বাড়ির নকশা

বাড়ির নকশা

জয়া কিছুক্ষণ বিজয় বা কর্নেল কারুর কোনো প্রশ্নের জবাব দিল না। তারপর কর্নেল চাপা স্বরে বললেন, “বিজয়, কলাবতী বা তার মেয়েকে বলো, এককাপ কড়া কফি নিয়ে আসুক।”

বিজয়ের কথায় ওরা চলে গেলে কর্নেল জয়ার দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টে তাকিয়ে বললেন, “জয়া, তুমি কি জানো আমি কে?”

জয়া খুব আস্তে মাথাটা একটু দোলাল। বিজয় বলল, “আমি কিন্তু বলিনি ওকে। শুধু কাকাবাবু–মানে মুখুয্যেমশাইকে না জানালে বিবেকে বাধে, তাই–”

কর্নেল তাকে থামিয়ে বললেন, “জয়া, ঘরে ক্লোরোফর্মের গন্ধ কেন? কেউ তোমাকে ক্লোরোফর্ম শুকিয়ে অজ্ঞান করে ফেলেছিল, তাই না?”

জয়ার চোখ ফেটে জল বেরিয়ে এল। সে বোবার মত তাকিয়ে রইল শুধু।

“কিছু নিয়ে গেছে কি ঘর থেকে?”

জয়া আবার মাথা দোলাল। বিজয় চমকে উঠেছিল। বলল, “এ তো অসম্ভব। ব্যাপার! দিনদুপুরে কেউ এই ঘরে ঢুকে ওকে অজ্ঞান করাবে এবং কিছু চুরি করে সবার চোখ এড়িয়ে পালিয়ে যাবে! নাঃ–আমি বিশ্বাস করি না।”

কর্নেল মৃদু ভর্ৎসনার সুরে বললেন, “আঃ! তুমি একটু চুপ করো, বিজয়! আমাকে কথা বলতে দাও।”

জয়া পালঙ্কের পাশে রাখা গোলাকার টেবিল থেকে জলের গেলাসটা নিল। এক চুমুক জল খেয়ে গেলাসটা রেখে আবার কর্নেলের দিকে ভিজে চোখে তাকাল।

কর্নেল বললেন, “কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে তোমার?”

জয়া মাথা দোলাল।

“ঠিক আছে। পরে শুনব। কফি নিয়ে আসুক। গরম কফি খেলে গলাটা ঠিক হয়ে যাবে। তবে শুধু ইশারায় দেখিয়ে দাও, কোথায় তোমার ওপর কেউ ক্লোরোফর্ম নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল।”

জয়া ইশারায় দরজার কাছটা দেখিয়ে দিল। তখন কর্নেল ঘরের বাতি জ্বেলে দিলেন। জানালাগুলোর পর্দাও সরিয়ে দিলেন। তারপর পকেট থেকে আতসকাঁচের। মতো দেখতে প্রকাণ্ড একটা গোল এবং হ্যান্ডেল লাগানো কাঁচ নিয়ে দরজার মেঝের ওপর হুমড়ি খেয়ে বসলেন।

ওই অবস্থায় বাইরের বারান্দায় গেলেন। তারপর ফিরে এসে বললেন, “লোকটা খালি পায়ে এসেছিল মনে হচ্ছে। কলাবতী, রঙ্গিয়া, বুদ্বুরাম সবাই এ ঘরে খালিপায়ে ঢুকেছে। লোকটা জুতোপায়ে ঢুকলে তা সত্ত্বেও একটু-আধটু চিহ্নও মেঝেয় পেতুম।”

একটুখানি চোখ বুজে থাকার পর চোখ খুলে ফের বললেন, “আচ্ছা বিজয়, এ বাড়ির দোতালায় আর নিচের তলায় কতগুলো ঘর আছে?”

 বিজয় হিসেব করতে থাকল। ইতিমধ্যে কলাবতী কফি নিয়ে এল। কর্নেল বললেন, “ঠিক আছে! তুমি এখন এস, কলাবতী!”

কলাবতী সলজ্জ হেসে বলল, “আপনাদের জন্য কফি আছে সায়েব!”

 কর্নেল হাসলেন। “তুমি বুদ্ধিমতী কলাবতী!”

কলাবতী ট্রে রেখে চলে গেল। কর্নেল নিজের হাতে পট থেকে কফি ঢেলে জয়াকে দিলেন। ততক্ষণে বিজয়ের হিসেব শেষ হয়েছে। সে বলল, “বড় ভুল। হয় আমার। মনে হচ্ছে, নিচের তলায় আটখানা আর ওপরে পাঁচখানা ঘর।”

জয়া মৃদু স্বরে বলল, “না। ওপরে ছখানা।”

 বিজয় বলল, ‘ও, হাঁ। জয়ের মানে দাদার ঘরের এপাশে একটা ঘর আছে। ভুলে গিয়েছিলাম।”

কর্নেল জিগ্যেস করলেন, “সে-ঘরে কী আছে?”

বিজয় বলল, “জানি না। তালাবন্ধ আছে–ছেলেবেলা থেকেই দেখছি। বাড়িতে কয়েকটা ঘরেই তালাবন্ধ আছে।”

জয়া বলল, “মায়ের কাছে শুনেছিলাম ও ঘরে আমার এক পিসি নাকি সুইসাইড করেছিলেন। তখন আমাদের জন্ম হয়নি। পরে বাবা ঘরটা অস্ত্রাগার করেন। আমাদের পূর্বপুরুষের সব অস্ত্রশস্ত্র এই ঘরে আছে।”

বিজয় বলল, “কে জানে! আমি ওসব খবর রাখি না।”

 কর্নেল বললেন, “জয়া, আর কথা বলতে আশা করি কষ্ট হচ্ছে না?”

জয়া বলল, “না।”

“তোমাকে অজ্ঞান করে ঘর থেকে কিছু নিয়ে গেছে কি না জিগ্যেস করলে তখন তুমি মাথা দুলিয়ে হ্যাঁ বললে! তার মানে তুমি জানো চোর কী নিতে এসেছিল?”

জয়া মুখ নামিয়ে বলল, “জানি। জিনিসটা আমার কাছেই ছিল।”

 “কী সেটা?”

জয়া একটু চুপ করে থেকে বলল, “কাকাবাবু একটা ছোট্ট কৌটোর মতো জিনিস লুকিয়ে রাখতে দিয়েছিলেন। সেটা জামার ভেতর বুকের কাছে লুকিয়ে  সবে ওপরে এসেছি–”

বিজয় নড়ে বসে বলল, “তাই তো! কাকাবাবু তো এলেন না! নিশ্চয় খবর পেয়েছেন কী হয়েছে।”

জয়া বলল, “কাকাবাবু ভাগলপুর গেছেন। যাবার আগে আমায় জিনিসটা দিয়ে গিয়েছিলেন। দরজা বন্ধ করে সেটা কোথায় লুকিয়ে রাখব ভাবছি, হঠাৎ দরজায় কেউ নক করল। রাত্রে হলে জিগ্যেস না করে দরজা খুলতুম না। দরজা যেই। খুলেছি, কেউ আমার ওপর এসে পড়ল। তারপর কিছু টের পাইনি। রঙ্গিয়া কখন এসে আমাকে পড়ে থাকতে দেখে ফ্যান চালিয়েছে। জলের ঝাঁপটা দিয়েছে। জ্ঞান . হবার পর সব মনে পড়ল। তখন দেখি জিনিসটা নেই।”

“জামার ভেতর রেখেছিলে আগের মতো?” কর্নেল জিগ্যেস করলেন।

“হ্যাঁ।” জয়া কফির পেয়ালা পাশের টেবিলে রেখে বলল, “একপলকের জন্য লোকটার মুখে কালো কুচ্ছিত একটা মুখোশ দেখেছিলুম। তার গায়ে ছাইরঙের কলারওয়ালা গেঞ্জি ছিল।”

কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। “তুমি বিশ্রাম করো জয়া! পরে আবার কথা বলব।”

বারান্দায় গিয়ে কর্নেল একটু দাঁড়ালেন হঠাৎ। বললেন, “বিজয়, খালি ঘরগুলোর চাবি কার কাছে থাকে?

বিজয় বলল, “সম্ভবত কাকাবাবুর কাছে।”

 “জয়ের ঘরের পাশের ঘরটা একবার দেখে যাই, এস।”

“কিন্তু তালাবন্ধ যে! ভেতরে তো ঢোকা যাবে না।”

 “বাইরে থেকেই দেখে যাব।”

বারান্দা দিয়ে এগিয়ে গেলেন দুজনে। বারান্দা পুব-পশ্চিমে এগিয়ে বিজয়ের ঘরের পর ডানদিকে দক্ষিণে ঘুরেছে। পাশাপাশি দুটো ঘরের দরজা সেখানে। বিজয় প্রথম ঘরের দরজাটা দেখিয়ে বলল, “এটাই সেই ঘর। পাশেরটায় জয় থাকে। তার ঘরে তালা এঁটে বেরোয়।” বলে সে জয়ের ঘরের পর্দাটা তুলে দেখিয়ে দিল।

জয়ের ঘরের পর বারান্দাটা শেষ হয়েছে জাফরিকাটা দেয়ালে। চৌকোনা নকশাকাটা ঘুলঘুলি-গুলোতে বাইনোকুলার দিয়ে কর্নেল বাইরেটা দেখে বললেন, “পুকুরের পাড়ে ওই বাড়িটাই কি তোমাদের ঠাকুরদালান!”

বিজয় উঁকি মেরে দেখে বলল, “হ্যাঁ। ওই যে পাশের ঘরের দরজার সামনে মাধব পাণ্ডাজি দাঁড়িয়ে আছেন দেখছেন, উনিই মাইনে করা পূজারী।”

“পুব-দক্ষিণ কোণের টিলাটা কি বাড়ির ভেতর, না বাইরে?”

“বাড়ির চৌহদ্দি-পাঁচিলের ভেতরই। ওই টিলার মাথায় ছোট্ট মন্দিরটা দেখতে পাচ্ছেন, ওটা হরমন্দির। আর ঠিক এমনি একটা ছোট টিলা আছে দক্ষিণ-পশ্চিম কোনায়। সেটা এখান থেকে দেখা যাচ্ছে না। ওটার মাথায় ওইরকম ছোট্ট একটা মন্দির আছে। সেটা গৌরীমন্দির। লোকে বলে হরটিলা গৌরীটিলা।”

কর্নেল একটু হাসলেন। “তোমার বাড়ির এলাকা দেখছি বিশাল। জঙ্গল পাহাড় জীবজন্তু আছে, আবার–”

কথা কেড়ে বিজয় বলল, “একটা আলাদা পৃথিবী বলতে পারেন। তবে ভীষণ গোলমেলে পৃথিবী। এখনও অব্দি পুরো এলাকার অনেকটাই আমার অচেনা। তেমনি রহস্যময়ও মনে হয়।”

কর্নেল ঘুরে পা বাড়িয়ে বললেন, “একটা নকশা পেলে ভাল হত।”

বিজয় বলল, “কিসের?”

“তোমাদের বাড়ির পুরো চৌহদ্দির। বিশেষ করে বাড়িটার নিচের তলা এবং এই দোতলার।”

“করে দিচ্ছি। আধঘণ্টা সময় দিন।”

“তুমি তো বললে অনেকটাই অচেনা তোমার।”

বিজয় হাসল। “জয়ার হেল্প নেব। তাছাড়া কলাবতাঁকেও ডাকব। দুজনের সবটাই নখদর্পণে।”  

জয়ের ঘরের পাশের ঘরটার দরজায় পর্দা নেই। মরচে ধরা তালা ঝুলছে। দেখে মনে হল, বহুকাল তালাটা খোলা হয়নি। কপাটের ফাঁকেও মাকড়সার জাল রয়েছে। ভেতরে কী সব অস্ত্র আছে কে জানে।

বারান্দা ঘুরেছে পশ্চিমে এবং বাঁকের মুখে নিচে নামার আরেকটা সিঁড়ি। কর্নেল সেই সিঁড়িতে নামতে যাচ্ছিলেন। বিজয় বলল, “ওটা বন্ধ রাখা হয়েছে। দাদার কুকুর নিচে গিয়ে বৈজু ঠাকুরকে ভয় দেখাত। শেষে কাকাবাবু নিচে সিঁড়ির দরজায় তালা আটকে দিয়েছেন।”

বারান্দায় অজস্র থাম। জয়ার ঘরের পর প্রথম সিঁড়ি। সেখান দিয়েই ওঠানামা করা হয়। কর্নেল নিচে গিয়ে বিজয়কে বললেন, “তুমি এবার একটা কাজ করো। একে একে দারোয়ান নছি সিং, কলাবতী, রঙ্গিয়, বৈজুঠাকুর, আর বুদ্বুরাম ডাক্তারবাবুকে ডেকে আনলে তখন তাকেও পাঠিয়ে দেবে। ওদের কাছে কিছু জানবার আছে।”

সিঁড়ির পাশেই গেস্টরুমে কর্নেল আছেন। ঘরে ঢুকে ক্যামেরা বাইনোকুলার ইত্যাদি টেবিলে রেখে ঝটপট পোশাক বদলে তৈরি হলেন। কিছুক্ষণের মধ্যে একে-একে নছি সিং, কলাবতী ও তার মেয়ে রঙ্গিয়া, বৈজু শেষে বুদ্বুরাম এল বিজয়ের সঙ্গে।

না–কেউ আজ সকাল থেকে সন্দেহজনক কিছু দেখেনি। প্রত্যেকেই বলল যে, অন্দরমহলে একটা চুহা বা বিল্লি ঘুসলেই তারা টের পাবে। কোনো অচেনা লোকের বাড়ি ঢোকার প্রশ্নই ওঠে না। কারণ পুবের খিড়কি আর দক্ষিণের খিড়কি ভেতর থেকে বন্ধ থাকে। বাকি রইল সদর দরজা। সেখানে করিডোর মতো প্যাসেজের মুখে সারাক্ষণ নছি সিং বসে আছে। কেউ এলে তার অজান্তে বাড়ি ঢুকতে পারবে না। পের্টিকোর সামনে হলঘরের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। পাশে বিপ্রদাসজির ঘরের বাইরের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। অতএব বাইরের কেউ বাড়ি ঢোকেনি বা বেরিয়েও যায়নি।

ঘণ্টাখানেক পরে বিজয় নকশা নিয়ে হাজির হল। কর্নেল নকশার ওপর ঝুঁকে পড়লেন।…