১০. তিন মূর্তি

১০. তিন মূর্তি

চাচি ঘড়ি দেখে চিৎকার করে বললেন, “সর্বনাশ! তিনটা বেজে গেছে!”

টুশি বুঝতে পারল না তিনটা বেজে গেলে সর্বনাশ হবে কেন। তারা স্কুল থেকে আসার পর খাওয়াদাওয়া শেষ করতে করতে মাঝে মাঝেই তিনটা বেজে যায়। চাচি আজকে কেন জানি দেরি করলেন না, বাসা থেকে বের হওয়ার আগে সবসময় যেরকম ড্রেসিং-টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে মুখে একটু কমপ্যাক্ট, চোখে আইলাইনারের ছোঁয়া এবং ঠোঁটে লিপস্টিক দেন, আজকে তাও করলেন না, চুলের মাঝে চিরুনি চালাতে চালাতে বাসা থেকে একরকম দৌড়ে বের হয়ে গেলেন। কী নিয়ে তাঁর এত তাড়াহুড়ো টুশি কিংবা তপু বুঝতে পারল না, তারা সেটা নিয়ে মাথাও ঘামাল না।

নানি ছোট বাচ্চাদের মতো দুই পা সোফায় তুলে গুটিসুটি মেরে বসেছিলেন। টুশি এবং তপু যতক্ষণ স্কুলে থাকে তার সময়টা কাটতে চায় না, বাচ্চা দুটো চলে এলে আর কোনো সমস্যা থাকে না। তার কাছ থেকে গল্প শোনার জন্যে পাগল হয়ে থাকে, তাদের সাথে গল্প করে সময়টা বেশ কেটে যায়। আজকেও তা-ই হচ্ছে, টুশি একটা বাটিতে খানিকটা সরষের তেল এনে নানির পায়ে ডলে ডলে মাখিয়ে দিচ্ছে, তপু মহা উৎসাহে হামানদিস্তায় পান-সুপুরি ঘেঁচে দিচ্ছে। নানির দাঁত নেই বলে একেবারে মিহি হতে হবে সেজন্যে সে একটু পরে পরে আঙুল দিয়ে পরীক্ষা করে দেখছে।

নানি তাঁর ছেলেবেলার গল্প করছেন, বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ি গিয়ে তার কী অবস্থা তার একটা ভয়ংকর বর্ণনা দিচ্ছেন, কিন্তু সেই ভয়ংকর অবস্থার গল্প শুনে দুজনেই হি হি করে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ছে। নানি কপট রাগে চোখ বড় বড় করে বলছেন, “এইটা হাসির কথা হল? আমি মরি দুঃখে আর তোরা সেই গল্প শুনে হাসিস”

এরকম সময়ে দরজায় কলিংবেলের শব্দ হল। থেমে থেমে দুইবার। টুশি এবং তপু একজন আরেকজনের দিকে তাকায়–কাবিল কোহকাফী কি এসেছে? সে ঢাকা শহরে ঘুরে ঘুরে বিচিত্র সব কর্মকাণ্ড করে বেড়াচ্ছে, তার বর্ণনা খবরের কাগজে উঠে আসছে–কখন কী বিপদ হবে কে জানে! টুশি উঠে দরজা খুলতে গেল। কিন্তু দরজা খোলার আগেই সে দেখতে পেল, বাইরে থেকে চাবি দিয়ে দরজা খুলে। ভিতরে তিনজন মানুষ ঢুকে গেছে।

তিনজন মানুষ দেখতে তিন রকম। একজন ছোট এবং শুকনো, চেহারার মাঝে একটা নেংটি ইঁদুরের ভাব। মুখটা ইঁদুরের মতো ছুঁচালো, চোখ দুটো কুতকুতে। তার পিছনে দুইজন মানুষের আকার বিশাল। একজনের মুখটা গোল, গায়ের রং ফরসা, সারা শরীরে মাংস, টাইট একটা টিশার্টের নিচে সেগুলো কিলবিল কিলবিল করছে, মানুষটাকে দেখলেই গণ্ডারের কথা মনে পড়ে। অন্য মানুষটির মাথাটা সরাসরি শরীরের উপর বসিয়ে দেয়া হয়েছে–কোনো গলা নেই। হাত দুটি লম্বা। এবং কেমন জানি সামনের দিকে ঝুঁকে আছে। গায়ের রং কুচকুচে কালো–সব মিলিয়ে একটা গরিলা-গরিলা ভাব। টুশি কয়েক সেকেন্ড অবাক হয়ে হাঁ করে এই বিচিত্র তিন মূর্তির দিকে তাকিয়ে রইল। সে একেবারে একশত ভাগ নিশ্চিত ছিল যে এরা ভুল করে এখানে চলে এসেছে, তার পরেও জিজ্ঞেস করল, “আপনারা। ভিতরে কেমন করে ঢুকেছেন? কাকে চান?”

ইঁদুরের মতো মানুষটা জিজ্ঞেস করল, “এইটা ইমতিয়াজ সাহেবের বাসা না?” মানুষটার গলা ফাটা বাঁশের মতো কর্কশ।

টুশি মাথা নেড়ে বলল, “জি। কিন্তু চাচা বাসায় নাই।”

ইঁদুরের মতো মানুষটা কর্কশ গলায় বলল, “তাতে কোনো অসুবিধা নাই। আমাদের দরকার তার শাশুড়ির সাথে!” এই বলে টুশিকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে তিনজন ভিতরের দিকে রওনা দিল। টুশি এত অবাক হল যে ভয় পাওয়ারও সময় পেল না, গলা উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল, “আপনারা কে? এখানে কী চান?”

ইঁদুরের মতো মানুষটা টুশিকে পুরোপুরি উপেক্ষা করে বলল, “কালাচান দরজাটা বন্ধ কর। দবির মিয়া বুড়িরে খুঁজে বের কর।”

টুশি দেখল কুচকুচে কালো গরিলার মতো মানুষটার নাম দবির মিয়া, সে ঘরের ভিতরে ঢুকে গেল। ফরসা এবং গণ্ডারের মতো মানুষটার নাম নিশ্চয়ই কালাচান, সে দরজা বন্ধ করে বলল, “জে মন্তাজ ওস্তাদ।” তার গলার স্বর মিহি মনে হয় পয়লা বৈশাখে পাঞ্জাবি পরে রমনার বটমূলে রবীন্দ্রসংগীত গাইতে যায়।

টুশি এবার এত রেগে গেল যে অবাক হবার সময় পেল না, চিৎকার করে বলল, “আপনারা কেন এখানে এসেছেন? কেমন করে বাসার ভিতরে ঢুকেছেন? এক্ষুনি বাইরে যান–”

তখন টুশি আবিষ্কার করল, ইঁদুরের মতো মানুষটি যাকে কালাচান মন্তাজ ওস্তাদ বলে ডাকছে, তার হাতের ব্যাগ খুলে সেখান থেকে একটা বেঁটে রিভলবার বের করছে। টুশি তখন প্রথমবার বুঝতে পারল, এখানে খুব বড় গোলমাল আছে। এবং সে এই প্রথমবার ভয় পেল।

ওস্তাদ রিভলবারটা পরীক্ষা করে হাতে নিয়ে বলল, “এই মেয়ে, তুমি যদি আর একটা বাজে কথা বলো তা হলে গুলি করে তোমার খুলি ফুটো করে দেব। বুঝেছ?”

টুশি মাথা নাড়ল, ওস্তাদকে জানাল যে সে বুঝেছে। এরকম সময় বাইরের ঘর থেকে খুব ভারী এবং মোটা গলায় দবির মিয়া বলল,”ওস্তাদ, বুড়িরে পাইছি।”

ওস্তাদ তখন টুশিকে বাইরের ঘরের দিকে ধাক্কা দিয়ে নিয়ে পিছনে পিছনে হেঁটে ঘরে ঢুকল। তপু এবং নানি অবাক হয়ে এই বিচিত্র দলটার দিকে তাকাল। নানি অবাক হয়ে বললেন, “কী গো বোনডি! এরা কারা?”

টুশি চিঁ চিঁ করে বলল, “আমি চিনি না নানি।”

“কার কাছে আসছে?”

“আপনার কাছে।”

“আমার কাছে?” নানি অবাক হয়ে ভুরু কুঁচকে ভালো করে দেখার চেষ্টা করলেন, জিজ্ঞেস করলেন, “কে বাবা? বাড়ি থেকে আসছ নাকি? তুমি জলিলের ভাই না?”

ইঁদুরের মতো মানুষটি, যে নিশ্চয়ই এই দলের নেতা এবং যাকে অন্য দুইজন মন্তাজ ওস্তাদ বলে ডাকছে এবারে নানির কাছে এগিয়ে বলল, “না খালা, আমি জলিলের ভাই না।”

“তা হলে তুমি কে?”

“আপনি আমারে চিনবেন না। আমরা আপনার কাছে বিশেষ কাজে এসেছি।”

“কী কাজ?”

 “খিলগাঁয়ে আপনার একটা বাড়ি আছে না–”

নানি লোকটাকে কথা শেষ করতে দিলেন না, হঠাৎ করে চিলের মতো তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, “ও আমার নেউলের বাচ্চা নেউল, খাটাশের বাচ্চা খাটাশ–আমার সাথে রং-তামাশা করতে আসছ–ঝাড় দিয়ে পিটিয়ে তোমার পিঠের ছাল যদি আমি না তুলি”

টুশি একটু কেশে বলল, “নানি।”

 নানি তেরিয়া হয়ে বললেন, “কী হয়েছে?”

“এদের কাছে পিস্তল।”

তপু বলল, “পি-পি-পি-পি–” সে কথা শেষ করতে পারল না, টুশি ধরে নিল পিস্তল বলতে গিয়ে ভয়ের চোটে কথা আটকে গেছে।

নানি জিজ্ঞেস করলেন, “পিস্তলটা আবার কী?”

 “বন্দুকের মতো। সাইজে ছোট।”

তপু বলল, “ব-ব-ব-ব-ব” টুশি ধরে নিল বন্দুক বলতে গিয়ে কথা শেষ করতে পারছে না।

মন্তাজ ওস্তাদ এইবারে পিস্তলটা হাতবদল করে বলল, “খালার চোখ মনে হয়। ভালো না। ছানি পড়েছে। ভালো দেখতে পান না। এই যে এইটারে পিস্তল বলে, ট্রিগার টানলে গুলি বের হয়।”

“খাটাশের বাচ্চা খাটাশ, তুই আমারে কী পেয়েছিস? আমি কি তোর পিস্তলরে ভয় পাই?” নানি আবার মুখে তুবড়ি ছোটালেন, “খ্যাংড়া কাঠির ঝাড় দিয়ে তোর ভূত আমি নামাব। খড়ম দিয়ে পিটিয়ে সিধা করব”।

মন্তাজ ওস্তাদের কালো মুখে অপমানের বেগুনি ছোপ ছোপ রং দেখা গেল। গণ্ডারের মতো চেহারার কালাচান তার মিহি রবীন্দ্রসংগীতের গলায় বলল, “ওস্তাদ এই মহিলার মুখ তো দেখি খুব খারাপ। একটা গুলি দিব নাকি চাঁদির মাঝে? মুখ বন্ধ করে দিব?”

মন্তাজ ওস্তাদ কালাচানকে ধমক দিয়ে বলল, “চুপ কর বেকুব। মুখ বন্ধ করে দিলে কাজ শেষ করব কেমন করে?” তারপর পিস্তলটা নাচাতে নাচাতে নানির একেবারে কাছে গিয়ে বলল, “খালা আপনার তো দুই পাই কবরে পিস্তলরে তো আপনার ভয় পাওয়ার কথা না। তবে–” ওস্তাদ খুব অর্থপূর্ণভাবে হেসে বলল, “আপনার দুই নাতি-নাতনির কিন্তু একেবারে কাঁচা বয়স। তারা মনে হয় পিস্তলরে ভয় পায়!”

“তুই কী বলতে চাস ছাগলের বাচ্চা ছাগল?”

“এই যে দেখছেন আমার দুই অ্যাসিস্টেন্ট তাদের নাম হচ্ছে কালাচান আর দবির মিয়া। এরা খালি হাতে টিপি দিয়ে ছোট বাচ্চার কচি মাথা মুরগির ডিমের মতো পটাশ করে ফাটিয়ে দিতে পারে। আমি অনেক চিন্তাভাবনা করে তাদেরকে নিয়ে এসেছি। কেন এনেছি জানেন?”

“কেন?”

“এই দবির মিয়া ধরবে মেয়েটারে, কালাচান ধরবে ছেলেটারে–আর আপনি যদি আমার কথা না শোনেন তা হলে দবির মিয়া পুটুস করে মেয়েটার মাথাটা টিপে গুঁড়ো করে দেবে, নাক দিয়ে তখন তার ঘিলু বের হয়ে আসবে। তাই না রে দবির?”

দবির মিয়া বাধ্য ছেলের মতো বলল, “জি ওস্তাদ।”

নানি কয়েকবার কিছু-একটা কথা বলার চেষ্টা করলেন, কিন্তু এবারে তার গলা দিয়ে কোনো আওয়াজ বের হল না।

মন্তাজ ওস্তাদ তার দুই সঙ্গীর দিকে তাকিয়ে বলল, “এই দবির আর কালাচান–সময় নষ্ট করে লাভ নাই। দুইজন দুইটারে ধর। আগেই পুটুস করে মাথাটা গুঁড়া করিস না”

কালাচান তার মিহি গলায় বলল, “জি ওস্তাদ।” তারপর দুই পা হেঁটে তপুর ঘাড় ধরে তাকে প্রায় শূন্যে ঝুলিয়ে সরিয়ে নিয়ে গেল। তপু বলল, “আ-আ-আ আ-_”

সে কী বলার চেষ্টা করছে টুশি এইবারে আন্দাজ করতে পারল না। দবির মিয়া। টুশির দিকে এগিয়ে এসে তার ঘাড় ধরে একপাশে টেনে নেয়। মানুষটার কালো লোমশ হাত দেখে টুশির কেমন জানি শরীর শিরশির করতে থাকে।

মন্তাজ ওস্তাদ এবারে গলার স্বর নরম করে নানিকে বলল, “খালা। আমি দশ পর্যন্ত গুনব। তার মাঝে আপনি এই কাগজটা সাইন করবেন। যদি না করেন তা হলে প্রথমে পুটুস করে মেয়েটার তার পরে ছেলেটার মাথাটা টিকটিকির ডিমের মতো গুঁড়ো করে দেয়া হবে। বুঝেছেন?”

নানি মুখ হাঁ করে ওস্তাদের দিকে তাকিয়ে থাকেন। তাঁর মুখ নড়ছে, দেখে

মন্তাজ ওস্তাদ হাতের পিস্তলটা নাচিয়ে বলল, “খালা আমাদের হাতে সাময় নাই। আমি দশ পর্যন্ত গুনব, তার মাঝে আপনার কাগজে সাইন করতে হবে। যদি না করেন, তা হলে–” কথা শেষ না করে ওস্তাদ হাত দিয়ে একজনের মাথা পিষে ফেলার ভঙ্গি করল।

তপু এবারে ভয় পেয়ে ফাসাস করে কাঁদতে শুরু করে। কালাচান মিহি গলায় বলল, “কাঁদছ কেন খোকা? মাথার হাড্ডি গুঁড়া করলে কিছু টের পাওয়া যায় না, তার আগেই শেষ!”

মন্তাজ ওস্তাদ গুনল, “এক।”

লাল মিয়া টুশির মাথায় হাত বুলিয়ে ঠিক কোন জায়গায় ধরে চাপ দেবে সেই জায়গাটা একবার দেখে নিল। হাতটা যে শুধু কালো আর লোমশ তা-ই নয় হাতের মাঝে সিগারেটের বোটকা গন্ধ।

মন্তাজ ওস্তাদ গুনল, “দুই।”

তপু কাঁদতে কাঁদতে বলল, “বাবা-বা-বা-বা–” শব্দটা কী হতে পারে টুশি চিন্তা করে বের করতে পারল না।

মন্তাজ ওস্তাদ বলল, “তিন।”

টুশির গলা শুকিয়ে যায়। এরা কারা কে জানে, কিন্তু মনে হচ্ছে একেবারে দয়ামায়াহীন দানব। সত্যি সত্যি যদি তার মাথা গুঁড়ো করে দেয়? মানুষটার হাত থেকে কি ছুটে যাবার চেষ্টা করবে? টুশি বুঝতে পারল তার কোনো উপায় নেই। মানুষটা একেবারে লোহার মতো শক্ত হাতে তার গলা এবং ঘাড় ধরে রেখেছে। নড়ার কোনো উপায়ই নেই।

মন্তাজ ওস্তাদ গুনল, “চার।”

 নানি এবারে হাত বাড়িয়ে বললেন, “দে কাগজ হারামজাদা।”

মন্তাজ ওস্তাদ একগাল হেসে বলল, “খালা, আপনার মুখটা খুব খারাপ। কোনোদিন এর জন্যে আপনি কিন্তু বিপদে পড়বেন।” ওস্তাদ কাগজটা নানির হাতে দিয়ে বলল, “নেন খালা।”

“কলম কই?”

মন্তাজ ওস্তাদ তার পকেট থেকে কলমটা বের করে নানির হাতে দিচ্ছিল, ঠিক তখন দরজায় কলিংবেল বেজে উঠল। সাথে সাথে ঘরে সবাই একেবারে পাথরের মতো স্থির হয়ে গেল। শুধু নানি খিক খিক করে মাঢ়ি বের করে হেসে বললেন, “এই তো লোকজন এসে গেছে, এখন বোঝো মজা!”

কালাচান তার মিহি গলায় ফিসফিস করে বলল, “এটা কে হতে পারে। ওস্তাদ?”

মন্তাজ ওস্তাদের মুখে চিন্তার একটা ছায়া পড়ল, সে মাথা চুলকে বলল, “এখন তো কারও আসার কথা না।”

মনে হয় ওস্তাদের কথাটা ভুল প্রমাণ করার জন্যেই আবার দুইবার কলিংবেল বেজে উঠল। ওস্তাদ ফিসফিস করে নিচু গলায় বলল, “দবির তুই এই মেয়েটারে নিয়ে দরজার কাছে যা। মেয়েটা দরজা খুলে যে আসছে তারে বিদায় করবে।” তারপর টুশির দিকে তাকিয়ে রিভলবারটা নাচিয়ে বলল, “ছেমড়ি যদি তুমি কোনো তেড়িবেড়ি কর তা হলে কিন্তু এই ছেমড়ার জান শেষ। একেবারে মগজের মাঝে, গুল্লি। ঠিক আছে?”

টুশি মাথা নেড়ে বলল, “ঠিক আছে।”

দরজায় আবার দুইবার কলিংবেলের শব্দ হল, যে-ই এসে থাকুক মানুষটার শরীরে ধৈর্য নামক পদার্থটি একেবারে নেই।

মন্তাজ ওস্তাদ রিভলবারটা নাচিয়ে বলল, “যা কালাচান। নিয়ে যা।”

টুশিকে প্রায় গলাধাক্কা দিয়ে দরজার কাছে নিয়ে গেল দবির মিয়া। দরজার কাছে নিয়ে তাকে ছেড়ে দিয়ে ফিসফিস করে বলল, “দরজা খোলো।”

টুশি দরজা খুলল এবং সাথে সাথে তার মুখ একশ ওয়াট বাল্বের মতো জ্বলে উঠল। দরজার সামনে কাবিল কোহকাফী দাঁড়িয়ে আছে। আজকে তার চেহারা আরও খোলতাই হয়েছে। চোখে কালো চশমা আর গলা থেকে একটা লাল গামছা ঝুলছে। টুশিকে দেখে মুখ খিঁচিয়ে বলল, “এতক্ষণ লাগে দরজা খুলতে?”

টুশি কোনো কথা না বলে কাবিল কোহকাফীর চোখের দিকে তাকিয়ে খুব সূক্ষ্মভাবে তাকে একটা সংকেত দেবার চেষ্টা করল, কিন্তু কাবিলের ভিতর কোনো সূক্ষ্ম ব্যাপার নেই, সে কিছুই বুঝতে পারল না। দবির মিয়া ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, “কে? বিদায় করে দাও তাড়াতাড়ি।”

টুশি বেশ কষ্ট করে মুখে একটা আশাভঙ্গের ছাপ ফুটিয়ে দরজা খুলে বলল, “কেউ না।”

 “কেউ না?” দবির মিয়া নিজেও এবারে এগিয়ে আসে–সে কাবিল কোহকাফীকে দেখতে পায় না কিন্তু কাবিল কোহকাফী তাকে দেখতে পেয়ে আঁতকে উঠে বলল, “ইয়া মাবুদ! এই কালা বিরিশ কোথা থেকে এসেছে?”

টুশি কোনো কথা বলল না, দরজাটা আরেকটু খুলে দিল, কাবিল কোহকাফী সাবধানে ভিতরে ঢুকে যায়। দবির মিয়া দরজা দিয়ে মাথা বের করে দুই দিকে দেখে পুরোপুরি নিঃসন্দেহ হয়ে নিল আসলেই কেউ নেই। তখন সে বেশ নিশ্চিন্ত হয়ে দরজাটা বন্ধ করে টুশির ঘাড়ে একটা ধাক্কা দিয়ে ভিতরের দিকে যেতে শুরু করে। কাবিল চিৎকার করে বলল, “এই ব্যাটা কালা বিরিশ, তুই এই মেয়েটার ঘাড়ে ধাক্কা দিচ্ছিস যে?”

তার কথা টুশি আর তপু ছাড়া কেউ শুনতে পেল না। টুশি কিছু বলল না, কিন্তু তপু সবকিছু ভুলে আনন্দে চিৎকার করে উঠল–”কা-কাকা-কা–”

ভাগ্যিস সে কথা শেষ করতে পারল না। ওস্তাদ তপুর দিকে তাকিয়ে বলল,– “কী হল, তুমি কাকের মতো কা কা করছ কেন?”

কাবিল বসার ঘরে এসে ঢুকে চারিদিকে তাকিয়ে বলল, “কী হচ্ছে এখানে? এই বদমাইশগুলো কী করতে চায়?”

তপু আবার বলার চেষ্টা করল, “কা-কাকা-কা” কিন্তু এবারেও বেশিদূর এগুতে পারল না। টুশি অনুমান করল শব্দটা নিশ্চয়ই কাবিল হবে।

মন্তাজ ওস্তাদ কলমটা এবারে নানির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “খালা কেউ আসে নাই। আমরা অনেক হিসাব করে এসেছি। এখন এখানে কেউ আসবে না। কাজেই দেরি না করে এইখানে একটা সাইন করেন খালা।”

ব্যাপারটি কী হচ্ছে বোঝার জন্যে কাবিল ওস্তাদের খুব কাছাকাছি এগিয়ে গেল। তার চোখেমুখে চরম বিরক্তি, ওস্তাদকে একটা মজা বোঝানোর জন্যে সে হাত দুটি মুষ্টিবদ্ধ করে প্রস্তুত হতে শুরু করে।

নানি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সাইন করতে যাচ্ছিলেন, ঠিক তখন টুশি বলল, “নানি।”

নানি অবাক হয়ে টুশির দিকে তাকিয়ে বলল, “কী হল বোনডি?”

 “তোমার যদি ইচ্ছা না করে তা হলে তুমি সাইন কোরো না।”

মন্তাজ ওস্তাদ হুঙ্কার দিয়ে বলল, “কী বলিস পুঁচকে মেয়ে? তোর সাহস তো দেখি কম না!”

টুশি ওস্তাদকে একেবারে কোনো পাত্তা না দিয়ে বলল, “নানি, তুমি এক কাজ করো–ইঁদুরের মতো দেখতে লোকটার পেটে একটা ঘুসি মারো।”

নানি চোখ কপালে তুলে বলল, “ঘুসি মারব?”

 “হ্যাঁ নানি।”

নানি আবার জিজ্ঞেস করলেন, “ঘুসি?”

“হ্যাঁ–দেখবে ব্যাটার কী অবস্থা হয়।”

“সত্যি বলছিস বোনডি?”

 “সত্যি বলছি।”

ঘুসি কীভাবে মারতে হয় নানির জানা নেই। তবুও তিনি হাতটা ঘুরিয়ে অত্যন্ত হাস্যকর একটা ভঙ্গিতে ওস্তাদের পেটে একটা ঘুসি মারলেন। কিন্তু সেই ঘুসির ফল হল ভয়ানক–ওস্তাদ একেবারে ছিটকে প্রায় উড়ে গিয়ে ঘরের অন্যপাশে আছাড় খেয়ে পড়ল, দেয়ালে মাথা ঠুকে তার চোখ একেবারে অন্ধকার হয়ে গেল। আসল ব্যাপারটি দেখল শুধু টুশি আর তপু। নানির ঘুসির সাথে তাল মিলিয়ে কাবিল তার সমস্ত শক্তি দিয়ে মন্তাজ ওস্তাদের পেটে একটা ঘুসি মেরেছে!

কালাচান এবং দবির মিয়া একেবারে হতবাক হয়ে নানির দিকে তাকিয়ে রইল। তাদের দুইজন থেকেও বেশি অবাক হল ওস্তাদ এবং ওস্তাদ থেকেও বেশি অবাক হলেন নানি। তিনি অবাক হয়ে যেই হাত দিয়ে ঘুসি মেরেছেন সেই হাতের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

টুশি বলল, “নানি ছেড়ে দিও না। গিয়ে আর কয়টা কিল-ঘুসি মারো।”

নানি উৎসাহ পেয়ে সোফা থেকে নেমে গুটি গুটি হেঁটে গিয়ে মন্তাজ ওস্তাদের মুখে আরেকটা ঘুসি মারলেন, কাবিল সেই ঘুসিতে সাহায্য করল এবং ওস্তাদ বিকট আর্তনাদ করে একেবার ধরাশায়ী হয়ে গেল। টুশি দেখল মানুষটারে উপরের পাটির একটা দাঁত খুলে এসেছে এবং থুঃ করতেই দাঁতটা বের হয়ে এল।

টুশি বলল, “নানি এখন আমাদেরকে রক্ষা করো।”

নানি এবারে গুটি গুটি তাদের দিকে এগুতে লাগলেন। টুশি টের পেল দবির মিয়া এবং কালাচান এবারে কেমন যেন নার্ভাস হয়ে গেছে। তারা একজন আরেকজনের দিকে তাকাল-দবির মিয়া ভয়ে ভয়ে বলল, “খবরদার, ভালো হবে না কিন্তু কালাচান তার মিহি গলায় বলল, “শেষ করে দিব আমরা–”

নানির এখন তার নতুন শক্তিতে পুরোপুরি বিশ্বাস–একটুও না ঘাবড়ে বললেন, “বলদের বাচ্চা বলদ, ছারপোকার ডিম, ইঁদুরের লেজ, তোদের চেহারা যেরকম খারাপ খাসলত সেরকম খারাপ, আজকে যদি আমি তোদের পিটিয়ে সিধে

করি, ঘুসি মেরে যদি ভুড়ি ফাঁসিয়ে না দিই, জিহ্বা টেনে ছিঁড়ে যদি কুকুরকে না খাওয়াই”

নানি তাঁর শুকনো পাতলা দুর্বল শরীর নিয়ে কাঁপতে কাঁপতে এগিয়ে আসতে লাগলেন। তাঁর সুদীর্ঘ জীবনে তিনি আগে কখনও কাউকে ঘুসি মারেন নি আজকে প্রথম দুটি ঘুসিতে যেভাবে ওস্তাদকে কাবু করেছেন তার বিশ্বাস এই দুজনকেও সেভাবে কাবু করতে পারবেন। টুশি চোখের কোনা দিয়ে দেখল কাবিল কোহকাফীও প্রস্তুত হয়ে আছে। ওস্তাদ শুকনো পাতলা মানুষ ছিল, সে ঘুসি মেরে কাবু করে দিয়েছে, কিন্তু এই দুজন প্রায় ছোটখাটো পাহাড়ের মতো, কাবিল ঘুসি মেরে কাবু করতে পারবে সে ব্যাপারে এতটা নিঃসন্দেহ নয়। তাই সে একটা চেয়ার হাতে ধরে রেখেছে, নানি ঘুসি মারার সাথে সাথে সে পিছন থেকে এটা দিয়ে মাথায় মারবে।

নানি মূর্তিমান যমের মতো এগিয়ে আসতে লাগলেন, টুশি বলল, “নানি বেশি কাছে আসার দরকার নাই। দূর থেকেই ঘুসি মারো–”

নানি একটু দূর থেকেই মারলেন–ঘুসিটা কালাচানের গায়ে লাগল কী না বোঝা গেল না কিন্তু সাথে সাথে বিকট আর্তনাদ করে ধড়াম করে সে নিচে পড়ে গেল। নানি দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে বললেন, “কত বড় সাহস, আমার সাথে লাগতে আসে!”

দবির মিয়ার বুকের ভেতর যেটুকু সাহস ছিল কালাচানের অবস্থা দেখে সেটুকুও উবে গেছে। সে টুশিকে ছেড়ে দিয়ে এবারে পালানোর চেষ্টা করে কিন্তু নানি এত সহজে তাদের ছেড়ে দেবার পাত্র নন, বললেন, “ধর–ধর বেটা বদমাইশকে”

ঘুসির মতো কথাতেও কাজ হল, দবির মিয়ার বিশাল দেহ কলাগাছের মতো পড়ে গেল, নানি দেখতে পেলেন না যে কাবিল তাকে পা বাধিয়ে ফেলে দিয়েছে।

তিনজনকেই ধরাশায়ী করে নানি হাত ঝাড়া দিয়ে কোমরে হাত রেখে অনেকটা বিজয়ী জেনারেলের মতো বললেন, “কেমন শিক্ষা হয়েছে এই ইন্দুরের বাচ্চাগুলোর?”

তপু বলল, “ভা-ভা-ভা “।

 টুশি তপুর অসমাপ্ত কথা শেষ করে বলল, “ভালো শিক্ষা হয়েছে!”

নানি জিজ্ঞেস করলেন, “আর কোনোদিন তেড়িবেড়ি করবে?”

 টুশি মাথা নাড়ল, “না নানি। আর সাহস পাবে না।”

 নানি বললেন, “আয় দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলি।”

বাসায় দড়ি খুঁজে পেল না তাই টুশি বুদ্ধি করে চাচির একটা শাড়ি বের করে সেটা দিয়ে তিনজনের হাত বেঁধে ফেলল। মানুষগুলো কোনো প্রতিবাদ করল না দুই কারণে, প্রথমত, নানি ক্যারাটের ভঙ্গিতে ঘুসি উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন, দ্বিতীয়ত, তপু ওস্তাদের পিস্তলটা হাতে দাঁড়িয়ে হুঙ্কার দিয়ে বলছিল, “একটু নড়লেই খু-খু খুন করে ফেলব।”

“খুন করে ফেলব” কথাটাই খুব ভয়ংকর সেটাকে যখন “খু-খু-খুন করে ফেলব” বলা হয় তখন সেটাকে আরও একশ গুণ বেশি ভয়ংকর শোনায়।

১০. তিন মূর্তি

১০. তিন মূর্তি

১০. তিন মূর্তি

চাচি ঘড়ি দেখে চিৎকার করে বললেন, “সর্বনাশ! তিনটা বেজে গেছে!”

টুশি বুঝতে পারল না তিনটা বেজে গেলে সর্বনাশ হবে কেন। তারা স্কুল থেকে আসার পর খাওয়াদাওয়া শেষ করতে করতে মাঝে মাঝেই তিনটা বেজে যায়। চাচি আজকে কেন জানি দেরি করলেন না, বাসা থেকে বের হওয়ার আগে সবসময় যেরকম ড্রেসিং-টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে মুখে একটু কমপ্যাক্ট, চোখে আইলাইনারের ছোঁয়া এবং ঠোঁটে লিপস্টিক দেন, আজকে তাও করলেন না, চুলের মাঝে চিরুনি চালাতে চালাতে বাসা থেকে একরকম দৌড়ে বের হয়ে গেলেন। কী নিয়ে তাঁর এত তাড়াহুড়ো টুশি কিংবা তপু বুঝতে পারল না, তারা সেটা নিয়ে মাথাও ঘামাল না।

নানি ছোট বাচ্চাদের মতো দুই পা সোফায় তুলে গুটিসুটি মেরে বসেছিলেন। টুশি এবং তপু যতক্ষণ স্কুলে থাকে তার সময়টা কাটতে চায় না, বাচ্চা দুটো চলে এলে আর কোনো সমস্যা থাকে না। তার কাছ থেকে গল্প শোনার জন্যে পাগল হয়ে থাকে, তাদের সাথে গল্প করে সময়টা বেশ কেটে যায়। আজকেও তা-ই হচ্ছে, টুশি একটা বাটিতে খানিকটা সরষের তেল এনে নানির পায়ে ডলে ডলে মাখিয়ে দিচ্ছে, তপু মহা উৎসাহে হামানদিস্তায় পান-সুপুরি ঘেঁচে দিচ্ছে। নানির দাঁত নেই বলে একেবারে মিহি হতে হবে সেজন্যে সে একটু পরে পরে আঙুল দিয়ে পরীক্ষা করে দেখছে।

নানি তাঁর ছেলেবেলার গল্প করছেন, বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ি গিয়ে তার কী অবস্থা তার একটা ভয়ংকর বর্ণনা দিচ্ছেন, কিন্তু সেই ভয়ংকর অবস্থার গল্প শুনে দুজনেই হি হি করে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ছে। নানি কপট রাগে চোখ বড় বড় করে বলছেন, “এইটা হাসির কথা হল? আমি মরি দুঃখে আর তোরা সেই গল্প শুনে হাসিস”

এরকম সময়ে দরজায় কলিংবেলের শব্দ হল। থেমে থেমে দুইবার। টুশি এবং তপু একজন আরেকজনের দিকে তাকায়–কাবিল কোহকাফী কি এসেছে? সে ঢাকা শহরে ঘুরে ঘুরে বিচিত্র সব কর্মকাণ্ড করে বেড়াচ্ছে, তার বর্ণনা খবরের কাগজে উঠে আসছে–কখন কী বিপদ হবে কে জানে! টুশি উঠে দরজা খুলতে গেল। কিন্তু দরজা খোলার আগেই সে দেখতে পেল, বাইরে থেকে চাবি দিয়ে দরজা খুলে। ভিতরে তিনজন মানুষ ঢুকে গেছে।

তিনজন মানুষ দেখতে তিন রকম। একজন ছোট এবং শুকনো, চেহারার মাঝে একটা নেংটি ইঁদুরের ভাব। মুখটা ইঁদুরের মতো ছুঁচালো, চোখ দুটো কুতকুতে। তার পিছনে দুইজন মানুষের আকার বিশাল। একজনের মুখটা গোল, গায়ের রং ফরসা, সারা শরীরে মাংস, টাইট একটা টিশার্টের নিচে সেগুলো কিলবিল কিলবিল করছে, মানুষটাকে দেখলেই গণ্ডারের কথা মনে পড়ে। অন্য মানুষটির মাথাটা সরাসরি শরীরের উপর বসিয়ে দেয়া হয়েছে–কোনো গলা নেই। হাত দুটি লম্বা। এবং কেমন জানি সামনের দিকে ঝুঁকে আছে। গায়ের রং কুচকুচে কালো–সব মিলিয়ে একটা গরিলা-গরিলা ভাব। টুশি কয়েক সেকেন্ড অবাক হয়ে হাঁ করে এই বিচিত্র তিন মূর্তির দিকে তাকিয়ে রইল। সে একেবারে একশত ভাগ নিশ্চিত ছিল যে এরা ভুল করে এখানে চলে এসেছে, তার পরেও জিজ্ঞেস করল, “আপনারা। ভিতরে কেমন করে ঢুকেছেন? কাকে চান?”

ইঁদুরের মতো মানুষটা জিজ্ঞেস করল, “এইটা ইমতিয়াজ সাহেবের বাসা না?” মানুষটার গলা ফাটা বাঁশের মতো কর্কশ।

টুশি মাথা নেড়ে বলল, “জি। কিন্তু চাচা বাসায় নাই।”

ইঁদুরের মতো মানুষটা কর্কশ গলায় বলল, “তাতে কোনো অসুবিধা নাই। আমাদের দরকার তার শাশুড়ির সাথে!” এই বলে টুশিকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে তিনজন ভিতরের দিকে রওনা দিল। টুশি এত অবাক হল যে ভয় পাওয়ারও সময় পেল না, গলা উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল, “আপনারা কে? এখানে কী চান?”

ইঁদুরের মতো মানুষটা টুশিকে পুরোপুরি উপেক্ষা করে বলল, “কালাচান দরজাটা বন্ধ কর। দবির মিয়া বুড়িরে খুঁজে বের কর।”

টুশি দেখল কুচকুচে কালো গরিলার মতো মানুষটার নাম দবির মিয়া, সে ঘরের ভিতরে ঢুকে গেল। ফরসা এবং গণ্ডারের মতো মানুষটার নাম নিশ্চয়ই কালাচান, সে দরজা বন্ধ করে বলল, “জে মন্তাজ ওস্তাদ।” তার গলার স্বর মিহি মনে হয় পয়লা বৈশাখে পাঞ্জাবি পরে রমনার বটমূলে রবীন্দ্রসংগীত গাইতে যায়।

টুশি এবার এত রেগে গেল যে অবাক হবার সময় পেল না, চিৎকার করে বলল, “আপনারা কেন এখানে এসেছেন? কেমন করে বাসার ভিতরে ঢুকেছেন? এক্ষুনি বাইরে যান–”

তখন টুশি আবিষ্কার করল, ইঁদুরের মতো মানুষটি যাকে কালাচান মন্তাজ ওস্তাদ বলে ডাকছে, তার হাতের ব্যাগ খুলে সেখান থেকে একটা বেঁটে রিভলবার বের করছে। টুশি তখন প্রথমবার বুঝতে পারল, এখানে খুব বড় গোলমাল আছে। এবং সে এই প্রথমবার ভয় পেল।

ওস্তাদ রিভলবারটা পরীক্ষা করে হাতে নিয়ে বলল, “এই মেয়ে, তুমি যদি আর একটা বাজে কথা বলো তা হলে গুলি করে তোমার খুলি ফুটো করে দেব। বুঝেছ?”

টুশি মাথা নাড়ল, ওস্তাদকে জানাল যে সে বুঝেছে। এরকম সময় বাইরের ঘর থেকে খুব ভারী এবং মোটা গলায় দবির মিয়া বলল,”ওস্তাদ, বুড়িরে পাইছি।”

ওস্তাদ তখন টুশিকে বাইরের ঘরের দিকে ধাক্কা দিয়ে নিয়ে পিছনে পিছনে হেঁটে ঘরে ঢুকল। তপু এবং নানি অবাক হয়ে এই বিচিত্র দলটার দিকে তাকাল। নানি অবাক হয়ে বললেন, “কী গো বোনডি! এরা কারা?”

টুশি চিঁ চিঁ করে বলল, “আমি চিনি না নানি।”

“কার কাছে আসছে?”

“আপনার কাছে।”

“আমার কাছে?” নানি অবাক হয়ে ভুরু কুঁচকে ভালো করে দেখার চেষ্টা করলেন, জিজ্ঞেস করলেন, “কে বাবা? বাড়ি থেকে আসছ নাকি? তুমি জলিলের ভাই না?”

ইঁদুরের মতো মানুষটি, যে নিশ্চয়ই এই দলের নেতা এবং যাকে অন্য দুইজন মন্তাজ ওস্তাদ বলে ডাকছে এবারে নানির কাছে এগিয়ে বলল, “না খালা, আমি জলিলের ভাই না।”

“তা হলে তুমি কে?”

“আপনি আমারে চিনবেন না। আমরা আপনার কাছে বিশেষ কাজে এসেছি।”

“কী কাজ?”

 “খিলগাঁয়ে আপনার একটা বাড়ি আছে না–”

নানি লোকটাকে কথা শেষ করতে দিলেন না, হঠাৎ করে চিলের মতো তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, “ও আমার নেউলের বাচ্চা নেউল, খাটাশের বাচ্চা খাটাশ–আমার সাথে রং-তামাশা করতে আসছ–ঝাড় দিয়ে পিটিয়ে তোমার পিঠের ছাল যদি আমি না তুলি”

টুশি একটু কেশে বলল, “নানি।”

 নানি তেরিয়া হয়ে বললেন, “কী হয়েছে?”

“এদের কাছে পিস্তল।”

তপু বলল, “পি-পি-পি-পি–” সে কথা শেষ করতে পারল না, টুশি ধরে নিল পিস্তল বলতে গিয়ে ভয়ের চোটে কথা আটকে গেছে।

নানি জিজ্ঞেস করলেন, “পিস্তলটা আবার কী?”

 “বন্দুকের মতো। সাইজে ছোট।”

তপু বলল, “ব-ব-ব-ব-ব” টুশি ধরে নিল বন্দুক বলতে গিয়ে কথা শেষ করতে পারছে না।

মন্তাজ ওস্তাদ এইবারে পিস্তলটা হাতবদল করে বলল, “খালার চোখ মনে হয়। ভালো না। ছানি পড়েছে। ভালো দেখতে পান না। এই যে এইটারে পিস্তল বলে, ট্রিগার টানলে গুলি বের হয়।”

“খাটাশের বাচ্চা খাটাশ, তুই আমারে কী পেয়েছিস? আমি কি তোর পিস্তলরে ভয় পাই?” নানি আবার মুখে তুবড়ি ছোটালেন, “খ্যাংড়া কাঠির ঝাড় দিয়ে তোর ভূত আমি নামাব। খড়ম দিয়ে পিটিয়ে সিধা করব”।

মন্তাজ ওস্তাদের কালো মুখে অপমানের বেগুনি ছোপ ছোপ রং দেখা গেল। গণ্ডারের মতো চেহারার কালাচান তার মিহি রবীন্দ্রসংগীতের গলায় বলল, “ওস্তাদ এই মহিলার মুখ তো দেখি খুব খারাপ। একটা গুলি দিব নাকি চাঁদির মাঝে? মুখ বন্ধ করে দিব?”

মন্তাজ ওস্তাদ কালাচানকে ধমক দিয়ে বলল, “চুপ কর বেকুব। মুখ বন্ধ করে দিলে কাজ শেষ করব কেমন করে?” তারপর পিস্তলটা নাচাতে নাচাতে নানির একেবারে কাছে গিয়ে বলল, “খালা আপনার তো দুই পাই কবরে পিস্তলরে তো আপনার ভয় পাওয়ার কথা না। তবে–” ওস্তাদ খুব অর্থপূর্ণভাবে হেসে বলল, “আপনার দুই নাতি-নাতনির কিন্তু একেবারে কাঁচা বয়স। তারা মনে হয় পিস্তলরে ভয় পায়!”

“তুই কী বলতে চাস ছাগলের বাচ্চা ছাগল?”

“এই যে দেখছেন আমার দুই অ্যাসিস্টেন্ট তাদের নাম হচ্ছে কালাচান আর দবির মিয়া। এরা খালি হাতে টিপি দিয়ে ছোট বাচ্চার কচি মাথা মুরগির ডিমের মতো পটাশ করে ফাটিয়ে দিতে পারে। আমি অনেক চিন্তাভাবনা করে তাদেরকে নিয়ে এসেছি। কেন এনেছি জানেন?”

“কেন?”

“এই দবির মিয়া ধরবে মেয়েটারে, কালাচান ধরবে ছেলেটারে–আর আপনি যদি আমার কথা না শোনেন তা হলে দবির মিয়া পুটুস করে মেয়েটার মাথাটা টিপে গুঁড়ো করে দেবে, নাক দিয়ে তখন তার ঘিলু বের হয়ে আসবে। তাই না রে দবির?”

দবির মিয়া বাধ্য ছেলের মতো বলল, “জি ওস্তাদ।”

নানি কয়েকবার কিছু-একটা কথা বলার চেষ্টা করলেন, কিন্তু এবারে তার গলা দিয়ে কোনো আওয়াজ বের হল না।

মন্তাজ ওস্তাদ তার দুই সঙ্গীর দিকে তাকিয়ে বলল, “এই দবির আর কালাচান–সময় নষ্ট করে লাভ নাই। দুইজন দুইটারে ধর। আগেই পুটুস করে মাথাটা গুঁড়া করিস না”

কালাচান তার মিহি গলায় বলল, “জি ওস্তাদ।” তারপর দুই পা হেঁটে তপুর ঘাড় ধরে তাকে প্রায় শূন্যে ঝুলিয়ে সরিয়ে নিয়ে গেল। তপু বলল, “আ-আ-আ আ-_”

সে কী বলার চেষ্টা করছে টুশি এইবারে আন্দাজ করতে পারল না। দবির মিয়া। টুশির দিকে এগিয়ে এসে তার ঘাড় ধরে একপাশে টেনে নেয়। মানুষটার কালো লোমশ হাত দেখে টুশির কেমন জানি শরীর শিরশির করতে থাকে।

মন্তাজ ওস্তাদ এবারে গলার স্বর নরম করে নানিকে বলল, “খালা। আমি দশ পর্যন্ত গুনব। তার মাঝে আপনি এই কাগজটা সাইন করবেন। যদি না করেন তা হলে প্রথমে পুটুস করে মেয়েটার তার পরে ছেলেটার মাথাটা টিকটিকির ডিমের মতো গুঁড়ো করে দেয়া হবে। বুঝেছেন?”

নানি মুখ হাঁ করে ওস্তাদের দিকে তাকিয়ে থাকেন। তাঁর মুখ নড়ছে, দেখে

মন্তাজ ওস্তাদ হাতের পিস্তলটা নাচিয়ে বলল, “খালা আমাদের হাতে সাময় নাই। আমি দশ পর্যন্ত গুনব, তার মাঝে আপনার কাগজে সাইন করতে হবে। যদি না করেন, তা হলে–” কথা শেষ না করে ওস্তাদ হাত দিয়ে একজনের মাথা পিষে ফেলার ভঙ্গি করল।

তপু এবারে ভয় পেয়ে ফাসাস করে কাঁদতে শুরু করে। কালাচান মিহি গলায় বলল, “কাঁদছ কেন খোকা? মাথার হাড্ডি গুঁড়া করলে কিছু টের পাওয়া যায় না, তার আগেই শেষ!”

মন্তাজ ওস্তাদ গুনল, “এক।”

লাল মিয়া টুশির মাথায় হাত বুলিয়ে ঠিক কোন জায়গায় ধরে চাপ দেবে সেই জায়গাটা একবার দেখে নিল। হাতটা যে শুধু কালো আর লোমশ তা-ই নয় হাতের মাঝে সিগারেটের বোটকা গন্ধ।

মন্তাজ ওস্তাদ গুনল, “দুই।”

তপু কাঁদতে কাঁদতে বলল, “বাবা-বা-বা-বা–” শব্দটা কী হতে পারে টুশি চিন্তা করে বের করতে পারল না।

মন্তাজ ওস্তাদ বলল, “তিন।”

টুশির গলা শুকিয়ে যায়। এরা কারা কে জানে, কিন্তু মনে হচ্ছে একেবারে দয়ামায়াহীন দানব। সত্যি সত্যি যদি তার মাথা গুঁড়ো করে দেয়? মানুষটার হাত থেকে কি ছুটে যাবার চেষ্টা করবে? টুশি বুঝতে পারল তার কোনো উপায় নেই। মানুষটা একেবারে লোহার মতো শক্ত হাতে তার গলা এবং ঘাড় ধরে রেখেছে। নড়ার কোনো উপায়ই নেই।

মন্তাজ ওস্তাদ গুনল, “চার।”

 নানি এবারে হাত বাড়িয়ে বললেন, “দে কাগজ হারামজাদা।”

মন্তাজ ওস্তাদ একগাল হেসে বলল, “খালা, আপনার মুখটা খুব খারাপ। কোনোদিন এর জন্যে আপনি কিন্তু বিপদে পড়বেন।” ওস্তাদ কাগজটা নানির হাতে দিয়ে বলল, “নেন খালা।”

“কলম কই?”

মন্তাজ ওস্তাদ তার পকেট থেকে কলমটা বের করে নানির হাতে দিচ্ছিল, ঠিক তখন দরজায় কলিংবেল বেজে উঠল। সাথে সাথে ঘরে সবাই একেবারে পাথরের মতো স্থির হয়ে গেল। শুধু নানি খিক খিক করে মাঢ়ি বের করে হেসে বললেন, “এই তো লোকজন এসে গেছে, এখন বোঝো মজা!”

কালাচান তার মিহি গলায় ফিসফিস করে বলল, “এটা কে হতে পারে। ওস্তাদ?”

মন্তাজ ওস্তাদের মুখে চিন্তার একটা ছায়া পড়ল, সে মাথা চুলকে বলল, “এখন তো কারও আসার কথা না।”

মনে হয় ওস্তাদের কথাটা ভুল প্রমাণ করার জন্যেই আবার দুইবার কলিংবেল বেজে উঠল। ওস্তাদ ফিসফিস করে নিচু গলায় বলল, “দবির তুই এই মেয়েটারে নিয়ে দরজার কাছে যা। মেয়েটা দরজা খুলে যে আসছে তারে বিদায় করবে।” তারপর টুশির দিকে তাকিয়ে রিভলবারটা নাচিয়ে বলল, “ছেমড়ি যদি তুমি কোনো তেড়িবেড়ি কর তা হলে কিন্তু এই ছেমড়ার জান শেষ। একেবারে মগজের মাঝে, গুল্লি। ঠিক আছে?”

টুশি মাথা নেড়ে বলল, “ঠিক আছে।”

দরজায় আবার দুইবার কলিংবেলের শব্দ হল, যে-ই এসে থাকুক মানুষটার শরীরে ধৈর্য নামক পদার্থটি একেবারে নেই।

মন্তাজ ওস্তাদ রিভলবারটা নাচিয়ে বলল, “যা কালাচান। নিয়ে যা।”

টুশিকে প্রায় গলাধাক্কা দিয়ে দরজার কাছে নিয়ে গেল দবির মিয়া। দরজার কাছে নিয়ে তাকে ছেড়ে দিয়ে ফিসফিস করে বলল, “দরজা খোলো।”

টুশি দরজা খুলল এবং সাথে সাথে তার মুখ একশ ওয়াট বাল্বের মতো জ্বলে উঠল। দরজার সামনে কাবিল কোহকাফী দাঁড়িয়ে আছে। আজকে তার চেহারা আরও খোলতাই হয়েছে। চোখে কালো চশমা আর গলা থেকে একটা লাল গামছা ঝুলছে। টুশিকে দেখে মুখ খিঁচিয়ে বলল, “এতক্ষণ লাগে দরজা খুলতে?”

টুশি কোনো কথা না বলে কাবিল কোহকাফীর চোখের দিকে তাকিয়ে খুব সূক্ষ্মভাবে তাকে একটা সংকেত দেবার চেষ্টা করল, কিন্তু কাবিলের ভিতর কোনো সূক্ষ্ম ব্যাপার নেই, সে কিছুই বুঝতে পারল না। দবির মিয়া ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, “কে? বিদায় করে দাও তাড়াতাড়ি।”

টুশি বেশ কষ্ট করে মুখে একটা আশাভঙ্গের ছাপ ফুটিয়ে দরজা খুলে বলল, “কেউ না।”

 “কেউ না?” দবির মিয়া নিজেও এবারে এগিয়ে আসে–সে কাবিল কোহকাফীকে দেখতে পায় না কিন্তু কাবিল কোহকাফী তাকে দেখতে পেয়ে আঁতকে উঠে বলল, “ইয়া মাবুদ! এই কালা বিরিশ কোথা থেকে এসেছে?”

টুশি কোনো কথা বলল না, দরজাটা আরেকটু খুলে দিল, কাবিল কোহকাফী সাবধানে ভিতরে ঢুকে যায়। দবির মিয়া দরজা দিয়ে মাথা বের করে দুই দিকে দেখে পুরোপুরি নিঃসন্দেহ হয়ে নিল আসলেই কেউ নেই। তখন সে বেশ নিশ্চিন্ত হয়ে দরজাটা বন্ধ করে টুশির ঘাড়ে একটা ধাক্কা দিয়ে ভিতরের দিকে যেতে শুরু করে। কাবিল চিৎকার করে বলল, “এই ব্যাটা কালা বিরিশ, তুই এই মেয়েটার ঘাড়ে ধাক্কা দিচ্ছিস যে?”

তার কথা টুশি আর তপু ছাড়া কেউ শুনতে পেল না। টুশি কিছু বলল না, কিন্তু তপু সবকিছু ভুলে আনন্দে চিৎকার করে উঠল–”কা-কাকা-কা–”

ভাগ্যিস সে কথা শেষ করতে পারল না। ওস্তাদ তপুর দিকে তাকিয়ে বলল,– “কী হল, তুমি কাকের মতো কা কা করছ কেন?”

কাবিল বসার ঘরে এসে ঢুকে চারিদিকে তাকিয়ে বলল, “কী হচ্ছে এখানে? এই বদমাইশগুলো কী করতে চায়?”

তপু আবার বলার চেষ্টা করল, “কা-কাকা-কা” কিন্তু এবারেও বেশিদূর এগুতে পারল না। টুশি অনুমান করল শব্দটা নিশ্চয়ই কাবিল হবে।

মন্তাজ ওস্তাদ কলমটা এবারে নানির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “খালা কেউ আসে নাই। আমরা অনেক হিসাব করে এসেছি। এখন এখানে কেউ আসবে না। কাজেই দেরি না করে এইখানে একটা সাইন করেন খালা।”

ব্যাপারটি কী হচ্ছে বোঝার জন্যে কাবিল ওস্তাদের খুব কাছাকাছি এগিয়ে গেল। তার চোখেমুখে চরম বিরক্তি, ওস্তাদকে একটা মজা বোঝানোর জন্যে সে হাত দুটি মুষ্টিবদ্ধ করে প্রস্তুত হতে শুরু করে।

নানি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সাইন করতে যাচ্ছিলেন, ঠিক তখন টুশি বলল, “নানি।”

নানি অবাক হয়ে টুশির দিকে তাকিয়ে বলল, “কী হল বোনডি?”

 “তোমার যদি ইচ্ছা না করে তা হলে তুমি সাইন কোরো না।”

মন্তাজ ওস্তাদ হুঙ্কার দিয়ে বলল, “কী বলিস পুঁচকে মেয়ে? তোর সাহস তো দেখি কম না!”

টুশি ওস্তাদকে একেবারে কোনো পাত্তা না দিয়ে বলল, “নানি, তুমি এক কাজ করো–ইঁদুরের মতো দেখতে লোকটার পেটে একটা ঘুসি মারো।”

নানি চোখ কপালে তুলে বলল, “ঘুসি মারব?”

 “হ্যাঁ নানি।”

নানি আবার জিজ্ঞেস করলেন, “ঘুসি?”

“হ্যাঁ–দেখবে ব্যাটার কী অবস্থা হয়।”

“সত্যি বলছিস বোনডি?”

 “সত্যি বলছি।”

ঘুসি কীভাবে মারতে হয় নানির জানা নেই। তবুও তিনি হাতটা ঘুরিয়ে অত্যন্ত হাস্যকর একটা ভঙ্গিতে ওস্তাদের পেটে একটা ঘুসি মারলেন। কিন্তু সেই ঘুসির ফল হল ভয়ানক–ওস্তাদ একেবারে ছিটকে প্রায় উড়ে গিয়ে ঘরের অন্যপাশে আছাড় খেয়ে পড়ল, দেয়ালে মাথা ঠুকে তার চোখ একেবারে অন্ধকার হয়ে গেল। আসল ব্যাপারটি দেখল শুধু টুশি আর তপু। নানির ঘুসির সাথে তাল মিলিয়ে কাবিল তার সমস্ত শক্তি দিয়ে মন্তাজ ওস্তাদের পেটে একটা ঘুসি মেরেছে!

কালাচান এবং দবির মিয়া একেবারে হতবাক হয়ে নানির দিকে তাকিয়ে রইল। তাদের দুইজন থেকেও বেশি অবাক হল ওস্তাদ এবং ওস্তাদ থেকেও বেশি অবাক হলেন নানি। তিনি অবাক হয়ে যেই হাত দিয়ে ঘুসি মেরেছেন সেই হাতের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

টুশি বলল, “নানি ছেড়ে দিও না। গিয়ে আর কয়টা কিল-ঘুসি মারো।”

নানি উৎসাহ পেয়ে সোফা থেকে নেমে গুটি গুটি হেঁটে গিয়ে মন্তাজ ওস্তাদের মুখে আরেকটা ঘুসি মারলেন, কাবিল সেই ঘুসিতে সাহায্য করল এবং ওস্তাদ বিকট আর্তনাদ করে একেবার ধরাশায়ী হয়ে গেল। টুশি দেখল মানুষটারে উপরের পাটির একটা দাঁত খুলে এসেছে এবং থুঃ করতেই দাঁতটা বের হয়ে এল।

টুশি বলল, “নানি এখন আমাদেরকে রক্ষা করো।”

নানি এবারে গুটি গুটি তাদের দিকে এগুতে লাগলেন। টুশি টের পেল দবির মিয়া এবং কালাচান এবারে কেমন যেন নার্ভাস হয়ে গেছে। তারা একজন আরেকজনের দিকে তাকাল-দবির মিয়া ভয়ে ভয়ে বলল, “খবরদার, ভালো হবে না কিন্তু কালাচান তার মিহি গলায় বলল, “শেষ করে দিব আমরা–”

নানির এখন তার নতুন শক্তিতে পুরোপুরি বিশ্বাস–একটুও না ঘাবড়ে বললেন, “বলদের বাচ্চা বলদ, ছারপোকার ডিম, ইঁদুরের লেজ, তোদের চেহারা যেরকম খারাপ খাসলত সেরকম খারাপ, আজকে যদি আমি তোদের পিটিয়ে সিধে

করি, ঘুসি মেরে যদি ভুড়ি ফাঁসিয়ে না দিই, জিহ্বা টেনে ছিঁড়ে যদি কুকুরকে না খাওয়াই”

নানি তাঁর শুকনো পাতলা দুর্বল শরীর নিয়ে কাঁপতে কাঁপতে এগিয়ে আসতে লাগলেন। তাঁর সুদীর্ঘ জীবনে তিনি আগে কখনও কাউকে ঘুসি মারেন নি আজকে প্রথম দুটি ঘুসিতে যেভাবে ওস্তাদকে কাবু করেছেন তার বিশ্বাস এই দুজনকেও সেভাবে কাবু করতে পারবেন। টুশি চোখের কোনা দিয়ে দেখল কাবিল কোহকাফীও প্রস্তুত হয়ে আছে। ওস্তাদ শুকনো পাতলা মানুষ ছিল, সে ঘুসি মেরে কাবু করে দিয়েছে, কিন্তু এই দুজন প্রায় ছোটখাটো পাহাড়ের মতো, কাবিল ঘুসি মেরে কাবু করতে পারবে সে ব্যাপারে এতটা নিঃসন্দেহ নয়। তাই সে একটা চেয়ার হাতে ধরে রেখেছে, নানি ঘুসি মারার সাথে সাথে সে পিছন থেকে এটা দিয়ে মাথায় মারবে।

নানি মূর্তিমান যমের মতো এগিয়ে আসতে লাগলেন, টুশি বলল, “নানি বেশি কাছে আসার দরকার নাই। দূর থেকেই ঘুসি মারো–”

নানি একটু দূর থেকেই মারলেন–ঘুসিটা কালাচানের গায়ে লাগল কী না বোঝা গেল না কিন্তু সাথে সাথে বিকট আর্তনাদ করে ধড়াম করে সে নিচে পড়ে গেল। নানি দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে বললেন, “কত বড় সাহস, আমার সাথে লাগতে আসে!”

দবির মিয়ার বুকের ভেতর যেটুকু সাহস ছিল কালাচানের অবস্থা দেখে সেটুকুও উবে গেছে। সে টুশিকে ছেড়ে দিয়ে এবারে পালানোর চেষ্টা করে কিন্তু নানি এত সহজে তাদের ছেড়ে দেবার পাত্র নন, বললেন, “ধর–ধর বেটা বদমাইশকে”

ঘুসির মতো কথাতেও কাজ হল, দবির মিয়ার বিশাল দেহ কলাগাছের মতো পড়ে গেল, নানি দেখতে পেলেন না যে কাবিল তাকে পা বাধিয়ে ফেলে দিয়েছে।

তিনজনকেই ধরাশায়ী করে নানি হাত ঝাড়া দিয়ে কোমরে হাত রেখে অনেকটা বিজয়ী জেনারেলের মতো বললেন, “কেমন শিক্ষা হয়েছে এই ইন্দুরের বাচ্চাগুলোর?”

তপু বলল, “ভা-ভা-ভা “।

 টুশি তপুর অসমাপ্ত কথা শেষ করে বলল, “ভালো শিক্ষা হয়েছে!”

নানি জিজ্ঞেস করলেন, “আর কোনোদিন তেড়িবেড়ি করবে?”

 টুশি মাথা নাড়ল, “না নানি। আর সাহস পাবে না।”

 নানি বললেন, “আয় দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলি।”

বাসায় দড়ি খুঁজে পেল না তাই টুশি বুদ্ধি করে চাচির একটা শাড়ি বের করে সেটা দিয়ে তিনজনের হাত বেঁধে ফেলল। মানুষগুলো কোনো প্রতিবাদ করল না দুই কারণে, প্রথমত, নানি ক্যারাটের ভঙ্গিতে ঘুসি উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন, দ্বিতীয়ত, তপু ওস্তাদের পিস্তলটা হাতে দাঁড়িয়ে হুঙ্কার দিয়ে বলছিল, “একটু নড়লেই খু-খু খুন করে ফেলব।”

“খুন করে ফেলব” কথাটাই খুব ভয়ংকর সেটাকে যখন “খু-খু-খুন করে ফেলব” বলা হয় তখন সেটাকে আরও একশ গুণ বেশি ভয়ংকর শোনায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *