৬. কোহকাফী এবং চাচা-চাচি

. কোহকাফী এবং চাচাচাচি

টুশি এবং তপু কী হয় দেখার জন্যে চোখ বিস্ফারিত করে তাকিয়ে রইল। তারা দেখল চাচা সোজা কাবিল কোহকাফীর দিকে এগিয়ে গিয়ে তার সাথে ধাক্কা খেলেন, ধাক্কা খেয়ে কাবিল কোহকাফি এবং চাচা দুইজন দুইদিকে উলটে পড়লেন এবং দুইজনেই যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠলেন। চাচি চাচাকে ধরে টেনে তুলতে তুলতে বললেন, “কী হয়েছে? কী হয়েছে তোমার?”

চাচা ভয়-পাওয়া ফ্যাকাশে মুখে বললেন, “বুঝতে পারলাম না, হঠাৎ মনে হল কোথায় যেন ধাক্কা খেলাম”

“ধাক্কা খেলে?” চাচি গলা উঁচু করে বললেন, “ফাঁকা ঘরে তুমি কেথায় ধাক্কা খাবে?”

তারা দুজনেই সামনের দিকে তাকায়, টুশি এবং তপু অবাক হয়ে দেখল তাদের দৃষ্টি কাবিল কোহকাফীর উপর দিয়ে ঘুরে সারা ঘর হয়ে ফিরে এল কিন্তু তারা কাবিল কোহকাফীকে দেখতে পেলেন না। কী আশ্চর্য! শুধু তাই না, কাবিল কোহকাফী চাচার সাথে ধাক্কা খেয়ে যে ছিটকে পড়ে যন্ত্রণায় কো কো করে শব্দ করছে সেটাও তাঁরা শুনতে পাচ্ছেন না। তপু কিছু-একটা বলতে যাচ্ছিল, টুশি তার হাতে চাপ দিয়ে তাকে থামিয়ে দিল–ব্যাপারটা বোঝা দরকার।

চাচা ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে কাবিল কোহকাফীর একেবারে গা ঘেঁষে এগিয়ে গেলেন কিন্তু তবু তাকে দেখতে পেলেন না। চাচা একটা চেয়ারে বসে কেমন যেন ভয় পেয়ে চারদিকে তাকাতে লাগলেন। চাচি কঠিন মুখে বললেন, “এখন কেমন লাগছে?”

“কেমনে আবার লাগবে। আমি বলছি কী-একটার সাথে যেন ধাক্কা খেলাম”

 “তুমি কোথাও ধাক্কা খাও নাই। তুমি হঠাৎ করে কলাপস করেছ। আমি একশবার করে বলছি খাওয়া কমাও খাওয়া কমাও–তুমি আমার কথা শোন না।” চাচি যখন চাচাকে গালাগাল শুরু করেন সেটা সাধারণত খুব ভয়ংকর ব্যাপার হয়, এবারেও তা-ই হল। চাচি তার খনখনে গলায় বলতে লাগলেন, “খেয়ে খেয়ে খাসির মতো মোটা হয়েছ, ব্লাডপ্রেশার হয়েছে, কোলেস্টেরল হয়েছে, এখন নিশ্চয়ই হার্ট এটাক হয়েছে। নিশ্চয় তুমি হার্ট এটাক হয়ে পড়ে গেছ।”

চাচা দুর্বল গলায় বললেন, “না। আমার হার্ট এটাক হয় নাই।”

“তা হলে কি স্ট্রোক করেছে?”

চাচা বিরক্ত হয়ে বললেন, “স্ট্রোক করবে কেন? তোমার সবকিছু নিয়ে বাড়াবাড়ি।”

চাচি চোখ-মুখ লাল করে বললেন, “আমার সবকিছু নিয়ে বাড়াবাড়ি? তুমি হাঁটতে হাঁটতে আছাড় খেয়ে পড়ে যাও আর সেটা নিয়ে কথা বললে আমার বাড়াবাড়ি হয়?”

চাচা কিছু না বলে তাঁর পেটে হাত বুলাতে বুলাতে চারিদিকে তাকাতে লাগলেন।

টুশি আর তপু দেখতে পেল কাবিল কোহকাফী উঠে এসে তাদের একেবারে কাছে এসে চাচা-চাচির ঝগড়া দেখতে দেখতে আনন্দে হাসতে লাগল। তারপর টুশির দিকে তাকিয়ে বলল, “এখন বিশ্বাস হল যে আমি জিন? দেখছ এরা আমাকে দেখতে পাচ্ছে না? আমার কথাও শুনতে পাচ্ছে না?”

সত্যি সত্যি চাচা-চাচি কাবিল কোহকাফীকে দেখতে পেলেন না, শুনতেও পেলেন না–দুজনে নিজেদের মতো ঝগড়া করতে লাগলেন। কাবিল কোহকাফী বুকে থাবা দিয়ে বলল, “বিশ্বাস হল আমি জিন?”

টুশি কিছু বলল না, তপু মাথা নেড়ে বলল, “বি-বিশ্বাস হয়েছে।”

চাচা এবং চাচি তপুর কথা শুনে তার দিকে ঘুরে তাকালেন, বললেন, “কী বললি? কী বিশ্বাস হয়েছে?”

তবু একেবারে থতমত খেয়ে গেল, এমনিতেই তার কথায় একটু তোতলামো এসে যায় এখন একেবারে বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে গেল, বলল, “না-না-না– মা মা-মা–জি-জি-জি–”

টুশি তাকে রক্ষা করল, বলল, “না চাচি কিছু না। আমি বলেছিলাম আপনারা সকালবেলাতেই চলে আসবেন, তপু আমার কথা বিশ্বাস করে নাই। এখন জিজ্ঞেস করছিলাম আমার কথা বিশ্বাস হয়েছে কি না–তাই বলছিল বিশ্বাস হয়েছে। তা ই না রে তপু?”

তপু বিপদ থেকে উদ্ধার পেয়ে খুব জোরে জোরে মাথা নাড়ল। চাচি এবারে চাচার পাশে একটা চেয়ারে বসে দুজনের দিকে প্রথমবার ভালো করে তাকালেন। বেশ চেষ্টা করে গলাটা একটু নরম করে বললেন, “রাত্রিবলা একা একা থাকতে ভয় করেছিল?”।

কাবিল কোহকাফী বলল, “ভয় করবে কেন? আমি ছিলাম না!”

চাচা-চাচি অবশ্যি কাবিল কোহকাফীর কথা শুনতে পেলেন না, টুশি মাথা নেড়ে বললেন, “না চাচি ভয় করে নাই।”

“রাত্রে কী খেয়েছিলে তোমরা?”

 “খিচুড়ি বেঁধে নিয়েছিলাম। আর ডিম ভাজা।”

কাবিল কোহকাফী বলল, “ফাস্ট ক্লাস রান্না হয়েছিল!” চাচা-চাচি সেটা শুনলেন না। চাচি বললেন, “ভেরি গুড। আই অ্যাম সরি, হঠাৎ করে আটকা পড়ে গেলাম তাই আসতে পারলাম না।”

টুশি সাহস করে জিজ্ঞেস করল, “কোথায় আটকা পড়েছিলেন?”

“মায়ের বাসায়। তপুর নানির শরীরটা ভালো না তো।”

“কী হয়েছে?”

 “বয়স হয়েছে তো তাই। মাথায় একটু গোলমালের মতো হয়েছে।”

তপু অবাক হয়ে বলল, “না-না-নানি পা-পাগল হয়ে গেছে?”

 চাচি অস্বস্তি নিয়ে বললেন, “না, ঠিক পাগল না তবে

চাচা ভেংচে বললেন, “বুড়ির ভিমরতি হয়েছে। এত বড় প্রপার্টি এতিমখানায় দান করে দেবে। ঢং দেখে বাঁচি না!”

চাচার কথা শুনে কাবিল কোহকাফী দুই পা এগিয়ে এসে বলল, তাতে অসুবিধে কী হয়েছে? একজন মানুষ তার প্রপার্টি দান করতে পারে না?”

চাচা সেই কথা শুনতে পেলেন না, গজগজ করে বললেন, “এতগুলো মানুষ মিলে বোঝালাম, বুড়ি তবু বোঝে না।”

চাচি বললেন, “থাক থাক, বাচ্চাদের সামনে এইসব কথা বলে লাভ নেই।”

কাবিল বুকে থাবা দিয়ে বলল, “আমার সামনে বলো। আমি বাচ্চা না। আমার বয়স এক হাজার দুইশ বাইশ।”

চাচা তার কথা শুনলেন না তাই কিছু বললেন না, কিন্তু কাবিল তাতে শান্ত হল না, সে টেবিলের মাঝখানে একটা থাবা দিয়ে বলল, “কী হল? কথা কানে যায় না?”

চাচা এবং চাচি কাবিলের কথা শুনতে পেলেন না, কিন্তু টেবিলের থাবাটা ঠিকই শুনতে পেলেন, চাচা চমকে উঠে বললেন, “কী হল? টেবিলটা এভাবে শব্দ করে কেঁপে উঠল কেন?”

চাচিও অবাক হয়ে টেবিলটার দিকে তাকালেন, কাঁধ ঝাঁকুনি দিয়ে বললেন, “কী জানি!”

টুশি এবারে চেষ্টা করে কাবিল কোহকাফীর চোখের দিকে তাকিয়ে চোখের ইশারায় তাকে পাগলামো করতে নিষেধ করল। কাবিল কোহকাফী চোখ মটকে বলল, “এখন কেমন জব্দ হয়েছ বাছাধন? একটু আগে যে আমাকে বাসা থেকে বের করে দিচ্ছিলে–এখন কেমন জব্দ হয়েছ? তোমার চাচা-চাচিকে আরেকটু শিক্ষা দেব? দেব নাকি?”

টুশি ভয়ে ভয়ে মাথা নেড়ে নিষেধ করল। কাবিল কোহকাফী চোখ পাকিয়ে বলল, “আর আমার সাথে বেয়াদপি করবে? করবে বেয়াদপি?”

টুশি তার চাচা-চাচির দৃষ্টি এড়িয়ে মাথা নেড়ে জানাল যে আর বেয়াদপি করবে না।

“মনে থাকে যেন। আমি হচ্ছি কাবিল বিন মুগাবালি মাহিন্দর কোহকাফী। শাহজাদি দুনিয়া আমার জন্যে পাগল ছিল। আমি আসল সোলেমানি জাদু জানি ইচ্ছা করলে মন্ত্র পড়ে সবাইকে টিকটিকি বানিয়ে দিতে পারি। আমার সাথে বেয়াদপি করলে খবর আছে! আর আমাকে বাসা থেকে বের করে দেবে?”

টুশি এবং তপু মাথা নাড়ল–এবারে চাচা-চাচির দৃষ্টি এড়াতে পারল না। চাচি ভুরু কুঁচকে বললেন, “এরকম বোকার মতো মাথা নাড়ছ কেন?”

টুশি ঢোক গিলে বলল, “না-মানে ইয়ে–”।

চাচি এবারে বাসার চারদিকে চোখ বুলিয়ে বললেন, “বাসার এই অবস্থা কেন? মনে হচ্ছে বাসার মাঝে ঝড় হয়ে গেছে। যাও–বাসাটা পরিষ্কার করো!”

টুশি এবং তপু চাচা-চাচির সামনে থেকে সরে গেল। টুশি আর তপু বসার ঘরে বইগুলো শেলফে তুলে টেবিল-ল্যাম্পটাকে সোজা করল, টেবিলটাকে ঠিক জায়গায় রেখে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ম্যাগাজিনকে টেবিলে সাজিয়ে রাখতে লাগল। তখন কাবিল কোহকাফী তাদের ঘরে এসে দাঁড়াল। টুশি ফিসফিস করে বলল, “ঘরটাকে তুমি এই অবস্থা করেছ। তুমি কেন পরিষ্কার করছ না!”

“আমি একটা সম্মানী জিন। আমি ঝাড় দার না।”

 “বেশি ঢং করলে চাচা-চাচিকে বলে দেব তোমার কথা!”

কাবিল কোহকাফী মুখ ভেংচে বলল, “বলে দেবে আমার কথা? বলে দাও তা হলে–তারা তোমার কথা বিশ্বাস করবে? তুমি প্রমাণ করতে পারবে যে আমি আসলেই আছি?”

টুশি মাথা চুলকাল, কাবিল কোহকাফী সত্যি কথাই বলেছে। অদৃশ্য কিছুর সাথে ধাক্কা খেয়ে তারা একটু অবাক হতে পারে কিন্তু এইখানে একটা অদৃশ্য জিন ঘুরে বেড়াচ্ছে সেটা কখনওই কেউ বিশ্বাস করবে না। জোর করে বললে উলটো ব্যাপার হতে পারে–ভাবতে পারে তাদের মাথা খারাপ হয়ে গেছে। টুশি বলল, “ঠিক আছে, ঠিক আছে, তোমার কথা কাউকে বলব না। তুমি থাকো। কিন্তু বেশি চিৎকার কোরো না–বেশি লাফঝাঁপ দিও না। বুঝেছ?”

“পুঁচকে মেয়ে, তোমার আমাকে উপদেশ দিতে হবে না। আমি একজন জ্ঞানী জিন। কখন কী করতে হয় আমি জানি। ক্রিটিক্যাল সময়ে আমি রাইট ডিসিশন নিতে পারি। খলিফা হারুন অর রশিদের সময়ে যখন–”

ঠিক তখন তারা শুনতে পেল তপুর আব্বা তার মোটা শরীর নিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে বাথরুম থেকে বের হয়ে আসছেন, চিৎকার করে বলছেন, “শায়লা, শায়লা দেখে যাও বাথরুমে!”

“কী হয়েছে?”

“বাথরুমে কাটা লম্বা চুলদাড়ি, জরিদার পোশাক–”

টুশি কাবিল কোহকাফীর দিকে তাকাল, ফিসফিস করে বলল, “ক্রিটিক্যাল সময়। রাইট ডিসিশন নাও দেখি!”

কাবিল মাথা চুলকাল, “সর্বনাশ! এখন কী হবে?” তপু বলল, “তো-তোমাকে কেউ দেখে না! তু-তুমি যাও–ওগুলো লুকিয়ে ফেলো। দৌড়াও।”

তপুর কথা শেষ হবার আগেই কাবিল কোহকাফী বাথরুমে ছুটে গেল, চোখের পলকে তার জরিদার পোশাকে কাটা চুলদাড়ি সবকিছু চেঁছে পুছে সরিয়ে নিয়ে চলে এল। কয়েক মুহূর্ত পরে চাচিকে চাচা বাথরুমে নিয়ে গেলেন, সেখানে কী হয় দেখার জন্যে টুশি এবং তপু এবং কাবিল কোহকাফীও হাজির হল। বাথরুমের দরজা খুলে চাচি বাথরুমের ভিতরে চারিদিকে তাকিয়ে বললেন, “কোথায়?”

চাচার মুখ হাঁ হয়ে গেল। চারদিকে তাকিয়ে আমতা-আমতা করে বললেন, “এ-এ-এইখানে ছিল!”

“কী ছিল?”

 “জরিদার পোশাক। এই লম্বা লম্বা কাটা চুলদাড়ি–”

চাচি চোখ ছোট ছোট করে চাচার দিকে তাকিয়ে রইলেন। চাচা ফ্যাকাশে মুখে বললেন, “কী হল? তুমি আমার দিকে এভাবে তাকিয়ে আছ কেন?”

চাচি কেমন জানি ঠাণ্ডা গলায় বললেন, “তোমার শরীর ভালো আছে ইমতিয়াজ?”

চাচা কেমন জানি রেগে উঠলেন, বললেন, “আমার শরীর ভালো থাকবে না কেন? তুমি ভাবছ আমি মিথ্যা কথা বলছি? আমি আসলে দেখি নাই?”

চাচি বললেন, “এই বাথরুমে তাকাও। কোথাও কিছু আছে?”

“না নাই। কিন্তু বিশ্বাস করো আমি স্পষ্ট দেখেছি।”

“আমি তোমার কথা বিশ্বাস করেছি, সেইজন্যেই বলছি।”

 “কী বলছ?”—

 “তুমি বিছানায় শুয়ে থাকো। আমি আইসব্যাগটা নিয়ে আসি।”

 চাচা মুখ শক্ত করে বললেন, “কেন?”

“তোমার মাথায় দিতে হবে। তোমার নিশ্চয়ই হেলুসিনেশান হচ্ছে। তুমি বিছানায় শুয়ে থাকো। তুমি উলটাপালটা জিনিস দেখছ। এটা ভালো লক্ষণ না।”

“কোনটা ভালো লক্ষণ না?”

“প্রথমে এমনিতে আছাড় খেয়ে পড়ে গেলে, এখন অদ্ভুত অদ্ভুত জিনিস দেখছ।”

“আমি কোনো অদ্ভুত জিনিস দেখি নাই।” চাচা চিৎকার করে বললেন, “আমি যেটা দেখেছি সেটাই বলেছি।”

চাচি চাচাকে জোর করে বিছানায় শুইয়ে দিলেন–এক হাজার বছর গোসল না করা কাবিল কোহকাফী এই বিছানায় ঘুমিয়েছে তাই চাদরে বালিশে একটা বোটকা গন্ধ। চাচা দুর্বল গলায় বললেন, “কেমন জানি গন্ধ গন্ধ লাগছে।”

চাচি বললেন, “সব তোমার মনের ভুল। তুমি চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকো।” চাচা চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইলেন।

.

দুপুরে খাবার টেবিলে খাওয়া শুরু করার কিছুক্ষণের মাঝেই চাচি হঠাৎ করে অবাক হয়ে লক্ষ্য করলেন টেবিলে রাখা সব খাবার শেষ হয়ে গেছে। চাচি ভুরু কুঁচকে চাচার দিকে তাকিয়ে বললেন, “ডাক্তাররা না বলেছ তুমি কম করে খাবে!”

চাচা মুখ কালো করে বললেন, “আমি কম করেই খাচ্ছি।”

“কম করে খাচ্ছ? সারা সপ্তাহের জন্যে রান্না করেছি তুমি একা সাবাড় করে দিয়েছ।”

চাচা রেগে উঠে বললেন, “আমি কখন খেয়েছি? একটু মুখে দিয়েছি না কি দিই নি”

চাচি টেবিলে রাখা ডেকচি কাত করে দেখিয়ে বললেন, “এই দ্যাখো। দুইটা মুরগি রান্না করেছিলাম, শুধু পাখনার একটা হাড্ডি আছে। তুমি খাওনি তো কে। খেয়েছে?”

টুশি আর তপু শক্ত হয়ে বসে রইল। শুধু তারাই আসল ব্যাপারটি দেখেছে– কাবিল কোহকাফী ঘুরে ঘুরে খাচ্ছে, একটু পরপর টেবিল থেকে খাবার তুলে নিচ্ছে। এক হাজার বছরের অভুক্ত জীনের ক্ষুধা এক দুইদিনে মিটবে বলে মনে হয় না।

চাচি বললেন, “বলো কে খেয়েছে।”

 চাচা রেগে চিৎকার করে বললেন, “তুমি খেয়েছ। তুমি।”

ব্যস–সাথে সাথে দুজনের তুমুল ঝগড়া শুরু হয়ে গেল। ঝগড়াটা একটু জমে ওঠার সাথে সাথে প্রায় নিয়মমাফিক তাদের রাগটা এসে পড়ল তপুর ওপর। চাচা হুংকার দিয়ে বললেন, “কী হল? তুই খাচ্ছিস না কেন?”

তপু বলল, “খা-খা-খাচ্ছি আলু।”

চাচি বললেন, “খবরদার কথা বলবি না, চুপ করে খা।”

তপু কথা বলল না, মাথা নেড়ে চুপচাপ খাবার চেষ্টা করল। কিন্তু তাতে মনে হল চাচির রাগ আরও বেশি হয়ে গেল। চোখ লাল করে বললেন, “কী বলেছি আমি?”

“ব-ব-ব–” ভয় পেয়ে তপুর কথা মুখে আটকে যায়। চাচি তখন আরও হিংস্র হয়ে উঠলেন, চিৎকার করে বললেন, “কী বলেছি আমি?”

তপু অসহায়ভাবে একবার টুশির দিকে তাকিয়ে আবার বলার চেষ্টা করল, “ব ব-ব–বলেছ–খ-খ-খ-” তপুর মুখ লাল হয়ে গেল, ঠিক করে কথা বলার চেষ্টায় তার চোখে পানি এসে যায়, ঠোঁটে কামড় দিয়ে সে প্রাণপণে আবার চেষ্টা করে– “খ-খ-খ “

চাচি চিলের মতো চিৎকার করে বললেন, “কথা বলো ঠিক করে বদমাইশ পাজি ছেলে–”

কাবিল কোহকাফী চাচির দিকে দুই পা এগিয়ে এসে বলল, “এই যে এই যে লেডি, কী করছেন আপনি? দেখছেন না ছেলেটা নার্ভাস–কথা বলতে অসুবিধে হচ্ছে দেখছেন না–”

চাচি কাবিল কোহকাফীকে দেখছেন না, তার কথাও শুনছেন না, ডালের চামুচটা হাতে নিয়ে ওপরে তুলে মারের ভঙ্গি করে আরেকবার গালাগাল করার জন্যে মুখ খুললেন ঠিক তখন কাবিল কোহকাফী চাচির মুখটা দুই হাত দিয়ে চেপে ধরল। চাচি একেবারে হতবাক হয়ে আবিষ্কার করলেন তিনি মুখ খুলতে পারছেন না, কয়েকবার চেষ্টা করে উঁ উঁ উঁ করে একটু শব্দ করে ছটফট করতে লাগলেন। চাচা অবাক হয়ে বললেন, “কী হয়েছে তোমার? কথা বলছ না কেন?”

কাবিল কোহকাফী চাচির মুখটা একটু ফাঁক করে দুই-একটা শব্দ বলতে দিল, “ক-ক-কথা ব-ব-বলতে পারছি না।” কাবিল কোহকাফী আবার শক্ত করে মুখ চেপে ধরল। চাচি মুখ খোলার জন্য প্রাণপন চেষ্টা করতে থাকেন কিন্তু কোনো লাভ হয় না। তার চোখ-মুখ লাল হয়ে, যায় চোখে পানি এসে যায় কিন্তু মুখ থেকে একটি শব্দ বের হয় না।

কাবিল কোহকাফী শেষ পর্যন্ত চাচির মুখ ছেড়ে দিয়ে সরে গেল, হুংকার দিয়ে বলল, “এখন বুঝেছেন কথ না বলতে পারলে কেমন লাগে? বুঝেছেন লেডি?”

চাচি কাবিল কোহকাফীর কথা না শুনতে পারলেও কথা বলতে না পারার কষ্টটা প্রথমবার টের পেলেন। সাবধানে নিজের দুই গালে, চোয়ালে মুখে হাত বুলাতে বুলাতে বললেন, “কী কী সর্বনাশ! ম-ম-মনে হল কেউ মুখ চেপে ধরে রেখেছে কথা বলতে দিচ্ছে না।”

চাচাকে কেন জানি হঠাৎ খুব খুশি মনে হল। দুলে দুলে হেসে বললেন, “এখন বুঝেছ তপু কেন তোতলা হয়েছে?”

“কেন?”

 “ফ্যামিলিগত ব্যাপার। তুমি তোতলা, তোমার ছেলেও তোতলা।”

 “আমি মোটেও তোতলা না।”

 “তা হলে একটু আগে কথা বলতে পারছিলে না কেন?”

“সেটা অন্য ব্যাপার” চাচি আরও কী-একটা বলতে চাইছিলেন কিন্তু তার । আগেই কাবিল কোহকাফী এসে চাচির মুখ শক্ত করে চেপে ধরল। চাচি প্রাণপণে কথা বলতে চাইলেন কিন্তু তাঁর মুখ দিয়ে শুধু উ উ ধরনের একটা শব্দ বের হল, কোনো কথা বের হল না।

চাচা উল্লসিত হয়ে বললেন, “এই দ্যাখো তুমি আবার তোতলাচ্ছ!”

কাবিল কোহকাফী চাচির মুখটাকে ছেড়ে দিয়ে বলল, “মনে থাকে যেন লেডি। এই ছোট ছেলেটাকে আপনি যদি উৎপাত করেন আপনার মুখ আমি চেপে ধরে রাখব। আমাকে চেনেন না–হুঁ! আমি হচ্ছি কাবিল বিন মুগাবালি মহিন্দর কোহকাফী।”

চাচি কিংবা চাচা কেউই কাবিল বিন কোহকাফীর কথা শুনতে পেলেন না, কিন্তু ঠিক করে কথা বলতে না পারার জন্যে ছোট একটা ছেলেকে যে যন্ত্রণা দেয়া যায় না হঠাৎ করে সেই জিনিসটা বুঝে গেলেন।

খাবার টেবিলে সবাই নিঃশব্দে খেতে লাগল। খুব ভালো করে লক্ষ করলে দেখা যেত টুশি এবং তপু চোখের কোনা দিয়ে কাবিল কোহকাফীর দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছে।

বিচিত্র এই জিনটাকে টুশি এবং তপু একসাথে ভালোবেসে ফেলল।