১. সূত্রপাত

প্রথম পরিচ্ছেদ – সূত্রপাত

১. গণ-আজাদী লীগ

১৯৪৭ সালের ৩রা জুন বৃটিশ-ভারতের সর্বশেষ গভর্নর জেনারেল লর্ড মাউন্টব্যাটেন তাঁর রোয়েদাদ ঘোষণা করেন। এই ঘোষণার পর মুসলিম লীগের অল্পসংখ্যক বামপন্থী কর্মীদের উদ্যোগে জুলাই মাসে ঢাকায় ‘গণ-আজাদী লীগ’ নামে একটি ক্ষুদ্র সংগঠন গঠিত হয়। ‘আশু দাবী কর্মসূচী আদর্শ’ এই নামে তাঁরা একটি ম্যানিফেস্টো প্রকাশ করেন এবং তাতে তাঁদের মধ্যে এক নোতুন চেতনার উন্মেষ লক্ষিত হয়। প্রথমেই নিজেদের আদর্শ ও কর্মসূচীর যৌক্তিকতাস্বরূপ তাঁরা ঘোষণা করেন:

দেশের স্বাধীনতা ও জনগণের স্বাধীনতা দুইটি পৃথক জিনিস। বিদেশী শাসন হইতে একটি দেশ স্বাধীনতা অর্জন করিতে পারে; কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, সেই দেশবাসীরা স্বাধীনতা পাইল। রাজনৈতিক স্বাধীনতার কোন মূল্যই নাই, যদি স্বাধীনতা জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি আনয়ন না করে? কারণ, অর্থনৈতিক মুক্তি ব্যতীত সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নতি সম্ভব নয়। সুতরাং, আমরা স্থির করিয়াছি পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য আমরা সংগ্রাম চালাইয়া যাইতে থাকিব। এতদুদ্দেশ্যে আমরা দেশবাসীর সম্মুখে আদর্শ ও কর্মসূচী উপস্থিত করিতেছি।[১]

পাকিস্তানে নাগরিক অধিকার অব্যাহত রাখা এবং সুদৃঢ় করার জন্যে এই ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠানটির প্রচেষ্টা শক্তিশালী এবং দীর্ঘস্থায়ী না হলেও প্রথম উদ্যোগ হিসাবে উল্লেখযোগ্য। ঢাকাস্থ মুসলিম লীগ কর্মীদের অন্যতম প্রধান নেতা কমরুদ্দিন আহমদ গণ-আজাদী লীগের আহ্বায়ক নিযুক্ত হন। সেদিক থেকেও প্রতিষ্ঠানটির উদ্যোগ তাৎপর্যপূর্ণ। স্বাধীনতার পূর্বে বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগ একটি বিরাট গণপ্রতিষ্ঠানে পরিণত হয় এবং ১৯৪৪ সালেই তার সদস্য সংখ্যা দাঁড়ায় পাঁচ লক্ষেরও বেশী।[২] কিন্তু তা সত্ত্বেও কৃষক মজুর নিম্নমধ্যবিত্তের স্বার্থ রক্ষার সংগ্রামে মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠানগণভাবে মোটেই সচেতন হয় নি। উপরন্তু তেভাগা আন্দোলন এবং সেই সংক্রান্ত বিলকে প্রাদেশিক পরিষদে বানচাল করার ক্ষেত্রে মুসলিম লীগের জোতদার শ্রেণীভুক্ত প্রভাবশালী সদস্যদের ষড়যন্ত্র সংগঠনের অপেক্ষাকৃত প্রগতিশীল মহলে যথেষ্ট হতাশার সঞ্চার করে। ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত অব্যাহত তেভাগা আন্দোলনে মুসলিম লীগ নেতৃত্ববৃন্দের এক বিরাট শক্তিশালী অংশের প্রতিক্রিয়াশীল ভূমিকার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটির চরিত্রও উদঘাটিত হয়।

গণ-আজাদী লীগের ম্যানিফেস্টোটি কোন শক্তিশালী সংগঠনের ঘোষণা ছিল না। সে ঘোষণা ছিলো মুসলিম লীগ কর্মীদেরই একটি প্রগতিশীল অংশের আত্মসমালোচনা এবং আত্মোপলব্ধির ঘোষণা। এতে তাঁরা আরও বলেন:

সত্যিকার পাকিস্তান অর্থে আমরা বুঝি, জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি। সুতরাং আমাদের এখন কর্তব্য এই নবীন পূর্ব পাকিস্তান রাষ্ট্রকে সুন্দরভাবে গঠিত করা, এবং মানুষের মধ্যে বৈপ্লবিক দৃষ্টিভঙ্গী আনয়ন করা।[৩]

যে বৈপ্লবিক দৃষ্টিভঙ্গি আনয়ন করার কথা উপরোদ্ধৃত অংশে বলা হয়েছে সে দৃষ্টিভঙ্গী অনেকাংশে সমাজতন্ত্রমুখী। তবে এই ঘোষণা যে মুসলিম লীগ চিন্তার প্রভাব মুক্ত নয় তার প্রমাণও এর মধ্যে আছে। এ জন্যে আশু দাবী হিসাবে একদিকে বলা হচ্ছে ‘লাঙল যার জমি তার’ ভিত্তিতে জমির বিলি ব্যবস্থা করিতে হইবে। তেভাগা বিল পাশ করিতে হইবে এবং বিল পাশ হইবার পূর্বে একটি অর্ডিন্যান্স দ্বারা এই বিলটি চালু হইবে।’[৪] এবং ‘বিনা খেসারতে জমিদারী প্রথার উচ্ছেদ করিতে হইবে এবং জমির উপর হইতে সর্বপ্রকার মধ্যস্বত্ব লোপ করিতে হইবে।[৫] অন্যদিকে আবার বলা হচ্ছে ‘মুসলমানদের জাকাত সরকার সংগ্রহ করিতে পারেন। এই টাকা মুসলিম শিক্ষার জন্য খরচ করিতে পারা যাইবে। কারণ, জাকাতের টাকা সব খাতে খরচ করা যায় না।[৬] এবং মসজিদকে ভিত্তি করিয়া জনগণের নিরক্ষরতা দূরীকরণের একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করা যাইতে পারে।[৭]

গণ-আজাদী লীগের এই ঘোষণাটিতে শিক্ষা ও ভাষা বিষয়ে যে দাবী করা হয় সেটা বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের খসড়া ম্যানিফেস্টো ব্যতীত এই জাতীয় অন্য কোন দলিলের মধ্যে এর পূর্বে দেখা যায়নি। বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের তদানীন্তন সম্পাদক আবুল হাশিম কর্তৃক প্রাদেশিক কাউন্সিলের সামনে পেশ করার জন্যে ১৯৪৬ সালে প্রণীত খসড়া ম্যানিফেস্টোটিতে* শিক্ষার অধিকার সম্পর্কে যে কয়েকটি গণতান্ত্রিক অধিকারের উল্লেখ ছিলো তার মধ্যে মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদানের বিষয়টি ছিলো অন্যতম।[৮] আলোচ্য ঘোষণাটিতে মাতৃভাষা, শিক্ষার মাধ্যম এবং রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়। যেমন: ‘মাতৃভাষার সাহায্যে শিক্ষাদান করিতে হইবে[৯] এবং বাংলা আমাদের মাতৃ ভাষা। এই ভাষাকে দেশের যথোপযোগী করিবার জন্য সর্বপ্রকার ব্যবস্থা করিতে হইবে। বাংলা হইবে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।[১০]

[*সপ্তম পরিচ্ছেদের বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগ শীর্ষক অংশ দ্রষ্টব্য।]

বাংলা হইবে পূর্ব-পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা- এর দ্বারা গণ-আজাদী লীগের মুখপাত্রেরা কি বলতে চেয়েছিলেন তা খুব স্পষ্ট নয়। তবে ঘোষণাটির মধ্যে বিশেষভাবে লক্ষণীয় ব্যাপার এই যে, তার মধ্যে যে সকল দাবী-দাওয়ার কথা আছে সেগুলি প্রায় সবই পূর্ব- পাকিস্তান সম্পর্কে। সারা পাকিস্তানে কি হওয়া উচিত সে সম্পর্কে তাঁদের যেন কোন বক্তব্যই নেই। শুধু ভাষার প্রশ্নেই নয়, অন্যান্য সকল প্রশ্ন সম্পর্কেও তাঁদের ঐ একই মনোভাব। ম্যানিফেস্টোটি এমনভাবে লিখিত যেন পূর্ব-পাকিস্তান একটি সম্পূর্ণ পৃথক রাষ্ট্র, তার সাথে পশ্চিম পাকিস্তানের কোন সম্পর্ক নেই। এর একটা সম্ভাব্য ব্যাখ্যা এই যে, তখনো পর্যন্ত মুসলিম লীগ বাঙলাদেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কোন সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হতে সক্ষম হয়নি। কাজেই গণ-আজাদী লীগের মুখপত্রদের হয়তো ধারণা ছিলো যে পাকিস্তানের দুই অংশে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন এমনভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে যার ফলে পূর্ব-পাকিস্তানকে একটি রাষ্ট্রীয় একক হিসাবে মোটামুটিভাবে গণ্য করা যেতে পারবে।

গণ-আজাদী লীগের বৈঠকগুলি অনুষ্ঠিত হয় জিন্দাবাহার প্রথম গলিতে কমরুদ্দীন আহমদের বাসায়। মোহাম্মদ তোয়াহা, অলি আহাদ, তাজউদ্দীন আহমদ এবং কমরুদ্দীন আহমদ যৌথভাবে কিছুসংখ্যক কর্মীদেরকে একত্রিত করেন। এঁরা সকলেই মুসলিম লীগের প্রতি আস্থা হারিয়েছিলেন এবং স্বাধীনতার পর এদেশে অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি গঠনের চিন্তা করছিলেন। উপরে আলোচিত ম্যানিফেস্টোটি সেই চিন্তারই ফল। নাগরিক অধিকার সংক্রান্ত বিষয়েই এই সংগঠনটির কাজকর্ম সীমাবদ্ধ ছিলো। ১৯৫০ সালের ফেব্রুয়ারীতে সংগঠনটির নাম পরিবর্তিত হয়ে দাঁড়ায় সিভিল লিবার্টিস লীগ।[১১]

২. ডক্টর শহীদুল্লাহর অভিমত

১৯৪৭ সালের জুলাই মাসে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ডক্টর জিয়াউদ্দীন আহমদ হিন্দীকে ভারতের রাষ্ট্রভাষা করার সুপারিশের অনুকরণে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার সপক্ষে অভিমত ব্যক্ত করেন। এই বক্তব্যের বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠানগতভাবে কোন প্রতিবাদ কেউ করেনি। মুসলিম লীগ মহলেও এ নিয়ে কোন বিতর্কের সূচনা হয়নি। কিন্তু জিয়াউদ্দীন আহমদের এই সুপারিশের অসারতা সম্পর্কে পূর্ব-পাকিস্তানের জনসাধারণ ও শিক্ষিত সমাজকে অবহিত করার উদ্দেশ্যে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা সমস্যা’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধ দৈনিক আজাদ পত্রিকায় প্রকাশ করেন।[১২] এ প্রবন্ধে তিনি বলেন :

কংগ্রেসের নির্দিষ্ট হিন্দীর অনুকরণে উর্দু পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষারূপে গণ্য হইলে তাহা শুধু পশ্চাদগমনই হইবে। …ইংরেজী ভাষার বিরুদ্ধে একমাত্র যুক্তি এই যে, ইহা পাকিস্তান ডোমিনিয়নের কোনও প্রদেশের অধিবাসীরই মাতৃভাষা নয়। উর্দুর বিপক্ষেও একই যুক্তি প্রযোজ্য। পাকিস্তান ডোমিনিয়নের বিভিন্ন অঞ্চলের অধিবাসীদের মাতৃভাষা বিভিন্ন, যেমন— পশতু, বেলুচী, পাঞ্জাবী, সিন্ধী এবং বাংলা; কিন্তু উর্দু পাকিস্তানের কোনও অঞ্চলেই মাতৃভাষারূপে চালু নয়। যদি বিদেশী ভাষা বলিয়া ইংরেজী ভাষা পরিত্যক্ত হয়, তবে বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষারূপে গ্রহণ না করার পক্ষে কোন যুক্তি নাই। যদি বাংলা ভাষার অতিরিক্ত কোন রাষ্ট্রভাষা গ্রহণ করতে হয়, তবে উর্দু ভাষার দাবী বিবেচনা করা কর্তব্য।[১৩]

এখানে একটি জিনিস বিশেষভাবে লক্ষণীয়। উর্দুর দাবী বিবেচনার ক্ষেত্রে ডক্টর শহীদুল্লাহ ধর্মের প্রসঙ্গ একেবারেই উত্থাপন করেননি। এক শ্রেণীর লোকে উর্দুর সপক্ষে অভিমত প্রকাশ করেন শুধু এই যুক্তিতে যে উর্দুর সাথে ইসলামের যোগাযোগ বাংলা ভাষার থেকে ঘনিষ্ঠ। শহীদুল্লাহ সাহেব এ ব্যাপারে কিছু উল্লেখ করার প্রয়োজন বোধ করেননি। তাঁর মতে আরবী ভাষাই বিশ্বের মুসলমানদের জাতীয় ভাষা।[১৪] সেই হিসাবে তিনি মনে করেন যে আরবী ভাষাকেও অন্যতম রাষ্ট্রভাষারূপে গ্রহণ করা যেতে পারে।[১৫] তবে ধর্মীয় ভাষা হিসাবে উর্দুর কোন স্থান নেই। ডক্টর শহীদুল্লাহ তাঁর প্রবন্ধটির শেষে বলেন:

বাংলাদেশের কোর্ট ও বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষার পরিবর্তে উর্দু বা হিন্দী ভাষা গ্রহণ করা হইলে, ইহা রাজনৈতিক পরাধীনতারই নামান্তর হইবে। ডাঃ জিয়াউদ্দীন আহমদ পাকিস্তানের প্রদেশসমূহের বিদ্যালয়ে শিক্ষার বাহনরূপে প্রাদেশিক ভাষার পরিবর্তে উর্দু ভাষার সপক্ষে যে অভিমত প্রকাশ করিয়াছেন আমি একজন শিক্ষাবিদরূপে উহার তীব্র প্রতিবাদ জানাইতেছি। ইহা কেবলমাত্র বৈজ্ঞানিক শিক্ষা ও নীতি বিরোধীই নয়, প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন ও আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের নীতি বিগর্হিতও বটে।[১৬]

এই প্রবন্ধটির পর ডক্টর শহীদুল্লাহ ১৭ই পৌষ, ১৩৫৪ তকবীর পত্রিকায় ‘পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষার ভাষা সমস্যা’ নামে আর একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন।[১৭] এই প্রবন্ধটিতে তিনি বাংলা, আরবী, উর্দু এবং ইংরেজী ভাষা সম্পর্কে পূর্ব-পাকিস্তানীদের নীতি কি হওয়া উচিত সে বিষয়ে আলোচনা করেন। বাংলা সম্পর্কে তিনি বলেন:

হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে প্রত্যেক বাঙ্গালীর জন্য প্রাথমিক শিক্ষণীয় ভাষা অবশ্যই বাঙলা হইবে। ইহা জ্যামিতির স্বীকৃত বিষয়ের ন্যায় স্বতঃসিদ্ধ। উন্মাদ ব্যতীত কেহই ইহার বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করিতে পারে না। এই বাঙ্গালাই হইবে পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক রাষ্ট্রভাষা।[১৮]

আরবী সম্পর্কে তাঁর অভিমত:

মাতৃভাষার পরেই স্থান ধর্মভাষার, অন্ততঃ মুসলমানের দৃষ্টিতে। …এই জন্য আমি আমার প্রাণের সমস্ত জোর দিয়া বলিব, বাঙ্গালার ন্যায় আমরা আরবী চাই। সেদিন পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম সার্থক হইবে, যেদিন আরবী সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষারূপে গৃহীত হইবে। …কিন্তু বর্তমানে আরবী পাকিস্তান রাষ্ট্রের একটি বৈকল্পিক ভাষা ভিন্ন একমাত্র রাষ্ট্রভাষারূপে গ্রহণের যথেষ্ট অন্তরায় আছে।[১৯]

উর্দু শিক্ষা সম্পর্কে ডক্টর শহীদুল্লাহ বলেন:

পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রদেশের জনগণের মধ্যে যোগ স্থাপনের জন্য, যাঁহারা উচ্চ রাজকর্মচারী কিংবা রাজনীতিক হইবেন তাঁহাদের জন্য একটি আন্তঃপ্রাদেশিক ( Interprovincial) ভাষা শিক্ষা করা প্রয়োজন। এই ভাষা উচ্চ শিক্ষিতদের জন্য ইংরেজীই আছে। ইহা অনস্বীকার্য বাস্তব ব্যাপার (Fact)। কিন্তু জনসাধারণের মধ্যে ইহা চলে না। তজ্জন্য উর্দুর আবশ্যকতা আছে। … এইজন্য রাজনৈতিক কারণে পাকিস্তান রাষ্ট্রের উচ্চ রাজকর্মচারী ও রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষী প্রত্যেক নাগরিকেরই উর্দু শিক্ষা করা কর্তব্য।[২০]

ইংরেজীকে পাকিস্তানের অন্যতম ভাষারূপে চালু রাখার সপক্ষে তিনি নিম্নোক্ত অভিমত প্রকাশ করেন:

আমরা পাকিস্তান রাষ্ট্রকে একটি আধুনিক প্রগতিশীল রাষ্ট্ররূপে দেখিতে চাই। তজ্জন্য ইংরেজী, ফরাসী, জার্মান, ইতালীয়ান বা রুশ ভাষাগুলির মধ্যে যে কোন একটি ভাষা আমাদের উচ্চশিক্ষার পঠিতব্য ভাষারূপে গ্রহণ করিতে হইবে। এই সকলের মধ্যে অবশ্য আমরা ইংরেজীকেই বাছিয়া লইব। ইহার কারণ দুইটি – ১. ইংরেজী আমাদের উচ্চ শিক্ষিতদের নিকট সুপরিচিত; ২. ইংরেজী পৃথিবীর মধ্যে সর্বাপেক্ষা অধিক প্রচলিত আন্তর্জাতিক ভাষা। আমি এই ইংরেজীকেই বর্তমানে পাকিস্তান রাষ্ট্রের অন্যতম রাষ্ট্রভাষারূপে বজায় রাখিতে প্রস্তাব করি।[২১]

ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহর উপরোক্ত ভাষা বিষয়ক মন্তব্য এবং সুপারিশগুলির মধ্যে অনেক জটিলতা এবং পরস্পরবিরোধিতা থাকলেও এগুলির গুরুত্ব অনস্বীকার্য। এ জটিলতা এবং পরস্পরবিরোধী চিন্তা তাঁর মধ্যেই শুধু ছিলো না। সমসাময়িক রাজনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ এবং জনসাধারণের চিন্তার মধ্যেও এ জটিলতা এবং পরস্পরবিরোধিতা যথেষ্ট পরিমাণে বিদ্যমান ছিলো।

৩. গণতান্ত্রিক যুব লীগ

১৯৪৭ সালের ১৪ই অগাস্টের পর কলকাতার সিরাজউদ্দৌলা হোটেলে কিছুসংখ্যক রাজনৈতিক কর্মী ও ছাত্রেরা পূর্ব পাকিস্তানে তাঁদের পরবর্তী কর্তব্য এবং কর্মপন্থা নির্ধারণের জন্যে সমবেত হয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন আতাউর রহমান (রাজশাহী), কাজী মহম্মদ ইদরিস, শহীদুল্লাহ কায়সার, আখলাকুর রহমান, একরামুল হক, আবদুর রশীদ খান প্রভৃতি। এ ব্যাপারে তাঁরা কমিউনিস্ট পার্টির আহাম্মদ রুহুল ও অন্যান্য নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের সাথে আলাপ-আলোচনা করেন। এইসব আলোচনার পর স্থির হয় যে স্বাধীনতা উত্তর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পাকিস্তানে অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক আন্দোলন এবং তার উপযুক্ত সংগঠন গঠন করা প্রয়োজন।[২২]

এরপর উপরোক্ত রাজনৈতিক কর্মীদের কয়েকজন ঢাকা এসে কমরুদ্দীন আহমদ, শামসুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদ, শাসমুদ্দীন আহমদ, তসদ্দুক আহমদ, মোহাম্মদ তোয়াহা, অলি আহাদ, আবদুল ওদুদ, হাজেরা মাহমুদ প্রভৃতির সাথে প্রাথমিক যোগাযোগ স্থাপন করেন। নোতুন পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক কর্মপন্থা নির্ধারণের জন্যে একটি সম্মেলন আহ্বানের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে তাঁরা সকলেই একমত হন এবং এ ব্যাপারে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দান করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অমিয় চক্রবর্তী এবং অজিত বসুও এ ব্যাপারে যথেষ্ট আগ্রহশীল ছিলেন।[২৩]

এই প্রাথমিক আলাপ আলোচনার পর নেতৃস্থানীয় কর্মীরা সারা পূর্ব বাঙলাকে কতকগুলি এলাকাতে ভাগ করে সেখানকার কর্মীদের সাথে সম্মেলন সংক্রান্ত ব্যাপারে যোগাযোগ স্থাপনের জন্যে সফর শুরু করেন। এই সফরের পর বেশ কিছুসংখ্যক কর্মী সম্মেলনে যোগদান করতে সম্মত হন এবং ১৯৪৭ সালের ২৪শে অগাস্ট ঢাকায় রাজনৈতিক কর্মীদের এই সম্মেলন অনুষ্ঠানের তারিখ নির্ধারিত হয়।[২৪]

৩১শে জুলাই সম্মেলনের জন্যে একটি অভ্যর্থনা কমিটি গঠিত হয়। কফিলউদ্দীন চৌধুরী এবং শামসুল হক যথাক্রমে সেই কমিটির সভাপতি এবং সম্পাদক মনোনীত হন। সম্মেলনের জন্যে একটি খসড়া ম্যানিফেস্টো ৫ই অগাস্ট ম্যানিফেস্টো নির্বাচন কমিটিতে পেশ করার পর সামান্য পরিবর্তিত হয়ে সেটি গৃহীত হয়। এই সভায় যাঁরা উপস্থিত ছিলেন তাঁদের মধ্যে মোহাম্মদ তোয়াহা, কমরুদ্দীন আহমদ, আজিজ আহমদ, নজমুল করিম, অলি আহাদ, তসদ্দুক আহমদ এবং তাজউদ্দীন আহমদের নাম উল্লেখযোগ্য। এই সভাতে আরও সিদ্ধান্ত হয় যে ম্যানিফেস্টোটি মুসলিম লীগেরই অন্তর্গত একটি পৃথক পার্টির নামে প্রকাশ করা হবে।[২৫]

সম্মেলন শুরু হওয়ার অল্প কয়েকদিন পূর্বে নানা অসুবিধার জন্যে সম্মেলনের তারিখ পরিবর্তিত হয় কিন্তু জেলা প্রতিনিধিদেরকে সময়মতো খবর দিতে না পারার জন্যে তাঁরা অনেকে নির্ধারিত তারিখের পূর্বদিন অর্থাৎ ২৩শে অগাস্ট ঢাকায় উপস্থিত হন। এইসব কর্মীদের নিয়ে সেদিন ১৫০ মোগলটুলীর মুসলিম লীগ অফিসে কমরুদ্দীন আহমেদের সভাপতিত্বে একটি সভা হয়। এই সভায় ত্রিপুরা, নোয়াখালী, বরিশাল, ময়মনসিংহ, সিলেট, ঢাকা এবং উত্তর বাঙলার কয়েকটি জেলার প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।[২৬] মুসলিম লীগ সরকার এই সম্মেলনটিকে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক কর্মীদের সমাবেশ বলে ধরে নিয়েছিলেন। ফলে বহু চেষ্টা সত্ত্বেও বার লাইব্রেরী হল ধরনের কোন জায়গায় এই সম্মেলন অনুষ্ঠানের অনুমতি লাভ সম্ভব হয়নি।[২৭] শুধু তাই নয়, অনুমতি পাওয়া গেলেও শহরের প্রতিকূল অবস্থার জন্যে সেখানে সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়া সম্ভবপরও ছিলো না। কাজেই শেষ পর্যন্ত ঢাকা মিউনিসিপ্যালিটির ভূতপূর্ব ভাইস চেয়ারম্যান, খান সাহেব আবুল হাসনাত আহমদের বাসায় এই সম্মেলনের স্থান নির্ধারিত হয়।[২৮]

এই সময়কার ছাত্র রাজনীতির কয়েকটি ঘটনা খুব উল্লেখযোগ্য; কারণ সেগুলি আসন্ন সম্মেলনটির কর্মসূচী ইত্যাদির উপর যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করে।

দেশ বিভাগের পূর্বে নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্র লীগ নামে মুসলিম ছাত্রদের যে সংগঠন ছিলো তার কিছুসংখ্যক সদস্য ১৯৪৭ এর অগাষ্ট মাসে ঢাকায় চলে আসেন। কলকাতা থেকে আগত এই সমস্ত ছাত্রদের মধ্যে প্রায় সকলেই ছিলেন সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন। ঢাকার ছাত্রদের মধ্যে সে সময় তাঁদের বিশেষ প্রভাব ছিলো না, কিন্তু তা সত্ত্বেও তাঁরা পূর্ব- পাকিস্তানের নোতুন করে একটি সাম্প্রদায়িক ছাত্র প্রতিষ্ঠান গঠন করার কথা চিন্তা করছিলেন। কিন্তু এই ছাত্রদের মধ্যে শাহ্ আজিজুর রহমান ও শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে উপদলীয় ঝগড়ার ফলে পুরাতন ছাত্র সংগঠনকে অবলম্বন করে নোতুন একটা সংগঠন গড়ে তোলা তাঁদের পক্ষে সম্ভব হয়নি।[২৯]

ঢাকার ছাত্রদের মধ্যেও এই সময় নোতুন প্রতিষ্ঠান গঠন সম্পর্কে নানা আলাপ-আলোচনা শুরু হয়। নঈমুদ্দীন আহমদ, আজিজ আহমদ, মোহাম্মদ তোয়াহা, অলি আহাদ, তাজউদ্দীন আহমদ প্রমুখ নেতৃস্থানীয় ছাত্রেরা একটি অসাম্প্রদায়িক ছাত্র প্রতিষ্ঠান গঠনের পক্ষপাতী ছিলেন।[৩০] ছাত্র ফেডারেশন নামে একটি প্রগতিশীল অসাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠান তখনো পর্যন্ত ছিলো কিন্তু কমিউনিস্টদের সাথে তাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকার জন্য মুসলমান ছাত্রেরা সরাসরিভাবে তাতে যোগদানের পক্ষাপাতী ছিলেন না।

উপরোল্লিখিত যে সমস্ত ছাত্রেরা অসাম্প্রদায়িক ছাত্র প্রতিষ্ঠান এবং অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির কথা চিন্তা করছিলেন তাঁদের মধ্যেও আলাপ-আলোচনাকালে কিছু মতপার্থক্য দেখা দেয়। তাঁদের মধ্যে কেউ সরাসরি একটি অসাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার উপর জোর দিলেও অন্যরা বাস্তব অবস্থার কথা বিবেচনা করে মনে করেন যে, তখনো পর্যন্ত পুরোপুরি অসাম্প্রদায়িক ছাত্র প্রতিষ্ঠানের জন্য মুসলমান ছাত্রেরা প্রস্তুত ছিলো না। কাজেই তাঁরা প্রস্তাব করেন যে আনুষ্ঠানিকভাবে সংগঠনের নাম ‘মুসলিম ছাত্র লীগ’ রাখা হোক কিন্তু কাজকর্মের মধ্যে দিয়ে ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠানটিকে পরিশেষে একটি অসাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার কাজও অব্যাহত থাকুক। পাছে প্রতিষ্ঠানটিকে কমিউনিস্ট প্রতিষ্ঠান বলে বিরোধী পক্ষীয় ছাত্র এবং সরকার-সংশ্লিষ্ট মহল আক্রমণ করতে না পারে বিশেষ করে তার জন্যেই এই দ্বিতীয় প্রস্তাবটি উত্থাপিত হয়। এই প্রাথমিক আলোচনা অবশ্য প্রকাশ্য সভায় কোনদিন উত্থাপিত হয়নি, অত্যন্ত অল্প সংখ্যক উদ্যোগী এবং নেতৃস্থানীয় ছাত্রদের মধ্যেই তা সীমাবদ্ধ ছিলো।[৩১]

এই ছাত্র প্রতিষ্ঠানটি গঠনের উদ্দেশ্যে ৩১শে অগাস্ট ফজলুল হক হলে ঢাকার সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রদের একটি সভা আহ্বান করা হয়।[৩০শে অগাস্ট নাজির লাইব্রেরীতে একটি ঘরোয়া বৈঠকে নঈমুদ্দীন আহমদ, আজিজ আহমদ, তাজউদ্দীন আহমদ প্রভৃতি পরদিনের সভাতে ‘মুসলিম’ শব্দটি ব্যবহার না করার বিষয়ে একমত হন। স্থির হয় যে, নঈমুদ্দীন আহমদ প্রথমেই সভার উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করে বক্তৃতা করবেন। সভাতে ঢাকা শহরের জন্য একটি অস্থায়ী সাংগঠনিক কমিটি গঠনের সিদ্ধান্তও এই বৈঠকে গ্রহণ করা হয়।[৩২]

৩১শে অগাস্ট বিকেলের দিকে ছাত্রেরা দলে দলে ফজলুল হক হলে সমবেত হতে শুরু করেন। এই সময় জাহের, দলিল, মুখলেস প্রভৃতিকে সাথে নিয়ে সালেক এবং তারপর নিজাম ও আলাউদ্দিনের নেতৃত্বে কলতাবাজারের কিছুসংখ্যক ছেলে সেখানে উপস্থিত হয়। তারা প্রকৃতপক্ষে সেদিনকার সেই সভা পণ্ড করার উদ্দেশ্যেই হাজির হয়েছিলো। কাজেই পূর্ব পরিকল্পনা অনুসারে সভা আরম্ভ হওয়ার কিছু পূর্বেই সালেক সভাপতির আসন অধিকার করে বসলো। ফজলুল হক হল ইউনিয়নের সহ-সভাপতি মোয়াজ্জেম চৌধুরী সভাপতি হিসাবে হাবিবুর রহমানের নাম প্রস্তাব করেন এবং তা যথারীতি সমর্থিত হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও সালেক সভাপতির চেয়ার পরিত্যাগ করতে অস্বীকার করে। এর ফলে চারিদিকে হৈ চৈ এবং মারপিট শুরু হয় এবং প্রধানতঃ সালেকের প্রতিই সকলের দৃষ্টি পড়ে। হেদায়েত, ইসমাইল, মোয়াজ্জেম চৌধুরী এবং অন্যান্য ছাত্রেরা খুবই উত্তেজিত হয়ে উঠে সালেককে ধরে দারুণভাবে মারপিট করে। গুণ্ডারাও এইভাবে ছাত্রদের কাছে মার খেয়ে হেরে যাওয়ার উপক্রম হয়। সালেকের শরীর মারের আঘাতে রক্তাক্ত ও ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায়। সে অবশেষে দৌড়ে পালিয়ে রেলওয়ে হাসপাতালের কাছাকাছি একটি বাড়ীতে আশ্রয় গ্রহণ করে।[৩৩]

গুণ্ডা ছাত্রদেরকে বিতাড়িত করার পর হাবিবুর রহমানের সভাপতিত্বে সভার কাজ যথারীতি শুরু হয়। প্রথমেই সভার উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করেন নঈমুদ্দীন আহমদ এবং পরে মোয়াজ্জেম চৌধুরী, মতিউর রহমান ও অন্যান্য কয়েকজন বক্তৃতা করে গুণ্ডামীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন। সভা এইভাবে ঘণ্টাখানেক চলার পর শাহ আজিজদের দলভুক্ত ইব্রাহিম এবং সুলতান সভাস্থলে প্রবেশ করে সভাপতির সাথে সরাসরি ঝগড়া শুরু করে। এর ফলে সভায় দারুণ হৈ চৈ আরম্ভ হয় এবং প্রভোস্ট মাহমুদ হোসেন সেখানে উপস্থিত হয়ে সকলকে সভাস্থল ত্যাগ করতে অনুরোধ করেন। ঠিক এই সময়ে একটি ট্রাকে করে কলতাবাজার এলাকার বেশ কিছুসংখ্যক গুণ্ডা ছোরা-ছুরি, রড ইত্যাদি নিয়ে ফজলুল হক হলের কম্পাউণ্ডে উপস্থিত হয়ে মোয়াজ্জেম, আজিজ আহমদ, খায়ের হেদায়েত প্রভৃতিকে আক্রমণ করতে উদ্যত হয়। কিন্তু পুনর্বার মাহমুদ হোসেন ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে গুণ্ডাদেরকে ধমকে হল থেকে তাড়িয়ে দেন। এই সমস্ত গণ্ডগোলের ফলে সেদিনকার সভায় যথেষ্ট ছাত্র সমাবেশ সত্ত্বেও ঢাকা শহর সাংগঠনিক কমিটি গঠন অথবা অন্য কোন সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ সম্ভবপর হয়নি।

ছাত্রদের হাতে মার খাওয়ার পর সালেক শহরের বিভিন্ন এলাকায় তার ক্ষত চিহ্নগুলি দেখিয়ে উত্তেজনা সৃষ্টির চেষ্টা করে এবং তার ফলে শহরের বহু লোকে ছাত্রদের উপর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। তারা প্রচার করে যে নাজিমুদ্দীন এবং পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ছাত্রেরা সভা করছিলো এবং সেই সভা ভেঙে দিতে যাওয়ার জন্যে ছাত্রেরা সালেকের উপর হামলা করেছে। মোটকথা সেদিনকার ঘটনাকে কেন্দ্র করে শহরে বেশ কয়েকদিন উত্তেজনা বিরাজ করতে থাকে।

যে ট্রাকটিতে চড়ে গুণ্ডারা ফজলুল হক হলে এসেছিলো তাজউদ্দীন আহমদ তার নম্বর টুকে রেখেছিলেন (BGD 629) এবং খোঁজ নিয়ে তাঁরা জানতে পারেন যে সেটি ছিলো পূর্ব বাঙলা সরকারের সিভিল সাপ্লাই ডিপার্টমেন্টের। একথা জানার পর তাজউদ্দীন আহমদ, শামসুদ্দীন আহমদ, মোয়াজ্জেম চৌধুরী এবং আরও তিনজন ছাত্র ২রা সেপ্টেম্বর বেসামরিক সরবরাহ বিভাগের মন্ত্রী নূরুল আমীনের বাড়ীতে গিয়ে সমস্ত ব্যাপারটির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান এবং সংশ্লিষ্ট অপরাধীদের উপযুক্ত শাস্তি দাবী করেন। নূরুল আমীন কিন্তু ছাত্রদেরকে বলেন যে সিভিল সাপ্লাই বিভাগের কোন কর্মচারীর ছেলে যদি ট্রাকটিকে ঐভাবে ব্যবহার করে থাকে তাহলে সে সম্পর্কে তাঁর করার কিছু নেই। ছাত্রেরা তখন তাঁকে জানান যে ট্রাকের সঠিক নম্বর তাঁদের কাছে আছে কাজেই তিনি অনায়াসে তার থেকে বের করতে পারেন কে প্রকৃতপক্ষে এই ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্ট এবং তারপর তাকে শাস্তিদানের ব্যবস্থাও করতে পারেন। কিন্তু নূরুল আমীন শেষ পর্যন্ত এ ব্যাপারে কোন কিছুই করেননি। এ ব্যাপারে তাঁর নিষ্ক্রিয়তার কারণ ছাত্রদের মধ্যে তাঁদের নিজেদের লোকরাই এ কাজ করেছিলো এবং তিনি সে কথা জানতেন।[৩৪]

যুব সম্মেলনের পরিবর্তিত তারিখ নির্ধারিত হয়েছিলো ৬ই ও ৭ই সেপ্টেম্বর। সরকার পক্ষীয় লোকেরা সম্মেলনটিকে পণ্ড করার জন্য নানা ব্যবস্থা অবলম্বন করে। ৫ই সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা আটটার দিকে ইব্রাহিম, ইরতিজা প্রভৃতি কয়েকজন মুসলিম লীগ অফিসের কাছাকাছি এবং অন্যান্য এলাকাতে সম্মেলনের বিরুদ্ধে ইস্তাহার বিলি করে গণ্ডগোল সৃষ্টির চেষ্টা করে। ৬ই সেপ্টেম্বরও তারা একটি ট্রাকে চড়ে সমস্ত শহর ঘুরে ইস্তাহার বিলি এবং সম্মেলনের বিরুদ্ধে নানা প্রকার ধ্বনি উচ্চারণ করতে থাকে।[৩৫]

যুব সম্মেলনে সকল দলের সেই সব রাজনৈতিক কর্মীদেরকে বিশেষভাবে আহ্বান করা হয়েছিলো যাঁরা ছিলেন পার্লামেন্টারী রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্কহীন। কিন্তু এই সম্মেলনের প্রায় পাঁচশত জন[৩৬] কর্মী সমবেত হলেও বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সুহরাওয়ার্দী- আবুল হাশিম গ্রুপের অন্তর্ভুক্ত এবং অন্যান্য বামপন্থী কর্মীরা ছাড়া অন্য কেউ এতে যোগদান করেননি। জেলাগুলির মধ্যে একমাত্র চট্টগ্রাম ছাড়া অন্য সব জেলার প্রতিনিধিরাই সম্মেলনটিতে উপস্থিত ছিলেন।[৩৭]

৬ই সেপ্টেম্বর দুপুর দু’টোয় খান সাহেব আবুল হাসনাতের বাসায় তসদ্দুক আহমদের সভাপতিত্বে সম্মেলন আরম্ভ হয়। সন্ধ্যে ছয়টার দিকে বিষয় নির্বাচনী কমিটি গঠিত হয় এবং সেই কমিটির সভা ভোর তিনটে পর্যন্ত চলে।[৩৮]

৭ই সেপ্টেম্বর সকাল ৯-৩০ মিনিটে সম্মেলনের কাজ আবার শুরু হয় এবং বিষয় নির্বাচনী কমিটির প্রস্তাবগুলি সবই একে একে শান্তিপূর্ণভাবে গৃহীত হয়। এই প্রস্তাবগুলি প্রধানত ছিলো গণদাবীর সনদ, খাদ্য সমস্যা এবং গণতান্ত্রিক যুব লীগ গঠন সম্পর্কে। এই দিন শামসুল হক সম্মেলনের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করে আধ ঘণ্টার একটি বক্তৃতা দান করেন।[৩৯] কর্মী সম্মেলনের উদ্দেশ্য বর্ণনা করতে গিয়ে সম্মেলনের পক্ষ থেকে প্রকাশিত গণ-দাবীর সনদের ভূমিকায় শামসুল হক বলেন:

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর কায়েদে আজম জিন্নাহ সাহেব বলিয়াছিলেন যে, তিনি তাঁহার কাজ করিয়াছেন এখন যুবকদেরই এই দেশ গড়িতে হইবে। কর্মী সম্মেলনেরও উদ্দেশ্য ছিল এমন একটি কর্মপন্থা স্থির করা যাহাতে পূর্ব পাকিস্তানের সকল হিন্দু-মুসলমান যুবক বর্তমান অবস্থায় তাহাদের কর্তব্য বুঝিয়া আজাদ পাকিস্তান রাষ্ট্রকে সুখী, গণতান্ত্রিক ও সমৃদ্ধশালী আদর্শ রাষ্ট্র হিসাবে গড়িয়া তুলিতে অগ্রসর হইতে পারেন।[৪০]

তিনি আরও বলেন:

সম্মেলনের প্রস্তাব অনুযায়ী কর্মীদের মনের এই আদর্শবাণী পাকিস্তান রাষ্ট্রের কর্ণধারগণ রাষ্ট্রগঠন পরিষদ, দেশের নেতৃবৃন্দ এবং জনসাধারণ সকলেরই কাছে উপস্থিত করা হইবে।[৪১]

সম্মেলনের প্রধান উদ্দেশ্য সম্পর্কে শামসুল হক বলেন:

পূর্ব পাকিস্তান কর্মী সম্মেলনের সবচেয়ে বড় উদ্দেশ্য ছিল একটি ঐক্যবদ্ধ গণতান্ত্রিক যুব প্রতিষ্ঠানের কর্মসূচী তৈয়ার করা এবং সারা দেশব্যাপী এই প্রতিষ্ঠান গড়িয়া তোলার দায়িত্ব গ্রহণের জন্য কর্মীদিগকে উদ্বুদ্ধ করা। উপরোক্ত উদ্দেশ্যেই যুব সংগঠনের ইস্তাহারখানা রচিত হইয়াছে। উহাতে বলা হইয়াছে যে, নবজাতক শিশু পাকিস্তান রাষ্ট্রকে সাহায্য করার জন্য দেশে বহু যুব প্রতিষ্ঠান স্বভাবতঃই গড়িয়া উঠিবে সন্দেহ নাই, কিন্তু সকল যুবশক্তির মিলন না ঘটিলে কোন বৃহৎ কাজই করা সম্ভব হইবে না। তাই যুব সংগঠনের ইস্তাহার যুবকদের অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উন্নতি সাধন ও পূর্ণ বিকাশের জন্য সাধারণ গণতান্ত্রিক নীতির উপর ভিত্তি করিয়াই রচিত হইয়াছে। কোন বিশেষ বিতর্কমূলক সমস্যা ও তাহার সমাধানের অবতারণা ইহাতে করা হয় নাই এবং জনগণের মূল দাবীর সনদকেও সরাসরি যুব সংগঠনের ইস্তাহার বলিয়া গৃহীত হয় নাই।[৪২]

পূর্ব পাকিস্তান কর্মী সম্মেলনে নিম্নলিখিত ভাষা বিষয়ক প্রস্তাব গৃহীত হয়:

পূর্ব পাকিস্তান কর্মী সম্মেলন প্রস্তাব করিতেছে যে, বাংলা ভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষার বাহন ও আইন আদালতের ভাষা করা হউক। সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কি হইবে তৎসম্পর্কে আলাপআলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভার জনসাধারণের উপর ছাড়িয়া দেওয়া হউক এবং জনগণের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলিয়া গৃহীত হউক।[৪৩]

পাকিস্তান গণতান্ত্রিক যুবলীগের পক্ষ থেকে যুব-ইস্তাহার নামে একটি পৃথক ঘোষণা এই সম্মেলনে গৃহীত হয়। তাতে শিক্ষা, সাহিত্য এবং সংস্কৃতি সম্পর্কে বলা হয়:

নিজের মাতৃভাষায় বিনা খরচে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক শিক্ষা পাওয়ার মৌলিক অধিকার প্রত্যেক ছেলেমেয়ের রহিয়াছে এবং তাহা তাহাদের জন্য অতি প্রয়োজনীয়। জাতীয় এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সহিত সামঞ্জস্য রাখিয়া শিক্ষা ব্যবস্থার প্রবর্তন করিতে হইবে।[৪৪]

এই ঘোষণাটিতে আরও বলা হয়:

যুবকদের সকল সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক স্বাধীনতার মূল নীতিকে সর্বদা প্রাধান্য দিতে হইবে এবং যুবকেরা কার্যে যাহাতে উত্তম সঙ্গীত, নাটক সাহিত্য এবং ছবি উপভোগ করিতে ও বুঝিতে পারে তাহার সুযোগ দিতে হইবে। সাহিত্য ও সংস্কৃতির মূল্যবোধ বাড়াইবার প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য এবং বিশেষ করিয়া গ্রামাঞ্চলে প্রয়োজনীয় সুবিধা দান করিতে হইবে। এই প্রয়োজনে গড়িয়া উঠা যুবকেন্দ্র এবং যুব সংগঠনকে রাষ্ট্রীয় সাহায্য দান করিতেই হইবে।[৪৫]

এছাড়া সাংস্কৃতিক স্বাধিকার সম্পর্কে ইস্তাহারটিতে স্পষ্টভাবে দাবী করা হয়:

রাষ্ট্রের অধীনস্থ বিভিন্ন এলাকার পৃথক পৃথক সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিকাশকে সরকার স্বীকার করিয়া নিবেন, জীবন এবং সংস্কৃতিকে গড়িয়া তুলিতে এইসব এলাকার সকল ব্যাপারে স্বায়ত্তশাসন মানিয়া লইতে হইবে।[৪৬]

১৯৪৭ সালের ৬ই ও ৭ই সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিত এই কর্মী সম্মেলনে একটি স্বতন্ত্র যুব প্রতিষ্ঠান গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। সেই অনুসারে প্রায় ২৫ জন সদস্য নিয়ে পাকিস্তান গণতান্ত্রিক যুবলীগের পূর্ব পাকিস্তান সাংগঠনিক কমিটি গঠিত হয়।[৪৭] এ সম্পর্কে আরও সিদ্ধান্ত হয় যে, উপরোক্ত সাংগঠনিক কমিটি জেলা এবং অন্যান্য ইউনিটে প্রাথমিক কাজকর্ম শেষ করে ছয় মাসের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক যুবকদের একটি সম্মেলন আহ্বান করবে।[৪৮] পূর্ব পাকিস্তান কর্মী সম্মেলন এবং গণতান্ত্রিক যুবলীগ সম্পর্কিত কোন খবর তৎকালীন কোন সংবাদপত্রে ছাপা হয়নি। সরকারী এবং সরকার-সমর্থক বেসরকারী হস্তক্ষেপই তার প্রধান কারণ। ছয় মাস পর নবগঠিত সংগঠনটির উদ্যোগে একটি বর্ধিত সম্মেলন আহ্বানের যে প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিলো সেটাও কার্যকরী হয়নি। বস্তুতঃপক্ষে গণতান্ত্রিক যুবলীগ যে উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্যে গঠিত হয়েছিলো তা বেশী দিন স্থায়ী হয়নি। সংগঠনটির পক্ষ থেকে ‘গণতান্ত্রিক যুব লীগ’ নামে একটি বুলেটিন আখলাকুর রহমান এবং আতাউর রহমানের সম্পাদনায় প্রাকশিত হয়। কিন্তু মাত্র কয়েকটি সংখ্যা বের হওয়ার পরই তা বন্ধ হয়ে যায়।[৪৯]

এই কর্মী সম্মেলনের পর ২৮শে ফেব্রুয়ারী থেকে ৬ই মার্চ। ১৯৪৮ এর মধ্যে কলকাতায় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া যুব সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। তাতে দেশ-বিদেশের বহু যুব প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা যোগদান করেন। গণতান্ত্রিক যুব লীগের পক্ষে এই সময় শামসুল হক, আবদুর রহমান চৌধুরী, শহীদুল্লাহ কায়সার, লিলি খান, লায়লা আরজুমান্দ বানু প্রভৃতি যোগদান করেন। শাহ আজিজুর রহমান এবং তাঁর দলভুক্ত পূর্বতন বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম ছাত্র লীগের কিছু সদস্য এই সম্মেলনে যোগদানের চেষ্টা করলেও গণতান্ত্রিক যুব লীগের প্রতিনিধিরাই পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধিদল হিসাবে এই সম্মেলনে স্বীকৃতি লাভ করেন।[৫০]

ঢাকাতে গণতান্ত্রিক যুব সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার এক বৎসর পর ১৯৪৮-এর সেপ্টেম্বরে রাজশাহী বিভাগের যুবকেরা ঈশ্বরদীতে একটি যুব সম্মেলনে মিলিত হন।[৫১] সম্মেলনের পর ‘পাকিস্তানের যুবসমাজের প্রতি’ শীর্ষক একটি ইস্তাহার তাঁরা প্রকাশ করেন। এক বৎসরের কাজকর্মের পর্যালোচনা প্রসঙ্গে ইস্তাহারটিতে বলা হয় যে, আমাদের ‘গণদাবীর সনদ’ একটি আদর্শ পরিকল্পনাই মাত্র রহিয়া গিয়াছে, ইহাকে কার্যে পরিণত করিবার সংগ্রাম আজও গড়িয়া উঠে নাই। ইহার ফলে প্রথম কিছুটা কর্মচাঞ্চল্যের পরেই যুব লীগ ঝিমাইয়া পড়িয়াছে।[৫২]

সম্মেলনে সাধারণভাবে… রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক অবস্থার পর্যালোচনার পর তাঁরা জমিদারী উচ্ছেদ, শ্রমিক আন্দোলন ইত্যাদি সম্পর্কে কতকগুলি প্রস্তাব গ্রহণ করেন।[৫৩]

৪. তমদ্দুন মজলিশের প্রাথমিক উদ্যোগ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কতিপয় ছাত্র এবং অধ্যাপকের উদ্যোগে ১৯৪৭ সালে ২রা সেপ্টেম্বর তমদ্দুন মজলিশ নামে একটি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান গঠিত হয়। এই প্রতিষ্ঠানটি রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে আলাপ-আলোচনা সভা-সমিতি ইত্যাদি ব্যাপারে প্রথম থেকেই বেশ কিছুটা সক্রিয় হয়। তারা ১৫ই সেপ্টেম্বর ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু?’ এই নামে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করে। তাতে লেখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেন, কলকাতা থেকে প্রকাশিত দৈনিক ইত্তেহাদ-এর সম্পাদক আবুল মনসুর আহমদ। তাছাড়া এই পুস্তিকাটির প্রথম দিকে তমদ্দুন মজলিশের পক্ষে ভাষা বিষয়ক একটি প্রস্তাব সংযোজিত হয়। সেটি লেখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এবং তমদ্দুন মজলিশের প্রধান কর্মকর্তা আবুল কাসেম। নীচে সেই প্রস্তাবটি সম্পূর্ণ উদ্ধৃত হলো:

১. বাংলা ভাষাই হবে:

(ক) পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষার বাহন। (খ) পূর্ব পাকিস্তানের আদালতের ভাষা। (গ) পূর্ব পাকিস্তানের অফিসাদির ভাষা।

২. পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের ভাষা হবে দু’টি – উর্দু ও বাংলা।

৩. (ক) বাংলাই হবে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষা বিভাগের প্রধান ভাষা। ইহা পূর্ব পাকিস্তানের শতকরা একশজনই শিক্ষা করবেন।

(খ) উর্দু হবে দ্বিতীয় ভাষা। যারা পাকিস্তানের অন্যান্য অংশে চাকুরী ইত্যাদি কাজে লিপ্ত হবেন তারাই শুধু ও ভাষা শিক্ষা করবেন। ইহা পূর্ব পাকিস্তানের শতকরা ৫ হইতে ১০ জন শিক্ষা করলেও চলবে। মাধ্যমিক স্কুলের উচ্চতর শ্রেণীতে এই ভাষা দ্বিতীয় ভাষা হিসাবে শিক্ষা দেওয়া যাবে।

(গ) ইংরেজী হবে পূর্ব পাকিস্তানের তৃতীয় ভাষা বা আন্তর্জাতিক ভাষা। পাকিস্তানের কর্মচারী হিসাবে যারা পৃথিবীর অন্যান্য দেশে চাকুরী করবেন বা যাঁরা উচ্চতর বিজ্ঞানশিক্ষায় নিয়োজিত হবেন তাঁরাই শুধু ইংরেজী শিক্ষা করবেন। তাদের সংখ্যা পূর্ব পাকিস্তানের হাজার করা ১ জনের চেয়ে কখনো বেশী হবে না। ঠিক একই নীতি হিসাবে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রদেশগুলিতে ওখানের স্থানীয় ভাষা বা উর্দু ১ম ভাষা বাংলা ২য় ভাষা আর ইংরেজী তৃতীয় স্থান অধিকার করবে।

৪. শাসনকার্য ও বিজ্ঞান-শিক্ষার সুবিধার জন্য আপাতত কয়েক বৎসরের জন্য ইংরেজী ও বাংলা উভয় ভাষাতেই পূর্ব-পাকিস্তানের শাসন কার্য চলবে। ইতিমধ্যে প্রয়োজনানুযায়ী বাংলা ভাষার সংস্কার সাধন করতে হবে।[৫৪]

আবুল কাসেম রাষ্ট্রভাষা প্রসঙ্গে তাঁর এই লেখায় বলেন যে, ইংরেজরা একসময়ে জোর করে আমাদের ঘাড়ে ইংরেজী ভাষা চাপিয়ে দিয়েছিলো। সেইভাবে কেবলমাত্র উর্দু অথবা বাংলাকে সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করলে পূর্বের সেই সাম্রাজ্যবাদী অযৌক্তিক নীতিরই অনুসরণ করা হবে। তিনি উল্লেখ করেন যে, কোন কোন মহলে সেই প্রচেষ্টা চলছে এবং তাকে প্রতিহত করার জন্যে আন্দোলন গড়ে তোলা দরকার। সর্বশেষে তমদ্দুন মজলিশের পক্ষ থেকে তিনি দাবী করেন :

লাহোর প্রস্তাবেও পাকিস্তানের প্রত্যেক ইউনিটকে সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতার অধিকার দেওয়া হয়েছে। আজই প্রত্যেক ইউনিটকে তাদের স্ব স্ব প্রাদেশিক রাষ্ট্রভাষা কি হবে তা নির্ধারণ করবার স্বাধীনতা দিতে হবে।[৫৫]

পুস্তিকাটির অন্য দু’জন লেখকের মধ্যে কাজী মোতাহার হোসেনের ‘রাষ্ট্রভাষা ও পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা-সমস্যা’ নামক প্রবন্ধটিতে ভাষা সমস্যাকে তৎকালীন সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে দেখার কিছুটা চেষ্টা আছে। তিনি তাঁর প্রবন্ধে ভাষার উন্নতি ও চর্চার ক্ষেত্রে মুসলমানদের ভূমিকা উল্লেখ করে বলেন :

মোগল যুগে বিশেষ করে আরাকান রাজসভার অমাত্যগণ, বাংলা ভাষার শ্রীবৃদ্ধির জন্য অকাতরে অর্থ ব্যয় করেছেন। মুসলমান সভাকবি দৌলত কাজী এবং সৈয়দ আলাওল বাংলা কবিতা লিখে অমর কীর্তি লাভ করেছেন। এঁদের ভাষা সংস্কৃত, আরবী, ফার্সী, উর্দু, প্রাকৃত প্রভৃতি নানা ভাষার শব্দসম্ভারে সমৃদ্ধ ছিল; কিন্তু এঁরা জোর করে কোনও নির্দিষ্ট ভাষা থেকে বিকট বিকট শব্দ আমদানী করতে চেষ্টা করেননি, তৎকালীন জনসমাজের নিত্য ব্যবহৃত বা সহজবোধ্য ভাষাতেই তাঁরা কাব্য রচনা করে গেছেন।[৫৬]

এসব কথা বলার প্রয়োজন হয়েছিলো তার কারণ এক শ্রেণীর লোকের ধারণা অনুসারে বাংলা হিন্দুদের ভাষা, কাজেই পরিত্যাজ্য এবং উর্দু ইসলামের ভাষা কাজেই গ্রহণীয়। এই সমস্যার প্রতি বিশেষভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করে তিনি বলেন:

পূর্ব-বাংলার মুসলমানদের আড়ষ্টতার আরও দুটি কারণ ঘটেছিল। প্রথমটি মাতৃভাষা বাংলার প্রতি অবহেলা, আর দ্বিতীয়টি ধর্মীয় ভাষায় সম্পর্কিত মনে করে উর্দু ভাষার প্রতি অহেতুক আকর্ষণ বা মোহ।[৫৭]

এর ফলে যে অবস্থা দাঁড়িয়েছে তা হলো:

বাঙালী মুসলমানের সত্যিকার সভ্যতা বলতে যেন কোন জিনিসই নাই, পরের মুখের ভাষা বা পরের শেখানো বুলিই যেন তার একমাত্র সম্পদ। স্বদেশে সে পরবাসী, বিদেশীই যেন তার আপন।

তাই তার উদাসীভাব, পশ্চিমের প্রতি অসহায় নির্ভর, আর নিজের প্রতি নিদারুণ আস্থাহীনতা। পশ্চিমা চতুর লোকেরা এ অবস্থায় পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করেছে। তারা জানে যে, বৃহৎ পাগড়ী বেঁধে বাংলাদেশে এলেই এদের পীর হওয়া যায়, কমের পক্ষে মৌলবীর আসন গ্রহণ করে বেশ দু’পয়সা রোজগারের জোগাড় হয়। শহুরে দোকানদার যেমন করে গ্রাম্য ক্রেতাকে ঠকিয়ে লাভবান হতে পারে, এ যেন ঠিক সেই অবস্থা। বাস্তবিক বাঙ্গালী মুসলমান বাঙ্গাল বলেই শুধু পশ্চিমা কেন পূর্ব পশ্চিম উত্তর দক্ষিণের সর্বভূতের কাছেই উপহাস ও শোষণের পাত্র।[৫৮]

বিকৃত ধর্মীয় সংস্কার কিভাবে মানুষকে বিপথগামী করে সে বিষয়ে তিনি বলেন:

আমি উর্দু ভাষাকে নিন্দা বা অশ্রদ্ধা করি না কিন্তু বাঙ্গালী মুসলমানের উর্দুর মোহকে সত্যসত্যই মারাত্মক মনে করি। যখন দেখি উর্দু ভাষায় একটা অশ্লীল প্রেমের গান শুনে ও বাঙ্গালী সাধারণ ভদ্রলোক আল্লাহের মহিমা বর্ণিত হচ্ছে মনে করে ভাবে মাতোয়ারা, অথবা বাংলা ভাষায় রচিত উৎকৃষ্ট ব্রহ্মসঙ্গীতও হারাম বলে নিন্দিত, তখনই বুঝি এসব অবোধ ভক্তি বা অবোধ নিন্দার প্রকৃত মূল্য কিছুই নাই।[৫৯]

কাজেই ডক্টর মোতাহার হোসেনের মতে বাংলা চর্চা ব্যতীত মুসলমানদের অন্য উপায় নেই:

এতদিন মুসলমান কেবল হিন্দুর ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে নিশ্চিত আরামে বসে বলেছে যে হিন্দুরা বাংলা ভাষাকে হিন্দুয়ানীভাবে ভরে দিয়েছে, কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানে তো তা চলবে না। এখানে ইসলামী ঐতিহ্য পরিবেশন করার দায়িত্ব মুখ্যত মুসলমান সাহিত্যিকদের বহন করাতে হবে। তাই আজ সময় এসেছে, মুসলমান বিদ্বজ্জন পুঁথি-সাহিত্যের স্থলবর্তী বাংলা সুসাহিত্য সৃষ্টি করে মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতির সঙ্গে দেশবাসীর পরিচয় স্থাপন করবেন; মাতৃভাষা সম্পূর্ণ সমৃদ্ধ হবে এবং ইসলামী ভাবধারা যথার্থভাবে জনসাধারণের প্রাণের সামগ্রী হয়ে তাদের দৈন্য এবং হীনতাবোধ দূর করবে। উর্দুর দুয়ারে ধর্না দিয়ে আমাদের কোনো কালেই যথার্থ লাভ হবে না।[৬০]

উপরোল্লিখিত উক্তিগুলি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ হলেও কাজী মোতাহার হোসেনের অন্য কতকগুলি অংশের বক্তব্য অধিকতর উল্লেখযোগ্য:

দারিদ্র্য দূর করতে হলে সামাজিক বৈষম্য দূর করা, বৈদেশিক শোষণ থেকে আত্মরক্ষা করা এবং জাতীয় সম্পদ যাই থাক, শিল্প বাণিজ্যের সাহায্যে তার সুবিনিময়ের ব্যবস্থা করা একান্ত আবশ্যক। শুধু প্রভাব কিছুটা খর্ব হলেই হবে না — ইংরেজের স্থান যেন বৈদেশিক বা অন্য কোন প্রদেশীয় লোকে দখল করে না বসে সে বিষয়ে লক্ষ্য রাখা নিতান্ত প্রয়োজন। কুচক্রী লোকেরা যাতে শিক্ষা ব্যবস্থার ভিতর দিয়ে, ভাষার বাধা সৃষ্টি করে নানা অজুহাতে পূর্ব পাকিস্তানের মানসিক বিকাশে বাধা না জমাতে পারে, সে বিষয়ে নেতৃবৃন্দ এবং জনসাধারণকে সজাগ থাকতে হবে।[৬১]

কাজেই,

উর্দুকে শ্রেষ্ঠ ধর্মীয় ভাষা বা বনিয়াদী ভাষা বলে চালাবার চেষ্টার মধ্যে যে অহমিকা প্রচ্ছন্ন আছে তা আর চলবে না। নবজাগ্রত জনগণ আর মুষ্টিমেয় চালিয়াত বা তথাকথিত বনিয়াদী গোষ্ঠীর চালাকীতে ভুলবে না। বরং পূর্ব পাকিস্তানে সরকারী চাকুরী করতে হলে প্রত্যেককে বাংলা ভাষায় মাধ্যমিক মান পর্যন্ত পরীক্ষা দিয়ে যোগ্যতা প্রমাণ করতে হবে। অন্যথায় শিক্ষানবিস সময়ের পরে অযোগ্য এবং জনসাধারণের সহিত সহানুভূতিহীন বলে এরূপ কর্মচারীকে বরখাস্ত করা হবে।[৬২]

সর্বশেষে, কায়েমী স্বার্থবাদীদেরকে সতর্ক করে দিয়ে তিনি বলেন:

আমাদের দেশেও, নোতুন পাকিস্তান রাষ্ট্রের জনগণ প্রমাণ করবে যে তারাই রাজা- উপাধীধারীদের জনশোষণ আর বেশী দিন চলবে না। বর্তমানে যদি গায়ের জোরে উর্দুকে বাঙ্গালী হিন্দু-মুসলমানের উপর রাষ্ট্রভাষা রূপে চালাবার চেষ্টা হয়, তবে সে চেষ্টা ব্যর্থ হবে। কারণ ধূমায়িত অসন্তোষ বেশী দিন চাপা থাকতে পারে না। শীঘ্রই তাহলে পূর্ব পশ্চিমের সম্বন্ধের অবসান হবার আশংকা আছে। জনমতের দিকে লক্ষ্য রেখে ন্যায়সঙ্গত এবং সমগ্র রাষ্ট্রের উন্নতির সহায়ক নীতি ও ব্যবস্থা অবলম্বন করাই দূরদর্শী রাজনীতিকের কর্তব্য।[৬৩]

‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা-না উর্দু?’ পুস্তিকাটিতে আবুল মনসুর আহমদ ‘বাংলা ভাষাই হইবে আমাদের রাষ্ট্রভাষা’ শীর্ষক তাঁর দুই পৃষ্ঠার ছোট লেখাটির মধ্যে বলেন :

উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করিলে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষিত সমাজ রাতারাতি ‘অশিক্ষিত’ ও সরকারী চাকুরীর ‘অযোগ্য’ বনিয়া যাইবেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে ফরাসীর জায়গায় ইংরেজীকে রাষ্ট্রভাষা করিয়া বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ মুসলিম শিক্ষিত সমাজকে রাতারাতি ‘অশিক্ষিত’ ও সরকারী কাজের ‘অযোগ্য’ করিয়াছিল।[৬৪]

অর্থাৎ তাঁর বক্তব্যের সরল অর্থ দাঁড়ায় এই যে, ইংরেজরা সাম্রাজ্যবাদী পরিকল্পনা অনুযায়ী যেমন ভারতবর্ষের মুসলমানদের অযোগ্য করেছিলো অনুরূপভাবে পশ্চিম পাকিস্তানীরাও উর্দুকে পূর্ব পাকিস্তানের উপর চাপিয়ে দিলে বাঙালীদেরকে অশিক্ষিত এবং অযোগ্য করার ষড়যন্ত্রে তাঁরা লিপ্ত আছেন বলে মনে করাই যুক্তিসঙ্গত হবে।

প্রথম পর্যায়ে শিক্ষিত ব্যক্তিদের মধ্যে ভাষা আন্দোলনের জন্ম এবং দ্রুত প্রসারের জন্যে পূর্ব পাকিস্তানে কর্মরত অনেক উর্দু ভাষী সরকারী কর্মচারী এবং পশ্চিম পাকিস্তানী আমলাদের বাঙালী বিরোধী মনোভাব এবং কার্যকলাপই অনেকাংশে দায়ী। উপরোল্লিখিত উক্তিগুলি থেকে একটি জিনিস বিশেষভাবে লক্ষণীয়। স্বাধীনতা লাভের মাত্র একমাসেরও কম সময়ের মধ্যে পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে তিক্ততা শুধু যে সৃষ্টি হয়েছে তাই নয়, যথেষ্ট বৃদ্ধি লাভ করেছে। ভাষার প্রশ্নটি এক অংশের দ্বারা যে অপর অংশের উপর প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ আধিপত্য বিস্তারের প্রশ্নের সঙ্গে জড়িত সে চেতনাও এই স্তরে ভাষা বিষয়ক চিন্তা এবং আলোচনার মধ্যে উপস্থিত।

সম্প্রতি ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে একটি প্রবন্ধে ফরিদ আহমদও অনুরূপ মত ব্যক্ত করেছেন।[৬৫] তাঁর মতে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সাধারণ মানুষের স্বার্থের প্রতি দৃষ্টি দেওয়ার আগ্রহ কারো মধ্যে দেখা গেলো না। উপরন্তু দেশের অবস্থা দেখে মনে হলো যেন সাদা প্রভুদের স্থলে শুরু হলো দেশীয় প্রভুদের এক নিশ্চিন্ত রাজত্ব। এই নোতুন প্রভুদের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের বিক্ষোভ স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই পুঞ্জীভূত হতে থাকলো এবং তার ফলে সরকারী আমলারা ক্রমশঃ জনসাধারণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তে থাকলেন। এই সমস্ত সরকারী আমলারা উর্দুতে এবং ইংরেজীতে কথা বলতেন এবং তাঁদের প্রায় সকলের মাতৃভাষাই ছিলো উর্দু। কাজেই অতি সত্ত্বর সাধারণ মানুষেরা এই সব কর্মচারীদেরকে বিদেশী বলে চিহ্নিত করলো এবং তাদের ভাষা উর্দুও পরিগণিত হলো একটি বিদেশী ভাষারূপে।

‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা – না উর্দু? নামে এই পুস্তিকাটির বেশী কপি বিক্রি করা সম্ভব হয়নি। যাঁদের কাছে সেটা বিক্রি করার চেষ্টা হয়েছিলো তাঁদের মধ্যে অধিকাংশই তখন ছিলেন বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার বিরুদ্ধে। শুধু শিক্ষিত জনসাধারণ নয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপুল সংখ্যক ছাত্রেরও অভিমত তাই ছিলো। সেজন্যে তাঁরা রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে তেমন উৎসাহ দেখাননি। এমনকি মুসলিম হল, ফজলুল হক হল ইত্যাদি ছাত্রাবাসেও এ নিয়ে প্রথম দিকে কোন ছোটখাটো ঘরোয়া বৈঠকের আয়োজন করাও ছিলো কষ্টসাধ্য।[৬৬]

১৯৪৭ সালের অক্টোবর মাসে তমদ্দুন মজলিশের সম্পাদক আবুল কাসেম ভাষা প্রশ্ন আলোচনা ও বিবেচনার জন্য ফজলুল হক হলে একটি সাহিত্য সভার আয়োজন করেন। এই সভায় সভাপতিত্ব করেন তৎকালীন পূর্ব বাঙলা সরকারের মন্ত্রী হাবিবুল্লাহ বাহার চৌধুরী। সভাপতি ব্যতীত উপস্থিত ব্যক্তিদের মধ্যে যাঁরা আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন তাঁদের মধ্যে কবি জসিমউদ্দীন, কাজী মোতাহার হোসেন, প্রাদেশিক মন্ত্ৰী সৈয়দ মহম্মদ আফজাল এবং আবুল কাসেম অন্যতম। বক্তাদের মধ্যে সকলেই বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার যৌক্তিকতা এবং তার জন্যে উপযুক্ত আন্দোলন গঠনের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করেন।[৬৭]

৫. ভাষার দাবীতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে প্রথম সভা

৫ই ডিসেম্বর, ১৯৪৭ ঢাকাতে বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটির সর্বশেষ বৈঠক বসে। ওয়ার্কিং কমিটির এই বৈঠকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় যে উর্দুকে পূর্ব-বাঙলার সরকারী ভাষা করা হবে না। কমিটির সভাপতি মৌলানা আকরম খাঁকে এই মর্মে সংবাদপত্রে একটি ঘোষণা প্রকাশের ক্ষমতা প্রদান করা হয়।[৬৮]

প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীনের সরকারী বাসভবন ‘বর্ধমান হাউসে’ এই বৈঠক চলাকালে বহুসংখ্যক ছাত্র এবং কয়েকজন শিক্ষক সেখানে উপস্থিত হয়ে বাংলাকে অবিলম্বে পূর্ব- পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার দাবীতে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। তাঁদের দাবী সহানুভূতির সাথে বিবেচিত হবে, মৌলানা আকরম খাঁর থেকে এই আশ্বাস লাভের পর বিক্ষোভকারীরা ‘বর্ধমান হাউস’ পরিত্যাগ করেন।[৬৯]

ঐ দিন তমদ্দুন মজলিশের প্রতিনিধি আবুল কাশেম. আবু জাফর শামসুদ্দীনসহ মৌলানা আকরম খানের সাথে ভাষার প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা করেন। এই আলোচনার পর একটি প্রেস বিবৃতিতে আবুল কাসেম বলেন, আলোচনা প্রসঙ্গে মৌলানা আকরম খাঁ তাঁদেরকে আশ্বাস দেন যে, পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষারূপে বাংলা ছাড়া অন্য কোন ভাষাকে চাপানোর চেষ্টা করলে পূর্ব পাকিস্তান বিদ্রোহ ঘোষণা করবে এবং তিনি নিজে সেই বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেবেন।[৭০]

এর পূর্বে করাচীতে একটি শিক্ষা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় এবং সেই সম্মেলনে অংশগ্রহণের পর পূর্ব-বাঙলা সরকারের মন্ত্রী হাবিবুল্লাহ বাহার এবং আবদুল হামিদ ৫ই ডিসেম্বর সন্ধ্যায় ঢাকা বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের সাথে সাক্ষাৎকারের সময় শিক্ষা সম্মেলনের সিদ্ধান্ত সম্পর্কে যা বলেন তার বিবরণ ৬ই ডিসেম্বরের মর্নিং নিউজ-এ প্রকাশিত হয়। এই বিবরণ অনুসারে তাঁরা বলেন যে শিক্ষা সম্মেলনে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার জন্যে সর্বসম্মতিক্রমে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে। ঐদিন মনিং নিউজ-এ প্রকাশিত এবং এপিআই পরিবেশিত একটি খবরে বলা হয় যে, শিক্ষা সম্মেলনে সর্বসম্মতিক্রমে উর্দুকে পাকিস্তানের লিংগুয়া ফ্রাংকা করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে, কিন্তু রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় নাই। পাকিস্তান সংবিধান সভাই রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নের মীমাংসা করবে।

শিক্ষা সম্মেলনের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ৬ই ডিসেম্বর বেলা দু’টোর সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ, জগন্নাথ ইন্টারমিডিয়েট কলেজ এবং অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রদের এক বিরাট সভা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপক এবং তমদ্দুন মজলিশের সম্পাদক আবুল কাসেমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয়।[৭১] রাষ্ট্রভাষার দাবীতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে এই হলো সর্বপ্রথম সাধারণ ছাত্রসভা। এই সভায় যাঁরা বক্তৃতা করেন তাঁদের মধ্যে মুনীর চৌধুরী, আবদুর রহমান, কল্যাণ দাশগুপ্ত, এ. কে. এম. আহসান, এস. আহমদ অন্যতম। ভাষা সমস্যার বিভিন্ন দিক নিয়ে বক্তারা বক্তৃতা দেন এবং বাংলা ভাষাকে সাংস্কৃতিক দাসত্বের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার ষড়যন্ত্রের বিষয় উল্লেখ করেন। সংস্কৃতির ক্ষেত্রে পূর্ব-বাঙলায় অধিবাসীদের বাঙালীত্বকে খর্ব করার এই প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করার জন্যে তাঁরা শ্রোতৃমণ্ডলীর কাছে আহ্বান জানান।[৭২]

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ইউনিয়নের ভাইস প্রেসিডেন্ট ফরিদ আহমদ এই সভায় নিম্নলিখিত প্রস্তাবগুলি পেশ করেন এবং সেগুলি সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়:

১. বাংলাকে পাকিস্তান ডোমিনিয়নের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা এবং পূর্ব পাকিস্তানের সরকারী ভাষা ও শিক্ষার মাধ্যম করা হোক।

২. রাষ্ট্রভাষা এবং লিংগুয়া ফ্রাঙ্কা নিয়ে যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা হচ্ছে তার মূল উদ্দেশ্য আসল সমস্যাকে ধামাচাপা দেওয়া এবং বাংলা ভাষা ও পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করা।

৩. পাকিস্তান সরকারের মন্ত্রী ফজলুর রহমানের এবং প্রাদেশিক সরকারের মন্ত্রী হাবিবুল্লাহ বাহার উর্দু ভাষার দাবীকে সমর্থন করার জন্যে সভা তাঁদের আচরণের তীব্র নিন্দা করছে।

৪. সভা মর্নিং নিউজ-এর বাঙালী বিরোধী প্রচারণার প্রতি নিন্দা জ্ঞাপন করছে এবং

জনসাধারণের ইচ্ছার প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শনের জন্যে পত্রিকাটিকে সাবধান করে দিচ্ছে।[৭৩] এক ঘণ্টাকাল এই সভা চলার পর বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ থেকে মিছিল সহকারে ছাত্রেরা বিভিন্ন রাস্তা প্রদক্ষিণ করে সেক্রেটারিয়েট ভবনে উপস্থিত হন। সেখানে কৃষিমন্ত্রী মহম্মদ আফজল ছাত্রদের সামনে বক্তৃতা দেন এবং বাংলা ভাষার দাবীকে সমর্থন করার প্রতিশ্রুতি দান করেন। এরপর ছাত্রেরা প্রাদেশিক মন্ত্রী নূরুল আমীনের বাসভবনে উপস্থিত হলে মন্ত্রী তাঁদেরকে এই মর্মে প্রতিশ্রুতি দেন যে, তিনি বাংলার জন্যে সংগ্রাম করবেন এবং এ কাজে ব্যর্থ হলে মন্ত্রীত্ব পদে ইস্তফা দেবেন। নূরুল আমীনের বাসভবন থেকে মিছিলটি হামিদুল হক চৌধুরীর বাসভবনে গমন করে। তিনিও বাংলার দাবী সমর্থন করার প্রতিশ্রুতি দেন এবং সে কাজে ব্যর্থ হলে ইস্তফা দেওয়ার কথা বলেন।[৭৪] মিছিলে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে কেউ কেউ অবশ্য বলেন যে, হামিদুল হক প্রকৃতপক্ষে বাংলা ভাষার দাবীকে সমর্থন করতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেন এবং ছাত্রদের সাথে এই বিষয়ে তাঁর অনেক তর্ক-বিতর্ক হয়।[৭৫] যাই হোক, হামিদুল হক চৌধুরীর বাসভবন থেকে মিছিলটি প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীনের বাসভবনে উপস্থিত হয়। নাজিমুদ্দীন সে সময় অসুস্থ থাকায় তিনি ছাত্রদের সাথে সাক্ষাতের ব্যাপারে তাঁর অক্ষমতা জানান এবং লিখিতভাবে তিনি তাঁদেরকে বলেন যে, শরীর সুস্থ হওয়ার পর তিনি এ বিষয়ে আলোচনা করতে প্রস্তুত আছেন। কিন্তু মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটি এবং পার্লামেন্টারী পার্টির মতামত না জানা পর্যন্ত তিনি ভাষার প্রশ্নে কোন সুনির্দিষ্ট মত প্রকাশ করতে অক্ষম।[৭৬] ফরিদ আহমদ কিন্তু উল্লেখ করেছেন যে নাজিমুদ্দীন তাঁদের সাথে স্বাস্থ্যগত কারণে সাক্ষাৎ করতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করলেও তাঁরা সেকথা অগ্রাহ্য করে প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎকারের জন্য দাবী জানাতে থাকেন এবং পরিশেষে নাজিমুদ্দীনের ব্যক্তিগত সেক্রেটারী খাজা নসরুল্লাহ তাঁদেরকে জানান যে, তিনজনের একটি প্রতিনিধিদলের সাথে তিনি সাক্ষাৎকার করতে সম্মত হয়েছেন। এরপর ফরিদ আহমদসহ তিনজনের একটি প্রতিনিধিদল প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং তাঁর সাথে বেশ কিছুক্ষণ বিতর্কের পর তিনি একটি কাগজে লিখিতভাবে আশ্বাস দেন যে, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার ব্যাপারে তিনি চেষ্টা করবেন।[৭৭] খাজা নাজিমুদ্দীনের বাসভবন থেকে মিছিলটি মর্নিং নিউজ-এর ঢাকা অফিসে গিয়ে কাগজের স্থানীয় প্রতিনিধির সাথে সাক্ষাৎ করে ভাষা সম্পর্কে তাঁদের নীতি পরিহার করার দাবী জানান।[৭৮]

৬. করাচীর শিক্ষা সম্মেলন

১৯৪৭-এর ৭ই ডিসেম্বর মনিং নিউজ-এ প্রাদেশিক মন্ত্রী হাবিবুল্লাহ বাহার এবং আবদুল হামিদের শিক্ষা সম্মেলন সম্পর্কে যে বক্তব্য প্রকাশিত হয়, তার প্রতিবাদে হাবিবুল্লাহ বাহার ১১ই ডিসেম্বর একটি বিবৃতি দেন। বিবৃতিটিতে তিনি বলেন:

করাচীতে অনুষ্ঠিত শিক্ষা সম্মেলন সম্পর্কে অনেক বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে। ঢাকা থেকে দূরে থাকার ফলে আমার পক্ষে সবগুলি সংবাদপত্র দেখা সম্ভ হয়নি। মর্নিং নিউজে বড় বড় হেড লাইনে প্রকাশিত একটি বিবৃতির প্রতি আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছিলো। সেটা অনুসারে আমি এবং শিক্ষামন্ত্রী জনাব আবদুল হামিদ সাংবাদিকদের কাছে বলেছি যে সম্মেলনে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার সিদ্ধান্ত সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়েছে। আমি তৎক্ষণাৎ এপিআই- এর মাধ্যমে ঘটনাটিকে অস্বীকার করে বলেছিলাম যে রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে সম্মেলনে কোন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। বিভিন্ন সংবাদপত্রে ভিন্ন ভিন্নভাবে কার্যবিবরণী প্রকাশিত হওয়াতে আমার বিবৃতি সত্ত্বেও বিভ্রান্তি অনেক বৃদ্ধি পেয়েছিলো।

ডিসেম্বরের ১১ তারিখে আজাদে প্রকাশিত জনাব ফজলুর রহমানের বিবৃতির ফলে বিভ্রান্তি আরও বৃদ্ধি লাভ করেছে। জনসাধারণের অবগতির জন্যে আমি এ বিষয়ে একটি বিস্তৃত বিবৃতি প্রকাশ করবো স্থির করেছি। কিন্তু তাতে অনেক সময় লাগবে। ইত্যবসরে আমি ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে একথা বলতে চাই যে, সংশ্লিষ্ট সাব-কমিটি পাকিস্তানের সমস্ত স্কুলে উর্দুকে একটি বাধ্যতামূলক ভাষা হিসেবে শিক্ষা দেওয়া এবং শিক্ষা ব্যবস্থায় উত্তরোত্তরভাবে উর্দুকে শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে গ্রহণ করার জন্যে সুপারিশ করেন। কিন্তু হামিদ সাহেব, আমি এবং বাঙলার অন্যান্য প্রতিনিধি এতে সম্মত হইনি। আমরা অত্যন্ত জোরালোভাবে প্রতিবাদ করে বলেছি যে, বাংলা ছাড়া অন্য কোন ভাষাকে বাঙলাদেশ শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে গ্রহণ করবে না। আমরা একথাও বলেছি যে, বাঙলাদেশের প্রাথমিক স্কুলগুলিতে উর্দুকে বাধ্যতামূলক ভাষা করা যেতে পারে না। দুইদিনব্যাপী আলোচনার পর আমরা প্রতিনিধিদেরকে একথা বোঝাতে সক্ষম হই এবং তার ফলে সাব-কমিটির সুপারিশ বাতিল হয়ে যায়। সভাপতি কর্তৃক আনীত একটি প্রস্তাবের শেষে উর্দুকে পাকিস্তানের লিংগুয়া ফ্রাংকা হিসাবে ঘোষণা করার কথা বলা হয়।

লিংগুয়া ফ্রাংকা বলতে মতামত বিনিময়ের জন্যে একটি সাধারণ ভাষা বোঝানো হয়েছিল। রাষ্ট্র ভাষা অথবা শিক্ষার মাধ্যমের সাথে তার কোন সম্পর্ক নেই। সংবিধান সভার কাছে সম্মেলন কোন সুপারিশ পেশ করেনি এবং ফজলুর রহমান সাহেবের বিবৃতিতে রাষ্ট্রভাষা ও শিক্ষার মাধ্যম সম্পর্কে যে প্রস্তাবের উল্লেখ করা হয়েছে সে রকম কোন প্রস্তাবও সেখানে গৃহীত হয়নি।[৭৯]

শিক্ষা সম্মেলনের সিদ্ধান্ত এবং ফজলুর রহমানের বিবৃতিকে কেন্দ্র করে পূর্ব-বাঙলায় উত্তেজনা সৃষ্টির ফলে সরকারী মহলে যথেষ্ট উদ্বেগের সঞ্চার হয়। এই কারণে ১৫ই ডিসেম্বর কেন্দ্রীয় সরকারের শিক্ষা দফতর থেকে একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তি[৮০] প্রচার করে বলা হয় যে, পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কি হবে এই নিয়ে পূর্ব-বাঙলায় সম্প্রতি যে আন্দোলন চলছে সে বিষয়ে তাঁদের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়েছে। বিজ্ঞপ্তিটিতে আরও বলা হয় যে, ফজলুর রহমানের বিবৃতির অনেক ভুল বিবরণ বিভিন্ন জায়গায় প্রকাশিত হয়েছে এবং তাঁকে ভ্রান্তভাবে উদ্ধৃতও করা হয়েছে। এরপর প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে ফজলুর রহমানের উদ্বোধনী বক্তৃতা থেকে নিম্নলিখিত উদ্ধৃতি দিয়ে তাঁর আসল বক্তব্যকে জনসাধারণের সামনে উপস্থিত করার প্রচেষ্টা হয়:

শুধু শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে নয়, যে সংস্কৃতির তারা বাহন সেই সংস্কৃতির প্রসারের জন্যেও, পাকিস্তানে প্রাদেশিক ভাষাগুলির সর্বোচ্চ বিকাশের ব্যবস্থা আমাদের করা প্রয়োজন। কিন্তু সেটা করার সময় আমাদের সাধারণ সংস্কৃতির ঐক্যকে আমরা বিসর্জন দিতে পারি না। এই ঐক্যকে রক্ষা করার জন্যে আমাদের প্রয়োজন একটি আন্তঃপ্রাদেশিক ভাষা এবং সেক্ষেত্রে উর্দুর দাবীকে বিশেষভাবে বিবেচনা করা কর্তব্য।

এরপর উর্দুর দাবী সম্পর্কে নানা যুক্তির অবতারণা করে ফজলুর রহমান তাকে সারা পাকিস্তানের লিংগুয়া ফ্রাংকা হিসাবে গ্রহণের সুপারিশ করেন। এ বিষয়ে শিক্ষা সম্মেলনে নিম্নলিখিত প্রস্তাবটি গৃহীত হয়:

এই সম্মেলন উর্দুকে পাকিস্তানের লিংগুয়া ফ্রাংকা হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্যে সংবিধান সভার কাছে সুপারিশ করছে। এই সভা আরও প্রস্তাব করছে যে, উর্দুকে স্কুলে একটি বাধ্যতামূলক ভাষা হিসাবে শিক্ষা দেয়া হোক কিন্তু প্রাইমারী স্কুলে কোন পর্যায়ে উর্দু শিক্ষা শুরু করা হবে সে বিষয়ে সিদ্ধান্তের ভার প্রাদেশিক সরকারের হাতে অর্পণ করা হোক। স্কুল পর্যায়ে শিক্ষার মাধ্যম কি হবে সে বিষয়ে সিদ্ধান্তও প্রাদেশিক সরকার গ্রহণ করবে।[৮১]

কেন্দ্রীয় শিক্ষা দফতরের এই বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে প্রকাশিত শিক্ষা সম্মেলনের উপরোক্ত প্রস্তাবগুলি একটু আগে উদ্ধৃত হাবিবুল্লাহ বাহারের বিবৃতির বক্তব্যের সাথে মোটেই সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। প্রথমতঃ হাবিবুল্লাহ বাহার তাঁর বিবৃতিতে উল্লেখ করেছেন যে শিক্ষা সম্মেলনের একটি সাব-কমিটি উর্দুকে পাকিস্তানের সমস্ত স্কুলে বাধ্যতামূলক ভাষা হিসাবে শিক্ষা দেওয়ার যে প্রস্তাব করেছিলো, সে প্রস্তাব তাঁর শিক্ষামন্ত্রী আবদুল হামিদের এবং বাঙলাদেশের অন্যান্য প্রতিনিধিদের প্রতিবাদ ও প্রচেষ্টার ফলে বাতিল হয়ে যায়। কিন্তু শিক্ষা দপ্তরের বিজ্ঞপ্তি অনুসারে প্রস্তাবটি বাতিল হয়নি, যথারীতি গৃহীত হয়েছে। দ্বিতীয়তঃ হাবিবুল্লাহ বাহার বলেছেন যে, সম্মেলন সংবিধান সভার কাছে কোন সুপারিশ করেনি। কিন্তু সরকারী বিজ্ঞপ্তিটি থেকে দেখা যাচ্ছে যে সম্মেলন উর্দুকে পাকিস্তানের লিংগুয়া ফ্রাংকা হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য সংবিধান সভার কাছে সুপারিশ পেশ করেছে। হাবিবুল্লাহ বাহারের বিবৃতির তারিখ ১১ই ডিসেম্বর এবং কেন্দ্রীয় শিক্ষা দফতরের প্রেস বিজ্ঞপ্তির তারিখ ১৫ই ডিসেম্বর। বিজ্ঞপ্তিটি প্রচারিত হওয়ার পর হাবিবুল্লাহ বাহারের কোন পাল্টা বিবৃতি সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়নি।

৭. দুর্বৃত্তদের হামলা

৭ই ডিসেম্বর বিকেল ২.৩০ মিনিটে রেল কর্মচারীদের একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। ইউনিয়নের নির্বাচিত সভাপতি অসুস্থ থাকায় সভাপতিত্ব করার জন্যে ফজলুল হককে নিয়ে আসা হয় কিন্তু সমস্ত অবাঙালী কর্মচারী একযোগে তাতে আপত্তি করলে ফজলুল হক সভাপতির আসন পরিত্যাগ করে চলে যান। এরপর বেলা প্রায় পাঁচটা পর্যন্ত দারুণ ঝগড়া-বিবাদ এবং মারামারির পর সমস্ত অবাঙালীকে সভাস্থল থেকে তাড়িয়ে দিয়ে নূরুল হুদার সভাপতিত্বে নোতুন করে সভার কাজ শুরু হয়।[৮২]

এই সভা সম্পর্কে সেদিনে ঢাকা শহরের স্থানীয় লোকদের মধ্যে ব্যাপকভাবে প্রচার করা হয় যে, সভাটি আসলে ছিলো হিন্দুদের সাথে মিলে ফজলুল হকের নেতৃত্বে একটি পাকিস্তানবিরোধী চক্রান্ত। তাছাড়া বাংলার মতো একটি হিন্দু ভাষাকে উর্দুর পরিবর্তে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার ষড়যন্ত্রের কথাও উল্লেখ করা হয়। এইসব প্রচারণার ফলে সেদিনই সিরাজউদ্দৌলা পার্কে ফজলুল হকের সভাপতিত্বে অন্য একটি সভা অনুষ্ঠিত হওয়াকালে ঢাকার কিছুসংখ্যক স্থানীয় লোক সেখানে উপস্থিত হয়ে চেয়ারে অগ্নিসংযোগ ও অন্যান্য হাঙ্গামার সৃষ্টি করে এবং সাধারণভাবে ছাত্রদের উপর তারা ভয়ানক ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে।[৮৩]

এই ঘটনার কয়েকদিন পর ১২ই ডিসেম্বর কিছুসংখ্যক লোক বাস ও ট্রাকে চড়ে পলাশী ব্যারাক এবং আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে উপস্থিত হয় এবং সরকারী কর্মচারী ও ছাত্রদেরকে লক্ষ্য করে ইট-পাটকেল ছুড়তে থাকে। কয়েক রাউণ্ড গুলিও এ সময় তারা বর্ষণ করে। এই সংবাদ আগুনের মতো সারা ঢাকা শহরে ছড়িয়ে পড়ে এবং বিভিন্ন এলাকা থেকে ছাত্র এবং ঢাকার জনসাধারণও এই গুণ্ডামী বন্ধ করার জন্যে ইঞ্জিনিয়ারিং হোস্টেলে সমবেত হয়। শুধু তাই নয়, তারা এর প্রতিকার দাবী করার জন্যে একটি মিছিল করে সেক্রেটারিয়েটের দিকে অগ্রসর হতে থাকেন। এই মিছিলটি শুধু ছাত্র মিছিল ছিলো না। এতে ঢাকা শহরের বিভিন্ন অংশের এবং বিভিন্ন শ্রেণীর নাগরিকরাও বিপুল সংখ্যায় যোগদান করেছিলেন। বস্তুত বাংলা ভাষার দাবীতে এ জাতীয় মিছিল এই সর্বপ্রথম।[৮৪] ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, মেডিক্যাল কলেজ ইত্যাদি পার হয়ে মিছিলটি প্রাদেশিক শিক্ষামন্ত্রী আবদুল হামিদের বাসভবনে উপস্থিত হয়। লুঙ্গী পরিহিত অবস্থায় মন্ত্রী মহোদয় তাড়াতাড়ি সমবেত ছাত্র-জনতার সাথে সাক্ষাৎ করেন।[৮৫]

গুণ্ডামীর প্রতিকারের জন্যে তাঁর কাছে দাবী জানানো হয়। এ ছাড়া তাঁকে ডাকটিকিট, মানি-অর্ডার ফর্ম ইত্যাদি থেকে বাংলা ভাষা বর্জন সম্পর্কে বলা হয় এবং উর্দুর সাথে বাংলাও যাতে এসব ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হতে পারে তাঁর কাছে সেই মর্মে দাবী জানানো হয়। রাষ্ট্রভাষা নিয়েও মন্ত্রীর সাথে সকলের ভয়ানক তর্ক-বিতর্ক চলে এবং তারপর বিক্ষোভকারীরা মন্ত্রীকে তাঁদের সাথে সেক্রেটারিয়েটে যেতে বলেন। তিনি সেই লুঙ্গী পরিহিত অবস্থাতেই মিছিলের সাথে সেক্রেটারিয়েটে যেতে বাধ্য হন। মিছিলটি মন্ত্রীর বাসভবন অবস্থানকালে কিছুসংখ্যক বিক্ষোভকারী তাঁর বাগানের অনেক ফুল এবং গাছপালা নষ্ট করে দেয়।[৮৬]

সেক্রেটারিয়েটে সেদিন কৃষিমন্ত্রী মহম্মদ আফজল ব্যতীত অন্যসব মন্ত্রীই অনুপস্থিত ছিলেন। তাঁদেরকই সে সময় ১৪ই ও ১৫ই ডিসেম্বর আহূত সারা ভারত মুসলিম লীগ কাউন্সিলে সর্বশেষ অধিবেশনে যোগদানের জন্য করাচী যেতে হয়েছিলো।[৮৭]

মিছিল গন্তব্যস্থলে পৌছানোর পূর্বেই সেক্রেটারিয়েটের সমস্ত গেট ভেতর থেকে বন্ধ করে দেওয়া হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও গেটের কাছে জনতা ছত্রভঙ্গ না হয়ে কোন একটা উপায় উদ্ভাবনের চেষ্টা করতে থাকে। এমন সময় আবদুল গণি রোড দিয়ে একটি গাড়িকে আসতে দেখে একজন সেটিকে থামায় এবং তার উপর দাঁড়িয়ে দেওয়াল ডিঙিয়ে সেক্রেটারিয়েটের মধ্যে প্রবেশ করে দ্রুতগতিতে বড় গেটটি ভেতর থেকে খুলে দেয়। এর ফলে মিছিলের জনতাকে আর গেটের বাইরে ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব হয় না। দলে দলে তারা সেক্রেটারিয়েটের ভেতর প্রবেশ করে।[৮৮]

আবদুল হামিদ এবং সৈয়দ আফজলের অফিসের সামনে মিছিলটি উপস্থিত হলে কৃষি দফতরের সেক্রেটারী কাদরী পুলিশ দিয়ে পিটিয়ে ছাত্রদেরকে তাড়িয়ে দেওয়ার জন্যে মন্ত্রী সৈয়দ আফজলকে পরামর্শ দেন। কিন্তু তিনি তাতে সম্মত না হয়ে ছাত্রদের সাথে আলাপ করে তাদেরকে বুঝিয়ে নিজের বক্তব্য বলার সিদ্ধান্ত নেন।[৮৯]

সৈয়দ আফজল দোতলা থেকে নিচে নেমে এসে ছাত্রদেরকে বোঝাবার চেষ্টা করলেন যে বাংলা ভাষা তিনিও চান, কাজেই ছাত্রদের সাথে তাঁর কোন বিরোধ নাই। আবদুল হামিদও সমবেত ছাত্র-কর্মচারীদের সম্বোধন করে বাংলা ভাষার দাবী সমর্থন করার প্রতিশ্রুতি দেন। অল্পক্ষণ পর তদানীন্তন চীফ সেক্রেটারী আজিজ আহমদকে সেখানে জোরপূর্বক হাজির করা হয় এবং তিনিও বাংলা ভাষার যথাযোগ্য স্বীকৃতির জন্যে চেষ্টা করবেন বলে ছাত্র-জনতার কাছে প্রতিশ্রুতি দিতে বাধ্য হন।[৯০] কিন্তু এসব সত্ত্বেও উত্তেজিত জনতা শান্ত হলো না। শুধু তাই নয়, এ সময় তারা মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে নানাপ্রকার বিরূপ ধ্বনি দিতে থাকে এবং এক পর্যায়ে সৈয়দ আফজলের দাড়ি ধরেও আকর্ষণ করে।[৯১] এছাড়া তারা উভয় মন্ত্রীকেই বাংলা ভাষার দাবী সমর্থন করবেন এবং সে কাজে ব্যর্থ হলে মন্ত্রীত্ব পদে ইস্তফা দেবেন, এই-মর্মে একটি লিখিত প্রতিশ্রুতিপত্রে স্বাক্ষরদান করতে বাধ্য করে।[৯২]

দুপুরের দিকে মিছিলটি সেক্রেটারিয়েটে ঢোকে কিন্তু চেঁচামেচি তর্ক-বিতর্কের মধ্যে দিয়ে বিকেল প্রায় চারটে হয়ে এলো। ছাত্রদের দাবী হলো গুণ্ডারা ছাত্রদের উপর কি অত্যাচার করেছে সেটা মন্ত্রী মহোদয়কে নিজে গিয়ে দেখে এসে তার উপযুক্ত প্রতিকার করতে হবে। অবশেষে একজন প্রস্তাব করলো যে মিছিলটি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের দিকে যাবে এবং মন্ত্রী আফজলকে তাদের সাথে যেতে হবে। শুরু তাই নয়, মন্ত্রী মহোদয়কে সেই মিছিল পরিচালনা করতে হবে। সৈয়দ আফজল এ প্রস্তাবের বিরোধিতা না করে বাধ্য হয়ে মিছিলে শরীক হতে সম্মত হন এবং পায়ে হেঁটে শেষ পর্যন্ত ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের হোষ্টেলে পৌঁছান। তিনি হোস্টেলের ভিতরে ঢুকে সব কিছু দেখেশুনে ছাত্রদের উপর যে অত্যাচার হয়েছে তার উপযুক্ত প্রতিবিধানের প্রতিশ্রুতি দেন।[৯৩]

কিন্তু ছাত্রেরা তাতে সন্তুষ্ট না হয়ে দাবী করলো যে, তিনি যে রাষ্ট্রভাষা বাংলা চান সেটা আবার তাঁকে লিখিতভাবে স্বীকার করতে হবে। একথায় মন্ত্রী কিছুক্ষণ ইতস্তত করার পর অবশেষে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতে তিনিও চান এ কথা লিখে দিতে বাধ্য হন।[৯৪] এরপর মহম্মদ আফজলসহ মিছিলটি পলাশী ব্যারাকের দিকে যায় এবং মাগরেবের নামাজের পর সেখানে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভায় মন্ত্রীর উপস্থিতিতে অনেকগুলি প্রস্তাব গৃহীত হয়। সেগুলিতে গুণ্ডামীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং তাদের দাবী ছাড়াও বাংলা ভাষা তার যথাযোগ্য মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব করা হয়।[৯৫] গুণ্ডারা যে সমস্ত গাড়ীগুলিতে চড়ে এসেছিলো সেগুলির নম্বর পূর্বেই রাখা হয়েছিল। মন্ত্রী সেই গাড়ী এবং তাদের ড্রাইভারদেরকে হাজতে আটক করার জন্যে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট রহমতুল্লাহ এবং ডিআইজি ওবায়দুল্লাকে সভাস্থলেই আদেশ দেন।[৯৬]

সেদিনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে ঢাকা শহরে প্রবল উত্তেজনা বিরাজ করতে থাকে। এ পর্যন্ত আশংকা করা হয় যে, উর্দু ও বাংলা সমর্থকদের মধ্যে হয়তো ছোরাছুরি নিয়ে দারুণ মারপিট হতে পারে। অবস্থা আয়ত্তে আনার উদ্দেশ্যে মন্ত্রী সৈয়দ আফজল শহরের বিভিন্ন এলাকা ঘোরার প্রস্তাব করেন এবং ফরিদ আহমদ ও অন্যান্য কয়েকজনকে নিয়ে মধ্যরাত্রি পর্যন্ত ঢাকার কতকগুলি এলাকা পরিদর্শন করেন। এ সময় সংবাদপত্র প্রতিনিধিদের মধ্যে একমাত্র কলকাতার দৈনিক স্টেটসম্যান-এর বিশেষ প্রতিনিধি আব্দুল ওয়াহাব তাঁদের সাথে ছিলেন।[৯৭]

সেক্রেটারিয়েট কর্মচারীরা যে এ ধরনের কোন মিছিল তৈরি করে সংগঠিতভাবে নিজেদেরই মন্ত্রীর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে পারে এটা অনেকাংশে অবিশ্বাস্য মনে হয়। কিন্তু তখনকার দিনে তাদের জীবন এবং মানসিক অবস্থার কথা স্মরণ করলে এ সবকিছুকেই সম্ভব মনে হবে।

উপরে বর্ণিত ঘটনার কিছু পূর্বে খুব সম্ভবত সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে প্রধানমন্ত্রী নাজিমুদ্দীনের সরকারী বাসগৃহ ‘বর্ধমান হাউসে’ সেক্রেটারিয়েট কর্মচারীদের একটি বিক্ষুব্ধ মিছিল প্রবেশ করে। নীলক্ষেত ব্যারাকে তখন পানির দারুণ অভাব। তাছাড়া দূষিত জল নিষ্কাশন, আবর্জনা পরিষ্কার ইত্যাদির কোন ব্যবস্থা সেখানে না থাকায় নীলক্ষেতে এক দারুণ অস্বাস্থ্যকর অবস্থার সৃষ্টি হয়। নীলক্ষেতে বসবাসকারী সেক্রেটারিয়েট কর্মচারীরা এ সবের প্রতিবাদে একদিন সকালের দিকে প্রধানমন্ত্রীর বাড়ি ঘেরাও করেন। তাঁদের সকলের হাতে ছিলো একটা করে বদনা, গাড়ু অথবা ঐ জাতীয় একটা কিছু। তাঁরা সেগুলি হাতে নিয়েই চীৎকার করে তাঁদের অবস্থার প্রতিকারের দাবী জানাতে থাকেন।[৯৮]

চেঁচামেচির মধ্যে একজন জোরে চীৎকার করে বলেন যে, তাঁদের দুরবস্থার আশু প্রতিকার না হলে নাজিমুদ্দীনকে তাঁরা ‘আউঙ সান’ করবেন। এই ঘটনার কিছুকাল পূর্বে জুলাই মাসে আততায়ীর হাতে বার্মার প্রধানমন্ত্রী আউঙ সান এবং তাঁর কয়েকজন সহকর্মী নিহত হন। কিন্তু নাজিমুদ্দীন এসবের কিছুই জানতেন না অথবা সেই সময় ব্যাপারটি তাঁর খেয়াল ছিল না। তিনি তাঁর পার্শ্ববর্তী একজনকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘আউঙ সান মানে কী?’[৯৯] কিছুক্ষণ বিক্ষোভ প্রদর্শনের পর প্রতিকারের আশ্বাস পেয়ে নীলক্ষেত ব্যারাকের সেক্রেটারিয়েট কর্মচারীরা ‘বর্ধমান হাউস’ পরিত্যাগ করেন।

১২ই ডিসেম্বরের উপরোল্লিখিত ঘটনা সম্পর্কে পূর্ব বাঙলা সরকার সেদিন একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেন।[১০০] তাতে বলা হয় :

একটি ঘটনায় বিশ ব্যক্তি আহত, যার মধ্যে দু’জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে এবং অন্যদেরকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, এই গুজব প্রচারিত হওয়ার পর আজ শহরে কিছুটা উত্তেজনা বিরাজ করতে থাকে। জানা গেছে যে, সকালের দিকে কিছুসংখ্যক অজ্ঞাত ব্যক্তি একটি বাসে চড়ে প্রচার করে বেড়ায় যে, উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করা উচিত। পলাশী ব্যারাকের লোকজন এবং আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ছাত্রেরা এই ঘোষণায় ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে এবং উভয়পক্ষে হাতাহাতির ফলে উপরোক্ত ব্যক্তিরা আহত হয়। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এবং পুলিশ সুপারিনটেনডেন্টের নেতৃত্বে পুলিশ বাহিনী ঘটনাস্থলে উপস্থিত হওয়ার পর সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসাবে সেই এলাকায় পাহারা মোতায়েন করা হয়। এই ঘটনার পর শহরে অনেক ভিত্তিহীন গুজব ছড়াতে থাকে এবং কেউ কেউ বলে যে, দু’তিন ব্যক্তির মৃত্যু ঘটেছে। অপর একটি রিপোর্ট অনুসারে নাকি পুলিশ গুলি ছুঁড়ে এবং জনতার উপর লাঠিচার্জ করে উপরোক্ত ব্যক্তিদের মৃত্যু ঘটায়।

এই সমস্ত মিথ্যা গুজবের ফলে শহরে ত্রাসের সঞ্চার হয় এবং বিকেলের দিকে একটি মিছিল সেক্রেটারিয়েটে গিয়ে সেখানে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। উত্তেজনা সত্ত্বেও অবস্থাকে সুকৌশলে এবং সংযমের সাথে আয়ত্তে আনা হয়। কৃষিমন্ত্রী মাননীয় সৈয়দ আফজল সাহেব এবং শিক্ষামন্ত্রী মাননীয় আবদুল হামিদ সাহেব বিক্ষোভকারীদের সাথে সাক্ষাৎ করে শৃঙ্খলা মেনে চলার জন্যে তাদের কাছে আবেদন জানান। জনাব আবদুল হামিদ জোর দিয়ে বলেন যে, ভাষার প্রশ্ন নিয়ে তর্কের কোন অবকাশ নেই কারণ পূর্ব-পাকিস্তানের জনগণের ইচ্ছা অনুসারেই সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। শ্রোতাদের উদ্দেশ্য করে সরকারের চীফ সেক্রেটারী তাঁর বক্তৃতার নোতুন রাষ্ট্রে শৃঙ্খলা এবং আইন-কানুন মেনে চলার প্রয়োজনীয়তার উপর বিশেষ জোর দেন। সকালের ঘটনার সাথে জড়িত অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণেরও তিনি প্রতিশ্রুতি দেন। বিক্ষোভকারীরা শান্তিপূর্ণভাবে বক্তৃতা শোনে এবং মন্ত্রীদের থেকে এই আশ্বাস লাভের পর সেখান থেকে চলে যায়। সকালের ঘটনাটির এবং বিশেষ করে সেই ঘটনার প্ররোচনা কারা যুগিয়েছে সে সম্পর্কে পুলিশ তদন্ত শুরু করেছে। এ পর্যন্ত প্রাপ্ত প্রমাণ থেকে মনে হয় যে, এই প্রদেশের মুসলমানদের মধ্যে ভাঙ্গন ধরাবার উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রের যে সমস্ত শত্রুরা অহরহ সজাগ আছে তারাই এই ঘটনা সৃষ্টির জন্যে দায়ী।

উপরোক্ত প্রেস বিজ্ঞপ্তিটিতে সেদিনকার ঘটনাবলীর বিশেষ বিশেষ অংশ চাপা দেওয়া থেকে করে সাম্প্রদায়িক প্রচারণা পর্যন্ত সমস্ত কিছুই আছে। জনতা শান্তভাবে চীফ সেক্রেটারী এবং মন্ত্রীদের বক্তৃতা শুনেছে এবং তারপর তারা শান্তভাবেই সেক্রেটারিয়েট ভবন পরিত্যাগ করে গেছে, এই কথা বলা হলেও বহু প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ থেকে সেকথা সম্পূর্ণ মিথ্যা বলেই প্রমাণিত হয়। উপরন্তু বিজ্ঞপ্তিটির সর্বশেষ বাক্যে প্রদেশের মুসলমানদের মধ্যে ভাঙ্গন ধরাবার উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রের যে সমস্ত শত্রু অহরহ সজাগ আছে তারাই এই ঘটনা সৃষ্টির জন্যে দায়ী এই কথা বলে সূক্ষ্মভাবে হিন্দুদেরকে সমস্ত ঘটনার জন্যে দায়ী করার প্রচেষ্টার মধ্যে সরকারের সাম্প্রদায়িক নীতিই খুব সহজভাবে ধরা পড়ে। শুধু তাই নয়, পরবর্তী সময়ে ঘটনাটি সম্পর্কে কোন সত্যিকার তদন্ত না করা এবং সেদিনের ঘটনার সাথে জড়িত ব্যক্তিদের বক্তব্য থেকে একথাই বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় যে ঘটনাটির সাথে সরকারী মহলের, বিশেষত আমলা গোষ্ঠীর ঘনিষ্ঠ যোগ ছিলো।

১২ই ডিসেম্বর বিকেলে নঈমুদ্দীন আহমদ এবং শামসুদ্দীন আহমদ OK রেস্তোরাঁয় (বর্তমান নাম আলেকজান্ডার) চা খেয়ে সামনের রাস্তায় নামামাত্র একদল গুণ্ডা নঈমুদ্দীন আহমদকে আক্রমণ করে এবং তাঁর মাথায় লাঠির বাড়ি মারে। এর ফলে তাঁর মাথা থেকে রক্ত ঝরতে থাকে। তাঁকে নিয়ে শামসুদ্দীন আহমদ তাড়াতাড়ি ফজলুল হক হল এবং সেখান থেকে মেডিকেল কলেজে নিয়ে যান। সেদিন বিকেলেই এই ঘটনার প্রতিবাদে ফজলুল হক হলে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়।[১০১]

নঈমুদ্দীন আহমদকে হাসপাতালে ভর্তি করা নিয়ে বেশ গণ্ডগোল হয়। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ প্রথমে নানা অজুহাতে তাঁকে সরাসরি ভর্তি করতে অসম্মত হলেও শেষে মন্টগোমারী সাহেবের প্রচেষ্টায় তেরো তারিখে সন্ধ্যার পর তাঁকে ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়। সেদিন সন্ধ্যার সময় তাজউদ্দীন আহমদ ফজলুল হক হল থেকে নঈমুদ্দীন আহমদের জন্যে খাবার নিয়ে তাঁর ওয়ার্ডে উপস্থিত হলে সেখানে চীফ সেক্রেটারী আজিজ আহমদ এবং জেলা ম্যাজিস্ট্রেট রহমতউল্লাকে নঈমুদ্দীনের বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেন। সেখানে দু’জন পুলিশ সাব-ইন্সপেক্টর নঈমুদ্দীন আহমদের FIR নিচ্ছিলেন। তাজউদ্দীন আহমদ চীফ সেক্রেচারীর সাথে সেখানে পূর্বদিনের গুণ্ডামী সম্পর্কে কিছু আলোচনা করেন এবং আজিজ আহমদ গুণ্ডামী দমন করার ব্যাপারে যথোচিত ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দেন কিন্তু এ আশ্বাস সত্ত্বেও সেদিন রায়সাহেব বাজারে একটি মিছিল পরিচালনাকালে মিটফোর্ড স্কুলের তিনজন ছাত্র গুণ্ডাদের আক্রমণে আহত হন।[১০২]

১৩ই ডিসেম্বর সেক্রেটারিয়েট কর্মচারীরা পূর্ণ হরতাল পালন করেন এবং সেদিন থেকে পনেরো দিনের জন্যে ঢাকা শহরে ১৪৪ ধারা জারী করা হয়। চকবাজারে সেদিন ঢাকার নবাব হাবিবুল্লাহ যে সভা আহ্বান করেছিলেন ১৪৪ ধারার জন্যে তা বাতিল হয়ে যায়।[১০৩] নবাব একটি প্রেস বিবৃতি মারফত বলেন যে, পাকিস্তান অত্যন্ত সংকটময় অবস্থার মধ্যে আছে কাজেই এ সময়ে আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের অর্থ বিপদ ডেকে আনা। ভাষার প্রশ্নে তিনি বলেন, সংবিধান সভা জনগণের প্রতিনিধিদের দ্বারাই গঠিত। কাজেই ভাষার প্রশ্নের সিদ্ধান্ত নেয়ার ভার তার ওপরই অর্পণ করা উচিত।[১০৪]

১৩ই ডিসেম্বর সেক্রেটারিয়েটে পূর্ণ হরতাল পালিত হওয়া এবং অন্যান্য কতকগুলি কারণে সংবাদপত্রের মাধ্যমে ঢাকা শহরে একথা রাষ্ট্র হয় যে বহু সরকারী কর্মচারী রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে ভিন্ন ভিন্ন পক্ষ অবলম্বন করছেন। এ সম্পর্কে আলোচনার জন্যে ১৬ তারিখে সেক্রেটারিয়েট এবং বিভিন্ন ডাইরেক্টরেটের সিনিয়র অফিসাররা একটি সভায় মিলিত হন। সেখানে সরকারী কর্মচারীদের বিরুদ্ধে এ জাতীয় ভিত্তিহীন প্রচারণার নিন্দা করা হয়। তাঁরা বলেন যে, ভাষা প্রশ্ন অথবা অন্য কোন রাজনৈতিক প্রশ্নের সাথে তাঁদের কোন সম্পর্ক নেই। প্রদেশের রাষ্ট্রভাষা জনগণের দ্বারাই নির্ধারিত হবে এবং সরকারী কর্মচারীরা সেই সিদ্ধান্তকে অনুগতভাবে কার্যকরী করবে।[১০৫]

ঐ দিনই মর্নিং নিউজ-এ পূর্ব বাঙলা সরকারের ডাইরেক্টর অব পাবলিক ইনষ্ট্রাকশন ডক্টর কুদরত-ই-খুদার সাথে ভাষার প্রশ্নে ১১ই ডিসেম্বর চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত একটি প্রেস সাক্ষাৎকারের বিবরণ প্রকাশিত হয়। তাতে কুদরত-ই-খুদা বলেন, ‘কোন জাতির জীবনে অস্বাভাবিক কোন জিনিসকে চাপিয়ে দেওয়া চলে না এবং সেটা উচিতও নয়। বাংলা আমাদের মাতৃভাষা।’

১৭ই ডিসেম্বর করাচীতে পাকিস্তান সংবিধান সভার নিয়ম-কানুন নির্ধারণ কমিটি সভার সরকারী ভাষা হিসাবে উর্দু ও ইংরেজীকে সমমর্যাদানের জন্যে সুপারিশ করেন। তাঁরা অবশ্য একথা উল্লেখ করেন যে, কোন সদস্য উপরোক্ত দুই ভাষাতে যদি নিজেকে ব্যক্ত করতে না পারেন তাহলে তিনি নিজের প্রাদেশিক ভাষাতেই বক্তৃতা দিতে পারবেন। অবশ্য এর জন্য তাঁকে সভাপতির অনুমতি প্রার্থনা করতে হবে। কমিটি ঐদিন শুধু সংবিধান সভার নিয়ম-কানুন নির্ধারণ করলেও তাঁরা সিদ্ধান্ত করেন যে বাজেট অধিবেশনের কয়েকদিন পূর্বে ঐ একই কমিটি গণ পরিষদেরও নিয়ম-কানুন নির্ধারণ করবেন।[১০৬]

ডিসেম্বর মাসের নানা ঘটনার পর জানুয়ারীর প্রথম সপ্তাহে ঢাকা শহরে রাষ্ট্র হয় যে ভাষা আন্দোলনের সাথে যুক্ত কর্মীদের বিরুদ্ধে সরকার গ্রেফতারী পরোয়ানা জারী করেছেন। এই সংবাদের সত্যতা যাচাইয়ের জন্যে নঈমুদ্দীন আহমদ, তাজউদ্দীন আহমদ, মহম্মদ তোয়াহা, অলি আহাদ, শফিউল আজম এবং ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুলের কিছু সংখ্যক ছাত্র ৮ই জানুয়ারী সন্ধ্যায় বর্ধমান হাউসে প্রধানমন্ত্রী নাজিমুদ্দীনের সাথে সাক্ষাৎ করেন। এই সাক্ষাৎকারের সময় শিক্ষামন্ত্রী আবদুল হামিদ এবং শিক্ষা দফতরের সেক্রেটারী ফজলে আহমদ করিম ফজলীও সেখানে উপস্থিত ছিলেন।[১০৭

৮. উর্দু সমর্থকদের তাত্ত্বিক বক্তব্য

১৯৪৭ এর ডিসেম্বরে করাচীর শিক্ষা সম্মেলনের পর প্রকাশিত মর্নিং নিউজের একটি সম্পাদকীয় এবং সিলেটের কিছুসংখ্যক শিক্ষাবিদ, ডাক্তার, সংস্কৃতিসেবী প্রভৃতির একটি স্মারকলিপিতে উর্দু সমর্থকদের তাত্ত্বিক বক্তব্য মোটামুটি স্পষ্টভাবে উপস্থিত করা হয়। এ দু’টির উল্লেখ সরকার পক্ষ ও প্রতিক্রিয়াশীল বুদ্ধিজীবী ও সংস্কৃতিসেবীদের দৃষ্টিভঙ্গী এবং উৎকণ্ঠার পরিচয় লাভের জন্য প্রয়োজন।

মর্নিং নিউজ তাঁদের ১৭ই ডিসেম্বরের একটি দীর্ঘ সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলেন:

পশ্চিম পাকিস্তানের প্রধান প্রধান কথ্য ভাষা পশতু, পাঞ্জাবী, ব্রাহমী ও সিন্ধী এবং পূর্ব পাকিস্তানে প্রধান কথ্য ভাষা বাংলা। প্রত্যেকটি গ্রুপই যদি নিজের ভাষাকে সরকারী ভাষারূপে চালু করার জন্য জোর দেয় তাহলে পাকিস্তানের বিভিন্ন অংশের মধ্যে সহযোগিতা, ভাবের আদান-প্রদান এবং পারস্পরিক সম্পর্কের অবসান ঘটবে। যার সামান্য কিছু বুদ্ধি আছে সে কখনোই এ কথা বলতে পারে না যে একজন পাঠান অথবা পশ্চিম পাঞ্জাবী তার পরিবারের লোকজনের সাথে পাঞ্জাবীতে কথা না বলে উর্দুতে কথা বলবে। এই একই মন্তব্য সিন্ধী, বালুচ এবং বাঙালীর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। ঢাকার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ব্যক্তিদের করাচীতে গৃহীত সিদ্ধান্তকে এতো খারাপভাবে ব্যাখ্যা করার অর্থ এ ছাড়া আর কিছুই নয়।

উপরোক্ত বক্তব্যের মূল লক্ষ্য প্রাদেশিক মন্ত্রী হাবিবুল্লাহ বাহার এবং আবদুল হামিদ। কারণ তাঁরাই করাচী থেকে ফিরে এসে বিবৃতির মাধ্যমে সম্মেলনের সিদ্ধান্তসমূহের যে ব্যাখ্যা দেন তার সাথে কেন্দ্রীয় সরকারের শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমান এবং কেন্দ্রীয় শিক্ষা দফতরের ব্যাখ্যার বিন্দুমাত্র সামঞ্জস্য ছিলো না।

ইংরেজী ভাষা এবং তার ব্যবহার সম্পর্কে সম্পাদকীয়টিতে বলা হয়:

আমাদের পূর্বতন শাসকদের ভাষা হিসাবে ইংরেজী দেশের সমস্ত অংশের লোকের আলাপ- আলোচনার মাধ্যম রূপে ব্যবহৃত হয়। সরকার এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষা এটা পূর্বেও ছিলো এবং এখনো পর্যন্ত আছে। এই ভাষাতেই দক্ষিণের লোক উত্তরের লোকদের সাথে এবং পূর্বের লোক পশ্চিমের ভাইদের সাথে চিঠিপত্র বিনিয়োগ করে। এখানেই শেষ নয়। একই ভাষাভাষী দুইজন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাপ্রাপ্ত লোক নিজেদের মধ্যে আলাপ- আলোচনার সময় সাধারণত ইংরেজীতেও কথা বলে। আমাদের সংবাদপত্র, আমাদের সাইন বোর্ড এবং আমাদের বিজ্ঞাপনসমূহ এখনো ইংরেজীতে প্রকাশিত হয়। সর্বোপরি আমাদের নেতারা এখনো প্রেস কনফারেন্সে এবং প্রেসে বিবৃতি দেওয়ার সময় ইংরেজীতেই তা করে থাকেন। এই অবস্থা ততদিন পর্যন্ত বজায় থাকবে যতদিন না আমরা বিদেশী আমলাতন্ত্র জোরপূর্বক আমাদের গলা দিয়ে যে পশ্চিমী ভাষাকে পার করেছে তার পরিবর্তে নিজেদের এমন একটি ভাষাকে ব্যবহার করতে শিখবো যার মধ্যে আমাদের চিন্তা, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির পরিচয় থাকে।

উর্দুকে বাংলা ভাষাভাষীদের উপর চাপিয়ে দেওয়া যে পাকিস্তানের আমলাতান্ত্রিক চক্রান্তের ফল, উর্দু ভাষা যে পাকিস্তানের কোন অংশের ভাষা নয়, একটি বিদেশী ভাষা এবং উর্দুর মাধ্যমে বাঙালীদের “চিন্তা, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির’ কোন পরিচয় যে পাওয়া যায় না একথা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের কাছে যত স্পষ্টভাবেই প্রতীয়মান হোক না কেন, উর্দু সমর্থকরা কিন্তু সেগুলিকেই তাঁদের দাবীর অন্যতম প্রধান যুক্তি হিসাবে উপস্থাপিত করতে সব সময়েই আগ্রহশীল ছিলেন।

কাজেই পূর্ব যুক্তির জের টেনে উর্দুর স্বপক্ষে মর্নিং নিউজ বলেন:

এ রকম একটা ভাষাই আমাদের হাতের কাছে আছে। সেটা হলো উর্দু, যাকে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের লোকেরা নাম দিয়েছিলেন হিন্দুস্থানী। উপমহাদেশের অর্ধেকের বেশী লোক এই ভাষায় কথা বলে এবং সাধারণভাবে সকলেই তা বোঝে। এর থেকেও বেশী এই যে, পোর্ট সাঈদ থেকে সাংহাই পর্যন্ত এই ভাষায় কথা বলা হয় এবং লোকে তা বোঝে।… উর্দু একটি আন্তর্জাতিক ভাষার পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে এবং এটা হলো দুই ডোমিনিয়নের ‘লিংগুয়া ইন্ডিকা’ যা আরবী এবং দেবনাগরী, দুই অক্ষরেই লেখা হয়। যদি তারা ইংরেজীকে চালু রেখে তাকে হিন্দুস্থানী এবং পাকিস্তানীদের চিন্তার উপর রাজত্ব করতে না দেন, তাহলে উৎসাহী মাতৃভাষাওয়ালাদের হাতে সবকিছু ছেড়ে দিলে আন্তঃপ্রাদেশিক এবং আন্তঃডোমিনিয়ন সামাজিক, আধিমানসিক এবং বাণিজ্যিক লেনদেন এক অচল অবস্থায় এসে দাঁড়াবে।

এরপর পূর্ব বাঙলার অধিবাসীদের সংস্কৃতির বর্ণনা প্রসঙ্গে পত্রিকাটি মন্তব্য করেন:

পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলের লোকদের সমস্যা দ্বিগুণ গুরুতর এবং গুরুত্বপূর্ণ। রাজনৈতিক দাসত্ব যথেষ্ট খারাপ কিন্তু বুদ্ধিগত দাসত্বের থেকে হীনতম ও নিম্নতম দাসত্ব আর কিছু নেই। বাঙালী পণ্ডিতদের মতে মুসলমানদের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলাদেশ যে ভাষা লাভ করে, সেটাই হিন্দু-মুসলমান লেখকদের হাতে পুঁথি সাহিত্য হিসাবে বিকশিত হয়। ইংরেজদের আগমন এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীকে দেওয়ানীদানের পর এ দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা এমনভাবে ভেঙে পড়ে, যার ফলে এক শতাব্দীর স্বল্প পরিসরের মধ্যে শাসকেরা উপনীত হয় নিতান্ত দরিদ্র অবস্থায়। তাদের প্রভাবই যে শুধু বিনষ্ট হলো তাই নয়, তারা আত্মবিশ্বাসও হারিয়ে ফেললো। ইংরেজী-জানা বুদ্ধিজীবীরা পাদ্রী এবং বৃটিশ আমলাদের সাথে যোগাযোগের মাধ্যমে যে মিলের চাকা দ্রুতভাবে ঘোরানোর কাজে লিপ্ত হলো, সেই মিলই তাদেরকে গুঁড়িয়ে দিলো! বাংলাদেশের লোকের সাধারণ ভাষা ক্ৰমশঃ সংস্কৃত প্রভাবাচ্ছন্ন হলো এবং মুসলমানেরা ‘ভদ্রলোক’ শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত হওয়ার জন্যে সেই ভাষার বাক-বৈশিষ্ট্যকে গ্রহণ করলো। এখানেই শেষ নয়। নিজের ঐতিহ্যের সাথে, তার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হলো এবং সংস্কৃতি ও সভ্যতার দিক দিয়েও সে হয়ে দাঁড়ালো দো- আঁশলা।

এই ‘দো-আঁশলা’ সংস্কৃতির হাত থেকে নিষ্কৃতি লাভ করে পূর্ব বাঙলার মুসলমানরা কিভাবে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি গড়ে তুলতে পারে সে সম্পর্কে মুরুব্বীয়ানার ভঙ্গীতে উপদেশ দেওয়ার প্রচেষ্টায় সম্পাদকীয়টিতে বলা হয়:

সেই পূর্ব অবস্থা ফিরে পাওয়ার একটা সুযোগ এখন তার সামনে উপস্থিত হয়েছে। নিজের মাতৃভাষা ভুলে যাওয়ার কথা কেউ তাকে বলছে না। করাচীতে তার যে সমস্ত শুভাকাঙ্ক্ষী মিলিত হয়েছিল তারা একটা দূরদর্শী পরামর্শ হিসাবে তাকে সমস্ত জড়তা মুছে ফেলে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে বলেছেন। ইন্দোনেশিয়াকে বাদ দিলে পূর্ব-বাঙলাই পৃথিবীর মধ্যে মুসলমানদের সব থেকে বড় একটা ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা। ইসলামের প্রতি সেই হিসাবে তার একটা কর্তব্য আছে। এ কাজ তার পক্ষে একা বিচ্ছিন্নভাবে থেকে বাংলার রসাস্বাদনের দ্বারা সম্ভব নয়। পাকিস্তান রাষ্ট্রের সিন্ধী, বালুচ, পাঞ্জাবী, পশতুভাষী প্রভৃতি নাগরিকদের মন তাকে প্রথমে বুঝতে হবে এবং সেই সাথে নিজের অসুবিধার কথাও তাদের বোঝাতে হবে। সকলের বোধগম্য একটি সাধারণ ভাষা ব্যতীত এ কাজ কীভাবে করা সম্ভব? আজ ইংরেজী সেই কাজ করছে। কিন্তু কতদিন পর্যন্ত? পাকিস্তানের লোকেরা যদি সত্যিই মুসলমান মতে কিছু করতে চায় তাহলে এখন থেকেই তাদেরকে সে প্রস্তুতি নিতে হবে এবং নিজেদের রাষ্ট্রের জন্যে একটি ভাষা নির্বাচন করতে হবে।…

বাংলা ভাষায় ইসলাম এবং ইসলামী ইতিহাসের উপর কোন বই-পুস্তক নেই বললেই চলে। আমরা এ বিষয়ে নিঃসন্দেহ যে আজকের একজন বিক্ষুব্ধ যুবক আগামী দিনে তার সন্তানরা যাতে আরও ভালো মুসলমান হয় সেটাই চায়। যুবকেরা যাতে তাদের ইসলামী ঐতিহ্য সম্পর্কে গর্ববোধ করে সে ব্যবস্থা করতে হবে এবং নিজেদের দায়িত্ব যাতে সাহস ও আত্মবিশ্বাসের সাথে পালন করার জন্যে প্রস্তুত হয়, তার দিকেও খেয়াল রাখতে হবে। তার পক্ষে আরবীতে লিখিত তথ্যের সাথে পরিচিত হওয়া খুব অসুবিধাজনক, ফরাসী তরজমাও তার পক্ষে বিরক্তিকর হবে। অন্য পক্ষে ইসলাম বিষয়ক এক বিশাল সাহিত্য উর্দুতে রয়েছে। বাঙলাদেশের মুসলমানেরা ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সকলেই উর্দু বলতে এবং বুঝতে পারে। তারা দিল্লী, আলীগড় অথবা লাখনৌ-এর লোকদের মতো চমৎকারভাবে উর্দুতে কথা বলতে না পারলেও প্রত্যেক মুসলমান শিশুই কোরানের বর্ণমালার সাথে পরিচিত, কাজইে উর্দু শেখা তার পক্ষে সহজই হবে। করাচীর সিদ্ধান্তের তাৎপর্য এখানেই। এর মধ্যেই পূর্ব-পাকিস্তানী মুসলমানদের মুক্তি এবং গৌরবময় ভবিষ্যৎ নিহিত।

উপরোদ্ধৃত সম্পাদকীয়টির মূল বক্তব্য পূর্ব বাঙলার মুসলমানরা এতদিন হিন্দু সংস্কৃতির আওতায় ছিলো এবং সেই আওতামুক্ত হয়ে নিজেদের সংস্কৃতি গঠন করতে হলে ইসলামী সংস্কৃতিই তার মূল অবলম্বন হওয়া উচিত এবং ইসলামী সংস্কৃতি সম্পর্কে জ্ঞান লাভের জন্যে বাংলা ভাষা তো নয়ই এমনকি আরবী, ফারসীও যথেষ্ট নয়। তার জন্যে আমাদেরকে দ্বারস্থ হতে হবে উর্দুর, কারণ ‘বাঙলাদেশের মুসলমানেরা ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সকলেই উর্দু বলতে এবং বুঝতে পারে।’ তা ছাড়া প্রত্যেক মুসলমান শিশু কোরানের বর্ণমালার সাথে পরিচিত হওয়ার ফলে তাদের পক্ষে উর্দু শেখা কোন কঠিন ব্যাপর নয়। কাজেই পূর্ব- বাঙলার অধিবাসী, তোমরা উর্দুর জয়ধ্বনি করো!

পূর্ব বাঙলার প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীনের কাছে প্রেরিত স্মারকলিপিতে[১০৮] সিলেটের কিছুসংখ্যক নাগরিক উর্দুর সমর্থনে যে যুক্তিতর্কের অবতারণা করেন তার সাথে মর্নিং নিউজ-এর বক্তব্যের কোন মৌলিক তফাৎ নেই। কিন্তু তাঁদের বক্তব্যের সাম্প্রদায়িক ও মুৎসুদ্ধি চরিত্র আরও স্পষ্টতর। বাংলা ভাষার দাবীতে যাঁরা আন্দোলন করেছিলেন, তাঁদের প্রতি কটাক্ষ করে স্মারকলিপিতে বলা হয়:

একদল লোক নিজেদেরকে বিরাট সাহিত্যিক, শিল্পী ও পণ্ডিত বলে জাহির করে উর্দুর বিরুদ্ধে দারুণ প্রচারণা শুরু করেছে। পূর্ব-বাঙলার লোকেরা একটি জাতি, এই উদ্ভট ধারণার বশবর্তী হয়ে তারা উর্দুকে জাতীয়তাবিরোধী বিদেশী ভাষা হিসেবে বর্জন করতে বদ্ধপরিকর হয়েছে। সীমিত দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে দেশপ্রেমের মুখোশ পরে তারা বাংলাকে পূর্ব- পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা করার জন্যে চারিদিকে তোলপাড় আরম্ভ করেছে। জনমতের প্রতিনিধিত্ব করার ভাব দেখিয়ে তারা নিজেরাই বাংলার মতো এমন এক ভাষার দাবী তুলেছে, যে-ভাষার একটি মুসলিম রাষ্ট্রের জাতীয় ভাষার মর্যাদা লাভের মত যোগ্যতা একেবারেই নেই। মুসলিম সংস্কৃতির গৌরবময় ঐতিহ্যবাহী উর্দু ভাষাকে বর্জন করার এই নির্লজ্জ প্রচেষ্টা যে শুধু ধ্বংসাত্মক তাই নয়, তা পশ্চাদমুখী, নিন্দনীয় এবং সর্বোপরি সার্বজনীন ইসলামী ভ্রাতৃত্বের প্রতি চ্যালেঞ্জস্বরূপ। তারা যদি বাংলাকে একটি বিশেষ পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে চালু করা এবং উর্দুকে ইংরেজীর জায়গায় রাষ্ট্রভাষা করার কথা বলতো তাহলে সেটা বোঝা যেতো। কিন্তু বাংলা সমর্থকরা পূর্ব-বাঙলা থেকে তাড়িয়ে দিতে চায় এবং আমাদের সুচিন্তিত মতানুসারে সেটা পূর্ব-পাকিস্তানের মুসলমানদের পক্ষে আত্মহত্যার শামিল।

তাঁদের এই বক্তব্যের সমর্থনে স্মারকলিপির স্বাক্ষরকারীরা কয়েকটি বিশেষ যুক্তির অবতারণা করেন। যথা:

মুসলিম জাতির মহান স্রষ্টা স্যার সৈয়দ, হালী, ডক্টর ইকবাল ও অন্যান্যদের জাতীয় সাহিত্য থেকেই মুসলিম পুনর্জাগরণের প্রেরণা এসেছিলো। আমরা যদি জাতীয়তাবাদ বিরোধী বলে উর্দুকে বর্জন করি, তাহলে আমরা নিজেদের প্রতিই বিশ্বাসঘাতকতা করবো এবং নিজেদেরকেই অস্বীকার করবো। এই ধ্বংসাত্মক প্রবণতা আমাদের মুসলিম জাতীয়তার ভিত্তিকে সম্পূর্ণভাবে বিনষ্ট এবং আমাদের পৃথক সত্তাকে ধ্বংস করবে। উর্দু এখনো সেই প্রেরণাউদ্দীপক শক্তি, যা এই বিশাল উপমহাদেশের দশ কোটি মুসলমানকে একতাবদ্ধ করতে পারে…। পবিত্র কোরান এবং অন্যান্য ইসলামী সাহিত্য থেকে প্রেরণাপ্রাপ্ত উর্দু ভাষাকে অবহেলা করে আমরা যদি প্রধানত রামায়ণ, মহাভারত, উপনিষদ, বেদ এবং অন্যান্য সংস্কৃত সাহিত্য থেকে প্রেরণাপ্রাপ্ত বাংলা ভাষার দিকে যাই, তাহলে আমরা আমাদের জাতীয় সত্তাকেই অস্বীকার করবো। পৃথক সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং দৃষ্টিভঙ্গী গঠিত ভারতের মুসলমানদের পৃথক জাতিতত্ত্বের উপর ভিত্তি করেই পাকিস্তানের ধারণার জন্ম। ভারতীয় মুসলমানদের জাতীয় ভাষা এবং ইসলাম ও আধুনিক বিজ্ঞান বিষয়ক সাহিত্যে সমৃদ্ধ উর্দুই পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হওয়ার জন্যে সর্বাপেক্ষা উপযুক্ত ভাষা।

এই যুক্তির পর স্মারকলিপিতে বলা হয় যে, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার সপক্ষে যারা ওকালতী করছেন তাদের মতের সাথে জনসাধারণের মতের কোন মিল নেই। উপরন্তু উর্দুর দাবী যারা করছেন তাঁরাই প্রকৃতপক্ষে জনমতের প্রতিনিধি। সিলেট জেলা মুসলিম ছাত্র ফেডারেশন, শর্ষিনায় অনুষ্ঠিত বঙ্গীয় প্রাদেশিক জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের কনফারেন্স, ‘২০ লক্ষ সিলেটবাসীর মুখপাত্র যুগভেরী’, পূর্ব বাঙলার একমাত্র মুসলিম সাপ্তাহিক ‘আসাম হেরাল্ড’, আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ডক্টর জিয়াউদ্দীন, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ফজলুর রহমান প্রভৃতির উদু সমর্থনের কথাও তাঁরা উল্লেখ করেন।

তাঁদের মতে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা না করে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করলে, পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে ঐক্যসূত্র বিচ্ছিন্ন হবে এবং তার ফলে পাকিস্তানী জাতীয়তা ধ্বংস হয়ে যাবে। এ ছাড়া তাঁরা বলেন যে, রবীন্দ্রনাথ-নজরুল ইসলামের বাংলা ভাষায় ‘প্রাদেশিক দেশপ্ৰেম প্রচার করা যায় কিন্তু কোন সামরিক কাজকর্ম সে ভাষার মাধ্যমে সম্ভ্রম নয়। বাংলা ভাষা বর-কনের আলাপের উপযোগী হতে পারে কিন্তু তার মাধ্যমে বীরত্বব্যঞ্জক কিছু ব্যক্ত করা চলে না। বাংলার তুলনায় উর্দু একটা বীর্যপূর্ণ ভাষা এবং তার চরিত্রে পুরুষত্ব আছে। উপরে উদ্ধৃত এবং আলোচিত স্মারকলিপির স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে নিম্নলিখিত কয়েকজন উল্লেখযোগ্য:

আসাম সরকারের ভূতপূর্ব মন্ত্রী মুদাব্বির হোসেন; নজমুল হোসেন, সভাপতি মুসলিম সাহিত্য সংসদ; শামসুজ্জামান চৌধুরী, দর্শনের সিনিয়র অধ্যাপক; আবদুল হাই, দর্শনের অধ্যাপক; মিসবাহুল বার চৌধুরী; খায়রুন্নেসা খানম; মৌলানা রাজিউর রহমান, সম্পাদক আসাম হেরাল্ড এবং যুগভেরী।

৯. ওয়ার্কার্স ক্যাম্প ও রশিদ বই সমস্যা

দেশভাগের পর আবুল হাশিম বর্ধমানে থেকে গেলেন এবং শহীদ সুহরাওয়ার্দীও ঢাকা এলেন না। তার ফলে মুসলিম লীগের নাজিমুদ্দীন-বিরোধী বামপন্থী দলের কর্মীরা প্রায় ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়লেন। আবুল হাশিম মুসলিম লীগের সভাপতি হিসাবে যখন নির্বাচন প্রার্থী হন তখন সুহরাওয়ার্দী তাঁকে সাহায্য করেননি। উপরন্তু ফজলুল হককেই প্রকারান্তরে সমর্থন করেছিলেন। এর ফলে তাঁর এবং আবুল হাশিমের মধ্যে দ্বন্দ্ব বেশ ভালোভাবে দেখা দেয়। মাউন্ট ব্যাটেন রোয়েদাদ ঘোষণার পর আবুল হাশিম জুন মাসের দিকেই তিন মাসের ছুটিতে যান এবং তাঁর স্থানে হাবিবুল্লাহ বাহার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হিসাবে কাজ করতে থাকেন।

৫ই আগস্ট, ১৯৪৭ পূর্ব বাঙলার নেতা নির্বাচনের সময় আবুল হাশিম সুহরাওয়ার্দীকে পার্টিগতভাবে কোন সাহায্য করেননি এবং অনেকটা তার ফলেই তিনি ৩৯/৭৫ ভোটে নাজিমুদ্দীনের কাছে পরাজিত হন। পূর্ব বাঙলায় নোতুন সরকার স্থাপিত হওয়ার পর আবুল হাশিম, সুহরাওয়ার্দী, কেউ ঢাকাতে না থাকায় তাঁদের উপদলীয় কর্মীদের বিরুদ্ধে নাজিমুদ্দীনরা যথেষ্ট তৎপর ও সক্রিয় হয়ে ওঠেন।[১০৯]

১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের পুরাতন কমিটিগুলিকে ভেঙে দিয়ে মুসলিম লীগ পুনর্গঠনের প্রস্তুতি আরম্ভ হয়। এ কাজের জন্যে যে সাংগঠনিক কমিটি গঠিত হয় তার সভাপতি মনোনীত হন মৌলানা আকরম খাঁ। তিনি ছাড়াও এই কমিটির অন্যান্য সদস্যদের মধ্যে ইউসুফ আলী চৌধুরী (মোহন মিঞা), নূরুল আমীন, আবদুল মোতালেব মালেক প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। এই প্রাদেশিক কমিটি ব্যতীত প্রত্যেক জেলাতে নয়জন সদস্যবিশিষ্ট এক একটি কমিটি গঠন করা হয় এবং সেখানেও একজন করে চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন।[১১০]

‘বামপন্থী’ মুসলিম লীগ কর্মীরা যাতে নোতুন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগের সাংগঠনিক কার্যে অংশগ্রহণ করতে পারেন তার উপযুক্ত ব্যবস্থাদি গ্রহণের উদ্দেশ্যে শামসুল হক, কমরুদ্দীন আহমদ, শেখ মুজিবুর রহমান, মুশতাক আহমদ প্রভৃতি যৌথভাবে ১৯৪৮ এর জানুয়ারীতে ঢাকা শহরে পুরাতন মুসলিম লীগ কর্মীদের একটি সম্মেলন আহ্বান করেন। ‘ওয়ার্কার্স ক্যাম্প’ নামে অভিহিত এই সম্মেলন মুসলিম লীগের সাবেক অফিস ১৫০ নম্বর মোগলটুলীতে কয়েকদিন ধরে অনুষ্ঠিত হয়। ‘ওয়ার্কার্স ক্যাম্প’ কোন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ছিলো না। এর একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল মুসলিম লীগের বামপন্থীদের পক্ষে সাংগঠনিক কার্যে অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি করা। এ জন্যে এই সম্মেলনে কোন কর্মকর্তা নির্বাচন করা হয়নি। মুসলিম লীগ যেহেতু সাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠান এজন্যে পূর্ব বর্ণিত গণতান্ত্রিক যুব লীগের কর্মীরা সাধারণভাবে এই সম্মেলনে যোগদান করেননি।[১১১] তবে কমরুদ্দীন আহমদ, শামসুল হক প্রভৃতির মতো কেউ কেউ উভয় সম্মেলনেই উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করেন।

ওয়ার্কার্স ক্যাম্পের সকল কর্মীই অবিভক্ত বাঙলায় শহীদ-হাশিম ‘বামপন্থী’ উপদলের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন এবং তাঁদের ভয়ে আকরম খাঁ, নাজিমুদ্দীন, নূরুল আমীন প্রমুখ ‘দক্ষিণপন্থী’ উপদলীয় নেতারা রীতিমতো শংকিত থাকতেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর শহীদ সুহরাওয়ার্দী এবং আবুল হাশিম উভয়েই পশ্চিম বাঙলায় থেকে যাওয়ায় মুসলিম লীগ রাজনীতিতে আবার আকরম খাঁ এবং খাজা পরিবারের প্রভাব প্রতিপত্তি স্থাপিত হয়। প্রায়-বিনষ্ট এই প্রভাব প্রতিপত্তি আবার নষ্ট হওয়ার আশংকায় আকরম খাঁ ওয়ার্কার্স ক্যাম্পের কর্মীদেরকে রশিদ বই দিতে সরাসরি অস্বীকার করেন। পদ্ধতি হিসাবে ইতিপূর্বেই তাঁরা স্থির করেছিলেন যে, বিভিন্ন সাংগঠনিক কমিটির সদস্য ব্যতীত অন্য কাউকে রশিদ বই দেবেন না। এ ছাড়া এই কমিটিগুলি গঠন করার সময়েও তাঁরা সর্বক্ষেত্রেই নিজেদের লোকদেরকে মনোনয়ন দান করেছিলেন।[১১২]

কিন্তু তাঁদের এই মনোভাব সত্ত্বেও প্রায় একরকম জোর করেই ক্যাম্প কর্মীদের একটি প্রতিনিধিদল আকরম খাঁর সাথে সাক্ষাৎ করেন। এই দলটিতে ছিলেন আতাউর রহমান, শামসুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান, মিসেস আনোয়ারা খাতুন, মোস্তফা আহমদ, কমরুদ্দীন আহমদ, সবুর খান, ফজলুল কাদের চৌধুরী এবং আরও কয়েকজন।[১১৩] আকরম খাঁ এই প্রতিনিধিদলটিকে বলেন যে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর মুসলিম লীগকে পূর্বের মতো এত বড় আকারে গঠন করার কোন প্রয়োজন নেই। এ ছাড়া তিনি ক্যাম্পের কর্মীদেরকে মুসলিম লীগ কর্মী হিসাবে বিবেচনা করতেই অস্বীকার করেন।[১১৪]

প্রাদেশিক সাংগঠনিক কমিটির সভাপতি মৌলানা আকরম খাঁর কাছ থেকে রশিদ বই পাওয়ার সরাসরি চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর কর্মীরা পাকিস্তান মুসলিম লীগের প্রধান অর্গানাইজার চৌধুরী খালিকুজ্জামানের কাছে এ ব্যাপারে সুপারিশের জন্যে পাঞ্জাব প্রাদেশিক মুসলিম লীগের ভূতপূর্ব সভাপতি মিঞা ইফতিখারুদ্দীনকে অনুরোধ করেন। ইফতিখারুদ্দীন জানুয়ারীর শেষ সপ্তাহে ঢাকা সফরে এলে মুসলিম লীগ কর্মীদের সাথে এ ব্যাপারে তাঁর বিস্তৃত আলোচনা হয়। খালিকুজ্জামানের সাথে রশিদ বই সংক্রান্ত বিষয়ে আলাপ করতে তিনি সম্মত হন। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তান ফিরে যাওয়ার পর তাঁর কাছ থেকে এ ব্যাপারে কোন সংবাদ পাওয়া যায়নি।[১১৫]

ফেব্রুয়ারী মাসে মিঞা ইফতিখারুদ্দীন দ্বিতীয়বার ঢাকা আসেন। এবারও তাঁর সাথে ওয়ার্কার্স ক্যাম্পের কর্মীরা মুসলিম লীগের সাংগঠনিক কাজকর্ম এবং রশিদ বই সংক্রান্ত বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করেন। এর পর পশ্চিম পাকিস্তান ফেরৎ গিয়ে ইফতিখারুদ্দীন খালিকুজ্জামানের সাথে রশিদ বই নিয়ে আলাপ করেন কিন্তু সমস্ত ব্যাপারটি প্রাদেশিক সাংগঠনিক কমিটির আওতাভুক্ত এই অজুহাত দেখিয়ে খালিকুজ্জামান কোন প্রকার হস্তক্ষেপ করতে অস্বীকৃত হন।[১১৬]

আকরম খাঁকে রশিদ বই দেওয়ার ব্যাপারে কোনক্রমেই সম্মত করাতে সক্ষম না হয়ে অবশেষে কর্মীরা বুড়িগঙ্গার অপর পারে জিঞ্জিরায় একটি সভা আহ্বান করেন। কিন্তু সরকারী অনুমতির অভাবে কোন সভা সেখানে অনুষ্ঠিত হয়নি।[১১৭]

এর পর কর্মীরা খান সাহেব ওসমান আলীর সহায়তায় নারায়ণগঞ্জে একটি কনভেনশন আহ্বানের চেষ্টা করেন। খান সাহেবকে সভাপতি করে একটি সংবর্ধনা কমিটিও গঠিত হয়। সভাটি নারায়ণগঞ্জের রহমতুল্লাহ ইনস্টিটিউটে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু নির্দিষ্ট দিনে সভা আরম্ভের পূর্বেই পুলিশ এবং পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলের লোকজন এসে সভাস্থলে উপস্থিত হয় এবং তারা যাতে সেখানে সভা করতে না পারে তার ব্যবস্থা করে। রহমতুল্লাহ ইনস্টিটিউটে সভা করতে অক্ষম হয়ে কর্মীরা নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়া ক্লাবে সমবেত হন।[১১৮]

প্রাথমিক রশিদ বইয়ের প্রশ্নটি আলোচনার জন্যে চৌধুরী খালিকুজ্জামানের কাছে একটি প্রতিনিধিদল পাঠানোর প্রস্তাব এই সভাতে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। প্রতিনিধি দলের সদস্য হিসাবে আতাউর রহমান খান এবং মিসেস আনোয়ারা খাতুন মনোনীত হন। তৎকালে কর্মীদের নিজেদের কোন সাংগঠনিক তহবিল না থাকার ফলে তারা প্রতিনিধিদলের যাতায়াতের ব্যয় বহনে সমর্থ ছিলো না কিন্তু আতাউর রহমান এবং আনোয়ার খাতুন নিজেরাই তাঁদের সমস্ত ব্যয়ভার বহন করতে সম্মত হলে তাঁদেরকেই প্রতিনিধিত্ব করার জন্যে নির্বাচন করা হয়।[১১৯]

প্রতিনিধিদলটি করাচীতে চৌধুরী খালিকুজ্জামানের সাথে সাক্ষাৎ করেন কিন্তু মুসলিম লীগের সাংগঠনিক কাজকর্মে অংশগ্রহণের উদ্দেশ্যে কর্মীদেরকে রশিদ বই দেওয়ার জন্যে আকরম খাঁকে অনুরোধ করতে তিনি অস্বীকার করেন। ওয়ার্কার্স ক্যাম্পের কর্মীরা সকলেই সরকারবিরোধী এবং সেই হিসাবে তাদেরকে মুসলিম লীগের সাথে কোন সম্পর্ক রাখতে দেওয়া চলে না এই মর্মেও খালিকুজ্জামান প্রতিনিধিদলটির কাছে মত প্রকাশ করেন।[১২০] মুসলিম লীগের প্রাদেশিক ও কেন্দ্রীয় অর্গানাইজারদের এই মনোভাব এবং আচরণের ফলে মুসলিম লীগ কর্মীদের মধ্যে যথেষ্ট হাতাশার সঞ্চার হয়। তাঁরা অনেকে এ থেকে সিদ্ধান্ত করেন যে মুসলিম লীগের সদস্য হিসাবে তাদের পক্ষে তৎকালীন অবস্থায় রাজনীতি করা আর সম্ভব নয়। কাজেই তার জন্যে একটি পৃথক প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন।

মুসলিম লীগ সাংগঠনিক কমিটির উপরোক্ত কার্যকলাপ এবং নোতুন রাজনৈতিক সংগঠন গঠন প্রসঙ্গে তৎকালীন দৈনিক ইত্তেহাদ সম্পাদক আবুল মনসুর আহমদ তাঁর আত্মস্মৃতিতে নিম্নলিখিত মন্তব্য ব্যক্ত করেছেন:

সুতরাং পাকিস্তান হাসিলের সঙ্গে সঙ্গেই মুসলিম লীগের দরজা জনগণের মুখের উপর বন্ধ করিয়া দেওয়া শুধু রাজনৈতিক অপরাধ ছিল না, নৈতিক মর‍্যাল ও এথিক্যাল অপরাধও ছিল। তবু নেতারা শুধুমাত্র কোটারি স্বার্থ রক্ষার জন্য মুসলিম লীগকে পকেটস্থ করিলেন। এই কাজে তাঁরা প্রথম অসাধুতার আশ্রয় নেন বাংলা বাটোয়ারা হইয়াছে এই অজুহাতে বাংলার মুসলিম লীগ ভাঙ্গিয়া দিয়া। কাজটা করলেন তারা এমন বেহায়া বেশরমের মত যে পাঞ্জাব ভাগ হওয়া সত্ত্বেও পাঞ্জাবের মুসলিম লীগ ভাঙ্গিলেন না। ফলে পক্ষপাতিত্বদোষে বমাল গ্রেফতার হইলেন। দ্বিতীয় অসাধুতা করিলেন তাঁরা নিজেদের বাধ্য-অনুগত লোক দিয়া এডহক কমিটি গঠন করিয়া। তৃতীয় অসাধু কাজ করিলেন নয়া মুসলিম লীগ গঠনের জন্য প্রাইমারী মেম্বারশিপের রশিদ বই বগল-দাবা করিয়া। মুসলিম লীগ কর্মীদের পক্ষে জনাব আতাউর রহমান খান ও বেগম আনওয়ারা খাতুন প্রথমে মওলানা আকরম খাঁ ও পরে চৌধুরী খালেকুজ্জামানের কাছে দরবার করিয়াও রশিদ বই পান নাই। তাঁরা নাকি স্পষ্টই বলিয়াছিলেন, এখন তাঁরা আর বেশী মেম্বার করিতে চান না। তাঁদের যুক্তি ছিল এখন শুধু গঠনমূলক কাজ দরকার। হৈ হৈ করিলে তাতে বিঘ্ন সৃষ্টি হইবে। এসব কথা আমি কলিকাতা বসিয়া খবরের কাগজে পড়িয়াছিলাম। নিজের কাগজ ‘ইত্তেহাদে’ এই অদূরদর্শিতার কঠোর নিন্দা করিয়াছিলাম। বলিয়াছিলাম, যেসব দেশে একদলীয় শাসন চালু আছে, সেখানেও রুলিং পার্টির দরজা এমন করিয়া বন্ধ করা হয় নাই। লীগ নেতৃত্বের এই মনোভাব ছিল অযৌক্তিক ও অবৈজ্ঞানিক। কায়েদে আযমের জীবিতকালেই শাসকগোষ্ঠী ও তাঁদের সমর্থকরা এই নীতি অনুসরণ করিয়াছিলেন দেখিয়া আমার মনে কম ধান্ধা লাগে নাই।[১২১]

কাজেই ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ব্যক্তিদের উপরোক্ত আচরণের ফলে:

অগত্যা মুসলিম লীগ কর্মীরা মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে প্রথমে নারায়গঞ্জে ও পরে টাঙ্গাইল কর্মী-সম্মিলনী করিয়া নেতাদের কাজের তীব্র প্রতিবাদ করেন এবং মুসলিম লীগের দরজা খুলিয়া দিতে দাবী করেন। নেতারা কর্ণপাত না করায় ১৯৪৯ সালে নিজেরাই মুসলিম লীগ গঠন করেন। সরকারী মুসলিম লীগ হইতে পার্থক্য দেখাইবার জন্য তাঁদের প্রতিষ্ঠানের নাম রাখিলেন: জনগণের (আওয়ামী) মুসলিম লীগ।[১২২]

১০. প্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ

অক্টোবর মাসে ফজলুল হক হলের সাহিত্য সভার পর তমদ্দুন মজলিশের উদ্যোগেই সর্বপ্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। সে সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটের কাছে রশিদ বিল্ডিং নামে একটি বাড়ী ছিলো। সেটি এখন আর নেই, কিন্তু তখনকার সেই রশিদ বিল্ডিংয়ের একটি কামরায় তমদ্দুন মজলিশের অফিস অবস্থিত ছিলো। সেখানেই তমদ্দুন মজলিশ এবং মুসলিম ছাত্রলীগের অল্প কয়েকজন কর্মীর উপস্থিতিতে সংগ্রাম পরিষদটি গঠিত হয় এবং তমদ্দুন মজলিশের অন্যতম প্রধান সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নূরুল হক ভূঞা তার আহ্বায়ক নির্বাচিত হন।[১২৩]

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর মানি অর্ডার ফর্ম, ডাক টিকিট এবং মুদ্রায় শুধুমাত্র ইংরেজী ও উর্দু ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। বাংলার ব্যবহার এগুলি থেকে বাদ দেওয়ার ফলে পূর্ব বাঙলার জনসাধারণ ও শিক্ষিত মহলে যথেষ্ট উদ্বেগ ও বিরুদ্ধ মনোভাবের সৃষ্টি হয়। এই সময় পাকিস্তান সরকারের শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমান উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করা, আরবী হরফে বাংলা লেখা ইত্যাদির সপক্ষে সভা-সমিতি ও সংবাদপত্রের মাধ্যমে অনেক বিতর্কের অবতারণা করেন। বস্তুতঃ এই পর্যায়ে তিনিই ছিলেন সরকারের বাংলা-বিরোধী নীতির অন্যতম প্ৰধান মুখপাত্র।

রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হওয়ার পরই ফজলুর রহমান ঢাকা আসেন এবং আবুল কাসেমসহ পরিষদের আরও কয়েজন সদস্য মওলা সাহেবের (ফজলুল হক) নাজির বাজারের বাসায় ১৯৪৮ এর ১লা ফেব্রুয়ারী তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করেন।[১২৪] এই সাক্ষাৎকারের সময় ফজলুর রহমানের সাথে সংগ্রাম পরিষদ পাকিস্তান পাবলিক সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষার বিষয় তালিকা থেকে বাংলা ভাষাকে বাদ দেওয়া, পাকিস্তানের মুদ্রা, ডাক টিকিট ইত্যাদিতে বাংলা ভাষা স্থান না পাওয়া ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা করেন।[১২৫] আলোচনা পরিশেষে তুমুল বিতর্কে পরিণত হয়।[১২৬] এই বিতর্ককালে অবশ্য ফজলুর রহমান বলেন যে, উপরোক্ত কয়েক ক্ষেত্রে বাংলা ভাষাকে বাদ দেওয়ার ব্যাপারটি একেবারেই ইচ্ছাকৃত নয়। নিতান্ত ভুলবশতঃই সেটা ঘটেছে। তিনি সে ভুল সংশোধনের আশ্বাসও প্রতিনিধিদলটিকে দান করেন।[১২৭]

এই সাক্ষাৎকার প্রসঙ্গে দৈনিক ইত্তেহাদ ‘ভুলের পুনরাবৃত্তি’ নামে একটি সম্পাদকীয়তে[১২৮] উল্লেখ করেন যে— শুধু মুদ্রা, ডাক টিকিট ও পাবলিক সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষার বিষয়- তালিকা থেকেই বাংলাকে বাদ দেওয়া হয় নাই। এগুলি ছাড়া পাকিস্তানের নৌবাহিনীতে পূর্ব পাকিস্তান থেকে লোক নিয়োগের ক্ষেত্রেও উর্দু এবং ইংরেজীতে পরীক্ষা নেওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে। এর পর উক্ত সম্পাদকীয়তে বলা হয়:

মিঃ ফজলুর রহমান হয়ত এগুলিকে ভুল বলিয়া চালাইবার প্রয়াস পাইবেন। কিন্তু সব কয়টি ক্ষেত্রেই বাংলা ভাষাকে ভুলে’ বাদ দেওয়া হইয়াছে, এ কথা কে বিশ্বাস করিবে? বিচক্ষণ রাষ্ট্রনায়ক ও কর্মকর্তাদের পক্ষে এতবার একই ভুল করা কী করিয়াই বা সম্ভব। নিতান্ত ‘ভুল’ ও বারে বারে পুনরাবৃত্তি করিলে যে তাহাই ‘শুদ্ধ’ হইয়া যায় সে খবর কি ফজলুর রহমান সাহেবের জানা নাই? পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশের মাতৃভাষা ও পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষার অস্তিত্বের কথা যাঁরা এইভাবে বারবার ‘ভুলিয়া যাইতে পারেন, তাঁদের পক্ষে পূর্ব পাকিস্তানকে একদিন ভুলিয়া যাওয়া বিচিত্র নয়।

এরপর রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নের সাথে পূর্ব পাকিস্তানের সামগ্রিক জীবনের সম্পর্কের বিষয়ে সম্পাদকীয়টিতে বলা হয়:

রাষ্ট্রভাষা সওয়ালটা শুধু রাজকার্যের মাধ্যমের সওয়াল নয়, এর সাথে রাষ্ট্রের জনগণের উন্নতি, অবনতি, আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার ও রাষ্ট্রীয় সংহতির প্রশ্নও অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। এইরূপ একটি নাজুক প্রশ্ন লইয়া ছেলেখেলা চলে না। কিন্তু দুঃখের সহিত আমরা লক্ষ্য করিতেছি যে, সেই ছেলেখেলাই যেন চলিতেছে। পাকিস্তানের মেজরিটির মাতৃভাষার বিরুদ্ধে যেন ব্যুরোক্র্যাটিক ষড়যন্ত্র চলিতেছে। নইলে অভিজ্ঞ ও দায়িত্বসম্পন্ন কর্মচারীদের পক্ষে এমন ‘ভুল’ বার বার দুহরানো সম্ভব নয়। কিন্তু এই পুনরাবৃত্তি ‘ভুলই’ হউক আর মতলবই হউক, এর পরিণতি রাষ্ট্রের পক্ষে সমান বিষময়। কারণ রাষ্ট্রভাষার মত নাজুক প্রশ্নের বিচার করিতে গিয়া জনগণের সমষ্টিগত সুবিধা ও সেন্টিমেন্টকে উপেক্ষা করিলে চলিবে না। শুধু মাত্র জনগণের মত লইয়াই এই প্রশ্নের সুষ্ঠু মীমাংসা হইতে পারে। গায়ের জোরে বা চালাকী করিয়া পাঁচ কোটি লোকের ঘাড়ে একটা ভাষা চাপানো যাইবে না। চাপাইতে গেলে তা একান্ত অস্বাভাবিক হইবে। বিংশ শতাব্দীর জটিল পরিবেশে জাতীয় ঐক্য ও রাষ্ট্রীয় সংহতি রক্ষার

একমাত্র উপায় হইতেছে রাষ্ট্রের প্রত্যেকটি অংশকে আত্মনিয়ন্ত্রণের সমান অধিকার দেওয়া! ফজলুর রহমানের সাথে সাক্ষাতের পর ফেব্রুয়ারী মাসেই সংগ্রাম পরিষদ বাংলা ভাষার দাবী জ্ঞাপক একটি স্মারকলিপিতে স্বাক্ষর সংগ্রহ শুরু করে এবং কয়েক হাজার স্বাক্ষরসহ সেটি সরকারের কাছে প্রেরিত হয়।[১২৯]

এর পূর্বে ১৯৪৮-এর ১১ই জানুয়ারী পাকিস্তান সরকারের যানবাহন ও যোগাযোগমন্ত্রী আবদুর রব নিশতার সফরের উদ্দেশ্যে সিলেটে উপস্থিত হন। সেখানে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষার বাহন এবং অফিস-আদালতের ভাষা হিসাবে বাংলা ভাষাকে ব্যবহার করার দাবী জানানোর জন্য সিলেট মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি আবদুস সামাদের নেতৃত্বে একটি ছাত্র প্রতিনিধিদল তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করেন। একটি মহিলা প্রতিনিধিদলও সেই সময় আবদুর রব নিশতারের সাথে সাক্ষাৎ করে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করার দাবী জানান।[১৩০]

এই সময় সিলেটের আলেম সমাজেও বাংলা ভাষার প্রশ্নে নানা প্রকার বিতর্কের সৃষ্টি হয়। সিলেট শহরে এই সময় তারিখবিহীন একটি প্রচারপত্রে মুসলমানদেরকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়, ‘আপনাদের দীনি ফরজ সর্বত্র সভাসমিতি করিয়া উর্দুর সমর্থনে জনমত গঠন করা ও উর্দু বিরোধীদের ফেরেববাজী হইতে মুসলিম জনসাধারণকে রক্ষা করা।[১৩১] সাপ্তাহিক নওবেলাল-এ এই প্রচারপত্রটির একটি প্রতিবাদও প্রকাশিত হয়।[১৩২] এর প্রায় এক মাস পর সিলেটের মুন্সীবাজার ইউনিয়নের জমিয়তে উলামায় ইসলামের একটি সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেই সভায় ভাষা প্রশ্নের উপর গৃহীত একটি প্রস্তাবে বলা হয় :

পাকিস্তান অর্জনে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে। সমস্ত পাকিস্তানের জনসংখ্যার দুই- তৃতীয়াংশ বাংলা ভাষাভাষী। সুতরাং গণনীতির দিক দিয়া সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানবাসীর পক্ষে অল্প সময়ে বাংলা শিক্ষা সহজ নহে বিধায় বিশেষ বিবেচনার স্থলে তথাকার রাষ্ট্রভাষা উর্দু ও পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা বাংলা এবং পশ্চিমের দ্বিতীয় ভাষা বাংলা, তৃতীয় ভাষা ইংরেজী এবং পূর্বের দ্বিতীয় ভাষা উর্দু, তৃতীয় ভাষা ইংরেজী হওয়া উচিত।

প্রস্তাবটিতে এ বিষয়ে পাকিস্তান সরকার ও গণ-পরিষদের বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়।[১৩৩] ১৯৪৮ সালে জানুয়ারীর দ্বিতীয়ার্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্যাকাল্টি অব আর্টস এবং সায়েন্স এক যুক্ত বৈঠকে সিদ্ধান্ত করেন পাকিস্তানের মেজরিটির মাতৃভাষার বিরুদ্ধে যেন ব্যুরোক্যাটিক ষড়যন্ত্র চলিতেছে যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত সমস্ত স্কুল কলেজে নিম্নতম থেকে আইএ পর্যন্ত ক্লাসেই মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা প্রদান করা হবে। সংবাদপত্রের খবরে আরও জানা যায় যে ১৯৫০-৫১ সেশন থেকে এই প্রস্তাব কার্যকরী করা হবে বলে তারা সিদ্ধান্ত নেন। এ বিষয়ে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে একটি পরিভাষা কমিটি ও গঠন করা হয়।[১৩৪]

এরপর ২রা ফেব্রুয়ারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ডক্টর মাহমুদ হাসান সলিমুল্লাহ মুসলিম হল ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠা দিবস উপলক্ষে বক্তৃতা দেওয়ার সময় ভাষা প্রসঙ্গে বলেন, ‘একমাত্র মাতৃভাষা ছাড়া আর কোন ভাষাই পাকিস্তানে শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে ব্যবহৃত হইতে পারে না।[১৩৫]

প্রথম দিকে ভাষা আন্দোলন কেবল মাত্র শিক্ষা-সংশ্লিষ্ট মহলেই সীমাবদ্ধ ছিলো কিন্তু এর পর তা ধীরে ধীরে অন্যান্য ক্ষেত্রেও বিস্তার লাভ করতে শুরু করে। জানুয়ারী মাসেই পাবনার স্থানীয় সংবাদপত্র প্রতিনিধি সমিতির এক সভায় বাংলা ভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষারূপে গ্রহণ করার দাবী জানানো হয়। এ ছাড়া এই দাবীর ভিত্তিতে আন্দোলন গঠন করার জন্যেও তাঁরা একটি স্বতন্ত্র প্রস্তাব গ্রহণ করেন।[১৩৬]

১৯৪৮ সালের ১৯শে ফেব্রুয়ারি ঢাকার নাগরিকবৃন্দের নামে ভাষা সম্পর্কিত নিম্নলিখিত বিবৃতিটি সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়:

এটা অস্বীকার করার উপায় নাই যে, পাকিস্তানের নেতারা যদি পূর্ব পাকিস্তানের উপর আরেকটি ভাষা চাপিয়ে দেন তাহলে তার দ্বারা পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের স্বার্থের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করে, তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার অস্বীকার করে, তাদের মধ্যে অনৈক্যের বীজ বপণ করে পাকিস্তানের ক্ষতিসাধান করা হবে।[১৩৭]

ফেব্রুয়ারী মাসের মাঝামাঝি সিলেটের কয়েকজন বিশিষ্ট মহিলা পূর্ব-পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীনের কাছে প্রেরিত একটি স্মারকলিপিতে বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার দাবী জানান। এতে যাঁরা স্বাক্ষরদান করেন তাঁদের মধ্যে মহিলা মুসলিম লীগের জেলা কমিটির সভানেত্রী বেগম জোবেদা খাতুন চৌধুরী, সহ-সভানেত্রী সৈয়দা শাহেরবানু, সম্পাদিকা সৈয়দা লুৎফুন্নেসা খাতুন, সৈয়েদা নজিবুন্নেসা খাতুন এবং সিলেট রাজকীয় বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষয়িত্রী রাবেয়া খাতুনের নাম উল্লেখযোগ্য।[১৩৮] এই স্মারকলিপি প্রেরণের সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর সিলেটের ইস্টার্ন হেরাল্ড পত্রিকায় ২৮শে ফেব্রুয়ারী একটি সম্পাদকীয় মন্তব্যে অন্যতম স্বাক্ষরকারিণী জোবেদা খাতুন এবং স্মারকলিপিটি সম্পর্কে কতকগুলি অশোভন ও বিরূপ উক্তি করা হয়। এই উক্তির প্রতিবাদে সাপ্তাহিক নওবেলাল-এ ১১ই মার্চ স্মারকলিপির অন্যতম স্বাক্ষরদাত্রী সৈয়েদা নজিবুন্নেসা খাতুনের একটি বিবৃতি প্রকাশিত হয়। তাতে তিনি বলেন যে, নিজেদের ন্যায্য ও ন্যায়সঙ্গত দাবী পেশ করার জন্যেই তাঁরা উপরোল্লিখিত স্মারকলিপি প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠিয়েছিলেন এবং এ কাজ করার পূর্ণ অধিকার তাঁদের আছে। তিনি আরও বলেন:

যাহারা পূর্ব পাকিস্তানের বাংলা ভাষাভাষী হইয়া মাতৃভাষার বিরুদ্ধাচরণ করেন তাহারা মাতৃ ভাষার বিশ্বাসঘাতক কু-পুত্র তুল্য। অনেকে আবার না বুঝিয়া, ধর্মের দোহাই শুনিয়া উর্দুর সমর্থন করেন। তাহাদের তত দোষ দেওয়া যায় না। কিন্তু যাহারা ধর্মের দোহাই দেন তাহাদের জিজ্ঞাসা করি যে উর্দু ভাষাভিজ্ঞ অপেক্ষা সিলেটের উর্দু অনভিজ্ঞ মুসলমানেরা ইসলাম ধর্মের অনুশাসন পালনে কোন অংশে হীন? বরং এ বিষয়ে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে সিলেটের মুসলমানদের তহজীব ও তমদ্দুন এক বিশিষ্ট স্থান লাভের অধিকারী বলিয়া অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা মত প্রকাশ করিয়াছেন। আমাদের বক্তব্য ছিল যে উর্দু ভাষাভাষী অধিক সংখ্যক শিক্ষয়িত্রী নিযুক্ত করিয়া পর্দানসীন মহিলাদের শিক্ষা ব্যবস্থা অসম্ভব ফলে অল্প দিনের মধ্যে অল্প শিক্ষিতা নারী জাতি অশিক্ষিতা হইয়া যাইবেন এবং স্বামী পুত্রের সহযোগিতা করিতে পারিবেন না। রাষ্ট্রভাষা যদি বাংলার পরিবর্তে উর্দু হয়, তবে আমাদের মত অল্প শিক্ষিতা নারীদের জন্য উর্দু শিক্ষার কী ব্যবস্থা হইবে, তাহা আমাদের ধারণাতীত মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা রক্ষাকল্পে সিলেটের মহিলাদের এই প্রচেষ্টা খুবই উল্লেখযোগ্য। তাঁদের এই প্রচেষ্টাকে অভিনন্দন জানিয়ে তমদ্দুন মজলিশের সম্পাদক আবুল কাসেম মহিলা লীগের সভানেত্রী জোবেদা খাতুনের কাছে নিম্নলিখিত পত্র প্রেরণ করেন:

আজ সত্যি আমরা অভূতপূর্ব আনন্দ এবং অশেষ গৌরব অনুভব করছি। সিলেটের পুরুষেরা যা পারেনি তা আপনারা করেছেন। উর্দুর সমর্থনে সিলেটের কোন কোন পত্রিকা যে জঘন্য প্রচার করছে আর সিলেটের কোন কোন পুরুষেরা স্মারকলিপি দিয়ে যে কলংকজনক অভিনয় করেছেন তা সত্যিই বেদনাদায়ক। কিন্তু আপনাদের প্রচেষ্টা দেখে মনে হচ্ছে আমাদের ভয়ের কোন কারণ নেই। আপনাদের প্রেরিত স্মারকলিপি আমাদের আশান্বিত করে তুলেছে। নিশতার সাহেবের সঙ্গে দেখা করেও আপনারা মাতৃভাষার প্রতি কর্তব্য সম্পাদন করেছেন। তমদ্দুন মসলিশ আজ আপনাদের অকৃত্রিম ধন্যবাদ জানাচ্ছে। আপনাদের প্রচেষ্টা জয়যুক্ত হউক। আশা করি আপনাদের নিঃস্বার্থ কর্মচাঞ্চল্যে বাংলা ভাষা আন্দোলন আরো সক্রিয়- আরো প্রবল হয়ে উঠবে।[১৩৯]

২৩শে ফেব্রুয়ারী, ১৯৪৮, পাকিস্তান গণ-পরিষদের প্রথম অধিবেশন আহূত হয়। এই অধিবেশনে যোগদান করার জন্যে পূর্ব বাঙলার প্রতিনিধি নূরুল আমীন, হাবিবুল্লাহ বাহার, গিয়াসুদ্দীন পাঠান প্রমুখ করাচী রওয়ানা হওয়ার পূর্বে আবুল কাসেম এবং তমদ্দুন মজলিশ রাষ্ট্রভাষা সাবকমিটি ও মুসলিম ছাত্র লীগের এক প্রতিনিধিদল তাদের সাথে সাক্ষাৎ করেন। এই সাক্ষাৎকালে তাঁরা পাকিস্তানের মুদ্রা, ডাক টিকিট, মানি অর্ডার ইত্যাদি বাংলা ভাষা বাদ দেওয়ার প্রতি গণ-পরিষদের উপরোেল্লাখিত সদস্যদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে সদস্যবৃন্দ প্রতিনিধিদলটিকে এ সম্পর্কে ভুল সংশোধনের আশ্বাস দেন।[১৪০]

ভাষা আন্দোলনের প্রাথমিক পর্যায়ে তমদ্দুন মজলিশ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বাংলা ভাষার দাবীতে প্রথম সংগ্রাম পরিষদ তাদের উদ্যোগেই গঠিত গয়। আন্দোলনের সাংগঠনিক দিকটির প্রতি লক্ষ্য রাখার ফলে ভাষা আন্দোলনকে সাংস্কৃতিক আলোচনাক্ষেত্র থেকে রাজনৈতিক আন্দোলনে উত্তীর্ণ করার ব্যাপারেও তাদের প্রচেষ্টা উল্লেখযোগ্য।

তমদ্দুন মজলিশের এই ভূমিকার জন্যে বাংলা ভাষা বিরোধী সংবাদপত্র এবং সাময়িকপত্রগুলোতে সে সময় তাদের অনেক বিরূপ সমালোচনা হয়। এ কাগজগুলির মধ্যে মর্নিং নিউজ, পাসবান এবং সিলেটের সাপ্তাহিক আসাম হেরাল্ড ও যুগভেরীর নাম উল্লেখযোগ্য। কিন্তু ভাষা আন্দোলন বিরোধী পত্রিকাগুলি এ ধরনের সমালোচনা করলেও সাপ্তাহিক ইনসাফ, জিন্দেগী ও দেশের দাবী এবং সিলেটের নওবেলাল পুরোপুরিভাবে এই আন্দোলনকে সমর্থন করে।

১৯৪৭ সালের জুলাই মাসে আজাদ পত্রিকায় বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে কিছু লেখা প্রকাশিত হয়। ১০ই জুলাই কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র স্বাধীনতা পত্রিকাতে ‘পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা শীর্ষক একটি পত্রে সেই প্রচেস্টার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানো হয়। পত্রটি লেখেন হামিদা সেলিম (রহমান)। ইনি পরবর্তী সময়ে ১৯৪৮-এর মার্চ মাসে যশোর রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক হিসাবে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। পত্রটি নিম্নরূপ :

বাঙালী হিসাবে যেমন আমরা সমগ্র বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের ভিতর দাবী করেছিলাম, তেমনি আজ বাংলাদেশের ভাষা হিসাবেও বাংলা ভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসাবে দাবী করবো না কেন? পূর্ব পাকিস্তানের জনপ্রিয় ‘আজাদের’ পৃষ্ঠায় বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রীয় ভাষায় পরিণত করার বিরুদ্ধে যুক্তি দেখে খুবই দুঃখ হয়।’ আমাদের বাঙালীর এতদিনের সাহিত্যকলা সবই কি আজ ভুলে যেতে হবে। কেমন করে আমরা ভুলে যাবো মাননীয় আকরম খাঁয়ের লেখা কোরানের তর্জমা, কেমন করে আমরা ভুলে যাবো তাঁর রচিত মোস্তফা চরিত, কেমন করে আমরা ভুলবো আমাদের নজরুলের গান? এই সাহিত্য কি আবার উর্দুতে তর্জমা হবে। শ্রদ্ধেয় আকরম খাঁ কি আবার আমাদের জন্য তাঁর কলম উর্দুর গণ্ডীতে সীমাবদ্ধ করবেন। পাকিস্তান জনগণের রাষ্ট্র। তাই তার ভাষা হবে জনগণের ভাষা। বাংলার সাড়ে চার কোটি লোক যে ভাষায় কথা বলে, যে ভাষায় সাহিত্য রচনা করে, যে ভাষায় মনের ভাব ব্যক্ত করে সে ভাষা তাদের নিজস্ব ভাষা হবে না এও বিশ্বাস করতে হবে? স্বাধীন পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ভাষার সাথে তাদের প্রাণের কোন যোগই থাকবে না, এও কি সত্য হবে?

কিন্তু আজাদ-এর এই বিরোধিতা তেমন বেশীদিন স্থায়ী হয়নি। ইত্তেহাদ-এর মতো জোরালোভাবে বাংলার দাবীকে স্বীকার এবং প্রচার না করলেও অল্প দিনের মধ্যে বাংলা ভাষার বিরোধিতা না করার সিদ্ধান্ত করে। এ প্রসঙ্গে নিম্নলিখিত উদ্ধৃতিটি উল্লেখযোগ্য:

১৯ শে আগস্ট, ১৯৪৭ সন। কলিকাতার মৌলালির আজাদ অফিসে জনাব আবুল কালাম শামসুদ্দীন সাহেবের টেবিলে বসে নতুন পাওয়া স্বাধীনতার স্বাদ অনুভব করছিলাম। এমন সময় তাঁরই স্টাফের একজন এসে প্রশ্ন করলেন, ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার বিষয়ে আমার মত কি হবে?’ ইত্তেহাদ তো বাঙলা ভাষার দিকে ঝুঁকে পড়ছে।’ এডিটর সাহেব সামান্য কথাবার্তার পর বললেন, – দিন জানিয়ে যে আমাদেরও মত অনুরূপ; তবে একটু ধীরে ধীরে আগান।[১৪১]

আজাদ সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দীনের সতর্ক পদক্ষেপের উপদেশ থেকে বোঝা যায় যে বাংলা ভাষার বিরোধিতার সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করলেও আজাদ ইত্তেহাদ-এর মতো জোরালো ভূমিকা গ্রহণের পক্ষপাতী ছিলো না।

বস্তুতঃ বাংলা ভাষার দাবী কিছুটা সমর্থন করলেও মার্চ মাসের ভাষা আন্দোলনের সময় আজাদ সর্বতোভাবে সরকারী পক্ষ অবলম্বন করে আন্দোলনের বিরোধিতা করে।

১১. কর্মী নির্যাতন

প্রথম পর্যায়ে বাংলা ভাষার আন্দোলন ছাত্র এবং শিক্ষিত সম্প্রদায়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো। কিন্তু একথাও সত্য যে বহু ছাত্র ও শিক্ষিত জনসাধারণ তৎকালে উর্দুর সপক্ষে ছিলেন। এই জাতীয় উর্দু সমর্থক এবং গুণ্ডাদের সহায়তায় প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিসমূহ ভাষা আন্দোলনের কর্মীদের উপর বহুবার হামলা করে। পুরাতন ঢাকার কতকগুলি এলাকায় সে সময় বাংলা সমর্থক ছাত্রদের প্রবেশ প্রায় অসম্ভব ছিল। রায়সাহেব বাজার থেকে এই সময় একটি উর্দু সমর্থক মিছিল বের হয়ে ঢাকা কলেজ পৌঁছায় এবং অন্য একটি অনুরূপ মিছিল ফজলুল হক হল থেকে শামসুল হুদার পরিচালনায় বের হয়ে ঢাকা কলেজ পৌঁছায় এবং কলেজ প্রাঙ্গণে (সিদ্দিক বাজারে) সমবেত হয়ে একটি সভা করে। সেই সভায় ভাষা আন্দোলনকে কুৎসিত ভাষায় নানাপ্রকার গালাগালি করে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবী জানানো হয়।[১৪২]

এই সময় ঢাকা রেল স্টেশনের কাছে ভাষা আন্দোলনকারীদের একটি মিছিলের উপর গুণ্ডারা লাঠি চালায়। এই লাঠি চালানোর ফলে কয়েকজন আহত হন।[১৪৩] এ ছাড়া সলিমুল্লাহ মুসলিম হল ইউনিয়নের তদানীন্তন সম্পাদক এবং তমদ্দুন মজলিশের কর্মী মোহাম্মদ সিদ্দিকুল্লা কসাইটুলীর বলিয়াদী প্রেসে একটি ইস্তাহার ছাপাতে গিয়ে গুণ্ডাদের হাতে লাঞ্ছিত হন এবং তাঁকে সেখানে আটক করা হয়। আটক অবস্থা থেকে তিনি একজনের সহায়তায় মুক্তি লাভ করে তাড়াতাড়ি সে এলাকা পরিত্যাগ করেন।[১৪৪] ১৯৫২ সালের সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক কাজী গোলাম মাহবুবও এই সময় নাজিমুদ্দীন রোডস্থ ঢাকা বেতার কেন্দ্রের কাছে বাংলা ভাষাবিরোধী গুণ্ডাদের দ্বারা আক্রান্ত হন।[১৪৫] বস্তুতঃ এ ধরনের গুণ্ডামী এবং ছাত্র নির্যাতনের উদাহরণ ছিল অসংখ্য।

ফরিদ আহমদ ভাষা আন্দোলনের এই পর্যায়ে সক্রিয় অংশগ্রহণ করা কালে একাধারে আইনের ছাত্র হিসাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ইউনিয়নের সহ-সভাপতি এবং ঢাকা সরকারী কলেজের ইংরেজীর অধ্যাপক ছিলেন। সরকারী কর্মচারী হিসাবে আন্দোলনে তাঁর ভূমিকা সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং ৬ই জানুয়ারী, ১৯৪৮-এ প্রাদেশিক চীফ সেক্রেটারী আজিজ সেক্রেটারিয়েটে নিজের অফিসে ফরিদ আহমদকে তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করতে বলেন। আজিজ আহমদ এই সাক্ষাৎকারের সময় ফরিদ আহমদকে বলেন যে, সরকারী কর্মচারী হিসাবে তিনি চাকরির নিয়ম-কানুন ভঙ্গ করে সক্রিয় রাজনীতির সাথে জড়িত হয়েছেন। এ জন্যে তিনি তাঁকে প্রথমে বরখাস্ত করবেন ভেবেছিলেন, কিন্তু পরে অল্প বয়সের কথা বিবেচনা করে প্রথমবারের মতো তিনি তাঁকে সাবধান করে দেওয়াই স্থির করেছেন। ফরিদ আহমদ উত্তরে তাঁকে বলেন যে, কর্তব্য সম্পর্কে তিনি নিজের ধারণা অনুসারেই কাজ করেছেন কাজেই এ ব্যাপারে তিনি মোটেই অনুতপ্ত নন।[১৪৬]

ঐ সাক্ষাৎকারের পর ফরিদ আহমদ ৮ই জানুয়ারী, ১৯৪৮, অফিসে গিয়ে বাংলাকে কেন্দ্রীয় পাবলিক সার্ভিস কমিশনের ভাষা হিসাবে বাদ দেওয়ার প্রতিবাদে চাকরীতে ইস্তফা দেন। এ প্রসঙ্গে দৈনিক ইত্তেহাদ-এর সম্পাদক আবুল মনসুর আহমদ একটি সম্পাদকীয় লেখেন।[১৪৭] এখানে উল্লেখযোগ্য যে, ১৯৪৭ সালে ফরিদ আহমদের এই ভূমিকা সত্ত্বেও পরবর্তী মার্চ ১৯৪৮ এবং ফেব্রুয়ারী ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের সাথে তাঁর কোন যোগাযোগই আর থাকেনি।

বাংলা ভাষার সপক্ষে ইস্তাহার বিলি করা, সভাসমিতি করা, বিবৃতি দেওয়া ইত্যাদি মারফতে জনমত গঠন চেষ্টার ফলে ঢাকার এক শ্রেণীর লোক এই সময় তমদ্দুন মসলিশের বিরুদ্ধে ভয়ানক ক্রুব্ধ এবং উত্তেজিত হয়ে ওঠে। ফলে তারা রশিদ বিল্ডিং-এ অবস্থিত তমদ্দুন মজলিশ ও সংগ্রাম পরিষদের অফিসে প্রবেশ করে আসবাবপত্র ভেঙ্গে চুরমার করে এবং কাজগপত্রসহ অন্যান্য জিনিসপত্র লুটপাট করে চলে যায়।[১৪৮] রশিদ বিল্ডিং-এর অফিস এইভাবে বিনষ্ট হওয়ার পর সংগ্রাম পরিষদের অফিস স্থানান্তরিত হয় ফজলুল হক ছাত্রাবাসে।[১৪৯]

.

তথ্যসূত্র (সংশোধন করা হয়নি) – প্রথম পরিচ্ছেদ: সূত্রপাত

আশু দাবী কর্মসূচী আদর্শ, প্রকাশক : কমরুদ্দীন, আহমদ, কনভেনার গণ-আজাদী লীগ, পূর্ব পাকিস্তান পাবলিশিং হাউজ, জুমরাইল লেন, ঢাকা। প্রথম সংস্করণ : জুলাই, ১৯৪৭, পৃ ১। বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের কাউন্সিল মিটিং-এ প্রাদেশিক সম্পাদক, আবুল হাশিমের রিপোর্ট, ১৭/১/১৯৪৪, Peoples’ War, Bombay, 3/12/1944.

আশুদাবী কর্মসূচী আদর্শ, পৃ ২।

পূর্বোক্ত, পৃ ৬। পূর্বোক্ত, পৃ ৮। পূর্বোক্ত, পৃ ৪। পূর্বোক্ত, পৃ ৭।

Draft Manifesto of the Bengal Provincial Muslaim League by Abul Hashim MLA, Secretary, Bengal Privincial Muslim League. Published by Shamsuddin Ahmed, 150, Mogaltuli, Dacca P 6.

আশুদাবী কর্মসূচী আদর্শ, পৃ ২২

১০ পূর্বোক্ত, পৃ ২৩।

8

১১

১২

১৩

কমরুদ্দীন আহমদ।

?

আজাদ ১৩৫৪, ১২ই শ্রাবণ। প্রবন্ধটি ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহর আমাদের ভাষা সমস্যা নামক পুস্তিকাতে পুনর্মুদ্রিত।

আমাদের ভাষা সমস্যা, রেনেসাঁস পাবলিকেশন্স, পৃ ৩২-৩৩।

১৪ পূর্বোক্ত, পৃ ৩২।

১৫ পূর্বোক্ত, পৃ ৩৪।

১৬ পূর্বোক্ত, পৃ ৩৪-৩৫।

১৭ আমাদের ভাষা সমস্যা, প্রবন্ধটি নামক পুস্তিকাতে পুনর্মুদ্রিত।

১৮ পূর্বোক্ত, পৃ ৩৬।

১৯ পূর্বোক্ত, পৃ ৩৬-৩৭।

২০ পূর্বোক্ত, পৃ ৩৭-৩৮।

২১ পূর্বোক্ত, পৃ ৩৯।

২২ আতাউর রহমান (রাজশাহী), শহীদুল্লাহ কায়সার।

২৩ পূর্বোক্ত।

২৪ কমরুদ্দীন আহমদ, আতাউর রহমান, শহীদুল্লাহ কায়সার, অলি আহাদ।

২৫ তাজউদ্দীন আহমদ-এর ডায়েরী, ৩১/৭/১৯৪৭, ৫/৮/১৯৪৭।

২৬ পূর্বোক্ত, ২৩/৮/১৯৪৭।

২৭. কমরুদ্দীন আহমদ, তাজউদ্দীন আহমদ, শহীদুল্লাহ কায়সার, আতাউর রহমান, অলি

আহাদ, মোহাম্মদ তোয়াহা।

২৯৮। বদরুদ্দীন উমর রচনাবলী খণ্ড ২

২৮ পূর্বোক্ত।

২৯

৩১

পূর্বোক্ত।

অলি আহাদ, তাজউদ্দিন আহমদ, আবদুল মতিন।

মোহাম্মদ তোয়াহা, অলি আহাদ, আবদুল মতিন, তাজউদ্দীন আহমদ।

৩২ তাজউদ্দিন আহমদ-এর ডায়েরী, ৩০/৮/১৯৪৭।

৩৩ পূর্বোক্ত, ৩১/৮/১৯৪৭।

৩৪ পূর্বোক্ত এবং জবানী সূত্র।

৩৫ তাজউদ্দীন আহমদ-এর ডায়েরী, ৫/৯/১৯৪৭, ৬/৯/১৯৪৭।

৩৬

শওকত আলী (১৫০ নং মোগলটুলী), আতাউর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদ।

৩৭ তাজউদ্দীন আহমদ-এর ডায়েরী, ৬/৯/১৯৪৭, আতাউর রহমান, শহীদুল্লাহ কায়সার,

কমরুদ্দীন আহমদ।

৩৮ তাজউদ্দীন আহমদ-এর ডায়েরী, ৬/৯/১৯৪৭।

৩৯ পূর্বোক্ত, ৭/৯/১৯৪৭।

80

আমরা গড়িবো স্বাধীন সুধি গণতান্ত্রিক পাকিস্তান, ভূমিকা : শামসুল হক। পূর্ব পাকিস্তান কর্মী সম্মেলনের পক্ষে মিঃ শামসুল হক কর্তৃক ১৫০, মোগলটুলী, ঢাকা হইতে প্রকাশিত এবং বলিয়াদী প্রিন্টিং ওয়ার্কস্, ঢাকা হইতে এএইচ সৈয়দ দ্বারা মুদ্রিত। এই পুস্তিকাটির শেষ পৃষ্ঠায় তমদ্দুন মজলিশ কর্তৃক সেপ্টেম্বর মাসে প্রকাশিত পুস্তিকা পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু-এর একটি বিজ্ঞাপনও প্রকাশিত হয়।

পূর্বোক্ত, পৃ ৯০।

৪২ পূর্বোক্ত, পৃ ৯০।

৪৩ পূর্বোক্ত, পৃ ২৪।

৪৪ পূর্বোক্ত, পৃ ৩৩।

৪৫ পূর্বোক্ত।

৪৬ পূর্বোক্ত। পৃ ৩৪।

89

আতাউর রহমান।

৪৮ পূর্বোক্ত।

৪৯

৫০

৫১

আতাউর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদ, কমরুদ্দীন আহমদ।

মোহাম্মদ তোয়াহা, আবদুল রহমান চৌধুরী, শহীদুল্লাহ কায়সার, শাহ আজিজুর রহমান। পাকিস্তানের বিপ্লবী যুবসমাজের প্রতি, প্রকাশক : মোহাম্মদ একরামুল হক সেক্রেটারী গণতান্ত্রিক যুব লীগের রাজশাহী বিভাগীয় আঞ্চলিক কমিটি। ( সেপ্টেম্বর ১৯৪৮)।[৫২ পূর্বোক্ত, পৃ ১।

৫৩ পূর্বোক্ত, পৃ ১১-১৬।

(8

পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা, না উর্দু? প্রকাশক : অধ্যাপক এমএ কাসেম, এমএমসি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, তমদ্দুন অফিস, রমনা, ঢাকা। প্রিন্টার : এএইচ সৈয়দ, বলিয়াদী প্রিন্টিং ওয়ার্কস্, ১৩৭ নং বংশাল রোড, ঢাকা।[১ম সংস্করণ : সেপ্টেম্বর ১৯৪৭, পৃ ১-২।[৫৫ পূর্বোক্ত, পৃ ৩।

৫৬ পূর্বোক্ত, পৃ ৬।

পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি (প্রথম খণ্ড) | ২৯৯

৫৭ পূর্বোক্ত, পৃ ৯।[৫৮ পূর্বোক্ত, পৃ ৯-১০।[৫৯ পূর্বোক্ত, পৃ ১১।[৬০ পূর্বোক্ত, পৃ ১০-১১।[৬১ পূর্বোক্ত, পৃ ৮।[৬২ পূর্বোক্ত, পৃ ১৫।

৬৩ পূর্বোক্ত, পৃ ১৬।[৬৪ পূর্বোক্ত, পৃ ১৭।

৬৫ Before the Twenty-First by Farid Ahmed The Concept of Pakistan,

৬৬

February 1966, P 30.

ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস, তমদ্দুন লাইব্রেরী, প্রকাশনায় : হাসান ইকবাল, ১৯, আজিমপুর রোড, ঢাকা। প্রথম প্রকাশ : জুন ১৯৫২, পৃ ৫-৬।

৬৭. পূর্বোক্ত, পৃ ৭।

৬৮ Morning News, December 7, 1947। দৈনিক আজাদ, ৭ই ডিসেম্বর, ১৯৪৭।

৬৯ Morning News, December 7, 1947

৭০ পূর্বোক্ত, December 6, 1947।

৭১ পূর্বোক্ত, December 10, 1947।

৭২ পূর্বোক্ত।

৭৩ পূর্বোক্ত।

৭৪

পূর্বোক্ত।

৭৫

৭৬

৭৭

অলি আহাদ, আবদুল মতিন।

Morning News, December 10, 1947.

Before the Twenty First by, Farid Ahmed. The Concept of Pakistan. P 32.

৭৮ Morning News, December 10, 1947.

৭৯ Morning News, December 13, 1947.

৮০ পূর্বোক্ত, December 17, 1947।

৮১ পূর্বোক্ত।

৮২ তাজউদ্দীন আহমদ-এর ব্যক্তিগত ডায়েরী, ৭/১২/১৯৪৭।

৮৩ পূর্বোক্ত।

৮৪ তাজউদ্দীন আহমদ-এর ডায়েরী, ১২/১২/১৯৪৭, আবদুল মতিন।

৮৫ আবদুল মতিন, আবুল কাসেম, অলি আহাদ।

৮৬ আবদুল মতিন, অলি আহাদ, আবুল কাসেম [ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস, ফেব্রুয়ারী,

১৯৬৭,পৃ ২১ এবং ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস, জুন ১৯৫২, পৃ ১৪]।

৮৭. শামসুদ্দীন আহমদ, অলি আহাদ, জহুর হোসেন চৌধুরী, আবুল কাসেম, ফরিদ আহমদ [The Concept of Pakistan, Feb, 66, P 32] তাজউদ্দীন আহমদ-এর ডায়েরী, ১২/১২/১৯৪৭।

bb Before the Twenty First by Farid Ahmed. The Concept of Pakistan. P 32.

জহুর হোসেন চৌধুরী।

৮৯

৩০০ | বদরুদ্দীন উমর রচনাবলী খণ্ড ২

১০

৯১

৯২

Farid Ahmed. The Concept of Pakistan. Feb. 1966, P 32.। ফরিদ আহমদ এখানে মন্ত্রী হাসান আলী সম্পর্কে যা বলেছেন সেটা ঠিক নয়। কারণ তিনি সে সময় করাচীতে ছিলেন। তার ঢাকা ফেরার তারিখ ১৯শে ডিসেম্বর (মর্নিং নিউজ, ২১ শে ডিসেম্বর)। আবুল কাসেম, ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস, পৃ ২১। তমদ্দুন মজলিশের পক্ষে মোহাম্মদ নুরন্নবী, মজলিশ অফিস।[৩১/২ আজিমপুর রোড, ঢাকা ৯। ফেব্রুয়ারী-১৯৬৭। শামসুদ্দীন আহমদ, অলি আহাদ, জহুর হোসেন চৌধুরী।

আবুল কাসেম (ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস, ফেব্রুয়ারী ১৯৬৭। পৃ ২১), শামসুদ্দীন আহমদ। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস, হন ১৯৫২। পৃ ১৪।

আবুল কাসেম (পূর্বোক্ত পৃ ২১), অলি আহাদ, শামসুদ্দীন আহমদ।

93 Farid Ahmed, Before the Twenty First.

৯৪

জহুর হোসেন চৌধুরী।

১৫ Farid Ahmed, Before the Twenty First. ৯৬ পূর্বোক্ত।

৯৭ পূর্বোক্ত। পৃ ৩২-৩৩। আবদুল ওয়াহাব।

৯৮ জহুর হোসেন চৌধুরী।

৯৯ পূর্বোক্ত।

Soo Morning News, December 13, 1947.

১০১ শামসুদ্দীন আহমদ।

১০২ তাজউদ্দীন আহমদ-এর ডায়েরী, ১৩/১২/১৯৪৭।[১০৩ পূর্বোক্ত।

১০৪ Morning News, December 17, 1947.

১০৫ পূর্বোক্ত; সভার তারিখটি ভুলবশতঃ ১৬ই ডিসেম্বর ছাপা হয়েছে। সঠিক তারিখ ১৫ই ডিসেম্বর।

Soy Morning News, December 19, 1947. ১০৭ তাজউদ্দীন আহমদ-এর ডায়েরী, ৮/১/১৯৪৮.

১০৮ Morning News, December 19, 1947.

১০৯ খয়রাত হোসেন, কমরুদ্দীন আহমদ, তফজ্জল আলী, তাজউদ্দীন আহমদ, আবদুল মালেক

মোস্তফা আহমদ।

১১০ ইউসুফ আলী চৌধুরী, শাহ আজিজুর রহমান, মহিউদ্দীন আহমদ।

১১১ কমরুদ্দীন আহমদ, মোস্তাক আহমদ।

১১২ ইউসুফ আলী চৌধুরী, শাহ আজিজুর রহমান, মহিউদ্দীন আহমদ, কমরুদ্দীন আহমদ,

মোস্তাক আহমদ, খয়রাত হোসেন।

?

১১৩ মোস্তাক আহমদ, কমরুদ্দীন আহমদ, আতাউর রহমান খান।

১১৪ পূর্বোক্ত।

১১৫ কমরুদ্দীন আহমদ।

১১৬ পূর্বোক্ত।

১১৭ মোস্তাক আহমদ।

১১৮ কমরুদ্দীন আহমদ, মোস্তাক আহমদ, খয়রাত হোসেন, শওকত আলী, আতাউর রহমান খান।

পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি (প্রথম খণ্ড) | ৩০১

১১৯ কমরুদ্দীন আহমদ, খয়রাত হোসেন, মোস্তাক আহমদ, আতাউর রহমান।

১২০ পূর্বোক্ত।

১২১ আবুল মনসুর আহমদ, আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর, প্রথম সংস্করণ, জুলাই ১৯৬৮, প্রকাশক : আবুল কাদির খান, নওরোজ কিতাবিস্তান, বাংলাবাজার, ঢাকা ১০০০,

পৃ ২৪৪-৪৫।

১২২ পূর্বোক্ত, পৃ ২৪৫।

১২৩ অলি আহাদ, ফরিদ আহমদ, কমরুদ্দীন আহমদ, নুরুল হক ভূঁঞা (‘ভাষা আন্দোলনের গোড়ার কথা’, ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস, ফেব্রুয়ারি ১৯৬৭, পৃ ৪, আবুল কাসেম (ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস, পৃ ১৬)।

১২৪ নওবেলাল, ১৯/২/১৯৪৮। ইত্তেহাদ-এর সম্পাদকীয়, ‘ভুলের পুনরাবৃত্তি’, পুনর্মুদ্রণ।[১২৫ পূর্বোক্ত।

১২৬ ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস, জুন ১৯৫২, পৃষ্ঠা ৮।

১২৭ নওবেলাল, ১৯/২/১৯৪৮, ভুলের পুনরাবৃত্তি।

১২৮ পূর্বোক্ত।

১২৯ আবুল কাসেম, ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস, ফেব্রুয়ারি ১৯৬৭, পৃ ১৭।

১৩০ নওবেলাল, ২২/১/১৯৪৮ এবং ১১/৩/১৯৪৮ আবুল কাসেমের পত্র।

১৩১ নওবেলাল, ৮/১/১৯৪৮।

১৩২ পূর্বোক্ত।

১৩৩ নওবেলাল, ৫/২/১৯৪৮।

১৩৪ নওবেলাল, ২৯/১/১৯৪৮।

১৩৫ নওবেলাল, ৫/২/১৯৪৮।[১৩৬ নওবেলাল, ২৯/১/১৯৪৮।[১৩৭ হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড, ২০/২/১৯৪৮

১৩৮ নওবেলাল, ২৬/২/১৯৪৮।[১৩৯ পূর্বোক্ত

১৪০ পূর্বোক্ত

১৪১ অধ্যাপক কাজী কামরুজ্জামান, ‘ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি’, ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস, ফেব্রুয়ারী ১৯৬৭, পৃ ৩৬। এই উদ্ধৃতিতে যে বানান ব্যবহার করা হয়েছে সেটা প্রবন্ধকারের। এক্ষেত্রে তিনি তমদ্দুন মজলিশ এবং বাংলা কলেজের বানান পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন।

১৪২ আবুল কাসেম, ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস, ফেব্রুয়ারী ১৯৬৭, পৃ ২০।

১৪৩ পূর্বোক্ত, পৃ ২১।

১৪৪ পূর্বোক্ত, পৃ ২০।

১৪৫ কাজী গোলাম মাহবুব।

১৪৬ Farid Ahmed, Before the Twenty First.

১৪৭ পূর্বোক্ত।

১৪৮ মহম্মদ তোয়াহা, অলী আহাদ, তাজউদ্দীন আহমদ, আবুল কাসেম, কমরুদ্দীন আহমদ।[১৪৯ মহম্মদ তোয়াহা, তাজউদ্দীন আহমদ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *