটাওকে ওখানে?

হঠাৎ এমন গলায় কথাটা বলে উঠলেন, প্রথম নীতা এসে যে চমক; খাওয়া তীব্র চিৎকার শুনেছিল, সেই রকম। দীপ্তেন্দু ভীষণ চমকে উঠেছিল, নীতার মতোই। কিছু বলতে যাচ্ছিল, দীনগোপাল নিজেই ফের আস্তে বললেন– কিছু না।

দীপ্তেন্দু নীতার দিকে তাকালে নীতা চোখ টিপল। দীপ্তেন্দুর দৃষ্টিতে বিস্ময় ছিল। বেড়ে গেল। দীনগোপাল লনে হাঁটতে হাঁটতে বললেন ফের–ও মাসে শান্ত চিঠি লিখেছিল। কিন্তু ঠিকানা ছিল না। অবিশ্যি ওর তো বরাবর এরকম। ভবঘুরে স্বভাব হলে যা হয়।

দীপ্তেন্দু বলল শান্তর সঙ্গে সেদিন দেখা হয়েছিল। রাস্তায়।

দীনগোপাল তার কথায় কান দিলেন না।. বললেন–তুমি তো মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভ?

–হ্যাঁ, কেন জ্যাঠামশাই?

–ওষুধপত্তরের খবরাখবর তুমি রাখো। দীনগোপাল দাঁড়িয়ে গেলেন। বিনা অপারেশনে ছানি সারানোর কোনও ওষুধ নেই?

দীপ্তেন্দু হাসল।–ও নিয়ে ভাববেন না। আমি ব্যবস্থা করে দেব’খন। বলুন কবে যাচ্ছেন?

দীনগোপাল আস্তে বললেন–এখানকার ডাক্তার বলেছে, এখনও ম্যাচিওর করেনি। বুঝি না! এক হোমিওপ্যাথকে দেখলাম কিছুদিন। সে আবার বলে, ছানি-টানি নয়। ঠাণ্ডা লেগে ইনফেকশান। শেষে–কে ওখানে?

দীপ্তেন্দু আবার চমকে উঠেছিল। কিছু বলতে যাচ্ছিল, নীতার ইশারায় চুপ করল। দীনগোপাল বাঁদিকে ঘুরে লনের ওধারে ভাঙা পাঁচিলের দিকে তাকিয়ে আছেন। এই সময় বাড়ির আলোগুলি জ্বলে উঠল। দীনগোপাল সামনে বারান্দার সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেলেন। ডাকলেননব!

আজ্ঞে! বারান্দা থেকে সাড়া দিল নব।

–চা। দীনগোপাল বারান্দায় উঠে বললেন–আর ইয়ে, দীপুর থাকার জন্য পুবের ঘরটা খুলে দে।

নব বলল–দিয়েছি। দাদাবাবু এলে তো ওই ঘরেই থাকেন।

ডাইনে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেলেন দীনগোপাল। আমার চা ওপরে পাঠিয়ে দে। আর দীপু, তোমরা গল্পটল্প করবে তো করো কিছুক্ষণ।

ওপরে-নিচে ছ’খানা ঘর। নিচের মধ্যিখানের ঘরটা বড় এবং সেটাই সাবেকি ড্রইংরুম। ভেতরে ঢুকে বাঁদিকের ঘরে গিয়ে ঢুকল দীপ্তেন্দু ও নীতা। দীপ্তেন্দু খাটে বসে সিগারেট জ্বালাল। নীতা একটু তফাতে চেয়ারে বসে বলল-হঠাৎ চলে এলে যে!

–আর তুই?

–আমিও অবিশ্যি তাই। নীতা আঙুল মটকাতে থাকল। তবে বিনি খরচায় সাইট-সিইং। একঘেয়েমি দূর করা। অনেক কৈফিয়ত দিতে পারি। তবে

দীপ্তেন্দু ধোঁয়ার রিং পাকিয়ে রিংটা দেখতে দেখতে বলল–একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে, জানিস?

নীতা একটু চমকে উঠল কী?

দীপ্তেন্দু খুব আস্তে বলল কাল বিকেলে তোর বউদি স্কুল থেকে বেরিয়ে বাসস্টপে দাঁড়িয়ে ছিল। সেই সময় একটা লোক ওকে জিগ্যেস করেছে, ও আমার স্ত্রী কি না। তারপর বলেছে, আপনার স্বামীকে বলবেন, সরডিহিতে ওঁর যে জ্যাঠামশাই থাকেন, তাঁর সাংঘাতিক বিপদ ঘটতে চলেছে। তোর বউদিকে তো জানিস। বাড়ি ফিরে আমাকে প্রায় ঠেলে বের করে দিল। এক্ষুনি গিয়ে দেখ কী ব্যাপার।

নীতা নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে শুনছিল। শ্বাস ছেড়ে বলল–আশ্চর্য! আমারও একই ব্যাপার।

-বল্।

বাসস্টপে একটা লোক—

 বলল সরডিহিতে জ্যাঠামশায়ের বিপদ?

–হুঁ। নীতা আনমনে বলল। লোকটার মুখে দাড়ি ছিল। আর –

চোখে সানগ্লাস?

-তাই। আমি ওকে চার্জ করতে যাচ্ছি, হঠাৎ একটা বাস এসে পড়তেই লোকটা সেই বাসে উঠে নিপাত্তা হয়ে গেল। তাছাড়া বাসস্টপের জায়গাটায় আলো ছিল না। ফিসফিসিয়ে কথাটা বলেই কেটে পড়েছিল।

দীপ্তেন্দু একটু চুপ করে থাকার পর বলল–তুই জ্যাঠামশাইকে একথা বলেছিস?

না। আমি এসেছি গত পরশু। বলল-বলব করে দুটো দিন কেটে গেল। আসলে জ্যাঠামশাইকে তো জানো। আনপ্রেডিক্টেবল ম্যান। কীভাবে রিঅ্যাক্ট করবেন, কে জানে। কিন্তু আমি আসার পর

নীতা থেমে গেল। নব ট্রেতে চায়ের পট আর কাপ নিয়ে ঘরে ঢুকল। বড় প্লেটে কিছু চানাচুর, বিস্কুট আর কয়েকটা সন্দেশ। সে কথা বলে কম। টেবিলে ট্রে রেখে বেরিয়ে গেল। দীপ্তেন্দু বলল, হুঁ বল্।

নীতা বলল, ব্যাপারটা তুমিও লক্ষ্য করেছ একটু আগে। জ্যাঠামশাই যখন তখন ‘কে ওখানে’ বলে উঠছেন। পরশু বিকেলে আমি আসার একটু পরে পাঁচিলের কাছে একটা ঝোপের দিকে তাকিয়ে জ্যাঠামশাই চেঁচিয়ে উঠেছিলেন কে ওখানে? আমি তখনই দৌড়ে গেলাম। কাউকে দেখতে পেলাম না! কিন্তু একখানে লক্ষ্য করলাম ঘাসগুলো সবে সোজা হচ্ছে। তার মানে সত্যিই কেউ ওখানে ছিল। ফিরে গিয়ে বললাম, শেয়াল বা কুকুরটুকুরও হতে পারে। জ্যাঠামশাই নিজেও অবিশ্যি বলেছেন ‘হ্যালুসিনেশান’। একটা চোখে ছানির জন্য নাকি ভুল দেখেছেন।

দীপ্তেন্দু একমুঠো চানাচুর তুলে নিয়ে বলল–কিছু বোঝা যাচ্ছে না। তবে আমার মনে হয়, বাসস্টপের লোকটার কথা ওঁকে বলা দরকার। চা খেয়ে নে। তারপর চল্‌, দুজনে গিয়ে বলি।

এই সময় বাইরে কাছাকাছি গাড়ির প্রি-প্রি এবং গরগর শব্দ হলো। নীতা উঠে গিয়ে উত্তরের জানালাটা খুলে দিলে একঝলক তীব্র আলো এসে ঢুকল। দীপ্তেন্দুও উঠে দেখতে গেল।

নব গেট খুলে দিলে একটা জিপ ঢুকল প্রাঙ্গণে! নীতা ব: অরুদা! সঙ্গে বউদিও এসেছে।

–অরুণ! বলে বেরিয়ে গেল দীপ্তেন্দু।

অরুণ ডাকছিল–জ্যাঠামশাই! জ্যাঠামশাই!

ওপরের ঘরের জানালা থেকে দীনোপাল সাড়া দিলেন। অরুণ হইহই করে উঠল। দীপু! আরে নীতা যে! কী অবাক, কী অবাক!

অরুণের বউ ঝুমা এসে নীতাকে জড়িয়ে ধরল। ইশ! কত্তোদিন পরে তোমার সঙ্গে দেখা হলো!

নীতা বলল তুমি বড্ড বেশি মুটিয়ে গেছ বউদি!

ঝুমা দীপ্তেন্দুর দিকে চোখের ঝিলিক তুলে বলল–আশাকরি, দীপুর বউয়ের টোয়েন্টি প্যার্সেন্টের বেশি নয়। দেখে তো প্রথমে চিনতেই পারিনি। দীপু ওষুধের ব্যাপারটা ভাল বোঝে! নিশ্চয় কোনও ট্যাবলেট খাওয়ায়, যাতে বেচারা আরও মোটা হতে হতে শেষে ঘরবন্দি হয়ে ওঠে এবং দীপুর পরকীয়া প্রেমের–সরি! ঝুমা জিভ কেটে থেমে গেল।

দীনগোপাল নেমে এসেছিলেন। অরুণ ও ঝুমা প্রণাম করলে বললেন– এবার শান্তটা এসে পড়লে দারুণ হয়! তিনি হাসছিলেন। মুখে খুশির ঝলমলানি। তারপর হাঁকলেন–নব!

–আজ্ঞে!

–এদের ওই ঘরটা খুলে দে। দ্যাখ, পরিষ্কার আছে নাকি। বিছানা বদলে দিবি। আর ইয়ে–আগে চা-টায়ের ব্যবস্থা। অরু, তোরা দীপুর ঘরে গিয়ে বসতে পারিস ততক্ষণ। কিছুক্ষণ পরে তোদের নিয়ে বসব।

দীনগোপাল আবার ওপরে চলে গেলেন। নব বিশাল লন পেরিয়ে গেটে তালা বন্ধ করতে গেল। সওয়া পাঁচটাতেই সন্ধ্যা ঘন হয়ে উঠেছে। বারান্দায় সিঁড়ির নিচে অরুণের গাড়িটার ওপর হলুদ আলোর ঝলক হিংস্র দেখাচ্ছে যেন। দীপ্তেন্দুর ঘরে এসে অরুণ প্রথমে সন্দেশগুলোকে গিলতে শুরু করল। তার ফাঁকে নীতাকে হুকুমও দিল–পটে আশা করি এখনও যথেষ্ট চা আছে। মেয়েদের চা খেতে নেই। দীপু আর আমি ভাগ করে খাব। তারপর ফের চা এলে আগে ফের দুজনে, বাকিটা তোমরা দুজনে। কেমন? আর এক একমাত্র লজিক হলো, পুরুষেরা সব কিছুতে আগে এবং মেয়েরা পরে। সনাতন শাস্ত্রীয় প্রথা।

ঝুমা চোখ পাকিয়ে বলল–ইউ টক টু ম্যাচ। থামো তো। সব সময় খালি–

অরুণ বলল–ওক্কে। কথা কম, কাজ বেশি।

সে খাবারগুলো একা শেষ করছিল। নীতা তার হাতে চায়ের কাপ ধরিয়ে দিয়ে আস্তে বলল–তোমাদেরও কি বাসস্টপে একটা লোক–

অরুণ প্রায় চেঁচিয়ে উঠল–ঝুমা! এবার বোঝ তাহলে। বাসস্টপে একটা লোক। দ্যাটস রাইট, নীতা!

দীপ্তেন্দু প্রথমে অরুণের দিকে, তারপর ঝুমার দিকে তাকাল। দৃষ্টিতে বিস্ময় ঝিকমিক করছিল। নীতা কথাটা ঠাট্টা করে বলেছিল! কিন্তু এবার সে গম্ভীর হয়ে গেল। দীপ্তেন্দুর হাতে চা দিয়ে বলল–মনে হচ্ছে গোটা ব্যাপারটা একটা হোক্স। শান্তদার কাণ্ড।

ঝুমা বলল–সেটা ওকে বোঝাও। সবতাতেই হইহই খালি।

অরুণ খাটে বসে বলল–হোক্স হোক আর ফোক্স হোক, এমন একটা চমৎকার জার্নি আর এক্সকার্সানের জন্য লোকটাকে ধন্যবাদ দেওয়া উচিত। সরডিহি এলে, বিলিভ মি, নতুন করে ভাইটালিটি পাই। ঝুমা ভিটামিনের কথা বলছিল। সরডিহি আস্ত ভিটামিন! এ বি সি ডি ই

তাকে থামিয়ে নীতা বলল বাসস্টপের লোকটার কথা বলল।

কথা কম, কাজ বেশি। অরুণ একই মেজাজে বলল।বাসস্টপে একটা দেড়েল লোক, চোখে কালো চশমা। সে কাছে এসে ফিসফিসিয়ে বলল, গো অ্যাট ওয়ান্স টু সরডিহি। ইওর জ্যাঠামশাই ইজ ইন ডেঞ্জার। তারপর হাওয়া!

দীপ্তেন্দু বলল, আরও একটু আছে। নীতা তুই বল্।

নীতা একটু হাসল।–এটা অবিশ্যি জ্যাঠামশাইয়ের নতুন বাতিক হতেও পারে। সবসময় দুয়ে-দুয়ে যোগ করে চার হওয়ার মতো ব্যাপার ঘটে না।

অরুণ বলল-গো অন!

–আসা অব্দি দেখছি, জ্যাঠামশাই খালি কে ওখানে!’ বলে চমকে উঠছেন। নীতা গলার স্বর নামিয়ে বলল–শেষে নিজেই বলছেন হ্যালুসিনেশান। আমারও তাই মনে হচ্ছে। চোখের গণ্ডগোলের জন্য ভুলভাল দেখছেন।

দীপ্তেন্দু বলল–কিন্তু তুই বললি, ঘাসগুলো–

অরুণ দ্রুত বলে উঠল–ঘাসগুলো! ঝুমা তোমাকে বলছিলাম সরডিহিতে নেচার কথা বলে। নেচার স্পিকস টু ম্যান। ঘাস ইজ আ পার্ট অব নেচার। সো ঘাস স্পিকস টু ম্যান!

ঝুমা চোখ পাকিয়ে তাকালে সে থেমে গেল। নীতা জ্যাঠামশাইয়ের চিৎকার এবং পাঁচিলের কাছে ঘাসগুলোর সোজা হওয়ার ঘটনাটি এবার একটু রহস্য। মিশিয়ে বর্ণনা করল। শোনার পর অরুণ মন্তব্য করল–জ্যাঠামশাইকে একটা অ্যালসেশিয়ান পোর কথা বলব।

নব আবার চা এবং কিছু খাবার আনল। সে চলে যাচ্ছে, এমন সময় অরুণ তাকে ডাকলনব, শোনো!

নব একগাল হেসে বলল–মুরগির মাংস খাবেন তো? সে ব্যবস্থা করেই রেখেছি।

ধুস! অরুণ হাসল। কী বলব না শুনেই মুরগি ছেড়ে দিল।

 ঝুমা বলল–এসেই তো মুরগির পালে হানা দাও। ওর দোষ, কী?

অরুণ সায় দেবার ভঙ্গি করে বলল–দিই। কারণ সরডিহির মুরগি অতি সুস্বাদু। তবে নবকে আমি এখন অন্য কিছু বলতে চাই। প্লিজ ডোন্ট ইন্টারফিয়ার। আচ্ছা, নব!

নব বিনীতভাবে বললবলুন দাদাবাবু!

ইদানীং তোমার কর্তাবাবু, মানে আমাদের জ্যাঠামশাই নাকি দিন দুপুরেও ভূত দেখতে পাচ্ছেন?

–আজ্ঞে। নব সায় দিয়ে বলল-যখন তখন। বুঝলেন দাদাবাবু? যখন তখন খালি কাউকে দেখছেন। আর এদিকে আমার হয়েছে যত জ্বালা। সব ফেলে বাড়ির চার তল্লাট খুঁজে হন্যে হচ্ছি। শেষে দিদি আসায় একটু হুলুস্থুলু থেমেছে মনে হচ্ছে।

দীপ্তেন্দু বলল–থেমেছে কোথায়?

নব একটু হাসল। তা অনেকটা থেমেছে, আজ্ঞে। চাঁচামেচি কমেছে। অন্তত রাতবিরেতে আর গণ্ডগোল করছেন না।

অরুণ বলল কতদিন থেকে ভূত দেখছেন জ্যাঠামশাই?

নব একটু ভেবে এবং হিসেব করে বলল–তা প্রায় সপ্তাটাক হবে। দুপুর রাত্তিরে প্রথম হুলুস্থুলুকে ওখানে, কে ওখানে’ করে চ্যাঁচামেচি। টর্চ আর বল্লম নিয়ে বেরুলাম। বস্তি থেকে লোকেরাও দৌড়ে এল। কিন্তু কোথায় কী? শেষে বাবুমশাইকে বললাম, থানায় খবর দিয়ে রাখা ভাল। তখন বললেন, আমারই চোখের ভুল। চোখে ছানি পড়লে নাকি এমন হয়।…

নব চলে গেলে নীতা বলল কিন্তু বাসস্টপের ব্যাপারটার ব্যাখ্যা কী?

ঝুমা বলল, তুমিই তো বললে, শান্ত সবাইকে নিয়ে একটা জোক করছে। হয়তো।

অরুণ চোখ বুজে বলল–গো অন বেবি! এক্সপ্লেন!

 ঝুমা মুখ টিপে হাসল–দেখবে, কালই শান্ত এসে পড়বে। আসলে ও আমাদের সবাইকে এখানে জড়ো করতে চাইছে।

নীতা ভুরু কুঁচকে বলল–কিন্তু কেন?

–অনেকদিন একসঙ্গে সবাই মিলে সরডিহিতে হইহুল্লোড় করতে আসা হচ্ছে না, তাই।

দীপ্তেন্দু বলল–ঠিক আছে। কিন্তু বাসস্টপের লোকটা কে?

–হয়তো ওর কোনো বন্ধু। নীতা রহস্য ফাঁস করার ভঙ্গিতে বলল। শান্তদাকে তো চেনো। ওর মাথায় অদ্ভুত অদ্ভুত প্ল্যান গজায়।…

এবার পরিবেশ হাল্কা হয়ে এসেছিল। ওরা চা খেতে খেতে নানা ব্যাপারে কথাবার্তা বলতে থাকল। কিছুক্ষণ পরে নব এসে খবর দিল কর্তাবাবু সবাইকে ওপরের ঘরে ডাকছেন। ওরা দীনগোপালের ঘরে গেল।

দোতালায় পূর্বদিকের ঘরটাতে দীনগোপাল থাকেন। ঘরটা খুবই অগোছাল। একটা সেকেলে প্রকাণ্ড খাট। তার ওপর বইপত্তর, আরও টুকিটাকি জিনিস। একটা স্যুটকেস পর্যন্ত। দেয়াল ঘেঁষে কয়েকটা কাঠ আর স্টিলের আলমারি। কোনার দিকে টেবিল এবং একটা গদি-আঁটা চেয়ার। দেয়ালে বেরঙা কয়েকটা ফোটো আর বিলিতি পেন্টিং। একটা সেকেলে ড্রেসিং টেবিলও আছে। নব কয়েকটা হাল্কা বেতের চেয়ার এনে দিল। দীনগোপাল গম্ভীর মুখে খাটে উঁই করা বালিশে হেলান দিয়ে বসে ছিলেন।  সবাই বসলে দীনগোপাল বললেন–তোমরা এসেছে, আমার খুব ভাল। লাগছে। কিন্তু একটা ব্যাপারে আমার একটু খটকা বেধেছে। সেটা হলো, তোমরা যে যখনই এসেছে, আগে খবর দিয়েছ। না, কেউ কেউ খবর না দিয়েও অবিশ্যি এসেছ। কিন্তু এভাবে প্রায় একই সঙ্গে এবং খবর না দিয়ে এসে পড়ার মধ্যে কী যেন একটা লিংক আছে।

অরুণ মুচকি হেসে বলল–আছে। এতক্ষণ আমরা সেই নিয়েই আলোচনা করছিলাম।

দীনগোপাল সোজা হয়ে বসে বললেন কী লিং? কেউ কি তোমাদের খবর দিয়েছে আমি মৃত্যুশয্যায়?

কথাটার মধ্যে কিছু রূঢ়তা ছিল। তাই পরস্পর মুখ তাকাতাকি করল ওরা। তারপর নীতা বলল–দোষটা আমারই, জ্যাঠামশাই! এসেই আপনাকে কথাটা বলা উচিত ছিল। কিন্তু বলিনি!

অরুণ ঝটপট বলল–আঃ! এত লুকোচুরির কী আছে? আমি বলছি জ্যাঠামশাই! পুরো ব্যাপারটা শান্তর জোক।

দীনগোপাল বিরক্ত মুখে বললেন–শান্ত বলেছে আমি মৃত্যুশয্যায়?

 জিভ কেটে দীপ্তেন্দু বলল–ছি, ছি! এ কী বলছেন জ্যাঠামশাই! আমরা কি কেউ আপনার প্রপার্টির লোভে

তাকে থামিয়ে অরুণ বলল–তুমি চুপ করো তো দীপু! জ্যাঠামশাই, শান্তকে তো জানেনবরাবর এরকম জোক করে। এবার করেছে কী, ওর এক বন্ধুকে দিয়ে আমাদের প্রত্যেককে খবর দিয়েছে, তোমার জ্যাঠামশাইয়ের খুব বিপদ। হি ইজ ইন ডেঞ্জার। গো অ্যান্ড প্রোটেক্ট হিম।

দীনগোপাল কান খাড়া করে শুনছিলেন। বললেন–আমার বিপদ?

— আজ্ঞে হ্যাঁ।

–কী বিপদ?

অরুণ একটু ইতস্তত করে বলল–সেটা তো বলেনি! কিন্তু এসে নীতার মুখে যা শুনলাম, তাতে মনে হলো, সত্যি যেন কী ঘটতে চলেছে। অবশ্যি আপনার চোখের অসুখ হয়েছে শুনলাম। নিজেও নাকি হ্যালুসিনেশান দেখার কথা বলেছেন।

দীনগোপাল হাসবার চেষ্টা করে বললেন–তাহলে তোমরা আমাকে প্রোটেকশান দিতে এসেছ?

দীপ্তেন্দু বলল না। মানে, অরুণ তো বলল, ব্যাপারটা শান্তর জোক। আলোচনা করে আমরা সিদ্ধান্তে এসেছি, শান্তর শিগগির এসে পড়ার সম্ভাবনা আছে। আসলে অনেকদিন আমরা একসঙ্গে সরডিহিতে এসে হইহল্লা করিনি।

হাত তুলে তাকে থামিয়ে দীনগোপাল বললেন বুঝতে পেরেছি।

অরুণ বলল–কিন্তু এবার আপনার ওই হ্যালুসিনেশান দেখার ব্যাপারটা একটু ক্লিয়ার হলে ভাল হয়, জ্যাঠামশাই!

দীনগোপাল একটু চুপ করে থাকার পর বলেলন–চোখের অসুখের জন্য কি না জানি না। কিছুদিন থেকে হঠাৎ হঠাৎ এটা ঘটছে। ঝোঁপজঙ্গল বা গাছপালার আড়ালে কাউকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখছি।

–চেহারার ডেসক্রিপশান দিন। অরুণ গম্ভীর চালে বলল।

 হাসলেন দীনগোপাল। কী ডেসক্রিপশান দেব? নিছক ছায়ামূর্তি।

–আহা, মানুষ তো?

–হ্যাঁ। মানুষের মতোই। কিন্তু আবছা চেহারা। আমি কিছু বলতেই অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। নীতাকে জিগ্যেস করো।

দীপ্তেন্দু বলল নীতা বলেছে। ঘাসে কেউ দাঁড়িয়েছিল। জন্তুজানোয়ার হওয়াই সম্ভব।

দীনগোপাল গম্ভীর মুখে বললেন কিন্তু আমি সেখানে আবছা মানুষের মূর্তিই দেখেছিলাম।

নীতা জোর দিয়ে বলল–মানুষ হলে পালাবে কোন পথে? পাঁচিলের ভাঙা জায়গাগুলোয় তো কাঠের শক্ত বেড়া। বড়জোর একটা শেয়াল বা কুকুর, তাও অনেক কষ্টে গলে যেতে পারে।

দীনগোপাল অন্যমনস্কভাবে খাটের কোনার দিকে জানালায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। তারপরই দ্রুত ঘুরে চেঁচিয়ে উঠলেন–কে ওখানে?

আচমকা এই চেঁচানিতে সবাই প্রথমে হকচকিয়ে উঠছিল। তারপর অরুণ একলাফে বাইরে বারান্দায় চলে গেল। ওদিকটা দক্ষিণ এবং বারান্দার মাথায় একটা চল্লিশ ওয়াটের বাল্ব জ্বলছে। আবছা হলুদ খানকটা আলো নিচে গিয়ে পড়েছে। ঝোঁপঝাড়, ঘাসে ঢাকা মাটি। সে হন্তদন্ত হয়ে সিঁড়ি দিয়ে নিচে চলে গেল। তাকে অনুসরণ করল দীপ্তেন্দু। দীনগোপাল বললেন হ্যালুসিনেশান! কিন্তু ওরা গ্রাহ্য করল না। ঝুমা উত্তেজিত ভাবে বারান্দায় গেল। তার পেছনে নীতা। দুজনেই দৃষ্টি তীক্ষ্ণ করে নিচের দিকে তাকিয়ে রইল।…

একটু পরে নিচে টর্চের আলো ঝলসে উঠল। অরুণের গলা শোনা গেল– দীপু তুমি ওদিকটায় যাও।

নবরও সাড়া পাওয়া গেল–কিছু না দাদাবাবু! খামোকা ছুটোছুটি করে লাভ নেই।

অরুণ বলল-শাট আপ! কাম অন উইথ ইওর বল্লম! হাথিয়ার লে আও জলদি!

দীপ্তেন্দুর হাতেও টর্চ। সে পূর্বদিক ঘুরে আলো ফেলতে ফেলতে উত্তরে গেটের দিকে যাচ্ছিল। সেই সময় বাড়ির পশ্চিমদিক থেকে অরুণের চিৎকার ভেসে এল-দীপু! দীপু! ধরেছি ধরে ফেলেছি ব্যাটাকে।

দীপ্তেন্দু দৌড়ে সেদিকে চলে গেল। নব একটা বল্লম হাতে বেরুল এতক্ষণে।

টর্চের আলোয় দীপ্তেন্দু হতভম্ব হয়ে দেখল, অরুণকে ধরাশায়ী করে তার ওপর বসে আছে গাদাগোব্দা প্রকাণ্ড একটা গুফো লোক। পরনে প্যান্ট, গলাবন্ধ। কোট, গলায় মাফলার জড়ানো। দীপ্তেন্দু থমকে দাঁড়িয়ে গেল।

নব বল্লম তাক করেছিল। সেও থেমে গেছে।

 দীপ্তেন্দু হো হো করে হেসে ফেলল।–কী অদ্ভুত কাণ্ড!

–অদ্ভুত তো বটেই! বলে গুঁফো লোকটি উঠে দাঁড়ালেন। হতভাগাকে বারবার বলছি, হাতে টর্চ–ভাল করে দ্যাখ কে আমি। কথায় কান করে না। অ্যাই অরুণ! ওঠ! নাকি ভিরমি খেলি?

দীপ্তেন্দু বলল–মামাবাবু, একটা কাণ্ড করলেন বটে!

–আমি করলাম, না অরুণ করল, তাই দ্যাখ!

 অরুণ পিটপিট করে তাকাচ্ছিল। উঠে বসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল কোনও মানে হয়?

–হয়। তোর মাথাটা বরাবর মোটা। নে–ওঠ!

অরুণ উঠে দাঁড়িয়ে বলল–সদর গেট রয়েছে। দিব্যি সেখান দিয়ে আসতে পারতেন! খামোকা আমাকে হ্যারাস করার জন্য লুকোচুরি খেলা। বরাবর আপনার এই উদ্ভুটে কারবার।

দীপ্তেন্দু হাসতে হাসতে বলল–আপনি পাঁচিল ডিঙিয়ে ঢুকেছিলেন নাকি? পারলেন?

গুফো ভদ্রলোক বললেন–পলিটিকাল লাইফে জেলের পাঁচিল টপকে পালিয়ে নিউজ হয়েছিলাম, ডোন্ট ফরগেট দ্যাট। দীনুদার বাড়ির পাঁচিল না আঁচিল!

তারপর অরুণের কাঁধে হাত রেখে মুচকি হাসলেন।–অনেককাল আগে জুডো শিখেছিলাম। দেখা গেল, ভুলিনি। আয়, দীনুদা কী অবস্থায় আছে দেখি। ওর বিপদের খবর পেয়েই তো আসা। আমার স্বভাব তো জানিস!

অরুণ গুম হয়ে বলল–জানি! গোয়েন্দাগিরি। তা প্রাইভেট ডিটেকটিভ এজেন্সি খুলে বসলেই পারেন!

‘মামাবাবু’ প্রভাতরঞ্জন পা বাড়িয়ে বললেন, আমার পুরো প্ল্যানটা তুই ভেস্তে দিলি। ভেবেছিলাম কয়েকটা রাত্তির চুপিচুপি এসে ঘাপটি পেতে বসে থাকব এবং দীনুদার, ব্যাপারটার একটা হেস্তনেস্ত করে ফেলব। হলো না। এদিক যে হোটেলে উঠেছি, সেখানে রাত্তিরে আজ পাঁঠার ঝোলের খবর আছে। জানিস তো, আমি ভয়ংকর আমিষাশী রাক্ষস।

দীপ্তেন্দু বলল–আচ্ছা মামাবাবু, আপনি কীভাবে জানলেন যে তার কথার ওপর অরুণ বললবাসস্টপে একটা লোক তো?

প্রভাতরঞ্জন থমকে দাঁড়িয়ে বললেন–মাই গুডনেস! তুই কী করে জানলি?–

যেতে যেতে দীপ্তেন্দু সংক্ষেপে ব্যাপারটা জানাল। শান্তা জোকের সম্ভাবনাটাও : উল্লেখ করল। প্রভাতরঞ্জন আনমনে বললেন–তাও বিচিত্র নয়। যাই হোক, শান্ত সত্যি এসে পড়লে এর মীমাংসা হবে। যতক্ষণ সে না আসছে, ততক্ষণ ব্যাপারটা হেঁয়ালি থেকে যাচ্ছে।…

ওপরে দীনগোপাল ততক্ষণে নীতা ও ঝুমার মুখে ঘটনাটা জানতে পেরেছেন। প্রভাতরঞ্জন সদলবলে ঘরে ঢুকলে ছড়ি তুলে হাসতে হাসতে বললেন–এস। আগে এক ঘা খাও, তারপর কথা।

প্রভাতরঞ্জন মাথা নিচু করে বললেন, মারো তাহলে।

দীনগোপাল হাত বাড়িয়ে তাকে টেনে কাছে বসালেন।আশা করি তুমিও বাসস্টপে কোনও লোকের মুখে আমার বিপদের খবর শুনে গোয়েন্দাগিরি করতে আসোনি!

প্রভাতরঞ্জন কিছু বলার আগেই অরুণ বলে উঠল–হ্যাঁ জ্যাঠামশাই, দা সেইম কেস।

ঘরে হাসির হুল্লোড় পড়ে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যে নব আরেক প্রস্থ চা দিয়ে গেল। চা খেতে যেতে শান্তর কথা উঠিল। প্রভাতরঞ্জন বললেন-শান্তর সঙ্গে মাসখানেক আগে কলেজ স্ট্রিটে দেখা হয়েছিল। বলল, বিয়ে করেছে। বউকে নিয়ে প্রণাম করতে যাবে। যায়নি।

নীতা চমকে উঠেছিল। শান্তদা বিয়ে করেছে? অসম্ভব। আমি বিশ্বাস করি না।

দীপ্তেন্দু বলল–আমিও না।

অরুণ বলল–আমিও। ঝুমা বলল–ভ্যাট! ও বিয়ে করবে কী? ও তো কোন ব্রহ্মচর্যাশ্রমে যেত-টেত শুনেছিলাম।

প্রভাতরঞ্জন হাসলেন।–তোমরা ভাবলে আমি ওর কথা বিশ্বাস করেছিলাম? নেভার।

অরুণ একটু কিন্তু-কিন্তু ভঙ্গি করে বলল-অবশ্যি, ওর পক্ষে অসম্ভব কিছু নেই। জ্যাঠামশাই, প্লিজ অন্যভাবে নেবেন না। ওর মধ্যে আপনার খানিকটা আদল আছে। আমাদের বংশের যদি কোনও বিশেষ লক্ষণ থাকে, সেটা খানিকটা আপনার আর শান্তর মধ্যেই আছে। আমার কথা না, বাবাই বলতেন।

দীনগোপাল একটু হেসে বললেন কী সেই লক্ষণ?

–জেদ। বলেই অরুণ হাত নাড়তে লাগল।না, না। কদর্থে বলছি না, সদর্থে। ইট ইজ জাস্ট লাইক-টু স্টিক টু আ পয়েন্ট। যা ভাল বুঝেছি, তাই করব–এরকম আর কী!

দীনগোপালের হাতে সেই ছড়িটা তখনও আছে। খেলার ভঙ্গিতে নাড়াচাড়া করতে করতে আনমনে বললেন–কোন পয়েন্ট স্টিক করে আছি, আমি নিজেই জানি না। আর জেদের কথা যদি ওঠে কিসের জেদ?

প্রভাতরঞ্জন বললেন–দীনুদা, ভয়ে বলি কি নির্ভয়ে বলি?

নির্ভয়ে। দীনগোপাল একটু হাসলেন।

প্রভাতরঞ্জন বললেন–একা এই সরডিহিতে পড়ে থাকা, নাম্বার ওয়ান। নাম্বার টু, বিয়ে কবোনি। নাম্বার থ্রি…।

বলে প্রভাতরঞ্জন হঠাৎ থেমে মুখে যথেষ্ট গাম্ভীর্য আনলেন। কথাটা গুছিয়ে বলতে চান এমন একটা হাবভাব। অরুণ সেই ফাঁকে বলে উঠল–হ্যালুসিনেশানের প্রাথমিক লক্ষণ ধরা পড়েছে। অথচ গা করছেন না। সাইকোলজির বইতে পড়েছি, এ একটা সাংঘাতিক অসুখ। অথচ গ্রাহ্য করছেন না। এও একটা জেদ।

ঝুমা স্বামীকে যথারীতি ধমকের সুরে বলল–থামো তো! হাতেনাতে প্রমাণ পেলে, হ্যালুসিনেশান নয়। মামাবাবুকে জানালা দিয়ে দিব্যি দেখতে পেলেন। কিসের হ্যালুসিনেশান?

প্রভাতরঞ্জন হাত তুলে বললেন–চুপ! নাম্বার থ্রি, উদ্দেশ্যহীন জীবনযাপন। সব মানুষেরই মোটামুটি একটা লক্ষ্য থাকে। দীনুদার ছিল না এবং এখনও যা দেখছি, নেই।

 দীনগোপাল ঈষৎ কৌতুকে বললেন–লক্ষ্য ব্যাপারটা কী?

লক্ষ্য দুরকমের। প্রভাতরঞ্জন ভারিক্কি চালে বললেন। বৈষয়িক এবং মানসিক। বৈষয়িক লক্ষ্য কী, আশা করি বুঝিয়ে বলার দরকার নেই। মানসিক লক্ষ্য বলতে ঐহিক আর পারলৌকিক, উভয়ই। ধরো, কেউ সমাজসেবা করে। আবার কেউ ঈশ্বরে মনপ্রাণ সমর্পণ করে।

দীনগোপাল আস্তে বললেন–ঈশ্বরটিশ্বর বোগাস। আর সমাজসেবার কথা বলছ! সেও একটা লোক-দেখানো ভড়ং। এই যে একসময় তুমি রাজনীতি করে বেড়াতে। জেল খেটেছ। কাগজে নাম ছাপা হয়েছিল। কিন্তু তারপর?

–তারপর আবার কী? প্রভাতরঞ্জন উজ্জ্বল মুখে বলেনে।…স্যাটিসফ্যাকশান! চিত্তের সন্তোষ। এটা জীবনে কম নয়, দীনুদা! একটা মহৎ কাজ করার তৃপ্তি। তাছাড়া জীবনের একটা মানেও তো আছে!

দীনগোপাল একই সুরে বললেন–ওসব আমি বুঝি না। তোমার জেল খাটায়-হা, তুমি একবার জেল থেকে পালিয়েও ছিলে, ভাল কথা–কিন্তু এতে কার কী উপকার হয়েছে বুঝি না। পৃথিবী বড় ব্যাপার–এই দেশটার কথাই ধরো। দিনে দিনে কী অবস্থাটা হচ্ছে! বাসের অযোগ্য একেবারে। নরক!

প্রভাতরঞ্জন অট্টহাসি হেসে বললেন–সিনিক! সিনিক! এক্কেবারে সিনিসিজম!

অরুণ বলল–শান্ত! অবিকল শান্তর কথাবার্তা।

–তাও তো শান্তর ব্যাপারটা বোঝা যায়। প্রভাতরঞ্জন বললেন। শান্ত, ওই যে কী বলে, উগ্রপন্থী রাজনীতি করত। আমার সঙ্গে একবার সে কী এঁড়ে তক্ক! যাই হোক, ঘা খেয়ে ঠকে শেষে শিখল। কিন্তু তোদের এই জ্যাঠামশাই ভদ্রলোকের ব্যাপারটা ভেবে দ্যাখ! কী দীনুদা? খুব চটিয়ে দিচ্ছি, তাই না?

হাসলেন দীনগোপাল।–তোমার তো চিরকাল ওই একটাই কাজ। লোককে চটানো। কিন্তু আমি পাথুরে মানুষ।

নীতার এসব কথাবার্তা ভাল লাগছিল না। সে ঝুমাকে ছুঁয়ে চোখের ইশারা করল, বারান্দায় গিয়ে গল্প করবে। ঝুমা বুঝতে পেরে উঠে দাঁড়াল। অরুণ মুচকি হেসে বলল–সরডিহিতে প্রচুর ভূত আছে। সাবধান!

ততক্ষণে ঝুমা ও নীতা বারান্দায়। অরুণের কথা শেষ হবার পর দুজনে এক গলায় চেঁচিয়ে উঠল–কে, কে?

শোনামাত্র প্রথমে প্রভাতরঞ্জন একটা হুংকার ছেড়ে দরজার দিকে ঝপ। দিলেন। অরুণ ও দীপ্তেন্দু তার পেছনে গিয়ে হাঁক ছাড়ল–কোথায়, কোথায়?

তারপরই ঝুমা ও নীতার হাসি শোনা গেল। প্রভাতরঞ্জন, দীপ্তেন্দু ও অরুণের মুখের আক্রমণাত্মক ভাব অদৃশ্য হলো। অরুণ বলল–তাহলে যা ভেবেছিলাম!

দীনগোপাল ঘরের ভেতর থেকে বললেন–শান্ত নাকি?

–আবার কে? প্রভাতরঞ্জন সহাস্যে শান্তকে টানতে টানতে ঘরে ঢোকালেন।

শান্ত কেমন চোখে সবার দিকে তাকাচ্ছিল। দীনগোপাল ডাকলেন–আয় শান্ত! তখন সে দীনগোপালের পা ছুঁয়ে প্রণাম করল।

অরুণ বলল-খুব জর চালটা দিয়েছিস, শান্ত! তবে আমরা ড্যাম গ্ল্যাড।

শান্ত বলল–আমি সত্যি কিছু বুঝতে পারছি না। হঠাৎ তোমরা এখানে…

তার কথা কেড়ে দীপ্তেন্দু বললন্যাকামি করবি নে।

ঝুমা চোখে ঝিলিক তুলে বলল ন্যাকামি মানে, বাসস্টপে একটা লোক।

অরুণ খ্যাখ্যা করে হেসে বলল–এবং মুখে দাড়ি, চোখে সানগ্লাস আমাদের সবাইকে এখানে পাঠিয়ে দিয়েছে।

শান্ত আস্তে বলল–হ্যাঁ। কাল সন্ধ্যায় গড়িয়াহাটের মোড়ে দাঁড়িয়ে আছি, হঠাৎ ওরকম একটা লোক কাছে এসে চাপা গলায় বলল, আপনার সরডিহির জ্যাঠামশাই বিপন্ন। শিগগির চলে যান। তারপর কথাটা বলেই ভিড়ে মিশে গেল। এমন হকচকিয়ে গিয়েছিলাম যে, ওকে কিছু বলব বা চার্জ করব, সুযোগই পেলাম না।

প্রভাতরঞ্জন কান করে শুনছিলেন। একটু কেশে বললেন–শান্ত, আশা করি জোক করছ না?

–না, আর যেখানে করি, জ্যাঠামশাইয়ের ব্যাপারে আমি জোক করি না। বলে সে আঙুল খুঁটতে থাকল। মুখটা নিচু।

দীনগোপাল খুব গম্ভীর হয়ে চোখ বুজে ছিলেন। ঘরে স্তব্ধতা ঘন হয়েছিল, চিড় খেল তার ডাকেনব! নব–অ!…