৪. নাজিমুদ্দীন সরকারের বিশ্বাসঘাতকতা

চতুর্থ পরিচ্ছেদ – নাজিমুদ্দীন সরকারের বিশ্বাসঘাতকতা

১. ব্যবস্থাপক সভায় খাজা নাজিমুদ্দীনের সরকারী প্রস্তাব

৬ই এপ্রিল, ১৯৪৮, মঙ্গলবার বেলা তিনটের সময় পূর্ব বাঙলা ব্যবস্থাপক সভার সে অধিবেশন বসে, তাতে প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন বাংলাকে সরকারী ভাষা ও শিক্ষার মাধ্যম করার জন্য নিম্নলিখিত প্রস্তাব পেশ করেন :

ক. পূর্ব-বাঙলা প্রদেশে ইংরাজীর স্থলে বাংলাকে সরকারী ভাষা হিসাবে গ্রহণ করিতে হইবে;

এবং

খ. পূর্ব-বাঙলার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে শিক্ষার মাধ্যম হইবে যথাসম্ভব বাংলা অথবা

প্রতিষ্ঠানগুলির অধিকাংশ স্কলারদের মাতৃভাষা।[২]

এর পর ব্যবস্থাপক সভায় কংগ্রেস দলের নেতা বসন্তকুমার দাস স্পীকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন যে, পূর্বদিন পরিষদের নেতা খাজা নাজিমুদ্দিন একটি নোটিশ মারফৎ জানিয়েছিলেন যে, তিনি সেদিন একটি প্রস্তাব উত্থাপন করবেন, কিন্তু তাঁর প্রস্তাবের বিষয়বস্তু সম্পর্কে কোনকিছু উল্লেখ করেননি। তিনি আরও বলেন যে, প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবটিকে সরকারী প্রস্তাব বলেই মনে হয় এবং সেটা সরকারী দলের অনুমোদনও নিশ্চয় লাভ করেছে। বসন্ত দাস প্রস্তাবটির বিবেচনার জন্যে সময় প্রার্থনা করে বলেন যে, এ বিষয়ে সংশোধনী প্রস্তাব আনার অধিকার তাঁদের আছে এবং তার পূর্বে মূল সরকারী প্রস্তাবটি তাঁদের পার্টি মিটিং- এ আলোচিত হওয়া প্রয়োজন।[৩]

বিরোধী দলীয় নেতার এই বক্তব্যের পর খাজা নাজিমুদ্দীন তাঁর প্রস্তাবের উপর আলোচনা পরদিন পর্যন্ত মুলতুবী রাখতে সম্মত হন। এর পর স্পীকার আবদুল করিম বলেন যে মুলতবী প্রস্তাবের সংখ্যা দুই একটি হলে কোন অসুবিধা হবে না। কিন্তু সংখ্যা যদি তার থেকে বেশী হয়, তাহলে যাঁরা সংশোধনী প্রস্তাব পেশ করতে চান, তাঁরা যেন পরদিন বেলা তিনটের মধ্যে সেগুলি দাখিল করেন।[৪]

৮ই এপ্রিল বৃস্পতিবার বেলা তিনটের সময় পরিষদের কাজ শুরু হয়। অন্যান্য কয়েকটি বিষয়ে প্রাথমিক আলোচনার পর স্পীকার আবদুল করিম সদস্যদেরকে ভাষা বিষয়ক সংশোধনী প্রস্তাবগুলি পেশ করতে অনুরোধ জানান। প্রধানমন্ত্রী নাজিমুদ্দীন তখন বলেন যে, পরিষদের সামনে পূর্বে যে প্রস্তাব তিনি উপস্থিত করেছেন, তার শেষ বাক্যে ‘স্কলার’- এর স্থলে ‘ছাত্র’ শব্দটি তিনি সংযোজন করতে চান।[৫]

২. ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের সংশোধনী প্রস্তাব

প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীনের উপরোক্ত বক্তব্যের পর বিরোধীদলীয় সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত সরকারী প্রস্তাবের উপর নিম্নলিখিত সংশোধনী প্রস্তাবটি[৬] পেশ করেন:

১. এই পরিষদের অভিমত এই যে –

ক. বাংলা পূর্ব-বাঙলা প্রদেশের সরকারী ভাষা রূপে গৃহীত হইবে;

খ. পূর্ব-বাঙলা প্রদেশে ইংরেজীর স্থলে বাংলা প্রবর্তনের জন্য আশু ব্যবস্থা অবলম্বন করিতে হইবে;

গ. পূর্ব-বাঙলার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে শিক্ষার মাধ্যম হইবে বাংলা।

২. এই পরিষদ আরও মনে করে যে, বাংলা পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিত; এবং

৩. এই পরিষদ পাকিস্তান সরকারের নিকট সুপারিশ করে যে –

ক. সর্বপ্রকার নোট ও টাকা-পয়সা, টেলিগ্রাফ, পোস্ট কার্ড, ফর্ম, বই ইত্যাদি ডাক সংক্রান্ত যাবতীয় জিনিস, রেলওয়ে টিকিট এবং পাকিস্তান সরকারের অন্য সর্বপ্রকার সরকারী ও আধা-সরকারী ফর্মে অবিলম্বে বাংলা প্রচলন করা হউক;

খ. কেন্দ্রীয় সিভিল সার্ভিসে এবং সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীতে যোগদানের জন্য সকল প্রকার প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যম এবং অন্যতম বিষয় হিসাবে বাংলা প্রবর্তন করিতে হইবে; এবং

৪. এই পরিষদ সংবিধান সভার সকল সদস্যকে অনুরোধ জানাইতেছে এবং পূর্ব বাঙলার প্রতিনিধিদের নিকট বিশেষভাবে আবেদন করিতেছে যাহাতে তাঁহারা বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করিবার জন্য সর্বপ্রকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা অবলম্বন করেন।

ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর প্রস্তাবটি পাঠ করার পরই সে সম্পর্কে কয়েকজন সদস্য আপত্তি উত্থাপন করেন। প্রথমেই আবদুল বারী চৌধুরী বলেন যে ধীরেন দত্তের উত্থাপিত সংশোধনী প্রস্তাবটি বাস্তবপক্ষে মূল প্রস্তাবের পরিবর্তে একটি সম্পূর্ণ নোতুন প্রস্তাব। কাজেই সেটি সংশোধনী প্রস্তাব হিসাবে কোনমতেই বিবেচিত হতে পারে না।[৭] শিক্ষামন্ত্রী আবদুল হামিদ বলেন যে প্রস্তাবটি সংশোধনী প্রস্তাবের আকারে কখনোই আসতে পারে না, কারণ তাতে এমন কতকগুলি বিষয়ের উল্লেখ আছে যেগুলির উপর প্রাদেশিক সরকারের কোন এখতেয়ার নেই।[৮] তাঁকে সমর্থন করে অর্থ দফতরের মন্ত্রী – হামিদুল হক চৌধুরী বলেন যে ধীরেন দত্তের প্রস্তাবটি কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে সুপারিশ আকারে একটি নোতুন প্রস্তাব হিসাবে আসতে পারে অন্য হিসাবে নয়, কারণ তার মধ্যে যে সমস্ত বিষয়ের উল্লেখ আছে সেগুলি প্রাদেশিক সরকারের আওতা বহির্ভূত।

উপরোক্ত সমালোচনার জবাবে ধীরেন দত্ত বলেন যে সহকারী প্রস্তাবটিতে বাংলা ভাষাকে শুধু পূর্ব-বাঙলার সরকারী ভাষা করার কথা বলা হয়েছে কিন্তু তাঁর প্রস্তাবে তিনি বাংলা ভাষাকে এই প্রদেশের মাতৃভাষা এবং পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার কথা বলেছেন। তাঁর সেই মূল প্রস্তাব যদি না নেওয়া হয় তাহলে সংশোধনী প্রস্তাব দেওয়ার কোন অর্থ হয় না।[১০] এর জবাবে প্রধানমন্ত্রী নাজিমুদ্দীন বলেন:

এটি একটি স্বীকৃত নীতি যে প্রাদেশিক সরকারের এলাকা বহির্ভূত কোনো বিষয়ে প্রাদেশিক পরিষদে প্রস্তাব উত্থাপন করা চলে না, তার জন্যে গভর্ণরের কাছে সরাসরি বক্তব্য পেশ করতে হয়। স্যার, আপনার হয়তো স্মরণ আছে যে আগেকার দিনে কেন্দ্রীয় সরকারের এখতেয়ারভুক্ত কোন বিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে বক্তব্য পেশ করতে হলে গভর্ণরের মাধ্যমে সেটা করার একটা নির্ধারিত পদ্ধতি ছিলো। যে সমস্ত বিষয়গুলি প্রাদেশিক একমাত্র সেগুলিই এখানে আলোচিত হতে পারে। এই প্রস্তাবটির যা বিষয়বস্তু তাতে করে এর একমাত্র আলোচনাক্ষেত্র সংবিধান সভা। সেই হিসাবে গভর্ণরের মাধ্যমে একটা আবেদন ব্যতীত অন্য কোনভাবে বিষয়টি তিনি এখানে আলোচনা করতে পারেন না।[১১]

ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের এই সংশোধনী প্রস্তাবটির বিরুদ্ধে খাজা নাজিমুদ্দীন ব্যবস্থাপক সভার এখতেয়ার এবং নির্ধারিত নীতির উল্লেখ করেন। এ প্রসঙ্গে একজন অভিজ্ঞ সংসদীয় রাজনীতিক হিসাবে তিনি পরবর্তী বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার আইনকানুন সম্পর্কেও স্পীকারের মাধ্যমে পরিষদকে স্মরণ করিয়ে দেন। এক্ষেত্রে নীতি বিষয়ে তিনি যাই বলুন রাষ্ট্রভাষা কর্ম-পরিষদের সাথে তিনি যে ৮ দফা চুক্তি সম্পাদন করেন তার তৃতীয় দফা অনুসারে তিনি এই মর্মে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন যে, পূর্ব-বাঙলা ব্যবস্থাপক সভার পরবর্তী অধিবেশনে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্যে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে সুপারিশ করে তিনি একটি সরকারী প্রস্তাব উত্থাপন করবেন। এই চুক্তিপত্রটি তিনি ১৫ই মার্চ প্রাদেশিক ব্যবস্থাপক সভায় পাঠ করবেন। এই চুক্তিপত্রটি তিনি ১৫ই মার্চ প্রাদেশিক ব্যবস্থাপক সভায় পাঠ করে শোনান। ধীরেন দত্তের প্রস্তাবটিতে ৮ দফা চুক্তি বহির্ভূত কোন বক্তব্য ছিলো না। বিতর্কের পরবর্তী পর্যায়ে কয়েকজন সদস্য চুক্তির এই দিকটি সম্পর্কে উল্লেখ করলেও কর্ম-পরিষদের সাথে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার সময় নাজিমুদ্দীনের এই নীতি জ্ঞান বিলুপ্ত হয়েছিলো কেন এ সম্পর্কে প্রশ্ন করে তাঁকে কেউই খুব বেশী বিব্রত করেননি। উপরন্তু প্রস্তাব মূল প্রস্তাবকে ছাড়িয়ে গেছে এবং তা প্রাদেশিক সরকারের এলাকা বহির্ভূত এই বলে স্পীকার সংশোধনী প্রস্তাবটিকে অগ্রাহ্য করায় এ বিষয়ে বিশেষ কোন উচ্চবাচ্য না করে সকলেই স্পীকারের সিদ্ধান্ত মেনে নেন।[১২] শুধু তাই নয় এই স্বীকৃতির পরও ধীরেন দত্তের সংশোধনী প্রস্তাবটি প্রাদেশিক সরকারের আওতা বহির্ভূত এই কথার পুনরুক্তি করে আবদুস সবুর খান এবং শামসুদ্দীন আহমদ খোন্দকার পরিষদের সময় নষ্ট করেন।[১৩]

প্রথম সংশোধনী প্রস্তাবটি নাকচ হওয়ার পর ধীরেন্দ্র দত্ত নিম্নোল্লিখিত দ্বিতীয় প্রস্তাবটি[১৪] উত্থাপন করেন:

১. এই পরিষদের অভিমত এই যে –

ক. বাংলা পূর্ব-বাঙলা প্রদেশের সরকারী ভাষা রূপে গৃহীত হইবে।

খ. পূর্ব-বাঙলা প্রদেশে ইংরাজীর স্থলে বাংলা প্রবর্তনের জন্য আশু ব্যবস্থা অবলম্বন করিতে হইবে।

গ. পূর্ব-বাঙলার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে শিক্ষার মাধ্যম হইবে বাংলা।

২. এই পরিষদ পাকিস্তান সরকারের নিকট সুপারিশ করে যে –

ক. সর্বপ্রকার নোট ও টাকা-পয়সা, টেলিগ্রাফ, পোস্টকার্ড, ফর্ম, বই ইত্যাদি ডাক সংক্রান্ত যাবতীয় জিনিস, রেলওয়ে টিকিট এবং পাকিস্তান সরকারের অন্য সর্বপ্রকার সরকারী ও আধা-সরকারী ফর্মে অবিলম্বে বাংলা প্রচলন করা হউক।

খ. কেন্দ্ৰীয় সিভিল সার্ভিসে এবং সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীতে যোগদানের জন্য সকল প্রকার প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার এবং অন্যতম বিষয় হিসাবে বাংলা প্রবর্তন করিতে হইবে।

এই দ্বিতীয় প্রস্তাবটিকেও খাজা নাজিমুদ্দীন প্রাদেশিক সরকারের এলাকা বহির্ভূত হিসাবে বিবেচনার অযোগ্য বলে বর্ণনা করেন। এ কথার পর ধীরেন দত্ত তৎক্ষণাৎ অন্য একটি সংশোধনী প্রস্তাব পেশ করতে উদ্যত হন। তাঁর এই অবস্থা দেখে হামিদুল হক চৌধুরী বলে ওঠেন যে ধীরেন বাবু তাঁর প্রস্তাবগুলির দোষত্রুটি সম্পর্কে পুরোপুরিভাবে অবহিত। কাজেই তিনি আসল সংশোধনী প্রস্তাবটির দিকে ধাপে ধাপে এগিয়ে আসছেন।[১৫]

ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত এর পর তাঁর তৃতীয় এবং শেষ সংশোধনী প্রস্তাব[১৬] পেশ করেন:

১. এই পরিষদের অভিমত এই যে—

ক. বাংলা পূর্ব-বাঙলা প্রদেশের সরকারী ভাষা রূপে গৃহীত হইবে।

খ. দুই বৎসরের মধ্যে পূর্ব বাঙলা প্রদেশে ইংরাজীর স্থলে বাংলা প্রবর্তনের জন্য আশু ব্যবস্থা অবলম্বন করিতে হইবে।

গ. পূর্ব-বাঙলার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে শিক্ষার মাধ্যম হইবে বাংলা।

ধীরেন দত্তের প্রস্তাব উত্থাপন পদ্ধতি থেকে এ কথা স্পষ্ট বোঝা যায় যে প্রস্তাবটি সম্পর্কে হামিদুল হকের বক্তব্য আংশিকভাবে সত্য। ধীরেন দত্তের প্রথম প্রস্তাবটি তিন অংশে বিভক্ত। এই তিন অংশকে তিনি এমনভাবে সাজিয়েছিলেন যাতে প্রথমবার সেটির বিরুদ্ধে আপত্তি উঠলে শেষ অংশকে তিনি বাদ দিতে পারেন এবং দ্বিতীয় প্রস্তাবের ক্ষেত্রে আপত্তি উঠলে দ্বিতীয় অংশটিকে বাদ দিয়ে প্রথম অংশটি আবার উত্থাপন করতে তাঁর কোন অসুবিধা না হয়। ধীরেন দত্তের তিন দফা প্রস্তাব এবং তার পরবর্তী পর্যায়ে কংগ্রেস দলীয় সদস্যদের একের পর এক সংশোধনী প্রস্তাব পেশের দ্বারা এটাই প্রমাণিত হয় যে, তাঁদের প্রস্তাবগুলি প্রত্যাখ্যাত হবে একথা তাঁরা পূর্বেই ধরে নিয়েছিলেন এবং সেই হিসাবে নাজিমুদ্দীন সরকারের সাথে ভাষার দাবী নিয়ে দরাদরি করার জন্যেই ধীরেন দত্ত ধাপে ধাপে তাঁর ন্যূনতম প্রস্তাবের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন। এদিক থেকে বিচার করলে প্রস্তাবটি ত্রুটিপূর্ণ এই উপলব্ধি থেকে আলোচ্য প্রস্তাবটি তিন দফায় পেশ করা হয়েছিলো, হামিদুল হকের এই যুক্তির ভ্রান্তি সহজেই বোঝা যাবে।

প্রস্তাবটি পাঠ করার পর ধীরেন দত্ত পরিষদে একটি ব্যাখ্যামূলক বক্তৃতা দেন। বাংলাকে যথাশীঘ্র দেশের শিক্ষা ও সরকারী কাজকর্মের ভাষা হিসাবে প্রচলনের যুক্তি হিসাবে তিনি বলেন:

এখন কথা হচ্ছে যে প্রস্তাব এই House-এ উত্থাপিত হয়েছে সে প্রস্তাবে কতদিনের ভিতর বাংলা ভাষা আমাদের Official language হবে তার উল্লেখ নাই। আমাদের কথা হচ্ছে অতি শীঘ্র তা করা দরকার। কারণ যদি অতি শীঘ্র তা করা না হয়, যদি তার ভিতর Dead line পড়ে যায় তাহলে ১০০ বৎসরেও বাংলা ভাষা এখানকার প্রাদেশিক ভাষার স্থান লাভ করতে পারবে না। সেইজন্য আমি বলছি যত শীঘ্র হয় তার ব্যবস্থা করুন যাতে আমরা বাংলা ভাষাকে সম্পূর্ণভাবে প্রাদেশিক ভাষায় পরিণত করতে পারি। বর্তমানে আর্জি ও শিক্ষাক্ষেত্রে সবকিছুই ইংরাজীর Through তে হয়ে আসছে। এখন হতে ইংরেজী বাদ দিয়ে বাংলা করতে হবে। অনেকে বাংলা ভালো জানেন, লিখতে পড়তে পারেন, অথচ Court কাছারীর কোন কাজের জন্য তাঁদের ইংরাজী জানা লোকের উপর নির্ভর করতে হয়। বাংলা হলে এই সব অসুবিধাগুলি দূর হতে পারে। আর একটা কথা। নিজের ভাষা আয়ত্ত করা সহজ কিন্তু পরের ভাষা ইংরাজী আমরা যতই বুঝি বা বলি আমার অভিজ্ঞতা হতে বলতে পারি যে নিজের ভাষা ছাড়া অন্য ভাষায় মনের ভাব ঠিক ঠিক ব্যক্ত করা যায় না। আমি একজন উকিল হিসাবে একথা বলতে পারি যে উকিল ও বিচার কর্তারাও মাতৃ ভাষায় বক্তৃতা ও রায় দানের ব্যবস্থা হলে ভালোভাবে কাজ করতে পারবেন। স্কুল-কলেজে শিক্ষার ভিতর দিয়ে বাংলাকে গড়ে তুলতে হবে। কাজেই বাংলা ভাষার উন্নতি ও পরিপুষ্টির জন্য একটি Committee গঠন করতে হবে যে রূপ পশ্চিমবঙ্গে গঠিত হয়েছে। যদি এ বিষয়ে ভালো ব্যবস্থা অবলম্বিত না হয় তাহলে ১০ বৎসরে কেন ১৫ বৎসরেও কোন উন্নতি হবে না। কাজে কাজেই ইংরেজী থেকে যাবে।[১৭]

বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্র ভাষা করার যুক্তি হিসাবে তিনি বলেন:

জনগণের দাবী যে প্রাদেশিক ভাষা নিয়েই পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে। জনগণের এই দাবীর পিছনে একটা যুক্তিসঙ্গত কারণ রয়েছে। আমরা যে রাষ্ট্র গঠন করছি এই রাষ্ট্রের সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানের ব্যবধান ২ হাজার মাইল। রাষ্ট্রের এক অংশের সঙ্গে অপর অংশের ব্যবধান ২ হাজার মাইল এমন ক্ষেত্রে রাষ্ট্র ভাষা দুইটি করাই সঙ্গত। প্রকৃত প্রস্তাবে পাকিস্তানের দুই Unit-এর মধ্যে এক Unit-এর ভাষা পুরোপুরি বাংলা আর এক unit- এ সিন্ধু, বেলুচিন্তান, পশ্চিম পাঞ্জাব ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে কোনটির ভাষার কোনটির সঙ্গে মিল নেই। এক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানের ৪ কোটি অধিবাসীর ভাষাকে তারা তাদের Unit-এর রাষ্ট্রভাষা দাবী করলে অন্যায় বলা যায় না। প্রথম যখন এ বিষয়ে কথা উঠেছিল তখন আমাদের প্রধানমন্ত্রী সাহেব বলেছিলেন একটা Agreement হচ্ছে যাতে বাংলাকে এই প্রদেশের রাষ্ট্রভাষা করা হয়। তিনি আরও জানান যে এটা পাকিস্তান মন্ত্রীসভাকে জানান হবে ও ব্যবস্থা করা হবে। মুসলিম লীগ পক্ষের সভ্য মিঃ আবদুল হাকিম বিক্রমপুরী এই প্রস্তাব এনেছিলেন যে বাংলা ভাষা প্রাদেশিক ভাষা হবে ও পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে। এই Agreement-এর উপর আমি সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলাম কিন্তু সে প্রস্তাব অগ্রাহ্য হয়েছে। আপনারা জানেন প্রকৃত প্রস্তাবে আবদুল হাকিম বিক্রমপুরী যে প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন তা শুধু বাংলাকে পাকিস্তানের Official language করবার জন্য। আমাদের উজিরে আজমের সেই প্রস্তাব আনা উচিত ছিলো।[১৮]

এর পর ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ফেব্রুয়ারী মাসে গণ-পরিষদের প্রথম অধিবেশনে ভাষা সম্পর্কিত বিতর্কের উল্লেখ করে বলেন:

আপনারা জানেন এটা সৰ্ববাদী সম্মত যে প্রকৃত প্রস্তাবে বাংলা ভাষাই এখানকার রাষ্ট্রভাষা আমাদের Constituent Assembly তে এই প্রস্তাব আমি গত অধিবেশনে উত্থাপন করেছিলাম। আমাদের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী সাহেব সেটা সংশোধন করে নেবেন এইটাই ছিল আমার অভিপ্রায়। আমাদের দেশের শিক্ষিতের শতকরা ৬০ জনের বেশী লোক বাংলা ভাষা পড়তে পারে অথচ ইংরাজী জানে না, উর্দু জানে না, এই প্রশ্নের উত্তরে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী সাহেব ব্যবস্থা করবো বলেছিলেন। আমি আমাদের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী সাহেবকে জিজ্ঞেস করছি যে তার কি ব্যবস্থা করা হয়েছে। Post card-এ বাংলার নাম নাই, Money order form-এ বাংলার নাম নাই, Telegraph-এ বাংলার নাম নাই, Railway ticket-এ বাংলার নাম নাই। আমি জিজ্ঞাসা করি বাংলাদেশের কত লোক বাংলা ছাড়া অন্য ভাষা বোঝে। উজিরে আজমের বোঝা উচিত ছিল যে, Currency তে বাংলা না থাকলে সাধারণ লোকের কত অসুবিধা হয়। Railway ticket নিয়েও কম অসুবিধা হবে না। একজন অজ্ঞলোক যে উর্দু জানে না এমন লোকের সংখ্যা এখানে খুব বেশী। তাদের অসুবিধার কথা একটু চিন্তা করুন।[১৯]

ধীরেন দত্ত তাঁর বক্তৃতার শেষে বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার সপক্ষে পরিষদের কাছে নিম্নলিখিত ভাষায় আবেদন করেন:

এই সংশোধনী প্রস্তাব প্রকৃত পক্ষে জনগণের নিজেদের : আমি প্রতিনিধি মাত্র। এই প্রস্তাব অনুসারে কাজ করলে জনসাধারণের যথেষ্ট কষ্টের ও অসুবিধার লাঘব হতে পারত। এগুলি Central Subject বলে উড়িয়ে দিলে চলবে না।

Provincial Administration-এর উপর যা এসে পড়েছে তার উপর Province agreement-এর জনগণের একটা দাবী আছে। এই সব প্রশ্ন উত্থাপন করলে উজিরে আজম ও মন্ত্রীবর্গ নানা কথা বলে থাকেন। আমি আপনাদের কাছে জানাতে চাই এটা সমর্থন করুন বা না করুন এটাই জনগণের দাবী। আমি পাকিস্তানের অধিবাসী হিসাবে এবং পাকিস্তানের প্রতি আমার আনুগত্য আছে বলে আমি এই অসুবিধার কথা পাকিস্তান পরিষদে পেশ করেছিলাম। আমার এর ভিতর অন্য কোন উদ্দেশ্য ছিল না। এটা আমার দাবী বলে মনে করি বলেই এই প্রশ্ন আমি উত্থাপন করেছিলাম। আমরা পাকিস্তান গ্রহণ করেছি বলে পাকিস্তান রাষ্ট্রের উপর আমাদের একটা দাবী রয়েছে। ৭ কোটি বাঙ্গালীর মধ্যে ৪ কোটির উপর পাকিস্তানে রয়েছে। তাদের রাষ্ট্রভাষা বাঙ্গালা হওয়া যুক্তিসঙ্গত এই জন্য আমি এই দাবী উপস্থিত করেছিলাম। আমি আশা করি মন্ত্রীমণ্ডলীর এবং জনগণের প্রতিনিধি যারা আছেন তাঁরা জনগণের এই দাবী সমর্থন করবেন এবং নিজেরাই এই প্রস্তাব করবেন। শুধু বাংলায় বক্তৃতা করলে চলবে না। বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করতে হবে।[২০]

বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা করার জন্যে প্রস্তাব উত্থাপনকালে পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্য জ্ঞাপন করে ধীরেন দত্তের কিছু বলা প্রয়োজন হয়েছিলো, তার কারণ গণ-পরিষদের প্রথম অধিবেশনের বিতর্ক থেকে শুরু করে কয়েকটি প্রতিক্রিয়াশীল সংবাদপত্র, মুৎসুদ্দীদের স্মারকলিপি, জিন্নাহর বক্তৃতা এবং প্রাদেশিক পরিষদের বিতর্কে ভাষা আন্দোলনকে হিন্দুদের দ্বারা প্ররোচিত এবং অন্তর্ঘাতমূলক বলে সব সময়ে অভিহিত করা হয়েছিল। অবশ্য ধীরেন দত্তর এই আনুগত্য প্রকাশের পর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন সম্পর্কে এই সাম্প্রদায়িক এবং উদ্দেশ্যেপ্রণোদিত মিথ্যা প্রচারণা যে বন্ধ হয়েছিলো তা নয়। বস্তুত এর কোন প্রভাবই সরকারী মহলের পরবর্তী সমালোচনার মধ্যে প্রতিফলিত হয়নি এবং তা না হওয়ারই কথা।

৩. অন্যান্য সংশোধনী প্রস্তাব

ধীরেনন্দ্রনাথ দত্তের বক্তৃতার পর সিলেটের মুনাওয়ার আলী একটি সংশোধনী প্রস্তাব পেশ করার সময় স্পীকার তাঁকে জিজ্ঞাসা করেন তিনি তাঁর প্রস্তাবগুলি লিখিতভাবে দাখিল করেছিলেন কি না। জবাবে মুনাওয়ার আলী বলেন যে তিনি পূর্বদিন কয়েকটি সংশোধনী প্রস্তাব লিখিতভাবে দাখিল করেছিলেন এবং অন্য একটির নোটিশও দিয়েছিলেন। তিনি আরও বলেন যে তিনি আশা করেছিলেন তাঁর প্রস্তাবগুলি মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারী পার্টি মিটিং-এ আলোচিত হবে কিন্তু বস্তুতঃপক্ষে তা হয়নি। কাজেই এখন যদি তাঁর নেতা অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী নাজিমুদ্দীন তাঁকে অনুমতি দেন তাহলে তিনি পরিষদে তাঁর সংশোধনী প্রস্তাবটি উত্থাপন করতে পারেন। মুনাওয়ার আলীর এই কথার পর পরিষদে তুমুল হাস্যধ্বনির মধ্যে স্পীকার তাঁকে বলেন, ‘আপনি দেখছি নিজের প্রস্তাব পেশ করার পরিবর্তে অন্যের দিকে তাকিয়ে আছেন।’ এর পর মুনাওয়ার আলী আর কোন উচ্চবাক্য না করে তাঁর সংশোধনী প্রস্তাবটি আনুষ্ঠানিকভাবে পেশ করা থেকে বিরত হন।[২১]

স্পীকারের নির্দেশমতো বিনোদচন্দ্র চক্রবর্তী এরপর নিম্নলিখিত সংশোধনী প্রস্তাবটি[২২] উত্থাপন করেন :

ক. পূর্ব-বাঙলা প্রদেশের সকল অফিস এবং আদালতে ইংরাজীর পরিবর্তে বাংলা সরকারী ভাষা হিসাবে গৃহীত হইবে; এবং

খ. পূর্ব-বাঙলায় বিশ্ববিদ্যালয় এবং অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে বাঙালীদের শিক্ষার মাধ্যম হইবে বাংলা।

বিনোদ চক্রবর্তী তাঁর সংশোধনী প্রস্তাবটি পাঠ করার পর বক্তৃতা প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন যে তিনি যেভাবে ভাষা বিষয়ক প্রস্তাবটি পরিষদের সামনে উপস্থিত করেছেন তাতে তাঁদের মনে যথেষ্ট আশংকার সঞ্চার হয়েছে। তিনি মন্ত্রীসভার উদ্দেশ্যের সততা সম্পর্কে তাঁদের সন্দেহের অবসান ঘটানোর জন্যে নাজিমুদ্দীনের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি সরকারী প্রস্তাবে ‘যথাসম্ভব’ কথাটির প্রতি বিশেষভাবে জোর দিয়ে বলেন যে এই ধরনের একটা অস্পষ্ট প্রতিশ্রুতি রক্ষার জন্যে সরকার যে কোন আশু ব্যবস্থা অবলম্বন করবেন সে ভরসা তাঁদের নেই। ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে সরকারী মনোভাবই যে তাঁদের এই আশংকার মূল কারণ একথাও তিনি তাঁর বক্তৃতায় উল্লেখ করেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন:

এই বাংলা ভাষার আন্দোলন অধিবেশন হবার পূর্ব হতে যখন আরম্ভ করা হয়েছিল, তখন আপনারা জানেন, যে সকল যুবক ও নেতৃবৃন্দ এই আন্দোলনের পুরোভাগে ছিলেন, তাঁরা ছিলেন সকলেই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের; এবং মুক্ত নাগরিক হিসাবে সম্পূর্ণভাবে এটা সমর্থন করবার ইচ্ছা আরও অনেকে প্রকাশ করেছিলেন। আমরা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অনেকে নানা দিক বিচার করে এর সঙ্গে যোগ দিতে পারি নাই। তাদের আমরা কোন সাহায্য করি নাই, তবুও তাদের নিন্দার ভাগী করা হয়েছে। যদি আমরা সর্ব সম্প্রদায় এই আন্দোলনকে আরও সাহায্য করতাম তাহলে আন্দোলন আরও বড় হয়ে উঠতো। তথাপিও প্রধানমন্ত্রী মহাশয় ঘোষণা করেছিলেন এই আন্দোলনের পিছনে অনেকের দুরভিসন্ধিমূলক সম্পর্ক ছিল।[২৩]

বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে সরকারী কর্মচারী এবং মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারী পার্টির ষড়যন্ত্রের বিষয়ে উল্লেখ করে বিনোদ চক্রবর্তী বলেন:

আপনারা জানেন এই বাংলা ভাষার প্রচলনের বিরুদ্ধে অনেক গোপন ষড়যন্ত্র হয়েছিল এবং যারা এই পথে বাধা সৃষ্টি করেছিল তারা কেবলমাত্র এটা নিজেদের মধ্যে আবদ্ধ রাখে নাই, সরকারী কর্মচারীদেরও প্রভাবান্বিত করেছিল এবং এই যুক্তিসঙ্গত আন্দোলন যারা করেছিলেন তাদেরও নির্যাতন ভোগ করতে হয়েছিল। এর দায়িত্বও কারো নিজের একার নয়, সমস্ত দলের ও নেতার প্রতি দায়িত্ব রয়েছে। আমরা খবরের কাগজে দেখেছি (১লা এপ্রিল) যে এই প্রদেশের ভাষা বাংলা হবে এবং পাকিস্তানেরও রাষ্ট্রভাষা করবার যে কথা হয়েছিল তা করা হবে না – এটাই লীগ দলের সভায় স্থির হয়েছে।[২৪]

জিন্নাহর পূর্ব-বাঙলা সফরের পর ভাষা সম্পর্কে পূর্ব-বাঙলা মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারী পার্টির ৩১শে মার্চ তারিখে অনুষ্ঠিত একটি বৈঠকে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে কেন্দ্রের কাছে সুপারিশের বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত হয়। জিন্নাহ কর্তৃক বাংলার দাবীকে অস্বীকার এবং উর্দুই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হওয়ার যোগ্য এই ঘোষণার পর পার্লামেন্টারী পার্টি রাষ্ট্র ভাষা সম্পর্কে প্রাদেশিক পরিষদে কোন সরকারী প্রস্তাব উত্থাপন করার পূর্ব সিদ্ধান্ত বাতিল করে। বিনোদ চক্রবর্তীর বক্তৃতায় তিনি এই ঘটনাটিরই উল্লেখ করেছেন। এ ছাড়া চীফ সেক্রেটারী আজিজ আহমদ, শিক্ষা সেক্রেটারী ফজলে আহমদ করিম ফজলী প্রভৃতি আমলাদের খোলাখুলি বাংলা বিরোধিতার কথা ভাষা আন্দোলনের সময় কারো অজানা ছিলো না। সরকারী কর্মচারী হওয়া সত্ত্বেও তাঁরা ভাষা এবং অন্যান্য সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে অনেক সময় সক্রিয় এবং সরাসরিভাবে তাঁদের মতামত বিভিন্ন জায়গায় ব্যক্ত করেন। এ বিষয়ে সরকারী নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে তাঁদের ভূমিকা খুব উল্লেখযোগ্য ছিলো। এইসব সমস্যার প্রতি লক্ষ্য রেখে বিনোদ চক্রবর্তী তাঁর বক্তৃতার শেষে বলেন:

আজ যদি নাগরিক অধিকার ও সুখ সুবিধা ক্ষেত্রে বাংলার স্বাতন্ত্র্য রোধ করা হয় তাহলে আমরা কোন কাজে অগ্রণী না হয়ে সকলের পিছনে পড়ে থাকবো। আর পাকিস্তানের এই অংশে দুর্গতি বেড়েই চলবে এবং পাকিস্তানের উন্নতিকর কাজে জনগণের মনোবল ক্ষুণ্ণ হবে। পাকিস্তান শাসনকার্যের যে সব কর্মচারী প্রয়োজন হবে তার অধিকাংশ সংখ্যানুপাতে বাংলা থেকেই নেবার প্রয়োজন হবে এবং সকল কাজে লোক সংখ্যারই অনুপাতে ও দায়িত্বে বাংলার স্থান থাকবে এটাও আমরা দেখতে চাই। আমাদের দায়িত্ব বিরাট, কর্তব্য মহান, সেই কর্তব্য ও দায়িত্ব আমাদের পালন করতে হবে। রাষ্ট্রভাষা বাংলা না হওয়ার কারণ সত্যই অনুধাবন করতে পারি না। যুক্তিসঙ্গত কোন কারণ থাকলে না হয় বুঝতে পারতাম, কিন্তু তা কিছুই দেখি না। ইংরাজীর কোনই প্রয়োজন নাই। এখন বাংলার প্রয়োজন এত বেশী এবং তা কথায় বলে শেষ করা যায় না। বাংলা এ প্রদেশের ভাষা হবেই এটা অবশ্য

খুব আনন্দের কথা। আজ আর বাংলাকে অবহেলা করলে চলবে না। আমরা যাতে ঠিকমতো আমাদের দায়িত্ব পালন করি সেই আলোচনাই করবো। নেতৃস্থানীয় যাঁরা আছেন তাঁরা এ বিষয়ে অবহেলা করছেন। সমস্ত পাকিস্তানে বাংলা যাতে অন্যতম রাষ্ট্র-ভাষারূপে স্থান পায় তার জন্য আমাদের চেষ্টা করা উচিত।[২৫]

বিনোদ চক্রবর্তীর বক্তৃতায় এই পর্যায়ে আবদুস সবুর খান তাঁকে বাধা দিয়ে স্পীকারকে বলেন যে ধীরেন দত্তের প্রধান সংশোধনী প্রস্তাবকে উত্থাপন করতে না দিয়ে তিনি পরিষদে ভাষা বিষয়ক আলোচনার গণ্ডী প্রকৃতপক্ষে নির্ধারণ করে দিয়েছেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও দেখা যাচ্ছে যে তিনি সে বিষয়ে সদস্যদেরকে যথেচ্ছ আলোচনার সুযোগ দান করছেন। এর পর তিনি সদস্যদেরকে কেবলমাত্র প্রাদেশিক ভাষা সম্পর্কেই নিজেদের বক্তব্য সীমাবদ্ধ রাখতে অনুরোধ জানান। বিনোদ চক্রবর্তীর বিরুদ্ধে তিনি অভিযোগ করেন যে তিনি নিজের বক্তৃতায় পাকিস্তানের এলাকা বহির্ভূত বিষয়ের উল্লেখ করেছেন। সমগ্র বক্তৃতাটি শেষ দিকে নাগরিক অধিকার ও সুখ সুবিধার ‘ক্ষেত্রে বাঙলার স্বাতন্ত্র’ রক্ষার কথা ছিল। এ কারণেই সবুর খান বিনোদনো চক্রবর্তীর বক্তৃতা সম্পর্কে উপরোক্ত অভিযোগ করেন। অন্যথায় সমগ্র বক্তৃতার মধ্যে পাকিস্তানের এলাকা বহির্ভূত অন্য কোন বিষয়ে বিন্দুমাত্র উল্লেখ ছিলো না। সবুর খানের আপত্তি উত্থাপনের পর স্পীকারের নির্দেশ অনুযায়ী বিনোদ চক্রবর্তী সামান্য দুই এক কথা বলে তাঁর বক্তৃতা শেষ করেন।[২৬]

স্পীকার আবদুল করিম এর পর সদস্যদেরকে বলেন যে তাঁরা যেন সেই সব সংশোধনী প্রস্তাবগুলি প্রথমে পেশ করেন যেগুলি মূল সরকারী প্রস্তাবটির প্রতিকল্প। সেগুলি আলোচনার পর অন্য সংশোধনী প্রস্তাবগুলি উত্থাপন করার জন্যে তিনি তাঁদেরকে অনুরোধ করেন। প্রধানমন্ত্রী নাজিমুদ্দীন এ বিষয়ে আপত্তি জানিয়ে স্পীকারকে বলেন যে সমস্ত সংশোধনী প্রস্তাবগুলি উত্থাপিত হওয়ার পর তিনি সেগুলির জবাব দিতে চান। স্পীকার তাঁর এই প্রস্তাবে আপত্তি না করায় একে একে অন্য সংশোধনী প্রস্তাবগুলি পেশ করা হয়।

বিনোদ চন্দ্র চক্রবর্তীর পর আবদুল বারী চৌধুরী যে সংশোধনী প্রস্তাব পেশ করেন তার মধ্যে দুই একটি সামান্য শব্দগত পরিবর্তন ব্যতীত উল্লেখযোগ্য কিছু ছিলো না। তবে প্রস্তাবটি পরিষদে পাঠ করার পর ইংরেজীতে একটি সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা দানকালে তিনি বলেন, উদ্দেশ্যের সততা সম্পর্ক কোন প্রকার সন্দেহ প্রকাশ না করে তিনি শুধু একথা বলতে চান যে সরকারী প্রস্তাবটি খুব অস্পষ্ট এবং অনির্দিষ্ট। বাংলা যে পূর্ব-বাঙলার সরকারী ভাষা হবে তা প্রস্তাবটি থেকে ভালোভাবে বোঝা যায় না। তাতে শুধুমাত্র এটুকুই বলা হয়েছে যে ভবিষ্যতে কোন এক সময়ে ইংরাজীকে তুলে দিয়ে তার স্থানে বাংলাকে পূর্ব-বাঙলার সরকারী ভাষা করা হবে।[২৭]

আবদুল বারী চৌধুরীর পর প্রভাসচন্দ্র লাহিড়ী যে সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপন করেন তার মধ্যে তিনিও সরকারী প্রস্তাবের মধ্যে ‘যথাসম্ভব’ কথাটি তুলে দিতে বলেন। তিনি অন্যান্য কয়েকটি সংশোধন ছাড়াও প্রস্তাবটির (খ) ধারার পর নিম্নলিখিত ধারাটি যোগ দেওয়ার প্রস্তাব[২৮] করেন:

(গ) এই পরিষদ আরও মনে করে যে (১) পাকিস্তান রাষ্ট্রের মুদ্রা, টেলিগ্রাম এবং ডাক সংক্রান্ত যাবতীয় জিনিস – যেমন পোস্ট কার্ড, ফরম, বই, রেলওয়ে টিকিট এবং অন্যান্য সরকারী ও আধা-সরকারী ফর্মে বাংলার ব্যবহার অবিলম্বে চালু করিতে হইবে এবং (২) কেন্দ্রীয় সিভিল সার্ভিস এবং সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর সমস্ত প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যম এবং অন্যতম বিষয় হিসাবে বাংলা প্রবর্তন করিতে হইবে।

এবং গ (১) ও গ (২) ধারা সম্বলিত প্রস্তাবটির এই অংশ যাহাতে পাকিস্তান সরকার কার্যকর করিতে পারেন সেই উদ্দেশ্যে তাঁহাদিগকে এ বিষয়ে অবগত করাইবার জন্য পূর্ব বাঙলা সরকারের নিকট অনুরোধ জানাইতেছে।

প্রস্তাবটির পাঠ শেষ হওয়ার পর আবদুল বারী চৌধুরী বলেন যে সংশোধনী প্রস্তাবটি কেন্দ্রীয় সরকারের আওতাভুক্ত এবং সেই হিসাবে সেটিকে অগ্রাহ্য করা উচিত।[২৯] এখানে উল্লেখযোগ্য যে প্রভাস লাহিড়ীর পূর্বে তিনি নিজের সংশোধনী প্রস্তাবের উপর বক্তৃতা প্রসঙ্গে সরকারী প্রস্তাবটিকে ‘অস্পষ্ট এবং অনির্দিষ্ট’ বলে বর্ণনা করেন। প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবটি অস্পষ্ট ছিলো এ জন্যে যে তার মধ্যে কিভাবে, কোথায় এবং কতদিনের মধ্যে বাংলা পূর্ব-বাঙলার সরকারী ভাষা হিসাবে প্রবর্তিত হবে সে সম্পর্কে কোন উল্লেখ ছিলো না। এই সমস্ত কথাই যখন প্রভাস লাহিড়ী তাঁর প্রস্তাবটিতে উল্লেখ করলেন তখন আবদুল বারী চৌধুরী সেগুলিকে কেন্দ্রীয় সরকারের আওতাভুক্ত এই কথা বলে আবার তার বিরোধিতা করলেন।

আবদুল বারী চৌধুরীর এই আপত্তির জবাবে এবং প্রভাসচন্দ্র লাহিড়ীর সংশোধনী প্রস্তাবের সমর্থনে কংগ্রেস সংসদীয় দলের নেতা বসন্তকুমার দাস বলেন যে প্রস্তাবিত (গ) ধারাটি কিছুতেই অগ্রাহ্য করা চলে না, কারণ প্রস্তাবটির প্রথম অংশে বলা হচ্ছে যে বাংলা হবে প্রদেশের সরকারী ভাষা এবং সেই হিসাবে প্রথম অংশটি থেকেই (গ) ধারাটি সরাসরিভাবে এসেছে। তিনি আরও বলেন যে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করা হোক এ বক্তব্য তাঁরা এই প্রস্তাবটিতে পেশ করেননি। তাঁরা শুধু এ কথাই বলেছেন যে মুদ্রা এবং অন্যান্য সবকিছুতেই বাংলা ভাষাকে ব্যবহার করা হোক। বাংলা এই প্রদেশের সরকারী ভাষা হবে তার অর্থই হলো এই প্রদেশের সাধারণ মানুষ যাতে মুদ্রা ইত্যাদির উপর লেখা বুঝতে পারে তার ব্যবস্থা করা। সেজন্যেই এই প্রদেশে যে মুদ্রা ব্যবহৃত হবে তাতে বাংলাতে সবকিছু লেখা থাকা দরকার। পাকিস্তান সরকার যাতে সে ব্যবস্থা করতে পারেন তার জন্যেই তাঁদেরকে এ বিষয়ে অবহিত করার উদ্দেশ্যে প্রাদেশিক সরকারকে অনুরোধ জানানো হয়েছে। কাজেই সংশোধনী প্রস্তাবটি সম্পূর্ণভাবে প্রাসঙ্গিক।[৩০]

শিক্ষামন্ত্রী আবদুল হামিদ এর পর বলেন যে বসন্তবাবু নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেননি যে প্রস্তাবটিতে ‘বাংলাকে অবিলম্বে সকল প্রকার মুদ্রায় ব্যবহার করা হোক’ একথা বলা হয়েছে। এবং যে রকম কোন প্রস্তাব তারা কিছুতেই গ্রহণ করতে পারেন না।[৩১]

বসন্তকুমার দাস এর জবাবে বলেন মন্ত্রী মহোদয়েরও উচিত প্রস্তাবটির শেষের দিকে কি আছে সেটা দেখা। কারণ সেখানে প্রস্তাবটিকে পাকিস্তান সরকারের কাছে পাঠিয়ে সেটি কার্যকর করার জন্যে তাঁদেরকেও অনুরোধ জানানো হয়েছে।[৩২] কিন্তু তা সত্ত্বেও মন্ত্রী আবদুল হামিদ বলেন যে যতক্ষণ পর্যন্ত ইংরাজী ‘shall’ কথাটি প্রস্তাবে আছে ততক্ষণ সেটিকে বাধ্যতামূলক বলেই ধরে নিতে হবে।[৩৩]

এর পর বসন্ত দাস বলেন নাজিমুদ্দীনের প্রস্তাবটিতে ‘সরকারী ভাষা’ কথাটি অত্যন্ত অস্পষ্ট। তার অর্থ অনেক কিছুই হতে পারে। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী পরিষদে কোন ব্যাখ্যাও উপস্থিত করেননি। কাজেই প্রভাস লাহিড়ীর সংযোজিত ধারাটি তাঁর বক্তব্যের একটি অনুসিদ্ধান্ত মাত্র।[৩৪] স্পীকার শেষ ধারাটি সম্পর্কে তাঁকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন যে, সংশোধন প্রস্তাবটির (গ) (১) এবং (গ) (২) অংশটি যাতে পাকিস্তান সরকার কার্যকর করতে পারেন সেজন্যে তাঁদেরকে সে বিষয়ে জানানোর উদ্দেশ্যে তাতে শুধু পূর্ব-বাঙলা সরকারকে অনুরোধ করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকার ইচ্ছা করলে তা কার্যকর করতেও পারেন, না করতেও পারেন। এটা একটা অনুরোধ মাত্র। এর মধ্যে কোন বাধ্যতা নেই।[৩৫] কিন্তু খাজা নাজিমুদ্দীন তাঁর এই বক্তব্যের বিরোধিতা করে বলেন যে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে কোন সুপারিশ করতে হলেই সেটা গভর্ণরের মাধ্যমে করতে হবে। পরিষদে সাধারণভাবে কোন প্রস্তাব পাস করে তা করা যাবে না।[৩৬]

বিতর্কের এই পর্যায়ে নাজিমুদ্দীন আবার এই প্রসঙ্গ উত্থাপন করায় বসন্তকুমার দাস তাঁকে স্মরণ করিয়ে দেন যে তিনি রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির সাথে যে চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছিলেন তাতে তিনি নিজের কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে এই বিষয়ে সুপারিশ করতে সম্মত হয়েছিলেন।[৩৭] কিন্তু নাজিমুদ্দীন বিরোধীদলের নেতার এই বক্তব্যকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে, আবার বলেন যে সুপারিশ করতে হলে তা গভর্ণরের মাধ্যমেই করতে হবে।[৩৮] প্রভাসচন্দ্র লাহিড়ীর সংশোধনী প্রস্তাবের উপর কিছুক্ষণ এই বিতর্কের পর তিনি নিজের প্রস্তাবটি ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলেন:

আমার মনে হচ্ছে কিছুদিন আগে যখন ভাষা সমস্যা নিয়ে আন্দোলন হয়েছিল সেই সময় আমাদের প্রধানমন্ত্রী মহাশয় একটা Agreement আমাদের পড়িয়ে শুনিয়েছিলেন তাতে আমরা আশান্বিত হয়েছিলাম। এখন যে প্রস্তাব উপস্থিত হয়েছে তাতে দেখছি Agreement- এর অনেক কথা প্রস্তাবের ভিতর নেই। আমি এই জিনিসই পরিষ্কার করে প্রকাশ করতে চাই। Official language of the province of East Bengal, in all offices of Government and semi-Government institutions and in all Courts, including the High Court of the Province. এখন যে সমস্ত গভর্ণমেন্ট Institution ও অফিস আছে এবং semi-Gvernment Institution যথা – District Board, Municipality এসব জায়গায়ও বাংলা ভাষা প্রচলিত হোক এইজন্য semi- Government কথাটি যোগ করতে বলছি। এবং High Court ও অন্যান্য Court এ বাংলা ভাষা প্রচলন করতে হবে কিন্তু High Court-এর Order না হলে অন্যান্য Court এ হতে পারে না। High Court থেকে যদি অন্যান্য Court-এ Direction দেয় তাহলে সেখানে বাংলা ভাষার রায় লেখা ইত্যাদি হতে পারে। (b) Clause-এ আছে As far as possible যার বাংলায় অর্থ হয় যথাসম্ভব – আমি এই কথাটি উঠিয়ে দিতে চাই। এবং তার পরে একটি alternative প্রস্তাব আছে যে-প্রদেশের ভিতর যেখানে অবাঙ্গালী ছাত্রের সংখ্যা বেশী সেখানে তাদের মাতৃভাষা গ্রহণ করা হবে আমি এই কথাটা বা এ জায়গাটা Amend করতে চাই। এতে দেখা যাচ্ছে কোন Institution এ যদি Majority ছাত্রদের ভাষায় শিক্ষার ব্যবস্থা হয় এবং সেখানে যদি অল্প সংখ্যক বাঙ্গালী ছাত্র থাকে তাহলে তাদের

শিক্ষার কোন ব্যবস্থা হবে না। যাতে উভয়ের শিক্ষা হয় তার ব্যবস্থা করা হোক।[৩৯] প্রভাসচন্দ্র লাহিড়ীর পর যতীন্দ্রনাথ ভদ্র তাঁর সংশোধনী প্রস্তাব পেশ করেন। এই প্রস্তাবে পূর্ববর্তী প্রস্তাবগুলির থেকে নোতুন কোন কথা বলা হয়নি। কয়েকটি শব্দ পরিবর্তনের সুপারিশ করা হয়েছিলো মাত্র। তাঁর এই সংশোধনী প্রস্তাবের উপর বক্তৃতা প্রসঙ্গে যতীন্দ্ৰনাথ ভদ্র বলেন:

এই Resolution খুব আশাপ্রদ হলেও এর ভিতর যে একটি কথা as far as possible আছে সেটি বাদ না দিলে অনেক অসুবিধা আসবে। ঐ as far as possible কথার ধূম্রজালে অনেক কিছু লুকায়িত থাকতে পারে বলে সন্দেহ হওয়া অহেতুক নয়, তাই আমি প্রস্তাব করছি যে ঐ As far as possible এর জায়গায় Immediately কথা লাগানো হোক। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মহাশয়ের প্রস্তাব গ্রহণ করতে কোন আপত্তিকর কারণ থাকতে পারে না এবং এটা ঠিক কাজই করা হবে। এই বাংলাদেশে অবাঙ্গালী আসবে না বা থাকবে না তা আমি বলছি না। কিন্তু যেখানে শতকরা ১০০ জন বাঙ্গালী সেখানে বাংলা ভাষা না করার কোন যৌক্তিকতা থাকতে পারে না। সেইজন্য আমি আশা করি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মহাশয় আমার প্রস্তাব গ্রহণ করবেন।[৪০]

এর পর অমূল্যচন্দ্র অধিকারী এবং সুরেশচন্দ্র দাসগুপ্ত যথাক্রমে তাঁদের সংশোধনী প্রস্তাব পেশ করেন। তাদের প্রস্তাবগুলিকে মোটামুটিভাবে পূর্ববর্তী প্রস্তাবগুলির পুনরুক্তিই বলা চলে। সুরেশ দাসগুপ্ত তাঁর সংশোধনী প্রস্তাবে বাংলাকে পূর্ব-বাঙলার সরকারী ও শিক্ষার ভাষা হিসাবে ১৯৪৮-এর জুন মাসের মধ্যে প্রচলনের কথা বলেন। অমূল্য অধিকারী তাঁর প্রস্তাবটি পাঠ করার পর কোন বক্তৃতা দেননি। সুরেশ দাসগুপ্ত তাঁর সংক্ষিপ্ত বক্তৃতায় ভাষা বিষয়ক প্রস্তাবটি পরিষদে উত্থাপন করার জন্যে প্রধানমন্ত্রী নাজিমুদ্দীনকে অভিনন্দন জানিয়ে তার পর বলেন:

কিন্তু বাংলা ভাষাকে আমরা যাতে তার যথাযোগ্য স্থানে প্রতিষ্ঠিত করতে পারি এইজন্য বলছিলাম প্রস্তাবের মধ্য হতে As far as possible কথাটি তুলে দিন। এর দুইটি কারণ রয়েছে। একটি হচ্ছে ইংরাজীর কোন কথা আমরা আনবো না। কোন দিন বাংলা ইংরাজীর সমান পর্যায়ে আসবে তা আমরা বিচার করবো না, তাহলে মাতৃভাষার অবহেলা করা হবে। আর দ্বিতীয় কথা হচ্ছে যে English will be replaced by Bengali এমন কোন কথা প্রস্তাবে থাকবে না। এই প্রকারের কথায় ভয় হয়। অনেক লোক এদেশে আসে বাইরে হতে তারা এই সুযোগে বাংলা শিখবে না। মাইনে নেবে এদেশ হতে আর এদেশের ভাষাকে অবহেলা করবে। … রাষ্ট্রের সকল প্রয়োজনীয় কাজে বাংলার প্রচলন করতে হবে আদালতে বাংলার প্রচলন করতে হবে। স্কুলে বাংলার প্রচলন করতে হবে, আইন বাংলা ভাষায় তৈরী করতে হবে। আমরা চাই যাবতীয় কিছু বাংলা ভাষায় করে দেওয়া হোক এবং তা As far as possible নয় যত শীঘ্র সম্ভব করুন।[৪১]

সুরেশ দাসগুপ্তের এই বক্তৃতার পর গোবিন্দলাল ব্যানার্জী একটি সংশোধনী প্রস্তাবে এক বৎসরের মধ্যে বাংলা ভাষা প্রচলনের কর্মসূচীকে কার্যকর করার প্রস্তাব করেন।

প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাব প্রসঙ্গে তিনি বলেন:

যে প্রস্তাব তিনি এনেছেন তাতে মনে সন্দেহ জাগছে তাই এটা সংশোধন করে আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করছি যে এক বৎসরের মধ্যে বাংলা ভাষার প্রচলন হবে তার চেষ্টা করতে হবে। এ সম্পর্কে আমাদের আরও একটি সন্দেহ জাগছে এবং তাতে গভর্ণমেন্টের কাজের অসুবিধা থেকে যাবে এইজন্য বলছি যে সরকারী কর্মচারীদের ভিতর অনেক non- Bengali offcer আছেন তাঁরা যে দেশের সেবা করছেন সেই দেশের ভাষাও তাঁদের শিখতে হবে। তা না হলে তাদের অসুবিধা হবে। কারণ আমাদের দেশের একটি ভাষাকে নির্দিষ্ট ভাষায় পরিণত করতে হবে অবশ্য বাংলা ভাষার সাথে অন্য ভাষাও থাকবে। আর একটি কথা – রাষ্ট্রনীতির দিক হতে আমরা স্বাধীন হয়েছি কিন্তু পাকিস্তানের অধিবাসী আজ পর্যন্ত তার তাৎপর্য ভালো করে উপলব্ধি করতে পারছে না। যারা পাকিস্তান অর্জন করছে তারা কতকগুলি জিনিস আজও বুঝতে পারছে না। তা শুধু আইনেই লেখা রয়েছে। যে দেশে তাদের জন্ম যে ভাষায় তারা ছোটবেলা হতে কথা বলতে শিখেছে সেই ভাষাকে যদি তারা নিজেদের ভাষারূপে গ্রহণ করবার অধিকার না পায় তাহলে তারা স্বাধীনতার কি অর্থ বুঝবে। সেইজন্য আমার সংশোধনী প্রস্তাব যে এক বৎসরের মধ্যে বাংলা ভাষার প্রচলন করবার ব্যবস্থা করা হোক।[৪২]

গোবিন্দ ব্যানার্জীর এই বক্তৃতার পর আহমদ আলী মৃধা প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবের (ক) ধারার শেষে ‘এবং যত শীঘ্র বাস্তব অসুবিধাগুলি দূর করা যায় তত শীঘ্র তাহা কার্যকর করা হইবে’ এই অংশ যোগ দেওয়ার কথা বলে একটি সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপন করেন।[৪৩] প্রস্তাবটি কার্যকর করার ক্ষেত্রে বিশেষ কতকগুলি অসুবিধার উল্লেখ করে তিনি বক্তৃতা প্রসঙ্গে বলেন:

বিজ্ঞানে বাংলা ভাষায় বই লিখতে এখনও অনেক সময়। ডাক্তারী পড়তে ইংরেজী ছাড়া উপায় দেখা যায় না। ইঞ্জিনিয়ার ইংরাজীতে পড়ে, ইংরাজীতে ভাবে, ইংরাজীতে গড়ে, ইংরাজীতে ভাঙ্গে, বাংলায় এইসব করতে হবে। দেখুন ঐ ঘড়িটি’ উহার ‘ডায়ালে’ লিখতে হবে বাংলার ১, ২, ৩ তবেই বাংলা ভাষা সমৃদ্ধ হবে। বিভিন্ন জগদ্দল পাথর আমাদের বুকের উপর থেকে নেমে গেলে আমরা মানুষ হয়ে দাঁড়াতে পারবো। ধীরেন বাবুর সবুর হয় না? এইসব বাধা যতদূর সম্ভব দূর না করে বাংলা ভাষা রাষ্ট্রভাষারূপে গ্রহণ করা যায় না। এই বলে আমার সংশোধনী প্রস্তাব পেশ করছি। আমি আশা করি আমাদের নেতা এটি গ্রহণ করবেন। 88

আহমদ আলী মৃধার পর রাজেন্দ্রনাথ সরকার একটি সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপন করে সেই প্রসঙ্গে বলেন:

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মহাশয় সময় উপযোগী এই প্রস্তাব এনেছেন বলে তিনি ধন্যবাদার্হ। কিন্তু এই প্রস্তাব যেভাবে আমাদের সামনে আনা হয়েছে তাতে অনেক সুবিধা আছে। আমরা জানি বাংলা ভাষার মধ্যে বহু রকম শব্দ আমরা গ্রহণ করেছি – মন্ত্রী মহাশয় বললেন, বাংলা ভাষা আরও অনেক শব্দ হজম করেছে এবং এখনও অনেক করতে হবে। সত্যই আমাদের ভাষার মধ্যে অনেক ইংরাজী, আরবী, উর্দু, ফার্সী ও অন্যান্য ভাষা এসে পড়েছে। সেগুলি ব্যবহার করা আমাদের অভ্যাস হয়ে গিয়েছে। সেইজন্য বলছি এই প্রস্তাব যদি সমর্থিত হয় তাহলে গভর্ণমেন্টের পক্ষ থেকে কোন কার্যকরী প্রস্তাব ঘোষণা করা হোক।[৪৫]

এর পর মনোরঞ্জন ধর তাঁর সংশোধনী প্রস্তাবে ডাক টিকিট, মুদ্রা, রেলওয়ে টিকিট, সরকারী ফর্ম ইত্যাদিতে বাংলা ব্যবহারের জন্যে পাকিস্তান সরকারের সাথে আলোচনার জন্যে পূর্ব-বাঙলা সরকারকে অনুরোধ জানান এবং সেই সাথে মূল প্রস্তাবটি থেকে ‘যথাসম্ভব’ কথাটি তুলে দেওয়ারও প্রস্তাব করেন।[৪৬]

মনোরঞ্জন ধরের পর মুদাব্বের হোসেন চৌধুরী একটি সংশোধনী প্রস্তাবে পূর্ববর্তী সংশোধনী প্রস্তাবগুলির মতই ‘যথা সম্ভব’ তুলে দেওয়ার কথা বলেন। এ ছাড়া তিনি আরও প্রস্তাব করেন যে পূর্ব-বাঙলার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে শিক্ষার মাধ্যম হবে বাংলা, উর্দু অথবা ছাত্রছাত্রীদের মাতৃভাষা। এই প্রসঙ্গে তিনি নিজের বক্তৃতায় বলেন যে, ৫১/৪৯ এই সংখ্যাধিক্য একটা ভয়ানক অনিশ্চিত ব্যাপার সেই জন্যে তিনি ‘অধিকাংশ’ কথাটি তাঁর সংশোধনী প্রস্তাব থেকে বাদ দিয়েছেন। তিনি বলেন যে, মণিপুরী চা বাগানগুলিতে তিনি সেখানকার ছাত্রদের মাতৃ ভাষায় তাদেরকে শিক্ষাদানের ব্যবস্থা দেখেছেন। তিনি এই ব্যবস্থাকে পরিবর্তন করার বিরোধী। ঢাকাতেও কোন কোন অঞ্চলে উর্দু ব্যবহৃত হয়।[৪৭]

এই কথা বলার সময় পরিষদে ‘না, না’ ধ্বনি ওঠে। এর পূর্বেও মুদাব্বের হোসেন যখন ইংরেজীতে তাঁর বক্তৃতা শুরু করেন তখন ধীরেন দত্ত তাঁকে বাংলাতে তাঁর বক্তব্য পেশ করার জন্যে বলায় কিছুটা উত্তেজনার সৃষ্টি হয়।[৪৮]

এর পর আবদুল বারী চৌধুরী তাঁর সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপনের পর একটি সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা দেন। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু ছিলো না।[৪৯] আবদুল বারী চৌধুরীর সংশোধনী প্রস্তাবটিই সেদিনকার পরিষদে প্রধানমন্ত্রী নাজিমুদ্দীনের প্রস্তাবের উপর সর্বশেষ সংশোধনী প্রস্তাব। এর পর সরকারী প্রস্তাবের কয়েকটি দিক এবং সাধারণভবে ভাষা প্রশ্নের উপরে পরিষদের কয়েকজন সদস্য তাঁদের বক্তব্য পেশ করেন। সর্বশেষ সংশোধনী প্রস্তাবটির পর পূর্ণেন্দু কিশোর সেনগুপ্ত খুব সংক্ষেপে দুই এক কথা বলার পর শামসুদ্দীন আহমদ ইংরেজীতে তাঁর বক্তৃতা শুরু করেন। পরিষদে ভাষা বিষয়ক প্রস্তাবটি উত্থাপনের জন্যে নাজিমুদ্দীনকে অভিনন্দন জ্ঞাপনের পর তিনি বলেন যে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সাথে প্রধানমন্ত্রী যে আট দফা চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছিলেন সেই চুক্তির শর্তগুলি তাঁর প্রস্তাবে কয়েকটি স্থানে পরিবর্তন করা হয়েছে। সেই চুক্তির চতুর্থ ধারায় ছিল যে প্রধানমন্ত্রী পরিষদে একটি সরকারী বিল উত্থাপন করবেন। শামসুদ্দীন আহমদের এই কথার প্রতিবাদ করে নজিমুদ্দীন বলেন যে, তিনি যা বলছেন তা সঠিক নয়। মোদাব্বের হোসেন প্রধানমন্ত্রীকে এই যুক্তিতে সমর্থনের চেষ্টা করেন যে পরিষদের বাইরে কার সাথে কি চুক্তি হয়েছে সেটা পরিষদে আলোচনার বিষয়বস্তু হতে পারে না। প্রভাসচন্দ্র লাহিড়ী তখন তার জবাবে বলেন যে প্রধানমন্ত্রী নিজেই তাঁদের অবগতির জন্যে পরিষদে চুক্তিটি পাঠ করে শুনিয়েছিলেন।[৫০] এই বির্তকের পর শামসুদ্দীন আহমদ আবার তাঁর বক্তৃতা শুরু করেন। বাংলাকে যথাশীঘ্র কিভাবে পূর্ব-বাঙলায় চালু করা সম্ভব সে প্রসঙ্গে তিনি বলেন:

১৯৪৯ সালের জানুয়ারী অথবা ঐ ধরনের কোন তারিখ থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পর্যায় পর্যন্ত সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বাংলাকে শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করতে হবে এই মর্মে আগামীকালই আমরা শিক্ষা বিভাগকে নির্দেশ দিতে পারি। স্যার, আমি মনে করি যে সমস্ত জিনিসটি যখন পরিষদের সামনে আনা হয়েছে তখন সেটা পরিষ্কার করে নেওয়া এবং এ ব্যাপারে একটা লক্ষ্য-তারিখ নির্ধারণ করা উচিত।[৫১]

এর পর শামসুদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রীকে ‘যথাসম্ভব’ কথাটি মূল প্রস্তাব থেকে প্রত্যাহার করে নিতে অনুরোধ করেন। তিনি বলেন যে ‘পূর্ব-বাঙলার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে শিক্ষার মাধ্যম বাংলা হবে’ প্রস্তাবটির পাঠ এই রকম হওয়া দরকার। কিন্তু তা সত্ত্বেও সরকারী প্রস্তাবের এই ধারার শেষ অংশের সাথে তাঁর কোন ঝগড়া নেই বলেও তিনি অভিমত প্রকাশ করেন। কোন প্রতিষ্ঠানে অধিকাংশ ছাত্রের মাতৃভাষা উর্দু অথবা বাংলা হলে সেইভাবে তাদেরকে শিক্ষা দানের অসুবিধার কথা উল্লেখ করলেও তিনি প্রস্তাবের সেই অংশের বিরোধিতা থেকে বিরত থাকেন। প্রস্তাবটি থেকে ‘যথাসম্ভব’ কথাটি তুলে নিলে অনেক ‘ভুল বোঝাবুঝি, হতবুদ্ধিতা এবং বিতর্কের’ অবসান হবে একথা বলার পর প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে পরিষদের সামনে প্রস্তাব উত্থাপনের জন্য তিনি প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়ে নিজের বক্তৃতা শেষ করেন।

শামসুদ্দীন আহমদের বক্তৃতার এই অংশের সাথে প্রধান অংশের বক্তব্যের গরমিল সহজেই লক্ষণীয়। প্রথমদিকে তিনি প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে চুক্তি-ভঙ্গের অভিযোগ উত্থাপন করলেও শেষের দিকে তিনি চুক্তি রক্ষার জন্যেই তাঁকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন।

এর পর স্বাস্থ্যমন্ত্রী হাবিবুল্লাহ বাহার পরিষদে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বিভিন্ন দিক নিয়ে একটি দীর্ঘ এবং পাণ্ডিত্যপূর্ণ বক্তৃতা দেন।[৫২] প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন জ্ঞাপন ব্যতীত তাঁর বক্তৃতায় পরিষদে উত্থাপিত সরকারী ভাষা বিষয়ক প্রস্তাবটি সম্পর্কে তিনি তেমন কোন আলোচনাই করেননি। তাঁর সেদিনকার বক্তৃতা পাঠ করলে মনে হয় তিনি যেন পরিষদে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে আলোচনার জন্যে না দাঁড়িয়ে বাংলাভাষা বিষয়ক একটি সাহিত্য সভায় সভাপতির ভাষণ প্রদান করছেন। অবশ্য এই প্রসঙ্গে তিনি বাংলা ভাষাকে পূর্ব-বাঙলার সরকারী ভাষা ও শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে প্রচলনের কতকগুলি বাস্তব দিক সম্পর্কে তাঁর বক্তৃতার শেষের দিকে আলোচনা করেন। মূল প্রস্তাবের উপর বিশেষ কোন বক্তব্য পেশ না করলেও বাংলা ভাষা সম্পর্কে তিনি সেদিন যে সব কথা বলেন তার কোন কোন অংশ ভাষাবিষয়ক কতকগুলি সাধারণ প্রশ্নের সাথে সম্পর্কিত এবং সেই হিসাবে তার উল্লেখ প্রয়োজন। বাংলা ভাষা চর্চার প্রথম পর্যায়ে তার প্রতি হিন্দু মুসলমান শাস্ত্রকার এবং নবাব বাদশাদের মনোভাব সম্পর্কে আলোচনা করে তিনি দেখাতে চান যে বাংলা বস্তুতঃপক্ষে মুসলমানদের দ্বারা গঠিত ভাষা। হিন্দুদের হাত থেকে উদ্ধার করে তারাই তাকে নবজীবন দান করে। এ সঙ্গে তিনি বলেন :

ইসলাম গণতান্ত্রিক ধর্ম, বিপ্লবী ধর্ম, এইজন্য ইসলামের অনুসারীরা স্বাভাবিকভাবেই জনগণের ভাষা বাঙলাকে রাজদ্বারে আসন দিয়েছিলেন। শাহী দরবারে বাঙ্গালা ভাষা যখন মজলিশ জমিয়ে বসেছিল সে সময় এদেশের শাস্ত্রকাররা রামায়ণ বা পুরাণের অনুবাদক বা অনুবাদের শ্রোতার জন্য রৌরব নরকের ব্যবস্থা দিচ্ছিলেন। কবি কালীদাস মহাভারতের প্রতি অধ্যয়ের শেষে ‘মস্তকে বাঁধিয়া ব্রাহ্মণের পদরজঃ কহে কালীদাস’ বলে ব্রাহ্মণের বন্দনা করলেও এতটুকু সহানুভূতি পাননি তাঁদের কাছ থেকে। বরং ভট্টাচার্য মহাশয়েরা প্রবাদ বাক্য তৈরী করেছিলেন কৃতিবেসে কাশীদেশে আর বামুন ঘেঁষে এই তিন সৰ্ব্বনেশে’ বলে। শুধু তাই নয় শ্রদ্ধেয় দীনেশচন্দ্র সেনের উদ্যোগে পূর্ববঙ্গ থেকে যে সব গীতিকথা ও পল্লীগান সংগৃহীত হয়েছে, যেগুলো সাহিত্যের অত্যুজ্জ্বল মণি, বিশ্বসাহিত্যে স্থান পাওয়ার যোগ্য বলে প্রশংসা পেয়েছে রমাঁ রঁলার মত আধুনিক সাহিত্য-রসিকদের কাছ থেকে, সেগুলোও সম্পূর্ণ বর্জিত হয়েছিল হিন্দু শাস্ত্রকারদের দ্বারা। কারণ কবির এই অপূর্ব সৃষ্টি শাস্ত্রের অনুশাসন মানেনি, লোকাচার ও সামাজিক সংস্কারের বিরুদ্ধে তুলেছে বিদ্রোহের আওয়াজ। এসব গানে নেই ঠাকুর দেবতা ব্রাহ্মণের প্রতি ভক্তির কথা। এতে আছে ইতর জাতির নায়কের কথা, কুমারী কন্যার স্বেচ্ছাবর গ্রহণের কথা, ভিন জাতির নায়ক-নায়িকার প্রেমের কাহিনী।

শাস্ত্রকারের বিদ্রোহের ভেতর দিয়ে যে সাহিত্যের ভিত্তি পত্তন হয়, যে ভাষা ছিল গণ- মানসের বাহন তা যে গোড়া থেকেই মুসলিম নবাব, আমীর বাদশাহদের সমর্থন লাভ করবে তা স্বাভাবিক। আজ সেই ভাষা যে নবজাত পূর্ব পাকিস্তানের আইনসভায় রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা লাভ করবে তা আরও স্বাভাবিক – ইংরেজীতে যাকে বলে In the fitness of things.

গৌড়ের দরবারে বাঙ্গলা ভাষার আদি কবি কৃত্তিবাস, বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাস যখন মর্যাদা লাভ করেছিলেন তখন ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের সমর্থন এঁরা পাননি। আনন্দের বিষয় আজ ব্রাহ্মণ, অব্রাহ্মণ, হিন্দু, মুসলিম, তপসিলী, খৃষ্টান সকলের সমর্থন পাচ্ছে জননী বঙ্গভাষা। বিরোধের সুর শোনা যাচ্ছে না আজকের এই সভায় কোন দিক থেকেই “অষ্টাদশ পুরানানি রামস্য চরিতানি চ। ভাষায়াং মানবং শ্রত্বা রৌরবং নরকং ব্রজেৎ।’ বলে বাঙ্গলা ভাষার সেবকদের যাঁরা অভিসম্পাত করছিলেন তাঁদের সুযোগ্য বংশধর বন্ধুবর গোবিন্দ ব্যানার্জি, গনেন ভট্টাচার্যী আজ আমাদের সঙ্গে হাত মেলাচ্ছেন তাঁদের ধন্যবাদ।[৫৩]

স্বাস্থ্যমন্ত্রী হাবিবুল্লাহ বাহারের বক্তৃতার এই অংশের মূল বক্তব্য হলো এই যে বাংলা আসলে মুসলমানদের ভাষা, তারাই হিন্দুদের বিরোধিতা সত্ত্বেও এর পরিচর্যা করে এসেছে, কাজেই মুসলমানরা তাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দান করবে সেটাই স্বাভাবিক। শুধু তাই নয়। তিনি বাংলাকে পূর্ব-বাঙলার রাষ্ট্র ভাষা করার উদ্যোগে ‘আজ’ শরীক হওয়ার জন্যে হিন্দু ব্রাহ্মণ পরিষদ সদস্যদেরকে ধন্যবাদও জ্ঞাপন করেন। এই বক্তৃতারই অন্যত্র তিনি আবার বলেন :

যে ভাষা ছিল গণ-মানসের বাহন তা যে গোড়া থেকেই মুসলিম নবাব, আমীর বাদশাহদের সমর্থন লাভ করবে তা স্বাভাবিক। আজ সেই ভাষা যে নবজাত পূৰ্ব্ব পাকিস্তানের আইনসভায় রাষ্ট্র ভাষার মর্যাদা লাভ করবে তা আরও স্বাভাবিক।

এই সমস্ত কথার মাধ্যমে হাবিবুল্লাহ বাহার কর্তৃক বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস এবং সমগ্র ভাষা আন্দোলনের চরিত্রকে বিকৃত করার অদ্ভুত প্রচেষ্টা বিশেষভাবে লক্ষণীয়। প্রথমতঃ বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসকে তিনি যেভাবে বর্ণনা করেছেন তার মধ্যে উনিশ এবং বিশ শতকে হিন্দু সাহিত্যিকদের বাংলা ভাষা চর্চা ও সাধনার বিন্দুমাত্র উল্লেখ নেই। হুসেন শাহী আমল থেকে এক লাফে খাজা নাজিমুদ্দীনের রাজত্বে পৌঁছে গিয়ে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দানের ক্ষেত্রে হিন্দুদের উদ্যোগ ও সহযোগিতাকে তিনি একটি অপ্রত্যাশিত ঘটনা বলে চিত্রিত করার যে চেষ্টা করেছেন তা হাস্যকর হলেও তাৎপর্যপূর্ণ।

হুসেন শাহী আমলে বাংলা ভাষার চর্চাকে উৎসাহ দান করা হয়েছিলো এজন্যে নয় যে ‘বাংলা ভাষা ছিল গণ-মানসের বাহন কাজেই স্বাভাবিকভাবেই মুসলিম নবাব, আমীর বাদশাহরা তাকে সমর্থন করেছিলেন।’ তাঁরা বাংলা চর্চার মাধ্যমে প্রকৃতপক্ষে বাঙলাদেশের হিন্দু ক্ষাত্রশক্তিকেই আঘাত করতে চেয়েছিলেন। মুসলমান সুলতানেরা বাঙলাদেশে রাজত্ব স্থাপন করলেও বিদেশী হিসাবে এদেশের সাথে তাঁদের কোন সংযোগ ছিলো না। সংস্কৃতচর্চাকারী হিন্দু অভিজাত সমাজের বিরুদ্ধে নানাভাবে সংগ্রাম করে তাঁরা এদেশে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠা করার যে পরিকল্পনা নিয়েছিলেন বাংলা চর্চায় উৎসাহদান ছিল তারই একটি। সেই সময় হিন্দু অভিজাতদের ভাষা ছিল সংস্কৃত। কাজেই তাঁরা নিজেদের স্বার্থ রক্ষার জন্যে বাংলার বিরোধিতা করেছিলেন এবং শাস্ত্রকাররা এ ব্যাপারে যথারীতি এগিয়ে এসেছিলেন তাঁদের সহায়তা করতে। প্রকৃতপক্ষে মুসলমান বাদশাহরা যে কারণে বাংলা ভাষার উন্নতিতে কিছুটা উৎসাহ দান করেছিলেন সেই একই রাষ্ট্রীয় এবং সামাজিক কারণে হিন্দু অভিজাত ও শাস্ত্রকাররা তার বিরোধিতা করেছিলেন। তার মধ্যে ‘গণমানস’, ‘গণস্বার্থত ইত্যাদির কোন প্রশ্নই ছিলো না।

যে নবাব বাদশাহরা মুসলমান হওয়ার জন্যে শত শত বছর পূর্বে বাংলা ভাষা চর্চায় উৎসাহ দান করেছিলেন ‘তাঁদের বংশধর’ খাজা নাজিমুদ্দীন বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ভাষার মর্যাদা দান করার প্রস্তাব করায় হাবিবুল্লাহ বাহার তাকে অত্যন্ত স্বাভাবিক বলে বর্ণনা করেছেন। একথা অনস্বীকার্য যে তাঁর এইসব উক্তি সদ্য সংঘটিত ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসকে বিকৃত করে বাংলা ভাষা কিভাবে খাজা নাজিমুদ্দীনের দ্বারা পূর্ব-বাঙলা ব্যবস্থাপক সভায় সরকারী ভাষা হিসাবে প্রস্তাবিত হলো সে বিষয়ে একটা ভ্রান্ত ধারণার সৃষ্টি করে।

এর পর ভারতীয় ইতিহাসে ভাষার ক্ষেত্রে অভিজাততন্ত্র ও গণতন্ত্রের ভূমিকা সম্পর্কে নিম্নোক্ত বক্তব্য উপস্থিত করে তিনি নিজের পূর্ব বক্তব্যকে জোরদার করার চেষ্টা করেন:

ভারতের ইতিহাস অভিজাততন্ত্র আর গণতন্ত্রের বিরোধের ইতিহাস। আদি যুগে অভিজাত ঋষিদের ভাষা ছিল বৈদিক ভাষা, আর লৌকিক ভাষা ছিল জনগণের ভাষা। এই দুই ভাষার বিরোধে লৌকিক ভাষার জয় হল। নিরুপায় হয়ে অভিজাততন্ত্রীরা লৌকিক ভাষাকে সংস্কৃত করে নিল। জনসাধারণ তখন ব্যবহার করতে লাগল লৌকিক ভাষা পালি। বিপ্লবী বৌদ্ধ ধর্ম্মের পৃষ্ঠপোষকতায় পালি হয়ে উঠলো ঐশ্বর্যশালী। পরের যুগে পালি হলো অভিজাত ভাষা, লৌকিক ভাষা হলো প্রাকৃত। পালিকে হারিয়ে জনগণের ভাষা প্রাকৃত চলল এগিয়ে। এর পর প্রাকৃতকে পরাস্ত করে জনগণের ভাষা অপভ্রংশ থেকে জন্ম নিল বাংলা, হিন্দি, গুজরাতী, আসামী, উড়িয়া, মারাঠি ও অন্যান্য প্রাদেশিক ভাষা।

অভিজাততন্ত্র আর গণতন্ত্রের এ লড়াই এখনো শেষ হয়নি। এ সংগ্রাম চলছে এখনো বাঙ্গলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বংশধারেরা বাঙ্গলাকে এখনো বেঁধে রাখতে চাচ্ছেন সংস্কৃতের শৃঙ্খলে। আর জনগণের ভাষা পেতে চাচ্ছে সাহিত্যের মর্যাদা। বাঙ্গলা ভাষা যখন রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা পেতে চলেছে সে সময় জনগণের ভাষা আমাদের কাছে স্বীকৃতি পাবে কিনা, এ প্রশ্ন নূতন করে আমাদের সামনে দেখা দিয়েছে। আমরা গণতন্ত্রের সমর্থক। এ প্রশ্নের উত্তর আমাদের দিতে পারা উচিত সহজেই। জনগণের ভাষাকে সাহিত্যের ভাষায় রূপায়িত করাই হবে আমাদের নীতি। লৌকিক বৈদিককে, পালি সংস্কৃতকে, প্রাকৃত পালিকে, অপভ্রংশ প্রাকৃতকে যেমন করে হারিয়ে দিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছিল তেমনিভাবে গণভাষা ও গণসাহিত্য সংস্কৃত ঘেঁষা অভিজাত সাহিত্যকে টেনে ফেলে মাথা উঁচু করে দাঁড়ায় – এই হবে আমাদের আকাঙ্ক্ষা।[৫৪]

অভিজাততন্ত্র এবং গণতন্ত্রের ভিত্তিতে ভারতীয় ইতিহাসে ভাষার লড়াইয়ের প্রসঙ্গ উত্থাপন করে হাবিবুল্লাহ বাহার তাঁর এই অংশের বক্তব্যকে যে পরিণতির দিকে নিয়ে গেছেন সেটাও সদ্য সংঘটিত ভাষা আন্দোলনের বিকৃত ব্যাখ্যা এবং ভাষা বিতর্কের প্রকৃত তাৎপর্য বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে বিভ্রান্তি সৃষ্টির আর একটি উদাহরণ। এই অংশের শেষে তিনি ‘সংস্কৃত ঘেঁষা অভিজাত সাহিত্য’কে বাদ দিয়ে বাংলা ভাষার প্রতিষ্ঠার উল্লেখ করেছেন। কিন্তু পূর্ব- বাঙলায় বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলন যে ‘সংস্কৃত ঘেঁষা অভিজাত সাহিত্য’ বিরোধী নয়, উর্দুকে পূর্ব-বাঙলার উপর চাপিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে একটা গণতান্ত্রিক সংগ্রাম এই গুরুত্বপূর্ণ কথার কোন উল্লেখ তাঁর বক্তৃতায় নেই। তাঁর বক্তব্য থেকে মনে হয় ভাষা আন্দোলন হিন্দু অভিজাতদের সংস্কৃত ভাষার বিরুদ্ধে খাজা নাজিমুদ্দীন এবং তাঁর মন্ত্রীসভার অন্যান্য ‘গণতন্ত্রের সমর্থকদের’ বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠার আন্দোলন।

ভারতীয় ইতিহাসের অন্যান্য পর্যায়েও যে ‘অভিজাতদের’ ভাষা উর্দুকে রাষ্ট্রীয় এবং অন্যান্য কারণে বাংলাভাষী পাকিস্তানীদের উপর চাপিয়ে দেওয়ার ফলেই ভাষা আন্দোলনের উৎপত্তি ও বিকাশ এবং তার পরিণতি হিসাবেই যে খাজা নাজিমুদ্দীনের সরকারী প্রস্তাব একথার উল্লেখ হাবিবুল্লাহ বাহারের পাণ্ডিত্যপূর্ণ বক্তৃতার কোথাও নেই।

এর পর হাবিবুল্লাহ বাহার বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে আরবী ফারসী প্রভাব নিয়ে আলোচনা করেন এবং এইসব ভাষার কত প্রকার শব্দ বাংলা ভাষার নিজস্ব হয়ে গেছে তার একটা তালিকাও পেশ করেন। বাংলা ব্যাকরণের উপর কতকগুলি শব্দ কিভাবে প্রভাব বিস্তার করেছে সেই প্রসঙ্গে তিনি বলেন:

বাঙ্গলা ব্যাকরণেও মুসলমান প্রভাব কম নয়। ‘খোর’ (গাঁজাখোর ইত্যাদি শব্দে) ‘দার’ (ঠিকাদার ইত্যাদি শব্দে), ‘দান’ (পিকদান ইত্যাদি শব্দে) এবং গিরি (গুরুগিরি ইত্যাদি শব্দে) তদ্ধিত প্রত্যয়ের কাজ করছে। ভট্টাচার্য্য পণ্ডিতের আপত্তি সত্ত্বেও ‘ধনদৌলত’, ‘গরীব-কাঙ্গাল’, ‘হাট-বাজার’, ‘জিনিষপত্র’, ‘লজ্জা-শরম’, ‘চালাক-চতুর’, ‘কাণ্ড-কারখানা’, ‘লোক-লস্কর’, ‘খানা-খন্দক’, ‘শাকসব্জী’, ‘ঝড়-তুফান’, ‘মুটে-মজুর’, ‘হাসি-খুশী’ প্রভৃতি যুগ্ম শব্দে সংস্কৃত, আরবী, ফারসীর সঙ্গে যেমন গলাগলি করে চলেছে তেমনি হিন্দু মুসলিম হাত ধরাধরি করে সৃষ্টি করেছে বাঙ্গালা সাহিত্য।[৫৫]

‘হিন্দু মুসলিম হাত ধরাধরি করে সৃষ্টি করেছে বাঙ্গালা সাহিত্য’ একথা এখানে এবং অন্যত্র দুই একবার স্বীকার করলেও হাবিবুল্লাহ বাহারের সমগ্র বক্তৃতার সত্যিকার প্রতিপাদ্য বিষয় ছিলো এই যে, মুসলমানরাই বাংলা সাহিত্যের বর্তমান উন্নতির কৃতিত্বের মুখ্য দাবীদার। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে মুসলমান কবি সাহিত্যিকদের দান অনস্বীকার্য এবং তাঁদের কাব্য ও সাহিত্য চর্চা যে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে নোতুন শব্দ এবং চিন্তাধারার দিক দিয়ে অনেকাংশে সমৃদ্ধ করেছে তাতেও কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু হাবিবুল্লাহ বাহার এই সত্যকে তার ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিতে বিচারের কোন চেষ্টা না করে কোন কোন প্রখ্যাত হিন্দু সমালোচক এবং ঐতিহাসিকের সাম্প্রদায়িক পথ অনুসরণ করেই তাঁর আগাগোড়া বক্তব্যকে একটা বিকৃত সাম্প্রদায়িক চরিত্র দান করেন। পূর্ব-বাঙলায় সাহিত্যিকদের সাহিত্যকর্ম কি ধরনের হবে সে সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি বলেন:

আদি বাঙ্গলা সাহিত্য গড়ে উঠেছে দেবতার লীলা খেলাকে কেন্দ্র করে। দেবভূমি থেকে বাঙ্গলা সাহিত্যকে মাটির পৃথিবীতে নামিয়েছেন মুসলমান। এর পর বহুদিন বাঙ্গলা সাহিত্যের কারবার ছিল রাজরাজড়া নিয়ে। ধীরে ধীরে উজির পুত্র, কোটাল পুত্র, সওদাগর পুত্র স্থান পেয়েছে এখানে। বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র মধ্যবিত্ত সমাজে সাহিত্যকে নামিয়ে এনেছেন। বাঙ্গলার বিরাট জনসমাজ এখনো সাহিত্যে স্থান পায়নি। আজ পাকিস্তানবাদী সাহিত্যিকের কাজ হবে- রিক্ত সর্বহারাকে সাহিত্যে স্থান দেওয়া। এদের হাসি কান্না, সুখ-দুঃখ নিয়ে সাহিত্য সৃষ্টি করা। এক কথায় সত্যিকারের গণ-সাহিত্য সৃষ্টির সাধনা হবে আমাদের সাধনা।[৫৬]

এক্ষেত্রে তাঁর পক্ষে ‘পাকিস্তানী’ সাহিত্যিকের পরিবর্তে ‘পাকিস্তানবাদী’ সাহিত্যিকদের উপর এদেশের সাহিত্যকে গণ-মুখী করার দায়িত্ব অর্পণ করার আবেদন বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। ভাষা ও সাহিত্য সম্পর্কে তাঁর এই সমস্ত সাধারণ বক্তব্যের পর তিনি বর্ণমালা এবং ব্যাকরণ সংস্কার সম্পর্কে নিজের অভিমত পরিষদে ব্যক্ত করেন:

বাঙ্গলা অক্ষর সংস্কার সম্পর্কে আমাদের কোন সংস্কার দিয়ে চালিত হলে চলবে না। বাঙ্গলায় আরবী বর্ণমালা চালানো যায় কিনা, এ বিষয়ে কোন মহলে আলোচনা চলছে। এক সময় বাঙ্গলা আরবী অক্ষরে লেখা হত তার প্রমাণ পাওয়া গেছে। আমার কাছে আলাওলের পদ্মাবতীর কয়েকখানি হাতে লেখা পুঁথি আছে। বইখানি আরবী অক্ষরে লেখা।[৫৭] (মাননীয় মিনিস্টার হাবিবুল্লাহ সাহেব এই সময় পুঁথিখানি সকলকে দেখান।) বাঙ্গলায় আরবী অক্ষরের প্রবর্তন হলে যদি আমাদের অসুবিধা হয়, ছাপা টাইপরাইটার ইত্যাদি ব্যাপারে আরবী অক্ষর অধিকতর বিজ্ঞানসম্মত বলে প্রমাণ হয়, নিশ্চয়ই আমরা এ অক্ষর গ্রহণ করবো। শুধু Sentiment-এর বশবর্তী হয়ে কিছু করা নিশ্চয়ই সমীচীন হবে না। বাঙ্গলায় রোমান বর্ণমালা প্রবর্তনের প্রস্তাবও রয়েছে আমাদের সামনে। এ সম্পর্কে ভাবা যেতে পারে। মনে রাখতে হবে আমরা এ ব্যাপারে বৈজ্ঞানিক মনোবৃত্তি দিয়ে যেন চালিত হই।[৫৮] বৈজ্ঞানিক মনোবৃত্তির নামে বাংলা অক্ষর বর্জন করে আরবী অক্ষর এবং অন্যথায় রোমান হরফ বিবেচনার প্রস্তাবকে হাবিবুল্লাহ বাহার এ ক্ষেত্রে যুক্তিসঙ্গত বলে দেখাতে চেয়েছেন। শুধু তাই নয়। আরবী অক্ষরের প্রতি তাঁর পক্ষপাতিত্বকেও তিনি গোপন করেননি। খোলাখুলিভাবে তাঁর বক্তব্যের যৌক্তিকতা প্রদর্শনের জন্যে আলাওলের একটি পুঁথি নিয়ে এসে সেটি সকলকে দেখাবার চেষ্টাও তিনি করেন। রোমান অক্ষরের কথা তিনি প্রসঙ্গত উল্লেখ করলেও নিজের বক্তৃতার মধ্যেই তিনি আরবী অক্ষর সম্পর্কে একথা স্বীকার করেছেন যে, ‘এ বিষয়ে কোন কোন মহলে আলোচনা চলছে।’ এই মহলটি হলো পাকিস্তান সরকারের শিক্ষা দফতর। আরবী অক্ষর প্রবর্তনের চেষ্টায় তাদের কার্যকলাপ এর পরও বেশ কিছুদিন পর্যন্ত অব্যাহত থাকে।

হাবিবুল্লাহ বাহার তাঁর এই সব গুরুত্বপূর্ণ উক্তির মাধ্যমে নানা বিভ্রান্তিকর বক্তব্য উপস্থিত করার পর এই কথা বলে তাঁর বক্তৃতা শেষ করেন :

আজ আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। এই নূতন আবহাওয়ায় আমরা সন্ধান পাব জাতির শাশ্বত প্রাণধারার। আমরা সহজভাবে সাড়া দিতে পারব বিশ্বসংস্কৃতির আবেদনে। নবলব্ধ আজাদীর অপূর্ব প্রাণশক্তি এনে দেবে আমাদের মানস ও মনকে অফুরন্ত উদ্যম ও তেজ এই উদ্যম এই প্রাণ-চঞ্চলতা থেকে জন্ম নেবে নূতন যুগের নূতন সাহিত্য। এই নূতন সাহিত্য সৃষ্টির ব্যাপারে আজকের এই রাষ্ট্রভাষা বিষয়ক প্রস্তাব নানাদিক থেকেই হবে সহায়ক।[৫৯]

হাবিবুল্লাহ বাহারের বক্তব্য যাই হোক, ভাষা ও বাচনভঙ্গীর প্রসাদ গুণে তাঁর বক্তৃতার সময় পরিষদে একটা গুরুগম্ভীর আবহাওয়ার সৃষ্টি হয়। সেই আবহাওয়াকে চুরমার করে এর পরই আবদুস সবুর খান ধীরেন দত্তের সমালোচনা প্রসঙ্গে বলেন যে ধীরেন বাবু তাঁর সংশোধনী প্রস্তাবে Immediately কথাটার উপর বড় জোর দিয়েছেন এবং বক্তৃতা দেওয়ার সময় প্রাদেশিকতার গণ্ডী ছাড়িয়ে গোটা পাকিস্তানকে নিয়ে আলোচনা করেছেন, যদিও প্রস্তাবে শুধু পূর্ব পাকিস্তানের কথাই আছে। এর পর তিনি ধীরেন দত্তকে জিজ্ঞাসা করেন তিনি সংবিধান সভায় এ সম্বন্ধে বক্তৃতা দেওয়ার চেষ্টা করেননি কেন? এ ছাড়া ধীরেন দত্ত প্রস্তাব করেছেন বাংলা ভাষাকে সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রভাষার স্থান দেওয়ার। কিন্তু সেটা যে সম্ভব নয় ধীরেনবাবু তা ভালোভাবেই জানেন। ভারতেও হিন্দী রাষ্ট্র ভাষা রূপে স্বীকৃত হলেও সেখানে তাকে সেইভাবে চালু করা একই কারণে বিলম্বিত হচ্ছে।[৬০]

সবুর খানের প্রশ্নের জবাবে ধীরেন দত্ত বলেন :

প্রথম কথা হচ্ছে যে কেন্দ্রীয় পরিষদের নিয়ম অনুসারে সেখানে ইংরাজীতেই সকল কাজকর্ম হয়ে থাকে। তৎসত্ত্বেও আমি বাংলায় বলতে চেষ্টা করেছিলাম সেকথা যাঁরা সেখানে উপস্থিত ছিলেন তাঁরা জানেন। আমি ইংরাজী জানা একজন উকিল একথা তমিজুদ্দীন সাহেব ও কায়েদে আজম জানেন। সে ক্ষেত্রে ইংরাজী না জানার অজুহাতে অন্য ভাষার ব্যবহার করতে পারি না। তাই আমাকে বাংলা বলার জন্য যথেষ্ট চেষ্টা করার পর ইংরাজীতে বলতে হয়েছিল।[৬১]

সংবিধান সভা ও গণ-পরিষদে ভাষাবিষয়ক যে নীতি নির্ধারিত হয়েছিল সে অনুসারে ইংরাজী এবং উর্দু ব্যতীত অন্য কোন ভাষা সেখানে ব্যবহার করা সম্ভব ছিল না। কোন সদস্য এই দুই ভাষার একটিও না জানলে শুধুমাত্র সে ক্ষেত্রেই অন্য ভাষায় বক্তৃতার অনুমতি ছিল। এই নীতি অনুসারে ইংরেজী জানা উকিল হিসাবে ধীরেন দত্তের বাংলায় বক্তৃতা দেওয়ার উপায় ছিল না।

খাজা নাজিমুদ্দীন কিন্তু এসব প্রশ্ন সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে ধীরেন দত্তের কথার প্রতিবাদে বলে ওঠেন, ‘সেটা ঠিক নয়। আপনি যদি ইংরেজীতে কথা বলতে না পারেন তাহলে আপনি বাংলা বলতে পারেন’।[৬২] সবুর খানের প্রশ্ন এবং ধীরেন দত্তের জবাবের পরিপ্রেক্ষিতে নাজিমুদ্দীনের এই বক্তব্য নিতান্তই অর্থহীন এবং হাস্যকর। খুব সম্ভবতঃ তাঁর এই অদ্ভুত উক্তির আসল কারণ বাংলাতে পেশ করা ধীরেন দত্তের বক্তব্য তাঁর পক্ষে সঠিকভাবে বোঝা সম্ভব হয়নি।

এই ঘটনার পর মহম্মদ আবদুল হকিম বিক্রমপুরী, আবদুল মমিন এবং নুরুল হোসেন খান পরিষদে বক্তৃতা করেন। আবদুল মমিন বলেন যে পরিষদে প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবের যে সমালোচনা হয়েছে তাতে মনে হয় তাঁরা চান আলাউদ্দীনের প্রদীপের মতো রাতারাতি সব পরিবর্তন করে দিতে। যাঁরা বাংলা সম্বন্ধে এত কথা বলেন তাঁরা নিজেরাই ইংরেজীতে প্রশ্ন করেন বলেও তিনি অভিযোগ করেন। এ প্রসঙ্গে নূরুল হোসেন খান শামসুদ্দীন আহমদের বক্তৃতার উল্লেখ করে বলেন যে তিনি বাংলা ভাষার একজন মন্তু ধ্বজাধারী হওয়া সত্ত্বেও ভাষা বিষয়ক প্রস্তাবের উপর নিজে বক্তৃতা করেছেন ইংরেজীতে। এর থেকেই স্পষ্ট প্রমাণিত হয় যে এদেশে বাংলা প্রচলনের জন্যে যথেষ্ট সময় প্রয়োজন।[৬৩]

৪. বিতর্কের জবাবে নাজিমুদ্দীনের বক্তব্য

এর পর ভাষা বিষয়ক সরকারী প্রস্তাবের উত্থাপক প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন তার প্রস্তাবের উপর বিতর্কের জবাব দিতে ওঠেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন যে প্রস্তাবটির দ্বিতীয় অংশটির কতকগুলি সমালোচনা সত্ত্বেও মূল প্রস্তাবটির বিষয় পরিষদে সম্পূর্ণ মতৈক্য লক্ষিত হয়েছে। একটি সমালোচনা হয়েছে ‘যথাসম্ভব’কে কেন্দ্র করে এবং অপরটি হয়েছে তারিখ নির্ধারণের বিষয়টি নিয়ে। এই দুই সমালোচনাকে বিবেচনা করে তিনি আহমদ আলী মৃধার ১৬ নম্বর সংশোধনী প্রস্তাবটিকে গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে পরিষদকে জানান। তিনি বলেন যে সংশোধনী প্রস্তাবটিকে গ্রহণ করার পর মূল প্রস্তাবের প্রথম অংশের পাঠ দাঁড়াবে নিম্নরূপ:

পূর্ব-বাঙলা প্রদেশে ইংরেজীর স্থলে বাংলাকে সরকারী ভাষা হিসাবে গ্রহণ করা হইবে; এবং যত শীঘ্র বাস্তব অসুবিধাগুলি দূর করা যায় তত শীঘ্র তাহা কার্যকর করা হইবে।[৬৪]

সংশোধনী প্রস্তাবটিকে গ্রহণ করার কারণ ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে খাজা নাজিমুদ্দীন বলেন:

আমি সংশোধনী প্রস্তাবটি গ্রহণ করেছি এজন্য যে প্রথমত, ইংরেজীর স্থান বাংলা কত দিনে নিতে পারবে সে বিষয়ে কোন নিশ্চয়তা নেই। কতকগুলি বাস্তব অসুবিধা যে আছে সেকথা অস্বীকার করা যায় না। উদাহরণস্বরূপ এই পরিষদে অধিকাংশ বক্তৃতা বাংলাতে দেওয়ার ক্ষেত্রে আমরা ইতিমধ্যেই একটা পদক্ষেপ নিয়েছি কিন্তু স্যার, একাধিকবার আপনি নিজের বাংলা বক্তৃতা রেকর্ড করা নিয়ে নানা অসুবিধার দিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে অনুরোধ জানিয়েছেন যাতে সদস্যেরা ইংরাজীতে তাঁদের বক্তৃতা দেওয়ার চেষ্টা করেন। সুতরাং, স্যার, আপনি সহজেই কল্পনা করতে পারেন যে এরকম একটা ছোট জায়গাতেও আমরা এমন বাস্তব অসুবিধার সম্মুখীন হচ্ছি যার ফলে আমি নিশ্চিত যে, এখানে বাংলা বক্তৃতার রিপোর্ট তৈরি করতে অনেক বেশী সময় লাগছে। কাজেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা অবলম্বন না করে যদি সমগ্র প্রশাসন এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে বাংলা প্রবর্তন করে দেওয়া হয় তাহলে সেটা খুব অসুবিধাজনক ব্যাপার হবে। আমি ইতিপূর্বেই উল্লেখ করেছি যে বাংলা ভাষায় টাইপ করার জন্য টাইপরাইটারের কোন ব্যবস্থা এখনো পর্যন্ত নেই এবং আমাদের নথিপত্র এবং অন্যান্য রেকর্ড টাইপ করার ক্ষেত্রে এটা এক বাস্তব অসুবিধা। কাজেই স্যার, এ বিষয়ে অসুবিধা আরও বৃদ্ধি পাবে। সুতরাং, আমি জোর দিয়ে বলছি যে এ প্রস্তাবকে এখনি কার্যকর করার পক্ষে আমাদের কি কি অসুবিধা আছে সেগুলি বিবেচনার জন্য এখনই একটি কমিটি নিয়োগ করা এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সে অসুবিধাগুলিকে দূর করে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলা যাতে ইংরাজীর স্থান নিতে পারে তার উপায় বের করার জন্য আমাদের পদক্ষেপ নেওয়ার চেষ্টা করা উচিত।[৬৫]

খাজা নাজিমুদ্দীনের প্রস্তাবে ‘যথাসম্ভব’ কথাটি ব্যবহারের জন্যে পরিষদে যে সমালোচনা হয়েছে সে সম্পর্কে তিনি বলেন:

স্যার, প্রস্তাবটির দ্বিতীয় অংশে ‘যথাসম্ভব’ এই কথাটির উপর অনেক সমালোচনা হয়েছে। আমরা যে প্রস্তাব এখন পাশ করাতে যাচ্ছি, সেটা যে একটা সরকারী প্রস্তাব এবং সেটাকে যে আপনারা এখনই কার্যকর করতে চান এ কথা আমি পরিষদকে বিবেচনা করতে বলবো। অবস্থা যা আছে সেইভাবে তাকে যদি আমরা রেখে দিই তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে বাংলার মাধ্যমে শিক্ষা দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রস্তাবটিকে কার্যকর করা সম্ভব হবে না। কারণ তার জন্য বাংলাতে লিখিত বই পুস্তক নেই। এমনকি মফাসসিলের ইন্টারমিডিয়েট এবং বিএ কলেজগুলির জন্যেও বাংলায় কোন বই নেই এবং সে কারণেই আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে এখনই বাংলাকে শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে গ্রহণ করা সম্ভব নয়। আমরা যদি ‘যথাসম্ভব’ কথাটি প্রস্তাব থেকে বাদ দিই তার অর্থ দাঁড়াবে এই যে প্রস্তাবটি পাশ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বাংলা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে পরিণত হবে। এই কাজ করা কি সম্ভব? আমার মনে হয় একজন বক্তা, মোদাব্বের হোসেন চৌধুরী – উল্লেখ করেছিলেন যে মাদ্রাসা শিক্ষার ক্ষেত্রে ফিকাহ হাদিস এবং অন্যান্য ধর্মীয় বইপত্রগুলি সমস্ত বাংলাতে তরজমা করতে হবে। সেক্ষেত্রে প্রস্তাবটিকে কিভাবে কার্যকর করা যাবে? আপনাদেরকে কিছু ফাঁক রাখতেই হবে অন্যথায় লোকে বলবে যে প্রস্তাবটি কার্যকর করা যায় না একথা ভালোভাবে জানা সত্ত্বেও ব্যবস্থাপক সভার মতো একটি দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠান কিভাবে এরকম একটি প্রস্তাব গ্রহণ করতে পারলো। বিলম্ব করার চেষ্টা সম্পর্কে কোন প্রশ্ন ওঠে না, কারণ ব্যবস্থাপক সভা তো রয়েছেই এবং যখনই আমরা সমবেত হবো তখনই আমরা কতদূর কি করেছি সে সম্পর্কে প্রশ্ন উঠবে এবং আমাদেরকে তার কৈফিয়ত্ত দিতে হবে। কাজেই ‘যথাসম্ভব’ কথাটি ইংরাজীর বদলে বাংলা প্রচলনে বিলম্ব ঘটানোর উদ্দেশ্যে বসানো হয়েছে এই সন্দেহ সঠিক নয়। শুধুমাত্র কতকগুলি দূরপনেয় অসুবিধার জন্য আপনাদেরকে কিছু ফাঁক রাখতেই হবে, কারণ বিশ্ববিদ্যালয় এবং মাদ্রাসা শিক্ষার ক্ষেত্রে বাংলাকে শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে প্রচলনের মতো অবস্থা সৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত ইংরেজীকে চালু রাখা ব্যতীত উপায় নেই।[৬৬]

এর পর ‘শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে অধিকাংশ ছাত্রের মাতৃভাষা’ নিয়ে প্রস্তাবটির দ্বিতীয় অংশের যে সমালোচনা হয়েছে সে সম্পর্কে নাজিমুদ্দীন পরিষদকে বলেন:

এই সমালোচনা প্রসঙ্গে আমার মাননীয় বন্ধুরা সুযোগমতো একথা ভুলে গেছেন যে পার্বত্য চট্টগ্রামের মতো এমন জায়গা আছে যেখানকার অধিবাসীদের মাতৃভাষা বাংলা নয়। তা ছাড়া ময়মনসিংহে যে এলাকাগুলিতে গারো এবং হাজংরা বসবাস করে সেখানকার অধিবাসীদের মাতৃভাষাও বাংলা নয়। এইসব এলাকাতে যদি বাংলাকে শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে প্রচলন করা হয় তাহলে তাদের কি হবে? আমাদের শিক্ষাবিদদের মতানুসারে ছাত্রদেরকে তাদের মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা দেওয়াই সব থেকে সহজ। যেহেতু পূর্ব বাংলার শতকরা ৯৯ জন বাংলায় কথা বলে সেজন্য আমরা বাংলাকে এখানে শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে রাখার প্রস্তাব করেছি। এই নীতিকে যদি আপনারা মেনে নেন তাহলে যাদের মাতৃভাষা বাংলা নয় তাদের জন্যও আপনাদেরকে উপযুক্ত ব্যবস্থা করতে হবে। মুদাব্বের হোসেন চৌধুরী তাঁর একটি সংশোধনী প্রস্তাবে বলেছেন যে সংখ্যার কথা বিবেচনা না করে যে সমস্ত স্কুলে উর্দুভাষী ছাত্র-ছাত্রী আছে সেখানে উর্দুর মাধ্যমে শিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা আমাদেরকে অবশ্যই রাখতে হবে। এটাও আবার সম্ভব নয়। ধরা যাক কোন একটি স্কুলে ২, ৫, অথবা ৭ জন আছে যাদের মাতৃভাষা বাংলা নয়। ৫,৬ অথবা ২০ জন ছাত্রকেও তাদের মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা দানের বিশেষ ব্যবস্থা শুধু যে অসুবিধাজনক তাই নয় সেটা খুব ব্যয়সাধ্যও বটে। যেখানে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শতকরা ৫১ জন ছাত্র উর্দুভাষী সেখানে অধিকাংশ ছাত্রের মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা দানের ব্যবস্থা আপনাদেরকে অবশ্যই করতে হবে। তার অর্থ এই নয় যে শতকরা ৪৯ জনকেও উর্দু শিখতে হবে। আমরা যথাসম্ভব চেষ্টা করবো যাতে ছাত্রদেরকে তাদের মাতৃভাষার মাধ্যমেই আমরা শিক্ষাদান করতে পারি। কাজেই আপনারা যদি সোজা ‘যথাসম্ভব’ কথাটিকে বাদ দেন তাহলে তার অর্থ এই হবে যে, হয় আপনি সেটা করতে বাধ্য থাকবেন অথবা বাধ্য থাকবেন না। কাজেই আমার মনে হয় ‘যথাসম্ভব’ কথাটি রাখা দরকার।[৬৭]

এর পর প্রধানমন্ত্রী নাজিমুদ্দীন বিরোধীদলের সহকারী নেতা ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের বক্তৃতার উত্তর দেন। তিনি বলেন যে এ ব্যাপারে তিনি যথেষ্ট ইতস্তত বোধ করেছেন এবং ধীরেন দত্তের বক্তৃতার সময় তিনি যেমন কোন গণ্ডগোল করেননি তেমনি তাঁর বক্তৃতার সময়ও বিরোধীদলের নেতা এবং তাঁর পার্টিও কোন গণ্ডগোল করবেন না, তিনি সেই আশা করেন। নাজিমুদ্দীন বলেন যে অন্যেরা তাঁকে ভুল বুঝুন সেটা তিনি চান না, তবে একথা সত্য যে ভাষা সংক্রান্ত যে প্রস্তাবটি ধীরেন দত্ত উত্থাপন করেছেন সেটা উত্থাপন করা চলে না একথা জানা সত্ত্বেও বিরোধীদলের সহকারী নেতা সে প্রস্তাব জোরপূর্বক উত্থাপন করেছেন। নিজের বক্তব্যকে আরও বিশদভাবে ব্যাখ্যার উদ্দেশ্যে তিনি বলেন:

মি: দত্তের বক্তৃতার মুখ্য বক্তব্য হলো পাকিস্তানের ভাষা বিষয়ক বিতর্ক। তাঁর বক্তৃতায় যে দু’ তিনটি বিষয়ের উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলি সম্পর্কেই আমি বলতে চাই। একটি হচ্ছে ডাক, মানি অর্ডার ফর্ম এবং অন্যান্য জিনিস সংক্রান্ত। এই পরিষদের অন্য কোন সদস্য যদি এই প্রশ্ন উত্থাপন করতেন তাহলে আমার অভিযোগের কিছু থাকতো না। কিন্তু আমার মনে হয় মি: দত্তের এই প্রশ্ন উত্থাপনের কোন অধিকার নেই। কারণ সংবিধান সভায় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী তাঁকে বলেছিলেন যে এখানে ঐ সমস্ত জিনিসের ব্যবস্থা করা হবে। আবার তিনি মানি অর্ডার ফর্ম, টেলিগ্রাফ ফর্ম, মুদ্রা ইত্যাদির প্রশ্ন তুলেছেন। এ ব্যাপারে একটা নিশ্চিত আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল এবং তাকে বলা হয়েছিল যে এ সম্পর্কে ইতিমধ্যে নির্দেশও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও সে প্রশ্ন আবার তোলা হয়েছে।[৬৮]

এই পর্যায়ে ধীরেন দত্ত নাজিমুদ্দীনের বক্তৃতায় বাধা দিয়ে বলেন যে প্রশ্নটি তিনি উত্থাপন করেছেন এজন্যে যে মানি অর্ডার ফর্মে তা এখনো করা হয়নি। এর উত্তরে নাজিমুদ্দীন বলেন যে পরিষদে এইসব প্রশ্ন ওঠার বহু পূর্বেই সেগুলি ছাপা হয়েছিলো। এ বিষয়ে তাঁকে নিশ্চিত আশ্বাস দেওয়া সত্ত্বেও প্রশ্নটি তিনি আবার নোতুন করে তুলেছেন। এর পর বিভিন্ন সার্ভিসে পরীক্ষার মাধ্যম হিসাবে বাংলা প্রচলনের বিষয়ে তিনি বলেন:

এদিক থেকে এই মর্মে আর একটি প্রশ্ন তোলা হয়েছে যে আমরা যদি বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা না করি তাহলে আমাদের ছেলেদের পক্ষে বিভিন্ন সার্ভিসে সুযোগ পাওয়া সম্ভব হবে না। স্যার, এটা একটা দারুণ ভুল কথা। যে কোন জায়গায় গিয়ে উর্দু বলুন তারা আপনাকে বুঝতে পারবে না। সিন্ধু, উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, বেলুচিস্তান যান, সেখানকার শতকরা ৯৯ জন ভালোভাবে উর্দু বুঝতে পারবে না। পাঞ্জাবের গ্রামগুলিতেও দেখবেন সেই একই অবস্থা। কাজেই এদিক দিয়ে অন্যান্যদের তুলনায় বাঙালীদের অসুবিধা বেশী হবে না। কেন্দ্রীয় সার্ভিসগুলির ক্ষেত্রে আমাদের কোটা সংরক্ষিত হবে। কেন্দ্রীয় সার্ভিসের সব পরীক্ষা হবে ইংরাজীতে এবং সংস্কৃত, ফারসী, আরবী, উর্দুর মতো বাংলাও সেই পরীক্ষার একটি বিষয় হিসাবে থাকবে। আমাদের ছেলেদের তুলনামূলকভাবে কোন অসুবিধা হবে না। তাদের অংশ সংরক্ষিত থাকবে এবং ইনশাল্লাহ বিভিন্ন সার্ভিসে তারা তাদের ন্যায্য অংশই পাবে।[৬৯]

কেন্দ্রীয় সার্ভিসে পূর্ব-বাঙলার সংরক্ষিত অংশ কত সে সম্পর্কে খয়রাত হোসেনের এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন যে সে বিষয়ে তখনো পর্যন্ত কোন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি।[৭০] এর পর রাষ্ট্র ভাষা সংগ্রাম পরিষদের সাথে ১৫ই মার্চের চুক্তির প্রসঙ্গটি তিনি উত্থাপন করেন:

ভাষার এই প্রশ্নটি মি: দত্ত এবং তাঁর পার্টির কয়েকজন সদস্য এখানে উত্থাপন করেছেন। তাঁরা ১৫ই মার্চের সেই তারিখটি এবং আমি যে চুক্তি করেছিলাম তা মনে রেখেছেন। কিন্তু ২১শে মার্চ অথবা ২৪শে মার্চ যা ঘটেছিল তার সবকিছুই তাঁরা ভুলে গেছেন। তাঁরা পাকিস্তানের প্রতি অনুগত, তাঁরা পাকিস্তানের রাষ্ট্রপ্রধানের প্রতিও অনুগত, কিন্তু পাকিস্তানের রাষ্ট্রপ্রধান যা বলেন তার কিছুই তাঁদের মনে থাকে না। একটা নোতুন সংবিধান যে হয়েছে সেকথাও তাঁরা স্বীকার করেন না।[৭১]

খাজা নাজিমুদ্দীন এই পর্যন্ত বলার পর পরিষদে হট্টগোল শুরু হয়। চীৎকার থেমে যাওয়ার পর খাজা নাজিমুদ্দীন আবার তাঁর বক্তব্য শুরু করেন:

পাকিস্তানের রাষ্ট্রপ্রধান কায়েদে আজম বলেছেন এই প্রশ্নটি আপনাদেরকে বিশৃঙ্খলার দিকে ঠেলে দেবে। আমি আপনাদেরকে তাঁর এ কথাটি বিবেচনা করতে বলছি। তাঁর মতে এই প্রশ্নটি ঠিক নয় এবং আমাদের তা আলোচনা করাও উচিত নয়। এই হলো তাঁর সুনির্দিষ্ট নির্দেশ। পাকিস্তানের মঙ্গল কিসের মধ্যে নিহিত সেটা অন্য যে কোন ব্যক্তির থেকে কায়েদে আজমই যে বেশী বোঝেন একথাও আমি তাঁদেরকে বিবেচনা করতে বলি। যে ব্যক্তি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা ও গঠন করেছেন তিনি বলছেন যে রাষ্ট্রের স্বার্থেই তা করা হচ্ছে। শিশুর মায়ের থেকে শিশুর প্রতি আপনাদের দরদ যদি বেশী হয় তাহলে আমার বলার কিছু নেই (হাততালি)। আপনাদের নিশ্চয় গঠনতান্ত্রিক অধিকার আছে, গণতান্ত্রিক অধিকার আছে এবং পৃথিবীর সমস্ত কিছু অধিকারই আছে কিন্তু পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতি অনুগত পাকিস্তানী হিসাবে আপনাদের কোন কর্তব্য আছে কিনা তা আমি আপনাদেরকে জিজ্ঞেস করতে চাই। রাষ্ট্রপ্রধান যখন বলেছেন যে এটা রাষ্ট্রকে বিশৃঙ্খলার দিকে ঠেলে দিয়ে তার কল্যাণকে বিপদগ্রস্ত করবে তখন অন্য লোকেরা কি চিন্তা করবে সেটা আমি তাঁদেরকে বিবেচনা করতে বলি। শুধুমাত্র নিজেদের মতামত ব্যক্ত করার গঠনতান্ত্রিক অধিকারের জন্য আপনারা একটা বিতর্কমূলক বিষয়ের অবতারণা করতে চান এবং এই প্রশ্নটি এখানে আনার জন্য পীড়াপীড়ি করেন। আমি নিজের মতামত ব্যক্ত করতে চাই না। পরিষদের উপরই আমি তা ছেড়ে দিচ্ছি। কিন্তু স্যার, আমি সব সময়েই কাজে বিশ্বাস করি, কথায় নয়। কাজটাই আসল। কিন্তু এই ভাষার প্রশ্নটি যে এখানে আনা হয়েছে সেটা আমার পক্ষে একটা দুর্ভাগ্যের বিষয়।[৭২]

নাজিমুদ্দীনের এই অদ্ভুত-যুক্তিপূর্ণ বক্তৃতা শেষ হওয়ার পর বিরোধীদলের নেতা বসন্তকুমার দাস বলেন যে প্রধানমন্ত্রী তাঁর প্রস্তাবটি উত্থাপনের সময় পরিষদে কোন বক্তৃতা করেননি এবং তার ফলেই এতো হতবুদ্ধিতার সৃষ্টি হয়েছে। তিনি যদি প্রথমেই ব্যাখ্যা করে বলতেন কেন তিনি বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা করার জন্যে পাকিস্তান সরকারের কাছে সুপারিশ করে কোন প্রস্তাব উত্থাপন করেননি, তাহলে এতো অসুবিধা সৃষ্টি হতো না। কাজেই তাঁর উচিত ছিল বিষয়টি পরিষদের সামনে ভালোভাবে ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দেওয়া। সেটা করলে কোন সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপনেরও আর প্রয়োজন হতো না।[৭৩]

বসন্তকুমার দাসের এই বক্তব্যের পর স্পীকার তাঁকে জিজ্ঞাসা করেন যে সেই অবস্থায় তাঁরা তাঁদের সংশোধনী প্রস্তাবগুলি প্রত্যাহার করবেন কিনা। এর উত্তরে বিরোধীদলের পক্ষ থেকে বসন্তকুমার দাস তাঁকে জানান যে তাঁরা সেগুলি প্রত্যাহার করবেন। প্রধানমন্ত্রী নাজিমুদ্দীন ইতিপূর্বেই তাঁর বক্তৃতায় আহমদ আলী মৃধার সংশোধনী প্রস্তাবটি গ্রহণ করবেন বলে জানিয়েছিলেন। সেই অনুসারে নিম্নলিখিত প্রস্তাবটি এর পর পরিষদে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়:

ক. পূর্ব-বাঙলা প্রদেশে ইংরাজীর স্থলে বাংলাকে সরকারী ভাষা হিসাবে গ্রহণ করা হইবে; এবং যত শীঘ্র বাস্তব অসুবিধাগুলি দূর করা যায় তত শীঘ্র তাহা কার্যকর করা হইবে।

খ. পূর্ব-বাঙলার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে শিক্ষার মাধ্যম হইবে যথাসম্ভব’ বাংলা অথবা প্রতিষ্ঠানগুলির অধিকাংশ স্কলারদের মাতৃভাষা।[৭৪]

রাষ্ট্রভাষা কর্ম-পরিষদের সাথে ১৫ই মার্চ সম্পাদিত চুক্তি ভঙ্গ করার যে যৌক্তিকতা দেখিয়ে প্রধানমন্ত্রী বিরোধীদলীয় হিন্দু সদস্যদের বিরোধিতা বন্ধ করলেন তা যে কোন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের পক্ষেই অত্যন্ত মারাত্মক। একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উত্থাপন করাকে রাষ্ট্রস্বার্থ বিরোধী বলে ঘোষণা করা একদিকে যেমন চরম ব্যক্তিশাসনের পরিচায়ক তেমনি আবার সেই ঘোষণাকে প্রাদেশিক প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক শিরোধার্য করে সে বিষয়ে সমস্ত আলোচনা বন্ধ রাখার হুমকিও সেই ব্যক্তিশাসনেরই অনিবার্য পরিণতি। আন্দোলনের মাধ্যমে পূর্ব-বাঙলায় বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার যে দাবী উত্থাপিত হয়েছিলো এবং যে দাবীকে প্রদেশের প্রধানমন্ত্রী আনুষ্ঠানিকভাবে চুক্তির মাধ্যমে স্বীকার করে নিয়েছিলেন তা তিনি কায়েদে আজমের দোহাই পেড়ে অস্বীকার তো করলেনই এমনকি যারা সে বিষয়ে পরিষদে আলোচনার সূত্রপাত করলেন তাদেরকে তিনি পরোক্ষভাবে রাষ্ট্রবিরোধী বলে অভিহিত করতেও দ্বিধাবোধ করলেন না। আন্দোলনের মুখে চুক্তি সম্পাদন এবং আন্দোলনের পর পরিস্থিতি পরিবর্তনের সুযোগে সেই চুক্তি ভঙ্গের মাধ্যমে পূর্ব-বাঙলার প্রধানমন্ত্রী রাজনৈতিক বিশ্বাসঘাতকতার সে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন তা এদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ইতিহাসে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ

কিন্তু শুধু প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীনই এই বিশ্বাসঘাতকতা করেননি। পার্লামেন্টারী উপদলের যে সমস্ত নেতারা রাষ্ট্র ভাষা আন্দোলনের নেতা হিসাবে নাজিমুদ্দীনের কাছে নিজেদের কৃতিত্ব জাহির করে মন্ত্রীত্ব ইত্যাদি পদ আদায়ের চেষ্টায় লিপ্ত ছিলেন তাঁদের বিশ্বাসঘাতকতা অধিকতর উল্লেখযোগ্য। মহম্মদ আলী, তফজ্জল আলী, ডক্টর মালেক প্রভৃতি এই উপদলভুক্ত নেতৃবৃন্দ পরিষদে ভাষা প্রশ্নের উপর বিতর্ককালে একটি বাক্যও উচ্চারণ করেননি। তাঁদের এই মৌন ভূমিকার কারণ ইতিমধ্যেই তাঁরা প্রাদেশিক সরকারের সাথে আপোষ আলোচনার মাধ্যমে বিক্রীত হয়েছিলেন। তাঁদের মন্ত্রীত্ব ও রাষ্ট্রদূতের পদ সম্পর্কে তাঁদেরকে নিশ্চিত আশ্বাস দেওয়া হয়েছিলো।

উপরোক্ত পার্লামেন্টারী নেতৃবৃন্দ ভাষা আন্দোলনের সদ্ব্যবহার করার পর পূর্ব-বাঙলা মুসলিম লীগের মধ্যে সুরহাওয়ার্দী সমর্থক উপদলটি ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। তাদের এক অংশ সরকারী মুসলিম লীগের কাছে আত্মসমর্পণ করে এবং অপর অংশ যোগদান করে নবগঠিত আওয়ামী মুসলিম লীগে।

তথ্যসূত্র (সংশোধন করা হয়নি) – চতুর্থ পরিচ্ছেদ: নাজিমুদ্দীন সরকারের বিশ্বাসঘাতকতা

8

East Bengal Legislative Assembly Proceedings, Vol. No. 4, Thursday, the 6th April, 1948, P 57.

মূল সরকারী প্রস্তাব এবং পরবর্তী সংশোধনী প্রস্তাবগুলি সবই পরিষদে ইংরেজীতে পেশ করা হয়। পূর্বোক্ত, P 58.

পূর্বোক্ত। Tuesday, the 8th April, 1948 P 134-35.

পূর্বোক্ত, Tuesday, the 8th April, 1948 P 134-35.

East Bengal Legislative Assembly Proceedings, Vol. No. 4, Thursday. the 8th April, 1948, P 135.

পূর্বোক্ত।

পূর্বোক্ত।

পূর্বোক্ত।

১০ পূর্বোক্ত, পৃ ১৩৬।

পূর্বোক্ত।

১২ পূর্বোক্ত।

১৩ পূর্বোক্ত।

১৪ পূর্বোক্ত, পৃ ১৩৬-১৩৭।

১৫ পূর্বোক্ত, পৃ ১৩৭।

১৬ পূর্বোক্ত।

১৭ পূর্বোক্ত, পৃ ১৩৭-৩৮।

১৮ পূর্বোক্ত, পৃ ১৩৮।

৩১০ | বদরুদ্দীন উমর রচনাবলী খণ্ড ২

১৯ পূর্বোক্ত।

২০ পূর্বোক্ত, পৃ ১৩৮-৩৯।

East Bengal Legislative Assembly Proceedings, Vo.l. No. 4 Thursday

the 8th April, 1948, P 139-40.

২২ পূর্বোক্ত, পৃ ১৪০।

২৩ পূর্বোক্ত, পৃ ১৪০-৪১।

২৪ পূর্বোক্ত, পৃ ১৪১।

২৫ পূর্বোক্ত।

২৬ পূর্বোক্ত।

২৭ পূর্বোক্ত, পৃ ১৪২।

২৮ পূর্বোক্ত, পৃ ১৪৩।

২৯ পূর্বোক্ত।

৩০ পূর্বোক্ত।

৩১ পূর্বোক্ত।

৩২ পূর্বোক্ত।

৩৩ পূর্বোক্ত।

৩৪ পূর্বোক্ত। পৃ ১৪৪।

৩৫ পূর্বোক্ত।

৩৬ পূর্বোক্ত।

৩৭ পূর্বোক্ত।

৩৮ পূর্বোক্ত।

৩৯ পূর্বোক্ত, পৃ ১৪৪-৪৫।

৪০ পূর্বোক্ত, পৃ ১৪৫।

81 পূর্বোক্ত, পৃ ১৪৬।

৪২ পূর্বোক্ত, পৃ ১৪৭।

৪৩ পূর্বোক্ত।

৪৪ পূর্বোক্ত, পৃ ১৪৮।

৪৫ পূর্বোক্ত, পৃ ১৪৮-৪৯।

৪৬ পূর্বোক্ত, পৃ ১৪৯।

৪৭ পূর্বোক্ত, পৃ ১৫০।

৪৮ পূর্বোক্ত, পৃ ১৫০।

৪৯ পূর্বোক্ত, পৃ ১৫১।

৫০ পূর্বোক্ত, পৃ ১৫১-৫২।

৫১ পূর্বোক্ত, পৃ ১৫২।

৫২ বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি হাবিবুল্লাহ বাহারের যে একটা সত্যিকার দরদ ও ভালবাসা ছিলো তা অনস্বীকার্য। প্রাদেশিক মন্ত্রীদের মধ্যে দু’তিনজন বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার কথা চিন্তা করতেন এবং সে ব্যাপারে সহায়তা করতে ইচ্ছুক ছিলেন তাদের মধ্যে বাহার সাহেব

পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি (প্রথম খণ্ড) | ৩১১

৫৩

নিঃসন্দেহে ছিলেন অগ্রহণ্য। কিন্তু তা সত্ত্বেও মন্ত্রীত্বের প্রতি তাঁর দুর্বলতাও ছিলো অনস্বীকার্য এই দ্বিবিধ দুর্বলতার দোটানা’য় পড়ে ইচ্ছাসত্ত্বেও বাংলাভাষার আন্দোলনে তিনি পরিপূর্ণভাবে কখনো শরীক হতে পারেননি। এ ব্যাপারে তাঁর দোদুল্যমানতা ও দ্বৈত আনুগত্য ব্যবস্থাপক সভায় তাঁর এই বক্তৃতার মধ্যে সুস্পষ্ট।

East Bengal Legislative Assembly Proceedings, পূর্বোক্ত, পৃ ১৫৩-৫৪।[৫৪ পূর্বোক্ত, পৃ ১৫৪।

৫৫ পূর্বোক্ত, পৃ ১৫৫-৫৬।

৫৬ পূর্বোক্ত, পৃ ১৫৭।

৫৭ মাননীয় মি: হাবিবুল্লাহ সাহেব এই সময় পুঁথিখানি সকলকে দেখান।

৫৮ পূর্বোক্ত, পৃ ১৫৭-৫৮।

৫৯ পূর্বোক্ত, পৃ ১৫৮।

৬০ পূর্বোক্ত, পৃ ১৫৮।

৬১ পূর্বোক্ত, পৃ ১৫৯।

৬২ পূর্বোক্ত।

৬৩ পূর্বোক্ত, পৃ ১৫৯- ৬১।

68

East Bengal Legislative Assembly Proceedings, Vo.l, No. 4 Thursday the 8th April, 1948, P 161.

৬৫ পূর্বোক্ত।

৬৬ পূর্বোক্ত, পৃ ১৬২।

৬৭. পূর্বোক্ত, পৃ ১৬২-৬৩।

৬৮ পূর্বোক্ত, পৃ ১৬৩।

৬৯ পূর্বোক্ত।

৭০ পূর্বোক্ত, পৃ ১৬৪।

পূর্বোক্ত।

৭২ পূর্বোক্ত।

৭৩ পূর্বোক্ত, পৃ ১৬৫।

৭৪ পূর্বোক্ত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *