৫. ভাষা আন্দোলন উত্তরঘটনাপ্রবাহ – ১৯৪৮

পঞ্চম পরিচ্ছেদ – ভাষা আন্দোলন উত্তরঘটনাপ্রবাহ- ১৯৪৮

১. সাধারণ অসন্তোষ ও সরকারী নীতি

মার্চ মাসের ভাষা আন্দোলনের পর ছাত্রদের কর্মতৎপরতা কিছুদিনের জন্যে কমে এলেও পূর্ব-বাঙলার সামগ্রিক পরিস্থিতি নানা প্রকার আর্থিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের দ্বারা ক্রমশ পরিবর্তিত হতে থাকে। ভাষা আন্দোলনের মতো ব্যাপক কোন ছাত্র বিক্ষোভ না ঘটলেও এ সময়ে ছাত্রেরা নিজেদের শিক্ষা ব্যবস্থা এবং সাধারণভাবে পূর্ব-বাঙলার নানা সমস্যা সম্পর্কে অনেকখানি সচেতন হয়ে ওঠে এবং ব্যক্তিগত ও সংগঠনগতভাবে বিভিন্ন রাজনৈতিক ও আর্থিক আন্দোলনের সাথে জড়িত হয়। এই পর্যায়েই শিক্ষা সংক্রান্ত দাবী- দাওয়ার ভিত্তিতে ঢাকাতে সর্বপ্রথম সংঘটিত হয় ব্যাপক ছাত্রী ধর্মঘট।

ছাত্র আন্দোলন ছাড়াও এ সময়ে সরকারী কর্মচারীদের ধর্মঘট এবং বিক্ষোভও উল্লেখযোগ্য। ব্যাপক খাদ্যাভাব ও দুর্ভিক্ষ, জিনিসপত্রের মূল্য বৃদ্ধি, আমলাতান্ত্রিক স্বেচ্ছাচার এবং চাকরীগত নানা অসুবিধার তাড়নায় জনসাধারণ ও সেক্রেটারিয়েট কর্মচারী থেকে শুরু করে পুলিশ কনস্টেবল পর্যন্ত সকলেই সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন ও সংগঠিতভাবে তাদের কাছে নিজেদের দাবী-দাওয়া পেশ করে। এবং সেগুলি আদায়ের জন্যে ধর্মঘটের আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়।

সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধের চেষ্টা, গ্রেফতার, বহিষ্কার আদেশ ইত্যাদির মাধ্যমে মতামতের স্বাধীনতা ও ব্যক্তি অধিকার খর্বের সরকারী চেষ্টা নিয়মিতভাবে শুরু হয়। এক্ষেত্রে আমলাদের স্বতঃপ্রণোদিত উদ্যোগ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। উচ্চপদস্থ আমলারা শুধু ব্যক্তি স্বাধীনতা খর্ব করেই ক্ষান্ত না থেকে নিজেদের রাজনৈতিক কর্তৃত্বকে নানাভাবে জাহির করার প্রচেষ্টা করে এবং তার ফলে ক্ষমতাশীন মুসলিম লীগের নেতৃস্থানীয় কিছু কিছু ব্যক্তির সাথেও তাদের রেষারেষি এবং সংঘর্ষ দেখা দেয়। এই অবস্থায় মওলানা ভাসানী, শামসুল হক প্রভৃতির নেতৃত্বে মুসলিম লীগকে পুনর্গঠনের শেষ চেষ্টা হিসাবে এপ্রিল ও মে মাসে টাঙ্গাইল ও নারায়ণগঞ্জে লীগ কর্মীসভা অনুষ্ঠিত হয়।[১]

রাজনীতি তেমন সংগঠিত রূপ পরিগ্রহ না করলেও দেশের এই সামগ্রিক পরিস্থিতির মধ্যে একদিকে শুরু হয় মুসলিম লীগের অন্তর্দ্বন্দ্ব ও অবক্ষয় এবং অন্যদিকে সরকার বিরোধী রাজনৈতিক দল ও আন্দোলন গঠনের বিবিধ উদ্যোগ। ১৯৪৮ এর এই পর্যায়ে পূর্ব-বাঙলার সাধারণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং সর্বস্তরের জনগণের চেতনার সাথে সাধারণ পরিচয়ের উদ্দেশ্যে নীচে কয়েকটি নির্বাচিত ঘটনা ধারাবাহিকভাবে উল্লিখিত হলো।

ক. কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মচারীরা ঢাকাতে ৮ই এপ্রিল বিভিন্ন দাবীতে ধর্মঘট শুরু করেন। এই ধর্মঘট ১৮ দিন স্থায়ী হওয়ার পর তাঁরা ধর্মঘট প্রত্যাহার করে ২৬ শে এপ্রিল কাজে যোগ দেন। সরকারী কর্মচারীরা এর পূর্বে বিভিন্ন বিক্ষোভে অংশগ্রহণ এবং ভাষা আন্দোলনের ধর্মঘটে যোগদান করলেও এই সর্বপ্রথম তাঁরা নিজেদের আর্থিক ও অন্যান্য দাবী-দাওয়ার ভিত্তিতে সংগঠিতভাবে ধর্মঘটকে আঠারো দিন অব্যাহত রাখেন।

খ. ঢাকার মেডিকেল ছাত্রেরা কতকগুলি দাবী-দাওয়া কর্তৃপক্ষের কাছে পেশ করেন। কর্তৃপক্ষ সেগুলি স্বীকার করতে সম্মত না হওয়ায় ৩৬ জন ছাত্র ১৮ই এপ্রিল থেকে অনশন ধর্মঘট শুরু করেন। অনশনকারী ছাত্রেরা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে জনস্বাস্থ্য বিভাগের মন্ত্রী হাবিবুল্লাহ বাহারের বাসভবনের সামনে এবং সার্জন জেনারেল ও মিটফোর্ড হাসপাতালের অফিসের সামনে কয়েকদিন ধরে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন।[২]

অবশেষে তাঁদের সমস্ত দাবি-দাওয়া কর্তৃপক্ষ কর্তৃক স্বীকৃত হওয়ার পর ২৭শে এপ্রিল তাঁরা নিজেদের ধর্মঘট প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেন।[৩]

গ. নোতুন বিক্রয় কর ধার্যের বিরুদ্ধে ঢাকা এবং প্রদেশের অন্যত্র জনসাধারণ ও দোকানদারদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। বিক্রয় কর সম্পর্কিত সরকারী সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে ২৬শে এপ্রিল ঢাকাতে পূর্ণ সাধারণ ধর্মঘট পালিত হয়। বিকেলের দিকে আরমানীটোলা ময়দানে মওলানা দীন মহম্মদের সভাপতিত্বে একটি বিরাট জনসমাবেশে অন্যান্যদের মধ্যে কমরুদ্দীন আহমদও বক্তৃতা করেন। সভায় কয়েকটি প্রস্তাব গৃহীত হয় এবং তার মধ্যে একটি বিশেষ প্রস্তাবে বিক্রয় কর সম্পর্কে সরকারী সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করার জন্যে সরকারকে অনুরোধ করা হয়। সরকার তাতে সম্মত না হলে ১৫ই মে থেকে উপযুক্ত ব্যবস্থা অবলম্বন করা হবে বলে সরকারকে তাঁরা সাবধান করে দেন।[৪]

ঘ. সংবাদপত্রের স্বাধীনতা খর্বের প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে ৩০শে এপ্রিল সিলেট কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদ অফিসে নওবেলাল-এর প্রধান সম্পাদক মহম্মদ আজরফের সভাপতিত্বে সিলেটের সাংবাদিকদের একটি সভা অনুষ্ঠিত হয় সেই সভায় তাঁরা নিম্নলিখিত প্রস্তাবটি সর্বসম্মতিক্রমে গ্রহণ করেন:

কেন্দ্রীয় পাকিস্তান সরকার কাগজের দুষ্প্রাপ্যতার দরুণ পূর্ববঙ্গের সাপ্তাহিক পত্রিকাগুলিকে বন্ধ করিবার জন্য যে আদেশ করিয়াছেন বলিয়া জানা গিয়াছে তাহাতে সিলেটের সাংবাদিকের এই সভা অত্যন্ত শংকিত হইয়াছে। এই আদেশের ফলে জনমতকে নিতান্ত অগণতন্ত্রীয়ভাবে রুদ্ধ করা হইয়াছে এবং যাহারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সাংবাদিকতার দ্বারা জীবিকার সংস্থান করিতেছিলেন তাহাদিগকে বেকার শ্রেণীতে পরিণত করা হইয়াছে। রাষ্ট্রের কল্যাণের জন্য যাহাতে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা পুনর্বার বহাল হয় এবং এতগুলি লোক বেকার না হইয়া পড়ে এই উদ্দেশ্যে এই সভা প্রাদেশিক ও কেন্দ্রীয় পাকিস্তান সরকারকে অবিলম্বে এই আদেশ প্রত্যাহার করার দাবী জানাইতেছে। বর্তমানে যেসব সংবাদপত্র প্রকাশিত হইতেছে তাহাদিগকে চালু রাখিবার জন্য উপযুক্ত ছাপার কাগজ সরবরাহ করিবার জন্য এই সভা উভয় সরকারের নিকট দাবী জানাইতেছে।[৫]

পূর্ব-বাঙলা সরকারের ডেপুটি ইনসপেক্টর জেনারেলের আদেশক্রমে নওবেলাল-এর প্রকাশনা ১৯৪৮-এর ১৩ই সেপ্টেম্বর থেকে ৮ই ডিসেম্বর পর্যন্ত বন্ধ থাকে।[৬]

ঙ. অল্পকাল পূর্বে সংঘটিত সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামার পর শহীদ সুহরাওয়ার্দী সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিরক্ষা এবং পূর্ব-বাঙলা থেকে সংখ্যালঘুদের প্রস্থান বন্ধ করার উদ্দেশ্যে প্রদেশ সফরের জন্যে ঢাকা উপস্থিত হলে ৩রা জুন তাঁকে জননিরাপত্তা আইনের ১০ ধারা বলে অন্তরীণ করা হয়। পূর্ব-বাঙলা সরকার এক ইস্তাহারে বলেন যে, সে সময় পূর্ব-বাঙলাতে এমন কোন পরিস্থিতির উদ্ভব হয় নাই যার জন্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিস্তারের উদ্দেশ্যে সুহরাওয়ার্দীর সফরের কোন প্রয়োজনীয়তা আছে। সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতির উন্নতির জন্যে ইতিমধ্যে যা কিছু করণীয় সরকার তা করেছেন কাজেই তাঁর সফরের আসল উদ্দেশ্য প্রদেশের আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ ব্যতীত অন্য কিছুই নয়। সুহরাওয়ার্দীর সফরের অন্যতম উদ্দেশ্য পূর্ব-বাঙলাকে পশ্চিম-বাঙলা অর্থাৎ ভারতের সাথে যুক্ত করা এই মর্মেও সরকারী ইশতাহারটিতে অভিযোগ করা হয়। তাতে বলা হয় যে সুহরাওয়ার্দী তাঁর সফরসূচী বাতিল করে প্রদেশ ত্যাগের ইচ্ছা প্রকাশ করলেই তাঁকে মুক্তি দেওয়া হবে। তিনি প্রাদেশিক সরকারের কাছে অনুরূপ ইচ্ছা প্রকাশ করার পর তাঁকে মুক্তি দান করা হয়[৭] এবং তিনি কলকাতার উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করেন।[৮]  

চ. ৩০শে জুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রেরা নানা অব্যবস্থা এবং শিক্ষক সমস্যা সম্পর্কে আলোচনার জন্যে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে সমবেত হন। সভায় সভাপতিত্ব করেন আবদুর রহমান চৌধুরী। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা অবলম্বনের জন্যে আবদুর রহমান চৌধুরীকে আহ্বায়ক নিযুক্ত করে একটি সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়।

এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগের একটি স্মারকলিপিতে বলা হয় যে, উত্তরোত্তরভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সব দিক দিয়ে অবনতির দিকে অগ্রসর হচ্ছে। স্মারকলিপিটিতে অব্যবস্থার কারণসমূহ উল্লেখ করার পর তার প্রতিকারকল্পে নিম্নলিখিত দাবীসমূহ উত্থাপন হয় :

১. বেতনের হার বৃদ্ধি করিতে হইবে, প্রারম্ভিক বেতন বর্তমানের ১৫০ টাকা হইতে বৃদ্ধি করিয়া ২৫০ টাকা করিতে হইবে।

২. অধ্যাপকগণের প্রচলিত বাধ্যতামূলক অবসর লাভের বয়স বৃদ্ধি করিয়া অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ন্যায় ইহা ষাট বৎসর করিতে হইবে।

৩. নিয়োগ ও পদোন্নতির সময় পক্ষপাতিত্ব, স্বজনপ্রীতি বা সাম্প্রদায়িকতা চলিবে না।

৪. অবিলম্বে শিক্ষিত ও অভিজ্ঞ অধ্যাপক নিয়োগ করিয়া বর্তমানের শূন্যপদ পূরণ করিতে হইবে।

৫. অধ্যাপকবৃন্দের অভাব অভিযোগ অবিলম্বে পূরণ করিতে হইবে।

৬. যাহারা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়িয়া চলিয়া যাইবেন বলিয়া সিদ্ধান্ত করিয়াছেন তাঁহাদিগকে রাখিবার জন্য অবিলম্বে ব্যবস্থা অবলম্বন করিতে হইবে।[১০]

ছ. দেড় মাস কাল বেতন না পাওয়ার ফলে বহু পুলিশ কনস্টেবল ১৪ই জুলাই ধর্মঘট এবং সারা ঢাকা শহরে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। সন্ধ্যার দিকে অবস্থা আয়ত্তে আনার জন্যে সরকার সামরিক বাহিনী তলব করেন এবং তারা লালবাগস্থ পুলিশ লাইনে ধর্মঘটী পুলিশদেরকে ঘেরাও করে।[১১] এই সময় সশস্ত্র পুলিশও সৈন্যদের মধ্যে সংঘর্ষ ও গুলি বিনিময়ের ফলে দুইজন পুলিশ নিহত এবং নয়জন আহত হয়।[১২]

জ. ২০শে অগাস্ট রাজশাহীতে একটি জনসভায় বক্তৃতাপ্রসঙ্গে পূর্ব-বাঙলার অর্থ, বাণিজ্য ও শিল্প সচিব হামিদুল হক চৌধুরী বলেন যে বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারী উচ্ছেদ করলে সেটা হবে ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে হস্তক্ষেপ এবং এই হস্তক্ষেপের ফলে সমগ্র অর্থনৈতিক জীবনে ব্যাপক অরাজকতা সৃষ্টি হবে। এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন যে কমিউনিজমের সাথে ইসলামের কোন সমঝোতা হতে পারে না। কাজেই কমিউনিস্টদের সম্পর্কে সকলের হুঁশিয়ার থাকা প্রয়োজন।[১৩]

ঝ. পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান পূর্ব-বাঙলা সফরের উদ্দেশ্যে ১৮ই নভেম্বর তেজগাঁ বিমানবন্দরে উপস্থিত হলে প্রাদেশিক মন্ত্রী পরিষদের সদস্য, সরকারী কর্মচারী, সাংবাদিক এবং এক বিরাট জনতা তাঁকে সম্বর্ধনা জ্ঞাপনের উদ্দেশ্যে সেখানে সমবেত হন। প্রধানমন্ত্রীকে আনুষ্ঠানিকভাবে অভ্যর্থনা জ্ঞাপনের উদ্দেশ্যে ঢাকার মুসলিম লীগের নেতৃ স্থানীয় কয়েকজন ব্যক্তিকে নিয়ে একটি অভ্যর্থনা কমিটি গঠিত হয়। এই অভ্যর্থনা কমিটির সদস্য এবং সাংবাদিকবৃন্দ সরকারী কর্মচারীদের দ্বারা নানাভাবে অপমানিত ও উপেক্ষিত হন। এই প্রসঙ্গে অভ্যর্থনা কমিটি ও সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে ‘আমলাতন্ত্রী স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জ্ঞাপন করা হয়।[১৪]

অভ্যর্থনা কমিটির যুগ্ম সম্পাদক সাহেবে আলম তাঁর বিবৃতিতে বলেন:

অভ্যর্থনা কমিটি গত কয়েকদিন ধরিয়া শাহী আয়োজন করিতেছিলেন। কিন্তু অত্যন্ত পরিত্যাপের বিষয় এই যে, বিমান ঘাঁটিতে উপস্থিত হইলে তাঁহাদিগকে সশস্ত্র প্রহরীদের পশ্চাতে থাকিতে দেওয়া হয়। প্রধানমন্ত্রীকে অভ্যর্থনা জানাইবার জন্য মন্ত্রীমণ্ডলী এবং উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মচারীরাই সম্মুখের সারিতে ছিল।

অভ্যর্থনা কমিটির অজ্ঞাতসারেই মন্ত্রী এবং উচ্চপদস্থ কর্মচারীদিগকে বিশেষ প্রবেশপত্র দেওয়া হয়। সরকারী ব্যবস্থা এমন অদ্ভুত হয় যে, পূর্ব পাকিস্তান মুসলেম লীগের সভাপতি, অভ্যর্থনা কমিটির চেয়ারম্যান, সম্পাদক এবং সংবাদপত্র প্রতিনিধিদিগকে সশস্ত্র রক্ষীরা একস্থান হইতে অন্যস্থানে তাড়াইয়া বেড়াইতেছিল।[১৫]

ঞ. ১৯শে নভেম্বর অর্থাৎ উপরোক্ত ঘটনার পরদিন পূর্ব-বাঙলা সাংবাদিক সংঘের এক বিশেষ অধিবেশনে তেজগাঁও বিমান ঘাঁটিতে প্রধানমন্ত্রীকে অভ্যর্থনা জ্ঞাপনের সময় যে অব্যবস্থা ও বিশৃঙ্খলা দেখা যায় তার সমালোচনা প্রসঙ্গে খায়রুল কবীর (আজাদ), গোলাম আহমদ (পাবান), কাজী শামসুল ইসলাম (জিন্দেগী) এবং আরও কয়েকজন সাংবাদিক বলেন যে ‘পূর্ববঙ্গের মন্ত্রীমণ্ডলী এবং সরকারী কর্মচারীগণের উচিত সংবাদপত্রের প্রতি তাঁহাদের দায়িত্ব উপলব্ধি করা।’

সভায় সর্বসম্মতিক্রমে নিম্নলিখিত প্রস্তাবগুলি গৃহীত হয় :

পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জনাব লিয়াকত আলী খাঁর তেজগাঁও বিমান ঘাঁটিতে উপস্থিতির সময় পূর্ববঙ্গ সরকারের চীফ সেক্রেটারীর আমন্ত্রণক্রমে বিমান ঘাঁটিতে উপস্থিত বিশিষ্ট সাংবাদিকগণের প্রতি মি: ডিএন পাওয়ার, মি: নর্টন জোন্স ও অন্যান্য সরকারী কর্মচারীরা যে অপমানসূচক আচরণ প্রদর্শন করিয়াছেন, পূর্ববঙ্গ সাংবাদিক সংঘের এই সভা তাহার তীব্র নিন্দা করিতেছে।

এই সভা গতকল্যকার ব্যাপার সম্পর্কে আজাদ, জিন্দেগী ও পাসবানে প্রকাশিত সংবাদের প্রতি পূর্ববঙ্গের প্রধানমন্ত্রী জনাব নূরুল আমীনের দৃষ্টি আকর্ষণ করিতেছে এবং এইরূপ অভিমত পোষণ করিতেছে যে, সরকারী কর্মচারীদের এই আচরণ দ্বারা সাংবাদিকগণের সর্বদেশ স্বীকৃত অধিকার ও সুবিধাদির উপর অন্যায় হস্তক্ষেপ করা হইয়াছে।[১৬]

ট. পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান ২০শে নভেম্বর পল্টন ময়দানে বিরাট এক জনসমাবেশে বক্তৃতা দানকালে বলেন:

আপনারা কখনই মনে এ ধারণার স্থান দিবেন না যে, পশ্চিম পাকিস্তানের নেতৃবর্গ ও তথাকার জনসাধারণ আপনাদের প্রগতি, সমৃদ্ধি ও হেফাজত সম্পর্কে সম্পূর্ণ উদাসীন। তাঁহারা আপনাদের পূর্ব পাকিস্তানের জনসাধারণের খেদমতের জন্য সদা সর্বদাই মনে প্রাণে হাজির আছেন।[১৭]

পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর পৃষ্ঠপোষকতামূলক মনোভাবের পরিচয় এই বক্তব্যের মধ্যে অত্যন্ত স্পষ্ট। তাছাড়া হেফজতকারী হিসাবে পাকিস্তানের নেতৃবর্গ না বলে ‘পশ্চিম পাকিস্তানের’ নেতৃবর্গের উল্লেখও এক্ষেত্রে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। এরপর বাঙালীদের প্রাদেশিকতার নিন্দা করে তিনি বলেন:

আজকাল নানাপ্রকার ধ্বনি শোনা যাইতেছে। পূর্ব পাকিস্তানের এক শ্রেণীর লোকের মধ্যে উগ্র প্রাদেশিকতার মনোভাব সৃষ্টি হইয়াছে। আপনাদিগকে স্মরণ রাখিতে হইবে যে, প্ৰকৃত মুসলমান কখনও তাহার চিন্তাধারাকে প্রাদেশিকতার সংকীর্ণ গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ রাখিতে পারে না। পাঞ্জাবী, বাঙ্গালী, সিন্ধী, পেশোয়ারী, পাঠান প্রভৃতির মধ্যে বৈষম্যের চিন্তা অন্তর হইতে মুছিয়া ফেলিতে হইবে। এছলামে ভেদাভেদের কোন স্থান নাই। আমরা পাঞ্জাবী, বিহারী, সিন্ধী, বাঙ্গালী কিংবা পেশোয়ারী যাহাই হইনা কেন আমাদিগকে সর্বদা স্মরণ রাখিতে হইতে যে, আমরা ‘পাকিস্তানী’ (হর্ষধ্বনি)।[১৮]

ঠ. সম্রাট ষষ্ঠ জর্জের কন্যা এলিজাবেথের পুত্র সন্তান প্রসব উপলক্ষে অন্যান্য সরকারী ভবনের সাথে রাজশাহী কলেজেও পাকিস্তান পতাকার সাথে বৃটিশের ইউনিয়ন জ্যাক উত্তোলন করা হয়। এর ফলে ছাত্রেরা দারুণভাবে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে এবং তারা ‘সাম্রাজ্যবাদ ধ্বংস হোক’, ‘কমনওয়েলথ ছাড়তে হবে’ ইত্যাদি ধ্বনি সহকারে জোরপূর্বক কলেজ ভবনে উত্তোলিত ইউনিয়ন জ্যাক নীচের নামিয়ে তা বিনষ্ট করে।[১৯]

প্রধামমন্ত্ৰী লিয়াকত আলীর রাজশাহী সফরকালে তাঁকে সম্বর্ধনা জ্ঞাপনের উদ্দেশ্যে রাজশাহীর ছাত্রেরা শোভাযাত্রার ব্যবস্থা করেন কিন্তু ২১শে নভেম্বর কর্তৃপক্ষ সেই শোভাযাত্রাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। প্রধানমন্ত্রীর কাছে ছাত্র প্রতিনিধিদের ডেপুটেশনের অনুমতিও তাঁরা বাতিল করে দেন। কর্তৃপক্ষের এই সব আচরণের ফলে ছাত্রদের মধ্যে বিক্ষোভ অনেক বৃদ্ধি পায় এবং তারা একটি প্রতিবাদ মিছিল বের করে। পুলিশের উপস্থিতিতে এই মিছিলটিকে গুণ্ডাদল লাঠি ও ছোরার সাহায্যে আক্রমণ করে এবং তার ফলে ২৫ জন আহত হন। সেই রাত্রে রাইফেল ও রিভলভারধারী পুলিশদল কলেজ হোস্টেল ঘেরাওপূর্বক হোস্টেলের মধ্যে ব্যাপক খানাতল্লাশী চালায়। কোন পরোয়ানা ছাড়াই দুইজন ছাত্রকে পুলিশ গ্রেফতার করে এবং পরে তাঁরাসহ মোট তিনজন ছাত্রকে রাজশাহী শহর থেকে বহিষ্কার করা হয়।[২০]

ড. ২৭শে নভেম্বর লিয়াকত আলী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে একটি ছাত্রসভায় ভাষণ দেন। এই উপলক্ষে তাঁকে একটি মানপত্র দেওয়ার বিষয় আলোচনার জন্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্থায়ী ভাইস চ্যালেন্সর ও সুলতানউদ্দিন আহমদ পূর্ব সন্ধ্যায় জগন্নাথ হলে এক ছাত্র সভা আহ্বান করেন। এই সভায় প্রধানমন্ত্রীকে প্রদত্ত মানপত্রটিতে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবীর অর্ন্তভুক্তির প্রস্তাব করা হলে প্রতিনিধিদের মধ্যে এ বিষয়ে গুরুতর মতভেদ দেখা দেয় এবং তার ফলে শেষ পর্যন্ত প্রস্তাবটিকে ভোটে দিতে হয়। অধিকাংশ ছাত্র প্রস্তাবটির স্বপক্ষে ভোট দেওয়ায় সেটি গৃহীত হওয়ার পর সেই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে কয়েকজন ছাত্র প্রতিনিধি সভাকক্ষ পরিত্যাগ করে।[২১] পরদিন বিকেলে নির্ধারিত সময়ে অস্থায়ী ভাইস চ্যালেন্সার সুলতানউদ্দিন আহমদের সভাপতিত্বে সভার কাজ শুরু হয়। বিশ্ববিদ্যালয় ইউনিয়নের সম্পাদক গোলাম আজম বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে মানপত্রটি পাঠ করেন। লিয়াকত আলী তাঁর ভাষণ দানকালে মানপত্রে উল্লিখিত বিভিন্ন বিষয়ের উপরই প্রধানতঃ নিজের বক্তব্যকে সীমাবদ্ধ রাখেন,[২২] কিন্তু ভাষা প্রশ্ন সম্পর্কে কোন নির্দিষ্ট অভিমত প্রকাশ করেন না।

১৭ নভেম্বর সন্ধ্যা সাতটায় আতাউর রহমানের সভাপতিত্বে রাষ্ট্রভাষা কর্ম-পরিষদের একটি বৈঠক বসে। আজিজ আহমদ, আবুল কাসেম, শেখ মুজিবুর রহমান, কমরুদ্দীন আহমদ, আবদুল মান্নান, আনসার এবং তাজউদ্দীন আহমদ এই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।[২৩] প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলীর আসন্ন পূর্ব-বাঙলা সফরকালে তাঁকে রাষ্ট্রভাষা কর্ম-পরিষদের পক্ষ থেকে একটি স্মারকলিপি দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয় এবং সেই স্মারকলিপিটির খসড়া তৈরীর ভার অর্পিত হয় কমরুদ্দীন আহমদের উপর।[২৪]

কমরুদ্দীন আহমদ কায়েদে জিন্নাহকে ২৪শে মার্চ তারিখে প্রদত্ত স্মারকলিপির ভিত্তিতে একটি নোতুন স্মরকলিপি তৈরী করে সেটি লিয়াকত আলীর ঢাকা অবস্থানকালে সরাসরি তাঁর কাছে পাঠিয়ে দেন। লিয়াকত আলী এই স্মারকলিপিটির কোন প্রাপ্তি স্বীকার করেন নি এবং রাষ্ট্রভাষা কর্ম-পরিষদের সাথে তাঁর কোন সাক্ষাৎকারই ঘটেনি।[২৫] ছাত্রদের প্রদত্ত স্মারকলিপিটির মতো এক্ষেত্রেও তিনি রাষ্ট্রভাষা প্রশ্ন সম্পর্কে কোন মন্তব্য প্রকাশ অথবা আলোচনা অনুষ্ঠান থেকে বিরত থাকেন।

২. ঢাকা শহরে ব্যাপক ছাত্রী বিক্ষোভ

ইডেন ও কামরুন্নেসা গার্লস স্কুল একত্রীভূত করার প্রতিবাদে এই দুই স্কুল ও ইডেন কলেজের প্রায় পাঁচশত ছাত্রী ১৫ই নভেম্বর ধর্মঘট করার পর বেলা দুটোর সময় প্রাদেশিক সেক্রেটারিয়েট ভবনের সামনে সমবেত হয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। উপরোক্ত দুটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান একত্রীভূত হওয়ার পর কামরুন্নেসা স্কুলের স্থাবর অস্থাবর যাবতীয় সম্পত্তি সরকারের কাছে হস্তান্তরিত করা হয় এবং উভয় প্রতিষ্ঠানের ছাত্রীরাই এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রবলভাবে প্রতিবাদ জ্ঞাপন করে। কামরুন্নেসা স্কুলের বরখাস্ত শিক্ষায়িত্রীদের পুনর্নিয়োগে, গরীব ছাত্রীদের জন্যে অধিক সংখ্যক বৃত্তি এবং ছাত্রীদের যাতায়াতের সুবন্দোবস্ত করার জন্যেও তারা দাবী জানায়। বিক্ষোভকারিণী ছাত্রীরা প্রাদেশিক শিক্ষামন্ত্রী আবদুল হামিদের সাথে সাক্ষাতের চেষ্টা করে কিন্তু তিনি মফস্বলে সফররত থাকায় তারা সেক্রেটারিয়েট থেকে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে উপস্থিত হয়।[২৬]

প্রধানমন্ত্রী নূরুল আমীন চারজন ছাত্রী প্রতিনিধির সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং সেই সাক্ষাৎকালে তিনি তাদেরকে বলেন যে মাত্র মাস কয়েক পূর্বে কামরুন্নেসা গার্লস স্কুলের কর্তৃপক্ষ এবং শিক্ষা বিভাগের সাথে যথোপযুক্ত আলাপ আলোচনার পর ইডেন স্কুল ও কামরুন্নেসা স্কুলকে একত্রিত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। কাজেই সংশ্লিষ্ট সরকারী বিভাগ এবং স্কুল কর্তৃপক্ষের সাথে পুনরায় এ ব্যাপারে আলোচনা না করা পর্যন্ত উল্লিখিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দুটিকে পৃথক করার নোতুন আদেশ তিনি দিতে পারেন না। কামরুন্নেসা স্কুলের বরখাস্ত শিক্ষায়িত্রীদের পুনর্নিয়োগ সম্বন্ধে অবশ্য নূরুল আমীন বলেন যে তাঁদের মধ্যে যাঁদের উপযুক্ত যোগ্যতা আছে তাঁদেরকে নোতুন স্কুলে শিক্ষকতার কাজে নিয়োগ করা হবে। তবে এ বিষয়ে শিক্ষা দফতরের সাথে আলোচনার পূর্বে তিনি কোন প্রতিশ্রুতি দিতে সরাসরি অস্বীকার করেন এবং শিক্ষা বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সাথে সাক্ষাতের জন্যে ছাত্রীদেরকে উপদেশ দেন।[২৭]

১৫ই তারিখের ছাত্রী বিক্ষোভ সম্পর্কে দৈনিক আজাদ-এ নিম্নলিখিত মন্তব্য প্রকাশিত হয়:

পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষা-সংকট সম্বন্ধে আমরা ইতিপূর্বে কয়েকবার মন্তব্য করিয়াছি। অবস্থা কতদূর চরমে উঠিয়াছে, তাহা পনেরোই নভেম্বর তারিখের ঢাকার ছাত্রী বিক্ষোভ হইতেই অনুমিত হয়। ছাত্রীদের এত বড় মিছিল ইতিপূর্বে ঢাকায় দেখা যায় নাই। নিতান্ত দায়ে না পড়িলে যে ছাত্রীরা বাহির হয় নাই, এ-কথা সহজেই উপলব্ধি করা যায়। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হইবার পরে এক বৎসরের অধিককাল চলিয়া গিয়াছে। এ পর্যন্ত ইডেন বালিকা বিদ্যালয়ের জন্য প্রয়োজনীয় গৃহ ও শিক্ষয়িত্রী যোগাড় করা কর্তৃপক্ষের পক্ষে সম্ভব হয় নাই। যে-সকল রিকুইজিশন করা বিরাট বাড়ীগুলি বর্তমানে অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য ব্যবহৃত হইতেছে, তাহার যে-কোন একটায় সহজেই এই বিদ্যালয়ের জন্য স্থান করা যাইতো। অন্যান্য অভিযোগ এই যে, বর্তমানে দুই স্কুলে মিলাইয়া যে এক হাজারের মতো ছাত্রী আছে, তাহাদের বসিবার উপযুক্ত বেঞ্চি প্রভৃতিও নাই, পড়াইবার জন্য শিক্ষয়িত্রীতো নাই-ই। দীর্ঘ এক বৎসরের এই অকর্মণ্যতা শিক্ষা বিভাগের যোগ্যতার সাক্ষ্য দেয় না। উজিরে আজম জনাব নূরুল আমিন শিক্ষা বিভাগের আসহাবে কাহাফী নিদ্রা ভাঙাইবার কোন ব্যবস্থা করিবেন কি?[২৮]

১৫ই তারিখ থেকে ইডেন ও কামরুন্নেসা স্কুলে ছাত্রী ধর্মঘট অব্যাহত থাকে। ২৪শে নভেম্বরও ছাত্রীরা পূর্ব দিনগুলির মতো স্কুলের প্রধান প্রবেশ দ্বারে পিকেটিং এবং বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। এই বিক্ষোভের ফলে স্কুলের সামনে পুলিশ মোতায়েন করা হয়। কিন্তু এসব সত্ত্বেও যতদিন কর্তৃপক্ষ ইডেন স্কুলকে পৃথক ভবনে স্থানান্তরিত না করেন ততদিন পর্যন্ত তারা শান্তিপূর্ণভাবে ধর্মঘট চালিয়ে যাওয়ার দৃঢ় সংকল্পের কথা ঘোষণা করে।[২৯]

কামরুন্নেসা ও ইডেন স্কুলের ছাত্রীদের অভাব অভিযোগ এবং নানা অসুবিধার প্রতি স্কুল কর্তৃপক্ষের উদাসীন মনোভাবের তীব্র নিন্দা করে ২৪শে তারিখে প্রিয়নাথ হাই স্কুলের ছাত্র ও শিক্ষকদের একটি সম্মিলিত সভায় প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। তাঁরা ধর্মঘটী ছাত্রীদের প্রতি আন্তরিক সহানুভূতি জ্ঞাপন করে অন্য একটি পৃথক প্রস্তাব গ্রহণ করেন।[৩০]

কামরুন্নেসা ও ইডেন স্কুলের ছাত্রী ধর্মঘট চলাকালে ১৮ই নভেম্বর ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজের ছাত্রেরাও তাদের নিজস্ব দাবী-দাওয়ার ভিত্তিতে ধর্মঘট শুরু করার প্রস্তুতি নেয়। এই উদ্দেশ্যে কলেজের সংগ্রাম পরিষদ নিম্নলিখিত বিবৃতি প্রচার করেন:

পুনঃ পুনঃ আবেদন ও ডেপুটেশন সত্ত্বেও পূর্ব বাংলা সরকার ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজের দাবী-দাওয়ার প্রতি ঔদাসীন্য প্রকাশ করায় কলেজ ছাত্রলীগ আগামী ২১শে নভেম্বর সোমবার সকাল সাতটা হইতে অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘট চালাইয়া যাইবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিয়া পূর্ব বাংলা সরকারকে নোটিশ দিয়াছেন।

উক্ত নোটিশে বলা হয়, সরকার সিদ্দিক বাজারের আবর্জনাময় ও অসুবিধাজনক পরিবেশে কলেজকে রাখার জন্য জেদ করায় এবং কলেজকে প্রথম শ্রেণীর কলেজে উন্নীত করিতে অহেতুক বিলম্ব করায় ও বাণিজ্য বিভাগকে স্থায়ী করিতে অস্বীকার করায় ছাত্রগণ ধৈর্যের চরম সীমায় উপনীত হইয়াছে। ছাত্রগণ আর সরকারের মিষ্টবাক্যে ভুলিতে প্রস্তুত নয়। তাহারা দাবী করিতেছে যে সরকার বর্তমানে প্রাক্তন ভাইস-চ্যান্সেলরের আদি বাড়িটি কলেজের জন্য ছাড়িয়া দিন, কলেজকে বর্তমান সেসন হইতে প্রথম শ্রেণীতে উন্নীত করুন, বাণিজ্য বিভাগকে স্থায়ী করার ও উক্ত বিভাগের সাথে সংশ্লিষ্ট শিক্ষকদের বাকী বেতন অবিলম্বে মিটাইয়া দিন ও ছাত্রাবাসগুলিতে উপযুক্ত চিকিৎসার ব্যবস্থা করুন। উক্ত দাবী অমান্য করা হইলে ছাত্রগণ আগামী ২১শে নভেম্বর সোমবার সকাল সাতটা হইতে অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘট ও প্রয়োজনবোধে অনশন ধর্মঘট আরম্ভ করিতে বাধ্য হইবে।[৩১]

এর পর ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজে ৫৭৫ জন ছাত্রের মধ্যে প্রায় ৫০০ ছাত্র ২৪শে নভেম্বর থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্যে ধর্মঘট শুরু করে। ধর্মঘটী ছাত্রেরা কলেজের প্রধান প্রবেশদ্বার বন্ধ করে রাখে। এর পর তারা সম্মিলিতভাবে মিছিল সহকারে সেক্রেটারিয়েট ভবনের সামনে উপস্থিত হলে পুলিশ তাদেরকে বাধা দান করে। এইভাবে বাধাপ্রাপ্ত হওয়ার পর মিছিলটি শহরের বিভিন্ন অঞ্চল প্রদক্ষিণ করে।[৩২]

২৩শে নভেম্বর ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজের একটি ছাত্র-প্রতিনিধি দল পূর্ব বাঙলা সরকারের শিক্ষা বিভাগের সেক্রেটারী ফজলে আহমদ করিম ফজলীর কাছে কয়েকটি দাবী পেশ করে কিন্তু কর্তৃপক্ষ সে দাবী-দাওয়ার প্রতি কর্ণপাত না করায় ছাত্রেরা ধর্মঘটের আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। ছাত্রদের দাবীগুলি নিম্নরূপ:

১. ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ বস্তি এলাকা হইতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলরের গৃহে স্থানান্তরিত করিতে হইবে।

২. কলেজটিকে ১ম শ্রেণীর কলেজে উন্নীত করিতে হইবে।

৩. ইন্টারমিডিয়েট কলেজের বাণিজ্য বিভাগকে স্থায়ী করিতে হইবে।

৪. কলেজের ছাত্রাবাসের অসুস্থ ছাত্রগণের চিকিৎসার ব্যবস্থা করিতে হইবে।[৩৩]

ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজের ছাত্র ধর্মঘটের দ্বিতীয় দিন ২৫শে নভেম্বর বেলা সাড়ে এগারোটার সময় ছাত্রদের একটি বিরাট মিছিল শহরের বিভিন্ন রাস্তা প্রদক্ষিণ করে প্রধানমন্ত্রী নূরুল আমীনের বাসভবনের সামনে সমবেত হয়। যেখানে তারা ‘প্রধানমন্ত্রী বেরিয়ে আসুন’, ‘আমাদের দাবী মানতে হবে’, ‘ছাত্র ঐক্য জিন্দাবাদ’ প্রভৃতি ধ্বনি দিতে থাকলে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে তাদেরকে জানানো হয় যে অসুস্থতার জন্যে তিনি তাদের সাথে দেখা করতে তখনকার মতো অক্ষম। একথা শোনার পর ছাত্রেরা তাঁকে অল্পক্ষণের জন্যে বারান্দায় দাঁড়িয়ে তাদের দাবী-দাওয়ার কথা শুনতে অনুরোধ করে। নূরুল আমীন কিন্তু তাদের সে অনুরোধ রক্ষা করতে অসম্মতি জানানোর পর ছাত্রেরা বিক্ষুব্ধ অবস্থায় বর্ধমান হাউজ পরিত্যাগ করে নানাপ্রকার ধ্বনি সহকারে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে উপস্থিত হয়ে মিছিল ভঙ্গ করে।[৩৪]

এর পূর্বে সকাল দশটায় ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ প্রাঙ্গণে এক সভায় নিম্নলিখিত প্রস্তাবগুলি গৃহীত হয়:

ক. আজাদ কাশ্মীর গভর্ণমেন্টও তাহার যুদ্ধরত মোজাহেদগণের প্রতি আমরা আন্তরিক সহানুভূতি প্রকাশ করিতেছি এবং প্রয়োজনবোধে তাঁহাদিগকে সকল প্রকার সাহায্য করিতে প্রস্তুত আছি।

খ. আমরা কামরুন্নেসা ও ইডেন গার্লস স্কুলের ধর্মঘটী ছাত্রীদের প্রতি আমাদের আন্তরিক সহানুভূতি প্রকাশ করিতেছি এবং তাহাদের অভিযোগের সুরাহা করিতে কর্তৃপক্ষের নিকট দাবী জানাইতেছি।

গ. ২৬শে নভেম্বরের ভিতর স্মারকলিপি পেশ করা হউক। সরকার আমাদের দাবী পূরণ না করিলে বাধ্য হইয়া ২৭শে নভেম্বর শনিবার হইতে অনশন ধর্মঘট আরম্ভ করিব।[৩৫]

সরকারী ইন্টারমিডিয়েট কলেজের ছাত্র ধর্মঘটের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করে ২৬শে নভেম্বর পূর্ব পাকিস্তান সুমলিম ছাত্রলীগের সেন্ট্রাল একোমডেশন কমিটির আহ্বায়ক মহম্মদ আবদুল ওদুদ সংবাদপত্রে বিবৃতি প্রসঙ্গে বলেন:

আমরা বিশ্বাস করি, ঢাকা ইন্টারের ছাত্রদের ন্যায্য সংগ্রামের পাশে কেবল ঢাকার ছাত্র সমাজ কেন, গোটা ছাত্রসমাজ আসিয়া ঐক্যবদ্ধভাবে দাঁড়াইবে। আমরা জানি, কোটি কোটি লোকের রাজধানী ঢাকায় একটি মাত্র সরকারী কলেজের উত্তম পরিবেশ, ছাত্র ও অধ্যাপকদের সকল প্রকার সুযোগ-সুবিধাবিশিষ্ট প্রথম শ্রেণীর কলেজ পুনর্গঠনে ছাত্রদের সত্যিকার সহযোগিতার ঐকান্তিক ইচ্ছা ও ন্যায়সঙ্গত দাবী রুটির দাবীর চাইতে কম জোরালো নহে বরং স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সুন্দর পাকিস্তান গঠনে অপরিহার্য।[৩৬]

১৫ই নভেম্বর থেকে ইডেন ও কামরুন্নেসা স্কুলের ধর্মঘট ১৫ তারিখ পর্যন্ত অব্যাহত থাকে এবং স্কুল এলাকায় পুলিশ বাহিনীকেও মোতায়েন রাখা হয়। ধর্মঘটী ছাত্রীদের সংগ্রাম পরিষদের মুখপাত্রেরা সংবাদপত্র প্রতিনিধিদেরকে জানায় যে তাদের দাবী কৰ্তৃপক্ষ কর্তৃক স্বীকৃত না হওয়া পর্যন্ত তারা সংগ্রাম অব্যাহত রাখবে। পরবর্তী শনিবার ২৭শে নভেম্বর সকাল নয়টায় কামরুন্নেসা স্কুল প্রাঙ্গণে উভয় স্কুলের ছাত্রীদের একটি জরুরী সভাও সেদিন আহ্বান করা হয়।[৩৭]

২৬শে তারিখে ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজের ছাত্রেরা সকাল আটটায় কলেজ হোস্টেল ও বেলা বারোটায় কলেজ প্রাঙ্গণে সমবেত হয়ে সভা করে এবং দৃঢ়তার সাথে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার প্রতিজ্ঞা নেয়। পূর্ব সন্ধ্যা পর্যন্ত সরকারের কাছে প্রেরিত চরমপত্রের কোন জবাব না পাওয়ার ফলে ২৭ তারিখে ছাত্রদেরকে আবার কলেজ প্রাঙ্গণে সমবেত হওয়ার জন্যে আহ্বান জানানো হয়।[৩৮]

ইডেন-কামরুন্নেসার ছাত্রী সংগ্রাম পরিষদ ছাত্রদেরকে সেদিন সকাল নয়টায় স্কুল প্রাঙ্গণে সমবেত হওয়ার জন্যে অনুরোধ করে।[৩৯]

ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ ও ইডেন-কামরুন্নেসা স্কুলের সংগ্রাম পরিষদ এক যুক্ত বিবৃতিতে জানান যে, ইডেন-কামরুন্নেসার শত শত ছাত্রী শান্তিপূর্ণভাবে ধর্মঘট চালিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও সরকার তাদের দাবীর প্রতিকারের কোন ব্যবস্থা করেন নাই। ঢাকা ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্রদের দাবীও অনুরূপভাবে উপেক্ষিত হওয়ার ফলে তারা ২৭শে নভেম্বর থেকে আমরণ অনশন ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। শিক্ষার প্রতি সরকারের চরম উদাসীনতার প্রতিবাদে যুক্ত বিবৃতিটিতে সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে তাঁরা ছাত্রছাত্রীদের প্রতি সংগ্রামের আহ্বান জানান। তাঁরা ২৭শে তারিখে মিছিল সহকারে ঢাকার সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীদেরকে বেলা বারোটায় সাধারণ প্রতিবাদ সভায় যোগদানের উদ্দেশ্যে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে সমবেত হওয়ার জন্যে অনুরোধ করেন।[৪০]

ধর্মঘটী ছাত্রছাত্রীদের সংগ্রামকে সমর্থন করে ২৭শে নভেম্বর পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ফেডারেশন, ছাত্রী সংঘ এবং নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগের পক্ষ থেকে সংবাদপত্রে বিবৃতি প্রচারিত হয়।[৪১]   

২৭শে নভেম্বর ঢাকাতে ধর্মঘটী ছাত্রছাত্রীদের সমর্থনে সাধারণ ছাত্র ধর্মঘট হয় এবং সারা শহরের ছাত্রছাত্রীরা বেলা দুটোর সময় বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে সমবেত হয়ে নিজেদের দাবী সম্পর্কে আলোচনা এবং সরকার ও কলেজ কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে।[৪২]

৩০শে নভেম্বর পর্যন্ত ইডেন-কামরুন্নেসার ধর্মঘট অব্যাহত রাখায় ১লা ডিসেম্বর প্রাদেশিক প্রধানমন্ত্রী নূরুল আমীন তাদেরকে ধর্মঘট প্রত্যাহার করে ক্লাসে যোগদানের জন্যে সংবাদপত্রে একটি বিবৃতি ও মারফত আবেদন জানান। বিবৃতিটিতে তিনি ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ এবং ইডেন-কামরুন্নেসা স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের ধর্মঘট সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন:

ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজের কিছুসংখ্যক ছাত্র ধর্মঘট করিয়া কলেজে যাওয়া বন্ধ করিয়াছে এবং তাহাদের কেহ কেহ কলেজে যোগদানেচ্ছু ছাত্রদের উপর বলপ্রয়োগও করিতেছে জানিয়া আমি ব্যথিত হইয়াছি। যে সময় জাতির জন্য একতা এবং নিয়মানুবর্তিতা একান্ত অপরিহার্য, ঠিক সেই সময়ে তাহাদের এই আচরণ আরও বেদনাদায়ক। আমি ব্যক্তিগতভাবে তাহাদের অভিযোগ সম্বন্ধে তদন্ত করিয়া দেখিয়াছি তাহাদের ধর্মঘটের পশ্চাতে কোন যুক্তিই নাই।

এবং

তরুণ মুসলিম ছাত্রীদের রাস্তায় রাস্তায় প্যারেড করিয়া বেড়ানো অত্যন্ত অসম্মানজনক এবং অশোভন। ইহা মুসলিম ঐতিহ্যের পরিপন্থী। পাকিস্তানে আমাদের, বিশেষ কিরয়া নারীদের মধ্যে ইসলামিক তমদ্দুন অনুসৃত হওয়া উচিত। আমি একান্তভাবে আশা করি যে, ছাত্রীরা এ বিষয়ে অবহিত হইবেন এবং ভবিষ্যতে অনুরূপ কার্য হইতে বিরত থাকিবেন। কারণ ইহাতে মুসলিম জনসাধারণ অত্যন্ত অস্বস্তি বোধ করেন।

নূরুল আমীন তাঁর বিবৃতিতে আগামী দুই বৎসরের মধ্যে কলেজের স্থানাভাব দূর করা, সেটিকে উচ্চ শ্রেণীতে উন্নীত করা, সেখানে বাণিজ্য বিভাগকে স্থায়ী করা ইত্যাদি বিষয়ে সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণের উল্লেখ করেন। এর পর তিনি আবার কলেজ স্কুলের ধর্মঘটী ছাত্রছাত্রীদের ধর্মঘটের অযৌক্তিকতা প্রসঙ্গে প্রথমে ইন্টারমিডিয়েট কলেজের ছাত্র এবং পরে ইডেন-কামরুন্নেসার ছাত্রীদেরকে উদ্দেশ্য করে বলেন:

শিক্ষকদের অগ্রিম বেতন, ভবিষ্যৎ উন্নতির আশা, চাকুরীর শর্তাশর্ত সম্পর্কে ছাত্রেরা যে অভিযোগ করিয়াছে, ‘প্রকৃত অবস্থার’ সহিত তাহার কোনই সামঞ্জস্য নাই। এ বিষয়টি চাকুরীদাতা এবং গ্রহীতার মধ্যে চাকুরীর এক সাধারণ শর্তের অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং অধিক বিলম্ব না করিয়া ধর্মঘট প্রত্যাহার করতঃ পড়াশোনায় মনোনিবেশ করিবার জন্য আমি ধর্মঘটী ছাত্রদের প্রতি আবেদন জানাইতেছি।

এবং

কামরুন্নেসা সরকারী বালিকা বিদ্যালয়ের ধর্মঘটী ছাত্রীদের প্রতিও আমি অনুরূপ আবেদন করিতেছি। কামরুন্নেসা স্কুলের কর্তৃপক্ষের পরামর্শক্রমেই কামরুন্নেসা এবং ইডেন বালিকা বিদ্যালয় একত্রিত করা হয়। দুইটি বিদ্যালয়ের বর্তমান মিলিত ছাত্রীসংখ্যা বিভাগ পূর্বকালীন কামরুন্নেসা বিদ্যালয়ের ছাত্রী সংখ্যা অপেক্ষাও কম। সরকার নারী শিক্ষার প্রতি যথেষ্ট গুরুত্ব দান করেন। ছাত্রী সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে স্কুল এবং কলেজের সংখ্যা বৃদ্ধি করা হইবে।

প্রধানমন্ত্রীর বিবৃতিতে ছাত্রছাত্রীদের ধর্মঘটের অযৌক্তিকতা এবং সুদূরপ্রসারী সরকারী পরিকল্পনা সম্পর্কে কিছু বললেও তাদের শিক্ষা এবং আবাসিক জীবনের নানা অসুবিধা সম্পর্কে তেমন কোন বক্তব্য তাতে ছিলো না। যাই হোক বিবৃতির মাধ্যমে তাঁর এই আবেদনের পূর্বেই ছাত্রদের কতকগুলি দাবী-দাওয়া স্বীকার করে নেওয়ায় ৩০ শে নভেম্বর দুপুর থেকে ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজের ছাত্রেরা ধর্মঘট প্রত্যাহর করে। যে সাতজন ছাত্র পঞ্চাশ ঘণ্টা উপবাস ছিলো তারাও তাদের অনশন ভঙ্গ করে।[৪৪]

সরকারী ইন্টারমিডিয়েট কলেজের ছাত্রদের ধর্মঘট অবসান এবং প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক ছাত্রীদের ধর্মঘট ‘মুসলিম ঐতিহ্যের পরিপন্থী’ এ কথা ঘোষণার পরও ইডেন-কামরুন্নেসার ছাত্রীরা তাদের ধর্মঘট ভঙ্গ না করায় শিক্ষামন্ত্রী আবদুল হামিদও সংবাদপত্রের মাধ্যমে একটি বিবৃতিতে[৪৫] বলেন যে সরকার মেয়েদের শিক্ষা বিস্তারের সুবিধা দান করতে সর্বদাই প্রস্তুত। এ ব্যাপারে তাদের অতিরিক্ত সুবিধাদানের সত্যিকার প্রয়োজন দেখা দিলে সরকার তা তাদেরকে দেবেন না ছাত্রীদের এরূপ আশংকা করা উচিত নয়। বিবৃতিটিতে তিনি আরও বলেন যে কামরুন্নেসা স্কুলের ন্যায়সঙ্গত অভাব-অভিযোগগুলি সরকারের বিবেচনাধীন আছে।

এর পর কর্তৃপক্ষ ছাত্রীদের দাবী আংশিকভাবে স্বীকার করে নেওয়ায় ৬ই ডিসেম্বর ছাত্রী সংগ্রাম পরিষদ ইডেন-কামরুন্নেসার প্রায় তিন সপ্তাহকাল স্থায়ী ধর্মঘটের অবসান ঘোষণা করে।[৪৬]

৩. পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলন

প্রাদেশিক স্বাস্থ্য মন্ত্ৰী হাবিবুল্লাহ বাহারের উদ্যোগে পূর্ব পাকিস্তানে সর্বপ্রথম একটি সাহিত্য সম্মেলনের ব্যবস্থা হয়। এই সম্মেলনের জন্যে যে অভ্যর্থনা সমিতি গঠিত হয় তাতে হাবিবুল্লাহ বাহার সভাপতি এবং অধ্যাপক অজিতগুহ ও সৈয়দ আলী আশরাফ উভয়ে সম্পাদক মনোনীত হন।[৪৭ দৈনিক আজাদ অফিসেই অভ্যর্থনা সমিতির বৈঠকগুলি অনুষ্ঠিত হয়।

৫ই ডিসেম্বর, রবিবার, অভ্যর্থনা সমিতির একটি সভায় ৮ স্থির হয় যে ৩১শে ডিসেম্বর, ১৯৪৮ ও ১লা জানুয়ারি ১৯৪৯ তারিখে পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। সম্মেলনের বিভিন্ন শাখা এবং শাখা সভাপতি সম্পর্কে বৈঠকটিতে নিম্নলিখিত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়:

অভ্যর্থনা – হাবিবুল্লাহ বাহার

মূল – ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ

কাব্য – জসীম উদ্‌দীন

শিশু সাহিত্য – বেগম শামসুন্নাহার

ভাষা বিজ্ঞান – আবুল হাসনাৎ

ইতিহাস – অধ্যক্ষ শরফুদ্দীন

পুঁথি সাহিত্য ও লোক সংস্কৃতি – ত্রিপুরাশংকর সেন শাস্ত্রী।

বিজ্ঞান – ডক্টর এসআর খাস্তগীর

চিকিৎসাবিজ্ঞান – ডক্টর আবদুল ওয়াহেদ

শিক্ষা – অধ্যক্ষ ইব্রাহিম খাঁ

৭ই ডিসেম্বর অভ্যর্থনা সমিতির বৈঠকে সম্মেলনের দ্বিতীয় দিন অর্থাৎ ১লা জানুয়ারী একটি ‘তাহজীব’ অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত হয়। এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানটির আয়োজনের জন্যে হাবিবুল্লাহ বাহার, সৈয়দ আলী আহসান, নাজির আহমদ, শামসুল হুদা, আবদুল আহাদ, আমিরুজ্জামান, আব্বাস উদ্দিন আহমদ, বেদারুদ্দীন আহমদ, মমতাজ আলী খান, লায়লা আরজুমন্দ বানু, মোহাম্মদ কাসেম, ফররুখ আহমদ, আবদুল কাইউম, ফতেহ লোহানী, নূরুল ইসলাম চৌধুরী, মুজীবর রহমান খাঁ, কাজী মোতাহার হোসেন, আসানুজ্জামান খাঁ, মোহাম্মদ সোলায়মান এবং খায়রুল কবীরকে নিয়ে একটি কমিটি গঠিত হয়।[৪৯] অনুষ্ঠান লিপি ও আনুষঙ্গিক ব্যবস্থাদি ঠিক করার জন্যে ১৭ই ডিসেম্বর বেলা ৩-৩০ মিনিটে ফজলুল হক হলের মিলনায়তনে উপরোক্ত অনুষ্ঠান কমিটির একটি বৈঠক বসে এবং তাতে অনুষ্ঠান সংক্রান্ত যাবতীয় ব্যাপার সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা হয়।[৫০]

সাহিত্য সম্মেলনের প্রস্তুতি চলাকালে ঢাকা প্রগতি লেখক ও শিল্পী সংঘের একটি বৈঠকে এই মর্মে মত প্রকাশ করা হয় যে, পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলনের উদ্দেশ্য প্রগতি সাহিত্য বিরোধী এবং প্রকৃত গণতন্ত্র ও গণসাহিত্যের পরিপন্থী। সেই অনুসারে তাঁরা একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে বলেন যে, অতঃপর লেখক সংঘের কোন সদস্য আসন্ন পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলনের সাথে কোন প্রকার সহযোগিতা করবেন না।

লেখক সংঘের উপরোক্ত ঘোষণাটি ২৯শে ডিসেম্বর আজাদ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় এবং তার ফলে সম্মেলনের অভ্যর্থনা সমিতির সম্পাদক অজিত গুহ একটা জটিল পরিস্থিতির সম্মুখীন হন। লেখক সংঘের সাথে তাঁর যোগাযোগ বরাবরই খুব ঘনিষ্ঠ ছিলো এবং ৩রা ডিসেম্বর সংঘের এক সাধারণ সভায় তাঁকে নোতুন বৎসরের জন্যে তার সভাপতিও করা হয়। অন্যান্যদের মধ্যে মুনীর চৌধুরী সম্পাদক এবং আবদুল্লাহ আলমুতী শরফুদ্দীন ও আলাউদ্দীন আল আজাদ যুগ্ম সহকারী সম্পাদক পদে নির্বাচিত হন।[৫১] সাহিত্য সম্মেলন বর্জন করার সিদ্ধান্ত সংঘের যে বৈঠকে নেওয়া হয় তাতে অজিত গুহ ব্যক্তিগতভাবে অনুপস্থিত ছিলেন এবং তাঁকে সেখানে উপস্থিত থাকার জন্যে কোন খবরও দেওয়া হয়নি।[৫২]

বস্তুতঃপক্ষে সম্মেলন বর্জন করার আকস্মিক সিদ্ধান্ত অজিত গুহের বিরুদ্ধে একটা শৃঙ্খলাগত ব্যবস্থা অবলম্বনের জন্যেই গৃহীত হয়। সম্মেলনের প্রস্তুতি বেশ কিছুদিন থেকেই চলে আসছিলো এবং অজিত গুহ তার অভ্যর্থনা সমিতির সম্পাদক হিসেবেও কয়েক সপ্তাহ ধরে কাজ করে আসছিলেন। কাজেই সম্মেলন সম্পর্কে লেখক সংঘ পূর্বেই একটা সিদ্ধান্ত নিতে পারতো। কিন্তু তারা তা নেয়নি। এর কারণ বর্জন সংক্রান্ত তাদের প্রস্তাবটির একটা পূর্ব ইতিহাস ছিলো যেটিকে বাদ দিয়ে সেই সিদ্ধান্তের সত্যিকার অর্থ ও তাৎপর্য বোঝা যাবে না।

রবীন্দ্র গুপ্ত নামে ভবানী সেন কলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘মার্কসবাদী’তে রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে একটি প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথকে প্রগতিবিরোধী সাহিত্যিক হিসাবে চিত্রিত করেন। সেই হিসাবে প্রগতিশীল সাহিত্যিকদের রবীন্দ্র সাহিত্য বর্জন করা একটি বৈপ্লবিক দায়িত্ব এই মর্মেও তিনি প্রবন্ধটিতে অভিমত প্রকাশ করেন। তাঁর এই বক্তব্যকে কেন্দ্র করে পশ্চিম বাঙলার সুধী ও সাহিত্যিক মহলে ১৯৪৮ সালে এক দারুণ বিতর্কের সৃষ্টি হয়। সুশোভন সরকার, গোপাল হালদার প্রভৃতি ভবানী সেনের রবীন্দ্রনাথ বর্জনের প্রস্তাবের বিরোধিতা করে লেখালেখি করেন এবং তাঁরা ছাড়াও অন্যান্যদের মধ্যে এই বিতর্ক বেশ ব্যাপক আকার ধারণ করে।

১৯৪৮ এর শেষের দিকে এই বিতর্কের ঢেউ পূর্ব-বাঙলায়, বিশেষতঃ ঢাকাতেও এসে পৌঁছায় এবং লেখক সংঘের অধিকাংশ সদস্যদের মধ্যেই রবীন্দ্রবিরোধী বক্তব্যই প্রাধান্য লাভ করে। মোটামুটিভাবে বলা চলে যে রবীন্দ্রনাথ প্রগতিবিরোধী কাজেই তাঁকে সেই হিসাবে বর্জন করার সিদ্ধান্ত লেখক সংঘে নীতিগতভাবে স্বীকৃত হয়।[৫৩] মুনীর চৌধুরী, আখলাকুর রহমান, আবদুল্লাহ আলমুতী প্রভৃতি এই রবীন্দ্রবিরোধিতার পুরোভাগে ছিলেন। এখানেই অজিত গুহের সাথে তাঁদের সরাসরি বিরোধ বাধে। কারণ অজিত গুহ রবীন্দ্রনাথকে প্রগতি বিরোধী সাহিত্যিক হিসাবে স্বীকার করতে অথবা তাঁকে বর্জন করতে সম্মত ছিলেন না।[৫৪]

প্রথমদিকে এই বিতর্ক লেখক সংঘের সদস্যদের মধ্যে মোটামুটিভাবে সীমাবদ্ধ থাকলেও সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের একটি সাহিত্য সভায় তা একটা সাধারণ বিতর্কে পরিণত হয়। এই সাহিত্য সভাটিতে হলের প্রভোস্টের সভাপতিত্বে ডক্টর শহীদুল্লাহ এবং অন্যান্যেরা আলোচনায় যোগদান করেন।[৫৫]

লেখক সংঘের সদস্য আখলাকুর রহমান এই সাহিত্য সভায় অংশগ্রহণকালে তাঁদের রবীন্দ্রবিরোধী বক্তব্যের সমর্থনে রবীন্দ্রনাথের ‘ভারত তীর্থ’ কবিতাটি থেকে—

পশ্চিম আজি খুলিয়াছে দ্বার, সেথা হতে সবে আনে উপহার
দিবে তার নিবে, মিলাব মিলিবে, যাবে না ফিরে-
এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে।।

এই অংশটি উদ্ধৃত করে বলেন যে কবিতাটিতে রবীন্দ্রনাথ বস্তুত সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজের ভারত অধিকারকে সমর্থন জানিয়েছেন এবং সেই হিসাবে সাহিত্যক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা মূলতঃ প্রতিক্রিয়াশীল। তিনি তীব্র ভাষায় রবীন্দ্রনাথ এবং রবীন্দ্র সাহিত্যের বিরুদ্ধে এ ধরনের আরও অনেক কিছু বলেন।

আখলাকুর রহমানের এই বক্তৃতা শেষ হওয়ার পর প্রগতি লেখক ও শিল্পী সংঘের সভাপতি অজিত গুহ তাঁর উপরোক্ত বক্তব্যের বিরোধিতা করেন এবং রবীন্দ্রনাথ থেকে অন্যান্য উদ্ধৃতি দিয়ে তাঁর সাহিত্যের প্রগতিশীল ভূমিকাকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেন। ডক্টর শহীদুল্লাহও আখলাকুর রহমানের বক্তব্যের প্রতিবাদ করে বক্তৃতা দেন।

সলিমুল্লাহ হলের এই সাহিত্য সভার পর লেখক সংঘের অভ্যন্তরে অজিত গুহের বিরুদ্ধে দারুণ বিক্ষোভ দেখা দেয় এবং লেখক সংঘের সভাপতি হওয়া সত্ত্বেও জনসাধারণের সামনে রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে ভুল বক্তব্য হাজির করার জন্যে তাঁরা তাঁর বিরুদ্ধে একটা শৃঙ্খলাগত ব্যবস্থা অবলম্বনের সিদ্ধান্ত নেন। সেই সিদ্ধান্তকে কার্যকর করার প্রাথমিক ব্যবস্থা হিসাবে তাঁরা পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলনকে মাত্র দুইদিন পূর্বে আকস্মিকভাবে বর্জন করার প্রস্তাব করেন।

পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলন বর্জন করার সপক্ষে লেখক সংঘের সিদ্ধান্ত আকস্মিক হলেও তার সঙ্গত কারণও অবশ্য ছিলো – সম্মেলনটি সর্বতোভাবে সরকারী উদ্যোগে আয়োজিত হওয়ায় স্বভাবতঃই তার মধ্যে প্রতিক্রিয়াশীলদের প্রাধান্য ছিলো অনস্বীকার্য।

কিন্তু তা সত্ত্বেও সম্মেলনটিকে দুদিন পূর্বে বর্জন করার সিদ্ধান্তের ফলে অভ্যর্থনা সমিতির সম্পাদক হিসাবে অজিত গুহ শেষ পর্যন্ত তাতে যোগদান করাই স্থির করেন। তবে তাঁর এই সিদ্ধান্তের অন্যতম কারণ ছিল এই যে তিনি ইতিমধ্যে সঠিকভাবে একথা জেনেছিলেন যে লেখক সংঘের সদস্যেরা তাঁকে সংঘ থেকে বহিষ্কার করতে বদ্ধপরিকর হয়েছিলেন। কাজেই সংঘের এই সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে তাদের সম্মেলন বিরোধী প্রস্তাব অনুযায়ী সম্মেলন বর্জন করতে তিনি নিজেকে বাধ্য মনে করেননি।[৫৬] পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার পর সংঘের নির্দেশ অমান্য করে তাতে যোগদানের অভিযোগে সম্মেলনের পরেই অজিত গুহকে প্রগতি লেখক ও শিল্পী সংঘ থেকে বহিষ্কার করা হয়।[৫৭]

৩১শে ডিসেম্বর, শুক্রবার, বিকেল ২.৩০ মি. কার্জন হলে বিপুল জনসমাগমের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম সাহিত্য সম্মেলনের প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। মৌলানা আবদুর রহিমের কোরান পাঠের দ্বারা সম্মেলনের উদ্বোধন হয়। তারপর কবি গোলাম মোস্তফা নবজাগ্রত নবচেতনা এবং সাহিত্য সাধনার ভবিষ্যৎ ও সাহিত্যিকদের কর্তব্য সম্পর্কে উচ্ছ্বসিত ভাষায় আলোচনা করেন। বেদারউদ্দীন, বিমলচন্দ্র রায়, শেখ লুৎফর রহমান প্রভৃতি রেডিও পাকিস্তানের শিল্পীবৃন্দ, আবদুল আহাদের পরিচালনায় নজির আহমদ রচিত “পাকিস্তান জিন্দাবাদ” নামে একটি গান পরিবেশন করেন।[৫৮]

তারপর অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি হাবিবুল্লাহ বাহার তাঁর ভাষণে শাহী জামানার ঢাকা ও পূর্ব-বাঙলার শিল্প, সাহিত্য ও স্থাপত্যের বিস্তারিত আলোচনা করেন। এই আলোচনার উপসংহারে তিনি বলেন:

এই দেশের সাহিত্যের ইতিহাস শাস্ত্রকার ও অভিজাতদের সঙ্গে জনগণের বিরোধের ইতিহাস। এ বিরোধে বারে বারে জনগণের জয় হয়েছে। জনগণের ভাষা বাঙ্গালাকে শাস্ত্রকাররা বর্জন করেছিলেন। তখন সেই ভাষা সাম্যবাদী ও গণতন্ত্রী পাঠান সুলতান ও আমীর ওমরাদের সমর্থন পেয়েছিলো।[৫৯] এই জন্যই দেখি কৃত্তিবাস, বিদ্যাপতি থেকে আরম্ভ করে আদিযুগের হিন্দু কবিরা এদের বন্দনা করেছেন কৃষ্ণের অবতার বলে। শুধু সমর্থন নয় রামায়ণ-মহাভারতের সঙ্গে অসংখ্য আরবী ফারসী গ্রন্থের অনুবাদ করেছেন মুসলিম সাহিত্যিকরা। এখনো মুসলিম কবিদের লেখা প্রায় দশ হাজার পুঁথি বঙ্গ সাহিত্যের জয় ঘোষণা করছে।

বঙ্গসাহিত্য পুষ্টিলাভ করেছে স্থানীয় ও মুসলিম তাহজিব-তমদ্দুনের সংঘাতের ফলে। এই সংঘাতেরই ফলে জন্ম হয়েছে শ্রী চৈতন্যের ও চৈতন্য পরবর্তী সাহিত্যের যার প্রাণবাণী ‘সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই।’

ইসলামী বিপ্লব বাঙ্গালায় সম্পূর্ণ হয় নাই নানা কারণে। তা সত্ত্বেও ইসলাম এখানে যেটুকু প্রভাব বিস্তার করেছে, তারই ফলে দেখি বাঙ্গালী ভারতের অন্য প্রদেশের চেয়ে বেশী গণতন্ত্রী, বেশী সাম্যবাদী, বেশী বিপ্লবী।

ইংরেজ আগমনের পরে আবার হয় সংস্কৃতি সংঘাত। এ দেশীয় মুসলিম ও ইউরোপীয় সংস্কৃতির সম্মেলনে হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের জন্ম। রবীন্দ্র পরবর্তী বাঙ্গালা সাহিত্যের সমৃদ্ধি যতখানি হয়ে থাকুক, এ সাহিত্যের বিরাট ত্রুটি এই যে, এর সঙ্গে ছিলো না গণমানসিকতার যোগ। এ ছিল মধ্যবিত্ত সমাজের সাহিত্য যাকে বলা যায় শহুরে সাহিত্য।

আজ আমরা স্বাধীনতা লাভ করেছি। পূর্ববঙ্গে জন্ম হয়েছে পাকিস্তান রাষ্ট্রের। শহর থেকে দূরে স্বাধীনতার আবহাওয়ায় তৈরী হবে আমাদের নূতন যুগের নূতন সাহিত্য। এতদিন বাঙ্গালা সাহিত্যে জনগণের জীবন প্রতিফলিত হয় নাই। এবার তাই হবে, নূতন পাকিস্তানী সাহিত্যে আমরা দেখতে পাবো ঐ সব মানুষের জীবনের ছবি, যারা মাটিতে ফলায় সোনা, পদ্মা, মেঘনা, সাগর- মহাসাগরে দেয় পাড়ি, ধানের ক্ষেতে বাজায় বাঁশী। এ সাহিত্য দেশের দুঃসাহসী জনগণের সাহিত্য।

পাকিস্তানের সোনার কাঠির স্পর্শে আজ পূর্ববঙ্গে জাগছে কবি, জাগছে শিল্পী, জাগছে নূতন যুগের সাহিত্যিক। শক্তিধর সৃষ্টিধর্মী শিল্পীর পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে। আজিকার সমবেত সাহিত্যিকদের মধ্য দিয়ে সেই অনাগত শিল্পীকে জানাই খোশ আমদেদ।[৬০]

ডক্টর শহীদুল্লাহ মূল সভাপতি হিসাবে তাঁর ভাষণে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নিজের মতামত ব্যক্ত করেন। জাতীয় সাহিত্য সম্পর্কে তিনি বলেন:

স্বাধীন পূর্ব বাংলার স্বাধীন নাগরিকরূপে আজ আমাদের প্রয়োজন হয়েছে সর্ব শাখায় সুসমৃদ্ধ এক সাহিত্য। এই সাহিত্যে আমরা আজাদ পাক-নাগরিক গঠনের উপযুক্ত প্রয়োজনীয় বিষয়ের অনুশীলন চাই। এই সাহিত্য হবে আমাদের মাতৃভাষা বাংলায়। পৃথিবীর কোন জাতি জাতীয় সাহিত্য ছেড়ে বিদেশী ভাষায় সাহিত্য রচনা করে যশস্বী হতে পারেনি। ইসলামের ইতিহাসের একেবারে গোড়ার দিকেই পারস্য আরব কর্তৃক বিজিত হয়েছিল, পারস্য আরবের ধর্ম নিয়েছিল, আরবী সাহিত্যেরও চর্চা করেছিল। কিন্তু তার নিজের সাহিত্য ছাড়েনি।[৬১]

হরফ সমস্যা সম্পর্কে তিনি বলেন:

কিছুদিন থেকে বানান ও অক্ষর সমস্যা দেশে দেখা দিয়েছে। সংস্কারমুক্তভাবে এগুলির আলোচনা করা উচিত এবং তার জন্য বিশেষজ্ঞদের নিয়ে পরামর্শ সমিতি গঠন করা আবশ্যক। যাঁরা পালি, প্রাকৃত ও ধ্বনিতত্ত্বের সংবাদ রাখেন, তাঁরা স্বীকার করতে বাধ্য যে বাংলা বানান অনেকটা অবৈজ্ঞানিক, সুতরাং তার সংস্কার দরকার। স্বাধীন পূর্ব বাংলায় কেউ আরবী হরফে, কেউ বা রোমান অক্ষরে বাংলা লিখতে উপদেশ দিচ্ছেন। কিন্তু বাংলার শতকরা ৮৫ জন যে নিরক্ষর, তাদের মধ্যে অক্ষরজ্ঞান বিস্তারের জন্য কি চেষ্টা হচ্ছে? যদি পূর্ব বাঙলার বাইরে বাংলাদেশ না থাকতো আর যদি গোটা বাংলাদেশে মুসলমান ভিন্ন অন্য সম্প্রদায় না থাকতো, তবে এই অক্ষরের প্রশ্নটা এতো সঙ্গীণ হত না। আমাদের বাংলাভাষী প্রতিবেশী রাষ্ট্র ও সম্প্রদায়ের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে হবে। কাজেই বাংলা অক্ষর ছাড়তে পারা যায় না। পাকিস্তান রাষ্ট্র ও মুসলিম জগতের সঙ্গে সম্পর্ক রাখার প্রয়োজনীয়তা আমরা স্বীকার করি। তার উপায় আরবী হরফ নয়; তার উপায় আরবী ভাষা। আরবী হরফে বাংলা লিখলে বাংলার বিরাট সাহিত্য ভাণ্ডার থেকে আমাদিগকে বঞ্চিত হতে হবে। অধিকন্তু আরবীতে এতগুলি নতুন অক্ষর ও স্বরচিহ্ন যোগ করতে হবে যে বাংলার বাইরে তা যে কেউ অনায়াসে পড়তে পারবে তা বোধ হয় না। ফলে যেমন উর্দু ভাষা না জানলে কেউ উর্দু পড়তে পারবে না, তেমনি হবে বাংলা।

শিক্ষা এবং অনুশীলনের সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন প্রসঙ্গে তিনি বলেন :

আমরা পূর্ব বাংলার সরকারকে ধন্যবাদ দেই যে তাঁরা বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক রাষ্ট্রভাষা রূপে গ্রহণ করে বাংলা ভাষার দাবীকে আংশিকরূপে স্বীকার করেছেন। কিন্তু সরকারের ও জনসাধারণের এক বিপুল কর্তব্য সম্মুখে রয়েছে। পূর্ব বাংলা জনসংখ্যায় গ্রেট বৃটেন, ফ্রান্স, ইতালি, স্পেন, পর্তুগাল, আরব, পারস্য, তুর্কি প্রভৃতি দেশের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। এই সোনার বাংলাকে কেবল জনে নয়, ধনে ধান্যে, জ্ঞানে গুণে, শিল্প বিজ্ঞানে পৃথিবীর যে কোন সভ্য দেশের সমকক্ষ করতে হবে। তাই কেবল কাব্য ও উপন্যাসের ক্ষেত্রে বাংলাকে সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না। দর্শন, ইতিহাস, ভূগোল, গণিত, রসায়ন, পদার্থবিদ্যা, ভূতত্ত্ব, জীবতত্ত্ব, ভাষাতত্ত্ব, অর্থনীতি, মনোবিজ্ঞান, প্রত্নতত্ত্ব প্রভৃতি জ্ঞান বিজ্ঞানের সকল বিভাগে বাংলাকে উচ্চ আসন দিতে হবে। তার জন্য শিক্ষার মাধ্যমে স্কুল কলেজ মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালয় আগাগোড়া বাংলা করতে হবে।[৬৩]

এর পর আবার উর্দু শিক্ষার উপরও জোর দিতে গিয়ে তিনি বলেন:

আযাদ পাকিস্তানে আমাদের অবিলম্বে শিক্ষা তালিকার সংস্কার করতে হবে। এই নূতন তালিকায় রাষ্ট্রভাষা উর্দুকে স্থান দিতে হবে। যারা এতদিন রাষ্ট্রভাষা রূপে ইংরেজির চর্চা করেছে, তাদের উর্দু শিখতে কি আপত্তি থাকতে পারে?[৬৪]

মূল সভাপতির ভাষণে ডক্টর শহীদুল্লাহর উপরোক্ত বক্তব্যসমূহ ছাড়াও তাঁর বক্তব্যের যে অংশটি সর্বাপেক্ষা গুরুতর বিতর্কের সৃষ্টি করে তা হলো:

আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য, তার চেয়ে বেশী সত্য আমরা বাঙালী। এটি কোন আদর্শের কথা নয়, এটি একটি বাস্তব কথা। মা প্রকৃতি নিজের হাতে আমাদের চেহারায় ও ভাষায় বাঙ্গালীত্বের এমন ছাপ মেরে দিয়েছেন যে, মালা-তিলক-টিকিতে কিংবা টুপি- লুঙ্গি-দাড়িতে ঢাকবার জো টি নেই।[৬৫]

ডক্টর শহীদুল্লাহর ভাষণ এবং প্রথম অধিবেশনের অন্যান্য লেখাগুলি পড়া শেষ হওয়ার পর পূর্ব-বাঙলা সরকারের শিক্ষা দফতরের সেক্রেটারী ফজলে আহমদ করিম ফজলী সৈয়দ আলী আহসানকে বলেন যে তিনি শ্রোতাদেরকে উদ্দেশ্য করে বাংলাতে কিছু বলতে চান। হাবিবুল্লাহ বাহার এ ব্যাপারে বিশেষ উৎসাহিত বোধ না করলেও শেষ পর্যন্ত সম্মত হন।[৬৬]

ফজলী বক্তৃতা দিতে উঠে প্রথমেই বলেন, ‘আজ এখানে যে সমস্ত প্রবন্ধগুলি পড়া হলো সেগুলি শোনার পর আমি ভাবছি আমি কি ঢাকাতে আছি না কলকাতায়।’ ফজলী তাঁর বক্তৃতায় ভাষা সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন যে পশ্চিম বাঙলার বাংলা ভাষার সাথে পূর্ব পাকিস্তানের বাংলার সংযোগ থাকার কোন কারণ নেই। কমিউনিস্টদের একটি জিনিস তাঁর খুব পছন্দ বলেও তিনি উল্লেখ করেন – কমিউনিস্টরা মনে করে যে সকল দেশের কমিউনিস্ট পরস্পরের সাথী এবং ভাই। কাজেই সে অবস্থায় পশ্চিম বাংলার হিন্দুদের সাথে এবং তাদের ভাষার সাথে পূর্ব পাকিস্তানী মুসলমানদের ভাষার যোগ কোথায়? এই সব মন্তব্য ছাড়াও তিনি সভাপতি ডক্টর শহীদুল্লাহর অভিভাষণের অনেক সরাসরি সমালোচনাও করেন।[৬৭]

ফজলী অনর্গল কথা বলে যাচ্ছিলেন এবং তাঁর বক্তৃতা শেষ হওয়ার কোন লক্ষণ না দেখে হাবিবুল্লাহ বাহার সভা চলাকালে সভাপতির সমালোচনা করা উচিত নয়, এই বলে ফজলীকে তাঁর বক্তৃতা শেষ করতে বলেন। কিন্তু স্বাস্থ্য মন্ত্রীর এই অনুরোধ সত্ত্বেও স্বাস্থ্য ও শিক্ষা দফতরের সেক্রেটারী তাঁর বক্তৃতা শেষ করতে সম্মত হলেন না। শুধু তাই নয়, পূর্ব ব্যবস্থা অনুযায়ী তাঁর কিছু সমর্থকও সেই সভাস্থলে উপস্থিত ছিলো, যারা হাবিবুল্লাহ বাহারের উপর এক সময় ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে এবং ফজলীকে বক্তৃতা করতে দেওয়ার জন্যে চীৎকার করে।[৬৮] এর পর ফজলী আরও অল্পক্ষণ বক্তৃতা করে আবোল তাবোল অনেক কিছু বলায় হাবিবুল্লাহ বাহার ভয়ানক উত্তেজিত হয়ে ওঠেন এবং তাঁকে মিথ্যাবাদী’ ইত্যাদি বলে তৎক্ষণাৎ বক্তৃতা শেষ করতে বলেন।[৬৯] এই পর্যায়ে প্রাদেশিক মন্ত্রী এবং তাঁর দফতরের সেক্রেটারীর মধ্যে খোলাখুলিভাবে তর্কবিতর্ক এবং অশালীন মন্তব্য বিনিময় হয়। অবস্থা প্রায় আয়ত্তের বাইরে যাওয়ার উপক্রম হলে অজিত গুহ এবং আলী আহসান মাইকের কাছে গিয়ে ফজলীকে মাইক ছেড়ে সভামঞ্চ থেকে নীচে নামতে বলেন। এতে ফজলী অজিত গুহের উপর খুব রুষ্ট হন। কিন্তু আলী আহসান আবার তাঁকে এই বলে মঞ্চ ত্যাগ করতে বলেন যে তিনি সভাস্থলে আর কিছুক্ষণ থাকলে ছাত্রদের হাতে মার খাওয়ার সম্ভাবনা।[৭১]

মঞ্চের উপর উদ্ভূত পরিস্থিতির ফলে ইতিমধ্যে সাধারণ শ্রোতারাও ফজলীর উপর ভয়ানক ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে এবং তাঁর বিরুদ্ধে নানাপ্রকার ব্যাঙ্গাত্মক ধ্বনি দিতে থাকে। সেই অবস্থায় বাধ্য হয়েই স্বাস্থ্য ও শিক্ষা দফতরের সেক্রেটারী ফজলে আহমদ করিম ফজলী সভাস্থলে উপস্থিত লোকজনের বিপুল করতালির মধ্যে ক্রুদ্ধচিত্তে সভাস্থল পরিত্যাগ করেন।[৭২] ফজলীর উপরোক্ত আচরণে হাবিবুল্লাহ বাহার তাঁর প্রতি ভয়ানক রুষ্ট এবং অসন্তুষ্ট হন। সম্মেলন শেষ হওয়ার পরই তিনি চীফ সেক্রেটারী আজিজ আহমদকে বলে তাঁকে স্বাস্থ্য দফতরের সেক্রেটারীর পদ থেকে অপসারণ করে অন্য একজনকে সেই পদে নিযুক্ত করেন।[৭৩] ফজলী অবশ্য অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা দফতরের সেক্রেটারীর পদে যথারীতি বহাল থাকেন।

সম্মেলনের দ্বিতীয় দিন ১লা জানুয়ারী আজাদ-এ সম্মেলনের উপর একটি সম্পাদকীয় প্রকাশিত হয়। সম্পাদকীয়টিতে সম্মেলন সম্পর্কে অত্যন্ত বিরূপ আলোচনার সংবাদ পেয়ে ৩১শে ডিসেম্বর রাত্রেই হাবিবুল্লাহ বাহার আজাদ অফিসে গিয়ে আবুল কালাম শামসুদ্দীনের সাথে দেখা করে সেটা বাতিলের চেষ্টা করেন। কিন্তু আজাদ অফিসে সম্পাদকের দেখা না পেয়ে এবং অন্যত্র সন্ধান করেও ব্যর্থ হয়ে তিনি শেষ পর্যন্ত এ ব্যাপারে কিছু করতে অক্ষম হন।[৭৪] কাজেই সম্পাদকীয়টি যথারীতি ১লা জানুয়ারী প্রকাশিত হয় এবং তাতে আজাদ সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দীন ডক্টর শহীদুল্লাহর সমালোচনা প্রসঙ্গে বলেন:

সভাপতি তাঁর ভাষণের এক স্থানে বলিয়াছেন, ‘আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য, তার চেয়ে বেশী সত্য আমরা বাঙ্গালী। এটি কোন আদর্শের কথা নয়, এটি একটি বাস্তব কথা। মা প্রকৃতি নিজের হাতে আমাদের চেহারায় ও ভাষায় বাঙ্গালীত্বের এমন ছাপ মেরে দিয়েছেন যে, তা মালা-তিলক-টিকিতে কিংবা টুপি-লুঙ্গি-দাড়িতে ঢাকবার জো টি নেই।’ অখণ্ড ভারতের যুক্ত বাংলায় সাহিত্যিক অভিভাষণে এমন কথা অনেকেই বলিয়াছেন বটে; কিন্তু বিভক্ত ভারতের দ্বিখণ্ডিত বাংলায় পাকিস্তানী পরিবেশে এই শ্রেণীর কথা শুনিতে হইবে, এ কথা ভাবা একটু কঠিন ছিল বৈ কি। তা ছাড়া কোন হিন্দু লেখক নয়, একেবারে স্বয়ং ডক্টর শহীদুল্লাহ ‘মা প্রকৃতির’ এমন স্তব গাহিবেন, একথাই বা কে ভাবিতে পারিয়াছিল। উপরোক্ত সম্পাদকীয়টিতে আরও বলা হয় যে ডক্টর শহীদুল্লাহ তাঁর ভাষণে ইসলামী ভাবধারা আমদানীর কোন প্রয়োজন বোধ করেননি। দ্বিতীয় দিনের অধিবেশনে ডক্টর শহীদুল্লাহ এক মৌখিক ভাষণে আজাদ-এর সম্পাদকীয়টির জবাব দিতে গিয়ে বলেন যে, ইসলাম সম্পর্কে কোন কথা বলার অধিকার দৈনিক পত্রিকাটির অপেক্ষা তাঁরই বেশী। কাজেই এ বিষয়ে তাদের মন্তব্য অনধিকার চর্চা ব্যতীত কিছুই নয়।[৭৫]

দ্বিতীয় দিনের অধিবেশনে সম্মেলনে একটি কার্যকরী সংসদ গঠনের প্রস্তাব আনা হয়। এই প্রস্তাবে অন্যান্যেরা ছাড়া হাবিবুল্লাহ বাহার, শামসুন্নাহার মাহমুদ, সৈয়দ আলী আহসান, সৈয়দ আলী আশরাফের নামও ছিলো। কার্যকরী সংসদ সংক্রান্ত প্রস্তাবটি উত্থাপন করার পর অধ্যাপক আবুল কাসেম তার প্রতিবাদ করেন। এর পর আরও কয়েকজন তাঁর সাথে এই প্রতিবাদে যোগ দেন। তাঁদের বক্তব্য ছিলো এই যে বাঙলার গ্রগতিবাদী তরুণ লেখক এবং ঢাকার বাইরের অনেক নামজাদা সাহিত্যিককে তার থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে।

প্রতিবাদের ফলে হাবিবুল্লাহ বাহার নিজেই প্রস্তাবটি প্রত্যাহার করেন। দ্বিতীয় দিনের অধিবেশনে ব্যবস্থাপক সভায় বাংলাকে পূর্ব-বাঙলার রাষ্ট্রভাষা করার যে প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিলো তাকে কার্যকরী করার জন্যে আবুল কাসেম একটি প্রস্তাব করেন এবং সর্বসম্মতিক্রমে সে প্রস্তাব গৃহীত হয়।[৭৬]

‘পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলনে কি দেখিলাম’ এই শিরোনামায় আকালী চৌধুরী কর্তৃক লিখিত প্রত্যক্ষদর্শীর একটি বিস্তৃত বিবরণ ৯ই জানুয়ারী ১৯৪৯-এর সাপ্তাহিক সৈনিক-এ প্রকাশিত হয়। বিবরণটির কয়েকটি অংশ উল্লেখযোগ্য।

সম্মেলন সম্পর্কে সাধারণভাবে মন্তব্য করতে গিয়ে তাতে বলা হয়:

পুরা একটি বছর এত ঢোল শহরতের পর সম্মেলনে যা পরিবেশন করলেন তা বহু কষ্টে পর্বতের মূষিক প্রসবের মতোই হয়েছিলো। গিয়েছিলাম পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলনে কিন্তু সেখানে না পেলাম পূর্ব পাকিস্তানকে আর না পেলাম পূর্ব পাকিস্তানের সাহিত্যকে I ঢাকার বাইরে যে পূর্ব পাকিস্তান আছে তা বোধহয় সম্মেলনের উদ্যোক্তরা মনেই করেননি 1 ডক্টর শহীদুল্লাহর ভাষণে বিক্ষুব্ধ প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণটিতে বলা হয় :

মূল সভাপতি পণ্ডিতপ্রবর শহীদুল্লাহ সাহেব তো তবু নূতন কথা কিছু আমাদের শুনিয়েছেন- মুসলমানের চেয়েও বেশী সত্য আমরা বাঙ্গালী, প্রকৃতি মা যেন আমাদের চেহারায় ছাপ মেরে দিয়েছেন; টিকি টুটিতে আমাদের ফরখ্ করবে কি করে।

নূতন কথাই বটে, মিস্টার জিন্নাহ আর তাঁর চেলা-ফেলাদের এই এতদিনকার পুরানো দুই জাতিত্বের রক্তক্ষয়ী চীৎকারের পর এবং পাকিস্তান কায়েম হওয়ার পরও মুসলমানদের চাইতে আমাদের বাঙ্গালী পরিচয়টাই খাঁটি সত্য এর চেয়ে অভিনব কথা আর কি হতে পারে? ‘পূর্ব পাকিস্তানের’ সাহিত্য সম্মেলনের প্রধান পুরোহিতের যোগ্য কথাই বটে।

এর পর আজাদ-এর সম্পাদকীয় সমালোচনা এবং ডক্টর শহীদুল্লাহর জবাবের জের টেনে বিবরণদাতা বলেন:

কিন্তু এত বড় পণ্ডিত ব্যক্তির সমালোচনা করতে যাবো না – এ ব্যাপারে ভয়ও আছে যথেষ্ট নিতান্ত অর্বাচীনের মতো কোন একটা দৈনিক সভাপতি সাহেবের খুঁত ধরতে গিয়েছিলো, বলতে চেয়েছিলো আমাদের সাহিত্যিক পিতামহ এই সভাপতি সাহেব দাদুর গল্পের মতোই সাহিত্যের অনেক পুরানো কাহিনী আমাদের শুনিয়েছেন। নূতন কিছু শুনাতে পারেননি! সভাপতি সাহেব তার মুখের মতো উত্তরই দিয়েছেন – এসব তিনি ভয় করবেন কেন! এরকম সমালোচনা কত তাঁর পায়ের তলা দিয়ে গড়ায়। শুধু তাই নয়, দৈনিকটি যে বলেছিলো ডক্টর সাহেব আমাদের সাহিত্যে ইসলামী ভাবধারা আমদানীর কোন প্রয়োজন অনুভব করেননি এ নাকি তার অনধিকার চর্চা। আমরাও স্বীকার করি। চোরের মুখে ধর্মের কাহিনী!

সম্মেলন আয়োজনের ক্ষেত্রে সরকারী মহলের উদ্যোগ এবং প্রথম দিনের অধিবেশনে হাবিবুল্লাহ বাহার ও ফজলীর ক্রুদ্ধ বাক্য বিনিময় সম্পর্কে বিবরণটির প্রাথমিক অংশটি উল্লেখযোগ্য :

দ্বিতীয় অধিবেশন আরম্ভ হওয়ার আগে কে একজন বলছিলো – এটাতো ইডেন বিল্ডিং সম্মেলন। ভদ্রলোকের অজ্ঞতা দেখে হেসেছিলাম – এখন আবার হাসলাম। বোকার ‘তৃতীয় হাসি’, অর্থাৎ এখন বুঝে হাসলাম। সম্মেলনের উদ্যোক্তাগণ সাহিত্য সম্মেলনের আয়োজনে সাহিত্যিকদের না ডেকে বড় বড় সরকারী কর্মচারীদের সহযোগিতা কামনা করেছেন বেশী করে, এই বোধহয় ছিল ভদ্রলোকটির ইশারা। কথাটা আমাদের আগেই বুঝা উচিত ছিলো। প্রথম দিনের অধিবেশনে ইডেন বিল্ডিং এর বিশিষ্ট কর্মচারী শিক্ষা বিভাগের সেক্রেটারী অবাঙালী এফএ করিম সাহেবকে বাংলা ভাষায় তমদ্দুন সম্বন্ধে বলতে দিয়ে পরে স্বভাবতঃ বক্তৃতাটা কিছু অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেলে সভপতির অপেক্ষা না করেই বাহার সাহেব যেভাবে ভদ্রলোককে ধমক দিয়েছিলেন (আর নিজেও ধমক খেয়েছিলেন) তাতে ইডেন বিল্ডিং এর কথাটা মনে হওয়া উচিত ছিলো আমাদের তখন। কিন্তু উজিরে সেক্রেটারীতে বেঁধে গেলো মুরগীর লড়াই। ব্যাপারটা দেখতে উপভোগ্য হয়েছিলো। মন্দ নয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পরাজিত, আর বাহার সাহেবের কাছে প্রেরণা পেয়ে হাজার হাজার লোকের হাততালির মধ্যে অপমানিত ও বিতাড়িত ভদ্রলোকের জন্যে সহানুভূতিতে প্রাণটা এতই আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলো যে তখন আর কিছু ভাববারই অবসর ছিলো না। এবার কথাটা বুঝলাম, আর এও বুঝলাম উজির সাহেবানদের সেক্রেটারীরা তাঁদেরকে থোড়াই কেয়ার করে থাকেন।

১৯৪৮ সালের এই সাহিত্য সম্মেলন এবং তৎকালীন রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে ডক্টর শহীদুল্লাহ ১৯৫৪ সালের এপ্রিল মাসে অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলনের উদ্ধোধনী ভাষণে নিম্নলিখিত মন্তব্য প্রকাশ করেন:

১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্টে বহু দিনের গোলামীর পর যখন আযাদীর সুপ্রভাত হলো তখন প্রাণে আশা জেগেছিল যে এখন স্বাধীনতার মুক্ত বাতাসে বাংলা সাহিত্য তার সমৃদ্ধির পথ খুঁজে পাবে। ১৯৪৮ সালের ডিসেম্বরে ঢাকায় যে সাহিত্য সম্মিলনীর অধিবেশন হয়েছিল, তাতে বড় আশাতেই বুক বেঁধে আমি অভিভাষণ দিয়েছিলুম। কিন্তু তারপর যে প্রতিক্রিয়া হয়, তাতে হাড়ে হাড়ে বুঝেছিলুম, স্বাধীনতার নূতন নেশায় আমাদের মতিচ্ছন্ন করে দিয়েছে। আরবী হরফে বাংলা লেখা, বাংলা ভাষায় অপ্রচলিত আরবী পারসী শব্দের অবাধ আমদানী, প্রচলিত বাংলা ভাষাকে গঙ্গাতীরের ভাষা বলে তার পরিবর্তে পদ্মাতীরের ভাষা প্রচলনের খেয়াল প্রভৃতি বাতুলতা আমাদের একদল সাহিত্যিককে পেয়ে বসলো। তাঁরা এই সব মাতলামিতে এমন মেতে গেলেন, যে প্রকৃত সাহিত্য সেবা যাতে দেশের ও দশের মঙ্গল হতে পারে, তার পথে আবর্জনা স্তূপ দিয়ে সাহিত্যের উন্নতির পথ কেবল রুদ্ধ করেই খুশিতে ভূষিত হলেন না, বরং খাঁটি সাহিত্যসেবীদিগকে নানা প্রকারে বিড়ম্বিত ও বিপদগ্রস্ত করতে আদা-জল খেয়ে কোমর বেঁধে লেগে গেলেন। তাতে কতক উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারীরা উসকানি দিতে কসুর করলেন না। ফলে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের চর্চা, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র এবং অন্যান্য পশ্চিমবঙ্গের কবি ও সাহিত্যকগণের কাব্য ও গ্রন্থ আলোচনা, এমন কি বাঙ্গালী নামটি পর্যন্ত যেন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র বলে কেউ কেউ মনে করতে লাগলেন। কেউ এতে মিলিত বঙ্গের ভূতের ভয়ে আতংকগ্রস্ত হয়ে আবোল তাবোল বকতে শুরু করে দিলেন এবং বেজায় হাত-পা ছুঁড়তে লাগলেন। করাচীর তাঁবেদার গত লীগ গভর্ণমেন্ট বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের উন্নতির জন্য কিছু করা দূরে থাক, বাঙ্গালী বালকের কচি মাথায় উর্দুর বোঝা চাপিয়ে দিলেন এবং কেন্দ্রীয় সরকারের আরবী হরফে বাংলা ভাষা লেখার এবং উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার অপচেষ্টায় সহযোগিতা করেছেন। এইরূপ বিষাক্ত আবহওয়ায় ১৯৪৮ সালের পরে আর কোনও সাহিত্য সম্মেলনের আয়োজন সম্ভবপর হয়নি।* আজ জনপ্রিয় পূর্ব বাঙ্গালার গভর্ণমেন্টের আশ্রয়ে আমরা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে এক সর্বদলীয় সাহিত্য সম্মেলনের আয়োজন করেছি।[৭৭]

[*১৯৪৮ সালের পর ১৯৫১ সালে চট্টগ্রামে এবং ১৯৫২ সালে কুমিল্লায় সাহিত্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। তবে ১৯৪৮ এর পর ১৯৫৪ সালেই ঢাকাতে সর্বপ্রথম সাহিত্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।]

তথ্যসূত্র (সংশোধন করা হয়নি) – পঞ্চম পরিচ্ছেদ: ভাষা আন্দোলন উত্তর ঘটনাপ্রবাহ- ১৯৪৮

তাজউদ্দীন আহমদ-এর ডায়েরী, ২৭/৪/১৯৪৮।

নওবেলাল, ২২/৪/১৯৪৮।

তাজউদ্দীন আহমদ-এর ডায়েরী, ২৭/৪/১৯৪৮।

8

তাজউদ্দীন আহমদ-এর ডায়েরী, ২৬/৪/১৯৪৮।

নওবেলাল, ৬/৫/১৯৪৮।

আজাদ, ১০/১২/১৯৪৮।

এখানে উল্লেখযোগ্য যে এই সময়ে শহীদ সুহরাওয়ার্দী পাকিস্তান গণপরিষদের একজন সদস্য ছিলেন। আজাদ, ১০/৬/১৯৪৮।

৩১২ | বদরুদ্দীন উমর রচনাবলী খণ্ড ২

£

আজাদ, ১/৭/১৯৪৮।

১০ পূর্বোক্ত।

তাজউদ্দীন আহমদ-এর ডায়েরী, ১৪/৭/১৯৪৮।

১২ আজাদ, ১৫/৭/১৯৪৮।

১৩ নওবেলাল, ২৬/৮/১৯৪৮।

18

আজাদ, ১৯/১১/১৯৪৮ ও ২০/১১/১৯৪৮।

১৫

আজাদ, ১৯/১১/১৯৪৮।

১৬

আজাদ, ২০/১১/১৯৪৮।

১৭

আজাদ, ২১/১১/১৯৪৮।

১৮ পূর্বোক্ত।

১৯

নওবেলাল, ৯/১২/১৯৪৮।

২০ পূর্বোক্ত।

২১

আজাদ, ২৭/১১/১৯৪৮।

২২ তাজউদ্দীন আহমদ-এর ডায়েরী, ২৭/১২/১৯৪৮।

২৩ পূর্বোক্ত।

২৪ তাজউদ্দীন আহমদ-এর ডায়েরী, ১৭/১২/১৯৪৮; কমরুদ্দীন আহমদ।[২৫ কমরুদ্দীন আহমদ।

26

আজাদ, ১৬/১১/১৯৪৮।

২৭ পূর্বোক্ত।

২৮ পূর্বোক্ত, ১৮/১১/১৯৪৮।[২৯ পূর্বোক্ত, ২৫/১১/১৯৪৮।[৩০ পূর্বোক্ত।

৩১ পূর্বোক্ত, ২০/১১/১৯৪৮।[৩২ পূর্বোক্ত, ২৫/১১/১৯৪৮।[৩৩ পূর্বোক্ত, ২৫/১১/১৯৪৮।

৩৪ পূর্বোক্ত, ২৬/১১/১৯৪৮।

৩৫ পূর্বোক্ত।

৩৬ পূর্বোক্ত।

৩৭ পূর্বোক্ত।

৩৮ পূর্বোক্ত।

৩৯ আজাদ, ২৬/১১/১৯৪৮।

৪০ পূর্বোক্ত, ২৭/১১/১৯৪৮।

81

পূর্বোক্ত।

৪২ তাজউদ্দীন আহমদ-এর ডায়েরী, ২৭/১১/১৯৪৮।

80 আজাদ, ১/১২/১৯৪৮।

৪৪ পূর্বোক্ত, ২/১২/১৯৪৮।

৪৫ পূর্বোক্ত, ৪/১২/১৯৪৮।

পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি (প্রথম খণ্ড) | ৩১৩

৪৬ পূর্বোক্ত, ৭/১২/১৯৪৮।

>

89

অজিত গুহ, সৈয়দ আলী আহসান।

৪৮

আজাদ, ৭/১২/১৯৪৮।

৪৯ পূর্বোক্ত, ৮/১২/১৯৪৮।

৫০ পূর্বোক্ত।

পূর্বোক্ত, ৪/১২/১৯৪৮।

৫২ অজিত গুহ।

৫৩ অজিত গুহ।

৫৪

পূর্বোক্ত।

এই সভার বিবরণ মূলতঃ অজিত গুহের থেকে প্রাপ্ত।

৫৬ অজিত গুহ।

৫৭ পূর্বোক্ত।

৫৮ আজাদ, ১/১/১৯৪৯।

৫৯

৬০

এই জাতীয় বক্তব্য হাবিবুল্লাহ বাহার পূর্ব-বাঙলা ব্যবস্থাপক সভায় বাংলা ভাষা সম্পর্কে আলোচনাকালে ইতিপূর্বে পেশ করেছিলেন। এই বইয়ের ১৩৫-৩৬ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য।— সম্পাদক। আজাদ, ১/১/১৯৪৯।

৬১ শহীদুল্লাহ সংবর্ধনা গ্রন্থ, মুহম্মদ সফিউল্লাহ সম্পাদিত, রেনেসাঁস প্রিন্টার্স।

৬২ পূর্বোক্ত, পৃ ৪৫।

৬৩ পূর্বোক্ত, পৃ ৪৬।

৬৪ পূর্বোক্ত, পৃ ৪৭।

৬৫

আজাদ, ১লা জানুয়ারী, ১৯৪৯।

৬৬ অজিত গুহ, সৈয়দ আলী আহসান।

৬৭ পূর্বোক্ত।

৬৮ অজিত গুহ।

৬৯ অজিত গুহ, সৈয়দ আলী আহসান।

90

অজিত গুহ।

সৈয়দ আলী আহসান।

৭২ সৈনিক, ৯/১/১৯৪৯।

৭৩ সৈয়দ আলী আহসান।

98

পূর্বোক্ত।

৭৫ সৈনিক, ৯/১/১৯৪৯।

৭৬ পূর্বোক্ত।

৭৭ পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলন, ১৯৫৪, উদ্বোধনী ভাষণ : ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, সাহিত্য

সম্মেলন কর্তৃক প্রকাশিত পুস্তিকা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *