৮. আরবী হরফ প্রবর্তনের ষড়যন্ত্র

অষ্টম পরিচ্ছেদ – আরবী হরফ প্রবর্তনের ষড়যন্ত্র

১. ফজলুর রহমানের উদ্যোগ

উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার মধ্যেই কেন্দ্রীয় সরকারের বাংলা ভাষা বিরোধী চক্রান্ত সীমাবদ্ধ ছিলো না। বাংলাকে ধ্বংস করার অন্যতম উপায় হিসাবে তাঁরা বাংলা ভাষায় আরবী হরফ প্রবর্তনের উদ্যোগ ১৯৪৭ সাল থেকেই শুরু করেছিলেন। বাঙলাদেশের প্রতিনিধি কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ফজলুর রহমানই ছিলেন এই হরফ পরিবর্তন প্রচেষ্টার ‘দার্শনিক’ এবং মূল প্রবক্তা।

নানা বক্তৃতা বিবৃতির মাধ্যমে তিনি বাংলা ভাষার হরফ পরিবর্তনের গুরুত্ব ব্যাখ্যা করে ক্রমাগতভাবে প্রচার করেন যে পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় সংহতি এবং জনগণের মধ্যে অর্থপূর্ণ ঐক্য রক্ষা ও সুদৃঢ় করার জন্যে পাকিস্তানের সকল ভাষার অক্ষর এক হওয়া উচিত। সিন্ধী, পশতু, পাঞ্জাবী ইত্যাদির হরফ আরবীর মতো অথবা অনেকাংশে সেই রকম। কাজেই সেখানে বিশেষ কোন অসুবিধা নেই। যত অসুবিধা বাংলার ক্ষেত্রে। কারণ বাংলা ভাষার অক্ষর দেবনাগরী থেকে উদ্ভূত এবং তার সঙ্গে আরবী হরফের কোন সাদৃশ্যই নেই। কাজেই বাংলার ক্ষেত্রে পরিবর্তনটা একেবারে মৌলিক। কিন্তু তা হলেও আরবী অক্ষর প্রচলন ব্যতীত বাংলাভাষীদের সাথে পশ্চিম পাকিস্তানবাসীর যথার্থ সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ঐক্য সম্ভব নয়। সেদিক দিয়ে এই পরিবর্তন অবশ্য প্রয়োজনীয়। ১৯৪৭ সাল থেকে শুরু হলেও আরবী হরফ প্রবর্তনের এই ষড়যন্ত্র ভালোভাবে দানা বাঁধে ১৯৪৯ সালে।

২৭শে ডিসেম্বর, ১৯৪৮, করাচীতে নিখিল পাকিস্তান শিক্ষক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেই সম্মেলনের উদ্বোধনী ভাষণে[১] পাকিস্তানের শিক্ষা সচিব ফজলুর রহমান পাকিস্তানের শিক্ষাকে ইসলামী আদর্শের ভিত্তিতে গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করেন এবং বাংলা ভাষায় আরবী হরফ প্রচলনের পক্ষে যুক্তি দিতে গিয়ে বলেন যে তার দ্বারা আঞ্চলিক ভাষাগুলির সংরক্ষণের কাজ সাধিত হবে। এছাড়া আরবী বর্ণমালা পাকিস্তানের বিভিন্ন প্রদেশের শিক্ষাগত সামঞ্জস্য বিধানেও সহায়তা করবে।

আরবী হরফ সম্পর্কে নিজের এই বক্তব্য ফজলুর রহমান ৭ই ফেব্রুয়ারী ১৯৪৯ এ পাকিস্তান শিক্ষা উপদেষ্টা বোর্ডের পেশোয়ারে অনুষ্ঠিত একটি সভায় আরও বিশদভাবে পেশ করেন। সহজ এবং দ্রুত যে হরফের ভাষা পড়া যায় সেই হরফই সব চাইতে ভালো। কোন হরফটা ভাল তাহা ঠিক করার পূর্বে একবার বিভিন্ন প্রদেশের হরফের বিচার প্রয়োজন। সিন্দু ভাষা হইতেছে সিন্ধী কিন্তু তার হরফ আরবী। পশ্চিম পাঞ্জাবের ভাষা উর্দু হইলেও তার হরফ ‘নাসতালিক’। পূর্ববঙ্গের ভাষা ও হরফ দুই বাংলা। কিন্তু সীমান্ত প্রদেশ ও বেলুচিস্তানের ভাষা পশতু হইলেও বহুলাংশে আরবী। বাংলায় বহু সংযুক্ত অক্ষর এর স্বরবর্ণের নানা চিহ্ন থাকায় উহা টাইপ রাইটিং বা শর্ট হ্যাণ্ডে ব্যবহার করা যায় না। নাসতালিক হরফ সম্বন্ধে ও অসুবিধা। ঐ অবশিষ্ট হরফসমূহের মধ্যে আরবীই সহজ এবং টাইপ রাইটিংয়েও ব্যবহার করা যাইতে পারে। রোমান হরফের ন্যায় ইহার ষোলোটি মূলরূপ আছে। সুতরাং দ্রুত লিখন ও পঠনের পক্ষে সুবিধাজনক বলিয়া আরবীকেই পাকিস্তানের হরফ করা উচিত। আমাদের দেশবাসীর শতকরা মাত্র দশভাগ লেখাপড়া জানে এবং অবশিষ্ট ৯০ ভাগ লিখিতে বা পড়িতে পারে না। হরফ আরবীই হউক বা আর যাহা হউক তাহাতে তাদের কিছু যায় আসে না। তবে সহজ হরফ প্রবর্তিত হইলে দেশের নিরক্ষরতা দূর করার পথ সুগম হইবে।[২]

ফজলুর রহমানের উপরোক্ত বক্তব্যকে মোটামুটি চার ভাগে বিভক্ত করা চলে। ক. যে হরফের মাধ্যমে যত সহজে ও তাড়াতাড়ি পড়া যায় সেই অক্ষর তত ভালো। খ. বাংলায় বহু সংযুক্ত অক্ষর ইত্যাদি থাকায় টাইপ রাইটারে এবং শর্ট হ্যাণ্ডের কাজে তা ব্যবহারের অসুবিধা। গ. এ সব দিক দিয়ে আরবী হরফই সর্বাপেক্ষা সহজ এবং উপযোগী। ঘ. আমাদের দেশের শতকরা ৯০ ভাগ নিরক্ষর কাজেই তাদেরকে আরবী হরফে শিক্ষা দিলে জনগণের নিরক্ষরতা দূর করা বহুলাংশে সহজ হবে। আরবী হরফের মাধ্যমে পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ঐক্য স্থাপন সহজতর হবে এই যুক্তি পূর্বে অনেক ক্ষেত্রে উল্লেখ করলেও এই বক্তৃতার মধ্যে তার কোন উল্লেখ নেই। কিন্তু তা সত্ত্বেও এই শেষোক্ত বক্তব্যটির উপর পরবর্তীকালে অনেক বেশী গুরুত্ব আরোপ করা হয়।

বাংলা ভাষায় আরবী হরফ প্রবর্তনের পক্ষে ফজলুর রহমানের উদ্যোগ সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য হলেও অন্যান্য বাঙালী মন্ত্রী এবং আমলাদের কৃতিত্বও এক্ষেত্রে কম ছিলো না। এমনকি হাবিবুল্লাহ বাহার পর্যন্ত বাংলাতে আরবী হরফ প্রবর্তনের প্রভাবকে ‘বিজ্ঞান সম্মত’ উপায়ে বিচার করার পরামর্শ দিয়ে এ ব্যাপারে ভাবাবেগের দ্বারা বাঙালিদেরকে চালিত না হওয়ার পরামর্শ দান করেন।[৩]

১৯৪৮ সালে ফজলুর রহমান সৈয়দ আলী আহসান এবং অন্যান্য কয়েকজনের সাথে মওলা সাহেবের বাসায় আরবী হরফ প্রবর্তন সম্পর্কে আলোচনা করেন। আলী আহসান তাঁকে বলেন যে পরিকল্পনাটির সম্ভাব্যতা পরীক্ষার জন্যে ডক্টর শহীদুল্লাহই সর্বাপেক্ষা উপযুক্ত ব্যক্তি, কাজেই তাঁকে সেই দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে। এরপর ফজলুর রহমান সরাসরি ডক্টর শহীদুল্লাহর সাথে কোন যোগাযোগ না করে তৎকালীন কেন্দ্রীয় শিক্ষা উপদেষ্টা মাহমুদ হাসানকে দিয়ে তাঁর কাছে একটি চিঠি দেন। সেই চিঠিতে মাহমুদ হাসান ডক্টর শহীদুল্লাহকে লেখেন যে সরকার সিদ্ধান্ত করেছেন পাকিস্তানকে ইসলামী মতে গঠন করতে এবং সেই উদ্দেশ্যে তাঁরা বাংলা ভাষায় আরবী অক্ষর প্রবর্তন করতে চান। এবং এর জন্যে তাঁর সাহায্য পেলে তাঁরা উপকৃত হবেন।ধ

ডক্টর শহীদুল্লাহ মাহমুদ হাসানের এই চিঠির কোন উত্তর না দিয়ে চিঠিটির সারমর্ম প্রেসের কাছে প্রকাশ করেন এবং তা কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকায় ছাপা হয়। এর কিছুকাল পরে ১৯৪৯-এর ১৪ই ডিসেম্বর ঢাকাতে শিক্ষা উপদেষ্টা বোর্ডের একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হলে সেই সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর তাঁদের সম্মানার্থে নিজের বাসভবনে একটি চা চক্রের আয়োজন করেন। মাহমুদ হাসান এবং ডক্টর শহীদুল্লাহ উভয়েই সেখানে উপস্থিত ছিলেন। আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের উল্লেখ করে হাসান ডক্টর শহীদুল্লাহকে বলেন যে তিনি আসলে দেশদ্রোহী তা না হলে সরকার থেকে তাঁর কাছে একটা জরুরী ব্যাপারে পত্র দিলে যথাস্থানে তার উত্তর না দিয়ে প্রেসের কাছে, বিশেষতঃ বিদেশী প্রেসের কাছে তিনি কখনই তার বিবরণ প্রকাশ করতে পারতেন না। ডক্টর শহীদুল্লাহ এর জবাবে বলেন যে তাঁর চিঠির উত্তর দেওয়ার কোন প্রয়োজন তিনি বোধ করেননি এবং প্রেসের লোকেরা তাঁকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করায় তিনি তাদেরকে সেটা জানিয়ে দিয়েছেন।[৫]

প্রাদেশিক শিক্ষা দফতরের সেক্রেটারী ফজলে আহমদ করিম ফজলী ছিলেন বাংলাতে আরবী হরফ প্রবর্তনের অন্যতম প্রধান উদ্যোক্তা। তিনি এবং ফজলুর রহমান উভয়ে চট্টগ্রামের মৌলানা জুলফিকর আলীকে দিয়ে ‘হুরুফুল কোরাণ সমিতি’ নামে একটি সমিতি প্রতিষ্ঠা করে তার মাধ্যমে আরবী হরফ বাংলাতে প্রবর্তনের আন্দোলন গঠনের চেষ্টা করেন। ঐ প্রচেষ্টার সাথে টিচার্স ট্রেনিং কলেজের ওসমান গণি এবং আরমানীটোলা ইস্কুলের ‘মৌলভী’ মৌলানা আবদুর রহমান বেখুদও যুক্ত ছিলেন।[৬] জুলফিকর আলী ‘পূর্ব-বাঙলা ভাষা কমিটির’ উর্দু হরফ সাব কমিটির সদস্যও মনোনীত হয়েছিলেন এবং সেই হিসাবে মূল কমিটির কাছে বাংলা ভাষায় উর্দু হরফ প্রবর্তনের সুপারিশও তিনি করেন। এ এ সম্পর্কে পূর্ব-বাঙলার শিক্ষা বিভাগের প্রাক্তন ডিরেক্টর আবদুল হাকিম বলেন:

জনৈক বাঙ্গালী উজীর সাহেবের* নিজের উর্দু জ্ঞান সম্পর্কে ঢাকাতে কিছু কিছু হাস্যোদ্দীপক কিংবদন্তী শ্রুত হয়।… ইনি কেন্দ্রের সর্বশক্তিমান উর্দু মহলে বাহবা পেতে চেয়ে বাঙলা ভাষাকে ‘হুরুফুল কুরআন’ দ্বারা সুশোভিত করবার জন্য তাঁর উদগ্র আকাঙ্ক্ষাকে কার্যকরী করতে চেয়েছিলেন। এজন্য বই-পুস্তক প্রকাশনার জন্য বার্ষিক ৩৫ হাজার টাকার একটা কেন্দ্রীয় মঞ্জুরীও তিনি পূর্বোক্ত প্রাদেশিক শিক্ষা সেক্রেটারীর** হাতে দেবার ব্যবস্থা করেন।

এদিকে শিক্ষা সেক্রেটারী পূর্বে চাটগাঁয়ে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট থাকাকালে তথাকার জনৈক স্কুল-মৌলবীকে হাত করেছিলেন। মৌলবী সাহেব বৃদ্ধ ও নিতান্তই ভালো মানুষ। তিনিই ‘হুরুফুল কুরআন’ নামের উদ্ভাবক ও এ বিষয়ে কতকগুলি বই-পুস্তকের রচক। তিনি তাঁর সরল, কিন্তু ভ্রান্ত বিশ্বাস মতে মনে করতেন যে মুসলমানদের জন্য শুধু ‘হুরুফুল কুরআন’ হবে একমাত্র লিখন পদ্ধতি; তাদের অন্য কোন হরফ শেখবার দরকার নেই। তিনি একদিন আমাকে এ বিষয়ে কিছু উপদেশ দিতে চেষ্টা করেছিলেন। শিক্ষা-বিভাগীয় সেক্রেটারী এই ব্যক্তির ‘হুরুফুল কুরআন’ পরিকল্পনা সম্পর্কে বেনামে ইংরেজী ভাষায় পুস্তিকা প্রচার করে অবুঝ বাঙালীদেরকে বুঝাতে চেয়েছিলেন যে একমাত্র ‘হুরুফুল কুরআনই,’ আমাদের পূর্ব- বাঙলার ভাষা-সমস্যা সমাধান করবে। এই পরহেজগার, নিঃস্বার্থ কিন্তু এক দেশদশী বাঙালী মৌলবীকে সামনে রেখে বাঙলা ভাষা নিধন ব্রতে পূর্বোক্ত চক্র অগ্রসর হতে থাকে। এই চক্রের বিরোধিতা করার জন্য তৎকালীন বাঙালী শিক্ষা ডিরেক্টর (ডিপিআই) নানা বাহানায় প্রদেশের বাইরে স্থানান্তরিত হন এবং তাঁর স্থলে জনৈক উর্দুভাষী অবাঙালীকে*** ডিরেক্টর করা হয়। এই শেষোক্ত ব্যক্তির হঠাৎ অকালমৃত্যু ঘটে বাঙলা-ভাষা আন্দোলনকালে (১৯৫২, ফেব্রুয়ারী) হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হবার ফলে। তার পর আমি কয়েকদিনের জন্য ঐ পদে বসি। তখন তাঁর পরিত্যক্ত কাগজ-পত্রের ভেতর দেখা গেল যে তিনি প্রাদেশিক সরকারকে একটি প্রস্তাবে বলেছিলেন যে বাঙালী মুসলমানদের ভাষা উর্দুরই একটি রূপান্তর মাত্র এবং উর্দু হরফে লিখলে ইহা উর্দু বলেই মনে হবে।[৮]

[*ফজলুর রহমান- ব. উ

**ফজলে আহমদ করিম ফজলী- ব. উ।

*** উত্তর প্রদেশের ফজলুর রহমান- ব. উ।]

২. কেন্দ্রীয় শিক্ষা উপদেষ্টা বোর্ডের কার্যকলাপের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ

১৯৪৯ সালের গোড়ার দিকেই কেন্দ্রীয় শিক্ষা উপদেষ্টা বোর্ড বাংলা ও অন্যান্য প্রাদেশিক ভাষা আরবী হরফে লেখার ব্যবস্থা প্রবর্তনের সুপারিশ পেশ করেছেন বলে একটি খবর প্রচারিত হয়। পূর্ব-বাঙলা ব্যবস্থাপক সভার অধিবেশন চলাযোগে ২৯শে মার্চ মনোরঞ্জন ধর পরিষদে এ ব্যাপারে শিক্ষা মন্ত্রী আবদুল হামিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এর জবাবে মন্ত্রী একটি লিখিত বিবৃতিতে বলেন যে, শিক্ষা উপদেষ্টা বোর্ড পূর্ব বাঙলা অথবা অন্য কোন প্রাদেশিক সরকারের কাছে অনুরূপ কোন প্রস্তাব বা সুপারিশ পেশ করেন নাই।[৯ সরকারীভাবে প্রাদেশিক মন্ত্রী আরবী হরফ প্রবর্তনের ষড়যন্ত্রকে অস্বীকার করলেও সে বিষয়ে ছাত্র এবং বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের মধ্যে সন্দেহের অবসান ঘটেনি। এই সন্দেহের মূল কারণ প্রশ্নটি শিক্ষা উপদেষ্টা বোর্ডের বিবেচনাধীন ছিলো। আরবী হরফকে কেন্দ্রীয় শিক্ষা দফতরের মাধ্যমে বাঙালীদের উপর চাপিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে ছাত্র সম্প্রদায় এবং জনসাধারণকে সাবধান করার উদ্দেশ্যে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগের ‘ভাষা কমিটির’ পক্ষ থেকে নঈমুদ্দীন আহমদ সংবাদপত্রে নিম্নলিখিত বিবৃতি প্রদান করেন:

পূর্ব পাকিস্তান পরিষদে সর্ব সম্মতিক্রমে গৃহীত গত বছরের প্রস্তাবটি উর্দু চাপানোর চেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিয়েছিল। আর একই পরিষদে গৃহীত প্রস্তাবকে বাতিল করতে পারে না। ভবিষ্যতে নব নির্বাচিত পরিষদও এ প্রস্তাবকে নাকচ করবার সাহস করবে না। কাজেই উর্দুর জন্য সামনের দুয়ার যখন রুদ্ধ তখন আরবী বর্ণমালার জিগীর তুলে পশ্চাৎ দুয়ার দিয়ে উর্দু প্রবর্তনের চেষ্টা হচ্ছে এবং পরিষদে গৃহীত প্রস্তাব ও বাংলা ভাষাকে খতম করবার ষড়যন্ত্র চলছে। যখনই আলেম সমাজ আরবীকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবী জানিয়েছেন তখনই এঁরা নীরবতা অবলম্বন করেছেন। আরবীকে বাধ্যতামূলক দ্বিতীয় ভাষা করার ব্যাপারেও এঁদের মুখে কথা নেই।

যে জিনিষটা পূর্ব পাকিস্তানের বুদ্ধিজীবীদের মনে সবচেয়ে বেশী আলোড়নের সৃষ্টি করেছে সেটা হচ্ছে এই যে, পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষিত লোকের হার শতকরা ১২ থেকে ১৫ জন; কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানে শতকরা ৫ জনেরও কম। আরবী বর্ণমালার দোহাই দিয়ে শতকরা এই ১৫জন শিক্ষিতকে কলমের খোঁচায় অশিক্ষিতে পরিণত করবার চেষ্টা চলছে। এমনিভাবে সাম্রাজ্যবাদী বৃটিশ সরকারও ইংরেজী প্রচলন করে ভারতের আরবী-পারসী শিক্ষিত মুসলমানকে কলমের এক খোঁচায় অশিক্ষিতে পরিণত করবার ষড়যন্ত্রে সাফল্যমণ্ডিত হয়েছিল। আরবী বর্ণমালা প্রচলিত হলে পশ্চিম পাকিস্তানের শিক্ষিতের হার ঠিকই থাকবে পক্ষান্তরে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষিতের হার শতকরা ১৫ থেকে নেমে আসবে নগণ্য ভগ্নাংশে। শিক্ষক অভাবে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষা ব্যবস্থা বর্তমান অবস্থাতেই অচল অবস্থার সম্মুখীন হয়েছে। এমতাবস্থায় সমস্ত শিক্ষিত সম্প্রদায় অশিক্ষিত বলে পরিগণিত হলে পূর্ব পাকিস্তানের গোটা শিক্ষা ব্যবস্থাই বানচাল হয়ে যাবে।

কাজেই ‘তোঘলকী’ প্ল্যানের উদ্যোক্তাদের আমরা স্বার্থহীন ভাষায় জানিয়ে দিতে চাই যে আরবী বর্ণমালার ধুয়া তুলে গত বছরের ভাষা প্রস্তাবকে নাকচ করার ষড়যন্ত্রকে আমরা কোনমতেই সহ্য করে নেব না।[১০]

এর পর ভাষা সংস্কার কমিটি প্রসঙ্গে নঈমুদ্দীন আহমদ বলেন:

আফসোসের বিষয় পরিষদের এ সিদ্ধান্তকে কার্যকরী করার জন্য গত ১৩ মাসের মধ্যে সরকারের তরফ হইতে কোন চেষ্টা হয় নাই। অন্তত ৪ বার ভাষা সংস্কার কমিটি গঠনের খবর সংবাদপত্রে প্রকাশিত হইয়াছে এবং জনাব মওলানা মহম্মদ আকরম খাঁ সাহেব প্রত্যেকবারেই এ সংবাদ অস্বীকার করিয়াছেন। প্রকাশ শিক্ষা দফতর হইতে ভাষা সংস্কার কমিটি নিয়োগ সম্পৰ্কীয় ফাইলটা গত ১২ মাস নিখোঁজ থাকে এবং আজও নাকি তাহা পাওয়া যায় নাই। বর্তমান বাজেট অধিবেশনের পূর্ব মুহূর্তে ভাষা সমস্যা বিশেষ করিয়া বর্ণমালা সম্পর্কীয় আন্দোলন যখন দানা বাঁধিয়া উঠিতে শুরু করে ঠিক সেই সময় উহা বন্ধ করার জন্যই একটা কমিটির নাম প্রচার করা হয়। সত্যিকার ভাষাবিদদের বাদ দিয়া যিনি বাংলা ভাষার জন্য জেহাদ করিতে চাহিয়া পরে চুপ করিয়া গিয়াছেন তাঁহাকেই সভাপতি এবং জনৈক সমর্থককে কমিটির সেক্রেটারী নিযুক্ত করা হইয়াছে। কমিটির সদস্যদের মধ্যে চক্ষু ও ক্ষত চিকিৎসকও আছেন। কমিটিতে দুইজন ভাষাবিদকে অবশ্য লওয়া হইয়াছে, সম্ভবত সে শুধু লোক দেখানোর জন্যই।

আমরা দ্বিধাহীন ভাষায় জানাইয়া দিতে চাই যে আরবী বর্ণমালার ধুয়া তুলিয়া গত বছরের ভাষা প্রস্তাবকে নাকচ করার চেষ্টা ছাত্র সম্প্রদায় ও জনসাধারণ বরদাস্ত করিবে না।[১১]

এর পূর্বে বিশ্ববিদ্যালয় নিম্ন কর্মচারী ধর্মঘট শুরু হওয়ার ঠিক পরই ফজলুল হক হল মিলনায়তেন ৪ঠা মার্চ বিকেল ৪-৩০ মিনিটে ‘পূর্ব পাকিস্তানের হরফ সমস্যা’ এবং ‘সোজা বাংলা’ প্রবর্তন সম্পর্কে তমদ্দুন মজলিশের সাহিত্য শাখার উদ্যোগে একটি আলোচা সভা অনুষ্ঠিত হয়। সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত স্থায়ী সেই সভায় সভাপতিত্ব করেন জগন্নাথ কলেজের অধ্যক্ষ আবদুর রহমান খান। ‘সোজা বাংলার’ উপর ডক্টর শহীদুল্লাহ একটি প্রবন্ধ পাঠ করেন। এর পর আলোচনা করেন কাজী মোতাহার হোসেন এবং সৈনিক সম্পাদক শাহেদ আলী চাটগাঁ সরকারী কলেজের অধ্যাপক ফেরদৌস খানের লেখা একটি ইংরেজী পুস্তিকার সহজ বাংলা অনুবাদ পাঠ করে সকলকে শোনান। পরিশেষে সভায় বাংলা ভাষার হরফ নির্ধারণের দায়িত্ব সত্যিকার ভাষা বিশেষজ্ঞদের উপর ছেড়ে দেওয়ার দাবী জানিয়ে শিক্ষা উপদেষ্টা কমিটির সুপারিশের বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দাসূচক একটি প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়।[১২] পূর্ব-বাঙলার বিশিষ্ট শিক্ষাবিদদের প্রতিবাদ জ্ঞাপনের সাথে সাথে বিশ্ববিদ্যায়ের ছাত্রেরাও এ ব্যাপারে সুষ্ঠুভাবে চিন্তাভাবনা শুরু করেন এবং ১৯৪৯ এর এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ছাত্রছাত্রীদের পক্ষ থেকে হরফ প্রশ্ন সম্পর্কে পাকিস্তান শিক্ষা উপদেষ্টা বোর্ড ও বর্ণমালা বিবেচনার বিশেষজ্ঞ কমিটির কাছে একটি স্মারকলিপি পেশ করা হয়।[১৩] এই স্মারকলিপিটিতে তাঁরা বলেন:

আমরা মনে করিতেছি যে, আরবী হরফ প্রণয়ন প্রচেষ্টার দ্বারা পৃথিবীর ৬ষ্ঠ স্থানাধিকারী বিপুল ঐশ্বর্যময়ী ও আমাদের জাতীয় জীবনের গৌরবের ঐতিহ্যবাহী বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির উপর হামলা করা হইতেছে। পাকিস্তানের জাতীয়তার ভিত্তি দৃঢ়তর করিতে, জাতীয় সংস্কৃতিকে অগ্রগামী করিতে এবং দুনিয়ার অন্যান্য জাতির সহিত আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতায় ইহাকে আত্মনির্ভরশীল ও সুপ্রতিষ্ঠিত করিতে অগ্রসর হইয়া বাংলার মতো একটি আঞ্চলিক প্রগতিশীল ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির উপর এই প্রকার নির্বোধ আক্রমণ কেবলমাত্র আমাদের জাতীয় জীবনের বন্ধ্যাত্ব এবং পশ্চাদগতিই টানিয়া আনিবে না বরং ইহার অপমৃত্যুই ডাকিয়া আনিবে। অতএব সংস্কার মোহ এবং স্বার্থশূন্য দৃষ্টিতে আমরা আমাদের জাতীয় নেতৃবৃন্দ, আইন পরিষদে নির্বাচিত প্রতিনিধিবৃন্দ এবং জাগ্রত জনসাধারণকে বিষয়টি বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ হইতে ধীর ও স্থির মস্তিষ্কে বিবেচনা করিয়া সিদ্ধান্তে উপনীত হইতে আরজ জানাইতেছি। নিঃসন্দেহে বাংলায় আরবী হরফ প্রণয়ন যে জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় জীবনের অগ্রগতিকে চিরতরে রুদ্ধ করিয়া দিবে তাহার স্বপক্ষে আমরা নিম্নলিখিত বৈজ্ঞানিক ও পক্ষপাতশূন্য যুক্তি উপস্থাপিত করিতেছি:

পাকিস্তান শিক্ষা উপদেষ্টা বোর্ড পাকিস্তানের প্রাদেশিক ভাষাগুলির জন্য আরবী হরফের যে সুপারেশ করিয়াছেন একমাত্র বাংলার উপরই তাহার আঘাত তীব্র এবং ব্যাপকভাবে পড়িবে। পাঞ্জাবী, সিন্ধী, ব্রাহুই, বেলুচী, পশ্তু এবং বাংলা – পাকিস্তানের এই প্রাদেশিক ভাষাগুলির মধ্যে একমাত্র বাংলাই সাহিত্য সম্পর্কে ভাব ঐশ্বর্যে, প্রকাশভঙ্গীর ঔৎকর্ষে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ভাষাগুলির মধ্যে অন্যতম। অন্যান্যগুলির সাহিত্যে কোন চর্চা নেই এবং বর্তমানে এই মৃতকল্প ভাষাগুলি উর্দু হরফেই লিখিত হইতেছে। কাজেই হরফ পরিবর্তনের আঘাত পাকিস্তানের সর্বপ্রধান এবং অধিক সংখ্যক লোকের ভাষা বাংলার উপরই পড়িবে। অনভিজ্ঞ এবং মুর্খ লোকেই শুধু বলিতে পারে হরফ পরিবর্তনে ভাষার কোন ক্ষতি বৃদ্ধি নাই।

পাকিস্তানের প্রদেশগুলির এবং মুসলিম দেশগুলির সাংস্কৃতিক ঐক্যের অজুহাত হরফ পরিবর্তনের প্রধান যুক্তি। কিন্তু সাংস্কৃতিক ঐক্যের উপায় কি হরফ? ইহা যাহারা বলে, হয় তাহারা কিছুই বুঝে না, না হয় লোককে ভুল বুঝাইবার চেষ্টা করে।

রাজনৈতিক ভূঁইফোড়েরা বা সাংস্কৃতিক অপগণ্ডের দল হরফকে ঐক্যের উপায় মনে করিতে পারে, কিন্তু সাংস্কৃতিক ঐক্যের উপায় পারস্পরিক সংস্কৃতির প্রতি দরদ। পাকিস্তানের সংস্কৃতি যদি সর্বাঙ্গীণ বিকাশ এবং পরিপূর্ণ উৎকর্ষ লাভ করে তাহা হইলেই মাত্র অন্যান্য মুসলিম দেশগুলির শ্রদ্ধা আকর্ষণ করিয়া সাংস্কৃতিক ঐক্যের পথ পরিষ্কার করিতে পারে। পাকিস্তানের প্রতিটি অঞ্চল, প্রতিটি শহর, গ্রাম যদি পরিপূর্ণভাবে আত্মপ্রকাশ করিতে পারে তবেই পাকিস্তানের সুস্থ সবল সর্বাত্মক-সংস্কৃতি গড়িয়া উঠিতে পারে। কিন্তু অবাঞ্ছনীয় জেদ এবং ক্ষুদ্র স্বার্থের বশবর্তী হইয়া যদি পাক-বাংলার আত্মসংস্কৃতির উৎকর্ষের পথ বন্ধ করা হয়, তাহা হইলে পাকিস্তানের সামগ্রিক সংস্কৃতিকেই আঘাত করা হইবে, মুসলিম জাহানের ঐক্যের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করা হইবে।…

পাক-বাংলার শতকরা ৯৫ জন অশিক্ষিত লোকের মধ্যে দ্রুত শিক্ষা বিস্তারের প্রয়োজন। বহুসংখ্যক শিক্ষিত লোককে এই কার্যের জন্য অগ্রসর হইতে হইবে। কিন্তু বাংলা হরফ পরিবর্তনের মধ্য দিয়া পাক-বাংলার শিক্ষিত সমাজকে অশিক্ষিতের শ্রেণীতে পরিণত করার চক্রান্ত সফল হইলে কে তাহাদিগকে শিক্ষা দান করিবে? এ পর্যন্ত যে লক্ষ লক্ষ পুস্তক বাংলা ভাষায় ছাপা হইয়াছে কে কবে সেগুলিকে আরবী হরফে রূপান্তরিত করিবে? হরফ পরিবর্তনের পশ্চাতে আছে শিক্ষা বিস্তারকে ব্যাহত করিবার ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র।

হরফ পরিবর্তনের মধ্য দিয়া পাক-বাংলার শিক্ষিত সমাজের উপরও ঘৃণিত আঘাত নামিয়া আসিতেছে। হরফ পরিবর্তনের বিশৃঙ্খলার মধ্যে দিশাহারা শিক্ষিত সমাজ সৃষ্টির অনুপ্রেরণাকে স্থায়ী রূপ দান করিতে পারিবে না। আজাদীর মধ্য দিয়া লব্ধ পাক-বাংলার নূতন জীবন চেতনাকে যদি হরফ পরিবর্তনের অছিলায় ব্যর্থ করিয়া দেওয়া হয় তাহা হইলে পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক জীবনের অপূরণীয় ক্ষতি হইবে। আঞ্চলিক প্রভুত্ব লাভের দূরাকাঙ্ক্ষা এমনিভাবে পাকিস্তানের শত্রুতা করিতে যাইতেছে। পাক-বাংলার মনে নূতন পরাধীনতার আশঙ্কাকে কায়েম করিয়া তুলিতেছে। সংস্কারমুক্ত মন লইয়া মুক্তির আলোকে বিচার করিয়া দেখা যায়:

এর পর বাংলা বিভাগের ছাত্র-ছাত্রীরা নিজেদের বক্তব্যকে আরও সরাসরিভাবে উপস্থিত করার উদ্দেশ্যে বলেন :

১. বাংলাকে আরবী হরফে লিখিতে হইলে নূতন যে প্রতীকগুলি গ্রহণ করিতে হইবে, তাহা শিখিবার জন্য একজন আরবী জানা লোকের যে পরিমাণ শ্রম ও অধ্যবসায়ের প্রয়োজন, তাহা অপেক্ষা অনেক কম শ্রম অধ্যবসায়ে বাংলা হরফ শিক্ষা করা সম্ভব।

২. কাজেই কোরান তেলাওয়াতের জন্য আরবী শিখিতে হয় বলিয়া আরবী হরফে বাংলা লিখিত হইলে লোকের শ্রম লাঘব হইবে তাহা বলা চলে না।

৩. লিখন পঠনে আরবী হরফ বাংলা হরফ হইতে অধিক সময় লয়।

৪. বাংলা হরফকে অতি সহজে টাইপ লিখো টাইপ প্রভৃতির উপযোগী করিয়া লওয়া যাইতে পারে। আরবী হরফে তাহা সম্ভব নহে।

৫. নূতন শিক্ষার্থীর পক্ষে আরবী হরফ (বাংলা ধ্বনি তত্ত্বের অনুযায়ী) শিক্ষা অপেক্ষা বাংলা হরফ শিক্ষা সহজ।

৬. হরফ পরিবর্তনের ভিতর শিক্ষা দ্রুত প্রসার ব্যাহত হইবে।

৭. পাক-বাংলার শিক্ষিত লোকের উপর যে আঘাত আসিবে, তাহাতে সারা পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক পুষ্টি অবাঞ্ছনীয়ভাবে ব্যাহত হইবে।

৮. বাংলা ভাষার সর্বাঙ্গীণ পরিপুষ্টি ও উন্নত বাচনভঙ্গীর সহিত হরফ পরিবর্তনের মধ্য দিয়া বিচ্ছিন্ন হইয়া পড়িলে পাক বাংলার ভাষা সাহিত্য বিজ্ঞান প্রভৃতির গভীর ভাব প্রকাশের অনুপযোগী হইয়া পড়িবে।

৯. বাংলাকে আরবী হরফে লিখিলেই উহার সহিত আরবী হরফ জানা লোকের পরিচয় স্থাপিত হইবে না।

উপরোক্ত বক্তব্য পেশ করিবার পর স্মারকলিপিটির শেষে তাঁরা নিম্নলিখিত দাবী উত্থাপন করেন:

এই সকল বিবেচনা করিয়া, পাকিস্তানের সম্পদ ও সংস্কৃতিতে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাষ্ট্র হিসাবে দেখিতে চাই বলিয়া আমাদের দাবী অন্ধ সংস্কার ও ক্ষুদ্র স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠিয়া হরফ সম্বন্ধে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিতে হইবে। বাংলা হরফকে পরিবর্তন করা চলিবে না। পাক- বাংলার শিক্ষা ও সংস্কৃতির উপর কসাইয়ের মত ছুরি চালনা করা চলিবে না। পাক-বাংলার তাহজীব ও তমদ্দুনকে পাকিস্তানের সামগ্রিক তমদ্দুনের একটি সবল অংশ হিসাবে গড়িয়া উঠিবার সুযোগ দিতে হইবে। শিক্ষা বিস্তারকে সহজতর করিতে হইবে।

আমরা আশা করি পাকিস্তানের শিক্ষা উপদেষ্টা বোর্ড আমাদের দাবীর যৌক্তিকতা স্বীকার করিয়া পাকিস্তানের ঐক্য এবং উন্নতির প্রতি তাঁহাদের নিষ্ঠার পরিচয় দিবেন।

বাংলা বিভাগের ছাত্র-ছাত্রীদের স্মারকলিপি প্রেরণের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের প্রতিবাদ সীমাবদ্ধ ছিলো না। বিভিন্ন সভা সমিতির মাধ্যমেও তাঁরা শিক্ষা উপদেষ্টা কমিটির নানা সুপারিশের বিরুদ্ধাচরণ করেন। ১০ই ডিসেম্বর, ১৯৪৯, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী সংসদের কার্যকরী পরিষদের এক সভায় আরবী হরফে বাংলা ভাষা লিখিবার তীব্র বিরোধিতা করা হয়। সভায় গৃহীত একটি প্রস্তাবে বলা হয় যে, আরবী হরফে বাংলা ভাষা লিখিবার পরিকল্পনা পূর্ব-বাঙলার জনসাধারণের উন্নতির একান্ত পরিপন্থী। ঐরূপ পরিকল্পনা যাতে কখনই কার্যকরী না হয় তার জন্য প্রস্তাবটিতে পূর্ব বাঙলা সরকারের কাছে আবেদন জানানো হয়।[১৪]

সেই দিনই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা একটি পৃথক সভায় আরবী হরফে বাংলা লেখার প্রস্তাবের বিরোধিতা করে একটি প্রস্তাবে দাবী জানান যে পরবর্তী ১৪ই থেকে ১৬ই ডিসেম্বর ঢাকায় পাকিস্তান শিক্ষা উপদেষ্টা বোর্ডের যে অধিবেশন হবে তাতে বাংলা ভাষার হরফ পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত যেন গৃহীত না হয়।[১৫]

১১ই ডিসেম্বর বেলা ২টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবন প্রাঙ্গণে এক ছাত্র সভায় আরবী হরফে বাংলা ভাষা লেখার প্রচেষ্টা সম্পর্কে আলোচনা হয়। সভায় বিভিন্ন বক্তা উক্ত প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে বক্তৃতা দেওয়ার পর একটি প্রস্তাবে তাঁরা বলেন যে আরবী হরফ প্রবর্তিত হলে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলে নিরক্ষরতা বৃদ্ধি পাবে এবং তার ফলে শিক্ষা ও রাজনীতি ক্ষেত্রে পূর্ব বাঙলার অপমৃত্যু ঘটবে। এ ছাড়া অন্য একটি প্রস্তাবে বাংলার বিরুদ্ধে উর্দুর প্রচার কার্যের প্রতিবাদ করায় ইডেন কলেজের দু’জন ছাত্রীকে উক্ত কলেজের অধ্যক্ষা শাস্তি দেওয়ার যে হুমকি দেখান তারও নিন্দা করা হয়।[১৬]

ঐ একই দিনে ইকবাল হলের ছাত্রবৃন্দ একটি সভায় আরবী হরফে বাংলা লেখার প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন। আরবী হরফে বাংলা লেখা হলে সাধারণভাবে সমগ্র পাকিস্তানে এবং বিশেষভাবে পূর্ব-বাঙলায় অগ্রগতির পথ রুদ্ধ হবে এই মর্মে সভায় মত প্রকাশ করা হয়। জাতির সাংস্কৃতিক ও ব্যবহারিক উন্নতির স্বার্থে আরবী হরফে বাংলা লেখার পরিকল্পনা পরিত্যাগ করে বাংলা হরফ ভাষা সাহিত্য ও শিক্ষাকে যুগোপযোগী করে তোলার জন্যে এই সভায় গৃহীত একটি প্রস্তাবের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট মহলকে অনুরোধ জানানো হয়।[১৭] একটি ছাত্র প্রতিনিধি দল ১১ই ডিসেম্বর পূর্ব-বাঙলা ব্যবস্থা পরিষদের সদস্যদের সাথে সাক্ষাৎ করে তাঁদেরকে বাংলা হরফের পক্ষ সমর্থনের জন্যে অনুরোধ জানান। এই সাক্ষাৎকারের পর জানা যায় যে অধিকাংশ পরিষদ সদস্যই আরবী হরফে বাংলা লেখার বিরোধী।[১৮] শুধু ছাত্র সম্প্রদায়ের মধ্যে নিজেদের কর্মসূচীকে সীমাবদ্ধ না রেখে ছাত্রেরা এই সময় আরবী হরফ প্রচলনের বিরোধিতা করে বিভিন্ন এলাকায় জনসাধারণের স্বাক্ষর সংগ্রহ শুরু করেন।[১৯]

বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা ছাড়া জগন্নাথ কলেজ, ইডেন কলেজ প্রভৃতি শিক্ষায়তনগুলিতেও আরবী হরফ প্রবর্তনের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। শুধু ঢাকা শহরেই নয়, প্রদেশের অন্যান্য স্থানেও এই ধরনের বহু সভা সমিতির খবর সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়।[২০] এই সমস্ত সভাগুলিতেই আরবী হরফ প্রচলনের প্রচেষ্টা থেকে বিরত হওয়ার জন্যে শিক্ষা উপদেষ্টা বোর্ডের কাছে তাঁরা দাবী জানান।

ঢাকা এবং প্রদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আরবী হরফ প্রবর্তনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সভা ও বিক্ষোভের ফলে সে সম্পর্কে পূর্ব-বাঙলা সরকার ১৪ই ডিসেম্বর একটি প্রেসনোট[২১] জারী করে তাতে বলেন যে, বাংলা ভাষা বাংলা হরফে লেখা হবে, না আরবী হরফে লেখা হবে সেটা পূর্ব বাঙলার জনসাধারণই তাদের স্বাধীন মতামতের দ্বারা নির্ধারণ করবে। পাকিস্তান শিক্ষা উপদেষ্টা বোর্ডের অধিবেশনে এ সম্পর্কে কোন আলোচনাই অনুষ্ঠিত হবে না। প্রেসে নোটটিতে আরও বলা হয়:

বাংলা ভাষায় আরবী হরফ চাপাইয়া দেওয়ার ব্যবস্থা করা হইতেছে এবং এই উদ্দেশ্যেই পাকিস্তান শিক্ষা উপদেষ্টা বোর্ডের ঢাকা অধিবেশন অনুষ্ঠিত হইতেছে – এইরূপ মিথ্যা গুজব রটাইয়া এক বিশেষ মহলের লোকেরা ঢাকার ছাত্র সমাজের মধ্যে যে উত্তেজনা সৃষ্টির চেষ্টা করিতেছে তৎপ্রতি সরকারের দৃষ্টি আকৃষ্ট হইয়াছে। কিন্তু শিক্ষা উপদেষ্টা বোর্ডের সভায় এ সম্পর্কে কোন আলোচনাই হইবে না। কাজেই বাংলা ভাষার উপর কোন হরফ চাপাইয়া দেওয়ার প্রশ্নই আসে না। বাংলা ভাষা বর্তমান চালু হরফে লিখিত হইবে, কি আরবী হরফে লিখিত হইবে প্রদেশবাসীর স্বাধীন মতামতের দ্বারাই তাহা নির্ধারিত হইবে। যে সকল লোক স্বীয় স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে ছাত্র সমাজকে কাজে লাগাইবার চেষ্টা করিতেছে, তাহাদের এই সকল ভিত্তিহীন গুজবে বিভ্রান্ত না হইবার জন্য সরকার এতদ্বারা ছাত্রগণকে সতর্ক করিয়া দিতেছেন।

কিন্তু এই সরকারী প্রেসনোট প্রকাশিত হওয়ার দিনই পাকিস্তান সরকারের শিক্ষা মন্ত্রী ফজলুর রহমান ঢাকায় শিক্ষা উপদেষ্টা বোর্ডের বৈঠকে এক বক্তৃতায়[২২] ইসলামী নীতির ভিত্তিতে শিক্ষা পদ্ধতি প্রবর্তন এবং জাতীয় ভাষা উর্দুর সর্ববিধ উন্নতি সাধনের জন্যে দেশবাসীর কাছে আহ্বান জানান। ইসলামী শিক্ষা প্রবর্তন সম্পর্কে তিনি বলেন:

ইসলামের নীতি যে কোন দৃষ্টিভঙ্গী হইতে পরীক্ষা করিলে ইহার সহিত আধুনিক যুগের সর্বাধিক উন্নত বোধশক্তির নিখুঁত মিল দেখা যাইবে। সুতরাং বিশ্বের নববিধান প্রতিষ্ঠার কার্যে সাহায্য করার উদ্দেশ্যে ইসলামের নীতি ও আমাদের শিক্ষা পদ্ধতির মধ্যে সংযোগ স্থাপন করিতে হইবে। বর্তমানে অবিলম্বে যে সমস্যার সমাধান করা আমাদের একান্ত প্রয়োজন তাহা হইতেছে উৎকৃষ্টভাবে ইসলামের নীতির ভিত্তিতে শিক্ষা পদ্ধতি প্রবর্তন করা।

উর্দুকে পাকিস্তানের জাতীয় ভাষা রূপে বর্ণনা করে তার উন্নতি সাধন সম্পর্কে ফজলুর রহমান বলেন:

উর্দুর দ্রুত উন্নতির জন্য ব্যাপক অভিযান প্রয়োজন। পল্লী অঞ্চলে প্রাপ্তবয়স্কদের শিক্ষা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা, জনপ্রিয় সাহিত্য সৃষ্টি, অভিধান রচনা, এবং বৈজ্ঞানিক ও টেকনিক্যাল শব্দের অনুবাদ প্রাথমিক ব্যবস্থা হিসাবে একান্ত অপরিহার্য।… সিন্ধু ব্যতীত পশ্চিম পাকিস্তানের সর্বত্র উর্দুর মাধ্যমে শিক্ষা দেওয়া হইয়া থাকে। শিক্ষার মাধ্যমিক অবস্থায় সিন্ধু ও পূর্ব পাকিস্তানে বাধ্যতামূলকভাবে উর্দু শিখিতে হইবে।

আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে ইংরেজীর স্থলে উর্দুর মাধ্যমে শিক্ষা দেওয়ার প্রশ্নটি ইহার সহিত জড়িত। শিক্ষা উপদেষ্টা বোর্ডের বিভিন্ন বৈঠকে গৃহীত সিদ্ধান্তেও এ সম্পর্কে মতবিরোধ রহিয়া গিয়াছে। এই কারণে সরকারও এই প্রশ্নটি সম্পর্কে নীতি নির্ধারণ করিতে পারেন নাই। এতদুপরি, কেন্দ্রীয় সরকারের অফিসসমূহের কার্য পরিচালনার জন্য উর্দুকে মাধ্যম হিসাবে গ্রহণ করিতে হইবে।

উর্দুর সমস্যা সমাধানের জন্য শিক্ষা উপদেষ্টা বোর্ড একটি কমিটি গঠন করুন এই আমার অভিমত। প্রাদেশিক সরকারও উর্দু ভাষার জন্য উৎসাহ ও উদ্দীপনার সহিত কাজ করিবেন বলিয়া আমি বিশ্বাস করি।

এই একই দিনে শিক্ষা উপদেষ্টা বোর্ডের বৈঠকের উদ্বোধনকালে পূর্ব-বাঙলার গভর্ণর স্যার ফ্রেডারিক বোর্ন বলেন[২৩] যে শিক্ষার সকল স্তরে বাংলা ভাষা শিক্ষার মাধ্যম হওয়া উচিত পাকিস্তানে সাধারণ ভাষা হিসাবে উর্দু প্রত্যেক সরকারী এবং বেসরকারী বিদ্যালয়ে অর্থাৎ পঞ্চম শ্রেণী হইতে ঊর্ধ্বতন শ্রেণীতে বাধ্যতামূলকভাবে শিক্ষণীয় ভাষা হওয়া উচিত

১৬ই ডিসেম্বর ঢাকাতে কেন্দ্ৰীয় শিক্ষা মন্ত্রী ফজলুর রহমানের সভাপতিত্বে পাকিস্তান শিক্ষা উপদেষ্টা বোর্ডের তৃতীয় অধিবেশন শেষ হয়। শিক্ষা বোর্ডের এই তিনদিন ব্যাপী অনুষ্ঠিত বৈঠকসমূহে বাংলা ভাষা সম্পর্কে কোন আলাপ আলোচনার সূত্রপাত না হলেও উর্দু ভাষা ও সাহিত্যের ভবিষ্যৎ উন্নয়নের উপায় উদ্ভাবনের জন্যে বোর্ড একটি উচ্চ ক্ষমতাশীল কমিটি নিয়োগের সুপারিশ করেন। যেহেতু উর্দুতে সরকারী ও ব্যবসায় সংক্রান্ত কার্যাবলী পরিচালনার জন্যে এ জাতীয় শব্দাবলীর প্রয়োজন সেজন্যে উল্লিখিত কমিটি উর্দু অভিধান ও বিশ্বকোষ প্রণয়ন এবং বিজ্ঞান সম্বন্ধীয় ও টেকনিক্যাল শব্দাবলীর উর্দু প্রতিশব্দও তৈরী করবেন।

এর পর অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে বাংলা ভাষায় আরবী হরফ প্রচলনের ষড়যন্ত্র হিসাবে তাঁরা শিক্ষা উপদেষ্টা বোর্ডের এই অধিবেশনে বলেন যে, যদি কোন ছাত্র তার মাতৃভাষার হরফে লিখিত পুস্তকাদি পাঠে আপত্তি করেন তাহলে তার সেই আপত্তিকে বিশেষভাবে বিবেচনা করতে হবে।[২৪]

উর্দু ভাষার সর্বাঙ্গীণ উন্নতির জন্যে ফজলুর রহমানের উদ্যোগে ১৯৫০ সালের ১৬ই ফেব্রুয়ারীর কেন্দ্রীয় শিক্ষা উপদেষ্টা বোর্ড কর্তৃক একটি কমিটি যথারীতি গঠিত হয়।[২৫] ১৯ জন সদস্য নিয়ে গঠিত এই কমিটির চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন ‘বাবায়ে উর্দু’ ডক্টর আবদুল হক।

৩. কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক আরবী হরফ প্রচলনের উদ্যোগ

কেন্দ্রীয় শিক্ষা দফতরের উদ্যোগে ১৮ই এপ্রিল, ১৯৫০ থেকে পূর্ব-বাঙলার বিভিন্ন জেলায় মোট ২০টি কেন্দ্রে আরবী হরফে বাংলা ভাষার মাধ্যমে প্রাপ্তবয়স্কদেরকে প্রাথমিক শিক্ষা দেওয়ার কাজ শুরু করা হয়। সরকারী মহলের সূত্রে জানা যায় যে প্রত্যেক শিক্ষা কেন্দ্ৰে ২৫ থেকে ৩৫ জন ছাত্র শিক্ষা গ্রহণ করতে আরম্ভ করেছে এবং ছয় মাসকাল তারা ঐ সব কেন্দ্রে শিক্ষা লাভে নিযুক্ত থাকবে।[২৬]

১৯৪৯ সালে প্রাপ্তবয়স্কদের শিক্ষা দান পরিকল্পনা খাতে কেন্দ্রীয় সরকার মোট ৩৫ হাজার টাকা মঞ্জুর করেন। কিন্তু ১৯৫০ সালে সেই টাকার অংক বাড়িয়ে তাঁরা এই খাতে ব্যয় বরাদ্দ করেন ৬৭ হাজার ৭৬৪ টাকা।[২৭] এই সমস্ত টাকাই অবশ্য পূর্ব বাঙলার ক্ষেত্রে খরচ হয় আরবী হরফে বাংলা প্রচলনের প্রচেষ্টায়। প্রাপ্তবয়স্ক শিক্ষার্থীদের জন্যে অস্থায়ীভাবে গৃহীত পাঠ্য তালিকানুযায়ী কেন্দ্রীয় খরচে তাঁরা আরবী হরফে বাংলা বই ছাপান এবং সেই সমস্ত বই বিনামূল্যে ছাত্রদের মধ্যে বিতরণের ব্যবস্থা করেন।[২৮] এ ছাড়া আরবী হরফে বাংলা পাঠ্য পুস্তক রচনাকারীদেরকে পুরস্কার দান করা হবে এই মর্মে কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে একটি বিজ্ঞপ্তিও প্রচার করা হয়।[২৯]

আরবী হরফে বাংলা ভাষা শিক্ষা দানের এই প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে পূর্ব-বাঙলা ভাষা সংস্কার কমিটির সদস্য ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এক বিবৃতি[৩০] প্রসঙ্গে বলেন:

এছলামী ভাবধারায় উর্দু বিশেষ সমৃদ্ধিশালী। কাজেই পাক-ভারত উপমহাদেশের মুসলমানদের মাতৃভাষা যাহাই হউক না কেন, উর্দু শিক্ষা মারফৎ তাঁহারা বিশেষ লাভবান হইবেন। কিন্তু উর্দু হরফের সাহায্যে বাংলা শিক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করিয়া অর্থ অপব্যয়ের কি মানে থাকিতে পারে?

আশ্চর্যের কথা এই যে, উহার সহিত পূর্ব বঙ্গ সরকারের কোন সম্পর্ক নাই। এই অর্থহীন ব্যাপারে কেন্দ্রীয় সরকার এক লক্ষ টাকা ব্যয় করিবেন। আমার আশংকা হয়, উহা বন্ধ করা না হইলে সরকারী টাকা অপব্যয় করা হইবে।

এর পূর্বেই সেপ্টেম্বর মাসে মৌলানা আকরম খাঁর সভাপতিত্বে গঠিত পূর্ব-বাঙলা ভাষা কমিটি তার চূড়ান্ত রিপোর্টে বাংলা ভাষায় আরবী হরফ প্রচলন অন্ততঃ বিশ বৎসর স্থগিত রাখার জন্যে সুস্পষ্টভাবে সুপারিশ করেন। ডক্টর শহীদুল্লাহ তাঁর বিবৃতিতে এই সুপারিশের প্রতিও সরকার এবং জনসাধারণের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।

পাকিস্তান সরকারের শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমান কিন্তু সমস্ত কিছুকে উপেক্ষা করে বাংলা ভাষায় আরবী হরফ প্রচলনের উদ্যোগ অব্যাহত রাখেন। এ প্রসঙ্গে তিনি ১১ই অক্টোবর, ১৯৫০ কেন্দ্রীয় পার্লামেন্টে অধ্যাপক রাজকুমার চক্রবর্তীর এক প্রশ্নের জবাবে বলেন[৩১] যে কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ব-বাঙলার প্রাপ্তবয়স্কদের শিক্ষা কেন্দ্রগুলির জন্যে ইতিমধ্যে প্রায় ৩১ হাজার টাকা ব্যয় করেছেন। তিনি আরও বলেন যে উপদেষ্টা বোর্ডে সুপারিশ অনুযায়ী আরবী হরফে লিখিত বাংলা ভাষায় শিক্ষা দান পরিকল্পনার যে কাজ শুরু হয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার তা পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। এ ব্যাপারে কাজ চালিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে কেন্দ্রীয় সরকার বেঙ্গল এডুকেশন সার্ভিসের একজন স্থায়ী অফিসারকে স্পেশাল অফিসার হিসাবে নিযুক্ত করেছেন। এ ছাড়া কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে পূর্ব-বাঙলা সরকারের শিক্ষা ও রেজিস্ট্রেশন সেক্রেটারীকে তত্ত্বাবধায়ক নিযুক্ত করা হয়েছে। এ বিষয়ে কেন্দ্ৰীয় সরকার একটি স্ট্র্যাণ্ডিং কমিটিও গঠন করেছেন।

ফজলুর রহমান এ প্রসঙ্গে দাবী করেন যে উপরোক্ত শিক্ষা কেন্দ্রগুলি প্রাপ্তবয়স্কদের আরবী হরফে বাংলা ভাষা শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে দ্রুত উন্নতি করে চলেছে এবং জনসাধারণের কাছে অত্যন্ত পরিচিত হয়ে উঠছে। এর প্রমাণস্বরূপ তিনি উল্লেখ করেন যে সরকারী সাহায্য ব্যতিরেকে স্থানীয় জনগণের প্রচেষ্টায় ইতিমধ্যে ৩৭টি অনুরূপ বেসরকারী প্রতিষ্ঠান জন্মলাভ করেছে।

এর প্রায় এক বছর পর পূর্ব-বাঙলা সরকার আরবী হরফে শিশুদেরকে শিক্ষা দেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করেন।[৩২] ১৯শে সেপ্টেম্বর তাঁরা জানান যে পূর্ব-বাঙলায় মুসলমান শিশুদেরকে প্রাথমিক অবস্থায় আরবী হরফের মাধ্যমে তাঁরা শিক্ষাদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এবং সেই সিদ্ধান্তকে কার্যকরী করার জন্যে প্রাথমিক শিক্ষার সাথে সংশ্লিষ্ট জেলা অফিসারদেরকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। নোতুন ব্যবস্থা অনুযায়ী শিশুরা ১ম এবং ২য় শ্রেণীতে আরবী অক্ষর পরিচয় শিক্ষা করবে এবং ৩য় শ্রেণীতে তাদেরকে আমপারা (কোরাণের প্রথম পারা) শিক্ষা দেওয়া হবে।

এ ছাড়া প্রদেশের প্রাথমিক শিক্ষা পুনর্গঠনের উদ্দেশ্যে ২৩ জন সদস্য নিয়ে প্রাদেশিক সরকার ‘পূর্ব-বাঙলা শিক্ষা ব্যবস্থা সংস্কার কমিটি’ নামে একটি কমিটি নিয়োগ করেন। মৌলানা আকরম খাঁ এই কমিটির চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন। প্রদেশের প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থাকে দেশের পরিবর্তিত অবস্থা ও ইসলামী আদর্শের ভিত্তিতে পুনর্গঠনের কাজে সরকারকে পরামর্শ দানই এই কমিটি নিয়োগের উদ্দেশ্যে বলে নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে জানানো হয়।[৩৩]

এই সংবাদ প্রচারিত হওয়ার মাত্র কয়েকদিন পরই ‘শিক্ষা ব্যবস্থা পুনর্গঠন কমিটির সভাপতি মৌলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ ২৪শে সেপ্টেম্বর এক বিবৃতি[৩৪] প্রসঙ্গে আরবী হরফে শিশুদেরকে শিক্ষাদানের সরকারী উদ্যোগে বিস্ময় প্রকাশ করে তার প্রতিবাদে বলেন:

প্রাথমিক বিদ্যালয়সমূহে প্রথম শ্রেণী হইতে বালক-বালিকাদিগকে আরবী হরফ শিক্ষাদান এবং চতুর্থ শ্রেণী হইতে উর্দু অবশ্য পাঠ্য বিষয় হিসাবে প্রবর্তন করার জন্য পূর্ব পাকিস্তান সরকার সিদ্ধান্ত করিয়াছেন বলিয়াছেন বলিয়া এপিপি যে খবর পরিবেশন করিয়াছেন তাহা দেখিয়া আমি বিস্মত হইয়াছি।

১৯৪৯ সালে মার্চ মাসে প্রাদেশিক সরকার পূর্ব পাকিস্তান শিক্ষা ব্যবস্থা পুনর্গঠন কমিটি নামক একটি ব্যাপক শক্তিসম্পন্ন কমিটি গঠন করেন। প্রদেশের প্রাথমিক, মাধ্যমিক মাদ্রাসা এবং মহিলা ও সংখ্যালঘুদের শিক্ষা ব্যবস্থা পুনর্গঠন করা সম্পর্কে পরামর্শ দান করার জন্যই এই কমিটি গঠন করা হইয়াছিল। প্রদেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদদের সমন্বয়ে এই কমিটি গঠিত হয়। সদস্যদের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাইস চ্যান্সেলর, মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের সভাপতি, আলীয়া মাদ্রাসার প্রিন্সিপ্যাল খান বাহাদুর জিয়াউল হক, শামসুল উলেমা মওলানা আবু নাসের ওয়াহিদ ও মওলানা জাফর আহমদ ওসমানীর নাম অত্যতম। ১৯৫০ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে এই কমিটি প্রাদেশিক সরকারের নিকট প্রাথমিক শিক্ষা সম্পর্কে সুপারিশ পেশ করিয়াছিলেন। শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কীয় অন্যান্য বিষয়ের চূড়ান্ত সুপারিশও ১৯৫১ সালের জুন মাসে প্রাদেশিক সরকারের নিকট পেশ করা হইয়াছে। দুর্ভাগ্যবশতঃ কি জন্য জানি না, এই সুপারিশ সরকার জনসাধারণের খেদমতে প্রকাশ করেন নাই। কি জন্য এই সুপারিশ প্রকাশ করা হয় নাই তাহা সরকারই ভালোভাবে জানেন। ইহা প্রকাশ করা হইলে প্রদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার বিভিন্ন দিক সম্পর্কে কমিটি যে সুপারিশ করিয়াছেন, প্রদেশবাসী তাহা প্রত্যক্ষ জানিবার সুযোগ লাভ করিতে পারিতেন। উপরোক্ত পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে কমিটির সভাপতি হিসাবে সরকারের সাম্প্রতিক প্রাথমিক শিক্ষা সম্পৰ্কীয় সিদ্ধান্ত এবং কমিটির প্রকৃত অবস্থা বিস্তারিত ব্যাখ্যা করা আমার পক্ষে কর্তব্য বলিয়া আমি মনে করি। যথাযোগ্য বিবেচনা ও কমিটির সদস্যবর্গের ব্যাপক ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এবং কমিটি কর্তৃক প্রকাশিত বহু প্রশ্নের উত্তর হিসাবে প্রাপ্ত জনগণের মতামতের উপর নির্ভর করিয়া যে সব সোপারেশ করা হইয়াছে, ইহার মধ্যে কয়েকটি নিম্নে প্রকাশ করা হইল:

ক. প্রাথমিক পর্যায়ে মাতৃভাষা ছাড়া অন্য কোন ভাষা শিক্ষা দেওয়া উচিত হইবে না। প্রাথমিক পর্যায়ে কেবলমাত্র মাতৃভাষা শিক্ষা দেওয়ার নীতি সর্বজনস্বীকৃত। এই নীতি ১৯৪৭ সালে কেন্দ্রীয় শিক্ষা সচিব জনাব ফজলুর রহমানের সভাপতিত্বে করাচীতে অনুষ্ঠিত পাকিস্তান শিক্ষা সম্মেলনে গৃহীত হইয়াছিল। উপরন্তু পাকিস্তানের শিক্ষা সম্বন্ধীয় পরামর্শ বোর্ডও এই নীতি স্বীকার করিয়া লইয়াছিলেন।

খ. আরবী বর্ণমালা শিক্ষাদান এবং মাতৃভাষার মাধ্যমে কোরাণ ও দীনিয়াত শিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা তৃতীয় শ্রেণী হইতে কায়েম করা উচিত।

পঞ্চম শ্রেণী হইতে আরবী শিক্ষা দান সম্পর্কীয় সরকারের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্ত হইতে পরিষ্কার বোঝা যায় যে, গভীরভাবে বিবেচনার পর গৃহীত কমিটির সোপারেশ সরকার কর্তৃক সরাসরি বাতেল এবং উপরে উল্লেখিত দুইটি অভিজ্ঞ প্রতিষ্ঠানের নির্দেশকে বরখেলাপ করা হইয়াছে।

প্রাথমিক শিক্ষা সম্পর্কে সরকারী উদ্যোগে গঠিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও কমিটির সুপারিশ এবং জনগণের সুস্পষ্ট ইচ্ছাকে উপেক্ষা করেই কেন্দ্রীয় সরকার নিজেদের প্রয়োজনমতো পূর্ব- বাঙলার প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণের সিদ্ধান্ত নেন। কখনো তাঁরা সরাসরি কেন্দ্রীয় সরকারের পরিচালনাধীনে বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহণ করেন এবং কখনও বা প্রাদেশিক সরকারের মাধ্যমে নিজেদের উদ্দেশ্য হাসিলের উদ্যোগ নেন। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারের এইসব প্রচেষ্টা মাঝে মাঝে এত নগ্ন হামলার আকার ধারণ করে যে সরকারের বশংবদ ব্যক্তিরাও তার প্রতিবাদ করতে বাধ্য হন। মৌলানা আকরম খাঁর উপরিউদ্ধৃত বিবৃতি তারই অন্যতম উদাহরণ।

৪. আরবীকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব

বাংলা ভাষায় আরবী হরফ প্রচলনের ষড়যন্ত্রের পাশাপাশি আরবীকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার জন্যে দেশের বিভিন্ন স্তরের কিছু ব্যক্তি নিজেদের অভিমত ব্যক্ত করেন। এঁদের মধ্যে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহর ভূমিকাই সব থেকে উল্লেখযোগ্য এবং ভাষা সম্পর্কে তাঁর অন্যান্য বক্তব্যের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ। তিনি উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা রূপে গ্রহণ করার এবং বাংলা ভাষায় আরবী হরফ প্রবর্তনের ঘোর বিরোধিতা সত্ত্বেও ধর্মীয় কারণে আরবীর প্রতি একটা বিশেষ দুর্বলতা এর পূর্বেও ব্যক্ত করেছেন। কয়েক বছর পূর্বে তিনি এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘সেদিন পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম সার্থক হইবে, যেদিন আরবী সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা রূপে গৃহীত হইবে।’[৩৫]

পূর্ব পাকিস্তান আরবী সংঘ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের কার্যকরী সমিতি ডক্টর শহীদুল্লাহর সভাপতিত্বে ১৯৪৯ সালের ডিসেম্বর মাসে পাকিস্তান গণপরিষদে পেশ করার জন্যে একটি খসড়া স্মারকলিপি[৩৬] অনুমোদন করেন। তাতে আরবীকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার সুপারিশ এবং শহরের বিভিন্ন কেন্দ্র ও মফঃস্বলে ‘দরসে কোরাণের’ ব্যবস্থা করার জন্যে সরকারকে অনুরোধ জানানো হয়।

এর পর ১৮ই জানুয়ারী, ১৯৫০, রাজশাহী কলেজের কিছু সংখ্যক ছাত্র আরবীকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার প্রয়োজনীয়তার উল্লেখ করা হয়। আরবী ভাষাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার জন্যে আইন মোতাবেক আন্দোলন চালানো হবে বলে সেই সভায় একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়।[৩৭]

স্টেট ব্যাংকের গভর্ণর জাহিদ হোসেনও আরবীকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব করেন এবং তাঁর সেই প্রস্তাব সিন্ধু আইন পরিষদের সদস্য এবং সিন্ধু আরবী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর সৈয়দ আকবর শাহ কর্তৃক সমর্থিত হয়। এই প্রসঙ্গে এক বিবৃতিতে[৩৮] তিনি বলেন যে আরবী ভাষা প্রবর্তন করলে মুসলিম জাহানের সাথে পাকিস্তানের সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হবে এবং ফলস্বরূপ রাজনৈতিক দিক দিয়ে এদেশ লাভবান হবে।

এর পর ১৯৫১ সালের ৯ই ফেব্রুয়ারী করাচীতে অনুষ্ঠিত বিশ্ব মুসলিম সম্মেলনের প্রকাশ্য অধিবেশনে ইসমাইলী সম্প্রদায়ের নেতা আগা খান বলেন[৩৯] যে আরবীকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করা হলে আরব জাহান, উত্তর আফ্রিকা এবং ইন্দোনেশিয়ার মুসলমানদের মধ্যে সাধারণ যোগাযোগ স্থাপিত হবে। এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন:

আমি খেয়ালের বশে কোন কিছু বলিতেছি না। আমি যাহা বলিতেছি তাহা জনসাধারণের এক বিরাট অংশের নিকট অপ্রিয়। কিন্তু তবুও দুনিয়ার মুসলমানদের সম্মুখে আমার মতামত প্রকাশ না করিলে আমার কর্তব্য অসমাপ্ত থাকিবে এবং এছলামের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করা হইবে।

আরবীকে রাষ্ট্র ভাষা করার এই সব প্রস্তাব অবশ্য পাকিস্তানের কোন অংশেই তেমন কোন সমর্থন লাভ করে নি। তবে এই দাবী ইসলামী সংস্কৃতির বিকাশের প্রশ্নের সাথে জড়িত থাকায় তা পরোক্ষভাবে রাষ্ট্রভাষা উর্দু এবং বাংলা ভাষায় আরবী হরফ প্রবর্তনের দাবীকে কতকগুলি মহলে জোরদার করে।

বিভিন্ন মহলে আরবীকে রাষ্ট্রভাষা করার যে প্রস্তাব উত্থাপিত হয় তার বিরোধিতা করে পাকিস্তান বৌদ্ধ লীগের সেক্রেটারী রবীন্দ্রনাথ বর্মী ১০ই ফেব্রুয়ারী, ১৯৫১ এক বিবৃতি দেন। কিন্তু এক্ষেত্রে আরবীর প্রতিবাদ করে ক্ষান্ত না হয়ে তিনি উর্দুর সমর্থনে কিছু ওকালতিও করেন:

পাকিস্তান মোছলেম লীগ কাউন্সিল সম্প্রতি এক প্রস্তাবে আরবীকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা রূপে গ্রহণ করিবার জন্য সুপারিশ করিয়াছেন। পাকিস্তানের স্রষ্টা মরহুম কায়েদে আজম এই ঢাকা শহরে সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করিয়াছিলেন যে, উর্দুই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হইবে। কারণ ইংরেজী ভাষার পর উপ-মহাদেশের অধিকাংশ লোক উর্দু ভাষা সহজে বুঝিতে পারে। কিন্তু পাকিস্তানের কোথাও আরবী ভাষায় কথাবার্তা বলা হয় না। পাকিস্তানের সংবাদপত্র এবং সাময়িক পত্রাদিও উর্দুতে প্রকাশিত হয়। আমাদের মনে হয় আরবীর পরিবর্তে উর্দুই রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিত।[৪০]

সংখ্যালঘু বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের প্রতিনিধির পক্ষে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ওকালতি নিতান্তই অস্বাভাবিক। একদিকে রাষ্ট্রদ্রোহী আখ্যা লাভের ভয়ে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে দাবী করার অক্ষমতা এবং অন্যদিকে আরবীর মতো একটি সম্পূর্ণ বিদেশী ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা রূপে গ্রহণ করার বিপদ এ দুইয়ের ফলেই খুব সম্ভবতঃ রবীন্দ্রনাথ বর্মীর উর্দু সমর্থন। কিন্তু কারণ যাই হোক, অমুসলমান সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের একজন প্রতিনিধির পক্ষে এ জাতীয় বক্তব্য পেশ যে চরম সুবিধাবাদ ও মেরুদণ্ডহীনতার পরিচায়ক সে বিষয়ে সন্দেহের বিন্দুমাত্র কারণ নেই।

তথ্যসূত্র (সংশোধন করা হয়নি) – অষ্টম পরিচ্ছেদ: আরবী হরফ প্রবর্তনের ষড়যন্ত্র

8

b

আজাদ, ২৮/১২/৪৮।

ঐ, ১২/৩/১৯৪৯।

এ বইয়ের ১৫৩ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য। [বর্তমান রচনা সংগ্রহের ৩৯৬ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য।- সম্পাদক]

সৈয়দ আলী আহসান।

পূর্বোক্ত

পূর্বোক্ত

Report of the East Bengal Language Committee, 1949. P 112.

কবি গোলাম মোস্তফা, বাংলা একাডেমী, বর্ধমান হাউস, ঢাকা। ডিসেম্বর ১৯৬৭, পৃ ৭৮-৭৯। নওবেলাল, ৭/৪/১৯৪৯।

১০ সৈনিক, ৮/৪/১৯৪৯।

১১

নওবেলাল, ৭/৪/১৯৪৯; সৈনিক, ৮/৪/১৯৪৯।

১২ সৈনিক, ১১/৩/১৯৪৯; তাজউদ্দীন আহমদ-এর ডায়েরী, ৪/৩/১৯৪৯।

১৩

পূর্ণ বিবরণ : সৈনিক, ২২/৪/১৯৪৯।

১৪

আজাদ, ১০/১২/১৯৪৯।

১৫ পূর্বোক্ত।

১৬ আজাদ, ১২/১১/১৯৪৯।

১৭

পূর্বোক্ত।

১৮ পূর্বোক্ত।

১৯ পূর্বোক্ত।

২০ পূর্বোক্ত।

২১ আজাদ, ১৪/১২/১৯৪৯।

22 আজাদ, ১৫/১২/৪৯।

২৩ পূর্বোক্ত।

28

আজাদ, ১৭/১২/১৯৪৯।

২৫

আজাদ, ১৭/২/১৯৫০।

২৬ আজাদ, ২৪/৫/১৯৫০।

২৭ পূর্বোক্ত।

২৮ পূর্বোক্ত।

২৯ পূর্বোক্ত।

আজাদ, ৪/১০/১৯৫০।

৩১ আজাদ, ১২/১০/১৯৫০।

৩২ আজাদ, ২০/৯/১৯৫১।

৩৩ পূর্বোক্ত।

৩৪ আজাদ, ২৫/৯/১৯৫১।

পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি (প্রথম খণ্ড) | ৩২১

৩৫ এই বইয়ের ২১ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য। [বর্তমান রচনা সংগ্রহের ২৫৪ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য।- সম্পাদক]

৩৬ আজাদ, ২৭/১২/১৯৪৯।

৩৭ আজাদ, ২৩/১/১৯৫০।

৩৮ আজাদ, ২৯/৪/১৯৫০।[৩৯ আজাদ, ১০/২/১৯৫১।

80

আজাদ, ১২/২/১৯৫১।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *