৬. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আন্দোলনের অগ্রগতি

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ – ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আন্দোলনের অগ্রগতি

১. পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগ

পূর্বতন বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম ছাত্র লীগ নেতৃত্বের বাংলা ভাষার বিরোধিতা এবং চরম সুবিধাবাদী ও প্রতিক্রিয়াশীল ভূমিকার জন্যে সাধারণ ছাত্রদের মধ্যে তাদের বিরুদ্ধে একটা তীব্র অসন্তোষ দেখা দেয়। সেই অবস্থায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু সংখ্যক নেতৃস্থানীয় ছাত্র একটি নোতুন ছাত্র প্রতিষ্ঠান গঠনে ১৯৪৮ এর প্রথম দিকেই উদ্যোগী হন।

নিজেদের মধ্যে কিছু প্রাথমিক ঘরোয়া আলোচনার পর সমগ্র প্রদেশের ছাত্রদের প্রতি একটি নোতুন ছাত্র প্রতিষ্ঠান গঠনের আহ্বান জানিয়ে ১৯৪৮ এর মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে তাঁরা ‘পূর্ব পাকিস্তানের মুসলিম ছাত্র-ছাত্রীদের প্রতি আবেদন’ নামে একটি সার্কুলার প্রচার করেন। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগ প্রতিষ্ঠার ইতিহাসে সার্কুলারটি একটি উল্লেখযোগ্য দলিল। প্রথমেই সাধারণ ছাত্রদের সহযোগিতা কামনা করে তাতে বলা হয়:

ছাত্র সমাজের অভূতপূর্ব ত্যাগ ও কর্মপ্রেরণা দ্বারাই আমরা পাকিস্তান অর্জন করিয়াছি। এই শিশু রাষ্ট্রকে গড়িয়া তুলিবার ব্যাপারেও আমাদেরই প্রধান ও সক্রিয় অংশগ্রহণ করিতে হইবে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হইবার পর হইতে পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র ও জনগণ যে সমস্ত সমস্যার সম্মুখীন হইয়াছেন তার আশু সমাধানের জন্য সুষ্ঠু ছাত্র আন্দোলন একান্ত প্রয়োজনীয়। দুর্ভাগ্যবশতঃ এ ব্যাপারে পূর্বতন ছাত্র প্রতিষ্ঠান ‘মুসলিম ছাত্র লীগ’ আমাদের নিরাশ করিয়াছে। বর্তমানে নির্জীব ও অকর্মণ্য এই প্রতিষ্ঠানের নিকট হইতে আমরা যাহা চাহিয়াছি, তাহার কিছুই পাই নাই। তাই পাকিস্তান রাষ্ট্রকে সুদৃঢ় ভিত্তির উপর গড়িয়া তুলিবার জন্য ঐক্যবদ্ধ ছাত্র আন্দোলন একান্ত প্রয়োজনীয় এবং এই ছাত্র আন্দোলন পরিচালনা করিবার জন্য ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগ’ নামে একটি নূতন ছাত্র প্রতিষ্ঠান গঠনে সহায়তা করিবার জন্য আমরা আপনাদের সহযোগিতা কামনা করি।

নোতুন ছাত্র প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয়তা এবং যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে সার্কুলারটিতে কয়েকটি কারণ উল্লেখ করে বলা হয়:

প্রশ্ন উঠিতে পারে পূর্বতন ‘মুসলিম ছাত্র লীগের’ পরিবর্তে নূতন ছাত্র প্রতিষ্ঠান কেন? আমাদের মনে হয় নিম্নোক্ত কারণগুলি এই প্রস্তাবিত নূতন ছাত্র প্রতিষ্ঠান গঠনের পক্ষে যথেষ্ট), ছাত্র লীগের বাৎসরিক সাধারণ নির্বাচনের জন্য কেন্দ্রীয় কাউন্সিলের সর্বশেষ অধিবেশন হইয়াছিল ১৯৪৪ সালে কুষ্টিয়াতে। তার পর গত চার বৎসরে ছাত্র লীগের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী কাউন্সিলের অন্তত ৮টি অধিবেশন হওয়া বাধ্যতামূলক থাকা সত্ত্বেও একটি অধিবেশনও ডাকা হয় নাই। ২. বারবার রিকুইজিশন নোটিশ দেওয়া সত্ত্বেও সেক্রেটারী কাউন্সিলের অধিবেশন আহ্বান করিতে ও নোতুন নির্বাচনের ব্যবস্থা করিতে অস্বীকার করিয়াছেন (কিন্তু দলবাজী করিবার জন্য ঢাকায় যুব-সম্মেলন করিয়াছেন)। ৩. চারি বৎসর পূর্বে গঠিত ছাত্র লীগের কর্ম পরিষদের সদস্যদের প্রায় সকলেরই ছাত্র জীবনের অবসান হওয়া সত্ত্বেও নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধির মানসে তাঁহারা গদি আঁকড়াইয়া বসিয়া রহিয়াছেন। ৪. ভূতপূর্ব ছাত্র লীগের কর্মকর্তারা দলীয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করিয়া মন্ত্রীগণের হাতে ক্রীড়া পুত্তলির অভিনয় করিতেছেন। ৫. মুসলিম লীগ বিভক্ত হওয়ার দৃষ্টান্ত থাকা সত্ত্বেও ছাত্র লীগ বিভক্ত হয় নাই (বাংলাদেশ পশ্চিমবঙ্গ ও পূর্ব পাকিস্তানে বিভক্ত হওয়ার পর ‘নিখিলবঙ্গ মুসলিম ছাত্র লীগ’ আর থাকিতে পরে না)। ৬. বর্তমানে উদ্ভূত জরুরী সমস্যাগুলির সমাধান করিতে এবং ছাত্র আন্দোলন পরিচালনা করিবার ব্যাপারে ছাত্র লীগের কর্মকর্তারা লজ্জাহীন নিষ্ক্রিয়তা প্রদর্শন করিয়াছেন। ৭. তথাকথিত ছাত্র নেতাদের ছাত্রনীতি বিরোধী কার্যকলাপ ও প্রতিষ্ঠানের নাম ভাঙ্গাইয়া চাকুরী সংগ্রহের প্রচেষ্টা ছাত্র সমাজে গভীর হতাশা ও বিক্ষোভের সঞ্চার করিয়াছে। ৮. জনকয়েক ছাত্র নেতার বাংলা ভাষা বিরোধী কার্যকলাপ এবং ঢাকায় বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করিবার আন্দোলনের বিরুদ্ধে তাঁদের সক্রিয় কর্মপন্থা এবং গুণ্ডামী ছাত্র ও জনসাধারণের মাঝে ছাত্র লীগের প্রতি ঘৃণার সঞ্চার করিয়াছে। ৯. এই কর্মকর্তারা নিজেরাও কিছু করিতেছেন না! পক্ষান্তরে কেহ কিছু করিবার জন্য আগাইয়া আসিলে নেতৃত্ব খোওয়া যাইবার ভয়ে তাঁহাদের বাধা দিতেছেন। এ বিষয়ে উত্তরবঙ্গ ছাত্র সম্মেলন (রাজশাহী) এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া যুব সম্মেলন (কলিকাতা) সম্পর্কে মিঃ আজিজুর রহমানের বিবৃতি প্রণিধানযোগ্য। ১০. তদুপরি ছাত্র লীগের গঠনতন্ত্র অনুযায়ীই ছাত্র লীগ বাতিল হইয়া গিয়াছে।

পূর্ব-বাঙলার ছাত্র সমাজ তৎকালে যে সমস্ত সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিলো সেগুলির উল্লেখ করে সার্কুলারের সাক্ষরদাতারা বলেন:

ইন্টারমিডিয়েট কম্পার্টমেন্টাল পরীক্ষা উত্তীর্ণ ছাত্রদিগকে ভর্তি করিবার ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চরম উদাসীনতা দেখাইয়াছে, পূর্ব পাকিস্তানে নবাগত ছাত্রদিগের পড়াশুনা এবং বাসস্থানের বন্দোবস্ত করিয়া দিতে সরকার পূর্ণ গাফিলতি প্রকাশ করিতেছে; বেপরোয়াভাবে রিকুইজিশন দিয়া সরকার সুপ্রতিষ্ঠিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি দখল করিয়া লইয়াছে; প্রাইমারী শিক্ষা ব্যবস্থা বানচাল হইয়া যাইবার পথে; বাংলা ভাষাকে শিক্ষার বাহন, রাষ্ট্র ভাষা এবং আদালতের ভাষা বলিয়া ঘোষণা করিতে বিশ্ববিদ্যালয় ও সরকার অস্পষ্ট ও সন্দেহজনক অভিমত প্রকাশ করিয়াছে; সরকারের উদাসীনতা এবং পরিচালনার অব্যবস্থার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংসের পথে আসিয়া পৌছিয়াছে; রাষ্ট্র ভাষারূপে বাংলা যেন স্থান না পায় তজ্জন্য ভীষণ ষড়যন্ত্র চলিতেছে এবং নূতন নোট, স্ট্যাম্প, খাম, পোস্টকার্ড, মানি অর্ডার ফর্ম, মুদ্রা ও অন্যান্য জিনিস হইতে সমস্ত পাকিস্তানের জনসাধারণের অংশের ভাষা বাংলাকে বাদ দেওয়া হইয়াছে। অন্যদিকে পূর্ব পাকিস্তানের নৌ-বাহিনী পরীক্ষায় উর্দুতে টেস্ট করিবার ছলনায় পূর্ব বাংলার যুবকদের বাদ দেওয়া হইতেছে। ইংরাজীর পরিবর্তে উর্দুর জুলুম আমাদের ঘাড়ে চাপিতে বসিয়াছে। বিমান, নৌ ও স্থল বাহিনীতে পূর্ব পাকিস্তানের নাগরিকদের পুরোপুরি বাদ দেওয়া হইতেছে।

এর পর নোতুন ছাত্র প্রতিষ্ঠানটির নীতি ও কর্মসূচী ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে তাঁরা বলেন:

আমাদের অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতা এই যে ছাত্র নেতাগণ বরাবর পেশাদার নেতাদের অঙ্গুলী হেলনে পরিচালিত হইয়া স্বাধীন নিষ্কলুষ ছাত্র সমাজের উপর কলংক লেপন করিয়াছেন। কিন্তু স্বাধীনতা অর্জনের পর আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির আমূল পরিবর্তন হওয়া প্রয়োজন। মন্ত্রীসভা বা বিরোধীদলের হস্তে ক্রীড়া পুত্তলি হওয়া আমাদের নীতি নয় বরং দলীয় রাজনীতির ব্যাপারে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ ও সম্পর্কহীন থাকিয়া পূর্ব পাকিস্তানে বিভিন্নমুখী প্রতিভা সৃষ্টি এবং উদ্ভূত জাতীয় সমস্যাগুলির উপর গঠনমূলক আন্দোলন সৃষ্টি করাই আমাদের উদ্দেশ্য। সরকারের জনকল্যাণকর কর্মপদ্ধতির প্রতি আমাদের সক্রিয় সাহায্য ও সহানুভূতি থাকিবে কিন্তু সরকারের জন ও ছাত্র স্বার্থ বিরোধী কর্মপন্থাকে আমরা রুখিয়া দাঁড়াইবো। পক্ষান্তরে বাধ্যতামূলক ফ্রি প্রাইমারী শিক্ষার ব্যাপক ব্যবস্থা, বিনা খেসারতে জমিদারী ও বর্গাদার প্রথার উচ্ছেদ, নানাবিধ কারিগরি শিক্ষার সুবন্দোবস্ত, পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক শিক্ষার সুবন্দোবস্তের জন্য সামরিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গঠন, ডাক্তারী ও ধাত্রীবিদ্যা প্রসারের জন্য উন্নত ধরনের নূতন কারিকুলামের দাবী, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, মুনাফাকারীর ও চোরা কারবারীর সমূলে বিনাশ এবং ইসলামী ভাবধারায় শিক্ষা প্রসারের জন্য আমাদের এই প্রস্তাবিত নব প্রতিষ্ঠান কাজ করিয়া যাইবে।

সর্বশেষ তাঁরা প্রত্যেক জেলা ও মহকুমায় পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগের অস্থায়ী সাংগঠনিক কমিটি গঠনর জন্যে ছাত্র সাধারণের কাছে আবেদন করেন এবং পরবর্তী সময়ে প্রাদেশিক পর্যায়ে নোতুন প্রতিষ্ঠানটির নির্বাচিত জেলা প্রতিনিধিদের একটি সম্মেলন আহ্বানের কথাও উল্লেখ করেন।

সার্কুলারটির দুটি পাদটিকার মধ্যে একটিতে বলা হয় যে বিভিন্ন স্বার্থের হস্তক্ষেপের ফলে বাংলা ভাষা সম্পর্কে ছাত্রদের দাবী পাকিস্তানের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ মহলের কাছে যথোপযুক্তভাবে উপস্থিত করা সম্ভব হয় নাই। এ বিষয়ে কায়েদে আজম এবং প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলীর কাছে ভাষা বিষয়ক দাবীর বিবরণসমূহ সরাসরি পাঠিয়ে দেওয়ার জন্যে অনুরোধ করা হয়। দ্বিতীয় পাদটিকাতে স্বাক্ষরকারীরা যথাশীঘ্র নিজ নিজ জেলায় সাংগঠনিক কাজের উদ্দেশ্যে কর্মীদের সাথে সংযোগ স্থাপন করবেন বলে সাধারণভাবে সকলকে জানানো হয়।

সার্কুলারটিতে ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ অস্থায়ী অর্গনাইজিং কমিটির’ নিম্নোক্ত সদস্যবৃন্দ স্বাক্ষর দান করেন:

নাইমউদ্দিন আহমদ বিএ অনার্স কনভেনর (রাজশাহী), আবদুল রহমান চৌধুরী বিএ (বরিশাল, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া যুব সম্মেলনে পাকিস্তান প্রতিনিধি দলের নেতা), আবদুল কুদ্দুস চৌধুরী বিএ অনার্স (চট্টগ্রাম), শেখ মুজিবুর রহমান বিএ (ফরিদপুর), আজিজ আহমদ বিএ (নোয়াখালী), আবদুল আজিজ এমএ (কুষ্টিয়া), সৈয়দ নূরুল আলম বিএ (মোমেনশাহী), আবদুল মতিন বিএ (পাবনা), দবিরুল ইসলাম বিএ (দিনাজপুর), মফিজুর রহমান (রংপুর), অলি আহাদ (ত্রিপুরা), নওয়াব আলী (ঢাকা), আবদুল আজিজ (খুলনা), নূরুল কবীর (ঢাকা সিটি)।

সাংগঠনিক কমিটির এই সার্কুলার প্রচারিত হওয়ার পর তার সদস্যেরা অন্যান্য কিছুসংখ্যক কর্মীদের সাথে একটি বৈঠকে মিলিত হন।* সে সময় নোতুন ছাত্র প্রতিষ্ঠানটিকে একটি অসাম্প্রদায়িক ছাত্র প্রতিষ্ঠান হিসাবে গঠন করার প্রশ্ন ওঠে।[১] শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর সঙ্গীরা মহম্মদ তোয়াহা এবং অলি আহাদের অসাম্প্রদায়িক ছাত্র প্রতিষ্ঠান গঠনের এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন।[২] অলি আহাদ উপরোদ্ধৃত সার্কুলারে সই দেওয়া সত্ত্বেও এই পর্যায়ে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির সাথে আর কোন সম্পর্ক না রাখার সিদ্ধান্ত নেন। শেখ মুজিবুর রহমান বলেন যে ‘মুসলিম’ শব্দটির একটা বিরাট মূল্য আছে কাজেই তখনো পর্যন্ত অসাম্প্রদায়িক ছাত্র প্রতিষ্ঠান গঠনের উপযুক্ত সময় আসেনি।[৩] এই মতবিরোধের ফলে তোয়াহা এবং অলি আহাদ নোতুন ছাত্র প্রতিষ্ঠানটির সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করা স্থির করেন। পাবনার আবদুল মতিন সে সময়ে তাঁদের দুজনকে ছাত্র প্রতিষ্ঠানটিতে অন্তত কিছুদিনের জন্যে থেকে তাকে একটা অসাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার চেষ্টা চালাতে অনুরোধ জানান। কিন্তু এই ধরনের কৌশলকে তোয়াহা এবং অলি আহাদ মনে করেন অচল এবং পরিত্যাজ্য। শুধু তাই নয় মতিনের এইসব কথাবার্তা তাঁরা দুজনে খুব অপছন্দ করেন এবং তাঁকে বলেন যে তিনি তখনো পর্যন্ত পেটি বুর্জোয়া সংস্কার থেকে মুক্ত হননি।[৫] এই বৈঠকের পর তোয়াহা এবং অলি আহাদ পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগের সাথে আর কোন সম্পর্ক না রাখলেও আবদুল মতিন এই নোতুন সংগঠনটির মধ্যে থেকেই কাজ করে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।[৬]

[* অলি আহাদ সাহেবের মতে বৈঠকটি হয় সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের ১২ নং কামরায়। কিন্তু পাবনার আবদুল মতিন সাহেবের মতানুসারে সেটি অনুষ্ঠিত হয় ফজলুল হক হলের মিলনায়তনে।]

এর পর নঈমুদ্দীন আহমদকে আহ্বায়ক নিযুক্ত করে উপরোক্ত যে কমিটি গঠিত হয় সেই কমিটি নোতুন ছাত্র প্রতিষ্ঠানটিকে গঠন করতে উদ্যোগী হয়। ১৯৪৯ সালের এপ্রিলে নইমুদ্দীন আহমদের বহিষ্কারের পর মুসলিম ছাত্র লীগের কেন্দ্রীয় অর্গানাইজিং কমিটি পুনর্গঠিত হলেও প্রতিষ্ঠানটির প্রথম প্রাদেশিক নির্বাচন ১৯৪৯ এর সেপ্টেম্বরের পূর্বে অনুষ্ঠান সম্ভব হয়নি। কিন্তু তাহলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং প্রদেশের বিভিন্ন জায়গায় কেন্দ্ৰীয় এবং এলাকাগত কমিটিগুলির নেতৃত্বে এই ছাত্র প্রতিষ্ঠানটির সদস্যেরা বিভিন্ন রাজনৈতিক আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে।[৭]

২. অসাম্প্রদায়িক ছাত্র রাজনীতি

পূর্ব-বাঙলার একমাত্র অসাম্প্রদায়িক ছাত্র প্রতিষ্ঠান ছিলো ছাত্র ফেডারেশন’। কিন্তু এই প্রতিষ্ঠানটির সাথে কমিউনিস্ট পার্টির ঘনিষ্ঠ সংযোগের ফলে মুসলমান ছাত্রেরা সাধারণভাবে তার সাথে জড়িত হওয়ার বিরোধী ছিলো। কাজেই প্রগতিশীল ছাত্র প্রতিষ্ঠান হিসাবে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পূর্বে সাধারণ ছাত্রদের মধ্যে তার যে প্রভাব ছিলো তা দারুণভাবে কমে আসে।

কিন্তু ছাত্র ফেডারেশনে যোগ দান করতে অনিচ্ছুক হলেও অল্পসংখ্যক ছাত্র অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির পক্ষপাতী ছিলেন এবং তাঁরা সেই ধরনের একটি অকমিউনিস্ট অসাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠান গঠনের চিন্তা করছিলেন। এই সময় ‘পাকিস্তান স্টুডেন্টস্ র‍্যালী’ বা ‘পাকিস্তান ছাত্র সংঘ’ নামে একটি অসাম্প্রদায়িক ছাত্র সংগঠন গঠনের চেষ্টা হয়। মহম্মদ গোলাম কিবরিয়াকে আহ্বায়ক নিযুক্ত করে এর জন্যে একটি কমিটি গঠিত হয় এবং সেই কমিটি প্রতিষ্ঠানটির উদ্দেশ্য, কর্মসূচী এবং গঠনতন্ত্রের একটি খসড়া[৮] ১৯৪৯-এর জানুয়ারীর দিকেই প্রকাশ করেন।

এই খসড়াটিতে অন্যান্য ছাত্র প্রতিষ্ঠানগুলি সম্পর্কে বলা হয় যে সেগুলির প্রত্যেকটিই কোন না কোন রাজনৈতিক দলের সাথে যুক্ত। তাছাড়া তারা প্রত্যেকেই কমিউনিজম, সমাজতন্ত্র, সাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদ ইত্যাদি আদর্শের প্রচারক। সেই হিসাবে বিভিন্ন ছাত্র প্রতিষ্ঠানগুলি ছাত্রদের মধ্যে নানাপ্রকার অস্বচ্ছ চিন্তার সৃষ্টি করছে।[৯]

একটি নোতুন ও স্বাধীন অসাম্প্রদায়িক ছাত্র প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তাতে আরও বলা হয়:

আমাদের জাতীয় ইতিহাসের এই গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে রাজনৈতিক দলগুলির সাথে অসম্পর্কিত একটি স্বাধীন অসাম্প্রদায়িক ছাত্র প্রতিষ্ঠানের অনুজ্ঞামূলক প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দিয়ে শেষ করা যায় না। বস্তুতঃপক্ষে ছাত্র আন্দোলনকে সঠিক নেতৃত্বদানের জন্য বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে একটি অসাম্প্রদায়িক ছাত্র প্রতিষ্ঠান গঠনের স্বপক্ষে অনেকেই জোরালোভাবে মত প্রকাশ করেছে। পাকিস্তান এখনো একটা গঠনমূলক পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে এবং একমাত্র পাকিস্তানী জাতীয়তাবাদই বিভিন্ন লোকজন, সম্প্রদায় এবং শ্রেণীকে একটি সংগঠনের মধ্যে একত্রিত করতে পারে। আচ্ছন্নতা ও নিষ্ক্রিয়তা কাটিয়ে উঠতে ছাত্রদেরকে তা দারুণভাবে উদ্বুদ্ধ করবে। কিন্তু সাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদ নয়, পাকিস্তানী জাতীয়তাবাদই পশ্চিমী জাতীয়তার উগ্র চরিত্র থেকে মুক্ত থাকতে পারে। জনসাধারণের আর্থিক ও সামাজিক মুক্তির জন্য তার একটা সমাজতান্ত্রিক বক্তব্য থাকবে।

‘পাকিস্তান স্টুডেন্টস্ র‍্যালীর উপরোক্ত এবং অন্যান্য বক্তব্যের মধ্যে বহু জটিলতা এবং অস্বচ্ছতা থাকলেও অসাম্প্রদায়িক ছাত্র প্রতিষ্ঠান গঠনের প্রাথমিক উদ্যোগ হিসাবে তা উল্লেখযোগ্য। এই খসড়াটিতে উর্দু এবং বাংলা এই উভয় ভাষাকেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার কথা বলা হয়। প্রাদেশিক ভাষা হিসাবে বাংলাকে অবিলম্বে চালু করার দাবীও তাতে জানানো হয়।[১০]

এই প্রতিষ্ঠানটির আহ্বায়ক মহম্মদ গোলাম কিবরিয়া অলি আহাদকে তাতে যোগদানের জন্যে অনুরোধ জানান। অলি আহাদ প্রথম দিকে কিছুটা উৎসাহ প্রকাশ করলেও কমরুদ্দীন আহমদ, তাজউদ্দীন, তোয়াহা এবং ডক্টর করিমের পরামর্শ মতো তিনি ‘স্টুডেন্টস্ র‍্যালীর’ সাথে জড়িত না হওয়ার সিদ্ধান্ত করেন।[১১]

ব্যক্তিগতভাবে অনেক ছাত্র অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে অংশ গ্রহণ করলেও একমাত্র ছাত্র ফেডারেশন ছাড়া এই পর্যায়ে অন্য কোন অসাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠান ছিলো না। অনেক দুর্বলতা সত্ত্বেও নানা গণতান্ত্রিক দাবীর ভিত্তিতে ছাত্র ফেডারেশন এই সময়ে অন্যান্য ছাত্র প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় সভা অনুষ্ঠানের চেষ্টা করলেও সুবিধাবাদী ছাত্র নেতৃত্ব এবং ছাত্রদের সাম্প্রদায়িক সংস্কারের জন্যে তার সাফল্য ছিলো খুবই সীমিত।

রাজশাহীতে ছাত্র ফেডারেশনের আবুল কাসেম এবং অন্য কয়েকজন ছাত্রের বহিষ্কার এবং ঢাকা ও প্রদেশের অন্যত্র বহু ছাত্রের উপর নির্যাতনমূলক ব্যবস্থার প্রতিকারের উদ্দেশ্যে ৮ই জানুয়ারী, ১৯৪৯ ‘জুলুম প্রতিরোধ দিবস’ উদযাপনের আহ্বান জানানো হয়।[১২] ঢাকা কলেজে আংশিক ধর্মঘট হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সেদিন পূর্ণ ধর্মঘট হয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় ময়দানে বেলা ২টার সময় মুসলিম ছাত্র লীগের আহ্বায়ক নঈমুদ্দীন আহমদের সভাপতিত্বে একটি সাধারণ ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় শেখ মুজিবুর রহমান, দবিরুল ইসলাম বক্তৃতা দেন। ছাত্রদের দাবীসমূহ বিবেচনা করে সেগুলিকে স্বীকার করে নেওয়ার জন্যে সরকারকে এক মাসের সময় দেওয়া হয়।[১৩]

কিন্তু প্রথম দিনের এই ধর্মঘট সত্ত্বেও পরবর্তী পর্যায়ে এই আন্দোলন বিশ্ববিদ্যালয়ের সুবিধাবাদী ছাত্র নেতৃত্বের ‘আপোষ’ মনোবৃত্তির ফলে আর অগ্রসর হতে পারেনি।[১৪]

১৪ই ফেব্রুয়ারী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ফেডারেশন ময়মনসিংহের হাজং চাষীদের উপর গুলিবর্ষণ ও চাষী হত্যার প্রতিবাদে একটি ছাত্রসভা আহ্বান করে। একদল ছাত্র সেই সভাটিকে ভেঙে দেওয়ার উদ্দেশ্যে পূর্বপ্রস্তুতি অনুসারে সেখানে উপস্থিত হয়। মহম্মদ বাহাউদ্দিনের সভাপতিত্বে সভা আরম্ভ হওয়ার পরই তাদের মধ্যে একজন ‘সভা কে আহ্বান করেছে’ এই কথা জানতে চেয়ে সভাপতির হাত ধরে টান দিয়ে তাঁকে নীচে নামিয়ে আনে এবং অন্য একজন সভাপতির চেয়ারটিকে বেলতলার পাশের পুকুরে ছুড়ে ফেলে দেয়। এর পর সেই ছাত্র গুণ্ডাদল নির্বিচারে উপস্থিত ছাত্রদের উপর কিল, চড়, ঘুষি মেরে সভাটিকে সম্পূর্ণভাবে পণ্ড করে।[১৫]

ছাত্র ফেডারেশন খুব সক্রিয় না হলেও সেই জাতীয় একটি প্রগতিশীল অসাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব স্বীকার এবং সহ্য করতে প্রতিক্রিয়াশীলরা প্রস্তুত ছিলো না। এজন্যেই তাদের উপর সে সময় প্রায়ই নানা প্রকার হামলা হতে দেখা যেতো। ১৪ই মার্চ তারিখে একদল গুণ্ডা সিলেটে ছাত্র ফেডারেশনের অফিসের উপর হামলা করে এবং সেই জাতীয় হামলা বন্ধ করার ব্যবস্থার জন্যে ছাত্র ফেডারেশনের সম্পাদক সংবাদপত্রে এক বিবৃতি দেন।[১৬]

৩. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিম্ন কর্মচারী ধর্মঘট

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিম্নতম বেতনের কর্মচারীরা কতকগুলি দাবী-দাওয়ার ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সাথে অনেকদিন আলাপ-আলোচনার পর তাঁদের দুরবস্থার প্রতিকারের অন্য কোন উপায় না দেখে এক মাসের নোটিশে ৩রা মার্চ থেকে ধর্মঘট শুরু করেন।[১৭

ধর্মঘটের প্রস্তুতির বিভিন্ন স্তরে বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকটি ছাত্র প্রতিষ্ঠানের, বিশেষতঃ ছাত্র ফেডারেশন এবং পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগের কর্মীদের সাথে কর্মচারীরা ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রক্ষা করেন এবং তাদের সমর্থন, উৎসাহ এবং সহযোগিতা ধর্মঘটের ক্ষেত্রে তাঁদেরকে অনেকাংশে পরিচালিত করে।

নিম্ন কর্মচারীদের ধর্মঘটের সমর্থনে ৩রা মার্চ ছাত্রেরাও ক্লাস বর্জন করেন। এর পর ৫ই মার্চ পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগের আহ্বান এবং উদ্যোগে১৮ পূর্ণ ছাত্র ধর্মঘটের পর বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে বেলা ১২-৩০ মিনিটে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। ১৯ তাতে ছাত্রেরা স্থির করেন যে কর্মচারীদের দাবী-দাওয়া কর্তৃপক্ষ যতদিন না স্বীকার করেন ততদিন পর্যন্ত তাঁরা সহানুভূতিসূচক ধর্মঘট অব্যাহত রাখবেন। তার পর সেই সভায় বিশ্ববিদ্যালয়ের নিম্ন কর্মচারী ও ছাত্রদের ধর্মঘট পরিচালনার ভার বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র কর্ম পরিষদের উপর অর্পণ করা হয়।[২০]

বেলা ২-৩০ মিনিটের সময় এই সভা শেষ হলে ছাত্রেরা ভাইস চ্যান্সেলরের বাড়ীর সামনে মিছিল সহকারে উপস্থিত হন এবং বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে থাকেন। সে সময় ভাইস- চ্যান্সেলরের বাসায় বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারও উপস্থিত ছিলেন। তিনি ছাত্রদের জানান যে সেদিন বিকেল পাঁচটায় বিশ্ববিদ্যালয় একজিকিউটিভ কাউন্সিলের বৈঠক বসলে তিনি তাঁদেরকে ধর্মঘট ইত্যাদির বিষয় অবহিত করবেন।[২১]

একজিকিউটিভ কাউন্সিল সেইদিনকার বৈঠকে ছাত্রদেরকে নিম্ন কর্মচারী ধর্মঘটে অংশগ্রহণকারী বলে ঘোষণা করে তাদের বিরুদ্ধে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা অবলম্বনের হুমকি দেন।[২২] বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের এই হুমকি সম্পর্কে আলোচনার জন্যে ছাত্র কর্ম-পরিষদের একটি সভায় কর্তৃপক্ষের হুমকির নিন্দা এবং ছাত্রদের মনোভাব ব্যাখ্যা করে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়।[২৩] মুসলিম ছাত্র লীগের আবদুর রহমান চৌধুরী তার নকল ভাইস চ্যান্সেলারের কাছে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব নেন কিন্তু তাঁর সে দায়িত্ব পালন না করায় সেটি কর্তৃপক্ষের কাছে পৌঁছায়নি। কয়েকদিন পর কর্ম-পরিষদের এক সদস্য এ বিষয়ে তাঁকে জিজ্ঞাসা করলে আবদুর রহমান চৌধুরী বলেন যে ইতিমধ্যে অনেক দেরী হয়ে গেছে, কাজেই সেটা তখন আর কর্তৃপক্ষের কাছে দেওয়ার কোন অর্থ নেই।[২৪]

ধর্মঘটকে শক্তিশালী করার আশায় সাধারণ ছাত্রেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেরানীদের সহানুভূতি লাভের আশায় তাঁদের অফিসের দরজায় যখন পিকেটিং করছিলেন সে সময়ে আবদুর রহমান চৌধুরী নিজে পিকেটারদেরকে সেখান থেকে সরিয়ে আনেন। পরদিন ছাত্রসভায় তাঁকে এ বিষয়ে খোলাখুলিভাবে প্রশ্ন করা হলে তিনি অবশ্য ব্যাপারটি সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করেন।[২৫]

৯ই মার্চ বেলা ১২-৩০ মিনিটে আবদুর রহমান চৌধুরীর সভাপতিত্বে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে একটি সভা হয়।[২৬] তাতে স্থির করা হয় যে ছাত্রেরা মিছিল করে ভাইস চ্যান্সেলরের বাড়ীতে যাবে এবং যতক্ষণ পর্যন্ত না কর্তৃপক্ষ লিখিতভাবে ধর্মঘট নিম্নকর্মচারীদের দাবী-দাওয়া স্বীকার করবেন ততক্ষণ পর্যন্ত তাঁরা ভাইস-চ্যান্সেলরের বাড়ীতে অবস্থান ধর্মঘট চালিয়ে যাবেন।[২৭] এই সিদ্ধান্ত অনুসারে সভার পর ছাত্রেরা মিছিল সহকারে ভাইস চ্যান্সেলরের বাসভবনে উপস্থিত হন। কিন্তু সেখানে রাত্রি ৯-৪৫ মিনিট পর্যন্ত অপেক্ষা করেও একজিকিউটিভ কাউন্সিল অথবা ভাইস-চ্যান্সেলরের কাছ থেকে কোন লিখিত প্ৰতিশ্ৰুতি অথবা আশ্বাস পাওয়া গেল না।[২৮] বেলা পাঁচটার দিকে ভাইস-চ্যান্সেলর, কোষাধ্যক্ষ, ডক্টর পিসি চক্রবর্তী, রেজিস্ট্রার প্রভৃতি ছাত্রদের সাথে দেখা করে এই মর্মে তাদেরকে একটা মৌখিক আশ্বাস দেন যে অদূর ভবিষ্যতে একজিকিউটিভ কাউন্সিলের সভায় তাঁরা ব্যাপারটি আলোচনার জন্যে প্রস্তাব করবেন।[২৯] মুসলিম ছাত্র লীগের নেতৃবৃন্দ কর্তৃপক্ষের এই মৌখিক আশ্বাসে মোটামুটিভাবে সন্তুষ্ট হয়ে সেদিন দুপুরের ছাত্রসভার সিদ্ধান্তের বরখেলাফ করে ছাত্রদেরকে ভাইস-চ্যান্সেলরের বাসভবন পরিত্যাগ করতে পরামর্শ দিলেন।[৩০]

পরদিন অর্থাৎ ১০ই মার্চ বেলা বারোটায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ছাত্র এবং নিম্নকর্মচারীদের একটি যৌথ সভা হয়।[৩১] সেই সভায় ছাত্র লীগের নেতৃবৃন্দ কর্তৃপক্ষের কথা বিশ্লেষণ করে সকলকে বুঝিয়ে দিতে চেষ্টা করেন যে ছাত্র এবং ধর্মঘটীরা প্রকৃতপক্ষে জয়লাভ করেছেন, কাজেই এর পর তাঁদের ধর্মঘট প্রত্যাহার করা উচিত।[৩২] কর্মপরিষদের বিশিষ্ট সদস্য দবিরুল ইসলাম ধর্মঘটী কর্মচারীদের কাছে এ ব্যাপারে বিশেষভাবে আবেদন জানালেন এবং ওজস্বিনী ভাষায় তাদেরকে প্রতিশ্রুতি দিলেন যে কর্তৃপক্ষ তাঁদের অঙ্গীকার রক্ষা না করলে ছাত্রেরা তাদের বুকের রক্ত দিয়ে ধর্মঘটীদের দাবী-দাওয়া আদায় করে দেবেন। ছাত্র নেতাদের এই বক্তৃতা ও প্রতিশ্রুতির পর নিম্নকর্মচারীরা তাদের ধর্মঘট প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত নেন এবং বেলা ১টার সময় নিজ নিজ কাজে যোগ দান করতে যান।[৩৩] কিন্তু ধর্মঘটীদের ধর্মঘট প্রত্যাহার ও কাজে যোগদানের সিদ্ধান্ত সত্ত্বেও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাদেরকে কাজে যোগ দিতে বাধা দেন। সেদিন সন্ধ্যায় রেডিওতে এবং পরদিন সংবাদপত্রের মাধ্যমে একটি বিবৃতি প্রচার করে ভাইস-চ্যান্সেলর বলেন যে ১০ই মার্চ বেলা ১১টার মধ্যে কর্মচারীদের কাজে যোগদানের কথা ছিলো। তারা ঐ সময়ে কাজে যোগদান না করায় তিনি তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা অবলম্বনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। পরদিন থেকে একজিকিউটিভ কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত মতো বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস অনির্দিষ্টকালের জন্যে বন্ধ রাখার কথাও তিনি ঘোষণা করেন।[৩৪] প্রকৃতপক্ষে পূর্ব দিন ভাইস-চ্যান্সেলরের সাথে ছাত্রদের আলাপের সময় বেলা ১১টার মধ্যে কর্মচারীদের কাজে যোগদানের কোন কথাই হয়নি।[৩৫]

কর্তৃপক্ষ ছাত্রদের সাথে তাঁদের মৌখিক চুক্তি ভঙ্গ করার পর ছাত্র কর্মপরিষদ সেদিনই একটি বৈঠকে মিলিত হন এবং নোতুন পরিস্থিতিতে পূর্ব নির্ধারিত পথেই সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া স্থির করেন। রাত্রি ৯টায় সেদিন ফজলুল হক হলের ছাত্রদের একটি সভা হয় এবং তাতে দবিরুল ইসলাম ও তাজউদ্দীন আহমদ পরিস্থিতির উপর বক্তৃতা দেন। রাত্রি ১১.৩০ মিনিট পর্যন্ত সভাটি স্থায়ী হয় এবং তাজউদ্দীন আহমদ ও রুহুল আমীনকে কর্ম-পরিষদের প্রতিনিধি হিসাবে নির্বাচিত করা হয়।[৩৬]

ফজলুল হক হলের এই সভা ভঙ্গ হওয়ার পর সলিমুল্লাহ মুসিলম হলে রাত্রি ১টায় কর্মপরিষদের একটি বৈঠক বসে। প্রায় এক ঘণ্টাকাল স্থায়ী এই বৈঠকে সামগ্রিকভাবে নোতুন পরিস্থিতির পর্যালোচনা করা হয়।[৩৭]

প্রথম থেকে শেষ পর্যায় পর্যন্ত ঘটনাবলীর বর্ণনা দিয়ে ১১ই মার্চ কর্ম-পরিষদের পক্ষ থেকে তাঁরা একটি বিবৃতি তৈরী করেন এবং সেটি সংবাদপত্রে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।[৩৮] সেদিন বিকেল ৪টায় ঢাকা হলের মিলনায়তনে একটি সভা বসে এবং ঢাকা ও ফজলুল হক হলের ছাত্রেরা মিলিতভাবে মিছিল করে বিকেল ৫.৩০ মিনিটে ভাইস-চ্যান্সেলরের বাসভবনে উপস্থিত হয়ে তাঁর কাছে বিভিন্ন দাবী উত্থাপন করেন। কিন্তু ভাইস- চ্যান্সেলর তাঁদের কোন আশ্বাস দিতে অস্বীকার করায় তাঁরা সন্ধ্যা ৭.৩০ মিঃ তাঁর বাসভবন এলাকা ছেড়ে হলে ফিরে আসেন।[৩৯] সেদিন রাত্রেই ১০টা থেকে ৩.৩০ পর্যন্ত সলিমুল্লাহ হলে কর্ম-পরিষদের একটি দীর্ঘ বৈঠক বসে।[৪০] ইতিমধ্যেই কর্তৃপক্ষ হল বন্ধ করার সিদ্ধান্তও ঘোষণা করেন।[৪১]

১২ই মার্চ সকাল ৯টায় সমস্ত হলের ছাত্রদের এক মিলিত মিছিল বের হয়। সলিমুল্লাহ হলের ছাত্রেরা তাতে ৯.৩০ মিনিটে যোগ দেয় এবং মিছিলটি তার পর ভাইস-চ্যান্সেলরের বাসভবনে উপস্থিত হলে দেখা যায় যে গৃহকর্তা তার পূর্বেই গৃহত্যাগ করে বেরিয়ে গেছেন। সেই অবস্থায় মিছিলটি নিয়ে শহর ঘোরার সিদ্ধান্ত হয় এবং লালবাগ, চকবাজার, ইসলামপুর, সদরঘাট, নবাবপুর, সিদ্দিকবাজার হয়ে মিছিলটি ফজলুল হক হলের সামনে এসে বেলা ১টায় শেষ হয়।[৪২]

বিকেল ৫টায় ঢাকা হলের ছাত্রেরা হল ছাত্রদের একটি সভায় স্থির করেন যে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ডাইনিং হল বন্ধ করে দেওয়ার নির্দেশ দিলেও তাঁরা নিজেরা তা চালিয়ে যাবেন। এর পর সন্ধ্যা ৬টায় সলিমুল্লাহ হলে ছাত্র কর্ম-পরিষদের এক বৈঠক বসে।[৪৩] সেই বৈঠকে পরবর্তী কর্মপন্থা সম্পর্কে আলোচনা চলাকালে একজন বক্তা পরিষ্কারভাবে বলেন যে ছাত্রেরা তখন আর সংগ্রামের জন্যে প্রস্তুত নয়, তাদের বিশ্রাম প্রয়োজন। এর পর উপরোক্ত নেতৃ স্থানীয় কর্মীটি অন্য কাউকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে সভা ভঙ্গ করে দেন।

১২ই মার্চ ছিলো পূর্ব-বাঙলা ব্যবস্থা পরিষদের বাজেট অধিবেশনের দ্বিতীয় দিন। সেদিন সকালের ছাত্র মিছিলের পর বিকেলের দিকে কিছু সংখ্যক ছাত্র পরিষদ ভবনের সামনে, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘আরবী হরফ চাই না’ ইত্যাদি ধ্বনি উত্থাপন করে দলবদ্ধভাবে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে।[৪৪] এই বিক্ষোভকারী ছাত্রদের মধ্যে সৈয়দ আফজাল হোসেন, মৃণালকান্তি বাড়রী, বাহাউদ্দিন চৌধুরী, ইকবাল আনসারী, আবদুস সালাম এবং একেএম মুনিরুজ্জামান চৌধুরীকে গ্রেফতার করা হয়। রাষ্ট্রভাষা বাংলার স্বপক্ষে বিশেষত আরবী হরফ প্রবর্তনের বিরুদ্ধে, এই বিক্ষোভটি প্রধানত ছাত্র ফেডারেশনের নেতৃত্বে পরিচালিত হয়।[৪৫]

পরদিন ১৩ই মার্চ ঢাকা হলের একটি সভায় খুব অল্পসংখ্যক ছাত্র বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকাকালে হলে থাকার স্বপক্ষে মত দেন। সেদিনই বেলা ১টার পর সলিমুল্লাহ হলে কৰ্ম- পরিষদের আর এক বৈঠক বসে। তাতে স্থির হয় যে অধিকাংশ ছাত্র হল ছেড়ে চলে গেলে সকলকেই তাঁরা হল ত্যাগ করতে বলবেন।[৪৬] ১৪ তারিখে সকাল ৯টায় ঢাকা হল প্রাঙ্গণে তাজউদ্দীন আহমদ প্রভৃতি অল্প সংখ্যক ছাত্র একত্রিত হয়ে স্থির করেন যে সকলে হল ত্যাগ করে চলে যাওয়ার জন্যে যেভাবে তৈরী হয়েছে তাতে তাঁদের পক্ষেও আর হলে থাকা সঙ্গত নয়। এই সিদ্ধান্ত অনুসারে এর পর তাঁরা সকলেই হল ত্যাগ করেন।[৪৭] নিম্নকর্মচারী এবং ছাত্র ধর্মঘটের উপর মন্তব্য করতে গিয়ে সাপ্তাহিক নওবেলাল বলেন:

দেশ বিভাগের পর বিশেষ করিয়া পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্রগণ অপরিসীম ক্ষতিগ্রস্ত হইয়াছেন তাহা সকলেই অবগত আছেন। অনেক আন্দোলনের পরও কর্তৃপক্ষ শিক্ষা ব্যবস্থার উল্লেখযোগ্য কোন উন্নতিই করেন নাই।

বর্তমান মহার্ঘ্যের দিনে নিম্নপদস্থ কর্মচারীদের বেতন ও ভাতা বৃদ্ধির দাবী যে অত্যন্ত ন্যায়সঙ্গত তাহা সকলেই স্বীকার করিবেন। ছাত্ররা স্বভাবতঃ আশাবাদী হইয়া থাকেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিম্নপদস্থ কর্মচারীদের দুরবস্থা তাহাদের প্রাণে অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই সমবেদনা ও সহানুভূতির উদ্রেক করিয়াছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের উচিত ছিল অবিলম্বে তাহাদের ন্যায্য দাবী-দাওয়া মানিয়া লওয়া এবং এই আর্থিক অনটনগ্রস্ত দরিদ্র পীড়িত কর্মচারীগণ যাহাতে নিশ্চিন্তে জাতির খেদমতে আত্মনিয়োগ করিতে পারে তাহার ব্যবস্থা করিয়া দেওয়া। কিন্তু তাহার বদলে কর্তৃপক্ষ বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ করিয়া দেওয়াই সমীচীন মনে করিয়াছেন। একেবারে বন্ধ করিয়া দিলেই সব লেটা চুকিয়া যাইতো। নয় কি?[৪৮]

৩রা থেকে ১৪ই মার্চ পর্যন্ত নিম্নকর্মচারী ও ছাত্র ধর্মঘটের উপর একজন প্রত্যক্ষদর্শী ‘ছাত্র আন্দোলনের গলদ কোথায়?’ নামে একটি বিস্তৃত আলোচনা ২৪শে মার্চের নওবেলালে প্রকাশ করেন। সমসাময়িক ছাত্র আন্দোলনের পর্যালোচনা হিসাবে তার কয়েকটি অংশ উল্লেখযোগ্য। আন্দোলন সম্পর্কে সাধারণভাবে মন্তব্য করতে গিয়ে তাতে বলা হয়:

জনগণ ভুলপথে সজ্ঞানে চলে না, ভুল পথে তারা পরিচালিত হয়… এটা গণআন্দোলনের বেলায় যেমন সত্য ছাত্র আন্দোলনের বেলায়ও তেমনই সত্য। সুতরাং আন্দোলনের যারা পরিচালক তাদের মনোবৃত্তি, তাদের আদর্শ ও তাদের কর্মদক্ষতার উপরই আন্দোলনের ফলাফল সম্পূর্ণ নির্ভর করে। হীন স্বার্থপর মনোবৃত্তি দ্বারা যে আন্দোলন পরিচালিত হয় তাহা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হইতে বাধ্য। গত বৎসরের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনেও এরূপ মনোবৃত্তির পরিচয় পাওয়া যায়। বর্তমান বৎসরের আন্দোলনের ঘটনাপ্রবাহ বিচার করিলেও ঐ একই মনোবৃত্তির স্বরূপ প্রকাশ পায়। অবশ্য পর্দার অন্তরালে নেতৃত্বের ধোঁকাবাজীর যে অভিনয় চলে তার স্বরূপ অনেক সময়ই সর্বসাধারণের চোখে পড়ে না। সদিচ্ছায় অনুপ্রেরিত বিশেষভাবে সংশ্লিষ্ট কর্মীরাই এই অভিনয়ের বাস্তব রূপ প্রমাণ করতে পারবেন। আলোচ্য আন্দোলনের সমস্ত ঘটনাপ্রবাহের সহিত পরিচিত হবার সৌভাগ্য হয়েছে বলেই আমি এ আন্দোলনের পূর্ণ বিশ্লেষণের একান্ত প্রয়োজন বোধ করছি।

এই প্রারম্ভিব মন্তব্যের পর কয়েকজন ছাত্রনেতার ভূমিকা সম্পর্কে উপরোক্ত সমালোচক বলেন:

৫ই মার্চ ছাত্র সভায় যে ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় তাহার পেছনেও নেতাদের হীন মনোবৃত্তির আভাস ছিল। কিন্তু ছাত্র সমাজ তা বুঝতে পারেনি। সদিচ্ছায় অনুপ্রেরিত হয়েই তারা পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগের বিশিষ্ট নেতা নঈমুদ্দীন আহমদের অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘটের প্রস্তাবে সায় দেয়। তারা বুঝতে পারেনি যে ঐ সকল নেতাদের হতভাগ্য কর্মচারীদের প্রতি কোন সত্যিকার দরদ ছিল না। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগের আবদুর রহমান চৌধুরী, শেখ মুজিবুর রহমান, মৌলবী গোলাম হায়দার প্রমুখ নেতৃবৃন্দ এই সিদ্ধান্তের পূর্বে ধর্মঘটী কর্মচারীদের সঙ্গে যে অভিনয় করেন তাহা ছাত্র সাধারণের কাছে সম্পূর্ণ গোপন করে যান। হতভাগ্য কর্মচারীদের প্রতি কিছুমাত্র সহানুভূতি থাকলেও তারা ধর্মঘটের পূর্বক্ষণে মির্জা গোলাম হায়দারকে একতাবদ্ধ কর্মচারীদের মধ্যে প্রেরণ করতেন না যাতে তাদের একতা ঐ সংকট মুহূর্তে ভেঙে পড়ে। সৌভাগ্যের বিষয় মির্জা গোলাম হায়দারের এই অপচেষ্টা সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয় এবং কর্মচারীদের কাছে মির্জা গোলাম হায়দারের মুখোশ ধরা পড়ে।

এর পর ৫ই মার্চের ধর্মঘট সম্পর্কে পর্যালোচনাটিতে আরও বলা হয়:

Lower Grade Employee’s Union-এর পরিচালনাধীনে কর্মচারীদের একতার বন্ধন দৃঢ় হতে দৃঢ়তর হয়ে দাঁড়ালো এবং তারা ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন। তখন নিজেদের মান বাঁচানোর জন্য পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগের তথাকথিত নেতৃবৃন্দ ৫ই মার্চ ছাত্রসভার আয়োজন করেন। তাঁদের সহানুভূতিসূচক বক্তৃতাগুলির পেছনে লুক্কায়িত ছিল এক হিংসাবৃত্তি – তাঁরা চেষ্টা করছিলেন যে সমস্ত উৎসাহী কর্মী কর্মচারীদের একতাবদ্ধ করায় মনোনিবেশ করেছিলেন তাদের সর্বনাশ সাধন করতে। এসব ব্যাপার তাঁরা ছাত্র সাধারণকে জানতে দেননি। সাধারণ ছাত্রদের ধোঁকা দিয়ে তাঁরা একটা অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘটের ভুয়া প্রস্তাব গ্রহণ করান। ভুয়া প্রস্তাব এজন্য বলছি যে, কোন কর্মপন্থা ভিন্ন অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘট চলতে পারে না। নেতৃবৃন্দ ছাত্রদের সম্বন্ধে কোন কর্মপন্থা দেননি। এই প্রস্তাবের কুফল দুদিন পরেই বেশ ভালোভাবেই প্রকাশ পায়। কর্মপন্থার অভাবে সাধারণ ছাত্রগণের মধ্যে শিথিলতা আসে এবং তারা আন্দোলন সম্বন্ধে সম্পূর্ণ উদাসীন মনোভাব পোষণ করতে থাকেন। নেতারাও তাই-ই চেয়েছিলেন।

১০ই মার্চ সাধারণ সভায় ধর্মঘট প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কর্তৃক ধর্মঘটীদেরকে কাজে যোগদান করতে বাধা দেওয়ার কারণ হিসাবে তাতে বলা হয়:

তারপর ভাইস-চ্যান্সেলর ধর্মঘটী কর্মচারীদের ধ্বংস সাধনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় অর্নির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেওয়ার ব্যাপারে গভর্ণমেন্টেরও অনুমোদন ছিল। ব্যবস্থাপক সভার বাজেট অধিবেশনের সময় ছাত্রদের দূরে রাখাই সরকারের স্বার্থের অনুকূল। তা ছাড়া বর্ণমালা নিয়েও ছাত্র আন্দোলনের আশংকা তারা করছিলেন। তাই দেখা গেল প্রধানমন্ত্রী ও ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট একাধিকবার ভাইস- চ্যান্সেলরের বাড়িতে গুপ্ত বৈঠক করছেন।

আন্দোলনের শেষ পর্যায়ের ঘটনাবলী সম্পর্কে মন্তব্য প্রসঙ্গে উপরোক্ত প্রত্যক্ষদর্শী বলেন:

আন্দোলনের শেষ দিকে আবদুর রহমান চৌধুরী প্রমুখ নেতৃবৃন্দ এক হীন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন। ভাইস-চ্যান্সেলরের সঙ্গে কথাবার্তায় আবদুর রহমান চৌধুরীর তোষামোদি মনোবৃত্তি সাধারণ ছাত্রদের কাছে প্রকাশ হয়ে পড়ে। আবদুর রহমান চৌধুরী কেবল তোষামোদ করেই ক্ষান্ত হননি, তিনি নিজে কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করেছিলেন কর্তৃপক্ষ যেন কঠোর হস্তে কয়েকজন আন্দোলনকারী ছাত্রকে দমন করেন। এই নেতৃবৃন্দের স্বরূপ আরও ভালোভাবে প্রকাশ পেল, যখন দেখা গেল যে সাধারণ একটা অর্ডারের উপর ছাত্ররা দলে দলে হল ছেড়ে চলেছে তখন নেতৃবৃন্দ তাতে রোখবার কোন ব্যবস্থা করছেন না। বরং সকল ছাত্ররা যাহাতে চলিয়া যায় তাহার ব্যবস্থা করিতে তথাকথিত নেতারা ব্যস্ত ছিলেন। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগ নেতৃবৃন্দের বিশ্বাঘাতকতা সম্পর্কে তাজউদ্দীন আহমদের ডায়েরীতেও একটি উল্লেখ আছে। ১৪ই মে, ১৯৪৯ তারিখে তাজউদ্দীন আহমদ তাঁর ডায়েরীতে লেখেন:

(আজ) তোয়াহা সাহেব এসেছিলেন সন্ধ্যে ৮টায় এবং তারপর আমার কামরায় এসেছিলেন নঈমুদ্দীন সাহেব। নঈমুদ্দীন সাহেবের বিশ্বাসঘাতকতার পর এই তাঁর প্রথম আবির্ভাব। আমরা রাত্রি ১১টা পর্যন্ত আলাপ করলাম।

২৯শে মার্চ সংবাদপত্রে প্রকাশিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একজিকিউটিভ কাউন্সিলের কাছে ভাইস-চ্যান্সেলরের প্রদত্ত রিপোর্টে বলা হয় যে ছাত্রেরা ধর্মঘট প্রত্যাহার করেছিলো এবং ধর্মঘটীরা কাজে যোগদান করতে এসেছিলো। কিন্তু তিনি তাদেরকে অনুমতি দেননি। তাঁর এই সিদ্ধান্তের কারণে তাদের যোগদান শর্তসাপেক্ষ ছিলো।[৪৯ ভাইস-চ্যান্সেলরের এই বক্তব্য তাঁর ১১ই তারিখে প্রচারিত বিবৃত্তির বক্তব্যের বিরোধী; কারণ তাতে তিনি বলেছিলেন যে, ধর্মঘটকারীরা কাজে যোগদান করতে অসম্মত হওয়ায় তাঁকে বাধ্যতাবশত বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দিতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের এই পরস্পরবিরোধী এবং মিথ্যা অভিযোগের জবাবে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র কর্ম পরিষদ ৪ঠা এপ্রিল সংবাদপত্রে এক বিবৃতি প্রকাশ করেন। তাতে বলা হয়:

প্রদেশের বিভিন্ন জায়গা হইতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান পরিস্থিতি জানিবার জন্য অনেকে উদ্বেগ প্রকাশ করিয়া আমাদিগকে বহু সহানুভূতিসূচক পত্র পাঠাইতেছেন। আমরা এই মনে করিয়া চুপ করিয়া থাকা বাঞ্ছনীয় মনে করিয়াছিলাম যে, ইতিমধ্যেই কর্তৃপক্ষ সকলের পক্ষে সম্মানজনক ও গ্রহণযোগ্য মীমাংসায় উপনীত হইতে পারিবেন। কিন্তু ভাইস- চ্যান্সেলরের একজিকিউটিভ কাউন্সিলের নিকট প্রদত্ত বিবৃতি; যাহা ২৯শে মার্চ তারিখে সংবাদপত্রে প্রকাশিত হইয়াছে, তাহা এমন এক নূতন পরিস্থিতির সৃষ্টি করিয়াছে যে, আমাদিগকে নূতনভাবে বর্তমান অবস্থা বিশ্লেষণ করিতে হইতেছে।

কোন নিরপেক্ষ ব্যক্তি যদি ভাইস-চ্যান্সেলরের ১১ই এবং ২৯শে মার্চ তারিখের বিবৃতি দুইটি বিশদভাবে পাঠ করেন তাহা হইলে দেখিতে পাইবেন যে, একই ব্যক্তির মুখ দিয়া একই ঘটনা সম্বন্ধে দুইটি পরস্পর বিরোধী বিবৃতি প্রকাশিত হইয়াছে। ১১ই তারিখে তিনি বলেন যে, যেহেতু ধর্মধটকারীরা কাজে যোগদান করে নাই, সেই হেতু অনির্দিষ্টকালের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করিয়া দেওয়া ছাড়া তাঁহার কোন গত্যন্তর ছিল না। ২৯শে মার্চ তিনি স্বীকার করেন যে ছাত্ররা ধর্মঘট প্রত্যাহার করিয়াছিল এবং ধর্মঘটিরা কাজে যোগদান করিতে আসিয়াছিল। কিন্তু তিনি তাহাদের অনুমতি দেন নাই, যেহেতু তাদের যোগদান শর্তসাপেক্ষ ছিল। কিন্তু প্রকৃত ঘটনা এই যে, ছাত্র এবং ধর্মঘটী কর্মচারীরা পূর্ব রাত্রে একজিকিউটিভ কাউন্সিলের সভ্যদের প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি অনুসারে ১০ই তারিখ বিনাশর্তে উভয়েই ধর্মঘট প্রত্যাহার করিয়াছিল।[২৯শে তারিখে ভাইস-চ্যান্সেলর যাহা স্বীকার করিলেন, ১১ই তারিখে তিনি তাহা গোপন করিলেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করা সম্বন্ধে দুইটি বিবৃতিতে সম্পূর্ণ দুইটি কারণ দর্শাইয়াছেন।

এর পর ছাত্রদের সম্পর্কে ভাইস-চ্যান্সেলরের অভিযোগ প্রসঙ্গে কর্ম-পরিষদ বলেন:

প্রদত্ত প্রতিশ্রুতির উপর নির্ভর করিয়াই ছাত্ররা এবং ধর্মঘটী কর্মচারীরা বিনাশর্তে তাহাদের ধর্মঘট প্রত্যাহার করিয়াছিল, স্থগিত রাখে নাই। ভাইস-চ্যান্সেলর অনুযোগ করেন যে, ছাত্ররা তাহাদের নিকট এমন এক অবস্থার সৃষ্টি করিয়াছিল যাহা বিশ্ববিদ্যালয় মানিয়া লইতে পারে নাই। আমরা পুনরায় ইহা পরিষ্কারভাবে বলিতে চাই যে ছাত্ররা ধর্মঘটকালীন একমাত্র মীমাংসাকার হিসাবেই কাজ করিয়াছিল।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর ক্ষেত্রে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক প্রসঙ্গে কর্ম-পরিষদ বলেন:

শিক্ষক ও ছাত্রদের মধ্যে সম্পর্ক হইতেছে ভক্তির এবং স্নেহের। দুর্ভাগ্যবশতঃ সেই সম্পর্ক তিক্ততায় পর্যবসিত হইয়াছে। ছাত্র ও শিক্ষকের মধ্যে মধুর সম্পর্ক, সেটা যদি নষ্ট হয়, তবে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের যাহা মহান এবং ভালো তাহাই নষ্ট হইয়া যায়।

ছাত্রদের সাথে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ৯ই মার্চ বিকেলের আলোচনায় ধর্মঘটীদের দাবী- দাওয়ার স্বীকৃতি এবং ধর্মঘট প্রত্যাহারের সম্পর্কে যে মৌখিক চুক্তি হয় পরদিন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তার বরখেলাফ করেন। তৎকালীন অবস্থা এবং ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে দুই কারণে কর্তৃপক্ষ ধর্মঘটী কর্মচারী ও ছাত্রদের সাথে সম্পাদিত চুক্তি ভঙ্গ করেন। তাঁদের প্রথম উদ্দেশ্য ছিলো ছাত্রদের থেকে ধর্মঘটীদেরকে বিচ্ছিন্ন করে তাদের সাথে পৃথকভাবে আলোচনা করা। ছাত্রদের অবর্তমানে নিম্ন কর্মচারীরা স্বাভাবিকভাবেই অনেক দুর্বল হয়ে পড়বে এবং সেই অবস্থায় তাদের সাথে একটা উপযুক্ত বোঝাপড়ার সুবিধে হবে। প্রকৃতপক্ষে তাই ঘটেছিলো। কারণ ছাত্রদের অনুপস্থিতিতে একজন ব্যতীত অন্য সব কর্মচারীরাই ধর্মঘট করে বিশ্ববিদ্যালয়ে অচলাবস্থা সৃষ্টি করা অন্যায় হয়েছে স্বীকার করে লিখিতভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করে। এ ছাড়া কর্তৃপক্ষের দেওয়া কতকগুলি শর্ত – যেমন ইউনিয়ন না মানা, ভবিষ্যতে ধর্মঘট না করা ইত্যাদি – সই করে কাজে যোগদান করে।[৫১] কর্তৃপক্ষের দ্বিতীয় উদ্দেশ্য ছিলো পূর্ব-বাঙলা ব্যবস্থাপক সভার অধিবেশন চলার সময় ছাত্রেরা যাতে ঢাকাতে না থাকে তার ব্যবস্থা করা। আরবী হরফ প্রবর্তনের প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ছাত্রদের মধ্যে তখন বেশ উত্তেজনা বিরাজ করছিলো। কাজেই প্রাদেশিক সরকার ১৯৪৮- এর মতো ছাত্র বিক্ষোভ যাতে আবার না ঘটে তার জন্যে কর্মচারী ধর্মঘটের সুযোগে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেন। ছাত্রদের সাথে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের আকস্মিক চুক্তিভঙ্গ এবং কাজ শুরু করতে ইচ্ছুক নিম্নকর্মচারীদেরকে কাজে যোগদান করতে বাধা দানের সেটাই ছিলো প্রধান কারণ। বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেওয়ার পর কর্তৃপক্ষ ২৭ জন ছাত্র-ছাত্রীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।* এদের মধ্যেও ৬ জনকে ৪ বৎসরের জন্যে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার, ১৫ জনকে হল থেকে বহিষ্কার, ৫ জনকে ১৫ টাকা হিসাবে এবং ১ জনকে ১০ টাকা হিসাবে জরিমানা করা হয়। এ ছাড়া তাঁরা শাস্তিপ্রাপ্ত ছাত্রদের বৃত্তি বন্ধ করারও সিদ্ধান্ত নেন। শুধু তাই নয়, তাঁরা আরও স্থির করেন যে ১৭ই এপ্রিলের মধ্যে অভিভাবকদের মধ্যস্থতায় সৎচরিত্র সম্পর্কিত সার্টিফিকেট দাখিল না করলে তাদেরকেও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হবে।[৫২] এঁদের মধ্যে অনেকেই এই ধরনের সার্টিফিকেট দাখিল করে এবং জরিমানা দিয়ে কর্তৃপক্ষের সাথে আপোষ করেন।

[* দবিরুল ইসলাম (অস্থায়ী আহ্বায়ক পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগ), আবদুল হামিদ (এমএ ক্লাস), অলি আহাদ (বিকম ক্লাস) আবদুল মান্নান (বিএ ক্লাস), উমাপতি মিত্র (এমএসসি পরীক্ষার্থী) সমীরকুমার বসু (এমএসসি ক্লাস) – এই ৬ জনকে ৪ বৎসরের জন্যে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়।
বিভিন্ন হল থেকে যাঁদেরকে বহিষ্কার করা হয় তাঁদের নাম: আবদুর রহমান চৌধুরী (সহ- সভাপতি, সলিমুল্লাহ মুসলিম হল ও আইন বিভাগের ছাত্র), জালালউদ্দিন আহমদ (এমএ ক্লাস), দেওয়ান মাহবুব আলী (আইন বিভাগের ছাত্র), আবদুর রসিদ ভূঁইয়া (এমএ ক্লাস), হেমায়েত উদ্দীন আহমদ (বিএ ক্লাস), আবদুল মতিন খাঁ (এমএ পরীক্ষার্থী), নুরুল ইসলাম চৌধুরী (এমএ ক্লাস), সৈয়দ জামাল কাদেরী (এমএসসি ক্লাস), আবদুস সামাদ (এমকম ক্লাস), সিদ্দিক আলী (এমএ ক্লাস) আবদুল বাকী (বিএ ক্লাস), জে পাত্রনবিশ (এমএসসি ক্লাস), অরবিন্দ বসু (সহ- সভাপতি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ইউনিয়ন এবং আইন বিভাগের ছাত্র)।
পনেরো টাকা হিসাবে যাঁদের জরিমানা করা হয় তাঁদের নাম: শেখ মুজিবুর রহমান (আইন ক্লাসের ছাত্র), কল্যাণ দাসগুপ্ত (এমএ ক্লাসের ছাত্র এবং সাধারণ সম্পাদক, ঢাকা হল), নঈমুদ্দীন আহমদ (আহ্বায়ক পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগ), নাদিরা বেগম (এমএ ক্লাসের ছাত্র), আবদল ওয়াদুদ (বিএ ক্লাসের ছাত্র)। এ ছাড়া লুলু বিলকিস বানু নামে আইন বিভাগের একজন ছাত্রীর দশ টাকা জরিমানা হয়।]

কর্তৃপক্ষের এই আচরণের প্রতিবাদে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র কর্ম-পরিষদ ১৭ই এপ্রিল অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয় খোলার পর থেকে সাধারণ ধর্মঘটের আহ্বান জানান।

বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অনুসৃত নীতি ও কর্মপন্থার সমালোচনা করে ১৪ই এপ্রিল নওবেলাল মন্তব্য করেন:

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আগামী ১৭ই এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয় খুলিবার নির্দেশ দিয়াছেন। কিন্তু জানা গিয়াছে যে, পূর্ব পাক মুসলিম ছাত্র লীগের উদ্যোগে ১৭ই তারিখ হইতে আবার ধর্মঘট শুরু করার সিদ্ধান্ত হইয়াছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ছাত্রদের উপর যে অন্যায় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা অবলম্বন করিয়াছেন তাহার প্রতিবাদ স্বরূপ এই ধর্মঘট শুরু হইবে। ছাত্রগণ বিশ্ববিদ্যালয়ের নিম্নতম কর্মচারীদের প্রতি সহানুভূতি জানাইয়া বিগত ৩রা মার্চ হইতে ধর্মঘট শুরু করেন এবং এই অপরাধেই কর্তৃপক্ষ উপরোক্ত শাস্তিমূলক ব্যবস্থা অবলম্বন করিয়াছেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র আন্দোলন আজ নতুন নয়। ইতিপূর্বে আরও বহুবার এমনকি ব্রিটিশ আমলেও অনুরূপ আন্দোলন হইয়া গিয়াছে। কিন্তু বর্তমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ন্যায় মধ্যযুগীয় প্রথায় ছাত্রদের বহিষ্কৃত করা হয় নাই। তাহাদের জানা উচিত, যে কারণে ছাত্র ধর্মঘট বা আন্দোলন সংঘটিত হয় তাহার প্রতিকার না করিয়া আন্দোলনকারীদের উপর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা অবলম্বন করিলে কোন সুফল লাভ হইতে পারে না। আন্দোলনকারী ছাত্র-ছাত্রীদের উপর হইতে অবিলম্বে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা প্রত্যাহার করিয়া তাহাদের ধর্মঘট করার কারণ দূর করিতে আমরা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের নিকট দাবী জানাইতেছি।

৪. আন্দোলনের নোতুন পর্যায়

নিম্নকর্মচারী ধর্মঘটে অংশ গ্রহণের জন্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৭ জন ছাত্র-ছাত্রীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা অবলম্বনের প্রতিবাদে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ফেডারেশন ও পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগ ১৭ই এপ্রিল সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে ছাত্র ধর্মঘট ঘোষণা করে।[৫৩]

প্রায় দু’ হাজার ছাত্র-ছাত্রী সেদিন বেলা বারোটায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে সমবেত হওয়ার পর সেখানে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেই সভায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের স্বৈরাচারী নীতির তীব্র নিন্দা করে প্রস্তাব গৃহীত হয়। সরকারের দালালী করার উদ্দেশ্যে নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগের কয়েকজন নেতা সভায় কিছু গণ্ডগোলের চেষ্টা করলেও সাধারণ ছাত্রেরা তাদেরকে দালাল হিসাবে সহজেই চিহ্নিত করে।[৫৪]

১৭ তারিখে সকাল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে ও রমনার বিভিন্ন এলাকায় সশস্ত্র পুলিশ মোতায়েন করা হয় এবং তারা ছাত্রদেরকে নানাভাবে ভয় দেখানোর চেষ্টা করে। বিশ্ববিদ্যালয়ে সভা শেষ হওয়ার পর পুলিশের অবস্থান সত্ত্বেও ছাত্রেরা বিরাট এক মিছিল সহকারে ভাইস-চ্যান্সেলরের বাড়ীতে উপস্থিত হয়। ভাইস-চ্যান্সেলরের সাথে সাক্ষাতের জন্যে তারা তাঁর কাছে বহুক্ষণ ধরে অনুরোধ জানানো সত্ত্বেও তিনি ছাত্রদের সাথে সাক্ষাৎ করতে শেষ পর্যন্ত কিছুতেই রাজী না হওয়ায় ১৭ তারিখেই রাত নয়টায় বিশ্ববিদ্যালয় পরিস্থিতির পর্যালোচনা এবং নোতুন কর্মপন্থা গ্রহণের উদ্দেশ্যে সাধারণ ছাত্রেরা একটি সভায় মিলিত হয়। পূর্ববর্তী কর্ম-পরিষদের সদস্য এবং পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগের দুজন বিশিষ্ট নেতা নঈমুদ্দীন আহমদ ও আবদুর রহমান চৌধুরী ইতিপূর্বে কর্তৃপক্ষের কাছে আত্মসমর্পণ করায় তাঁদেরকে বাদ দিয়ে সেই সভায় নোতুনভাবে একটি কর্মপরিষদ গঠিত হয়।[৫৫] রাত দশটা পর্যন্ত ভাইস-চ্যান্সেলর ছাত্রদের সাথে দেখা করতে অস্বীকার করায় নোতুন কর্ম-পরিষদের সিদ্ধান্ত অনুসারে দশ পনেরো জন ছাত্র ভাইস-চ্যান্সেলরের বাড়ীতে সারা রাত অবস্থান ধর্মঘট করে।[৫৬]

১৮ই এপ্রিল ঢাকা শহরের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রেরা ধর্মঘট পালন করে।[৫৭] কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের গেটে সকাল থেকেই পিকেটিং শুরু হলেও সেদিন বিজ্ঞান, বাণিজ্য এবং আইনের ছাত্রেরা সকলেই ক্লাসে যোগ দেয়। মূল কলাভবনে ধর্মঘট হলেও অল্পসংখ্যক ছাত্র সেখানেও ক্লাস করে।[৫৮]

বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ থেকে একটি বিরাট মিছিল বের হয়ে সকালের দিকে শহর প্রদক্ষিণ করে[৫৯] এবং বেলা তিনটের দিকে মেডিকেল হোস্টেলের ব্যারাক এবং ইঞ্জিনিয়ারিং হোস্টেলের ভেতর দিয়ে ঢুকে ভাইস-চ্যান্সেলরের বাড়ীর দিকে অগ্রসর হতে থাকে।[৬০] পুলিশ সে সময় তাদেরকে বাধা দেওয়া সত্ত্বেও কোন ঘটনা সৃষ্টি না করেই ছাত্রেরা ভাইস- চ্যান্সেলরের বাড়ীতে প্রবেশ করতে সমর্থ হয়।[৬১] সেখানে গিয়ে তারা অবস্থান ধর্মঘটীদের সাথে যোগদান করে।[৬২]

ভাইস-চ্যান্সেলরের বাসভবনে বিকেল ৫-৩০ মিনিটে বিশ্ববিদ্যালয় একজিকিউটিভ কাউন্সিলের বৈঠক বসে। সেই সময় ইব্রাহিম খান, ওসমান গণি, আবদুল হালিম, ডক্টর টি. আহমদ, পিসি চক্রবর্তী এবং মিজানুর রহমান ছাত্রদের সাথে একটা আলোচনার সূত্রপাত করেন। প্রথম দিকে কিছুটা আশার সঞ্চার হলেও শেষ পর্যন্ত রাত দুটোর সময় তা ব্যর্থ হয়।[৬৩] এর পর প্রায় তিরিশজন ছাত্র ভাইস-চ্যান্সেলরের বাড়ীর প্রাঙ্গণে সারারাত অবস্থানের সিদ্ধান্ত নেয়৬৪ এবং বিশ্ববিদ্যালয় কর্মপরিষদ ২০শে এপ্রিল সাধারণ ধর্মঘট ঘোষণা করে।[৬৫]

১৯শে এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন ধর্মঘট অথবা পিকেটিং হয়নি।[৬৬] বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্ত এলাকায় সেদিন সশস্ত্র পুলিশ মোতায়েন করা হয়। বেলা তিনটের সময় ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট, ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ এবং পুলিশ সুপারিনটেন্ডেন্ট বহুসংখ্যক সশস্ত্র পুলিশ সাথে নিয়ে ভাইস-চ্যান্সেলরের বাড়ীতে হাজির হন[৬৭] এবং কিছুক্ষণ পর অবস্থান ধর্মঘটরত সাত আটজন ছাত্রকে গ্রেফতার করেন।[৬৮]

১৮ তারিখের ঘোষণা অনুসারে ২০শে এপ্রিল ঢাকার সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট শুরু হয়। সকালের দিকেই পুলিশ বিশ্ববিদ্যালয় এবং মেডিকেল কলেজের গেটের সামনে থেকে অনেক ছাত্রকর্মীকে গ্রেফতার করে। অন্যান্য জায়গাতেও কর্মীরা পুলিশ কর্তৃক গ্রেফতার হয়।[৬৯] পুলিশের বাধা সত্ত্বেও বেলা দেড়টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে এক বিরাট ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হয়। সেই সভায় পুলিশ জুলুমের নিন্দা করে ছাত্রেরা প্রস্তাব গ্রহণ করে। ২৭ জন ছাত্র-ছাত্রীর উপর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বহিষ্কারাদেশ সরকারী দমন নীতিরই যে একটি বীভৎস রূপ বক্তৃতার মাধ্যমে একথার সকলেই কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।[৭০] এবং সেজন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রতিকার দাবীর উদ্দেশ্যে তারা মিছিল সহকারে সেক্রেটারিয়েটের দিকে অগ্রসর হয়।[৭১]

ঢাকা হলের কাছে এই মিছিলটির উপর পুলিশ বেপরোয়াভাবে লাঠি চালিয়ে এবং কাঁদুনে গ্যাস ছুড়ে সকলকে ছত্রভঙ্গ করে দেয়।[৭২] এরপর ছাত্র-ছাত্রীরা আবার একত্রিত হয়ে মিছিল করে এবং সেক্রেটারিয়েটের দক্ষিণ গেটের কাছে উপস্থিত হয়। পুলিশ সেখানে তাদের পথ রোধ করে।[৭৩] দুই ঘণ্টা সেখানে দাঁড়িয়ে ভিতরে প্রবেশের চেষ্টার পর ছাত্রেরা যখন জোরপূর্বক পুলিশ কর্ডন ভেদ করে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে তখন পুলিশেরা নিরস্ত্র ছাত্র-ছাত্রীদের উপর অবিরাম লাঠি চালায় এবং কাঁদুনে গ্যাস ছোড়ে। এর ফলে বেশ কয়েকজন গুরুতরভাবে আহত হওয়ার পর তাদেরকে চিকিৎসার জন্যে হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়।[৭৪]

কিন্তু এত উৎপীড়ন ও নির্যাতনের পরও ছাত্র-ছাত্রীরা আবার একত্রিত হয়ে বেলা তিনটের দিকে মিছিল করে শহর প্রদক্ষিণের সিদ্ধান্ত নেয় এবং ‘ছাত্র ঐক্য জিন্দাবাদ’, ‘জুলুমবাজী চলবে না’, ‘হাজার লোকের ভাত মারা চলবে না’, ‘মজুর কৃষক ছাত্র ভাই ভাই’, ইত্যাদি ধ্বনি দিতে দিতে নাজির বাজার, মানসী, নবাবপুর, সদরঘাট, পাটুয়াটুলি, ইসলামপুর, চক, জেল গেট, বেগম বাজার, ট্রেনিং কলেজ রোড হয়ে আরমানীটোলা ময়দানে জমায়েত হয়। সেখানে সমবেত জনসাধারণের সামনে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত বিভিন্ন ছাত্রবক্তারা সমগ্র পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে বোঝায় এবং কয়েকটি প্রস্তাব গ্রহণের পর পুলিশ জুলুমের প্রতিবাদে পরদিন আবার ধর্মঘট ঘোষণা করে।[৭৬]

সেদিন অলি আহাদকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠের সামনে এবং মতিন, এনায়েত করিম ও নিতাই গাঙ্গুলীকে সেক্রেটারিয়েট গেটের সামনে গ্রেফতার করে। খালেক নওয়াজ, আজিজ আহমদ, বাহাউদ্দিন সকালের দিকেই গ্রেফতার হন। এ ছাড়া আরো অনেককে গ্রেফতার করে দূর দূর জায়গায় নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়।[৭৭]

আরমানীটোলা ময়দানের সমাবেশে ২১শে এপ্রিল ধর্মঘট ঘোষণা সত্ত্বেও বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন পিকেটিং হয়নি। তবে ছাত্রদের মধ্যে ক্লাস করার উৎসাহও সেদিন তেমন ছিলো না। বিকেলের দিকে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে ছাত্রেরা একটি মিছিল বের করে সেক্রেটারিয়েটের পাশ দিয়ে অগ্রসর হয়ে করোনেশন পার্কে উপস্থিত হয় এবং সেখানে একটি জনসভা অনুষ্ঠান করে।

২২ তারিখে ঢাকা হল ছাত্রদের একটি সভায় ৬ জনকে নিয়ে একটি কর্মপরিষদ গঠিত হয়। পরদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে আংশিক ধর্মঘট হয়। ফজলুল হক হলের দুই চারজন ছাত্র ছাড়া অন্য কেউই সেদিন ক্লাসে যোগদান করেনি। কিন্তু কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের ভুল ব্যবস্থাপনার জন্যে সেদিন কোন বিক্ষোভ মিছিল ইত্যাদি সম্ভব হয়নি।[৮৯]

ছাত্র কর্ম-পরিষদ ২৫শে এপ্রিল সাধারণ ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন এবং সেই সিদ্ধান্তকে কার্যকরী করার জন্যে ছাত্রকর্মীরা শহরের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করেন। কিছুসংখ্যক নেতৃস্থানীয় ছাত্রের বিরোধিতা ও বিশ্বাসঘাতকতা এবং সরকারের দমনমূলক ব্যবস্থা সত্ত্বেও ধর্মঘটের প্রস্তুতি অব্যাহত থাকে এবং জনসাধারণ ছাত্রদের আহ্বানে উৎসাহের সাথে সাড়া দেন। এর ফলে সরকার গণ্ডগোল আশংকার অজুহাতে সমগ্র রমনা এলাকায় ১৪৪ ধারা জারী করে।[৮০]

পূর্ব-বাঙলার রাজনৈতিক ইতিহাসে ১৯৪৯ সালের ২৫শে এপ্রিল একটি গুরুত্বপূর্ণ পথচিহ্ন। এই দিনই সর্বপ্রথম ছাত্রদের সাথে বৃহত্তর জনসাধারণের সত্যিকার রাজনৈতিক সংযোগ স্থাপিত হয় এবং ছাত্রজনতা সম্মিলিতভাবে স্বৈরাচারী সরকারের নির্যাতন ও নানা প্রতিক্রিয়াশীল নীতির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের ভিত্তি স্থাপন করে।

২৫শে এপ্রিল ঢাকা শহরে এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের সৃষ্টি হয়। নীলক্ষেত ও পলাশী ব্যারাকের সরকারী কর্মচারীরা বেলা ১২-৩০ মিনিট পর্যন্ত অফিস না গিয়ে[৮১] এবং চক থেকে শুরু করে ইসলামপুর, পাটুয়াটুলি, নবাবপুর পর্যন্ত সমস্ত দোকানপাট ও বাস রিক্সা পর্যন্ত বন্ধ রেখে সেদিন এক ঐতিহাসিক ধর্মঘটে সমগ্র ঢাকা শহর ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে মিলিত হয়। এই ধর্মঘটের জন্যে শহরে ছাত্রদেরকে পিকেটিং করতে হয়নি। পিকেটিং সেদিন করেছে সাধারণ শ্রমিক ও দোকান কর্মচারীরা। নির্যাতিত ছাত্রদের থেকে শহরের উৎপীড়িত জনসাধারণ ও শ্রমিক কর্মচারীদেরকে বিচ্ছিন্ন করার চক্রান্তকে সম্পূর্ণভাবে বানচাল করে ২৫শে এপ্রিল বস্তুতঃপক্ষে পূর্ব বাঙলার রাজনৈতিক ইতিহাসে রচনা করেছিলো এক নোতুন দিগন্ত।

বেলা ১২টা থেকে শহরের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ধর্মঘটী ছাত্র-ছাত্রীরা দলে দলে আরমানীটোলা ময়দানে সমবেত হতে থাকে এবং ১টার সময় সেখানে তাজউদ্দীন আহমদের সভাপতিত্বে[৮২] একটি জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। হাজার হাজার ছাত্র-জনতা সেই সভায় ঐক্যবদ্ধভাবে আওয়াজ তোলে’ ‘ফ্যাসিস্ট নীতি ধ্বংস হোক’ ‘পুলিশ জুলুম চলবে না’ ‘১৪৪ ধারা বাতিল করো’ ‘বহিষ্কার আদেশ প্রত্যাহার করো’, ‘ছাত্র বন্দীদের মুক্তি চাই।’[৮৩] সভা শেষ হওয়ার পর আরমানীটোলা ময়দান থেকে সেক্রেটারিয়েটের উদ্দেশ্যে একটি বিরাট মিছিল সহকারে হাজার হাজার ছাত্র এবং জনসাধারণ বিভিন্ন ধ্বনিতে ঢাকার আকাশ বাতাস মুখরিত করে বেগমবাজার, জেলগেট, চকবাজার, মোগলটুলী, ইসলামপুর, সদরঘাট, নবাবপুর হয়ে অবশেষে স্টেশন রোডে উপস্থিত হয়। সারা পথে অসংখ্য মানুষ এগিয়ে এসে মিছিলে যোগদান করায় ইতিমধ্যে মিছিলের কলেবর অনেকখানি স্ফীত হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও নাজির বাজার রেলওয়ে ক্রসিং পার হওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব হলো না। গাড়ী বোঝাই সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী সেখানে তাদের পথ রোধ করলো।[৮৪]

পুলিশের দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হয়ে মিছিল এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যে ছাত্র জনসাধারণও তখন বদ্ধপরিকর হলো। ‘ব্যারিকেড ভাঙতে হবে’, ‘১৪৪ ধারা মানবো না’ ইত্যাদি ধ্বনি তুলে তারা পুলিশ কর্ডন ভেদ করে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে পুলিশ লাঠি চালনা করে ও কাঁদুনে গ্যাস ছুড়ে মিছিলটিকে সেখানে ছত্রভঙ্গ করে দিলো।[৮৫]

এরপর নাজির বাজার রেল ক্রসিং পরিত্যাগ করে সকলে নবাবপুর ক্রসিং এর সামনে উপস্থিত হয় কিন্তু সেখানেও পুলিশবাহিনী কর্ডন সৃষ্টি করে তাদেরকে বাধা দেয় এবং সেই পুলিশ বেষ্টনী ভেদ করতে অসমর্থ হয়ে ছাত্রেরা রাস্তার উপরেই বসে পড়ে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে। সশস্ত্র পুলিশ তখন নিরস্ত্র শোভাযাত্রাকারীদের উপর নির্দয়ভাবে অবিরাম লাঠি চালনার দ্বারা তাদের মধ্যে অনেককে জখম করে দেয়। সাধারণ পথচারী এবং নবাবপুর এলাকার ওষুধপত্রের দোকানগুলির মধ্যেকার কর্মচারীরা পর্যন্ত সেদিন পুলিশের মারধোর ও নির্যাতনের হাত থেকে রেহাই পায়নি।[৮৬] ‘পল ফার্মেসী’ নামে একটি ওষুধের দোকানে কয়েকজন আশ্রয় গ্রহণ করে। একজন পাঞ্জাবী হাবিলদারকে নিয়ে এক পুলিশ ইন্সপেক্টর দোকানটিতে ঢুকে প্রায় ১৫ ব্যক্তিকে অমানুষিকভাবে মারধোর করে।[৮৭] ২৫শে এপ্রিলের নানা ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্ট ছাত্রদের মধ্যে ২৪ জনকে গ্রেফতার করা হয়।[৮৮]

পুলিশের এই নির্যাতনের পরও ছাত্রজনতার মধ্যে হতাশার পরিবর্তে দেখা দেয় নোতুন উদ্দীপনা এবং ‘ছাত্র জনসাধারণ ঐক্য জিন্দাবাদ’ ‘খুদ আতপ চলবে না’, ‘ভাত কাপড় শিক্ষা চাই’ ইত্যাদি ধ্বনি দিতে দিতে তারা নবাবপুর রোড দিয়ে ভিক্টোরিয়া পার্কে সমবেত হয়। ভিক্টোরিয়া পার্কের সেই সভায় জনসাধারণ দলে দলে যোগদান করে এবং বক্তৃতা দিয়ে ছাত্রদের প্রতি তাদের ঐক্য ও সংহতির কথা ঘোষণা করে। অন্যান্য প্রস্তাবের মধ্যে একটিতে পরদিন প্রতিবাদ ধর্মঘট এবং করোনেশন পার্কে সাধারণ সভার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

এই পর্যায়ের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আন্দোলনের তীব্রতা ও ব্যাপকতা ধীরে ধীরে কমে আসে। ২৬শে এপ্রিল সাধারণ ধর্মঘট এবং সাধারণ সভা অনুষ্ঠানের পরিবর্তে কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ ক্রমাগত ধর্মঘট প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং ২৭শে এপ্রিল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঢাকার অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে নিয়মিতভাবে ক্লাস শুরু হয়। এরপর ছাত্র কর্ম-পরিষদ পরবর্তী কর্মপন্থা নির্ধারণের জন্যে মাঝে মাঝে বৈঠকে মিলিত হয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহে ধর্মঘটের আহ্বান জানায়।[৯০] কিন্তু এসব সত্ত্বেও আন্দোলনের পূর্বাবস্থা আর ফিরে আসে না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আন্দোলনের সমর্থনে পূর্ব-বাঙলার বিভিন্ন অঞ্চলে ধর্মঘট ও সভাসমিতি হয় এবং ছাত্র সম্প্রদায় ব্যাপকভাবে পুলিশী জুলুমের প্রতিবাদ করে।[৯১] মার্চ-এপ্রিলের ছাত্র আন্দোলন করার ক্ষেত্রে পার্লামেন্টারী রাজনীতির ভূমিকা প্রসঙ্গে সাপ্তাহিক সৈনিক-এর নিজস্ব সংবাদদাতার একটি রিপোর্টে বলা হয়:

তখন ছাত্রদের মনে দৃঢ় বিশ্বাস জন্মে গেল যে এই অনির্দিষ্টকালের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেওয়ার পিছনে পার্লামেন্টারী রাজনীতি কাজ করছে। ১১ই মার্চ থেকে পূর্ব-বাংলা আইন পরিষদের অধিবেশন শুরু হলো। ঐদিনই একদল ছাত্র বাংলা ভাষায় আরবী হরফ প্রচলনের প্রতিবাদ জানিয়ে পরিষদের রাস্তায় শোভাযাত্রা করে এবং ফলে কিছু ধরপাকড়াও হয়। ঠিক এক বৎসর আগে ঐদিনই তমদ্দুন মজলিশের* ঐতিহাসিক বাংলা ভাষার আন্দোলন শুরু হয় এবং তখন ছাত্র সমাজ পরিষদের সম্মুখে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে এবং এমনকি সরকারকে পরিষদ রক্ষার জন্য সামরিক বাহিনীর সাহায্য নিতে হয়েছিল। এবার যদিও পরিষদ গৃহের চতুর্দিকে পুরো দেওয়াল দিয়ে ঘেরা হয়েছে তবুও ছাত্রদের বিশ্বাস করা যায় না(!) তাই সবচেয়ে ভালো উপায় হলো আইন পরিষদের অধিবেশন শেষ না হওয়া পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের রাজধানী থেকে সরিয়ে রাখা। এই বিশ্বাস আরো প্রবল হলো যখন অনার্স এমএ পরীক্ষার্থী ছাত্রদের পর্যন্ত হল থেকে একপ্রকার জবরদস্তি করে বের করে দেওয়া হলো।… তাছাড়া ছাত্রদের শাস্তি দেওয়ার ব্যাপারেও নাকি অল্পস্বল্প রাজনীতি ঢুকেছে। যে সমস্ত ছাত্রছাত্রী শাস্তি পেয়েছে তাদের অনেকেই নাকি ধর্মঘট ব্যাপারে একেবারেই জড়িত ছিলো না, এমনকি কয়েকজন ধর্মঘটের পূর্ব থেকেই রাজধানীর বাইরে ছিলো।

[*ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে তমদ্দুন মজলিশের এই জাতীয় বক্তব্য অত্যন্ত বিভ্রান্তিকর। ১৯৪৭-৪৮ সালে আন্দোলন সে পর্যন্ত সাংস্কৃতিক গণ্ডীর মধ্যেই শুধু সীমাবদ্ধ ছিলো সে পর্যন্ত অন্যান্য রাজনৈতিক গোষ্ঠীর সাথে তারাও উল্লেখযোগ্যভাবে উদ্যোগী হয়। ভাষা আন্দোলনকে সাংস্কৃ তিক থেকে রাজনৈতিক পর্যায়ে উত্তীর্ণ করার ক্ষেত্রেও তমদ্দুন মজলিশের প্রাথমিক প্রচেষ্টা উল্লেখযোগ্য। কিন্তু ১১ই মার্চ, ১৯৪৮-এর পর থেকে ভাষা আন্দোলনে তাদের গুরুত্ব অন্যান্যদের তুলনায় ক্রমশঃ এবং দ্রুত কমে আসে। কাজেই ১৯৪৮-এর ভাষা আন্দোলনকে কোন ক্রমেই ‘তমদ্দুন মজলিশের আন্দোলন’ অথবা কোন বিশেষ ব্যক্তি বা রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর আন্দোলন হিসাবে অভিহিত করা চলে না। কিন্তু তমদ্দুন মজলিশের পত্রপত্রিকা এবং অধ্যাপক আবুল কাসেম লিখিত ও প্রকাশিত ভাষা আন্দোলনের উপর বিভিন্ন পুস্তিকা এই জাতীয় বিভ্রান্তিকর প্রচারণায় পরিপূর্ণ। পূর্ব-বাঙলার ভাষা-আন্দোলনকে যথার্থভাবে বোঝার জন্যে এইসব বক্তব্য ও প্রচারণা সম্পর্কে যথোচিতভাবে সাবধান হওয়ার প্রয়োজন নিতান্ত অপরিহার্য।- ব. উ.]

এ সম্পর্কে তাজউদ্দীন আহমদ নিজের ব্যক্তিগত ডায়েরীতে ১৭ই এপ্রিল নিম্নলিখিত মন্তব্য করেন:

বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ২৭ জন ছাত্রের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছেন। এদের মধ্যে কয়েকজন আছে যারা বিভিন্ন ঘটনায় কোন অংশ গ্রহণ করেনি। এর থেকে প্রমাণিত হয় যে অন্য ব্যাপারের জের টেনে তাদের বিরুদ্ধে এইভাবে প্রতিশোধ নেওয়া হচ্ছে।

২৮শে এপ্রিল সাপ্তাহিক নওবেলাল ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বৈরাচার’ নামে একটি সম্পাদকীয় লেখেন। তাতে তাঁরা বলেন:

নিম্নতম কর্মচারীদের অতি সঙ্গত দাবীর প্রতি সহানুভূতি জানাইবার জন্যই ছাত্ররা ধর্মঘট করে। ছাত্রদের এই সহানুভূতি প্রদর্শন মোটেই অপ্রত্যাশিত নয়। কারণ অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে সকল দেশেই ছাত্ররা চিরকাল প্রতিবাদ জানাইয়া আসিয়াছে। ছাত্ররা সাধারণত আদর্শবাদী। সকলপ্রকার অবিচারের বিরুদ্ধে মাথা উঁচু করিয়া দাঁড়ানোই তাদের স্বভাব ধর্ম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাপারেও যদি তাহাই ঘটিয়া থাকে তাহাতে আর আশ্চর্য হইবার কি আছে? স্বল্পবেতন কর্মচারীদের দাবীর যৌক্তিকতা কর্তৃপক্ষ স্বীকার করিয়া লইয়াছিলেন। অতএব তাহাদের উচিত ছিল এই দাবী পূরণ করার সমস্ত ব্যবস্থা করা। তাহা না করিয়া তাহারা নিলজ্জভাবে ন্যায়নিষ্ঠ ছাত্রদের প্রতি দমননীতি প্রয়োগ করিতে ব্যস্ত হইয়া পড়িলেন। এক স্বাধীন দেশের বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের জন্য ইহার চেয়ে লজ্জার ব্যাপার আর কি হইতে পারে? তাই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের খেদমতে আমাদের আরজ তাহারা যেন মিথ্যা আত্মমর্যাদা বোধ পরিহার করিয়া বাস্তববাদী পরিচালকদের মত ছাত্রদের আদর্শবাদীতার প্রতি নজর রাখিয়া সমস্যার উপযুক্ত সমাধান করিয়া তাহাদের বর্তমান স্বৈরাচারমূলক দমন নীতি প্রত্যাহার করেন।

মার্চ-এপ্রিলের ছাত্র আন্দোলনের যে সমস্ত ছাত্র গ্রেফতার হন তাঁদের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগের অস্থায়ী আহ্বায়ক দবিরুল ইসলামের পক্ষে হাই কোর্টে হেবিয়াস কর্পাসের আবেদন করা হয়[৯৩] এবং শহীদ সুহরাওয়ার্দী সেই কেস পরিচালনা করেন।[৯৪] হেবিয়াস কর্পাস আবেদন পেশ করার সময় সুহরাওয়ার্দী হাইকোর্টকে বলেন যে দবিরুল ইসলামের উপর আটক আদেশ অযৌক্তিক। তিনি মন্ত্রীসভার বিরোধী হতে পারেন কিন্তু মন্ত্রীসভার বিরোধিতার অর্থ রাষ্ট্রবিরোধিতা নয়। কাজেই সেই অভিযোগে কোন ব্যক্তিকে নিরাপত্তা আইনে বন্দী করা চলে না।[৯৫]

দবিরুল ইসলামকে ১৮ই জানুয়ারী ১৯৫০ বিনাশর্তে মুক্তি দান করা হয় এবং তার কয়েকদিন পূর্বে রাজশাহীর আতাউর রহমান ও খুলনার মহম্মদ একরাম মুক্তি লাভ করেন।[৯৬]

তথ্যসূত্র (সংশোধন করা হয়নি) – ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আন্দোলনের অগ্রগতি

মহম্মদ তোয়াহা, অলি আহাদ, আবদুল মতিন (পাবনা)। পূর্বোক্ত।

৩১৪ | বদরুদ্দীন উমর রচনাবলী খণ্ড ২

পূর্বোক্ত।

8

আবদুল মতিন।

পূর্বোক্ত।

পূর্বোক্ত।

সৈনিক, ৯ই সেপ্টেম্বর ১৯৪৯।

Pakistan Student’s Rally, Aims, objects and Programme, Draft

Constitution, Printed and Published by Mr. Golam Kibria at the Banijja Barta Cmilla.

পূর্বোক্ত, পৃ ৫।

১০ পূর্বোক্ত, পৃ ১০।

১২

অলি আহাদ এবং তাজউদ্দীন আহমদ-এর ডায়েরী, ২৮/১/১৯৪৯-১৬/২/১৯৪৯। নওবেলাল, ২০ শে জানুয়ারী, ১৯৪৯।

১৩ তাজউদ্দীন আহমদ-এর ডায়েরী, ৮/১/১৯৪৯।

18

নওবেলাল, ২০ শে জানুয়ারী, ১৯৪৯।

১৫ পূর্বোক্ত, ২৩ শে ফেব্রুয়ারী ১৯৪৯।[১৬ পূর্বোক্ত, ৩১ শে মার্চ ১৯৪৯।

,

১৭ নওবেলাল, ২৪ শে মার্চ, ১৯৪৯।[১৮ পূর্বোক্ত।

১৯

20

২১

তাজউদ্দীন আহমদ-এর ডায়েরী, ৫/৩/১৯৪৯। নওবেলাল, ২৪ শে মার্চ, ১৯৪৯।

তাজউদ্দীন আহমদ-এর ডায়েরী, ৫/৩/১৯৪৯।

২২ নওবেলাল, ২৪শে মার্চ, ১৯৪৯।

২৩ পূর্বোক্ত।

২৪ পূর্বোক্ত।

২৫ পূর্বোক্ত।

২৬ তাজউদ্দীন আহমদ-এর ডায়েরী, ৯/৩/১৯৪৯।

27

নওবেলাল, ২৪শে মার্চ, ১৯৪৯।

২৮ তাজউদ্দীন আহমদ-এর ডায়েরী, ৯/৩/১৯৪৯।[২৯ পূর্বোক্ত।

৩০

নওবেলাল, ২৪শে মার্চ, ১৯৪৯।

৩১ তাজউদ্দীন আহমদ-এর ডায়েরী, ৯/৩/১৯৪৯,

৩২ নওবেলাল, ২৪/৩/১৯৪৯।

৩৩ পূর্বোক্ত।

৩৪ তাজউদ্দীন আহমদ-এর ডায়েরী, ১১/৩/১৯৪৯, নওবেলাল, পূর্বোক্ত, ১৭/৩/১৯৪৯ এবং

24/৩/১৯৪৯।

৩৫ তাজউদ্দীন আহমদ-এর ডায়েরী, ১০/৩/১৯৪৯ এবং নওবেলাল।

৩৬ তাজউদ্দীন আহমদ-এর ডায়েরী, ১০/৩/১৯৪৯।

পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি (প্রথম খণ্ড) | ৩১৫

৩৭ পূর্বোক্ত।

৩৮ পূর্বোক্ত, ১১/৩/১৯৪৯।

৩৯ পূর্বোক্ত।

৪০ পূর্বোক্ত।

81

নওবেলাল, ২৪/৩/১৯৪৯।

৪২ তাজউদ্দীন আহমদ-এর ডায়েরী, ১২/৩/১৯৪৯।[৪৩ পূর্বোক্ত।

88

নওবেলাল, ২৪/৩/১৯৪৯।

৪৫ পূর্বোক্ত, ১৭/৩/১৯৪৯।

৪৬ তাজউদ্দীন আহমদ-এর ডায়েরী, ১৩/৩/১৯৪৯।

৪৭ পূর্বোক্ত, ১৪/৩/১৯৪৯।

৪৮

নওবেলাল, ১৭ই মার্চ ১৯৪৯।

৪৯ পূর্বোক্ত, ১৪ই এপ্রিল ১৯৪৯।

৫০ পূর্বোক্ত।

৫১ সৈনিক, ১৫ই এপ্রিল, ১৯৪৯।

৫২ সত্যযুগ, ৪ঠা এপ্রিল, ১৯৪৯; The Statesman, April 4, 1949; সৈনিক, ১৫ই এপ্রিল,

১৯৪৯।

নওবেলাল, ৫ই মে ১৯৪৯।

৫৩

৫৪ পূর্বোক্ত।

৫৫ পূর্বোক্ত।

৫৬ পূর্বোক্ত।

৫৭ পূর্বোক্ত।

৫৮ তাজউদ্দীন আহমদ-এর ডায়েরী, ১৮/৪/১৯৪৯।

৫৯

নওবেলাল, ৫ই মে ১৯৪৯।

৬০ পূর্বোক্ত, তাজউদ্দীন আহমদ-এর ডায়েরী, ১৮/৪/১৯৪৯।

৬১

তাজউদ্দীন আহমদ-এর ডায়েরী, ১৮/৪/১৯৪৯।

৬২ নওবেলাল, ৫ই মে ১৯৪৯।

৬৩ তাজউদ্দীন আহমদ-এর ডায়েরী, ১৮/৪/১৯৪৯।[৬৪ পূর্বোক্ত।

৬৫

নওবেলাল, ৫ই মে ১৯৪৯।

৬৬ তাজউদ্দীন আহমদ-এর ডায়েরী, ১৯/৪/১৯৪৯।[৬৭ পূর্বোক্ত।

৬৮ পূর্বোক্ত, এবং নওবেলাল, ৫ই মে ১৯৪৯।

৬৯ নওবেলাল, ৫ই মে ১৯৪৯।

৭০ পূর্বোক্ত, এবং তাজউদ্দীন আহমদ-এর ডায়েরী, ২০/৫/১৯৪৯।

৭১

নওবেলাল, ৫ই মে ১৯৪৯।

৭২ পূর্বোক্ত।

৩১৬ | বদরুদ্দীন উমর রচনাবলী খণ্ড ২

৭৩ পূর্বোক্ত।

৭৪ পূর্বোক্ত, এবং তাজউদ্দীন আহমদ এর ডায়েরী, ২০/৪/১৯৪৯।

৭৫

নওবেলাল, ৫ই মে ১৯৪৯।

৭৬

তাজউদ্দীন আহমদ-এর ডায়েরী, ২০/৪/১৯৪৯।

৭৭ পূর্বোক্ত।

৭৮ পূর্বোক্ত।

৭৯ পূর্বোক্ত।

bo

৮১

নওবেলাল, ৫ই মে ১৯৪৯। এবং তাজউদ্দীন আহমদ-এর ডায়েরী, ২৪/৪/১৯৪৯।

তাজউদ্দীন আহমদ-এর ডায়েরী, ২৫/৪/১৯৪৯।

৮২ পূর্বোক্ত।

৮৩ নওবেলাল, ৫ই মে ১৯৪৯।

৮৪ পূর্বোক্ত, এবং তাজউদ্দীন আহমদ-এর ডায়েরী, ২৫/৪/১৯৪৯।

৮৫ পূর্বোক্ত।

৮৬ পূর্বোক্ত।

৮৭ তাজউদ্দীন আহমদ-এর ডায়েরী, ২৫/৫/১৯৪৯।

৮৮ নওবেলাল, ৫ই মে ১৯৪৯ এবং তাজউদ্দীন আহমদ-এর ডায়েরী, ২৫/৫/১৯৪৯।

৮৯ তাজউদ্দীন আহমদ-এর ডায়েরী, ২৫/৫/১৯৪৯।

৯০ পূর্বোক্ত, ২৬/৪/১৯৪৯-৩/৫/১৯৪৯।

৯১

নওবেলাল, ২১শে এপ্রিল ও ১২ই মে ১৯৪৯।

৯২ সৈনিক, ২২শে এপ্রিল, ৪৯।

৯৩ নওবেলাল, ২৬শে মে ১৯৪৯।

৯৪ তাজউদ্দীন আহমদ-এর ডায়েরী, ৭/৬/৪৯-১৫/৬/১৯৪৯।

৯৫ নওবেলাল, ৯ই জুন ১৯৪৯।

৯৬

তাজউদ্দীন আহমদ-এর ডায়েরী, ২১/১/৫০।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *