৩. পূর্ব-বাঙলায় মহম্মদ আলী জিন্নাহ

তৃতীয় পরিচ্ছেদ – পূর্ব-বাঙলায় মহম্মদ আলী জিন্নাহ

১. মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারী পার্টি

১৯৪৭ সালের জুলাই মাসে শহীদ সুহরাওয়ার্দী পূর্ব বাংলা মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারী পার্টির নেতা নির্বাচনে নাজিমুদ্দীনের কাছে পরাজিত হন।[১] এর পর নাজিমুদ্দীন যথারীতি ঢাকাতে পূর্ব-বাঙলার প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শপথ গ্রহণ করে নিজের মন্ত্রীসভার অন্যান্য সদস্যদের নাম গভর্ণরের কাছে পেশ করেন। এই মন্ত্রীসভাতে নাজিমুদ্দীন তাঁর উপদলের বাইরের কোন মুসলিম লীগ সদস্যকে গ্রহণ করেননি। এর ফলে বিভাগপূর্ব কালের নাজিমুদ্দীন বিরোধী সদস্যের নোতুন পরিস্থিতিতেও একটি উপদল হিসাবে কাজ করতে থাকে। শুধু তাই নয়। তাঁরা নাজিমুদ্দীন মন্ত্রীসভার পতন ঘটানোর জন্যে সীমাবদ্ধ ক্ষমতা সত্ত্বেও যথাসাধ্য চেষ্টা করে যান।

প্রধানমন্ত্রী নাজিমুদ্দীন এই উপদলটিকে যে শুধু মন্ত্রীসভার আসন থেকেই বঞ্চিত করেছিলেন তা নয়। তিনি এবং মৌলানা আকরম খাঁ অন্যান্যদের সহযোগিতায় তাদেরকে এবং তাদের সমর্থকদেরকে মুসলিম লীগ সংগঠনের বাইরে রাখতেও চেষ্টার ত্রুটি করেননি। ওয়ার্কার্স ক্যাম্পের লোকজনদেরকে রশিদ বই দিতে অস্বীকৃতি এবং প্রদেশে ও জেলায় জেলায় নিজেদের ইচ্ছেমতো সাংগঠনিক কমিটি গঠন করাও তাঁদের এই কার্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত ছিলো। খাজা নাজিমুদ্দীনের সুহরাওয়ার্দী ভীতির মতো আকরম খাঁর ছিলো ভাসানী ভীতি। তিনি মনে করতেন মওলানা ভাসানী প্রাদেশিক মুসলিম লীগের মধ্যে এলে তাঁর সভাপতিত্ব রক্ষা করা দুঃসাধ্য হবে।[২] এই চিন্তা থেকে তিনি সিলেট জেলা মুসলিম লীগ এবং প্রাদেশিক মুসলিম লীগ উভয় ক্ষেত্রেই ইচ্ছেমতো ভাঙ্গাচোরা এবং রদবদল করেন।[৩]

বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটিকে ভেঙে দিয়ে সেই কমিটির পূর্ব বঙ্গীয় সদস্য এবং আসাম মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটির সিলেটীয় সদস্যদের নিয়ে একটি নোতুন পূর্ব-বাঙলা মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটি গঠিত হয়। এই কমিটির প্রথম এবং একমাত্র বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ঢাকাতে। সে সময় দেখা যায় যে প্রাদেশিক ওয়ার্কিং কমিটিতে মওলানা ভাসানী, মাহমুদ আলী, দেওয়ান মহম্মদ আজরফ, দেওয়ান আবদুল বাসেত, প্ৰভৃতিসহ প্রায় আটজন সিলেটের প্রতিনিধিত্ব করেন। ওয়ার্কিং কমিটিতে এদের উপস্থিতি আকরম খাঁর পছন্দ না হওয়ায় তিনি সেই প্রাদেশিক কমিটিকে ভেঙে দেন। এর পর তিনি একটি নোতুন সাংগঠনিক কমিটি গঠন করেন যার মধ্যে পূর্বোল্লিখিত পুরাতন সদস্যদের একজনকেও না রেখে মুনাওয়ার আলীকে সিলেটের একমাত্র প্রতিনিধি হিসাবে মনোনীত করা হয়।[৪]

এই নোতুন কমিটিতে আকরম খাঁ এবং মুনাওয়ার আলী ব্যতীত অন্য সদস্যদের মধ্যে ছিলেন হাবিবুল্লাহ বাহার চৌধুরী, আবদুল্লাহেল বাকী, আহমদ হোসেন, আবদুল মোতালেব মালেক, নূরুল আমীন, আসাদউল্লাহ এবং ইউসুফ আলী চৌধুরী। আকরম খাঁ এই কমিটির চেয়ারম্যান এবং ইউসুফ আলী চৌধুরী ও আসাদউল্লাহ দুজনেই যৌথভাবে সেক্রেটারী মনোনীত হন। এই কমিটি গঠিত হয় জিন্নাহর পূর্ব-বাঙলা সফরের পর।[৫]

সিলেট জেলা সাংগঠনিক কমিটির চেয়ারম্যান মনোনীত হন মাহমুদ আলী। ১৯৪৮-৪৯ সালের মধ্যে তাঁরা ব্যাপকভাবে মুসলিম লীগের সদস্য সংগ্রহ করেন। সিলেট লীগের এই উদ্যোগে আশংকান্বিত হয়ে আকরম খাঁ বেআইনিভাবে কতকগুলি অপ্রাসঙ্গিক কারণ দেখিয়ে তাঁদের জেলা সাংগঠনিক কমিটিকেও ভেঙে দেন এবং মাহমুদ আলীকে বাদ দিয়ে নোতুনভাবে অন্য একটি কমিটি গঠন করেন।[৬]

নোতুন প্রাদেশিক সাংগঠনিক কমিটিতে সুহরাওয়ার্দী সমর্থক ডক্টর মালেক এবং আহমদ হোসেনকে রাখলেও জেলা সাংগঠনিক কমিটিগুলির উপর নিজেদের পূর্ণ কর্তৃত্ব রাখার ফলে মুসলিম লীগের দরজা পূর্ববর্তী সুহরাওয়ার্দী-আবুল হাশিম সমর্থক উপদলীয় লোকদের জন্যে প্রায় সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়।

আকরম খাঁর সাংগঠনিক কমিটির সম্পাদক ইউসুফ আলী চৌধুরী পরবর্তী সময়ে স্বীকার করেন[৭] যে, আকরম খাঁ সুহরাওয়ার্দী গ্রুপের লোকজনদেরকে ইচ্ছাকৃতভাবে বাদ দিয়ে তাঁদের প্রতি অবিচার করেছিলেন। কিন্তু তিনি আবার এ কথাও বলেন যে, তাঁরা, অর্থাৎ নাজিমুদ্দীন আকরম খাঁ উপদলের লোকেরা, সে কাজ করেছিলেন অনেকটা প্রতিহিংসামূলকভাবে। সুহরাওয়ার্দী দেশভাগের পূর্বে যখন মুসলিম লীগ মন্ত্রীসভা গঠন করেন তখন তিনি নিজেদের উপদলের বাইরে কাউকে তাতে স্থান দেননি। কাজেই পূর্ব বাঙলার নোতুন মন্ত্রীসভা গঠনকালে নাজিমুদ্দীন সুহরাওয়ার্দী অনুসৃত পথ ধরেই তাঁরা নিজের উপদলের মধ্যে থেকেই মন্ত্রীসভার প্রত্যেকটি সদস্য নির্বাচন করেছিলেন। আকরম খাঁরও এ ব্যাপারে উদ্বেগ কম ছিলো না। বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের মধ্যে আবুল হাশিমের সাংগঠনিক দক্ষতা ও তৎপরতার ফলে আকরম খাঁ সংগঠনগতভাবে সম্পূর্ণভাবে কোণঠাসা হয়েছিলেন। মওলানা ভাসানীকে পূর্ব-বাঙলা মুসলিম লীগের সাংগঠনিক কাজের সাথে যুক্ত করে তিনি পূর্ব অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তি হতে দিতে নিতান্তই নারাজ ছিলেন। কাজেই সে সম্ভাবনাকে রোধ করার জন্যে উপযুক্ত ব্যবস্থা অবলম্বনের ক্ষেত্রে তিনি কোন ত্রুটি রাখেননি।[৮]

মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারী পার্টি এবং মুসলিম লীগ সংগঠনের মধ্যে এই উপদলীয় কার্যকলাপের প্রভাব থেকে ছাত্র রাজনীতি মুক্ত ছিলো না। দেশ ভাগের পূর্বে মুসলিম ছাত্রলীগের মধ্যে আবুল হাশিম ও নাজিমুদ্দীনের সমর্থকরা দুই উপদলে বিভক্ত ছিলেন।

সে সময় সুহরাওয়ার্দীর থেকে আবুল হাশিমের প্রভাবই ছাত্রদের মধ্যে অনেক বেশি শক্তিশালী ছিলো। কিন্তু দেশভাগের পর আবুল হাশিম বর্ধমানে থেকে যাওয়ায় তাঁর সমর্থক ছাত্রদের একটি প্রভাবশালী অংশ সুহরাওয়ার্দী সমর্থক পূর্ব-বাঙলা মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারী উপদলের সাথে যুক্ত হয় এবং অন্য একটি অংশ বামপন্থী রাজনীতির সিদ্ধান্ত নেয়। প্রথম দলের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমান, শওকত আলী, নূরুদ্দীন আহমদ, সালেহ আহমদ, মোয়াজ্জেম হোসেন প্রভৃতির নাম উল্লেখযোগ্য। দ্বিতীয় দলের মধ্যে ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ, মহম্মদ তোয়াহা, অলি আহাদ প্রভৃতি। ছাত্রদের যে উপদলটি নাজিমুদ্দীন মন্ত্রীসভাকে সমর্থন করতো তার মধ্যে শাহ আজিজুর রহমান, আনোয়ার হোসেন প্রমুখ ছিলেন নেতৃস্থানীয়।

ছাত্রলীগের উপরোল্লিখিত উপদলগুলির মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমানের উপদলের সাথেই মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারী পার্টির সুহরাওয়ার্দী সমর্থক উপদলের সর্বাপেক্ষা ঘনিষ্ট সংযোগের ফলে তাঁরা একযোগে কিছু কিছু কাজ করেন এবং তার ফলে পার্লামেন্টারী উপদলটির সুবিধাবাদী রাজনীতির পথই প্রশস্ত হয়।ঐ খাদ্য আন্দোলন এবং ভাষা আন্দোলনের সময় অবশ্য আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী ছাত্রদের সাথে সাধারণভাবে মহম্মদ আলী, তফজ্জল আলী প্রমুখ উপদলীয় নেতাদের একটি কার্যকরী সম্পর্ক কিছুদিনের জন্যে স্থাপিত হয় এবং তারা অনেকে তাঁদের উপদলীয় বৈঠকেও মাঝে মাঝে যোগদান করেন।[১০]

২০শে ডিসেম্বর, ১৯৪৭ বেলা ৩-৩০ মিনিটে ‘বলিয়াদী হাউসে’ পার্লামেন্টারী উপদলের এই জাতীয় একটি বৈঠক হয়। এতে পার্লামেন্টারী পার্টির বাইরের অনেক কর্মীও উপস্থিত থাকেন। মহম্মদ আলী, তফজ্জল আলী, ডক্টর মালেক প্রভৃতি ব্যবস্থাপক সভার ১৬ জন সদস্য ব্যতীত অন্য যাঁরা উপস্থিত ছিলেন তাঁদের মধ্যে কমরুদ্দীন আহমদ, তাজউদ্দীন আহমদ, শেখ মুজিবুর রহমান, শওকত আলী, শামসুজ্জোহা, আসলাম, আবদুল আউয়াল, আজিজ আহমদ, মহিউদ্দীন আহমদ (বরিশালের মহিউদ্দীন আহমদ নয়) আতাউর রহমান খাঁ, কফিলউদ্দীন চৌধুরী, কাদের সর্দার এবং মতি সর্দারের নাম উল্লেখযোগ্য।[১১]

পরদিন মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারী পার্টির খাদ্য সমস্যা, পাট সমস্যা, ইত্তেহাদ, মন্ত্রী ও পার্লামেন্টারী সেক্রেটারী প্রভৃতিদের মাইনে ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনার সিদ্ধান্ত হয়। নাজিমুদ্দীন মন্ত্রীত্ব অপসারণের সম্ভাবনা প্রশ্নও এই আলোচনার অন্তর্ভুক্ত থাকে এবং সেই প্রসঙ্গে বিকল্প মন্ত্রীত্ব যাঁর নেতৃত্বে গঠিত হবে কর্মীরা তাঁর নাম জানতে চান। পার্লামেন্টারী পার্টির নেতারা এই প্রশ্নের জবাব পরবর্তী সোমবার অর্থাৎ ২২শে ডিসেম্বর সঠিকভাবে তাঁদেরকে জানাতে পারবেন এই মর্মে আশ্বাস দেন।[১২]

বৈঠকটি রাত্রি ৮টা পর্যন্ত স্থায়ী হয়। এর পর একটি মোটরগাড়ীতে চড়ে তাজউদ্দীন আহমদ, শওকত আলী, শেখ মুজিবুর রহমান এবং মহিউদ্দীন পলাশী ব্যারাক, সলিমুল্লাহ হল, নীলক্ষেত ব্যারাক, ফজলুল হক হল, ইঞ্জিনিয়ারিং হোস্টেল এবং নিমতলী মেসে ‘ইত্তেহাদ’ কাগজ বিতরণ করেন।[১৩] ‘ইত্তেহাদ’ এই সময় নাজিমুদ্দীন-বিরোধী উপদলটিকে সমর্থন এবং বিভিন্ন সমস্যার ক্ষেত্রে পূর্ব-বাঙলা মন্ত্রীসভার নিষ্ক্রিয়তার সমালোচনা করতো। এ জন্যে তখন ইত্তেহাদকে সরকারীভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও সে সময় লোক মারফত বড় বড় প্যাকেটে নিয়মিতভাবে ইত্তেহাদ ঢাকাতে আসতো এবং ছাত্রেরা তা মাঝে মাঝে বিতরণ করতেন।[১৪]

২১শে ডিসেম্বর সকালে নাজিমুদ্দীনের সভাপতিত্বে মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারী পার্টির প্রথম বৈঠক বসে। এতে ১১৬ জনের মধ্যে মন্ত্রীসহ ৮০ জন সদস্য উপস্থিত থাকেন। স্পীকার ও ডেপুটি স্পীকার নির্বাচনের জন্যে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পূর্ব-বাঙলা ব্যবস্থাপক সভার বৈঠক আহ্বান করার জন্যে তাঁরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।[১৫]

বিকেল ৪টা থেকে পার্লামেন্টারী পার্টির দ্বিতীয় দফা বৈঠক শুরু হয় এবং সেই বৈঠক চলাকালে অসদস্য কিছুসংখ্যক ছাত্র, কর্মী এবং নেতারাও উপস্থিত থাকেন। এদের মধ্যে কমরুদ্দীন আহমদ, শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদ, শওকত আলী, অলি আহাদ প্রভৃতির নাম উল্লেখযোগ্য। খাদ্য সমস্যার বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনাকালে এই সময় মন্ত্রীত্ববিরোধী মনোভাব চরমভাবে ব্যক্ত হয়। কন্ট্রোল এবং কর্ডন প্রথা তুলে নেওয়ার জন্যে বিরোধীপক্ষীয়েরা দারুণভাবে চাপ দিতে থাকেন এবং এ নিয়ে ভোটাভুটির কথাও ওঠে কিন্তু শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানের খাদ্য মন্ত্রীর আসন্ন সফর পর্যন্ত এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত স্থগিত রাখতে সকলে একমত হন।[১৬]

এর পরদিন সকাল ৯টায় উপদলীয় পরিষদ সদস্যেরা তফজ্জল আলীর জয়নাগ রোডস্থ বাসাতে নিজেদের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নির্ধারণের জন্যে একটি আলোচনা সভায় মিলিত হন।[১৭] এই সভার সিদ্ধান্ত মতো ডক্টর মালেক শহীদ সুহরাওয়ার্দীকে ঢাকাতে এসে তাঁদের দলের নেতৃত্ব গ্রহণ এবং নাজিমুদ্দীন মন্ত্রীসভাকে অপসারণের জন্যে আমন্ত্রণ জানানোর উদ্দেশ্যে কলকাতা যান।[১৮]

ডক্টর মালেক সুহরাওয়ার্দীকে বলেন যে তিনি যদি পাকিস্তানে আসতে ইচ্ছে করেন তাহলে তখনই তার উপযুক্ত সময়; কারণ তৎকালীন অবস্থা, তাঁদের পক্ষে অত্যন্ত অনুকূল। সুহরাওয়ার্দী সমস্ত কথা শোনার পরও ঢাকা আসতে সম্মত হলেন না। তিনি ইতিপূর্বে পূর্বে বাঙলায় না আসার সিদ্ধান্ত নেওয়াই এর কারণ। সুহরাওয়ার্দীর সাথে এই আলোচনাকালে ডক্টর মালেকের সাথে নওগাঁওয়ের পরিষদ সদস্য সিরাজুল ইসলামও উপস্থিত ছিলেন। উপদলীয় পার্লামেন্টারী পার্টির নেতৃত্বের প্রসঙ্গে সুহরাওয়ার্দী তাঁদের নিজেদের মধ্যেই একজনকে নেতা নির্বাচন করে নেওয়ার পরামর্শ দেন।[১৯]

কলকাতা থেকে ঘুরে এসে ডক্টর মালেক মহম্মদ আলী এবং তফজ্জল আলীকে সুহরাওয়ার্দীর সাথে তাঁর আলাপের বিষয়ে জানালে তাঁরা উভয়েই তাঁকে পুরোপুরি বিশ্বাস করতে অস্বীকার করেন। পরে সিরাজুল ইসলামও ডক্টর মালেকের কথা সঠিক বলে তাঁদেরকে জানালে তাঁরা শেষ পর্যন্ত সুহরাওয়ার্দীর নেতৃত্ব সম্পর্কে আশা ত্যাগ করেন। মুহম্মদ আলী এ ব্যাপারে ঢাকা থেকে সুহরাওয়ার্দীর সাথে টেলিফোনে আলাপ করেছিলেন।[২০]

সুহরাওয়ার্দী প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার পর নেতা নির্বাচন উপদলটির পক্ষে এক বিরাট সমস্যার আকারে দেখা দিল। মহম্মদ আলী, শামসুদ্দীন আহমদ (কুষ্টিয়া) প্রভৃতির কথা বিবেচিত হলেও এদের মধ্যে কারো প্রতি সকলের তেমন আস্থা ছিলো না। পার্লামেন্টারী পার্টির মধ্যে তখন ফজলুল হকের সমর্থক ছিলেন মাত্র চার পাঁচজন। কাজেই সেদিক থেকে তাঁকে নির্বাচন করারও অসুবিধে ছিলো।[২১]

সুহরাওয়ার্দীর ঢাকা না আসার সিদ্ধান্ত, নেতা নির্বাচনে অক্ষমতা ইত্যাদির পর পার্লামেন্টারী উপদলটির নেতৃবৃন্দ নাজিমুদ্দীন মন্ত্রীসভাকে অপসারণের চিন্তা বর্জন করে তার উপর চাপ দিয়ে একটা আপোষরফায় উপনীত হওয়ার জন্যে তৈরি হন এবং সর্বতোভাবে সেই চেষ্টা করতে থাকেন। ভাষা আন্দোলনকে তাঁরা এই উদ্দেশ্যেই ব্যবহারের চেষ্টা করেন। এর পর থেকে নাজিমুদ্দীনের বিরুদ্ধে উপদলীয় রাজনীতিতে সক্রিয় থাকলেও মহম্মদ আলী, তফজ্জল আলী প্রভৃতি নেতারা জিন্নাহর বিরাগভাজন হওয়ার ভয়ে সর্বদা সন্ত্রস্ত থাকতেন এবং নাজিমুদ্দীনও তাঁদের কার্যকলাপ সম্পর্কে জিন্নাহর কাছে নিয়মিতভাবে অভিযোগ উপস্থিত করতেন। প্রথম পার্লামেন্টারী পার্টির বৈঠকের পর তাঁদের বিরুদ্ধতার কথা জানিয়ে নাজিমুদ্দীন জিন্নাহ এবং লিয়াকত আলীর সাথে ঢাকা থেকে টেলিফোনযোগে আলাপও করেন।[২২]

ভাষা আন্দোলন ভালোভাবে রাজনৈতিক রূপ পরিগ্রহ করার পূর্ব পর্যন্ত উপদলীয় নেতারা প্রদেশের বিভিন্ন স্থানে ছাত্র এবং অন্যান্য কর্মীদের সাথে যোগাযোগের জন্যে মাঝে মাঝে সফর করতেন। এই উদ্দেশ্যে রাজশাহী কলেজের ছাত্রদের দ্বারা একবার আমন্ত্রিত হয়ে নঈমুদ্দীন আহমদ এবং তফজ্জল আলী ৩১শে জানুয়ারী সেখানে পৌছান। রাজশাহীতে ইতিপূর্বেই ১৪৪ ধারা জারী করা হয়েছিলো কিন্তু গান্ধী হত্যার পর শোকসভা অনুষ্ঠানের জন্যে ১৪৪ ধারা তুলে নেওয়া তফজ্জল আলী এবং অন্যান্যেরা ভুবনমোহন পার্কে একটি সভায় বক্তৃতা দিতে সমর্থ হন।[২৩]

এর পরই নরসিংদীতে পুরনো কিছু কৃষক কর্মীরা একটি সভার আয়োজন করেছিলেন এবং সেই সভায় মহম্মদ আলীর সভাপতিত্ব করার এবং ডক্টর মালেক, তফজ্জল আলী, কমরুদ্দীন আহমদ প্রমুখ কয়েকজনের বক্তৃতা দানের কথা ছিলো। নির্ধারিত দিনে সকাল দশটার সময় অর্থাৎ ট্রেন ছাড়ার কিছু পূর্বে মহম্মদ আলী নরসিংদী না যাওয়ার সিদ্ধান্ত জানিয়ে কমরুদ্দীন আহমদকে খবর দেন। এর কারণ ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে তিনি বলেন যে, জিন্নাহর কাছে এই মর্মে অভিযোগ করা হয়েছে যে তাঁরা জমিদার উচ্ছেদের জন্য আন্দোলন করছেন এবং জিন্নাহ এ জাতীয় কর্মসূচীকে রাষ্ট্রদ্রোহী বিবেচনা করায় তাঁর পক্ষে কৃষক সভাটিতে যাওয়া আর সম্ভব নয়।[২৪]

তফজ্জল আলী বলেন যে, মহম্মদ আলীর সিদ্ধান্ত জানার পরও তিনি নরসিংদী যাওয়ার কর্মসূচী পরিবর্তন না করে পূর্ব কথামতো সেখানে যান এবং যথারীতি বক্তৃতা করেন।[২৫] কিন্তু কমরুদ্দীন আহমদ এ প্রসঙ্গে বলেন যে নরসিংদী পৌঁছবার পূর্বে মহম্মদ আলীর মত পরিবর্তনের বিষয়ে তফজ্জল আলী কিছু জানতেন না। সেখানে উপস্থিত হয়েই তিনি তাঁর কাছে সেকথা জানতে পারেন এবং ভীতিবশত সভায় কোন বক্তৃতা দিতে অস্বীকার করেন।[২৬]

নাজিমুদ্দীন-বিরোধী উপদলটির মূল সমস্যা ছিলো এই যে, রাজনীতিগতভাবে তাঁদের কোন পৃথক সত্তা না থাকায় মুসলিম লীগ পরিত্যাগ করার কোন ক্ষমতা তাদের ছিলো না এবং মুসলিম লীগের মধ্যে নাজিমুদ্দীন জিন্নাহর প্রিয়পাত্র থাকায় উপদলীয় রাজনীতিতেও তাঁদের বিশেষ কোন ভবিষ্যৎ তাঁরা দেখেননি। সুহরাওয়ার্দীর অবর্তমানে এই পরিস্থিতি রীতিমতো ঘোরালো আকার ধারণ করে। এই অবস্থাতেই আপোসের পথকেই তাঁরা বেছে নেন এবং মন্ত্রীসভায় স্থান লাভ এবং অন্যান্য উপযোগী চাকরির জন্যে নাজিমুদ্দীনের ওপর উপদলীয় চাপ প্রয়োগ করতে থাকেন।

ভাষা আন্দোলনের সময় তাঁরা নাজিমুদ্দীনকে ক্রমাগত বলেন যে, আন্দোলন তাঁদের নেতৃত্বেই পরিচালিত হচ্ছে কাজেই তাঁদের সাথে একটা উপযুক্ত মীমাংসায় উপনীত না হলে আন্দোলন থামার কোন সম্ভবনা নেই। তাঁদের এই দাবীকে নাজিমুদ্দীন জিন্নাহর কাছে মুসলিম লীগ ও রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপ বলে প্রমাণের চেষ্টা করলেও পরিশেষে তিনিও তাদের সাথে একটা আপোস রফা করে গণ্ডগোলের হাত থেকে পরিত্রাণ লাভের চেষ্টা করেন। ভাষা আন্দোলন চলাকালে ১৩ই মার্চ খাজা নসরুল্লাহর বাড়ী ‘দিলখুশায়’* উভয়পক্ষের আপোষ-মীমাংসার জন্যে একটি আলোচনা বৈঠক বসে। তাতে মন্ত্রী সভার পক্ষে উপস্থিত থাকেন নাজিমুদ্দীন একা। অন্যপক্ষে থাকেন মহম্মদ আলী, তফজ্জল আলী এবং ডক্টর মালেক। এই বৈঠকে নাজিমুদ্দীনের সাথে উপদলীয় নেতাদের একটা মিটমাটের কথা হয়। কিন্তু নাজিমুদ্দীনকে তাঁরা বলেন যে, আপোষ-মীমাংসাকে পুরোপুরিভাবে কার্যকরী করতে হলে ছাত্রদেরকে জেল থেকে মুক্তিদান এবং ভাষার দাবীকে স্বীকৃতি দিতে হবে। নাজিমুদ্দীন মোটামুটিভাবে তাতে সম্মত হলেও এ বিষয়ে কোন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত সেদিন সম্ভব হয় নি।[২৭] এই আপোষ আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতেই তফজ্জল আলী পরদিন সকালে তাঁর বাড়ীতে তোয়াহা এবং তাজউদ্দীন আহমদকে বলেন যে, তাঁরা অর্থাৎ ছাত্রেরা খুব সম্ভবত দুইজন মন্ত্রী এবং একজন রাষ্ট্রদূত পাচ্ছেন। তফজ্জল আলীর এই উক্তিতে ছাত্রদের মধ্যে দারুণ বিক্ষোভ দেখা দেয় এবং তাঁরা সংগ্রাম পরিষদের থেকে আনোয়ারা খাতুন এমএলএ-কে সেদিনই ফজলুল হক হলে অনুষ্ঠিত একটি সভায় বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেন এবং ১৫ তারিখে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ সভায় তা কার্যকরী করেন। এ ছাড়া ১৪ তারিখেই তাঁরা বেশ কয়েকজন দিলখুশাতে গিয়ে পার্লামেন্টারী নেতাদের আপোষ-মীমাংসা এবং সুবিধাবাদীতার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। ছাত্রদের এই অবস্থা দেখে মহম্মদ আলী এবং অন্যান্য নেতারা তাঁদেরকে আশ্বাস দেন যে, ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্যে তাঁরা নাজিমুদ্দীনের সাথে কোন আপোষের মধ্যে যাবেন না।

[* বাড়ীটি এখন ভেঙে ফেলা হয়েছে। বর্তমানে যে স্থানে ঢাকা ইমপ্রুভুমেন্ট ট্রাস্ট বিল্ডিং প্রাচী হোটেল ইত্যাদি আছে দিলখুশা সেখানেই অবস্থিত ছিলো। বাড়ীটির সমগ্র কম্পাউণ্ডের নাম ছিলো মতিঝিল। বর্তমান মতিঝিল এলাকার নামের উৎপত্তি সেখান থেকে।]

নাজিমুদ্দীনের সাথে ১৩ই মার্চের আলোচনা সত্ত্বেও উপদলীয় নেতারা তফজ্জল আলীকে স্পীকার পদে মনোনয়নের জন্যে পার্লামেন্টারী পার্টিতে দাঁড় করাবার সিদ্ধান্ত নেন। ১৪ই মার্চ বিকেল ৩-৩০ মিনিটে ‘বর্ধমান হাউসে’ পার্লামেন্টারী পার্টির সভা শুরু হলে সেখানে আবদুল করিম এবং তফজ্জল আলীর মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়। আবদুল করিম প্রায় বিশ- পঁচিশ ভোটের ব্যবধানে তফজ্জল আলীকে পরাজিত করে পরদিন স্পীকার পদের নির্বাচনের জন্যে মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারী পার্টি কর্তৃক মনোনীত হন।[২৮] সেদিনের সভায় ভাষা আন্দোলন সম্পর্কেও আলোচনা হয় এবং আলোচনা চলার সময় রাত্রি প্রায় ৯টা পর্যন্ত ছাত্রেরা প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের বাইরে বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে থাকেন।[২৯]

রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, পার্লামেন্টারী পার্টির মধ্যে উপদলীয় কার্যকলাপ ইত্যাদির পরিপ্রেক্ষিতে প্রাদেশিক সরকার পূর্ব-বাঙলায় জিন্নাহর উপস্থিতি প্রয়োজনীয় মনে করেন এবং তাঁকে যথাশীঘ্র পূর্ব বাঙলায় আগমনের জন্যে আমন্ত্রণ জানান। কিছুদিন থেকেই জিন্নাহর এই সফরের কথা আলোচিত হচ্ছিলো কিন্তু এবার তাড়াতাড়ি তার সঠিক তারিখ নির্ধারণ করে ১৯শে মার্চ তাঁর ঢাকা আগমনের কথা ঘোষণা করা হলো।

২. জিন্নাহর ঢাকা আগমন ও রেসকোর্সের বক্তৃতা

১৯শে মার্চ বিকেলে জিন্নাহ তেজগাঁ বিমানবন্দরে পৌঁছান। হাজার হাজার লোক তাঁকে সম্বর্ধনা জ্ঞাপনের উদ্দেশ্যে বিমানবন্দরে সমবেত হয় এবং অসংখ্য লোক রেসকোর্সের ময়দান থেকে তেজগাঁ পর্যন্ত পথের দুই পাশে তাঁর দর্শন লাভের উদ্দেশ্যে অপেক্ষা করতে থাকে।

কিন্তু জিন্নাহ রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় তাঁকে দেখে পাশ্ববর্তী জনতা কোন ধ্বনি দেয় না। ছাত্রদের অনেকের মধ্যে তাঁর এই সফরের বিষয়ে কিছুটা উৎসাহের অভাবও দেখা যায়। ভাষা আন্দোলনকালে পুলিশী অত্যাচারই তার প্রধান কারণ ছিলো।[৩০]

বিমানবন্দরের পথে এবং শহরের মধ্যে জিন্নাহর আগমন উপলক্ষে মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ এবং সিরাজউদ্দৌলা, মীরমদন, মোহনলাল প্রভৃতির নামে তোরণ প্রস্তুত করে সেগুলিকে নানাভাবে সুসজ্জিত করা হয়।[৩১] কিন্তু সেদিন বিকেলের দিকে বৃষ্টিপাতের ফলে সেগুলি অনেকাংশে নষ্ট হয়ে যায়। জিন্নাহর সম্মানে সন্ধ্যার পর শহরে বিস্তৃত আলোকসজ্জা এবং অধিক রাত্রি পর্যন্ত বাজি পোড়ানোর ব্যবস্থা হয়।[৩২]

২১শে মার্চ ঢাকার নাগরিকেরা রেসকোর্সের ময়দানে জিন্নাহকে সম্বর্ধনা জ্ঞাপনের আয়োজন করেন। ৫.১৫ মিনিটে জিন্নাহ উপস্থিত হওয়ার পর সম্বর্ধনা কমিটির সভাপতি নবাব হাবিবুল্লাহ একটি মানপত্র পাঠ করেন। এর পর জিন্নাহর বক্তৃতা শুরু হয়।[৩৩] প্রায় এক ঘণ্টাকাল বক্তৃতার মধ্যে ভাষার প্রশ্ন এবং ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে তাঁর নানা বক্তব্য তিনি সুস্পষ্ট ভাষায় ব্যক্ত করেন। ভাষা আন্দোলনের উদ্দেশ্য এবং আন্দোলনকারীদের চরিত্র সম্পর্কে শ্রোতামণ্ডলীকে সতর্ক করে দিয়ে তিনি বলেন:

কিন্তু আমি একথা আপনাদেরকে বলতে চাই যে, আমাদের মধ্যে নানা বিদেশী এজেন্সীর অর্থ সাহায্যপুষ্ট কিছু লোক আছে যারা আমাদের সংহতি বিনষ্ট করতে বদ্ধপরিকর। তাদের উদ্দেশ্য হলো পাকিস্তানকে ধ্বংস করা। আপনারা সাবধান হয়ে চলুন আমি তাই চাই; আমি চাই আপনারা সতর্ক থাকুন এবং আকর্ষণীয় স্লোগান ও বুলির দ্বারা বিভ্রান্ত না হন। তারা বলছে যে, পাকিস্তান ও পূর্ব-বাঙলা সরকার সর্বতোভাবে আপনাদের ভাষাকে ধ্বংস করতে চায়। মানুষের পক্ষে এর থেকে বড় মিথ্যা ভাষণ আর কিছু হতে পারে না। সোজাসুজিভাবে আমি একথা আপনাদেরকে বলতে চাই যে, আপনাদের মধ্যে কিছুসংখ্যক কমিউনিস্ট এবং বিদেশীদের সাহায্যপ্রাপ্ত এজেন্ট আছে এবং এদের সম্পর্কে সাবধান না হলে আপনারা বিপদগ্রস্ত হবেন। পূর্ব বাঙলাকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা তারা পরিত্যাগ করেনি এবং এখনো পর্যন্ত সেটাই তাদের লক্ষ্য।[৩৪]

পাকিস্তানে ভাষা-ভিত্তিক জাতীয়তার বিরোধিতা করতে গিয়ে তিনি বলেন :

পাকিস্তান এবং বিশেষ করে আপনাদের প্রদেশ এখনো পর্যন্ত যে সমস্ত বিপদের সম্মুখীন সে সম্পর্কে আবার আমি সুস্পষ্ট ভাষায় আপনাদেরকে সাবধান করে দিতে চাই। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠাকে প্রতিহত করতে না পেরে, পরাজয়ের দ্বারা বাধাগ্রস্ত ও হতাশ হয়ে পাকিস্তানের শত্রুরা এখন পাকিস্তানী মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির দ্বারা রাষ্ট্রকে ধ্বংস করার দিকে মনোযোগ দিয়েছে। প্রাদেশিকতার উস্কানি দানের মাধ্যমেই তাদের এই প্রচেষ্টাকে তারা অব্যাহত রেখেছে। যে পর্যন্ত না এই বিষয়কে আপনারা রাজনীতি থেকে বর্জন করছেন, সে পর্যন্ত আপনারা নিজেদেরকে একটা সত্যিকার জাতি হিসাবে গঠন করতে সক্ষম হবেন না। আমার বাঙালী, পাঞ্জাবী, সিন্ধী, বেলুচী, পাঠান ইত্যাদি সম্পর্কে কিছু বলতে চাই না। ইউনিট হিসাবে সেগুলির অবশ্য একটি অস্তিত্ব আছে। কিন্তু আপনাদেরকে জিজ্ঞেস করি: চৌদ্দশ বছর পূর্বে আমাদেরকে যে শিক্ষা দেওয়া হয়েছিলো আমরা কি তা ভুলে গেছি? আমার মতো আপনারা সকলেই এখানে বহিরাগত। বাঙলাদেশের আদি অধিবাসী কারা? যারা এখন এদেশে বাস করছে তারা নয়; কাজেই ‘আমরা বাঙলা বা সিন্ধী বা পাঠান বা পাঞ্জাবী’ এ কথা বলার প্রয়োজন কি। না, আসলে আমরা সকলেই হলাম মুসলমান।[৩৫]

রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন যে পূর্ব-বাঙলার জনসাধারণের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত এ কথা অস্বীকার করে তিনি মন্তব্য করেন:

এ কথা আমি পূর্বেই বলেছি যে, মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির উদ্দেশ্যেই ভাষার প্রশ্ন তোলা হয়েছে। আপনাদের প্রধানমন্ত্রীও একটি সদ্য প্রকাশিত বিবৃতিতে যথার্থভাবেই এ কথা উল্লেখ করেছেন। তাঁর সরকার এদেশের শান্তি বিঘ্নিত করার জন্য রাজনৈতিক আন্তর্ঘাতক অথবা তাদের এজেন্টদের যে কোন চেষ্টাকে কঠিনভাবে দমন করার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় আমি খুশী হয়েছি। বাংলা এই প্রদেশের সরকারী ভাষা হবে কিনা সেটা এ প্রদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই স্থির করবেন। আমার কোন সন্দেহে নেই যে যথাসময়ে এই প্রদেশের অধিবাসীদের ইচ্ছানুসারেই এই প্রশ্নের মীমাংসা হবে।[৩৬]

উর্দুকে রাষ্ট্র ভাষা করার যুক্তি দেওয়ার চেষ্টায় তিনি বলেন :

আমি সুস্পষ্ট ভাষায় আপনাদেরকে জানাতে চাই যে, আপনাদের দৈনন্দিন জীবনের ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার ব্যবহার নিয়ে কোন রকম প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হবে এ কথার মধ্যে কোন সত্যতা নেই। কিন্তু আপনারা, এই প্রদেশের অধিবাসীরাই, চূড়ান্তভাবে স্থির করবেন আপনাদের প্রদেশের ভাষা কি হবে। কিন্তু এ কথা আপনাদেকে পরিষ্কারভাবে বলে দেওয়া দরকার যে, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু, অন্য কোন ভাষা নয়। এ ব্যাপারে যদি কেউ আপনাদেরকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে তাহলে বুঝতে হবে সে হচ্ছে রাষ্ট্রের শত্রু। একটিমাত্র রাষ্ট্রভাষা ছাড়া কোন জাতিই এক সূত্রে গ্রথিত হয়ে কার্যনির্বাহ করতে পারে না। অন্য দেশের ইতিহাসের দিকে তাকিয়ে দেখুন। অতএব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু। কিন্তু আমি পূর্বেই বলেছি, এ প্রসঙ্গ পরে আসবে।[৩৭]

জিন্নাহর উপরোক্ত বক্তব্যের অর্থ এই দাঁড়ায় যে, পূর্ব-বাঙলার সরকারী ভাষা বাংলা হবে কিনা সে সম্পর্কে তিনি কিছুই জানেন না। বাংলা অথবা উর্দু যাই হোক সেটা তারা নিজেরাই স্থির করতে পারবে। কিন্তু পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা সম্পর্কে পূর্ব-বাঙলার মানুষকে কোন স্বাধীনতা দেওয়া যেতে পারে না। শুধু তাই নয়, সে স্বাধীনতা যদি কেউ দাবী করে তাহলে সে নিশ্চিতভাবে রাষ্ট্রের শত্রু। কাজেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নটি বিচার করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার তিনি পূর্ব-বাঙলার, এমনকি সারা পাকিস্তানের জনসাধারণের উপর ছেড়ে না দিয়ে সে দায়িত্ব নিজেই ব্যক্তিগতভাবেই গ্রহণ করেছিলেন এবং তার সেই সিদ্ধান্তের কেউ বিরোধিতা করলে তাকে তিনি ধরে নিয়েছিলেন রাষ্ট্রদ্রোহীতা ও অন্তর্ঘাতী গৃহ-শত্রুতার শামিল বলে। এ জন্যে উর্দু ভাষা সম্পর্কে উপরোক্ত বক্তব্যের পরই তিনি আবার ঘোষণা করেন:

আমি আবার আপনাদেরকে বলছি, রাষ্ট্রের দুশমনের ফাঁদে পড়বেন না। দুর্ভাগ্যবশতঃ আপনাদের মধ্যে ঘরোয়া শত্রুতা আছে এবং আমাকে দুঃখের সঙ্গে জানাতে হচ্ছে যে তারা বাইরের থেকে অর্থ সাহায্যপ্রাপ্ত মুসলমান। কিন্তু তারা একটা মস্ত ভুল করছে। আমরা ভবিষ্যতে অন্তর্ঘাতকদেরকে আর কিছুতেই সহ্য করবো না। আমরা আমাদের রাষ্ট্রে বিশ্বাসঘাতক ঘরোয়া শত্রুদেরকে সহ্য করবো না। এসব যদি বন্ধ করা না হয় তাহলে আমি নিশ্চিত যে আপনাদের সরকার এবং পাকিস্তান সরকার এই বিষাক্ত শক্তিকে নির্দয়ভাবে দমন করার জন্য, কঠিনতম ব্যবস্থা অবলম্বন করবে।[৩৮]

এরপর পাকিস্তানের রাষ্ট্রপ্রধান একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করে বলেন যে, মুসলিম লীগই শত বাধা বিপত্তি সত্ত্বেও পাকিস্তান হাসিল করেছে কাজেই সকলেরই মুসলিম লীগে যোগদান করা উচিত। অন্য রাজনৈতিক দলের প্রতিষ্ঠাকে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ হিসেবে বর্ণনা করে মুসলিম লীগ বিরোধীদেরকে তিনি রাষ্ট্রের শত্রু হিসেবে চিত্রিত করেন। এই প্রসঙ্গে রেস কোর্সের বক্তৃতায় তিনি কতকগুলি স্লোগান দেন:

মুসলিম লীগ আপনাদের হাতে একটি পবিত্র আমানতের মতো। এই পবিত্র আমানতকে আমাদের দেশের ও জনগণের কল্যাণের জিম্মাদার হিসাবে আমরা রক্ষা করবো, না রক্ষা করবো না? আমরা যা অর্জন করেছি তাকে ধ্বংস করা অথবা আমরা যা লাভ করেছি তা দখল করার উদ্দেশ্যে যাদের অতীত সন্দেহাতীত নয় এ জাতীয় লোকদের নেতৃত্বে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা রাজনৈতিক দল কি খাড়া করতে দেওয়া হবে? এই প্রশ্ন আমি আপনাদেরকে জিজ্ঞেস করছি। আপনারা কি পাকিস্তানে বিশ্বাস করেন? (হাঁ, হাঁ, চীৎকার) পাকিস্তান অর্জন করে কি আপনারা সুখী হয়েছেন? (হাঁ, হাঁ বলে চীৎকার) পূর্ব বাঙলা অথবা পাকিস্তানের অন্য কোন অংশ ভারতীয় ইউনিয়নে চলে যাবে এটা কি আপনারা চান? (না, না) আপনারা দি পাকিস্তানের খেদমত করতে চান, যদি আপনারা পাকিস্তানকে গঠন করতে চান, যদি আপনারা পাকিস্তানের সংস্কার করতে চান তা হলে আমি বলবো যে, প্রতিটি মুসলমানের সামনে একটিমাত্র সৎ পথই খোলা আছে – তাহলো মুসলিম লীগে যোগদান করে নিজের সাধ্যমত পাকিস্তানের খেদমত করা। কোন রকম বিদ্বেষ অথবা শুভেচ্ছার অভাবের জন্যে নয়, তাদের অতীত কার্যকলাপের জন্যেই ব্যাঙের ছাতার মতো যে সমস্ত পার্টিগুলি গজিয়ে উঠছে সেগুলিকে সন্দেহের চোখে দেখা হবে।[৩৯]

জিন্নাহ খুব সম্ভবতঃ ঢাকা এবং যশোরের বাঙালী-অবাঙালী উত্তেজনা ও সংঘর্ষ এবং পার্লামেন্টারী রাজনীতিকদের সুবিধাবাদীতার উল্লেখ করে তাঁর বক্তৃতার এক পর্যায়ে বলেন:

আমাকে জানানো হয়েছে যে এই প্রদেশের কোন কোন অংশে অবাঙ্গালী মুসলমানদের বিরুদ্ধে একটা মনোভাব বর্তমান আছে। এই প্রদেশের এবং পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কি হবে সে প্রশ্নকে কেন্দ্র করে কিছু উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে। এ সম্পর্কে আমি শুনেছি যে কিছুসংখ্যক রাজনৈতিক সুবিধাবাদীরা প্রশাসনকে বিব্রত করার উদ্দেশ্যে ছাত্র সম্প্রদায়কে ব্যবহার করেছে।[৪০]

জিন্নাহর বক্তৃতায় ভাষা সম্পর্কে তার বিবিধ মন্তব্য এবং আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে ঘন ঘন সতর্ক ও সাবধান বাণী উচ্চারণ করার সময় মাঝে মাঝে শ্রোতাদের মধ্যে স্বতঃস্ফূর্তভাবে কিছু কিছু বিক্ষুব্ধ কথাবার্তা শোনা যায়।[৪১] ময়দানের কোন কোন এলাকায় উর্দুই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে এ কথা শোনার পর মৃদু ‘না, না’ ধ্বনিও উত্থিত হয়।[৪২] কিন্তু মোটামুটিভাবে সেই বিরাট জনসমুদ্র শান্তভাবেই জিন্নাহর বক্তৃতা শোনে।[৪৩]

মুসলিম লীগ ও উর্দুর স্বপক্ষে মতামত ব্যক্ত করার ফলে ছাত্র সমাজ, এমনকি জনসাধারণের একাংশ জিন্নাহর বিরুদ্ধে কিছুটা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। তারা আশা করেছিলো যে তিনি রাষ্ট্রপ্রধান এবং পাকিস্তানের অবিসংবাদী নেতা হিসেবে নাজিমুদ্দীন সরকারের আন্দোলনকালীন নির্যাতনমূলক কার্যকলাপকে সমর্থন করবেন না। কিন্তু জিন্নাহ সে রকম কোন নিরপেক্ষতা রক্ষা না করে সোজাসুজি আন্দোলনকারীদেরকে অন্তর্ঘাতক, রাষ্ট্রশত্রু, দেশদ্রোহী ইত্যাদি আখ্যায় ভূষিত করে তাদের উপর অত্যাচারকে সমর্থন এবং ভবিষ্যতেও তাদেরকে কঠোরতর শাস্তিদানের কথা ঘোষণা করায় অনেকেই খোলাখুলিভাবে তাঁর সমালোচনায় মুখর হয়ে ওঠে। শুধু তাই নয় কোন স্থানে তাঁর সম্মানে নির্মিত গেট আংশিকভাবে ভেঙ্গে দিয়ে এবং তাঁর ছবি ছিঁড়ে তারা তাঁর বিবিধ মন্তব্যের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে।[৪৪]

প্রথম অবস্থায় মনে হয়েছিলো যে উর্দু সমর্থক ছাত্রেরা বিভিন্ন হলের মধ্যে জিন্নাহর বক্তৃতার সুযোগ নিয়ে হয়তো মারপিট ও গুণ্ডামী করতে পারে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সে রকম কিছুই হয়নি। উপরন্তু বাংলা বিরোধী যে সমস্ত ছাত্রেরা পূর্বে অন্য ছাত্রদের বিছানা এবং অন্যান্য আসবাবপত্র পুড়িয়ে দিতো তাদের কয়েকজনের বিছানাপত্রই স্বতঃস্ফূর্তভাবে বাংলা সমর্থক ছাত্রেরা পুড়িয়ে ফেলে এবং তাদের কয়েকজনকে ধরে মারপিটও করে। এর কারণ জিন্নাহর বক্তৃতায় নাজিমুদ্দীন সরকারের স্বপক্ষে তাঁর বক্তব্য এবং উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার দৃঢ় মনোভাব। রেস কোর্সের বক্তৃতার পর ছাত্রদের মধ্যে জিন্নাহর ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা অনেকাংশে ক্ষুণ্ণ হয় এবং তার ফলে বাংলার প্রতি সমর্থনও বৃদ্ধি পায়।[৪৫]

৩. জিন্নাহর সমাবর্তন বক্তৃতা

২৪শে মার্চ সকালের দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জিন্নাহর সম্মানে একটি বিশেষ সমাবর্তন উৎসবের আয়োজন করেন। আমন্ত্রণ গ্রহণ করার সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ডক্টর মাহমুদ হাসানকে জিন্নাহ বলেন যে, সময়ের অভাবে লিখিত বক্তৃতা দেওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়; কাজেই তিনি নিজের বক্তব্য ছাত্রদের সামনে মৌখিকভাবে বলবেন।[৪৬]

কার্জন হলে আয়োজিত এই সমাবেশে শৃঙ্খলা, ছাত্রদের কর্তব্য, রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে নানা বাস্তব অসুবিধা ইত্যাদির উল্লেখ করার পর জিন্নাহ ভাষা আন্দোলনকে উপলক্ষ্য করে রাষ্ট্রশত্রুদের কার্যকলাপ সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য আবার উপস্থিত করতে গিয়ে বলেন:

ইদানীং আপনাদের প্রদেশের উপর অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে আক্রমণ চালানো হচ্ছে। আমাদের শত্রুরা – দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে তাদের মধ্যে এখনো কিছু সংখ্যক মুসলমান আছে— পাকিস্তানকে দুর্বল করে এ প্রদেশকে পুনরায় ভারতীয় ডোমিনিয়নের অন্তর্ভুক্ত করার উদ্দেশ্যে সক্রিয়ভাবে প্রাদেশিকতার উস্কানী দিতে নিযুক্ত হয়েছে। যারা এই খেলা শুরু করেছে তারা বোকার স্বর্গে বাস করছে। কিন্তু এই সত্ত্বেও তারা তাদের চেষ্টা থেকে বিরত হবে না। এই রাষ্ট্রের মুসলমানদের সংহতিকে খর্ব করে জনগণকে আইন ভঙ্গ করতে প্ররোচিত করার জন্য প্রত্যহ মিথ্যা প্রচারণার বন্যা বইছে। আমি দুঃখের সাথে লক্ষ্য করেছি যে, আপনাদের প্রধানমন্ত্রী পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করার পরও আপনাদের মধ্যে কেউ কেউ সাম্প্রতিক ভাষা বিতর্কের সাথে জড়িত হয়ে পড়েছেন। অন্যান্য উপায়ের মতো এটাও প্রাদেশিকতার বিষ এই প্রদেশের মধ্যে সযত্নে ঢুকিয়ে দেওয়ার একটা সূক্ষ্ম উপায়। এটা কি আপনাদের কাছে বিসদৃশ মনে হয় না যে ভারতীয় প্রেসের এক অংশ, যাদের কাছে পাকিস্তানের নাম পর্যন্ত একটা অভিশাপের মতো, তারাই ভাষার বিতর্কের প্রশ্নে আপনাদের ‘যথার্থ অধিকার’ আদায়ের জন্য আজ উঠেপড়ে লেগে গেছে। এটা কি তাৎপর্যপূর্ণ নয় যে, অতীতে যারা মুসলমানদের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেছে অথবা আপনাদের আত্মনিয়ন্ত্রণের মৌলিক অধিকারের ক্ষেত্রে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছে তারাই আজ আকস্মিকভাবে আপনাদের অধিকার রক্ষার নাম করে ভাষার প্রশ্নে আপনাদেরকে সরকারের বিরুদ্ধতা করার জন্য উস্কানী দিচ্ছে? এই সব পঞ্চম বাহিনী সম্পর্কে আমি আপনাদেরকে সাবধান করে দিচ্ছি।[৪৭]

এর ঠিক পরই রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে তিনি বলেন:

আমি রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে আমার বক্তব্য আবার বলছি। এই প্রদেশের সরকারী কাজের জন্য এই প্রদেশের লোকেরা নিজেদের ইচ্ছামতো যে কোন ভাষা ব্যবহার করতে পারে। যথাসময়ে এবং এই প্রদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সুচিন্তিত মতামতের মাধ্যমে তাদের ইচ্ছানুসারেই এই প্রশ্নের মীমাংসা হবে। কিন্তু রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রদেশের যোগাযোগের ভাষা হিসাবে একটি ভাষা থাকবে। এবং সে ভাষা হবে উর্দু অন্য কোন ভাষা নয়। কাজেই স্বাভাবিকভাবে রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু যা এই উপমহাদেশের লক্ষ লক্ষ মুসলমানদের দ্বারা পুষ্ট হয়েছে, যা পাকিস্তানের এক থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত সকলেই বোঝে এবং সর্বোপরি যার মধ্যে অন্য যে কোন প্রাদেশিক ভাষার থেকে ইসলামী সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য বাস্তবরূপ লাভ করেছে এবং যে ভাষা অন্যান্য ইসলামী দেশগুলিতে ব্যবহৃত ভাষার সর্বাপেক্ষা কাছাকাছি।[৪৮]

জিন্নাহর বক্তৃতার এই পর্যায়ে অর্থাৎ ‘উর্দুই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে’ এই ঘোষণামাত্র হলের মধ্যে বেশ কিছু সংখ্যক ছাত্র ‘না, না’, বলে চীৎকার করতে থাকেন।[৪৯] জিন্নাহ তাঁর সমাবর্তন বক্তৃতায় উর্দুই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে এ কথা যে উল্লেখ করবেন সেটা ছাত্রেরা নিশ্চিতভাবে ধরে নিয়েছিলেন। কাজেই তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের জন্যেও তাঁরা আগে থেকেই প্রস্তুত হয়েছিলেন। যাঁরা তাঁর বক্তব্যের বিরুদ্ধে চীৎকার করে প্রতিবাদ করেছিলেন তাঁদের মধ্যে আবদুল মতিন, এ. কে. এম আহসান প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।[৫০]

প্রতিবাদের সময় কয়েক মুহূর্ত নিশ্চুপ থাকার পর জিন্নাহ তাঁর বক্তৃতা আবার শুরু করেন :

ভারতীয় ইউনিয়ন থেকে উর্দুকে যে বিতাড়িত করা হয়েছে, এমনকি উর্দু বর্ণমালার সরকারী ব্যবহারও যে সেখানে বন্ধ করা হয়েছে এটা সম্পূর্ণ তাৎপর্যহীন নয়। জনগণকে উত্তেজিত করার জন্য যারা ভাষার বিতর্ককে ব্যবহার করছে এসব ঘটনা তাদেরও অত্যন্ত ভালোভাবে জানা আছে। আন্দোলনের কোন যুক্তিই এক্ষেত্রে ছিলো না। কিন্তু এটা স্বীকার করা তাদের মতলব হাসিলের পক্ষে সহায়ক হতো না। এই বিতর্ককে ব্যবহার করার ক্ষেত্রে তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য এই রাষ্ট্রের মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করা। বস্তুতঃ এই কাজের জন্য তারা খোলাখুলিভাবেই অবাঙালী মুসলমানদের বিরুদ্ধে তাদের ঘৃণা উদ্রেকের যথেষ্ট চেষ্টা করছে। আপনাদের প্রধানমন্ত্রী করাচী থেকে ফিরে এসে ভাষা বিতর্কের উপর বিবৃতি মারফৎ এ প্রদেশের জনগণকে তাদের ইচ্ছানুসারে বাংলাকে সরকারী ভাষা হিসাবে ব্যবহারের অধিকার দেওয়ার কথা বলার পর আন্দোলনের আর কোন পথ খোলা নেই দেখে তারা তাদের কৌশল পরিবর্তন করলো। তারা এরপর বাংলাকে কেন্দ্রীয় পাকিস্তান সরকারের রাষ্ট্রভাষা করার দাবী জানালো এবং একটি মুসলিম রাষ্ট্রের সরকারী ভাষা হিসাবে উর্দুর স্বাভাবিক দাবী অনস্বীকার্য দেখে বাংলা এবং উর্দু দুই ভাষাকেই তারা পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার দাবী তুললো। এ সম্পর্কে কোন ভুল করা চলবে না। এই রাষ্ট্রের বিভিন্ন অংশগুলি একত্রে এগিয়ে যাওয়ার জন্য প্রয়োজন একটিমাত্র রাষ্ট্রভাষা এবং আমার মতে একমাত্র উর্দুই হতে পারে সেই ভাষা।[৫১]

রেস কোর্সের বক্তৃতা এবং এই একই সমাবর্তন বক্তৃতার প্রথম দিকেও উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার কথা জিন্নাহ যেখানেই বলেছেন সেখানেই তিনি সেটাকে একটা ঘোষণার মতো প্রচার করেছেন। কিন্তু এই প্রথম তিনি উর্দুর উল্লেখ করতে গিয়ে অপেক্ষাকৃত মৃদু ভাষা প্ৰয়োগ করে বললেন, ‘আমার মতে একমাত্র উর্দুই হতে পারে সেই ভাষা।’ জিন্নাহর বক্তব্য এবং বাচনভঙ্গীর এই আকস্মিক পরিবর্তনের কারনে সমাবর্তন সমাবেশে ছাত্রদের প্রতিবাদ। পুনর্বার প্রতিবাদের সম্মুখীন হওয়ার আশংকাতেই এই পরবর্তী পর্যায়ে তিনি উর্দুর দাবীকে নিজের ব্যক্তিগত অভিমত হিসেবে উপস্থিত করতে চেষ্টা করেন।

কিন্তু তা সত্ত্বেও রাষ্ট্রশক্রদের উল্লেখ করে তিনি আবার বলেন :

রাষ্ট্রকে ধ্বংস এবং সরকারকে হেয় প্রতিপন্ন করার উদ্দেশ্যে পাকিস্তানের দুশমন ও কিছুসংখ্যক সুবিধাবাদী রাজনীতিবিদরা যে কৌশল গ্রহণ করেছে সে সম্পর্কে আপনাদেরকে সাবধান করার জন্যই আমি এ বিষয়ে এত বিস্তারিতভাবে আলোচনা করলাম। আপনাদের মধ্যে যারা জীবন শুরু করতে যাচ্ছেন তাদের এ জাতীয় লোকজন সম্পর্কে সাবধান থাকা প্রয়োজন। যাদেরকে এখনো কিছুদিন পড়াশোনা করতে হবে তাদের উচিত কোন রাজনৈতিক পার্টি অথবা স্বার্থপর রাজনীতিকের দ্বারা নিজেদেরকে ব্যবহৃত না হতে দেওয়া।[৫২]

এর পর ছাত্রদের উদ্দেশ্যে আবার তিনি পর পর কতকগুলি সাবধান বাণী উচ্চারণ করেন:

প্রথমত, আমাদের মধ্যে পঞ্চম বাহিনী সম্পর্কে সাবধান থাকুন। দ্বিতীয়ত, স্বার্থপর লোকদের সম্পর্কে সতর্ক থাকুন কারণ তারা নিজেরা সাঁতার কাটার জন্য আপনাদেরকে ব্যবহার করতে ইচ্ছুক। তৃতীয়ত, রাষ্ট্রের সত্যিকার নিঃস্বার্থ ও একনিষ্ঠ খাদেম যারা সর্বতোভাবে জনগণকে সমর্থন করে এবং তাদের সেবা করতে ইচ্ছুক তাদেরকে চিনতে শেখা দরকার। চতুর্থত, মুসলিম লীগ পার্টিকে শক্তিশালী করুন কারণ তা আপনাদের সেবায় নিয়োজিত থেকে এক মহৎ ও গৌরবময় পাকিস্তান গড়ে তুলতে সক্ষম হবে। পঞ্চমমত, মুসলিম লীগ পাকিস্তান অর্জন ও প্রতিষ্ঠা করেছে এবং সেই পবিত্র আমানতের হেফাজতকারী হিসাবে পাকিস্তানকে গড়ে তোলা মুসলিম লীগেরই কর্তব্য। ষষ্ঠত, আমাদের সংগ্রামের সময় যারা অনেকে নিজেদের কড়ি আঙুলটি পর্যন্ত নাড়েনি, নানাভাবে আমাদের বিরুদ্ধতা করেছে এবং পদে পদে সব রকম বাধা-বিপত্তি সৃষ্টি করেছে এবং যাদের মধ্যে অনেকেই আমাদের শত্রু শিবিরে আমাদের বিরুদ্ধে কাজ করেছে, তারা এখন এগিয়ে এসে নানা আকর্ষণীয় স্লোগান ও বুলি আওড়াতে পারে এবং আপনাদের সামনে নানাপ্রকার আদর্শ ও কর্মসূচী হাজির করতে পারে। কিন্তু তাদেরকে এখনো নিজেদের আন্তরিকতার প্রমাণ দিতে হবে এবং মনের মধ্যে কোন সত্যিকার পরিবর্তন এসেছে কিনা সেটা প্ৰমাণ করার জন্য ব্যাঙের ছাতার মতো নোতুন নোতুন পার্টি গঠন না করে মুসলিম লীগকে সমর্থন এবং তাতে যোগদান করতে হবে।[৫৩]

৪. রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সাথে সাক্ষাৎকার

২৪শে মার্চ সন্ধ্যা ৬-৩০ মিনিটে জিন্নাহ রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের একটি প্রতিনিধিদলকে সাক্ষাৎ দান করেন।[৫৪] এই সাক্ষাৎকার অনুষ্ঠিত হয় চীফ সেক্রেটারী আজিজ আহমদের বাসভবনে।[৫৫]

এই সাক্ষাতের সময় সংগ্রাম পরিষদের সদস্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন শামসুল হক, কমরুদ্দীন আহমদ, আবুল কাসেম, তাজউদ্দীন আহমদ, লিলি খাঁ, মহম্মদ তোয়াহা, আজিজ আহমদ, অলি আহাদ, নঈমুদ্দীন আহমদ, শামসুল আলম এবং সৈয়দ নজরুল ইসলাম।[৫৬]

আলোচনার প্রথমেই জিন্নাহ রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সদস্যদেরকে বলেন যে, নাজিমুদ্দীনের সাথে তাঁদের যে চুক্তি হয়েছে সেটাকে তিনি স্বীকার করেন না, কারণ নাজিমুদ্দীনের থেকে জোরপূর্বক সেই চুক্তিতে সই আদায় করা হয়েছে। এর প্রমাণ হিসেবে তিনি বলেন যে আট দফা চুক্তির মধ্যে প্রত্যেকটি দফাতেই নাজিমুদ্দীনকে কি করতে হবে তাই বলা হয়েছে কিন্তু অন্য পক্ষের কর্তব্য সম্পর্কে কোনই উল্লেখ নেই। চুক্তি কখনো একতরফা হয় না, সর্বতোভাবে তা একটা দ্বিপাক্ষিক ব্যাপার। কিন্তু আটদফা চুক্তি স্পষ্ট প্রমাণ করে যে তা এক পক্ষের সুবিধার জন্য করা হয়েছে এবং চুক্তিতে স্বাক্ষর জোরপূর্বকই আদায় করা হয়েছে এবং সেই অনুসারে চুক্তিটি সম্পূর্ণভাবে অবৈধ এবং অগ্রাহ্য।[৫৭]

সংগ্রাম পরিষদের সদস্যেরা সহৃদয়তাপূর্ণ মনোভাব নিয়েই জিন্নাহর সাথে দেখা করতে গিয়েছিলেন। কিন্তু গোড়াতেই তাঁর এই আক্রমণাত্মক কথায় তাঁদের মনে সঙ্গে সঙ্গেই একটা বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টির ফলে ঘরের আবহাওয়া সম্পূর্ণভাবে পাল্টে গেলো।[৫৮] এবং ভাষা প্রশ্ন নিয়ে সাধারণভাবে জিন্নাহর সাথে তাঁদের তর্কাতর্কি শুরু হয়ে পরিশেষে তো ঘোরতর ঝগড়ায় পরিণত হলো।[৫৯] প্রথমেই মহম্মদ তোয়াহা তাঁকে সরাসরি বলেন যে, তাঁরা রাষ্ট্রভাষা বাংলা চান। এর উত্তরে জিন্নাহ বলেন যে, তিনি তাঁদের কাছে রাজনীতি শিক্ষা করতে আসেন নি।[৬০]

জিন্নাহর প্রধান বক্তব্য ছিলো এই যে, পাকিস্তানে একাধিক রাষ্ট্রভাষা হলে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিপন্ন হবে। তাছাড়া একাধিক রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নটিকে তিনি পৃথিবীর ইতিহাসে নজিরবিহীন বলেও বর্ণনা করেন।[৬১] সেই পর্যায়ে মহম্মদ তোয়াহা তাঁকে বলেন যে কানাডা, সুইজারল্যান্ড প্রভৃতি দেশে দুই বা ততোধিক রাষ্ট্রভাষা আছে কাজেই প্রশ্নটি মোটেই নজিরবিহীন নয়। জিন্নাহ কিন্তু ঐ সমস্ত দেশে একাধিক রাষ্ট্রভাষার কথা সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করেন।[৬২] এতে তোয়াহা তাঁকে বলেন যে, একাধিক রাষ্ট্রভাষার কথা একটি ঐতিহাসিক সত্য কাজেই সেই সত্যকে তিনি কিভাবে অস্বীকার করতে পারেন। এর উত্তরে জিন্নাহ উষ্মার সাথে বলেন যে তিনি ইতিহাস পাঠ করেছেন, তিনি এসব কথা জানেন।[৬৩] তাঁর এই জবাব শুনে অলি আহাদ বলেন যে, তিনিও ইতিহাস পড়েছেন এবং তিনি জানেন যে কায়েদে আজম ইতিহাসকে বিকৃত করছেন মাত্র। শুধু তাই নয়। এর পর অলি আহাদ জিন্নাহকে ব্যঙ্গ করে বলেন যে, তিনি শুধু ইতিহাসই জানেন, তা নয়, তিনি বস্তুতঃপক্ষে এ কথাও জানেন যে, জিন্নাহ্ পাকিস্তানের গভর্ণর জেনারেল এবং ইংল্যান্ডের রানীর কাছে তার অপসারণের জন্য তাঁরা আবেদন জানাতে পারেন।[৬৪]

অলি আহাদের উপরোক্ত কথায় জিন্নাহ রীতিমতো ক্রুব্ধ হয়ে ওঠেন এবং অলি আহাদ ও সংগ্রাম পরিষদের অন্যান্য সদস্যদের উচ্চকণ্ঠে বকাবকি করতে থাকেন। এর ফলে ঘরের মধ্যে দারুণ হৈ চৈ পড়ে যায়।[৬৫] এই পর্যায়ে জিন্নাহর মিলিটারি সেক্রেটারী গণ্ডগোল আশংকা করে কাছাকাছি জায়গা থেকে তাড়াতাড়ি এসে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করেন। কিন্তু পরে অবস্থা আশঙ্কাজনক কিছু নয় বুঝে তিনি আবার ভেতরের দিকে চলে যান।[৬৬] এই তর্কাতর্কির মধ্যে একবার ফাতেমা জিন্নাহ চায়ের তদারক করার জন্যে ঘরের মধ্যে অল্পক্ষণের জন্যে আসেন।[৬৭]

ইসলাম, রাষ্ট্রভাষা, শৃঙ্খলা ইত্যাদি সম্পর্কে নানা অপ্রীতিকর আলোচনার মধ্যে দিয়ে মাগরেবের নামাজের সময় হয়ে এলো। শামসুল হক তখন জিন্নাহকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘এবার নামাজের সময় হয়েছে, কাজেই কিছুক্ষণের জন্যে আলোচনা স্থগিত রাখা হোক’। শামসুল হকের এই কথায় জিন্নাহ্ ভয়ানক বিরক্ত হয়ে ওঠেন। কারণ তিনি মনে করলেন যে তিনি নামাজ পড়েন না, এটা জেনেই ইচ্ছাকৃতভাবে তাঁকে বিব্রত এবং অপদস্থ করার জন্যেই নামাজের প্রস্তাব করা হয়েছে।[৬৮] আসলে কিন্তু শামসুল হক সে সময় নিয়মিত নামাজ পড়তেন এবং সেই নিয়ম রক্ষার জন্যেই তিনি নামাজ পড়ার প্রস্তাব করেছিলেন। জিন্নাহ এই প্রস্তাবে বাহ্যত বিরক্তি বোধ করলেও তার বিরুদ্ধে কোন মন্তব্য করা থেকে বিরত ছিলেন এবং নামাজের বিরতি দেওয়ার প্রশ্নটি সম্পূর্ণভাবে এড়িয়ে যাচ্ছিলেন।[৬৯] কিন্তু তার এই এড়িয়ে যাওয়ার মনোভাব লক্ষ্য করে শামসুল হক দ্বিগুণ উৎসাহে নামাজের বিরতির কথা বারবার বলায় ঘরের মধ্যে এক দারুণ অপ্রীতিকর অবস্থার উদ্ভব হয়।[৭০] নানা উত্তেজনা সত্ত্বেও জিন্নাহ এবং রাষ্ট্রভাষা কর্ম-পরিষদের সদস্যদের মধ্যে বিতর্ক ৭-১৫ মিনিট পর্যন্ত অব্যাহত থাকে।[৭১] শামসুল হকের নামাজ প্রস্তাবের ফলে আলোচনার মধ্যে অন্য জাতীয় জটিলতার সৃষ্টি না হলে তা হয়তো আরো কিছুক্ষণ স্থায়ী হতো।

এই সাক্ষাৎকারের সময় রাষ্ট্রভাষা কর্ম-পরিষদের পক্ষ থেকে জিন্নাহর কাছে নিম্নলিখিত স্মারকলিপিটি পেশ করা হয়:

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের একমাত্র মুসলমান যুবকদের লইয়া গঠিত এই কর্মপরিষদ মনে করেন যে, বাংলা পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিত। কারণ প্রথমত, তাঁহারা মনে করেন যে, উহা পাকিস্তানের সমগ্র জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশের ভাষা এবং পাকিস্তান জনগণের রাষ্ট্র হওয়ায় অধিকাংশ লোকের দাবী মানিয়া লওয়া উচিত। দ্বিতীয়ত, আধুনিক যুগে কোন কোন রাষ্ট্রে একাধিক ভাষা রাষ্ট্রভাষা হিসাবে গৃহীত হইয়াছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ নিম্নোক্ত কয়েকটি দেশের নাম করা যায়: বেলজিয়াম (ফ্লেমিং ও ফরাসী ভাষা), কানাডা (ইংরেজী ও ফরাসী ভাষা), সুইজারল্যান্ড (ফরাসী, জার্মান ও ইতালীয় ভাষা), দক্ষিণ আফ্রিকা (ইংরেজী ও আফ্রিকান ভাষা), মিসর (ফরাসী ও আরবী ভাষা), শ্যামা (থাই ও ইংরেজী ভাষা)। এতদ্ব্যতীত সোভিয়েট রাশিয়া ১৭টি ভাষা রাষ্ট্রভাষা হিসাবে গ্রহণ করিয়াছে।

তৃতীয়ত, এই ডোমিনিয়নের সমস্ত প্রাদেশিক ভাষার মধ্যে একমাত্র বাংলা ভাখা রাষ্ট্রভাষা স্থান অধিকার করার পক্ষে উপযুক্ত। কারণ সম্পদের দিক বিবেচনায় এই ভাষাকে পৃথিবীর মধ্যে সপ্তম স্থান দেওয়া হইয়াছে।

চতুর্থত, আলাওয়াল, নজরুল ইসলাম, কায়কোবাদ, সৈয়দ এমদাদ আলী, ওয়াজেদ আলী, জসিমউদ্দীন ও আরো অনেক মুসলমান কবি ও সাহিত্যিক তাঁহাদের রচনা সম্ভার দ্বারা এই ভাষাকে সমৃদ্ধিশালী করিয়াছেন।

পঞ্চমত, বাংলার সুলতান হুসেন শাহ, সংস্কৃত ভাষার প্রতিদ্বন্দ্বিতা সত্ত্বেও এই ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার পর্যায়ে উন্নীত করিয়াছিলেন এবং এই ভাষার শব্দ সম্পদের মধ্যে শতকরা ৫০ ভাগ পারসিক ও আরবী ভাষা হইতে গৃহীত।

উপসংহারে আমরা বলিতে চাই যে, যে কোন পূর্ণ গণতান্ত্রিক দেশে প্রত্যেক নাগরিকের কয়েকটি মৌলিক অধিকার আছে। কাজেই যে পর্যন্ত না আমাদের অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত হয় সে পর্যন্ত বাংলা ভাষার জন্যে এই আন্দোলন চালাইয়া যাওয়া হইবে।*

[* যুগান্তর (কলকাতা) ২/৪/১৯৪৮]

জিন্নাহর কাছে প্রদত্ত এই স্মারকলিপিটিতে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে বাংলা ভাষার দাবী উপস্থিত করা হলেও তার মধ্যে সাম্প্রদায়িক প্রভাব সহজেই লক্ষ্যণীয়। বাংলা ভাষার স্বীকৃতির স্বপক্ষে যুক্তিস্বরূপ তাঁরা কেবলমাত্র কয়েকজন মুসলমান কবি সাহিত্যিকের রচনার উল্লেখ করেছেন। তাঁরা আরো বলেছেন যে, মুসলমান সুলতান হুসেন শাহ বাংলা ভাষার পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন এবং বাংলা ভাষার মধ্যে শতকরা ৫০ ভাগ শব্দই আরবী ফারসী। শতকরা ৫০ ভাগ না হলেও বাংলা ভাষাতে আরবী ফারসী শব্দ প্রচুর আছে, মুসলমান কবি সাহিত্যিকদের রচনায় বাংলা ভাষা যথেষ্ট সমৃদ্ধ এবং সুলতান হুসেন শাহ বাঙলা ভাষার উন্নতির প্রাথমিক পর্যায়ে তার পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন, এ সবই সত্য। কিন্তু তবু বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার যৌক্তিকতা হিসাবে অন্যান্য বিবেচনার উপর গুরুত্ব না দিয়ে এগুলির উপর গুরুত্ব দেওয়া এবং রাষ্ট্রভাষা কর্ম-পরিষদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের ‘একমাত্র মুসলমান যুবকদের দ্বারা গঠিত’ এই কথার মাধ্যমে কর্ম-পরিষদের সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গীর কিছুটা পরিচয় পাওয়া যায়।

রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের নেতৃত্বে যে সব ছাত্র এবং অছাত্র প্রতিষ্ঠানের নেতারা ছিলেন, তাঁর মাত্র কয়েক মাস পূর্বেও মুসলিম লীগ রাজনীতির সাথে ছিলেন ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমেই তাঁরা সর্বপ্রথম একটি সত্যিকার গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। ভাষা আন্দোলন মূলতঃ একটি অসাম্প্রদায়িক আন্দোলন হলেও রাতারাতি কর্মীদের দৃষ্টিভঙ্গী পরিবর্তিত হয়নি এবং সেটা সম্ভবও ছিলো না। সমস্যাটিকে সেইভাবে দেখা খুবই স্বাভাবিক। উপরন্তু কর্ম-পরিষদের মধ্যে আবুল কাসেমের মতো কয়েকজন প্রভাবশালী সদস্য ছিলেন, যাঁদের দৃষ্টিভঙ্গী ছিলো পুরোপুরি সাম্প্রদায়িক। এইসব কারণে স্মারকলিপিটি অসম্পূর্ণভাবে সাম্প্রদায়িকতার প্রভাবমুক্ত হয়নি।

দ্বিতীয়ত, আরবী ফারসী শব্দ, মুসলমান সাহিত্যিকদের রচনা এবং হুসেন শাহের পৃষ্ঠপোষকতার উল্লেখ, সরকার এবং প্রতিক্রিয়াশীল মহলের বাংলা-বিরোধী প্রচারণাকে খণ্ডন করার জন্যেও কিছুটা প্রয়োজন হয়েছিল। বাংলা ভাষার সঙ্গে ইসলামের যে কোন সম্পর্ক নেই, বস্তুত সে ভাষা যে ইসলামী সংস্কৃতিবিরোধী, এই প্রচারণায় বাংলা ভাষা বিরোধীরা অত্যন্ত মুখর হয়েছিলো। এর ফলেই হয়তো বাংলা ভাষার সাথে মুসলমানদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কথা স্মারকলিপিতে বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়।

কর্ম-পরিষদ ‘কেবলমাত্র মুসলমান’ যুবকদের দ্বারা গঠিত, এ বক্তব্যের চরিত্র সম্পূর্ণভাবে সাম্প্রদায়িক হলেও অন্যান্য যুক্তিগুলি সম্পূর্ণ গুরুত্বহীন নয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার স্বপক্ষে অন্যান্য বহু যুক্তি ছিলো, যেগুলি গণতান্ত্রিক কর্মী ও নেতারা জিন্নাহর সামনে সরাসরি উপস্থিত করতে পারতেন। প্রকৃতপক্ষে তাঁরা সেটা করা থেকে বিরত থাকেন। এর ফলে তাঁরা সাম্প্রদায়িক যুক্তিকে সাম্প্রদায়িক যুক্তির দ্বারাই মোটামুটিভাবে খণ্ডন করার চেষ্টা করেন। তত্ত্বগতভাবে অন্য কোন সুষ্ঠু বক্তব্য তাঁরা এই স্মারকলিপিটির মধ্যে উপস্থিত করতে সক্ষম হননি।

৫. ছাত্র প্রতিনিধিদের সাথে আলোচনা

ঢাকা অবস্থানকালে প্রতিনিধিস্থানীয় ছাত্রদের সাথে সাক্ষাতের জন্যে জিন্নাহ্ ইচ্ছে প্রকাশ করেন। সেই অনুসারে বিভিন্ন ছাত্রাবাসের প্রভোস্টদের মাধ্যমে ছাত্রাবাসগুলির সহ-সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকদেরকে এই সাক্ষাৎকারের কথা বলা হয়। কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় ইউনিয়নের সহ-সভাপতিও এই সাক্ষাৎকারের জন্যে আমন্ত্রিত হন।[৭২] ২০শে মার্চ জিন্নাহর সাথে এই ছাত্র প্রতিনিধিদলটি চীফ সেক্রেটারীর বাসভবনে সাক্ষাৎ করেন।[৭৩]

প্রত্যেকের সাথে পৃথক পৃথকভাবে পরিচিত হওয়ার পর জিন্নাহ্ সকলকে জিজ্ঞেস করেন, সেই অবস্থায় তিনি ছাত্রদের জন্যে কি করতে পারেন। মহম্মদ তোয়াহা এর জবাবে তাকে বলেন যে, ইচ্ছে করলে তিনি একটি ছাত্র সমাবেশে বক্তৃতা দিতে পারেন। জিন্নাহ বলেন, এ বিষয়ে তিনি চিন্তা করে দেখবেন।[৭৪]

পনেরো-বিশ মিনিটকাল স্থায়ী এই সাক্ষাৎকারে রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে কোন আলোচনা কোন পক্ষ থেকেই উত্থাপন করা হয়নি। জিন্নাহ্ ব্যক্তিগতভাবে প্রত্যেকের কুশল জিজ্ঞাসা করেন এবং অত্যন্ত মামুলী কিছু কথাবার্তার পর তিনি চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ান।[৭৫] এই সময় মহম্মদ তোয়াহা তাঁর হাতে ইংরেজীতে লিখিত একটি স্মারকলিপি দিয়ে বলেন, ‘ভাষা সমস্যার উপর এটি একটি স্মারকলিপি। আপনি এটি পড়ে দেখবেন।’ জিন্নাহ্ স্মারকলিপিটি হাতে নিয়ে পাশের টেবিলে রেখে দেন, কিন্তু সে বিষয়ে কোন মন্তব্য করেন না।[৭৬] এই স্মারকলিপিটিই রাষ্ট্রভাষা কর্ম-পরিষদের পক্ষ থেকে আবার তাঁর হাতে ২৪শে মার্চ তারিখে দেওয়া হয়।[৭৭]

ঘর ছেড়ে সকলে কিছুটা বাইরে আসার পর জিন্নাহ্ মিলিটারি সেক্রেটারী হঠাৎ দৌড়ে এসে মহম্মদ তোয়াহাকে বলেন যে, অন্য সকলে চলে যাক, কিন্তু তোয়াহা এবং নজরুল ইসলাম যেন তৎক্ষণাৎ কায়েদে আজমের সাথে আর একবার দেখা করেন। মিলিটারি সেক্রেটারীর এই কথা শুনে তাঁরা দুজনে ভেতরে গিয়ে দাঁড়াতে জিন্নাহ্ তাঁদের বললেন যে, সাক্ষাৎকারের ব্যাপারে একটা ভুল হয়ে গেছে। তিনি শুধু মুসলমান ছাত্রদের সাথে দেখা করতে চেয়েছিলেন, হিন্দু ছাত্রদের সাথে নয়।[৭৮]

প্রত্যেক ছাত্রাবাসের সহ-সভাপতি এবং সম্পাদককে জিন্নাহর সাথে সাক্ষাতের জন্যে আমন্ত্রণ করায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ ছাত্রবাসের দুইজন হিন্দু ছাত্র প্রতিনিধিও সেদিন অন্য ছাত্রদের সাথে গিয়েছিলেন। ছাত্রদের সাথে জিন্নাহ্ যে সব বিষয়ে আলোচনা করতে চেয়েছিলেন সেগুলি তিনি হিন্দু ছাত্রদের সামনে আলোচনার জন্যে মোটেই প্রস্তুত ছিলেন না এবং তার জন্যে সাক্ষাৎকারের সময় বিশেষ কোন আলোচনা না করে অল্পক্ষণ পরেই সাক্ষাৎকার তিনি শেষ করে দেন।[৭৯

মহম্মদ তোয়াহা জিন্নাহ্ কথা শুনে তাঁকে বলেন যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা বিভিন্ন ছাত্রাবাসে থাকে এবং বার্ষিক নির্বাচনের মাধ্যমে নিজেদের প্রতিনিধি নির্বাচন করে। সেই নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মধ্যে হিন্দু ছাত্রদের জগন্নাথ ছাত্রাবাসের প্রতিনিধিরাও ছিলেন।[৮০]

জিন্নাহ্ তখন তোয়াহাকে বলেন যে, সেই জাতীয় কোন ছাত্র প্রতিনিধিদের সাথে তিনি আলোচনা করতে চাননি। তিনি চান মুসলিম ছাত্র রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের ছাত্রদের সাথে ছাত্র রাজনীতি বিষয়ে কিছু আলাপ-আলোচনা করতে।[৮১] তোয়াহা তখন তাঁকে বলেন যে, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ সেই জাতীয় প্রতিষ্ঠান এবং তাদের প্রতিনিধিদের সাথে তিনি আলাপ করতে পারেন। এই কথায় জিন্নাহ্ বলেন যে, তাদের সাথেই আলোচনা করা দরকার। তোয়াহা তাঁকে জানান যে, মুসলিম ছাত্রলীগ প্রকৃতপক্ষে দুইভাবে বিভক্ত। জিন্নাহ্ তখন তোয়াহা এবং নজরুল ইসলামের ঠিকানা লিখে রাখেন এবং বলেন যে, দুই অংশের ছাত্র সংগঠনের সাথেই তিনি সাক্ষাৎ করবেন।[৮২]

শাহ আজিজুর রহমানরা সেই সময় নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ নামে একটি স্বতন্ত্র ছাত্র প্রতিষ্ঠান গঠন করেছিলেন। এই প্রতিষ্ঠানটি মোটামুটিভবে কলকাতা থেকে আগত বঙ্গীয় মুসলিম ছাত্রলীগের নাজিমুদ্দীন সমর্থক উপদলীয় নেতৃত্বের আওতাভুক্ত ছিলো। সেই হিসাবে ঢাকার ছাত্র সম্প্রদায়ের মধ্যে তার বিশেষ কোন প্রভাব ছিলো না। কিন্তু সে প্রভাব না থাকলেও পার্লামেন্টারী রাজনীতির সাথে তাদের যথেস্ট যোগাযোগ ছিলো।

জিন্নাহ এই ছাত্র প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের সাথে ২২শে মার্চ সাক্ষাৎ করেন। এই দলটিতে তখন শাহ্ আজিজুর রহমান ব্যতীত দেলাওয়ার হোসেন, লুৎফর রহমান, সুলতান হোসেন খান, আবদুল মালেক এবং মাজহারুল কুদ্দুসও উপস্থিত ছিলেন। জিন্নাহ তাঁদের সাথে ছাত্র ঐক্য এবং অন্যান্য বিষয়ে আলাপ করেন এবং পুনরায় তাদের সাথে দেখা করবেন, একথা জানান।[৮৩]

এর পর জিন্নাহ্ মিলিটারি সেক্রেটারী মহম্মদ তোয়াহাকে চিঠি দিয়ে জানান যে, তিনি তাঁদের সাথে সাক্ষাৎ করতে চান। চিঠিতে তোয়াহাকে অনুরোধ করা হয়, তিনি যেন অন্য আর একজন ছাত্র প্রতিনিধিকে তার সাথে নিয়ে আসেন।[৮৪] সেই কথামতো তোয়াহা আলোচনার জন্য মিলিটাররি সেক্রেটারীর কাছে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের আহ্বায়ক নঈমুদ্দীন আহমদের নাম পাঠান[৮৫] শাহ আজিজুর রহমানও মহম্মদ তোয়াহার মতো মিলিটারী সেক্রেটারীর চিঠি পান এবং তাঁর দলভুক্ত মাজহারুল কুদ্দুসের নাম দেন।[৮৬]

পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ এবং নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের প্রতিনিধিদের সাথে জিন্নাহর এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ২৩শে মার্চ।[৮৭]

এই আলোচনাকালে জিন্নাহ ছাত্রদেরকে যা বলেন তার সারমর্ম এই যে, তিনি মুসলমান ছাত্রদের মধ্যে বিভেদের পরিবর্তে একতা চান। তিনি বলেন যে, আল্লাহ্ যদি পাকিস্তানকে রক্ষা না করতেন, তাহলে পাকিস্তানের জন্ম দিবসেই তার সমগ্র কাঠামো ভেঙে পড়তো। পাকিস্তান একটি শিশু রাষ্ট্র, কাজেই তাকে রক্ষা করতে হলে আভ্যন্তরীণ ঐক্য সব থেকে বড়ো প্রয়োজন। রাষ্ট্র গঠন করার জন্যে ছাত্রদের সব রকম আন্দোলন ও সংগঠনের সামনে থাকতে হবে এবং সে কাজ তাদের করতে হবে ঐক্যবদ্ধভাবে। এই উদ্দেশ্য সফল করার জন্য প্রয়োজন দুই ছাত্র প্রতিষ্ঠানকে ভেঙে একটিমাত্র প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমস্ত মুসলমান ছাত্রের একতাবদ্ধ হওয়া।[৮৮]

জিন্নাহ্ উপরোক্ত বক্তব্য শোনার পর তোয়াহা এবং নঈমুদ্দীন তাঁকে বলেন যে, ছাত্র ঐক্য তাঁরাও চান, কিন্তু যে কোন ঐক্য প্রচেষ্টার পূর্বে দেখা দরকার আগে যে সাংগঠনিক ঐক্য ছিলো, তাতে ভাঙন ধরলো কি কারণে। সেটা জানলে দুটি ছাত্র প্রতিষ্ঠান কিভাবে সম্ভব হলো, তাও পরিষ্কারভাবে বোঝা যাবে। এর জবাবে জিন্নাহ, তাঁদেরকে বলেন, ‘ঠিক আছে, তোমরা চিন্তা করো। আমি পরে আবার তোমাদের সাথে দেখা করবো।’[৮৯]

এরপর ছাত্র প্রতিনিধিদেরকে জিন্নাহ্ আলোচনার জন্যে আবার ডেকে পাঠান। ঐ দিন শাহ আজিজের সাথে ছিলেন মাজহারুল কুদ্দুস, কিন্তু মহম্মদ তোয়াহার সাথে নঈমুদ্দীনের পরিবর্তে ছিলেন বরিশালের আবদুর রহমান চৌধুরী। তাঁদেরকে পূর্বে যে প্রবেশপত্র দেওয়া হয়েছিলো তাতে তোয়াহা এবং নঈমুদ্দীনের নাম লেখা ছিলো। নঈমুদ্দীনের পরিবর্তে আবদুর রহমান চৌধুরী যে তোয়াহার সাথে যাবেন, এ কথা পূর্বে তাঁদেরকে জানানো হয়নি। কাজেই আবদুর রহমান চৌধুরীর প্রবেশপত্রের জন্যে কিছুক্ষণ বিলম্ব হয়।[৯০]

এইবার জিন্নাহ, প্রথমে ভিন্ন ভিন্নভাবে দুই দলের সাথে আলাপ করলেন। এর পরে দুই দলকেই একত্রিত করে নিয়ে বসলেন।[৯১] তোয়াহা এবং আবদুর রহমান চৌধুরী আলোচনা প্রসঙ্গে তাঁকে বললেন যে, নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের সংগঠন হিসাবে বিশেষ কোন অস্তিত্বই নেই। এর নেতারা সকলেই বিভিন্ন অফিসে চাকরি করে। তাদের দলভুক্ত বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম ছাত্রলীগের শেষ সভাপতি শামসুর হুদা চৌধুরী নিজে এখন রেডিও পাকিস্তানের কর্মচারী। অন্যদেরও সেই অবস্থা, কাজেই ঐ সংগঠনের সত্যিকার কোন অস্তিত্ব নেই। তোয়াহাদের এই যুক্তিকে খণ্ডন করার জন্যে শাহ আজিজুর রহমানও তাদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ উত্থাপন করেন।[৯২]

এই সমস্ত আলোচনার মধ্যে জিন্নাহ্ এক পর্যায়ে বলে ওঠেন, নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ সংগঠন হিসাবে মৃত। তোমরা সকলে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগে যোগদান করে একত্রে একটি সংগঠন গড়ে তোলো। এরপর এই নোতুন সংগঠনকে আশীর্বাদ জানিয়ে তিনি একটি বাণী দেন। তাতে তিনি বলেন যে, এই সংকটময় মুহূর্তে ঐক্যের প্রয়োজনই সব থেকে বেশী। এ ছাড়া তিনি উপস্থিত চারজন নেতাকে দিয়ে একটি ছোট ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করিয়ে নেন। তাতে বলা হয় যে, তাঁরা সকলে মিলিতভাবে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের মধ্যে কাজ করে যাবেন।[৯৩]

ছোট ঘোষণাটি স্বাক্ষরিত হয়ে গেলেও জিন্নাহ্ নিজের বাণী সংবাদপত্রের মাধ্যমে প্রচার করতে নিষেধ করেছিলেন। চূড়ান্তভাবে সমস্ত কিছু ঠিকঠাক করার পরই তিনি সেটাকে সংবাদপত্রে দেওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন।[৯৪]

কাগজটিতে স্বাক্ষর দেওয়ার পরও শাহ আজিজুর রহমান জিন্নাহকে বার বার বলতে থাকেন যে, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগের নেতা এবং কর্মীরা যদি কায়েদে আজমকে বিশ্রী ভাষায় গালাগালি করা বন্ধ রাখেন, তাহলে সকলের সাথে মিলিতভাবে কাজ করে যেতে তাঁদের কোন আপত্তি নেই। শাহ আজিজের এই বক্তব্যকে সম্পূর্ণ মিথ্যা বলে অভিহিত করে তোয়াহা বলেন, ‘আমাদের কায়েদে আজমকে কেউই বিশ্রী ভাষায় গালাগালি করছে না।’ এইসব তর্কাতর্কির মুখে জিন্নাহ ছাত্রদেরকে বলেন, ‘তোমাদের কায়েদে আজমকে কেউ গালাগালি দিলে তিনি কিছুই মনে করবেন না।[৯৫]

ছাত্রদের সাথে জিন্নাহ্ ২৪ তারিখের সাক্ষাৎকার এখানেই শেষ হয়। এর ঠিক পরই তিনি রাষ্ট্রভাষা কর্ম-পরিষদের প্রতিনিধিদের সাক্ষাৎ দান করেন।

জিন্নাহ্ ২৫শে মার্চ চট্টগ্রাম যান এবং ২৭ তারিখে সেখান থেকে ঢাকা ফিরে আসেন। সেদিনই তিনি ছাত্রদের বৈঠকের জন্য আবার ডেকে পাঠান। শাহ আজিজুর রহমান, মাজহারুল কুদ্দুস, মহম্মদ তোয়াহা এবং আবদুর রহমান চৌধুরী – এই চারজন সেদিন চীফ সেক্রেটারীর বাসভবনে নির্ধারিত সময়ে উপস্থিত হন।[৯৬]

শাহ আজিজুর রহমান সেদিন তাঁর সাথে দৈনিক আজাদ এবং অন্যান্য পত্রিকার অনেকগুলি কপি নিয়ে গিয়েছিলেন।[৯৭] শাহ আজিজ বলেন যে, তাঁরা আজাদের যে কপিগুলি নিয়ে গিয়েছিলেন, সেগুলিতে তাঁদের কার্যকলাপ সম্পর্কিত অনেক রিপোর্ট ছাপা হয়েছিলো, এবং সেগুলি তাঁরা জিন্নাহকে দেখাতে চেয়েছিলেন।[৯৮] তোয়াহা এবং আবদুর রহমান চৌধুরী কিন্তু বলেন যে, আজাদের কপিগুলি শাহ আজিজেরা নিজেদের কার্যকলাপের রিপোর্ট দাখিল করার জন্যে নিয়ে যাননি। তাঁরা সেগুলি নিয়ে গিয়েছিলেন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ এবং তার নেতৃস্থানীয় কর্মদেরকে কমিউনিস্ট প্রমাণ করার জন্যে।[৯৯]

কিছুদিন পূর্বেই ফেব্রুয়ারীর শেষ সপ্তাহে কলকাতায় যে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া যুব সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় তাতে পূর্ব পাকিস্তান থেকে একটি প্রতিনিধি দল যায়। তাতে তোয়াহারই নেতৃত্ব করার কথা ছিলো, কিন্তু বিশেষ অসুবিধার জন্য শেষ পর্যন্ত তাঁর পক্ষে সম্মেলনে যোগদান সম্ভব হয়নি।[১০০] তাঁর পরিবর্তে আবদুর রহমান চৌধুরী দলটির নেতৃত্ব করেন।[১০১] শাহ আজিজেরা সম্মেলনে যোগদান করলেও তাঁদেরকে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধি হিসাবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। সে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিলো আবদুর রহমান চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন গ্রুপটিকে।[১০২] সেই হিসাবে কলকাতার কাগজগুলিতে তাঁদের সম্পর্কে রিপোর্ট এবং তাঁদের ছবি ছাপা হয়েছিলো। ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেসও ঐ একই সময়ে কলকাতায় অনুষ্ঠিত হয় এবং তার সাথে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া যুব সম্মেলনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিলো। এজন্যে সাধারণভাবে সেই সম্মেলনকে এবং বিশেষভাবে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধিদলকে আক্রমণ করে আজাদে অনেক কিছু ছাপা হয়। শাহ আজিজেরা জিন্নাহকে এই সমস্ত রিপোর্ট এবং ছবি দেখিয়ে তাঁর কাছে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ এবং তার নেতৃস্থানীয় কর্মীদেরকে কমিউনিস্ট এবং তাদের সাথে আঁতাতকারী বলে প্রমাণ করতে চেষ্টা করেন। তাঁদের এই প্রচেষ্টা শেষ পর্যন্ত বিফল হয়নি।[১০৩]

২৭শে মার্চের এই সাক্ষাৎকারের সময় জিন্নাহ প্রথমে শাহ আজিজুর রহমান এবং মাজহারুল কুন্দুসকে আলোচনার জন্যে ভেতরে ডেকে নিয়ে যান। শাহ আজিজেরা তাদের কাগজপত্রের বাণ্ডিলসহ জিন্নাহর সাথে বেশ কিছুক্ষণ অবস্থান ও আলোচনা করেন।[১০৪]

শাহ আজিজেরা জিন্নাহর সাথে আলাপ শেষ করে বাইরে আসার পর মহম্মদ তোয়াহা এবং আবদুর রহমান চৌধুরীকে ভেতরে ডাকা হয়। এবার কিন্তু জিন্নাহ্ আর তাঁদের সাথে সাক্ষাৎ করলেন না। তাঁর মিলিটারি সেক্রেটারী তাঁদের কাছে এসে বললেন, আপনারা ঐক্যবদ্ধ হতে না পারার জন্যে কায়েদে আজম দুঃখ প্রকাশ করেছেন।[১০৫]

শাহ আজিজুর রহমান এবং মাজহারুল কুদ্দুস কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগকে কমিউনিস্ট প্রতিষ্ঠান হিসাবে চিহ্নিত করার চেষ্টা এবং ২৪ তারিখে রাষ্ট্রভাষা কর্ম-পরিষদের সাথে সাক্ষাৎকারের সময় জিন্নাহর সাথে তোয়াহা এবং অন্যান্যদের বিতর্ক-এই দুই কারণে তিনি তোয়াহা এবং মুসলিম ছাত্রলীগের প্রতি নিজের মনোভাব পরিবর্তন করে মুসলিম ছাত্রদের মধ্যে ঐক্য স্থাপনের প্রচেষ্টা থেকে বিরত হন। মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারী পার্টির কিছু লোকজন এবং লীগদলীয় অন্যান্য নেতাদেরও এ ব্যাপারে একটি সক্রিয় ভূমিকা ছিল।[১০৬]

এর পূর্বের সাক্ষাৎকারের সময় তিনি যে বাণী দিয়েছিলেন, সে সম্পর্কে সংবাদপত্রে কিছু প্রকাশ না করার জন্যে জিন্নাহ্ অনুরোধ করেছিলেন, কিন্তু আবদুর রহমান চৌধুরী সে অনুরোধ শেষ পর্যন্ত রক্ষা করেননি। তিনি সংবাদপত্রে এই মর্মে একটি বিবৃতি দেন যে, কায়েদে আজম ছাত্র সম্প্রদায়ের মধ্যে রাজনৈতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টাকে আশীর্বাদ জানিয়েছেন এবং পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগকেই স্বীকৃতি দিয়েছেন। কাজেই সকলের উচিত পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগে যোগদান করে ছাত্র ঐক্যকে শক্তিশালী করা।[১০৭]

৬. জিন্নাহর বিদায়বাণী ও পূর্ব-বাঙলা সফরের ফলাফল

পূর্ব-বাঙলার সফর শেষে করাচী রওয়ানা হওয়ার প্রাক্কালে জিন্নাহ, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের উদ্দেশ্যে রেডিও পাকিস্তানের মাধ্যমে ২৮শে মার্চ একটি বিদায় বাণী প্রচার করেন।[১০৮] তাতে অন্যান্য বক্তব্যের সাথে রাষ্ট্রভাষার প্রশ্ন এবং আন্দোলন সম্পর্কিত বিষয়ে তিনি যে অভিমত ব্যক্ত করেন, তার মধ্যে নোতুনত্ব না থাকলেও তাঁর দৃষ্টিভঙ্গী ও চিন্তার পরিধির সাথে পরিচয় লাভের জন্যে পুনরুক্তি হলেও তা নিঃসন্দেহে উল্লেখযোগ্য

এক শ্রেণীর লোকের মধ্যে নব-অর্জিত স্বাধীনতাকে যথেচ্ছাচারের অধিকার হিসাবে দেখার একটা দুঃখজনক প্রবণতা আমি লক্ষ্য করছি। এ কথা সত্য যে, বিদেশী রাজত্বের অবসানের পর জনগণই এখন তাদের ভাগ্যের নিয়ন্তা। শাসনতান্ত্রিক পদ্ধতিতে যে কোন সরকার বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা তাদের আছে। তার অর্থ আবার এই নয় যে, সাধারণ ভোটে নির্বাচিত সরকারের উপর এখন যে কোন একদল লোক নিজের ইচ্ছাকে বেআইনীভাবে চাপিয়ে দিতে পারবে। সরকার এবং তার নীতি প্রাদেশিক বিধান সভার নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ভোটের দ্বারা পরিবর্তিত হতে পারে। শুধু তাই নয়, কোন সরকারের পক্ষে এক মুহূর্তের জন্য ঐ জাতীয় উচ্ছৃঙ্খল দায়িত্বজ্ঞানহীন লোকদের দলবদ্ধ গুণ্ডামী এবং রাজত্ব সহ্য না করে তার সমস্ত শক্তি দিয়ে এই অবস্থার মোকাবেলা করা উচিত। এক্ষেত্রে আমি বিশেষভাবে ভাষার বিতর্কের কথা ভাবছি, যেটা এই প্রদেশের বিভিন্ন স্থানে অযথা অনেক উত্তেজনা ও সমস্যা সৃষ্টি করেছে। এই অবস্থাকে আয়ত্তে না আনলে এর ফলাফল ভয়ংকর হতে পারে। এ প্রদেশের সরকারী ভাষা কি হওয়া উচিত, সেটা আপনাদের প্রতিনিধিরাই স্থির করবেন। কিন্তু এই ভাষার বিতর্ক আসলে প্রাদেশিকতার বৃহত্তর বিতর্কের একটি দিক। আমি এ বিষয়ে নিশ্চিত যে, আপনারা একথা নিশ্চয় উপলব্ধি করেন যে পাকিস্তানের মতো একটি নবগঠিত রাষ্ট্র, যার দুই অংশ পরস্পর থেকে অনেকখানি দূরে, যেখানে সকল অংশের সকল নাগরিকের মধ্যেকার একতা এবং সংহতি, তার প্রগতি, এমনকি অস্তিত্বের জন্যেও অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। মুসলিম জাতির ঐক্যের মূর্তরূপই হলো পাকিস্তান এবং সেইভাবেই তা বজায় থাকবে। মুসলমান হিসাবে সেই ঐক্যকে আমাদের রক্ষা করতে হবে। আমরা যদি প্রথমে নিজেদেরকে বাঙালী, পাঞ্জাবী, সিন্ধী ইত্যাদি মনে করে শুধু প্রসঙ্গক্রমে নিজেদেরকে পাকিস্তানী মনে করি, তাহলে পাকিস্তান ধ্বংস হতে বাধ্য। মনে করবেন এটা একটা দুর্বোধ্য কথা : এই সম্ভাবনা সম্পর্কে আমাদের শত্রুরা খুবই সচেতন এবং আমি আপনাদের সতর্ক করে দিয়ে বলতে চাই যে, তারা ইতিমধ্যেই এ কাজে ব্যস্ত রয়েছে। আমি আপনাদের সোজাসুজি জিজ্ঞেস করবো : যে সমস্ত ভারতীয় রাজনৈতিক সংস্থা ও প্রেসের মুখপত্র সর্বতোভাবে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলো, তারাই যখন পূর্ব বাঙলার মুসলমানদের ‘ন্যায়সঙ্গত দাবীর প্রতি তাদের বিবেকের সমর্থন জানাতে আসে, তখন সেটাকে আপনাদের কাছে একটা অশুভ ব্যাপারে বলে কি মনে হয় না? একথা কি অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে বোঝা যায় না যে, পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠানকে রোধ করতে অক্ষম হয়ে এই সমস্ত সংস্থাগুলি বর্তমানে প্রচারণার মাধ্যমে মুসলমান ভাইদেরকে একে অপরের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে ভেতর থেকে পাকিস্তানকে ধ্বংস করার চেষ্টা করছে? আমি চাই, যাতে আপনারা প্রাদেশিকতার এই হলাহল, যা আমাদের শত্রুরা আমাদের রাষ্ট্রের মধ্যে ঢুকিয়ে দিতে চায়, তার সম্পর্কে সতর্ক থাকুন।[১০৯]

জিন্নাহর পূর্ব-বাঙলা সফরের অন্যতম প্রধান ফল পূর্ব-বাঙলা মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারী পার্টির অন্তর্দ্বন্দ্বের অবসান। ঢাকায় অবস্থানকালে জিন্নাহ্ মহম্মদ আলীর সাথে ব্যক্তিগতভাবে আলাপ করেন এবং তাকে বার্মায় পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত হিসাবে পাঠিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।[১১০] তফজ্জল আলী, আবদুল মালেক প্রভৃতির সাথে মন্ত্রীত্ব ইত্যদির প্রশ্ন নিয়ে কোন সরাসরি আলাপ না হলেও তাঁদের সাথে একটা আপোষ রফায় উপনীত হওয়ার জন্যে খাজা নাজিমুদ্দীনকে তিনি নির্দেশ দেন।[১১১]

মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারী পার্টির সদস্যদের সাথেও তিনি মিলিত হন এবং সেই সমাবেশে ভাষণদান করতে গিয়ে বলেন যে, তাঁরা যেন নিজেদেরকে বাঙালী, পাঞ্জাবী, সিন্ধী ইত্যাদি মনে না করে খাঁটি পাকিস্তানী হিসাবে রাষ্ট্রের ঐক্য ও শৃঙ্খলা রক্ষার কাজে মনোনিবেশ করেন। পার্লামেন্টারী পার্টির আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের অবসান ঘটানোর জন্যে তিনি সকলের কাছে আবেদন করেন। সেই প্রসঙ্গে সরকারের বিরুদ্ধে তাদের কোন অভিযোগ থাকলে, সেটি সরাসরি তাঁকে জানানোর জন্যে তিনি সদস্যদেরকে উপদেশ দেন।[১১২]

এই সময় ডক্টর মালেক জিন্নাহকে জিজ্ঞেস করেন যে, ব্যবস্থাপক সভায় সরকারী লোকদেরকে খোলাখুলিভাবে প্রশ্ন করে বিব্রত করা চলে কিনা। এর উত্তরে তিনি বলেন যে, সে জাতীয় আচরণ শৃঙ্খলা বহির্ভূত এবং সেই হিসাবে তা’ কিছুতেই অনুমোদন করা যায় না।[১১৩] ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকার, পার্লামেন্টারী পার্টিতে ঐক্যের উপর গুরুত্ব দান এবং সর্বোপরি পার্টির আভ্যন্তরীণ কলহ মিটিয়ে নেওয়ার জন্যে নাজিমুদ্দীনের প্রতি নির্দেশের ফলে মহম্মদ আলী বার্মায় পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূতের পদ এবং ডক্টর মালেক এবং তফজ্জল আলী প্রাদেশিক সরকারের মন্ত্রীত্বের পদ লাভ করেন। পার্লামেন্টারী উপদলের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা এইভাবে গদিনশীন হওয়ার ফলে মুসলিম লীগের পার্লামেন্টারী পার্টিতে আভ্যন্তরীণ গোলযোগের মোটামুটি অবসান ঘটে এবং তার ফলে নাজিমুদ্দীন সরকারের শক্তি অনেকখানি বৃদ্ধি লাভ করে। এই শক্তিবৃদ্ধির প্রভাব এপ্রিল মাসে প্রাদেশিক ব্যবস্থাপক সভার অধিবেশন চলাকালে নাজিমুদ্দীন সরকারের আচরণের মধ্যে স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়। উর্দু ও ইংরেজীর সাথে বাংলাকেও জাতীয় পরিষদের সরকারী ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করার ফলে পূর্ব-বাঙলায় ভাষা আন্দোলন একটি রাজনৈতিক আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়। এই আন্দোলনের ফলে প্রাদেশিক সরকার রাষ্ট্রভাষা কর্ম-পরিষদের সাথে এই মর্মে চুক্তিবদ্ধ হতে বাধ্য হন যে, তাঁরা প্রাদেশিক পরিষদের পরবর্তী অধিবেশনে বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার জন্যে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে সুপারিশ করে একটি প্রস্তাব গ্রহণ করবেন। এই চুক্তির ফলে ভাষা আন্দোলনের সাফল্য অনেকখানি নিশ্চিত মনে হওয়ায় রাষ্ট্রভাষা কর্ম-পরিষদ আন্দোলন প্রত্যাহার করেন।

জিন্নাহ্ এই চুক্তি সম্পাদিত হওয়ার মাত্র চারদিন পর ঢাকা সফরে আসেন এবং তার দুই দিন পর ২১শে মার্চ তারিখে রেসকোর্সের সংবর্ধনা সভায় ভাষা আন্দোলন এবং প্রাদেশিক সরকার ও রাষ্ট্রভাষা কর্ম-পরিষদের মধ্যেকার চুক্তিকে সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করেন যে, উর্দু ব্যতীত অন্য কোন ভাষাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসাবে দাবী করার অধিকার পাকিস্তানের কোন নাগরিকের নেই। শুধু তাই নয়, সে দাবী কেউ উত্থাপন করলে, একথা নিশ্চিতভাবে ধরে নেওয়া চলে যে, সেই ব্যক্তি রাষ্ট্রশত্রু, ভারতের পোষা গুপ্তচর এবং সেই হিসাবে নাগরিক অধিকারের অযোগ্য। কাজেই তাকে কঠোর হস্তে দমন করা রাষ্ট্রের পক্ষে একটি অপরিহার্য কর্তব্য।

কেবলমাত্র রেস কোর্সের বক্তৃতাতেই নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন ভাষণে বিভিন্ন প্রতিনিধি দলের সাথে আলাপ আলোচনায় এবং পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি বিদায় বাণীতেও তিনি ঐ একই বক্তব্যের পুনরুক্তি করেন। তাঁর এই আচরণ সত্ত্বেও পূর্ব-বাঙলায় ভাষা আন্দোলন ১৯৪৮ সালে আবার নোতুনভাবে শুরু করা সম্ভব হয়নি। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন – বিরোধী নানা উক্তি এবং পূর্ব-বাঙলার জনসাধারণের বিভিন্ন দাবী-দাওয়াকে প্রাদেশিকতা আখ্যা দিয়ে কেন্দ্ৰীয় সরকারের প্রতি আনুগত্যের আহ্বান সত্ত্বেও জিন্নাহ্ ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা এবং তাঁর প্রতি সাধারণ মানুষের অপরিসীম শ্রদ্ধাই এই পর্যায়ে নোতুন আন্দোলন গঠনের পক্ষে ছিলো মস্ত বাধাস্বরূপ। এই অবস্থায় পরিপূর্ণ সুযোগ নিতে পূর্ব-বাঙলায় প্রাদেশিক সরকার কোন গাফিলতি করেনি।

কিন্তু নিজের ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তাকে জিন্নাহ্ আন্দোলন দমন করার কাজে ব্যবহার করতে সমর্থ হলেও তাঁর বিভিন্ন প্রকার উক্তির ফলে ছাত্র এবং জনসাধারণের মধ্যে তাঁর জনপ্রিয়তা অনেকখানি কমে আসে। শুধু রাষ্ট্রপ্রধান হিসাবেই নয়, পাকিস্তান আন্দোলনে অবিসংবাদী নেতা হিসাবেও পাকিস্তানের বিভিন্ন অংশের গণতান্ত্রিক দাবী-দাওয়াকে তিনি নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে বিচার করবেন, সকলেই তাই আশা করছিলো। কিন্তু তিনি তাদের সে আশা পূর্ণ না করায়, প্রথম পর্যায়ে একটি নিদারুণ হতাশার ভাব সকলকে আচ্ছন্ন করে এবং তার ফলে প্রায় সকলেই আন্দোলনের ক্ষেত্রে কিছুদিনের জন্যে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন।

জিন্নাহ্ ঢাকা পরিত্যাগ করার পর রাষ্ট্রভাষা কর্ম-পরিষদের একটি বৈঠক হয়। সেই বৈঠকে আন্দোলনের পর্যালোচনাকালে ছাত্রলীগ এবং তমদ্দুন মজলিশের সদস্যেরা নিজেদের সংগঠনের কৃতিত্বের উপর জোর দেওয়ার চেষ্টা করেন।[১১৪] তমদ্দুন মজলিশ আন্দোলনের প্রথম পর্যায়ে, বিশেষতঃ যখন সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলো, তখন একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিন্তু মার্চের প্রথম দিক থেকে আন্দোলন রাজনৈতিক চরিত্র পরিগ্রহ করার সাথে সাথে তমদ্দুন মজলিশের গুরুত্ব এবং তাদের নেতৃত্বর প্রভাব উল্লেখযোগ্যভাবে কমে আসে। এই পরবর্তী পর্যায়ে গণতান্ত্রিক যুব লীগভুক্ত কর্মীবৃন্দ, মুসলিম ছাত্র লীগ এবং সাধারণ ছাত্র সমাজই আন্দোলনের নেতৃস্থানীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

আন্দোলনের সময় তমদ্দুন মজলিশের শামসুল আলম এবং মুসলিম ছাত্র লীগের নইমুদ্দীন আহমদ যৌথভাবে রাষ্ট্রভাষা কর্ম-পরিষদের আহ্বায়কের কাজ করেন।[১১৫] এই দু-জনের মধ্যে শামসুল আলমের কাছেই পরিষদের খাতাপত্র এবং অন্যান্য রেকর্ড থাকতো।[১১৬] কর্ম-পরিষদের এই বৈঠকে শামসুল আলম আহ্বায়কের পদে ইস্তফা দেন। কারণ তাঁর মতে আন্দোলন তখন এমন এক পর্যায়ে উপনীত হয়েছিলো, যাতে করে সত্যিকার কিছু করার জন্যে প্রয়োজন ছিলো একটি নোতুন কর্ম-পরিষদ। পুরাতন পরিষদ তাঁর মতে সেদিক থেকে ছিলো সম্পূর্ণ অনুপযুক্ত।[১১৭]

সেই বৈঠকেই শামসুল আমল মহম্মদ তোয়াহার কাছে সমস্ত কাগজপত্র বুঝিয়ে দেন এবং তারপর এমএসসি শেষ বর্ষের ছাত্র আবদুল মান্নান অস্থায়ীভাবে আহ্বায়কের কাজ চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যে মনোনীত হন।[১১৮]

তথ্যসূত্র (সংশোধন করা হয়নি) – তৃতীয় পরিচ্ছেদ: পূর্ব-বাঙলায় মহম্মদ আলী জিন্নাহ

আজাদ, ৬ই আগস্ট, ১৯৪৭ [ভুলবশতঃ জুলাই লেখা হয়েছে]। ইউসুফ আলী চৌধুরী [মোহন মিঞা]।

৩০৬ | বদরুদ্দীন উমর রচনাবলী খণ্ড ২

8

A

মোহন মিঞা, শাহ আজিজুর রহমান, মাহমুদ আলী।

মাহমুদ আলী।

নওবেলাল, ৮ই এপ্রিল, ১৯৪৮।

মোহন মিঞা, মাহমুদ আলী, শাহ আজিজুর রহমান।

লেখকের কাছে এক সাক্ষাৎকারে।

মোহন মিঞা, শাহ আজিজ।

তাজউদ্দীন আহমদ, তোয়াহা, কমরুদ্দীন আহমদ।

শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদ, কমরুদ্দীন আহমদ, শওকত আলী। তাজউদ্দীন আহমদ-এর ডায়েরী, ২০/১২/১৯৪৭।

১২ পূর্বোক্ত।

১৩ পূর্বোক্ত।

18

তাজউদ্দীন আহমদ, শেখ মুজিবুর রহমান, অলি আহাদ।

১৫ তাজউদ্দীন আহমদ-এর ডায়েরী, ২১/১২/১৯৪৭।

১৬ পূর্বোক্ত।

১৭

তাজউদ্দীন আহমদ-এর ডায়েরী, ২২/১২/১৯৪৭, ডক্টর মালেক।

১৮ ডক্টর মালেক।

১৯ পূর্বোক্ত।

২০ পূর্বোক্ত।

২১

ডক্টর মালেক।

২২ ডক্টর মালেক, তফজ্জল আলী।

২৩

তফজ্জল আলী।

২৪ কমরুদ্দীন আহমদ।

25 লেখকের সাথে সাক্ষাৎকারে।

২৬

লেখকের সাথে সাক্ষাৎকারে।

২৭

তফজ্জল আলী।

২৮

খয়রাত হোসেন, মোহন মিঞা।

Amrita Bazar Patrika, 6/3/1948.

৩০ তাজউদ্দীন আহমদ-এর ডায়েরী, ১৯/৪/১৯৪৮।

৩১ নওবেলাল, ১৯/৩/১৯৪৮।

৩২ তাজউদ্দীন আহমদ-এর ডায়েরী, ১৯/৩/১৯৪৮।

৩৩ পূর্বোক্ত।

৩৪

Quaid-I-Azam Mohammad Ali Jinnah’s Speeches as Governor General, Pakistan Publication, Karachi P 85-86.

৩৫ পূর্বোক্ত, পৃ ৮৭-৮৮।

৩৬ পূর্বোক্ত, পৃ ৮৯।

৩৭ পূর্বোক্ত।

৩৮ পূর্বোক্ত, পৃ ৮৯-৯০।

পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি (প্রথম খণ্ড) | ৩০৭

৩৯ পূর্বোক্ত, পৃ ৯০।[৪০ পূর্বোক্ত, পৃ ৮৭।

81

তাজউদ্দীন আহমদ, শহীদুল্লাহ কায়সার, সালাহউদ্দীন আহমদ, অলি আহাদ, তোয়াহা, আব্দুল মতিন।

৪২

পূর্বোক্ত।

৪৩ পূর্বোক্ত।

88

80

৪৬

তাজউদ্দীন আহমদ-এর ডায়েরী, ১৯/৩/১৯৪৮; শহীদুল্লাহ কায়সার। মহম্মদ তোয়াহা, শহীদুল্লাহ কায়সার।

Quaid-I- Azams Speeches as Governor General, P 92.

৪৭ পূর্বোক্ত, পৃ ৯৪।

৪৮ পূর্বোক্ত, পৃ ৯৪-৯৫।

89

আবদুল মতিন, আবুল কাসেম।

৫০ পূর্বোক্ত।

৫১ পূর্বোক্ত, পৃ ৯৫।

৫২ পূর্বোক্ত।

৫৩ পূর্বোক্ত, পৃ ৯৬।

৫৪ কমরুদ্দীন আহমদ, মহম্মদ তোয়াহা, তাজউদ্দীন আহমদ, আবুল কাসেম, সৈয়দ নজরুল

ইসলাম, অলি আহাদ।

৫৫ জিন্নাহ তাঁর ঢাকা সফরকালে সেখানেই অবস্থান করছিলেন। সেই বাড়ীটির ১৯৫৪ সালে নির্বাচনের পর পূর্ব বাংলার প্রধানমন্ত্রীর সরকারী বাসভবন এবং আইয়ুব খানের শাসনামলে বহু সংস্কার ও সম্প্রসারণের পর প্রেসিডেন্টের সরকারী বাসভবনে পরিণত হয়। বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর এই ভবনটি প্রধানমন্ত্রীর সরকারী বাসভবন হিসেবে ব্যবহৃত হয় এবং তার নাম দেওয়া হয় ‘গণভবন।

৫৬

মহম্মদ তোয়াহা, অলি আহাদ, তাজউদ্দীন আহমদ।

৫৭ পূর্বোক্ত।

৫৮ আবুল কাসেম, তাজউদ্দীন আহমদ, মহম্মদ তোয়াহা, অলি আহাদ, কমরুদ্দীন আহমদ,

সৈয়দ নজরুল ইসলাম।

৫৯

তোয়াহা, অলি আহাদ, তাজউদ্দীন আহমদ, কমরুদ্দীন আহমদ

৬০ পূর্বোক্ত।

৬১ পূর্বোক্ত।

৬২ পূর্বোক্ত।

৬৩ পূর্বোক্ত।

৬৪ কমরুদ্দীন আহমদ, তাজউদ্দীন আহমদ।

৬৫ কমরুদ্দীন আহমদ, অলি আহাদ, মহম্মদ তোয়াহা।

৬৬ অলি আহাদ, মহম্মদ তোয়াহা, তাজউদ্দীন আহমদ, কমরুদ্দীন আহমদ, আবুল কাসেম।

৬৭ পূর্বোক্ত।

৬৮ তাজউদ্দীন আহমদ-এর ডায়েরী, ২৪/৩/১৯৪৮।

৩০৮ | বদরুদ্দীন উমর রচনাবলী খণ্ড ২

৬৯ যুগান্তর, ২/৪/১৯৪৮।

१0

তাজউদ্দীন আহমদ-এর ডায়েরী, ২৪/৩/১৯৪৮।

৭১

মহম্মদ তোয়াহা, সৈয়দ নজরুল ইসলাম।

৭৩

৭২ পূর্বোক্ত।

মহম্মদ তোয়াহা।

98

মহম্মদ তোয়াহা, সৈয়দ নজরুল ইসলাম।

৭৫ পূর্বোক্ত।

৭৬

মহম্মদ তোয়াহা, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মহম্মদ তোয়াহা, সৈয়দ নজরুল ইসলাম।

৭৭

মহম্মদ তোয়াহা। সৈয়দ নজরুল ইসলাম শুধু এইটুকু স্মরণ করতে পারেন যে, দ্বিতীয়বার তাঁদের দুজনকে ভিতরে ডেকে নেওয়া হয়েছিল।

৭৮ পূর্বোক্ত।

৭৯ পূর্বোক্ত।

bo মহম্মদ তোয়াহা।

৮১ পূর্বোক্ত।

৮২ শাহ আজিজুর রহমান।

bo

মহম্মদ তোয়াহা।

৮৪ পূর্বোক্ত।

৮৫ শাহ আজিজুর রহমান।

৮৬

মহম্মদ তোয়াহা, শাহ আজিজুর রহমান।

৮৭

মহম্মদ তোয়াহা, শাহ আজিজ।

৮৮

মহম্মদ তোয়াহা।

৮৯ তাজউদ্দীন আহমদ-এর ডায়েরী, ২৪/৩/১৯৪৮; মহম্মদ তোয়াহা, শাহ আজিজ, আবদুর

৯০

৯১

রহমান চৌধুরী।

মহম্মদ তোয়াহা, আবদুর রহমান চৌধুরী।

মহম্মদ তোয়াহা।

৯২ মহম্মদ তোয়াহা, আবদুর রহমান চৌধুরী।

£ R R

১৩

তোয়াহা, শাহ আজিজ, আবদুর রহমান চৌধুরী।

৯৪ পূর্বোক্ত।

৯৫ মহম্মদ তোয়াহা।

৯৬

৯৭

মহম্মদ তোয়াহা, আবদুর রহমান চৌধুরী।

মহম্মদ তোয়াহা, শাহ আজিজ, আবদুর রহমান চৌধুরী।

৯৮ মহম্মদ তোয়াহা, আবদুর রহমান চৌধুরী।[৯৯ পূর্বোক্ত।

১০০ মহম্মদ তোয়াহা।

১০১ মহম্মদ তোয়াহা, আবদুর রহমান চৌধুরী।

১০২ আবদুর রহমান চৌধুরী, শহীদুল্লাহ কায়সার।[১০৩ মহম্মদ তোয়াহা, আবদুর রহমান চৌধুরী।

পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি (প্রথম খণ্ড) | ৩০৯

১০৪ মহম্মদ তোয়াহা।

১০৫ পূর্বোক্ত।

১০৬ পূর্বোক্ত।

১০৭ মহম্মদ তোয়াহা, আবদুর রহমান চৌধুরী।

Sob Quaid-I-Azam Mohammad Ali Jinnah, Speeches as Governor General, P 107. ১০৯ পূর্বোক্ত, P 109-10.

১১০ ডক্টর মালেক, তফজ্জল আলী, কমরুদ্দীন আহমদ।

১১১ পূর্বোক্ত।

১১২ ডক্টর মালেক।

১১৩ পূর্বোক্ত।

১১৪ তাজউদ্দীন আহমদ।

১১৫ মহম্মদ তোয়াহা, কমরুদ্দীন আহমদ, আবুল কাসেম।

১১৬ পূর্বোক্ত।

১১৭ মহম্মদ তোয়াহা।

১১৮ পূর্বোক্ত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *