২. প্রথম রাজনৈতিক সংগ্ৰাম

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ – প্রথম রাজনৈতিক সংগ্ৰাম

১. গণ-পরিষদে ভাষা বিষয়ক প্রস্তাব

২৩শে ফেব্রুয়ারী, ১৯৪৮, পাকিস্তান গণ-পরিষদের প্রথম অধিবেশন শুরু হয়। এই অধিবেশনে বিরোধী দল দুটি সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপন করেন। প্রথম প্রস্তাবটিতে বৎসরে অন্ততঃ একবার ঢাকায় পাকিস্তান গণ-পরিষদের অধিবেশন অনুষ্ঠানের দাবী জানানো হয়। দ্বিতীয় প্রস্তাবটি ছিলো ভাষা বিষয়ক। এটিতে উর্দু এবং ইংরেজীর সাথে বাংলাকেও গণ-পরিষদের অন্যতম ভাষা হিসাবে ব্যবহার করার দাবী উত্থাপন করা হয়।[১] প্রস্তাবটি উত্থাপন করেন পূর্ব বাঙলার প্রতিনিধি ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। খুব সম্ভবতঃ গণ-পরিষদের কংগ্রেস দলের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রস্তাবটি পেশ করা হয়নি। ধীরেন দত্ত ব্যক্তিগতভাবেই তা করেছিলেন। এ প্রসঙ্গে তিনি লেখকের কাছে ১৯শে জুলাই, ১৯৬৮তে লিখিত একটি পত্রে বলেন:

‘বাংলা ভাষা’ আমাদের রাষ্ট্রীয় ভাষা হুউক ইহাই ছিল আমার প্রস্তাব। ইহা আমার পার্টি প্রস্তাব ছিল বলিয়া মনে হচ্ছে না।

কিন্তু ব্যক্তিগত হলেও কংগ্রেস দলের সমস্ত সদস্য এই প্রস্তাব সমর্থন করেন এবং কয়েকজন এর সপক্ষে বক্তৃতা দেন।

প্রথম সংশোধনী প্রস্তাবটি ২৪শে তারিখে আলোচিত হয় এবং তমিজুদ্দীন খান সেটির বিরোধিতা করার পর পরিষদ কর্তৃক তা বাতিল হয়ে যায়। ভাষা বিষয়ক দ্বিতীয় প্রস্তাবটি আলোচিত হয় অধিবেশনের তৃতীয় দিন, ২৫শে ফেব্রুয়ারীতে। এই আলোচনাকালে গণ- পরিষদে তুমুল বিতর্কের সৃষ্টি হয়। ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত কর্তৃক উত্থাপিত এই প্রস্তাবটির বিরোধিতা করে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান বলেন:

এখানে এ প্রশ্নটা তোলাই ভুল হয়েছে। এটা আমাদের জন্যে একটি জীবনমরণ সমস্যা। আমি অত্যন্ত তীব্রভাবে এই সংশোধন প্রস্তাবের বিরোধিতা করি এবং আশা করি যে এ ধরনের একটি সংশোধনী প্রস্তাবকে পরিষদ অগ্রাহ্য করবেন।[২]

শুধু তাই নয়। প্রস্তাব উত্থাপনকারীদের উদ্দেশ্যের সততার প্রতি কটাক্ষপাত করে তিনি আরও বলেন:

প্রথমে এই প্রস্তাবের উদ্দেশ্য নির্দোষ বলিয়া আমি ভাবিয়াছিলাম। কিন্তু বর্তমানে মনে হয় পাকিস্তানের অধিবাসীদের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি করা এবং একটি সাধারণ ভাষার দ্বারা ঐক্যসূত্র স্থাপনের প্রচেষ্টা হইতে মুসলমানদের বিচ্ছিন্ন করাই এই প্রস্তাবের উদ্দেশ্য।[৩]

লিয়াকত আলী খানের এই সাম্প্রদায়িক বক্তব্য সম্ভব হয়েছিলো প্রধানত এই কারণে যে পরিষদে মুসলমান সদস্যেরা সকলেই ছিলেন সরকারী মুসলিম লীগ দলভুক্ত এবং তাঁরা দলগতভাবে বাঙালী-অবাঙালী নির্বিশেষে সমস্বরে প্রস্তাবটির নিন্দা এবং বিরোধিতা করেছিলেন। অন্য পক্ষে প্রস্তাবটি যারা উত্থাপন করেন এবং তার সমর্থনে বক্তৃতা করেন তাঁরা সকলেই ছিলেন হিন্দু এবং কংগ্রেস দলভুক্ত।

গণ-পরিষদে কংগ্রেস দলের সেক্রেটারী রাজকুমার চক্রবর্তী সংশোধনী প্রস্তাবটির সমর্থনে বলেন:

উর্দু পাকিস্তানের কোন প্রদেশেরই কথ্য ভাষা নয়। তা হচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তানের উপরতলার কিছুসংখ্যক মানুষের ভাষা। পূর্ব-বাঙলা এমনিতেই কেন্দ্রীয় রাজধানী করাচী থেকে অনেক দূরে অবস্থিত, তার উপর এখন তাদের ঘাড়ে একটা ভাষাও আবার চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। একে গণতন্ত্র বলে না। আসলে এ হলো অন্যান্যদের উপর উচ্চশ্রেণীর আধিপত্য বিস্তারের প্রচেষ্টা। বাঙলাকে আমরা দুই অংশের সাধারণ ভাষা করার জন্যে কোন চাপ দিচ্ছি না। আমরা শুধু চাই পরিষদের সরকারী ভাষা হিসাবে বাঙলার স্বীকৃতি। ইংরেজীকে যদি সে মর্যাদা দেওয়া হয় তাহলে বাঙলা ভাষা সে মর্যাদার অধিকারী।[৪]

মোহাজের এবং পুনর্বাসন মন্ত্রী গজনফর আলী খান[৫] প্রস্তাবটির বিরোধিতা করে বলেন:

পাকিস্তানের একটিমাত্র সাধারণ ভাষা থাকবে এবং সে ভাষা হচ্ছে উর্দু। আমি আশা করি যে অচিরেই সমস্ত পাকিস্তানী ভালোভাবে উর্দু শিক্ষা করে উর্দুতে কথাবার্তা বলতে সক্ষম হবে।

উর্দু ভাষার সাথে ইসলামী সংস্কৃতির যোগ সম্পর্কে তিনি বলেন :

উর্দু কোন প্রদেশের ভাষা নয়, তা হচ্ছে মুসলিম সংস্কৃতির ভাষা এবং উর্দু ভাষাই হচ্ছে মুসলিম সংস্কৃতি।

পরিষদের কংগ্রেস দলভুক্ত হিন্দু সদস্যদের প্রতি কটাক্ষপাত করে তিনি বলেন: বাঙলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায় এই বিতর্কের তাৎপর্য যে উপলব্ধি করে এর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেছেন এতে আমি খুশী হয়েছি।

গজনফর আলী খানের এই শেষোক্ত বক্তব্যের ভিত্তি হচ্ছে বিতর্ককালে পূর্ব-বাঙলার মুসলিম লীগ দলভুক্ত সদস্যদের আচরণ এবং বক্তৃতা। পূর্ব-বাঙলার প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন সংশোধনী প্রস্তাবটির বিরোধিতা করতে গিয়ে বলেন:

পূর্ব পাকিস্তানের অধিকাংশ অধিবাসীরই এই মনোভাব যে একমাত্র উর্দুকেই রাষ্ট্রভাষারূপে গ্রহণ করা যাইতে পারে।[৬]

খাজা নাজিমুদ্দীন ছাড়া গণ-পরিষদের সহ-সভাপতি তমিজুদ্দীন খানও ভাষা সংক্রান্ত সংশোধনী প্রস্তাবটির বিরোধিতা করে বক্তৃতা দেন।[৭]

২. সংবাদপত্রের সমালোচনা

প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীনের উপরোক্ত বক্তৃতা প্রসঙ্গে ২৮শে ফেব্রুয়ারী ‘বাংলা ভাষা ও পাকিস্তান’ শীর্ষক এক সম্পাদকীয় প্রবন্ধে দৈনিক আজাদ মন্তব্য করেন:

খাওয়াজা সাহেব কবে রাষ্ট্রভাষার ব্যাপারে পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসীদের গণভোট গ্রহণ করিলেন, তাহা আমরা জানি না। আমাদের মতে, তাঁর উক্তি মোটেই সত্য নয়। আমরা বিশ্বাস করি গণভোট গ্রহণ করিলে বাঙলা ভাষার পক্ষে শতকরা ৯৯ ভোটের বড় কম হইবে না। এ অবস্থায় এমন গুরুত্বের ব্যাপারে তিনি (খাওয়াজা নাজিমুদ্দীন) এইরূপ একটি দায়িত্বহীন উক্তি করিয়া শুধু পূর্ব পাকিস্তানের মৌলিক স্বার্থেরই ক্ষতি করেন নাই, এদেশবাসীর পক্ষে আপন প্রতিনিধিত্বের অধিকারের মর্যাদাকেও ক্ষুণ্ণ করিয়াছেন। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের মৌলিক স্বার্থকে এভাবে বিকাইয়া দেওয়া কি এতই সহজ?

ঐ একই দিনে দৈনিক ইত্তেহাদ ‘অবিশ্বাস্য’ শীর্ষক একটি সম্পাদকীয়তে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের বক্তব্যের সমালোচনা প্রসঙ্গে বলেন:

এমন একটি নির্দোষ প্রস্তাব এবং যে প্রস্তাবের সহিত পাকিস্তানের তিন-চতুর্থাংশ নাগরিক মৌলিক অধিকারের প্রশ্ন জড়িত তাহাকে বিভেদ সৃষ্টিকারী প্রস্তাব অভিহিত করাতে এ প্রস্তাবটি অগ্রাহ্য করার পথ খোলাসা হইয়াছে বটে, কিন্তু ন্যায় ও যুক্তির দরওয়াজা বন্ধ করা হইয়াছে।[৮]

এই সময় ইত্তেহাদ এবং আজাদ পত্রিকা কলকাতা থেকেই প্রকাশিত হতো। এ ছাড়া আনন্দবাজার পত্রিকা, অমৃতবাজার পত্রিকা, যুগান্তর, স্বাধীনতা ইত্যাদিতে ভাষা সংক্রান্ত বিষয়ে যে সব সংবাদ ও সম্পাদকীয় মন্তব্য প্রকাশিত হয় সেগুলি পূর্ব-বাঙলার সরকারী মহলে যথেষ্ট বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। এ ছাড়াও অন্যান্য কারণে সংবাদপত্রগুলির কিছু মন্তব্য উল্লেখযোগ্য।

২৭শে ফেব্রুয়ারী, ১৯৪৮, আনন্দবাজার পত্রিকা ‘পাকিস্তানের গণতন্ত্র’ শীর্ষক নিম্নোক্ত দীর্ঘ সম্পাদকীয়টি প্রকাশ করেন:

পাকিস্তান গণ-পরিষদের অধিবেশনের প্রারম্ভ হইতে এ পর্যন্ত যাহা ঘটিয়াছে তাহাতে পাকিস্তানী গণতন্ত্রের পরিচয় বিশেষ করিয়াই পাওয়া যাইতেছে। পাকিস্তানের প্রধানতম অংশরূপে পূর্ব বঙ্গের এবং বিশেষ করিয়া পাকিস্তানী অধিবাসী হিন্দু শিখ মাইনরিটির পক্ষে ইহা লক্ষ্য করিবার বিষয়। গণ-পরিষদের পরিচালনার বিধান রচনার জন্য আলোচ্য ৭০টি প্রস্তাবের মধ্যে ৬৮টি মাত্র ৬০ মিনিটের মধ্যে প্রায় বিনা আলোচনাতেই গৃহীত হইয়াছে। মাত্র দুইটি উল্লেখযোগ্য সংশোধনী প্রস্তাব উঠিয়াছিল কিন্তু সে সংশোধন প্রস্তাব রূঢ় অবজ্ঞায় উপেক্ষিত হইয়াছে। সংশোধন প্রস্তাবের মধ্যে প্রধান দুইটি প্রস্তাব পূর্ববঙ্গের পক্ষ হইতে উত্থাপিত; প্রথম প্রস্তাবে অনুরোধ করা হইয়াছিল যে বৎসরে অন্তত একবার পূর্ববঙ্গে ঢাকায় পাকিস্তান পরিষদের অধিবেশন হউক। প্রস্তাবটি হিন্দু সদস্য কর্তৃক উত্থাপিত এবং মুসলমান সদস্য কর্তৃক সমর্থিত। কিন্তু মিঃ জিন্নার কৌশলে পূর্ববঙ্গের অন্যতম সদস্য মিঃ তমিজুদ্দিনকে ইহার প্রতিকূলতা করিতে হইয়াছে।

ইহার পরদিন গণ-পরিষদে ভাষা সংক্রান্ত প্রস্তাব উত্থাপিত হয়। গণ-পরিষদের পরিচালনার বিধান যাঁহারা রচনা করিয়াছেন তাঁহারা বলেন যে, পাকিস্তান গণ-পরিষদের আলোচনায় ইংরেজী বা উর্দু ছাড়া আর কোন ভাষা ব্যবহৃত হইতে পারিবে না। পূর্ব বঙ্গের অন্যতম সদস্য শ্রীযুক্ত ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত যে সংশোধন প্রস্তাব উত্থাপন করিয়াছিলেন তাহা অখণ্ডনীয়।

সমগ্র পাকিস্তানের ৬ কোটি ৯০ লক্ষ লোকের মধ্যে ৪ কোটি ৪০ লক্ষ লোকেরই ভাষা বাঙলা। সুতরাং পাকিস্তানের গণ-পরিষদের আলোচনায় বাঙলাকে স্থানদান তো করিতেই হইবে, বাঙলাকেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা রূপে স্বীকার করিয়া লওয়া উচিত। শ্রীযুক্ত দত্তের যুক্তি খণ্ডন করিবার উপায় ছিল না। সেই জন্য উর্দুপন্থী পাকিস্তানীরা ইহার উপর কল্পিত উদ্দেশ্য আরোপ করিয়া ইহাকে হেয় করিবার চেষ্টা করিয়াছেন। তাঁহাদের সুবিজ্ঞ বিবেচনায় ইহা মুসলমানদের মধ্যে ভেদ ঘটাইবার চেষ্টা। পূর্ববঙ্গের অধিবাসীরা বাঙলাভাষী খাঁটি বাঙালী। পাকিস্তানের লোকসংখ্যা তাঁহারাই সর্বাধিক। এই অবস্থায় তাঁহাদের প্রতিনিধিরা যদি তাঁহাদের মাতৃভাষাকে পাকিস্তান রাষ্ট্রে ও উহার গণপরিষদে সম্মানের সহিত বসাইবার চেষ্টা করিয়া থাকেন, তাহা তাঁহাদের পক্ষে সম্পূর্ণ স্বাভাবিকভাবেই হইয়াছে। কিন্তু পূর্ববঙ্গের প্রতিনিধিদিগের এই স্বাভাবিক ও সঙ্গত দাবী স্বীকার করিয়া লওয়া দূরে থাকুক, পাকিস্তানের অধিনায়ক ও তাঁহার সাঙ্গোপাঙ্গগণ ইহার প্রতি অশ্রদ্ধা প্রকাশ করিয়াছেন এবং অবজ্ঞার সহিত ইহা প্রত্যাখ্যান করিয়াছেন।

পূর্ববঙ্গের প্রতিনিধিদের উপরে অসদুদ্দেশ্য আরোপ ছাড়া পাকিস্তানের কর্তৃপক্ষ আপনাদের এই অসঙ্গত আচরণের সমর্থনে আর একটি যুক্তি দিয়েছিলেন। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী মিঃ লিয়াকত আলী ঘোষণা করিয়াছেন যে, পাকিস্তান, ‘মুসলিম রাষ্ট্র’ অতএব ইহার রাষ্ট্রভাষা বা গণ-পরিষদের আলোচনার ভাষা ‘মুসলিম রাষ্ট্রের ভাষা’ ছাড়া আর কিছুই হইতে পারে না; মিঃ লিয়াকত আলীর মতে উর্দুই হইলো মুসলিম রাষ্ট্রভাষা। ভাষারও যে ধর্মভেদ ও সম্প্রদায় ভেদ আছে এরূপ কিম্ভূতকিমাকার যুক্তি এ পর্যন্ত কদাচিৎ শোনা গিয়াছে; বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে রাষ্ট্রকে ধর্মের দ্বারা চিহ্নিত করিবার চেষ্টাই বাতুলতা। তাহাতেও ক্ষান্ত না হইয়া পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ভাষার উপর পর্যন্ত ধর্মের সীলমোহর লাগাইয়া দিতে চাহিতেছেন। ভাষার পরিচয় স্থান হিসাবেই হইয়া থাকে ও স্থান হিসাবেই ভাষার প্রাধান্য ঘটিয়া থাকে। ইহার সহিত ধর্মের সম্বন্ধ কোথা হইতে আসিলো? ‘মুসলমান রাষ্ট্র’ হইলেই তাহার ভাষা উর্দু হইবে কেন? তুরস্ক, আরব, পারস্য, আফগানিস্তান মুসলমান-প্রধান এবং মুসলমান শাসিত রাষ্ট্র। তাহারা কি উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করিয়াছে, না প্রত্যেকের দেশীয় ভাষাকেই সেই মর্যাদা দিয়াছে? এই পুরাতন মুসলমান শাসিত রাষ্ট্রসমূহ যদি স্ব স্ব দেশীয় ভাষাকেই গ্রহণ করিয়া থাকিতে পারে তাহা হইতে হঠাৎ রাষ্ট্র পাকিস্তানই বা তাহা অগ্রাহ্য করিয়া একটি কৃত্রিম ভাষাকে সকলের উপর চাপাইতে চাহিতেছে কেন? বাঙলাকে অগ্রাহ্য করিয়া উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষারূপে চালাইবার চেষ্টা কতদূর অসঙ্গত, অস্বাভাবিক ও গণতন্ত্রবিরোধী একটু বিশ্লেষণ করিয়া দেখিলেই তাহা বুঝা যাইবে। পাকিস্তান রাষ্ট্রের অন্তর্গত প্রদেশ ৫টি। পূর্ব বাঙলা, পশ্চিম পাঞ্জাব, সীমান্ত প্রদেশ, সিন্ধু ও বেলুচিস্তান; ইহার মধ্যে পূর্ব বাঙলার ভাষা বাঙলা, পশ্চিম পাঞ্জাবের ভাষা পাঞ্জাবী, সীমান্ত প্রদেশের ভাষা পশতু, সিন্ধু প্রদেশের ভাসা সিন্ধি ও বেলুচিস্তানের ভাষা বেলুচি। ইহার মধ্যে একটিও পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হইবার সৌভাগ্য লাভ করিল না। কিন্তু যাহা পাকিস্তানের কোন প্রদেশেরই ভাষা নহে তাহাকেই সকলের উপর চাপাইয়া দেওয়া হইলো। ইহা যদি জবরদস্তি না হয় তাহা হইলে জবরদস্তি আর কাহাকে বলে? নিতান্ত দুঃখের বিষয় এই যে পূর্ব বাঙলার মুসলমান সদস্যগণ এই জবরদস্তির নিকট আত্মসমর্পণ করিয়াছেন। মৌলানা আকরম খাঁ একদিন শাসাইয়াছিলেন যে বাঙলা ভাষার দাবী অগ্রাহ্য হইলে তিনি বিদ্রোহ ঘোষণা করিবেন। কিন্তু পাকিস্তানের গণ-পরিষদের অধিবেশনে তাঁহাকে বাক্যস্ফুট করিতে দেখিলাম না। মিঃ লিয়াকত আলী খাঁ মহাশয়ের উক্তির প্রত্যুত্তরে একথা তিনি বলিলেন না যে, মুসলমানী ভাষা বলিয়া যদি কোন ভাষার কল্পনাই করিতে হয় এবং তাহাকেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করিতে হয়, তাহা হইলে পাকিস্তানের অধিকাংশ মুসলমান যে ভাষায় কথা কহে এবং যে ভাষা তাহাদের দানে সমৃদ্ধ সেই ভাষারই রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা পাওয়া উচিত। কিন্তু মিঃ জিন্নাহর তর্জনীর সম্মুখে সে কথা বোধহয় কাহারও বলিবার উপায় ছিল না। চক্ষের উপর এই ব্যাপার দেখিয়াও পূর্ববঙ্গের জনসাধারণ ও পূর্ববঙ্গ আইনসভার সদস্যগণ যদি সতর্ক না হন, তাহা হইলে পাকিস্তানের প্রধানতম অংশ হইয়াও অচিরে পূর্ববঙ্গকে পশ্চিম পাকিস্তানের অনুগ্রহজীবীর পর্যায়ে নামিয়া দাঁড়াইতে হইবে। পাকিস্তানকে মুসলিম রাষ্ট্র বলিয়া ঘোষণা করিয়া পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী মহাশয় হিন্দু ও শিখ মাইনরিটির অবস্থাতো শোচনীয় করিয়া তুলিলেন। কিন্তু এই হুমকির শাসন চলিতে থাকিলে হিন্দু, মুসলমান নির্বিশেষে পূর্ব-বাঙলার সকলের অবস্থাই অনুকম্পার যোগ্য হইয়া উঠিবে।

মহম্মদ আলী জিন্নাহ, প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান ও মুসলিম লীগের অন্যান্য সদস্যদের ভূমিকা এবং পাকিস্তানের রাজনৈতিক অবস্থার সমালোচনা ও পর্যালোচনা প্রসঙ্গে অমৃতবাজার পত্রিকা ২৭শে ফেব্রুয়ারী যে সুদীর্ঘ সম্পাদকীয় প্রকাশ করে সেটিও অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য। এই প্রবন্ধে পত্রিকাটি বলেন:

পাকিস্তানের বিধান পরিষদে মিঃ লিয়াকত আলী খানের উক্তিতে বাংলাদেশে এবং তার বাইরে অনেকে আঘাত পেতে পারেন কিন্তু আমরা যে বিরাট কোন আঘাত পাইনি এ কথা স্বীকার করি। নিজের মনের কথা প্রকাশকালে এতো চমৎকার অকপটতার পরিচয়দানের জন্যে আমরা তাঁকে ধন্যবাদ জানাই। অমুসলমানরা এখন নিশ্চিতভাবে বুঝে নেবে তাদের আসল অবস্থা কি। ভবিষ্যতে পাকিস্তানে কি অবস্থার সৃষ্টি হবে এ সম্পর্কে মুসলমানরাও চিন্তা শুরু করবে। মিঃ লিয়াকত আলী খানের বক্তব্যের মধ্যে কোন অপরিচ্ছন্নতা, দ্বিধা অথবা দ্ব্যর্থতা নেই। আমরা ধরে নিচ্ছি এ ক্ষেত্রে তিনি লীগ নেতৃত্বের সুবিবেচিত নীতিই অনুসরণ করেছেন। বুধবারে পাকিস্তান বিধান পরিষদে কার্যনির্বাহ সংক্রান্ত আইনের খসড়া নিয়ে বিতর্ক চলছিল। সরকারের পক্ষ থেকে প্রস্তাব করা হয় যে প্রত্যেক সদস্যকে হয় উর্দু নয় ইংরেজীতে পরিষদকে সম্বোধন করতে হবে। বিরোধী কংগ্রেসদল কর্তৃক এই প্রস্তাব সংশোধনের জন্য একটি পাল্টা প্রস্তাবে উর্দু ও ইংরেজীর সাথে বাংলাকেও পরিষদের সরকারী ভাষা হিসাবে গ্রহণ করার অনুরোধ জানানো হয়। সংশোধনী প্রস্তাবটি যিনি পেশ করেছিলেন তিনি একথা পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করেন যে প্রাদেশিকতার বশবর্তী হয়ে তিনি প্রস্তাবটি উত্থাপন করেননি, করেছিলেন এজন্য যে পাকিস্তানের জনসংখ্যার বিপুল অধিকাংশের কথ্য ভাষা বাংলা – এই কারণে তাকে যথাযোগ্য স্বীকৃতি দেওয়াই কর্তব্য। মিঃ লিয়াকত আলী খান তাঁর আসন থেকে উঠে দাঁড়িয়ে সংশোধনী প্রস্তাবটির বিরোধিতা করেন। তিনি বলেন যে, পাকিস্তান একটি মুসলিম রাষ্ট্র, প্রত্যেক মুসলিম রাষ্ট্রের একটি মুসলিম ভাষা থাকা দরকার এবং উর্দু হচ্ছে সর্বোৎকৃষ্ট মুসলিম ভাষা। বাঙলাদেশের মুসলমানরা এই বিস্ময়কর বক্তব্যকে মনে মনে কিভাবে গ্রহণ করেছেন আমরা জানি না কিন্তু সে যাই হোক সংশোধনী প্রস্তাবটি বাতিল হয়ে গেছে। পাকিস্তানের পূর্ব সুবার দায়িত্বপ্রাপ্ত খাজা নাজিমুদ্দীনও মনে করলেন যে বিতর্ককালে তাঁরও আবার কিছু একটা বলা দরকার। কাজেই পরিষদকে তিনি বললেন – কার অথরিটিতে সেকথা জিজ্ঞেস করার অধিকার আমাদের নেই – যে পূর্ব পাকিস্তানের অধিকাংশ লোকের মত হচ্ছে এই যে উর্দুই একমাত্র ভাষা যা পাকিস্তানের সাধারণ ভাষা হিসাবে গৃহীত হতে পারে। তিনি আরও বলেন যে বাঙলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার পেছনে কোনই যুক্তি নেই। কাজেই খাজা নাজিমুদ্দিনের মতানুসারে পাকিস্তানের অর্থ হলো এই যে প্রত্যেক বাঙালী বাড়ীতে, প্রত্যেক বাঙালী স্কুলে এবং প্রত্যেক বাঙালী আইন আদালতে প্রত্যেককে বাঙলা বর্জন করে উর্দুতে কথা বলতে হবে। ইতিমধ্যে রাষ্ট্রের প্রতিটি বিভাগের উচ্চ পর্যায়ের চাকুরীতে যে সমস্ত লোকজন বহাল হয়েছে তাদের সাথে প্রদেশের ভাষা, আচার-আচরণ, রীতিনীতি এবং ঐতিহ্যের কোন সম্পর্ক নেই। শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে তারা অত্যন্ত শান্তিপূর্ণভাবে অনুপ্রবেশ করতে শুরু করেছেন। এবার সাংস্কৃতিক আধিপত্যের মাধ্যমে নিজেদের পরিকল্পনাকে তারা এগিয়ে নিয়ে যাবেন। পূর্ব বাঙলাকে দৃঢ় এবং নিশ্চিতভাবে পাকিস্তান রাষ্ট্রের একটি গুরুত্বহীন অংশে পরিণত করতে হবে। করাচী এবং কিছু পরিমাণে লাহোর সমস্ত কিছুর উপর কর্তৃত্ব করবে এবং খাজা নাজিমুদ্দীন ও তাঁর বাংলাভাষী মন্ত্রীরা করাচী ও লাহোরের লোকজনের এজেন্ট হিসাবে কাজ করে যাবেন। পূর্ব বাঙলার অধিকাংশ মানুষ যদি তাই চান তাহলে তাই তাঁরা পাবেন। কারণ তাঁরা যে ধরনের সরকারের যোগ্য হবেন সেই ধরনের সরকারই তাঁরা পাবেন। কিন্তু এই পাকিস্তানের জন্যেই কি তাঁরা এত মাস ও বৎসর যাবৎ চীৎকার করে এসেছেন। এই কি সেই ইসলামী রাষ্ট্র যে সম্পর্কে এতদিন তাদেরকে অনেক রোমান্টিক কাহিনী বলা হয়েছে? পাকিস্তানের জন্য কি তাহলে তাদেরকে আজ নিজেদের মাতৃভাষা ও বহুযুগের পুরাতন সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গি বর্জন এবং সাধারণ লোককাহিনী, গান ও গাথার মাধ্যমে গঠিত সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সৌভ্রাতৃত্বের মহান ঐতিহ্যকে চিরদিনের জন্য পরিত্যাগ করতে হবে? এগুলির দ্বারা কায়েদে আজম মহম্মদ আলী জিন্নাহর উচ্চাকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ হতে পারে। আমরা মিঃ লিয়াকত আলী খানের রাজকীয় ভারসাম্য ও ধীরতার প্রশংসা করি কিন্তু এ বিষয়ে আমাদের বিন্দুমাত্র কোন সন্দেহ নেই যে আমাদের মুসলমান ভাইয়ের সামনে এক চরম বিপর্যয় উপস্থিত। মুসলমানদেরকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করার জন্যে অথবা আভ্যন্তরীণ বিপ্লব ঘটানোর উদ্দেশ্যে আমরা একথা বলছি না। আমরা এ কথা বলছি যাতে করে পূর্ব পাকিস্তানী মুসলমানরা পশ্চিমের সংকীর্ণ, ধর্মান্ধ এবং পরমত-অসহিষ্ণু জাতীয়তাবাদের খপ্পরে পতিত না হন। ভারতীয় ইউনিয়নে সকল নাগরিককে একটি বিশেষ সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় তত্ত্বের প্রতি দৃঢ় আনুগত্য প্রকাশ করতে বলা যেমন বিপজ্জনক এবং অর্থহীন তেমনি পাকিস্তান রাষ্ট্রের শাসনকর্তারা সেই রাষ্ট্রের সকল মুসলমানকে একটি নির্দিষ্ট এবং অপরিবর্তনীয় জীবন ব্যবস্থা বরাদ্দ করলে সেটাও হবে অনুরূপভাবে বিপজ্জনক এবং অর্থহীন। বহু শতাব্দী ধরে ভারতবর্ষের ইতিহাস এমন এক পথে বিকাশ লাভ করেছে যার যথার্থ তুলনা অন্য দেশের ইতিহাসের মধ্যে খুঁজলে সে প্রয়াস ব্যর্থ হতে বাধ্য। একথা বলার অর্থ প্রাদেশিক ঈর্ষা, এলাকাগত স্বাতন্ত্র্য অথবা সাংস্কৃতিক বিচ্ছিন্নতার ইন্ধন জোগানো নয়। বাংলাভাষী সংখ্যাগুরুসহ অন্যান্য সকল মানুষের উপর পাকিস্তান যখন উর্দু চাপিয়ে দিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ তখন তার ফলে যে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হবে তাকে অংকুরেই বিনষ্ট করতে না পারলে বাঙালী মুসলমানরা পাকিস্তানের মানচিত্র থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। এই অবস্থায় আমরা অসহায় এবং হতভাগ্য অমুসলমানদের সম্পর্কে কি বলবো? তাদের দাবী- দাওয়া ইচ্ছাকৃতভাবে প্রত্যাখ্যাত, ন্যায়সঙ্গত স্বার্থ নিন্দা সহকারে অগ্রাহ্য এবং ক্ষীণ-কণ্ঠ প্রতিবাদ ধর্মান্ধ পাকিস্তানীদের প্রচণ্ড চীৎকারে নিমজ্জিত! দৃঢ় ও কঠোরভাবে এবং বিবেকের তোয়াক্কা না রেখে তাদেরকে শুধু যে একটি সম্পূর্ণ বিদেশী ভাষার দাসত্ব করতে বলা হচ্ছে তাই নয়, ইসলামী রাষ্ট্র এবং কোরান ও শরিয়তের নির্দেশ অনুযায়ী যে আইন গঠিত হবে তার প্রতিও তাদেরকে আনুগত্য প্রকাশ করতে নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে। করাচীতে তাদের কণ্ঠস্বর অরণ্যে রোদনেরই মত। নিজেদের পিতৃপুরুষের দেশ পূর্ব-বাঙলাতেও তাদের অবস্থা বিদেশী বহিরাগত এবং অনধিকার প্রবেশকারী অপেক্ষা ভালো নয়। ভারতবর্ষ বিভাগের সময় এবং তার পূর্বেও ইসলামী রাষ্ট্রের উপর জোর দেওয়াকেও কেউ কোন গুরুত্ব দেয়নি। কিন্তু সময় কিছুটা অতিবাহিত হওয়ার পর এ সম্পর্কে এখন আর আত্মপ্রসাদের কোন স্থান নেই। কায়েদে আজম জিন্নাহ যখন ইসলামের কথা বলেন, তখন তিনি বুঝেসুঝেই সে কথা বলেন। মিঃ লিয়াকত আলী খান দেখিয়ে দিয়েছেন যে ইসলামী রাষ্ট্র কি ধরনের হবে। এই পরিপ্রেক্ষিতে অমুসলমান সংখ্যালঘুদের অধিকার ও স্বার্থ সংক্রান্ত বহু আলোচিত নিরাপত্তার কথা অর্থহীন এবং তুচ্ছ বাগাড়ম্বর মাত্র। মিঃ লিয়াকত আলী খানের বক্তব্যের সরল অর্থ এই যে তারা যদি ইসলামী প্রভুত্ব এবং তার আনুষঙ্গিক সবকিছুর সাথে নিজেদেরকে খাপ খাইয়ে নিতে না পারে তাহলে তাদের স্থান হবে রাষ্ট্রের বাইরে। কায়েদে আজম জিন্নাহ, মুসলিম লীগের সর্বোচ্চ কাউন্সিল এবং পূর্ব পাকিস্তান সুবায় মিঃ জিন্নাহর ভারপ্রাপ্ত প্রতিনিধিদের এই কি আসল অভিপ্রায়, আমরা একথা জানতে চাই। দেশের অবস্থা আজ কোথায় দাঁড়িয়েছে এ নিয়ে বাঙলাদেশের হিন্দু-মুসলমানরা নিশ্চয়ই একইভাবে চিন্তা করছেন।

১৯৪৮ সালের এই সময়ে কোন দৈনিক পত্রিকা ঢাকা থেকে প্রকাশিত হতো না। যে কয়টি সাপ্তাহিক পত্রিকা তখন প্রকাশিত হতো তার মধ্যে সিলেটের ‘নওবেলাল’ ছিলো সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য। এই পত্রিকাটিতে ৪ঠা মার্চ তারিখে পাকিস্তান গণ-পরিষদের ভাষা বিষয়ক প্রস্তাব এবং তার সম্পর্কে আলোচনা ও সিদ্ধান্তের উপর ‘রাষ্ট্রভাষা’ শীর্ষক একটি দীর্ঘ সম্পাদকীয় প্রকাশ করা হয়। রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নের সাথে পূর্ব-বাঙলার সাংস্কৃতিক জীবনের ও সাংস্কৃতিক আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের যোগসূত্রের কথা উল্লেখযোগ্য করে তাতে বলা হয়:

পাকিস্তান লাভ করিবার পূর্বে পূর্ব-পাকিস্তানবাসীদের ধারণা ছিল যে, তাহাদের সংস্কৃতি, তহজিব, তমদ্দুন সকল অবস্থায়ই অক্ষুণ্ণ থাকিবে। পাকিস্তান রাষ্ট্রের এলাকাধীন বিভিন্ন প্রদেশের বাসিন্দা মুসলমান গতিকে, তাহাদের মধ্যে মজহাবী একতা ছাড়া ভাষাগত বিষয়ে বিভিন্ন প্রদেশের নানাবিধ পার্থক্য রহিয়াছে তাহা অস্বীকার করিবার উপায় নাই। যদি এক ভাষার আধিপত্যে অন্য ভাষার প্রসার সংকুচিত হয় অথবা অন্য প্রদেশের সংস্কৃতি নষ্ট হইবার সূচনা দেখা যায় তাহা হইলে যে প্রদেশের ভাষার মর্যাদার হানি হইয়াছে তাহার প্রতি অবিচার করা হইবে।

বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের সাথে কেন্দ্রীয় পাকিস্তান সরকারের তুলনা করে পত্রিকাটি বলেন:

সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজদের আমলেও গভর্ণমেন্টের কারেন্সী নোটেও বাংলা ভাষার স্থান ছিল। পাকিস্তান সরকার বাংলাকে তুলিয়া ফেলিয়াছেন। পাকিস্তান সরকারের মনি অর্ডারের ফরম ডাক টিকেট, পোস্টকার্ড ইত্যাদিতে বাংলার স্থান নাই।

প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলীর উক্তি সম্পর্কে নওবেলাল বলেন:

এই প্রস্তাবের প্রসঙ্গে পাকিস্তানের উজিরে আজম জনাব নিয়াকত আলী যে অসংলগ্ন কথার অবতারণা করিয়াছেন তাহাতে বাস্তবিকই মর্মাহত হইতে হয়। তিনি বলিয়াছেন পাকিস্তান একটি মুসলিম রাষ্ট্র, তাই পাকিস্তানের ভাষা হইবে মুসলিমদের ভাষা উর্দু। এই সব অপরিণামদর্শী ভাষণের আলোচনাও এক দুঃখজনক ব্যাপার। তবে এই সব ঘোষণার প্রতিক্রিয়া যে মারাত্মক হইতে পারে সে সম্বন্ধে আমরা জনাব লিয়াকত আলী খানকে ভাবিয়া দেখিতে অনুরোধ করি।

খাজা নাজিমুদ্দিনের উক্তির সমালোচনা প্রসঙ্গে এতে বলা হয়:

এই প্রসঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের জনমতের উল্লেখ করিতে যাইয়া জনাব নাজিমুদ্দিন খান যে সব অপ্রত্যাশিত মন্তব্য করিয়াছেন তার জন্য নিশ্চয়ই তাহাদিগকে একদিন পূর্ব পাকিস্তানবাসীর নিকট জবাবদিহি করিতে হইবে। খাজা সাহেবের পারিবারিক ভাষা উর্দুকে পূর্ব পাকিস্তানের জনসাধারণ তাহাদের সাধারণ ভাষারূপে গ্রহণ করিতে চায় এই তথ্য কোথায় আবিষ্কার করিলেন?

গণ-পরিষদের মুসলিম লীগ দলীয় বাঙালী সদস্যদের উদ্দেশ্যে পত্রিকাটি বলেন:

এইভাবে আপনার মাতৃভাষার মূলে যাহারা কুঠারাঘাত করিতেছেন, তাহারা কি একবার ভাবিয়াও দেখেন নাই সে ভাষার ভিতর দিয়াই জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষা, সুখ-দুঃখ, আদর্শ প্রভৃতি রূপ পাইয়া থাকে। ভাষা সম্পূর্ণ বিকাশ লাভ না করিলে জাতির মেরুদণ্ড গঠিত হইয়া উঠিতে পারে না। কোন এক বিশেষ প্রভাবে পড়িয়া তাঁহারা হয়ত আপনাদের অস্তিত্বের বিলোপ করিতে পারেন, তবে পূর্ব পাকিস্তানের চার কোটি চল্লিশ লক্ষ লোক কিছুতেই তাহাদিগকে ক্ষমা করিবে না। কিছুতেই তাহারা তাহাদের মাতৃভাষা বাংলার অবমাননা সহ্য করিবে না। তাই ইতিমধ্যেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রেরা ধর্মঘট করিয়াছে এবং মিছিল সহকারে সর্বত্র বিক্ষোভ প্রদর্শন করিয়াছে। কেবল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রগণই নহে পূর্ব পাকিস্তানের সর্বত্র এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে তুমুল আন্দোলন গড়িয়া উঠিতেছে। এই গণবিক্ষোভ যখন পূর্ণ আত্মপ্রকাশ করিবে তখন এইসব নেতাদের আসন ও টলটলায়মান হইয়া পড়িবে।

সর্বশেষে পাকিস্তানের শান্তি এবং ঐক্য বজায় রাখার আবেদন জানিয়ে সম্পাদকীয়টিতে বলা হয়:

তাই পূর্বাহ্নেই আমরা কর্তৃপক্ষ মহলকে অনুরোধ করিতেছি যদি পাকিস্তানের সংহতি, ঐক্য ও সর্বোপরি শান্তি বজায় রাখিবার জন্য তাহাদের মনে এতটুকু আগ্রহ থাকে তাহা হইলে অনতিবিলম্বে তাহাদের কর্মের সংশোধন করুন। পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা ও শিক্ষার মাধ্যম রূপে বাঙলাকে গ্রহণ করুন। তাহা না হইলে স্বভাবতঃই পূর্ব পাকিস্তানবাসীর মনে এই ধারণা বদ্ধমূল হইতে থাকিবে যে পূর্ব পাকিস্তানের উপর যুক্ত প্রদেশ ও পশ্চিম পাঞ্জাবের লোকের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করিবার জন্য বাংলাকে আস্তে আস্তে তার ন্যায্য আসন হইতে সরাইয়া ফেলা হইতেছে।

৩. সভা ও সাংগঠনিক উদ্যোগ

বাংলা ভাষাকে গণ-পরিষদের অন্যতম ভাষা করার দাবী অগ্রাহ্য হওয়ার সংবাদ ঢাকায় প্রকাশিত হওয়ামাত্র ছাত্র, রাজনীতিক ও শিক্ষিত মহলে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। উর্দুকে পূর্ব-বাঙলার অধিকাংশ লোক রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষপাতী, খাজা নাজিমুদ্দিনের এই উক্তিকে তাঁরা সকলে সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন বলে বর্ণনা করেন। তাঁরা অত্যন্ত বিস্ময়ের সাথে প্রশ্ন করতে থাকেন যে গণ-পরিষদের মুসলিম লীগ দলীয় বাঙালী সদস্যেরা কোন্ হিসাবে বাংলা ভাষাকে পরিষদের অন্যতম ভাষা করার বিরুদ্ধে ভোট দিলেন।[৯]

গণ-পরিষদের বাংলা ভাষা বিরোধী সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ২৬শে ফেব্রুয়ারী ঢাকার ছাত্র সম্পদায় ধর্মঘট পালন করেন। ঐদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ এবং স্কুলের ছাত্রেরা ক্লাস বর্জনের পর একটি মিছিল বের করে বাংলা ভাষার সমর্থনে নানা প্রকার স্লোগান দিতে দিতে রমনা এলাকা প্রদক্ষিণ করে। এই মিছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে এসে শেষ হওয়ার পর বিকেলের দিকে সেখানে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভায় সভাপতিত্ব করেন বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপক এবং তমদ্দুন মজলিশের সম্পাদক আবুল কাসেম। পূর্ব-পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগের আহ্বায়ক নঈমুদ্দীন আহমদ, ফজলুল হক হল ইউনিয়নের সহ-সভাপতি মহম্মদ তোয়াহা এবং অধ্যাপক আবুল কাসেম গণ-পরিষদের সিদ্ধান্ত এবং সেই প্রসঙ্গে গণ-পরিষদের মুসলিম লীগ দলভুক্ত বাঙালী সদস্যদের আচরণ এবং উক্তিসমূহের তীব্র নিন্দা করে বক্তৃতা দান করেন।[১০]

বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ছাত্রসভায় পূর্ব-বাঙলার প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের বক্তৃতার তীব্র প্রতিবাদ করে, বাংলা ভাষাকে গণ-পরিষদের অন্যতম সরকারী ভাষা করার উদ্দেশ্যে একটি সংশোধনী প্রস্তাব আনার জন্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে অভিনন্দন জানিয়ে এবং এ সম্পর্কে পূর্ব- বাঙলার মুসলমান সদস্যদের মনোভাব ও ঢাকা বেতারের মিথ্যা ও পক্ষপাতমূলক সংবাদ প্রচারের বিরুদ্ধে সর্বসম্মতিক্রমে কয়েকটি প্রস্তাব গৃহীত হয়।[১১] ‘পূর্ব পাকিস্তান প্রতিবাদ দিবস’ পালন করতে ছাত্র সমাজকে আহ্বান জানানোর জন্যে তমদ্দুন মজলিশের রাষ্ট্রভাষা সাব-কমিটিকে অনুরোধ জানিয়ে এই সভায় একটি পৃথক প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়।[১২]

গণ-পরিষদের সিদ্ধান্ত এবং পাকিস্তান মুসলিম লীগের বাংলা ভাষা বিরোধী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে সক্রিয় আন্দোলন গঠন করার উদ্দেশ্যে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগ, বিভিন্ন ছাত্রাবাস এবং তমদ্দুন মজলিশের যৌথ উদ্যোগে ২রা মার্চ ফজলুল হক হলে সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কর্মীদের একটি সভা আহ্বান করা হয়।[১৩] যাঁরা এই সভায় উপস্থিত হন এবং আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন তাঁদের মধ্যে কমরুদ্দীন আহমদ, রণেশ দাসগুপ্ত, আজিজ আহমদ, অজিত গুহ, আবুল কাসেম, সরদার ফজলুল করিম, শামসুদ্দীন আহমদ, কাজী গোলাম মাহবুব, নঈমুদ্দীন আহমদ, তফজ্জল আলী, আলী আহমেদ, মহীউদ্দিন, আনোয়ারা খাতুন, শামসুল আলম. শওকত আলী, আউয়াল, মহম্মদ তোয়াহা, অলি আহাদ, শামসুল হক, শহীদুল্লাহ কায়সার, লিলি খান, তাজউদ্দীন আহমদ প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।[১৪] এই সভায় সভাপতিত্ব করেন কমরুদ্দীন আহমদ।[১৫]

ভাষা আন্দোলনকে সুষ্ঠু সাংগঠনিক রূপ দেওয়ার জন্যে এই সভায় ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ নামে একটি সর্বদলীয় পরিষদ গঠিত হয় এবং গণ আজাদী লীগ, গণতান্ত্রিক যুব লীগ, তমদ্দুন মজলিশ, সলিমুল্লাহ মুসলিম হল, ফজলুল হক মুসলিম হল ইত্যাদি ছাত্রাবাস ও পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগ এদের প্রত্যেকটি থেকে দুজন করে প্রতিনিধি তার সদস্য হিসাবে মনোনীত হন। সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক হিসাবে মনোনীত হন শামসুল আলম।[১৬]

এই সভায় সংগ্রাম কমিটির সদস্যদের নাম আলোচনাকালে আবুল কাসেম অজিত গুহের নাম সদস্য হিসেবে রাখার বিরোধিতা করে বলেন অজিত বাবু হিন্দু কাজেই তাঁর অন্তর্ভুক্তি আন্দোলনের পক্ষে ক্ষতিকর হবে। অজিত গুহ এর প্রতিবাদ করে একটি দীর্ঘ বক্তৃতা দেন এবং বলেন যে, আন্দোলনের তাতে কোন অসুবিধা হবে না বরং সুবিধাই হবে। কারণ ভাষা আন্দোলন একটা গণতান্ত্রিক আন্দোলন এবং তাতে কোন সাম্প্রদায়িক বিবেচনা স্থান পাওয়া উচিত নয়।[১৭]

অজিত গুহ প্রগতিশীল লেখক সংঘের প্রতিনিধি হিসেবে এই সভায় যোগদান করেন। অজিত গুহের মতে আবুল কাসেম সাম্প্রদায়িক প্রশ্নের অবতারণা করলেও তাঁর আসল উদ্দেশ্য ছিলো প্রগতিশীল লেখক সংঘকে সংগ্রাম কমিটি থেকে বাদ দেওয়া। শেষ পর্যন্ত অজিত গুহকে সংগ্রাম কমিটির সদস্য করা হয়নি।[১৮] বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার জন্যে একটি প্রস্তাব গ্রহণের পর সভায় পাকিস্তান গণ-পরিষদের সরকারী ভাষার তালিকা থেকে বাংলা ভাষাকে বাদ দেওয়ার প্রতিবাদ হিসাবে ১১ই মার্চ সমগ্র পূর্ব-বাঙলায় সাধারণ ধর্মঘটের আহ্বান জানিয়ে অপর একটি প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়।[১৯]

সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের যে সাব-কমিটি গঠিত হয় তার কয়েকটি বৈঠকে ১১ তারিখের ধর্মঘট সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা হয়। এই সাব-কমিটির দু’টি বৈঠক পর পর ৪ঠা এবং ৫ই মার্চ বিকেল পাঁচটায় ফজলুল হক হলে অনুষ্ঠিত হয়।[২০]

১১ই মার্চের সাধারণ ধর্মঘটকে বানচাল করার উদ্দেশ্যে দলিউর রহমান এবং মুখলেসুর রহমানের প্ররোচনায় ঢাকা ইন্টারমিডেয়েট কলেজের অধ্যক্ষ নানাপ্রকার গণ্ডগোল সৃষ্টির চেষ্টা করেন। তাঁদের উদ্যোগে ৭ই মার্চ কলেজ প্রাঙ্গণে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয় এবং তাতে কলেজের অধ্যক্ষও বক্তৃতা দান করেন।[২১]

৪. সিলেটে প্রতিক্রিয়াশীলদের হামলা

৮ই মার্চ সিলেট তমদ্দুন মজলিশ এবং সিলেট জেলা মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের যৌথ উদ্যোগে সিলেটের গোবিন্দ পার্কে একটি জনসভার আয়োজন করা হয়। এই সভার উদ্দেশ্য ছিল নাজিমুদ্দীন পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা ও শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে বাংলাকে গ্রহণ করার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তার জন্যে তাঁকে ধন্যবাদ দেওয়া এবং অবিলম্বে তাঁর এই প্রতিশ্রুতিকে কার্যে পরিণত করার দাবী জানানো। সভাটিতে সভাপতিত্ব করেন আসাম প্রাদেশিক মুসলিম লীগের প্রাক্তন সম্পাদক মাহমুদ আলী। সভার কাজ শুরু হওয়ার ঠিক পরেই কয়েকজন লোক উর্দু পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হোক এই বলে চীৎকার করে ওঠে। পর মুহূর্তেই দুষ্কৃতিকারীদের মধ্যে একজন সভাপতির চেয়ার দখল করে তাতে বসে পড়ে এবং আবদুল বারী (ধলা) নামে গুণ্ডা প্রকৃতির এক ব্যক্তি টেবিলের উপর চড়ে আবোল- তাবোল বক্তৃতা শুরু করে। এইভাবে আবদুল বারী এবং তার অন্যান্য সহযোগী গুণ্ডারা সভায় বাংলা ভাষার সমর্থকদেরকে বক্তৃতাদানে বাধা দিতে থাকে। শুধু তাই নয়। তারা সেই সাথে সভাপতি মাহমুদ আলী, নওবেলাল-এর প্রধান সম্পাদক মোহাম্মদ আজরফ পাকিস্তান মুসলিম লীগের সদস্য ও সিলেট তমদ্দুন মজলিশের সম্পাদক দেওয়ান অহিদুর রহমান রেজা এবং সিলেট জেলা মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি মোহাম্মদ আবদুস সামাদকে লক্ষ্য করে ইট পাটকেল ছোঁড়ে এবং কয়েকজন ছাত্রকে প্রহার করে। এরপর তারা অধিকতর উগ্র মূর্তি ধারণ করে টেবিল-চেয়ারে লাথি মারতে থাকে এবং একজন পাকিস্তানের পতাকা পর্যন্ত ছিঁড়ে ফেলে। গুণ্ডাদের এই আচরণে সমবেত জনসাধারণ খুব ক্রুদ্ধ এবং বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে তাদেরকে পাল্টা আক্রমণে উদ্যত হয়। পুলিশ উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও হাঙ্গামা আয়ত্তে আনা অসম্ভব হয়ে পড়লে সভাপতি তাড়াতাড়ি কয়েকটি প্রস্তাব গ্রহণের পর সভা ভঙ্গ করে দেন।

মূল সভা ভেঙ্গে দেওয়ার পর উপরোল্লিখিত আবদুল বারীর সভাপতিত্বে অন্য একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভায় সিলেট মুসলিম লীগের নেতা আজমল আলী বক্তৃতার মাধ্যমে নানা মিথ্যা প্ররোচণার দ্বারা কিছু লোককে এমন উত্তেজিত করে তোলেন যে তারা গোবিন্দ পার্কের বাইরে এসে তমদ্দুন মজলিসের সদস্য এবং মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের নেতা মকসুদ আহমদকে অমানুষিকভাবে প্রহার করে। এই প্রহারের ফলে তিনি মূর্ছিত হয়ে পড়েন।[২২]

এই ঘটনার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করে উপরোল্লিখিত সভাটির আহ্বায়কদ্বয়, সিলেট তমদ্দুন মজলিশের সম্পাদক দেওয়ান অহিদুর রহমান রেজা এবং সিলেট জেলা মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি মোহাম্মদ আবদুস সামাদ একটি বিবৃতিতে বলেন:

আমরা আজাদ পাকিস্তানের প্রত্যেকের মতামত প্রকাশ করার সুযোগদান করিবার জন্য বহু যুগের দাসত্বের অবসান ঘটাইয়াছি। তাহা প্রমাণ করার সময় আসিয়াছে। কিন্তু আজ আমরা সিলেটবাসী অরাজকতার দৌরাত্ম্য আর কতদূর সহ্য করিব। তাই আমাদের নিবেদন, আপনারা ব্যক্তি স্বাধীনতাকে কোণঠাসা করিয়া অরাজকতাকে আর কত প্রশ্রয় দিবেন? আজ আমাদের জাতীয় সম্মান লাঞ্ছিত ও অপমাণিত।[২৩]

এ প্রসঙ্গে বিবৃতিটিতে তাঁরা আরও বলেন:

সিলেটে গুণ্ডামির নগ্নরূপ বহুদিন হইতে সিলেটবাসী জনসাধারণের অসহ্য হইয়া উঠিয়াছে। জনাব নিশতার সাহেব যখন সিলেট পরিদর্শনে আসেন তখন আমরা গুণ্ডামীর বেপরোয়া নমুনা লক্ষ্য করিয়াছি – পাকিস্তান সরকার এই অন্যায় আচরণের বিরুদ্ধে কোন প্রতিকার করেন নাই, তাই দিন দিন গুণ্ডাপ্রভাব জনমতকে ও ব্যক্তি স্বাধীনতাকে ভয় দেখাইয়া গোলমাল সৃষ্টি করে ও অভদ্র ব্যবহার দ্বারা কণ্ঠরোধ করিতে চায়। আমরা ইহার আশু প্রতিকার দাবী করিতেছি।

গোবিন্দ পার্কের ৮ই মার্চের এই ঘটনার প্রতিবাদে সিলেট জেলা মুসলিম মহিলা লীগ ১০ই মার্চ আর একটি সভা আহ্বান করেন। এই সভায় উপস্থিত হওয়ার জন্যে সিলেটের বিক্ষুব্ধ নাগরিকেরা যখন দলে দলে গোবিন্দ পার্কে সমবেত হচ্ছিলেন ঠিক সেই সময়ে সিলেটের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এম ইসলাম চৌধুরী একটি আদেশ জারী করে সমগ্র সিলেট জেলায় উর্দু বাংলার প্রশ্নে সভা শোভাযাত্রার অনুষ্ঠান দুই মাসের জন্যে নিষিদ্ধ করেন।[২৪] সিলেটের এই সকল ঘটনাবলী সম্পর্কে ‘নাগরিক অধিকার’ শীর্ষক একটি সম্পাদকীয় প্রবন্ধে নওবেলাল বলেন:

যাহারা রাষ্ট্রের কল্যাণ চায় অথবা রাষ্ট্রের জন্য আত্মোৎসর্গ করিতেও প্রস্তুত যদি কোন রাষ্ট্রপতির কোন অবৈধ আচরণে বিভক্ত হইয়া সাধারণ সভায় অথবা প্রেসের মারফতে তাহাদের মত ব্যক্ত করিতে চায় কোন স্বাধীন দেশেই তাহাদের মতামতকে গলা টিপিয়া মারিয়া ফেলা হয় না। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় আমাদের সিলেটের কোন পদস্থ ব্যক্তির বিরুদ্ধে কোনো টু শব্দ করিলেই একদল উগ্রপন্থী সাম্প্রদায়িক মতাবলম্বী লোক মারমুখী হইয়া উঠে। ন্যায়, সত্য ও রাজনৈতিক নীতির দিক দিয়া তাহাদের এই সকল কার্য যে নিতান্ত গর্হিত তাহা পুনর্বার বলিবার কোন প্রয়োজন নাই।[২৫]

এরপর সম্পাদকীয়টিতে বলা হয়:

এই সব অনাচারের মূল বিশ্লেষণ করিলে সহজেই ধরা পড়িবে যে একদল প্রতিক্রিয়াশীল লোকের ষড়যন্ত্রের ফলেই এই সব দুর্নীতি প্রশ্রয় পাইতেছে। রাষ্ট্রের কল্যাণের জন্য কোন বিজ্ঞানসম্মত ও প্রগতিশীল প্রস্তাব উত্থাপন করিলেই ইহারা প্রগতিশীল লোককে রাষ্ট্রশত্রুরূপে প্রচার করিতে আরম্ভ করে এবং যে কোন উপায়ে তাহাদের কণ্ঠরোধ করিবার প্রয়াস পায়। এই ফ্যাসিস্ট দলের প্রভাবে ও প্ররোচনাতেই সিলেটে নানাবিধ অনাচারের অনুষ্ঠান চলিতেছে। আমরা এদিকে পাকিস্তান সরকারের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি আকর্ষণ করিতেছি। বাঙলা ভাষা আন্দোলনে সিলেটের জনসাধারণের মধ্যে সক্রিয় রাজনৈতিক প্রতিরোধের যথেষ্ট পরিচয় পাওয়া যায়। প্রথম থেকেই ছাত্র, সাংবাদিক, মহিলাকর্মী এবং জনসাধারণ দৃঢ়ভাবে এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন এবং ভাষা সংক্রান্ত সর্বপ্রকার সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কার্যকলাপের পুরোভাগে তাঁরা অবস্থিত থাকেন। তাঁদের এই প্রতিরোধের আর একটি উদাহরণ ১১ই মার্চ তারিখে ভাষা প্রশ্নের উপর সিলেটের আঠারোজন অত্যন্ত বিশিষ্ট নাগরিকের এক দীর্ঘ বিবৃতি।[২৬] এই বিবৃতিটিতে তারা ঘোষণা করেন:

পাকিস্তানের সংহতি রক্ষা করিবার জন্য যদি জেহাদ করিতে হয় তাহা হইলে আমরাই সর্বাগ্রে ঝাঁপাইয়া পড়িব। পাকিস্তানের অন্তর্গত বিভিন্ন প্রদেশের তামুদ্দুনিক প্ৰগতি যাহাতে নষ্ট না হয় তার জন্যই বাংলা বা সিন্ধী প্রভৃতি ভাষার যথাযোগ্য স্থান দিতে আমরা বদ্ধপরিকর।

উর্দু সমর্থকদের প্রচারণা সম্পর্কে তাঁরা বলেন :

পূর্ব পাকিস্তানে যাঁহারা উর্দুর সমর্থক এই সুযোগে তাঁহারা বাংলার সমর্থনকারীদের বিরুদ্ধে নানাবিধ মিথ্যা প্রপাগান্ডা শুরু করিয়া জনমতকে বিভ্রান্ত করিবার চেষ্টা করিতেছে। তাঁহাদের মুখে প্রায়ই শুনা যায় যাহারা বাংলা ভাষার সমর্থক তাহারা পাকিস্তানের সংহতি নষ্ট করিতে চায়। তাহারা পাকিস্তানের ঘোর শত্রু। তাঁহারা প্রায় সর্বত্রই প্রচার করিতেছে উর্দু আমাদের মজহাবী ভাষা, উর্দুর বিরুদ্ধে কথা বলা ধর্মদ্রোহিতারই নামান্তর।

এর পর সর্বশেষে জনসাধারণের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তাঁরা বলেন:

আমরা পূর্ব পাকিস্তানী জনসাধারণকে বাংলার ন্যায্য মর্যাদা আদায় করিতে আহ্বান জানাইতেছি। মানি অর্ডার ফরম ইত্যাদিতে বাংলার কোন স্থান না দিয়া কেন্দ্ৰীয় পাকিস্তান সরকার যে ভুল করিয়াছেন তাহা অনতিবিলম্বে সংশোধিত করিতে হইবে। বাংলাকে উর্দু এবং ইংরাজীর সাথে পাকিস্তান পার্লামেন্টের বিতর্কের অন্যতম ভাষারূপে গ্রহণ করিতে হইবে। পাবলিক সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষাগুলিতে বাংলা ভাষাকে অন্যতম ভাষারূপে স্থান দিতে হইবে। পূর্ব পাকিস্তানের অফিস আদালতের ভাষারূপে বাঙলাকে স্বীকার করিতে হইবে। পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষার মাধ্যম ও রাষ্ট্রভাষারূপে এখনই গ্রহণ করিতে হইবে। তাহা না হইলে পূর্ব পাকিস্তান অর্থনৈতিক, তামুদ্দুনিক, কৃষ্টিগত ও সরকারী চাকুরীক্ষেত্রে বহুদূর পিছাইয়া পড়িবে এবং পূর্ব পাকিস্তানের নিকট এই আয়াসলব্ধ আজাদী অর্থহীন হইয়া পড়িবে। কেন্দ্রীয় পাকিস্তান সরকারের ধামাচাপা নীতির ফলে পূর্ব পাকিস্তানের জনমনে ক্রমশ নানাবিধ সন্দেহের সৃষ্টি হইতেছে। ইহাকে দূর না করিলে পাকিস্তানের সংহতি নষ্ট হইতে পারে।

ঐ একই দিনের নওবেলাল-এ উর্দুর সমর্থনে মুসলিম লীগ কাউন্সিলের সদস্য আজমল আলী চৌধুরী একটি বিবৃত্তিতে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের সমালোচনা এবং খাজা নাজিমুদ্দিনের প্রতি অভিনন্দন জ্ঞাপন করেন। তিনি বলেন:

মিঃ দত্ত (ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত) সংশোধনী প্রস্তাব পেশ করিবার সময় হয়ত ভুলিয়া গিয়াছিলেন যে ভারতীয় রাষ্ট্রের গণ-পরিষদের ভাষারূপে দেবনাগরী অক্ষরে লিখিত হিন্দুস্থানী ভাষা গ্রহণ করা হইয়াছে। সেই হিন্দুস্থানী ভাষা গ্রহণ করার সময় সংখ্যাগরিষ্ঠ বা সংখ্যালঘিষ্ঠদের কোন প্রশ্নই উঠে নাই। হিন্দুস্থানীকে প্রাধান্য দিবার প্রধানতম কারণ এই যে হিন্দুস্থানীর সঙ্গে হিন্দু সংস্কৃতি ও হিন্দু ঐতিহ্যের যোগসূত্র বর্তমান। দেবনাগরী লিপির এখন মরণদশা উপস্থিত এবং অত্যন্ত সীমাবদ্ধ অঞ্চলে এই লিপির প্রচলন রহিয়াছে। ভারতীয় পরিষদে গৃহীত হিন্দুস্থানী কাহারও কথ্য ভাষা নহে। অপরদিকে ভারতের সাধারণ ভাষারূপে উর্দুর দাবী স্যার তেজ বাহাদুর সাপ্রুর মত লোকেও স্বীকার করিয়াছেন। উর্দুকে ভারতীয় রাষ্ট্র অস্পৃশ্য জ্ঞানে ত্যাগ করার একমাত্র কারণ এই যে উর্দুর মাঝে ইসলামী সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের গন্ধ রহিয়াছে। ভারতের সর্বত্র এক ভাষার মাধ্যমে যখন একতা সৃষ্টির প্রয়োজন হইল তখন ভারতীয় ডোমিনিয়নের অন্তর্গত বিভিন্ন ভাষাভাষী লোক তাহাদের সংকীর্ণ প্রাদেশিকতা ভুলিয়া গেল। অথচ সেই একই যুক্তি বলে উর্দুকে যখন পাকিস্তানের সাধারণ ভাষারূপে গ্রহণ করার দাবী উঠিল তখন ইহাকে মহা ভুল বলিয়া আখ্যা দিলেন।

আজমল আলী তাঁর বিবৃতিতে পরিশেষে বলেন:

পাকিস্তানের সংহতি ও সংস্কৃতিগত ঐক্য বজায় রাখিবার জন্য পাকিস্তান গণ-পরিষদে ইংরেজীর পরেই উর্দুকে ন্যায়সঙ্গতভাবেই স্থান দেওয়া হইয়াছে। আমি পাক-গণ-পরিষদে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কিত আলোচনায় সাহসের সহিত তাঁহাদের অভিমত ব্যক্ত করার জন্য জনাব লিয়াকত আলী খান ও জনাব খাজা নাজিমুদ্দীনকে অভিনন্দন জানাইতেছি। আজমল আলী তাঁর বিবৃতিতে যে সব যুক্তির অবতারণা করেছেন সেগুলি শুধু তাঁর নিজস্ব নয়। বেশ কিছুসংখ্যক মুৎসুদ্দীস্থানীয় উর্দু সমর্থকদের মতবাদকেই তিনি তাঁর বিবৃতিটিকে ব্যক্ত করেছেন। ১১ই মার্চের ঐ একই সাপ্তাহিকে আসাম প্রাদেশিক মুসলিম লীগ কাউন্সিলের প্রাক্তন সদস্য মতসির আলীও আরবী এবং উর্দুর সপক্ষে একই ধরনের একটি বিবৃতি প্রচার করেন।

৫. ১১ই মার্চের সাধারণ ধর্মঘট

১০ই মার্চ রাত্রে ফজলুল হক হলে রাষ্ট্রভাষা কর্ম পরিষদের একটি সভা বসে। এই সভায় পরদিনের ধর্মঘটের বিস্তারিত কর্মসূচী সম্পর্কে আলোচনা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।[২৭] তখন পর্যন্ত ১১ই মার্চ ঢাকা শহরে ১৪৪ ধারা জারী করা হয়নি কিন্তু পরদিন সে রকম কোন পরিস্থিতির উদ্ভব হলে কর্মপন্থা কি হবে সে সম্পর্কে সভাটিতে আলোচনা হয়। এই আলোচনাকালে শামসুল হক ১৪৪ ধারা জারী হলে তা ভঙ্গ না করার পক্ষে মত প্রকাশ করেন। কিন্তু অলি আহাদ, আবদুল ওদুদ প্রভৃতি ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে মত দেন।[২৮] এ সম্পর্কে কোন সঠিক সিদ্ধান্ত এই সভায় গৃহীত হয়নি। সরকার কর্তৃক শহরে ১৪৪ ধারা জারী না করার ফলে এ সিদ্ধান্তের গুরুত্বও খুব বেশী ছিলো না। কাজেই মূল আলোচনা পরদিনের পিকেটিং সংক্রান্ত বিষয়ের মধ্যেই মোটামুটিভাবে সীমাবদ্ধ থাকে।[২৯]

১১ই মার্চের সাধারণ ধর্মঘটকে সম্পূর্ণভাবে সাফল্যমণ্ডিত করার জন্যে ব্যাপকভাবে পরদিন পিকেটিং করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কোন্ কোন্ জায়গায় কোন্ সময়ে পিকেটিং শুরু করা দরকার এবং কে কোন্ জায়গায় থেকে সেই পিকেটিং পরিচালনা করবে এই সভায় সেটা মোটামুটিভাবে স্থির করা হয়।[৩০] ইডেন বিল্ডিং-এর প্রথম ও দ্বিতীয় গেট, রমনা পোস্ট অফিস, পলাশী ও নীলক্ষেত ব্যারাক, জেলা আদালত, হাইকোর্ট, রেলওয়ে ওয়ার্কশপ ইত্যাদি স্থানে বিশেষ পিকেটিং-এর ব্যবস্থা করা হয়। রেলওয়ে ওয়ার্কশপের পিকেটিং-এর জন্যে তিনটি পয়েন্ট ঠিক করা হয় – রেলওয়ে হাসপাতালের সামনে ও পাশে দুই রেলওয়ে ক্রসিং-এ এবং আবদুল গণি রোডের দিক থেকে ওয়ার্কশপে প্রবেশের পথে। পিকেটিং চলাকালে কেউ কেউ গ্রেফতার হলে তাদের স্থান যাতে অন্যেরা নিতে পারে তার ব্যবস্থাও ঠিক হয়। এটা করা হয় এজন্যে যাতে একদল গ্রেফতার হওয়ার পর লোকের অভাবে পিকেটিং বন্ধ হয়ে না যায়।[৩১]

১৯৪৮ সালের আন্দোলনের সময় সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের বিশেষ কোন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা থাকেনি। নেতৃস্থানীয় ছাত্রদের মধ্যে একমাত্র হলের সহ-সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং শামসুল আলম ব্যতীত অন্য কাউকে আন্দোলনে বিশেষভাবে অংশগ্রহণ করতেও দেখা যায়নি। ফজলুল হক হল, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ এবং মেডিকেল কলেজই এ ব্যাপারে বিশেষভাবে সক্রিয় ছিলো।[৩২]

১১ই মার্চ খুব ভোর হতেই ছাত্রেরা পিকেটিং-এর জন্যে বিভিন্ন হল থেকে বেরিয়ে পড়েন। রেলওয়ে ওয়ার্কশপে কাজ শুরু হতো ভোর পাঁচটা থেকে। কাজেই ছাত্রেরা তার পূর্বেই নির্ধারিত তিনটি পয়েন্ট-এর পিকেটিং-এর জন্যে উপস্থিত হন। এ ছাড়া যে যে এলাকায় যখন অফিস বসার কথা অথবা অফিসের জন্যে লোকজনের ঘর থেকে বের হওয়ার কথা (যেমন নীলক্ষেত ও পলাশী ব্যারাক) সেখানেও ছাত্রেরা সময়মতো উপস্থিত হয়েছিলেন।[৩৩] কিছু নেতৃস্থানীয় লোকজন সেদিন গ্রেফতার হয়ে জনপ্রিয়তা অর্জনের সিদ্ধান্ত পূর্বেই নিয়ে বসেছিলেন এবং তাঁদের এই মনোভাবের কথা অনেকেরই জানা ছিল। কাজেই কর্মীদের মধ্যে কেউ কেউ ঐ ধরনের নেতাদের কাছাকাছি পিকেটিং-এর সময় না থাকার সিদ্ধান্ত নেন। কারণ তাঁদের কাছে থাকলে গ্রেফতারের সম্ভাবনা বেশী থাকতো এবং তার ফলে অধিক সংখ্যক কর্মী গ্রেফতার হয়ে গেলে ধর্মঘট বানচাল হওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পেতো।[৩৪] ১১ তারিখে বিশ্ববিদ্যালয় এবং শহরের অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে পূর্ণ ধর্মঘট হয়েছিলো কিন্তু সকালের দিকে বিশ্ববিদ্যালয় অথবা অন্য কোন জায়গায় কোন সভা অথবা মিছিল অনুষ্ঠিত হয়নি। এর কারণ ধর্মঘটকে সাফল্যমণ্ডিত করার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানোর সিদ্ধান্তের ফলে সকালের দিকে ছাত্রেরা পিকেটিং-এর উদ্দেশ্যে শহরের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়েন।

সেদিন সকালের দিকে রমনা ডাকঘরের সামনে যে সমস্ত ছাত্রেরা পিকেটিং-এর জন্যে গিয়েছিলেন পুলিশ তাঁদেরকে গ্রেফতার করে সামনের একটি গাছতলায় ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকে। দলটিতে ছাত্রদের সংখ্যা ছিলো তেরো চৌদ্দ। পুলিশ সুপারিনটেনডেন্ট গফুরও তখন রমনা ডাকঘরের সামনে উপস্থিত ছিলেন। অল্পক্ষণের মধ্যে মহম্মদ তোয়াহা ঘটনাস্থলে উপস্থিত হলে তাঁকে উদ্দেশ্য করে গফুর বলেন, ‘দেখেন এরা কিভাবে পিকেটিং করছে।’ এর জবাবে তোয়াহা তাঁকে বলেন যে, স্ট্রাইকের সময় পিকেটিং হবেই, সেটা খুব স্বাভাবিক। এই নিয়ে গফুরের সাথে মহম্মদ তোয়াহার তর্কাতর্কি চলাকালে সেখানে তাজউদ্দীন আহমদ এবং সরদার ফজলুল করিম উপস্থিত হন। তাঁরা মহম্মদ তোয়াহার সাথে সামান্য কথাবার্তার পর রমনা ডাকঘর এলাকা পরিত্যাগ করেন। গফুরের সাথে ছাত্রদের বিশেষ করে তোয়াহার তর্কাতর্কি কিছুক্ষণ চলে এবং পরিশেষে বাড়াবাড়ি করলে কঠিন এবং উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে তিনি ছাত্রদেরকে হুমকি দেখানোর চেষ্টা করেন।[৩৫]

হাই কোর্টের গেটের সামনে কিছুসংখ্যক ছাত্র পিকেটিং শুরু করে এবং উকিলদেরকে সেদিনের মতো আদালতের কাজ বন্ধ রাখার জন্যে অনুরোধ এবং চাপ প্রয়োগ করতে থাকে। এই সময়ে উকিলরা ছাত্রদের সাথে বাদপ্রতিবাদে প্রবৃত্ত হন এবং আদালতে উপস্থিত না হলে তাঁদের মক্কেলদের কত ক্ষতি হবে সেকথা ছাত্রদেরকে বোঝানোর চেষ্টা করেন। এই প্রসঙ্গে ফজলুল হক অমৃতবাজার পত্রিকার একজন প্রতিনিধির কাছে এক মৌখিক বিবৃতিতে বলেন:

বেলা ১০-৩০ মিনিটের সময় আমি হাই কোর্টের গেটের সামনে উপস্থিত হই কিন্তু ছাত্রেরা সেখানে পিকেটিং করতে থাকার ফলে ভিতরে ঢুকতে অসমর্থ হই। ছাত্রদেরকে আমি বলি যে আমার প্রায় আটটি কেস কোর্টে আছে এবং আমার অনুপস্থিতিতে আমার মক্কেলরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কিন্তু তাদেরকে এ ব্যাপারে কিছুতেই রাজী করাতে সক্ষম না হয়ে অবশেষে আমি বাড়ীর দিকে রওয়ানা হই।[৩৬]

এই ঘটনাকালে পূর্ব বাঙলার তৎকালীন জেনারেল অফিসার কমান্ডিং আইয়ুব খান একটি পরিদর্শনের কাজ শেষ করে হাই কোর্ট প্রাঙ্গণে অবস্থিত সদ্য স্থাপিত বিভাগীয় সাময়িক হেড কোয়ার্টারে যাওয়ার সময় ফজলুল হক এবং ছাত্রদের এই আলোচনা ও বিতর্ক লক্ষ্য করেন এবং পরবর্তীকালে তাঁর ‘প্রভু নয় বন্ধু’ নামক পুস্তকে এই ঘটনার মিথ্যা, বিকৃত ও বাহাদুরীপূর্ণ এক বর্ণনা দেন। বর্ণনাটি নিম্নরূপ:

আমার মনে আছে একদিন একটি পরিদর্শনের কাজ শেষ করে আমি হাই কোর্ট ফেরত যাচ্ছিলাম। আমি দেখলাম ফজলুল হক আদালতের কাজে বাধা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে ছাত্রদেরকে মাটির উপর উপুড় হয়ে শুয়ে পড়তে বলেছিলেন। আমি গাড়ীর ভেতর থেকে জিজ্ঞেস করেছিলাম কী জন্য ঐ সব করা হচ্ছিলো। ফজলুল হক আমাকে দেখেছিলেন এবং দেখার পর আমাকে তাঁর রীতিমতো ভীতিপ্রদ মনে হওয়ায় তিনি শান্তভাবে ছাত্রদেরকে সে এলাকা ছেড়ে চলে যেতে পরামর্শ দিয়েছিলেন।[৩৭]

শুধু ফজলুল হকই নয়, অন্যান্য অনেক ছাত্রদের সাথে আলোচনা এবং বাদানুবাদে প্রবৃত্ত হন। কিন্তু তাতেও কোন ফল হয় না। এর পর ছাত্রদের উপর পুলিশ লাঠি চার্জ করলে উকিলরা তার প্রতিবাদে আদালত সেদিনের মতো বর্জন করার সিদ্ধান্ত নেন।[৩৮]

ছাত্রেরা শুধু হাই কোর্টের সামনে নয়, সেক্রেটারিয়েটের সামনেও অফিস বর্জন করার জন্যে স্লোগান দিতে থাকেন এবং পিকেটিং অব্যাহত রাখেন। পিকেটিং চলাকালে সেখানেও ছাত্রদের উপর লাঠি চার্জ করা হয়। অমৃতবাজার পত্রিকার প্রতিনিধির সাথে সাক্ষাৎকারের সময় ফজলুল হক এই প্রসঙ্গে বলেন:

হাই কোর্ট থেকে বাড়ী ফেরার পথে সেক্রেটারিয়েটের কাছে আমি একদল ছাত্রকে দেখি। আমি তাদেরকে নানাভাবে বোঝাবার চেষ্টা করি এবং তাদেরকে বাড়ী ফেরৎ যেতে অনুরোধ করি। এই সময় হঠাৎ একদল ছাত্রকে পুলিশ ধাওয়া করায় তারা দৌড়ে এসে আমি যেখানে দাঁড়িয়েছিলাম সেখানে হাজির হয়। আমি দেখলাম একদল পুলিশ আমার চতুর্দিকে যে ছাত্রেরা জড়ো হয়েছিলো তাদেরকে মারপিট করতে শুরু করলো। লাঠির একটা বাড়ি আমারও হাঁটুর উপর পড়ায় আমি খুব যন্ত্রণা অনুভব করি। এর পর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে আমি ক্ষতস্থান ব্যান্ডেজ করিয়ে নিই। তবে আমার আঘাত তেমন গুরুতর ছিলো না।[৩৯]

১১ই মার্চ সকালের এই পিকেটিং-এর সময়ে ছাত্রেরা সেক্রেটারিয়েটের তোপখানা এবং আবদুল গণি রোডস্থ উভয় গেটের সামনেই সমবেত হয়েছিলেন। শামসুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান, অলি আহাদ প্রমুখ কয়েকজন পিকেটিং করেন প্রথম গেটে (আবদুল গণি রোড)। দ্বিতীয় গেটে (তোপখানা রোড) পিকেটিং করেন কাজী গোলাম মাহবুব, শওকত আলী, বরকত এবং অন্য দুইজন। পিকেটিং চলাকালে শামসুল হকের সাথে পুলিশের অনেক তর্কবিতর্ক হয়।[৪০]

দ্বিতীয় গেটের সামনে শওকত আলীরা পিকেটিং শুরু করার পর কিছুসংখ্যক সেক্রেটারিয়েট কর্মচারী সামনের গেট দিয়ে না ঢুকে পাশের একটা মসজিদের সাথে সংলগ্ন পাঁচিলের ফাঁক দিয়ে সেক্রেটারিয়েটের মধ্যে ঢুকতে শুরু করে। তখন দুজনকে সেখানে পিকেটিং-এর জন্যে মোতায়েন করা হয়। পিকেটিং চলাকালে দ্বিতীয় গেটে সার্জেন্ট রবার্টসন প্রথমে হাজির হন। ছাত্রদের সাথে কিছুক্ষণ আলাপ করার পর তিনি অন্যত্র চলে যান। তারপর সেখানে উপস্থিত হন সিটি পুলিশ সুপারিনটেনডেন্ট চ্যাথাম, ইন্সপেক্টর জেনারেল জাকির হোসেন এবং তার ডেপুটি ওবায়দুল্লাহ। তাঁরা তিনজনে প্রথমে সেক্রেটারিয়েটের মধ্যে ঢোকেন। সে সময় তাঁদেরকে কেউ বাধাদান করেনি। তার মিনিট পাঁচেক পর তাঁরা তিনজনেই আবার বের হয়ে এসে নিজেদের গাড়ী ভিতরে নিয়ে যাওয়ার হুকুম দেন। সে সময় শওকত আলী, কাজী গোলাম মাহবুব প্রভৃতি তাঁদেরকে বাধাদান এবং গাড়ী ভিতরে যাতে কোনমতো না নিয়ে যাওয়া যায় তার জন্যে চেষ্টা করতে থাকেন। সেই অবস্থায় পুলিশ সুপার চ্যাথাম কাজী গোলাম মাহবুব ও বরকতকে উদ্দেশ্য করে বলেন যে, তাঁদের দুজনকেই গ্রেফতার করা হলো। এর পর শওকত আলী গাড়ীর সামনে পা লম্বা করে সোজা মাটিতে শুয়ে পড়ে গাড়ীটির পথরোধ করেন। তখন জাকির হোসেন ‘তোমাকেও গ্রেফতার করা হলো’ এই বলে শওকত আলীর একটি হাত ধরে ফেলেন। শওকত আলী তখন অন্য হাতটি দিয়ে গাড়ীর সাদা চকচকে বাম্পারটিকে ধরেন এবং গাড়ীর অগ্রসর হওয়ার সাথে সাথে তিনিও মাটির উপর ছেঁচড়িয়ে সামনের দিকে এগিয়ে চলেন। সেই সাথে জাকির হোসেনকেও তিনি টানতে টানতে সাথে নিয়ে যান এবং প্রচুর গালাগালি বর্ষণ করতে থাকেন।[৪১]

এর পর শওকত আলী, কাজী গোলাম মাহবুব প্রভৃতিকে ওয়াইজঘাটের কোতোয়ালীতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তখন শামসুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান, অলি আহাদ এবং অন্যান্য অনেককে ইতিপূর্বেই গ্রেফতার করে আনা হয়েছিলো। কিছুক্ষণ পর থানার ওসি সকলকে জিজ্ঞেস করলো শওকত আলী এবং কাজী গোলাম মাহবুব কে? এই বিশেষ খোঁজের কারণ হলো এই যে জাকির হোসেন তাঁদের দুজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে কোতোয়ালীতে ফোন করেছিলেন। তাঁরা উভয়েই অভিযোগ অস্বীকার করা সত্ত্বেও তাঁদেরকে বলা হয় যে তাঁদের বিরুদ্ধে বিশেষ ও নির্দিষ্ট অভিযোগ আছে। কাজেই সেই অনুসারে তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। কোতোয়ালীতে খাওয়া-দাওয়ার পর বেলা প্রায় চারটের দিকে শামসুল হক, মুজিবুর রহমান, কাজী গোলাম মাহবুব, শওকত আলী প্রভৃতি বহু কর্মীকে ঢাকা জেলখানায় স্থানান্তরিত করা হয়।[৪২]

সকালের দিকে ছাত্রদের উপর পুলিশের লাঠিচার্জ ইত্যাদির প্রতিবাদে বিকেল দুটো আড়াইটার দিকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে একটি বিরাট সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের আহ্বায়ক নঈমুদ্দীন আহমদ। এই সভায় বক্তারা উত্তেজনাপূর্ণ বক্তৃতা দেন এবং একটি প্রস্তাবে ছাত্রদের উপর সেদিনকার পুলিশী জুলুমের কঠোর সমালোচনা ও প্রতিবাদ করেন। এ ছাড়া অন্য একটি প্রস্তাবে তাঁরা পাকিস্তান সংবিধান সভার যে সকল পূর্ববঙ্গীয় সদস্য বাঙালীদের স্বার্থ রক্ষা করতে অক্ষম হন তাঁদের পদত্যাগও দাবী করেন।[৪৩]

বিশ্ববিদ্যালয়ের এই সভাশেষে ছাত্রেরা প্রধানমন্ত্রী নাজিমুদ্দীনের সাথে সাক্ষাতের জন্য মিছিল সহকারে কার্জন হল হয়ে হাই কোর্টের সামনে উপস্থিত হলে পুলিশ আবার তাদেরকে বাধাদান করে। প্রথমে স্থির করা হয়েছিলো বিকেলেও সকালের মতো সেক্রেটারিয়েটের তোপখানা গেট পর্যন্ত গিয়ে সেখান থেকে ভেতরে প্রবেশ করার চেষ্টা হবে। কিন্তু পুলিশের কাছ থেকে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে মিছিলটি উত্তরে আবদুল গণি রোডের দিকে অগ্রসর হয়। মিছিল ইতিমধ্যে বড়ো আকার ধারণ করে এবং তাকে সরাসরি বাধা দেওয়ার চেষ্টা না করে পুলিশেরা অন্য গেট দিয়ে সেক্রেটারিয়েটের মধ্যে প্রবেশ করে ছাত্রদেরকে উত্তর দিকের গেটের সামনে বাধা দেওয়ার ব্যবস্থা নেয়। মিছিলটি কিন্তু উত্তরের গেটে পৌঁছাবার পূর্বেই গেট ভেতর থেকে বন্ধ করে দেওয়া হয়।[৪৪]

ছাত্রেরা সেক্রেটারিয়েট গেটের সামনে উপস্থিত হয়ে ভেতরে ঢোকার জন্যে দাবী জানাতে থাকলে এক সময় পুলিশ সুপারিনটেনডেন্ট গফুর গেটের তালা খুলে তাঁর পুলিশ বাহিনী নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে আসেন এবং ছাত্রদেরকে তাড়া করে মার দেওয়ার জন্যে পুলিশদের উদ্দেশ্যে চীৎকার করে তাঁর আদেশ জারী করেন। এর পর পুলিশ এলোপাথাড়ীভাবে ছাত্রদেরকে মারপিট শুরু করে। রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম সদস্য মহম্মদ তোয়াহার হাতে এই সময় সাইকেল ছিলো। সেই অবস্থাতেই পুলিশ বন্দুকের বাঁট দিয়ে তাঁকে আঘাত করে। এ সময় তিনি তাঁদের একজনকে আক্রমণ করে তার হাত থেকে বন্দুক ছিনিয়ে নেন। বন্দুকের বেল্ট ধরে টান দেওয়ার ফলেই সেটা সহজে তাঁর হাতে চলে আসে। তখন বেশ কিছুসংখ্যক পুলিশ বন্দুক উদ্ধার করার জন্য তাঁকে ঘিরে ফেলে। অল্পক্ষণ পরই তিনি আহত হয়ে মাটিতে পড়ে যান।[৪৫] এবং পুলিশ সুপার গফুর দৌড়ে সেখানে উপস্থিত হয়ে বন্দুক বেহাত হওয়ার জন্যে কয়েকজন পুলিশকে দুতিন বাড়ি হান্টার মারেন। এর পর মহম্মদ তোয়াহার হাত থেকে বন্দুক তারা কেড়ে নেয়।[৪৬]

পুলিশের এই লাঠিচার্জের ফলে অনেক ছাত্র আহত হন এবং অল্পক্ষণ পরেই তাঁরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়েন। এরপর ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ ওবায়দুল্লাহ তোয়াহাকে ধরে সেক্রেটারিয়েটের মধ্যে নিয়ে যান।[৪৭] বেশ কিছুক্ষণ তাঁকে বসিয়ে রাখেন। সেই সময় ওবায়দুল্লাহ প্রধানমন্ত্রী নাজিমুদ্দীনকে টেলিফোনে জিজ্ঞেস করে মুহম্মদ তোয়াহাকে গ্রেফতার করা হবে কি না। জবাবে খুব সম্ভবত আহত অবস্থায় তাঁকে গ্রেফতারের বিরুদ্ধে মত দেওয়ায় একটি অ্যাম্বুলেন্সে করে তাঁকে সেক্রেটারিয়েট থেকে তারা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসার জন্যে পাঠায় এবং সেখানে তাঁকে কয়েকদিন থাকতে হয়।[৪৮] ১১ই মার্চের এই ঘটনাবলী সম্পর্কে পূর্ববঙ্গ সরকারের একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়:

বাংলাকে কেন্দ্রের সরকারী ভাষা না করার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জ্ঞাপনের উদ্দেশ্যে ১১ই মার্চ আহুত সাধারণ ধর্মঘটকে কার্যকর করবার জন্যে আজ ঢাকাতে কিছুসংখ্যক অন্তর্ঘাতক এবং একদল ছাত্র ধর্মঘট করার চেষ্টা করে। শহরের সমস্ত মুসলিম এলাকা এবং অধিকাংশ অমুসলিম এলাকাগুলি ধর্মঘট পালন করতে অসম্মত হয়। শুধুমাত্র কিছু কিছু হিন্দু দোকানপাট বন্ধ থাকে। শহরের এবং আদালতের কাজকর্ম সম্পূর্ণ স্বাভাবিক ছিলো। রমনা এলাকায় অবশ্য ধর্মঘটকারীরা কিছু কিছু অফিসের লোকদেরকে কাজে যোগদানে বাধা দেয়। পিকেটিং করার উদ্দেশ্যে ছাত্রদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র এক একটি দল সেক্রেটারিয়েট, হাই কোর্ট এবং অন্য কতকগুলি অফিসের সম্মুখে সমবেত হয়। এদের মধ্যে অনেককে শান্তভাবে স্থান ত্যাগ করতে সম্মত করা গেলেও অন্যান্যেরা আক্রমণোদ্যত হয়ে সেখানে অবস্থিত পুলিশ ও অফিস যোগদানে ইচ্ছুক কিছুসংখ্যক লোকজনের উপর ইটপাটকেল ছোঁড়ে এবং অন্যান্য হিংসাত্মক কার্যকলাপ শুরু করে। এর ফলে পুলিশ লাঠিচার্জ করতে বাধ্য হয় এবং ৬৫ জনকে গ্রেফতার করে। এক সময় দুবার বন্দুকের ফাঁকা আওয়াজ পর্যন্ত করতে হয়। বিক্ষোভ প্রদর্শন ও পুলিশ তৎপরতার ফলে মোট চৌদ্দ ব্যক্তি আহত হন এবং তাঁদেরকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এদের মধ্যে কেউই গুরুতরভাবে অথবা গুলির আঘাতে আহত হননি। খানা তল্লাসীর ফলে যে সমস্ত প্রমাণাদি এখন সরকারের হস্তগত হয়েছে তার থেকে স্পষ্টই বোঝা যায় যে, মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ এবং প্রশাসনিক হতবুদ্ধিতা সৃষ্টি করে পাকিস্তানকে খর্ব করার উদ্দেশ্যে একটা গভীর ষড়যন্ত্র চলছে।[৪৯] ১১ই মার্চ কেবলমাত্র কিছুসংখ্যক অমুসলমানদের দোকান বন্ধ ছিলো এবং ভাষা আন্দোলনের উদ্দেশ্য মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি ও পাকিস্তানকে খর্ব করা, এই বক্তব্যের মাধ্যমে প্রেস বিজ্ঞপ্তিটিতে সমগ্র আন্দোলনের একটা সাম্প্রদয়িক ব্যাখ্যা দেওয়ার প্রচেষ্টা সহজেই লক্ষণীয়। এই প্রসঙ্গে সাপ্তাহিক নওবেলাল-এর ঢাকাস্থ প্রতিনিধি প্রেরিত একটি চিঠিতে[৫০] বলা হয়:

১১ই মার্চের এত বড় ঘটনার পর পূর্ববঙ্গ সরকার যে প্রেসনোট বাহির করেন তাহা পড়িলেই বুঝা যায় প্রকৃত সংবাদকে ব্ল্যাক আউট করার জন্য সরকার চেষ্টা করিয়াছেন। প্রেসনোটে বলা হয় মাত্র কতিপয় বিভেদ সৃষ্টিকারী, রাষ্ট্রের দুশমন এই ধর্মঘটে যোগ দিয়েছিল। শহরের সমগ্র মুসলিম এলাকা ধর্মঘটে অংশ গ্রহণ করিতে অস্বীকার করে অর্থাৎ সরকারের মতে মুষ্টিমেয় কম্যুনিস্ট এবং কতিপয় হিন্দু ধর্মঘটে অংশ নিয়াছিল। অথচ কে না জানে ধর্মঘটকে সফল করিয়া তুলিবার জন্য ঢাকার প্রত্যেকটি মুসলমান ছাত্র পুলিশের গুলি বেয়নেট ও লাঠির সম্মুখে বুক পাতিয়া দিয়াছিল। অথচ সরকারের মতে মুসলমানরা এই আন্দোলনে যোগ দেয় নাই। প্রচারণার কী অপূর্ব নমুনা।

১১ই মার্চের ধর্মঘটের দিনে ধর্মঘটী ছাত্রদের পিছনে একদল গুণ্ডাকে লেলিয়ে দেওয়া হয় এবং তারা অনেকে অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয় এবং কয়েকটি অফিসের সামনে পিকেটিংরত ছাত্রদেরকে ভয় দেখাতে থাকে। এদেরই একাংশ পরে শহরের একটি পুস্তকের দোকান লুট করে। অপর এক অংশ ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ প্রাঙ্গণে পিকেটিংরত ছাত্রদের উপর হামলা চালায়। কিন্তু তারা শুধু ছাত্রদেরকে আক্রমণ করেই ক্ষান্ত না হয়ে কলেজের অধ্যাপক আহসান হাবীবকেও আঘাত করে।[৫১]

সেদিনের ধর্মঘটে ছাত্রদের সাথে বেশ কিছুসংখ্যক সেক্রেটারিয়েট এবং রেল কর্মচারীও যোগদান করেন এবং তার ফলে ঢাকাতে কিছুক্ষণের জন্যে অত্যন্ত আংশিক রেল ধর্মঘটও হয়।[৫২] রেলওয়ে ওয়ার্কশপে ধর্মঘটের জন্যে পিকেটিং করার সময় ছাত্রদের সাথে একবার পুলিশের সংঘর্ষ ঘটে এবং সে সময় কয়েকজন ছাত্রকে গ্রেফতার করা হয়।[৫৩]

১১ই মার্চের ধর্মঘট শুধুমাত্র ঢাকাতেই সীমাবদ্ধ ছিলো না। পূর্ব-বাঙলার প্রায় সর্বত্র ঐদিন ছাত্রেরা পূর্ণ ধর্মঘট পালন করেন। রাজশাহীতে সরকারী কলেজ কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধতার জন্যে ছাত্রদের মধ্যে কিছু বিক্ষোভ এবং উত্তেজনার সৃষ্টি হয় কিন্তু পূর্ণ হরতাল পালন করার পর তাঁরা ভুবনমোহন পার্কে ভাষার দাবীতে একটি সভার অনুষ্ঠান এবং ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ স্লোগান চিহ্নিত ব্যাজ বিক্রী করেন।[৫৪] ঢাকা ব্যতীত অন্যান্য জায়গায় মোটামুটি শান্তিপূর্ণভাবে এই ধর্মঘট পালিত হলেও যশোর ছিলো সেদিনের আর একটি ব্যতিক্রম। যশোর রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন আলমগীর সিদ্দিকী এবং হামিদা সেলিম (রহমান)। সভাপতি ছিলেন জেলা কংগ্রেস সভাপতি ডক্টর জীবনরতন ধর। সদস্যের মধ্যে হাবিবুর রহমান, অনন্ত মিত্র, মসিউর রহমান প্রভৃতির নাম উল্লেখযোগ্য। ১১ই মার্চ যশোরে মমিন গার্লস স্কুল ব্যতীত অন্যান্য প্রত্যেকটি স্কুল ও কলেজে পূর্ণ ধর্মঘট পালিত হয়। মুসলিম একাডেমী, সম্মিলনী (হিন্দু ছেলেদের স্কুল) জেলা স্কুল ইত্যাদিতে ধর্মঘটের পর মিছিল বের হয়। এই সময় মোমিন গার্লস স্কুলে ধর্মঘট না হওয়ার সংবাদ পৌঁছলে সমগ্র মিছিলটি সেখানে উপস্থিত হয়ে ধর্মঘট করে বেরিয়ে আসার জন্যে ছাত্রীদেরকে আহ্বান করতে থাকে এবং তার ফলে দারুণ উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। কলেজ কর্তৃপক্ষ হরতালের সম্পূর্ণ বিপক্ষে ছিলেন এবং কিছু সংখ্যক ছাত্রীও সেই দলে ছিলো। জেলা ম্যাজিস্টেট নোমানীর মেয়েও ছিলো ঐ দলভুক্ত এবং সে সক্রিয়ভাবে অন্য সকলকে ধর্মঘট করতে বাধা দিতে থাকে। এই সময় হামিদা সেলিম তাকে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দেওয়াতে তার একটি দাঁত ভেঙে যায় এবং তার ফলে উত্তেজনা আরও বৃদ্ধি পায়। শেষ পর্যন্ত মোমিন গার্লস স্কুলের মেয়েরাও ধর্মঘটে যোগদান করে।

এর পর সমগ্র মিছিলটি যশোর কালেক্টরেটের সামনে উপস্থিত হয় এবং ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ স্লোগান দিতে থাকে। এই সময় এক পর্যায়ে পুলিশ তাদেরকে বাধা দিতে শুরু করলে কিছুসংখ্যক ছাত্র উত্তেজিত হয়ে উঠে ডাবের খোশা ইত্যাদি পুলিশের দিকে ছুঁড়তে থাকে। এর ফলে পুলিশের মধ্যেও উত্তেজনার সৃষ্টি হয় এবং প্রথমে তারা লাঠি চালায় ও পরে ভয় দেখানোর জন্যে বন্দুকের ফাঁকা আওয়াজ করে। এরপরই ছাত্র মিছিলটি একেবারে ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে।

এই ঘটনার প্রতিবাদে সেদিন বিকেলের দিকে যশোরে সমস্ত দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়, পূর্ণ ধর্মঘট পালিত হয় এবং শহরে দারুণ সরকারবিরোধী উত্তেজনা বিরাজ করতে থাকে। সংগ্রাম পরিষদের এক গোপন বৈঠকে সেদিন সন্ধ্যাতেই অনির্দিষ্টকালের জন্যে ছাত্র ধর্মঘট চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। কলেজ কর্তৃপক্ষ অবশ্য অবস্থার অবনতি লক্ষ্য করে এর পর নিজেরাই কলেজ অনির্দিষ্টকালের জন্যে বন্ধ করে দেন।[৫৫]

৬. ১১ই মার্চের নির্যাতনের প্রতিবাদ

পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র লীগের আহ্বায়ক নঈমুদ্দীন আহমদ ১২ই মার্চ সংবাদপত্রে একটি বিবৃতির মাধ্যমে এগারো তারিখের সরকারী জুলুমের প্রতিবাদ করেন। বিবৃতিটিতে বলা হয় যে, দেশের শতকরা ৬৮ ভাগ মানুষের মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলন দমন করার জন্যে নাজিমুদ্দিন সরকার ফ্যাসিস্ট নীতি অবলম্বন করেছেন। নিরীহ ছাত্রদের উপর তাঁরা গুলি চালিয়েছেন, লাঠি চার্জ করেছেন এবং তাদের অনেককে গ্রেফতার করেছেন। যে সমস্ত যুবক ও ছাত্রেরা বৃটিশ বেয়নেটের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে সরকার তাদের উপর উৎপীড়ন করতেও দ্বিধাবোধ করেনি। বিবৃতিটিতে তিনি আশা প্রকাশ করেন যে, এই সব দমনমূলক ব্যবস্থার মুখে ভীতসন্ত্রস্ত না হয়ে ছাত্রেরা বাংলাকে তাদের রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলনকে সাফল্যমণ্ডিত করতে সক্ষম হবে। পূর্ব পাকিস্তানের সকল ছাত্র-ছাত্রীদেরকে ভাষা আন্দোলনে যোগদানের জন্যেও তিনি এই বিবৃতির মাধ্যমে আহ্বান জানান।[৫৬]

নঈমুদ্দীন আহমদের এই বিবৃতিতে ১১ই মার্চের বিভিন্ন ঘটনাবলীতে আহত ও পুলিশ কর্তৃক ধৃত ছাত্রদের একটা হিসাবও দেওয়া হয়। সেই হিসাব মতে আহতের সংখ্যা ২০০; গুরুতরভাবে আহত – ১৮; ধৃত – ৯০০ (এদের মধ্যে অনেককে পরে ছেড়ে দেওয়া হয়) এবং জেলবন্দী – ৬৯।

অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস অব পাকিস্তান পরিবেশিত একটি সংবাদে জানা যায় যে ১১ই মার্চের সরকারী নির্যাতনের প্রতিবাদে পরদিন সকালের দিকে জগন্নাথ কলেজে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভা চলাকালে বেলা সাড়ে বারোটার দিকে প্রায় একশোজন লোক বাইরে থেকে এসে সভায় লোকদের উপর ইটপাটকেল ছুঁড়তে শুরু করে। এর ফলে দলিউর রহমান নামে একজন ছাত্র আহত হয়। ঢাকা মিউনিসিপ্যালিটির প্রাক্তন চেয়ারম্যান বি. দাসগুপ্ত গুণ্ডাদের বাধাদান করতে গেলে তাঁর উপরেও তারা হামলা চালায়।[৫৭]

এ ছাড়াও ১২ই মার্চ ঢাকাতে কতকগুলি বিক্ষিপ্ত ঘটনা ঘটে। দুই ব্যক্তিকে কম্যুনিস্ট সন্দেহে লোহার রড দ্বারা আঘাত করা হয়। রমনা এলাকা মোটামুটিভাবে শান্ত থাকলেও সেক্রেটারিয়েটের সামনে অবাধ যাতায়াত সেদিন বন্ধ থাকে এবং সশস্ত্র প্রহরীরা সমস্ত এলাকাটিকে পাহারা দেয়।[৫৮] কিন্তু তা সত্ত্বেও ছাত্রেরা বিশ্ববিদ্যালয় এবং তার আশেপাশের এলাকায় মিছিল বের করে পুলিশী জুলুম ও বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে।[৫৯]

১২ তারিখের সংবাদপত্রে প্রকাশিত একটি বিবৃতি মারফত ফজলুল হক পূর্ববঙ্গ ব্যবস্থাপক সভার সকল সদস্যের প্রতি পদত্যাগের আহ্বান জানান। তিনি বলেন যে, পরিষদ কর্তৃক ১১ তারিখের ঘটনাবলীর বিরুদ্ধে তাঁদের ঘৃণা ও ক্ষোভ প্রকাশের উপযুক্ত ব্যবস্থা না হলে সরাসরি প্রতিবাদ জ্ঞাপনের জন্যে ব্যবস্থাপক সভার সমস্ত সদস্যের পদত্যাগ করা উচিত। পুলিশ কর্তৃক নিরীহ ছাত্রদের উপর উৎপীড়নের প্রতিবাদে তিনিই সর্বপ্রথম তাঁর সদস্যপদ ত্যাগ করবেন বলেও এই বিবৃতিটিতে তিনি ঘোষণা করেন।[৬০] কিন্তু প্রাদেশিক ব্যবস্থাপক সভা উপরোক্ত মর্মে কোন ব্যবস্থা অবলম্বন না করা সত্ত্বেও ফজলুল হকসহ ব্যবস্থাপক সভার কোন সদস্যই ১৯৪৮ সালে পদত্যাগ করেননি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং শহরের অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে ১৩ই মার্চ পূর্ণ ধর্মঘট পালিত হয়। ১১ তারিখের পুলিশী জুলুমের প্রতিবাদে ১৫ই মার্চ পর্যন্ত ধর্মঘট অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত হয়, কারণ ঐদিনটি ছিলো পূর্ববঙ্গ ব্যবস্থাপক সভার প্রথম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হওয়ার তারিখ। ছাত্রেরা ধর্মঘটের পর সেদিন স্লোগান দিতে দিতে শহরের বিভিন্ন এলাকা মিছিল সহকারে প্রদক্ষিণ করে।[৬১]

১৩ই মার্চের একটি সরকারী ঘোষণা অনুযায়ী কলকাতা থেকে প্রকাশিত অমৃতবাজার পত্রিকা, আনন্দবাজার পত্রিকা এবং স্বাধীনতার আমদানী পূর্ব-বাঙলায় নিষিদ্ধ করা হয়। এই আদেশ অনুসারে সেদিন তেজগাঁও বিমানবন্দরে উপরোক্ত সংবাদপত্রগুলির কপি পৌঁছলে পুলিশ তৎক্ষাণাৎ সেগুলিকে হস্তগত এবং বাজেয়াপ্ত করে।[৬২]

১৪ই মার্চ তারিখেও পূর্ব-বাঙলার সর্বত্র ধর্মঘট পালন করা হয়। ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, যশোর, খুলনা, বরিশাল, ফরিদপুর ইত্যাদি শহরে ছাত্রেরা বিপুল উদ্দীপনার সাথে ধর্মঘটে অংশগ্রহণ করে।[৬৩]

১৫ই মার্চ পূর্ব বাঙলা ব্যবস্থাপক সভার প্রথম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। এই অধিবেশনে যোগদানের জন্যে প্রদেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ব্যবস্থাপক সদস্যেরা ঢাকাতে উপস্থিত হন এবং মুসিলম লীগ পরিষদ দলের একটি সভা ১৪ তারিখে বেলা ৩-৩০ মিনিটে প্রধানমন্ত্রী নাজিমুদ্দীনের বাসভবন ‘বর্ধমান হাউসে’ শুরু হয়। এই সভা চলাকালে সেখানে বেশ কিছুসংখ্যক ছাত্র রাত্রি নয়টা পর্যন্ত সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন এবং ১১ তারিখে ধৃত ছাত্রদের মুক্তিদান এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানান।[৬৪] পার্লামেন্টারী পার্টির এই সভায় ১১ই মার্চের ঘটনা সম্পর্কে বিস্তৃত আলোচনা হয়।[৬৫]

৭. চুক্তি স্বাক্ষর ও পূর্ব বাঙলা ব্যবস্থাপক সভার প্রথম অধিবেশন

মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারী পার্টির অন্তর্ভুক্ত নাজিমুদ্দীন-বিরোধী উপদলের কয়েকজন নেতৃ স্থানীয় সদস্য এই সময়ে ভাষা আন্দোলনের সুযোগে নাজিমুদ্দীনের সাথে আপোষ-মীমাংসার মাধ্যমে কিছু সুবিধা আদায়ের জন্যে কথাবার্তা চালাতে থাকেন।

১৪ তারিখে সকাল নয়টার দিকে মহম্মদ তোয়াহা এবং তাজউদ্দীন আহমদ তফজ্জল আলীর বাসায় তার সাথে দেখা করতে যান। তাঁদের উদ্দেশ্য ছিলো নাজিমুদ্দীনের সাথে সংগ্রাম পরিষদের যে চুক্তির কথা আলোচিত হচ্ছিলো তার সম্পর্কে সরকার পক্ষের মনোভাব কী সে কথা জিজ্ঞেসা করা। তফজ্জল আলী কিন্তু তাঁদেরকে দেখেই উৎসাহের সাথে ইংরেজীতে বলে ওঠেন, ‘তোমরা দুজন মন্ত্রী এবং একজন রাষ্ট্রদূত পাচ্ছো’। এ কথা শুনে মহম্মদ তোয়াহা বিস্ময়ের সাথে তাঁকে বলেন, “বলছেন কী? আমরা কি আন্দোলন করছি মন্ত্রী করার জন্যে? আমরা এখন জানতে এসেছি সংগ্রাম পরিষদের সাথে চুক্তি সম্পর্কে আলোচনা কখন শুরু হবে।’[৬৬]

তফজ্জল আলী এবং অন্য কয়েকজন যে মন্ত্রী হওয়ার জন্যে ভেতরে ভেতরে ষড়যন্ত্র করছিলেন সাধারণ কর্মীদের সে সম্পর্কে কোন ধারণা ছিলো না। কিন্তু এই ঘটনার পর তাঁরা স্পষ্টভাবে আন্দোলনে তাঁদের ভূমিকা উপলব্ধি করেন। ভাষা আন্দোলনের সাথে কিছু যোগাযোগ রক্ষা করে তাঁরা নাজিমুদ্দীনকে এ কথা বুঝাচ্ছিলেন যে, আন্দোলনের তাঁরাই প্রকৃত নেতা কাজেই তাঁদের সাথে একটা আপোষ মীমাংসা হলে আন্দোলন থামিয়ে দেওয়া যাবে।[৬৭]

সেদিন সকালের ঘটনার পর কিছুসংখ্যক কর্মী নিয়ে তাজউদ্দীন আহমদ প্রভৃতি খাজা নসরুল্লাহর বাসভবন দিলকুশায় মহম্মদ আলীর সাথে এ ব্যাপারটি নিয়ে আলোচনার জন্যে উপস্থিত হন। নেতাদের মধ্যে অন্যান্যেরাও সেখানে ছিলেন এবং তাঁরা সকালেই প্রতিশ্রুতি দেন যে ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্যে তাঁরা নাজিমুদ্দীনের সাথে কোন আপোষের মধ্যে যাবেন না।[৬৮]

সেদিন অর্থাৎ ১৪ তারিখে সন্ধ্যা বেলায় ফজলুল হক হলে অনুষ্ঠিত সংগ্রাম কমিটির বৈঠকে মহম্মদ তোয়াহা এই বিষয়টির উল্লেখ করেন। আনোয়ারা খাতুন এম. এল. এ. সেই সময় আইনের ছাত্রী হিসেবে সংগ্রাম কমিটির সেই সভাতে উপস্থিত ছিলেন। তার সাথে তফজ্জল আলীদের যোগাযোগ ছিলো। তিনি বস্তুতঃপক্ষে তাঁদের গ্রুপেরই সদস্য ছিলেন। সেজন্য মহম্মদ তোয়াহা সেই সভাতে আনোয়ারা খাতুনকে বলেন যে, পার্লামেন্টারী পার্টির লোকজনের সাথে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকায় সংগ্রাম কমিটির সভায় তাঁর উপস্থিতি বাঞ্ছনীয় নয়। কাজেই তিনি যেন আর কমিটির কোন বৈঠকে ভবিষ্যতে যোগ না দেন।[৬৯] পরদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত সাধারণ সভাতেও উপরোক্ত বিষয় সম্পর্কে আলোচনা হয় এবং পার্লামেন্টারী পার্টির লোকজনের সুবিধাবাদীতার সাথে ভাষা আন্দোলনের সম্পর্ক ছিন্ন করার উদ্দেশ্যে আনোয়ারা খাতুনকে আনুষ্ঠানিকভাবে সংগ্রাম কমিটি থেকে বহিষ্কার করা হয়।[৭০]

১৪ই মার্চ সংগ্রাম কমিটির সভায় পরদিন সাধারণ ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। মহম্মদ তোয়াহা এবং তাজউদ্দীন আহমদ এই সিদ্ধান্তের উপর বিশেষভাবে জোর দেন। ১৫ই মার্চ পূর্ব-বাঙলা ব্যবস্থাপক সভার সর্বপ্রথম অধিবেশন আহূত হয়েছিলো। সেদিক থেকে ধর্মঘটের সিদ্ধান্তটি ছিলো খুব গুরুত্বপূর্ণ। কাজেই সেই ধর্মঘটকে সফল করার জন্যে কর্মীরা সব রকম উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এই উদ্দেশ্যে কর্মীদেরকে টঙ্গী এবং কুর্মিটোলাতে রেল ধর্মঘটের জন্যে পাঠানো হয়। মেডিকেল কলেজের হাউস সার্জেন ডক্টর করিমকে দেওয়া হয় অ্যাম্বুলেন্সের দায়িত্ব। পুলিশী নির্যাতনের কথা চিন্তা করেই অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করা হয়। এ ছাড়া সেটিকে কর্মীদের যাতায়াতের কাজে ব্যবহার করার কথাও তাঁরা বিবেচনা করেন।[৭১]

১৫ই মার্চ সকালের দিকে বৃষ্টি শুরু হয় এবং তার ফলে পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী কর্মীরা হল এবং অন্যান্য জায়গা থেকে সময়মতো উপস্থিত হতে পারেননি। এই অবস্থা দেখে মহম্মদ তোয়াহা এবং তাজউদ্দীন প্রথমে হলের ছাত্রদেরকে একত্রিত করেন এবং তারপর রমনা পোস্ট অফিস থেকে নীলক্ষেত ও পলাশী ব্যারাক পর্যন্ত বিভিন্ন পিকেটিং পোষ্টে কর্মীদেরকে মোতায়েন করেন। ডক্টর করিম এরপর তাঁর অ্যাম্বুলেন্স গাড়ী এবং লোকজন নিয়ে জগন্নাথ হোষ্টেল এবং আগামসী লেনের মেসে গিয়ে সেখান থেকে কর্মীদেরকে নিয়ে আসেন।[৭২]

১৫ তারিখের ধর্মঘটে সেক্রেটারিয়েট এবং রমনা এলাকার অন্যান্য অফিসের বাঙালী কর্মচারীরা যোগদান করেন। বেলা সাড়ে এগারোটার দিকে রেলকর্মচারীরাও ধর্মঘটে যোগ দেন। পিকেটারদেরকে দলে দলে বিভিন্ন এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয় এবং বেলা প্রায় বারোটার সময় মেডিকেল হাসপাতালের গেটের সামনে পুলিশ কাঁদুনে গ্যাস ছাড়ে।[৭৩]

১৫ই মার্চ মহম্মদ আলী এবং খাজা নসরুল্লাহ সকাল আটটার দিকে কমরুদ্দীন আহমদের বাসায় উপস্থিত হয়ে তাঁকে বলেন যে, নাজিমুদ্দীন সেদিন বেলা সাড়ে এগারোটার সময় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির সাথে ভাষা প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা করতে চেয়েছেন।[৭৪] এই খবর পাওয়ার পর সাড়ে দশটার সময়ে ফজলুল হক হলে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের একটি জরুরী বৈঠক ডাকা হয়। সেই বৈঠকে নাজিমুদ্দীনের প্রস্তাবটি বিবেচনার পর সাক্ষাতের বিষয়ে তাঁরা একমত হন এবং প্রধানমন্ত্রীর সাথে তাঁদের আলোচনার ধারা সম্পর্কেও নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলেন। চুক্তির শর্তগুলির আলোচনার জন্য কমরুদ্দীন আহমদ যে প্রাথমিক খসড়া প্রস্তুত করেন সেটিও এই বৈঠকে আলোচিত এবং মোটামুটিভাবে অনুমোদিত হয়।[৭৫]

রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের কয়েকজন সদস্য প্রধানমন্ত্রী নাজিমুদ্দীনের সাথে আলোচনার জন্যে পূর্ব নির্ধারিত ব্যবস্থা মতো ‘বর্ধমান হাউসে’ সাড়ে এগারোটার সময় উপস্থিত হন। এঁদের মধ্যে আবুল কাসেম, কমরুদ্দীন আহমদ, মহম্মদ তোয়াহা,[৭৬] নঈমুদ্দীন আহমদ, নজরুল ইসলাম, আজিজ আহমদ, আবদুর রহমান চৌধুরী[৭৭] প্রভৃতি নাম উল্লেখযেগণ্য। নাজিমুদ্দীন প্রস্তাব করেন যে প্রাদেশিক সরকারের চীফ সেক্রেটারী আজিজ আহমদ এই আলোচনাকালে উপস্থিত থাকবেন। কিন্তু সংগ্রাম পরিষদের সদস্যেরা তাতে সম্মত না হওয়ায় আজিজ আহমদকে বাদ দিয়েই আলোচনা অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত হয়। এর ঠিক পরই কিছুক্ষণের জন্যে খাজা নাজিমুদ্দীন অনুপস্থিত থাকেন এবং তাঁর ব্যক্তিগত সেক্রেটারী খাজা নসরুল্লাহ সংগ্রাম পরিষদের সাথে চা পান ও গল্প-গুজব করতে থাকেন। খুব সম্ভবতঃ চীফ সেক্রেটারী আজিজ আহমদের সাথে তাড়াতাড়ি পরামর্শের প্রয়োজন বোধ করায় নাজিমুদ্দীনকে ‘বর্ধমান হাউসের বাইরে অথবা টেলিফোনে আলাপের জন্যে অন্য কোন পৃথক ঘরে যেতে হয়। সেটাই তাঁর মধ্যবর্তী অনুপস্থিতির কারণ হিসাবে সংগ্রাম পরিষদের দুই একজন সদস্য উল্লেখ করেন।[৭৮]

প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীনের সাথে সংগ্রাম পরিষদের এই আলোচনা বৈঠকে তুমুল বিতর্ক এবং উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। সংগ্রাম পরিষদ চুক্তির যে শর্তগুলি পেশ করেন তার মধ্যে কতকগুলি স্বীকার করতে সম্মত হলেও অন্য কতকগুলির ক্ষেত্রে প্রথমে তিনি তাঁর সুস্পষ্ট অসম্মতি জ্ঞাপন করেন। সংগ্রাম পরিষদকে তিনি বলেন যে, বাংলাকে পূর্ব বাঙলার সরকারী ভাষা, আদালতের ভাষা ও শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে ঘোষণা করতে তার কোন আপত্তি নেই। কিন্তু বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার জন্যে সুপারিশ করে পূর্ব-বাঙলা ব্যবস্থাপক সভায় কোন প্রস্তাব উত্থাপন করতে তিনি কোনক্রমেই রাজী নন। কারণ রাষ্ট্রভাষা কি হবে সেটা প্রাদেশিক পরিষদের দ্বারা নির্ধারিত হবে না। বিষয়টি কেন্দ্রীয় সরকারের এখতিয়ারভুক্ত এবং সংবিধান সভার মাধ্যমে তাঁরাই এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার মালিক। ইত্তেহাদ, আনন্দবাজার পত্রিকা, স্বাধীনতা, অমৃতবাজার পত্রিকা, যুগান্তর ইত্যাদি কাগজের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার প্রসঙ্গে নাজিমুদ্দীন বলেন যে পত্রিকাগুলি বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্যে সুপারিশ করার ফলে তাদের উপর নিষেধাজ্ঞা জারী করা হয়েছে এ কথা ঠিক নয়। নিষেধাজ্ঞা জারীর মূল কারণ উপরোক্ত পত্রিকাগুলির পাকিস্তান বিরোধী প্রচারণা।[৭৯]

সংগ্রাম পরিষদের আর একটি দাবী ছিলো ভাষা আন্দোলনে জড়িত থাকার জন্যে কোন সরকারী কর্মচারীকে শাস্তিদান বন্ধ করতে হবে। এ সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী বলেন যে, শৃঙ্খলাভঙ্গকারী সরকারী কর্মচারীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা অবলম্বন না করলে রাষ্ট্রের কাজকর্ম শৃঙ্খলার সাথে চালনা করা সম্ভব হবে না। কাজেই কোন সরকারী কর্মচারী সরকারবিরোধী বিক্ষোভে সক্রিয়ভাবে যোগদান করলে তার বিরুদ্ধে শাস্তিমুলক ব্যবস্থা গ্রহণ ব্যতীত উপায় নেই।[৮০] আন্দোলন শুরু হওয়ার পর থেকেই সরকারীভাবে আন্দোলনকে রাষ্ট্রের শত্রুদের দ্বারা পরিচালিত বলে আখ্যায়িত করা হয়েছিলো। বস্তুতঃপক্ষে নাজিমুদ্দীন তার পূর্ব রাত্রেই একটি বেতার ভাষণে এই বক্তব্য প্রচার করেছিলেন। সংগ্রাম পরিষদ প্রধানমন্ত্রীকে বলেন যে, সরকারী প্রেসনোট জারী করে প্রকাশ্যভাবে তাঁকে ভুল স্বীকার করতে হবে এবং সেই সঙ্গে ঘোষণা করতে হবে যে, আন্দোলন রাষ্ট্র-শত্রুদের দ্বারা পরিচালিত হয়নি। এর জবাবে নাজিমুদ্দীন বলেন যে, তিনি এ ব্যাপারে সংগ্রাম পরিষদের সদস্যদের কাছে ত্রুটি স্বীকার এবং দুঃখ প্রকাশ করতে পারেন কিন্তু প্রকাশ্যভাবে সেটা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়।[৮১]

এই বৈঠকে বহুক্ষণ ধরে তর্কবিতর্ক চলে কিন্তু সংগ্রাম পরিষদের সদস্যেরা তাঁদের দাবীতে অনমনীয় থাকার ফলে নাজিমুদ্দীন শেষ পর্যন্ত সবকটি দাবী মেনে নিতে বাধ্য হন। শুধু তাই নয়। আট দফা চুক্তির শেষ দফাটি তিনি স্বহস্তে লেখেন।[৮২] কারণ সেটি প্রথম খসড়ার মধ্যে ছিলো না। ক্ষমা প্রার্থনা করে বিশেষ প্রেস বিজ্ঞপ্তি জারী করতে তিনি অস্বীকার করার পর অষ্টম দফাটি নোতুনভাবে লিখিত হয়।

সর্বসম্মত চুক্তিটির বিবরণ নিম্নরূপ:

১. ২৯শে ফেব্রুয়ারী, ১৯৪৮, হইতে বাংলা ভাষার প্রশ্নে যাঁহাদিগকে গ্রেফতার করা হইয়াছে তাঁহাদিগকে অবিলম্বে মুক্তি দান করা হইবে।

২. পুলিশ কর্তৃক অত্যাচারের অভিযোগ সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং তদন্ত করিয়া এক মাসের মধ্যে এ বিষয়ে একটি বিবৃতি প্রদান করিবেন।

৩. ১৯৪৮ এর এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে পূর্ব-বাঙলা সরকারের ব্যবস্থাপক সভায় বেসরকারী আলোচনার জন্যে যে দিন নির্ধারিত হইয়াছে সেইদিন বাঙলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করিবার এবং তাহাকে পাকিস্তান গণ-পরিষদে এবং কেন্দ্রীয় সরকারের পরীক্ষাদিতে উর্দুর সমমর্যাদা দানের জন্যে একটি বিশেষ প্রস্তাব উত্থাপন করা হইবে।

৪. এপ্রিল মাসে ব্যবস্থাপক সভায় এই মর্মে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করা হইবে যে প্রদেশের সরকারী ভাষা হিসেবে ইংরেজী উঠিয়া যাওয়ার পরই বাঙলা তাহাদের স্থলে সরকারী ভাষারূপে স্বীকৃত হইবে। ইহা ছাড়া শিক্ষার মাধ্যমও হইবে বাঙলা। তবে সাধারণভাবে স্কুল-কলেজগুলিতে অধিকাংশ ছাত্রের মাতৃভাষার মাধ্যমেই শিক্ষাদান করা হইবে। আন্দোলনে যাঁহারা অংশগ্রহণ করিয়াছেন তাঁহাদের কাহারো বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হইবে না।

৬. সংবাদপত্রের উপর হইতে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হইবে।

৭. ২৯শে ফেব্রুয়ারী হইতে পূর্ব-বাঙলার যে সকল স্থানে ভাষা আন্দোলনের জন্য ১৪৪ ধারা জারী করা হইয়াছে সেখান হইতে তাহা প্রত্যাহার করা হইবে।

৮. সংগ্রাম পরিষদের সাথে আলোচনার পর আমি এ ব্যাপারে নিঃসন্দেহ হইয়াছি যে, এই আন্দোলন রাষ্ট্রের দুশমনদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয় নাই।[৮৩]

চুক্তিপত্রটি স্বাক্ষরিত হওয়ার পূর্বে আবুল কাসেম, কমরুদ্দীন আহমদ প্রভৃতি জেলখানায় উপস্থিত হয়ে ভাষা আন্দোলনে বন্দীদেরকে চুক্তিপত্রটি দেখান। শামসুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান, অলি আহাদ, শওকত আলী, কাজী গোলাম মাহবুব প্রমুখ চুক্তির শর্তগুলি দেখার পর তার প্রতি তাঁদের সমর্থন ও অনুমোদন জ্ঞাপন করেন। এর পর সংগ্রাম পরিষদের সদস্যেরা আবার ‘বর্ধমান হাউসে ফিরে আসেন এবং সরকারের পক্ষে প্রধানমন্ত্রী নাজিমুদ্দীন এবং সংগ্রাম পরিষদের পক্ষে কমরুদ্দীন আহমদ চুক্তিপত্রটিতে স্বাক্ষর দেন।[৮৪]

দুপুর একটায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে সেদিন একটি সাধারণসভার পর ছাত্রেরা মিছিল সহকারে সেখান থেকে বের হয়ে পরিষদ ভবনের সামনে উপস্থিত হয়। পরিষদ ভবনের উল্টো দিকেই ছিলো ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের এলাকা। ছাত্রেরা প্রধানত সেখানেই একত্রিত হয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে থাকেন।[৮৫]

এই সময় পর্যন্ত চুক্তিপত্র স্বাক্ষরিত হওয়ার সংবাদ সাধারণভাবে প্রচার করা হয়নি। কিন্তু ছাত্র-জনতার ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা লক্ষ্য করে আবুল কাসেম তাদেরকে শান্ত করার চেষ্টায় চুক্তি সম্পাদিত হওয়ার কথা উল্লেখ করেন। এর সাথে সাথেই চতুর্দিক থেকে তাঁকে ঘেরাও করে গালাগালি বর্ষণ করতে থাকলে তিনি চুক্তির শর্তগুলি তাদেরকে চীৎকার করে শোনাবার চেষ্টা করেন। কিন্তু নাজিমুদ্দীনের সাথে চুক্তি সম্পাদনের কথায় সকলে এতো বেশী উত্তেজিত হয়ে ওঠে যে আবুল কাসেমের কথায় কর্ণপাত না করে তারা তাঁর বিরুদ্ধেও দারুণভাবে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। এই অবস্থায় তোয়াহা প্রভৃতি কয়েকজন সেখানে তাড়াতাড়ি উপস্থিত হয়ে তাদেরকে শান্ত করার জন্যে বলেন যে চুক্তিটি চূড়ান্ত কিছুই নয়। সেটাকে কেন্দ্র করে আলোচনার সূত্রপাত হয়েছে মাত্র। সরকার যদি তাঁদের ভাষা বিষয়ক দাবী স্বীকার করতে অস্বীকার করে তাহলে আন্দোলন তাঁরা চালিয়ে যাবেন।[৮৬] এই ঘোষণার পর জনতা তাঁদের প্রতি শান্তভাব ধারণ করলেও বিক্ষোভ প্রদর্শন থেকে বিরত হলো না। তারা দাবী করতে থাকলো যে স্বয়ং নাজিমুদ্দীনের কাছ থেকে তারা চুক্তি সম্পর্কে শুনতে চায়। কিন্তু নাজিমুদ্দীন তাদের সামনে উপস্থিত না হওয়ায় বিক্ষোভ তাদের অব্যাহত থাকলো।[৮৭] আন্দোলনকে অব্যাহত রাখার জন্যে ঘটনাস্থলেই সংগ্রাম কমিটির নেতাদেরকে পরদিন ১৬ই মার্চ পুনরায় সাধারণ ধর্মঘটের আহ্বান জানাতে হয়।[৮৮]

৮. পরিষদের অভ্যন্তরে

পরিষদের অধিবেশন শুরু হওয়ার পূর্বেই ভবনের সামনে ছাত্রেরা একত্রিত হয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে থাকে। অধিবেশনের শুরুতেই আবদুল করিম এবং নজমুল হক বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পরিষদের স্পীকার এবং ডেপুটি স্পীকার নির্বাচিত হন। তাঁদের উভয়ের নামই মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারী পার্টির পক্ষ থেকে প্রস্তাব করা হয়।[৮৯]

পরিষদের অন্য কাজ শুরু হওয়ার পূর্বে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বাইরে ছাত্রদের উপর কোন অত্যাচার হচ্ছে কি না সে সম্পর্কে জানতে চান। এরপর প্রতাপচন্দ্র গুহ রায়ের এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী নাজিমুদ্দীন বলেন যে সংগ্রাম পরিষদের সদস্যের সাথে বৈঠকে ব্যস্ত থাকার ফলে পরিষদ ভবনে উপস্থিত হতে তাঁর বিলম্ব ঘটেছে। সরকার এবং সংগ্রাম কমিটির মধ্যে একটি চুক্তি সম্পাদিত হওয়ার পর তিনি বন্দীদের মুক্তির জন্যে আদেশ দিয়েছেন! তিনি বলেন যে সংগ্রাম পরিষদের সাথে তাঁর এই মর্মে কথাবার্তা হয় যে চুক্তি সম্পাদনের পর তারা সেক্রেটারিয়েট এবং পরিষদ ভবনের দিকে আর আসবে না। তাই চুক্তি সত্ত্বেও তারা আবার পরিষদ ভবনের সামনে উপস্থিত হয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করায় তিনি বিস্ময় প্রকাশ করেন। নাজিমুদ্দীন বলেন যে চুক্তি অনুসারে তিনি সেক্রেটারিয়েট এবং পরিষদ ভবন ছাড়া অন্য সব জায়গা থেকে পুলিশ প্রত্যাহার করেছেন। তবে পরিষদ ভবনের সামনে ঠিক সেই মুহূর্তে কি ঘটছে সে সম্পর্কে তিনি কিছুই জানেন না। প্রধানমন্ত্রীর এই প্রাথমিক বিবৃতির পর প্রতাপচন্দ্র গুহ রায় তাঁর কাছে জানতে চান যে ১১ই মার্চের ঘটনা সম্পর্কে তিনি পরিষদে সেদিন কোন বিবৃতি দান করবেন কিনা। এর জবাবে নাজিমুদ্দীন বলেন যে, সে সম্পর্কে আলোচনা পার্লামেন্টারী পার্টিতে হয়ে গিয়েছে এবং তার উপর বিবৃতিও সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। কাজেই তা নিয়ে অধিক আলোচনা তিনি ভালো মনে করেন না।[৯০]

এই সময় প্রতাপচন্দ্র গুহ রায়, মনোরঞ্জন ধর প্রভৃতি বাইরে ছাত্রদের উপর কোন পুলিশী অত্যাচার হচ্ছে কিনা সেটা দেখে আসার জন্যে চাপ দিতে থাকেন এবং তার ফলে পরিষদের ভেতরে দারুণ গণ্ডগোল ও উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। কিন্তু স্পীকার সকলকে শান্ত হয়ে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য শোনার জন্যে অনুরোধ করায় অবস্থা অনেকখানি স্বাভাবিক হয়ে আসে এবং নজিমুদ্দীন সংগ্রাম কমিটির সাথে আলোচনা সম্পর্কে পরিষদের সামনে নিম্নলিখিত রিপোর্ট পেশ করেন:

যে সমস্ত দলগুলি এই আন্দোলন শুরু করেছে তাদেরকে নিয়ে গঠিত সংগ্রাম কমিটির সাথে সকাল থেকে আমি আলোচনা করছিলাম। আলোচনার ফলে আমাদের মধ্যে একটা বোঝাপড়া হয়। এর পর তাদেরকে জেলখানায় গিয়ে যারা সেখানে আছে তাদের সাথে সাক্ষাতের অনুমতি দেওয়া হয়। তারা সেখান থেকে ফিরে আসার পর চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়। যারা জেলে আছে তাদের সকলের মুক্তির জন্যে আমি আদেশ দিয়েছি। তারা আমাকে সমস্ত পুলিশ প্রত্যাহার করতে বলেছে। আমি পরিষদ ভবন এবং সেক্রিটারিয়েট ব্যতীত অন্য সব জায়গা থেকে পুলিশ প্রত্যাহার করতে বলেছি। পুলিশ প্রত্যাহারের ব্যাপারে তাদেরকে আমি আশ্বাস দিয়েছি এবং সেই মর্মে আদেশও দেওয়া হয়েছে। কাজেই পরিষদের সামনে তাদের আর আসা উচিত নয়। পরিষদের সামনে ছাড়া তারা যেখানে ইচ্ছা সেখানে যেতে পারে, তারা রমনা অথবা অন্য যে কোন জায়গায় যেতে পারে। কি ঘটছে আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। তারা এখানে এসে বিক্ষোভ প্রদর্শন করছে কেন? আমার কাছেই চুক্তির একটি কপি আছে। সেক্রেটারিয়েট এবং পরিষদের সামনে ছাড়া অন্য সব জায়গা থেকে পুলিশ প্রত্যাহার করা হয়েছে। আমার মনে হচ্ছে সংগ্রাম কমিটিকে তারা বর্জন করেছে। এ ছাড়া আর কি হতে পারে আমি কিছুই জানি না।[৯১] প্রধানমন্ত্রী এই পর্যন্ত বলার পর পরিষদে আবার হট্টগোল শুরু হয়। তখন তিনি আট দফা চুক্তিটি সম্পূর্ণ পাঠ করে তাঁদেরকে শোনান।[৯২]

এর পর ডক্টর মালেক পুলিশ প্রত্যাহার সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের উল্লেখ করে বলেন যে তাঁর আশ্বাস সত্ত্বেও তিনি নিজে দেখে এসেছেন যে পুলিশের স্থানে মিলিটারী মোতায়েন করা হয়েছে। এর উত্তরে নাজিমুদ্দীন বলেন যে মিলিটারী প্রথম থেকেই সেখানে মোতায়েন করা ছিলো এবং পুলিশ অন্যান্য জায়গা থেকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। এ ছাড়া কাউকে আর গ্রেফতার করা অথবা কারো কাজে বাধা দেওয়াও হয়নি। তাদের সাথে এই ব্যবস্থা হয়েছিলো যে তারা পরিষদ ভবন এবং সেক্রেটারিয়েট ছাড়া আর অন্য যে কোন জায়গাতেই অবাধে ঘোরাফেরা করতে পারবে।[৯৩]

প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য শেষ হওয়ার পূর্বেই পরিষদে আবার তুমুল হট্টগোল শুরু হয় এবং অনেকেই প্রধানমন্ত্রীকে বাইরে গিয়ে সচক্ষে অবস্থা দেখে আসার জন্যে দাবী জানাতে থাকেন।

এই গণ্ডগোল চলাকালে মহম্মদ আলী বলেন যে নিশ্চয়ই নোতুন কোন পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে। বিক্ষাভকারীরা এখানে আসতে চায়, কারণ এটাই একমাত্র জায়গা যেখানে জনসাধারণ তাদের দাবী পেশ করতে পারে। কাজেই পরিষদের উচিত ব্যাপারটিকে ভালোভাবে বিবেচনা করা। প্রধানমন্ত্রী নিজে বাইরে গিয়ে স্বচক্ষে অবস্থা দেখে আসুন তা তিনি চান না। তিনি চান যে পরিষদের প্রতিনিধি হিসাবে প্রধানমন্ত্রী তাদের কাছ থেকে জানুন তারা কি চায় এবং তাদের অভিযোগগুলির মীমাংসা কিভাবে করা সম্ভব।[৯৪] এই পর্যায়ে মসিউদ্দিন আহমদ বলেন যে পুলিশ অফিসার গফুরের জন্যে সংগ্রাম কমিটির সাথে প্রধানমন্ত্রীর চুক্তি বাতিল হয়ে গেছে। গফুর বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ঢুকে সেখানে মহিলা ছাত্রীদের উপর কাঁদুনে গ্যাস ছুঁড়েছে। কাজেই যে চুক্তি হয়েছিলো তা নষ্ট হয়ে গেছে এবং তার ফলেই বাইরে বিক্ষোভ শুরু হয়েছে। সমস্ত ব্যাপারটির জন্যে তিনি গফুরকে দায়ী করেন।[৯৫]

১৫ই মার্চ সকালের দিকে প্রধানমন্ত্রী ছাত্রদের উত্তেজনা এবং মনোবলের কথা চিন্তা করে পূর্ব-বাঙলার জেনারেল অফিসার কমান্ডিং আইয়ুব খানকে তলব করেন। আইয়ুব খান হাজির হলে তাঁকে প্রধানমন্ত্রী পরিষদ ভবনের চতুর্দিকে ফৌজ মোতায়েন করে ছাত্রদের সম্ভাব্য আক্রমণ থেকে পরিষদ সদস্যদেরকে রক্ষা করার জন্যে অনুরোধ করেন আইয়ুব খান তাঁর রাজনৈতিক আত্মজীবনীতে বলেছেন যে প্রথমে তিনি প্রধানমন্ত্রীর এই অনুরোধ অগ্রাহ্য করা স্থির করেছিলেন কিন্তু নাজিমুদ্দীন তাঁকে মন্ত্রীত্ব সংকটের কথা বলায় তিনি অবশেষে সরকারের পতন রোধ করার উদ্দেশ্যে তার প্রস্তাবে সম্মত হন। এর পর মেজর পীরজাদার অধীনে একটি পদাতিক কোম্পানী পরিষদ ভবনের কাছাকাছি মোতায়েন করা হয়।[৯৭] ডক্টর মালেক এই কোম্পানীটিকে দেখেই পরিষদ ভবনের কাছে মিলিটারী অবস্থানের উল্লেখ করেন।

পরিষদের মধ্যে ফজলুল হক, আনোয়ারা খাতুন এবং অন্যান্যেরা প্রধান মন্ত্রীকে বাইরে গিয়ে অবস্থা সচক্ষে দেখে আসার জন্যে ক্রমাগত দাবী জানাতে থাকেন। এই সময় একবার অত্যন্ত উত্তেজিত অবস্থায় আনোয়ারা খাতুন বলেন, গত ১১ই মার্চ তারিখে যা হয়েছে,

তা হয়েছে। আজ পুলিশ মেয়েদের গায়ে হাত দিয়েছে, গলা টিপে মেরেছে, তার প্রতিকার চাই। ঐ সমস্ত চোরামী এখানে চলবে না। আমরা চাই প্রধানমন্ত্রী সেখানে গিয়ে দেখে আসুন।[৯৮]

আনোয়ারা খাতুনকে সমর্থন করে শামসুদ্দীন আহমদ বলেন যে, পুলিশ মেয়েদের গায়ে যখন হাত তুলেছে তখন এই মুহূর্তে সকলের পদত্যাগ করা উচিত।[৯৯]

এর পর স্পীকার বিকেল ৪-৫৫ মিনিট পর্যন্ত পরিষদ মূলতবী ঘোষণা করেন।

পরিষদের কাজ আবার শুরু হলে মহম্মদ আলী নোতুনভাবে প্রস্তাব রাখেন যে ঘটনা যেহেতু পরিষদ ভবনের সামনে ঘটছে সেজন্যে পরিষদের স্পীকারের উচিত পরিষদের কয়েকজন সদস্য এবং বিক্ষোভকারীদের মধ্যে কয়েকজনকে নিয়ে তাঁর নিজের কামরায় একটা বৈঠকে মিলিত হওয়া। এর দ্বারা তাদের সত্যকার অভিযোগ সম্পর্কে অবহিত হওয়া যাবে এবং বোঝা যাবে অভিযোগগুলির প্রতিবিধান করা কতদূর এবং কিভাবে সম্ভব।[১০০]

মহম্মদ আলীর এই প্রস্তাব সম্পর্কে পরিষদের অভিমত জিজ্ঞাসা করলে হামিদুল হক চৌধুরী স্পীকারকে বলেন যে অল্পক্ষণের মধ্যেই সমস্যার একটা কিছু সমাধান হবে, কারণ প্রধানমন্ত্রী পরিষদের বাইরে গিয়ে নিজে ছাত্র প্রতিনিধিদের সাথে সাক্ষাৎ করেছেন। যে কয়েকজন ছাত্রকে গ্রেফতার করা হয়েছে তাদেরকেও ছেড়ে দেওয়া হবে।[১০১]

পরিষদের অভ্যন্তরে সদস্যদের চাপে এবং বাইরের ক্রমবর্ধমান বিক্ষোভের ফলে নাজিমুদ্দীন পরিষদ কক্ষ ত্যাগ করে পরিষদ ভবনেই নিজের অফিসে সংগ্রাম পরিষদের কয়েকজনের সাথে সাক্ষাৎ করেন। কিন্তু এই আলোচনা সত্ত্বেও বাইরের বিক্ষোভ শান্ত হয় না। তারা নাজিমুদ্দীন সরকার এবং পুলিশী জুলুমের বিরুদ্ধে এবং রাষ্ট্রভাষা বাংলার জন্যে নানাপ্রকার ধ্বনি উচ্চারণ করতে থাকে এবং পরিষদ ভবনের এলাকা পরিত্যাগ করতে অস্বীকার করে। এই বিক্ষোভ চলাকালে মাঝে মাঝে ফজলুল হক, মহম্মদ আলী, তফজ্জল আলী, নেলী সেনগুপ্তা, ধীরেন্দ্র দত্ত, খাজা নসরুল্লাহ, আব্দুল মালেক প্রভৃতি পরিষদ সদস্যেরা বাইরে এসে ছাত্র এবং অন্যান্য বিক্ষোভকারীদের সাথে কথা বলেন এবং বাংলা ভাষার দাবীর স্বপক্ষে মত প্রকাশ করেন।[১০২]

সন্ধ্যা পর্যন্ত বিক্ষোভকারীরা স্থান ত্যাগ না করায় আইয়ুব খান নিজে পরিষদ ভবনে উপস্থিত হন এবং ডিআইজি, ওবায়দুল্লাহকে জিজ্ঞেস করেন তিনি ছাত্রদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত পুলিশী ব্যবস্থা অবলম্বন করে তাদেরকে তাড়িয়ে দিচ্ছেন না কেন। আইয়ুব খানের বর্ণনা অনুসারে এর উত্তরে ওবায়দুল্লাহ তাঁকে বলেন যে তিনি আদেশ করলে ওবায়দুল্লাহ সে কাজ করতে পারেন কিন্তু রাজনীতিবিদদের জন্যে ছাত্রদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিতে রাজী নন। এর কারণ জিজ্ঞেস করায় ওবায়দুল্লাহ আইয়ুব খানকে বলেন তিনি ছাত্রদেরকে মারপিট করে তাড়িয়ে দিলে তারা পরদিন তাঁর বিরুদ্ধে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে সমস্ত দোষ তাঁর ঘাড়ে চাপিয়ে দেবে। তারা নিজেরা এ ব্যাপারে কোন দায়িত্বই গ্রহণ করবে না। কাজেই লিখিত আদেশ ছাড়া মৌখিক আদেশে ওবায়দুল্লাহ ছাত্রদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে অসম্মতি জ্ঞাপন করেন।[১০৩]

এর পর আইয়ুব খান পরিষদের ভিতরে গিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করে তাঁকে বলেন যে সন্ধ্যে হয়ে আসছে এবং ছাত্রেরাও ক্রমশঃ তাঁদের কোম্পানীর নিকটবর্তী হচ্ছে। নাজিমুদ্দীন তখন জানতে চান কি উপায়ে সমস্যার সমাধান সম্ভব। আইয়ুব তখন তাঁকে পরিষদের অধিবেশন মুলতুবী করিয়ে দিয়ে বাড়ী চলে যেতে উপদেশ দেন। এতে নাজিমুদ্দীন বলেন যে তিনি একটা গুরুত্বপূর্ণ বক্তৃতা তখনো পর্যন্ত শেষ করতে পারেননি কাজেই তাঁর পক্ষে তৎক্ষণাৎ বাড়ী যাওয়া সম্ভব নয়। এ কথা বলার ঠিক পরেই তিনি নিজের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে আইয়ুব খানকে পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করতে বলেন। পাঁচ মিনিট পর নাজিমুদ্দীন পরিষদের অধিবেশন সেদিনের মতো মুলতবী রাখার ব্যবস্থা করে বাইরে এলে আইয়ুব খান মেজর পীরজাদাকে প্রধানমন্ত্রীর গাড়ীটি পরিষদ ভবনের পেছন দিকে নিয়ে আসার জন্যে বলেন। এর পর আইয়ুব এবং পীরজাদা উভয়ে মিলে প্রধানমন্ত্রীকে জগন্নাথ হলের পুরাতন রান্নাঘরের ভেতর দিয়ে পার করে গাড়ীতে চড়িয়ে বাড়ী পাঠিয়ে দেন।[১০৪]

প্রধানমন্ত্রীকে বাড়ী পাঠিয়ে দিয়ে পরিষদ ভবনের বাইরে ছাত্রদের কাছে গিয়ে আইয়ুব খান বলেন যে ‘পাখী উড়ে গেছে’। এই কথা শুনে সকলে উচ্চৈস্বরে হেসে উঠে এবং আবহাওয়া অনেকখানি হালকা হয়ে যায়। এক পর ফজলুল হক এবং মহম্মদ আলী বাইরে এসে ছাত্রদের সাথে কথাবার্তা শুরু করলে আইয়ুব মহম্মদ আলীর কাঁধে টোকা দিয়ে তাঁকে বলেন, “আপনি কি একটা বুলেট খাওয়ার অপেক্ষায় আছেন?’ এতে মহম্মদ আলী রুষ্ট হয়ে আইয়ুবকে বলেন, ‘আপনি অভদ্র ব্যবহার করছেন। আইয়ুব খান এর পর মহম্মদ আলীকে রূঢ় ভাষায় বাড়ী ফেরত যেতে বলেন।[১০৫]

সেদিন আইয়ুব খান মহম্মদ আলীর সাথে যে ব্যবহার করেছিলেন তার প্রতিবাদে মহম্মদ আলী তাঁর বিরুদ্ধে নাজিমুদ্দীনের কাছে নালিশ করেন। এর ফলে নাজিমুদ্দীন আইয়ুব খানকে ডেকে পাঠিয়ে মহম্মদ আলীর সাথে গণ্ডগোল মিটিয়ে নিতে বলেন। আইয়ুব খান লিখেছেন যে নাজিমুদ্দীন তাঁকে এ ক্ষেত্রেও মন্ত্রীত্ব সংকটের দোহাই দেন। মহম্মদ আলীকে এর পর ‘বর্ধমান হাউসে’ ডেকে নিয়ে যাওয়া হয় এবং আইয়ুব খান তখন তাঁকে বলেন যে, তিনি যা করেছেন তা নিতান্তই ঠাট্টাচ্ছলে কাজেই সেটাকে তাঁর গুরুত্ব দেওয়া উচিত হয়নি।[১০৬]

৯. বন্দীমুক্তি ও পরবর্তী বিক্ষোভ

১৫ই মার্চ সন্ধ্যার দিকে ভাষা আন্দোলনের বন্দী ছাত্রদেরকে মুক্তি দেওয়ার উদ্দেশ্যে জেল গেটে হাজির করা হয়। সেই সময় তাঁদের মুক্তির জন্যে বহু লোক বাইরে অপেক্ষা করছিলেন। জেল গেটে বন্দীদেরকে হাজির করার পর জটিল পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। জাকির হোসেন, শওকত আলী এবং কাজী গোলাম মাহবুবের বিরুদ্ধে বিশেষভাবে অভিযোগ করায় তাঁদের বিরুদ্ধে ভাষা আন্দোলন ছাড়াও একটা স্বতন্ত্র মামলা দাঁড় করানো হয়েছিলো। কাজেই ভাষা আন্দোলনের বন্দীদের মধ্যে তাঁরা গণ্য না হওয়ায়, তাঁদের মুক্তির আদেশ আসেনি।[১০৭] রণেশ দাসগুপ্তকে নিয়েও সেই একই সমস্যা দেখা দেয়।[১০৮] অন্য সকলে যদি এঁদেরকে জেলে রেখে বেরিয়ে আসতে সম্মত হতেন তাহলে গণ্ডগোল হতো না। কিন্তু এই তিনজনকে বাদ দিয়ে একজনও জেল পরিত্যাগ করতে সম্মত না হওয়ার দারুণ উত্তেজনা এবং হট্টগোলের সৃষ্টি হলো। প্রধানমন্ত্রীর সাথে এ নিয়ে মহম্মদ তোয়াহা টেলিফোনে আলাপ করে অবস্থার গুরুত্ব তাঁকে বোঝানোর পর উপরোক্ত তিনজনসহ সকলেরই মুক্তির আদেশ দিতে তাঁরা বাধ্য হন।[১০৯] এর পর মুক্তিপ্রাপ্ত কর্মীদেরকে একটি ট্রাকে চড়িয়ে শহরের মধ্যে ঘোরানোর পর ফজলুল হক হলে সেদিন সন্ধ্যা বেলাতেই তাদের জন্য একটি সম্বর্ধনারও আয়োজন করা হয়।[১১০]

১৫ই মার্চ ফজলুল হক হল থেকে মুজিবুর রহমান এবং শত্তকত আলী ১৫০ নম্বর মোগলটুলীতে গিয়ে সেখানেই রাত্রি যাপন করেন। পরদিন খুব সকালে তাঁরা আবার ফজলুল হক হলে ফেরত গিয়ে ছাত্রদেরকে একটি প্রতিবাদ সভার জন্যে একত্রিত করার চেষ্টা করতে থাকেন।

এই সভা পূর্ব দিনের পুলিশী জুলুমের প্রতিবাদে হলেও মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারী পার্টির নাজিমুদ্দীন-বিরোধী উপদলের লোকেরা তার সুযোগ গ্রহণের চেষ্টা করেন। তাঁদের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিলো মন্ত্রীসভাকে আন্দোলন ও বিক্ষোভের দ্বারা বিপর্যস্ত করে নিজেদের জন্যে কিছু বিশেষ সুবিধা আদায় করা। ১১ তারিখে মুজিবুর রহমান, শওকত আলী প্রভৃতি গ্রেফতার হওয়ার পর সেদিনই তফজ্জল আলী তাঁদের সাথে সাক্ষাৎ করে অনেক কান্নাকাটি করেন।[১১১] এর কারণ উক্ত তারিখে পরিষদের স্পীকার নির্বাচনের কথা ছিলো এবং তিনি ভেবেছিলেন মুসলিম লীগের ছাত্রকর্মীদেরকে দিয়ে নিজের সমর্থনে নাজিমুদ্দীনের উপর চাপ দিলে তাঁরা তফজ্জল আলীকেই শেষ পর্যন্ত স্পীকার পদে মনোনয়ন দিতে বাধ্য হবেন। পার্লামেন্টারী পার্টির সাথে সংশ্লিষ্ট কর্মীদের গ্রেফতারের পর তাঁর সে আশা ব্যর্থ হয়।

১৪ তারিখ সন্ধ্যায় বর্ধমান হাউসে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারী পার্টির সভাতে পরদিন পরিষদে স্পীকার পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্যে আবদুল করিম এবং তফজ্জল আলীর নাম প্রস্তাব করা হয়। তফজ্জল আলী সেই নির্বাচনে আবদুল করিমের কাছে ২০-২৫ ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হন।[১১২] মহম্মদ আলীর নেতৃত্বাধীন মুসলিম লীগের পার্লামেন্টারী উপদলের সাথে নাজিমুদ্দীনের তখনো পর্যন্ত কোন চূড়ান্ত আপোষ সম্ভব হয়নি এবং তাকে সম্ভব করার জন্যে ছাত্রদের সাহায্যে মন্ত্রীসভার বিরুদ্ধ তাঁরা নোতুনভাবে বিক্ষোভের ব্যবস্থা করেন।[১১৩] পূর্বদিনের পুলিশী জুলুমের ফলে সে কাজ সহজেই সম্ভব হয়েছিলো।

১৬ই মার্চ সকালে নয়টার দিকে ফজলুল হক হলে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের একটি বৈঠকে পূর্বদিন প্রধানমন্ত্রীর সাথে সম্পাদিত চুক্তির কয়েকটি স্থান সংশোধনের পর দুপুরের দিকে সেই সংশোধনী প্রস্তাব সাধারণ ছাত্রসভায় পেশ করে তাঁদের অনুমোদন লাভেরও সিদ্ধান্ত হয়।[১১৪]

১৬ তারিখে সকালের দিকে নাজিমুদ্দীন তফজ্জল আলীর মাধ্যমে সংগ্রাম কমিটির কাছে জানতে চান যে চুক্তি সত্ত্বেও আন্দোলন অব্যাহত আছে কেন। তিনি তো চুক্তি অনুসারে নিজের কর্তব্য সম্পাদন করেছেন কিন্তু চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর সংগ্রাম কমিটি কর্তৃক আন্দোলন প্রত্যাহারের যে ‘অলিখিত’ চুক্তি তাঁদের সাথে হয়েছিলো তাঁরা সে অনুসারে কাজ করছেন না কেন। তফজ্জল আলী ফজলুল হক হলে এসে সংগ্রাম কমিটির কমরুদ্দীন আহমদ, আবুল কাসেম, তাজউদ্দীন আহমদ প্রভৃতির সাথে এ নিয়ে আলোপ করেন। তাঁকে সংগ্রাম কমিটির পক্ষ থেকে নাজিমুদ্দীনকে বলতে বলা হয় যে আন্দোলনের উপর তাঁদের সম্পূর্ণ হাত নেই। আন্দোলন এখন এমন পর্যায়ে চলে গেছে যেখান থেকে সহজে তা হঠাৎ প্রত্যাহার করা কারো পক্ষে সম্ভব নয়।[১১৫]

বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ সভার নির্ধারিত সময়ের কিছু পূর্বেই বেলা দেড়টার সময় শেখ মুজিবুর রহমান কালো শেরওয়ানী এবং জিন্নাহ টুপী পরিহিত হয়ে একটি হাতলবিহীন চেয়ারে সভাপতির আসন অধিকার করে বসেন।[১১৬] সেই সভায় তাঁর সভাপতিত্ব করার কোন কথা ছিলো না, কারণ ঢাকার তৎকালীন ছাত্র আন্দোলনের মধ্যে তাঁর ভূমিকা ছিলো নিতান্ত নগণ্য। কিন্তু এ সত্ত্বেও তিনি নিজেই সেই সভায় সভাপতিত্ব করার সিদ্ধান্ত নেন এবং নির্ধারিত সময়ের পূর্বেই সভাপতির চেয়ার দখল করেন।[১১৭] সভায় প্রথম দিকেই সকালে ফজলুল হক হলের বৈঠকে গৃহীত নিম্নলিখিত সংশোধনী প্রস্তাবগুলি গৃহীত হয়:

ঢাকা এবং অন্যান্য জেলায় পুলিশী বাড়াবাড়ি সম্পর্কে তদন্তের জন্য সংগ্রাম কমিটি কর্তৃক অনুমোদিত এবং সরকারী ও বেসরকারী সদস্যদের সমন্বয়ে গঠিত একটি তদন্ত কমিটি নিয়োগ করিতে হইবে।

বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা মর্যাদাদানের সুপারিশ করিয়া প্রস্তাব গ্রহণের উদ্দেশ্যে আলোচনার জন্য পূর্ব-বাঙলা পরিষদের অধিবেশন চলাকালে একটি বিশেষ দিন নির্ধারণ করিতে হইবে।

সংবিধান সভা কর্তৃক তাঁহারা উপরোক্ত সংশোধনী প্রস্তাবগুলি অনুমোদন করাইতে অসমর্থ হইলে সংবিধান সভায় এবং পূর্ব-বাঙলা মন্ত্রীসভার সদস্যদিগকে পদত্যাগ করিতে হইবে।[১১৮]

উপরোক্ত প্রস্তাবগুলি গৃহীত হওয়ার পর অলি আহাদের মাধ্যমে সেটি প্রধানমন্ত্রী নাজিমুদ্দীনের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।[১১৯] প্রস্তাব গ্রহণের পর মুজিবুর রহমান অন্য কাউকে বক্তৃতার সুযোগ না দিয়ে নিজেই বক্তৃতা শুরু করেন। সেই এলোপাথাড়ী বক্তৃতার সারমর্ম কিছুই ছিলো না।[১২০] অল্পক্ষণ এইভাবে বক্তৃতার পর তিনি অন্য কাউকে বক্তৃতার সুযোগ না দিয়ে হঠাৎ, ‘চলো চলো অ্যাসেমব্লি চলো’ বলে স্লোগান দিয়ে সকলকে মিছিল সহকারে পরিষদ ভবনের দিকে যাওয়ার জন্যে আহ্বান জানান।[১২১] সেদিনকার পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচী অনুযায়ী মিছিলের কোন কথা ছিলো না। কিন্তু এই হঠাৎ-উদ্ভূত পরিস্থিতির পর মিছিলকে বন্ধ করা কারো পক্ষে সম্ভব হলো না। কাজেই ছাত্রেরা সরকার বিরোধী এবং বাংলা ভাষার সমর্থনে নানা প্রকার ধ্বনি দিতে দিতে পরিষদ ভবনের দিকে অগ্রসর হলো।

ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, মেডিকেল কলেজ এবং পরিষদ ভবনের নিকটবর্তী চৌমাথার কাছে মিছিলটি পৌঁছালে পুলিশ তাদেরকে বাধাদান করে। এর পর ছাত্রেরা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের তারের বেড়া পার হয়ে কলেজ এলাকার মধ্যে ঢুকে পড়ে এবং সেখানেই অবস্থান করে নাজিমুদ্দীন মন্ত্রীত্বের পদত্যাগ দাবী এবং পুলিশী জুলুমের বিরুদ্ধে ধ্বনি দিতে থাকে।[১২২] অধিবেশন চলাকালে বাইরে দারুণ হট্টগোল হচ্ছিলো। এই সময় ভেতরে থেকে কোন কোন সদস্য মাঝে মাঝে বের হয়ে এসে ছাত্রদের কাছে মুখ দেখিয়ে যাচ্ছিলেন। তাঁদের এই আচরণের কারণ ছিলো রাস্তায় নেমে ছাত্রদের হাতে যাতে মারধোর খেতে না হয় তার ব্যবস্থা করা। এই সময়ে হাতিয়ার মৌলানা আবদুল হাই একবার উপরের ব্যালকনীতে দাঁড়িয়ে নাটকীয় ভঙ্গীতে ছাত্রদেরকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘চালাও চালাও আমরা আছি ইত্যাদি।[১২৩]

পরিষদ ভবনের পূর্ব গেটে এই সময়ে ছাত্রেরা গিয়ে কিছুসংখ্যক পরিষদ সদস্যকে মারপিট ও গালাগালি শুরু করে। এদের মধ্যে নাজিমুদ্দীন বিরোধী উপদলীয় সদস্যেরাও কেউ কেউ ছিলেন। এই খবর শওকত আলী প্রভৃতির কাছে পৌঁছানোর পর পূর্ব গেটে এমন নোতুন কর্মীদেরকে মোতায়েন করা হয় যাঁরা তাঁদের সমর্থক পরিষদ সদস্যদেরকে চিনতেন।[১২৪]

সন্ধ্যা পর্যন্ত পরিষদ ভবনের সামনে ছাত্রদের এই বিক্ষোভ চলতে থাকলো এবং তাদের মধ্যে সেই এলাকা পরিত্যাগ করার কোন লক্ষণ দেখা গেলো না। এর ফলে পরিষদ সদস্য থেকে শুরু করে স্পীকার, ডেপুটী স্পীকার এবং মন্ত্রীসভার সদস্যেরা সকলে অধিবেশন শেষ হওয়ার তিন ঘণ্টা পর পর্যন্ত তাদের দ্বারা ঘেরাও হয়ে থাকেন। এই পর্যায়ে হামিদুল হক চৌধুরী পরিষদ ভবনের সিঁড়ির উপর দাঁড়িয়ে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট রহমতুল্লাহকে উদ্দেশ্য করে বলেন যে, তার উচিত ছাত্রদেরকে গুলি করা। হামিদুল হকের এই কথা শুনে শওকত আলী প্রত্যুত্তরে তাঁকে অত্যন্ত কঠিন ‘লৌকিক’ ভাষায় গালাগালি করে পরিষদ ভবনের বাইরে রাস্তায় বেরিয়ে আসতে বলেন।[১২৫]

এইভাবে ছাত্রদের উত্তেজনা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাওয়া এবং অবস্থা পুলিশের আয়ত্তের বাইরে যাওয়ার উপক্রম হলে ম্যাজিস্টেট রহমতুল্লাহ শামসুল হককে ডেকে বলেন যে পাঁচ মিনিটের মধ্যে ছাত্রেরা যদি পরিষদ ভবন এলাকা পরিত্যাগ করে না যায় তাহলে তাদের উপর লাঠিচার্জ করা হবে। শামসুল হক তখন তাঁকে বলেন যে, আরো কিছু বেশি সময় প্রয়োজন কারণ এত বিরাট জনতাকে বুঝিয়ে পাঁচ মিনিটের মধ্যে সেখান থেকে সরানো সম্ভব নয়। শামসুল হক এই কথা বলার সাথে সাথেই পুলিশ লাঠিচার্জ শুরু করে এবং চতুর্দিকে দৌড়াদৌড়ি পড়ে যায়। গফুরের নেতৃত্বে পুলিশ বাহিনী এর পর এলোপাথাড়ীভাবে লাঠিচার্জ, কাঁদুনে গ্যাস এবং বন্দুকে ফাঁকা আওয়াজ দিয়ে জনতাকে ছত্রভঙ্গ করার জন্যে সর্বপ্রকার চেষ্টা চালায়। এর ফলে উনিশজন আহত হন কিন্তু তাঁদের মধ্যে শওকত আলীর অবস্থাই ছিলো সব থেকে গুরুতর।[১২৬]

লাঠিচার্জ শুরু হওয়ার সাথে সাথে অন্যান্যের মতো শওকত আলীও দৌড়াতে থাকেন। এ সময় তাঁর পেছনে একটি পাঞ্জাবী পুলিশও তাঁকে ধরার জন্যে তাঁর পিছনে পিছনে দৌড়াতে শুরু করে। সে শওকত আলীর খুব নিকটেই ছিলো এবং নিজের হাতের ডাণ্ডা দিয়ে তাঁর শরীরের মাঝে মাঝে আঘাত করছিলো। এইভাবে দৌড়াতে দৌড়াতে তিনি যখন মেডিকেল কলেজের গেটের (বর্তমান শহীদ মিনার) কাছে পৌছান তখন পুলিশটি তাঁর পুরো হাতের উপর খুব জোরে একটা লাঠির বাড়ি দেয় এবং তার ফলে শওকত আলী মূর্ছিত হয়ে মাটির উপর পড়ে যান। এ সময়ে পলাশী ব্যারাকের কর্মচারীরাও সব কাছাকাছি ছিলেন। তারা ‘নারায়ে তকবীর’ ধ্বনি তুলে দৌড়ে তাঁর দিকে এগিয়ে আসেন। পরে শওকত আলীকে সেখান থেকে তুলে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।[১২৭] পরিষদ ভবন ছাড়া মেডিকেল কলেজের গেটের সামনেও পুলিশ সেদিন কাঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপ করে।[১২৮] এরপর ‘বলিয়াদী হাউসে’ নাজিমুদ্দীন বিরোধী উপদলীয় সদস্যের একটি সভা বসে। সেখানে গিয়ে তাজউদ্দীন আহমদ এবং শামসুদ্দীন আহম্মদ শওকত আলীর উপর পুলিশী আক্রমণের বিষয়ে তাঁদেরকে বিস্তারিতভাবে খবর দেন।[১২৯]

রাত্রি সাড়ে এগারোটা থেকে সংগ্রাম পরিষদের একটি বৈঠক শুরু হয় এবং তা দুটো পর্যন্ত চলে। সেই বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় যে পুলিশী জুলুমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে ১৭ই মার্চ ধর্মঘট এবং সভা হবে, কিন্তু কোন মিছিল বের হবে না।[১৩০]

১৭ই মার্চ ঢাকার সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে ধর্মঘট পালিত হয়। এরপর বেলা ১২-৩০ মিনিটে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে নঈমুদ্দীন আহমদের সভাপতিত্বে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। ছাত্র ফেডারেশনের কয়েকজন সদস্য সংগ্রাম কমিটিতে তাঁদের প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিত্বের প্রস্তাব করায় সভাতে বেশ গণ্ডগোলের সৃষ্টি হয়। সভাতে সেদিন যাঁরা বক্তৃতা দেন তাঁদের মধ্যে শামসুল হক অন্যতম। জিন্নাহর ঢাকা আগমন উপলক্ষে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে হরতাল বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সভা সেদিন শেষ হয় বেলা ২-৩০ মিনিটে।[১৩১]

১৭ই মার্চ বিকেলে নঈমুদ্দীন আহমদকে সঙ্গে নিয়ে তাজউদ্দীন কামরুদ্দীন আহমদের বাসায় তাঁর সাথে দেখা করতে যান। কমরুদ্দীন আহমদ একটি সভায় যোগদানের উদ্দেশ্যে পূর্বদিন সিরাজগঞ্জ চলে যাওয়ায় তাঁর সাথে তাঁদের দেখা হয়নি। এর পর একটি রিকশায় চড়ে ফজলুল হক হলের দিকে ফেরত আসার পথে তাঁরা নাজিরাবাজারের ফুলতলা মেসের কাছাকাছি পৌছলে তিনটি বাসের মধ্যে সালেক, ইব্রাহীম প্রভৃতি তাঁরা তাদের দলবলসহ সেখানে দেখতে পান এবং তারাও তাঁদের দুজনকে হঠাৎ ঐ অবস্থায় দেখে আক্রমণ করে। ঘটনাচক্রে মতি সর্দারও সেই সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত হলে তাঁর সহায়তায় নঈমুদ্দীন আহমদরা গুণ্ডাদের আক্রমণ থেকে রক্ষা পান।[১৩২]

পূর্ব-বাঙলা পরিষদের তৃতীয় দিনের অধিবেশন শান্ত পরিস্থিতিতে অনুষ্ঠিত হয়। সেদিন প্রধানমন্ত্রী নাজিমুদ্দীন ঘোষণা করেন যে প্রাদেশিক সরকার তৎকালীন শিক্ষানীতি পরিবর্তন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এবং নোতুন নীতিকে চূড়ান্ত রূপদানের জন্যে তাঁরা শিক্ষাবিদ ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সাথে উপযুক্তভাবে পরামর্শ করবেন। তিনি আরও ঘোষণা করেন যে, এক বৎসরের মধ্যে মাধ্যমিক শিক্ষা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংক্রান্ত অর্ডিন্যান্সকে বাতিল করে তাঁরা নোতুন অর্ডিন্যান্স প্রণয়ন করবেন।[১৩৩]

১৭ তারিখ পরিষদের অধিবেশন চলাকালে মুসলিম লীগ দলীয় একজন সদস্য দাবী করেন যে পরিষদের কাজকর্ম বাংলা ভাষাতে চালানো উচিত। এর জবাবে স্পীকার আবদুল করিম বলেন যে, ভাষার প্রশ্নটি পরিষদের দ্বারা নির্ধারিত হতে হবে। তবে তার পূর্বে সদস্যরা নিজেদের ইচ্ছেমতো যে কোন ভাষায় বক্তৃতা দান করতে পারবেন।[১৩৪]

১১ই মার্চের ছাত্র ধর্মঘটের ফলে উদ্ভূত পরিস্থিতির জন্য যশোরে ১৪৪ ধারা জারী করা হয় কিন্তু তা সত্ত্বেও আন্দোলন, বিক্ষোভ এবং তার সাথে প্রতিক্রিয়াশীলদের গুণ্ডামী সবকিছুই সেখানে অব্যাহত থাকে। শহরে এবং পার্শ্ববর্তী এলাকায় বেশ কিছুসংখ্যক অবাঙালী মোহাজেরদের অবস্থানের ফলে অবস্থা আরও জটিল আকার ধারণ করে। ১৮ই মার্চ এই অবাঙালী মোহাজেররা ভাষা আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করে এবং সন্ধ্যার দিকে রেলওয়ে স্টেশনে কিছুসংখ্যক নিরীহ লোকজনদের উপর হামলা চালায়। এ বিষয়ে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত প্রধানমন্ত্রী নাজিমুদ্দীনকে নিম্নলিখিত পত্র দেন:

যশোর হইতে প্রাপ্ত বিভিন্ন রিপোর্ট এবং দায়িত্বসম্পন্ন ব্যক্তিদের সংবাদপত্রে প্রকাশিত বিবৃতি হইতে ইহা স্পষ্ট যে, ১১ই মার্চ অর্থাৎ যে দিন হইতে ছাত্রেরা বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করিবার উদ্দেশ্যে ধর্মঘট পালন করে সেই দিন হইতে যশোর শহরে ক্রমাগত অরাজকতা বিরাজ করিতেছে। ইহা ১৮ই মার্চ চরম পর্যায়ে উপনীত হয়। খবরে প্রকাশ যে, সেদিন বহুসংখ্যক অবাঙালী মুসলমান লাঠি এবং অন্যান্য মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হইয়া শহরে প্রবেশ করে। পুলিশ তাহাদিগকে বাধাদান করিলেও তাহাদের মধ্যে কাউকে গ্রেফতার করে না অথবা যে সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র তাহাদের নিকট ছিল তাহা কাড়িয়া নেয় না। ঐ একই দিনে বৈকাল প্রায় ৬টার সময় তাহাদের একটি দল রেলওয়ে স্টেশনে উপস্থিত হইয়া নির্বিচারে বহু লোককে আক্রমণ করে। ইহার ফলে ১৬ ব্যক্তি আহত হইয়াছে বলিয়া খবর পাওয়া গিয়াছে। তাহাদের অধিকাংশই অমুসলমান। আরও জানা গিয়াছে যে ঐ এলাকার লোকজনের মধ্যে ত্রাস সঞ্চারের উদ্দেশ্যে এই সব কাজ অবাঙ্গালী মুসলমানরাই করিয়াছে এবং তাহার ফলে বহু হিন্দু নারী ও শিশু শহর পরিত্যাগ করিয়া যাইতেছে। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট একজন অবাঙ্গালী মুসলমান। বাংলা ভাষা আন্দোলনের প্রতি তাঁহার কোন সহানুভূতি নাই এবং সেই হিসাবে তিনি এই সংঘর্ষে একটি বিশেষ পক্ষ অবলম্বন করিয়াছেন।

অপরাধীদিগকে কঠিন শাস্তি প্রদান করা উচিত। এ ব্যাপারে আপনার ব্যক্তিগত হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। যদি দেখিতে পাওয়া যায় যে ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট সত্যিই এই ঘটনার সহিত জড়িত তাহা হইলে তাঁহাকে অবিলম্বে বদলীর ব্যবস্থা করা উচিত।[১৩৫]

ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের এই পত্রটি তিনি নিজে ২৪শে মার্চ পূর্ব-বাঙলা পরিষদে পাঠ করে শোনান। প্রধানমন্ত্রী এ ব্যাপারে তদন্ত করেছেন কি না এবং কি ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন সে বিষয়েও তিনি তাঁর কাছে জানতে চান।[১৩৬]

নাজিমুদ্দীন ধীরেন্দ্র দত্তের এই প্রশ্নের জবাব দানকালে বলেন, যে ১১ই তারিখ থেকে যশোরে অরাজকতা বিরাজ করার কথা বিরোধী দলের নেতা স্বীকার করেছেন। এই অরাজকতা দূর করে সেখানে আইন ও শৃঙ্খলা রক্ষার জন্যে স্থানীয় অফিসাররা যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন। তিনি আরও বলেন যে, দুর্ভাগ্যবশত ১৮ তারিখে বিরাট সংখ্যক বিহারীরা যশোর শহরে প্রবেশ করে। পুলিশ ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট তাদেরকে সরিয়ে দেন এবং তারা চলে যায়। এরপর অত্যন্ত অপ্রত্যাশিতভাবে রেলওয়ে স্টেশনের উপর তারা আক্রমণ করে বসে। এই লোকদেরকে কেন গ্রেফতার করা হয়নি সে বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী তদন্তের আশ্বাস দেন। এ ছাড়া তিনি বলেন যে ১৮ তারিখের পর কোন ঘটনা ঘটেনি এবং অবস্থা সম্পূর্ণ আয়ত্তাধীন। কিন্তু এসব সত্ত্বেও তাঁকে এ কথা স্বীকার করতে হয় যে, যশোর শহরে তখন পর্যন্ত দারুণ ভয়ভীতি ও উত্তেজনা বিরাজ করছিলো। তিনি এই ভীতি এবং উত্তেজনা দূর করার জন্যে যথাসাধ্য চেষ্টারও আশ্বাস দেন।[১৩৭]

১৭ তারিখে রাত্রি নয়টার দিকে ফজলুল হক হলের হাউস টিউটর মাজহারুল হকের কামরায় সংগ্রাম কমিটির একটি বৈঠক বসে এবং তা প্রায় এগারোটা পর্যন্ত চলে।[১৩৮]

পরদিন সকাল নয়টায় মাজহারুল হকের কামরায় পুনরায় সংগ্রাম কমিটির বৈঠক বসে। তাতে ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে কমিটির বক্তব্যের উপর একটি বিবৃতির খসড়া তৈরি করা হয়। এ ছাড়া সেই বৈঠকে জিন্নাহকে সম্বর্ধনা জ্ঞাপন করার উদ্দেশ্যে একটি ছাত্র সম্বর্ধনা কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সেদিন বিকালে ফজলুল হক হলে মহম্মদ তোয়াহার কামরায় তিনি এবং তাজউদ্দীন আহমদ ১৬ই মার্চের ঘটনাবলীর উপর একটি ব্যাখ্যামূলক বিবৃতির খসড়াও প্রস্তুত করেন।[১৩৯]

তথ্যসূত্র (সংশোধন করা হয়নি) – দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ: প্রথম রাজনৈতিক সংগ্ৰাম

আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৬/২/১৯৪৮; Amrita Bazar Patrika, 27/2/1948. Amrita Bazar Patrika, ( Town Edition) 27/2/1948.

নওবেলাল, ৪/৩/১৯৪৮।

8 Patrika, 27/2/1948.

2)

٩

১২

পূর্বোক্ত।

নওবেলাল, ৪/৩/১৯৪৮।

পূর্বোক্ত, সম্পাদকীয়।

নওবেলাল, ৪/৩/১৯৪৮।

নওবেলাল, ৪/৩/১৯৪৮।

পূর্বোক্ত এবং আনন্দবাজার পত্রিকা ( শেষ শহর সংস্করণ), ২৭/২/১৯৪৮।

Amrita Bazar Patrika, 26 / 2 / 1948; ৪/৩/১৯৪৮।

আনন্দবাজার পত্রিকা (শেষ শহর সংস্করণ), ২৭/২/১৯৪৮।

১৩ তাজউদ্দীন আহমদ-এর ডায়েরী, ২/৩/১৯৪৮।

১৪ পূর্বোক্ত।

১৫ পূর্বোক্ত।

১৬

১৭

অলি আহামদ, কমরুদ্দীন আহমদ, তাজউদ্দীন আহমদ। অজিত গুহ।

১৮ পূর্বোক্ত।

১৯ নওবেলাল, ৪/৩/১৯৪৮।

২০ তাজউদ্দীন আহমদ-এর ডায়েরী, ৪/৩/১৯৪৮ ও ৫/৩/১৯৪৮।

২১ পূর্বোক্ত, ৭/৩/১৯৪৮।

২২ ঘটনার পূর্ণবিবরণ, নওবেলাল, ১১/৩/১৯৪৮।

২৩ পূর্বোক্ত।

২৪ পূর্বোক্ত।

২৫ পূর্বোক্ত।

২৬ পূর্বোক্ত।

২৭ অলি আহাদ।

২৮ পূর্বোক্ত।

২৯ পূর্বোক্ত।

৩০ অলি আহাদ, তাজউদ্দীন আহমদ।

৩১ তাজউদ্দীন আহমদ।

৩২ তাজউদ্দীন, অলি আহাদ।

৩৩ পূর্বোক্ত।

৩৪ তাজউদ্দীন আহমদ।

৩৫ মহম্মদ তোয়াহা, তাজউদ্দীন আহমদ

৩৬ Amrita Bazar Patrika, 12 / 3 / 1948.

পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি (প্রথম খণ্ড) | 303

৩৭

Friends Not Masters, by Mohammad Ayub Khan P 30. ৩৮ Patrika, 12/3/1948.

৩৯

পূর্বোক্ত।

80

৪১

শওকত আলী, মহম্মদ তোয়াহা।

শওকত আলী।

৪২ পূর্বোক্ত।

>

83 Patrika, 12/3/1948.

88

মহম্মদ তোয়াহা, কমরুদ্দীন আহমদ।

৪৫ পূর্বোক্ত।

৪৬

মহম্মদ তোয়াহা।

৪৭ পূর্বোক্ত।

৪৮ পূর্বোক্ত।

৪৯

Patrika, 12/3/1948.

৫০

৫১

নওবেলাল, ২৫/৩/১৯৪৮।

পূর্বোক্ত।

৫২ আবুল কাসেম।

৫৩ জিয়াউল হক, সুলতানুজ্জামান।

৫৪

৫৫

আতাউর রহমান।

এখানে যশোরের ঘটনার পূর্ণ বিবরণ হামিদা রহমান ও মজিদ খান থেকে প্রাপ্ত।

৫৬ Patrika, 13/3/1948.

৫৭ পূর্বোক্ত।

৫৮ পূর্বোক্ত।

৫৯ কমরুদ্দীন আহমদ, তাজউদ্দীন আহমদ।

৬০ Patrika, 13/3/1948. [৮১ পৃষ্ঠায় তারিখ ভুল আছে। সংবাদটি ১৩/৩/১৯৪৮ তারিখ

সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়

৬১ পূর্বোক্ত। 14/3/1948.

৬২ পূর্বোক্ত।

৬৩ নওবেলাল, ১৯/৩/১৯৪৮।

৬৪ তাজউদ্দীন আহমদ-এর ডায়েরী, ১৪/৩/১৯৪৮; Patrika, 16 / 3/1948.

৬৫ আব্দুল জব্বার খদ্দর, তফজ্জল আলী।

৬৬

মহম্মদ তোয়াহা, তাজউদ্দীন আহমদ।

৬৭ পূর্বোক্ত।

৬৮ তাজউদ্দীন আহমদ-এর ডায়েরী, ১৪/৩/১৯৪৮।

৬৯ তাজউদ্দীন আহমদ, মহম্মদ তোয়াহা।

৭০ পূর্বোক্ত।

৭১

ডক্টর করিম, তাজউদ্দীন আহমদ।

৭২ তাজউদ্দীন আহমদ-এর ডায়েরী, ১৫/৩/১৯৪৮।

৩০৪ | বদরুদ্দীন উমর রচনাবলী খণ্ড ২

৭৩ পূর্বোক্ত।

কমরুদ্দীন আহমদ।

৭৪

৭৫ পূর্বোক্ত

£ & 2 2 2

৭৬

٩٩

মহম্মদ তোয়াহা এর পূর্বে হাসপাতাল থেকে বাইরে আসেন মহম্মদ তোহায়া।

আবদুর রহমান চৌধুরীর উপস্থিতির কথা আবদুর রহমান চৌধুরী ও আবুল কাসেম ব্যতীত অন্য কেউ স্মরণ করতে পারেন না।

৭৮ কমরুদ্দীন আহমদ, আবুল কাসেম।

৭৯ পূর্বোক্ত।

৮০ পূর্বোক্ত।

৮১ পূর্বোক্ত।

৮২ পূর্বোক্ত।

৮৩

East Bengal Assembly Proceeding, Vol No. 1. Amrita Bazar Patrika,

16/3/1948.

৮৪ অলি

অলি আহাদ, শেখ মুজিবুর রহমান, মহম্মদ তোয়াহা, শওকত আলী, কমরুদ্দীন আহমদ।[৮৫ আবুল কাসেম, মহম্মদ তোয়াহা।

৮৬ মহম্মদ তোয়াহা, আবুল কাসেম।

৮৭ তাজউদ্দীন আহমদ-এর ডায়েরী, ১৫/৩/১৯৪৮।

৮৮ পূর্বোক্ত।

৮৯

E. B. Assembly Proceeding, 15/3/1948 Vol. No.1.

৯০ পূর্বোক্ত।

৯১ পূর্বোক্ত।

৯২ পূর্বোক্ত।

৯৩ পূর্বোক্ত।

৯৪ পূর্বোক্ত।

৯৫ পূর্বোক্ত।

১৬

Friends Not Masters, by Ayub Khan P 28-29. ৯৭ পূর্বোক্ত, P 29.

৯৮

E. B. Assembly Proceeding, 15 / 3 / 1948 Vol. No. 1.

৯৯ পূর্বোক্ত।

১০০ পূর্বোক্ত।[১০১ পূর্বোক্ত।

১০২ আবুল কাসেম, তাজউদ্দীন আহমদ, শওকত আলী।[১০৩ Friends Not Masters, by Ayub Khan P 29.

১০৪ পূর্বোক্ত, P 29; মহম্মদ তোয়াহা, কমরুদ্দীন আহমদ।[১০৫ পূর্বোক্ত, P 30.

১০৬ পূর্বোক্ত।

১০৭ মহম্মদ তোয়াহা, শওকত আলী।

পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি (প্রথম খণ্ড) | ৩০৫

১০৮ মহম্মদ তোয়াহা, রণেশ দাশগুপ্ত।

১০৯ পূর্বোক্ত।

১১০ শেখ মুজিবুর রহমান, তোয়াহা, শওকত আলী, অলি আহাদ।[১১১ শওকত আলী।

১১২ মোহন মিঞা, আবদুল জব্বার খদ্দর, খয়রাত হোসেন।

১১৩ তাজউদ্দীন আহমদ, তোয়াহা।

১১৪ তাজউদ্দীন আহমদ-এর ডায়েরী, ১৬/৩/১৯৪৮।

১১৫ কমরুদ্দীন আহমদ, তফজ্জল আলী।

১১৬ মহম্মদ তোয়াহা।

১১৭ তোয়াহা, সৈয়দ নজরুল ইসলাম।

১১৮ Amrita Bazar Patrika, 17/3/1948.

১১৯ তাজউদ্দীন আহমদ-এর ডায়েরী, ১৬/৩/১৯৪৮।

১২০ মহম্মদ তোয়াহা, তাজউদ্দীন আহমদ।

১২১ মহম্মদ তোয়াহা, তাজউদ্দীন, সৈয়দ নজরুল ইসলাম।

১২২ তোয়াহা, তাজউদ্দীন, শামসুদ্দীন আহমদ।

১২৩ তাজউদ্দীন আহমদ।

১২৪ শওকত আলী।

১২৫ পূর্বোক্ত।

১২৬ শামসুদ্দীন আহমদ, শওকত আলী, মহম্মদ তোয়াহা, তাজউদ্দীন আহমদ-এর ডায়েরী,

১৬/৩/১৯৪৮।

১২৭ শওকত আলী।

১২৮ Amrita Bazar Patrika, 17/3/1948.

১২৯ তাজউদ্দীন আহমদ-এর ডায়েরী, ১৬/৩/১৯৪৮।

১৩০ পূর্বোক্ত।

১৩১ পূর্বোক্ত।

১৩২ পূর্বোক্ত।

133 East Bengal Assembly Proceeding, 17/3/1948, Vol. No. 2.

১৩৪ পূর্বোক্ত, 17/3/1948.

১৩৫ পূর্বোক্ত, 24/3/1948.

১৩৬ পূর্বোক্ত।

১৩৭ পূর্বোক্ত।

১৩৮ তাজউদ্দীন আহমদ-এর ডায়েরী, ১৭/৩/১৯৪৮।

১৩৯ পূর্বোক্ত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *