৯. পূর্ব-বাঙলা ভাষা কমিটি

নবম পরিচ্ছেদ – পূর্ব-বাঙলা ভাষা কমিটি

১. পূর্ব-বাঙলা ভাষা কমিটির প্রতিষ্ঠা

‘পূর্ব-বাঙলায় প্রচলিত বাংলা ভাষা প্রমিতকরণ, সহজীকরণ ও সংস্কারের প্রশ্ন পরীক্ষার উদ্দেশ্যে ৯ই মার্চ, ১৯৪৯, পূর্ব-বাঙলা সরকার ‘পূর্ব-বাঙলা ভাষা কমিটি’ নামে একটি কমিটি স্থাপন করেন।[১] ঐ একই সরকারী প্রস্তাবে (পূর্ব-বাঙলা সরকার প্রস্তাব নং ৫৯০ ইডেন) নিম্নলিখিতভাবে কমিটির শর্তনির্দেশ করা হয়:

১. পূর্ব-বাঙলার জনগণের ভাষা (বাংলা ব্যাকরণ, বানান ইত্যাদি সহ) সহজীকরণ, সংস্কার ও প্রমিতকরণের প্রশ্ন বিবেচনা করিয়া সে বিষয়ে সুপারিশ করা।

২. যে সমস্ত বিদেশী টেকনিক্যাল এবং অন্যান্য শব্দের পরিভাষা উপরোক্ত ভাষায় নেই সেগুলির জন্য নোতুন শব্দ ও ফ্রেজ কিভাবে গঠন করা যায় এবং সেগুলিকে কিভাবে যতদূর সম্ভব অনুবাদ করা যায় তার উপায় নির্দেশ করা।

৩. উপরোক্ত ভাষাকে কিভাবে পাকিস্তান এবং বিশেষ করে পূর্ব-বাঙলার প্রতিভা ও সংস্কৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ করা যায় সে বিষয়ে কমিটি অন্য যা কিছু প্রয়োজন বোধ করেন সেই অনুসারে পরামর্শ দান।[২]

মৌলানা আকরম খাঁর সভাপতিত্বে সরকারী ও বেসরকারী ব্যক্তিদের দ্বারা গঠিত এই কমিটির সদস্যদের নাম নীচে উল্লিখিত হলো:

১. মৌলানা মোহাম্মদ আরকম খাঁ, সভাপতি

২. হাবিবুল্লাহ বাহার চৌধুরী, প্রাদেশিক মন্ত্রী

৩. ডক্টর আবদুল মোতালেব মালিক, প্রাদেশিক মন্ত্রী

৪. ডক্টর মোয়াজ্জেম হোসেন, ভাইস চ্যান্সেলর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

৫. মৌলানা আবদুল্লাহ আল-বাকী, এমএলএ

৬. ডক্টর মহম্মদ শহীদুল্লাহ, অধ্যক্ষ বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

৭. আবুল কালাম শামসুদ্দীন, এমএলএ সম্পাদক, দৈনিক আজাদ

৮. সৈয়দ আবুল হাসনাত মহম্মদ ইসমাইল, ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ, পূর্ব-বাঙলা সরকার, ঢাকা।

৯. মীজানুর রহমান, ডেপুটি সেক্রেটারী, শিক্ষা বিভাগ, পূর্ব বাঙলা সরকার।

১০. মাজউদ্দিন আহমদ, প্রাক্তন অধ্যক্ষ, মুরারীচাঁদ কলেজ, সিলেট।

১১. শাইখ শরাফউদ্দিন, অধ্যক্ষ, ইসলামী ইন্টারমিডিয়েট কলেজ।

১২. একিউএম আদমউদ্দিন, অধ্যাপক, ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজ, নওগাঁ, রাজশাহী।

১৩. মৌলভী জুলফিকার আলী, স্বত্বাধিকারী, আলাবিয়া প্রেস, চট্টগ্রাম।

১৪. গণেশ চন্দ্র বসু, অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

১৫. মোহিনী মোহন দাস।

১৬. গোলাম মুস্তফা, হেড মাস্টার, সেক্রেটারী৩

উপরোক্ত সদস্যরা ছাড়াও বিভিন্ন পর্যায়ে নিম্নলিখিত ব্যক্তিদেরকে কমিটির সদস্য করা হয়:

১. ডক্টর মুহম্মদ এনামুল হক, অধ্যক্ষ, বাঙলা বিভাগ, রাজশাহী কলেজ।

২. আবদুল মজিদ, পূর্ব-বাঙলা সরকারের বাংলা অনুবাদক

৩. অজিতকুমার গুহ, অধ্যাপক জগন্নাথ কলেজ, ঢাকা।[৩]

কমিটির কাজ শুরু হওয়ার পর থেকে কমিটির মধ্যে আরও কিছু কিছু পরিবর্তন করা হয়। গোলাম মোস্তফা সেক্রেটারী হিসাবে কাজ করতে অক্ষম হওয়ায় তাঁর পরিবর্তে ইসলামী ইন্টারমিডিয়েট কলেজের অধ্যক্ষ শ‍ইখ শরাফুদ্দীন ৯ই মে, ১৯৪৯, সেক্রেটারীর পদে নিযুক্ত হন। এর পর শাইখ শরাফুদ্দীনের স্থানে চট্টগ্রামের বিভাগীয় স্কুল পরিদর্শক নজমুল হোসেন চৌধুরী সেক্রেটারী নিযুক্ত হন। তিনি ২১শে মে, ১৯৪৯, নোতুন পদে যোগদান করে সে বছরই ৩০শে জুন অবসর গ্রহণ করেন। এর পর শিক্ষা বিভাগের আবু সাঈদ মাহমুদ ১৯শে জুলাই, ১৯৪৯, পূর্ব-বাঙলা ভাষা কমিটির সেক্রেটারীরূপে কার্যভার গ্রহণ করেন এবং শেষ পর্যন্ত কাজ চালিয়ে যান। এ ছাড়া শিক্ষা বিভাগের আহমদ হোসেনকে অংশকালীন সেক্রেটারী হিসাবে নিযুক্ত করা হয়।[৪]

১৯৪৯ এর ডিসেম্বর মাসে ডক্টর মালেক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হিসাবে করাচীতে চলে যান এবং তাঁর স্থানে বেসামরিক বিভাগের মন্ত্রী সৈয়দ মহাম্মদ আফজল কমিটির সদস্য নিযুক্ত হন।[৫] গণেশচন্দ্র বসু কমিটির প্রথম বৈঠকে উপস্থিত থাকার পর আর সদস্য হিসাবে থাকতে অনিচ্ছা প্রকাশ করায় ১৯৫০-এর মে মাসে তাঁর স্থানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক হরনাথ পালকে নিযুক্ত করা হয়। কিন্তু এর পর হরনাথ পালও কমিটির সদস্য হিসাবে থাকতে অনিচ্ছা প্রকাশ করায় ঢাকার জগন্নাথ কলেজের অধ্যাপক অজিতকুমার গুহ ১৯৫০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে কমিটির সদস্য নিযুক্ত হন।[৬]

গোলাম মোস্তফা পর পর কমিটির অনেকগুলি বৈঠকে উপস্থিত না হওয়ার জন্যে তাঁর পরিবর্তে বেগম শামসুন্নাহার মাহমুদকে ১৯৫০ এর জুন মাসে কমিটির সদস্য নিযুক্ত করা হয়।[৭] সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি মোহিনী মোহন দাসের মৃত্যুর পর তাঁর স্থানে ১৯৫০ এর মার্চ মাসে কমিটির সদস্য নিযুক্ত হন পূর্ব-বাঙলা সরকারের তফশিলী শিক্ষার স্পেশাল অফিসার আম্বিকাচরণ দাস।[৮]

কবি গোলাম মোস্তফার সাথে পূর্ব-বাঙলা ভাষা কমিটির সম্পর্কচ্ছেদের ব্যাপারে পূর্ব বাঙলা সরকারের প্রাক্তন শিক্ষা ডিরেক্টর আবুদল হাকিম বলেন:

কবি এই সময় একটা শক্তিশালী ভাষা বিরোধী মিশ্রচক্রের সান্নিধ্যে এসে তাদের বেড়াজালে আটকা পড়বার মতো হয়েছিলেন। চক্র নানা ছলে রটাতে চেষ্টা করছিল যে এত বড় জনপ্রিয় বাঙালী কবিও তাদের সাথে রয়েছেন এবং বাঙলা ভাষাকে উর্দু হরফে লিখবার প্রস্তাবে রাজী হয়েছেন। কবি যে ভাষা-সংস্কার কমিটির সেক্রেটারী ছিলেন তদ্বারা উক্ত মতের পরিপোষক সুপারিশ করাবার জন্য ঐ চক্র থেকে পীড়াপীড়ি শুরু হয়।[৯] …
কবিকে যাঁরা ঘনিষ্ঠভাবে জানতেন তাঁরা কখনই বিশ্বাস করতে পারতেন না যে তিনি বাঙলা ভাষা বিরোধী উক্ত চক্রের সঙ্গে সহযোগিতা করে তাদের কার্য সিদ্ধির সহায়ক হতে পারেন।[১০]

এ সম্পর্কে ভাষা কমিটির অন্যতম সদস্য এবং গোলাম মোস্তফার পরবর্তী সেক্রেটারী শাইখ শরাফুদ্দীন বলেন:

আরবী ভাষায় সুপণ্ডিত না হলেও কুরআন মজিদ পাঠ ও তরজমা উপলক্ষে আরবী ভাষার প্রতি তিনি বিশেষভাবে ঝুঁকে পড়েন। এমন কি তিনি বাংলা ভাষাতেও আরবী হরফ ব্যবহারের বিশেষ পক্ষপাতী ছিলেন। এই কারণে কেউ কেউ তাঁকে বাংলা আরবী হরফের উদ্যোক্তা এডুকেশন সেক্রেটারী ফজলী সাহেবের ধামাধরা বলে বিদ্রূপ করতেন। কিন্তু তাঁরা বোধহয় জানে না যে, প্রকৃত ব্যাপারটি এর বিপরীত। কারণ গোলাম মোস্তফা সাহেবকে পূর্ববঙ্গ ভাষা কমিটির সেক্রেটারী নিযুক্ত করার পরপরই ফজলী সাহেবের সঙ্গে মতবিরোধের ফলেই তিনি ঐ কমিটির সেক্রেটারী পদ ত্যাগ করেন; এমন কি এই উপলক্ষে তাঁর আসল সরকারী চাকরী হেড মাস্টারী পদেও ইস্তফা দিয়ে তিনি নিবিষ্টভাবে সাহিত্য সাধনায় ব্রতী হন।[১১]

উপরোক্ত দুইজনের বক্তব্য থেকে একথা স্পষ্ট প্রমাণিত হয় যে কবি গোলাম মোস্তফা আরবী হরফ প্রবর্তন ইত্যাদি বিষয়ে সরকারের সাথে বহুভাবে সহযোগিতা করেছিলেন। কিন্তু একথাও আবার সত্য যে ভাষা কমিটির সেক্রেটারী হিসাবে, কর্তৃপক্ষ মহলের সাথে তাঁর একটা মতানৈক্য ঘটে, যার ফলে তিনি সরাসরি ইস্তফা না দিলেও কমিটির বৈঠকগুলিতে যোগদানে বিরত থাকেন এবং সেজন্যে পরিশেষে কমিটির সদস্যপদ থেকে তাঁকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। গণেশচন্দ্র বসু এবং হরনাথ পালও যে কমিটির সাথে একমত হতে না পারার জন্যে তার থেকে বিদায় গ্রহণ করেন সে বিষয়েও কোন সন্দেহ নেই। এতে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই, কারণ বাংলা ভাষাকে ইসলামী করার এবং বাঙলা ভাষায় আরবী অক্ষর প্রবর্তনের নানা প্রচেষ্টার তোলপাড়ের মধ্যে অমুসলমান হিসাবে কমিটির আবহাওয়া তাঁদের পক্ষে রীতিমতো অস্বস্তিকরই ছিলো।

২২শে ও ২৩শে জুন, ১৯৪৯, মৌলানা আকরম খাঁর সভাপতিত্বে পূর্ব বাঙলা ব্যবস্থাপক সভার কমিটি রুমে ভাষা কমিটির প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।[২২ তারিখে অনেকগুলি প্রশ্নের উপর বিস্তারিত আলোচনার পর স্থির হয় যে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মহলের মতামত সংগ্রহের জন্যে একটি প্রশ্নমালা প্রস্তুত করে সেটিকে ব্যাপকভাবে প্রচারের ব্যবস্থা করা দরকার। এর পর দিনের বৈঠকে প্রশ্নমালাটির একটি খসড়া পেশ করা হয় এবং সেটি বহুক্ষণ আলোচনার পর পরিবর্তিত ও পরিবর্ধিত অবস্থায় গৃহীত হয়।[১২]

২. কমিটির কার্যপ্রণালী

২৩শে জুন যে প্রশ্নমালাটি কমিটির দ্বারা গৃহীত হয় সেটি প্রাদেশিক ব্যবস্থা পরিষদ ও কেন্দ্রীয় সংবিধান সভার সদস্য; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও কোর্টের সদস্য; ঢাকা মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের সদস্য ও কর্মচারী; সেক্রেটারিয়েট ও শিক্ষা ডাইরেক্টরেটের কর্মচারী; সকল জেলা ও বিভাগীয় কর্মচারী, মাদ্রাসা ও কলেজের অধ্যক্ষ; সমস্ত সরকারী মাধ্যমিক স্কুল এবং কয়েকটি বাছাবাছা বেসরকারী মাধ্যমিক স্কুল; সমস্ত জেলা বোর্ড, লোকাল বোর্ড, জেলা স্কুল বোর্ড ও মিউনিসিপ্যালিটি; এবং সকল শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক এবং গণ্যমান্য ব্যক্তির কাছে মতামতের জন্যে পাঠানো হয়।[১৩]

সর্বমোট ১২০০ কপি প্রশ্নমালা উপরোক্ত ব্যক্তিদের কাছে পাঠানো হয় এবং তার মধ্যে ৩০৪ জন সেগুলি ফেরত পাঠিয়ে তার মাধ্যমে কমিটিকে নিজেদের মতামত জানান। এই উত্তরগুলির সারাংশ তৈরি করে একটি ছোট পুস্তিকা ছাপা হয় এবং সেটি বিবেচনা এবং পর্যালোচনার জন্যে কমিটির সদস্যদের মধ্যে বিতরণ করা হয়।[১৪]

এ ছাড়া রেডিও পাকিস্তান এবং সংবাদপত্রের মাধ্যমে প্রশ্নমালাটি প্রচার করা হয় এবং জনসাধারণকে সে সম্পর্কে তাঁদের মতামত কমিটির কাছে পাঠানোর জন্যে তাঁরা অনুরোধ জানান। এর ফলে সংবাদপত্রে ও সাময়িক পত্রিকাদিতে কিছু বিতর্ক সৃষ্টি হয় এবং কমিটি এইভাবে প্রকাশিত বিভিন্ন প্রবন্ধের মতামতও বিবেচনা করেন।[১৫] অনেকে সরাসরিভাবে কমিটির কাছে লিখিতভাবে তাঁদের মতামত জানান। কমিটি তাঁদের রিপোর্টে এ প্রসঙ্গে তিনজনের নাম উল্লেখ করেন : ইব্রাহীম খাঁ, ঢাকা মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের সভাপতি; ডক্টর মুহম্মদ এনামুল হক, রাজশাহী কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যক্ষ; এবং আবদুল মজিদ, পূর্ব-বাঙলা সরকারের বাংলা অনুবাদক ও রেজিস্ট্রার অব পাবলিকেশন্স।[১৬]

কমিটি রিপোর্টে বলেন যে তাঁরা তাঁদের মতামত গঠনের ক্ষেত্রে অনেকগুলি বইপত্রের দ্বারাও উপকৃত হন। এ সমস্ত বইয়ের লেখকদের মধ্যে কতকগুলি নাম তাঁরা বিশেষভাবে উল্লেখ করেন। যেমন : ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, সৈয়দ আবুল হাসনাত মহম্মদ ইসমাইল, ফিরদৌস খান, মৌলভী জুলফিকার আলী, ‘হেকমতী হুরুদে’র লেখক জাফর আলী। এ ছাড়া ‘Farsight’ ছদ্মনামে লিখিত একটি রচনা এবং তমদ্দুন মজলিশ কর্তৃক প্রকাশিত অপর একটি পুস্তিকার কথাও তাঁরা উল্লেখ করেন।[১৭]

৩. ভাষা কমিটির বৈঠক

২৩শে জুন, ১৯৪৯, ভাষা কমিটির বৈঠকে কয়েকজন সদস্য বলেন যে সরকার ভাষা কমিটির যে শর্তনির্দেশ করেছেন তাতে হরফ পরিবর্তনের কোন কথা নেই এবং সেই হিসাবে হরফ পরিবর্তনের সম্পর্কে আলোচনা কমিটির এখতেয়ার বহির্ভূত। কিন্তু অন্যেরা বলেন যে ‘সংস্কার’ এবং ‘সহজীকরণে’র কথা যখন বলা হয়েছে তখন তার মধ্যেই হরফের প্রশ্ন এসে যেতে পারে এবং সেটাও বিবেচনা করা দরকার। কিছুক্ষণ এ বিষয়ে আলোচনার পর সভাপতি আকরম খাঁ এই মর্মে অভিমত প্রকাশ করেন যে সরাসরি হরফের কথা উল্লিখিত না হলেও হরফের প্রশ্নটি পূর্ব-বাঙলার লোকের ‘প্রতিভা ও সংস্কৃতি’র সাথে জড়িত, কাজেই সেটি কমিটির আলোচনার এখতেয়ারভুক্ত।[১৮]

এ সময় একজন সদস্য জানতে চান যে কমিটির কাজের সাথে সংখ্যালঘুদের স্বার্থ জড়িত আছে কিনা। এর উত্তরে সভাপতি বলেন যে শর্তনির্দেশের ১ এবং ৩ ধারায় ‘পূর্ব বাঙলার জনগণ’ এই ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে; কাজেই সংখ্যালঘুরাও তার অন্তর্গত।[১৯] এই প্ৰশ্ন খুব সম্ভবতঃ গণেশচন্দ্র বসু উত্থাপন করেন এবং মৌলানা আকরম খাঁর ব্যাখ্যায় তাঁর সন্দেহভঞ্জন না হওয়ায় তিনি কমিটির সাথে সংশ্লিষ্ট থাকতে নিজের অসম্মতির কথা তাঁদেরকে জানান। এই বৈঠকের পর তিনি কমিটির কোন পরিবর্তী বৈঠকে আর যোগদান করেননি।

১৯৫০ এর ১০ই মার্চের বৈঠকে অনেকেই অনুপস্থিত ছিলেন; কাজেই সেদিন বিশেষ কোন আলোচনা হয়নি। তবে মোটামুটিভাবে তাঁরা স্থির করেন যে ভাষা সমস্যার বিভিন্ন দিক বিস্তারিতভাবে বিবেচনার জন্যে কয়েকটি সাব-কমিটি গঠন করা প্রয়োজন।[২০]

৩রা মে কমিটির তৃতীয় বৈঠকে সর্বসম্মতিক্রমে স্থির হয় যে হরফ পরিবর্তনের প্রশ্নে রোমান হরফের কথা বিবেচনার কোন প্রয়োজন নেই। এক্ষেত্রে উর্দু হরফই প্রাসঙ্গিক। কাজেই উর্দু হরফ এবং সহজীকৃত বাংলা হরফের মধ্যেই আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখা দরকার।[২১] হরফ প্রশ্নের উপর অনেক আলোচনার পর সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে সহজীকৃত বাংলা হরফ অথবা উর্দু হরফ প্রবর্তনের প্রশ্নটি আপাততঃ স্থগিত রেখে এই দুই হরফের উপযোগিতা প্রথমে পরীক্ষা করে দেখা দরকার। তার জন্যে উপরোক্ত দুই হরফে অক্ষরজ্ঞান বিস্তারের উপর বিস্তৃতভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজনের উপরেও তাঁরা গুরুত্ব আরোপ করেন।[২২]

এই পর্যায়ে কয়েকজন সদস্য উল্লেখ করেন যে উর্দু হরফের মাধ্যমে প্রাপ্তবয়স্কদের শিক্ষার জন্যে কেন্দ্রীয় সরকার একটা পরীক্ষামূলক ব্যবস্থা অবলম্বন করেছেন; কাজেই সে বিষয়ে নোতুনভাবে আর কিছু করার প্রয়োজন নেই। কিন্তু আলোচনার পর কমিটি স্থির করেন যে কেন্দ্রীয় সরকার যে পরীক্ষা কার্য হাতে নিয়েছেন তার নির্ভরতা যাচাই করার জন্যে তাঁরা যে অবস্থায় এবং যে বিষয়গুলি নিয়ে পরীক্ষা চালাচ্ছেন সেই বিষয়গুলি নিয়েই আরো পরীক্ষা চালানো দরকার।[২৩]

এই সিদ্ধান্তের পর ডক্টর শহীদুল্লাহ প্রস্তাব করেন যে এই জাতীয় পরীক্ষা শুধু উর্দু এবং সহজীকৃত বাংলা অক্ষরেও চালানো দরকার। তাঁর প্রস্তাব অন্য কোন সদস্য সমর্থন না করায় সেটি বাতিল হয়ে যায়।[২৪]

সেদিনের বৈঠকে কমিটি বাংলা ভাষার সংস্কার ও সহজীকরণের জন্যে একটি সাব-কমিটি নিযুক্ত করেন। সেই কমিটিতে থাকেন: মৌলানা আকরম খাঁ (সভাপতি), হাবিবুল্লাহ বাহার, ডক্টর মহম্মদ শহীদুল্লাহ, সৈয়দ আবুল হাসনাত মহম্মদ ইসমাইল, অজিতকুমার গুহ, ডক্টর এনামুল হক এবং আবদুল মজিদ।[২৫]

১৯শে ও ২০শে অগাস্ট ভাষা কমিটির চতুর্থ বৈঠকে আরো দুটি সাব-কমিটি গঠিত হয়। বিদেশী শব্দ বাংলায় শব্দান্তরিত করার জন্যে যে সাব-কমিটি তাঁরা গঠন করেন তাতে থাকেন: মৌলানা আকরম খাঁ (সভাপতি), আবুল হাসনাত ইসমাইল, শাইখ শরাফুদ্দীন, একিউএম আদমউদ্দীন এবং আবুল সাঈদ মাহমুদ (কনভেনর)।[২৬] উর্দু হরফ সাব-কমিটির সদস্য থাকেন: মৌলানা আকরম খাঁ (সভাপতি), শাইখ শরাফুদ্দীন, একিউএম আদমউদ্দীন, জুলফিকর আলী এবং আবু সাঈদ মাহমুদ (কনভেনর)।[২৭]

১৯ শে সেপ্টেম্বর ভাষা কমিটির পঞ্চম বৈঠকে হরফ প্রশ্নের উপর কতকগুলি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এই প্রসঙ্গে কমিটি উর্দু হরফ সাব-কমিটির রিপোর্টেটি আলোচনা করেন। সাব- কমিটির রিপোর্টটিতে বলা হয়:

সুতরাং যেহেতু আরবীতে কোরাণ পাঠ সকল মুসলমানের জন্যে বাধ্যতামূলক ও সেই হিসাবে প্রস্তাবিত প্রাথমিক শিক্ষা স্কীমে পাঠ্যতালিকাভুক্ত এবং বাংলা ও উর্দু (উর্দু হচ্ছে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা) উভয় ভাষাই প্রস্তাবিত মাধ্যমিক শিক্ষা স্কীমে উর্দুভাষী ও বাংলাভাষী শিশুদের জন্যে অবশ্য পাঠ্য বিষয় এবং যেহেতু সহজীকৃত অবস্থাতেও বাংলা হরফ একাধিক হরফের ভার লাঘব করবে না উপরন্তু চিরকালের জন্যে আমাদের জনগণের উপর একটা নিষ্প্রয়োজনীয় এবং গুরুতর বোঝা চাপিয়ে দিবে তাই হরফ, বানান ও ব্যাকরণের মধ্যে বাস্তবতঃ যতখানি সম্ভব ঐক্য বিধান অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। সেই হিসাবে উর্দু হরফ সাব- কমিটি সর্বোচ্চ গুরুত্ব সহকারে সুপারিশ করছে বাংলা হরফের পরিবর্তে উর্দু হরফ (অর্থাৎ ফারসী ও উর্দু অক্ষর সংযোজিত আরবী হরফ) ব্যবহার অবশ্য প্রয়োজনীয়।[২৮]

এ ছাড়া নিজেদের মূল সুপারিশকে কার্যকরী করার জন্যে তাঁরা যে পথ নির্দেশ করেন তার মধ্যে বিভিন্ন স্থানে উর্দু হরফে লেখা বই পড়তে শেখানোর জন্যে শিক্ষকদের শিক্ষাকেন্দ্র স্থাপন এবং মুদ্রক, প্রকাশক ও সংবাদপত্র মালিকদের কাছে উর্দু হরফ চালু করার আবেদন উল্লেখযোগ্য।[২৯]

উর্দু ভাষা সাব-কমিটির উপরোক্ত সুপারিশগুলি আলোচনার পর ভাষা কমিটি খুব দৃঢ়ভাবে অভিমত প্রকাশ করেন যে, সে পর্যায়ে বাংলা ভাষায় উর্দু হরফ প্রবর্তন বাঞ্ছনীয় অথবা সম্ভব কোনটিই নয়। এ প্রসঙ্গে যুক্তি দিতে গিয়ে তাঁরা বলেন:

ক. সহজীকৃত ও সংস্কারপরবর্তী অবস্থায় বাংলা হরফ যে রূপ নেবে তাতে সেটা উর্দু অথবা অন্য যে কোন হরফ থেকে পড়া, লেখা, ছাপানো অথবা টাইপের কাজের পক্ষে অনেক সহজ হবে।

খ. বাংলা শব্দের উচ্চারণের মধ্যে যে বিশেষত্ব আছে তা উর্দু হরফের মাধ্যমে প্রকাশ করা সম্ভব নয়।

গ. বাংলাতে উর্দু হরফ গ্রহণ করলে বিগত ৫০০ বছরের বাংলা সাহিত্যের সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের সাথে ভবিষ্যৎ বংশধরদের সম্পর্ক সম্পূর্ণভাবে ছিন্ন হবে। বাংলা সাহিত্যের বিশাল সম্পদ, যার একটা বড়ো অংশ মুসলিম সাহিত্যিক, কবি ও চিন্তাবিদদের দ্বারা গঠিত, উর্দু হরফে রূপান্তরিত করা এবং সেটা ছাপার ব্যবস্থা করা এক দারুণ কঠিন ব্যাপার। ঘ. উর্দু হরফের আশু প্রবর্তন প্রদেশের সমগ্র শিক্ষা ব্যবস্থাকে লণ্ডভণ্ড করে দেবে এবং সেই হিসাবে সেটা শিক্ষার প্রগতির পক্ষে হয়ে দাঁড়াবে ভয়াবহ। এর দ্বারা যে শুধু যাবতীয় পাঠ্যপুস্তক নোতুন হরফে রূপান্তরিত করার প্রয়োজন দেখা দিবে তাই নয়। এই প্রয়োজন মেটানো প্রায় অসম্ভব এবং তা প্রদেশের সাধ্যের বাইরে। শুধু তাই নয় এতে করে ৫০,০০০ প্রাথমিক শিক্ষকদের (যারা উর্দু হরফের সাথে পরিচিত নয়) মধ্যে শতকরা ৯০ জন বেকারে পরিণত হবে। তাদেরকে নোতুনভাবে শিক্ষা দেওয়া অথবা তাদের পরিবর্তে অন্যদেরকে নিয়োগ করা সম্ভব হবে না এবং তাতে করে শতকরা ৯০টি স্কুল বন্ধ হয়ে যাবে। এ ছাড়া লেখক, বইপুস্তক রচয়িতা, সাংবাদিক, মুদ্রক, কম্পোজিটর প্রভৃতি বিভিন্ন ধরনের লোকের রুজি-রোজগার এর ফলে বন্ধ হবে এবং প্রদেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনে তা ডেকে আনবে বিশৃঙ্খলা।[৩০] এইসব কারণে তাঁরা বাংলা ভাষায় উর্দু হরফ প্রবর্তন না করার সুপারিশ করেন। শাইখ শরাফুদ্দীন এই সুপারিশের বিরোধিতা করায় প্রস্তাবটি ভোটে দেওয়া হয়। মৌলানা আকরম খাঁসহ আটজন সদস্য প্রস্তাবের স্বপক্ষে ভোট দেন। বিরোধিতা করেন শাইখ শরাফুদ্দীন এবং জুলফিকার আলী। এতেও সন্তুষ্ট না হয়ে শ‍ইখ শরাফুদ্দীন নিজের বক্তব্য পৃথকভাবে রেকর্ড করেন।[৩১]

কমিটি এর পর অবশ্য উর্দু ভাষার প্রচলনের জন্যে যথেষ্ট গুরুত্ব আরোপ করে একটি পৃথক প্রস্তাব নেন, যাতে তাঁরা বলেন যে স্কুলে মাধ্যমিক পর্যায় থেকে বাধ্যতামূলকভাবে উর্দু শিক্ষার প্রবর্তন করা দরকার। এই প্রসঙ্গ উর্দু ভাষার সংস্কারের প্রয়োজনের কথাও অবশ্য তাঁরা উল্লেখ করেন।[৩২]

১৯শে সেপ্টেম্বরের এই বৈঠকে ভাষা সংস্কার সাব-কমিটির রিপোর্টও আলোচিত হয় এবং সে বিষয়ে ভাষা কমিটি তাঁদের প্রস্তাবে সাব-কমিটির সুপারিশগুলিকে অনুমোদন করেন। সেগুলিকে কার্যকরী করার জন্যে সরকারের কাছে তাঁরা নিজেরাও কতকগুলি বিশেষ সুপারিশ জানান।[৩৩]

বাংলা ভাষা, বাংলা ব্যাকরণ, বাংলা বর্ণমালা, বানান পদ্ধতি ও হরফ নোতুন টেকনিক্যাল ও বিদেশী শব্দ বাছাই এবং বিদেশী শব্দের শব্দান্তকরণ ইত্যাদি বিষয়ে ভাষা কমিটি অনেক রকম সুপারিশ করে।

ভাষা সংস্কার সাব-কমিটির রিপোর্টটিকে প্রায় হুবহু অনুমোদন করে সর্বত্র সহজ বাংলার দ্রুত প্রচলনের জন্যে তাঁরা প্রাদেশিক সরকারকে ভালোভাবে তাগিদ দেন।[৩৪] ‘সাধু ভাষা’ ও ‘চলিত ভাষা’ আধুনিক বাংলার এই দুই ঢংকেই তাঁরা স্বীকৃতি দেন।

১. পূর্ব-বাঙলায় প্রচলিত সরল শব্দবিন্যাস ও সহজ বাক্যরীতির ব্যবহার দ্বারা ভাষায় সংস্কৃত প্রভাব যথাসম্ভব এড়িয়ে যেতে হবে;

২. মুসলিম লেখকদের প্রকাশভঙ্গী ও ভাবসমূহ ইসলামী আদর্শের সাথে Strictly conform করা উচিত এবং

৩. পূর্ব-বাঙলায় সাধারণভাবে ব্যবহৃত শব্দ, idiom, phrase, বিশেষত পুঁথি ও বহুল প্রচলিত সাহিত্যে যেগুলি ব্যবহৃত হয় সেগুলি ভাষাতে আরও স্বাধীনভাবে প্রবর্তন করতে হবে।[৩৫]

উপরিনির্দেশিত নিয়মকানুন অনুসারে কিভাবে বাক্য রচনা করতে হবে সাব-কমিটির রিপোর্টে তার কতকগুলি উদাহরণ দেওয়া হয়। উদাহরণগুলি নীচে উদ্ধৃত করা হলো:

ক. অরণ্য বিহঙ্গম-কাকলীতে মুখরিত ও নির্ঝরণীর কলনাদে নন্দিত = পাখীর গানে ও ঝর্ণার গানে বন গমগম করিতেছে।

খ. তিনি যাবতীয় বিষয় আনুপূর্বিক অবগত হইয়া বিস্ময়াপন্ন হইলেন = তিনি সবকিছু আগাগোড়া শুনিয়া তাজ্জব হইলেন।

গ. যতদিন পৃথিবীতে জীবন ধারণ করিব, ততদিনে তোমায় বিস্মৃত হইব না = তোমাকে সারাজীবন মনে রাখিব।

ঘ. আমি তোমার জন্ম জন্মান্তরেও ভুলিব না = আমি তোমায় কেয়ামতের দিন পর্যন্ত ভুলিব না।

ঙ. হে কায়িদ-ই-আজম, আমরা তোমার পদে শ্রদ্ধার অর্ঘ্য নিবেদন করি = কায়িদ-ই-আজম, আমরা তোমারে মন-প্রাণে সম্মান করি আর তোমায় সালাম জানাই।

চ. মাসের পরিসমাপ্তিতে ঋণ শোধ করিব = মাস কাবারিতে দেনা (করজ) আদায় করিব।

ছ. আমায় দুটো ভাত দাও = আমার চারটা ভাত দাও।

জ. হিল্লোলিত সমীরে তরঙ্গিনী আন্দোলিত হইতে লাগল = লীলুয়া বাতাসে নদী নাচিতে লাগিল।[৩৬]

উপরোক্ত উদাহরণগুলি যে কত যান্ত্রিকভাবে নির্ধারণ করা হয়েছে তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ এই যে সংস্কৃত প্রভাবিত বলে যে বাক্যগুলি উল্লেখ করা হয়েছে সে রকম বাক্য এখন কেউ ব্যবহারই করে না। এমনকি পশ্চিম বাংলার হিন্দু সাহিত্যিকেরা পর্যন্ত সে রকম ভাষার ব্যবহার এখন তো করেনই না বরং তার ব্যবহার হিন্দুরা বহু দিন পূর্বেই বাদ দিয়েছেন। কাজেই সাব-কমিটি এক্ষেত্রে কতকগুলি কাল্পনিক উদাহরণ ইচ্ছামতভাবে গঠন করে সেগুলিকে সহজ করার আপ্রাণ চেষ্টায় চলিত শব্দ এবং দু’ চারটে আরবী ফারসী শব্দ আমদানী করে ভাষার বিপ্লব সৃষ্টি করছেন বলে যে দাবী করেছেন তার কোন সত্যিকার ভিত্তি নেই। উপরন্তু যাঁরা সাহিত্য রচনা করবেন তাঁদের উপর হুকুমদারী করার প্রচেষ্টা চালাতে গিয়ে কমিটির অধিকাংশ সদস্য নিজেদের মুৎসুদ্দী চরিত্র সমগ্র রিপোর্টটির মধ্যে খুব ভালোভাবেই জাহির করেছেন।[৩৭]

বিভিন্ন পর্যায়ে ভাষা কমিটির বৈঠকগুলিতে যে সমস্ত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় সেগুলিই সুপারিশ হিসাবে সরকারের কাছে পেশ করা হয়। কমিটির অধিকাংশ সুপারিশের সাথেই শাইখ শরাফুদ্দীনের মতানৈক্য ঘটায় মূল রিপোর্টটির সাথে নিজের অভিমতও তিনি রেকর্ড করেন এবং সেটিও কমিটির রিপোর্টের সাথে সরকারের কাছে পেশ করা হয়। শাইখ শরাফুদ্দীন তাঁর সুপারিশে অন্যান্য অনেক কিছুর সাথে বলেন যে দেশের বিপুল সংখ্যক লোক আরবী হরফে বাংলা লেখার পক্ষপাতী কাজেই আরবী হরফ প্রচলনের জন্যে কেন্দ্রীয় সরকার যে প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন তার সাথে প্রাদেশিক সরকারের উচিত ঘনিষ্ঠভাবে সহযোগিতা করা। তিনি আরও বলেন যে উর্দু যেহেতু পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা তাই সকল পাকিস্তানীকেই উর্দু শিখতে হবে।[৩৮]

৭ই ডিসেম্বর, ১৯৫০, পূর্ব-বাঙলা ভাষা কমিটি তাঁদের মূল রিপোর্টকে চূড়ান্ত আকার দেন[৩৯] এবং তাতে নিম্নলিখিত সদস্যেরা স্বাক্ষর প্রদান করেন:

১. মোহাম্মদ আকরম খাঁ

২. আবদুল্লাহ আল-বাকী

৩. মহম্মদ শহীদুল্লাহ

৪. সৈয়দ মহম্মদ আফজল

৫. হবিবুল্লাহ চৌধুরী

৬. মীজানুর রহমান

৭. সৈয়দ আবুল হাসনাত মহম্মদ ইসমাইল

৮. অজিতকুমার গুহ

৯. একিউএম আদমউদ্দিন

১০. আবুল কালাম শামসুদ্দীন

১১. শামসুন্নাহার মাহমুদ

১২. শাইখ শরাফুদ্দীন – অনৈক্যমূলক নোটসহ। [৪০]

যে দিন ভাষা কমিটির রিপোর্টটি চূড়ান্তভাবে গৃহীত হয় সেদিনই সেটি কমিটির সভাপতি মৌলানা আকরম খাঁ কর্তৃক পূর্ব-বাঙলা সরকারের শিক্ষা দফতরের সেক্রেটারীর কাছে প্রেরিত হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রাদেশিক সরকার সেটিকে জনসাধারণের অবগতির জন্যে প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকেন। কমিটি ভাষা সংস্কার ইত্যাদি প্রশ্নের বহু প্রতিক্রিয়াশীল সুপারিশ পেশ এবং অনাবশ্যক প্রশ্নের অবতারণা সত্ত্বেও তাঁরা আরবী হরফ প্রচলন ইত্যাদির বিরুদ্ধে দৃঢ় মত পোষণ করেন।

ভাষা কমিটি স্থাপনের প্রধান উদ্দেশ্য ছিলো আরবী হরফ প্রচলনের পক্ষে একটা সুপারিশ আদায় করা। ফজলে আহমদ করিম ফজলী এবং অন্যান্য ষড়যন্ত্রকারীদের সেই চক্রান্ত ব্যর্থ হওয়ায় তাঁরা ভাষা কমিটির অন্য সুপারিশগুলির প্রতি কোন গুরুত্ব আরোপের প্রয়োজন আর বোধ করেননি। উপরন্তু সেই রিপোর্টকে চেপে রেখে তার সুপারিশের বিরুদ্ধে সমগ্র পূর্ব-বাঙলায় আরবী হরফ প্রচলনের উদ্দেশ্যে সরকারীভাবে এর পরও তাঁদের উদ্যোগ তাঁরা অব্যাহত রাখেন।

পাকিস্তানে সামরিক শাসন কায়েম হওয়ার পরই সর্বপ্রথম ভাষা কমিটির এই রিপোর্ট ১৯৫৮ সালেই প্রকাশিত হয়। পূর্বে যে কারণে সরকার রিপোর্টটি প্রকাশ করেননি ঠিক সেই কারণেই আইয়ুব সরকার সেটি প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেন।

পূর্বে আরবী হরফ প্রচলন সম্ভব না হওয়ায় সরকার রিপোর্টটি প্রকৃতপক্ষে বাতিলই করে দেন। কিন্তু আইয়ুবের সময়ে আরবী হরফ প্রচলনের প্রশ্ন উত্থাপন ছিলো একেবারেই অসম্ভব, কাজেই সেই কারণে রিপোর্টটি তাঁদের পক্ষে চাপা দেওয়ার কোন কারণ ছিলো না। তাঁরা সেটির অন্যান্য প্রতিক্রিয়াশীল সুপারিশগুলিকে সেই পর্যায়ে কার্যকরী করার প্রতিই ছিলেন অধিকতর আগ্রহী এবং সেই আগ্রহের ফলেই তাঁরা রিপোর্টটিকে তাড়াতাড়ি প্রকাশ করে দেন।

আইয়ুবের স্বৈরাচারী শাসনকালে পূর্ব-বাঙলার সাংস্কৃতিক স্বাধিকারের ক্ষেত্রে যে বিভিন্ন হামলা এসেছিলো ভাষা কমিটির রিপোর্টের উপর গুরুত্ব প্রদান ছিলো তারই প্রথম পদক্ষেপ।

তথ্যসূত্র (সংশোধন করা হয়নি) – নবম পরিচ্ছেদ: পূর্ব-বাঙলা ভাষা কমিটি

১.

2.

৩.

8.

Report of the East Bengal Language Committee, 1946. Officer on Special Duty (Home Dept. ) East Pakistan Govt, Press, Dacca. P 2.

Report, P2.

পূর্বোক্ত, পৃ ২-৩। পূর্বোক্ত, পৃ ৩।

পূর্বোক্ত।

৬. পূর্বোক্ত

৭.

পূর্বোক্ত।

৮. পূর্বোক্ত, পৃ ৪।

৯.

কবি গোলাম মোস্তফা, সংগ্রহ ও সম্পাদনা ফিরোজা খাতুন, বাঙলা একাডেমী, ডিসেম্বর

১৯৬৭, পৃ ৭৮।

১০. পূর্বোক্ত, পৃ ৭৯।[১১. পূর্বোক্ত, পৃ ৫২।

12. Report, P4.

13. Report, P 4.

১৪. পূর্বোক্ত।

১৫. পূর্বোক্ত।

১৬. পূর্বোক্ত, পৃ ৬।

১৭. পূর্বোক্ত।

১৮. Report, পৃ ৭৩।

১৯. পূর্বোক্ত।

২০. পূর্বোক্ত, পৃ ৭৫।

২১. পূর্বোক্ত, পৃ ৭৬।

২২. পূর্বোক্ত, পৃ ৭৭।

২৩. পূর্বোক্ত।

২৪. পূর্বোক্ত।

২৫. পূর্বোক্ত।

২৬. পূর্বোক্ত, পৃ ৮০।

২৭. পূর্বোক্ত, পৃ ৮১।

৩২২ | বদরুদ্দীন উমর রচনাবলী খণ্ড ২

২৮. পূর্বোক্ত, পৃ ১১২।[২৯. পূর্বোক্ত, পৃ ১১৫।

৩০. পূর্বোক্ত, পৃ ৮৫।

৩১. পূর্বোক্ত।

৩২. পূর্বোক্ত, পৃ ৮৬।[৩৩. পূর্বোক্ত, পৃ ৮৬-৮৭।

৩৪. পূর্বোক্ত, পৃ ৭।[৩৫. পূর্বোক্ত।

৩৬. পূর্বোক্ত, পৃ ১০২ – ৩।

৩৭. পূর্বোক্ত, পৃ ১২।

৩৮. পূর্বোক্ত, পৃ ১৫।

৩৯. পূর্বোক্ত, পৃ ১৪।

৪০. পূর্বোক্ত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *