৭. পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের উত্থান

সপ্তম পরিচ্ছেদ – পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের উত্থান

১. বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগ

১৯৩৬ সালের পূর্বে বাঙলাদেশে মুসলিম লীগের কোন উল্লেখযোগ্য সংগঠন ছিলো না। কায়েদে আজম ইংল্যান্ড থেকে ফেরার পর কলকাতায় আসেন এবং ভারতবর্ষের অন্যান্য প্রদেশের মতো বাঙলাদেশের মুসলিম লীগ গঠনে সচেষ্ট হন। ১৯৩৬ সালে ইস্পাহানীর বাসভবনে কিছুসংখ্যক মুসলমান নেতাদের সাথে আলাপ আলোচনার পর তিনি ঢাকার নবাব হাবিবুল্লাহকে সভাপতি করে একটি প্রাদেশিক কমিটি গঠন করেন। এই কমিটি অল্পকাল পরেই ১৯৩৭ সালের নির্বাচনের মুখে আবার মৌলানা আকরম খাঁর সভাপতিত্বে নোতুনভাবে গঠিত হয়। সভাপতি আকরম খাঁ এবং সম্পাদক হোসেন শহীদ সুহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে এই প্রাদেশিক কমিটি ১৯৪৩-এর নভেম্বর পর্যন্ত বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের কাজকর্ম পরিচালনা করে।

১৯৪০ সালে লাহোর প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার পরবর্তী পর্যায়ে মুসলিম লীগ মহলে কিছু উৎসাহ উদ্দীপনার সঞ্চার হলেও সাংগঠনিক দিক থেকে প্রাদেশিক লীগ তখনও অত্যন্ত দুর্বল ছিলো। সে সময় শুধু বাঙলাদেশের জেলাসমূহে মুসলিম লীগের যে কোন কমিটি ছিলো না তা নয়, এমনকি কেন্দ্র কলকাতায় তাঁদের কোন সুপরিচালিত অফিসঘর পর্যন্ত ছিলো না। সাংগঠনিক তহবিল বলতে কিছু না থাকার ফলে কোষাধ্যক্ষ হাসান ইস্পাহানী এবং তাঁর মতো দু’চারজন ধনী মুসলিম লীগ সমর্থকের সাহায্যের উপরই তাঁদেরকে নির্ভর করতে হতো। মোটামুটিভাবে বলা চলে যে ১৯৩৬ থেকে ১৯৪৩ পর্যন্ত মুসলিম লীগের সাধারণ জনপ্রিয়তা কিছুটা বৃদ্ধিলাভ করলেও প্রাদেশিক ও জেলা পর্যায়ে সংগঠন বলতে তাদের কিছুই ছিলো না।

মুসলিম লীগ শ্রেণীগতভাবে ছিলো একটি সামন্ত-বুর্জোয়া প্রতিষ্ঠান। কংগ্রেসের চরিত্রও তাই ছিলো। ঊনিশশো চল্লিশের দিকে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলন জোরদার হওয়ার সাথে সাথে নিম্ন মধ্যবিত্ত প্রভাব অবশ্য অত্যন্ত দ্রুত মুসলিম লীগের মধ্যে অনুভূত হতে থাকে। এই সময় বামপন্থী শক্তিসমূহের নোতুন শক্তি বৃদ্ধির সাথে সাথে অন্যদিকে আবার সাম্প্রদায়িক প্রভাবও ক্রমশঃ বৃদ্ধি লাভ করে। সাম্রাজ্যবাদবিরোধী জাতীয় আন্দোলনের মধ্যে এই দুই স্রোতের ক্ষিপ্রতার মুখে বাঙলাদেশের মুসলমান মধ্যবিত্তের মধ্যে সূত্রপাত হয় সাংগঠনিক চেতনার। এই সন্ধিক্ষণেই ১৯৪৩ সালের ৬ই নভেম্বর প্রাদেশিক কাউন্সিলের সভায় আবুল হাশিম বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সম্পাদক নির্বাচিত হন।[১]

এই নির্বাচনের পর আবুল হাশিম বাঙলাদেশে মুসলিম লীগকে উপযুক্তভাবে সংগঠিত করার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। বিস্তৃত সফরসূচী তৈরী করে তিনি প্রত্যেক জেলায় জেলায় কর্মীদের সাথে ব্যক্তিগত যোগাযোগ স্থাপন করেন এবং মুসলমান যুবকেরা তাঁর এই সাংগঠনিক তৎপরতায় আকৃষ্ট হয়ে দলে দলে মুসলিম লীগের পতাকাতলে সমবেত হতে থাকে। ১৯৪৪-এর প্রথম দিকে তিনি নারায়ণগঞ্জে একটি ছাত্র সম্মেলনে সভাপতিত্ব করতে আসেন।[২] এবং তারপর সেই বৎসরই তাঁর উদ্যোগে ৯ই এপ্রিলে ঢাকার ১৫০ নম্বর মোগলটুলীতে প্রাদেশিক মুসলিম লীগের একটি শাখা অফিস স্থাপিত হয়।[৩] বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগ এবং পাকিস্তানোত্তর রাজনীতির ইতিহাসে এই শাখা অফিসের গুরুত্ব অসামান্য। ঢাকার এই অফিসকে কেন্দ্র করেই ১৯৪৪-৪৭ এ সমগ্র পূর্ব-বাঙলায় ব্যবস্থাপক সভার নির্বাচনসহ মুসলিম লীগ সংগঠনের অন্যান্য কাজ পরিচালনা করা হয় এবং পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরবর্তী কয়েক বৎসর এই অফিসকে অবলম্বন করেই এখানকার বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি ক্রমশঃ সংগঠিত হয়।

মুসলিম লীগের সাংগঠনিক কাজকর্ম এবং সাধারণভাবে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনের অগ্রগতির সাথে সাথে প্রাদেশিক এবং জেলা সংগঠনগুলিতে নোতুন মধ্যবিত্ত ও সামন্ত স্বার্থের একটা সংঘর্ষ ধীরে ধীরে দানা বাঁধতে থাকে। মুসলিম লীগের উচ্চপর্যায়ের নেতৃত্বে অভিজাত জমিদার ও জোতদার প্রভাব বেশী থাকলেও মুসলমান মধ্যবিত্তের রাজনৈতিক উত্থানের ফলে সে প্রভাবের প্রতাপ ক্রমশঃ কমে আসে। পূর্ব বাঙলার মুসলিম লীগের মধ্যে ঢাকার নবাববাড়ী কেন্দ্রিক সামন্ত প্রভাব খর্ব করার ক্ষেত্রে ১৫০ নম্বর মোগলটুলীর যুবকদের ভূমিকা তাই অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য। সমগ্র বাঙলাদেশে মুসলিম লীগ সংগঠনের চরিত্র কিভাবে পরিবর্তিত হলো তা বোঝার জন্যে এই যুবকদের রাজনৈতিক কর্মপদ্ধতি ও তৎপরতার পর্যালোচনা একান্ত অপরিহার্য।

সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলনে যে সমস্ত মুসলমান যুবকেরা রাজনীতিগতভাবে এগিয়ে আসেন তাঁরা ধীরে ধীরে প্রাদেশিক সম্পাদক আবুল হাশিমের নেতৃত্বে সংগঠিত হতে থাকেন। মুসলিম লীগের মধ্যে সামন্ত আভিজাত্যের প্রাধান্য খর্ব করার ক্ষেত্রে তাঁদের প্রথম বিজয় সূচিত হয় ঢাকা জেলা মুসলিম লীগের নির্বাচনে। এই নির্বাচনের মাধ্যমে খাজা নাজিমুদ্দীন, খাজা শাহাবুদ্দীন, সৈয়দ আবদুস সেলিম, সৈয়দ সাহেবে আলম প্রভৃতি খাজা পরিবারের লোকজনদেরকে সম্পূর্ণভাবে পরাস্ত করে মানিকগঞ্জের আওলাদ হোসেনকে সভাপতি এবং মুন্সীগঞ্জের শামসুদ্দীন আহমদকে সম্পাদক করে একটি নোতুন জেলা কমিটি নির্বাচিত হয়।[৪] এর পর থেকে বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগ এবং সমগ্র বাঙলাদেশের লীগ সংগঠনে খাজা পরিবার-কেন্দ্রিক অভিজাত এবং অপেক্ষাকৃত রক্ষণশীল নেতৃত্বের পরিবর্তে এক নোতুন নেতৃত্ব ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে শুরু করে এবং এই অগ্রগতির সাথে সাথে প্রাদেশিক সম্পাদক আবুল হাশিমের ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা এবং ক্ষমতাও প্রভূতভাবে বৃদ্ধি পায়।

প্রাদেশিক লীগের সম্পাদক হিসাবে আবুল হাশিম সর্বপ্রথম একটি খসড়া ম্যানিফেস্টো প্রচার করেন। ঢাকা থেকে জেলা সম্পাদক শামসুদ্দীন আহমদ কর্তৃক প্রকাশিত এই ম্যানিফেস্টোটির মুখবন্ধে বলা হয়:

বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগ মনে করে যে এই পূর্বাঞ্চলের জনসাধারণের জীবন ও অবস্থার সাথে সম্পর্কিত পাকিস্তানের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও নৈতিক নীতি কি হবে সে কথা স্পষ্টভাবে নির্দেশ করার সময় এখন উপস্থিত হয়েছে। এ ধরনের একটা নকশা যে শুধুমাত্র পূর্ব পাকিস্তানের মানুষকেই উদ্বুদ্ধ করতে সহায়ক হবে তাই নয়। এর দ্বারা মুসলিম জাতীয়তাবাদী আন্দোলন সম্পর্কে সংস্কারাচ্ছন্ন ও আশংকান্বিত লক্ষ লক্ষ অমুসলমানদের অন্তরের আস্থা ও উপলব্ধি সৃষ্টি হবে। দেশবাসীর সামনে এই ম্যানিফেস্টো পেশ করার সময় বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগ আশা করে যে এটিকে তাঁরা শুধু আগামীদিনের স্বাধীনতার সনদ হিসাবেই নয়, আজকের সংগ্রামের পথনির্দেশ হিসাবেও গ্রহণ করবেন।[৫]

উপরোক্ত ম্যানিফেস্টোটিতে সংবিধান সভা সম্পর্কে বলা হয়:

পূর্ব পাকিস্তানের সার্বভৌমত্ব জনগণের মধ্যে নিহিত থাকবে। সার্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচিত সংবিধান সভা একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা করবে।[৬]

বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের এই দলিলটিতে যে কর্মসূচী প্রচারিত হয় তা খুবই উল্লেখযোগ্য কারণ এগুলির মাধ্যমেই প্রতিষ্ঠানটির অভ্যন্তরে এক নোতুন আন্দোলনের সাথে কিছুটা পরিচিত হওয়া যায়। আলোচ্য কর্মসূচীর কয়েকটি ধারা নীচে উল্লিখিত হলো:

৩. আইনের ক্ষেত্রে সমতা: আইনের ক্ষেত্রে সমতা নীতি হিসাবে স্বীকৃত ও প্রযোজ্য হবে। ন্যায় বিচারকে করা হবে সহজ ও ত্বরান্বিত। রাষ্ট্রবিরোধী অপরাধমূলক আইন এবং বিনা বিচারে আটক রাখার প্রথা উচ্ছেদ করা হবে। সকল বিচারাধীন বন্দীকে হেবিয়াস কর্পাসের নিরাপত্তার আশ্রয় মুক্তভাবে দান করা হবে। বিচার বিভাগকে করা হবে শাসন বিভাগ থেকে বিযুক্ত।[৭]

৪. নাগরিক অধিকার: বাক স্বাধীনতা এবং লেখা, আন্দোলন, মেলামেশা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিত ও কার্যক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। একমাত্র জনসাধারণের সতর্কদৃষ্টিই এই স্বাধীনতার অপব্যবহারের খবরদারী করবে।[৮]

৬. শ্রমের স্বাধীনতা: সকল সমর্থ ব্যক্তিদের কাজ রাষ্ট্র নিশ্চিত করবে। শ্রেণী, বিশ্বাস ও সংস্কৃতি নির্বিশেষে সকল পুরুষ ও নারীকে সমান সুযোগ-সুবিধা দান করা হবে। নারীদের বিশেষ অক্ষমতা ও প্রয়োজনসমূহের প্রতি দৃষ্টি রেখে তাদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা রাখা হবে। নিজ নিজ শ্রমের ফল ভোগ করার অধিকার প্রত্যেকেরই থাকবে।[৯]

৭. শিক্ষার অধিকার: শিক্ষার দায়িত্ব রাষ্ট্রের হাতে ন্যাস্ত থাকবে এবং তা প্রত্যেক পুরুষ ও নারীর জন্য হবে বাধ্যতামূলক। প্রাথমিক শিক্ষা অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক হবে, মাধ্যমিক শিক্ষার জন্য ব্যাপকভাবে উৎসাহ দেওয়া হবে এবং উচ্চ শিক্ষাকে করা হবে সস্তা ও সহজলভ্য। মাতৃ ভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদানের ব্যবস্থা হবে।* দেশের কারিগরি ও শিল্পক্ষেত্রে পশ্চাৎপদত্বের পরিপ্রেক্ষিতে পেশাগত ও কারিগরি শিক্ষার উপর জোর দেওয়া হবে এবং উচ্চ গবেষণা ও তার বিভিন্ন প্রয়োগের ক্ষেত্রে সর্বপ্রকার সুযোগ-সুবিধা দান করা হবে।[১০

[*এ বইয়ের ২২তম পৃষ্ঠায় ভুলবশত বলা হয়েছে যে ম্যনিফেস্টোটিতে ভাষা বিষয়ক কোন দাবী উত্থাপন করা হয়নি।- ব. উ.]

৯. একচেটিয়া স্বার্থের উচ্ছেদ: সকল খাজনাপ্রাপ্তিমূলক স্বার্থের উচ্ছেদ করা হবে। যানবাহনসহ সকল গুরুত্বপূর্ণ শিল্প অবিলম্বে জাতীয়করণ করা হবে। সকল একচেটিয়া স্বার্থ, বিশেষত পাটের একচেটিয়া স্বার্থ অবিলম্বে উচ্ছেদ করা হবে।[১১]

১০. শ্রমিকের অধিকার: শ্রমিকদের নিম্নতম মজুরী ও মহার্ঘভাতা প্রচলিত অবস্থানুযায়ী নিশ্চিত করতে হবে। ছুটি সংক্রান্ত আইনসহ আট ঘণ্টা দিন প্রবর্তন করা হবে। রাষ্ট্র সকলের জন্য বেকারত্ব বীমা ও বার্ধক্য ভাতা নিশ্চিত করবে এবং নারী শ্রমিকদের জন্য মাতৃকল্যাণ ও শিশুদের নার্সারীর ব্যবস্থা রাখবে। শ্রমিকদের সংঘবদ্ধ হওয়া, সভাসমিতি করা ও ট্রেড ইউনিয়ন সংক্রান্ত অন্যান্য সর্বপ্রকার কাজকর্ম এবং যৌথ দর কষাকষির জন্য ধর্মঘটের অধিকার থাকবে।[১২]

১১. কৃষকদের অধিকার: কৃষকদের স্বার্থ রক্ষা ও সর্বপ্রকার খাজনার মধ্যে একটা সামঞ্জস্য বিধান করা হবে। সর্বপ্রকার অন্যায়মূলক কর উচ্ছেদ করা হবে। রাষ্ট্র সমবায় পদ্ধতিতে চাষ আবাদ করবে এবং কৃষকেরা যাতে তাদের কৃষিজাত দ্রব্যসমূহের ন্যায্য মূল্য লাভ করতে পারে সেজন্যে সমবায় বিক্রয় ব্যবস্থার প্রতি উৎসাহ দান করবে। রাষ্ট্র বিশাল আকারে সেচ পরিকল্পনা গ্রহণ করবে যাতে করে দেশের কোন অঞ্চলে কৃষকেরা চাষ আবাদের উপযুক্ত সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত না হয়।[১৩]

১২. কারিগরদের অধিকার: রাষ্ট্র শিল্পায়নের কাজে আত্মনিয়োগ করবে কিন্তু তা সত্ত্বেও গ্রাম্য কারিগরি শিল্পসমূহের প্রতিও উপযুক্ত দৃষ্টি দেওয়া হবে। কারণ তাদের উন্নতির দ্বারা সাধারণভাবে সমগ্র গ্রামের অধিকতর কল্যাণ সাধিত হবে। এ জন্যেই রাষ্ট্র বিভিন্ন গ্রাম্য কারিগরি শিল্পকে প্রত্যক্ষভাবে সাহায্য, প্রয়োজনমতো অতিরিক্ত অর্থ প্রদান, কাঁচামাল সরবরাহ এবং উৎপন্ন দ্রব্যের বিক্রয় ব্যবস্থাকে সংগঠিত করবে।[১৪]

ম্যানিফেস্টোটির এ পর্যন্ত উদ্ধৃত অংশের থেকে একথাই মনে হবে যে সেটি একটি জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের সাধারণ কর্মসূচী। কিন্তু মুসলমান এবং অমুসলমান সংখ্যালঘুদের অধিকার সম্পর্কে ম্যানিফেস্টোটিতে যা বলা হয়েছে তাতে মুসলমান ও অমুসলমান সংখ্যালঘুদের কতকগুলি নির্দিষ্ট ও গুরুত্বপূর্ণ গণতান্ত্রিক অধিকারের উল্লেখ থাকলেও মুসলমানদের জন্য ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অভিভাবকের ভূমিকা নির্দেশ করার ফলে তার সামগ্রিক গণতান্ত্রিক চরিত্র অনেকাংশে খর্ব হয়েছে। মুসলিম লীগের সাধারণ কাঠামোর কথা বিবেচনা করলে অবশ্য সহজেই বোঝা যাবে যে তার মধ্যে মুসলমানদের এই ভূমিকা নির্দেশ অস্বাভাবিক ছিলো না। পাকিস্তান যে ইসলামী রাষ্ট্র হবে একথা কিন্তু ম্যানিফেস্টোটির কোন স্থানেই উল্লেখ করা হয়নি। মুসলমানদের অধিকার সম্পর্কে ১৪ ধারায় শুধু বলা হয়েছে:

মুসলমান সমাজে শরিয়তের আইনকানুন যাতে প্রযুক্ত ও পালিত হয় তার প্রতি দৃষ্টি রাখা হবে মুসলিম লীগের কর্তব্য। ইসলামের নৈতিক মূল্য পুনরুত্থিত ও ইসলামী নীতিসমূহ অনুসরণ করা হবে। ইতিহাস, লোকগীতি, শিল্প ও সঙ্গীতের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানে ইসলামী সংস্কৃতির যে বিকাশ শত শত বছর ধরে ঘটেছে তাকে পুনরুজ্জীবিত করার প্রচেষ্টাকে বিশেষভাবে উৎসাহ দান ও জনপ্রিয় করা হবে।[১৫]

বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশের মধ্যে সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধিতা ও ধর্মীয় আনুগত্যের যে আপাত সমন্বয় সাধিত হয়েছিলো তারই পরিচয় পাওয়া যায় ম্যানিফেস্টোটির শেষ দুই অনুচ্ছেদে

ইসলাম তার অনুসরণকারীদের কাছে সাম্য ও স্বাধীনতার যে নীতি প্রচার করে তার দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগ মানবতার মুক্তির জন্য চূড়ান্ত সংগ্রাম যাতে আর বিলম্বিত না হয় তার জন্য সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সকল দল ও ব্যক্তিকে একত্রিত ও ঐক্যবদ্ধ হতে আহ্বান জানাচ্ছে।

দেশবাসীর সামনে বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগ নিজের ভূমিকাকে স্পষ্টভাবে তুলে ধরতে গিয়ে আবুবকরের বিখ্যাত নীতি অনুসারেই চলার চেষ্টা করে: ‘আমি যদি সঠিক হই, আমাকে অনুসরণ করো। আমি যদি ভুল করি, আমাকে সংশোধন করো।’ এই নীতির উপর নির্ভর করেই বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগ সর্বস্তরের দেশবাসীর কাছে আবেদন জানাচ্ছে যাতে তাঁরা এগিয়ে আসেন এবং সমবেত শক্তি দ্বারা এ প্রচেষ্টার কামিয়াবীর মাধ্যমে এই সোনার দেশ পূর্ব পাকিস্তানের লক্ষ লক্ষ অধিবাসীকে রক্ষা করেন।[১৬]

বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগ কর্তৃক প্রকাশিত এই খসড়া ম্যানিফেস্টোটি সমগ্র প্রাদেশিক লীগের সমর্থন লাভ করেনি। এমনকি এই দলিল প্রচারের কোন অধিকার আবুল হাশিমের নেই কাজেই তা প্রচারের জন্যে তাঁর বিরুদ্ধে শৃঙ্খলাগত ব্যবস্থা অবলম্বন করা হোক এই মর্মে শহীদ সুহরাওয়ার্দী পর্যন্ত প্রাদেশিক লীগ সভাপতি আকরম খাঁকে একটি পত্র দেন। সেই পত্রটি আকরম খাঁ আবার আবুল হাশিমের অবগতির জন্যে তাঁর কাছে পাঠান।[১৭]

এ ছাড়া সামন্ত প্রভাবাধীন দক্ষিণপন্থী মহলেও ব্যাপারটি নিয়ে আবুল হাশিম এবং তাঁদের ‘বামপন্থী’ উপদলের বিরুদ্ধে দারুণ এক বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও একথা বলা চলে যে ১৯৪৩ সালের পর থেকে মুসলিম লীগের পতাকাতলে যে নোতুন যুব সম্প্রদায় ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী জনসাধারণ দলে দলে সমবেত হয়ে মুসলিম লীগকে তাঁদের সমর্থন দান করতে বদ্ধপরিকর হয়েছিলেন এই ম্যানিফেস্টোটিতে তাঁদের আশা আকাঙ্ক্ষাই বিশেষভাবে প্রতিফলিত ও প্রতিধ্বনিত হয়েছিলো। বস্তুতপক্ষে এই দলিলটিকে কেন্দ্র করেই আবুল হাশিমের নেতৃত্বে বাঙলাদেশের মুসলিম যুব সম্প্রদায় নিজেদেরকে আদর্শগত ও সংগঠনগতভাবে সুসংহত করেন।

এখানে লক্ষ্য করার বিষয় এই যে সুহরাওয়ার্দী, এবং বিশেষ করে আবুল হাশিমের নেতৃত্বে মুসলিম লীগের বামপন্থী শক্তি নাজিমুদ্দীন ও সাধারণভাবে খাজা পরিবারের নেতৃত্বাধীন প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতিকে গুরুতরভাবে আঘাত করতে সক্ষম হলেও মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে সামন্ত স্বার্থের প্রতাপকে তারা উপযুক্তভাবে খর্ব ও পরাভূত করতে সক্ষম হয়নি। শুধু তাই নয়, উপরোক্ত ম্যানিফেস্টোতে উল্লিখিত কোন কোন কর্মসূচীকে নিজেদের মন্ত্রীত্ব থাকাকালে বাস্তবায়িত করার প্রচেষ্টাকে তারা সমস্ত শক্তি দিয়ে বাধা প্রদান করেছে। প্রাদেশিক মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারী পার্টিতে তেভাগা বিলের পরিণাম এ প্রসঙ্গে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

শহীদ সুহরাওয়ার্দী এবং আবুল হাশিম তো বটেই এমনকি ফজলুর রহমান প্রভৃতি দক্ষিণপন্থী নাজিমুদ্দীন উপদলভুক্ত বিশিষ্ট কয়েকজন নেতারও জমি অথবা জমিদারীতে বিশেষ কোন ব্যক্তিগত স্বার্থ ছিলো না। কাজেই সাধারণ নির্বাচনের পর ১৯৪৭ সালে সুহরাওয়ার্দী মন্ত্রীসভার পক্ষ থেকে রাজস্ব সচিব ফজলুর রহমান চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে শোষিত বাঙালী কৃষকদেরকে কিছুটা রেহাই দেওয়ার জন্যে তেভাগা বিল প্রণয়ন করেন এবং তা প্রাদেশিক মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারী পার্টিতে যথারীতি পেশ করা হয়। কিন্তু মন্ত্রীসভার এই উদ্যোগ সত্ত্বেও উত্তর বাঙলার কিছু সংখ্যক শক্তিশালী জোতদারদের নেতৃত্বে পার্লামেন্টারী পার্টির মধ্যে সামন্তশক্তি এমন চাপ সৃষ্টি করে যে আত্মরক্ষার্থে মুসলিম লীগ মন্ত্রীত্ব সেই বিল প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়।

কিন্তু মুসলিম লীগের শ্রেণীগত পরিচয় যে এই প্রথম উদঘটিত হলো তাই নয়। এর পূর্বেও প্রতিষ্ঠানগতভাবে মুসলিম লীগের সামগ্রিক শ্রেণী চরিত্রের পরিচয় পাওয়া যায় তখনই, যখন আলোচ্য ম্যানিফেস্টোটির বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়াশীল লীগ মহলে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার ফলে সেটিকে ওয়ার্কিং কমিটিতে তো বটেই এমনকি প্রাদেশিক কাউন্সিলেও আলোচনার জন্যে পেশ করা সম্ভব হয় না। তথাকথিত বামপন্থী উপদলের অন্যতম প্রধান নেতা হওয়া সত্ত্বেও আবুল হাশিমের সাথে ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব এবং ম্যানিফেস্টোটির নীতিসমূহের প্রতি পূর্ণ আস্থার অভাবে সুহরাওয়ার্দীও সেটি প্রাদেশিক কাউন্সিলে উত্থাপনের ব্যাপারে বিরোধিতা করেন।[১৮] এর ফলে সাধারণভাবে যুব সম্প্রদায়ের মধ্যে এই কর্মসূচীর পেছনে বিরাট সমর্থন থাকলেও প্রাদেশিক কাউন্সিলে তাকে পাশ করিয়ে নেওয়ার মতো প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা ‘বামপন্থী’দের ছিলো না।

শুধু তাই নয়। তেভাগা আন্দোলনকে দমনের উদ্দেশ্যে মুসলিম লীগ সরকার কৃষকদেরকে জেলে পুরে, তাদেরকে উত্তর বাঙলার বিভিন্ন জায়গায় গুলি করে হত্যা করে যে নির্মম নির্যাতন তাদের উপর চালিয়েছিলো সেটা একমাত্র তাদের শ্রেণী শত্রুদের দ্বারাই সম্ভব। মুসলিম লীগকে সংগঠিত করার ক্ষেত্রে মুসলমান যুব সম্প্রদায়ের উদ্দীপনা এবং অসংখ্য কর্মীর অক্লান্ত পরিশ্রম সত্ত্বেও এই সাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠানটির শ্রেণীগত চরিত্র সাধারণ কর্মীদের কাছে ধীরে ধীরে উদঘাটিত হতে শুরু করে। তেভাগা বিলের ক্ষেত্রে আবুল হাশিমের মধ্যেও উৎসাহের যে অভাব দেখা যায় তাকে শুধু নিশ্চিত পরাজয়ের মুখে অনিবার্য নিষ্ক্রিয়তা বলে অভিহিত করা চলে না। এখানেও শ্রেণী চরিত্রের প্রশ্নই সত্য অর্থে প্রাসঙ্গিক। ম্যানিফেস্টোর মধ্যে কৃষকদের অধিকারের উল্লেখ এবং তেভাগা আন্দোলনের মুখে তেভাগা বিল প্রণয়নে তাঁর উৎসাহ থাকলেও সেই বিলকে মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারী পার্টিতে পাশ করিয়ে নেওয়ার জন্যে যে পরিশ্রম ও সাংগঠনিক তৎপরতার প্রয়োজন ছিলো আবুল হাশিম তার জন্যে কোন উৎসাহ অথবা তাগিদ অনুভব করেননি। তেভাগা বিলের পরিণতি নিশ্চিত জেনেও ‘তেভাগার রাজনীতি’র স্বপক্ষে মুসলিম লীগের ‘বামপন্থী’ মহলে এবং সামগ্রিকভাবে দেশে একটা আন্দোলন গঠনের চিন্তাও তাঁর মধ্যে আসেনি।

বস্তুতঃপক্ষে ১৯৪৩ সালের নভেম্বরের পর থেকে ১৯৪৭ সালে তেভাগা বিল প্রত্যাখ্যান হওয়া পর্যন্ত এই পর্যায়টিই গণপ্রতিষ্ঠান হিসাবে বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সব থেকে গৌরবময় অধ্যায়। এর পর সূত্রপাত হয় সামগ্রিকভাবে মুসলিম লীগ নেতৃত্বের প্রতি সত্যিকার বামপন্থী অনাস্থার। মুসলিম লীগের মধ্যে আবুল হাশিমের সাংগঠনিক এবং আদর্শগত নেতৃত্বের সর্বোচ্চ বিকাশ এই পর্যায়েই ঘটে। এর পর থেকে তাঁর চিন্তার মধ্যে রক্ষণশীল প্রভাব ধীরে ধীরে মাথা চাড়া দেয় এবং অগাষ্ট ১৯৪৭-এর পর তাঁর রাজনৈতিক চিন্তা এমন এক পথ ধরে অগ্রসর হতে থাকে যার ফলে ১৯৬৫ সালের দিকে সাধারণ মানুষের কাছে তাঁর তুলনায় শহীদ সুহরাওয়ার্দী তো বটেই, এমনকি খাজা নাজিমুদ্দীনকেও মনে হয় বামপন্থী।

আবুল হাশিমের নেতৃত্বে মুসলিম লীগের মধ্যে গণতান্ত্রিক চেতনাসম্পন্ন যুব সম্প্রদায় যেভাবে একত্রিত হয়েছিলেন সেটা একদিক দিয়ে স্বাভাবিক হলেও প্রগতিশীল রাজনীতি ক্ষেত্রে তা অনেক বিভ্রান্তিও সৃষ্টি করেছিলো। মুসলমান যুবকদেরকে সত্যিকার প্রগতিশীল রাজনৈতিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে ১৯৪৭-এর পর তাদেরকে নোতুন নেতৃত্বদানের যে সম্ভাবনা ছিলো ধর্মীয় রাজনৈতিক চিন্তার ফলে তাঁর পক্ষে সেটা আর সম্ভব হয়ে ওঠেনি।

এর ফলে যারা ইতিমধ্যে মুসলিম লীগের মধ্যে এসেছিলেন তাদের বিপুল অধিকাংশ‍ই পরবর্তীকালে রাজনীতির প্রগতিশীল ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিসমূহকেই জোরদার করেন। কাজেই আবুল হাশিমের প্রাথমিক রাজনৈতিক চিন্তা এবং সাংগঠনিক শক্তির মধ্যে যে সম্ভাবনা ছিলো তা গণতান্ত্রিক চেতনাসম্পন্ন যুবকদেরকে মুসলিম লীগের অন্তর্গত চরম রক্ষণশীলদের দুর্গকে অনেকাংশে ধ্বংস করতে সমর্থ হলেও মুসলিম যুব সম্প্রদায়কে সত্যিকার বামপন্থী প্রগতিশীল রাজনীতিতে উদ্বুদ্ধ করতে সমর্থ হয়নি উপরন্তু তাদের অনেককেই সেই পথ থেকে বিচ্যুত করে মুসলিম লীগের পতাকাতলে সমবেত করে পরিশেষে তাদেরকে করেছিলো হতাশাচ্ছন্ন ও বিভ্রান্ত।

কিন্তু মুসলমান যুব সম্প্রদায়ের এই রাজনৈতিক পরিক্রমাকে আবার কোনক্রমেই অস্বাভাবিক বলা চলে না। ব্যাপকভাবে গণতান্ত্রিক ও বামপন্থী আন্দোলনে অংশ গ্রহণের প্রাথমিক পর্যায় হিসাবে তৎকালীন অবস্থায় সাধারণভাবে তাদের এই ভূমিকা শুধু স্বাভাবিক নয়, প্রয়োজনীয়ও ছিলো। এর ফলে দেখা যায় যে অল্প সংখ্যক হলেও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ঠিক পরবর্তী সময়ে মুসলিম লীগের এই ‘বামপন্থী’ উপদলভুক্ত যুবকরাই পূর্ব-বাঙলায় বিরোধীশক্তিকে সংহত ও সাংগঠনিক রূপ দান করেন এবং অতি অল্প সংখ্যক হলেও তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ সত্যিকার বামপন্থী রাজনীতি গঠনকার্যে সচেষ্ট হন।

২. মোগলটুলীর শাখা অফিস

১৫০ নম্বর মোগলটুলীতে বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের যে শাখা অফিস স্থাপিত হয় কলকাতার সাথে তার সম্পর্ক ছিন্ন হলেও ১৯৪৭-এর অগাষ্ট মাসের পরও তাকে কেন্দ্র করে আবুল হাশিম-সুহরাওয়ার্দী উপদলের কর্মীরা মোটামুটি একত্রিত থাকেন। এই অফিসটি ঢাকাতে অবস্থিত থাকলেও সারা পূর্ব-বাঙলায় নাজিমুদ্দীন সরকার বিরোধী যুবকেরা রাজনীতিক্ষেত্রে তাকেই অবলম্বন করে নিজেদের প্রাথমিক কাজকর্ম পরিচালনা করেন।

যে সমস্ত কর্মীরা মোগলটুলীর এই শাখা অফিসকে কেন্দ্র করে পূর্ব বাঙলায় নোতুন রাজনীতি গঠন চিন্তায় নিযুক্ত ছিলেন তাঁদের মধ্যে শামসুল হক, কমরুদ্দীন আহমদ, মহম্মদ তোয়াহা, অলি আহাদ, শওকত আলী, তাজউদ্দীন আহমদ, আতাউর রহমান, শামসুজ্জোহা, মহম্মদ আলমাস, মহম্মদ আউয়াল প্রভৃতির নাম উল্লেখযোগ্য। পরবর্তী সময়ে শেখ মুজিবুর রহমান এবং অন্যান্য কয়েকজনও কলকাতা থেকে আসার পর সেই রাজনীতির সাথে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত হন।

মাউন্টব্যাটেন রোয়েদাদ ঘোষিত হওয়ার পর ১৯৪৭-এর জুলাই মাসে কমরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে উপরোল্লিখিত কর্মীদের মধ্যে কয়েকজন গণআজাদী লীগ নামক একটি প্রতিষ্ঠান গঠন করেন। সে বছরই আগস্ট সেপ্টেম্বরে ১৫০ নম্বর মোগলটুলীকে কেন্দ্র করে গণতান্ত্রিক যুব লীগ গঠনের সাংগঠনিক কাজকর্ম পরিচালিত হয়। এর পরবর্তী সময়েও ঢাকার ছাত্র আন্দোলন এবং বিবিধ রকম গণআন্দোলনের ক্ষেত্রেও এই কর্মীদের ভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

মোগলটুলীর অফিসকে কেন্দ্র করে মুসলিম লীগের যে সমস্ত কর্মীরা একত্রিত ছিলেন তাঁদের মধ্যে নানাপ্রকার রাজনৈতিক চিন্তা এলেও মুসলিম লীগ থেকে সরাসরি বিচ্ছিন্ন হওয়ার ইচ্ছা তাঁদের অধিকাংশের মধ্যেই ছিলো না। তাঁরা প্রাথমিক পর্যায়ে মুসলিম লীগকে নোতুনভাবে সংগঠিত করে তার মধ্যেই নিজেদের শক্তিকে সংহত করতে চেয়েছিলেন। এজন্যেই শামসুল হক এবং শেখ মুজিবুর রহমান ওয়ার্কার্স ক্যাম্প নামে অভিহিত মুসলিম লীগ কর্মী সম্মেলন আহ্বান করে রশিদ বই দেওয়ার জন্যে আকরম খাঁর উপর চাপ প্রয়োগের চেষ্টা করেছিলেন। আকরম খাঁ কিন্তু ওয়ার্কার্স ক্যাম্পের কর্মীদেরকে লীগবিরোধী রাষ্ট্রদ্রোহী আখ্যা দিয়ে তাদেরকে রশিদ বই দিতে অস্বীকার করেন।

ওয়ার্কার্স ক্যাম্পের কর্মীদের প্রতি আকরম খাঁর এই আচরণই প্রাথমিক পর্যায়ে মুসলিম লীগের বিপর্যয়ের অন্যতম প্রধান কারণ। ক্ষুদ্র উপদলীয়ও ব্যক্তি স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে সাংগঠনিক সমস্যাকে বিচার করলে তিনি সহজেই উপলব্ধি করতেন যে, ১৫০ নম্বর মোগলটুলীকে ঘিরে যে কর্মী গোষ্ঠী সৃষ্টি হয়েছিলো তারাই ছিলো মুসলিম লীগের সত্যিকার সম্পদ, তিনি যাদেরকে নিয়ে নোতুনভাবে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগ গঠন করতে চলেছিলেন তারা নয়। আবুল হাশিমের ভয়ে সন্ত্রস্ত আকরম খাঁ কিন্তু তাঁর ব্যক্তিগত দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করে দেখেছিলেন যে পূর্বোক্ত কর্মীদেরকে সাংগঠনিক কাজকর্মের সাথে যুক্ত হওয়ার সুযোগ দিলে তারা পরিশেষে তাঁর নেতৃত্বের পক্ষে বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়াবে। এই চিন্তা থেকেই তিনি তাদেরকে মুসলিম লীগের আওতার বাইরে রাখতে সচেষ্ট হন। এ কাজ করতে গিয়ে তিনি যুব কর্মীদেরকে পাকিস্তানবিরোধী আখ্যা দিতেও দ্বিধা বোধ করেননি, যদিও পাকিস্তান অর্জনের ক্ষেত্রে তাদের পরিশ্রম ও অবদান তাঁর থেকে কোন অংশেই কম ছিলো না।

আকরম খাঁর এই নীতি পূর্ব-বাঙলা মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারী পার্টির দ্বারা পুরোপুরি সমর্থিত হয়েছিলো কারণ সেখানে নাজিমুদ্দীনের ছিলো সুহরাওয়ার্দী ভীতি। নাজিমুদ্দীন এবং তাঁর উপদলের লোকজনেরা পূর্ব-বাঙলায় সুহরাওয়ার্দীর আগমনকে দারুণ বিপজ্জনক মনে করতেন এবং সেজন্যে মোগলটুলীর কর্মীরা যাতে মুসলিম লীগের সাংগঠনিক কাজকর্মের সাথে যুক্ত হতে না পারে সেদিকেও তাঁদের লক্ষ্য কম ছিলো না।

মুসলিম লীগের সাংগঠনিক কাজকর্মের ক্ষেত্রে এই অবস্থা সৃষ্টির ফলে বলিষ্ঠ কর্মীর অভাবে তার সম্প্রসারণ ও শক্তিবৃদ্ধি তো হয়ই নি। উপরন্তু সমগ্র প্রতিষ্ঠানটিই ধীরে ধীরে পার্লামেন্টারী পার্টির লেজুড়ে পরিণত হয়েছিলো। এই লেজুড় বৃত্তি ১৯৪৯-এর এপ্রিল মাসে টাঙ্গাইল উপনির্বাচনের সময় মুসলিম লীগের পক্ষে এক দারুণ বিপর্যয়ের সৃষ্টি করে।

১৯৪৭ থেকে ১৯৪৯ পর্যন্ত মোগলটুলীর অফিসকে কেন্দ্র করে মুসলিম লীগের যুব কর্মীরা মোটামুটিভাবে একত্রিত থাকেন। এই সময়ে তাঁরা অবশ্য একটি নোতুন সংগঠনের জন্যে নানা প্রকার উদ্যোগ গ্রহণ ও চিন্তা ভাবনা উপেক্ষা করেননি। নোতুন সংগঠনটি সাম্প্রদায়িক হবে, না অসাম্প্রদায়িক; তার রাজনৈতিক, আর্থিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মসূচী কি হবে; ছাত্র সম্প্রদায়ের মধ্যে তাঁরা কিভাবে অগ্রসর হবেন; পার্লামেন্টারী পার্টির সুহরাওয়ার্দী- সমর্থক উপদলের সাথে কতখানি যোগাযোগ রাখা সঙ্গত হবে; এই সব বিষয়ে তাঁরা নিজেদের বৈঠকে প্রায়ই আলোচনা করতেন। এই বৈঠকগুলি মোগলটুলী ছাড়াও অধিকাংশ সময় কমরুদ্দীন আহমদের জিন্দাবাহার লেনস্থ বাসা এবং চাষাড়া-নারায়ণগঞ্জের খান সাহেব ওসমান আলীর বাসায় অনুষ্ঠিত হতো। এই বৈঠকগুলির সাথে কমরুদ্দীন আহমদ, তাজউদ্দীন আহমদ, মহম্মদ তোয়াহা, অলি আহাদ, শামসুজ্জোহা, আলমাস, আউয়াল প্রভৃতি বিশেষভাবে যুক্ত ছিলেন।[১৯]

পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ, প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে মোগলটুলীতে একত্রিত কর্মীরা ধীরে ধীরে বিচ্ছিন্ন হয়ে রাজনীতির বিভিন্ন খাতে নিজেদের কাজকর্মকে পরিচালনা করলেও একথা নিঃসন্দেহে বলা চলে যে পরবর্তীকালে সামগ্রিকভাবে তাঁরা পূর্ব-বাঙলার রাজনীতির উপর অনেকখানি প্রভাব বিস্তার করতে সমর্থ হন।

৩. টাঙ্গাইল উপনির্বাচন

ভাসানীর মওলানা আবদুল হামিদ খাঁন পূর্ব-বাঙলায় আসার পর ময়মনসিংহ জেলার টাঙ্গাইল দক্ষিণ (মুসলিম) কেন্দ্র থেকে পূর্ব-বাঙলা ব্যবস্থাপক সভার সদস্য নির্বাচিত হন। নির্বাচনের পর করোটিয়ার জমিদার খুররম খান পন্নী ভাসানীর নির্বাচনকে অবৈধ ঘোষণা করার জন্যে আবেদন জানান। সেই আবেদনের ভিত্তিতে প্রাদেশিক গভর্ণর উপরোক্ত নির্বাচন বাতিল করে দেন। তাছাড়া নির্বাচনে ব্যয়ের হিসেবে দাখিল না করার অপরাধে মওলানা ভাসানী, খুররম খান পন্নী প্রভৃতি চারজন ১৯৫০ সাল পর্যন্ত কোন নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করতে পারবেন না এই মর্মে তাঁদের উপর সরকারী নিষেধাজ্ঞাও জারি করা হয়।[২০]

১৯৪৯ সালে টাঙ্গাইল দক্ষিণ (মুসলিম) কেন্দ্রে প্রাদেশিক সরকার নোতুন করে আবার নির্বাচনের ব্যবস্থা করেন। এই খবর শোনার পর ১৫০ মোগলটুলীতে মোস্তাক আহমদ, শওকত আলী, শামসুল হক, কমরুদ্দীন আহমদ, নবাবজাদা হাসান আলী প্রভৃতি মিলে শামসুল হককে মুসলিম লীগের বিরোধী প্রার্থী হিসাবে দাঁড় করানোর সিদ্ধান্ত নেন। এর পর অন্যান্য সকলেই মোটামুটিভাবে এ ব্যাপারে একমত হন কিন্তু তবু নির্বাচনের ব্যাপারে সাবধান হওয়ার জন্যে নারায়ণগঞ্জের ওসমান আলীর বাসায় এক বৈঠকে শওকত আলী, শামসুজ্জোহা প্রভৃতি ১৫০ নম্বরের সাথে সংশ্লিষ্ট কর্মীরা স্থির করেন যে মুসলিম লীগ যদি শামসুল হককে মনোনয়ন দেয় তাহলে তাঁরা তাঁকে সমর্থন তো করবেনই না উপরন্তু অন্য একজনকে তাঁর পরিবর্তে দাঁড় করিয়ে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধাচরণ করবেন। শেষ পর্যন্ত অবশ্য শামসুল হকই মুসলিম লীগ বিরোধী প্রার্থী হিসাবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন এবং প্রাদেশিক মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটি মনোনয়ন দেন খুররম খান পন্নীকে।[২১]

কিন্তু ইতিপূর্বে প্রাদেশিক সরকারের জারীকৃত নিষেধাজ্ঞা অনুসারে ১৯৫০ সালের পূর্বে আইনত কোন কেন্দ্ৰেই নির্বাচন প্রার্থনার অধিকার খুররম খানের ছিলো না। এই অসুবিধা দূর করার জন্যে গভর্ণর বিশেষ ক্ষমতা বলে কেবলমাত্র মুসলিম লীগ প্রার্থী খুররম খানের বিরুদ্ধে নির্বাচন সংক্রান্ত নিষেধাজ্ঞাটি প্রত্যাহার করেন। ভাসানী এবং অপর দুইজনের বিরুদ্ধে সে নিষেধাজ্ঞা অবশ্য পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বলবৎ থাকে।[২২]

নূরুল আমীন সরকারের এই চরম অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং নিলর্জ্জ দলীয় রাজনীতির বিরুদ্ধে সমগ্র প্রদেশে কর্মীদের মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষ দেখা দেয়। মুসলিম লীগ নেতৃত্ব এবং প্রতিষ্ঠানটির সামগ্রিক চরিত্রও এই অদৃষ্টপূর্ব সরকারী সিদ্ধান্তের ফলে জনসাধারণের কাছে উদ্‌ঘাটিত হয়। এই প্রসঙ্গে সাপ্তাহিক নওবেলাল ‘একটি দৃষ্টান্ত’ নামে এক সম্পাদকীয় নিবন্ধে[২৩] বলেন:

মুসীলম লীগ গণতান্ত্রিক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত বলিয়াই জনসাধারণ জানিত এবং সেই জন্য তাহাদের সমর্থনও দান করিয়াছেন। কিন্তু মুসলিম লীগের বর্তমান অগণতন্ত্রী নীতির ফলে জনসাধারণ যদি তাহাদের সমর্থন প্রত্যাহার করে, তাহা হইলে দায়িত্ব কাহার হইবে? জনসাধারণের – না দলীয় স্বার্থে যাহারা গণতন্ত্রের ন্যায়নীতিকে জলাঞ্জলি দিয়া ফ্যাসিস্ট নীতি অবলম্বন করিয়াছেন তাহাদের?

এই প্রশ্নের জবারের ভার আমরা গণতন্ত্রে দৃঢ়বিশ্বাসী পাকিস্তানের কোটি কোটি জনগণের উপর ছাড়িয়া দিতেছি।

দেশের সত্যিকারের কোন উন্নতিমূলক পরিকল্পনা সামনে লইয়া যে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান আগাইয়া যায় না, তাহার পক্ষে এইরূপ ফ্যাসিস্ট নীতি অবলম্বন করা ছাড়া কি উপায় আছে? পাকিস্তান লাভের পর মুসলিম লীগের কর্তব্য ছিল জনগণের সত্যিকারের প্রতিনিধি হিসাবে সদ্য জাগ্রত এক জাতির সামনে রাষ্ট্রগঠনমূলক পরিকল্পনা লইয়া আগাইয়া আসা। কিন্তু মুসলিম লীগ সে কর্তব্য মোটেই পালন করে নাই। বরং দলীয় উপদলীয় স্বার্থ নিয়া কোন্দল করিতেই রত রহিয়াছে। এমতাবস্থায় জনসাধারণ যদি মুসলিম লীগের প্রতি আস্থা হারাইয়া ফেলে তাহা হইলে কাহাকে দোষী করা যাইবে?

টাঙ্গাইল উপ-নির্বাচনে মুসলিম লীগ প্রার্থী খুররম খানের বিরুদ্ধে শামসুল হক স্বতন্ত্র প্রার্থী রূপে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার কথা ঘোষণা করেন। তাঁর এই সিদ্ধান্ত মুসলিম লীগ সরকারের বিরোধী মহলে সন্তোষজনক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে এবং তাঁদের মধ্যে অনেকেই শামসুল হককে সক্রিয়ভাবে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন। এ ব্যাপারে ১৫০ নম্বর মোগলটুলীর ‘পার্টি হাউসকে’ কেন্দ্র করে যে কর্মীদল তখনো পর্যন্ত মোটামুটি একত্রিত ছিলেন তাঁরাই সব থেকে সংগঠিত এবং ব্যাপকভাবে শামসুল হকের পক্ষে নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করেন। মোস্তাক আহমদই ছিলেন এই নির্বাচনের মূল সংগঠনক। তা ছাড়া অন্যান্য যাঁরা এক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা নেন তাঁদের মধ্যে কমরুদ্দীন আহমদ, নারায়ণগঞ্জের শামসুজ্জোহা, মহম্মদ আলমাস, মহম্মদ আউয়াল এবং শওকত আলী, আজিজ আহমদ, হজরত আলী প্রভৃতির নাম উল্লেখযোগ্য।[২৪]

নির্বাচনী সংগ্রাম পরিচালনার জন্যে বিরোধী পক্ষের অর্থাভাব বেশ কিছুটা অসুবিধার সৃষ্টি করে। আলমাস নারায়ণগঞ্জ এলাকা থেকে ৫০০ টাকা তোলেন। তা ছাড়া চেম্বার অব কমার্সের সাখাওয়াৎ হোসেন ৫০ টাকা, আতাউর রহমান খান ৫০ টাকা, কাদের সর্দার ১৫০ টাকা দেন। অন্যান্যদের থেকে আরও কিছু টাকা নিয়ে সর্বসাকুল্যে নির্বাচনের জন্যে কর্মীরা প্রায় ১৩০০ টাকা তুলতে সমর্থ হন।[২৫] মুসলিম লীগের বিপুল অর্থ সামর্থ্যের তুলনায় শামসুল হকের এই অবস্থা রীতিমতো আশংকাজনক ছিলো। কিন্তু তা সত্ত্বেও অর্থাভাব নির্বাচনের ক্ষেত্রে তেমন কোন প্রতিবন্ধকতাই সৃষ্টি করতে পারেনি।[২৬]

স্থানীয় স্কুল এবং করোটিয়া কলেজের বহুসংখ্যক ছাত্র শামসুল হকের নির্বাচনী সংগ্রামে খুব মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে। তারা অর্ধভুক্ত অবস্থায় এবং পায়ে হেঁটে নির্বাচনী এলাকার বিভিন্ন কেন্দ্রে ব্যাপক সরকার বিরোধী প্রচারণা চালায় এবং সরকারী সভা সমিতিতে দলে দলে উপস্থিত হয়ে সেগুলিকে বিরোধীদলের সভায় পরিণত করে। এই ধরনের তিন চারটি সভায় প্রধানমন্ত্রী নূরুল আমীন এবং অন্যান্য মন্ত্রীদের উপস্থিতিতে শামসুল হকও সরকারকে বিভিন্ন বিষয়ে চ্যালেঞ্জ দেন এবং তাঁদের গণবিরোধী নীতিসমূহের তীব্র সমালোচনার দ্বারা সেখানে মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠান ও সরকারের বিরুদ্ধে প্রবল বিক্ষোভের সৃষ্টি করেন।[২৭]

নির্বাচনকালে খুররম খানের স্ত্রী তাঁর স্বামীর বিরুদ্ধে শামসুল হকের পক্ষে প্রচারণায় অংশ গ্রহণের জন্যে বিরোধীদলের কাছে প্রস্তাব পাঠান কিন্তু তাঁরা তাঁর সেই প্রস্তাব অস্বীকৃতি জানানোর পর বেগম পন্নী নিজেই একটি ইস্তাহার প্রচার করে তাতে তাঁর স্বামীর ব্যক্তিগত চরিত্রের প্রতি দোষারোপ করেন ও ভোটারদেরকে খুররম পন্নীর পক্ষে ভোট না দেওয়ার জন্যে আবেদন জানান।[২৮]

এই নির্বাচনের সময় পূর্ব পাকিস্তানের মুসলিম লীগ সভাপতি মৌলানা আকরম খাঁ, সম্পাদক ইউসুফ আলী চৌধুরী এবং প্রধানমন্ত্রী নূরুল আমীন ভোটারদের উদ্দেশ্যে নিম্নোক্ত আবেদন[২৯] প্রচার করেন:

লাখো মোজাহেদের ত্যাগ ও কোরবাণীর ফলে আমরা পাকিস্তান লাভ করিয়াছি। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মোসলেম রাষ্ট্র আমাদের পাকিস্তান। পাকিস্তানের গঠনতন্ত্র আইন-কানুন তৈরী হইতেছে ইসলামী শরিয়ত মোতাবেক। এই নূতন রাষ্ট্রের শিশু অবস্থায় একে কত বিপদ – কত মছিবতের সম্মুখীন হইতে হইতেছে। কত জানী দুষমন শৈশবেই ইহাকে নষ্ট করিবার চেষ্টা করিতেছে। ভারতের ১০ কোটি মুছলমান মুছলেম লীগের ঝাণ্ডার নীচে একযোগে কাজ করিয়াছিল বলিয়াই আমরা পাকিস্তান হাসিল করিতে পারিয়াছিলাম। পাকিস্তান হাসিলের জন্য মুছলেম সংহতি ও মোছলেম লীগের যতখানি দরকার ছিল আজ পাকিস্তানকে গড়িয়া তুলিবার জন্য এর দরকার তার চেয়েও বেশী। কায়েদে আজম বারে বারে বলিয়াছেন – পাকিস্তানকে মজবুত করিতে হইলে মুছলিম লীগকে মজবুত করিতে হইবে। এন্তেকালের কিছু দিন আগে তিনি ঢাকায় বক্তৃতায়ও মুছলিম লীগের দুষমনদের সম্বন্ধে আপনাদের সতর্ক করিয়াছেন, এবং মুসলিম লীগকে শক্তিশালী করিবার জন্য আকুল আহ্বান জানাইয়াছেন।

পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার ইছলামী শরিয়ত মোতাবেক যে আইন কানুন তৈরী করিতেছেন, তা চালু করিতে হইলে প্রাদেশিক আইন সভারও মুসলমান সদস্যদিগকে একদিন একমত হইয়া মুছলিম লীগের ভিতর থাকিয়া কাজ করিতে হইবে। আপনারা জানেন দক্ষিণ টাঙ্গাইল হইতে আগামী ২৬ শে এপ্রিল পূর্ববঙ্গ আইন সভার উপ-নির্বাচন হইবে। এইবার এই আসনের জন্য মুছলিম লীগের তরফ হইতে নমিনেশন পাইয়াছেন করোটিয়ার স্বনামধন্য চাঁদ মিয়া সাহেবের নাতি খুররম খাঁ পন্নী। পাকিস্তান রাষ্ট্রকে রক্ষা করিতে হইলে – মজবুত করিতে হইলে – আপনাদের কর্তব্য হইবে একবাক্যে মুছলিম লীগের সাইকেল মার্কা বাক্সে ভোট দেওয়ার। মুছলিম লীগে ও মুছলিম জামাতে ভাঙন ধরাইবার জন্য পাকিস্তান লাভের আগে যেমন চেষ্টা হইয়াছে এখনও সেই রকম চেষ্টা হইতেছে। বন্ধুর বেশে আসিয়া অনেকে মুছলিম লীগের ও মুছলিম লীগ প্রার্থীর বিরুদ্ধে অনেক কিছুই বলিবে। আপনি যদি মুছলিম রাষ্ট্রকে মজবুত দেখিতে চান, দুনিয়ায় পাকিস্তানের ও মুছলিম জাতির ঝাণ্ডা চলন্ত হোক এ যদি আপনার কামনা হয়, আপনি নিশ্চয়ই লীগ প্রার্থী খুররম খাঁ পন্নির জন্য মুছলিম লীগের সাইকেল মার্কা বাক্সে ভোট দিবেন। মনে রাখবেন এ ভোট মুছলিম লীগ ও পাকিস্তান দৃঢ় করিবার জন্য। আশা করি অন্যবারের ন্যায় এবারও আপনারা মুছলিম লীগকে সমর্থন করিয়া মোছলিম জমাত কায়েদে আজম ও পাকিস্তানের মর্যাদা রক্ষা করিবেন।

‘টাঙ্গাইল উপ-নির্বাচন’ নামে একটি সম্পাদকীয়তে দৈনিক আজাদ নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতা সম্পর্কে মন্তব্য প্রসঙ্গে বলেন:

দুইজন প্রার্থী বর্তমানে এই আসনের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করিতেছেন বলিয়া জানা গিয়াছে। এই দুইজনের মধ্যে জনাব খুররম খান পন্নী সাহেব লীগের মনোনয়ন লাভ করিয়াছেন। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী জনাব শামসুল হক সাহেব দুই বৎসর আগে তদানীন্তন প্রাদেশিক লীগ সেক্রেটারী জনাব আবুল হাশেমের অনুবর্তী হিসাবে লীগের প্রচার কার্যে নিযুক্ত ছিলেন। আশা করা গিয়াছিল যে, লীগ কর্মী হিসাবে শেষোক্ত প্রার্থী জনাব শামসুল হক সাহেব লীগ মনোনয়নপ্রাপ্ত প্রার্থী জনাব খুররম খান পন্নীর অনুকূলে নির্বাচন-দ্বন্দ্ব হইতে সরিয়া দাঁড়াইয়াছেন। এটি খুবই দুঃখজনক ব্যাপার, সন্দেহ নাই। লীগের নিয়ম-শৃঙ্খলা লীগ কর্মী বলিয়া পরিচিত এক ব্যক্তি ভাঙিবেন, পূর্ব পাকিস্তানের সত্যকার লীগারদের কাছে তাহা এতদিন অভাবনীয় ব্যাপারই ছিল…।

শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগ সম্পাদকীয়টিতে করা হয়েছে সে অভিযোগ বস্তুতঃ প্রযোজ্য ছিলো সংবাদপত্রটির মালিক এবং পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগের সভাপতি মৌলানা আকরম খাঁ এবং মুসলিম লীগের অন্যান্য নেতৃবৃন্দের ক্ষেত্রে। তাঁরাই মুসলিম লীগকে কুক্ষিগত করে তাঁদের উপদলের বাইরের কোন কর্মী অথবা নেতা যাতে প্রতিষ্ঠানে ঠাঁই পেতে না পারেন তার জন্যে সর্বপ্রকার ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। তাঁদের এ ধরনের নানা কীর্তিকলাপের পর মুসলিম লীগের প্রতি আস্থার অভাব ছিলো খুবই যুক্তিসঙ্গত ও স্বাভাবিক। সে সম্পর্কে কোন কিছু উল্লেখ না করে আজাদ-এর উক্ত সম্পাদকীয়টিতে ভোটারদেরকে সতর্ক করার উদ্দেশ্যে আবার বলা হয়:

আমরা অবশ্য শামসুল হক সাহেবের এই লীগ-বিদ্রোহিতায় বিস্মিত হই নাই। তিনি আগেও যত না ছিলেন সত্যকার লীগমনা কর্মী তার চাইতে বেশী ছিলেন আবুল হাশিম সাহেবের অন্ধ ভক্ত শিষ্য। জনাব আবুল হাশিমের হঠকারিতাপূর্ণ কীর্তিকলাপের সাথে পূর্ব পাকিস্তানের জনসাধারণের, বিশেষ করিয়া লীগারদের পরিচয় যথেষ্টই আছে, কাজেই সে সম্পর্কে এখানে পুনরালোচনা অনাবশ্যক। সেই আবুল হাশিম সাহেবের অন্ধভক্ত শিষ্য হঠকারিতার বশবর্তী হইয়া লীগ-নির্দেশ অমান্য করিয়া বসিবেন, তাতে বিস্ময়ের বিষয় আর কি থাকিতে পারে! টাঙ্গাইলের ভোটারদের কাছে আমাদের আরজ এখনো পূর্ব পাকিস্তান সর্বাংশে বিপদমুক্ত হয় নাই, এখনো বাহিরের শত্রুদল পাকিস্তানের নাম-নিশানা মুছিয়া ফেলার জন্য সুযোগের অপেক্ষায় ওঁৎ পাতিয়া আছে এবং পাকিস্তানপন্থীদের মধ্যে অন্তর্বিরোধ ও ভাঙন সৃষ্টির মধ্য দিয়াই যে সে সুযোগ আসিবে, ইহারা তাহা জানে। কাজেই আমরা ভোটারদের উদ্দেশ্যে সতর্কবাণী উচ্চারণ করি: সাধু সাবধান।

নির্বাচনে শামসুল হক বিপুল ভোটাধিক্যে জয়লাভ করেন। কিন্তু আজাদ-এ এই জয়কে ‘অল্প সংখ্যক ভোটে’ বলিয়া অভিহিত করার চেষ্টা হয়। সংবাদপত্রটির সেই একই সংখ্যায় আবার একথাও বলা হয় যে ‘ভোটের সঠিক সংখ্যা এখনও জানা যায় নাই।[৩১]

নির্বাচন শেষ হওয়ার ঠিক পরই একটি ঘটনায় মোহন মিঞা, শাহ আজিজুর রহমান, সোলায়মান ও আলাউদ্দীনের সাথে জড়িত হয়ে পড়ার জন্যে শামসুল হক, মোস্তাক আহমদ এবং টাঙ্গাইলের একজন স্থানীয় ব্যক্তি বদিউজ্জামানকে গ্রেফতার করা হয়। যে যুবক পুলিশ অফিসারটি তাঁদেরকে গ্রেফতার করেন তিনি জানান যে তাঁদের জামিনে মুক্তি লাভের কোন সম্ভাবনা নেই। কারণ তাঁদেরকে যাতে জামিন না দেওয়া হয় সেই মর্মে ঢাকা থেকে নির্দেশ এসেছে। এই খবর দেওয়ার সাথে তিনি শামসুল হক ও মোস্তাক আহমদকে উপদেশ দেন মোহন মিঞা, শাহ আজিজুর রহমান এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্যদের বিরুদ্ধে পাল্টা মামলা দায়ের করতে।[৩২]

সেই অনুসারে অগ্রসর হয়ে শামসুল হক পক্ষ পাল্টা মামলা দায়ের করার পর সেই পুলিশ অফিসারটি মহকুমা হাকিম খুরশিদ আলমের বাসায় উপস্থিত হন। সেখানে তখন মোহন মিঞা এবং অন্যান্যরা অতিথি হিসাবে অবস্থান করছিলেন। মহকুমা হাকিমকে পুলিশ অফিসারটি পাল্টা মামলার কথা জানান এবং মোহন মিঞাদেরকে ঐ একই কারণে গ্রেফতার করার প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করেন। এর উত্তরে মহকুমা হাকিম মোহন মিঞাদেরকে জামিন দিতে নির্দেশ দিলে পুলিশ অফিসারটি তাঁকে জানান যে অন্যদেরকে একই ধরনের মামলায় জামিন না দেওয়ার নির্দেশ আছে, কাজেই সেই নির্দেশ প্রত্যাহার না করা পর্যন্ত অন্যদেরকে জামিন দেওয়া সম্ভব হবে না। এর পর অন্য উপায় না দেখে মহকুমা হাকিম সকলকেই জামিন দেওয়ার নির্দেশ দেন। সেই মামলা কয়েক বছর ধরে চলে এবং শেষ পর্যন্ত দুই পক্ষের একটা আপোষের মাধ্যমে মামলাটির নিষ্পত্তি হয়।[৩৩]

নির্বাচনে জয় লাভের পর ৮ই মে শামসুল হক ঢাকা পৌঁছাবেন এই সংবাদ পাওয়ার পর শওকত আলী, কমরুদ্দীন আহমদ, আতাউর রহমান খান, আলী আমজাদ খান প্রভৃতি সকলে মিলে তাঁকে সম্বর্ধনা জানানোর ব্যাপারে উদ্যোগী হন। কিন্তু কাদের সর্দার তাতে সম্মত না হয়ে আতাউর রহমানকে বলেন যে ঢাকাতে সে রকম কোন অনুষ্ঠানের প্রয়োজন নেই। যা করতে হয় টাঙ্গাইলেই করা উচিত। একথা শুনে আতাউর রহমান স্থির করেন যে বেশী হাঙ্গামা না করে তাঁরা কয়েকজন স্টেশনে গিয়ে শামসুল হককে নিয়ে আসবেন। এই সময় মুসলিম লীগের গুণ্ডারাও মাজেদ সর্দারের নেতৃত্বে শামসুল হকের সম্বর্ধনার আয়োজন বানচাল করার চেষ্টা করবে এই মর্মে তাঁদেরকে শাসাতে থাকে। এই সংবাদ পেয়ে শওকত আলী, কমরুদ্দীন আহমদ, আতাউর রহমান প্রভৃতি ক্যাপ্টেন শাহজাহানের বাড়ীতে উপস্থিত হন এবং উপরোক্ত পরিস্থিতির মোকাবেলার উপায় সম্পর্কে নিজেদের মধ্যে আলোচনা শুরু করেন। এই আলোচনা চলাকালে লতিফুর রহমান নামে একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার ক্যাপ্টেন শাহজাহানের বাড়ীতে তাঁর সাথে দেখা করতে যান। ক্যাপ্টেন শাহজাহানের সাথে লতিফুর রহমানের বিশেষ বন্ধুত্ব ছিলো। তিনি সবকিছু শোনার পর তাঁদেরকে এই মর্মে আশ্বাস দেন যে মাজেদ সর্দার তাঁর অধীনে ঠিকাদারী করেন, কাজেই তিনি তাঁকে ধমক দিয়ে এই সব গুণ্ডামীর মধ্যে না যাওয়ার জন্যে বলে দেবেন। লতিফুর রহমান তাঁর কথা রেখেছিলেন এবং তাঁর নির্দেশমতো মাজেদ সর্দার শেষ পর্যন্ত এ ব্যাপারে কোন প্রকার গণ্ডগোল সৃষ্টি থেকে বিরত হন। শুধু তাই নয় মাজেদ সর্দার স্বীকারও করেন যে তাঁকে টাকা দিয়ে গণ্ডগোল সৃষ্টির জন্যে বলা হয়েছিলো।

এর পর শামসুল হকের সম্বর্ধনার জন্যে যথারীতি সব ব্যবস্থা করা হয়। রেলওয়ে স্টেশন থেকে মিছিল সহকারে তাঁকে নবাবপুর রোড দিয়ে নিয়ে গিয়ে ভিক্টোরিয়া পার্কে সকলে সমবেত হওয়ার পর সেখানে একটি জনসভা অনুষ্ঠিত হয়।[৩৪]

টাঙ্গাইল নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার পর দৈনিক আজাদ আবার একটি সুদীর্ঘ সম্পাদকীয় নিবন্ধ প্রকাশ করেন। এই সম্পাদকীয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এর মধ্যে শুধু যে মুসলিম লীগ সমর্থক একটি পত্রিকার মতামতই ব্যক্ত হয় তা নয়, প্রাদেশিক মুসলিম লীগ এবং প্রাদেশিক সরকারের অন্তর্দ্বন্দ্বও তাতে স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে। ‘টাঙ্গাইলের উপনির্বাচন’ শীর্ষক এই সম্পাদকীয়টিতে[৩৫] বলা হয়:

টাঙ্গাইলের উপনির্বাচনে লীগ মনোনীত প্রার্থী হারিয়া গিয়াছেন। ইহা মুছলিম লীগ নির্বাচনের ইতিহাসে এক অভিনব এবং অভাবিতপূর্ব ব্যাপার। কোন সাধারণ নির্বাচনের সময় যদি কোন একজন লীগ প্রার্থীর পরাজয় ঘটে, তবে তাকে এতখানি গুরুত্ব না দিলেও চলে। কারণ, তখন লীগের নির্বাচন জয়ের প্রচেষ্টা একই সঙ্গে বহুদিকে ছড়াইয়া দিতে হয়। কিন্তু একটা উপনির্বাচনের পরাজয়ের সময় এই ধরনের কৈফিয়ত দিয়া অব্যাহতি লাভ করা যায় না। তার পর বিভক্ত ও অবিভক্ত বাঙ্গলার লীগের ইতিহাসে কোন পরিষদী উপনির্বাচনে লীগ প্রার্থীর আর কোন দিন পরাজয় ঘটে নাই। জাতির আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতীক এবং জাতির একমাত্র বলিয়া বহুকীর্তিত লীগের ভাগ্যে এই কলংক স্পর্শ অত্যন্ত শোচনীয় ঘটনা। এক হিসাবে একে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক ইতিহাসের অন্যতম প্রধান মর্মান্তিক ব্যাপার বলিয়া চিরকাল বেদনা এবং ক্ষোভের সাথে দেশের মানুষ স্মরণ করিবে।

কিন্তু প্রশ্ন জাগে, কেন এইরূপ ঘটনা ঘটিল। পূর্ব বাঙ্গালার লীগের বহু কষ্টে অর্জিত গৌরব আজ কেন এইভাবে কলংক-মলিন হইল? এ প্রশ্ন আজ পূর্ব পাকিস্তানের কল্যাণকামী মানুষ মাত্রেই জিজ্ঞেসা না করিয়া পারেন না। আমাদের মনে হয় এ প্রশ্নের সদুত্তর পাইতে হলে বহু দূরে যাইবার কোন দরকার নেই। একটু তলাইয়া দেখিলেই, একটা সত্য সকলের নিকট পরিষ্কার হইয়া যাইবে যে, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর লীগের জীবন ও কার্যে এরূপ কতকগুলি ব্যাপার সংঘটিত হইয়াছে, যার ফলে লীগ তাহার জনপ্রিয়তা এবং আবেদনের অনিবার্যতা অনেকখানি হারাইয়া ফেলিয়াছে। পাকিস্তান আনিতে হইবে – লীগের সে অতীত আবেদন আজ আর নাই, যদিও পাকিস্তান রক্ষা করিতে হইবে – এ আবেদন আজও অর্থপূর্ণ। কায়েদে আজমের অতুলনীয় নেতৃত্ব আজ আর নাই; যদিও কায়েদে আজমের অসমাপ্ত কাজের ভার তাঁর স্বনামধন্য অনুসারী নেতাদের স্কন্ধে পড়িয়াছে – পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত এবং কায়েদে আজম পরলোকগত হওয়ার পর পাকিস্তানকে রক্ষার ও জনগণের ইচ্ছাকে অভিব্যক্তি দেওয়ার দায়িত্ব আজও লীগের : তবু সে দায়িত্ব আজ যথাযথ পালিত হইতেছে না। লীগের আভ্যন্তরীণ দুর্বলতা এবং লীগ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানের বিভিন্ন সরকারের ক্ষমতার লোভে এমন এক পরিস্থিতির সৃষ্টি হইয়াছে, যাতে লীগের কার্যে ত্রুটি বিচ্যুতি এবং গলদ দেখা দিতেছে। জনগণের মোকাবেলা করে বিশেষভাবে আজ লীগ, কিন্তু সর্বব্যাপী ক্ষমতা পরিচালনা করে সরকার। সরকারের প্রভাব লীগের কার্যকলাপকে আজ সর্বত্র প্রভাবান্বিত করিতেছে মায় উপনির্বাচনের প্রার্থী মনোনয়নের ব্যাপারে। ফলে নিজেদের বিশেষ ত্রুটি ও বিচ্যুতিরই নয়, সরকারী কাজের পাপের বোঝাও লীগকে সমানভাবে বহন করিতে হইতেছে। মুসলিম লীগ আজ সর্বত্র সরকারী ইচ্ছা ও অনিচ্ছার বাহন হইয়া দাঁড়াইয়াছে, জনগণের ইচ্ছা অনিচ্ছার লীগ আর বাহন নয়। এরই দরুন লীগ আজ জনপ্রিয়তা হারাইতে বসিয়াছে। যেদিন হইতে লীগ সরকারী ইচ্ছার প্রতিচ্ছবিতে পরিণত হইয়াছে সেদিন হইতে তার কার্যকলাপে যথেচ্ছাচার ও দোষ ত্রুটি নানাদিক হইতে আত্মপ্রকাশ করিতে আরম্ভ করিয়াছে। টাঙ্গাইলে লীগ প্রার্থী মনোনয়নেও ইহা লক্ষ্যিত হইয়াছিল। জনমতের মুখ না চাহিয়া সরকারী মহলের ইচ্ছার জয়ই এক্ষেত্রে হইয়াছিল। আমরা কিছুদিন আগে টাঙ্গাইলে লীগের জয়ই কামনা করিয়াছিলাম – কিন্তু মনোয়ননের ব্যাপারে যে প্রকাণ্ড ভুল হইয়াছিল, তা আজ না বলিয়া উপায় নাই। বেশ বুঝা গেল, বহুদিন হইতে বহু ব্যাপারে অনাচার চরমে উঠিয়াছিল এবং তাহাই জনসাধারণের ধৈর্যের বাঁধ ছিঁড়িয়া দিয়াছে। এ সত্যই টাঙ্গাইলের উপনির্বাচনের ভিতর দিয়া ঘোষিত হইল। টাঙ্গাইলের এই পরাজয় লীগের পরাজয় নিশ্চয়ই; কিন্তু ইহা এক হিসাবে সরকারের উপর অনাস্থা। নির্বাচনী প্রচার কার্যে পাঁচজন মন্ত্রীর উপস্থিতিও তার ফলাফলকে প্রভাবান্বিত করিতে পারিল না –

ঘটনার ইঙ্গিত আজ সকলকে গভীরভাবে ভাবিয়া দেখিতে হইবে। টাঙ্গাইলের পরাজয়কে এক প্রকাণ্ড বিপদ সংকেত বলিয়া সকলকে আজ গ্রহণ করিতে হইবে। লীগের বিরুদ্ধে উত্তোলিত বিদ্রোহের পতাকা একদিন সমগ্র পাকিস্তানকে আচ্ছন্ন করিবে কি না, লীগ এবং পাকিস্তান বিচ্ছিন্ন ও বিধ্বস্ত হইবে কি না, এ কথাও হয়ত এখন হইতেই চিন্তা করিতে হইবে। শুধু চিন্তা নয়, আজ ইহা সকল লীগপন্থীকে চক্ষুন্মিলনে সাহায্য করুক – ইহাই আমাদের প্রার্থনা।

আমাদের পাপ কোথায় গলদ কোনখানে তারই ক্ষমাহীন সন্ধান ও কঠোর প্রতিকারের সংকল্প আজ প্রত্যেক লীগপন্থীকে গ্রহণ করিতে হইবে। বাঁচা মরার সংকট-সংকেত যদি আজ ইহা হইতে গ্রহণ করিতে না পারে তবে আমাদের বিপর্যয়কে কেউ ঠেকাইতে পারিবে না। লীগকে সকল দুর্বলতা, সকল প্রভাব এবং পতন স্খলনের হাত হইতে মুক্তি দানের অনিবার ইচ্ছা আজ জাতির মনে জাগিয়া উঠুক। লীগ পুনরায় হোক সত্যিকারের জনগণের প্রতিষ্ঠান এবং লীগ আজ আবার পরিচালনা করুক সরকারকে। লীগের ভিতর আবার শিখার মত জ্বলিয়া উঠুক জাতির ইচ্ছাশক্তি এবং তারই সাথে পূর্ব মহিমায় লীগের প্রতিষ্ঠা হোক জনগণের মনে।

আজাদের উপরোদ্ধৃত সম্পদকীয়টিতে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগ সভাপতি আকরম খাঁকে বাঁচিয়ে শুধুমাত্র প্রাদেশিক সরকারের উপর দোষারোপ করা হয়। সেই প্রসঙ্গ উল্লেখ করে টাঙ্গাইল উপনির্বাচনের উপর একটি প্রবন্ধে ৬ই মে, ১৯৪৯, সাপ্তাহিক সৈনিক নিম্নলিখিত মন্তব্য করে:

টাঙ্গাইলের সবচেয়ে জাঁদরেল প্রভাবশালী জমিদার, যাঁর পূর্বপুরুষ কলেজ ও অন্যান্য মহা প্রতিষ্ঠান করেছেন – তাঁকে সামান্য একজন নিঃস্ব কর্মী পরাজিত করেছেন – সুতরাং জমিদারী বা তালুকদারী শাসন যে চলবে না তা বলাই বাহুল্য। আজাদ বলেছে, এ নির্বাচন সরকারের প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করেছে। আমরা বলি – এ নির্বাচন সভাপতিসহ লীগ নেতাদের প্রতি দৃঢ় অনাস্থা জানিয়েছে। আরও জানিয়েছে – বিনা খেসারতে জমিদারী প্রথা উচ্ছেদই জনগণ চায়।… শোনা যায় চাটগাঁ উপনির্বাচনে লীগ প্রার্থীর নিশ্চিত পরাজয় হবে জেনেই লীগ কর্তৃপক্ষ নির্বাচন ঘোষণা করছেন না। কিন্তু এভাবে কতদিন আত্ম বা স্বার্থ রক্ষা করা চলবে? টাঙ্গাইল নির্বাচন লোকের চোখ খুলে দিয়েছে। এখন সরকারী প্রার্থীর বিরুদ্ধে দাঁড়াতে বা ভোট দিতে কেউ দ্বিধা বা ভয় করবে না। টাঙ্গাইলে মন্ত্রীরাও গিয়েছিলেন সরকারী টাকা খরচ করেই। কিন্তু যে লীগ মন্ত্রীদের উপস্থিতিতে ছাত্র কৃষক মজুরের জিন্দাবাদে সকল স্থান মুখরিত হতো, সে মন্ত্রীরাই সেখানে দারুণভাবে অপমানিত ও অপদস্থ হয়েছেন। শুধু তাই নয়, মন্ত্রীদের সব কয়টি সভাই শামসুল হকের মিটিংএ পরিণত হয়েছে।

নির্বাচিত হওয়া সত্ত্বেও কিন্তু শামসুল হককে পূর্ব-বাঙলা ব্যবস্থাপক সভায় আসন গ্রহণ করতে দেওয়া হয়নি। মওলানা ভাসানীর মতো তাঁর বিরুদ্ধেও একটি নির্বাচনী মামলা দায়ের করা হয়। প্রাদেশিক সরকার বিচারপতি আমীনউদ্দীন আহমদ, এনায়েতুর রহমান এবং শহরউদ্দীনকে নিয়ে একটি বিশেষ ট্রাইবুন্যাল গঠন করেন এবং সেই ট্রাইবুনালের উপর নির্বাচন মামলাটি পরিচালনার দায়িত্ব অর্পিত হয়। ট্রাইবুনাল তাঁদের প্রথম বৈঠকেই স্থির করেন যে মামলাটির নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচিত প্রতিনিধি শামসুল হক ব্যবস্থাপক সভায় আসন গ্রহণ করতে পারবেন না।[৩৬]

একটি নির্বাচনী ইস্তাহারকে ভিত্তি করে টাঙ্গাইল নির্বাচনে শামসুল হকের বিরুদ্ধে মামলাটি দায়ের করানো হয়। মওলানা ভাসানী আসাম থেকে চলে আসার পর ময়মনসিংহের টাঙ্গাইল মহকুমার কাগমারী গ্রামে বসবাস আরম্ভ করেন এবং টাঙ্গাইল থেকেই পূর্ব-বাঙলা ব্যবস্থাপক সভার সদস্য নির্বাচিত হন। সেই নির্বাচন বাতিল হওয়ার পর বন্ধু-বান্ধব ও মুরিদদের সাথে দেখা করার উদ্দেশ্যে তিনি আসাম প্রদেশের ধুবড়ী শহরে উপস্থিত হলে আসাম সরকার মার্চ মাসের মাঝামাঝি তাঁকে গ্রেফতার করে। টাঙ্গাইলের দ্বিতীয় উপনির্বাচনের সময় ভাসানী ধুবড়ী জেলে অবস্থান করছিলেন। হজরত আলী নামে শামসুল হক সমর্থক একজন কর্মী সেখানে ভাসানীর সাথে সাক্ষাৎ করে শামসুল হকের স্বপক্ষে একটি ইস্তাহারে তাঁর স্বাক্ষর নিয়ে আসেন। নির্বাচনী প্রচারণার কাজে ভাসানীর স্বাক্ষরযুক্ত সেই ইস্তাহার বিলির ব্যবস্থা আরম্ভ হলে কমরুদ্দীন আহমদ প্রভৃতি তৎক্ষণাৎ সেই ইস্তাহার বিলির ব্যবস্থা বন্ধ করার নির্দেশ দিয়ে ছাপা ইস্তাহারগুলি নষ্ট করে দেন। কিন্তু তার পূর্বেই বেশ কিছু সংখ্যক ইস্তাহার নির্বাচনী এলাকায় বিলি হয়ে গিয়েছিলো। ইস্তাহারটিতে ভাসানীর স্বাক্ষরের ফ্যাক্সিমিলি পর্যন্ত ব্লক করে দেওয়া হয়েছিলো।[৩৭]

ইস্তাহারটির বিলি বন্ধ করার নির্দেশ সত্ত্বেও তার কপি মুসলিম লীগ কর্মী ও সরকার পক্ষীয় লোকদের হস্তগত হয় এবং নির্বাচনের ফলাফল ঘোষিত হওয়ার পর এই মর্মে তারা শামসুল হকের নির্বাচন বাতিলের আবেদন করে যে নির্বাচনে তিনি ভাসানীর স্বাক্ষর জাল করে জয়লাভের উদ্দেশ্যে অসৎ পন্থা অবলম্বন করেছেন। তারা আরও বলে যে মৌলানার স্বাক্ষরযুক্ত ইস্তাহার যখন জেল কর্তৃপক্ষ কর্তৃক অনুমোদিত হয়নি তখন সেই ইস্তাহার যে নিতান্তই জাল সে বিষয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।[৩৮]

এই নির্বাচনী মামলা ১৯৫০ সাল পর্যন্ত চলে এবং শহীদ সুহরাওয়ার্দী ট্রাইবুনালের সামনে শামসুল হকের পক্ষে সেই মামলায় আবির্ভাবের উদ্দেশ্যে ঢাকা আসেন। এই সময় ১৯শে জুলাই, ১৯৫০, প্রাদেশিক সরকারের নির্দেশে স্বরাষ্ট্র দফতরের সেক্রেটারী তাঁকে জানান যে ঢাকায় অবস্থানকালে তাঁকে নিজের কার্যাবলী ইলেকশান ট্রাইবুনালের ব্যাপারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে হবে। ঢাকা শহরের বাইরে তিনি অন্য কোন জায়গায় যেতে অথবা কোন জনসভাতে বক্তৃতা দান করতে পারবেন না। ট্রাইবুনালের কাজ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ২৮শে জুলাইয়ের মধ্যে তাঁকে পূর্ব-বাঙলা পরিত্যাগ করতে হবে। এবং সরকারের এইসব নির্দেশ অমান্য করলে তাঁকে গ্রেফতারও করা প্রয়োজন হতে পারে। প্রাদেশিক সরকারের এই নির্দেশপত্র পাওয়ার পর সুহরাওয়ার্দী সংবাদপত্র প্রতিনিধিদের কাছে বলেন যে তিনি পাকিস্তানের উন্নতি ও মঙ্গল কামনা করেন এবং পূর্ব পাকিস্তান সরকার গণতন্ত্রের মূলনীতিকে কেন যে উপেক্ষা করে চলেছেন তার কারণ উপলব্ধি করতে তিনি অক্ষম।[৩৯]

বৎসরাধিককাল টাঙ্গাইল নির্বাচনী মামলা চলার পর তার রায় বের হয় এবং শামসুল হকের নির্বাচনকে ট্রাইবুনাল বাতিল ঘোষণা করেন।

এই নির্বাচনের পর পাকিস্তান দেশীয় রাজ্য মুসলিম লীগের সভাপতি মনজুর আলম করাচীতে এক সাংবাদিক বৈঠকে বলেন যে পূর্ব-বাঙলার একটি উপনির্বাচনে মুসলিম লীগ প্রার্থীর পরাজয় খুবই অর্থপূর্ণ। মুসলিম লীগ যে আর সকল মুসলমানের প্রতিনিধিত্ব করে না এই নির্বাচনই তা প্রমাণ করেছে। সাংবাদিক বৈঠকটিতে মনজুর আলম পাকিস্তান গণপরিষদ, প্রাদেশিক আইন সভা ও মুসলিম লীগের নোতুন নির্বাচন দাবী করেন।[৪০]

প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে টাঙ্গাইল উপনির্বাচনে লীগ প্রার্থীর শোচনীয় পরাজয়ের পর পূর্ব বাঙলার বহু এলাকাতে উপনির্বাচনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিলেও ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনের পূর্বে নূরুল আমীন সরকার পরাজয়ের আশঙ্কায় অন্য কোন এলাকাতেই উপনির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করেননি।

৪. মুসলিম লীগের আভ্যন্তরীণ সংকট

মুসলিম লীগ সংগঠনকে ব্যক্তিগত ও উপদলীয় স্বার্থে কুক্ষীগত রাখার ফলে তার মধ্যে যে আভ্যন্তরীণ সংকট শুরু হয় টাঙ্গাইলের উপনির্বাচনে ঘটে তার প্রথম বহিঃপ্রকাশ। পুরাতন পরীক্ষিত কর্মী এবং নোতুন উৎসাহী লোকজনের অভাবে মুসলিম লীগ সংগঠনগতভাবে নিতান্ত দুর্বল হয়ে পড়ে এবং সরকারী কীর্তিকলাপের বোঝায় ভারাক্রান্ত হয়ে সেই সংকট এক তীব্র আকার ধারণ করে।

এই অবস্থায় পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক ইউসুফ আলী চৌধুরী সংবাদপত্র মারফৎ জানান যে ১৮ই এবং ১৯শে জুন বিকেল ৩টায় কার্জন হলে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগ কাউন্সিলের একটি সভা অনুষ্ঠিত হবে। সেই সভায় আলোচ্য বিষয় হিসাবে উল্লিখিত হয়: ১. গত সভার কার্য বিবরণীর অনুমোদন, ২. সাধারণ সম্পাদকের রিপোর্ট, ৩. কাশ্মীরের বর্তমান অবস্থা, ৪. দেশের বর্তমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা, ৫. সংগঠন এবং ৬. বিবিধ। এ ছাড়া কোন সদস্য যদি কোন প্রস্তাব উত্থাপন করতে ইচ্ছুক হন তাহলে তাঁকে নিজের প্রস্তাব পরবর্তী ১৫ই জুনের পূর্বে ১৭৬ নং নবাবপুর রোডে কেন্দ্রীয় লীগ অফিসে পাঠিয়ে দেওয়ার জন্যে অনুরোধ জানানো হয়।[৪১]

লীগ কাউন্সিলের এই সভা অনুষ্ঠিত হওয়ার কয়েকদিন পূর্বে প্রাদেশিক সভাপতি আকরম খাঁন কাউন্সিল এবং ওয়ার্কিং কমিটিতে বিবেচনার জন্যে তাঁর পদত্যাগপত্র দাখিল করেন।[৪২] টাঙ্গাইল উপনির্বাচনে সরকারী লীগ প্রার্থীর শোচনীয় পরাজয়ের পর আকরম খাঁর সংবাদপত্র আজাদ যে সম্পাদকীয় প্রকাশ করেন তার মধ্যেই মুসলিম লীগের আভ্যন্তরীণ সংকটের কিছু পরিচয় পাওয়া যায়। প্রাদেশিক সভাপতির পদত্যাগ প্রতিষ্ঠানটির এই সংকটেরই যে অনিবার্য পরিণতি পরবর্তী কাউন্সিল অধিবেশনে তা ভালোভাবে প্রমাণিত হয়।

১৮ই জুন অর্থাৎ কাউন্সিলের অধিবেশন শুরু হওয়ার দিনে দৈনিক আজাদ ‘কাউন্সিলের অধিবেশন’ শীর্ষক এক সম্পাদকীয় প্রকাশ করেন। তাতে প্রথমদিকে সম্মেলনের সাফল্য কামনা এবং ‘লীগের দুষমনদের’ কার্যকলাপের উপর মন্তব্য প্রকাশের পর সভাপতির পদত্যাগ সম্পর্কে বলা হয়:

প্রসঙ্গতঃ এখানে জনাব মৌলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ সাহেবের পদত্যাগপত্রের কথাও আলোচিত হওয়ার যোগ্য মনে করি। সুদিনে দুর্দিনে লীগের জন্মদিন হইতে জনাব মৌলানা সাহেব লীগের সাথে যুক্ত আছেন, এবং কখনও সৈনিক হিসাবে এবং কখনও তার অগ্রভাবে দাঁড়াইয়া সংগ্রাম করিয়া আসিয়াছেন। সুতরাং তাঁর প্রাদেশিক লীগ সভাপতির পদত্যাগের অর্থ লীগের সাথে তাঁর বিযুক্তি নয় মোটেই। তাঁর সাহায্য সহানুভূতি এবং সেবা হইতে লীগ কখনও বঞ্চিত হইবে না, হইতেও পারে না। তিনি ধীরভাবে বিবেচনা করিয়া আজ পদত্যাগের যে সিদ্ধান্ত করিয়াছেন, তাতে লীগের অকল্যাণকর কিছুই তিনি কামনা করেন নাই। হয়ত লীগের অধিকতর কল্যাণের জন্যই তা তিনি করিয়াছেন। তিনি হয়তো মনে করেন সভাপতি হিসাবে লীগের সেবা করার চাইতে লীগের সাথে সাধারণভাবে সংশ্লিষ্ট থাকিয়া তিনি লীগের অধিকতর সেবা করিতে পারিবেন। কাজে কাজেই তাঁর এ সিদ্ধান্তকে আমরা অভিনন্দিতই করিতেছি।

আকরম খাঁর পদত্যাগপত্র এবং আজাদ-এর এই সম্পাদকীয় মন্তব্য সত্ত্বেও কাউন্সিলের অধিবেশন এবং তার পরবর্তী পর্যায়ের ঘটনাবলী থেকে শুধু এ কথাই বিশেষভাবে প্রমাণিত হয় যে আকরম খাঁ সত্য অর্থে প্রাদেশিক লীগ সভাপতির পদ পরিত্যাগ করতে মোটেই আগ্রহী ছিলেন না। কাউন্সিলের সভায় লীগের সাংগঠনিক বিষয় নিয়ে তুমুল বাকবিতণ্ডা ও গণ্ডগোলের সম্ভাবনা তিনি পূর্বেই অনুমান করেছিলেন এবং সেই সভায় সভাপতিত্ব করতে গিয়ে সাধারণ সদস্যদের মোকাবেলা করার সাহস তাঁর ছিলো না। এ কারণেই পদত্যাগপত্র দাখিল করে সেই দায়িত্ব এড়িয়ে গিয়ে পশ্চাৎদ্বার দিয়ে আবার সভাপতির পদে বহাল হওয়ার ষড়যন্ত্রের মধ্যেও তিনি কোন ত্রুটি রাখেননি।[৪৩] বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের ইতিহাসে তার এই পদত্যাগপত্র দাখিলের ব্যাপারটির কোন নোতুন কথা ছিলো না। অবস্থা বুঝে একাধিকবার তিনি সে কাজ করেছিলেন। এবং সংকট উত্তীর্ণ হওয়ার পর সভাপতির পদে পুনবহালও হয়েছিলেন।

আজাদ-এর পূর্বোক্ত সম্পাদকীয়টির বক্তব্য আকরম খাঁর পদত্যাগের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো না। মুসলিম লীগের আভ্যন্তরীণ অন্যান্য সংকট সম্পর্কে তাতে বলা হয়:

নূতন করিয়া পাকিস্তানে লীগ গঠিত হইতেছে। কিন্তু গড়িয়া উঠিতে না উঠিতেই লীগের ভিতর ভাঙ্গনও ধরিয়াছে। সীমান্ত পশ্চিম পাঞ্জাব এবং সিন্ধুর লীগেও নানারূপ বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়াছে, এবং বাহির হইতে দেখিলে পূর্ব পাকিস্তানকে যদিও খুব শান্ত এবং সংহত দেখা যায়, তথাপি এখানেও ভিতরে গোলমাল আছে। ফলে এখানে লীগ ও লীগের গভর্ণমেন্ট জনপ্রিয়তা হারাইতে বসিয়াছে। পরিস্থিতির এই ক্রমবর্ধমান অবনতিকে রোধ করিতে হইবে। একাধিক সাম্প্রতিক ঘটনায় ইহা প্রমাণিত হইয়া গিয়াছে যে, আজ আত্মশুদ্ধির নির্মম ব্যবস্থা অবলম্বন না করিলে দেশবাসীর অসন্তোষ ক্রমেই ব্যাপক হইতে ব্যাপকতর হইয়া উঠিবে এবং পরিণামে লীগ ও লীগের মন্ত্রীসভার ধ্বংসই হয়তো অনিবার্য হইয়া উঠিবে। আমরা অতীতে একাধিকবার এজন্য লীগ ও মন্ত্রীসভাকে লক্ষ্য করিয়া সতর্ক বাণী উচ্চারণ করিয়াছি। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের সাথে স্বীকার করিতে হইবে যে, আমাদের সতর্কবাণীর বাঞ্ছিত প্রতিক্রিয়া হয় নাই। যাহোক অতীতের ব্যাপার ঘাঁটাইয়া কোন লাভ নাই। এবারকার লীগ কাউন্সিল যদি আত্মশুদ্ধির ব্যবস্থা করিতে পারেন, তবেই আত্মরক্ষার পথ আবিষ্কার হবে।

প্রাদেশিক মুসলিম লীগ কাউন্সিলের সভায় যোগদানের উদ্দেশ্যে ১৮ই জুন ঢাকা উপস্থিত হলে এপিপি’র প্রতিনিধির সাথে এক সাক্ষাৎকার[৪৪] প্রসঙ্গে পাকিস্তান মুসলিম লীগের সভাপতি চৌধুরী খালিকুজ্জামান বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর মন্তব্য ব্যক্ত করেন। মুসলিম লীগের ভূমিকা সম্পর্কে তিনি বলেন যে অতীতে তাঁদেরকে বহু বাধা বিঘ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে কিন্তু প্রত্যেক ক্ষেত্রেই সে বাধা তাঁরা উত্তীর্ণ হয়েছেন। ভবিষ্যতেও নানা বাধা বিপত্তিকে সেইভাবেই অতিক্রম করতে হবে। যে রাজনৈতিক বিচক্ষণতার বলে মুসলমানরা পাকিস্তান অর্জন করেছে তার দ্বারাই তারা ভবিষ্যতে রাষ্ট্রের ঐক্য রক্ষা করবে।

টাঙ্গাইলের উপনির্বাচন সম্পর্কে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি আসল ব্যাপার সম্পূর্ণভাবে এড়িয়ে গিয়ে বলেন যে, মুসলিম লীগ জনগণের আস্থা হারিয়েছে একথা ঠিক নয়। কেন্দ্রে ও প্রদেশে মুসলিম লীগ সরকারের একদলীয় শাসন অব্যাহত আছে এবং সরকার সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সর্বত্র জনসাধারণের প্রতিনিধিত্ব করছেন। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন যে মুসলমানদের ধর্মীয় এবং অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য একই এবং এ দুটোকে পৃথক করা চলে না। এ প্রসঙ্গে মুসলিম লীগের অর্থনৈতিক পরিকল্পনার একটি উদাহরণ দিতে গিয়ে তিনি বলেন যে, জমিদার ও রায়তের মধ্যেকার সম্পর্ক নির্ধারণের জন্যে ইতিপূর্বে মুসলিম লীগ কর্তৃক একটি কৃষি কমিটি নিযুক্ত হয়েছে!

আলোচনার উপসংহারে খালিকুজ্জামান বলেন যে, মুসলিম লীগ ও শাসনযন্ত্রের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করার জন্যে এবং শাসনতন্ত্র প্রণয়নের ক্ষেত্রে সাধারণ নীতি নির্ধারণের কাজে মুসলিম লীগের উপযুক্ত ভূমিকা গ্রহণের উদ্দেশ্যে শাসনযন্ত্রের রাজনৈতিক বিভাগসমূহের সাথে লীগের উপদেষ্টা কমিটিসমূহের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রক্ষার ব্যবস্থা হওয়া বাঞ্ছনীয়।

১৮ই জুন, মঙ্গলবার, বিকেল ৩টার সময় কার্জন হলে এক উত্তেজনাময় পরিবেশের মধ্যে প্রাদেশিক মুসলিম লীগের কাউন্সিল অধিবেশন শুরু হয়। সেই অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন পূর্ব পাকিস্তান লীগের সহ-সভাপতি মৌলানা আবদুল্লা হিল বাকী ৪৫ চারশোর বেশী কাউন্সিল সদস্যের মধ্যে প্রায় তিনশো জন সভায় যোগদান করেন।[৪৬] চৌধুরী খালিকুজ্জামানও সেদিন উপস্থিত ছিলেন।[৪৭]

সভাস্থলে সাংবাদিকদেরকে প্রবেশ করতে না দেওয়ার জন্যে প্রথম দিকেই গণ্ডগোল শুরু হয়। সাংবাদিকদের প্রতি এই মনোভাবের কারণ সম্পর্কে সাধারণ সদস্যেরা কৈফিয়ৎ দাবী করলে সভাপতি তাঁদের জানান যে প্রাদেশিক লীগ ওয়ার্কিং কমিটির এক সাম্প্রতিক প্রস্তাবানুযায়ী এ জাতীয় সভায় সাংবাদিকদেরকে প্রবেশ না করতে দেওয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে।[৪৮] সদস্যেরা কিন্তু এই জবাবে সন্তুষ্ট না হয়ে মঞ্চে উপস্থিত নেতৃবৃন্দ এবং অন্যান্যদের সাথে এক বাদানুবাদে প্রবৃত্ত হন। এইভাবে কয়েক ঘণ্টা আলোচনার পর সাংবাদিকদেরকে সভাগৃহে প্রবেশ করতে দেওয়ার প্রস্তাবটি ভোটে দেওয়া হলে বিপুল ভোটাধিক্যে তা গৃহীত হয়।[৪৯] প্রস্তাবটির বিপক্ষে ভোট পড়ে মাত্র ১২টি।[৫০]

এর পর সাংবাদিকেরা সভাগৃহের ভেতরে প্রবেশ করেন। কিন্তু আসরের নামাজের সময় হওয়ায় সভা কিছুক্ষণের জন্যে মুলতুবী থাকে। নামাজের পর আবার কাজ আরম্ভ হলে প্রথমে যুগ্ম-সম্পাদক শাহ মহম্মদ আজিজুর রহমান বিগত অধিবেশনের কার্যবিবরণী পাঠ করেন এবং তা যথারীতি গৃহীত হয়।[৫১] এর পর প্রাদেশিক লীগ সম্পাদক ইউসুফ আলী চৌধুরী তাঁর লিখিত রিপোর্ট পেশ করেন।[৫২]

রিপোর্টটিতে তিনি বলেন যে লীগ ওয়ার্কিং কমিটি পাকিস্তান থেকে জমিদারী প্রথা উচ্ছেদ করার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে ব্যবস্থাপক সভার পরবর্তী অধিবেশনেই জমিদারী প্রথা বিলোপ করার জন্যে প্রাদেশিক সরকারকে অনুরোধ জানিয়েছেন।

টাঙ্গাইল উপ-নির্বাচনে মুসলিম লীগের শোচনীয় পরাজয়ের সত্যিকার গুরুত্বকে ঢাকা দেওয়ার উদ্দেশ্যে তিনি বলেন যে দেশ বিভাগের পর পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদে ৪টি এবং কেন্দ্রীয় গণ-পরিষদের ২টি আসনে উপ-নির্বাচন হয়েছে। তার মধ্যে ৪টিতে লীগ প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। এ ছাড়া গণ-পরিষদের নির্বাচনে লীগ প্রার্থী শহীদ সুহরাওয়ার্দীকে পরাজিত করে জয়লাভ করেছেন বলেও তিনি কাউন্সিলকে জানান। এর পর টাঙ্গাইলের পরাজয় প্রসঙ্গে কৈফিয়ৎ স্বরূপ তিনি বলেন যে তাঁদের নিজেদের কিছু গাফিলতি, জয়লাভের নিশ্চয়তা এবং প্রতিপক্ষের সুযোগ সুবিধার প্রাচুর্যই সেই বিপর্যয়ের কারণ! লীগ সম্পাদকের রিপোর্টে উপনির্বাচনটি সম্পর্কে উপরোক্ত মন্তব্য যে সম্পূর্ণ ভ্রান্ত ও ভিত্তিহীন সেকথা বলাই বাহুল্য।

ইউসুফ আলী চৌধুরী তাঁর রিপোর্টে এর পর বলেন যে পাকিস্তানকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে হলে ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগতভাবে মুসলিম লীগের পশ্চাতে সকল শক্তি নিয়োগ করে ইসলামী ভ্রাতৃত্ব, সাম্য ও ন্যায়ের ভিত্তিতে মুসলমানদের মধ্যে একতা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠান পর একতা হ্রাস পেয়েছে বলে তিনি দুঃখ প্রকাশ করেন। তিনি উপস্থিত কাউন্সিলারদেরকে উদ্দেশ্য করে বলেন যে মুসলিম লীগই মুসলমানদের একমাত্র রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান এবং বিশ্বাস, ঐক্য ও শৃঙ্খলা হচ্ছে তাঁদের লক্ষ্য।

সাধারণভাবে এসব কথা বলার পর লীগ সম্পাদক কতকগুলি অসুবিধার ব্যাপারে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেন এবং তার মধ্যেই মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠান ও সরকারের দ্বন্দ্ব ও আভ্যন্তরীণ সংকটের পরিচয় উদ্ঘাটিত হয়।

সাংগঠনিক অক্ষমতার বিষয় উল্লেখ করতে গিয়ে ইউসুফ আলী চৌধুরী বলেন যে প্রাদেশিক লীগ সম্পাদক হিসাবে নিজের কর্তব্য তিনি সন্তোষজনকভাবে সম্পাদন করেছেন, এ দাবী করার ক্ষমতা তাঁর নেই। প্রতি পদক্ষেপে তাঁকে নানা অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়েছে বলেও তিনি জানান। সরকারী সহায়তা ছাড়া কোন বাড়ীঘর পাওয়া সম্ভব নয় এবং সেই সহযোগিতার অভাবে তাঁর পক্ষে প্রাদেশিক মুসলিম লীগের অফিসঘর স্থাপন পর্যন্ত সম্ভব হয়নি। এছাড়া লীগের তহবিল একেবারে শূন্য বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

এর পর সর্বশেষে তিনি সরাসরিভাবে মুসলিম লীগ ও সরকারের মধ্যে সহযোগিতার অভাব প্রসঙ্গে দুঃখ প্রকাশ করে বলেন যে, প্রতিষ্ঠান ও সরকারের মধ্যে সহযোগিতার অভাব সত্ত্বেও একথা অস্বীকার করা চলে না যে সরকার মুসলিম লীগের সৃষ্টি এবং তাকে জনপ্রিয় রাখার দায়িত্ব সরকারকে অবশ্যই পালন করতে হবে।

জনগণ থেকে মুসলিম লীগ ১৯৪৯ সালেই কতখানি বিচ্ছিন্ন প্রাদেশিক লীগ সম্পাদক ইউসুফ আলী চৌধুরী প্রকৃতপক্ষে তাঁর উপরোক্ত রিপোর্টে তারই একটি সঠিক ও সুস্পষ্ট হিসাব দাখিল করেন এবং এই বিচ্ছিন্নতার চিত্র কাউন্সিল অধিবেশনের পরবর্তী পর্যায়ে অধিকতর স্পষ্টভাবে উদ্‌ঘটিত হয়।

প্রাদেশিক সম্পাদক তাঁর রিপোর্ট পেশ করার পর বহু সদস্য কর্তৃপক্ষের কাছে বিভিন্ন প্রশ্ন উত্থাপন করে সেগুলির উত্তর দাবী করেন। সেই সব প্রশ্নের মধ্যে প্রাদেশিক সভাপতি আকরম খাঁর পদত্যাগের কারণ, প্রাদেশিক লীগের গঠনতন্ত্র রচিত না হওয়ার কারণ, টাঙ্গাইল উপনির্বাচনে মুসলিম লীগের সর্বশক্তি নিয়োজিত না হওয়ার কারণ, মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারী বোর্ড গঠিত না হওয়ার কারণ, পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতে ড্রাম চালান দেওয়া* সম্বন্ধে ট্রাইবুনাল নিযুক্ত না হওয়ার কারণ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।[৫৩] এ ছাড়া আরও কয়েকটি উল্লেখযোগ্য প্রশ্ন হলো ভালো কাজ করলে কর্মীদেরকে কমিউনিস্ট আখ্যা দেওয়া হয় কেন? লীগ এমএলএ-রা দুর্নীতির আশ্রয় নেয় কেন? ইস্পাত ড্রাম নিয়ে জনৈক মন্ত্রী যে দুর্নীতির আশ্রয় নিয়েছেন তার তদন্ত হয় না কেন? টাঙ্গাইলের অযৌক্তিক নমিনেশন দেওয়ার জন্যে দায়ী কে? জেলায় জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বা অন্যান্য সরকারী কর্মচারীরা লীগ সদস্যদের অপমান করে কেন? বিনা খেসারতে জমিদারী প্রথা রহিত হয় না কেন?[৫৪]

[* ড্রাম চালান দেওয়ার ব্যাপারে তৎকালীন অর্থ দফতরের মন্ত্রী হামিদুল হক চৌধুরী জড়িত ছিলেন। সে সময়ে তাঁর বিরুদ্ধে সংবাদপত্রে অনেক লেখালেখি হয় এবং লীগ বিরোধীরা সেগুলি টাঙ্গাইল নির্বাচনের সময়েও প্রচারণার কাজে লাগান।]

সাধারণ সদস্যবৃন্দের উপরোক্ত প্রশ্নবাণে জর্জরিত হয়ে লীগ কর্তৃপক্ষ, বিশেষত অধিবেশনের সভাপতি মৌলানা বাকী প্রশ্নগুলির জবাবদানের ব্যাপারে সম্পূর্ণভাবে এড়িয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে এক ‘গণতান্ত্রিক’ উপায় উদ্ভাবন করেন। তিনি কোন সদস্যকে প্রশ্ন করতে বাধা দেওয়া তো দূরের কথা প্রত্যেককেই যথেচ্ছাভাবে প্রশ্ন করতে উৎসাহিত করায় প্রশ্ন করতে করতে মগরিবের নামাজের সময় উপস্থিত হয়।[৫৫] এর ফলে সদস্যেরা প্রশ্নের বোঝা খালি করা সত্ত্বেও কর্তৃপক্ষ সময়ের অভাবে সেদিন সেগুলির জবাব দান স্থগিত রেখে পরদিন সে বিষয়ে আলোচনা হবে বলে ঘোষণা করেন।[৫৬]

এর পর প্রত্যেক জেলা থেকে একজন করে প্রতিনিধি নিয়ে সর্বসম্মতিক্রমে একটি বিষয় নির্বাচনী কমিটি গঠিত হয়। জেলা প্রতিনিধি ছাড়াও প্রাদেশিক লীগের কর্মকর্তারা পদাধিকার বলে সেই কমিটির সদস্য হন।[৫৭]

এই কমিটি গঠিত হওয়ার পর সভাপতি ঘোষণা করেন যে চৌধুরী খালিকুজ্জামান বিশ্বের মুসলিম দেশসমূহের বর্তমান পরিস্থিতি এবং বিশেষ করে পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্বন্ধে বক্তৃতা করবেন।[৫৮]

ইতিমধ্যে সভাগৃহে একথা প্রচারিত হয় যে মৌলানা আকরম খাঁকে আবার পশ্চাদ্বার দিয়ে প্রাদেশিক লীগের সভাপতির পদে বহাল করার জন্যে কর্তৃপক্ষ মহল তৎপর হয়েছেন এবং খালিকুজ্জামান সেই উদ্দেশ্যে সম্মেলনের উপর প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করবেন।[৫৯ এর ফলে কাউন্সিলারদের মধ্যে দারুণ উত্তেজনার সৃষ্টি হয় এবং উপরোক্ত ঘোষণার পর কয়েকজন সদস্য বক্তৃতা মঞ্চের উপর উঠে দাবী করেন যে চৌধুরী খালিকুজ্জামানের বক্তৃতার পূর্বেই প্রাদেশিক লীগ সভাপতি মৌলানা আকরম খাঁর পদত্যাগ সম্পর্কে আলোচনা করতে হবে। এই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে কয়েকজন সদস্য আপত্তি জ্ঞাপন করলে কার্জন হলের মধ্যে তুমুল হট্টগোলের সৃষ্টি হয়। কোন প্রকার শৃঙ্খলা রক্ষা না করে বহু সদস্য বক্তৃতামঞ্চে আরোহণ করে অস্বাভাবিকভাবে বক্তৃতা দেওয়ার চেষ্টা করেন। অবস্থা আয়ত্তে আনার উদ্দেশ্যে সভাপতি আবদুল্লাহিল বাকী কিছু বলার চেষ্টা করলে একজন সদস্য তাঁর সামনে থেকে মাইক সরিয়ে নেন। অপর একজন পূর্ববর্তী সদস্যের এই আচরণে আপত্তি জানালে গণ্ডগোল আরও বৃদ্ধি লাভ করে।[৬০]

গোলমালের মধ্যে কয়েকজন সদস্য মঞ্চের উপর থেকে নীচে পড়ে যান। কয়েকটি ফুলের টবও মেজের উপর পড়ে চূর্ণবিচূর্ণ হয়। এই পরিস্থিতিতে উত্তেজিত অবস্থায় সমবেত কাউন্সিলররা প্রায় সকলেই নিজেদের আসন থেকে উঠে দাঁড়ান এবং সভাগৃহে এক দারুণ বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়।[৬১] অবস্থা কোনক্রমেই আয়ত্তের মধ্যে আনতে সমর্থ না হয়ে সভাপতি পরদিন পর্যন্ত সভা মুলতুবী ঘোষণা করেন।[৬২]

কাউন্সিলের অধিবেশন সেদিনের মতো মুলতুবী ঘোষিত হওয়ার পর সন্ধ্যেবেলা শতাধিক সদস্য কার্জন হল প্রাঙ্গণে একটি প্রতিবাদ সভায় মিলিত হন।[৬৩] এঁদের মধ্যে বরিশাল জেলা লীগ সম্পাদক মহীউদ্দীন আহমদ, বরিশাল জেলা বোর্ডের সদস্য শাহজাহান চৌধুরী, মহম্মদ ওয়াসেক, মাহবুবুল হক প্রভৃতি লীগ নেতারাও ছিলেন।[৬৪] সমবেত সদস্যদের মধ্যে কেউ কেউ বলেন যে সভার জন্যে যে সমস্ত ভলান্টিয়ার জড়ো করা হয়েছিলো তাদের অনেকেই ছিলো গুণ্ডা প্রকৃতির এবং হলের ভিতর গণ্ডগোলের সময় তারাই বরিশালের মহীউদ্দীন আহমদ ও শাহজাহান চৌধুরীকে ঘুষি মেরে মাটিতে ফেলে দেয়। গুণ্ডাদের সাহায্যে সভা আয়ত্তে রাখার ক্ষেত্রে লীগ নেতা ও মন্ত্রীদের ভূমিকা সম্পর্কেও কেউ কেউ মন্তব্য করেন। সভা আরম্ভ হওয়ার পর বক্তারা আলোচনা প্রসঙ্গে সেখানে বলেন যে গুণ্ডা প্রকৃতির লোককে ভলান্টিয়ার করা এবং লীগ সদস্যদেরকে তাদের দ্বারা অপমানিত করা মুসলিম লীগের ইতিহাসে একটি কলংকজনক অধ্যায়।[৬৫]

অনেকে এই সব কথায় উত্তেজিত হয়ে কাউন্সিলের পরবর্তী অধিবেশন বর্জন করার প্রস্তাব আনেন।[৬৬] কিন্তু শেষ পর্যন্ত কতিপয় কাউন্সিল সদস্যের অন্যায় ও অভদ্র কার্যকলাপের তীব্র নিন্দা করে প্রস্তাব গ্রহণ[৬৭] এবং পরদিন সভায় যোগদান করে গণতান্ত্রিক ‘সংগ্রামের’ সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর প্রতিবাদ সভার কাজ শেষ হয়।[৬৮]

পরদিন রবিবার ১৯শে জুন বেলা ১০টায় অধিবেশন আরম্ভ হওয়ার কথা ছিলো।[৬৯] সেই অনুসারে নির্ধারিত সময়মতো প্রায় একশো জন কাউন্সিলর কার্জন হল প্রাঙ্গণে সমবেত হন এবং বহুক্ষণ ধরে অপেক্ষা করতে থাকেন। ইতিমধ্যে শোনা যায় যে কোন এক অজ্ঞাত কারণে কর্তৃপক্ষ সভার সময় বেলা ১.৩০ মিঃ পর্যন্ত পিছিয়ে দিয়েছেন।[৭০]

কিছু সংখ্যক কাউন্সিলার এবং সাংবাদিক সমবেত সদস্যদের সাথে আলাপ-আলোচনা প্রসঙ্গে বলেন যে পূর্বদিনের মতো সেদিনকার অধিবেশনে আর কোন গণ্ডগোল হবে না। নেতারা যা বলবেন এবার সেই মতো কাজ হবে। এর কারণ হিসাবে তাঁরা উল্লেখ করেন যে পূর্ব রাত্রিতে মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ, মন্ত্রীবর্গ, আকরম খাঁ ও নবাববাড়ীর নেতাদের মধ্যে গোপন বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। সমস্ত রাত্রি নেতাদের মোটর-ট্যাক্সী অলিতে-গলিতে গিয়ে

প্রত্যেক সদস্যকে ‘ঠাণ্ডা’ করেছে। তার উপর সেদিন বিকেলেই প্রাদেশিক সম্পাদক ইউসুফ আলী চৌধুরী কাউন্সিলারদেরকে এক চা চক্রে আপ্যায়িত করার ব্যবস্থা করেছেন। সুতরাং এত কিছুর পর লীগ নেতাদের বিরুদ্ধে আর কোন প্রতিবাদের সম্ভাবনা নেই একথা ধরে নেওয়াই স্বাভাবিক।[৭১]

এই সব আলোচনা চলাকালে সদস্যেরা সমালোচনা প্রসঙ্গে আরও অনেক কিছু বলেন। একজন মন্তব্য করেন যে, যারা বেশী উত্তেজিত অবস্থায় লাফালাফি করছে তাদের মধ্যে অনেকেই দুর্নীতিপরায়ণ। একজনের দিকে অঙ্গুলী নির্দেশ করে অন্য একজন বলেন যে মস্ত প্রগতিশীলের অভিনয় করলেও আসলে তিনি কালোবাজারীতে সিদ্ধহস্ত। অন্য একজন বলেন যারা গণ্ডগোল করছে আসলে তারা কিছুই নয়, কেরাসিন তেল বা টিনের পারমিটের আশ্বাস পেলে তারা সকলেই ‘ঠাণ্ডা’ হয়ে যাবে। তাদের মধ্যে শতকরা নব্বইজন জমিদার, জোতদার, ব্যবসায়ী। সুতরাং হাওয়া কোনদিকে বইবে তা সহজেই অনুমান করা চলে।[৭২] দ্বিতীয় দিন সভার কাজ কিন্তু বেলা ১-৩০ মিনিটেও শুরু করা সম্ভব হয়নি। সভাপতি মৌলানা বাকী সময়মতো উপস্থিত হলেও অন্যান্য নেতৃবৃন্দের অনুপস্থিতির কারণে সভার কাজ আরম্ভ হতে আরও দেড় ঘণ্টা বিলম্ব ঘটে। এই বিলম্বের ফলে সমবেত কাউন্সিলররা নানা বিরূপ মন্তব্য প্রকাশ করলেও সভার কাজ শান্তিপূর্ণভাবেই শুরু হয়।[৭৩] প্রথমেই সভাপতি আবদুল্লাহিল বাকী একটি ছোট বক্তৃতা দেন। এই প্রসঙ্গে তিনি কলকাতার দৈনিক ইত্তেহাদ-এ প্রকাশিত পূর্বদিনের অধিবেশনের রিপোর্টের প্রতি সকলের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যে তার একাংশ পাঠ করে শোনান এবং বলেন যে পত্রিকাটি বিশেষ উদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়ে কাউন্সিল অধিবেশন সম্পর্কে বিকৃত বিবরণ পরিবেশন করেছে।[৭৪] প্রেস প্রতিনিধিদের উপস্থিতি নিয়ে অধিবেশনে পূর্বদিনের বিতর্ক প্রসঙ্গে ইত্তেহাদ-এর উপরোক্ত বিবরণটিতে বলা হয় :

অধিকাংশ সদস্য প্রেস প্রতিনিধিকে বৈঠকে উপস্থিত হইতে দিবার দাবী জ্ঞাপন করেন। কতিপয় মন্ত্রী ও সভাপতি মওলানা আবদুল্লাহিল আল বাকী সাহেব আবেদন করেন যে এই বৈঠকে অনেক গোপনীয় বিষয় আলোচনা হইবে এবং দোষ-ত্রুটি পৃথিবীর বহু জনগণের সম্মুখে প্রকাশিত হইয়া পড়িবে ইহা আপনাদের বুঝা উচিত।[৭৫]

উপরোক্ত বিবরণটি পাঠ করার পর তা সত্য কিনা সেকথা তিনি কাউন্সিলরদেরকে জিজ্ঞাসা করেন। উত্তরে তাঁরা সকলে বলেন যে বিবরণটি সম্পূর্ণ মিথ্যা, কোন মন্ত্রী বা সভাপতি কেউই তাঁদের কাছে উপরোক্ত মর্মে আবেদন করেননি। আবদুল্লাহিল বাকী এর পর বলেন যে ইত্তেহাদ-এর বিবরণের অপর অংশে বলা হয়েছে যে সদস্যেরা মঞ্চ আক্রমণ করেন এবং তাঁদের দ্বারা চেয়ার টেবিল চূর্ণীকৃত হয়। কাউন্সিল সদস্যেরা সেই বিবরণকেও মিথ্যা বলে সভাপতির সাথে একমত হন।[৭৬]

উল্লিখিত বিবরণসমূহ অল্পকিছু পরিবর্তিত অবস্থায় দৈনিক আজাদ, সাপ্তাহিক নওবেলাল এবং সাপ্তাহিক সৈনিক-এ প্রকাশিত হয়। কাজেই ইত্তেহাদ-এর বিবরণ ‘সম্পূর্ণ’ মিথ্যা মনে করার কোন কারণ নেই। এখানে উল্লেখযোগ্য হলো দ্বিতীয় দিনের অধিবেশনে কাউন্সিলরদের নমনীয় মনোভাব। সাংবাদিকদের প্রবেশাধিকার এবং আকরম খাঁর পদত্যাগপত্র বিবেচনার প্রশ্ন নিয়ে পূর্বদিন যাঁরা তুমুল হট্টগোল সৃষ্টি করে পরিশেষে তাকে মারামারিতে পরিণত করেছিলেন তাঁরাই সেই ঘটনাসমূহের বিবরণকে মাত্র পরদিনই সম্পূর্ণ মিথ্যা ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে স্বীকার করলেন এ ব্যাপার যতই আশ্চর্যজনক হোক অকারণঘটিত নয়। তা হলো পূর্ব রাত্রিতে লীগ কর্তৃপক্ষ, মন্ত্রীবর্গ ও লীগ সভাপতির ‘সাংগঠনিক’ তৎপরতারই অবশ্যম্ভাবী পরিণতি!

আবদুল্লাহিল বাকী তাঁর বক্তৃতা শেষ করে পাকিস্তান মুসলিম লীগ সভাপতি চৌধুরী খালিকুজ্জামানকে ভাষণ দেওয়ার জন্যে আহ্বান করেন। কিন্তু তার পূর্বে তিনি ঘোষণা করেন যে খালিকুজ্জামানের বক্তৃতার সময় সাংবাদিকদেরকে সভাগৃহ পরিত্যাগ করতে হবে। তিনি বলেন যে পাকিস্তান লীগ সভাপতি এবং কাউন্সিলরদের ইচ্ছানুসারেই সেই সিদ্ধান্ত করা হয়েছে। পূর্বদিন যে কাউন্সিলাররা সাংবাদিকদেরকে সভাগৃহে উপস্থিত রাখার জন্যে প্রায় চার ঘণ্টা ধরে দারুণ বাকবিতণ্ডা ও বিতর্ক চালিয়েছিলেন পরদিন তাঁরা প্রাদেশিক লীগ সভাপতির এই ঘোষণার কোন প্রতিবাদ করা তো দূরে থাকুক শান্তভাবে তার প্রতি নিজেদের সমর্থনই জ্ঞাপন করেছিলেন।[৭৭]

কাউন্সিলারদের পক্ষ থেকে কোন প্রতিবাদ না হওয়ায় আবদুল্লাহিল বাকী সাংবাদিকদেরকে সভাগৃহ ত্যাগ করতে নির্দেশ দেন এবং তাঁরা সেই নির্দেশ অনুসারে সভাগৃহ পরিত্যাগ করেন। এর পর তাঁরা অধিবেশনের সভাপতির কাছে প্রেরিত এক স্মারকলিপিতে তাঁদের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান। তাতে তাঁরা বলেন যে চৌধুরী খালিকুজ্জামানের বক্তৃতার সময় সাংবাদিকদেরকে উপস্থিত থাকতে দেওয়া হবে না একথা পূর্বাহ্নে তাঁদেরকে জানানো উচিত ছিলো। প্রথমে সাংবাদিকদেরকে উপস্থিত থাকার জন্যে অনুমতিপত্র প্রদান করে পরে আবার তাদেরকে সভাকক্ষ ত্যাগ করার নির্দেশ দেওয়া মোটেই সমীচীন হয়নি। লীগ কর্তৃপক্ষের এই আচরণে সাংবাদিকগণ দুঃখ প্রকাশ করেন

চৌধুরী খালিকুজ্জামান তাঁর বক্তৃতায় কাশ্মীর, আফগানিস্তান এবং অন্যান্য মুসলিম রাষ্ট্রসমূহের অবস্থা সম্পর্কে বিশেষভাবে আলোচনা করেন। তিনি বলেন যে, মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম রাষ্ট্রসমূহ বৃটিশ ও আমেরিকার তল্পিবাহকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। এই সব রাষ্ট্রের জনগণ মুষ্টিমেয় লোকের শোষণের কবলে পড়ে স্বাধীনতার আস্বাদ থেকে বঞ্চিত রয়েছে। তিনি এ প্রসঙ্গে আরও বলেন যে মধ্যপ্রাচ্যের জনগণকে শোষণকারী ‘বে’ ও ‘পাশা’দের কবল থেকে মুক্ত করার দায়িত্ব পাকিস্তানী জনসাধারণকেই গ্রহণ করতে হবে। এই ভাষণে লীগ সভাপতির বক্তব্য প্রায় সম্পূর্ণভাবে মধ্যপ্রাচ্যের ‘জনগণের শোষণ’ এবং তাদেরকে ‘মুক্ত’ করার বিবরণ ও আবেদনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে।[৭৯] দেশীয় কোন সমস্যা সম্পর্কে কোন বক্তব্যই তিনি লীগ কাউন্সিলরদের সামনে পেশ করার প্রয়োজন বোধ করেননি!

খালিকুজ্জামানের এই ভাষণের উপর সাপ্তাহিক নওবেলাল ‘চৌধুরী সাহেবের ভাষণ’ নামে একটি দীর্ঘ সম্পাদকীয়৮০ প্রকাশ করেন। সেই সম্পাদকীয়টির উপসংহারে বলা হয়:

চৌধুরী সাহেব মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম রাষ্ট্রগুলির অবস্থা সম্পর্কে সচেতন হইয়া অপরকেও সেই সম্বন্ধে সচেতন করাইবার যে সাধু প্রয়াস পাইয়াছেন সেই জন্য আমরা তাঁহাকে জানাই মোবারকবাদ!

জনাব চৌধুরী সাহেবের ভাষণের ‘স্বেচ্ছাতন্ত্রের অবসান’, ‘নির্যাতিত মানবতার মুক্তি’, ‘স্বাধীন, সুখী, গণতন্ত্রী সরকার গঠনের আহ্বান’ পাকিস্তানের জনসাধারণের মনে যতখানি সাড়া জাগইবার কথা ততখানি আলোড়ন আনিতে পারে নাই – আনিতে পারে না। অতি ক্ষোভের সহিত এই কথা না বলিয়াও আমরা পারিতেছি না, চৌধুরী সাহেবের এই ভাষণে কোথায় যেন ফাঁক – কোথায় যেন – আন্তরিকতার অভাব রহিয়াছে। এক মধুর স্বপ্ন ভাঙিয়া গিয়াছে বাস্তবের রূঢ়তায়। এই স্বপ্নের আবেশ হাজার চেষ্টা সত্ত্বেও আর আসিবে না – তাই যেন চৌধুরী সাহেব আর এক স্বপ্নের মধুরতায় জনসাধারণকে টানিয়া লইতে প্রয়াস পাইয়াছেন। লীগ কাউন্সিলের তিন তিনটি দিন অধিবেশনের পরেও জনসাধারণের জীবন ধারণের সমস্যার সমাধানের ঘোর ব্যর্থতা আমাদের চিন্তাধারাকে এই গতিপথে পরিচালিত করিতেই বাধ্য করে। চৌধুরী সাহেব লীগ কাউন্সিলের অধিবেশনের ব্যর্থতা সম্বন্ধে নিশ্চিত হইয়া প্রতিনিধিদের মনকে অন্যপথে পরিচালনা করিবার উদ্দেশ্যেই সুচতুরভাবে যেন এই প্রসঙ্গে অবতারণা করিয়া ভগ্নতরীকে কোনরূপে তীরে ভিড়াইয়া রাখিবার চেষ্টা করিয়াছেন — লীগ কাউন্সিলের অধিবেশনের প্রহসনের উপর কোমল, মধুর যবনিকা টানিবার চেষ্টা করিয়াছেন। জীবনযাত্রার প্রতিটি ক্ষেত্রে যে বিভিন্ন সমস্যার চাপে জনসাধারণের নাভিশ্বাস উপস্থিত হইয়াছে তাহাদের একটির মাত্র সমাধান করিলেও বা সমাধানের ইঙ্গিত দিলেও চৌধুরী সাহেবের ভাষণ পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে করিত উদ্বেলিত – যে নির্যাতিত মুসলিম জনসাধারণের জন্য চৌধুরী সাহেবের আহ্বান তাহারা একান্ত আগ্রহে চাহিয়া রহিত পাকিস্তানের প্রতি। চৌধুরী সাহেবের ভাষণ গণতন্ত্রী মনকে উদ্বুদ্ধ ও আনন্দিত করিলেও সে আনন্দ নিঃসংশয় নহে, সংশয়ে সে আনন্দ ম্লান। এখানেই চৌধুরী সাহেবের ভাষণের ব্যর্থতা।

খালিকুজ্জামানের বক্তৃতার পর তুমুল বাকবিতণ্ডার মধ্যে আবদুল মোমেন খান কর্তৃক উত্থাপিত সরবরাহ বিভাগ সম্বন্ধীয় একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। এই প্রস্তাবে সরবরাহ বিভাগের তিনটি শাখা – সংগ্রহ, চলাচল ও বণ্টন, উঠিয়ে দিয়ে সেগুলিকে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কর্তৃত্বাধীনে নিয়ে আসা এবং সরবরাহ বিভাগ যথাশীঘ্র তুলে দেওয়ার জন্যে সুপারিশ করা হয়। প্রস্তাবটির সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী নূরুল আমীন এবং অর্থমন্ত্রী হামিদুল হক চৌধুরী বক্তৃতা দেন। হামিদুল হকের বক্তৃতার সময় কাউন্সিলারদের মধ্যে অনেকে ঘন ঘন বাধা সৃষ্টি করেন। প্রাক্তনমন্ত্রী শামসুদ্দীন আহমদ একটি সংশোধনী প্রস্তাব পেশ করার পর কাউন্সিলারদের ভোটে তা বাতিল হয়ে যায়। সেদিনের অধিবেশন মধ্যরাত্রিতে শেষ হয়।[৮-১ শেষ পর্যন্ত আকরম খাঁর পদত্যাগপত্র কাউন্সিল অধিবেশনে আলোচিত হয়নি। প্রাদেশিক লীগ ওয়ার্কিং কমিটি কেন্দ্রীয় লীগ সভাপতি খালিকুজ্জামানের উপর সে বিষয়ে সিদ্ধান্তের দায়িত্ব অর্পণ করেন। সেই অনুসারে খালিকুজ্জামান ১৯শে জুনের অধিবেশনে কাউন্সিলারদেরকে জানান যে, যেসব কারণে আকরম খাঁ পদত্যাগ করেছেন সে সম্পর্কে উপযুক্ত অনুসন্ধান করে তিনি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন।[৮২] কাউন্সিল অধিবেশনের পর খালিকুজ্জামান তাঁর ‘অনুসন্ধান’ কার্য শেষ করেন এবং তিনি ঢাকা পরিত্যাগের পূর্বেই আকরম খাঁর পদত্যাগপত্র যথারীতি প্রত্যাহার করা হয়।[৮৩]

প্রাদেশিক লীগ কাউন্সিলের অধিবেশন তৃতীয় দিন, ২০শে জুন, বেলা দশটায় ডিস্ট্রাক্ট বোর্ড হলে আরম্ভ হয়।[৮৪] এই সভায় বহুসংখ্যক প্রস্তাব গৃহীত হয়। সেগুলির মধ্যে রমজান মাসে সর্বপ্রকার নাচগান, সিনেমা ও মদ্যপান নিষিদ্ধ করা, নোতুন শাসনতন্ত্র রচনা করা, অতি শীঘ্র পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠান করা, পরিষদে উপস্থাপিত জমিদারী ক্রয় বিল আইনে পরিণত করা দাবী জ্ঞাপক প্রস্তাবসমূহ উল্লেখযোগ্য।[৮৫] শেষোক্ত প্রস্তাবের এক সংশোধনী প্রস্তাবে বিনা খেসারতে আগামী ১৯৫০ সালের মধ্যে জমিদারী প্রথা উচ্ছেদের সুপারিশ করা হয় কিন্তু সেই সংশোধনী প্রস্তাবটি ৬০/৩৯ ভোটে কাউন্সিলাররা বাতিল করে দেন।[৮৬] পাকিস্তানের সর্বপ্রধান রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান মুসলিম লীগের প্রাদেশিক কাউন্সিলের তিনদিনের এই অধিবেশনের পর সদস্যদের অনেকেরই মন হতাশায় আচ্ছন্ন হয় এবং তাঁরা খোলাখুলিভাবে অন্তরের এই ভাব পরস্পরের কাছে ব্যক্ত করেন।[৮৭]

৫. রোজ গার্ডেনের মুসলিম লীগ কর্মী সম্মেলন

মওলানা ভাসানী ধুবড়ী জেল থেকে মুক্তি লাভের পর ঢাকা এসে আলী আমজাদ খানের বাসায় কয়েকদিন অবস্থান করেন। সেই সময় তিনি ঢাকার রাজনৈতিক কর্মীদের মধ্যে অনেককেই তাদের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করতে থাকেন। আলোচনা প্রসঙ্গে শওকত আলী প্রমুখ ১৫০ নম্বর মোগলাটুলরি কয়েকজন কর্মী তাঁকে একটি কর্মী সম্মেলন আহ্বানের এবং তার জন্যে উপযুক্ত প্রস্তুতি গ্রহণের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেন।[৮৮]

আলী আমজাদ খানের বাড়ীতে এই আলোচনার পর ১৫০ নম্বর মোগলটুলীতে একটি কর্মী বৈঠক আহ্বান করা হয়। তাতে এমন কয়েকজন এসে উপস্থিত হন যাদেরকে বৈঠকে যোগদানের জন্যে কোন আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। এঁদের মধ্যে কুষ্টিয়ার শামসুদ্দীন আহমদ এবং চেম্বার অব কমার্সের সাখাওয়াৎ হোসেনের নাম উল্লেখযোগ্য।[৮৯] সাখাওয়াৎ হোসেন টাঙ্গাইল নির্বাচনের জন্যে ইতিপূর্বেই কিছু অর্থ সাহায্যও করেছিলেন।

বৃহত্তর কর্মী সম্মেলনের প্রস্তুতি হিসাবে সেই বৈঠকে মওলানা ভাসানী আলী আমজাদ খানকে সভাপতি এবং ইয়ার মুহম্মদ খানকে সম্পাদক করে একটি অভ্যর্থনা কমিটি গঠন করেন। কিন্তু বৈঠকটিতে বহু অবাঞ্ছিত ব্যক্তির উপস্থিতিতে এমনিতেই কয়েকজন নেতৃস্থানীয় কর্মীর মধ্যে রীতিমতো বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। এঁদের মধ্যে শওকত আলী ছিলেন অন্যতম। তিনি বৈঠকের আলোচনা এবং অভ্যর্থনা কমিটির অবস্থা দেখে ভয়ানক বিরক্ত হয়ে উপরের তলায় চলে যান এবং সম্মেলনটির সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করার সিদ্ধান্ত নেন। এই মানসিক অবস্থায় তাঁর সাথে উপরের ঘরে খোন্দকার আবদুল হামিদের দেখা হয়। তিনি শওকত আলীকে বলেন যে এ ব্যাপারে রাগারাগি না করে স্থিরভাবে নীচে গিয়ে নিজের বক্তব্য স্পষ্টভাষায় এবং সোজাসুজি পেশ করা দরকার।[৯০]

খোন্দকার আবদুল হামিদের পরামর্শ মতো শওকত আলী এর পর নীচে গিয়ে উপস্থিত সকলকে এবং বিশেষ করে মওলানা ভাসানীকে বলেন যে অভ্যর্থনা কমিটি যেভাবে তৈরি হয়েছে তাতে অভ্যর্থনা হয়তো হবে কিন্তু সম্মেলন হবে না। প্রসঙ্গটিকে আবার এইভাবে উত্থাপন করার পর অনেকেই শওকত আলীর কথার তাৎপর্য উপলব্ধি করেন এবং শেষ পর্যন্ত মওলানা ভাসানীকে সভাপতি, ইয়ার মহম্মদ খানকে সম্পাদক এবং মুস্তাক আহমদকে অফিস সম্পাদক করে অন্যান্যদেরসহ একটি নোতুন কমিটি গঠিত হয়।[৯১]

সেই সময় ১৫০ নম্বর মোগলটুলীর কর্মীদের মধ্যে শওকত আলী ছিলেন অত্যন্ত উদ্যোগী। তিনি দবিরুল ইসলামের মামলা পরিচালনার জন্যে শহীদ সুহরাওয়ার্দীকে ট্রাংকযোগে ঢাকা আসার জন্যে অনুরোধ জানান এবং তাঁর অনুরোধ মতো শহীদ সুহরাওয়ার্দী জুন মাসে ঢাকা এসে ক্যাপ্টেন শাহজাহানের ‘নূরজাহান বিল্ডিংস্থ’ বাসায় এগারো দিন অবস্থান করেন। মামলা শেষ হওয়ার পর সুহরাওয়ার্দী কলকাতা ফেরৎ যাওয়ার ব্যবস্থা করতে বলায় শওকত আলী তাঁকে বলেন যে, তাড়াতাড়ি কলকাতা ফেরৎ না গিয়ে তাঁর ঢাকাতেই থাকা উচিত কারণ ঢাকাতে না থেকে শুধু যাওয়া আসা করলে তার দ্বারা কোন সমস্যার সমাধান হবে না। সুহরাওয়ার্দী এর উত্তরে শুধু তাঁদেরকে মুসলিম লীগ রাজনীতি বর্জন করে তার পরিবর্তে উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের আওয়ামী লীগের মতো আওয়ামী লীগ নামে একটি নোতুন প্রতিষ্ঠান গঠনের পরামর্শ দেন। সুহরাওয়ার্দীর এই পরামর্শ মতো শওকত আলীরা মওলানা ভাসানীর সাথে নোতুন রাজনৈতিক সংগঠনের ব্যাপারে আলাপ আলোচনা করেন।[৯২]

২৩শে এবং ২৪শে জুন, ১৯৪৯, মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে গঠিত অভ্যর্থনা সমিতির পক্ষ থেকে সারা পূর্ব-বাঙলা প্রদেশের মুসলিম লীগ কর্মীদের এক সম্মেলন আহ্বান করা হয়। অন্য কোন সুবিধাজনক জায়গা না পাওয়ায় শেষ পর্যন্ত কাজী বশীরের (হুমায়ুনের) আমন্ত্রণে তাঁর স্বামীবাগস্থ বাসভবন ‘রোজ গার্ডেনে’ সম্মেলনের স্থান নির্দিষ্ট হয়।[৯৩] সম্মেলনের প্রস্তুতি চলাকালে মওলানা ভাসানী ১৫০, মোগলটুলীতে অবস্থান করেছিলেন। ২০শে জুনের দিকে মুস্তাক আহমদ এবং অন্যান্যেরা খবর পান যে সম্মেলনের পূর্বে সরকার ভাসানীকে গ্রেফতারের পরিকল্পনা করছেন। এই সংবাদ পাওয়ার পরই মোস্তাক আহমদ কাজী বশীরের সাথে পরামর্শ করে শওকত আলীর সহায়তায় সেই রাত্রেই মওলানা ভাসানীর গায়ে একটা কম্বল জড়িয়ে ঘোড়ার গাড়ীতে করে তাঁকে রোজ গার্ডেনে পৌছে দেন এবং সম্মেলন শেষ না হওয়া পর্যন্ত তিনি সেখানেই থাকেন।[৯৪]

২৩শে জুন বিকেল তিনটে থেকে রোজ গার্ডেনের দোতলার হল ঘরে সম্মেলন শুরু হয়। তাতে প্রায় আড়াইশো থেকে তিনশো কর্মী উপস্থিত হন।[৯৫] সম্মেলন সেদিন সন্ধ্যা রাত্রি পর্যন্ত চলে।[৯৬]

প্রথম অধিবেশনে যাঁরা উপস্থিত ছিলেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন :

শামসুল হক, আবদুল জব্বার খদ্দর, খয়রাত হোসেন, আনোয়ারা খাতুন, আলী আহমদ. খান, খোন্দকার মুস্তাক আহমদ, শওকত আলী, ফজলুল কাদের চৌধুরী, শামসুদ্দীন আহমদ (কুষ্টিয়া), আতাউর রহমান খান, আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ, আলী আমজাদ খান, ইয়ার মহম্মদ খান। এ ছাড়া মৌলানা মহম্মদ আরিফ চৌধুরী, পূর্ব পাকিস্তান জমিয়তে ওলামায়ে ইসলামের সহ-সভাপতি মওলানা শামসুল হক, যুগ্ম-সম্পাদক মৌলানা এয়াকুব শরীফ এবং ঢাকার বিশিষ্ট ব্যবসায়ী প্রভিন্সিয়াল লাইব্রেরীর মালিক আবদুর রশিদের নামও উল্লেখযোগ্য। রেলওয়ে শ্রমিক প্রতিষ্ঠান, ছাত্র প্রতিষ্ঠান এবং অন্যান্য নানা প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরাও এই সম্মেলনে যোগদান করেন।[৯৭]

ফজলুল হকও সেদিন অল্প কিছুক্ষণের জন্যে সম্মেলনের প্রথমদিকে উপস্থিত থাকেন এবং একটি সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা দেন। তাতে তিনি জনগণের চরম দুর্ভোগ এবং ব্যক্তি স্বাধীনতার সংকটের উল্লেখ করেন। তিনি বলেন যে ক্ষুধিত জনগণকে সংঘবদ্ধ করার জন্যে যুবসমাজ এবং লীগ কর্মীদের কর্মক্ষেত্রে অবতীর্ণ হওয়া উচিত। পরিষদের যে সমস্ত সদস্য দলীয় প্রভাবের চাপে বিভিন্ন গণদাবীকে আইন সভায় উত্থাপন করতে অক্ষম জনমতের চাপ সৃষ্টি দ্বারা তাদেরকে নিজেদের দায়িত্ব পালনে বাধ্য করা উচিত বলেও তিনি অভিমত প্রকাশ করেন। সর্বশেষে জনগণের পক্ষে সংগ্রামের জন্যে নিজের প্রস্তুতির কথা ঘোষণা করে তিনি সম্মেলন কক্ষ পরিত্যাগ করেন।[৯৮]

সেদিনকার সভায় বক্তৃতা ছাড়াও শামসুল হক পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগ সম্মেলনে বিবেচনার জন্য ‘মূলদাবী’ নামে পুস্তিকা আকারে ছাপা বক্তব্যে কর্মসূচী বিষয়ক কতকগুলি প্রস্তাব উত্থাপন করেন। তাঁর এই প্রস্তাবসমূহই সম্মেলনের পর সামান্য পরিবর্তিত অবস্থায় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রথম খসড়া ম্যানিফেস্টো রূপে প্রকাশিত এবং প্রচারিত হয়।[৯৯]

সুদীর্ঘ আলোচনার পর পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ নামে নোতুন একটি সংগঠনের মধ্যে লীগকে গণ-প্রতিষ্ঠান হিসাবে পুনর্গঠন করার প্রস্তাব গৃহীত হয়। এ ছাড়া আরও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক মুসলিম নরনারীকে লীগের সভ্য হিসাবে গণ্য করা হবে। তার জন্যে তাঁদেরকে কোন চাঁদা দেওয়ার প্রয়োজন হবে না। প্রাপ্তবয়স্ক, মুসলমানেরা শুধু একটা ‘ক্রীড়ে’ স্বাক্ষর দিলেই তাঁরা নোতুন প্রতিষ্ঠানের সভ্যরূপে বিবেচিত হবেন।[১০০] বিভিন্ন জেলা থেকে আগত প্রতিনিধি স্থানীয় কর্মীদের এই সম্মেলনে অনেকগুলি সর্বসম্মত প্রস্তাব গৃহীত হয়। সেগুলির মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য হলো বিনা খেসারতে অবিলম্বে জমিদারী প্রথার উচ্ছেদ, প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে সাধারণ নির্বাচন, মন্ত্রীমণ্ডলীর বিবিধ কার্যকলাপ তদন্তের জন্যে বিচার বিভাগীয় ব্যবস্থা, কারারুদ্ধ ছাত্র নেতাদের মুক্তি, ছাত্রদের উপর থেকে শাস্তিমূলক আদেশ প্রত্যাহার, অবিলম্বে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা প্রবর্তন, বিক্রয়কর প্রত্যাহার। এ ছাড়া খাদ্য পরিস্থিতি সম্পর্কে একটি বিশেষ প্রস্তাবে দাবী করা হয় যে, খাদ্য সংকট দূর করার উদ্দেশ্যে অবিলম্বে সরকারী উদ্যোগে একটি সর্বদলীয় খাদ্য সম্মেলন আহ্বান, প্রাদেশিক, জেলা মহকুমা ও ইউনিয়ন খাদ্য পরামর্শদাতা কমিটি গঠন এবং অবিলম্বে খাদ্য অভিযান শুরু করা হোক। লেভী সম্পর্কে যে সব সরকারী অন্যায় ও অবিচার অনুষ্ঠিত হচ্ছিলো সেগুলির প্রতিকারের জন্যেও বিশেষভাবে দাবী জানানো হয়।[১০১]

২৩শে তারিখে অধিবেশনের শেষ পর্যায়ে মওলানা ভাসানী সাংগঠনিক কমিটি সম্পর্কে আলোচনা প্রসঙ্গে বলেন যে প্রত্যেক জেলা এবং প্রতিষ্ঠান থেকে একজন করে প্রতিনিধি কমিটিতে রাখা দরকার। তাঁর এই প্রস্তাবে কর্মীদের মধ্যে অনেকেই এই বলে আপত্তি করেন যে, সেভাবে কমিটি গঠিত হলে তা এতো বড় হবে যে তার মাধ্যমে কোন সাংগঠনিক কাজই সুষ্ঠুভাবে সম্ভব হবে না।[১০২]

এই সমস্ত আলোচনার পর সকলে মওলানা ভাসানীকে অনুরোধ করেন তিনি যেন নিজে কমিটির নাম স্থির করে আধ ঘণ্টার মধ্যে তাঁদেরকে সেই নামগুলি জানান। এইভাবে অনুরুদ্ধ হয়ে ভাসানী পরামর্শের জন্যে কয়েকজনকে সাথে নিয়ে একটি ঘরের মধ্যে ঢোকেন এবং কিছুক্ষণ পর বাইরে এসে প্রায় ৪০ জন নিয়ে গঠিত একটি কমিটি প্রস্তাব করেন। সেই কমিটিতে মওলানা ভাসানী সভাপতি, শামসুল হক সম্পাদক এবং শেখ মুজিবুর রহমান ও খোন্দকার মুস্তাক আহমদ যুগ্ম-সম্পাদক হিসাবে প্রস্তাবিত হন। ভাসানীর প্রস্তাবিত সেই কমিটি সর্বসম্মতিক্রমে অনুমোদিত হয়।[১০৩]

সম্মেলনের পরদিন সকালে ভাসানী শওকত আলীকে বলেন যে কমিটির মধ্যে তিনি, শামসুল হক, মুজিবুর রহমান, মুস্তাক আহমদ সকলেই ১৫০ মোগলটুলীর লোক একথা বলে অনেকেই তাঁদের সমালোচনা করছে। শওকত আলী তাঁকে এর জবাবে বলেন যে তাতে কোন ক্ষতি হবে না, তবে অসুবিধা হবে আজেবাজে লোক নিয়ে গঠিত ৪০ জনের বড়ো কমিটি নিয়ে। এর উত্তরে মওলানা ভাসানী আবার তাঁদেরকে বলেন যে বড়ো কমিটিতে কোন অসুবিধা হবে না। তিনি ঘন ঘন কমিটির বৈঠক ডাকবেন এবং তাতে পর পর তিনবার অনুপস্থিত থাকলেই যে কোন সদস্যকে বাদ দিয়ে দেওয়া হবে। কমিটির গঠন নিয়ে এর পূর্বে শওকত আলীরা শামসুল হকের সাথেও আলাপ করেন।[১০৪]

২৪শে তারিখ বিকেল ৫-৩০ মিঃ মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে আরমানীটোলা ময়দানে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সর্বপ্রথম জনসভা অনুষ্ঠিত হয় এবং তাতে প্রায় চার হাজার মানুষ উপস্থিত থাকেন। সভা আরম্ভ হওয়ার পূর্বে কালু মিঞা, আলাউদ্দীন, ইব্রাহীম প্রভৃতি মুসলিম লীগের লোকদের নেতৃত্বে একদল গুণ্ডা সভা ভেঙে দেওয়ার উদ্দেশ্যে সেখানে হাজির হয়ে কিছু চেয়ার টেবিল চুরমার করে কিছুক্ষণের মধ্যেই তাড়াতাড়ি উধাও হয়। কিন্তু এসব সত্ত্বেও সভার কাজ বিঘ্নিত না হয়ে সমবেত জনতার মধ্যে মুসলিম লীগ বিরোধী মনোভাবের তীব্রতা বৃদ্ধি পায়।[১০৫]

৬. শামসুল হকের প্রস্তাব এবং আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রথম ম্যানিফেস্টো

পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগ কর্মী সম্মেলনে বিবেচনার জন্যে শামসুল হক ‘মূলদাবী’ নামে একটি ছাপা পুস্তিকাতে লিপিবদ্ধ তাঁর বক্তব্য পাঠ করেন। পুস্তিকাটির মুখবন্ধের প্রারম্ভে তিনি বলেন:

ইং ১৯৪৯ সনের ২৩শে ও ২৪শে জুন তারিখে ঢাকায় অনুষ্ঠিত “পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগ কর্মী সম্মেলন” মনে করে যে, সব কালের সব যুগের, সব দেশের যুগ প্রবর্তক ঘটনাবলীর ন্যায় লাহোর প্রস্তাবও একটা নূতন ইতিহাসের সৃষ্টি করিয়াছে। বিরুদ্ধ পরিবেশে মানবের দেহ, মন ও মস্তিষ্কের উন্নতি ও পূর্ণ বিকাশ সম্ভব নয়। মানুষ পরিবেশের দাস একথা আধুনিক বৈজ্ঞানিকগণও স্বীকার করেন। বিরুদ্ধ পরিবেশে পূর্ণ ইসলামিক মনোভাব এবং সমাজ বিধান গড়িয়া তোলা সম্ভব নয়। ভারতের মুসলমানগণ বহু শতাব্দীর সঞ্চিত অভিজ্ঞতা হইতে এই মহা সত্য উপলব্ধি করিয়াই বিরুদ্ধ পরিবেশে বা দারুল হরবের পরিবর্তে ইসলামিক পরিবেশ বা দারুল ইসলাম কায়েম করার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হইয়াছিল। কিন্তু পাকিস্তান ইসলামিক রাষ্ট্র হইলেও শুধু মুসলমানের রাষ্ট্র বা শুধু মুসলমানের জন্য প্রতিষ্ঠিত করিবার এবং পাশ্চাত্য সভ্যতা ও শিক্ষা প্রভাবান্বিত ইসলাম-বিরোধী সাম্রাজ্যবাদী, ধনতান্ত্রিক ও আত্মকেন্দ্রিক পরিবেশ গড়িয়া তুলিবার ইচ্ছা তাহাদের ছিল না।[১০৬]

এই সম্মেলনের কিছুদিন পূর্বে ১৯৪৮ সালে শামসুল হক বর্ধমান গিয়ে আবুল হাশিমের বাড়ীতে কয়েক সপ্তাহ অবস্থান করেন এবং তাঁর Creed of Islam নামক পুস্তকের প্রথম খসড়ার শ্রুতিলিখনের পর তার একটি অনুলিপি তৈরী করে সেটি সাথে নিয়ে ঢাকা আসেন। সেই অনুলিপিকে ভিত্তি করে বৈপ্লবিক দৃষ্টিভঙ্গীতে ইসলাম’ নামে তিনি একটি পুস্তকও রচনা করে তা প্রকাশ করেন। এ ছাড়া সেই সময় আবুল হাশিম তাঁর অনুরোধে পূর্ব পাকিস্তানে একটি নোতুন পার্টির ম্যানিফেস্টোর খসড়াও তাঁকে প্রস্তুত করে দেন।[১০৭] শামসুল হকের লিখিত ‘মূলদাবীর’ মধ্যে আবুল হাশিমের তত্ত্বগত চিন্তার প্রভাব সহজেই লক্ষণীয়। উদাহরণস্বরূপ:

রব বা স্রষ্টা হিসাবেই সৃষ্টির বিশেষ করিয়া সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব মানুষের সাথে আল্লার সবচাইতে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। বস্তুতঃ রব বা স্রষ্টা, পালন বা পোষণকর্তা হিসাবে, বিশ্ব ও সৃষ্টিকে ধাপের পর ধাপ, স্তরের পর স্তর, পরিবর্তনের পর পরিবর্তনের ভিতর দিয়া কতকগুলি স্থায়ী ও সাধারণ ক্রমবিকাশ ও ক্রমোন্নতির নিয়মানুসারে এক অবস্থা হইতে অপর অবস্থার ভিতর দিয়া ধীরে ধীরে কিন্তু সুনিশ্চিতরূপে চরম সুখ, শান্তি ও পূর্ণতা প্রাপ্তির দিকে আগাইয়া নিবেন। ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গীতে আল্লাহ শুধু মুসলমানের নয় – জাতি, ধর্ম ও বর্ণ নির্বিশেষে সমগ্র মানবের। রবই আল্লার সত্যিকার পরিচয়। রব হিসাবে রবুবিয়াৎ বা বিশ্ব-পালনই তাঁর প্রথম ও প্রধান কাজ। সুতরাং দুনিয়ার উপর আল্লার খলিফা বা প্রতিভূ হিসাবে মানব এবং খেলাফৎ হিসাবে রাষ্ট্রের প্রথম এবং প্রধানকাজ ও কর্তব্য হইল আল্লার উপায় ও পদ্ধতি অনুসারে বিশ্বের পালন করা এবং জাতি, ধর্ম ও বর্ণ নির্বিশেষে মানুষের সামগ্রিক সুখ, শান্তি, উন্নতি, কল্যাণ ও পূর্ণ বিকাশের জন্য চেষ্টা, সাধনা ও সংগ্রাম করা।[১০৮]

মুসলিম লীগ সম্পর্কে শামসুল হক পুস্তিকাটিতে বলেন:

নিখিল ভারত মুসলিম লীগ কখনও দল বিশেষের প্রতিষ্ঠান ছিল না; ইহা ছিল ভারত উপমহাদেশের মুসলিম জনগণের জাতীয় প্ল্যাটফর্ম বা মঞ্চ। ইহার উদ্দেশ্য পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পাকিস্তানের মূল নীতিগুলিকে কার্যকরী করিয়া তুলিতে হইলে প্রয়োজন নতুন চিন্তাধারা, নতুন নেতৃত্ব এবং নতুন সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক নীতি ও কর্মসূচী এবং মুসলিম লীগকে মুসলিম জনগণের সত্যিকার জাতীয় প্ল্যাটফর্ম মঞ্চ হিসাবে গড়িয়া তোলার।… কিন্তু দুঃখের বিষয় বর্তমান পকেট লীগ নেতৃবৃন্দ উপরোক্ত কর্মপন্থা অনুসরণ না করিয়া তাঁহাদের নিজেদের কায়েমী স্বার্থ এবং প্রতিক্রিয়াশীল নেতৃত্ব বজায় রাখার জন্য লীগের মর্যাদা ও জনপ্রিয়তা ভাঙ্গাইয়া চলিয়াছেন। এই উদ্দেশ্যেই তাহারা মুসলিম লীগকে দলবিশেষের প্রতিষ্ঠান করিয়া ফেলিয়াছেন। শুধু তাহাই নয় মানবের প্রতি আশীর্বাদ স্বরপ ইসলামকেও ব্যক্তি, দল ও শ্রেণী বিশেষের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য অন্যায় এবং অসাধুভাবে কাজে লাগানো হইতেছে। কোনও পাকিস্তান প্রেমিক এমন কি মুসলিম লীগের ঝানু কর্মীগণ পর্যন্ত নীতি ও কর্মসূচী সম্পর্কে কোনরূপ প্রশ্ন উত্থাপন করিতে অথবা প্রস্তাব করিতে পারে না। কেহ যদি এইরূপ করিবার চেষ্টা করে তাহা হইলে তাহাদিগকে পাকিস্তানের শত্রু বলিয়া আখ্যাত করা হয়।[১০৯]

আলোচ্য মুসলিম লীগ কর্মী সম্মেলনে নোতুন দল গঠনের উদ্যোগ সত্ত্বেও সেই দলের নেতৃ বৃন্দ যে মূলত মুসলিম লীগের ‘আদর্শ’ ইত্যাদির প্রভাব বিন্দুমাত্র উত্তীর্ণ হতে সক্ষম হননি তার পরিচয় শামসুল হকের সাংগঠনিক বক্তব্যের মধ্যেও স্পষ্টভাবে পাওয়া যায়:

পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগ কর্মী সম্মেলন মনে করে যে মুসলিম লীগকে এইসব স্বার্থান্বেষী মুষ্টিমেয় লোকদের পকেট হইতে বাহির করিয়া সত্যিকার জনগণের মুসলিম লীগ হিসাবে গড়িয়া তুলিতে হইলে, মুসলিম লীগকে সত্যিকার শক্তিশালী মুসলিম লীগ বা মুসলিম জামাত বা মুসলিম জাতীয় প্ল্যাটফর্ম বা মঞ্চে পরিণত করিতে হইলে প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক মুসলিমকে ইহার সদস্য শ্রেণীভুক্ত করিতে হইবে, অন্যথ্যায় মুসলিম লীগকে পাশ্চাত্য সভ্যতা, গণতন্ত্র ও সাংগঠনিক নীতি প্রভাবান্বিত দলবিশেষের পার্টি বলিয়া ঘোষণা করিয়া অপরাপর সবাইকে সাধ্যমতো দল গঠন করিবার সুযোগ, সুবিধা ও অধিকার দিতে হইবে। মুসলিম লীগের ভিতর প্রত্যেক ব্যক্তি, দল ও উপদলের স্বাধীন মতামত আদর্শ, নীতি ও কর্মসূচী ব্যক্ত এবং তার পিছনে সংঘবদ্ধ হইবার অধিকার দিতে হইবে। তদুপরি ছাত্র, যুবক, মহিলা, চাষী, ক্ষেত মজুর, মজদুর প্রভৃতি শ্রেণী সংঘ গড়িয়া তুলিবার স্বাধীনতা থাকিবে।[১১০]

শামসুল হকের উপরোক্ত বক্তব্য থেকে মনে হয় মুসলিম লীগকে একটি পার্টি হিসাবে গঠনের পরিকল্পনা তাঁর চিন্তার মধ্যে তখন ছিলো না। তিনি মুসলিম লীগকে একটি ব্যাপক গণফ্রন্ট হিসাবে গঠন করার চিন্তাই করেছিলেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে তাঁর দ্বারা লিখিত এবং প্রচারিত খসড়া ম্যানিফেস্টোতে তিনি এই চিন্তা বর্জন করে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগকে একটি দল হিসাবে গঠন করার কথাই ঘোষণা করেন।

‘মূলনীতি’তে অবশ্য শামসুল হক বস্তুত পক্ষে একটি পার্টি ম্যানিফেস্টোর খসড়াই পেশ করেন। এই খসড়া ম্যানিফেস্টোর সাথে আবুল হাশিম কর্তৃক প্রচারিত বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের খসড়া ম্যানিফেস্টোর সাদৃশ্য সহজেই লক্ষণীয়। সামান্য সংশোধিত হয়ে মূলনীতির অন্তর্গত এই খসড়াটিই পরবর্তীকালে আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রথম খসড়া ম্যানিফেস্টোরূপে প্রকাশিত এবং প্রচারিত হয়।

‘মূলদাবী’তে উত্থাপিত প্রস্তাবগুলিতে বয়স্কদের ভোটাধিকার, ব্যক্তি স্বাধীনতা, আইনের চোখে সমতা, ধর্মের স্বাধীনতা, সংখ্যালঘুদের ন্যায্য অধিকার, দেশ-রক্ষার অধিকার, বৈদেশিক নীতি, মানুষের সমান অধিকার, কাজ করার অধিকার, শিক্ষার অধিকার, স্বাস্থ্যের অধিকার, নারীর অধিকার ছাড়াও ইসলামী রাষ্ট্র এবং কৃষি-পুনর্গঠন ও শিল্পবিপ্লব সম্পর্কে যা বলা হয় তা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

ইসলামী রাষ্ট্রের রূপ সম্পর্কে তাতে বলা হয়:

১. পাকিস্তান খেলাফৎ অথবা ইউনিয়ন অব পাকিস্তান রিপাবলিকস্ বৃটিশ কমনওয়েলথের বাহিরে একটি স্বাধীন সার্বভৌম ইসলামী রাষ্ট্র হইবে।

২. পাকিস্তানের ইউনিটগুলিকে আত্মনিয়ন্ত্রণের পূর্ণ অধিকার দিতে হইবে।

৩. রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব আল্লার প্রতিভূ হিসাবে জনগণের উপর ন্যস্ত থাকিবে।

৪. গঠনতন্ত্র হইবে নীতিতে ইসলামী গণতান্ত্রিক ও আকারে রিপাবলিকান।[১১১]

কৃষি-পুনর্গঠন প্রস্তাব বলা হয় :

১. জমিদারী প্রথা ও জমির উপর অন্যান্য কায়েমী স্বার্থ বিনা খেসারতে উচ্ছেদ করিতে হইবে।

২. সমস্ত কর্ষিত ও কৃষি উপযোগী অকর্ষিত জমি কৃষকদের মধ্যে সমভাবে বণ্টন করিয়া দিতে হইবে।

৩. তাড়াতাড়ি অর্ডিনেন্স জারী করিয়া ‘তেভাগা’ দাবী মানিয়া লইতে হইবে।

৪. রাষ্ট্রের তত্ত্বাবধানে অবিলম্বে সমবায় ও যৌথ কৃষিপ্রথা প্রতিষ্ঠা করিতে হইবে।

৫. নিম্নলিখিত বিষয়ে কৃষকদের অবিলম্বে সাহায্য করিতে হইবে:

ক. সেচ ব্যবস্থার সুবিধা ও সার প্রস্তুতের পরিকল্পনা।

খ. উন্নত ধরনের বীজ ও বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি।

গ. সহজ ঋণ দান ও কৃষি ঋণ হইতে মুক্তি।

ঘ. ভূমি-করের উচ্ছেদ না হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত ভূমিকর শতকরা পঞ্চাশ ভাগ কমানো।

ঙ. ভূমিকরের পরিবর্তে কৃষি-আয় কর বসানো।

চ. খাদ্য শস্য প্রভৃতি জাতীয় ফসলের সর্বনিম্ন ও সর্ব-ঊর্ধ্ব দর নির্ধারণ করিয়া দিতে হইবে এবং পাটের সর্বনিম্ন দর বাঁধিয়া দিতে হইবে।

ছ. খাদ্য শস্যের ব্যবসা সরকারের হাতে একচেটিয়া থাকা উচিত। পাট ব্যবসা ও বুনানীর লাইসেন্স রহিত করিতে হইবে।

জ. সকল রকমের সমবায় সমিতিগুলিকে সাহায্য ও উৎসাহ দিতে হইবে।

৬. কালে সমস্ত ভূমিকে রাষ্ট্রের জাতীয় সম্পত্তিতে পরিণত করিতে হইবে এবং সরকারের অধিনায়কত্ব ও তত্ত্বাবধানে যৌথ ও সমবায় কৃষিপ্রথা খুলিতে হইবে।[১১২]

দেশীয় শিল্পকে নানা বিপদের হাত থেকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে ‘মূলদাবী’তে নিম্নলিখিত কর্মসূচীর উল্লেখ করা হয়:

১. প্রাথমিক শিল্পগুলিকে জাতীয় সম্পত্তিতে পরিণত করিতে হইবে যেমন, – যুদ্ধ শিল্প, ব্যাংক, বীমা, যানবাহন, বিদ্যুৎ সরবরাহ, খনি, বনজঙ্গল ইত্যাদি; এবং অন্যান্য ছোটখাটো শিল্পগুলিকে পরিকল্পনার ভিতর দিয়া সরাসরি রাষ্ট্রের তত্ত্বাবধানে আনিতে হইবে।

২. পাট ও চা শিল্পকে জাতীয় সম্পত্তিতে পরিণত করিতে হইবে এবং পাট ও চা ব্যবসা সরকারের হাতে একচেটিয়া থাকিবে।

৩. কুটির শিল্পগুলিকে সুচিন্তিত পরিকল্পনার ভিতর দিয়া বিশেষভাবে সাহায্য ও উৎসাহ দান করিতে হইবে।

৪. বিল, হাওর ও নদীর উপর হইতে কায়েমী স্বার্থ তুলিয়া দিয়া সরকারের কর্তৃত্বাধীনে মৎস্যজীবীদের মাঝে যৌথ উপায়ে বণ্টন করিয়া দিতে হইবে এবং সুপরিকল্পিত পদ্ধতিতে বৈজ্ঞানিক উপায়ে মৎস্যের চাষ ও মৎস্য ব্যবসার পত্তন করিতে হইবে। ফিশারী বিভাগের দ্রুত উন্নয়ন করিয়া এই সমস্ত বিষয়ে শিক্ষা প্রসার করিতে হইবে ও উন্নত ধরনের গবেষণাগার খুলিতে হইবে।

৫. শিল্প ও ব্যবসায়ে ব্যক্তিগত একচেটিয়া অধিকার থাকিবে না।

৬. বৃটিশের নিকট হইতে ষ্টার্লিং পাওনা অবিলম্বে আদায় করিতে হইবে এবং তাহা দ্বারা যন্ত্রপাতি ক্রয় করিতে হইবে ও শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়িয়া তুলিতে হইবে।

৭. দেশের আভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ব্যবসাকে নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত করিবার ভার রাষ্ট্রকে গ্রহণ করিতে হইবে।

৮. সমস্ত বৃটিশ ও বৈদেশিক ব্যবসাকে জাতীয় সম্পত্তিতে পরিণত করিতে হইবে।

৯. শিল্পে বৈদেশিক মূলধন খাটানো বন্ধ করিতে হইবে।

১০. শিল্পে মুনাফার হার আইন করিয়া বাঁধিয়া দিতে হইবে।[১১৩]

বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের ম্যানিফেস্টোর অনুকরণেই শামসুল হকের প্রকাশিত এই মূল দাবীর খসড়াটিও সর্বশেষে নিম্নোক্ত আহ্বান জানায়:

মানবতার চূড়ান্ত মুক্তি সংগ্রাম যাতে বিলম্বিত না হয়, সেজন্য জনতাকে তাহাদের সমস্ত ব্যক্তিগত এবং দলগত বিভেদ বিসর্জন দিয়া এক কাতারে সমবেত হইতে মুসলিম লীগ কর্মী সম্মেলন আবেদন জানাইতেছে। সাম্রাজ্যবাদী সরীসৃপের ফোঁস ফোঁস শব্দ আজ সমাজের আনাচে-কানাচে সর্বত্র শোনা যাইতেছে – সেই ফোঁস-ফোঁস শব্দই যেন এই যুগে সঙ্গীত। আমাদের কওমী প্রতিষ্ঠান এই সরীসৃপদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালাইয়া তাহাদের বিষদাঁত উৎপাটন করিতে বদ্ধপরিকর। হজরত আবু বকর সিদ্দিকী (রাঃ) বলিয়াছিলেন : ‘যদি আমি ঠিক থাকি, তবে আমাকে অনুসরণ করো, আর যদি আমি ভ্রান্ত হই, আমাকে সংশোধন করো।’ সেই অমর আদর্শকেই সামনে ধরিয়াই কওমী প্রতিষ্ঠান সমস্ত দেশবাসীকে সমতালে আগাইয়া আসিতে আহ্বান জানাইতেছে; আসুন আমরা কোটি কোটি নর-নারীর সমবেত চেষ্টার গণ-আজাদ হাসিল করিয়া সোনার পূর্ব পাকিস্তানকে সুখী, সমৃদ্ধ ও গণতান্ত্রিক ভিত্তিতে গড়িয়া তুলি।[১১৪]

আওয়ামী মুসলিম লীগের সাথে ১৫০ নম্বর মোগলটুলীর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও সেখানকার সাথে সংশ্লিষ্ট কর্মীদের মধ্যে অনেকেই এই নোতুন সংগঠনটির সাথে যুক্ত না হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। আওয়ামী মুসলিম লীগের সাম্প্রদায়িক চরিত্রই তার প্রধান কারণ। যে সমস্ত নেতৃস্থানীয় কর্মীরা এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন তাঁদের মধ্যে কমরুদ্দীন আহমদ, মহম্মদ তোয়াহা, অলি আহাদ, তাজউদ্দীন আহমদ প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।

তথ্যসূত্র (সংশোধন করা হয়নি) – সপ্তম পরিচ্ছেদ: পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের উত্থান

8

Proceedings of the Annual Meeting of Bengal Provincial Muslim League, 1943.

Annual Report of the Bengal Provincial Muslim League, Branch Office, Dacca. 1944, by Sham ul Huq, Worker in Charge, P1.

পূর্বোক্ত, পৃ ১-২, ৮১।

আবুল হাশিম, শামসুদ্দীন আহমদ, কমরুদ্দীন আহমদ।

Draft Manifesto of Bengal Provincial Muslim League, by Abul Hashim,. Secretrary, Bengal Provincial Muslim League, Published by Shamuddin Ahmed, Purba Pakistan Publishing House 150, Mogaltuli, P 4. পূর্বোক্ত, পৃ ৫।

পূর্বোক্ত।

b

পূর্বোক্ত।

পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি (প্রথম খণ্ড) | ৩১৭

পূর্বোক্ত, পৃ ৫-৬।

১০ পূর্বোক্ত, পৃ ৬।

১১

পূর্বোক্ত।

১২ পূর্বোক্ত, পৃ ৬-৭

১৩ পূর্বোক্ত। পৃ ৭। পূর্বোক্ত।

১৪

১৫ পূর্বোক্ত, পৃ ৮।

১৬

পূর্বোক্ত, পৃ ১২।

১৭

আবুল হাশিম।

১৮ আবুল হাশিম, কমরুদ্দীন আহমদ।

১৯

20

কমরুদ্দীন আহমদ এবং তাজউদ্দীন আহমদের ডায়েরীর বিভিন্ন অংশ, ১৯৪৭-৪৯।

নওবেলাল, ৫ই মে, ১৯৪৯।

শওকত আলী।

২২ পূর্বোক্ত।

২৩ পূর্বোক্ত।

২৪ কমরুদ্দীন আহমদ, মোস্তাক আহমদ।

২৫ কমরুদ্দীন আহমদ।

২৬ পূর্বোক্ত।

২৭

শওকত আলী, মোস্তাক আহমদ।

২৮ মোস্তাক আহমদ।

২৯

আজাদ, ২০শে এপ্রিল, ১৯৪৯।

৩০

আজাদ, ২৩শে এপ্রিল, ১৯৪৯।

৩১

আজাদ, ২রা মে, ১৯৪৯।

৩২ মোস্তাক আহমদ।

৩৩ পূর্বোক্ত।

৩৪ কমরুদ্দীন আহমদ, মোস্তাক আহমদ।

৩৫ আজাদ, ৩রা মে, ১৯৪৯।

৩৬ কমরুদ্দীন আহমদ।

৩৭ পূর্বোক্ত।

৩৮ পূর্বোক্ত।

৩৯

নওবেলাল, ২৭শে জুলাই, ১৯৫০।

80

নওবেলাল, ২রা জুন, ১৯৪৯।

৪১

নওবেলাল, ৯ই জুন, ১৯৪৯।

৪২ পূর্বোক্ত, ১৬ই জুন, ১৯৪৯।[৪৩ সৈনিক, ২৪শে জুন ১৯৪৯।

88

আজাদ, ১৯শে জুন, ১৯৪৯।

80

নওবেলাল, ২৩শে জুন, ১৯৪৯।

৩১৮ | বদরুদ্দীন উমর রচনাবলী খণ্ড ২

৪৬ আজাদ, ১৯শে জুন, ১৯৪৯।

89 পূর্বোক্ত।

৪৮

89

আজাদ, ১৯শে জুন, ১৯৪৯ এবং নওবেলাল, ২৩শে জুন, ১৯৪৯।

আজাদ, ১৯শে জুন, ১৯৪৯, নওবেলাল, ২৩শে জুন, ১৯৪৯; সৈনিক, ২৪শে জুন।

৫০ আজাদ, ১৯শে জুন, ১৯৪৯।

৫১ পূর্বোক্ত।

৫২ পূর্বোক্ত।

৫৩ পূর্বোক্ত।

৫৪ সৈনিক, ২৪শে জুন, ১৯৪৯।

৫৫ পূর্বোক্ত।

৫৬ আজাদ, ১৯শে জুন।

৫৭ পূর্বোক্ত।

৫৮ পূর্বোক্ত।

৫৯ সৈনিক, ২৪শে জুন ১৯৪৯।

৬০ আজাদ, ১৯শে জুন।

৬১ পূর্বোক্ত।

৬২ পূর্বোক্ত, নওবেলাল, ২৩শে জুন, ১৯৪৯।

৬৩ আজাদ, ১৯শে জুন, ১৯৪৮; সৈনিক, ২৪ শে জুন ১৯৪৯।

৬৪ সৈনিক, ২৪শে জুন, ১৯৪৯।

৬৫. পূর্বোক্ত।

৬৬ পূর্বোক্ত।

৬৭ আজাদ, ১৯শে জুন, ১৯৪৯।[৬৮ সৈনিক, ২৪শে জুন, ১৯৪৯।[৬৯ পূর্বোক্ত।

৭০ পূর্বোক্ত।

৭১

পূর্বোক্ত।

৭২

পূর্বোক্ত।

৭৩

আজাদ, ২০শে জুন, ১৯৪৯।

98

দৈনিক আজাদ, ২০শে জুন, ১৯৪৯।

৭৫

পূর্বোক্ত।

৭৬ পূর্বোক্ত।

٩٩

পূর্বোক্ত।

৭৮ পূর্বোক্ত, নওবেলাল, ২৩শে জুন, ১৯৪৯।

৭৯

নওবেলাল, ২৩শে জুন ১৯৪৯।

৮০ পূর্বোক্ত।

৮১ পূর্বোক্ত।

আজাদ ২০শে জুন, ১৯৪৯।

পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি (প্রথম খণ্ড) | ৩১৯

৮৩ সাপ্তাহিক সৈনিক, ২৪শে জুন, ১৯৪৯।

৮৪

নওবেলাল, ২৩শে জুন, ১৯৪৯।

৮৫ পূর্বোক্ত

৮৬ পূর্বোক্ত এবং সৈনিক, ২৪শে জুন, ১৯৪৯।

৮৭

নওবেলাল, ২৩শে জুন, ১৯৪৯।

৮৮ শওকত আলী।

৮৯ পূর্বোক্ত।

৯০ পূর্বোক্ত।

৯১

মুস্তাক আহমদ, শওকত আলী।

৯২ পূর্বোক্ত।

৯৩ মুস্তাক আহমদ, শওকত আলী, কমরুদ্দীন আহমদ।

৯৪ শওকত আলী, মুস্তাক আহমদ।

৯৫

১৬

৯৭

মুস্তাক আহমদ, শওকত আলী, খয়রাত হোসেন, আবদুল জব্বার খদ্দর, আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ।

শওকত আলী।

শওকত আলী, আবদুল জব্বার খদ্দর, মুস্তাক আহমদ, আবদুল রশীদ তর্কবাগীশ এবং নওবেলাল, ৭ই জুলাই, ১৯৪৯।

৯৮ নওবেলাল, ৭ই জুলাই, ১৯৪৯।

১৯

শওকত আলী, মুস্তাক আহমদ। মূল দাবী এবং আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রথম খসড়া ম্যানিফেস্টো এ ব্যাপারে তুলনীয়।

১০০ নওবেলাল, ৭ই জুলাই, ১৯৪৯।

১০১ পূর্বোক্ত।

১০২ শওকত আলী।

১০৩ শওকত আলী, মুস্তাক আহমদ।

১০৪ শওকত আলী।

১০৫ তাজউদ্দীন আহমদ-এর ডায়েরী, ২৪/৬/১৯৪৯।

১০৬ মূল দাবী-পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগ কর্মী সম্মেলনে বিবেচনার জন্য, প্রস্তাবক : শামসুল

হক এমএলএ পৃ ১।

১০৭ আবুল হাশিম, বদরুদ্দীন উমর।

১০৮ মূল দাবী, পৃ ৭।

১০৯ পূর্বোক্ত, পৃ ১০-১১।[১১০ পূর্বোক্ত, পৃ ১১-১২।[১১১ পূর্বোক্ত, পৃ ১৪।

১১২ পূর্বোক্ত, পৃ ২৪-২৫।

১১৩ পূর্বোক্ত, পৃ ২৭-২৮।

১১৪ পূর্বোক্ত, পৃ ৩০-৩১।

৩২০ | বদরুদ্দীন উমর রচনাবলী খণ্ড ২

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *