১২. কিডন্যাপ

১২. কিডন্যাপ

কাবিল কোহকাফী খাবার টেবিলে পা ঝুলিয়ে বসে কলা খাচ্ছে। খেতে খেতে বলল, “আরেকবার পড়ো দেখি টুশি।”

টুশি বলল, “এক জিনিস কতবার পড়ব?”

কাবিল কোহকাফী কলায় একটা কামড় দিয়ে বলল, “আহ্! পড়ো না একবার!”

টুশি আর তপু স্কুল থেকে এসে চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে এসে দেখে বাসায় চাচা বা চাচি নেই। কাবিল কোহকাফী ডাইনিং-টেবিলে বসে কলা খাচ্ছে। আজকাল প্রায় প্রত্যেক দিনই তার কোথাও-না-কোথাও একটা অ্যাডভেঞ্চার হয়, পরদিন সেটা খবরের কাগজে ছাপা হয়। টুশিকে পরদিন তাকে সেটা পড়ে শোনাতে হয়।

টুশি পড়তে শুরু করল, “দুর্ধর্ষ ব্যাংক ডাকাত ছলিম গ্রেফতার। গতকাল দুপুরবেলা মতিঝিলে ব্যাংক ডাকাতি করতে গিয়ে ছলিম নামে একজন দুর্ধর্ষ ব্যাংক ডাকাত ধরা পড়েছে। খবরে প্রকাশ অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে সে প্রায় এগারো লক্ষ টাকা নিয়ে পলায়ন করার সময় হঠাৎ করে ফুটপাথে আছাড় খেয়ে পড়ে। সে উঠে দৌড়াতে শুরু করার পর আবার আছাড় খেয়ে পড়ে। ব্যাংকের সামনে তার সহযোগীরা গাড়ি নিয়ে প্রস্তুত ছিল এবং মাত্র ত্রিশ থেকে চল্লিশ ফুট স্থান অতিক্রম করতে গিয়ে এই দুর্ধর্ষ ডাকাত ছলিম ক্রমাগত আছাড় খেয়ে পড়তে থাকে এবং তখন পুলিশ এসে তাকে গ্রেফতার করে।

“দুর্ধষ ব্যাংক ডাকাত ছলিম পুলিশের কাছে স্বীকারোক্তি করার সময় জানায় যে তার মনে হচ্ছিল পায়ের ভেতর অন্য কেউ পা প্রবেশ করিয়ে তাকে ফেলে দিচ্ছিল। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায় কেউ সেখানে উপস্থিত ছিল না।

 “সংবাদদাতা একজন ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করার পর ডাক্তার বলেছেন এটি সম্ভবত মাংশপেশি এবং স্নায়ুর একটি দুরারোগ্য রোগ। রোগটি সংক্রামক হতে পারে সন্দেহ করে এই দুর্ধর্ষ ডাকাত ছলিমকে হাজতে আলাদা করে রাখা হয়েছে বলে জানানো হয়।

“পুলিশ সূত্র জানায় এ ব্যাপারে জোর তদন্ত চলছে।”

টুশি পড়া শেষ করে কাবিল কোহকাফীর দিকে তাকাল–কাবিল কোহকাফী তখন দুলে দুলে হাসছে। তৃতীয় কলাটাতে একটা কামড় দিয়ে বলল, “তোমরা যদি ছলিম ডাকাতের অবস্থাটা দেখতে তা হলে হাসতে হাসতে মারা যেতে!”

টুশি বলল, “আচ্ছা কাবিল কোহকাফী, মানুষকে ল্যাং মেরে ফেলে দেওয়া ছাড়া তুমি আর অন্য কিছু করতে পার না?”

“অন্য কী?”

টুশি একটু ইতস্তত করে বলল, “আমরা আরব্য রজনীতে পড়েছি জিনেরা আরও কত কী করতে পারে! আকাশে উড়তে পারে। বড় হতে পারে ছোট হতে পারে। মানুষের ইচ্ছাপূরণ করতে পারে।”

“কে বলেছে পারি না। আমিও পারি।”

 “তা হলে সেগুলো করে দেখাও না কেন?”

 “কী দেখতে চাও?”

 “যেমন মনে করো–” টুশি হঠাৎ ইতস্তত করে থেমে যায়।

তপু বলল, “আমি বু-বুঝেছি আপু কী চায়!”

কাবিল তপুর দিকে তাকাল, “কী চায়?”

“টু-টুশি আপু মনে করে তার চেহারা বেশি ভালো না, সেইজন্যে চেহারাটা সু-সুন্দর করতে চায়!”

কাবিল কোহকাফী হা হা করে হেসে উঠল। টুশি একটু রেগে উঠে বলল, “কী হল, তুমি হাসছ কেন? এইটা কি হাসির ব্যাপার?”

কাবিল মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ এইটা হাসির ব্যাপার। কারণ চেহারার মাঝে ভালো আর খারাপ নাই। মানুষ ভালো হলে চেহারাটা ভালো লাগে, মানুষ খারাপ হলে তার চেহারাটাও খারাপ লাগে।”

টুশি কঠিন মুখ করে বলল, “যাক আর বড় বড় কথা বলতে হবে না। তুমি বলো আমার চেহারা তুমি ভালো করে দিতে পারবে কি না।”

“চেহারার পরিবর্তন তো আমাদের জন্যে ডালভাত। আমরা জিনেরা হচ্ছি এর এক্সপার্ট। ভালো চেহারা খারাপ করে দিতে পারি। ভালো ঠ্যাং লুলা করে দিতে পারি। ভালো চোখ কানা করে দিতে পারি”।

“এইগুলো তো সবাই পারে! তুমি উলটোটা পার কী না বলো। লুলা ঠ্যাং ঠিক করতে পার? কানা চোখ ভালো করতে পার? খারাপ চেহারা ভালো করতে পার?”

কাবিল কোহকাফী মাথা চুলকে বলল, “পারার কথা! তোমরা তো জান জিন হচ্ছে খুব উঁচু পর্যায়ের একটা ব্যাপার। আমাদের অনেক ক্ষমতা!”

“ওহ্!” টুশি অধৈর্য হয়ে বলল, “তুমি সোজাসুজি বলে দাও না–আমার চেহারাটা তুমি ভালো করে দিতে পারবে কি না!”

কাবিল কোহকাফী ইতস্তত করে বলল, “মনে হয় পারব।”

টুশি সরু চোখে তাকিয়ে বলল, “কেন? মনে হয় কেন? তুমি শিওর না কেন?”

“কারণ এইসব কাজকর্মের জন্যে অনেক প্র্যাকটিস করতে হয়। কেউ বেশি পারে, কেউ কম পারে।”

তপু জিজ্ঞেস করল, “তুমি বেশি পার না কম পার?”

“আমি?” কাবিল কোহকাফী একটু ইতস্তত করে বলল, “আমি–মানে আসলে হয়েছে কি-শাহজাদি দুনিয়ার পিছনে ঘুরোঘুরি করে ইয়ে মানে”।

টুশি মাথা নেড়ে বলল, “তার মানে তুমি পার না। তুমি হচ্ছ অপদার্থ জিন। লাফাংরা।”

“লাফাংরা?”

“হ্যাঁ। লাফাংরা মানে হচ্ছে ফালতু।”

কাবিল কোহকাফী রেগে গিয়ে বলল, “আমি মোটেও লাফাংরা না। প্রত্যেক দিন পত্রিকায় আমার উপর খবর বের হয়।”

“সেটাতে তোমার কোনো কেরানি নাই। মানুষ অদৃশ্য হলে এগুলো করতেই পারে। যে-কেউ পারবে। আমি অদৃশ্য হলে আমিও করতে পারব।” টুশি মুখ শক্ত করে বলল, “যদি পার তা হলে আমার চেহারাটা ঠিক করে দাও।”

কাবিল কোহকাফী টেবিলে থাবা দিয়ে বলল, “ঠিক আছে! আমি যদি জিনের বাচ্চা জিন হই, কোহকাফ নগরের আগুন দিয়ে যদি আমার শরীর তৈরি হয়ে থাকে তা হলে এক সপ্তাহের মাঝে তোমার চেহারাকে আমি আগুনের খাপরার মতো সুন্দর করে দেব!”

তপু জিজ্ঞেস করল, “আ-আগুনের খাপরা?”

“হ্যাঁ। তোমার গায়ের রং হবে বেদানার মতো, ভুরু হবে ধনুকের মতো, চোখ। হবে ভ্রমরের মতো, দাঁত হবে মুক্তার মতো–”

টুশি লজ্জা পেয়ে বলল, “এত কিছুর দরকার নাই। শুধু দেখে যেন কেউ নাক না সিঁটকায়, তা হলেই হবে।”

তপু জিজ্ঞেস করল, “তু-তুমি কেমন করে করবে?”

“একটা জিন জীবনে কমপক্ষে একটা জাদু করতে পারে। আমি সেই জাদুটা করব!”

“কীভাবে ক-করবে?”

“আসল সোলেমানি জাদু নামে একটা বই আছে। দুই হাজার বছর আগের বই। সেই বইটা যোগাড় করতে হবে। সেইখানে জিনদের সব জাদুর কথা লেখা আছে।”

“কী কী জাদু আছে সেখানে?”

“সবরকম জাদু। মানুষকে কীভাবে টিকটিকি বানাতে হয়। লোহাকে কীভাবে সোনা বানাতে হয়। আকাশে কীভাবে উড়তে হয়। অত্যাচারী রাজাকে কীভাবে শাস্তি দিতে হয়। সবকিছু আছে।”

“কীভাবে অ-অদৃশ্য হতে হয় সে-সেটা লেখা আছে?”

কাবিল কোহকাফী মাথা চুলকে বিমর্ষ হয়ে বলল, “সেটা মনে হয় নাই।”

“কেন নাই?”

“কারণ এইটা অনেক বড় জাদু। সবাই পারে না।”

টুশি জিজ্ঞেস করল, “তা হলে তুমি অদৃশ্য হয়ে আছ কেমন করে?”

“আমাকে অনেক বড় জাদুকর বাণ মেরে অদৃশ্য করে রেখেছে। শাহজাদি দুনিয়ার নানি ছিল আসল ডাইনি বুড়ি। শাহজাদি দুনিয়া যখন ট্রিক্স করে আমাকে বোতলের মাঝে ভরে দিল–সেই ডাইনি বুড়ি তখন বোতলের মুখ লাগিয়ে বাণ মেরে দিয়েছে!”

“তা হলে তোমাকে কখনও কেউ দেখবে না?”

কাবিল কোহকাফী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “কেউ যদি সেই বাণ ছুটাতে পারে তা হলে দেখবে।”

টুশি জিজ্ঞেস করল, “সেই বাণ কেমন করে ছোটাবে?”

 “ডাইনি বুড়ি সেটা জানি কোথায় লিখে রেখেছে।”

“কোথায়?”

“সেটা তো জানি না। শাহজাদি দুনিয়া অনেক অনুরোধ করল তখন মন্ত্রটা লিখে দিল।”

তপু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “তা-তা হলে তোমাকে আর কেউ কখনও দে-দেখবে না?”

কাবিল কোহকাফী মুখ কালো করে বলল, “নাহ্।”

টুশি জিজ্ঞেস করল, “তা হলে আমরা দুইজন কেমন করে দেখি?”

কাবিল কোহকাফী মাথা চুলকে বলল, “সেইটা আমি জানি না। মনে হয় আমি যখন বোতল থেকে বের হই তখন সেই ধোঁয়া তোমাদের নাকে গেছে। মনে হয় সেই ধোঁয়া যাদের নাকে যায় তারা দেখতে পায়?”

যুক্তিটা টুশির খুব বিশ্বাসযোগ্য মনে হল না, কিন্তু সে সেটা নিয়ে আপত্তিও করল না।

তপু কথা বলতে বলতে জানালার কাছে গিয়ে বাইরে তাকিয়ে কিছু-একটা দেখে ভালো করে দেখার জন্যে পরদা তুলে তাকাল। টুশি জিজ্ঞেস করল, “কী দেখিস?”

 “একটা মা-মাইক্রোবাস।”

“মাইক্রোবাসে দেখার কী আছে?”

 “না, কেমন জানি স-সন্দেহ হচ্ছে।”

“কী সন্দেহ?”

“কয়েকবার এদিক ঘু-ঘুরেছে। এখন রাস্তার পা-পা-পাশে দাঁড়িয়ে আছে! প পরদা দিয়ে ঢাকা। ভেতরে কে দে-দে-দেখা যায় না।”

টুশি হাত দিয়ে ব্যাপারটা উড়িয়ে দিয়ে বলল, “ধুর! ঢাকা শহরে কয় হাজার মাইক্রোবাস আছে তুই জানিস?”

টুশির কথা সত্যি। ঢাকা শহরে আসলেই কয়েক হাজার মাইক্রোবাস আছে। তবে এটি ছিল একটি বিশেষ মাইক্রোবাস। এর ভিতরে মন্তাজ ওস্তাদ, কালাচান। আর দবির মিয়া ছাড়াও আরও দুইজন মানুষ ছিল। শুধু মানুষ নয়, টুশিদের বাসাটাকে চোখে-চোখে রাখার জন্যে এই মাইক্রোবাসটা যন্ত্রপাতিতে বোঝাই করা ছিল। জানালার কাছে দাঁড়িয়ে তপু জানতেও পারল না দামি ভিডিও ক্যামেরা দিয়ে ঠিক সেই মুহূর্তে তার ভিডিও করে কম্পিউটারে সেটা বিশ্লেষণ করা শুরু করে দেয়া হয়েছে!

পরদিন যে-খবরটি কাবিল কোহকাফীকে পড়ে শোনাতে হল সেটি ছিল এরকম :

নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা

“গতকাল মতিঝিলের একটি ব্যস্ত সড়কে একটি শিশু নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে অলৌকিকভাবে রক্ষা পেয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছে জানা যায় যে একটি শিশু হঠাৎ করে রাস্তা পার হওয়ার জন্যে দৌড় দিয়ে একটি চলন্ত ট্রাকের সামনে পড়ে যায়। ট্রাক ড্রাইভার তার চলন্ত ট্রাক থামাতে সক্ষম না হলেও শিশুটি সম্পূর্ণ অলৌকিকভাবে ট্রাকের তলা থেকে রাস্তার একপাশে চলে আসে। শিশুটি জানায় তার মনে হয়েছে যে কোনো-একজন মানুষ তাকে টেনে রাস্তা থেকে সরিয়ে এনেছে যদিও প্রত্যক্ষদর্শীরা সেখানে কোনো মানুষ দেখে নি।

এই অলৌকিক ঘটনার পর শিশুটি “পিচ্চি পীর” নামে পরিচিত হয়েছে এবং স্থানীয় মানুষেরা তার থেকে পানি পড়া নেয়ার জন্যে ভিড় জমাচ্ছে। শিশুটির পিতা তার সন্তানের জন্যে একটি খানকায়ে শরিফ স্থাপনের জন্যে ওয়ার্ড কমিশনারের কাছে আবেদন করেছেন।”

.

এর পরের দিন যে-খবরটি কাবিল কোহকাফীকে পড়ে শোনাতে হল সেটি এরকম :

পুলিশ সার্জেন্ট নাজেহাল

“গতকাল মহাখালি এলাকায় একজন পুলিশ সার্জেন্টকে অত্যন্ত বিচিত্র উপায়ে নাজেহাল হতে দেখা গেছে। খবরে প্রকাশ এই পুলিশ সার্জেন্ট একটি চলমান ট্রাককে থামিয়ে প্রকাশ্যে ট্রাক ড্রাইভারের নিকট থেকে উৎকোচ গ্রহণ করে। ট্রাকটি চলে যাবার পর পুলিশ সার্জেন্ট সরে যাওয়ার চেষ্টা করে রাস্তার উপর পড়ে যায়। সে কিছুতেই হাঁটতে পারছিল না এবং তাকে ঘিরে একটি ভিড় জমে যায়।

পুলিশ সার্জেন্টকে ধরাধরি করে রাস্তার পাশে নিয়ে যাবার পর দেখা যায় তার জুতোর দুটি ফিতা গিঁট দিয়ে বেঁধে রাখার কারণে সে হাঁটতে পারছিল না।

কে কীভাবে তার জুতোর ফিতায় গিঁট দিয়েছে সেটি এখনও রহস্যাবৃত তবে ঘটনাটি এই এলাকায় কৌতুকের সৃষ্টি করেছে।”

.

এর পরের দিন কাবিল কোহকাফীকে যে খবরটি পড়ে শোনানো হচ্ছিল, সেটি এরকম :

স্কুলছাত্রীর সাহসিকতা

স্কুলছাত্রীকে উত্যক্ত করার কারণে কীভাবে সে কিছু বখাটে ছাত্রকে তুলোধুনা করেছে সেই খবরটি যখন মাত্র পড়তে শুরু করেছে ঠিক তখন টুশি শুনতে পেল কে যেন দরজা খুলে ঘরে ঢুকেছে।

টুশি এবং তপু মাথা ঘুরিয়ে তাকিয়ে হতবাক হয়ে যায়। দরজায় মন্তাজ ওস্তাদ, কালাচান এবং দবির মিয়া। মন্তাজ ওস্তাদের হাতে একটা রিভলবার, দবির মিয়ার হাতে একটা কাটা রাইফেল এবং কালাচান একটা বড় বস্তা ধরে রেখেছে। টুশি কয়েক সেকেন্ড কোনো কথা বলতে পারল না, হাঁ করে এই তিন মূর্তির দিকে তাকিয়ে রইল। তপু বলল, “ততা-তো-তোমরা? পু-পুলিশ ছেড়ে দিয়েছে?”

মন্তাজ ওস্তাদ বলল, “না, ছাড়ে নাই।”

 “তা হলে?”

“তোমার বাবা খুব বুদ্ধিমান মানুষ। তাই আমাদেরকে পুলিশে দেয় নাই। পুলিশের সাথে আমাদের খুব খাতির, পুলিশ আমাদের কখনও ধরে না।”

টুশি চোখের কোনা দিয়ে একবার কাবিলকে দেখল, কাবিল কোহকাফী যতক্ষণ ঘরে আছে তাদের কোনো ভয় নেই। সে চোখ পাকিয়ে বলল, “তোমরা কেন বাসায় এসেছ? এক্ষুনি বের হয়ে যাও।”

মন্তাজ ওস্তাদ চোখ টিপে বলল, “না গেলে কী করবে খুকি?”

“আগেরবার তো মাত্র একটা দাঁত ভাঙা হয়েছিল–এবার সবগুলো দাঁত ভেঙে দেয়া হবে।”

মন্তাজ ওস্তাদ এগিয়ে এসে খপ করে টুশির ঘাড় ধরে নিজের কাছে টেনে এনে তার মাথার কাছে রিভলবারটা ধরে বলল, “বেয়াদপ মেয়ে, বড়দের সাথে কেমন করে কথা বলতে হয় কেউ শেখায় নি?”

টুশি নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করল কিন্তু পারল না। ততক্ষণে কালাচান তার বস্তা নিয়ে চলে এসেছে। বস্তা খুলতেই টুশি দেখল তার ভেতরে মুড়ি। এক বস্তা মুড়ি নিয়ে এই মানুষটি এখানে কেন এসেছে টুশি বুঝতে পারল না। সে অবাক হয়ে। দেখল কালাচান মুড়িগুলো মেঝেতে ঢালতে শুরু করেছে এবং দেখতে দেখতে সারা মেঝে মুড়িতে ঢেকে গেল!

টুশি অবাক হয়ে এই মানুষগুলোর কাজকর্ম দেখছিল–তার মাকে মন্তাজ ওস্তাদ তার মাথার পিছনের চুল ধরে তার মুখটি নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলল,  “বেয়াদপ মেয়ে–তোমার এই কালা কুচ্ছিৎ চেহারা নিয়ে তো তোমার মনে খুব দুঃখ। আমি কী করব জান?”

টুশি অবাক হয়ে মন্তাজ ওস্তাদের দিকে তাকাল–সে কেমন করে জানে যে চেহারা নিয়ে তার মনে দুঃখ? মন্তাজ ওস্তাদ তার ফোকলা দাঁত দিয়ে পিচিক করে একটু থুতু ফেলে বলল, “আমি এখন রিভলবারের বাঁট দিয়ে তোমার নাকটা ভেঙে ফেলব। তোমার কুৎসিত চেহারা তখন আরও কুৎসিত হয়ে যাবে!”

টুশি ঝটকা মেরে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে বলল, “ছাড়ো আমাকে ছাড়ো বলছি।”

মন্তাজ ওস্তাদ বলল, “এত ব্যস্ত হচ্ছ কেন? তোমাকে রেডি হওয়ার একটু সময় দিচ্ছি। আমি বলব ওয়ান টু থ্রি তারপর মারব তোমার নাকে। ঠিক আছে

টুশি নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার প্রাণপণ চেষ্টা করতে থাকে কিন্তু মানুষটার হাত লোহার মতো শক্ত, কিছুতেই নিজেকে ছাড়াতে পারে না। মন্তাজ ওস্তাদ বলল, “ওয়ান।”

কাবিল কোহকাফী এতক্ষণ চুপ করে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে ছিল, এবারে সে টুশিকে বাঁচানোর জন্যে এগিয়ে এল। ঠিক তখন হঠাৎ করে টুশি মুড়ির রহস্য বুঝতে পারল। এই মানুষগুলো কাবিলকে দেখতে পায় না কিন্তু হাঁটার সময় মুড়িতে পা দিলে তার পায়ের চাপে মুড়িগুলো গুঁড়ো হয়ে যায় তারা সেই গুঁড়ো হয়ে যাওয়া মুড়ি দেখে বুঝতে পারে কাবিল কোথায় আছে। তিনজন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মেঝের দিকে তাকিয়ে ছিল এবং কাবিল ঠিক কোনদিক দিয়ে টুশির কাছে এগিয়ে আসছে বুঝতে পারল। টুশি সাবধান করার জন্যে চিৎকার করে বলল, “না–কাবিল না–”

কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে। কালাচান এবং দবির মিয়া হঠাৎ করে একসাথে কোথা থেকে দুটি রঙের ক্যান বের করে আনে, কিছু বোঝার আগে তারা নিখুঁতভাবে কাবিলের দিকে লক্ষ্য করে সেই রঙের ক্যানে চাপ দিয়ে রং স্প্রে করে দেয়। টুশি অবাক হয়ে দেখল মুহর্তে কাবিলের সারা মুখ হাত-পা স্প্রে ক্যানের রঙে। মাখামাখি হয়ে গেল। সাথে সাথে মন্তাজ ওস্তাদ টুশিকে ধাক্কা দিয়ে রিভলবারটা কাবিলের দিকে ধরে বলল, “কাবিল কোহকাফী, তুমি মানুষটা অদৃশ্য হতে পার– কিন্তু তোমার চোখে-মুখে হাতে যে রং লেগেছে সেটা আমরা দেখছি! একটু নড়লেই তোমাকে আমি গুলি করব।”

কাবিল তার পরেও নড়ার চেষ্টা করল কিন্তু ততক্ষণে কালাচান এবং দবির মিয়া দুইপাশ থেকে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে।

টুশি এবং তপু গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে থাকে কিন্তু তার ভিতরে তিনজন মিলে কাবিল কোহকাফীকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলল।

টুশি খোলা দরজা দিয়ে বাইরে ছুটে যেতে চাইছিল কিন্তু দবির মিয়া তাকে ধরে ফেলল। কিছু বোঝার আগে তপু এবং টুশি এই দুজনকেও দুটি চেয়ারে বেঁধে ওদের মুখে মন্তাজ ওস্তাদ সার্জিক্যাল টেপ লাগিয়ে দিল। ঘরের হুটোপুটি শুনে বাইরে কেউ এসেছে কি না সেটা সাবধানে পরীক্ষা করে, পকেট থেকে অ্যালকোহলের বোতল বের করে তুলো দিয়ে ভিজিয়ে কাবিল কোহকাফীর চোখ মুখের সব রং মুছে নেয়। তাকে পুরোপুরি অদৃশ্য করে মানুষ তিনজন যেভাবে এসেছিল সেভাবে এবারে নিঃশব্দে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।

.

সন্ধেবেলা চাচা-চাচি বাসায় এসে আবিষ্কার করলেন ঘর-বোঝাই মুড়ি এবং তার মাঝে টুশি এবং তপু চেয়ারে বাঁধা। তারা ছুটে এসে তাদের খুলে দিয়ে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস জিজ্ঞেস করলেন, “কী হয়েছে?”

টুশি কিছু বলল না। তপু কঠিন মুখে তার বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমার বন্ধুরা এসেছিল আব্দু।”

চাচা অবাক হয়ে বললেন, “আমার বন্ধুরা?”

“হ্যাঁ। সেদিন যে তিনজনকে আমরা ধরেছিলাম তারা আজকে আবার এসেছে। বলেছে তারা তোমার বন্ধু।”

চাচার মুখ হাঁ হয়ে গেল, তোতলাতে তোতলাতে বললেন, “ম-ম-মন্তাজ ওস্তাদ?”

তপু এতটুকু তোতলাল না, বলল, “হ্যাঁ। তারা বলেছে তুমি তাদেরকে পুলিশে দেও নাই।”

চাচা তোতলাতে তোতলাতে বললেন, “কে-কে-কেন এসেছিল?”

তপু বলল, “আমাকে কেন জিজ্ঞেস করছ? তোমার বন্ধুদের তুমি কেন জিজ্ঞেস কর না?”

টুশি অবাক হয়ে তপুর দিকে তাকিয়ে রইল, তার কথায় তোতলামির কোনো চিহ্ন নেই।

চাচা কিছু-একটা বলার চেষ্টা করছেন–কিন্তু ঠিক বলতে পারছেন না, টুশি সেটা শোনার চেষ্টাও করছে না।

তার শুধু কাবিল কোহকাফীর কথা মনে পড়ছে। কোথায় আছে কাবিল কোহকাফী? কেমন আছে কাবিল কোহকাফী?

১২. কিডন্যাপ

১২. কিডন্যাপ

১২. কিডন্যাপ

কাবিল কোহকাফী খাবার টেবিলে পা ঝুলিয়ে বসে কলা খাচ্ছে। খেতে খেতে বলল, “আরেকবার পড়ো দেখি টুশি।”

টুশি বলল, “এক জিনিস কতবার পড়ব?”

কাবিল কোহকাফী কলায় একটা কামড় দিয়ে বলল, “আহ্! পড়ো না একবার!”

টুশি আর তপু স্কুল থেকে এসে চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে এসে দেখে বাসায় চাচা বা চাচি নেই। কাবিল কোহকাফী ডাইনিং-টেবিলে বসে কলা খাচ্ছে। আজকাল প্রায় প্রত্যেক দিনই তার কোথাও-না-কোথাও একটা অ্যাডভেঞ্চার হয়, পরদিন সেটা খবরের কাগজে ছাপা হয়। টুশিকে পরদিন তাকে সেটা পড়ে শোনাতে হয়।

টুশি পড়তে শুরু করল, “দুর্ধর্ষ ব্যাংক ডাকাত ছলিম গ্রেফতার। গতকাল দুপুরবেলা মতিঝিলে ব্যাংক ডাকাতি করতে গিয়ে ছলিম নামে একজন দুর্ধর্ষ ব্যাংক ডাকাত ধরা পড়েছে। খবরে প্রকাশ অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে সে প্রায় এগারো লক্ষ টাকা নিয়ে পলায়ন করার সময় হঠাৎ করে ফুটপাথে আছাড় খেয়ে পড়ে। সে উঠে দৌড়াতে শুরু করার পর আবার আছাড় খেয়ে পড়ে। ব্যাংকের সামনে তার সহযোগীরা গাড়ি নিয়ে প্রস্তুত ছিল এবং মাত্র ত্রিশ থেকে চল্লিশ ফুট স্থান অতিক্রম করতে গিয়ে এই দুর্ধর্ষ ডাকাত ছলিম ক্রমাগত আছাড় খেয়ে পড়তে থাকে এবং তখন পুলিশ এসে তাকে গ্রেফতার করে।

“দুর্ধষ ব্যাংক ডাকাত ছলিম পুলিশের কাছে স্বীকারোক্তি করার সময় জানায় যে তার মনে হচ্ছিল পায়ের ভেতর অন্য কেউ পা প্রবেশ করিয়ে তাকে ফেলে দিচ্ছিল। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায় কেউ সেখানে উপস্থিত ছিল না।

 “সংবাদদাতা একজন ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করার পর ডাক্তার বলেছেন এটি সম্ভবত মাংশপেশি এবং স্নায়ুর একটি দুরারোগ্য রোগ। রোগটি সংক্রামক হতে পারে সন্দেহ করে এই দুর্ধর্ষ ডাকাত ছলিমকে হাজতে আলাদা করে রাখা হয়েছে বলে জানানো হয়।

“পুলিশ সূত্র জানায় এ ব্যাপারে জোর তদন্ত চলছে।”

টুশি পড়া শেষ করে কাবিল কোহকাফীর দিকে তাকাল–কাবিল কোহকাফী তখন দুলে দুলে হাসছে। তৃতীয় কলাটাতে একটা কামড় দিয়ে বলল, “তোমরা যদি ছলিম ডাকাতের অবস্থাটা দেখতে তা হলে হাসতে হাসতে মারা যেতে!”

টুশি বলল, “আচ্ছা কাবিল কোহকাফী, মানুষকে ল্যাং মেরে ফেলে দেওয়া ছাড়া তুমি আর অন্য কিছু করতে পার না?”

“অন্য কী?”

টুশি একটু ইতস্তত করে বলল, “আমরা আরব্য রজনীতে পড়েছি জিনেরা আরও কত কী করতে পারে! আকাশে উড়তে পারে। বড় হতে পারে ছোট হতে পারে। মানুষের ইচ্ছাপূরণ করতে পারে।”

“কে বলেছে পারি না। আমিও পারি।”

 “তা হলে সেগুলো করে দেখাও না কেন?”

 “কী দেখতে চাও?”

 “যেমন মনে করো–” টুশি হঠাৎ ইতস্তত করে থেমে যায়।

তপু বলল, “আমি বু-বুঝেছি আপু কী চায়!”

কাবিল তপুর দিকে তাকাল, “কী চায়?”

“টু-টুশি আপু মনে করে তার চেহারা বেশি ভালো না, সেইজন্যে চেহারাটা সু-সুন্দর করতে চায়!”

কাবিল কোহকাফী হা হা করে হেসে উঠল। টুশি একটু রেগে উঠে বলল, “কী হল, তুমি হাসছ কেন? এইটা কি হাসির ব্যাপার?”

কাবিল মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ এইটা হাসির ব্যাপার। কারণ চেহারার মাঝে ভালো আর খারাপ নাই। মানুষ ভালো হলে চেহারাটা ভালো লাগে, মানুষ খারাপ হলে তার চেহারাটাও খারাপ লাগে।”

টুশি কঠিন মুখ করে বলল, “যাক আর বড় বড় কথা বলতে হবে না। তুমি বলো আমার চেহারা তুমি ভালো করে দিতে পারবে কি না।”

“চেহারার পরিবর্তন তো আমাদের জন্যে ডালভাত। আমরা জিনেরা হচ্ছি এর এক্সপার্ট। ভালো চেহারা খারাপ করে দিতে পারি। ভালো ঠ্যাং লুলা করে দিতে পারি। ভালো চোখ কানা করে দিতে পারি”।

“এইগুলো তো সবাই পারে! তুমি উলটোটা পার কী না বলো। লুলা ঠ্যাং ঠিক করতে পার? কানা চোখ ভালো করতে পার? খারাপ চেহারা ভালো করতে পার?”

কাবিল কোহকাফী মাথা চুলকে বলল, “পারার কথা! তোমরা তো জান জিন হচ্ছে খুব উঁচু পর্যায়ের একটা ব্যাপার। আমাদের অনেক ক্ষমতা!”

“ওহ্!” টুশি অধৈর্য হয়ে বলল, “তুমি সোজাসুজি বলে দাও না–আমার চেহারাটা তুমি ভালো করে দিতে পারবে কি না!”

কাবিল কোহকাফী ইতস্তত করে বলল, “মনে হয় পারব।”

টুশি সরু চোখে তাকিয়ে বলল, “কেন? মনে হয় কেন? তুমি শিওর না কেন?”

“কারণ এইসব কাজকর্মের জন্যে অনেক প্র্যাকটিস করতে হয়। কেউ বেশি পারে, কেউ কম পারে।”

তপু জিজ্ঞেস করল, “তুমি বেশি পার না কম পার?”

“আমি?” কাবিল কোহকাফী একটু ইতস্তত করে বলল, “আমি–মানে আসলে হয়েছে কি-শাহজাদি দুনিয়ার পিছনে ঘুরোঘুরি করে ইয়ে মানে”।

টুশি মাথা নেড়ে বলল, “তার মানে তুমি পার না। তুমি হচ্ছ অপদার্থ জিন। লাফাংরা।”

“লাফাংরা?”

“হ্যাঁ। লাফাংরা মানে হচ্ছে ফালতু।”

কাবিল কোহকাফী রেগে গিয়ে বলল, “আমি মোটেও লাফাংরা না। প্রত্যেক দিন পত্রিকায় আমার উপর খবর বের হয়।”

“সেটাতে তোমার কোনো কেরানি নাই। মানুষ অদৃশ্য হলে এগুলো করতেই পারে। যে-কেউ পারবে। আমি অদৃশ্য হলে আমিও করতে পারব।” টুশি মুখ শক্ত করে বলল, “যদি পার তা হলে আমার চেহারাটা ঠিক করে দাও।”

কাবিল কোহকাফী টেবিলে থাবা দিয়ে বলল, “ঠিক আছে! আমি যদি জিনের বাচ্চা জিন হই, কোহকাফ নগরের আগুন দিয়ে যদি আমার শরীর তৈরি হয়ে থাকে তা হলে এক সপ্তাহের মাঝে তোমার চেহারাকে আমি আগুনের খাপরার মতো সুন্দর করে দেব!”

তপু জিজ্ঞেস করল, “আ-আগুনের খাপরা?”

“হ্যাঁ। তোমার গায়ের রং হবে বেদানার মতো, ভুরু হবে ধনুকের মতো, চোখ। হবে ভ্রমরের মতো, দাঁত হবে মুক্তার মতো–”

টুশি লজ্জা পেয়ে বলল, “এত কিছুর দরকার নাই। শুধু দেখে যেন কেউ নাক না সিঁটকায়, তা হলেই হবে।”

তপু জিজ্ঞেস করল, “তু-তুমি কেমন করে করবে?”

“একটা জিন জীবনে কমপক্ষে একটা জাদু করতে পারে। আমি সেই জাদুটা করব!”

“কীভাবে ক-করবে?”

“আসল সোলেমানি জাদু নামে একটা বই আছে। দুই হাজার বছর আগের বই। সেই বইটা যোগাড় করতে হবে। সেইখানে জিনদের সব জাদুর কথা লেখা আছে।”

“কী কী জাদু আছে সেখানে?”

“সবরকম জাদু। মানুষকে কীভাবে টিকটিকি বানাতে হয়। লোহাকে কীভাবে সোনা বানাতে হয়। আকাশে কীভাবে উড়তে হয়। অত্যাচারী রাজাকে কীভাবে শাস্তি দিতে হয়। সবকিছু আছে।”

“কীভাবে অ-অদৃশ্য হতে হয় সে-সেটা লেখা আছে?”

কাবিল কোহকাফী মাথা চুলকে বিমর্ষ হয়ে বলল, “সেটা মনে হয় নাই।”

“কেন নাই?”

“কারণ এইটা অনেক বড় জাদু। সবাই পারে না।”

টুশি জিজ্ঞেস করল, “তা হলে তুমি অদৃশ্য হয়ে আছ কেমন করে?”

“আমাকে অনেক বড় জাদুকর বাণ মেরে অদৃশ্য করে রেখেছে। শাহজাদি দুনিয়ার নানি ছিল আসল ডাইনি বুড়ি। শাহজাদি দুনিয়া যখন ট্রিক্স করে আমাকে বোতলের মাঝে ভরে দিল–সেই ডাইনি বুড়ি তখন বোতলের মুখ লাগিয়ে বাণ মেরে দিয়েছে!”

“তা হলে তোমাকে কখনও কেউ দেখবে না?”

কাবিল কোহকাফী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “কেউ যদি সেই বাণ ছুটাতে পারে তা হলে দেখবে।”

টুশি জিজ্ঞেস করল, “সেই বাণ কেমন করে ছোটাবে?”

 “ডাইনি বুড়ি সেটা জানি কোথায় লিখে রেখেছে।”

“কোথায়?”

“সেটা তো জানি না। শাহজাদি দুনিয়া অনেক অনুরোধ করল তখন মন্ত্রটা লিখে দিল।”

তপু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “তা-তা হলে তোমাকে আর কেউ কখনও দে-দেখবে না?”

কাবিল কোহকাফী মুখ কালো করে বলল, “নাহ্।”

টুশি জিজ্ঞেস করল, “তা হলে আমরা দুইজন কেমন করে দেখি?”

কাবিল কোহকাফী মাথা চুলকে বলল, “সেইটা আমি জানি না। মনে হয় আমি যখন বোতল থেকে বের হই তখন সেই ধোঁয়া তোমাদের নাকে গেছে। মনে হয় সেই ধোঁয়া যাদের নাকে যায় তারা দেখতে পায়?”

যুক্তিটা টুশির খুব বিশ্বাসযোগ্য মনে হল না, কিন্তু সে সেটা নিয়ে আপত্তিও করল না।

তপু কথা বলতে বলতে জানালার কাছে গিয়ে বাইরে তাকিয়ে কিছু-একটা দেখে ভালো করে দেখার জন্যে পরদা তুলে তাকাল। টুশি জিজ্ঞেস করল, “কী দেখিস?”

 “একটা মা-মাইক্রোবাস।”

“মাইক্রোবাসে দেখার কী আছে?”

 “না, কেমন জানি স-সন্দেহ হচ্ছে।”

“কী সন্দেহ?”

“কয়েকবার এদিক ঘু-ঘুরেছে। এখন রাস্তার পা-পা-পাশে দাঁড়িয়ে আছে! প পরদা দিয়ে ঢাকা। ভেতরে কে দে-দে-দেখা যায় না।”

টুশি হাত দিয়ে ব্যাপারটা উড়িয়ে দিয়ে বলল, “ধুর! ঢাকা শহরে কয় হাজার মাইক্রোবাস আছে তুই জানিস?”

টুশির কথা সত্যি। ঢাকা শহরে আসলেই কয়েক হাজার মাইক্রোবাস আছে। তবে এটি ছিল একটি বিশেষ মাইক্রোবাস। এর ভিতরে মন্তাজ ওস্তাদ, কালাচান। আর দবির মিয়া ছাড়াও আরও দুইজন মানুষ ছিল। শুধু মানুষ নয়, টুশিদের বাসাটাকে চোখে-চোখে রাখার জন্যে এই মাইক্রোবাসটা যন্ত্রপাতিতে বোঝাই করা ছিল। জানালার কাছে দাঁড়িয়ে তপু জানতেও পারল না দামি ভিডিও ক্যামেরা দিয়ে ঠিক সেই মুহূর্তে তার ভিডিও করে কম্পিউটারে সেটা বিশ্লেষণ করা শুরু করে দেয়া হয়েছে!

পরদিন যে-খবরটি কাবিল কোহকাফীকে পড়ে শোনাতে হল সেটি ছিল এরকম :

নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা

“গতকাল মতিঝিলের একটি ব্যস্ত সড়কে একটি শিশু নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে অলৌকিকভাবে রক্ষা পেয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছে জানা যায় যে একটি শিশু হঠাৎ করে রাস্তা পার হওয়ার জন্যে দৌড় দিয়ে একটি চলন্ত ট্রাকের সামনে পড়ে যায়। ট্রাক ড্রাইভার তার চলন্ত ট্রাক থামাতে সক্ষম না হলেও শিশুটি সম্পূর্ণ অলৌকিকভাবে ট্রাকের তলা থেকে রাস্তার একপাশে চলে আসে। শিশুটি জানায় তার মনে হয়েছে যে কোনো-একজন মানুষ তাকে টেনে রাস্তা থেকে সরিয়ে এনেছে যদিও প্রত্যক্ষদর্শীরা সেখানে কোনো মানুষ দেখে নি।

এই অলৌকিক ঘটনার পর শিশুটি “পিচ্চি পীর” নামে পরিচিত হয়েছে এবং স্থানীয় মানুষেরা তার থেকে পানি পড়া নেয়ার জন্যে ভিড় জমাচ্ছে। শিশুটির পিতা তার সন্তানের জন্যে একটি খানকায়ে শরিফ স্থাপনের জন্যে ওয়ার্ড কমিশনারের কাছে আবেদন করেছেন।”

.

এর পরের দিন যে-খবরটি কাবিল কোহকাফীকে পড়ে শোনাতে হল সেটি এরকম :

পুলিশ সার্জেন্ট নাজেহাল

“গতকাল মহাখালি এলাকায় একজন পুলিশ সার্জেন্টকে অত্যন্ত বিচিত্র উপায়ে নাজেহাল হতে দেখা গেছে। খবরে প্রকাশ এই পুলিশ সার্জেন্ট একটি চলমান ট্রাককে থামিয়ে প্রকাশ্যে ট্রাক ড্রাইভারের নিকট থেকে উৎকোচ গ্রহণ করে। ট্রাকটি চলে যাবার পর পুলিশ সার্জেন্ট সরে যাওয়ার চেষ্টা করে রাস্তার উপর পড়ে যায়। সে কিছুতেই হাঁটতে পারছিল না এবং তাকে ঘিরে একটি ভিড় জমে যায়।

পুলিশ সার্জেন্টকে ধরাধরি করে রাস্তার পাশে নিয়ে যাবার পর দেখা যায় তার জুতোর দুটি ফিতা গিঁট দিয়ে বেঁধে রাখার কারণে সে হাঁটতে পারছিল না।

কে কীভাবে তার জুতোর ফিতায় গিঁট দিয়েছে সেটি এখনও রহস্যাবৃত তবে ঘটনাটি এই এলাকায় কৌতুকের সৃষ্টি করেছে।”

.

এর পরের দিন কাবিল কোহকাফীকে যে খবরটি পড়ে শোনানো হচ্ছিল, সেটি এরকম :

স্কুলছাত্রীর সাহসিকতা

স্কুলছাত্রীকে উত্যক্ত করার কারণে কীভাবে সে কিছু বখাটে ছাত্রকে তুলোধুনা করেছে সেই খবরটি যখন মাত্র পড়তে শুরু করেছে ঠিক তখন টুশি শুনতে পেল কে যেন দরজা খুলে ঘরে ঢুকেছে।

টুশি এবং তপু মাথা ঘুরিয়ে তাকিয়ে হতবাক হয়ে যায়। দরজায় মন্তাজ ওস্তাদ, কালাচান এবং দবির মিয়া। মন্তাজ ওস্তাদের হাতে একটা রিভলবার, দবির মিয়ার হাতে একটা কাটা রাইফেল এবং কালাচান একটা বড় বস্তা ধরে রেখেছে। টুশি কয়েক সেকেন্ড কোনো কথা বলতে পারল না, হাঁ করে এই তিন মূর্তির দিকে তাকিয়ে রইল। তপু বলল, “ততা-তো-তোমরা? পু-পুলিশ ছেড়ে দিয়েছে?”

মন্তাজ ওস্তাদ বলল, “না, ছাড়ে নাই।”

 “তা হলে?”

“তোমার বাবা খুব বুদ্ধিমান মানুষ। তাই আমাদেরকে পুলিশে দেয় নাই। পুলিশের সাথে আমাদের খুব খাতির, পুলিশ আমাদের কখনও ধরে না।”

টুশি চোখের কোনা দিয়ে একবার কাবিলকে দেখল, কাবিল কোহকাফী যতক্ষণ ঘরে আছে তাদের কোনো ভয় নেই। সে চোখ পাকিয়ে বলল, “তোমরা কেন বাসায় এসেছ? এক্ষুনি বের হয়ে যাও।”

মন্তাজ ওস্তাদ চোখ টিপে বলল, “না গেলে কী করবে খুকি?”

“আগেরবার তো মাত্র একটা দাঁত ভাঙা হয়েছিল–এবার সবগুলো দাঁত ভেঙে দেয়া হবে।”

মন্তাজ ওস্তাদ এগিয়ে এসে খপ করে টুশির ঘাড় ধরে নিজের কাছে টেনে এনে তার মাথার কাছে রিভলবারটা ধরে বলল, “বেয়াদপ মেয়ে, বড়দের সাথে কেমন করে কথা বলতে হয় কেউ শেখায় নি?”

টুশি নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করল কিন্তু পারল না। ততক্ষণে কালাচান তার বস্তা নিয়ে চলে এসেছে। বস্তা খুলতেই টুশি দেখল তার ভেতরে মুড়ি। এক বস্তা মুড়ি নিয়ে এই মানুষটি এখানে কেন এসেছে টুশি বুঝতে পারল না। সে অবাক হয়ে। দেখল কালাচান মুড়িগুলো মেঝেতে ঢালতে শুরু করেছে এবং দেখতে দেখতে সারা মেঝে মুড়িতে ঢেকে গেল!

টুশি অবাক হয়ে এই মানুষগুলোর কাজকর্ম দেখছিল–তার মাকে মন্তাজ ওস্তাদ তার মাথার পিছনের চুল ধরে তার মুখটি নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলল,  “বেয়াদপ মেয়ে–তোমার এই কালা কুচ্ছিৎ চেহারা নিয়ে তো তোমার মনে খুব দুঃখ। আমি কী করব জান?”

টুশি অবাক হয়ে মন্তাজ ওস্তাদের দিকে তাকাল–সে কেমন করে জানে যে চেহারা নিয়ে তার মনে দুঃখ? মন্তাজ ওস্তাদ তার ফোকলা দাঁত দিয়ে পিচিক করে একটু থুতু ফেলে বলল, “আমি এখন রিভলবারের বাঁট দিয়ে তোমার নাকটা ভেঙে ফেলব। তোমার কুৎসিত চেহারা তখন আরও কুৎসিত হয়ে যাবে!”

টুশি ঝটকা মেরে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে বলল, “ছাড়ো আমাকে ছাড়ো বলছি।”

মন্তাজ ওস্তাদ বলল, “এত ব্যস্ত হচ্ছ কেন? তোমাকে রেডি হওয়ার একটু সময় দিচ্ছি। আমি বলব ওয়ান টু থ্রি তারপর মারব তোমার নাকে। ঠিক আছে

টুশি নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার প্রাণপণ চেষ্টা করতে থাকে কিন্তু মানুষটার হাত লোহার মতো শক্ত, কিছুতেই নিজেকে ছাড়াতে পারে না। মন্তাজ ওস্তাদ বলল, “ওয়ান।”

কাবিল কোহকাফী এতক্ষণ চুপ করে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে ছিল, এবারে সে টুশিকে বাঁচানোর জন্যে এগিয়ে এল। ঠিক তখন হঠাৎ করে টুশি মুড়ির রহস্য বুঝতে পারল। এই মানুষগুলো কাবিলকে দেখতে পায় না কিন্তু হাঁটার সময় মুড়িতে পা দিলে তার পায়ের চাপে মুড়িগুলো গুঁড়ো হয়ে যায় তারা সেই গুঁড়ো হয়ে যাওয়া মুড়ি দেখে বুঝতে পারে কাবিল কোথায় আছে। তিনজন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মেঝের দিকে তাকিয়ে ছিল এবং কাবিল ঠিক কোনদিক দিয়ে টুশির কাছে এগিয়ে আসছে বুঝতে পারল। টুশি সাবধান করার জন্যে চিৎকার করে বলল, “না–কাবিল না–”

কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে। কালাচান এবং দবির মিয়া হঠাৎ করে একসাথে কোথা থেকে দুটি রঙের ক্যান বের করে আনে, কিছু বোঝার আগে তারা নিখুঁতভাবে কাবিলের দিকে লক্ষ্য করে সেই রঙের ক্যানে চাপ দিয়ে রং স্প্রে করে দেয়। টুশি অবাক হয়ে দেখল মুহর্তে কাবিলের সারা মুখ হাত-পা স্প্রে ক্যানের রঙে। মাখামাখি হয়ে গেল। সাথে সাথে মন্তাজ ওস্তাদ টুশিকে ধাক্কা দিয়ে রিভলবারটা কাবিলের দিকে ধরে বলল, “কাবিল কোহকাফী, তুমি মানুষটা অদৃশ্য হতে পার– কিন্তু তোমার চোখে-মুখে হাতে যে রং লেগেছে সেটা আমরা দেখছি! একটু নড়লেই তোমাকে আমি গুলি করব।”

কাবিল তার পরেও নড়ার চেষ্টা করল কিন্তু ততক্ষণে কালাচান এবং দবির মিয়া দুইপাশ থেকে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে।

টুশি এবং তপু গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে থাকে কিন্তু তার ভিতরে তিনজন মিলে কাবিল কোহকাফীকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলল।

টুশি খোলা দরজা দিয়ে বাইরে ছুটে যেতে চাইছিল কিন্তু দবির মিয়া তাকে ধরে ফেলল। কিছু বোঝার আগে তপু এবং টুশি এই দুজনকেও দুটি চেয়ারে বেঁধে ওদের মুখে মন্তাজ ওস্তাদ সার্জিক্যাল টেপ লাগিয়ে দিল। ঘরের হুটোপুটি শুনে বাইরে কেউ এসেছে কি না সেটা সাবধানে পরীক্ষা করে, পকেট থেকে অ্যালকোহলের বোতল বের করে তুলো দিয়ে ভিজিয়ে কাবিল কোহকাফীর চোখ মুখের সব রং মুছে নেয়। তাকে পুরোপুরি অদৃশ্য করে মানুষ তিনজন যেভাবে এসেছিল সেভাবে এবারে নিঃশব্দে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।

.

সন্ধেবেলা চাচা-চাচি বাসায় এসে আবিষ্কার করলেন ঘর-বোঝাই মুড়ি এবং তার মাঝে টুশি এবং তপু চেয়ারে বাঁধা। তারা ছুটে এসে তাদের খুলে দিয়ে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস জিজ্ঞেস করলেন, “কী হয়েছে?”

টুশি কিছু বলল না। তপু কঠিন মুখে তার বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমার বন্ধুরা এসেছিল আব্দু।”

চাচা অবাক হয়ে বললেন, “আমার বন্ধুরা?”

“হ্যাঁ। সেদিন যে তিনজনকে আমরা ধরেছিলাম তারা আজকে আবার এসেছে। বলেছে তারা তোমার বন্ধু।”

চাচার মুখ হাঁ হয়ে গেল, তোতলাতে তোতলাতে বললেন, “ম-ম-মন্তাজ ওস্তাদ?”

তপু এতটুকু তোতলাল না, বলল, “হ্যাঁ। তারা বলেছে তুমি তাদেরকে পুলিশে দেও নাই।”

চাচা তোতলাতে তোতলাতে বললেন, “কে-কে-কেন এসেছিল?”

তপু বলল, “আমাকে কেন জিজ্ঞেস করছ? তোমার বন্ধুদের তুমি কেন জিজ্ঞেস কর না?”

টুশি অবাক হয়ে তপুর দিকে তাকিয়ে রইল, তার কথায় তোতলামির কোনো চিহ্ন নেই।

চাচা কিছু-একটা বলার চেষ্টা করছেন–কিন্তু ঠিক বলতে পারছেন না, টুশি সেটা শোনার চেষ্টাও করছে না।

তার শুধু কাবিল কোহকাফীর কথা মনে পড়ছে। কোথায় আছে কাবিল কোহকাফী? কেমন আছে কাবিল কোহকাফী?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *