৭. স্কুল

. স্কুল

রাত্রিবেলা কাবিল কোহকাফী টুশি আর তপুর ঘরে ঘুমাল। টুশি তার বালিশটা কাবিল কোহকাফীকে দিয়েছিল, কিন্তু তার জন্যে নরম বিছানায় ব্যবস্থা করা গেল না। কাবিল কোহকাফী ইচ্ছে করলে বাইরের ঘরে সোফায় শুয়ে ঘুমাতে পারে, কিন্তু ভোরবেলা চাচা ঘুম থেকে উঠে সোফায় বসে কিছুক্ষণ টিভি দেখেন–ভুল করে যদি অদৃশ্য কাবিল কোহকাফীর ভুঁড়ির উপর বসে যান তা হলে যা, একটা কেলেঙ্কারি হবে সেটা আর বলার মতো নয়!

টুশি এবং তপু দুজনের ঘুমই হল ছাড়া-ছাড়া তাদের দুজনের কেউ টের পায় নি নাকডাকার ব্যাপরটি এরকম ভয়ংকর হতে পারে। যখনই ঘুমিয়েছে তখনই স্বপ্ন দেখেছে যে তারা একটা প্লেনে করে যাচ্ছে কিংবা একটা সিংহ গর্জন করে তাদের তাড়া করছে কিংবা একটা মিছিলে হাজার হাজার মানুষ চিৎকার করছে–একটু পরে পরে তাদের ঘুম ভেঙে গেছে আর তারা আবিষ্কার করেছে যে প্লেনের শব্দ, সিংহের গর্জন বা মিছিলের চিৎকারের শব্দ ঘুম ভাঙার পরও শোনা যাচ্ছে– খানিকক্ষণ পর তারা টের পেয়েছে যে সেটা কাবিল কোহকাফীর নাকডাকার শব্দ!

ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে টুশি আর তপু তাদের স্কুলের জন্যে রেডি হতে থাকে তখন তারা শুনতে পেল চাচি রান্নাঘর থেকে চিৎকার করছেন, কে নাকি ফ্রিজ থেকে সব রুটি খেয়ে ফেলেছে! এটা নিশ্চয়ই কাবিল কোহকাফীর কাজ–টুশি আর তপু ভয়ে ভয়ে থাকল–ব্যাপারটি নিয়ে চাচা কিংবা চাচি কোনোকিছু সন্দেহ না করে বসেন। কিন্তু সেরকম কিছু হল না, কারণ চাচা বিরক্ত হয়ে চাচিকে বললেন, “কী ভোরবেলা উঠেই তুমি ক্যাটক্যাট শুরু করলে–”

চাচি তখন রেগে আগুন হয়ে বললেন, “কী? আমি ক্যাটক্যাট করি? তোমার এত বড় সাহস”

ব্যস দুজনে খেপে গেলেন এবং তার এক ফাঁকে টুশি আর তপু স্কুলের জন্যে বের হয়ে যায়। তারা মাত্র বাসা থেকে বের হয়ে রাস্তায় পা দিয়েছে তখন শুনল কাবিল কোহকাফী পিছন থেকে চিৎকার করতে করতে আসছে, “দাঁড়াও! দাঁড়াও আমিও যাব।”

টুশি আর তপু অবাক হয়ে কাবিল কোহকাফীর দিকে তাকাল, টুশি জিজ্ঞেস করল, “তুমি? তুমি কোথায় যাবে?”

“তোমরা যেখানে যাচ্ছ।”

“আমরা স্কুলে যাচ্ছি।”

“আমিও স্কুলে যাব।”

টুশি মাথা নেড়ে বলল, “বড় মানুষেরা স্কুলে যায় না। স্কুলে যায় ছোট ছেলে মেয়েরা, আর তুমি বড় মানুষও না, তুমি হচ্ছ একটা জিন!”

তপু টুশির হাত ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, “টু-টু-টু-শি আপু–”

“কী হল?”

“তু-তু-তুমি এইভাবে কথা বোলো না, স-স-সবাই তোমার দিকে অবাক হয়ে দে-দেখছে।”

টুশির হঠাৎ করে মনে পড়ল যে রাস্তায় যারা যাচ্ছে আসছে তাদের কেউ কাবিল কোহকাফীকে দেখছে না, তাই সে যখন অদৃশ্য কাবিল কোহকাফীর সাথে কথা বলছে তাকে নিশ্চয়ই সবাই ভাবছে মাথা খারাপ! টুশি নিশ্বাস ফেলে বলল, “ঠিকই বলেছিস।” তারপর আড়চোখে কাবিলের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমরা এখন সোজাসুজি তোমার দিকে তাকিয়ে কথাও বলতে পারব না। তা হলে সবাই আমাদের পাগল ভাববে।”

কাবিল কোহকাফী চুটকি বাজিয়ে বলল, “কোনো চিন্তা নাই। আমার দিকে না তাকিয়ে একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে কথা বলো–আমি শুনে নেব।”

তপু বলল, “টু-টু-টুশি আপু। তাড়াতাড়ি চলো, দে-দেরি হয়ে যাচ্ছে।”

“হ্যাঁ চল।”

কাবিল কোহকাফীও বলল, “চলো।”

টুশি আর তপু সামনে এবং তাদের দুই পা পিছনে কাবিল কোহকাফী হাঁটতে শুরু করে। বড় রাস্তায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে কয়েকটা অঘটন ঘটে গেল, মাথায় টুকরি নিয়ে একজন পুরানো কাগজ শিশি-বোতল নিয়ে যাচ্ছিল, কাবিল কোহকাফীর সাথে ধাক্কা খেয়ে তার পুরানো কাগজের বাণ্ডিল রাস্তায় ছড়িয়ে পড়ল–মানুষটা অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে টুকরিতে কাগজের বাণ্ডিল তুলতে তুলতে বলল, “কী আজব কাণ্ড–মনে হল ধাক্কা খেলাম কিন্তু ধাক্কা খাওয়ার কিছু নাই।”

কাবিল মানুষটাকে সাহায্য করার জন্যে আসতে চাইছিল, টুশি নিষেধ করল, সাহায্যের বদলে তখন উলটো ঝামেলা শুরু হয়ে যাবে–মানুষ যখন দেখবে কাগজের বাণ্ডিল নিজে থেকে লাফিয়ে লাফিয়ে টুকরিতে ঢুকে যাচ্ছে সেটা একটা মহা কেলেঙ্কারি হয়ে যেতে পারে।

টুকরি মাথায় মানুষের সাথে ধাক্কা থেকেও চমকপ্রদ ঘটনা ঘটল যখন আট দশ বছরের কয়েকটা বাচ্চা কথা নেই বার্তা নেই হঠাৎ করে কোথা থেকে ছুটে এল এবং তাদের মাঝে একজন অদৃশ্য কাবিল কোহকাফীর ভেতর দিয়ে বের হয়ে। যাবার চেষ্টা করল। বাচ্চাটা আরেকটু হলে আছাড় খেয়ে পড়ত, কিন্তু কাবিল কোহকাফী তাকে ঠিক সময়ে ধরে ফেলে সোজা করে দাঁড় করিয়ে দেয়। কাবিল কোহকাফীকে দেখতে পাচ্ছে বলে ব্যাপারটি টুশি আর অপুর কাছে মোটেও অস্বাভাবিক মনে না হলেও অন্য বাচ্চাগুলোর চোখ গোল আলুর মতো বড় হয়ে। যায়। তারা দেখল বাচ্চাটি আছাড় খেয়ে মাটিতে পড়ার শেষ মুহূর্তে হঠাৎ ম্যাজিকের মতো সোজা হয়ে আকাশের দিকে উঠে মাটিতে দু-পায়ের ওপর। দাঁড়িয়েছে। ব্যাপারটি কীভাবে সম্ভব কেউ সেটা বুঝতে পারল না।

কাবিল কোহকাফীকে সাথে নিয়ে গেলে এরকম আরও কত কী ঘটবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই, তাই তারা তাড়াতাড়ি স্কুলে যাবার চেষ্টা করতে থাকে। কিন্তু বড় রাস্তায় এসে কাবিল কোহকাফীকে নড়ানো খুব মুশকিল হয়ে যায়। সে এর আগে কখনও গাড়ি দেখে নি এবং রাস্তার গাড়িগুলোর দিকে সে হাঁ করে তাকিয়ে রইল। চোখ কপালে তুলে বলল, “ইয়া মাবুদ! এটা কী তেলেসমাতি!”

টুশি কাবিলের দিকে না তাকিয়ে বলল, “এইটা তেলেসমাতি না। এইটার নাম গাড়ি।”

“চলে কেমন করে? ঘোড়াগুলো কোথায় ঢুকিয়েছে?”

টুশি মাথা নেড়ে বলল, “এর মাঝে কোনো ঘোড়া নাই। এগুলো ইঞ্জিন দিয়ে চলে।”

“ইঞ্জিন! সেগুলো আবার কীরকম জানোয়ার? কখনও নামও শুনি নাই। কোন দেশে পাওয়া যায়?”

 “এগুলো কোনো জন্তু-জানোয়ার না। এগুলো মেশিন!”

“কী আশ্চর্য!” কাবিল কোহকাফী চোখ ছানাবড়া করে তাকিয়ে থেকে বলল, “কী আচানক ব্যাপার!”

টুশি কাবিল কোহকাফীকে খোঁচা দিয়ে বলল, “তাড়াতাড়ি চলো, তা না হলে স্কুলে দেরি হয়ে যাবে।”

দুই-দুইবার ধাক্কা খেয়ে কাবিল কোহকাফী এবারে মানুষের ধাক্কা বাঁচিয়ে খুব সাবধানে যেতে থাকে, তার পরেও একজন অন্ধ ফকির, একজন হকার আর একজন ট্রাফিক পুলিশের সাথে ছোট মাঝারি আর বড় একটা ধাক্কা লাগিয়ে ফেলল। শুধু যে মানুষের সাথে ধাক্কা লাগিয়েই গোলমাল পাকাল তা নয়, একেবারে নিজে নিজেও সে একটা গোলমাল পাকাল। সেটা শুরু হল এভাবে।

একজন খুব সেজেগুজে থাকা ফিটফাট মানুষ রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে জুতো পালিশ করাচ্ছে, জুতো পালিশ করছে একটা ছোট ছেলে। ছেলেটা খুব যত্ন করে জুতো পালিশ করে সেটা চকচকে একটা আয়নার মতো করে ফেলেছে। মানুষটা। দেখে খুব খুশি হয়ে পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে একটা ময়লা নোট ছুঁড়ে দিল। ছেলেটা চোখ কপালে তুলে বলল, “স্যার এইটা কী দিলেন?”

ফিটফাট মানুষটা বলল, “যা যা বেটা ভাগ! যা দিয়েছি বেশি দিয়েছি।”

“বেশি দিয়েছেন?” ছেলেটা রেগে বলল, “এইটা বেশি হল?”

মানুষটা রেগে এবারে ছেলেটার মাথায় একটা চটি মেরে বলল, “চুপ কর ছোটলোকের বাচ্চা। চড় মেরে দাঁত ভেঙে ফেলব।”

ছোট ছেলেটার মনে হয় বেশ তেজ আছে, তেরিয়া হয়ে বলল, “কী বললেন? আমি ছোটলোকের বাচ্চা? এতক্ষণ ধরে জুতো পালিশ করলাম আর এই ছেঁড়া একটা নোট দিয়ে আমারে বলেন ছোটলোকের বাচ্চা? কে আসলে ছোটলোকের বাচ্চা?”

ফিটফাট মানুষটা এবারে হুংকার দিয়ে বলল, “তবে রে হারামজাদা–” তারপর পা তুলে সে ছোট ছেলেটাকে কষে একটা লাথি মেরে বসল–অন্তত সে তা-ই ভাবল। আসলে অবশ্যি সেটা ঘটল না, কারণ কাবিল কোহকাফী বিদ্যুদ্বেগে মাঝখানে গিয়ে তার লাথিটা ফেরাল, তারপর টুশি আর তপু কিছু বোঝার আগে মানুষটার বুকের কাপড় ধরে ওপরে তুলে তাকে পিছনে ছুঁড়ে ফেলে দিল। টুশি এবং তপুর কাছে মনে হল কাজটি ভয়ংকর কিন্তু অন্য সবার কাছে মনে হল কাজটি অবিশ্বাস্য রকমের হাস্যকর। তারা কেউ কাবিল কোহকাফীকে দেখেনি, তারা দেখেছে ফিটফাট একটা মানুষ ছোট একটা বাচ্চাকে লাথি মারতে গিয়ে হঠাৎ মাঝখানে তার পা ব্রেক কষেছে, তারপর হঠাৎ করে রকেটের মতো সে উপরে উঠে গিয়ে উলটো দিকে ডাইভ দিয়ে কাদা-পানির মাঝে উলটো হয়ে পড়েছে। কোনো মানুষ কাদায় পিছলে পড়লে হাসা উচিত নয় জেনেও সবাই হেসে ফেলে–এখানে ফিটফাট একটা মানুষ নিজে থেকে একটা হাস্যকর ভঙ্গিতে উলটোভাবে কাদার মাঝে লাফিয়ে পড়েছে মানুষজন হাসতেই পারে। আশপাশে যারা ছিল সবাই হো হো করে হাসতে শুরু করে দেয়। সবচেয়ে জোরে হাসল জুতো পালিশ করা ছেলেটা–সে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে হাসতে হাসতে মাটিতে লুটোপুটি খেতে থাকে।

ফিটফাট মানুষটা, যে আর ফিটফাট নেই, কোনোমতে কাদা থেকে উঠে ছেলেটার দিকে তেড়ে আসছিল, তখন রাস্তার লোকজন তাকে থামায়–একজন বলল, “ভাই! আপনি জোকারি করে কাদার মাঝে লাফাচ্ছেন–পোলাপান হাসবে না? হাসার কাজ করলে তো তোক হাসবেই।”

মানুষটা মুখ খিঁচিয়ে বলল, “আমি লাফ দেই নাই–আমাকে ধাক্কা মেরেছে।”

“কে ধাক্কা মেরেছে? বাতাস?”

মানুষটা এর কোনো উত্তর দিতে পারল না, রাগে ফোঁস ফোঁস করতে লাগল। জুতো পালিশ করা ছেলেটা একটু নিরাপদ দূরত্বে সরে গিয়ে চিৎকার করে বলল, “গরিবের বন্ধু হচ্ছে আল্লাহ্! আপনি গরিবকে ঠকিয়েছেন তাই আল্লাহ্ আপনার শাস্তি দিয়েছে!” ছেলেটার চোখেমুখে অবশ্যি ঠকে যাওয়ার কোনো চিহ্ন দেখা গেল না, সবগুলো দাঁত বের করে হেসে বলল, “খোদার কসম স্যার আপনি যে সার্কাস দেখাইলেন চাইনিজ সার্কেও সেটা দেখাতে পারবে না।”

মানুষটা আবার তেড়ে গেল কিন্তু ছেলেটা ততক্ষণে দৌড়ে সরে গেছে, অনেকদূর থেকে তার হাসির শব্দ শোনা যেতে থাকে।

টুশি আর তপু দ্রুত সেই জায়গা থেকে চলে গেল–কাবিল কোহকাফী দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আরও কিছুক্ষণ চিৎকার করতে চাইছিল, কিন্তু টুশি আর তপু তাকে সেই সুযোগ দিল না।

স্কুলের কাছাকাছি এসে টুশি কাবিল কোহকাফীকে বলল, “তুমি স্কুলের ভিতরে আবার কোনো গোলমাল শুরু করো না যেন।”

কাবিল কোহকাফী বলল, “আমি কখনও কোনো গোলমাল করি না।”

টুশি চোখ পাকিয়ে বলল, “কী বললে, গোলমাল কর না? একটু আগে কী করেছ?”

কাবিল কোহকাফী মুখ শক্ত করে বলল, “এটা গোলমাল হল। একজন পাজি মানুষকে একটু টাইট করা হল–”

টুশি মাথা নাড়ল, বলল, “মনে থাকে যেন স্কুলের ভিতরে তুমি কাউকে টাইট দিতে পারবে না।”

কাবিল কোহকাফী মুখ সুচালো করে বলল, “খুব যদি পাজি হয়–ডাবল গেজ পাজি–তখন আমি যদি শুধু”।

“তুমি কারও গায়ে হাত দিতে পারবে না।”

“হাত দিতে পারব না? একটু ধাক্কা–একটু কাতুকুতু একটু ডলাডলি–”

“উঁহু।” টুশি গম্ভীর মুখে বলল, “তুমি আমাকে কসম খেয়ে বলো কারও গায়ে তুমি হাত দেবে না।”

কাবিল কোহকাফী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “ঠিক আছে। ঠিক আছে কথা দিচ্ছি।”

“কী কথা দিচ্ছ? স্পষ্ট করে বল।”

কাবিল কোহকাফী বিরক্ত হয়ে বলল, “কথা দিচ্ছি যে কারও গায়ে হাত দেব না।”

“কসম খেয়ে বলো।”

 “কসম? কসম খেয়ে কেন বলতে হবে?”

 “কারণ তোমাকে আমি চিনি। খাও কসম।”

“ঠিক আছে ঠিক আছে কসম খাচ্ছি।” কাবিল কোহকাফী মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, “শাহজাদি দুনিয়ার চোখের ভুরুর কসম, তার রেশমি চুলের কসম, তার গালের তিলের কসম। কোহকাফ নগরের কসম। আসমান জমিনের কসম মুরগির রোস্টের কসম”

টুশি কী করবে বুঝতে না পেরে চোখ কপালে তুলে হতাশ হয়ে মাথা নাড়ল।

.

তবে কাবিল কোহকাফী তার কথা রেখেছিল, সে স্কুলে কারও গায়ে হাত দেয় নি। স্কুল কম্পাউন্ডের ভেতরে কিছু দোলনা আছে–ছোট ছোট বাচ্চারা সেখানে উঠে আবিষ্কার করল কোনো কারণ ছাড়াই আজ দোলনাগুলো দুলছে। অন্যদিন সেগুলো দুলিয়ে দেবার জন্যে অন্যদের সাধাসাধি করতে হত–আজকে কাউকে বলতেও হচ্ছে না দোলনাগুলো বেশ নিজে নিজেই দুলছে! শুধু তা-ই নয়, কেউ যদি অন্যকে চড়তে না দিয়ে নিজে নিজে বেশিক্ষণ দোলনায় বসে থাকতে চায় তা হলে কেন জানি বসতে পারে না–পিছলে পড়ে যায়। বেশি ছোট বাচ্চা নিজে থেকে উঠতে না পারলেও কীভাবে কীভাবে জানি দোলনায় উঠে যাচ্ছে। ব্যাপারগুলো খুব বিচিত্র, বলা যেতে পারে অবিশ্বাস্য কিন্তু ছোট ছোট বাচ্চারা সেটা নিয়ে একেবারেই মাথা ঘামাল না। শুধু টুশি আর তপু আসল ব্যাপারটা দেখতে পেল, কাবিল কোহকাফী মহা আনন্দে ছোট বাচ্চাদের সাথে দোলনা নিয়ে খেলছে, দোলনা ধাক্কা দিচ্ছে, ছোটদের দোলনায় তুলে দিচ্ছে, যারা বেশি সময় ধরে দোলনায় বসে আছে তাদের। নামিয়ে দিচ্ছে–কেউ তাকে দেখছে না, শুধু তার মজার কাজকর্মগুলো টের পাচ্ছে। বয়স্ক কোনো মানুষ হলে হয়তো ঘাবড়ে যেত কিন্তু ছোট হওয়ার অনেক মজা কেউই ব্যাপারটি নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে না।

আরও কিছু বিচিত্র ব্যাপার ঘটল–যেটা কেউই ঠিক বুঝতে পারল না। যেমন তপুর কথায় একটু তোতলামো আছে বলে ক্লাসের দুষ্টু ছেলেরা তাকে নিয়মিতভাবে ভ্যাংচায়, আজ হঠাৎ করে তাদের বিপদ হয়ে গেল। যেমন বাইরে ছোটাছুটি করে। সবাই কুমির কুমির খেলছে, তপু লাফ দিয়ে সিঁড়িতে উঠে বলল, “আমি ডা-ডা ডাঙায়–”

তাকে ঠাট্টা করে সাদিব নামে ছেলেটা দাঁত বের করে হেসে বলল, “ডা-ডা ডাঙা ভা-ভা-ভাঙা– ডা-ডা-ডাঙা ভা-ভা-ভাঙা–”

সাথে সাথে খুব একটা বিচিত্র ব্যাপার ঘটে যায়, সাদিবের মনে হল তার শার্টের কলার ধরে কেউ যেন উপরে তুলে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে নিচে নামিয়ে দিয়েছে। সে যা ভয় পেল সেটি আর বলার মতো নয়। একটু পর খেলতে খেলতে তপু যখন মাঠে নেমে চিৎকার করে বলল, “কু-কু-কুমির তোর জলে নেমেছি” তখন তাদের ক্লাসের পাজি একটা মেয়ে, নাম শাওন, মুখ ভেংচে বলল, “কু-কু কুমির কু-কু-কুমির–”

হঠাৎ করে শাওনের মনে হল তার বেণিটায় কেউ একটা হ্যাঁচকা টান দিয়েছে, শাওন যন্ত্রণায় চিৎকার করে পিছনে তাকিয়ে দেখে কেউ নেই। সে যত না অবাক হল ভয় পেল তার থেকে অনেক বেশি। সারাদিন এরকম ঘটনা ঘটতে থাকল– তপুকে কেউ টিটকারি করা মাত্র সাথে সাথে তার শাস্তি পেয়ে যায় এবং দিনের শেষে আর কেউ তপুকে নিয়ে টিটকারি করার সাহস পেল না। ব্যাপারটা টুশি এবং তপু দুজনেই লক্ষ করেছে–তপুর যা আনন্দ হল সেটা আর বলার মতো নয় কিন্তু টুশি ব্যাপারটাকে একেবারেই ভালো চোখে দেখল না। কাবিল কোহকাফীকে এক কোনায় ঠেলে নিয়ে ফিসফিস করে বলল, “তুমি বলেছ তুমি কারও গায়ে হাত দেবে না।”

কাবিল কোহকাফী বুকে থাবা দিয়ে বলল, “আমি কারও গায়ে হাত দেই নাই।”

“একটু আগে তুমি একটা মেয়ের বেণি ধরে টান দিয়েছ।”

 “বেণি হচ্ছে চুল–আমি চুলে হাত দিয়েছি গায়ে হাত দেই নাই”

এই নিয়ে তর্ক করা যেত কিন্তু ঠিক সেই সময়ে ক্লাসের ঘণ্টা পড়ে গেল। টুশি ক্লাসে যাবার সময় ফিসফিস করে বলল, “দ্যাখো–তুমি যদি আমার ক্লাসে ঢোকো ভালো হবে না কিন্তু।”

কাবিল কোহকাফীর চোখ উত্তেজনায় চকচক করে উঠল, সে দুই পা এগিয়ে এসে আগ্রহ নিয়ে বলল, “কেন? ক্লাসে ঢুকলে কী হবে?”

টুশি দুর্বলভাবে চেষ্টা করল, বলল, “তুমি আমাকে কথা দিয়েছ–”

“আমি কথা দিয়েছি কারও গায়ে হাত দেব না।” কাবিল কোহকাফী চোখ নাচিয়ে বলল, “কিন্তু আমি তোমার ক্লাসে ঢুকব না সেটা তো কথা দিই নাই।”

টুশি রেগেমেগে কিছু-একটা বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু ঠিক তখন টুশির ক্লাসের একটি মেয়ে টুশির দিকে অবাক হয়ে বলল, “তুমি একা একা কথা বলছ কেন?”

টুশি মেয়েটার দিকে তাকিয়ে ঠাণ্ডা চোখে বলল, “আমার যখন খুব মেজাজ খারাপ হয় তখন আমি নিজে নিজে কথা বলি।”

মেয়েটা, যে ক্লাসের মাঝে সবচেয়ে সুন্দরী কিন্তু যে সারা ক্লাসের মাঝে সবচেয়ে পাজি, যার নাম ফারিয়া, একেবারে নায়িকাদের মতো ঢং করে খিলখিল করে হেসে বলল, “ও মা! তোমার চেহারা যেরকম অদ্ভুত তোমার স্বভাবও সেরকম অদ্ভুত!”

কাবিল কোহকাফী ফারিয়ার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল, টুশি দাঁতে দাঁত ঘষে ফিসফিস করে বলল, “খবরদার কাবিল কোহকাফী।”

ফারিয়া বলল, “কী বলছ?” টুশি চোখ লাল করে বলল, “কিছু বলি নাই।”