১৬. শেষ কথা

১৬. শেষ কথা

নানির দুই হাত ধরে টুশি আর তপু টেনে নিয়ে যাচ্ছে–তার পিছনে পিছনে সুট টাই পরা বেশ কয়েজন মানুষ। নানি মাঢ়ি বের করে হাসার চেষ্টা করে বললেন, “আমাকে এভাবে টানছিস কেন?”

টুশি বলল, “তোমার দেয়া বাড়িতে কী সুন্দর ‘শিশুসদন’ হয়েছে দেখবে না?”

“দেখতেই তো এসেছি। যেভাবে টানছিস আমি দেখব কেমন করে?”

পিছনের সুট-টাই পরা মানুষগুলো একটু হাসল, বলল, “আপনার নাতি নাতনি হচ্ছে ডেঞ্জারাস মানুষ, তারা জিনকে ধরে শিশিতে ভরে ফেলে–আপনাকে যে সেরকম কিছু করছে না সেইটাই বেশি!”

নানি বললেন, “সত্যি কথাই তো! তোরা সেই জিনকে কী করেছিস? টেলিভিশনে এখনও দুই বেলা দেখায়”

“ছেড়ে দিয়েছি।”

“ছেড়ে দেবার আগে বললি না কেন দুই ঘড়া সোনার মোহর নিয়ে আসতে?”

“বলেছিলাম নানি–আজকালকার মডার্ন জিনেরা খুব ফাঁকিবাজ, সোনাদানা আনতে চায় না!”

সুট-টাই পরা মানুষগুলো একটা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে গেল। একজন বলল, “এই যে এটা হচ্ছে শিশুসদনের এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টরের রুম! এই ভদ্রলোক না হলে আপনার শিশুসদন দাঁড় করানো যেত না! অসম্ভব কাজের মানুষ–”

“হ্যাঁ।” অন্য একজন বলল, “দিন নাই রাত নাই খেটে যাচ্ছেন।”

 নানি চোখের চশমাটা ঠিক করে বললেন, “কী যেন নাম মানুষটার?”

 তপু ফিসফিস করে বলল, “কাবিল কোহকাফী।”

 “কী বললি?”

টুশি গলা উঁচিয়ে বলল, “বলেছে কফিল কোরায়শি।”

“ও আচ্ছা, হ্যাঁ।” নানি মাথা নাড়লেন, “কফিল কোরায়শি। বুড়ো হয়ে গেছি তো–তাই নাম মনে থাকে না!”

দরজার সামনে কথাবার্তা শুনে পরদা সরিয়ে শিশুসদনের এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর কফিল কোরায়শি বের হয়ে এল, তার পরনে গাঢ় নীল রঙের সুট এবং টকটকে লাল টাই। চোখে চশমা, চুলের কাছে অল্প একটু পাক ধরেছে, মুখে মৃদু একটা হাসি। কাবিল কোহকাফীকে টুশি আর তপু ছাড়া আর কেউ কখনও দেখেনি, দেখলেও তারা প্রাক্তন কাবিল কোহকাফী কিংবা বর্তমান কফিল কোরায়শিকে চিনতে পারত কি না সন্দেহ!

নানির দিকে তাকিয়ে প্রাক্তন কাবিল কোহকাফী এবং বর্তমান কফিল কোরায়শি বলল, “আসুন, আসুন ভেতরে আসুন। আপনি আসবেন শুনে আমাদের শিশুসদনের সব বাচ্চারা একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে!”

 “অনুষ্ঠান? গান-বাজনা?”

“হ্যাঁ। কফিল কোরায়শি বলল, “শুধু গান-বাজনা না, নাচ এবং কমিক সবকিছু আছে। আমাদের বাচ্চারা অসম্ভব ট্যালেন্টেড!”

কফিল কোরায়শি পিছনের লোকগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনাদের ঠিক চিনতে পারলাম না!”

হাসিখুশি একজন এগিয়ে কফিল কোরায়শির সঙ্গে হাত মিলিয়ে বলল, “আমরা এসেছি টুশির জন্যে তৈরি ট্রাস্ট বোর্ড থেকে। আপনি হয়তো জানেন টুশির নানা তার সব প্রপার্টি একটা ট্রাস্টে দিয়ে আমাদের মতো কয়েকজন মেম্বারের হাতে দায়িত্ব দিয়ে গেছেন।”

কফিল কোরায়শি বলল, “হ্যাঁ শুনেছি।”

ট্রাস্টের দায়িত্ব হচ্ছে দেখা টুশি যেন একটা পারিবারিক অ্যাটমস্ফিয়ারে বড় হয়। বাচ্চাকাচ্চার সাথে। যেখানে সে খুশি থাকে।”

“আচ্ছা।”

“টুশি আমাদের কাছে অ্যাপ্লাই করেছে যে সে এই শিশুসদনে সব বাচ্চাদের সাথে থাকতে চায়। আমরা তাই দেখতে এসেছি। যদি দেখি সত্যিই এখানে থাকলে সে ভালো থাকবে আমরা তাকে থাকতে দেব!”

“ভেরি গুড!” কফিল কোরায়শি বলল, “সেটা খুব চমৎকার একটা ব্যাপার হবে। আমাদের এই শিশুসদনের বাচ্চারা টুশির জন্যে পাগল। এইটুকুন মানুষ কিন্তু ছোট বাচ্চাদের কী চমৎকারভাবে ম্যানেজ করে দেখলে অবাক হয়ে যাবেন।”

ফরসামতন অন্য একজন ভদ্রলোক বললেন, “আমরা জানি। সব খবরই আমরা পাই!”

কফিল কোরায়শি বলল, “আসেন, বাচ্চারা আপনাদের জন্যে অপেক্ষা করছে!”

বারান্দার মতো একটা জায়গায় প্রায় গোটা ত্রিশেক নানা বয়সের বাচ্চা অপেক্ষা করছিল, নানিকে নিয়ে সবাই সেখানে হাজির হতেই সেখানে একটা আনন্দের ধ্বনি শোনা গেল। ছোট ছোট বাচ্চারা ছুটে এসে টুশিকে ঘিরে ধরল, তাদের সবারই কিছু-একটা বলার রয়েছে। হাঁটতে পারে না এরকম একজন হামাগুড়ি দিয়ে এসে টুশির পা ধরে বসে রইল।

নানি মাঢ়ি বের করে হেসে বললেন, “এরা দেখি তোকে খুব পছন্দ করে!”

টুশি মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ, আমি তো এসে এদের গল্পবই পড়ে শোনাই, তাই!”

কফিল কোরায়শি গলা উঁচিয়ে বলল, “এখন সবাই নিজের জায়গায় গিয়ে বসো। আমরা আমাদের অনুষ্ঠান শুরু করব।”

অনুষ্ঠান শুরু করার আনন্দে বাচ্চাগুলো আবার আনন্দের একটা ধ্বনি করে প্রায় ছুটে গিয়ে মেঝেতে বসে পড়ে। কফিল কোরায়শি বলল, “সবার আগে স্বাগতম সংগীত গেয়ে শোনাবে মিতুল।”

পিছনে বসে থাকা অসম্ভব মায়াকাড়া চেহারার একটা মেয়ে উঠে দাঁড়াল, তারপর খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে সামনে এগিয়ে এল। নানি ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলেন, “আহারে! এই মেয়েটার পায়ে কী হয়েছে?”

টুশি বলল, “বাম পা’টা কেমন জানি শুকিয়ে গেছে।”

 “ডাক্তার কী বলে?”

“নার্ভের কী যেন অসুখ। আস্তে আস্তে নাকি শরীরের অন্য জায়গাও শুকিয়ে যাবে।”

“আহা রে!”

 “কিন্তু কী সুন্দর গান গায়–তুমি শুনলে অবাক হয়ে যাবে নানি।”

টুশির কথা সত্যি–মিতুল গাইতে শুরু করতেই উপস্থিত সবাই একেবারে স্তব্ধ হয়ে মোহগ্রস্তের মতো এই ছোট মেয়েটির গান শুনতে লাগল। সবার মনে হল তারা বুঝি কোনো এক বিস্ময়কর স্বপ্নের জগতে চলে গেছে।

.

সেদিন সন্ধেবেলা কফিল কোরায়শির অফিসে টুশি আর তপু চুকচুক করে কোল্ড ড্রিংক খাচ্ছে, কাবিল কোহকাফী তার এক্সিকিউটিভ চেয়ারে বসে পা দোলাতে দোলাতে তাদের দিকে তাকিয়ে মৃদু মৃদু হাসছে! হাসতে হাসতে বলল, “তা হলে তোমরা দুইজন এখন সেলিব্রেটি?”

টুশি মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ। সেদিন একটা সাবানের কোম্পানি এসেছে আমাদের দিয়ে একটা বিজ্ঞাপন করার জন্যে! ভেবে দ্যাখো আমার মতো কালো একটা মেয়ে করছে সাবানের বিজ্ঞাপন! কন্ট্রাক্ট সাইন করলেই বস্তা বস্তা টাকা দেবে!”

তপু বলল, “পত্রিকার মানুষেরা বলছে যদি ইন্টারভিউ দিই তা হলে আমাদের কয়েক লাখ টাকা দেবে!”

“টুশি বলল, নিউইয়র্কের একটা মিউজিয়াম তোমার শিশিটা বিশ হাজার ডলার দিয়ে কিনতে চাচ্ছে।”

কাবিল কোহকাফী মুচকি মুচকি হেসে বলল, “তা হলে রাজি হচ্ছ না কেন?”

টুশি চোখ বড় বড় করে বলল, “সর্বনাশ! যদি জানাজানি হয়ে যায় তুমিই সেই কাবিল কোহকাফী তা হলে আমাদের শিশুসদনের কী হবে?”

তপু বলল, “আমরা লুকিয়ে লুকিয়ে থাকি, তারপরেই অটোগ্রাফ দিতে দিতে হাত ব্যথা হয়ে যায়।”

টুশি এদিক-সেদিক তাকিয়ে গলা নামিয়ে বলল, “তুমি কি আবার আগের মতো অদৃশ্য হতে পারবে?”

 “মনে হয় না। অলৌকিক যা ক্ষমতা ছিল সব মনে হয় খরচ করে ফেলেছি!”

“কী অলৌকিক ক্ষমতা?”

 “এই মনে করো মানুষকে টিকটিকি বানানো–লোহাকে সোনা বানানো–”

তপু হি হি করে হেসে বলল, “তুমি এগুলো কিছু পার না আমরা জানি!”

কাবিল কোহকাফী কোনো কথা না বলে মিটিমিটি হাসতে লাগল। টুশি বলল, “কী হল, তুমি এভাবে হাসছ কেন?”

“মনে আছে, তোমাকে কথা দিয়েছিলাম তোমার চেহারাকে আগুনের খাপরার মতো সুন্দর করে দেব?”

“হ্যাঁ।”

 “আমি মনে হয় এখন সেটা পারব।”

টুশি চোখ বড় বড় করে বলল, “সত্যি?”

“সত্যি। আমার ক্ষমতা তো কম তাই বেশি অলৌকিক কাজ করতে পারি না। যা ক্ষমতা ছিল শেষ করে ফেলেছি–আর মনে হয় একটা পারব। সত্যিকারের অলৌকিক একটা কাজ!”

টুশি তীক্ষ্ণ চোখে কাবিল কোহকাফীর দিকে তাকিয়ে বলল, “সত্যি পারবে?”

“হ্যাঁ। রাতারাতি তোমার চেহারা অন্যরকম হয়ে গেলে তো তোমাকে কেউ চিনবে না–তাই পুরো ব্যাপারটা হবে ধীরে ধীরে–মনে করো এক বছর সময় নিয়ে।”

টুশি বলল, “তুমি সত্যিই এরকম অলৌকিক একটা কাজ করতে পারবে?”

“হ্যাঁ। সব মন্ত্র ইন্টারনেট থেকে ডাউনলোড করেছি।”

“ভেরি গুড!” টুশি মাথাটা একটু এগিয়ে বলল, “তুমি তোমার অলৌকিক ক্ষমতা দিয়ে মিতুলের পা ঠিক করে দাও।”

“মিতুলের পা?”

 “হ্যাঁ। পারবে না?”

 “পারব। কিন্তু তোমার না চেহারা নিয়ে এত দুঃখ ছিল?”

“এখন আর নেই। চেহারাটা বাইরের জিনিস–ভালো কিংবা খারাপ তাতে কিছু আসে যায় না!”

কাবিল কোহকাফী কিছুক্ষণ টুশির দিকে তাকিয়ে তার কাছে এগিয়ে এসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, “তুমি ঠিকই বলেছ টুশি। যারা তোমার পরিচিত তারাই ঠিক করে জানে তোমার চেহারা কত সুন্দর।”

.

বাসায় যাবার জন্যে টুশি আর তপু কফিল কোরায়শির সাথে সিঁড়ি দিয়ে নামছে তখন দেখতে পেল মোটাসোটা একটা ছেলে খুব মনোযোগ দিয়ে উপরে তাকিয়ে আছে। টুশি জিজ্ঞেস করল, “কী দেখছ তুমি?”

“টিকটিকি।”

টুশি হেসে ফেলল, “টিকটিকি একটা দেখার জিনিস হল?”

 ছেলেটা বলল, “এগুলো অন্যরকম।”

“অন্যরকম?”

“হ্যাঁ ঐ দেখো, তিনটা টিকটিকি সবসময় একসাথে থাকে। একটা হচ্ছে। শুকনো সেইটা হচ্ছে লিডার। তার পিছে পিছে থাকে দুইটা ভোটকা ভোটকা টিকটিকি। একটা কালো রঙের আরেকটা সাদা রঙের। যেটা কালো সেটার ঘাড় বলতে গেলে নেই। যেটা সাদা সেইটা কেমন জানি চিকন গলায় ডাকে”

টুশি চোখ বড় বড় করে প্রায় চিৎকার করে বলল, “কী বললে? কী বললে তুমি?”

ছেলেটা অবাক হয়ে টুশির দিকে তাকাল। সাধারণ টিকটিকির কয়টা কথা শুনে টুশি এরকম করে চিৎকার করছে কেন সে কিছুতেই বুঝতে পারল না।